সমুদ্র মন্থনে
পুরীর সমুদ্রের গায়ে একটা হোটেলে উঠেছে নীলিমা । সাথে মা ও ওর কলিগ সুমিতা । হোটেলটা নোনাধরা।কবে কোন কালে যে রং পড়েছিল তা বলা মুশকিল । দেখতে দীন হীন হলেও কেমন যেন একটা প্রাণের ছোঁওয়ার আভাস আছে এ বাড়িতে । সামনে দক্ষিণ । যতো দূর চোখ যায় নীল সমুদ্র । দিন নেই রাত নেই অবিশ্রান্ত ঢেউ এর গর্জণ । সমুদ্রের সকালে এক রং বিকেলের আর এক রং। মেঘলা দিনে সমুদ্র আর আকাশ কে আলাদা করা যায় না । পাশের বাড়িটা বিধবা আশ্রম । তিন তলা পুরানো কাঠামোর। এক তলার আধ খানা বালির তলে ডুবে গেছে । তাই চারটে সিঁড়ি উঠলেই দোতলায় উঠে যাওয়া যায় । পূব দিকটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে ঐ বাড়ি। তাই পূবের হাওয়া না পেলেও দক্ষিণের উত্তাল হাওয়া লন্ড ভন্ড করে দিচ্ছে ঘরের সবকিছু ।
সুমিতা দাশ নজরে পড়ার মতো । নীলিমা ছোট খাটো চেহারার মেয়ে । কিন্তু চেহারায় চটক আছে । শ্যাম বর্ণ বলা যায় না । কালোই বলা চলে । একমাথা কোঁকড়ানো চুল । কাঁধে এসে পড়েছে । একটু পুরুষ পুরুষ ভাব ;ওর ব্যক্তিত্ব ই ওকে কাছের করে টানে । বয়স আঠাশ কিন্তু আজ অবধি কোন ও পাত্র জোটাতে পারেন নি ওর মা । পাশের ঘরের বিনয় মুখার্জি আর ওর দিদি এসেছেন।এরই মধ্যে আলাপ হয়ে গেছে দু ঘরের । বিনয় মুখার্জির দিদির বয়স নীলিমার মায়ের থেকে কমই হবে । বেশির ভাগ সময় নীলিমার মায়ের আলাপের উৎস টা হলো মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ খোঁজা। কিন্তু মুখার্জি শুনে একটু দমে গেছেন। নীলিমা র বাবা’ টিসকোর ‘ বড়ো কর্মকর্তা । নীলিমারা চার বোন । নীলিমার যখন চোদ্দ বছরে তখন দীপান্বিতার দিন । বাড়িতে খুব জাঁক করে বাজি পোড়ানো হচ্ছিল । বাজি পোড়াতে নীলিমার ফ্রকে আগুন ধরে গেল । ভয়াবহ আগুন । অনেক চিকিৎসা করে বেঁচে গেল সে। কিন্তু সেই আগুন ওর জীবনে যৌবনের ফুটন্ত কুঁড়ির প্রকাশকে থামিয়ে দিয়ে ওর অন্তরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল । একটা ।বিরাট পরিবর্তন এলো ওর জীবনে।
গভীর হতাশার মধ্যে ওর মনে ঈশ্বর ভক্তির জন্ম নিলো ।মনকে বেঁধে ফেললো নীলিমা । ক্রমে ক্রমে ঈশ্বরের দিকে মন চলে গেল । ঈশ্বরের নামে চোখে জল । বাবা মা ভয় পেয়ে গেলেন । নিয়ে গেলেন এক গুরুদেবের কাছে । গুরুদেব দীক্ষা দিচ্ছিলেন । ফ্রক পড়া নীলিমা দাঁড়িয়েছিল অদূরে । গুরুদেব সকলকে ফেলে রেখে ইশারায় ডাকলেন নীলিমাকে,কানে মন্ত্র দিলেন সকলকে ফেলে রেখে । সকলেই নীলিমার পরিবর্তন লক্ষ্য করেন । নীলিমার মধ্যে ব্যক্তিত্বময়ী রূপের প্রকাশ হলো । শুরু হলো পড়া শুনা। এবার ঈশ্বর থেকে মন ফিরলো লেখা পড়ায় । কিন্তু সব কিছুর মূলেই ছিল ঈশ্বর ভক্তি । ভালো ফল হতে লাগল পরীক্ষায়। অসীম ব্যক্তিত্বের আধার হলো সে। অংক নিয়ে এম ,এস ,সি পড়লো । স্কুলে চাকরি ও পেয়ে গেল ।
মনে হয় সে একটা আধার এ আছে । ওর ব্যক্তিত্বর ফলে ওকে জানবার অদম্য আগ্রহ হয়েছে বিনয় মুখার্জির। ওর ঐ আবরণ ঊন্মোচন করতেই হবে । নীলিমাকে জানবার এক অদম্য নেশায় পেয়ে বসেছিল । ওকে পেলেই বুঝি সব পাওয়া হয়ে যাবে বিনয়ের।তাঁর সৌন্দর্য পিয়াসী মন ,নীলিমার ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে গেল । নীলিমারা তিন জন আর বিনয়রা দুজনে একসাথে সমুদ্র স্নানে গেছে ।,নীলিমার মনে হলো বিনয় কোন একটা ফন্দি আঁটছে । প্রথমেই নীলিমার মাকে সমুদ্র স্নানে নামালো । যেখানে অল্প ঢেউ সেখানে স্নান করিয়ে দিলেন নীলিমার মায়ের । বিনয়ের দিদি জলে নামতে চাইলেন না । বললেন- “বিনু ওদের দুজনের দিকে খেয়াল রাখিস । আমি এখানে বসছি ।” বিনয়ের হাত ধরতে রাজি হলো না নীলিমা । বললো – আমি একাই পারবো । বিনয় ইচ্ছে করে ই বাঁ দিকে রাখলো নীলিমাকে। আর ডান হাতে সুমীতা কে রাখলেন । যাতে দরকারে নীলিমাকে ধরতে পারেন । একটু এগিয়ে নীলিমা বসে পড়লো সমুদ্রের জলে । ছোট বড়ো ঢেউ আসছে আবার যাচ্ছে । আনন্দে ভরপুর মন । ঠিক সেই সময় নজরে পড়লো সুমিতা বিনয়কে জাপটে ধরলো । নীলিমার ভেতরটা জ্বালা করে উঠলো । বহু দিনের একটা দুঃখ উথলে ওঠে । নীলিমা জানে বিনয়রা কি চায় মেয়েদের কাছে । সুমিতারা এগিয়ে এলো । ওর পাশ দিয়ে ওপরে ওঠার সময় বললো ।- কী দারুণ লাগল তাই না বিনয় দা? সুমীতার মুখে আনন্দের প্রকাশ । সুমিতার আনন্দে বিগলিত হয়ে হাসছে সেই ছেলে । সুমিতা কে আজ দারুণ দেখাচ্ছে । বাসন্তী রঙ এর চুড়িদার পড়েছে । এ রং ওকে ই মানায় । বিনয় ঢেউ এ খেলা করছে নীলিমার ধারে কাছে । এমন সময় একটা বিশাল ঢেউ এসে তছনছ করে করে দিলো নীলিমাকে। তরিৎ বেগে নীলিমাকে জাপ্টে ধরলো বিনয়। নীলিমার বুকের আঁচল খসে পড়েছে । লেপটে রয়েছে কোমরের কাছে । বিনয়ের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ নীলিমা । এটা ই যেন নীলিমা চাইছিলো । একটা পুরুষ ওকে বুকের মাঝে পিষে ফেলুক । হঠাৎ ই আচ্ছন্ন তা কেটে গেল নীলিমার। তার দৈন্যতা ঢাকার জন্য লেপটে থাকা আঁচল টানার বৃথাই চেষ্টা করে । বিনয়ের বাহু থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে । বাইরের থেকে দেখলে নীলিমার গালে লালের ছোপ । কিন্তু ভেতরটা ছেয়ে যায় দীনতায়। যাতে ওর কোনো হাত ছিল না । সেই ভয়াবহ ঘটনার ফলে তার একদিকের বুক পুড়ে গিয়েছিল।
পরদিন আর বিনয়ের মুখোমুখি হতে চায়নি । সবাই বেড়াতে গেলে ও ওদের সাথে যায় নি। উদ্দেশ্য বিনয়ের মুখোমুখি না হওয়া । সবাই বেড়িয়ে যাবার কিছুক্ষন পর বিছানা থেকে উঠে পড়লো নীলিমা । ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে চুল আঁচড়ে একটা ঢিলে খোঁপা বেঁধে নিলো। মায়ের একটা দুধ সাদা খোলের তাঁতের সবুজ পেড়ে শাড়ি পরে নিলো । হাতেএকটা ম্যাচিং পার্স নিলো । ম্যাচিং চটি পড়ে দরজায় তালা দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ।
স্বর্গ দ্বারের কাছে যেতে মনে হলো কে যেন পিছু নিয়েছে। পিছু ফিরলো নীলিমা । হ্যাঁ যা ভয় করেছিল তাই হলো । সে ই আসছে । কিন্তু নীলিমার শরীরে কিসের আলোড়ন!! নীলিমা তো এর জন্য প্রস্তুত ছিল না ।!! সারা শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ। তাড়াতাড়ি পালাতে চেষ্টা করতে গেল কিন্তু তার আগেই বলিষ্ঠ একখানা হাত ওর কাঁধে এসে পড়ল । ঐ হাতের এতো দৃঢ়তা যে যে নীলিমা এক চুলও নড়তে পারলো না।
এ হাত কি অধিকার বোধের কথা বলছে?নাকি নীলিমার মন ই ঐ হাতের কাছ থেকে নড়তে চাইছে না?