স্বপ্ন- ব্যথিত আঁখি
বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক ছিল সবদিকে ভয়ংকর এক বিভীষিকা।
এক লাফে বাজারদর লাফিয়ে যেন মগডালে—
মাছ মাংস দুর্মূল্য –একদর, কমপক্ষে দশটাকা কেজি ! হাসি পাচ্ছে তাই না, কিন্তু আমি ত বলছি তাদের কথা —চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, যাদের চার অংকের মাহিনা তখন খুব কমই ছিল, আর যদি না তারা চুনোপুঁটি ব্যবসাদার না হতেন বা করপোরেট সংস্থানে কাজ না করতেন। যাক্। সে সময়ে বিদ্যুত বিভ্রাটের খামতি স্থায়িভাবে জাঁকিয়ে বসল, বাড়ি অফিস ব্যাঙ্ক স্কুল কলেজ সর্বত্র । কোন সতর্কতার নোটিশ নেই, নেই সময়ের হিসাব বা মাত্রা জ্ঞান। কিন্তু সবরকম অসুবিধা আমাদের ত মানিয়ে নেবার অভ্যাস ছিল আর তাছাড়া এ ব্যাপারে “খুড়োর কলের গাজর” ঝোলানোও ছিল। সবার এক কথা “সাঁওতালডিহির ইউনিট” চালু হলেই বিদ্যুত সমস্যার মুক্তি।
অগত্যা হ্যারিকেন, মোমবাতি, ল্যাম্প, এমারজেন্সি লাইট, ইনভার্টার, হাতপাখা আর ফাঁক ফোকরে সময় মতো জলের পাম্প চালানো , ওভনে কেক বানানো, কেমন সে তরিবত? লোডশেডিং এ কেক তৈরির আয়োজন, আর কারেন্ট এলেই ওভেনে ঢোকান,অভ্যাস বশত সব মেনে নেওয়া।
বর্ষাকালে রাস্তা ঘাট সবসময় খরস্রোতা নদী অথবা ঘোলা সাগর– একমাত্র টানা রিকশা ভরসা। যা কিনা বাদলাকালে কলকাতার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যান।
এই সাথে চলছিল উত্তর বঙ্গের নক্সালবাড়ি উদ্ভুত
” নক্সাল আন্দোলন”।
চারদিক বিপর্যস্ত। ধড়পাকড়, চিরুনী-তল্লাস। পনেরো থেকে পঁচিশ তরুণ ছোকরা যে কোন বাড়িতে তখন বিপজ্জনক– অশনি সংকেত। আঠারো বছরের জওয়ান ছেলের পেটে সজোরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভাঙা “ভদকা”র বোতল। পঙ্গুতা তার সারাজীবনের সাথী। প্রমাণের দরকার নেই, সময় কোথায়? কোন পক্ষেই সময় ছিল না। বড্ড তাড়াতাড়ি হাউই বাজি জ্বলে উঠেই নিভে গিয়েছিল।
আমার আবার সরকারী চাকুরী, বাড়িতে আছে পনেরো বছরের ভাগ্নেও, হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি, দ্রুতগতিতে চলবে। সে আর বিচিত্র কি!!!
হ্যাঁ, এই পটভূমিতেই আমার কাছে এক স্বপ্নালু ছেলের আগমন একটি রাতের জন্য । আশ্রয় না ভরসা, না রক্ষা না বিশ্বাস!!! কিন্তু সে চোখের স্বপ্ন আমি অনুভবে বুঝতে পেরেছিলাম আর অসহায়ের মতো অতি সাধারন একটি ঘরে পড়া পুরনো শাড়ি দিয়ে স্বপ্ন পুরনের সাহায্য করেছিলাম মাত্র।
আসলে ঘটনাটি আচমকা কয়েক ঘন্টার মধ্যে আরম্ভ ও শেষ, ধরুন রাত এগারোটা থেকে ভোর চারটে। সেদিন সারা রাত আমার ঘুম আসে নি, চোখের পাতা বুজে ধ্যান ছিল কখন ঊষার আগমন হবে। দোতলায় আমাদের শোবার ঘরের সংলগ্ন পাশের ঘরেই ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল তাদের।
“চলে যান এখন, বাড়ির লোকজন পাড়ার লোকজন যে সব জেগে উঠে পড়বে ভোর হয়েছে, সবাই যে টের পেয়ে যাবে।”
পূঁবদিক তখন আবির রঙে বিদায় নিচ্ছেন ঊষা। পাড়া টের পেয়েছিল কিনা জানি না তবে বাড়ির সবাই হয়ত জেনেও মুখে কুলুপ , সেটাই যে তখন অলিখিত নিয়ম !
