Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মার্ডার ডট কম || Anish Deb

মার্ডার ডট কম || Anish Deb

০১.

মাউসে ডাবল ক্লিক করতেই মনিটরে রঙিন ছবিটা পালটে গেল। আর ঠিক তখনই পারফিউমের গন্ধ নাকে এল আমার। সুতরাং কিবোর্ডে আঙুল চালানো থামিয়ে মনিটরের দিক থেকে চোখ সরালাম।

বর্ষা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

কী দারুণ দেখাচ্ছে ওকে! গাঢ় নীলের ওপরে সাদা-ফুল চুড়িদার। গলায় সাদা ওড়না। কপালে টিপ, চোখে কাজল। নাকে সরষের দানার মতো নাকছাবি।

অফিসের কাজ ছাড়া আমার কাছে ও খুব একটা আসে না। আর যদিও বা হঠাৎ করে আসে, তো দু-পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না। আমিই বরং এই প্রোগ্রামটা কেমন যেন ট্রাবল দিচ্ছে, অমুক ফ্লপিটা কি তোমার কাছে আছে?, ম্যানেজারসাহেব ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে কোথায় গেলেন বলো তো!–এই সব ছলছুতোয় ওর সিটের কাছে যাই। সেখানে আশাবাদী দু-চারজন পুরুষের ভিড় সবসময়েই লেগে আছে। তাই আমার কেমন যেন লজ্জা করে। অথচ ওর কাছে না গিয়েও পারি না। ভেতর থেকে কে যেন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।

বর্ষার টেবিলের কাছে গেলেই আমার অস্কার পুরস্কারের কথা মনে পড়ে। দ্য নমিনিজ আর… বলেই চার-পাঁচটি নাম। আর তারপরই .অ্যান্ড দ্য অ্যাওয়ার্ড গোজ টু…। এই অফিসের চার পাঁচজন সেই অস্কার নমিনির মতোই ওর চারপাশে ঘুরঘুর করছে তার মধ্যে আমিও আছি। অ্যাওয়ার্ড শেষ পর্যন্ত কে পাবে জানি না।

রীতেনদা, একটা হেল্প করবেন?

এরকম মিষ্টি অনুরোধে সমরখন্দ-বোখারাও দিয়ে দেওয়া যায়। তাই বললাম, তোমাকে হেল্প করার জন্যে আমি আপাদমস্তক তৈরি। বলো, কী করতে পারি। ইট উইল বি মাই প্লেশার।

বর্ষা আমার পাশের একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর মুখে একটা ছেলেমানুষি কাঁচুমাচু ভাব ফুটিয়ে আবদারের গলায় বলল, আপনার মোবাইল ফোনটা একটু ইউজ করতে দেবেন?

আমি বুক পকেট থেকে নোকিয়া সিক্স-ওয়ান-ওয়ান-জিরোটা বের করে ওর হাতে দিলাম। বললাম, ইচ্ছে হলে সারাদিন রাখতেও পারো।

না, না–জাস্ট একটা ফোন করব। হাসল ও ও অফিসের ফোন থেকে কিছুতেই লাইন পাচ্ছি না।

বর্ষা আমার সামনে বসেই বোতাম টিপতে শুরু করল।

আমি কি সিট ছেড়ে উঠে যাব?

না, না, আপনি থাকতে পারেন। প্রাইভেট কিছু নয়…দিদির সঙ্গে একটু কথা বলব।

আমি কম্পিউটারে কাজ বন্ধ রেখে বর্ষাকে অনুভব করতে লাগলাম।

আমাদের অফিসটা এয়ার কন্ডিশন্ড, কিন্তু কাচের জানলা দিয়ে বাইরের গনগনে রোদ্দুর দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে শীত-গ্রীষ্ম এবং বর্ষা..দারুণ!

ফোন শেষ করে হ্যান্ডসেটটা আমাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বর্ষা বলল, অনেক চার্জ উঠল, না?

আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ, সাংঘাতিক। কাল থেকে আমাকে টোল-পড়া অ্যালুমিনিয়ামের বাটি নিয়ে নীচে গণেশ অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথে ঘুরতে হবে।

বর্ষা হাসল। ওর গালে টোল পড়ল।

তোমাকে কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছে। আজকের দিনটা সাবধানে থেকো।

কেন!

আমাদের অফিসে নেকড়ে আর হায়েনা তো কিছু কম নেই!

বর্ষা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যে, মনে হল আমাকে ও তার মধ্যে ধরবে কি ধরবে না ভাবছে।

এমন সময় প্রকাশ রায়চৌধুরী এগিয়ে এল আমাদের কাছে।

ফরসা, লম্বা-চওড়া, মাথায় কঁকড়া চুল, গলায় সোনার চেন, একটু ওভারস্মার্ট। ও একজন অস্কার নমিনি। তাই বর্ষাকে আমার কাছে পাঁচমিনিটের বেশি বসতে দেখে সাঙ্ঘাতিকরকম উতলা হয়ে পড়েছে।

আমার দিকে আড়চোখে একপলক দেখে বর্ষার দিকে মনোযোগ দিল প্রকাশ : হাই রেইন, আমার কম্পিতে কিছু ডেটা ঢোকানোর ব্যবস্থা করো। মাই মেশিন ইজ স্টার্ভিং।

বর্ষাকে প্রকাশ রেইন বলে। তাই আমি ওকে মনে-মনে বলি রেইনম্যান।

আমার হাতের মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল প্রকাশ ও মোবাইল ফোনটা নেওয়ার পর রীতেনদার স্ট্যাটাস কিন্তু হেভি বেড়ে গেছে। আগে রীতেনদাকে কেউ পাত্তা দিত না–এখন থোড়া-থোড়া দিচ্ছে।

প্রকাশ বর্ষাকে আর-একবার ডেটার তাগাদা দিয়ে চলে গেল।

আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার মুখ আর কান বেশ লাল হয়েছে।

বর্ষা নরম গলায় বলল, প্রকাশদার কথায় কিছু মাইন্ড করবেন না।

না, মাইন্ড করিনি। ব্যাপারটা খুব স্পষ্টঃ নেকড়ে হায়েনাকে কামড় বসিয়ে গেল।

খিলখিল করে হেসে উঠল বর্ষা। আমার বুকের ভেতরে পাগলা হাওয়া নেচে উঠল।

হঠাৎ দেখি আমাদের ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার মঙ্গল পুরকায়স্থ আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আড়ালে ওঁকে আমরা মংপু বলে ডাকি।

মংপুও একজন অস্কার নমিনি। যদিও ওঁর বয়েস পঞ্চান্ন–একটি ছেলে, একটি মেয়ে, এবং একটি হস্তিনী স্ত্রী আছে।

আমি চাপা গলায় বর্ষাকে বললাম, আর-একটা গোদা নেকড়ে আসছে। তুমি সিটে ফিরে যাও। আমি আর কামড় খেতে চাই না। বরং বিকেলের দিকে দশমিনিট গল্প করতে যাব।

বর্ষা ও. কে. বলে চটপটে পায়ে নিজের সিটের দিকে রওনা দিল।

আর কী আশ্চর্য! মংপুও কম্পাসের অনুগত কাটার মতো গতিপথ পালটে বর্ষার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল।

গত চার-পাঁচ বছরে যে-কটা সফ্টওয়্যার কোম্পানি নাম করেছে তার মধ্যে আমাদের কোম্পানি সফট কর্পোরেশন বেশ এগিয়ে রয়েছে। এখানে প্রোগ্রামার হিসেবে মাইনে আমি খারাপ পাই না। কিন্তু ফ্যামিলি বার্ডেন থাকায় অর্ডার সাপ্লাইয়ের ছোটখাটো একটা ব্যবসাও চালাই। ব্যবসার খাতিরেই মাসদুয়েক হল মোবাইল ফোনটা নিয়েছি। আমার ছোটভাই ব্রতীন বি.এস-সি. পাশ করেছে। গত বছর। তারপর ব্যবসার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে বেশ খানিকটা হাঁফ ছাড়তে পারছি।

হঠাৎই বিপ-বিপ করে দুবার শব্দ হল।

চমকে উঠলাম। প্রথমে মনে হল আমার ফোনের ব্যাটারি হয়তো কাবু হয়ে পড়েছে। কারণ, ব্যাটারি লো হলেই বিপ শব্দ হয়। কিন্তু সে তো একটা শব্দ–দুবার তো নয়! তখনই খেয়াল হল, সেলফোনে কেউ কোনও মেসেজ পাঠালে দুবার বিপ-বিপ শব্দ হয়। দিনসাতেক আগে হ্যান্ডসেট রিপেয়ার করার একজন টেকনিশিয়ানের মেসেজ পেয়েছিলাম সঙ্গে তার মোবাইল নাম্বার।

পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে দেখি তার এল সি ডি প্যানেলে একটা মেসেজ ফুটে উঠেছে। মেসেজটা ভারী অদ্ভুত?

সেক্সি ফ্রেন্ডশিপ উইথ সুইট লেডিজ! সিক্রেসি গ্যারান্টিড।
কল ৯৮৩০০ ০১২৩৪।

তার মানে! মিষ্টি মেয়েদের সঙ্গে অন্যায় বন্ধুত্ব! কেউ জানতে পারবে না!

মিনিটখানেকের জন্যে আমার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার কখনও সেরকম ঘনিষ্ঠতা হয়নি। সেরকম কোনও সুযোগও আসেনি।

আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বাপি চলে গেছেন। একমাত্র বোন মিলি আর ওর পরের ভাই ব্রতীন তখন বেশ ছোট। মা ক্রনিক আলসারের রুগি। কী করে যে দিনের পর দিন লড়াই চালিয়েছি সে আমিই জানি! আজ মায়ের বয়েস আরও বেড়েছে, আরও অসুস্থ হয়েছে। মিলির এখনও বিয়ে দেওয়া হয়নি। মা সবসময় সেই চিন্তা করে। আমি মায়ের কাছে আরও দুটো বছর সময় চেয়েছি। বলেছি, আমি আর ব্রতীন মিলে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে মিলিকে ভালোভাবে পাত্রস্থ করব। কিন্তু মাঝে-মাঝে নিজেরই মনে হয়, শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারব তো! বাপি চলে গিয়ে আমাকে বড় অসহায় করে গেছেন।

নিজেকে নিয়ে আমি বেশ ভাবি। বয়েস তিরিশ পেরিয়ে গেল। একজন সুপুরুষ যুবকের জীবনে যেসব সুন্দর-সুন্দর ঘটনা ঘটে তার কিছুই আমার কপালে জুটল না। বন্ধুবান্ধবের মুখে কত রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনি। শুনে রাতে কত উলটোপালটা কল্পনা করি। বর্ষাকে কত আদর করি। মাধুরী দীক্ষিত কিংবা জুলিয়া রবার্টসও আমার ভালোবাসাবাসির ছায়া-যুদ্ধ থেকে। বাদ যায় না। আমার মধ্যে যে একটা প্রেমিক মন আছে সেটা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারি না।

হয়তো সেইজন্যেই মোবাইল ফোনের মেসেজটা আমার মনে দাগ কাটল। ফোন-নম্বরটা মুখস্থ হয়ে গেল সহজেই। তারপর ভাবলাম, এ আবার সেই পার্টি লাইন বা টেলি-ফ্রেন্ড-এর মতো নয়তো! যত ভালোবাসা শুধু টেলিফোনে! সেও তো আর-একরকম ছায়া-যুদ্ধ!

না, ওসব টেলিফোন-ঠেলিফোন নয়। আসল ব্যাপারটা আমার একবার চেখে দেখতে ইচ্ছে করছে।

তা হলে ওই নম্বরে পরে একটা ফোন করে দেখলে কেমন হয়!

আমার সফ্টওয়্যার ডেভেলাপমেন্টের কাজে বারবার ভুল হয়ে যেতে লাগল। যতই ছুটির সময় কাছে এগিয়ে আসতে লাগল ততই ভেতরে-ভেতরে চঞ্চল হয়ে উঠলাম।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ টেবিল ছেড়ে বর্ষার কাছে গেলাম।

ও একমনে কম্পিউটারে কাজ করছিল। অস্কার নমিনিরা কেউ ধারে কাছে নেই–শুধু আমি ছাড়া।

ঘাড় বেঁকিয়ে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল ও। ডান হাতের সুন্দর আঙুলগুলো মাউস আঁকড়ে রয়েছে। মাউসটা আমার হাত হতে পারত।

বলুন, রীতেনদা–।

আমি চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্লাস্টিক আর কাচের পার্টিশন দিয়ে তৈরি ছোট-ছোট কিউবি। যে-যার সিটে বসে কাজ করছে। শুধু এয়ারকুলারের ভোমরার ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

কখন বেরোবে অফিস থেকে? আমি আলতো করে জিগ্যেস করলাম।

হাতের কাজটা কমপ্লিট হলেই বেরোব। একটু দিদির বাড়ি যেতে হবে।

বর্ষার বাড়ি শুনেছি এন্টালির দিকে। আর আমার সূর্য সেন স্ট্রিটে। তবুও অনেক সময় ওর সঙ্গে বাস স্টপ পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয়। তবে একা নয়–আরও দু-একজন নমিনি সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে। কোনও-কোনও দিন মঙ্গল পুরকায়স্থ বর্ষাকে লিফ্ট দেন। বর্ষার কাছেই শুনেছি, মাঝে-মাঝেই নাকি উনি বর্ষাকে লাঞ্চ কিংবা ডিনারের প্রস্তাব দিতে ছাড়েন না।

সাহস করে বলতে পারলাম না, ঠিক আছে, দুজনে একসঙ্গে বেরোব। তার বদলে মুখ ফসকে অস্কার পুরস্কারের ব্যাপারটা ওকে বলে ফেললাম। শুনে ও তো হেসেই অস্থির।

আমি ওর হাসি দেখছিলাম। আর এদিক-ওদিক থেকে চার-পাঁচ জোড়া চোখ আমাদের দেখছিল।

ওর হাসির ঝিলিক কমলে পর বললাম, দ্যাখো, স্পষ্ট কথা বলাই ভালো। আমি কিন্তু সাধুপুরুষ নই–আমিও একজন অস্কার নমিনি।

আবার খিলখিল হাসি। তারপরঃ আপনি দারুণ জোক করতে পারেন। অস্কার অ্যাওয়ার্ড..অস্কার নমিনি…মাই গুডনেস! হাসির চোটে ওর চোখের কোণে জল এসে গিয়েছিল। আঙুল বুলিয়ে সেই জল মুছে নিল বর্ষা।

বর্ষার কাছে এলে আমার কী যে হয়! মনের সব কথা উজাড় করে বলতে ইচ্ছে করে। মোবাইল ফোনে আসা মেসেজটাও ওকে বলতে ইচ্ছে করল। তাই ভয় পেয়ে নিজের সিটে ফিরে এলাম।

আসার পথে লক্ষ করলাম, প্রকাশ রায়চৌধুরী দূর থেকে আমাকে দেখছে।

.

সেদিন রাতে, আটটা নাগাদ, মেসেজটা আর-একবার এল।

আমি পাড়ার চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা সামনে নিয়ে বর্ষার কথা ভাবছিলাম। মন টন ভীষণ খারাপ। তখনই বিপ-বিপ শব্দটা হল।

হঠাৎই মাথার মধ্যে কী যে হল, উচ্ছৃঙ্খল হতে খুব সাধ জাগল। বর্ষার ওপর অনেকটা অভিমান নিয়েই চায়ের কাপ ফেলে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। কাছাকাছি একটা ফোন বুথে ঢুকে পড়ে বোতাম টিপলাম : ৯৮৩০০ ০১২৩৪।

একটু পরেই ও-প্রান্তে একজন মহিলার মিষ্টি গলা পেলাম।

হ্যালো।

আপনারা আমার মোবাইল ফোনে একটু আগে একটা…একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন। সকালেও মেসেজটা একবার পেয়েছিলাম।

আপনার মোবাইল নাম্বারটা কাইন্ডলি বলবেন?

নাম্বার বললাম।

কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা বললেন, আপনি মিস্টার রীতেন মিত্র?

হ্যাঁ। আমার গলাটা হঠাৎই কেমন শুকিয়ে গেল। ওরা আমার নাম জানল কেমন করে! তা হলে কি সবার মোবাইল নাম্বার আর নামের লিস্ট তৈরি করে তারপরই ওরা মেসেজ পাঠাতে শুরু করেছে।

আপনারা…মানে আমার নাম..ইয়ে…।

রিল্যাক্স, মিস্টার মিত্র। আপনি ফর নাথিং নার্ভাস হচ্ছেন। আমাদের বিজনেসের ক্যাপিটালই হল সিক্রেসি আর প্রাইভেসি। মহিলা আমাকে আশ্বাস দিলেন : আপনি কাল সন্ধে সাতটায় আমাদের অফিসে চলে আসুন। আমাদের এনরোলমেন্ট ফি দুশো টাকা। আর তারপর সার্ভিস অনুযায়ী চার্জ। ঠিক সাতটায় আসবেন কিন্তু!

এরপর তিনি পার্কসার্কাস অঞ্চলের একটি ঠিকানা বললেন। কীভাবে সেখানে পৌঁছতে হবে সেটা পাখি-পড়া করে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর হেসে বললেন, ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই। এখানে এলে আপনার ভালো লাগবে। তবে মনে রাখবেন, তিনতলার ফ্ল্যাট ফ্ল্যাটের দরজায় নেমপ্লেটে লেখা আছে মিস্টার পি. দত্তগুপ্ত, ক্লিয়ারিং এজেন্ট। ওখানে লোক থাকবে। তাকে দুশো টাকা দিয়ে দেবেন ক্যাশ। তারপর আমরা আপনাকে খুশি করার জন্যে যা-যা করা দরকার করব। গুডনাইট।

কেমন একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলাম আমি। মনে-মনে বেশ কৌতূহল হচ্ছিল। দুশো টাকা খুব একটা বেশি নয়। তারপর কত–তিনশো, পাঁচশো, হাজার? একবার, মাত্র একটিবার, ব্যাপারটা চেখে দেখতে ক্ষতি কী! মা, মিলি, ব্রতীন, বর্ষা–কেউ কিছু টেরই পাবে না।

সুতরাং পরদিন কাঁটায়-কাঁটায় সন্ধে সাতটায় দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলাম।

.

০২.

পালিশ করা বিশাল কাঠের দরজা। তাতে ম্যাজিক আই লাগানো। দরজার ডানদিকের ফ্রেমে কলিংবেলের বোতাম।

নেমপ্লেটের লেখাটা আর-একবার পড়ে নিয়ে কলিংবেলের বোতাম টিপলাম।

দত্তগুপ্তদের ফ্ল্যাটবাড়িটা বেশ পুরোনো ধাঁচের। এক-একটা তলার হাইট প্রায় পনেরো-ষোলো ফুট হবে। বাড়ির বাইরের চেহারাটা জব চার্নক হলেও ভেতরটা ঋত্বিক রোশন। অভিজাত পয়সাওয়ালা মানুষজনই এইসব ফ্ল্যাটে থাকে।

বাড়িতে ঢুকেই প্রথম যে-ব্যাপারটা আমার নজর কেড়েছে সেটা নির্জনতা। সিঁড়ি আর অলিন্দ দেখে মনে হয় না কেউ এখানে থাকে।

শব্দ করে দরজা খুলে গেল।

দরজা খুলতেই পারফিউমের উগ্র গন্ধ আমাকে স্বাগত জানাল।

দারুণ সাজগোজ করা একজন মহিলা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে। ফরসা, গোলগাল চেহারা, কোঁকড়ানো চুল। বয়েসটা এমন জায়গায় চলে গেছে যে, মেকাপের কথা আর শুনছে না।

মহিলা বড় বড় শ্বাস ফেলছিলেন। ওঁর ভারী বুক ওঠা-নামা করছিল।

আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতরটা টিপটিপ করছিল অকারণেই। বেশ টের পাচ্ছিলাম, কপালের পাশ দিয়ে ঘামের রেখা গড়িয়ে নামছে।

রুমাল বের করে ঘাম মুছে নিয়ে আমি বললাম, আমার…আমার নাম রীতেন মিত্র। সাতটায় আমার আসার কথা ছিল।

ভদ্রমহিলা হাসলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর মুখটা মিষ্টি হয়ে গেল।

আসুন, ভেতরে আসুন। ওঁর গলাও দারুণ মিষ্টি।

আমি ভেতরে ঢুকতেই মহিলা দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলেন।

সামনের ঘরটা রিসেপশান কিউবিলের ঢঙে সাজানো। বাঁদিকে ঝকঝকে কাউন্টার–তার ওপরে টেলিফোন আর কম্পিউটার। পাশেই রাখা নোটপ্যাড আর পেন।

ডান দিকের কোণে একটা সুদৃশ্য টুলে রাখা আছে একটা চিনেমাটির ফুলদানি–তাতে রংবেরঙের ফুলের তোড়া বসানো। তার পাশ ঘেঁষে লম্বা একটা সোফা। সোফার ঠিক ওপরে দেওয়ালে টাঙানো একটা রঙিন ছবি। ছবিতে কয়েকটি মেয়ে লোভনীয় ঢঙে দাঁড়িয়ে। ওদের শরীরের ওপরে লেবেল সাঁটার মতো করে একটা ইংরেজি ক্যাপশান লেখা? সে হ্যালো টু এভরিবডি। তার পাশেই একটা ক্যালেন্ডার আর একটা ফুটফুটে বাচ্চার ছবি ঝুলছে। অন্যায় খেলার ছিটেফেঁটাও নেই কোথাও।

ফ্ল্যাটটা কেমন নিঝুম আর ফঁকা-ফঁকা। তাতে আমার একটু অবাক লাগছিল। কিন্তু ওরাই তো ফোনে বলেছে, সিক্রেসি আর প্রাইভেসি ওদের ক্যাপিটাল! তাই হয়তো এ-সময়টায় আর কাউকে আসতে বলেনি।

ভদ্রমহিলা কেমন যেন এলোমেলো ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন। নার্ভাসভাবে বারবার শাড়ি ঠিক করছিলেন। আমাকে সোফায় বসতে বলে কাউন্টারের ওপাশে গিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটকাতে লাগলেন।

আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঢোঁক গিলে বললাম, আমার…দুশো টাকা দেওয়ার কথা ছিল। টাকাটা পকেট থেকে বের করে ওঁর দিকে এগিয়ে দিলাম।

কাঁপা হাতে টাকাটা নিয়ে রিসেপশান কাউন্টারের একটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি একটু বসুন। আমি মিস্টার দত্তগুপ্তকে খবর দিচ্ছি।

একটা কাঠের দরজা ঠেলে মহিলা ফ্ল্যাটের ভেতরের দিকে চলে গেলেন। আমি দুরুদুরু বুকে অন্যায় অভিযানের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

মিনিটখানেক পরেই ভদ্রমহিলা ফিরে এলেন। ছোট্ট করে হেসে বললেন, আপনি বসুন, উনি এখুনি আসছেন। আমি আপনার জন্যে কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে আসছি।

কথাটা বলেই মহিলা ফ্ল্যাটের সদর দরজা খুলে ব্যস্ত পায়ে চলে গেলেন। আমি অপেক্ষা করার জন্যে তৈরি হয়ে টেনশান কাটাতে একটা সিগারেট ধরালাম।

প্রায় মিনিট পনেরো কেটে যাওয়ার পর আমার ধৈর্যে টান পড়ল। দত্তগুপ্তের হল কী! সিগারেট কখন শেষ হয়ে গেছে! ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটার ঘরে পৌঁছে গেছে। নাঃ, এবার একটু খোঁজ করা দরকার।

সোফা ছেড়ে উঠে পড়লাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে তারপর ফ্ল্যাটের ভেতরে যাওয়ার দরজাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কান পেতে কথাবার্তার শব্দ শোনার চেষ্টা করলাম।, কোনও শব্দ নেই। এই ফ্ল্যাটটা বোধহয় শুধুই যোগাযোগের অফিস। সুইট লেডিজরা থাকে অন্য কোথাও হয়তো নিজের নিজের আস্তানায়।

দরজায় চাপ দিতেই পাল্লা খুলে গেল।

সামনেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা। পুরোনো আমলে বারান্দা ছিল, এখন ডাইনিং স্পেস। আলো নেভানো থাকায় আবছা আঁধার ছড়িয়ে রয়েছে। তার ডানদিকে দুটো ঘর। দুটো ঘরের দরজাই হাট করে খোলা। একটা অন্ধকার, অন্যটায় আলো জ্বলছে।

চুরুটের হালকা গন্ধ নাকে আসছিল। মিস্টার দত্তগুপ্ত কি চুরুট খাচ্ছেন?

হঠাৎই ফোন বাজতে শুরু করল।

ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। যেন চুরি করতে এসে ধরা পড়ে গেছি। তারপরই বুঝলাম, পকেটে আমার সেলফোন বাজছে।

ফোনটা পকেট থেকে বের করে অফ করে দিলাম। সুরেলা বাজনা থেমে যেতেই ফ্ল্যাটটা আগের চেয়ে দ্বিগুণ নিস্তব্ধ মনে হল।

যে-ঘরটায় আলো জ্বলছিল, পা টিপেটিপে সেই ঘরটার দিকে এগোলাম।

ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়েই দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি। এবং রাজধানী এক্সপ্রেস যেন দুরন্ত গতিতে ছুটে এসে আমার হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা মারল। বুকের ভেতরে ধুকপুকুনি থমকে গেল। কয়েক লহমার জন্যে। তারপরই তাড়া খাওয়া কাঠবেড়ালির মতো ছুটতে শুরু করল ধকধক…ধকধক…।

ঘরের ধবধবে বিছানায় চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে প্যান্ট-শার্ট পরা একজন মানুষ। তার হাত পা অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না কারণ, মুখের ওপরে একটা বালিশ চাপা দেওয়া রয়েছে।

ইনিই কি মিস্টার পি. দত্তগুপ্ত? কে জানে!

কৌতূহল আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল।

ঘরের সর্বত্র বিলাসিতার সিলমোহর। আসবাবপত্র, বিছানা, লাইট, ফ্যান সবই প্রিমিয়াম কোয়ালিটির। তবে ঘরে পাগলের মতো অনুসন্ধান চালিয়ে কেউ সাজানো-গোছানো ঘরটাকে ছন্নছাড়া করে তুলেছে। বেশ কয়েকটা ড্রয়ার খোলা। আলমারির পাল্লা খোলা। জামাকাপড়, কাগজপত্র সব মেঝেতে ছড়ানো।

ঘরের এক কোণে বিদেশি রঙিন টিভিতে বিবিসি-র খবর চলছে। কিন্তু ভলিয়ুম কমানো থাকায় কোনও শব্দ হচ্ছে না। আর হলেও বিছানায় বিচিত্র ঢঙে শুয়ে থাকা ভদ্রলোকের কানে সে আওয়াজ নিশ্চয়ই ঢুকত না।

বিছানার খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই বালিশের গায়ে পোড়া গর্তটা আমার নজরে পড়ল। বালিশটা একটানে সরাতেই দত্তগুপ্তকে কিংবা বলা ভালো, দত্তগুপ্তের পাস্ট টেন্সকে–দেখা গেল। ওঁর ধ্বংস হয়ে যাওয়া মুখটা আসলে কেমন ছিল সেটা বুঝতে হলে প্রত্নতত্ত্ববিদের প্রয়োজন। ওঁর মাথার নীচের বালিশটা লাল। কখনও যে ওটা সাদা ছিল সেটা বেশ কষ্ট করে বুঝতে হয়।

হাতুড়ে অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি দত্তগুপ্তের পালস দেখার চেষ্টা করলাম। অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। তবে ওঁর শরীরটা এখনও গরম আছে। মানে, যে-ই ওঁকে খুন করে থাকুক– ব্যাপারটা খুব বেশি আগে হয়নি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে রিভলভারটা চোখে পড়ল না।

কে খুন করল দত্তগুপ্তকে? ওই মহিলা নয় তো! ওঁর আচরণ কেমন অদ্ভুত মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু মেয়েরা কি এরকম নৃশংসভাবে রিভলভার ব্যবহার করে?

আমি যখন এই ফ্ল্যাটে আসি তখন দত্তগুপ্ত নিশ্চয়ই ওপারে চলে গেছেন। কারণ, যতই মুখে বালিশ চাপা দিয়ে আওয়াজ বন্ধ করার চেষ্টা হোক না কেন একটা ভোতা শব্দ নিশ্চয়ই আমার কানে আসত। এমনও তো হতে পারে, দত্তগুপ্তকে খুন-টুন করে ভদ্রমহিলা যখন ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাওয়ার মতলব আঁটছিলেন ঠিক তখনই আমি এসে হাজির হয়েছি।

হতে পারে অনেক কিছুই। এখন ওই ভদ্রমহিলার খোঁজ করা দরকার। উনি যদি খুনি নাও হন, উনি নিশ্চয়ই কিছু-না-কিছু জানবেন। কোল্ড ড্রিঙ্কস আনার নাম করে উনি গেলেন কোথায়! চম্পট দেননি তো!

এই প্রথম কৌতূহলকে ছাপিয়ে ভয় আমার মনে জায়গা করে নিল। ঠান্ডা ঘাম তৈরি হল বুকে-পিঠে। তারপর ধীরে-ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে লাগল।

একটা নির্জন ফ্ল্যাটে আমি আর একটা ডেডবডি! এখন যদি কেউ আসে তা হলে কী ভাববে? যদি পুলিশ আসে!

প্রায় দৌড়ে রিসেপশানে চলে এলাম। আমাকে চমকে দিয়ে রিসেপশানের টেলিফোনটা বাজতে শুরু করল।

নিস্তব্ধ ফ্ল্যাটে টেলিফোনের আওয়াজ আমার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পিটছিল। তাই রিসিভারটা তুলে কাউন্টারের ওপরে নামিয়ে রাখলাম। ফোনে একটা পুরুষকণ্ঠ হ্যালো হ্যালো বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল।

হঠাৎই আমার মনে হল, আমার নাম, মোবাইল নাম্বার সবই দত্তগুপ্তদের কাছে রয়েছে। এই খুনের তদন্ত করতে এসে পুলিশ যদি সেসব খুঁজে পায় তা হলে আমাকেই হয়তো মার্ডারার বলে সন্দেহ করবে। তা ছাড়া বাড়িতে অফিসে সবাই জেনে যাবে আমি এই ফ্ল্যাটে কেন এসেছিলাম। আমার মনের অবস্থাটা কেউ বুঝতে চাইবে না। শুধু অভিযোগের আঙুল তুলেই চেনা-জানা মানুষজন তাদের দায়িত্ব শেষ করবে।

চটপট চলে গেলাম রিসেপশান কাউন্টারের ওপারে। কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে আমার নাম আর মোবাইল নাম্বার থাকাটা অসম্ভব নয়। মেশিনটা অন করাই ছিল। অভ্যস্ত হাতে হার্ড ডিস্কের সব ফাইল মুছে ফেলার নির্দেশ দিলাম। কম্পিউটার জানতে চাইল আমি সত্যিই সব ফাইল মুছে ফেলতে চাইছি কি না। উত্তরে আমি ওয়াই টিপে এন্টার বোতামটা টিপে দিলাম।

এইভাবে পাগলের মতো একের পর এক ডিরেক্টরি মুছে ফেলতে লাগলাম।

কম্পিউটার যখন মুছে ফেলার কাজ করছিল সেই সময়ে আমি সবকটা ড্রয়ার খুলে কাগজপত্র হাঁটকাতে লাগলাম।

খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই একটা ডায়েরিগোছের খাতা পেয়ে গেলাম। তাতে অনেক মেয়ের নাম লেখানামের পাশেই লেখা রয়েছে টেলিফোন নাম্বার। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার নজরে পড়ল। প্রতিটি মেয়ের নামের পাশে ব্র্যাকেটে একটি করে নাম লেখা রয়েছে। যেমন, শ্রীজাতা সরকার (সিমি) : ২৪৩ ৭১১২।

লিস্টটায় দ্রুত নজর বোলাতে গিয়ে মারাত্মক একটা ধাক্কা খেলাম।

বর্ষা দাশগুপ্ত (কঙ্কণা) : ২৪৫ ০৮৬৩।

বর্ষার নাম এখানে কেন! ওর ফোন নাম্বার জানি না, তবে নাম-পদবি দুটোই হুবহু মিলে যাচ্ছে! ওর সঙ্গে দত্তগুপ্তের কি কোনও যোগাযোগ ছিল?

একটা কাগজের টুকরোয় ওর ফোন নাম্বারটা টুকে নিয়ে সেটা বুকপকেটে রাখলাম।

আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও যখন আমার নাম বা ফোন নাম্বার পেলাম না তখন খানিকটা স্বস্তি পেলাম। তা হলে দত্তগুপ্তের যা-কিছু রেকর্ড ছিল সবই ওই হার্ড ডিস্কে!

কম্পিউটারে ফাইল মোছামুছির কাজ শেষ হতেই পকেট থেকে রুমাল বের করলাম। ফ্ল্যাটে ঢোকার পর থেকে যেখানে-যেখানে আমার আঙুলের ছাপ পড়েছে বলে মনে হল সেই সব জায়গা পাগলের মতো মুছতে শুরু করলাম। উত্তেজনায় মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না। কেউ যদি ফ্ল্যাটে এসে এখন আমাকে দেখতে পায় তা হলে সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকবে না।

তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করে খুব সাবধানে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। তারপর রুমাল দিয়ে হাতলটা ধরে পাল্লা টেনে দিতেই নাইটল্যাচ ক্লিক শব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। রাস্তায় বেরিয়েই বর্ষাকে একটা ফোন করতে হবে। তখনই বুঝব দত্তগুপ্তের বর্ষা আমার বর্ষা কি না।

কিন্তু ফ্ল্যাটবাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসার সময় একটা ছোট্ট ভুল করে বসলাম। মাথা ঠান্ডা থাকলে এই ভুলটা হয়তো হত না।

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে যখন একতলায় নামছি তখন একজন মোটাসোটা ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা। মাথায় টাক, চর্বি-থলথলে মুখ, কোলে ভুড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে হাঁফিয়ে পড়েছেন।

আমাকে দেখে অবাঙালি টানে জিগ্যেস করলেন, দোত্তোগুপ্তাবাবুর ফ্লেটটা কো-তোলায় হোবে বলতে পারেন? ফোনে দোতোলা বোলল না সেকিন্ড ফ্লোর বোলল…।

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বাংলা তিনতলায়, ইংরেজি সেকেন্ড ফ্লোর। তারপর ওঁর জলহস্তীর মতো চেহারা আর ঘাম-জবজবে মুখ দেখে কেমন যেন মায়া হল। বেচারা কষ্ট করে আরও কতকগুলো সিঁড়ি ভাঙবে! তাই যোগ করলামঃ কিন্তু ওঁর ফ্ল্যাট তো এখন বন্ধ আছে।

বোন্ধ! ইয়ে কেইসন কোম্পনি? এতোটা পোথ দওড় করিয়ে…।

হঠাৎই বুঝলাম ওঁর সঙ্গে কথা বলে ভুল করেছি। কিন্তু এখন তীর হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। পুলিশ যদি দত্তগুপ্তের খুনের তদন্ত করতে করতে এই ভদ্রলোকের খোঁজ পায় তা হলে আমার খোঁজ শুরু করতে আর দেরি হবে না।

মাথা নীচু করে তরতরে পায়ে সিঁড়ি নামতে শুরু করলাম। আমার কেমন যেন দম আটকে আসছিল। একটু বাতাসের জন্যে ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছিল।

.

০৩.

পার্কসার্কাস ময়দানের কাছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে বড়-বড় শ্বাস নিলাম। ভেতরের অস্থির ওলটপালট ব্যাপারটা ধীরে-ধীরে স্থির হয়ে এল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে অলস চোখে গাড়ি, বাস, অটো, ট্রাম আর লোকজন দেখতে লাগলাম।

তারপর, মন যখন পুরোপুরি শান্ত হল, তখন পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। ফোনের সুইচ অন করে বুক পকেট থেকে বর্ষার ফোন নাম্বার লেখা চিরকুটটা বের করে নিলাম। ওর নাম্বারটা ডায়াল করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি মনে-মনে ভগবানকে ডাকছিলাম : দত্তগুপ্তের বর্ষা আর আমার অস্কার পুরস্কার বর্ষা যেন এক না হয়।

কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ও-প্রান্তে ফোন ধরে কেউ হ্যালো বলল। আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার চোখের সামনে পার্কসার্কাস অঞ্চলটা বনবন করে লাট খেয়ে আবার কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, মাতালের মতো টলতে লাগল। কারণ, দুটো বর্ষা এক হয়ে গেছে!

আমি কুলকুল করে ঘামতে শুরু করলাম। কী বলব এখন ওকে?

ও-প্রান্তে বর্ষা হ্যালো হ্যালো বলেই চলেছিল। কয়েক সেকেন্ড এলোমেলো ভাবনার পর আমি খসখসে গলায় বললাম, রীতেনদা বলছি। তোমার সঙ্গে এক্ষুনি খুব জরুরি দরকার আছে।

রীতেনদা! বর্ষা অবাক হয়ে গেলঃ আপনি আমার নাম্বার পেলেন কী করে!

ওসব পরে বলব। এক্ষুনি তোমার সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার।

ন-না। বরং কাল অফিসে বলবেন।

বর্ষা, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। দু-বছর ধরে তোমার সঙ্গে একই সেকশানে কাজ করছি– কোনওদিন তোমার ফোন নাম্বার জানতে চেয়েছি। কিন্তু এখন অ্যাবসলিউট ইমার্জেন্সি। আমাদের এক্ষুনি দেখা হওয়া দরকার–ফোনে এসব কথা বলা যাবে না।

কাল পর্যন্ত ওয়েট করা যায় না…তা হলে অফিসে…।

আমি ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলাম। একটু রূঢ় গলায় বললাম, পি. দত্তগুপ্ত নামে কোনও ক্লিয়ারিং এজেন্টকে চেনো? পার্কসার্কাসে তিনতলায় ফ্ল্যাট…।

ন-না তো, চিনতে পারছি না তো! কেন, চেনার কথা?

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সিক্রেসি আর প্রাইভেসি ছিল দত্তগুপ্তের ক্যাপিটাল। সোজা আঙুলে দেখছি ঘি উঠবে না!

অতএব আঙুল বাঁকাতে হল।

চিনতে পারছ না! আরে যে-দত্তগুপ্ত তোমার নাম রেখেছে কঙ্কণা। ও-প্রান্তে চমকে উঠে শ্বাস টানল বর্ষা।

আমি আরও বললাম, একটা ভালো খবর আছে। দত্তগুপ্ত ঘণ্টাদেড়েক আগে ওঁর ফ্ল্যাটে মার্ডার হয়েছেন।

কী বলছেন, রীতেনদা! বর্ষা একেবারে আঁতকে উঠল।

হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এবার নিশ্চয়ই তোমার দেখা করতে কোনও অসুবিধে হবে না!

আরও আধঘণ্টা পর, সাড়ে আটটা নাগাদ, আমি বর্ষার মুখোমুখি বসে কথা বলতে শুরু করলাম।

মৌলালির মোড়ের কাছাকাছি একটা রেস্তরাঁয় আমরা চা আর ওমলেট নিয়ে মুখোমুখি বসেছি। বর্ষা শাড়ি পরে এসেছে। তাতে ওর ধার এতটুকুও কমেনি–অন্তত আমার কাছে। কোনও রেস্তরাঁয় এই প্রথম আমরা একান্তে বসেছি। পরিস্থিতি অন্যরকম হলে প্রথম এভাবে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা দারুণ হত।

আমি নীচু গলায় বর্ষাকে সব খুলে বললাম। আমার অন্যায় বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভে লজ্জায় গলা জড়িয়ে গেল, চোখে জল আসতে চাইল। বললাম, নিঃসঙ্গতায় পাগলের মতো লাগছিল আমার, মাথার গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। আমাকে যেন ও ক্ষমা করে।

ক্ষমা করবে কী, বর্ষা তখন ফ্যাকাসে মুখে পাথর হয়ে বসে আছে–চোখে শূন্য দৃষ্টি।

অনেকক্ষণ পর ও কথা বলল, রীতেনদা, কী হবে এখন!

আমি একটু চিন্তা করে বললাম, চুপ করে বসে থাকা ছাড়া কোনও পথ নেই। তবে পুলিশ হয়তো দু-চারদিনের মধ্যে তোমাকে ফোন করতে পারে।

তখন কী বলব?

প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরে মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল। ভেতরে-ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলাম। কিন্তু বর্ষাকে জিগ্যেস করতে কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল। আর এও মনে হচ্ছিল, ওর উত্তরটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেবে।

পুলিশের প্রশ্নটা যদি আমি তোমাকে জিগ্যেস করি?

বর্ষা মাথা নীচু করে বসে রইল।

দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে তোমার নাম আর ফোন নম্বর পাওয়া গেল কেন?

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল বর্ষা। ওর মুখ নীচু থাকায় মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না।

যখন ও মুখ তুলল তখন ওর চোখে জল।

আমার বুকের ভেতরে ভাঙচুর শুরু হয়ে গেল।

বর্ষা ধীরে-ধীরে ওর কথা বলে গেল। মাঝে-মাঝে নাক টানল, রুমাল দিয়ে চোখ মুছল।

দত্তগুপ্তের ব্যবসা মেয়ে নিয়ে। তবে ওঁর ব্যবসার অনেকগুলো স্তর আছে। তার একেবারে প্রাথমিক স্তরে রয়েছে টেলিফোনে বন্ধুর মতো সুখ-দুঃখের গল্প করা। তারপরের স্তর টেলিফোনে নোংরা রগরগে গল্প। এর পরের ধাপে টেলিফোনে নয়–একেবারে মুখোমুখি গল্প এবং প্রেম। তবে কিছুতেই শরীর ছোঁয়া চলবে না। দত্তগুপ্তের মাল্লম্যানরা সেটা নজর রাখত।

এরপর আসছে বডিলাইন লেভেল। এর প্রথম লেভেলের এলাকা হল চুমু থেকে গভীর শৃঙ্গার পর্যন্ত। আর তার পরের ফাইনাল লেভেল হল ফ্রি-স্টাইল।

নানান ধরনের ক্লায়েন্টের জন্যে দত্তগুপ্তের নানানরকম ব্যবস্থা।

দত্তগুপ্তের কাছে বর্ষা প্রথম লেভেলের চাকরি করত। সপ্তাহে তিনদিন দু-ঘণ্টা করে ওকে নানা ধরনের ক্লায়েন্টের সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করতে হত। এর জন্যে মাসে ও দেড় হাজার টাকা করে পেত। টেলিফোনে ওর ছদ্মনাম ছিল কঙ্কণা।

দত্তগুপ্ত ওকে বহুবারই বলেছেন প্রাথমিক স্তর থেকে ওপরের স্তরগুলোয় উঠতে। তাতে বর্ষা টাকাও পাবে অনেক বেশি। কিন্তু বর্ষা রাজি হয়নি। টাকার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে এই কাজ ও করত বটে, তবে তার জন্যে রুচি বিসর্জন দেয়নি।

টেলি-গার্ল হওয়ার চাকরিটা ও পায় ওর এক বান্ধবীর মারফত। তখন ও আমাদের কোম্পানিতে চাকরি পায়নি। খুব অভাবের সময়ে এই চাকরিটা ওকে দারুণ সাহায্য করেছে। তা ছাড়া দত্তগুপ্ত ওর সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি, কখনও কোনও অন্যায় প্রস্তাবও দেননি। এখন চাকরিটা চলে যাওয়াতে ওর একটু অসুবিধেই হবে।

রীতেনদা, আপনি হয়তো আমাকে খারাপ ভাবছেন…কান্না চাপতে-চাপতে বর্ষা কোনওরকমে বলল, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে যা-যা বললাম সব অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি। আমি শুধু টেলিফোনেই গল্প করতাম–তার বেশি কিছু নয়। তবে অনেক সময় অনেক কিছু দেখতাম…সেসব কাউকে বলা যাবে না। মিস্টার দত্তগুপ্ত এই একটা ব্যাপারে বারবার করে ওয়ার্নিং দিয়েছিলেন। ওঁর অনেক বাজে ধরনের লোকজন জানাচেনা ছিল। কেউ বেয়াড়াপনা করলে তাকে ঢিট করার ব্যবস্থা ওই লোকগুলোই করত।

বর্ষা এখনও রুমাল ব্যবহার করে চলেছে। ওর চোখ ফুলে উঠেছে। আমি ওকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। আজ সকালেই আমরা কত দূরে ছিলাম, আর এখন কত কাছাকাছি চলে এসেছি!

বর্ষার কাছেই শুনলাম, দত্তগুপ্ত খুব ছোট মাপে ব্যাবসা শুরু করে মাত্র চারবছরেই সেটাকে বিশাল জায়গায় নিয়ে গেছেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ওঁর ক্লোজ কানেকশান ছিল। এসব ব্যবসায় এই টাইপের কানেকশান না থাকাটাই অস্বাভাবিক। তাদেরই কেউ কি দত্তগুপ্তকে খুন করল!

বর্ষাকে আমি নানা প্রশ্ন করলাম। তার মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর ও দিতে পারল। তবে বারবার করে আমাকে বলল, এসব কথা যেন আমাদের দুজনের বাইরে আর কারও কাছে না যায়, রীতেনদা।

তুমি মিস্টার দত্তগুপ্তের কাছে কতদিন ধরে এই পার্টটাইম জবটা করছিলে?

অলমোস্ট দু-বছর।

তোমাকে স্যালারি পেমেন্ট করত কে?

মিস্টার দত্তগুপ্ত নিজে।

তুমি কোথায় বসে টেলিফোনে গল্প করতে?

পার্কসার্কাসের ওই ফ্ল্যাটে বসে কথা বলতাম। ওখানে একটা ঘরে পাঁচটা টেলিফোন রাখা আছে–আমরা পাঁচজন মেয়ে সেখানে বসে একসঙ্গে কাজ করতাম।

ওদের নাম জানো?

না। সবাই ছদ্মনাম ব্যবহার করত। ওরাও আমাকে কঙ্কণা নামে চিনত।

তোমাদের আসল নাম কে কে জানত?

মিস্টার দত্তগুপ্ত জানতেন। আর জানতেন ওঁর পি. এ. মিস রোজি।

মিস রোজিকে কেমন দেখতে?

বর্ষা মিস রোজির চেহারার মোটামুটি একটা বর্ণনা দিল। সেটা আমার দেখা রিসেপশানের ওই মহিলার সঙ্গে মোটেই মিলল না।

তখন আমি রহস্যময়ী সেই মহিলার চেহারা যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে বর্ণনা করলাম। তারপর জানতে চাইলাম, এরকম চেহারার কাউকে তুমি ওখানে দেখেছ?

কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বর্ষা বলল, ম-ম-না।

যে-পাঁচজন টেলিফোনে কথা বলত তাদের দেখতে কেমন?

না–ওদের চেহারার সঙ্গেও আপনার ওই ভদ্রমহিলার কোনও মিল নেই।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমি বললাম, ওই মহিলাকে পেলে অনেক কিছু জানা যেত। কে জানে, হয়তো দত্তগুপ্তকে উনিই শেষ করে দিয়েছেন…।

বর্ষা এতক্ষণে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। বেয়ারাকে ডেকে বিল মিটিয়ে আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এলাম।

বর্ষা একটু ইতস্তত করে বলল, কাল আমার দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা ছিল…আমি আর ওখানে যাব না।

না, যেয়ো না। তবে মিস রোজিকে একটা ফোন করে বোলো যে, তোমার শরীর খারাপ। তখন উনি নিশ্চয়ই বলবেন, দত্তগুপ্ত মার্ডার হয়েছেন। ওঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালালে তুমি হয়তো অনেক কিছু জানতে পারবে। সেগুলো আমাকে বোলো। দুজনে ডিসকাস করে যা হোক একটা রাস্তা খুঁজে বের করব।

আমরা চুপচাপ থাকি না! আমাদের ঝামেলায় জড়ানোর কী দরকার!

বর্ষার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললাম, তোমার হয়তো ঝামেলায় না জড়ালেও চলবে, কিন্তু আমি যে অলরেডি ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি। ওই মোটা ভদ্রলোক সিঁড়িতে আমাকে দেখেছেন। ফ্ল্যাটের কোথাও-না-কোথাও হয়তো আমার আঙুলের ছাপ রয়ে গেছে। এমন কী নাম আর মোবাইল নাম্বারও হয়তো কোনও খাতা-টাতা বা ডায়েরিতে লেখা আছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেশান শুরু করলে দু-পাঁচ দিনের মধ্যেই আমার কথা জানতে পারবে। তখন আমাকে নির্ঘাত অ্যারেস্ট করবে। মা-ভাই-বোনের কাছে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না। চাকরিটাও হয়তো খোয়াতে হবে। একটু থেমে কয়েকবার শ্বাস টানলাম আমি। ভেতরে-ভেতরে একটা গোঁয়ার্তুমি টের পাচ্ছিলাম। সেই সঙ্গে রাগও হচ্ছিল। অন্যায় ইচ্ছে নিয়ে আমি দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু কোনও অন্যায় আমি করিনি। দত্তগুপ্তকে কেনা-কে মার্ডার করেছে, অথচ সেই দায়টা চেপে যাবে আমার ঘাড়ে! বেশ মজার ব্যাপার তো! ওই ভদ্রমহিলাকে সামনে পেলে একবার দেখে নিতাম।

না, বর্ষা–এত সহজে আমি ছেড়ে দেব না। জেদি ঘোড়ার মতো এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লাম আমি ও ওই মিস্টিরিয়াস লেডিকে আমি খুঁজে বের করবই! তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পারোনাও থাকতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। আই ডোন্ট কেয়ার ইভন। দিস ইজ মাই গেম। শুধু-শুধু তোমাকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে ট্রাবল দিলাম…।

ভালোবাসার অস্কার নমিনি হয়ে রাস্তার মাঝে চারপাশের লোকজনের চোখের সামনে আমি বর্ষার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে পড়তে পারি। কিন্তু আমাকে অন্যায়ভাবে খুনের দায়ে কেউ জড়াতে চাইলে হাঁটুগেড়ে বসার কোনও প্রশ্নই নেই। বর্ষা পাশে না থাকতে চায় না থাক। গ্রীষ্ম তো রইল!

বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আমরা গ্রীষ্ম অনুভব করছিলাম। গুমোট চটচটে গরম। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না।

বর্ষা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আড়চোখে দেখল আমাকে। তারপর অপরাধী গলায় বলল, সরি, রীতেনদা। আপনি যা ভালো বোঝেন করুন। আমি পাশে আছি। দিস ইজ আওয়ার গেম।

ওর কথাটা শোনামাত্রই এত আনন্দ হল যে, সম্পর্ক অন্যরকম হলে আর পরিবেশ অন্যরকম হলে ওকে একেবারে জাপটে ধরে একটা ইয়ে খেতাম।

বর্ষা আমাকে ওর বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার অনুমতি দিল। আর আমার মোবাইল নাম্বারটাও টুকে নিল।

বাড়ি ফেরার পথে মায়ের ফোন পেলাম। আমার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে দুশিন্তায় ফোন করেছে।

মায়ের কথায় মনে-মনে হাসি পেল।

আমার দুশ্চিন্তার কথা মা যদি জানত!

.

০৪.

পরদিন খবরের কাগজে তিন নম্বর পৃষ্ঠায় ছোট্ট করে খবরটা ছাপা হল।

দত্তগুপ্তের পুরো নাম পিনাকী দত্তগুপ্ত। বয়েস বাহান্ন। ওঁর বেআইনি ব্যবসা মাপে বেশ বড়। পুলিশের ধারণা বখরার ব্যাপার নিয়ে গোলমাল হওয়ায় অপরাধজগতের কেউ ওঁকে খুন করেছে। মুখে বালিশ চাপা দিয়ে গুলি করার কারণ খুনি গুলির আওয়াজ চাপা দিতে চেষ্টা করেছে। এখনও সন্দেহভাজন কাউকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখছে।

আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার কথা পুলিশ এখনও জানতে পারেনি। কিন্তু কী করে ওই ভদ্রমহিলাকে খুঁজে পাওয়া যায়? দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটবাড়ির কাছে গিয়ে আমি কি তা হলে নজর রাখব? যদি ওই মহিলাকে হঠাৎ করে দেখতে পেয়ে যাই! নাকি বর্ষা যেমন বলছে, ঝামেলায় না জড়িয়ে চুপচাপ থাকব?

সারাটা দিন এইসব পাগল করা চিন্তা নিয়ে কাটতে লাগল। মা বেশ কয়েকবার জিগ্যেস করল, কী হয়েছে। আমি প্রতিবারই পাশ কাটানো জবাব দিলাম। টের পাচ্ছিলাম, মিলি আর ব্রতীন বেশ দূরত্ব বজায় রেখে অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছে। কারণ, হাজার সমস্যাঁতেও ওরা কখনও আমাকে এরকম বিপর্যন্ত দেখেনি।

সিগারেটের পর সিগারেট পুড়তে লাগল। আচমকা এরকম বিপদে জড়িয়ে পড়ে নিজেকে বেশ অসহায় লাগছিল। তবে এও মনে হচ্ছিল, এরকম ঝামেলায় না জড়ালে বর্ষাকে এতটা কাছাকাছি পেতাম না। এই কাছাকাছির আলাদা কোনও মানে আছে কি না একমাত্র ভবিষ্যই এর উত্তর দিতে পারে।

অফিসে গিয়ে যান্ত্রিকভাবে কাজে বসে পড়লাম। বর্ষা ওর সিটে বসে কাজ করতে করতে বারবারই আমার দিকে দেখছিল। টিফিনের সময় ও আমার কাছে এল। চাপা গলায় বলল, কাগজে নিউজটা দেখেছেন, রীতেনদা?

দেখেছি। বোধহয় আজ সন্ধেবেলা খাস খবর-এ দেখাবে।

আজ মিস্টার দত্তগুপ্তের ওখানে ফোন করতে আমার ভয় করছে।

ভয়ের কী আছে! তুমি তো জাস্ট একটা ফোন করছ। সেরকম হলে ঝপ করে লাইন কেটে দেবে। আর ফোনটা করবে কোনও এস.টি.ডি. বুথ থেকে।

বর্ষা আমার কথা শুনল বটে, তবে তেমন নিশ্চিন্ত হল বলে মনে হল না।

ওকে বললাম, সেরকম জরুরি কোনও খবর থাকলে আমাকে মোবাইলে ফোন করে জানাতে।

এমন সময় মংপু চলে এলেন আমাদের কাছে।

বর্ষা, আই ওয়ান্ট য়ু। কাম টু মাই রুম। চেন্নাইয়ের প্রজেক্টটা নিয়ে একটু ডিসকাশন আছে।

বর্ষা আমার দিকে একটা অসহায় চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে মংপুর সঙ্গে ওঁর কাচের কিউবিল এর দিকে চলে গেল।

পুরকায়স্থর বর্ষা, আই ওয়ান্ট য়ু কথাটা অনেকক্ষণ ধরে বেসুরোভাবে আমার কানে বাজতে লাগল। কী চমৎকার! বর্ষা, তোমাকে চাই।

বর্ষার সঙ্গে এর বেশি আর কথা বলার সুযোগ পাইনি। বেশ আনমনাভাবে অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে এলাম। তারপর বর্ষার ফোনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

সন্ধেটা আমার টিভি দেখে কাটছিল।

সামনে চায়ের কাপ, আঙুলের ফাঁকে সিগারেট, আর চোখ টিভির রঙিন পরদায়। কখন ফোন করবে বর্ষা? কখন?

হঠাৎই কেউ যেন চাবুকের বাড়ি মারল আমার পিঠে। একী দেখছি আমি! টিভির পরদায় সেই মুখ! সেই মহিলা! দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে আমাকে বুদু বানিয়ে কেটে পড়েছিল।

একটা ট্যালকম পাউডারের বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছিল। ড্রিম ট্যালকম পাউডার লাগালে আপনার কোনওরকম অসুখ-বিসুখ করবে না, রূপকথার গল্পের মতো আপনি সারাজীবন সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারবেন। দাম অত্যন্ত কম, এবং একটা কিনলে আর-একটা ফ্রি।

এরকম একটা স্বপ্নের পাউডারের বিজ্ঞাপনে সেই রহস্যময় মহিলা অভিনয় করছেন! ভদ্রমহিলার পোশাক-আশাক ও মেকাপ অন্যরকম হলেও ওঁকে চিনে নিতে আমার একটুও অসুবিধে হল না।

কিন্তু কী করে এঁকে ধরা যায়!

কিছুক্ষণ ভেবে ঠিক করলাম ওই পাউডার কোম্পানির অফিসে যাব। সেখান থেকেই শুরু করব আমার খোঁজ।

ভদ্রমহিলার হদিস পাওয়ার পর কোথায় আমার টেনশান কমবে, তা নয়, উলটে টেনশান যেন বেড়ে গেল। একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে চললাম, আর বর্ষার ফোনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বর্ষার ফোন এল।

মোবাইল ফোনে জিঙ্গল বেল-এর সুর বেজে উঠতেই ফোন তুলে নিলাম আমি।

হ্যালো।

রীতেনদা, বর্ষা বলছি।

বলো, কী খবর?

মিস রোজিকে ফোন করেছিলাম। বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে পুলিশ ফ্ল্যাটটা সিল করে দিয়েছে। সমস্ত কাগজপত্র খতিয়ে দেখছে। ফলে ওই ফ্ল্যাটে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। মিস রোজি ওঁর রেসিডেন্সের ফোন নাম্বার দিয়েছেন। বলেছেন মাঝে-মাঝে ওঁকে ফোন করে খবর নিতে।

গুড। এদিকে আমার কাছে তো দারুণ খবর আছে।

কী খবর?

সেই মিস্টিরিয়াস লেডিকে পেয়ে গেছি। বর্ষাকে ব্যাপারটা খুলে বললাম।

এবার কী করবেন? উত্তেজিত গলায় জানতে চাইল ও।

কাল ওই পাউডারের কোম্পানি দিয়ে শুরু করব। তারপর কপাল যদি গোপালপুরে নিয়ে যায়, তাও যাব। তাই এখন দু-চারদিন অফিস যাওয়াটা আমার আনসার্টেইন। আমি ফোন করে মংপুকে বলে দেব। তুমি হায়েনা আর নেকড়ের পালের মধ্যে সাবধানে থেকো।

এসব ঠাট্টা এখন ভাল্লাগছে না, রীতেনদা। তারপর একটু থেমে? আমি কাল আপনার সঙ্গে যাব।

একটু ভেবে আমি বললাম, না–এখন নয়। সময় হলে আমি বলব। তুমি বরং টাইম পেলে ড্রিম ট্যাঙ্ক-এর অ্যাডটা দেখো। আর দরকার মনে করলেই আমাকে মোবাইলে ফোন কোরো, ও. কে.?

হু একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ষা নিমরাজি হল।

ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। একটা ঝাটের কাজে পা বাড়ানোর আগে মনটাকে শান্ত করা দরকার।

.

ড্রিম ট্যালক তৈরি করে ভারত কসমেটিক্স লিমিটেড। কয়েকটা বড়সড়ো স্টেশনারি দোকানে ঘোরাঘুরি করে, পাউডারের কৌটোর গায়ে লেখা কোম্পানির ