Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শুয়োর বিষয়ক একটি অসম্পূর্ণ গবেষণাপত্র

শুয়োর বিষয়ক একটি অসম্পূর্ণ গবেষণাপত্র

প্রথমে বন্দনা করি বাহ-নন্দন
অতঃপর বন্দি আমি কোটি দেবগণ।
ধরিত্রী আকুল যবে প্রলয় সলিলে
তোমা রূপ ধরি বিষ্ণু রক্ষে প্রাণিকুলে।
পশু মধ্যে তুমি শ্রেষ্ঠ তুমি শক্তিমান
পাপীরে পবিত্র কর তুমি পুণ্যবান।

(আদিকাণ্ড, বরাহ বন্দনা কাব্য, কবিকুলতিলক অখিলবন্ধু দেবশৰ্ম্মণ প্রণীত, ১২৩১ সন)

শুয়োর বিষয়ক গবেষণায় কৌশিকের প্রথম আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিল একটি অকিঞ্চিৎকর ছেঁড়া ঠোঙা।

জিলিপি বরাবরই কৌশিকের প্রিয়। বস্তুটির আড়াই প্যাঁচের রহস্য এবং মহিমা কৌশিককে বরাবরই বিস্মিত করেছে। কিন্তু একদিন জিলিপির বদলে তার ছেঁড়া ঠোঙা ওর তীব্র বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল।

ঠোঙার শেষ জিলিপিটির সদগতি করে কৌশিক যখন সামান্য ছেঁড়া ঠোঙাটিকে ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই পয়ার ছন্দে লেখা কয়েকটি লাইন ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ঠোঙাটি সম্ভবত কোনও ফোটোকপি করা কাগজ থেকে তৈরি হয়েছিল। তার ফলেই কৌশিক প্রথম কবিকুলতিলক অখিলবন্ধু দেবশর্মণের নাম জানতে পারে এবং শুয়োরের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

বছর চব্বিশের একজন সুপুরুষ যুবকের যখন টিভি, ভিডিও, ত্রিভঙ্গ নৃত্য (যার প্রচলিত নাম ব্রেক ডান্স) এবং তরুণীতে আকৃষ্ট হওয়ার কথা, তখন কৌশিক প্রথাগত পথ ছেড়ে হঠাৎই শুয়োরের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

কৌশিক বরাবর মাঝারি। ও জন্মসূত্রেও মাঝারি পিতামাতার সন্তান। ওঁদের বিত্ত এবং সামাজিক গুরুত্বও ছিল মাঝারি। পড়াশোনা ও আচরণে কৌশিক প্রত্যাশা মতোই মাঝারি-রেখাকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করেছে। ওর পড়াশোনার বিষয় ছিল বাংলা এবং লক্ষ্য ছিল যথারীতি স্কুল বা কলেজে শিক্ষকতা।

বাংলায় এম. এ. মাঝারিভাবে পাশ করার পর ও নিয়মমাফিক অ্যাপ্লিকেশান, ইন্টারভিউ ইত্যাদি দিয়ে চলেছে। এবং নিয়মমতো বরাবরই ওর নাম প্যানেলে থেকেছে, চ্যানেলে যায়নি।

ক্রমাগত এইসব প্রচেষ্টায় যখন কৌশিকের একেবারে মাখামাখি অবস্থা, তখন ওর মাঝারি জীবন এক তরুণীর ভালোবাসায় কিছুটা ডগমগ হয়ে ওঠে। কিন্তু এবারেও ওর প্যানেলে নাম থেকে যায়, তরুণীর অন্যত্র বিয়ে হয়, কৌশিক বিয়ের নেমন্তন্ন পায় এবং কেঁদে আকুল হয়।

এইভাবে কৌশিক আদর্শ মাঝারি বাঙালি তরুণ হয়ে ওঠে। শুরুতে ও যে প্রচ্ছন্ন বেকার ছিল, ক্রমে তা অপ্রচ্ছন্ন হয়ে উঠতে থাকে। তবে জিলিপির প্রতি ওর দুর্বলতায় কখনও কোনওরকম ভাটা পড়েনি।

সুতরাং অপ্রচ্ছন্ন বেকার কৌশিক শুয়োর বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠার পর একজন একনিষ্ঠ গবেষকের মতো এই অদ্ভুত চতুষ্পদটি সম্পর্কে তত্ত্বগত ও বাস্তবসম্মত অনুসন্ধান শুরু করে দিল।

শুয়োর এবং মানুষের সম্পর্ক

কৌশিক ঘুণাক্ষরেও জানত না, এই চতুষ্পদটির সঙ্গেই মানুষের সম্পর্ক প্রাচীনতম। এই তথ্য ওকে জানাল বালক-বালিকার জন্য প্রকাশিত ব্রিটানিকা জুনিয়ার এনসাইক্লোপিডিয়া। সুইডা পরিবারের সদস্য এই প্রাণীটি মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদিম মানুষ প্রথম যেসব প্রাণীকে পোষ মানিয়েছিল, তার মধ্যে শুয়োর ছিল প্রধান। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ২৯০০ বছর আগে এশিয়াটিক সোয়াইনকে মানুষ পোষ মানায়। আর তাদের ইয়োরোপিয়ান জাতভাইয়েরা মানুষের কাছে পোষ মানে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল নাগাদ। কিন্তু অনেক চেষ্টা এবং খোঁজাখুঁজি করেও কৌশিক ভারতীয় শুয়োর অথবা পশ্চিমবঙ্গের শুয়োর সম্পর্কে সেরকম কোনও ঐতিহাসিক তথ্য জোগাড় করতে পারেনি। তবে ও মোটামুটি ধরে নিল, মানুষের (সম্ভবত) প্রাচীনতম গৃহপালিত পশুর নাম শুয়োর।

এ-থেকে কৌশিক দুটো সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় :

১) শুয়োর মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২) শুয়োরের ঐতিহ্য মানুষের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

এ ছাড়া আরও কয়েকটি তথ্য কৌশিককে বিচলিত করে ও শুয়োর মানুষের মতোই স্তন্যপায়ী। এবং মানুষের মধ্যে যেমন সাদা-কালো ভেদ আছে, শুয়োরের মধ্যেও সাদা-কালো ভাগ আছে। তবে কিছু শুয়োর আছে, যাদের রং সাদা কালো মেশানো। আর পশ্চিমবঙ্গে প্রধানত যে-শুয়োর পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়, তার রং কালো।

সদ্য আবিষ্কৃত এই বৈশিষ্ট্যগুলো কৌশিককে রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে। এবং একইসঙ্গে শুয়োর বিষয়ে ওর আগ্রহকে পাঁচ গুণ করে দেয়।

শুয়োরের আচরণ ও গতিবিধি

শুয়োরের আচরণ একটু-একটু কৌশিকের জানাই ছিল। কিন্তু গবেষণার তীব্রতা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ও শুয়োর সম্পর্কে বহুগুণ বেশি মনোযোগী হয়ে উঠল।

কৌশিকের বাড়ির কাছাকাছি একটি প্রায়-মজে-যাওয়া দুর্দশাগ্রস্ত খাল আছে। এককালে নাকি এই খালে বজরা ভাসত। এখন যা ভাসে তা শুধুই কচুরিপানা এবং মানুষের বর্জ্য পদার্থ।

এই খালের পাড়ে অসংখ্য ঝুপড়ি। ঝুপড়িগুলো আবর্জনা ও মানুষে একেবারে উপচে পড়ছে। এই সব নিম্নবর্গের জনগণের কেউ-কেউ শুয়োর পালন করে থাকেন। শুয়োর পালনের কাজে খালের দুর্গন্ধময় ভয়ংকর নারকীয় পরিবেশ যথেষ্ট অনুকূল। খালের জলে থিকথিক করা পাঁক কালো কালো শুয়োরগুলোর গরম শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। শুয়োরের খাদ্য যা বাস্তবে অখাদ্য এবং কুখাদ্য–এখানে পাওয়া যায় অঢেল। সুতরাং অনায়াসে শুয়োরের পাল এখানে লালিতপালিত হয় এবং নির্বিঘ্নে দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করে।

কৌশিক লক্ষ করেছে, আবর্জনার প্রতি আকর্ষণ শুয়োরের মৌলিক প্রবণতা। অক্লান্তভাবে নোংরা ঘেঁটে দেখা তাদের প্রিয় নেশা। পরিবেশ কোনও কারণে সাফসুতরো হয়ে উঠলেই শুয়োরের দঙ্গলে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে। কারণ, নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশকেই তারা জিইয়ে রাখতে চায়। কোনও শুয়োরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে নিয়ে গেলে সে হয় নোংরা পরিবেশে ফিরে আসে, অথবা সেই পরিষ্কার পরিবেশকে দ্রুত দূষিত করে নিজের বাসযোগ্য করে তোলে।

এ ছাড়া আরও একটা ব্যাপার কৌশিক লক্ষ করেছে : শুয়োর যখন নিজের খেয়ালে চরে বেড়ায় তখন কোনওদিকেই সে ভুক্ষেপ করে না–শুধুমাত্র নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অর্থাৎ, নিজের স্বার্থটুকু বাদ দিলে শুয়োরকে মোটামুটিভাবে আত্মভোলা বলা যায়।

শেষ লাইনটায় প্রচ্ছন্ন পরস্পরবিরোধী ভাব লক্ষ করে কৌশিক নিজের স্বার্থটুকু বাদ দিলে কথাগুলো কেটে দেয়।

কৌশিক যতই ওর পর্যবেক্ষণের ফলাফল নিয়ে চিন্তা করছিল ততই দুটো সিদ্ধান্ত ওর মগজে স্পষ্ট চেহারা নিচ্ছিল?

১) নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শুয়োরের ভীষণ প্রিয়। ২) নিজের ব্যাপার ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে শুয়োর যারপরনাই অন্যমনস্ক।

শুয়োরের চাষঃ নানা দেশে

ব্রিটানিকা জুনিয়ার এনসাইক্লোপিডিয়া-র ১৯৮০ সালের সংস্করণ কৌশিককে শুয়োরের চাষ সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্য জোগান দিল।

শুয়োরের চাষের ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে চিন। সেখানে গড়ে দুশো মিলিয়ান শুয়োর প্রতিপালন করা হয়।

চিনের পরেই রয়েছে ব্রাজিল। সে-দেশে গড় শুয়োরের সংখ্যা ষাট মিলিয়ান। ব্রাজিলের পর জায়গা পেয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়া। এবং তালিকায় দশ নম্বর স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক।

বেশ কয়েকমাস যাবৎ শুয়োর-চর্চার ফলে কৌশিকের মনে এইরকম ধারণা জন্মেছিল যে, পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে শুয়োরের সংখ্যা মোটেই অবহেলা করার মতো নয়। ফলে, বিদেশি বইয়ের শুয়োর-তালিকায় ভারতের নাম না দেখে ও একটা ছোটখাটো অথচ উল্লেখযোগ্য ধাক্কা গেল।

একইসঙ্গে ওর মনে হল ও ভারতে শুয়োর সম্ভবত প্রচ্ছন্নভাবে লালিতপালিত হয়। বিদেশের পরিসংখ্যানবিদরা এইসব প্রচ্ছন্ন শুয়োরকে সহজে চিহ্নিত করতে পারেন না।

শুয়োরের চাষ যে বেশ লাভজনক তা কৌশিক পড়াশোনা করে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। চাষের শুয়োর প্রধানত দু-রকমের : চর্বিপ্রধান ও মাংসপ্রধান। তবে আশির দশক থেকেই চর্বিপ্রধান শুয়োরের তুলনায় মাংসপ্রধান শুয়োরের চাহিদা বেড়েছে।

একটা শুয়োর স্রেফ চোখে দেখে তার ওজন আঁচ করা শক্ত। যেমন, সবচেয়ে বড় জাতের পুরুষ-শুয়োরের ওজন প্রায় ৪৫০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। আর স্ত্রী-শুয়োরের সর্বোচ্চ ওজন ৩৬০ কেজি ছুঁই-ছুঁই।

এই তথ্য জানার পর কৌশিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় যে, প্রাণীদের মধ্যে শুয়োরের আপেক্ষিক গুরুত্বই বোধহয় সবচেয়ে বেশি।

বন্ধুমহলে কৌশিকের শুয়োর বিষয়ক গবেষণা যথেষ্ট হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছিল। তা ছাড়া ওকে দেখলেই বন্ধুরা নানা ধরনের লঘু মন্তব্য করে ওঠে। এমনকী আদিরসের রসিকতা করতেও ছাড়ে না।

একদিন এ-জাতীয় রসিকতায় নাস্তানাবুদ হয়ে কৌশিক যখন প্রায় কোণঠাসা এবং পর্যদস্ত, তখন সে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করে, ভারতে প্রচ্ছন্ন শুয়োরের সংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যা অত্যন্ত বেশি।

কৌশিকের এই মন্তব্যের ফলে, কী জানি কী কারণে, ওর বন্ধুরা বেশ আহত হয়েছিল।

কৌশিক তাতে খানিকটা মজা পেয়ে বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গের জমিতে শুয়োরের চারা লাগালে তা দেখতে দেখতে লকলকিয়ে বেড়ে উঠবে।

সে-রাতে কৌশিক শুয়োরের চারা শব্দজুটি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে গভীরভাবে ভেবেছিল।

শুয়োর টুপি পরে, না কি পরে না

এই ভাবনা কৌশিকের মাথায় উদয় হয় মহাকবি সুকুমার রায়ের একটি কবিতা পড়ে।

কবিতাটি নামহীন এবং আবোল তাবোল গ্রন্থে পাদপূরণ হিসেবে সঙ্কলিত। কিন্তু কৌশিক অনায়াসে সেই কবিতার মোক্ষম চারটি লাইন মুখস্থ করে ফেলেছে?

বলব কি ভাই হুগলি গেলুম
বলছি তোমায় চুপি-চুপি
দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর
মাথায় তাদের নেইকো টুপি।

সুকুমার রায়ের কবিতা বরাবরই কৌশিককে ভাবায়। যেমন, তার হুঁকোমুখো হ্যাংলা কবিতার শ্যামাদাস মামা তার । আফিঙের থানাদার লাইনটির মধ্যে কৌশিক বর্তমানে বহুল প্রচলিত এবং প্রায় সর্বজনস্বীকৃত মামাতন্ত্রের আভাস পায়। কিংবা, ছায়াবাজি-র ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা লাইনটির মধ্যে ও বর্তমানের যাবতীয় তদন্ত কমিশন গঠন ও তাদের হাস্যকর প্রচেষ্টার

স্পষ্ট ইঙ্গিত পায়। এবং এ-জাতীয় তদন্ত কমিশন যে তদন্তের চেয়ে কমিশনের ওপরেই বেশি জোর দিয়ে থাকে, সেই তাৎপর্যও যেন রায়সাহেবের কবিতার এই লাইনটির অন্তরাল থেকে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে ব্যঙ্গের হাসি হাসে।

ঠিক একইভাবে কিম্ভুত কবিতার মধ্যে কৌশিক নিজেকে শনাক্ত করার চেষ্টা অথবা আত্মানুসন্ধানের ইঙ্গিত পায়। আর খুড়োর কল তো খুড়োর কল! পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এই বস্তুটিকে হাড়ে হাড়ে চেনে।

সুতরাং, সুকুমার রায় যিনি কৌশিকের মতে মহাকবি যখন লেখেন টুপিহীন শুয়োর একটি আশ্চর্য ঘটনা, তখন এটা কি ধরে নেওয়া যায় না যে, টুপি পরা শুয়োরের সংখ্যাই সাধারণত বেশি! অথবা, একটু ঘুরিয়ে কি বলা যায়, টুপি পরা শুয়োর বেশি প্রচলিত?

আবোল তাবোল প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। সুতরাং, এটা আশা করা খুবই অযৌক্তিক যে, এখনও একমাত্র হুগলিতেই টুপি পরা শুয়োরের আধিপত্য। যদি একসময় তারা হুগলিতে থেকেও থাকে, এই ৭০ বছরে তারা নিশ্চয়ই নিয়মিত হারে বংশবৃদ্ধি করেছে এবং পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তা ছাড়া, হুগলি শব্দটা রায়সাহেব শুধুমাত্র ল বর্ণের অনুপ্রাসের জন্যও ওই কবিতায় ব্যবহার করে থাকতে পারেন।

এইরকম বহুমুখী চিন্তার পর কৌশিক মনে মনে সিদ্ধান্তে পৌঁছোয়ঃ

১) টুপি পরা এবং টুপিহীন–দু-রকম শুয়োরই এখানে পাওয়া যায়।

২) টুপিহীন শুয়োরকে টুপি পরানোর জন্য টুপি পরা শুয়োররা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে থাকে।

কৌশিকের বিক্ষিপ্ত চিন্তা এবং সমস্যা

শুয়োর গবেষণায় কৌশিক যতই নিমগ্ন হয়, ওর মাথায় ততই বিক্ষিপ্ত চিন্তা জায়গা করে নিতে থাকে। যেমন, ওর মনে হয়, শুয়োরের দুধ মানুষের প্রাচীন পূর্বপুরুষ কবে প্রথম পান করেছিল। সেই দুধের অণুর কোনওরকম রাসায়নিক প্রভাব কি অধস্তন অথবা উত্তরপুরুষে প্রবাহিত হয়েছে? শুয়োরের মারাত্মক অসুখ কলেরা। এই কলেরা সংক্রামক। মানুষের কলেরার সঙ্গে শুয়োর কলেরার কী সম্পর্ক, বা আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি না, সে-বিষয়ে কৌশিক অনুসন্ধান করতে বদ্ধপরিকর।

বস্তুত, শুয়োরের ভাবনায় কৌশিক এতই আচ্ছন্ন হয়ে উঠল যে, ও শুয়োর বিষয়ক স্বপ্ন অনায়াসে দেখতে লাগল। শুয়োরের ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ এবং দেড় প্যাঁচওয়ালা লেজও ওর গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

ইদানীং কৌশিক নানারকম মানুষ দ্যাখে আর অবাক হয়ে ভাবে, এককালে আমাদের হাতদুটো ছিল সামনের পা। পায়ে খুর ছিল না বটে, তবে গায়ে বড়-বড় লোম ছিল।

এইসব ভাবনায় নিমজ্জিত অবস্থায় কৌশিক একদিন ময়দানের একটি জনসভায় হাজির ছিল। ওর উদ্দেশ্য ছিল, শুয়োর বিষয়ে আরও নতুন নতুন তথ্যসংগ্রহ। আর টুপি পরা শুয়োর টুপিহীন শুয়োরকে কীভাবে টুপি পরাতে চেষ্টা করে তাও হাতে-নাতে দেখা।

মঞ্চে এক প্রখ্যাত এবং ঘোড়েল রাজনীতিবিদ জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছিলেন। ভাষণের সারমর্ম বিপক্ষের রাজনৈতিক দলের গায়ে কাদা ছোঁড়া। আজকাল এটাই সহজ পথ হয়ে উঠেছে? আমি যে কত ভালো তা প্রমাণ করার একমাত্র উপায়, তুমি কত খারাপ সেটা সবাইকে সহজে বুঝিয়ে দেওয়া। এ-জাতীয় কাদাঘাটার মধ্যে কৌশিক যথারীতি শুয়োর-প্রবণতার লক্ষণ দেখতে পেল।

বক্তৃতার শেষে সেই নেতা যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন তখন কৌশিক তার মুখোমুখি হাজির হয়ে নিষ্পাপভাবে প্রশ্ন করে, আপনার ও-দুটো হাত, না সামনের পা?

পরিণামে, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ক্যাডাররা কৌশিককে তুলোধোনা করে।

মার খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় কৌশিক যখন অন্ধকার খোলা মাঠে পড়ে থাকে তখন ওর নিজেকে টুপিহীন শুয়োর মনে হয়। কিন্তু যারা ওকে নৃশংসভাবে আক্রমণ করেছিল, তারাও কি একই শ্রেণির? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কৌশিক জ্ঞান হারায়। আকাশের চাঁদ ও তারা ওর অচেতন দেহ পাহারা দিতে থাকে।

কৌশিক সুস্থ হয়ে ওঠে সতেরো দিন পরে।

ময়দানে সেই পশুর মতো আক্রমণ ওকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। বরং ও বুঝতে পারে, টুপিহীন শুয়োরদের বেশিরভাগই হয় অন্ধ, নয়তো আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর।

কৌশিক বুঝতে পার, ওর সামনে এখন অনেক কাজ। শুয়োর বিষয়ে আরও অনেক গবেষণা ওকে করতে হবে।

এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে কৌশিক জিলিপির কাছে কৃতজ্ঞতা বোধ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress