Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লাস্ট বেঞ্চের ছেলেটা || Saswati Das

লাস্ট বেঞ্চের ছেলেটা || Saswati Das

লাস্ট বেঞ্চের ছেলেটা

হারানবাবু একটা স্কুলে দীর্ঘ পঁচিশ বছর শিক্ষকতা করে আজ অবসর গ্রহণ করলেন। অবসর নিয়ে ফেরার সময় তাঁর চোখ দুটো বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এতদিনের বহু সুখ দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত স্কুল, টিচার্সরুম, ক্লাসরুম সব হারান বিশ্বাসকে পেছেনে টানছিল। একটা দিনের কথাতো তিনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। সে দিন গরমের ছুটির পর প্রথম স্কুল খুলেছে। হারানবাবু ক্লাস সেভেনের অংক ক্লাস নিতে গেছেন।
তিনি বোর্ডে অংক টুকে দিয়ে বললেন এই অংক গুলো করে ফেল তাড়াতাড়ি।আজকে নতুন অংক শেখাবো।সবাই খাতা বের করে অংকে মন দিলো।কিন্তু লাস্ট বেঞ্চের একটা ছেলে বসে বসে মুখ নিচু করে বেঞ্চের তলায় কিছু একটা করছে। হারানবাবুর নজর এড়াল না।তিনি পাশের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন “এই, লাল্টু কি করছে রে?”
হরি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো “স্যার ও অংক করছে না, ও ঠোঙা বানাচ্ছে।”
হারানবাবু বেজায় ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “লাল্টু উঠে আয় এদিকে।”
লাল্টু ভয়ে ভয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে গিয়ে স্যারের কাছে দাঁড়িয়েছে।
“হাত পাত, হাত পাত, অংক ক্লাসে ঠোঙা বানানো? তুমি মুদি দোকান দেবে? আজ তোকে আমি ছাড়বো না।”
বলে কয়েক ঘা স্কেলের বাড়ি মেরেও মনঃপুত হলো না, তারপর লাল্টুকে বললেন, “যা কান ধরে বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়া। আজ তোর টিফিন খাওয়া বন্ধ। এই, সব দেখবি তো ও যেন আজ টিফিন না খায়।”
হরি বলল, “স্যার ও টিফিন খাবে কি? ও তো কোনো দিনই টিফিন আনে না।”
” কেন? টিফিন আনে না কেন? কিরে তুই টিফিন আনিস না কেন?”
“স্যার আমার বাবাতো খুব গরিব,তাই মা টিফিন দিতে পারে না।”
“তোর বাবা কি করে?”
” বাবা আগে রিক্সা চালাতো, কিন্তু ছয় মাস আগে বাবার কিডনির অসুখ ধরা পরে। আমাদের যা ছিল সব বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা চালানো হয়, কিন্তু এখনও চিকিৎসায় অনেক টাকা লাগে। বাবা ঘরে বসে বসে ঠোঙা তৈরি করে। মা এক বাড়ি রান্না করে, আর দুই বাড়ি ঠিকে কাজ করে। আমি তাই বাবার সাথে হাতে হাতে ঠোঙা তৈরি করে বাবাকে সাহায্য করি যাতে দুটো টাকা বেশি পাওয়া যায়।”
হারানবাবুর চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল।লাস্ট বেঞ্চের সব ছেলেই যে বখাটে হয় না,লাল্টুর মতো ছেলেরাই তার প্রমান। উনি লাল্টুকে বললেন, “লাল্টু বোস; অংক গুলো আমাকে করে এনে দেখা।”
লাল্টু সব অংক করে স্যারকে দেখালো।
হারানবাবু দেখলেন সবকটা অংকই ঠিক করেছে। তার মানে গরমের ছুটিতে সে পড়ায় ফাঁকি দেয় নি। হারানবাবু খুব খুশি হয়ে বললেন,
“তুই অনেক বড় হবি। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। যত কষ্টই হোক পড়াশোনাটা চালিয়ে যাবি। কোথাও অসুবিধা হলে আমাকে দেখাবি।
তারপর থেকে হারানবাবু লাল্টুর মাথায় স্নেহের হাত রেখে ছিলেন। ওর কোনো অংক বুঝতে অসুবিধা হলে হারানবাবু অফ পিরিয়ডে ওকে ডেকে অংক বুঝিয়ে দিতেন। সেদিনের পর থেকে উনি লাল্টুকে নিয়ে যেন একটা বাজি ধরে ছিলেন, ওকে যে করেই হোক জেতাতেই হবে, লাল্টুর হার যেন তারই হার। সেই লাল্টু যেদিন মাধ্যমিকে ৯২% নম্বর পেয়ে স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়েছিলো, সেদিন সব চাইতে বেশি খুশি হয়েছিলেন হারানবাবু। আজ লাল্টু না উনি এই নম্বর নিয়ে পাস করেছেন। লাল্টু অংকে পেয়েছিল ৯৯।
