শিলিগুড়ি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে
শিলিগুড়ি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে অর্জুন যখন বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছল, তখন প্লেনের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু পৌঁছে শুনল, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট দেরিতে আসছে, হাতে অনেকখানি সময়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে।
আজ সকাল থেকেই টেনশন শুরু। গতকাল মোটর সাইকেলটা বিগড়ে ছিল। গ্যারাজ থেকে বলল, আজ বিকেলের আগে দেবে না। অর্জুন ঠিক করেছিল, সারাদিন বাড়িতেই কাটাবে। কাকাবাবু সমগ্র হাতে এসেছে, ওটা পড়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু সকালবেলায় আচমকা অমল সোমের চিঠি এল। এই চিঠিটি বেশ কিছুদিন পরে এল। অমলদা এখন আর জলপাইগুড়িতে থাকেন না। কোথায় থাকেন তা কাউকে জানান না। জলপাইগুড়ির বাড়ি দেখাশোনা করে তাঁর প্রতিবন্ধী ভৃত্য। মাঝে-মাঝে অর্জুন খোঁজখবর নিয়ে আসে।
অমল সোমই অর্জুনের সত্যসন্ধানে দীক্ষাগুরু। বিয়ে-থা করেননি। ইদানীং তিনি সত্যসন্ধানের চেয়ে অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়েছেন। কেউ বলে সন্ন্যাসী হয়েছেন। মাঝে-মাঝে তাঁর চিঠি পায় অর্জুন। তিনি কোথায় আছেন, এক জায়গায় আছেন কিনা তা অর্জুনের জানা নেই। চিঠির উত্তর দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
আজকের চিঠিটা বিদেশ থেকে। অর্জুন অমল সোমের পরিচিত হাতের লেখা দেখতে পেয়েছিল, স্নেহভাজনেষু, আশা করি ভাল আছ। বিশেষ প্রয়োজনে এই চিঠি লিখছি। কয়েকটি জরুরি কাজে লন্ডনে আছি। এখানে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। মেয়েটির নাম ডরোথি ম্যাকড়োনান্ড। তার পূর্বপুরুষ এক সময় ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। সেই জন্য তাঁকে ভারতবর্ষে থাকতে হয়েছিল। ভদ্রলোক জলপাইগুড়ি শহরে ছিলেন বেশ কিছুকাল। মেয়েটি তার পূর্বপুরুষের কর্মক্ষেত্র দেখতে আগ্রহী। আগামী চোদ্দই অগাস্ট সে কলকাতা হয়ে বাগডোগরায় পৌঁছবে। তুমি তাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করে দেখাবার ব্যবস্থা কোরো।
তোমার কাজকর্ম নিশ্চয়ই ভাল চলছে। আবেগে তাড়িত হয়ো না, ক্ষুদ্র ঘটনাও যুক্তি দিয়ে বিচার কোরো। শুভেচ্ছা জেনো।–অমল সোম।
চিঠিটা পড়ার পর হাতে সময় ছিল না। অমল সোমের অনুরোধ আদেশের চেয়ে অনেক বেশি অর্জুনের কাছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, ডরোথি ম্যাকডোনাল্ড জলপাইগুড়িতে এসে কোথায় থাকবে? এখানে ভাল হোটেল তেমন নেই। কদমতলায় একটি সাধারণ হোটেল আছে, এ ছাড়া সরকারি তিস্তা ভবন। বরং শিলিগুড়িতে অনেক ভাল ব্যবস্থা এবং সেখানে থাকাই ওঁব পক্ষে সুবিধেজনক।
বাইক নেই, দেড় ঘন্টার রাস্তা কোনও মতে ডিঙিয়ে যখন সে এয়ারপোর্টে পৌছাল তখন বাইরে চড়া রোদ, প্লেন আসেনি। বাগডোগরা এয়ারপোর্টটা বেশ ছোট। যাত্রীদের অপেক্ষা করার জায়গাটা এখন গমগম করছে। যে প্লেনটি আসছে, তাতেই এঁরা কলকাতায় যাবেন। অর্জুন লক্ষ করেছে, ট্রেনে ওঠার আগে যাত্রীদের মুখের হাবভাব দেখে তেমন কিছু মনে হয় না, কিন্তু প্লেনে ওঠার আগে একটা আলাদা চেহারা ধরা পড়ে। একটু যেন কৃত্রিম আর সেটা নিজেকে মূল্যবান মনে করার চেষ্টায় কি না জানা নেই।
প্লেন নামল। ছোট প্লেন, যাত্রীর সংখ্যা তাই অল্প। সিঁড়ি দিয়ে যারা নেমে এল, তাদের মধ্যে একমাত্র বিদেশিনীকে চিনতে অসুবিধে হল না। মেমসাহেবদের বয়স বোঝা বেশ মুশকিল। অর্জুন আন্দাজ করল ইনি তিরিশের নীচেই হবেন।
ফেন্সিং পেরিয়ে ভদ্রমহিলা বেশ নার্ভাস ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাতে অর্জুনের মনে হল, ওর বয়স বাইশেব বেশি হতেই পারে না। চোখের মণি নীল, সোনালি চুল, পরনে নীল স্কার্ট আর সাদা জামা। অনেকটা স্কুল-ইউনিফর্মের মতো। হাতে একটা সুন্দর ব্যাগ। ওকে সবাই লক্ষ করছে এটা দেখতে পেয়ে অর্জুন এগিয়ে গেল, এক্সকিউজ মি।
মহিলা মুখ ফেরাতেই অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি ডরোথি ম্যাকডোনাল্ড?
সঙ্গে সঙ্গে হাসি ফুটল। খুব মিষ্টি হাসি। আর সেই হাসি দেখে অর্জুনের মনে পড়ল সাউন্ড অব মিউজিকের জুলি ক্রিস্টির কথা। এর সঙ্গে প্রচণ্ড মিল সেই অভিনেত্রীর।
ডরোথি মাথা নেড়ে ইংরেজিতে বলল, হ্যাঁ। আমি ডরোথি। তুমি অর্জুন?
নিজেকে অর্জুন ভাবতে ভাল না লাগলেও সে মাথা নাড়ল।
তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে। আমি একটু নার্ভাস টাইপের। ভাবছিলাম তুমি না এলে আমি কী করব। অবশ্য মিস্টার সোম তোমার ব্যাপারে আমাকে অনেক ভরসা দিয়েছেন।
অর্জুন হাসল, উনি আমাকে বেশি স্নেহ করেন।
ডরোথি মাথা নাড়ল, না। ওঁর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে ওসব ব্যাপার ওঁর তেমন নেই। উনি খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ।
অমলদা ডরোথিকে কী বলেছেন জানা নেই, অতএব এ-বিষয়ে কথা বাড়াল অর্জুন। সে হাত বাড়িয়ে হাতব্যাগটা চাইতেই ডরোথি মাথা নাড়ল, না,। এটা আমি নিজেই বইতে পারব। মুশকিল হচ্ছে আমার সুটকেস নিয়ে। ওটা খুব ভারী।
অর্জুন দেখল প্লেনের পেট থেকে মালপত্র নামিয়ে আনছে কর্মীরা। সেটাকে হস্তগত করতে এগিয়ে গেল সে। ডরোথি যে ইতিমধ্যে পাবলিকের দ্রষ্টব্য বিষয় হয়ে গেছে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সবাই হাঁ করে দেখছে মেয়েটাকে। অর্জুন খানিকটা দূর থেকে ডরোথিকে দেখল সাগ্রহে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে এখন। মানুষজনের চাহনিকে কোনও গ্রাহ্য করছে না। আমেরিকানদের মতো ডরোথি লম্বা নয়। গায়ের রঙে ক্যাটকেটে ভাব নেই। বরং মোলায়েম গমের মতো চামড়ার রঙ। চোখাচোখি হতে ডরোথি হাসল। হাসলে যে ওকে খুব সুন্দর দেখায় তা নিশ্চয়ই ওর জানা। সুটকেসটা সত্যি খুব ভারী। বাইরে বের করে ট্যাক্সিতে ওঠাতে গিয়ে মনে হল কাঁধ থেকে হাতটা ছিড়ে যাবে। শিলিগুড়ির ট্যাক্সির মিটার থাকে না, রঙ আলাদা করে তাদের চেনানোর ব্যবস্থা নেই। পেছনের আসনে বসে ডরোথি জিজ্ঞাসা করল, তুমি নিজে গাড়ি চালাও না?
প্রথমে বুঝতে পারেনি অর্জুন। তার নিজস্ব গাড়ি নেই। মোটরবাইকেই চমৎকার চলে যায়। সম্প্রতি এক বন্ধুর গাড়ি নিয়ে ট্রায়াল দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করেছে সে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ডরোথি বলল, ইণ্ডিয়ায় দেখছি ড্রাইভাররাই গাড়ি চালায়, মালিক নিজে স্টিয়ারিং-এ বসে না।
অর্জুন হাসল, তুমি ভুল করছ। এটা একটা ট্যাক্সি। আমার গাড়ি নেই।
ট্যাক্সি? অদ্ভুত! লোকে কী করে বুঝবে কোনটা ট্যাক্সি, কোনটা নয়।
অর্জুন মনে-মনে বলল, অবাক হওয়ার অনেক কিছু চারদিকে ছড়িয়ে আছে মেয়ে। আমাদের অনেক কিছুই অদ্ভুত! আগে প্রাইভেট গাড়ির নাম্বার প্লেটের শেষে ওয়াই থাকলে আমরা বুঝতাম ওটা ভাড়া খাটে, আজকাল আর সে-নিয়ম মানা হয় না। একজন বিদেশি এদেশে এলে এত অসঙ্গতি বের করতে পারে, যাতে অভ্যস্ত হয়ে আছি বলে আমাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এয়ারফোর্সের এলাকা দিয়ে ট্যাক্সিটা যাচ্ছিল। ইউনিফর্ম-পরা সৈনিকরা সাইকেলে চেপে যাওয়া-আসা করছে। উবোথি জিজ্ঞেস করল, এটা কি সামরিক জায়গা?
অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
ওরা তোমাদের এই রাস্তা ব্যবহার করতে দিচ্ছে কেন?
এয়ারপোর্টে যাওয়া-আসার আর কোনও রাস্তা নেই বলে।
অদ্ভুত!
অর্জুন হাসল। ইংরেজি বলতে তার তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। আর ডরোথির উচ্চারণ খুব স্পষ্ট বলে কথা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। ওর মনে পড়ল লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে গিয়ে ইংরেজি ভাষা বুঝতে সে এক সময় কী রকম হিমশিম খেয়েছিল!
অমলদার চিঠি আমি আজ সকালে পেয়েছি।
অমলদা কে?
যিনি তোমাকে আমার কথা বলেছেন। ওঁর পুরো নাম অমল সোম।
আচ্ছা! কিন্তু তুমি বললে অমলদা?
বয়স্কদের আমরা নামের সঙ্গে দাদা বলি। সেটা সংক্ষেপে অমলদা হয়েছে।
ডরোথি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল।
অর্জুন বলল, উনি লিখেছেন তোমার পূর্বপুরুষ এদিকে চাকরি করতেন।
হ্যাঁ। আমার ঠাকুরদা। উনি ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। অনেক জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত বাংলার উত্তর প্রান্তে দীর্ঘকাল চাকরি করেন। ওঁর লেখা একটা ডায়েরি আমি হঠাৎ পাই। তা থেকে ব্যাপারটা জানতে পারি।
উনি কি এখনও বেঁচে আছেন?
না। বেঁচে থাকলে ওঁর বয়স ছিয়াশি হত। কথা বলতে বলতে হাতব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট ডায়েরি বের করে ডরোথি পাতা ওলটাল। ট্যাক্সি এখন বাগডোগরা বাজার পেরিয়ে শিলিগুড়ির দিকে ছুটছে।
এখানে আমি কিছু নোট করে নিয়েছি। জলপাইগুড়ি কত দূরে?
এই ট্যাক্সি নিয়ে সোজা গেলে এক ঘন্টার মতো পড়বে।
মিস্টার সেন বলেছিলেন তুমি সেখানেই থাকো।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন।
আমরা তো জলপাইগারিতে যাচ্ছি?
নামটা জলপাইগারি নয়, উচ্চারণ হবে জলপাইগুড়ি। হ্যাঁ, আমরা যেতে পারি, কিন্তু মুশকিল তোমার থাকার জন্য ভাল হোটেল ওখানে নেই। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে শিলিগুড়ির হোটেলে থাকতে বলব।
শিলিগুড়ি। হ্যাঁ, এই নামটা আছে, তবে খুব ইম্পর্ট্যান্ট নয়।
তোমার ঠাকুরদার সময় শিলিগুড়ির কোনও ভূমিকা ছিল না, কিন্তু এখন কলকাতার পরেই শিলিগুড়ি মূল্যবান শহর।
কোনও গেস্ট হাউস নেই জলপাইগুড়িতে?
চলো দেখি।
ঠাকুরদা ওখানকার সার্কিট হাউসের খুব প্রশংসা করেছিলেন।
অর্জুন কিছু বলল না। অর্ধ শতাব্দী আগে জলপাইগুড়ি যা ছিল এখন তা নেই। কোণঠাসা হয়ে-হয়ে শহরটা কোনও মতে ধুকছে। তিস্তা ভবনে নিয়ে যেতে হবে ডরোথিকে। জায়গা পাওয়া গেলে ভাল। সে ডরোথির দিকে তাকাল। ডরোথি জানলা দিয়ে চায়ের বাগান দেখছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত। ওর ঠাকুরদার কর্মস্থল ছিল এদিকে। ভদ্রলোক নেই। তাঁর ডায়েরি পড়ে ওর মনে হল জায়গাটা দেখে আসা দরকার আর অমনই চলে এল? এই আসার জন্য প্রচুর টাকা এবং সময় খরচ হয়েছে এবং তাতে ভূক্ষেপ নেই। ওরা মাঝে-মাঝে এমন কাণ্ড করে! যে-লোকটা প্রথম পাহাড়ে ওঠার কথা ভেবেছিল তাকেও তো লোকে অবাক চোখে দেখেছিল। আমরা বলি ইউরোপ এবং আমেরিকার মানুষ খুব প্র্যাকটিক্যাল। তারা অপ্রয়োজনীয় কোনও কাজ করে না। কিন্তু যে মানুষ ইংলিশ চ্যানেল পার হয়, নায়েগ্রার ওপর থেকে লাফিয়ে রেকর্ড করতে চায় জীবনের বিনিময়ে, তারা কতখানি প্র্যাকটিক্যাল? সেদিক দিয়ে আমরা তো এতকাল ঝুঁকি এড়িয়ে ঘরে বসে থাকতে পছন্দ করে এসেছি।
ট্যাক্সি শিলিগুড়ি শহরে ঢুকল অর্জুন অনুরোধ করায়। ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। তাকে নাকি জলপাইগুড়ি থেকে খালি ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে আসতে হবে, সেটা পোষাবে না। অর্জুন অন্য সময় হলে তর্ক করত। কদমতলার বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ালেই লোকটা শিলিগুড়ির যাত্রী প্রচুর পাবে এটা জানা কথা। ডরোথির জন্যই সে কিছুটা বাড়তি টাকা দিতে রাজি হল।
তোমাদের এখানকার শহরগুলো তৈরির সময় কোনও পরিকল্পনা ছিল?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না।
কেন?
ব্রিটিশরা আমাদের এইভাবেই অভ্যস্ত করেছিল।
অর্জুনের উত্তর শোনামাত্র ডরোথি অবাক হয়ে তাকাল, তোমাদের দেশে এখনও আমার পূর্বপুরুষদের প্রভাব আছে?
ব্রিটিশদের তৈরি অনেক ভাল জিনিস নিয়ে আমরা যেমন এখনও গর্ব করি, তেমনই ওদের কীর্তির জন্যে কোনও-কোনও ক্ষেত্রে আমাদের দাম দিতে হয়।
তোমার কথার মানে আমি বুঝতে পারলাম না।
তোমার পূর্বপুরুষরা এ-দেশটাকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এখান থেকে যা কিছু ভাল তা দেশে নিয়ে যেত তারা। আর নিজেরা থাকত বলে কোনও মতে বসবাসের যোগ্য করে রেখেছিল। আমাদের কথা তারা কখনওই ভাবেনি। তবে কোনও-কোনও ব্রিটিশ মানুষ হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। তাঁদের কথা আমি বলছি না।
ডরোথি সোজা হয়ে বলল। গাড়ি তখন শিলিগুড়ি ছাড়িয়েছে। ডরোথি বলল, আমার পূর্বপুরুষ তোমাদের এখানে সরকারি চাকরি করতে এসেছিলেন আর আমি এত কাল পরে তাঁর কর্মক্ষেত্র দেখার জন্যে ছুটে এসেছি একথা নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাস করনি?
আমি অবাক হয়েছি।
তা হলে সত্যি কথা বলছি। কারণ তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন।
অর্জুন তাকাল।
ডরোথি বলল, আমি এসেছি প্রায়শ্চিত্ত করতে।
কিসের প্রায়শ্চিত্ত?
আমার পিতামহ যে অন্যায় করেছেন, যার জন্যে তিনি শেষজীবনে অনুতাপে দগ্ধ হয়েছেন সেই কারণেই আমি এখানে এসেছি। উনি সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। তাঁকে লন্ডন, দিল্লি, কলকাতার আদেশ মান্য করতে হত। তখন তোমাদের দেশের কিছু মানুষ স্বাধীনতা পাওয়ার জন্যে আন্দোলন করছিল। সেই আন্দোলনকে দমন করার দায়িত্ব ছিল ঠাকুরদার ওপর। জলপাইগুড়িতে থাকার সময় ঠাকুরদা প্রতিদিনের ঘটনা তাঁর ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। কীভাবে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরতেন, তাঁদের মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে অত্যাচার করতেন, তার বিস্তৃত বিবরণ আমি পড়েছি। আর এসব কাজের পেছনে তাঁর যুক্তি ছিল যে, তিনি তাঁর দেশ ব্রিটেনের জন্যেই করেছেন। তাঁর ওপরওয়ালার নির্দেশ তিনি পালন করেছেন। ডরোথি বেশ উত্তেজিত গলায় কথা বলছিল। আর সেই কারণে তার ইংরেজি শব্দগুলো একটু অন্যরকম ভাবে অর্জুনের কানে বাজছিল। ডরোথি একটু থামতেই অর্জুন বলল, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। চাকরি করতে গেলে ওপরওয়ালার নির্দেশ মানতেই হয়। তবে ইতিহাস বলে কোনও-কোনও ইংরেজ অফিসার অধিকারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন।
ডরোথি মাথা নাড়ল, ঠিক। সেই কথাই ঠাকুরদা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন। কেউ বোমা নিয়ে তাঁকে মারতে আসছে জানার পর তিনি কী করতে পারতেন? ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবেন না আক্রমণকারীর মুখোমুখি হবেন? সেক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্যে তাঁকেও অস্ত্র চালাতে হত। সেই লোকটা মরে গেলে শহিদ হয়ে যেত আর ঠাকুরদা খুনি। অথচ দুজনেই তার কর্তব্য করছে।
তুমি বললে এদেশে এসেছ পূর্বপুরুষের করা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে। অথচ তুমি পূর্বপুরুষের কাজকেই এখন সমর্থন করছ। অর্জুন বলল।
আমি ততটাই সমর্থন করছি, যতটা তাঁদের করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আরও অনেকের মতো আমার ঠাকুরদা সীমা হারিয়েছিলেন। তাঁর ডায়েরিতে আমি তিনজন মানুষের নাম পেয়েছি যাদের ওপর বীভৎস অত্যাচার করেছেন তিনি এবং তাঁর পুলিশ। এগুলো স্রেফ জেদের বশে করেছিলেন। শেষ বয়সে দেশে বসে তিনি এই তিনটি কাজের জন্যে অনুশোচনা করতেন। ডরোথি তাকাল স্পষ্ট চোখে, আমি ওই তিনটি মানুষের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
কতদিন আগের ঘটনা?
প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগের কথা।
চোখ বন্ধ করল অর্জুন। ওরে বাস! এ তো অনেক সময়। অতদিন আগে যাঁদের ওপর ডরোথির ঠাকুরদা অত্যাচার করেছিলেন তাঁরা কি এখনও বেঁচে আছেন? উবোথির ঠাকুরদাই তো এখন পৃথিবীতে নেই। সে জিজ্ঞেস করল, যদি তাঁরা না বেঁচে থাকেন?
তা হলে তাদের পরিবারের কাছে যাব।
এই তিনজন মানুষ কারা?
দুঃখিত। ইণ্ডিয়ান নাম আমার ঠিকঠাক মনে থাকে না। ঠাকুরদার ডায়েরিতে তাদের নাম আছে। দেখে বলতে হবে। ডরোথিকে এখন একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল।
তোমার ঠাকুরদার নাম কী?
রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড।
জলপাইগুড়ি শহরের মানুষ একজন ইংরেজের কথা অনেকদিন জানত। তাঁর নামে তিস্তার পারে একটা ফেরিঘাটকে লোকে কিং সাহেবের ঘাট বলে চিনত। তিস্তার ওপর ব্রিজ এং দুপাশে বাঁধ হওয়ার পর সেই ঘাটের অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে এবং নামটাও হারিয়ে গিয়েছে। তবে এখনও কিছু কিছু সরকারি বাড়ি ব্রিটিশদের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীন ভারতবর্ষের আর পাঁচটা শহরের মতো জলপাইগুডি ইংরেজদের কথা ভুলতে পেরেছে। রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড নামের একজন ইংরেজ প্রশাসক যে এই শহরে ছিলেন তা এখন কারও জানার কথা নয়, যদি না তিনি সেই আমলের মানুষ হন। অর্জুন এই নামটি প্রথম শুনল।
তিস্তা ভবনে জায়গা পাওয়া গেল। রেসকোর্স ছাড়িয়ে এই সরকারি অতিথিশালার পরিবেশ চমৎকার। ডরোথিকে সেখানে তোলার পর সমস্যা দেখা দিল খাবার নিয়ে। শুধু চা-টোস্ট ছাড়া সেখানে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। যিনি রান্না করেন তিনি ছুটিতে গিয়েছেন। হোটেল থেকে ভাত-তরকারি আনলে ডরোথির পক্ষে মারাত্মক হবে, কারণ সে ঝাল একদম সহ্য করতে পারে না। ইতিমধ্যে কলকাতায় নামী হোটেলে শখে পড়ে ইণ্ডিয়ান কারি খেয়ে সে বিপদে পড়েছিল। জলপাইগুড়ি শহরে বিদেশিদের উপযুক্ত কোনও খাবারের দোকান নেই।
ডরোথিকে বিশ্রাম নিতে বলে অর্জুন পোস্ট অফিসের মোড়ে চলে এল। তার মনে হচ্ছিল এপিদা এব্যাপারে কিছু করতে পারেন। এ পি রায় এই শহরের বিখ্যাত শিল্পপতি, অনেক চা বাগানের মালিক। জলপাইগুড়ি এবং কলকাতার খেলাধুলোর সঙ্গে জড়িত। অর্জুনকে বেশ পছন্দ করেন। মিনিট পাঁচেক হেঁটে এপিদার বাড়িতে পৌঁছে সে হতাশ হল। এপিদা কলকাতায়। গিয়েছেন। টাউন ক্লাবের সন্তু চ্যাটার্জি সেখানে ছিল। অর্জুনের সমস্যার কথা শুনে বললেন, আজকাল সাহেবরা তো ঝোল-ভাত খায়। মাসিমাকে বল কম ঝাল দিয়ে বেঁধে দিতে, দেখবি দিব্যি খেয়ে নেবে।
অর্জুনের খেয়াল হল মায়ের কথা। পেটের অসুখের জন্য মা নিজের জন্য ঝালবিহীন রান্না রাঁধেন। সেটা কম উপাদেয় নয়। মাকে বললে হয়।
সন্তুদা জিজ্ঞেস করলেন, মেমসাহেবটি কি বেড়াতে এসেছেন?
হ্যাঁ। ওঁর ঠাকুরদা এক সময় এই শহরে চাকরি করতেন।
বারান্দার কোণে চেয়ারে গুটিসুটি মেরে এক বৃদ্ধ বসেছিলেন। এ পি রায়ের বাবা এস পি রায়ের আমলের মানুষ। সম্ভবত ওদের কথা শুনছিলেন তিনি। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী লোকটার?
রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড।
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, কত সাহেব এল গেল, কত তাদের নামের বাহার। একজনের নাম ছিল শেকসপিয়র। বুঝলে সন্তু, লোকটা নিজের নাম সই করতে পারত না। অশিক্ষিত। লন্ডনে গুণ্ডামি করত। তাকে এখানে পুলিশ করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তা তাকে রায়কত পাড়ার জীবন মিত্তিরের বড় ছেলে পঞ্চানন এমন টাইট দিয়েছিল–।
এ গল্প আমি অনেকবার শুনেছি মামা। সন্তুদা বললেন।
শুনবেই তো। একটা মানুষের জীবনে তো লক্ষ লক্ষ গল্প থাকতে পারে। যা দেখেছি তাই বলছি। তখন ছিল দেশপ্রেম, ডেডিকেশন। আহা।
আপনি রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ডের কথা মনে করতে পারছেন না? অর্জুন জিজ্ঞেস করল। বৃদ্ধকে তার ভাল লাগছিল।
ম্যাক–। ম্যাক সাহেব?
তা তো জানি না।
একজন ছিল। সবাই তাকে ম্যাকহেব বলত। খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়োল ম্যাকের দাপটে। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, সেই ম্যাক ছিল টেরার।
সন্তুদা অর্জুনকে নিয়ে খানিকটা দূরে সরে এলেন, ওঁর মাথা ঠিক নেই। তুমি একজনের কাছে যেতে পার। জলপাইগুড়ির ইতিহাস ভদ্রলোকের জানা।
কার কথা বলছেন?
সুধীর মৈত্র। এক কালে অধ্যাপনা করতেন। পাহাড়ি পাড়ায় থাকেন। অনুপকে তো চেনো। ওদের দুটো বাড়ি পরে ওঁর বাড়ি।
সুধীর মৈত্রের বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। জলপাইগুড়ি শহরে বসে বইপত্রে শুধু নিজের জন্যে যদি কেউ ড়ুবে থাকেন তা হলে তাঁর নাম সুধীর মৈত্র। নিজের পরিচয় দিতে ভদ্রলোক অর্জুনকে বসতে বললেন। চারপাশে বইয়ের স্তুপ। মেঝেতে শতরঞ্জি পাতা। কোনও আসবাব নেই। ভদ্রলোক বসে আছেন বাবু হয়ে। সত্তরের ওপর বয়স হলেও শক্ত আছেন। পরনে ফতুয়া পাজামা। চোখে চশমা, চুলগুলো ধবধবে। বললেন, তোমার কথা শুনেছি। লাইটারটা তো?
অর্জুন লজ্জা পেল হ্যাঁ।
বল, কী জন্য এসেছ?
অর্জুন জানাল। সুধীরবাবু বললেন, মেয়েটি নিশ্চয়ই তার দাদু সম্পর্কে সব জানে, তাকে জিজ্ঞেস না করে তুমি আলাদা করে জানতে চাইছ কেন?
এখন পর্যন্ত বলতে পারেন শুধুই কৌতূহল। জানা থাকলে ওর সঙ্গে কথা বলতে সুবিধে হবে। তা ছাড়া ও জেনেছে দাদুর ডায়েরি পড়ে। সেটা কতখানি সত্যি তাতেও তো সন্দেহ থাকবে। অর্জুন বলল।
মনে হয় সত্যি। কারণ ইংরেজরা যখন নিজের জন্যে ডায়েরি লেখে তখন বানিয়ে লেখে না। কোন সময়টার কথা বললে?
ধরুন থার্টি ফাইভ থেকে ফর্টি টু।
ও ব্বাবা। একেবারে অগ্নিগর্ভ কাল। ওঁর নাম রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড। তাই তো? সুধীরবাবু উঠলেন। প্রায় দেওয়াল ঢাকা বইয়ের রাশির মধ্যে খুঁজতে শুরু করলেন উবু হবে। শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেলেন বইটা। পাতলা বইটির পাতা ওলটাতে ওলটাতে ওঁর মুখে স্বস্তির হাসি ফুটল। একটা ছোট শহরকে নিয়ে খুব বেশি লোক ভাবে না। কলকাতার তিনশো বছর নিয়ে প্রচুর বই আছে তবু প্রথম পঞ্চাশ বছরের সব কিছু আমরা জানতে পারি না। আর জলপাইগুড়ি নিয়ে কে মাথা ঘামায়? তবু কিছু কিছু অন্য ধরনের মানুষ কাজ করেছেন বলে এখনও আমরা ফিরে তাকাতে পারি। কথা বলছিলেন পাতা ওলটাতে ওলটাতে। হঠাৎ স্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি মধুপর্ণী পত্রিকায় জলপাইগুড়িকে নিয়ে লেখা সংখ্যাটা পড়েছো?
অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমার কাছে আছে।
খুব ভাল কাজ। সবকটা দিক কভার করা হয়েছে। পত্রিকাটা কখনও হাতছাড়া কোরো না। হ্যাঁ, কী নাম যেন?
রিচার্ড ম্যাকডোনান্ড।
ইয়েস। পেয়েছি। থার্টি ফাইভ নয়, থার্টি ফোরে ভদ্রলোক জলপাইগুড়িতে আসেন। বাঃ, ইনি তো দেখছি টেগার্টের সহোদর।
টেগার্ট?
সেই কুখ্যাত ব্রিটিশ, যিনি কলকাতায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের টুটি টিপে ধরে ব্রিটিশ সিংহকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। রিচার্ড সাহেবও সেই জাতের কর্মচারী। তাঁর প্রতাপে জলপাইগুড়ির স্বাধীনতা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়েছিল। এই বইটিতে লেখা আছে তিনি যোগ্য হাতে বিদ্রোহীদের দমন করেছিলেন। বুঝতেই পারছ এই বই সাহেবদের লেখা। যা, এখন আমার মনে পড়েছে। বইটি রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন সুধীরবাবু। তারপর মাথা নাড়লেন, না, শুধু স্মৃতির ওপর নির্ভর করে তোমাকে বলা ঠিক হবে না। তুমি বিকেলবেলায় আসতে পারবে? আমি এর মধ্যে আশা করছি ওঁর সম্পর্কে তথ্য জানতে পারব।
অর্জুন বলল, ঠিক আছে। তবে এ নিয়ে আপনাকে খুব ব্যস্ত হতে হবে না। ওই মেয়েটি নাম বলায় আমার কৌতূহল হয়েছিল, এইমাত্র।
কৌতূহল হওয়াই তো স্বাভাবিক। একটি ব্রিটিশ মেয়ে অতদূর থেকে ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে ছুটে এল তার দাদুর কর্মস্থল দেখতে, ব্যাপারটা অভিনব। আচ্ছা, মেয়েটি কি বর্ধমানে যাওয়ার কথা বলেছে? সেখানেও রিচার্ড সাহেব কিছুদিন ছিলেন!
না। আমাকে কিছু বলেনি।
তা হলে জলপাইগুড়ির বিশেষ গুরুত্ব ওর কাছে আছে। যে মানুষটির জন্যে আছে, তার সম্পর্কে আমাদের আরও তথ্য জানা দরকার। তুমি বিকেলে এসো।