“হ্যাঁ, চলে যাচ্ছি, খাবার জল দিন , একটা চিরুনি আর আপনার একটা আটপৌরে শাড়ি আর…দেবেন।”
“শাড়ি!!”
চাওয়া ছিল দাবী ও হুকুম সুরে, অনুরোধ নয়।
“কিছু খাবার দিই।”
“না”
কি দৃঢ় প্রত্যয় কঠিন চোখের কালো ছেলেটির, পাশে শুয়ে আছে ছোটোখাটো চেহারার ফর্সা ছেলেটি ,তখনও সে ঘুমে,শরীর তার কাহিল, জখম পায়ে আমার দেওয়া ন্যাকরার পট্টী বাঁধা গতরাতের। হ্যাঁ, গতরাতেই ত এসেছিল তারা শুধু একটা রাতের জন্য, খুব ভোরে চলে যাবার প্রতিশ্রুতি। না, ওরা বলেন নি কিছু, বলেছিলেন যিনি, তিনিই ওদেরকে এনেছিলেন (আমার একস্নেহভাজন “নকশালপন্থী” ভাই )। সেই ভোরে আমাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন এক আটপৌরে স্বামী স্ত্রী, আমার স্বামী তাদের পাড়া পাড় করে অনেকটা নিরাপদ দূরত্বে এগিয়ে দিতে সাথে সাথে গেলেন।
এটা একটা ঘটনা, যাবার আগে ঘোমটা টানা বউটির দিকে তাকালাম আর তখনই সেই ব্যথামেদুর কটাক্ষ আমার দিকেও , সে চোখের ভাষা , আমাকে কি —-ধিক্কার , না আশ্বাস, না প্রবোধ , না কৃতজ্ঞতা!!! জানি না, আমি শুধু তার স্বপ্নাতুর চোখে যেন মধুঝরা বেদনা দেখলাম। কত আর বয়স– ঊনিশ, কুড়ি কি একুশ । কোন্ এক স্বপ্নের দেশ গড়ার মোহে সর্বস্ব বিসর্জন। কোন্ এক মায়ের সন্তান সে, কোন্ এক আদর্শে নিবেদিত, মরণ তার হাতছানিতে— নিতে বা দিতে। আর আজও আমি তাকে ভুলতে পারি নি—
এখন? কেমন আছে সে? মন অস্থির করা ভয়ংকর চিন্তা বাদ দিয়ে ভাবি— হয়ত বা আছে সে এক সুখী সংসারে স্বামী ও পিতার ভূমিকায়। শরীরে কি কোন দোষ, খোঁড়া কি হাতকাটা, কিম্বা গুহ্যদ্বারে কি এক চিরকালীন খত, কাঠের রড ঢোকানোর চ্যালেঞ্জ!!!। কিংবা—- অথবা , না থাক্ সেসব কথা—–
না, আর বলি কি এ কোন রাজনীতি আদর্শের গল্প নয় এ শুধু এক– দুচোখ ভরা ব্যর্থ বেদনার স্বপ্নের ইতিহাস।
এ গল্পটি লিখেছিলাম অনেক আগেই আজ মনে হলো—
আবার নেটিজেনদের লিখি….
আবার একটু আশা নিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির মোকাবিলায় যদি কোন কাণ্ডারী…….
থাক্ ,স্বপ্নের কথা না হয় থাক্।