মাষ্টার স্টোরী টেলার ‘ও হেনরি
উইলিয়াম সিডনী পোর্টার (William Sydney Porter)-এর জন্ম হয় তাঁর ১১ই সেপ্টেম্বর ১৮৬২
গ্রিন্সবরো, নর্থ ক্যারোলাইনা, কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা (বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র)।
তিনি ও হেনরি( ও হেনরি, অলিভিয়ার হেনরি, অলিভার হেনরি) ছদ্মনাম লেখা লেখি শুরু করেন জেলে থাকার সময়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই এই ছদ্মনাম নেন। রসিকতা, বিশেষ ধরণের চরিত্রায়ন ও গল্পের শেষে টুইস্টের জন্য বিশ্ব সাহিত্যে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আলোচিত একজন ছোট গল্পকার। তিনি আমেরিকান জীবনযাপন নিয়ে প্রায় ছয়শোর মতো গল্প লিখেছেন।
অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া ছেড়েছিলেন পনেরো(১৫) বছর বয়সেই। কখনও সাপ্তাহিক পত্রিকার ব্যবস্থাপক, কখনও কলাম লেখক, আবার কখনও ওষুধের দোকানের কর্মচারী হয়ে কাজ করেছেন , পরে ব্যাংকের কেরানি সহ বিভিন্ন ধরণের চাকরি করেছেন উইলিয়াম সিডনী পোর্টার(হেনরি)।
১৮৯৬ সালে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে উইলিয়াম সিডনী পোর্টার(হেনরি) পালিয়ে যান। পরে স্ত্রীর অসুস্থতার খবর শুনে, লুকিয়ে বাড়িতে দেখা করতে এলে পুলিশ তাকে হাতে-নাতে ধরেন। বিচারে তার পাঁচ বছর জেল হয়ে যায়। এইসময় তিনি এই জেলের ভিতরে বসেই লেখালেখি শুরু করেন।
জেলে বসে ‘অলিভার হেনরি’ ছদ্মনামে গল্প লিখে পোষ্ট করতে থাকেন পত্র পত্রিকায়। মোট চোদ্দটি গল্প লিখে পাঠিয়েছিলেন সে সময় তিনি। পত্রিকাওয়ালারা জানতেন না যে গল্পের লেখক একজন আসামী।
তবে তাঁর ভাল আচরণের জন্য তিন বছর পরেই জেল কতৃপক্ষ তাকে মুক্তি দেন। মুক্তি পেয়েই উইলিয়াম সিডনী পোর্টার(হেনরি) আবার ফিরে যান মেয়ে মার্গারেটের কাছে। মেয়ে জানতো না বাবা জেলে ছিল এতদিন, জানতো বাবা ব্যবসার কাছে বাইরে ছিলেন।
বিষয়বস্তুর গভীরতা, শব্দের নিপুণ খেলা, নিখুঁত চরিত্র চিত্রায়ন ও চমকপ্রদ পরিসমাপ্তি ছিল তাঁর গল্পের মূল সম্পদ। তাঁর গল্পগুলো খুব আকর্ষণীয় এবং মর্মস্পর্শী। তাঁর গল্পে ফুটে ওঠে একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন সংগ্রাম, তাঁর লেখায় বিচিত্র পেশার মানুষের দেখা মেলে, জীবনের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হাসি-কান্নার ছবি ধরা পড়েছে তার গল্পে। সবক্ষেত্রের মানুষকে নিয়েই ও. হেনরি গল্প লিখেছেন। তবে তাঁর গল্পের একটি অসাধারণ বিষয় হলো তিনি কখনোই কোনও মানুষকে, খারাপ মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেননি। তাঁর গল্পের পাত্রপাত্রীরা এতই সাধারণ স্তরের যে পড়তে গেলে মনে হবে এরা তো আমাদের চারপাশেরই মানুষ।
জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে ওঠেন বেশ প্রভাবশালী একজন লেখক। তাঁর গল্প বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর গল্প বিভিন্ন দেশের পাঠ্যক্রমে স্থান পেয়েছে। কেননা তাঁর গল্পের মধ্যে আছে মনুষ্যত্ববোধ ও নীতির শিক্ষা৷ এইজন্য তাকে ‘মাষ্টার অফ স্টোরী টেলার’ বলা হয়ে থাকে।
তাঁর ‘উপহার’ (The Gift of the Magi) গল্পের কাহিনী সংক্ষেপে এইরকম।
ডেলা আর জিম দম্পতি, বড়দিন উপলক্ষে দু’জনে দুজনকে উপহার দিতে চায়। কিন্তু দুজনেরই অভাব। হাতে তেমন অর্থ নেই। ডেলার ছিল লম্বা চুল যা জিম খুব ভালবাসতো, আর জিমের ছিল পূর্ব-পুরুষের দেয়া সোনার একটি ঘড়ি যা সে খুব ভালবাসত। দুজনই দুজনের জন্য উপহার কেনে। ডেলা তার লম্বা চুল বিক্রি করে জিমের সোনার ঘড়ি ঝোলানোর জন্য প্লাটিনামের চেন কেনে, আর জিম তার বাপ-দাদার সোনার ঘড়ি বেচে ডেলার জন্য উপহার আনে চুলের চিরুনি ও সোনার ক্লীপ। এরচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার আর কি হতে পারে?
হেনরি তাঁর এক-একটা গল্পে একেক রকমের চমক হাজির করতে পারেন। এই জন্যই গল্পকার হিসাবে তাঁর যেন জুড়ি মেলা ভার।
লেখকের আরেকটা গল্প।
গল্পটার নাম ‘শেষ পাতা’ (The Last Leaf)।
এই গল্পে জনসি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। ডাক্তার তার বন্ধু স্যুকে বলেছিল বাঁচবার আশা নেই। শুধু যদি জনসির নিজের বাঁচার ইচ্ছা তীব্র করতে পারে, তবেই হয়তো বাঁচতে পারে। কিন্তু জনসি স্যুকে বলে তার বিছানার পাশে জানালা দিয়ে যে গাছটা দেখা যাচ্ছে, সেই গাছের শেষ পাতাটা যেদিন ঝরে যাবে সেদিন সেও মারা যাবে। অল্প কিছু পাতা নিয়ে বড় গাছটা দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে তখন। কিন্তু একে একে সব পাতা ঝরে গিয়ে, টিকে থাকে মাত্র চারটি পাতা । জনসি ভাবে কাল সকালেই সবগুলো ঝরে যাবে। কিন্তু সকালে উঠে দেখে, শেষ অবধি একটা পাতা টিকে থাকে, ঝরে না। জনসিও সুস্থ হয়ে ওঠে। তারপর জনসি জানতে পারে একটা পাতা নিয়ে গাছটার ছবি এঁকেছেন তারই বাসার ওপরতলায় থাকা আরেক শিল্পী বেরম্যান। এটাই তার জীবনের শেষ ছবি, কারণ এই ছবিটা আঁকার পর বৃষ্টির রাতে ভিজে সেখানে রাখতে গিয়ে নিউমোনিয়া হয় বেরম্যানের। এবং সে মারা যায় শেষপর্যন্ত।
জীবদ্দশাতেই ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ব সাহিত্যের জগতে একটি জনপ্রিয় নাম। তার জীবদ্দশায় মুক্তি পায় তিনটি নির্বাক ছবি- ‘দ্য স্যাক্রিসাইস’ (১৯০৯), ‘ট্রাইং টু গেট এ্যারেস্টেড’ (১৯০৯) ও ‘হিজ ডিউটি’ (১৯০৯)। তার লেখা অবলম্বনে নির্মিত আরও দুটি বিখ্যাত ছবি হলো ‘দ্য এ্যারিজোনা কিড’ (১৯৩১) ও ‘দ্য কিসকো কিড’ (১৯৩১)।
১৯৫২ সালে পাঁচটি গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ও হেনরিস ফুল হাউস’। এতে স্থান পেয়েছে ‘দ্য কপ এ্যান্ড দ্য এ্যান্থেম’, ‘দ্য ক্লারিওন কল’, ‘দ্য লাস্ট লিফ’, ‘দ্য রানসাম অব রেড চিফ’ ও ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’।
তাঁর লেখা — ‘উপহার’ (The Gift of the Magi), ‘সুর ও বেসুর’, ‘শেষ পাতা’ (The Last Leaf), ‘বিশ বছর পর’, ‘প্রেম, ঘড়ি ও খলিফা’, ‘সাজানো ঘর’, ‘কুবের ও ফুলশর’, ‘বিশ্ব নাগরিক’, ‘প্রথম প্রেম’, ‘প্রকৃতির বিধান’, ‘জাত শহুরে’, ‘দালালের প্রেম’, ‘একটি অসমাপ্ত কাহিনী’, ‘সবুজ দরোজা’, ‘প্রেমের পূজায়’, ‘গরম অমিয় ভেল’
– এই গল্পগুলি সংগ্রহ করে পড়ে দেখতে পারেন গল্পপ্রেমী পাঠকরা। সবগুলো গল্পই অসাধারণ। পড়ে আপনারা আনন্দ পাবেন নিশ্চিত। এর মধ্যে আমার খুব ভাল লেগেছে ‘উপহার’, ‘সুর ও বেসুর’, ‘শেষ পাতা’, ‘সবুজ দরোজা’, ‘বিশ্ব নাগরিক’।
কিন্ত বড় আপসোসের কথা, মাত্র সাতচল্লিশ(৪৭) বছর বয়সে এই মহান গল্পকারের মৃত্যু হয় ৫ জুন ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্ব সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। বিশ্ব সাহিত্যের তিন দিকপাল গল্পকারের মধ্য তিনি ছিলেন অন্যতম একজন (বাকী দু’জন হলেন – ফ্রান্সের মোঁপাসা ও রাশিয়ার চেখব)।