Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যখন কিছুই মনে পড়ছে না || Anish Deb

যখন কিছুই মনে পড়ছে না || Anish Deb

তখন আপনি কী করবেন?

অফিস থেকে ফেরার সময় যদি আপনার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়, আর আপনি সব ভুলে যান, কিছুই যদি আপনার মনে না পড়ে, তখন আপনি কী করবেন বলুন তো!

আমি নিজে কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছি না বলে দিশেহারা হয়ে আপনাকে জিগ্যেস করছি।

রোজকার মতো অফিস থেকে ফিরছিলাম। একটু আনমনা ছিলাম বলে ঠিকঠাক বাসে উঠতে পারিনি। টিকিট কাটার সময় কন্ডাক্টর ভাই বলল যে, বাসটা রাজাবাজার থেকে ডানদিকে ঘুরে যাবে। অথচ আমার সোজা রাস্তা ধরে কোথায় একটা যেন যাওয়ার কথা। তাই বাসটা রাজাবাজার স্টপেজে এসে ডানদিকে ঘুরে থামতেই নেমে পড়েছি।

প্রায় সাতটা বাজে। চার রাস্তার মোড়টা গাড়ি-ঘোড়া, অটো আর সাইকেল ভ্যানে জট পাকিয়ে আছে। তার সঙ্গে পিলপিল করছে ব্যস্ত মানুষের দল।

মোড়টা কোনাকুনি পার হয়ে উলটোদিকের বাস স্টপে যেতে হবে। সেখান থেকেই সোজাসুজি যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে।

তো সেই চেষ্টাই করছিলাম। এদিক-সেদিক ছুটে চলা গাড়ির গতিপথ এড়িয়ে কায়দা করে রাস্তাটা পার হচ্ছিলাম। আর ঠিক তখনই অ্যাক্সিডেন্টটা হল।

একটা ট্যাক্সি আর একটা মিনিবাস তেরছাভাবে বাঁক নিচ্ছিল, আর তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে তাড়া খাওয়া নেংটি ইঁদুরের মতো এঁকেবেঁকে ছুটে যাচ্ছিল দুটো অটো। আমি বোধহয় একসেকেন্ডের জন্যে অন্যমনস্ক হয়েছিলাম…ঠিক মনে নেই। একটা অটো আমাকে পাশ থেকে এসে ধাক্কা মারল। আমি ছিটকে গিয়ে বাড়ি খেলাম একটা বাসের গায়ে। মাথাটা কী একটা শক্ত জিনিসে ঠুকে গেল। তারপর পড়ে গেলাম রাস্তায়।

লোকজনের হইহই কানে এল। তার সঙ্গে গাড়ির নানারকম হর্নের শব্দ। ব্যস, তারপর আর কিছু মনে নেই।

একটু পরে চোখ মেলে যখন তাকালাম, তখন আমাকে ঘিরে অনেক ঝুঁকে পড়া মানুষের ভিড়। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই চাপা চিৎকার উঠল, জ্ঞান ফিরেছে! জ্ঞান ফিরেছে!

দেখলাম আমি ফুটপাথে পড়ে আছি। চারপাশে গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ। আমার মুখ-চোখ মাথা জলে ভেজা। গায়ে মাথায় ব্যথা। বাঁ-হাতের কনুইয়ের কাছটা জ্বালা করছিল। ওপর ওপর তাকিয়ে জামা-প্যান্টে কোনও রক্তের দাগ খুঁজে পেলাম না।

বেশ কয়েকটা হাত আমাকে ধরাধরি করে দাঁড় করাল। অনেকে একসঙ্গে জিগ্যেস করল, খুব লেগেছে?, হাঁটতে পারবেন তো? ফিট না লাগলে বলুন এন. আর.এস-এ নিয়ে যাই।

হাত-পা নেড়েচেড়ে দেখলাম, সেরকম কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। মোটামুটি ঠিক আছি।

আশপাশ থেকে লোকজন তখনও মন্তব্য করছে, খুব লাকিলি বেঁচে গেছেন। আর একটু হলেই বাসের তলায় ঢুকে যেতেন–, ওরকম রিস্ক নিয়ে রাস্তা পার হন কেন? বাড়ি ফিরতে পারবেন তো? একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যান।

হ্যাঁ, একটা ট্যাক্সি ধরতে হবে। বাড়ি ফিরতে হবে।

ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, আমার সঙ্গে সবসময় যে-ফোলিও ব্যাগটা থাকে সেটা দেখতে পাচ্ছি না। ওটা খুঁজতে চারপাশে তাকালাম।

নোংরা ফুটপাথ, তার কোল ঘেঁষে আরও নোংরা নর্দমা। কিন্তু না, আমার ব্যাগটা কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।

তখনই আরও খেয়াল করলাম, বাঁ-হাতের কবজিতে বাঁধা স্টিল ব্যান্ডের রিস্টওয়াচটাও নেই। কেউ ওটা খুলে নিয়েছে।

ততক্ষণে চারপাশের লোকজনের ভিড় ফিকে হয়ে গেছে। যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আবার।

আমার মাথার বাঁ-দিকটা দপদপ করছিল। ভেজা চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমার জ্ঞান ফেরাতে কেউ হয়তো মাথায় মুখে জল ঢেলেছিল।

কিন্তু কতক্ষণ আমি অজ্ঞান হয়ে ছিলাম? বড়জোর পাঁচ মিনিট কি দশ মিনিট। তার মধ্যেই আমার ব্যাগটা হাতিয়ে নিয়ে কেউ চম্পট দিয়েছে!

তখনই মনে হল, বাড়িতে একটা ফোন করা দরকার।

কিন্তু কাকে? বাড়িতে কে কে আছে আমার?

আশ্চর্য! কিছু তো মনে পড়ছে না!

পাগলের মতো স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম। আমি কি বিয়ে করেছি? আমার কি ছেলেমেয়ে আছে? আমি কে? আমার নাম কী?

আমি হতবুদ্ধি হয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুই মনে পড়ছে না।

অস্থির মন ফুটন্ত দুধের মতো ছটফট করছিল। অসংখ্য প্রশ্ন কিন্তু কোনও উত্তর নেই।

নাঃ, কাউকে না কাউকে একটা ফোন করা দরকার। নিশ্চয়ই মোবাইল ফোনে আমার চেনা মানুষজনের অনেক ফোন নাম্বার আছে। দেখি তো!

পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল ফোনটা বের করতে গেলাম।

নেই।

মোবাইল ফোন নেই। ওয়ালেট নেই। এমনকী রুমালটা পর্যন্ত নেই।

সামান্য কয়েক মিনিট অজ্ঞান হয়ে ছিলাম, আর সেই ফাঁকেই সবকটা জিনিসের হাত পা গজিয়ে গেছে! কেউ ওদের চক্ষুদান করেছে।

আমি এখন কী করি!

না, ভয় পেলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা করে একটু ভাবতে হবে।

নোংরা ফুটপাথ ধরে আমি পা ফেলতে লাগলাম। একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগলাম।

ফুটপাথের ওপরে একটা ভাতের হোটেল, তার একপাশে তোলা উনুন জ্বলছে। তারপরই দুটো টেলারিং-এর দোকান, একটা পিচবোর্ডের বাক্স তৈরির কারখানা, একটা ওষুধের দোকান।

ওষুধের দোকানের পাশে একটা কোনাচে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বড়-বড় কয়েকটা শ্বাস নিলাম। মনে-মনে এক-দুই-তিন গুনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম। তারপর খুব খুঁটিয়ে ভাবতে শুরু করলমে।

আমার নাম মনে পড়ছে না। আমি কে তা জানি না। আমি কোথায় যাচ্ছিলাম সেটা মনে করতে পারছি না। আমি অফিস থেকে রওনা হয়েছি সেটা মনে আছে, কিন্তু অফিসটার নাম কী, সেটা কোথায় কিছু মনে নেই।

তা হলে বিজ্ঞানের ভাষায় যেটাকে অ্যামনেজিয়া বলে এটা তাই? বাসে মাথাটা ঠুকে গিয়ে কি এই কাণ্ডটা হয়েছে?

আমার কাছে কোনও টাকাপয়সা নেই, কোনও কাগজপত্র বা আইডেনটিটি প্রুফ নেই। আমি জামা-প্যান্ট পরা একজন ভদ্রলোক–এখন শুধু এইটুকুই আমার পরিচয়।

রাস্তায় প্রচুর লোকের চলাচল। তাদের দেখে আমার হিংসে হচ্ছিল। ওরা জানে নিজেদের পরিচয়। আর..আর ওদের পকেটে কম-বেশি পয়সা আছে।

মাথাটা দপদপ করছিল। আর তার সঙ্গে খিদেও পাচ্ছিল।

শেষ কখন খেয়েছি আমি? নিশ্চয়ই দুটো কি আড়াইটের সময় অফিসে টিফিন-ঠিফিন যা হোক খেয়েছি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবার পর মনে হল পুলিশের কাছেই যাই। আমার অদ্ভুত দুরবস্থার কথাটা খুলে বলি। আমার জায়গায় আপনি হলেও হয়তো ঠিক একই কাজ করতেন–পুলিশকে গিয়েই আপনার এই বিচিত্র সমস্যায় কথা বলতেন।

ওই তো, একজন ট্রাফিক পুলিশ চৌরাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ট্র্যাফিক কন্ট্রোল করছে। মনে পড়ল, ফুটপাথে শোওয়া অবস্থায় যখন আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল তখন আমি একজন ট্রাফিক পুলিশকে ভিড়ের মধ্যে দেখেছিলাম। দুজন একই লোক কি না কে জানে!

দোনামনা পা ফেলে আমি পুলিশটির দিকে এগিয়ে গেলাম।

কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পুলিশটি আড়চোখে আমার দিকে একবার তাকাল শুধু। তারপর হাত নেড়ে গাড়ি চলাচল ম্যানেজ করতে লাগল।

পুলিশটিকে দেখতে বেশ লম্বা-চওড়া। ভুড়ি নেই। গায়ের রং কালো, কিন্তু নাক-মুখ-চোখ সুন্দর–যেন পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য।

আ-আমি…আমি ভীষণ প্রবলেমে পড়েছি…।

পুলিশটি তেরছাভাবে আমাকে একবার দেখল ও কেন? কী প্রবলেম?

প্রশ্ন দুটো করেই আবার হাত নেড়ে ছুটন্ত গাড়ির তদারকিতে মন দিল।

আ-আমি..সবকিছু ভুলে গেছি…।

পুলিশ এবার চমকে উঠল । অ্যাঁ! কী বললেন?

আমার কিছুই মনে পড়ছে না। সবকিছু হঠাৎ ভুলে গেছি।

আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে আমাকে খুঁটিয়ে দেখল।

সব ভুলে গেছেন মানে? আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার ট্র্যাফিক ম্যানেজ করার কাজে ঢুকে গেল। আমাকে ভুলে গেল কি না কে জানে!

আমি ওর আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। বেশ কাতর গলায় বললাম, প্লিজ, আমার কথাটা একবার শুনুন। প্লিজ।

আবার আমার দিকে তাকাল। আচমকা একটা হাই তুলল।

দেখুন, আধঘণ্টা মতন আগে একটা বাসের সঙ্গে আমার ধাক্কা লেগেছে। ওই যে–ওই জায়গাটায় জায়গাটা আঙুল তুলে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ও মাথায় সামান্য চোট পেয়েছি। কিন্তু তারপর থেকে আমার আর কিছু মনে পড়ছে না। আমি কে, কোথায় আমার বাড়ি, আমার বাড়িতে কে-কে আছে কিচ্ছু না। বিশ্বাস করুন, আমি সব ভুলে গেছি।

চোখে অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল পুলিশটি। তার সঙ্গে খানিকটা বিস্ময় মেশানো ছিল–যেন কোনও আজব প্রাণী দেখছে। একইসঙ্গে আমার ধুলো-ময়লা লাগা ব্র্যান্ডেড শার্ট-প্যান্ট জরিপ করল।

আমি তাতে আরও মরিয়া হয়ে পুলিশ-ভদ্রলোককে বোঝাতে চেষ্টা করলাম : প্লিজ, আমাকে একটু হেল্প করুন। আমি এখন কী করব বুঝতে পারছি না…।

সব বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো এখন ডিউটিতে…পুলিশটি ভদ্র গলায় বলল, আপনি বরং থানায় গিয়ে কথা বলুন…।

থানায় যাব? তারপর? ওরা আমাকে কীভাবে সাহায্য করবে? আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করবে না। আর যদি বিশ্বাস করে তা হলে হয়তো কোনও মেন্টাল হসপিটাল কি পাগলখানায় আমাকে চালান করে দেবে।

আমাকে ইতস্তত করতে দেখে পুলিশটি বোধহয় আমার সমস্যা বুঝতে পারল। একটু সহানুভূতির গলায় বলল, আপনি এক কাজ করুন। কোথাও একটু বসে চুপচাপ বিশ্রাম নিন। দেখবেন, হয়তো ঘণ্টাখানেক কি ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে সব মনে পড়ে যাবে।

এরপর আর কিছু করার নেই। লজ্জা আর সঙ্কোচে পুলিশটিকে আমি বলতে পারলাম না যে, আমার খিদে পাচ্ছে এবং আমার পকেটে একটি পয়সাও নেই।

আমার ফুটপাথে ফিরে এলাম। কোথাও চুপচাপ বসে একটু অপেক্ষাই না হয় করি। কে বলতে পারে, যেমন হুট করে আমার মেমারি লস হয়েছে হয়তো তেমন হুট করেই আবার সব স্মৃতি ফিরে আসবে।

কিন্তু এল না। পুরো একঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট আমি একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়ির ধাপে বসে কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু কোনও স্মৃতিই ফিরে এল না। শুধু একটা কচি ছেলের গলায় বার তিনেক বাপি ডাকটা মনে-মনে শুনতে পেলাম। আর একটা দশ-বারো বছরের মেয়ের গলায় বাপি ডাকটা মনের মধ্যে বারকয়েক ধাক্কা মারল।

আমার কি তা হলে ছেলে-মেয়ে আছে? বাড়িতে বউও আছে? ওরা নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা নিয়ে আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় হাঁ করে বসে আছে। আরও ঘণ্টা দুই কি তিন দেখে তারপর পুলিশ হাসপাতাল করব। তারপর আরও এক-দু-দিন কেটে যাওয়ার পর পুলিশ হয়তো আমার খোঁজ পাবে। কিন্তু কী অবস্থায় পাবে কে জানে!

পথচারী লোকদের দাদা, কটা বাজে? জিগ্যেস করে আমি সময়ের খবর রাখছিলাম। পৌনে দু-ঘণ্টা কেটে যেতেই ব্যাপারটা অসহ্য হয়ে উঠল। ধৈর্যের বাঁধ-ভেঙে তো গেলই, উপরন্তু খিদের চাপটা বেপরোয়া চেহারা নিল।

পেটে অসহ্য কষ্ট। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার। খাবারের দোকান-টোকান বা রাস্তায়-হেঁটে চলা লোকজনকে কিছু খেতে দেখলেই প্রাণটা হ্যাংলার মতো দশহাত জিভ বের করে দোলাচ্ছে, হু-হু করছে।

বেশ কয়েকবার সিঁড়ির ধাপ ছেড়ে উঠে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে আঁজলা ভরে জল খেয়ে এলাম। কিন্তু জল তো জল! সে কি আর পেটে থাকে!

নাঃ, যদি আমার বউ ছেলে-মেয়ে থাকে, যদি তারা পুলিশে খবর দেয়, তা হলে আগামীকাল পুলিশ নির্ঘাত আমার ডেডবডি খুঁজে পাবে। খিদের যে এত জ্বালা আমি আগে কখনও বুঝিনি।

শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে আবার ওই ট্রাফিক পুলিশটার কাছে গেলাম।

আমাকে দেখেই সে চিনতে পারল। বলল, কী ব্যাপার? এখনও বাড়ি যাননি?

আমি কাতর গলায় বললাম, কী করে যাব! আমার যে কিছুই মনে পড়ছে ন। বিশ্বাস করুন।

নির্বিকার মুখে সে বলল, আমার তো কিছুই করার নেই–আপনি বরং থানায় যান…।

থানায়? আবার সেই গোরু রচনা!

আর কিছু ভাবার আগেই অসহ্য খিদেয় আমার পেট মুচড়ে উঠল। আর থাকতে পারলাম না। ডানহাতটা পুলিশটার দিকে বাড়িয়ে একেবারে রাস্তার ভিখিরি হয়ে গেলাম : স্যার, আমাকে দশটা টাকা দেবেন? তখন থেকে না খেয়ে আছি। আর সইতে পারছি না…।

পুলিশটার চোখ ছোট হয়ে গেল। সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল দুবার। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, হুঁ, বুঝেছি। গালে কয়েকবার আঙুল ঘষল লোকটা। ওর ডানহাতটা প্যান্টের পকেটে ঢুকে গেল। যখন হাতটা বেরিয়ে এল তখন আঙুলে ধরা পঞ্চাশ পয়সার একটা কয়েন : এটা রাখো। ডিউটির সময় আমাদের কাছে টাকাপয়সা থাকে না, জানোই তো!

আপনি থেকে তুমি-তে নেমে এসেছে পুলিশটা। এখন ওর চোখে আমি পাতি ভিখিরি।

আমি পঞ্চাশ পয়সার কয়েনটা নিলাম। অপমানে কান থেকে যেন আগুনের হলকা বেরোচ্ছিল।

আমার মনে হচ্ছিল, এই কাজগুলো আমি নয়, আমার মতো দেখতে অন্য একটা লোক করছে। সেই লোকটা একটা সাধারণ ট্রাফিক কনস্টেবলকে স্যার বলছে, তার কাছে ভিক্ষে চাইছে, পঞ্চাশ পয়সা ভিক্ষে হাত পেতে নিচ্ছে, তারপর লজ্জা আর গ্লানিতে মাথা ঝুঁকিয়ে চলে যাচ্ছে ফুটপাথের কোণের একটা ছোট্ট স্টেশনারি দোকানে, পঞ্চাশ পয়সায় দুটো সাধারণ বিস্কুট কিনে রাক্ষসের মতো কপকপ করে কামড়াচ্ছে, চিবোচ্ছে, এবং গিলছে।

আমার চোখে জল এসে গেল। সেই অবস্থাতেই রাস্তার ধারে বসানো কল থেকে পেট ভরে জল খেলাম। আঃ, কিছুক্ষণের জন্যে শান্তি।

কিন্তু তারপর? কোথায় যাব? কী করব? জানি না, মাথায় কিছু খেলছে না।

আধঘণ্টা যেতে না যেতেই পেটের মধ্যে আবার খিদের মোচড় শুরু হল। এবার তার চরিত্র আরও ভয়ংকর, পাগলের মতো ক্ষিপ্ত আর হিংস্র।

আমি ট্র্যাফিক পুলিশটার চোখ এড়াতে অন্যদিকে হাঁটা দিলাম।

রাত ক্রমশ বাড়ছিল। আমি যেদিকে হাঁটতে শুরু করেছি সেদিকটা বেশ নির্জন আর অন্ধকার। রাস্তায় তেমন দোকানপাট নেই। লাইটপোস্টের বাতিগুলো মলিন–টিমটিম করে জ্বলছে।

আর একইসঙ্গে আমার মাথার ভেতরে খিদের আগুন লকলক করে জ্বলছে।

ঢং ঢং করে ট্রামের ঘন্টি কানে এল। বাঁ-দিকে একটা ট্রাম ডিপো। সেখান থেকে একটা ট্রাম বেরোচ্ছে।

একটা লোক ট্রামটার সামনে দিয়ে চট করে লাইন পেরিয়ে আমার কাছাকাছি চলে এল। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না।

দাদা, প্লিজ, একটা কথা শুনবেন?

কী? লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে জড়ানো গলায় উত্তর দিল। টের পেলাম ওর মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। আর জামাকাপড় বেশ ময়লা এবং মামুলি। দেখে অভাবী বলেই মনে হচ্ছে।

আমাকে দশটা টাকা দেবেন? আমার…আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।

দশ টাকা! এক টাকা দু-টাকায় হবে না! লোকটা চোখ কপালে তুলে কথাগুলো বলল। তারপর আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখল ও চেহারা দেখে তো বেশ বড়লোক টরলোক মনে হচ্ছে! হঠাৎ ভিক্ষের লাইন ধরলে কেন, ওস্তাদ?

আমি আমার অদ্ভুত দুর্ঘটনার কথা বললাম। বললাম যে, আমি সবকিছু ভুলে গেছি, আমার সর্বস্ব খোয়া গেছে, আর অসহ্য খিদেয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

ভুরু কপালে তুলল লোকটা। শব্দ করে একটা সেঁকুর তুলল। মদের গন্ধের ঝাপটা ছিটকে এল আমার নাকে। গা গুলিয়ে উঠল।

লোকটা জড়ানা উচ্চারণে বলল, স্টোরিলাইনটা দারুণ কেঁদেছ, ওস্তাদ। মাশাআল্লা! ফিলিম লাইনে গেলে তোমার তরক্কি ঠেকায় কোন শালা! কিন্তু গুরু, আমার পকেট তো ফাঁকা। একেবারে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড। সরি, গুরু…।

কথাগুলো বলতে-বলতে লোকটা হাঁটা দিল। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে আমাকে হাত নেড়ে টা-টা করল।

আমি ডানহাতের চেটোটা মুখের ভেতরে পুরে দিয়ে হালকা কামড় বসালাম। ব্যথা লাগছে।

আচ্ছা, এই ব্যথাটা যদি কষ্ট করে সহ্য করতে পারি তা হলে নিজের একটা আঙুলের ডগা কি চিবিয়ে খেয়ে ফেলা যায়?

নাঃ, এটা ভাবা সহজ, কিন্তু কাজে করা কঠিন।

আমি পাগলের দৃষ্টিতে এপাশ-ওপাশ তাকালাম। একটু দূরেই চোখে পড়ল আবর্জনার স্তূপ। ওর মধ্যে ঘাঁটাঘাঁটি করলে কি কোনও এঁটো খাবারের টুকরো পাওয়া যাবে?

ব্যাপারটা ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে উঠল। আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এই আবর্জনা থেকে খাবার খুঁটে খাব আমি? আমি!

হাঁটতে-হাঁটতে আরও খানিকটা পথ পেরিয়ে গেছি। হঠাৎই চোখে পড়ল একটা রাস্তা বাঁ দিকে ঢুকে গেছে। নির্জন ফাঁকা রাস্তা। এখানে-সেখানে লাইটপোস্টের আলো ছিটকে পড়েছে। রাস্তার মাঝে দুটো নেড়ি কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে।

কিন্তু দুরে দুটো ছায়াকে দেখা যাচ্ছে না? এদিকেই এগিয়ে আসছে!

আমি বাঁ-দিকের রাস্তাটায় ঢুকে পড়ে ফুটপাথে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওরা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।

আমার ভয়ংকর খিদে আমাকে দিয়ে নানান বাজে চিন্তা করাচ্ছিল। আর সেই চিন্তাগুলোর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল আমার বিবেক। আমাকে বারবার বোঝাচ্ছিল, আমি একজন ভদ্রলোক, এই শহরের একজন আইন-মেনে-চলা নাগরিক, আমার হয়তো বউ আছে, ছেলে-মেয়েও আছে–শুধু দোষের মধ্যে আমার স্মৃতি মুছে গেছে। কিন্তু তা হলেও আমি একজন ভদ্রলোক–এবং ভদ্রলোকই থাকতে চাই।

বেশ বুঝতে পারছিলাম, লড়াইয়ে বিবেক ক্রমশ কাবু হয়ে পড়ছিল। আর নিঃশব্দ চিৎকারে বাঁচাও! বাঁচাও! বলছিল বারবার।

ওরা খুব কাছে এসে পড়তেই আমি ফুটপাথ থেকে নেমে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। বয়েস আটাশ থেকে তিরিশের মধ্যে। বোধহয় প্রেমিক প্রেমিকা।

ছেলেটার চোখে চশমা, লম্বা, রোগা, তবে মেয়েটা যৌবনময়। পরনে ছাপা চুড়িদার।

আমাকে আচমকা মুখোমুখি আবিষ্কার করে ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল। চশমার কাচের পেছনে ওর চোখ বড়-বড় হল।

মেয়েটা ছেলেটার গায়ে লেপটে গিয়ে ওর হাতের ডানা আঁকড়ে ধরল।

আমি ওদের আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, প্লিজ, ভয় পাবেন না। আমাকে কিছু টাকা দিতে পারেন? দশ-বিশ টাকা হলেও চলবে…।

আমার চোখে ওরা কী দেখল কে জানে! মেয়েটা হাউমাউ করে চিল-চিৎকার শুরু করল। আর ছেলেটা পাগলের মতো ছুট লাগাল বড় রাস্তার দিকে।

আমি কী করব ভেবে না পেয়ে তাড়াতাড়ি পা চালালাম। এই রাস্তাটা কোনদিকে গেছে কে জানে!

পেছন থেকে মেয়েটার চিৎকার শুনতে পেলাম, ওই যে, পালিয়ে যাচ্ছে! ভদ্রভাষায় টাকা ছিনতাই করতে এসেছে।

পেছন ফিরে দেখি কুঁজো হয়ে দাঁড়ানো একটা মোটা মতন লোক মেয়েটার কাছে দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনছে।

আমি ভয় পেলাম। আর দেরি না করে ছুট লাগালাম।

অচেনা রাস্তায় ছোটাছুটি করে এ-গলি সে-গলি করে একটা নির্জন রাস্তায় এসে ফুটপাথে বসে পড়লাম। ফোঁস-ফোঁস করে নিশ্বাস পড়ছে, বুকটা হাপরের মতো ওঠা-নামা করছে। আর পেট? পেট হিংস্র বাঘের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছে আর ঘাঁও! ঘাঁও! করে গর্জন করছে।

আমার কান্না পেয়ে গেল। এখন আমি কী করি! কী করলে আমি দু-মুঠো খেতে পাব?

কাঁদতে কাঁদতেই এপাশ-ওপাশ তাকালাম।

রাত হয়তো এগারোটা পেরিয়ে গেছে। রাস্তায় হাতে গোনা লোক। আমি ওদের দিকে ঈর্ষাতুর চোখে চেয়ে আছি। ওদের পকেটে পয়সা আছে। ইচ্ছে করলেই ওরা কিছু কিনে খেতে পারে। আমার অসহায় অবস্থার কথা ওরা কেউ ভাবছে না।

একসময় চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালাম। পেটের হিংস্র বাঘটা এখন সারা শরীরে চারিয়ে যাচ্ছিল। খিদের যন্ত্রণা যে এত মারাত্মক হতে পারে তা আমি কোনওদিন কল্পনা করিনি। অসহ্য যন্ত্রণা। পেটটা যেন কেউ কষে নিংড়ে দিচ্ছে। ওঃ!

বিশ্বাস করুন, এ যন্ত্রণা আপনিও সহ্য করতে পারতেন না।

কী করব? জল খাব পেট পুরে? পাতি জল?

কিন্তু তারপরও এখনও সারাটা রাত আমার সামনে পড়ে রয়েছে। সারাটা রাত! ওই হিংস্র বাঘটা তো একটু পরেই আবার ফিরে আসবে।

আপনি এরকম সাংঘাতিক অবস্থায় পড়লে কী করতেন বলুন তো!

হঠাৎই ফুটপাথটার দিকে চোখ গেল আমার। ফুটপাথটা নতুন করে সারানো হচ্ছে। বালির ওপরে বসানো হচ্ছে কংক্রিটের ছোট-ছোট স্ল্যাব। একপাশে কয়েকশো স্ল্যাব থাক দিয়ে সাজানো রয়েছে। আগামীকাল ওগুলো কাজে লাগানো হবে।

আমার জায়গায় আপনি থাকলে যা করতেন আমি ঠিক তাই করলাম। ঝুঁকে পড়ে একটা কংক্রিটের স্ল্যাব হাতে তুলে নিলাম। শক্ত মুঠোয় ওটা আঁকড়ে ধরে একটা লাইটপোস্টের পাশে শরীরটা আড়াল করে দাঁড়ালাম। বারদুয়েক হাত দুলিয়ে স্ল্যাবটার ওজন পরখ করলাম। যথেষ্ট ভারী।

তারপর অপেক্ষা করতে লাগলাম।

একটু পরেই টের পেলাম, খিদের বাঘটা আবার দাপাদাপি করছে। চাপা তর্জন-গর্জন শুরু করে দিয়েছে।

এই রাস্তাটা নির্জন হলেও কেউ না কেউ এ-পথে হেঁটে আসবে। হয় এখনই, নইলে কিছুক্ষণ পর।

লোকটা কাছাকাছি এলেই লাইটপোস্টের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা এই ভুখা মানুষটা আচমকা সেই লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তারপর সমস্ত নীতিকথা ভুলে কংক্রিটের স্ল্যাবটা উঁচিয়ে ধরবে শূন্যে। এবং প্রবল গতিশক্তিতে সেটা আছড়ে দেবে সেই পথচারীর মাথায়। নিরীহ মানুষটা হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে, নয়তো মরেই যাবে। তারপর তার পকেট হাতড়ে…।

ওই তো, দূরে একটা লোক হেঁটে আসছে–একা!

ঠিক কতটা জোরে মাথায় মারলে ওই লোকটা অজ্ঞান হতে পারে আমি জানি না। লোকটা হয়তো মরেও যেতে পারে। কারণ, কংক্রিটের এই স্ল্যাবটা অস্ত্র হিসেবে মারাত্মক। আর এরকম অস্ত্র ব্যবহার করার কোনওরকম অভিজ্ঞতা আমার নেই।

বেশ বুঝতে পারছি, ঈশ্বর চাইছেন, এই সময় একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা এই রাস্তায় ঘটে যাক। কিন্তু তাই বলে একটা সম্পূর্ণ অচেনা নিরীহ লোক এভাবে প্রাণ দেবে?

আমার মনে দোলাচল শুরু হল। আমি কি ঠিক করছি?

একবার মনে হল, ঠিক করছি। এটা একজন ভুখা মানুষের লড়াই। কিন্তু তারপরই মনে হল, না, এটা ঠিক নয়–এটা পাপ।

আপনি হলে কী করতেন বলুন তো?

তাড়াতাড়ি বলুন। লোকটা কাছে এসে গেছে।

আমি কংক্রিটের স্ল্যাবটা মরিয়া ঢঙে আঁকড়ে ধরলাম। তারপর…।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress