মেঘে ঢাকা তারা : 01
মাধববাবু তক্তপোশে বসে বেশ ছোটখাটো লেকচার দিয়ে চলেছেন; তক্তপোশে, মেঝেতে এদিক-ওদিক বসে কয়েকজন ছেলে। স্কুল ফাইনাল দিতে চলেছে তারা।
—তাহলে বুঝতে পারলে, এই পরীক্ষাই জীবনের প্রথম বৃহত্তর জগতে প্রবেশের পথ। কি রে পরশা?
পরেশ মাথা চুলকোচ্ছে।
—আজ্ঞে ইংরাজিটারেই ভয়!
মাধববাবু আশ্বাস দেন—ভয় কি রে! টেস্টে তো ভালো নম্বর ছিল। আমার হাতে ফার্স্ট পেপারে পঞ্চাশ পেয়েছিস! কইরে তামাকটা!
একজন ছেলে ফুঁ-দিয়ে কলকেটা তুলে দেয় হুঁকোতে বসিয়ে। দুবার টান দিয়ে একটু ধাতস্থ হন মাধববাবু।
—হ্যাঁ, বলছিলাম দেশের কথা। নৌকায় করে মাদারিপুর সদরে যেতাম, পথে আঠারোবাঁকির ধারে গঞ্জের হাট থেকে উঠত তরমুজ, ফুটি।
ও হ্যাঁ!…
হঠাৎ কি মনে পড়তেই উঠে পড়েন।
—একটু বসো তোমরা, আসছি! ওগো—
ছিটে বেড়ার ঘরের ফংবঙে দরজাটা দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে ভিতরে ঢুকেই রান্নাঘরের দাওয়ায় স্ত্রীকে দেখে চমক ভাঙে মাধব মাস্টারের।
—কই, হল তোমাদের?
কাদম্বিনী যেন আকাশ থেকে পড়ে—কী হবে?
মাধববাবু আমতা আমতা করেন।
—মানে ওরা চলে যাচ্ছে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে, এতকাল প্রতি বৎসরই যাবার আগে ওদের তো কিছু জলযোগ করতে বলি, তাই এবারও—
কাদম্বিনী অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
এতকাল আর আজকাল!
এই দুটোর মধ্যে যে একটা আকাশ-জমিন পার্থক্য গড়ে উঠেছে, এত চেষ্টা করেও ওই খেয়ালি আপন-ভোলা লোকটিকে তারা তা বোঝাতে পারেনি।
সেদিন ছিল নিজের দেশ, নিজের কিছু জমিজারাত, একটু আশ্রয় ছিল। সাতপুরুষের গ্রামে একটু মান-সম্মান পরিচিতিও না থাকা ছিল না। আজ সব কোন দিকে হারিয়ে বানেভাসা খড়কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছে এই অচেনা অজানা ঠাঁই-এ, সামান্য ওই স্কুলমাস্টারির চাকরিতে ভরসা করে, তা ওই আপনভোলা লোকটিকে বোঝাতে পারে না কাদম্বিনী। একার রোজগার আর ওই এতগুলি পোষ্য। অভাব আর অনটনের নগ্নছায়া এ সংসারের সর্বত্র।
মাধববাবু স্ত্রীর দিকে চেয়ে শিউরে ওঠেন।
—মানে তাড়াহুড়োয় তোমাকে বলতে বোধহয় ভুলে গেছি!
কাদম্বিনীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। অসময়ে এত ঝামেলা! শুধু মেহন্নতই নয় বেশ কিছু খরচাও। বেশ চড়াস্বরেই জবাব দেয় কাদম্বিনী।
—কেতাত্ব করেছো! এখন পাই কোথা?
—এতদিনের রীতি উলটে যাবে? মানে যা হয় কিছু মিষ্টিমুখ—
নীতা বাবার অবস্থা দেখে এগিয়ে আসে, মাকে সামলাবার চেষ্টা করে।
—আঃ, কী করছো মা! বছরের একটা দিন বই তো নয়?
মাধববাবু সাহস পান—দেখ দিকি মা!
নীতাই দায়িত্ব নেয়—তুমি বাইরের ঘরে গল্প করো বাবা। আমি দেখছি।
মাধববাবু নীতাকে দেখে ভরসা পান।
—বেশ, বেশ! সত্যি আমারই ভুল হয়ে গেছে। মনেই ছিল না যে তোদের ও কথাটা জানানো দরকার। তা বসুক ওরা একটু, ইংরাজিটাই আলোচনা করি। কাজ হবে ওদের, তুই এদিকে জোগাড় কর।
মাধববাবু চলে যেতেই কাদম্বিনী মেয়ের দিকে মুখ তুলে চাইল, বজ্রের দীপ্তি ভরা সেই চাহনি, যেকোন মুহূর্তেই বর্ষণ শুরু হবে। নীতা মাকে চেনে, চুপ করে কি ভাবছে। প্রশ্ন করে কাদম্বিনী।
—কী করা হবে জোগাড়ের? খুব তো বলা হল!
—তুমি উনুনে আঁচ দিয়ে দাও।
নীতা এগিয়ে গেল দরজার কাছে—এই পরেশ?
পরেশ পাশের ঘর থেকে বের হয়ে আসে, নীতা তার হাতে কয়েকটা টাকা তুলে দিয়ে বলে—দু’সের ময়দা, পোয়াদেড় ঘি, আর চিনি একসের নিয়ে আয়।
পরেশ কিছু বলবার চেষ্টা করে, নীতা ধমক দিয়ে ওঠে।
—যাও। বের হয়ে গেল সে।
কাদম্বিনী গজগজ করে উনুনে আগুন দিতে থাকে।
—এক দিনের সংসার খরচা। গেল তো!
—যাক মা। আমার টাকা থেকে দিলাম।
—তাও তো সংসারেই থাকত। এসব নবাবী আমার ভাল লাগে না নীতা। গজগজ করে আপন মনে কাদম্বিনী।
—ছাত্রদের নেমতন্ন! যত্তোসব-
ও ঘর থেকে হাসির শব্দ শোনা যায়। নীতাও উৎকর্ণ হয়ে শুনছে, মাধববাবু গল্প ফেঁদেছেন। বেশ উৎসাহভরে
—সনৎ ছিল সেবার ফার্স্ট বয়, ফ্রি তো পাবেই, স্কলারশিপও নেবে। পাশের গাঁ মদনপুর স্কুল থেকে ওকে বলল ফ্রিশিপ দোব, বোর্ডিং ফ্রি দোব। ওকে লুফে নেবার জন্য কত ঝুলোঝুলি। সনৎ গেল না শুধু আমার ইংরাজি পড়ানো দেখে।
একটু দম নিয়ে আবার শুরু করেন।
—পীরগঞ্জ স্কুলকে জেলাস্কুলও ভয় করত, বুঝলি। সেবার ইনস্পেক্টার এসে কি বেকুব খুব কড়াকড়ি পরীক্ষা করেছেন ক্লাসে গিয়ে। তারপর নিজেই ঠাণ্ডা। স্রেফ ‘ইনভার্টেড কমা’র হরফে ওই সনৎ ঠাণ্ডা করেছিল তাকে। ও ছিল জুয়েল।
নীতার ময়দা মাখা যেন বন্ধ হয়ে যায়। বিকালের ম্লান আলো পড়েছে ঝিঙেলতার ফুলে, কোথায় পাখি ডাকছে। শনশন হাওয়া হাঁকে নারকেলগাছের মাথায়, মনটা কেমন কোন সুদূরে উধাও হয়ে যায় দূর আকাশে মেঘের ভেলায়। হঠাৎ বাবার ডাকে চমক ভাঙে।
—হল রে?
—হচ্ছে বাবা।
ময়দার লেচিগুলো বেলতে থাকে নীতা। লুচি ভাজছে কাদম্বিনী। মুখের মেঘ তখনও কাটেনি। বলে ওঠে—
—কিছু সরিয়ে রাখ নীতা, গীতা মন্টু আছে। যা ধরে দিবি ওই ধুন্দুর দলের সামনে, সব যাবে। রাতে আজ রান্না হবে না। বুঝলি?
তবু যাহোক একটু সাশ্রয় করতে চায় না! নীতা মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। উনুনের একঝলক আভা পড়েছে মায়ের শীর্ণ গালে। এককালে সুন্দরী ছিল। আজ সংসারের কঠিন চাপে, অভাব আর হতাশার তাড়নায় মায়ের দেহমন সব বদলে গেছে। একটা কাঠিন্য ফুটে উঠেছে, জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত একটি নারীর ছবি—জীবন্ত ছবি।
বাইরের ঘরে হাসির শব্দ উঠেছে। মাধব মাস্টার হাসছেন, অট্টহাসি। জীবনকে তুচ্ছ করে তোলার প্রচেষ্টা ফুটে উঠেছে ওই হাসির ছন্দে—শব্দে।
ঘরছাড়া দেশছাড়া হয়ে পর-মাটিতে উঠে এসেছে তারা। চারিদিকে শুধু অভাব আর অনটন, তারই সঙ্গে যুদ্ধ করে আজ যেন শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে উঠেছে কাদম্বিনী।
হাড়মাস ভাজা-ভাজা হয়ে গেছে। ওই হাসির শব্দ শুনে গা জ্বলে ওঠে। নীতার দিকে চেয়ে থাকে, নীতার চোখেও ওই হাসির সংক্রমণ।
—বাবা যেন কি!
—ওর নিয়ে ও আছে। নইলে হাসি আসে? মরণ! মেয়ের দিকে চাইল কাদম্বিনী।
হঠাৎ মায়ের কঠিন দৃষ্টির সামনে কি যেন দুর্বলতা ধরা পড়ে যেতেই অপ্রস্তুত হয় নীতা, মাথা নিচু করে ময়দা বেলতে থাকে।
ওরা খাওয়ার পর চলে গেছে।
মা মেয়ের এই মতদ্বৈততার মাঝে চটির শব্দ তুলে ঢোকেন মাধববাবু। ছোট ছেলে মন্টু একটা পিঁড়ির ওপর বসে লুচি খাচ্ছে। ছোট ছেলের দিকে চেয়ে মাধববাবু বলে ওঠেন,—
—তোর আর ওদিন আসবে না মন্টু। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উঠতেই যা মাড়ন পাড়ন চলেছে, ফাইনালে যাবার ধকল তাতে সইবে না।
মন্টু যখন তখন কথা বলা নিরাপদ মনে করে না। চুপ করে খেয়ে যায়। মাধববাবু স্ত্রীর দিকে না চেয়েই বলে ওঠেন নীতাকে।
—ওরা খুব খুশি, বুঝলি নীতা। এ ব্যাচে দু’চারটে ভাল ছেলে আছে। তবে তেমন কিছু নয়।
কাদম্বিনী ঝাঁঝিয়ে ওঠে—ওরা বি. এ. এম. এ. পাশ করলে চারটে হাত গজাবে?
—করুক না, তোমার মেয়েও বি. এ. পাশ করবে বড়বউ। কি বল নীতা? ওর যা বুদ্ধিশুদ্ধি। এত ছেলে-মেয়ে দেখলাম ওর মত ক্বচিৎ নজরে পড়েছে। অনার্স নিয়ে পাশ করে যাবে ও।
মাধববাবু হুঁকো টানতে থাকেন; জুতকরে পিঁড়ি টেনে বসে।
কাদম্বিনী স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে; সদ্য অপব্যয়ের দুঃখ তখনও সামলাতে পারেনি। তার উপর আবার সেই পুরনো ঘায়ে আঘাত করেছেন মাধববাবু। পীরগঞ্জের প্রাচুর্যের দিনগুলো তখনও মনে রয়েছে স্মৃতির মতো।
ওই আপনভোলা লোকটিকে নিয়ে পদে পদে কি নাকাল না হতে হয়েছে তাকে। স্বামীকে দেখেছে দিনরাত ডুবে রয়েছে মোটা মোটা বইয়ের মধ্যে, না হয় স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে গল্প-গুজবে। যে সময় অন্য মাস্টাররা টিউশানি করেছে একটার পর আর একটা, সেই সময় তিনি নিজে পড়ে পড়ে সময় নষ্ট করেছেন। না-হয় গরিব ছেলেদেরকে বিনা মাইনেতে পড়িয়েছেন। পীরগঞ্জে তাই করেছেন আজও তেমনিই চলেছে। এর আর হের ফের হয় নি।
কাদম্বিনী বাধা দিয়েছে—কি হবে ঘরের খেয়ে বরে মোষ তাড়িয়ে। টাকাকড়ি দেয় কিছু ওরা? বিনি মাইনেতে কেন পড়াবে?
—দেবে কোত্থেকে? কিন্তু সারা জীবনে ওরা মাধব মাস্টারকে ভুলবে না বড়বউ! —ছাই! তাতে কার কি এল গেল?
নিজের কথা কোন দিনই ভাবেননি। অন্য জগতের চিন্তায় মশগুল। সংসারের দিকে ফিরেও চাননি। দেশের ছেলেকে মানুষ করতেই দিন গেছে। নিজের ছেলেদের পর্যন্ত মানুষ করতে পারেননি। বড় ছেলে শঙ্কর বার কয়েক ম্যাট্রিক দিয়ে ফেল করার পর হাল ছেড়ে দিয়েছে। মন্টু পড়ছে, তবে সেদিকে বিশেষ মন নেই তার। তাকেও খরচার খাতাতেই লিখে রেখেছেন তিনি।
বলেন—গাধা পিটিয়ে ঘোড়া হয় না বড়বউ।
পড়েছেন এইবার নীতাকে নিয়ে। মেয়েকে পাশ করাবেন। নিজেই আবার রীতিমতো পড়ছেন মেয়েকে পড়াবার জন্য। বই আর পড়াশোনা আর ছাত্রদের গল্প, এই নিয়েই জীবন কেটেছে, দিন কাটছে এখনও
কিন্তু সংসারের সেই দৈন্য কোনো দিনই ঘোচেনি। উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। একটা কালো ছায়া ঘিরে আসছে এই ছোট্ট বাড়িটাতে।
সেদিনও সংসারের টাকা থেকে কয়েক টাকা সরিয়ে পুরনো বই একরাশ কিনে এনেছেন ফুটপাথ থেকে। ছেলেমেয়েদের ভাতের উপর তরকারি দিতে পারেনি, পরনের পোশাকও জোটেনি। এই তো এতদিনের বিদ্যাসাধনার মুরোদ।
আজ আবার মেয়েকে নিজের পথে নিয়ে যাবার জন্য স্বপ্ন দেখেন মাধববাবু। কাদম্বিনী সহ্য করতে পারে না। এত দিনের সঞ্চিত জ্বালা ফেটে পড়ে দুর্বার প্রতিরোধে নীতাকে পড়াবার কথায় কাদম্বিনী বলে ওঠে।
—হ্যাঁ, তা আবার নয়। এত লেখাপড়া শিখে নিজে তো দু’হাত বের করে খাচ্ছো, ভাতের ওপর তরকারি জোটে না, দুটো পয়সার মুখ দেখলাম না জীবনে। মেয়েকেও আবার সেইপথে নিয়ে যাবার শখ।
মাধববাবু নীতার দিকে আশ্বাস ভরে তাকালেন, মেয়েকে ভরসা-স্থল বলে মনে হয়। কিন্তু নীতা নেই, কি আনতে রান্নাঘরের ওদিকে গেছে।
মাধববাবু স্ত্রীর সামনে অসহায়। বাইরের সেই আনন্দমুখর লোকটি স্ত্রীর দিকে তাকালেন—তবে? সমস্যা সমাধানের পথ তাঁর সামনে নেই।
কাদম্বিনী বলে ওঠে—ও মেয়েকে বিয়ে-থা দেবার চেষ্টা করো। পড়িয়ে কাজ নেই। ঢের হয়েছে।
—বিয়ে? সে-যে অনেক টাকার ব্যাপার!
মন্টু বাবার সামনে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। কোনো রকমে গো-গ্রাসে গিলে উঠে পড়ে। নীতাও এরকম প্রসঙ্গ উঠবে মনে করেই সরে গেছে। মাকে চেনে সে। ওর কণ্ঠে শুধু অভাবের জ্বালাই ফুটে ওঠে।
মাধববাবু বলেন—তা ছাড়া ওই কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে বলো? তাও বিনা পণে?
ঢুকতে গিয়ে নীতা দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল। তার রূপ নেই, সারা দেহ ঘিরে যৌবনের ব্যর্থ গুঞ্জন, সেই কথাটাই পুরুষের কাছ থেকে শুনে চমকে ওঠে নীতা। সব আলো যেন নিভে আসে। সরে গেল ওদিকে।
মাধববাবু ভাবছেন
লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে খরচ যা আছে তা কিস্তিবন্দি, নীতা নিজেই তা রোজগার করে নেয় টুউশানি থেকে। মাধববাবু বলে-কয়ে স্কুলে গার্লস সেকশনে একটা চাকরির ব্যবস্থাও করেছেন তাতে সংসারের সুরাহা হবে, নীতাও পড়াশোনা চালাতে পারবে।
কিন্ত বিয়ে? তার মতো বিত্তহীন দরিদ্রের ওই কুশ্রী মেয়ের জন্য কোনো রাজপুত্র বসে নেই! কাদম্বিনী বলে ওঠে।
—কেন নেতাজি কলোনির যতীন মুখুজ্জের ছেলে?
—যতীন মুখুজ্জে? চমকে ওঠেন মাধববাবু।
মদনপুরের সেই মোক্তার, একটা ইতর-চশমখোর লোক। তার ছেলে নাকি শিয়ালদহে কাটাপোশাকের দোকান দিয়ে দু’পয়সা আয় করে।
কাদম্বিনী বলে ওঠে—হ্যাঁগো, যতীনের ছেলে গোপাল।
এবার অবাক হবার পালা মাধববাবুর। হাতের হুঁকোটা মুখ থেকে সরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখছেন আর নিরীক্ষণ করছেন ওকে। গোপালের সব ইতিহাস ওর নখদর্পণে। বলে ওঠেন—সে তো তিনবার ক্লাস এইটে ফেল করে পড়াশোনা ছেড়েছে, কাঠগোঁয়ার বাঁদর ছেলে। অবস্টিনেট বয়।
কাদম্বিনী গর্জে ওঠে—তবে কি এম. এ. পাশ গেজেটেড অফিসার পাবে?
মাধববাবু সায় দিতে পারেন না, গোপালের মতো অপাত্রে নীতাকে তুলে দিতে পারবেন না! তার বিদ্যাবুদ্ধি, রুচি-শিক্ষা কোনটাকেই মেনে নিতে পারবে না গোপাল। সারা জীবন তিলে তিলে জ্বলে মরার চেয়েও বিয়ে না হওয়াই ভালো। মাধববাবু শেষ জবাব দেন। কণ্ঠস্বর অজ্ঞাতেই ‘কঠিন হয়ে উঠেছে তাঁর।
—হাত-পা বেঁধে জেনে-শুনে ওকে জলে ফেলতে পারব না বড়বউ। না-না!
খ্যাঁক করে ওঠে বড়বউ—তবে রাজপুত্র খোঁজোগে?
—উঁহু, ও পড়বে।
একটা জায়গায় মাধববাবু স্ত্রীর মতবাদকে অগ্রাহ্য করতে পারেন কঠিনভাবে।
কিছুদিন আগেও ফাঁকা মাঠ জলা পড়ে ছিল এখানে। বাঁশবন জলকচুর ঝোপের নীচে দিয়ে খালটা বয়ে গেছে। জনহীন সেই উপকণ্ঠের মাঠে আজ শত শত গৃহহারা পরিবার বাসা বেঁধেছে পাকিস্তান থেকে সব হারিয়ে এসে। লাইনের ধারে আমবাগানের গাছের পাতায় আবছা আলো, শিরশিরিয়ে ওঠে নারকেলপাতায় চাঁদের আলোমাখা বাতাস। দূরে দূরে দু-একটা আলো জ্বলছে। ভেসে আসে কীর্তনের সমবেত তান। কলোনির মাঝে কীর্তন-খোলা গড়ে তুলেছে তারা।
জানলার ধারে বসে আছে নীতা, বাবার কথাগুলো তখনও কানে ভাসে—কালো মেয়ে, কুৎসিত সে। তার জন্য কোনো রাজপুত্র কোনোদিনই আসবে না।
রাজপুত্র!
মনে পড়ে একখানি মুখ। সনৎকে আজও ভোলে নি! নিবিড় আঁধারের মধ্যে একটু ম্লান শিখা বলে মনে হয়। দূর আকাশের তারার মত ঝিকিমিকি তোলে আশার আনন্দে! সব দুঃখ গ্লানি হালকা হয়ে যায়।
ঝড়ো বাতাস বইছে! হু হু বাতাস। গাছগাছালির মাথা কাঁপানো বাতাস। …. মনের সব দুর্বলতা তার ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়।
একটা ট্রেন সার্চলাইট জ্বেলে হু হু শব্দে বের হয়ে গেল আঁধার ফাটিয়ে, তীক্ষ্ণস্বরে বাঁশিটা বাজছে প্রাণের সাড়ায়। ওই বাঁশিটাও যেন নীতার মনে সুর এনেছে, অজানা আনন্দ এনেছে।
সন্ধ্যার পর বারান্দায় পড়তে বসেছে মন্টু আর গীতা।
ফরসা সুন্দরী মেয়ে। ঠিক নীতার উল্টো। রূপে কথায় চাল চলনেও। দু’চোখে তার যৌবনের সদ্যজাগর জি, ছন্দ! চুলগুলো পিঠের উপর মেলা; নীতাকে বলে ওঠে—
—কই দিদি, ইংরাজিটা বলে দেনা ভাই, খটমট ঠেকছে।
—না পড়লে সবই খটমট ঠেকে। নীতা জবাব দেয়।
গীতা বলে—কি করি বল, মাথায় যে কিছু ঢোকে না।
মন্টু পড়ছিল, পড়ার চেয়ে দুষ্টমিটাই তার বেশি; মাঝে মাঝে থামে আর চিৎকার করে পাড়ার সবাইকে পড়ার সংবাদটা জানান দেয়,
উমরাটিপুরে সুবেদারগৃহেঁ
সেদিন বাজিছে বাঁশি।….
গীতার কথাতে মুখ ভেংচে ওঠে।
—তা ঢুকবে কেন? মাথায় কি পোরা আছে জানিস? কাউ ডাং–স্রেফ গোবর।
—অ্যাই—গীতা ফোঁস করে ওংে।
মন্টুও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে—কাম অন, ফাইট।
—মন্টু! নীতা ধমক দিয়ে ওঠে।
মন্টু আবার পড়তে বসে; গীতাও মাথা দুলিয়ে পড়ে। These lines have been taken from Wordsworth’s ‘Solitary Reaper’. Here the poet….
কলরব! নীতা এই বিচিত্র জগতের মাঝে পথ হারিয়ে এসে পড়েছে অন্যমনে। মাঝে মাঝে কেমন যেন দূরে চলে যায় এদের হাসিসুরভরা জগৎ ছেড়ে। সেই দূর পথ ছেয়ে আছে নিবিড় অন্ধকার। সে জগতের ঊর্ধ্বাকাশে তারার স্নিগ্ধ জ্যোতি নিয়ে চেয়ে থাকে সনৎ! নীতার ওইটুকুই যেন ধ্রুবতারা। চিন্তার ক্ষীণ আলো সেখানে পথ খুঁজে পায় না।
—অ্যাই দিদি! গীতার ডাকে নীতা ফিরে এল আবার নিজের জগতে। কেমন যেন সনৎকে মনে পড়ে বার বার। আকাশের উঠোনে অসংখ্য তারা ফুল ফুটেছে।
একটা সুর উঠেছে। ওপাশের টিনের বেড়া দেওয়া ছোট ঘরে গলা সাধছে শঙ্কর। ক্ষীণ একটা সুরের রেশ রাতের বাতাসে মিশে রয়েছে, মিষ্টি একটা আমেজ আনে।
নীতাও পড়ায় মন দেয়।
গীতা এ বাড়ির চালচলনের সম্পূর্ণ বিরোধী; বাবার এই গলাবদ্ধ কোট, তালতলার চটি আর দিদির সাদামাটা পোশাকগুলোকে সহ্য করতে পারে না সে। এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে হয়ে যায় দু-এক পশলা প্রায়ই।
ক্লাসে সব মেয়েই যেন তার চেয়ে অনেক ভাল পোশাক পরে আসে। নিজে পড়াশোনাও পারে না, তার উপর পোশাক-আশাকের দৈন্যটাও বড় করে ঠেকে। সাবানকাচা কাপড় আর একই ব্লাউজ গায়ে, দিনের পর দিন একই স্যাণ্ডেল পরে স্কুলে যেতে বিশ্রী ঠেকে। নিজের অপরিসীম দৈন্যে সে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সেদিন কথাটা মাকে জানিয়ে দেয় গীতা।
—যাব না ক্লাশে, এই ছিরি করে বের হতে পারে মানুষ?
কাদম্বিনী তরকারি কুটতে কুটতে মেয়ের কথায় মুখ তুলে চাইল। রূপ! …. এতরূপ দেখে সেও বিস্মিত হয়; গীতাও জেনে ফেলেছে সেই কথাটা। কাদম্বিনী বলে ওঠে।
—ওই তো রঙিন শাড়িটা পরে যা।
—ছাই শাড়ি।
—নবাবনন্দিনীর ওতে মন ভরে না। এখন থেকেই সাজগোজের বাহার। বলগে না বাপকে, সেও তো দিতে পারে।
ওখানে বলে কিছু হবে না, মাও জানে—জানে গীতাও। তাই আপনমনেই গজগজ করে গীতা।
—ওই ক্যাটকেটে শাড়ি পরে যেতে পারব না।
—যাস্ নে।
গীতা মুখ গোমড়া করে মায়ের দিকে চাইল।
বাবার সুপারিশে বিনা মাইনেতে স্কুলে পড়ে, তার উপর ওই পোশাক, সর্বদাই যেন মাথা নিচু হয়ে থাকে তার। স্কুলে মানসীকে দেখেছে চমৎকার একটা গোয়ালিনী-আঁকা কটকী শাড়ি পড়ে এসেছিল; হাতে নতুন ডিজাইনের গহনা। ক্লাসের মেয়েরা ভেঙে পড়ে তার দিকে। রাতারাতি দাম বেড়ে যায় মানসীর।
তাও মানসীর না আছে রূপ, না আছে স্বাস্থ্য। কাঠির মতো সরু দেহ, বুক কোমর কিছুই নেই।
গীতা গুম হয়ে বসে থাকে। বইপত্তর ছিটানো, স্কুলে যেতে মন সরে না। একটা মালিন্য তার সারা মনে কালো জমাট দাগ কেটে রেখেছে।
মাধববাবু ছাতা হাতে বেরুচ্ছেন, কাদম্বিনীর ডাকে ফিরে চাইলেন।
—গীতার দুখানা শাড়ি নাহলে চলবে কি করে? আর পাঁচজন শাড়ি গয়না পরে স্কুলে আসে। তাদের দেখাদেখি—
স্ত্রীর কথা শেষ হল না, মাধববাবু বলে ওঠেন—স্কুলে পড়তে যায়, না শাড়ি গয়নার ডিজাইন দেখতে যায় তোমার মেয়ে?
—তাই বলে সাধ আহ্লাদ নেই? তোমার সংসারের এই অভাব কোন দিনই মিটবে না, ওরা কি অপরাধ করেছে?
আচ্ছা কিনে দোব। দু’খানা শাড়ি বই তো নয়? দিও। মাধববাবু ব্যাপারটা চাপা দিতে চেষ্টা করেন।
স্ত্রী প্রশ্ন করে। –কোত্থেকে দেব! কত টাকা দিয়েছ এ মাসে চাল-ডাল হাটবাজার করতে?
মাধববাবু ট্রেনের শব্দ শুনে চমকে ওঠেন। এই নটা বাইশের ট্রেন চলে গেল! হন্তদন্ত হয়ে যেন পালাতে পারলে বাঁচেন। এই সময় বাড়িতে না থাকাই নিরাপদ। নীতাও নেই যে মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করবে। কাদম্বিনী তাই বকে চলবে বিনা বাধায়।
—ইস্ ফের দেরি হয়ে গেল স্কুলে।
মাধববাবু বের হয়ে পড়েন ছাতা বগলে বাড়ি থেকে।
কলকাতার রাস্তায় দশটার ভিড় শুরু হয়েছে। গিজগিজ করে মাথা; হন্তদন্ত হয়ে সবাই দৌড়োচ্ছে ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে। কেরানিকুল মহাতীর্থের পানে চলেছে দলবেঁধে! যেন বর্ষার নদী-নালা দু’কূল ছাপিয়ে বয়ে চলেছে বড় নদীর দিকে।
তারই ভিড়ে হারিয়ে গেছে নীতা। সকালে কলেজ সেরে এগিয়ে চলে কলেজ স্কোয়ারের পাশ দিয়ে শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের পানে। অপেক্ষাকৃত জনহীন এই গলির এ মোড় ও মোড় ঘুরে চুন-বালি খসা হলদে তেতলা বাড়িটায় ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
কেরানিকুলের মেস, ছাত্র-ফাত্র রাখে না তারা, বছরে চারমাস তাদের কামাই। মেসকমিটির লোকসান। তবু সনৎ এইখানে রয়েছে—তার কামাই নেই। ঘরবাড়ি চালচুলোহীন একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র। ওরা নেহাত দয়া করেই ঠাঁই দিয়েছে তাকে। দশটার বাবুরা সবে বের হচ্ছেন অপিসে। বয়স্করা কেউ কেউ গলির ফাঁক দিয়ে চিলতে আকাশ কোলে সূর্যের ইশারার পানে তাকিয়ে নমস্কার করেছে অপিস বের হবার আগে; অপেক্ষাকৃত ছোকরা কেরানির দল ধোপদুরস্ত কাপড় পরে চুলে শেষবারের মতো চিরুনি বুলিয়ে বের হচ্ছে।
—সনবাবু আছেন?
এমন সময় হঠাৎ নীতাকে ঢুকতে দেখে ছোকরা ফিরে তাকাল। প্রৌঢ় ভদ্রলোকের মুখেও বিরক্তির রেখা, সূর্যপ্রণামে বাধা পড়ল কে জানে অপিসে কি হবে! যা হাজিরার কড়াকড়ি, পড়ল বোধহয় লাল দাগ।
অন্য ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে ছাতা বগলে ছুটলেন রেশনের থলি হাতে। মেসের ঠাকুরকে শোনায়-
আজ ওবেলায় বাড়ি যাব ঠাকুর। সোমবার সকালে মিল নেবে।
নীতার দিকে তাকিয়ে দেখবার জবাব দেবার সময় কারোও নেই। অন্য জগতের লোক ওরা; ঘড়ির কাঁটাকে ধরবার জন্য ছোটে।
ছোটার বিরাম নেই। ছুটতে ছুটতে একদিন হুমড়ি খেয়ে পড়ে—ছোট্ট জগতের সীমা সীমিত হয়ে যায়। আর ওঠে না। জীবন-যন্ত্রণার শেষ হয়ে যায়।
দুড়দাড় বাবুরা বের হয়ে যাচ্ছেন।
ঠাকুর জবাব দেয় নীতার কথায়।
—সনবাবু? অছি পাড়া। সে নিচের ঘরকু যিও।
নিচেরতলায় এঁদো ঘর, একপাশে ইটের তাকমতো করে তাতে মেসের কাদের চটের বিছানা গাদাকরা, ম্যানেজারের আমকাঠের হাতবাক্স। অন্যদিকের তাকে বই, খাতাপত্র, সস্তা দামের আয়না। মেঝেতে শতরঞ্জি জড়ানো-বিছানা, পাশে একটা মাদুরে বসে সনৎ পড়ছে। হঠাৎ নীতাকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে যায়। কাঁধে একটা ব্যাগ, হাতে কলেজের বইপত্র। জুতোটা খুলে ভেতরে ঢোকে।
—তুমি এ সময়?
হাসে নীতা—কেন আসতে নেই?
সনৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সাধারণত দুপুর বেলায় আসে সে। বাবুরা মেসের নৈতিক চরিত্র বজায় রাখবার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। পুরুষের মেসে মেয়েছেলের আনাগোনা নাকি পাড়ার লোকেরা সহ্য করবে না। সনৎ যে একরকম এদের দয়াতেই আছে, তার এই জুলুম বেশি করেই ঠেকবে ওদের।
নীতা বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বলে ওঠে—রাখো।
—এমনি করে কত নেব বলতে পারো নীতা?
সনতের কণ্ঠস্বরে একটা সঙ্কোচ। হাসে নীতা।
—কেন, হঠাৎ সুমতি হচ্ছে নাকি? কথাটার মোড় বদলাবার জন্যই বলে ওঠে নীতা।
—বাবা কালই ছেলেদের তোমার কথা বলছিলেন। স্কলারশিপ পেতে হবে তোদের সনতের মতো। তারপর এম.এ পাশ করে রিসার্চ করবি। কত দিন যাওনি ওদিকে! কি ভাবছ সনৎ? জবাব দেয় সনৎ। –এম. এ. পাশ করে মাস্টার মশায়কে এবার প্রণাম করে আসব। নাই বা গেলাম কদিন, খবর তো পাই। আর যার জন্য যাওয়া সে তো আসে – mountain comes to Mohammad.
নীতা হাসে। –থাক, আর রসিকতা করতে হবে না। হ্যাঁ Jather Berry-র বই বলছিলে না?
—এদিকে যে আসছে মাসেই পরীক্ষা! নীতা প্রশ্ন করে।
—কি করা যাবে! সনৎ জবাব দেয়।
নির্জন মেস। কলরব কোলাহল, বাবুদের স্নান করার হুল্লোড়, খাওয়ার হাঁকডাক, খড়মের পটাপট শব্দ থেমে গেছে।… চা আর বিস্কুট আনে চাকরটা।
নীতা হাসে—বাজে খরচ করছ কিন্তু!
—অনেক সময় বাজে খরচ করেও আনন্দ পাই নীতা!
নীতা কথা বলল না, একবার চোখ তুলে তাকাতে কেমন যেন দুর্বার লজ্জা এসে বাধা দেয়! ঘামছে অকারণেই। সনৎ ওর এই ক্ষণিকের সচেতন মধুর একটি অনুনয়-ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নীতা অনুভব করে ওর দৃষ্টির স্পর্শ।
বাবার কথাটা মনে পড়ে : রূপ নেই, কালো মেয়েকে কে নেবে বল?
হাসছে সনৎ—কি হল হঠাৎ?
—কিছু নয়! নীতা নিজেকে সামলে নিয়েছে। মাথা-চাড়া দিয়ে ওঠে কর্তব্যপরায়ণ কর্মঠ মেয়েটি।
—এম. এ. পাশ করে কী করবে?
—আগে পাশই করি!
নীতা ধমকে ওঠে—মানে? ফার্স্ট ক্লাস পেতেই হবে। তারপর রিসার্চ করবে। বুঝলে?
—হুকুম? সনতের কণ্ঠস্বর হালকা হয়ে আসে।
—হ্যাঁ মশাই!
উঠে পড়ে নীতা। ওদিকে স্কুলে চাকরির সময় হয়ে গেছে। নিজের পড়াশোনা, তারপর কাজকর্ম—তবু আনন্দ পায় নীতা আর পাঁচজনের মুখে-হাসি ফুটুক। মনের কোণে একটা সুর জাগে; গুনগুনানি সুর।
সনৎ তাকে এগিয়ে দিতে আসে রাস্তা পর্যন্ত।
সুরের হালকা রেশটা তখনও মনে রয়েছে। সব কিছু যেন সুন্দর। ওই রোদমাখা গাছগাছালি লাইনের উপর বসে ল্যাজঝোলা পাখিটাকে কেমন ভালো লাগে। খালের বুকে ছোট নৌকার মাঝি ওকে কোন জগতে হারিয়ে যাবার ডাক আনে।
সবকিছু নিয়ে তার জগৎ—সুন্দর-সুরময়-বৰ্ণময়।
নীতা বাড়িতে পা-দিয়েই একটু বিস্মিত হয়। নিতা গুম হয়ে বসে আছে। বইপত্র চারিপাশে ছিটানো। মা গজগজ করছে।
—পড়াবে মেয়েকে? দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষছি। দোব ধরে এক-একটা কানা খোঁড়ার ঘাড়ে চাপিয়ে। হাঁড়ি ঠেলবে দুবেলা—আর শাশুড়ি ননদের খোঁটা-ঝাঁটা খাবে তবেই ঢিট হয়ে যাবে। তেজ মারব এইবার।
নীতা ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না; তবে একটা কিছু ঘটেছে তা বেশ অনুমান করতে পারে।
মন্টু ওদিকে দাঁড়িয়ে, মা ফেটে পড়ে তাকে দেখে
—পড়াশোনা গোল্লায় গেছে! এ বাড়ির সবই ওই ছন্ন! হবে না? বাপ কেমন!
নীতা ঘরের ভিতর সরে গেল। জানে একবার মায়ের মেজাজ চড়লে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে চড়ার দিকেই যাবে। বাবা এইটুকু জানেন, তাই এড়িয়ে যান সুযোগ পেলেই।
সব ধকল মায়ের উপর দিয়েই যায়। শত অভাব-অভিযোগে জ্বলছে, ছেলেমেয়েদের কিছু আব্দারের কথা সেই তাতের উপর ঘি-এর মতো ছিটিয়ে পড়ে; ধোঁয়া থেকে আগুন লকলকিয়ে ওঠে।
বড়দা শঙ্কর বাড়িতে পা-দিয়ে মায়ের ওই বকাবকি শুনে বলে ওঠে—
—চুপ করবে তুমি? কাক-চিলও বসতে দেবে না’ বাড়িতে?
শঙ্করের নেশা এখন গান শেখা—রেওয়াজ করা। পেশা বর্তমানে কিছুই নেই। ভবিষ্যতে কি করবে তাও অজানা, তা নিয়ে ভাবনাও করে না। বেপরোয়া। দিনরাত রেওয়াজ করা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বাঁ-হাতে রঙিন সুতো বাঁধা, কোন খাঁ-সাহেবের কাছে ন্যাড়া বেঁধে শাগরেদ হয়েছে। পরনে ঢোলা পাঞ্জাবিটা খুলে হ্যাঙ্গারে-টাঙিয়ে রাখে যেন গিলের ভাঁজটুকুও নষ্ট না হয়। সবে ধন নীলমণি, এইটি সম্বল। পায়ের চটিটা পালিশ করতে বসে।
কাদম্বিনী জবাব দেয়—আমার কথাগুলোই শুনতে পাস না?
শঙ্কর জোরে জোরে পালিশ বুলোতে থাকে। বলে ওঠে—
—উহুঁ, বাবা শুনব না? সাধা গলা। উদারা-মুদারা ছেড়ে তারায় গিটকিরি—সপাট তান করছ। এইবার খেয়ালের রেওয়াজ করো মাদার। দিনে চারটি ঘণ্টা ব্যাস! … গঙ্গুবাই হাংগল।
জ্বলে ওঠে কাদম্বিনী ছেলের কথায়, কি উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেল। ডালটা উনুনে পুড়ছে বোধহয়, গন্ধ ছাড়ছে। শশব্যস্তে ঝগড়াটা আপাতত মুলতুবি রেখে রান্নাচালার দিকে ছুটল।
হাসতে থাকে শঙ্কর—দেখলি তো! বাব্বা! কি বলেছিলি রে তোরা মাদারকে? একেবারে ফায়ার!
বাড়িতে একটু শান্তি ফিরে আসে, পরিবেশটা বদলে যায় শঙ্কর আসার পর থেকেই। নীতা খোঁপাটা খুলে স্নান করবার আয়োজন করছে। ওর দিকে এগিয়ে যায় শঙ্কর; দুটো আঙুল ঠোঁটের কাছে ধুম-পানের ভঙ্গিতে রেখে বলে ওঠে—
—কিসসু নেই। গোটাকতক পয়সা ছাড় না!
কি ভেবে নীতা ব্যাগ থেকে একটা সিকি বের করে দেয়!
শঙ্কর ব্যাগটার দিকে উঁকি মেরে বলে ওঠে,
—ইস্ এত টাকা পেলি কোথায় রে? স্কুলের মাইনে বুঝি? তা দে এক পাত্তিই দে না?
উহুঁ, একটা চাকরি-বাকরির চেষ্টা দেখো। বুঝলে?
সিকিটাকে হাতে এপিঠ-ওপিঠ দেখতে থাকে শঙ্কর। জবাব দেয় কি ভেবে-
—চাকরি! ক’টা মাস যেতে দে। ওস্তাদ রেডিওতে চান্স করে দেবেন বলেছেন। শিল্পীর চাকরি করা সাজে না। একবার নাম বেরোলে হয়। জানিস আমীর খাঁ এক সিটিং-এ কত পান? বারোশো টাকা! দু’ঘণ্টায় বাবার একবছরের রোজগার তুলে নেন। একবার ঠেলে উঠতে দে, দেখবি তারপর। পয়সা আশমানে উড়ে বেড়াচ্ছে। ধরে নিতে পারলেই বাস!
হাতের সিকিটা নখের টোকা দিয়ে আশমানে তুলে খপ করে ধরে ফেলে শঙ্কর পকেটস্থ করে।
সত্যি? নীতা বলে ওঠে, কি যেন স্বপ্ন দেখছে শঙ্কর। গীতা-মন্টুও!
নীতা ওদের দিকে চেয়ে আছে। গীতার পরনের শাড়িটা ছেঁড়া, মুখে-চোখে কি একটা আশার দূরাগত আলোর আভা।
নীতা বলে ওঠে—কাল শহরে যাবি গীতা? কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
গীতা চেয়ে ওঠে—তাই চল দিদি!
মন্টু তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে, ওকে কাছে টেনে বলে ওঠে নীতা—কিরে, তোর কি চাই?
মন্টু দিদির কানে কানে কি বলে।
হাসছে নীতা। এই তার জগৎ!
কাদম্বিনীর গলা শোনা যায়—চান-টান করবি, না হেঁসেল আগলে সারাদিন বসে থাকব?
–যাই মা!
বাড়ির সেই কঠিন কঠোর পরিবেশটা বদলে গেছে। আবার সকলের মনে সুর জাগে, মুখে হাসি ফোটে।
শঙ্কর চটি পালিশ করতে করতে বলে ওঠে—
—ওই যে পাত্তির কথাটা বললাম, মনে রাখিস কিন্তু! আবার গুনগুন সুরে শঙ্কর চটি পালিশ করতে বসেছে।
জীবনের স্রোত বয়ে চলেছে। মানুষের ভিড়।
হাজারো মানুষের মনে হাজারো চিন্তার জট; মহাসমুদ্রে সবাই যেন একটি স্বতন্ত্র দ্বীপ। নিজের চারিপাশে স্তব্ধ নির্জন ঢেউভাঙা সমুদ্র। কোথাও প্রবালের রঙ, কোথাও মেঘঢাকা বৃষ্টিভরা আকাশ কোথাও সিন্ধুপারের উর্মি, তার ঢেউভাঙা গুঞ্জরণ।
হাজারো মানুষ চলেছে তবু তারা স্বতন্ত্র, সবাকার অস্তিত্ব মিলে একটি স্রোতমুখর মহাজীবনধারা
মন্টু-গীতা আর নীতা একগাদা জিনিসপত্র কিনে কলেজ স্কোয়ারে ঢুকেছে। একচিলতে সবুজের নিশানা—পুকুরের জলে দামাল ছেলেদের ঝাঁপাঝাঁপি। বাইরের কর্মব্যস্ত জীবন এই চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে যেন বদলে গেছে। পোশাকি নয়—কেমন ঢিলে-ঢালা চলন। বউ-ঝিরা ছেলেপুলেদের নিয়ে এসেছে, কোথাও বসেছে কথকতার আসর। অলস-মন্থর গতিতে বয়ে চলেছে এখানের স্রোত।
দুটো বেঞ্চে পাকামাথা টেকো কজন ভদ্রলোক লাঠি রেখে বসে খোসগল্প করছে। অবসর জীবন!… কয়েকটা কলেজের ছেলে হাসি-গল্প করতে করতে চলেছে। কে যেন মালকোঁচা মেরে ওই ভিড়ের মধ্যেই হারানো যৌবনকে ধরবার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ঘুরপাক দিচ্ছে।
—কি হে, বসবে না সামন্ত?
সামন্ত চলতে চলতে জবাব দেয়—উহুঁ, মোটে তিন পাক হয়েছে গোলদিঘির পাঁচ-পাক না দিয়ে বসব না।
—তাহলে সাতপাকে বাধা কি হে? রসিকতা করে প্রৌঢ় সঙ্গী বেঞ্চে বসে বসেই।
মন্টুর হাসি আর ধরে না, গীতাও খুব খুশি। উপচে পড়ছে যেন নীতা।
—ডালমুট খাবি?
নীতার কথায় গীতাই বলে উঠে—উহুঁ, আলুকাবলি বেশ খাট্টা দিয়ে।
মন্টু পয়সা নিয়ে আলুকাবলিওয়ালা খুঁজতে যায় পুকুরের ধারের চাতালের রেলিং টপকে। আজ নীতা একটা দুঃসাহসিক কাজ করছে। প্রথম মাইনে টিউশানি আর বৃত্তির টাকা পেয়ে বেশ একটু খরচ করে ফেলেছে ওদের কাপড়-চোপড়, বইপত্র আরও কিছু কিনে। মন্টু, গীতা আর দাদার কথা ভোলেনি সে। মা আর গীতার জন্য ভালো শাড়ি কিনেছে। জমকালো রঙে গীতাকে মানায় চমৎকার। নতুন ডিজাইনের কটকি শাড়িটা পছন্দ করে কিনেছে সে। রুচিজ্ঞান আছে গীতার।
আলুকাবলি খাচ্ছে তিনজনে বসে। নীতাও যেন ওদের হাসি আর আনন্দের মাঝে নিজে ওদের দলে ভিড়ে গেছে।
আবছা আলো পড়েছে পুকুরের জলে, সেই আলোর বিচ্ছুরণ গীতার ফরসা পুরুষ্ট দেহে ও কোঁকড়ানো একরাশ চুলে। মন্টুর বগলে সদ্যকেনা বুটের জোড়াটা। মাকে বলেছিল কাল কিনে দিতে, মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
—এমনি জুতো জোটে না, তায় জুতো পরে বল খেলবেন?
হাসছে মন্টু মায়ের কথাটা স্মরণ করে!
—জানিস বড়দি, মা বলে জম্বুরা লইয়া খেলস। সামনের বছর ডিভিশনে খেলবই দেখবি।
হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে—অ্যাই বড়দি, সনৎদা যাচ্ছে, ওই যে
মন্টু আলুকাবলির ঠোঙা সমেত উঠে দাঁড়িয়েছে—ডাকব?
সনৎ চলেছে, একটা সাদা পাঞ্জাবি গায়ে, পায়ে পুরনো স্যান্ডেল। বগলে কতকগুলো বই নিয়ে আনমনে যাচ্ছে সে।
নীতা যেন চমকে ওঠে—না! থাম তুই।
কিন্তু আর উপায় নেই। মন্টুর গলা শুনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ জলের পাশে একঝাঁক ফুটন্ত লাল ক্যানা ফুলের কেয়ারির পাশে ওদের দেখে এগিয়ে আসে।
—তোমরা?
হঠাৎ চোখ থেমে যায় গীতার দিকে তাকিয়ে। এক ঝিলিক আলো ওর চোখের তারায়। কি যেন একটা মাধুর্য ঝরে পড়ে। ওর দেহ ঘিরে প্রথম যৌবনের জাগরণী সুর, দেহ-মনে ওর শ্যাম উপবনের নিশানা, পাখির ডাকা কোন্ সুরের রেশ।
একটি মুহূর্ত! চমকে ওঠে সনৎ!
সামলে নিয়ে এগিয়ে যায় সে।
—হ্যালো, লেডি অব দি লেক উইথ আলুকাবলি, কতদিন পর দেখলাম তোমাকে! গীতা কৃত্রিম কোপে যেন ফেটে পড়ে-থাক থাক, আর বাজে বকতে হবে না। যেতেই মনে থাকে না, আবার কথা?
নীতা সনতের দিকে তাকাল অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে, সনৎ রেলিং টপকে এসে ওদের পাশে বসল।
—সদলবলে মার্কেটিংএ বুঝি?
নীতা কিছু বলবার আগেই মন্টু জবাব দেয়—হ্যাঁ বুটজোড়াটা দেখবেন? গ্র্যান্ড, স্মুথ রানিং পাইক।
সনৎ হাসে–থাক, থাক, ওসবের কিছু বুঝি না।
নীতা মাথা নামাল সনতের দিকে তাকিয়ে, কেমন যেন একটা লজ্জার আভাস জেগে ওঠে। এতদিন পরে ওদের সামনে সনতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করতে বাধে তার।
গীতাই বলে ওঠে,—আপনার মেস কতদূর এখান থেকে?
—কাছেই, শ্রীগোপাল মল্লিক লেনে।
—চলুন দেখে যাই, গীতার সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে একটু যেন লজ্জায় পড়ে সনৎ। নীতার দিকে তাকাল অসহায় দৃষ্টিতে।
নীতা জানে ওর অবস্থার কথা। এঁদো ঘর—এক পাশে মেসের ঠাকুর তার সঙ্গী। কেরোসিন কাঠের নড়বড়ে টেবিল, আর মেসের বাবুদের সেই তীব্র কটাক্ষ, এসবের মাঝে সনৎ খুবই বিব্রত বোধ করে। তারপর তিনজন গেলে নিদেন তিন কাপ চাও আনাতে হবে। এক দিনের জলখাবারের খরচা।
তবু বলে ওঠে সনৎ, –বেশ তো, চলো!
নীতা বাধা দেয়—সন্ধ্যা হয়ে গেছে গীতা, সামনে পরীক্ষার পড়া। আপনার মেসে গেলে অনর্থক সময় নষ্ট হবে। পরে আসা যাবে একদিন, আজ থাক!
গীতা দিদির দিকে তাকিয়ে থাকে। দিদিটা যেন কি! একটা দিন ছাড়া পেয়েছে গীতা। টই টই করে শহরময় চষে-ঘুরে বেড়াবে, তা নয় সন্ধ্যাবেলা থেকেই বাড়ি ঢুকতে হবে। খুশি হতে পারে না গীতা।
উঠে পড়ে। রাস্তা দিয়ে চলেছে তারা।
মন্টু আর গীতা আগে আগে চলেছে।
সনৎ বলে ওঠে নীতাকে—ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলে আজ।
কালো মেয়েটি ডাগর চোখ মেলে বলে ওঠে—ঠিকই করেছি হয়তো।
কথা কইল না সনৎ, নীতার কাছে তার খবর নিবিড়ভাবেই জানা। হঠাৎ নীতা প্রশ্ন করে, —বইগুলো কিনেছ? জেথার বেরির বই?
সনৎ জবাব দেয়।—লাইব্রেরি থেকে নিয়ে চালাতে হবে।
—থাক! নীতা বই-এর মোড়কটা এগিয়ে দেয় তার দিকে।
–দেখা না হলে আসতে হতো অন্যদিন। এটা রাখো!
—নীতা!
অবাক হয়ে যায় সনৎ, কোন্ টাকা থেকে এ বই কেনা তা জানে সনৎ, কি বলতে যায়, মন্টু আর গীতার দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দেয় নীতা।
—চুপ করো, ওরা শুনতে পাবে।
সনৎ বই কখানা নিল ওর হাত থেকে, একটু স্পর্শ লাগে হাতে!
কালো কালো গড়ন, কপালে এসে পড়েছে দু-একগাছি ঘামে ভেজা পাতলা চুল। দু’চোখে আবছা আলোর দীপ্তি, পুষ্ট হাতে একগাছি পাতলা কঙ্কন। নিরাভরণা, কিন্তু মনের শ্রী শুচিতা বুদ্ধির দীপ্তি ওর সব কালো ছাপিয়ে নিটোল কামনার রূপবতী কন্যায় পরিণত করেছে।
মাঝে মাঝে এই জনতার মাঝে অতি পরিচিত এই মেয়েটিকে মনে হয় দূরের মানুষ। নীল আকাশের তারার মতোই অধরা সে।
রাত্রির ট্রেন শহরের উপকণ্ঠের হাজারো বাসিন্দার ভিড়ে ভরে উঠেছে। সারাদিন সেই দশটা- ছটার বোঝাটানা কাজ সেরে ফিরছে কেরানি, দোকানদার টাট বন্ধ করে চলেছে। মেয়েদেরও অনেকেই রয়েছে ট্রেনে। তাদের কেউ অপিসে চাকরি করে, রাত্রে কলেজ সেরে, সারাদিন পর ফিরছে কর্মক্লান্ত দেহ-মন নিয়ে। কেউ এসেছিল চাকরির উমেদারি করতে, হতাশ হয়ে ফিরছে। তাদের টুকরো কথার আলোচনা কানে আসে। ট্রেনেই জীবন সংগ্রামের ইতিহাসটা বোঝা যায়। সেই ভিড়ের মধ্যেই ওরা বিকিকিনিও করছে।
হাতকাটা তেল, সার্জিক্যাল অয়েল আর আছে কবিরাজ কালিপদ দের আশ্চর্য মলম। কাটা ঘা, পোড়া ঘা, নালী ঘা, খোস, যাবতীয় বিষাক্ত ক্ষতে—গড়গড় করে আবৃত্তি করে চলেছে।
নীতা অবাক হয়ে যায়—পরেশ!
পরেশ সুটকেশ হাতে ভিড় ঠেলে এইদিকে এসেছে।
বাবার অন্যতম ছাত্র, পরেশ গলা নামিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
মুখে-হাসি ফুটে ওঠে তার—হ্যাঁ, পরীক্ষা দিয়ে কিইবা করি? লেগে গেলাম একটা কাজে—যা হয়।
পড়তে পারবে না আর, এখন থেকেই ক্যানভাসারি শুরু করেছে। পরেশ সহজভাবেই প্রশ্ন করে নীতাকে।
—কলকাতা গিয়েছিলে? মাস্টার মশায়ের শরীর ভালো?
ট্রেনটা ধিকিয়ে ধিকিয়ে চলেছে ঠাস বোঝাই যাত্রী নিয়ে।
পরেশের দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা কইবার ফুরসতও নেই, বলে ওঠে—যাই নীতাদি, দেখি গে দুটো কামরা।
কঠিন কঠোর জীবনের দুর্বার ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়ে চলেছে সবাই। বাঁচবার, দুমুঠো খাবার সমস্যাই বড়। চাকায় চাকায় শব্দ ওঠে ট্রেনের গতিবেগের। আঁধার ফুঁড়ে গাড়িখানা চলেছে। চলতি গাড়ির পা-দানিতে ভর করে এ কামরা থেকে ও কামরায় চলে গেল পরেশ, একটু অসতর্কতা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু।
তবু সাবলীল গতিতে সে চলেছে—বেপরোয়া। দুর্দম গতিশীল একটা পদার্থ অভাব আর ধ্বংস। তারই ওপর ভর দিয়ে টপকে চলেছে ওদের বাঁচবার সংগ্রাম। পরেশের কথা ভাবছে নীতা।
বাড়িতে পা দিয়েই দেখে এক পশলা হয়ে গেছে বোধহয়। বাবা চুপ করে বসে রয়েছেন, সামনে একগাদা পরীক্ষার খাতা ছড়ানো, দেখবার মতো মানসিক প্রস্তুতি তাঁর নেই। বাড়িতে ইতিমধ্যে বাবার সঙ্গে মায়ের রীতিমতো একচোট বচসা হয়ে গেছে, যদিও সবটা একতরফাই তবু গুম হয়ে আছেন মাস্টারমশাই, কাদম্বিনী অপেক্ষা করছে ওদের ফেরার, পরের অধ্যায় তখনও মুলতুবি রয়েছে। কাদম্বিনী ওদের দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নীতা সরে গেল, বেশ বুঝতে পেরেছে ওর মুখ দেখে।
গীতা—মন্টুর ওদিকে খেয়াল নেই। গীতা মায়ের সামনে শাড়ির পাট ভেঙে দেখাতে থাকে।
—কেমন চমৎকার হয়েছে দেখ দিকি মা? দিদির টেস্ট আছে বলতে হবে। এই বড়দার পাঞ্জাবি আর পায়জামার কাপড়।
মন্টু মায়ের সামনে বুটের ফিতে ধরে দোলাতে থাকে; তুমি তো দাওনি তবু জুটে গেছে—ভাবখানা এমনি আর কি!
কাদম্বিনীর মন-মেজাজ এমনিতে ভালো ছিল না। মুদির দোকানের বাকি টাকা মাসকাবার না হলে শোধ হবে না, এদিকে চাল কিছু চাই; আনতে গিয়ে নবীন মুদি যা-তা বলেছে তাদের তাই নিয়েই বচসার সূত্রপাত হচ্ছে এতক্ষণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।
তার মধ্যে হঠাৎ এতগুলো টাকা অপব্যয় করে আসতেই যেন ফেটে পড়ে কাদম্বিনী। ছেলেমেয়ে সবাই আলাদা ধাতে গড়া। হাত কামড়ে মাথা ঠুকে মরতে ইচ্ছে করে। তারা জানে না—এই বিলাসিতার এই সাধারণ স্বাভাবিক দাবিটুকু মেটানোর অধিকার তাদের কাছে দুরাশামাত্র সমস্যা তাদের একটাই। দুবেলা দুমুঠো ভাত আর পরনে কোনমতে একখানা কাপড়; এর বাইরে কিছুর আশা করা ওদের অপরাধ।
নীতা ঘরের ভিতর জামাকাপড় ছাড়ছে; গরমে ট্রেনের ধকলে হাঁপিয়ে উঠেছে। ভিজে গেছে ঘামে জ্যাবজেবে হয়ে ব্লাউজ পর্যন্ত; নিচের জামাটা খুলে যেন স্বস্তি পায়। আজ মনে মনে একটা স্বস্তি পেয়েছে—সংসারে তারও ঠাঁই আছে। দাম আছে। দাদা, ভাই, বোন, সনৎ, সকলের জন্যই তার ভাবনা। সুখী হোক তারা। সনতের দু’চোখে সেই কৃতজ্ঞতার ছাপ ভোলেনি, তার দুর্বার একক সংগ্রামে সেও সঙ্গী হতে পেরেছে—এ এক নিবিড় তৃপ্তির স্পর্শ আনে তার সারা মনে।
হঠাৎ বাইরের আনন্দধ্বনি থেমে গেছে।
মায়ের কঠিন স্বর শোনা যায়—পেটে ভাত নেই জলে কপ্পুর। এমনি করে মুঠো মুঠো টাকা ছিটিয়ে আসবে অকারণে তোমার ওই সোহাগি মেয়ে?
অন্ধকারে মায়ের কঠিন স্বর শুনে ঘরের মধ্যে চুপ করে দাঁড়াল নীতা। ব্যাপারটা যে এতদূর অবধি গড়াবে তা সে কল্পনাও করেনি।
মাধববাবু পরীক্ষার খাতা থেকে মুখ তুললেন। একটা জায়গাতে মাঝে মাঝে মাধববাবু কঠিন হয়ে যান; সেটা তাঁর জীবনের আদর্শবাদের ক্ষেত্রে। পরিষ্কার বোঝাপড়া করতে পারেন সেই জায়গায়, কঠিন হতে পারেন। অন্যত্র তা পারেন না।
নীতার বেলাতে তাঁর একটা বক্তব্য আছে। আশপাশে আরও মেয়েদের দেখেছেন, আগেকার নিশ্চিন্ত জীবনের কথাও মনে পড়ে। নিজে মেয়ের বিয়ে দিতে পারেননি উপযুক্ত পাত্রে; তার শখ-সাধও মেটাতে অক্ষম তিনি। পড়াশোনা করছে নীতা—তবুও সে-ই নিজের খরচ জোগাচ্ছে নিজের পরিশ্রমেই। সংসারের কাছে তার কোনো ঋণ নেই, সংসারের দাবিই বা থাকবে কোত্থেকে?
কাদম্বিনীর কথাতে স্থির কণ্ঠে জবাব দেন—তোমার টাকা নয়, তার নিজের টাকা খরচ করেছে সে।
—তুমি কিছু বলবে না?
—কি করে কিছু বলি বলো? নিজেরই দেওয়া কর্তব্য। সেগুলো করতে পারি না; ও যদি করে, বাধা দেবার আমি কে?
মাধববাবুর কণ্ঠে অসহায় ভাব; স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করেন।—কোনো অন্যায় তো সে করেনি। তবে বলতে পারো একটু বেশি খরচ করে ফেলেছে।
কাদম্বিনী কোনো যুক্তি-তর্ক মানতে চায় না। তাই বলে ওঠে।—সোহাগ দিয়ে ওই মেয়ের মাথা তুমিই খাচ্ছো বলে রাখলাম। তাও যদি রূপ থাকত! পরের ঘরে পাঠাতে পারলে নিশ্চিন্ত হতাম। তাও কি যাবে আপদ? হাড়মাস জ্বালিয়ে খাবে। যেমন রূপ বাড়ছে—তেমনি গুণও মরি মরি!
বাড়িতে একটা স্তব্ধতা ফুটে ওঠে; গীতা পড়তে বসেনি। মন্টুও।
…মা ঘর থেকে বের হয়ে এসে হেঁকে ওঠে, গীতা-গা মুছতে ব্যস্ত। মায়ের কথাগুলো কানে আসে।
—নে, খুব হয়েছে। এইবার পড়তে বসে কেতাখ করো! দিনরাত রূপ আর তারই লেপাপোছা চলেছে। কালে কালে কত আর দেখব।
বাবার প্রতিবাদ শোনা যায়—আঃ, কি বলছ যা তা!
—ঠিক কথাই বলছি।
কাদম্বিনী রান্নাচালায় গিয়ে ঢোকে।
ভাঙা সুর তবু জোড়া লাগে না। ওরা পড়ছে। নীতা বই খুলে বসে আছে—মন বসে না। মা এর চেয়ে মুখোমুখি তাকে কিছু বললে হয়তো ভালো করত—বাবাকে বলবার, দুঃখ দেবার জন্যই মনটা ভার হয়ে রয়েছে নীতার।
স্তব্ধ বুকচাপা পরিবেশে, আঁধার আর হতাশার মাঝেও কেমন একটা মিষ্টি স্পর্শ জেগে আছে।
একটা সুর ওঠে! আঁধারের মাঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে সুরটা।
বাড়ির আবহাওয়া বদলে যায় শঙ্করের আসার সঙ্গে সঙ্গেই! কাপড়গুলো দেখে বলে ওঠে—নাইস!
নাইস কাপড় এনেছিস যে নীতা! না, তোর পছন্দ আছে। মেনি থ্যাঙ্কস্! কি রে, চুপ করে আছিস যে?
নীতা জবাব দেয়—এমনিই!
—উহুঁ, মাদার কিছু বলেছে নির্ঘাত।
পরক্ষণেই শঙ্কর সব কিছু যেন ফুঁ-দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
—আরে ধ্যুৎ, মা যা বলবার বলুক, তুই যা করবি করে যা। চল, খাবি না?
দাদার কথায় উঠে পড়ে ওরা সবাই, নীতার খাবার ইচ্ছে নেই। সামান্য কথা কাটাকাটির পর না খেতে বসলে দাদা এখুনি বাড়ি মাথায় তুলবে। আশপাশের বাড়িতে আলোচনাও শুরু হবে। বয়স্থা মেয়েকে মা কি নিয়ে যেন বকেছে—মেয়ে না খেয়ে রইল। যদি কলকাতার আরও কোন কথা বের হয়ে পড়ে কলোনিতে, বেশ রসালো আলোচনার খোরাক হয়ে উঠবে সকলের কাছে।
সাত-পাঁচ ভেবেই নীতা উঠে বসল।
—চলো!
বাড়িটা স্তব্ধ। বাবার ঘরে আলো নিভে গেছে। চারিদিক কেমন নিঝুম। কোথায় রাতের ট্রেনখানা একটা শব্দ তুলে বের হয়ে গেল।
খেতে বসে ওরা, শঙ্কর বকবক করছে।
—ওস্তাদ দরবারি কানাড়া দিয়েছেন, বুঝলি? ভারি মিঠে রাগ, রেওয়াজ করব শুনবি তখন।
গলা খাটো করে বলে ওঠে শঙ্কর—হ্যাঁরে? কাল দিবি তো একপাত্তি?
ভাত মাখতে মাখতে জবাব দেয় নীতা।
—মাকে সব দিয়ে দিইছি, আমার হাতে আর কিছুই রাখিনি।
শঙ্কর একবার বোনের দিকে তাকাল, না ওর চোখ দেখে বুঝতে পারে মিছে কথা বলেনি। হতাশ হয় সে।
—যাঃ, তুই একটা আস্ত ইডিয়ট, টাকা হাতছাড়া যে করে সে একটা ফুলস্কেল ইডিয়ট।
নীতা কথা বলে না, ভাতগুলো নাড়াচাড়া করে অন্য মনে।