আজ উনি যখন স্কুল থেকে অবসর নিচ্ছেন লাল্টুর কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ছিল।কিছু কিছু ছাত্র তাদের ছাপ রেখে যায়, লাল্টু সেরকমই একজন। একটু অন্যমনস্ক ভাবে হারানবাবু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা গাড়ি ওঁর সামনে হ্যাঁচকা ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভার চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “কি কাকা দেখতে পান না? এক্ষুনি তো চাপা পড়তেন আর দোষ হতো ড্রাইভারের!”
হারানবাবু লজ্জিত হয়ে বললেন, “কিছু মনে করো না বাবা, আমি লক্ষ্য করিনি।” পেছনের সিটে বসা ব্যক্তি ড্রাইভারকে বলল, “গাড়ি সাইড করো আমি নামবো।” ড্রাইভার বলল স্যার ছেড়ে দিন, উনি লক্ষ্য করেন নি। কি হবে বয়স্ক মানুষের সঙ্গে শুধু শুধু ঝামেলা করে?”
“তোমাকে যা বললাম তুমি তাই করো।”
“ঠিক আছে স্যার।'”
গাড়ি থেকে নেমে ব্যক্তিটি হারানবাবুর কাছে এসে বলল
“স্যার আমায় চিনতে পারছেন? আমি লাল্টু”
বলে, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা হারানবাবুকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। ড্রাইভার আশ্চর্য হয়ে দেখলো ওর স্যারের কর্ম। স্যার কে ও রাশভারী মানুষ হিসেবেই জানে,খুবই কম কথা বলে। সেই মানুষ রাস্তায় দাঁড়ানো একজন মাঝবয়সী লোকের পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে!
হারানবাবু অবাক বিস্ময়ে বললেন ” লাল্টু? আমাদের বিষ্ণুপুর স্কুলের লাল্টু?
“হ্যাঁ স্যার আমি সেই লাল্টু।যাকে আপনি ক্লাস সেভেনে ঠোঙা বানানোর অপরাধে শাস্তি দিয়ে ছিলেন, মনে পড়ে স্যার? সেদিন শাস্তি না পেলে বোধ হয় আজ আপনার সামনে এই লাল্টু থাকতো না; হয়তো বেনো জলের মতো হারিয়ে যেতে? আমি আপনাকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না স্যার, আমার বাবার পরেই আমার কাছে আপনার স্থান সর্বোচ্চ। আপনি যদি আমাকে পথ না দেখতেন তাহলে আমি কোনদিন এখানে পৌঁছতে পারতাম না।”
হারানবাবু লাল্টুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই এখন কোথায় আছিস?”
“স্যার আমি এখানকার পড়া শেষ করে অংক নিয়ে গবেষণা করতে লন্ডনের অক্সফোর্ড উনিভার্সিটি যাই। এখন ওখানেই থাকি এই কিছুদিন হলো ভারতে এসেছি। আপনি কেমন আছেন স্যার?”
“আজ আমি চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলাম। আজ তোর কথা খুব মনে পড়ছিলো। তোর কথা ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিলাম।তাতেই তোর গাড়ির সামনে এসে গেছি।”
“স্যার আমার অনেক সৌভাগ্য আজ আপনার সাথে দেখা হলো। আমি কিছুদিন পরেই আবার লন্ডন চলে যাবো। আর কোনোদিন ফিরবো কি না জানি না। তবে আপনাকে আমি সারা জীবন হৃদয় আসনে বসিয়ে রাখবো। আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠুন স্যার আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবো।”
“আমিতো তোর উল্ট দিকে যাচ্ছিলাম। তুই আবার উল্ট ঘুরবি?”
“স্যার আপনার এই সেবাটুকু করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। এইটুকু আমাকে করতে দিন স্যার!”
হারানবাবুকে নিয়ে লাল্টু গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসলো। দামি গাড়ি রাজ হাঁসের মতো ছুটে চলল শহরের বুক চিরে। ঠান্ডা গাড়িতে গা এলিয়ে দিয়ে হারানবাবু মনে মনে ভাবলেন এ জয় আমারই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress