Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সুরের সরস্বতী || Saswati Das

সুরের সরস্বতী || Saswati Das

সুরের সরস্বতী

মানুষের এই নশ্বর দেহ মৃত্যুর পর চিতার আগুনে ছাই হয়ে যায়। শুনেছি মানুষের নাভি পোড়ে না।কিন্তু আজ মনে হল শুধু নাভি না, কারো কারো কণ্ঠকেও পোড়ানো যায় না। এমনই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী সুরসম্রাজ্ঞী, ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর, তিনি চলে গেলেন। তাঁর দীর্ঘ ৯২বছরের এই যাত্রা সমাপ্ত হল ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২২। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু রয়ে গেলেন আপামর ভারতীয়র হৃদয় আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে।

পিতা দীননাথ মঙ্গেশকরের মৃত্যুর পর তাঁর পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে ছোট্ট লতার কাঁধে। মাত্র তের বছর বয়সে তাঁর এবং তাঁর বাবার সাধনা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাইরে বেরিয়ে ফিল্মি গান গাইতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। সেই শুরু তার পথ চলা। তবে ফিল্মি গানে জায়গা পেতে তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সদ্য পিতৃহারা অসহায় কিশোরী লতা গিয়েছিলেন ফিল্মিস্থানে গান গাইবার একটা সুযোগ পেতে। কিন্তু সেদিন তাকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল। তবে সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দর তাকে নিরাশ করেন নি। তিনি লতাকে দিয়ে একটি গান রেকর্ডিং করান।সেই রেকর্ডিং এ উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন দিকপাল সঙ্গীত পরিচালক খেমচন্দ প্রকাশ, নৌশাদ, এবং অনিল বিশ্বাস। এই তিনজনই লতার সুরেলা কন্ঠ এবং গায়কীর স্বতঃস্ফুর্তিতে আকৃষ্ট হয়ে লতাকে তাদের সুরে গান গাইবার সুযোগ করে দিলেন।
১৯৪২সালের ২৪এপ্রিল লতার বাবার মৃত্যু হয়।এর পর সংসারে নেমে আসে চরম অর্থসংকট।পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সর্বজেষ্ঠ হওয়ার কারণে তাঁকেই তুলে নিতে হয় সংসার পালনের গুরুভার।অর্থের প্রয়োজনে লতাকে ছ বছর ফিল্মে অভিনয় করতে হয়েছিল।
১৯৪৯সালে ‘মহল’ ছবিতে তার গাওয়া গান ‘আয়গা অনেওয়ালা’ সুপারহিট হওয়ার পর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর লতা মঙ্গেশকর তৎকালীন ইন্দোর রাজ্যে(বর্তমান মধ্যপ্রদেশ) একটি মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন মারাঠি ও কোঙ্কিনী সঙ্গীতজ্ঞ এবং মঞ্চ অভিনেতা। জন্ম থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা লতার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ লক্ষণীয়। একদিন পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের একজন ছাত্রের একটি বিশেষ রাগ অনুশীলনের সময় তার ত্রুটি সংশোধন করে দেয় ছোট্ট লতা। সেই সময় তাঁর পিতা বুঝতে পারেন সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অভাবনীয় অনুরাগের কথা।
জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল হেমা। তাঁর বাবা পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর পরিচালিত ‘ভাওবন্ধন’ নাটকে হেমা ‘লতিকা’ চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই সময় থেকে তাঁর নাম পরিবর্তন করে ‘হেমা’ থেকে ‘লতা’ রাখা হয়।

সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর ছিলেন এক কিংবদন্তি। দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী হয়ে রইলেন।লতার যুগের শেষ হবে না।অসামান্য প্রতিভাধর ভারতের নাইটেঙ্গেল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁর শ্রোতাদের সুর লহমায় মুগ্ধ আবিষ্ট করে রেখেছেন। এমন উচ্চতায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন যে আজ থেকে শতবৎসর পরও হয়তো এই উপমহাদেশের কোন প্রান্তে কিংবা ইউরোপ আমেরিকায় কাউকে না কাউকে গাইতে শোনা যাবে লতার গানের কলি, এখানেই সময়কে অতিক্রম করে লতা অনন্যা।
লতার কণ্ঠে ছিল এক আশ্চর্য ক্ষমতা। গানের ভাব অনুযায়ী গায়কীকে তৈরি করে নেবার অসামান্য দক্ষতা ছিল তাঁর।
একই ছবিতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন নায়িকার লিপে কন্ঠ দিয়েছিলেন, প্রতি ক্ষেত্রে গায়কী পাল্টে নিয়ে। নার্গিসের মত প্রায় প্রৌঢ় নায়িকার কণ্ঠে যিনি মানানসই তিনিই আবার কিশোরী নায়িকার কণ্ঠেও সমান ভাবে সপ্রতিভ। একবার নৌশাদ বলেছিলেন- ‘ লতার মতো সঙ্গীত প্রতিভা আমি আর পাইনি।বিভিন্ন মাধ্যমেই এক একজন আসেন যাঁর মাথায় ঈশ্বর হাত রাখেন।লতা এমনই একজন।’
লতা মঙ্গেশকর ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় ও বিদেশি ভাষায় খুব সাবলীল ভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। তাঁর গানের ভাণ্ডারে আমরা ৩০হাজারের বেশি গান পেয়েছি। এক হাজারের বেশি ভারতীয় ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছেন।
ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এই কিংবদন্তি গায়িকার সঙ্গে বাংলা তথা বাঙালি সংস্কৃতির গভীর যোগাযোগ ছিল।১৯৫৬সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে “প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে” গানটি তাঁর গাওয়া প্রথম বাংলা গান। এরপর তিনি সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্তর সুরেও বহু কালজয়ী বাংলা গান গেয়েছেন। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায় ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’।পরবর্তী সময়ে তিনি বহু সুরকারের সুরে বাংলা গান গেয়েছেন। বাংলা ভাষাকে তিনি নিজের মাতৃভাষার মতোই সম্মান করতেন,ভালোবাসতেন। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস তাঁর বড় প্রিয় ছিল।
আকাশ ছোঁয়া খ্যাতির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অজস্র পুরস্কার সম্মানের মিছিল তাঁর দরজায় বার বার কড়া নেড়েছে।
তেইশ বার শ্রেষ্ঠ প্লে-ব্যাক সিঙ্গার পুরস্কার অর্জন করেন।
মধ্যপ্রদেশ সরকার তাকে ‘তানসেন পুরস্কার’ প্রদান করে।
কোলাপুর,খয়রাগড়, হায়দ্রাবাদ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পেয়েছিলেন।
১৯৬৯ সালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পান।
১৯৮৯সালে পান ভারতীয় চলচিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার।
১৯৯৭সালে ‘মহারাষ্ট্র ভূষণ’ পুরস্কার অর্জন করেন।ওই বছরই ৬ই ফেব্রুয়ারি বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম সম্মানে ভূষিত হন সুর সাধিকা লতা মঙ্গেশকর।
১৯৯৯সালে ‘এন আর টি জাতীয় পুরস্কার’ পান।
ওই বছরই ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন।
২০০১সালে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত রত্ন’ পুরস্কার লাভ করেন সুরের সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর।
সংগীতকে ভালোবেসে এবং ছোট থেকেই ভাই-বোনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী আজীবন অবিবাহিত রয়ে গেলেন।
সঙ্গীতকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন করে তিনি একাই জীবন কাটিয়ে দিলেন।
তবে শোনা যায় তাঁর জীবনেও কোনো এক সময় একমুঠো বসন্ত এসেছিল। তিনি ভালোবেসেছিলেন দুঙ্গারপুর রাজ ঘরানার মহারাজ রাজ সিং কে।কিন্তু রাজ সিংয়ের পারিবারিক কারণে এই প্রেম পরিণতি পায় নি। সেই থেকে তিনি আমৃত্যু কারো সাথে পরিণয়সূত্রে বাঁধা পড়েন নি।
লতা মঙ্গেশকর তার জীবনের শেষ গান ‘সৌগন্ধ মুঝে ইস মিটটি কি’ ময়ূরেশ পাইএর সুরে রেকর্ড করে ছিলেন,ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং দেশের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে। ছবিটি ২০১৯সালের ৩০শে মার্চ মুক্তি পায়।

২০২২সালের ৮ই জানুয়ারি সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর কোভিড আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।কোনোদিন হার না মানা লতা ২৮দিনের জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত হার স্বীকার করে নিলেন। জীবন তাঁকে ছেড়ে চলে গেল।৬ই ফেব্রুয়ারি সকাল ৮:১২মিনিটে তাঁর নশ্বর দেহের প্রয়াণ ঘটে। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।তার অগণিত সঙ্গীত অনুরাগী ভক্তদের চোখের জলের ভেজা পথ দিয়ে।’চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়, আঁধারের শেষ ভোর হবে।’ কিন্তু তার এই আঁধার শেষে আর কোনো দিন ভোর আসবে না। তবু মনে হয় তিনি অবিনশ্বর। তার কন্ঠ অবিনশ্বর। উনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন অগণিত সঙ্গীতপ্রেমীর মনের মণিকোঠায় আকাশ প্রদীপ হয়ে।
আগামী প্রজন্ম তাঁকে সুরে সুরে মনে রাখবে- “নাম গুম জায়গা চেহেরা য়ে বদল জায়গা,মেরি আওয়াজ হি পেহেচান হ্যায়….” সকল সঙ্গীত অনুরাগী মানুষের মনে এই সুর চিরকাল গুঞ্জরিত হবে।
সুরের সরস্বতী লতা মঙ্গেশকরের শ্রীচরণে আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress