সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি
সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি কা’ক বলে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অপার কৌতূহল আছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তাদের সেই কৌতূহল নিরসনের জন্য, এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
মানবিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে (humanities) সংস্কৃতির একটি মানে হল কোন একক ব্যক্তির শিল্প, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ভদ্রতায় নির্দিষ্ট মাত্রায় সূক্ষতা অর্জন। সাংস্কৃতিক সূক্ষতার মাত্রা কখনও কখনও সভ্যতাগুলো থেকে কম জটিল সমাজগুলোকে পার্থক্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই উঁচু নিচু ক্রমানুসারে সমাজ সাজানোর বিষয়টি সাংস্কৃতিক পুঁজিতে (cultural capital) কার কতোটুকু অধিকার আছে তার ভিত্তিতে অভিজাতদের জন্য উঁচু সংস্কৃতি এবং নীচু শ্রেণীর জন্য নীচু সংস্কৃতি (low culture), জনপ্রিয় সংস্কৃতি (popular culture), বা লোক সংস্কৃতি (folk culture) এই শ্রেণী ভিত্তিক পার্থক্য করা হয়ে থাকে। গণ সংস্কৃতি (Mass culture) বিংশ শতাব্দীতে গণের দ্বারা উৎপাদিত (mass-produced) ভোগবাদী সংস্কৃতি’র (consumer culture) গণমাধ্যমে প্রচারিত রূপকে (mass mediated) নির্দেশ করে। কিছু দর্শন যেমন – মার্ক্সীয় দর্শন (Marxism) বা ক্রিটিক্যাল থিউরি (critical theory) যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে সংস্কৃতি কখনও কখনও নীচু শ্রেণীর লোকদের কাজে লাগানোর জন্য বা মিথ্যা সচেতনতা (false consciousness) তৈরির জন্য অভিজাতদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কালচারাল স্টাডিজ (cultural studies)-য়ে এ ধরণের দৃষ্টিকোন দেখতে পাওয়া যায়। বিস্তৃত সামাজিক বিজ্ঞান (social sciences) এ তাত্ত্বিক সামাজিক বস্তুবাদের (cultural materialism) দৃষ্টিকোন থেকে মানুষের জীবনের বস্তুগত অবস্থান থেকে মানুষের প্রতিমূর্তি-সংস্কৃতির জন্ম হয় কারণ মানুষ তার শরীরগত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই অবস্থার তৈরি করে এবং মানুষের বিবর্তনের স্বভাব (evolved biological) দ্বারা সংস্কৃতির ভিত্তি পাওয়া যায়।
যখন সংস্কৃতিকে গণনার যোগ্য সংখ্যা (count noun) হিসেবে দেখা হয় তখন সংস্কৃতি মানে হচ্ছে প্রথা, ঐতিহ্য, সমাজ বা সম্প্রদায় যেমন একটি নৃগোষ্ঠিগত দল বা জাতির মূল্যবোধ। বিভিন্ন সময়ে যে জ্ঞান আহৃত হয় তার সমষ্টিই সংস্কৃতি। এই ধারণায় বহুসংস্কৃতিবাদ (multiculturalism) শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান এবং একই গ্রহে বসবাসরত বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধকে মূল্যায়ন করে। কখনও কখনও একটি দেশের উপদলের নির্দিষ্ট অনুশীলনকে “সংস্কৃতি” বলা হয় {(উদাহরণস্বরূপ: ব্রো কালচার (“bro culture”)} বা মূলধারা বিরোধী সংস্কৃতি (counterculture)। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান (cultural anthropology) এ কোন মানুষের সংস্কৃতি তার বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং অনুশীলন তার নিজের সংস্কৃতির ভিত্তিতে করা হয় (cultural relativism) এ ধারায় সংস্কৃতি সহজে নিরপেক্ষভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় না বা মূল্যায়ন করা হয় না কারণ যে কোন মূল্যায়ন ওই সংস্কৃতির মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয়।
কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। উক্ত বিষয়গুলোকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগ রোজকার জীবনযাপনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত আর দ্বিতীয়ভাগ জীবন উপভোগের ব্যবস্থা এবং উপকরণের সাথে সম্পকির্ত।
সংস্কৃতি হল মানুষের টিকে থাকার কৌশল এবং পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী। মানুষের এই কৌশলগুলো ভৌগোলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে।
পূর্বপুরুষদের যেমন এইসব কৌশলগুলি ছিল তা থেকে উত্তরপুরুষেরা এই কৌশলগুলি পেয়েছে। তারপর সময় ও যুগের প্রেক্ষিতেও তারা কিছু নতুন কৌশল সৃষ্টি করে। তাই বলা যায় সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরোপিত অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তেমনি তা কিছুটা আবার অর্জিতও বটে।
নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে –
‘সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হল সংস্কৃতি।’
ম্যালিনোস্কির মতে –
‘সংস্কৃতি হল মানব সৃষ্ট এমন সব কৌশল বা উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।’
স্যামুয়েল পুফেনডর্ফের মতে –
‘সংস্কৃতি বলতে সেই সকল পন্থাকে বোঝায় যার মধ্য দিয়ে মানব জাতি তাদের প্রকৃত বর্বরতাকে কাটিয়ে ওঠে এবং ভ্রান্তিমূলক কৌশলের মাধ্যমে পূর্ণরূপে মানুষে পরিণত হয়।’
আর এর বিপরীতে যা অবস্থান করে
তাকেই সমাজপতিরা অপসংস্কৃতি বলে থাকেন।
এইসব পুঁথিগত তাত্ত্বিক তত্ত্বকথা জেনে বুঝে মেনে নিয়ে, এক কথায় সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য, সহজ সরল ভাষায় বলা চলে , মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসার নামই সংস্কৃতি।
অন্যথায় কাউকে হিংসা করা, ঘৃণা করা, অবজ্ঞা করা হেয় করা, কারও জন্য বিদ্বেষ ভাব মনের ভিতর পুষে রাখাই হলো অপসংস্কৃতি। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির কোন যোগ নেই। হয়তো সুশিক্ষা পেলে অপসংস্কৃতি কিছুটা মন থেকে দূর সম্ভব হয়, তার বেশী কিছু নয়।
এই অপসংস্কৃতির বীজ আমরা ছোট বেলা থেকেই মনের ভিতর অজান্তে লালন করে চলি। এর উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে প্রধানতঃ আত্মীয় বন্ধু পরিজন ও প্রতিবেশীদের ঘিরেই।যাদে সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতার ও প্রতিদ্বন্দ্বীতার সম্পর্ক থাকে।সেখানেই এর উৎপত্তি।
তাদের উন্নতি,ধনবৃদ্ধি, প্রভাব বা ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমাদের মনে ঈর্ষার ভাব জন্ম নেয়। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ যদি বড় চাকরী পায় , কারও মেয়ের যদি সুপাত্রে বিয়ে হয় , তবে মনে মনে আমরা হিংসা বোধ করি। অবচেতন মনে তাদের উন্নতি আমরা সহ্য করতে পারি না।
আমরা হিংসার জ্বালায়,ঘৃণার বিষে, বিদ্বেষের যন্ত্রণায় পুড়ে মরি ভিতরে ভিতরে। অন্যের কাছে তার নিন্দা করে আরাম পাই , আত্মতুষ্টিতে ভুগি।
তা’তে একপ্রকাশ আপাত শান্তি মেলে বটে, স্বস্তি মেলে না,ক্ষোভ যন্ত্রণা সম্পূর্ণ দূর হয় না। আখেরে কিছু লাভ হয় না।
যেমন, ধরুন –
আমার ছেলে কোন রকমে তৃতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করল,আর ভাগ্নে প্রথম বিভাগে উচ্চ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করল, তা’তে মনের ভিতরে অহেতুক ক্ষোভ জ্বালা বিদ্বেষ অনুভব করি। করার অবশ্য যথার্থ কোন কারণ নেই। তবুই মনে বিদ্বেষ বশতঃ বোন আর ভাগ্নের সম্পর্কে ঈর্ষা শুরু হয় ভিতরে ভিতরে।
আসলে এটা একটা মানসিক রোগ।
এর প্রতিকার পাওয়া সহজে সম্ভব নয়। পরিচিত জনের ক্ষয় ও ক্ষতিতে আমরা এক প্রকারের বিকৃত সুখ ও আনন্দ লাভ করি। এই জন্যই ফরাসী কবি বোধহয় বলেছেন, –
‘ নিজের দুঃখ দুর্দশার কথা, কাউকে বোলো না,সে তোমার সামনে, মুখে সহানুভূতি দেখালেও, মনে মনে খুশি হবে।’
বোধহয় আসলে আমরা সকলেই মনে মনে অপসংস্কৃতিবান। সংস্কৃতি আমাদের আয়ত্ব করতে হয় অনেক নিষ্ঠা ও যত্নের সাথে। যা খুব সহজ ও সুলভ নয় মোটেও। মন ও মননের সঙ্গে এ’জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। তবেই একসময় হয়তো সংস্কৃতিবান হয়ে উঠা যায়। যেমন, পেরেছিলেন – গৌতমবুদ্ধ, চৈতন্যদেব, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমুখেরা।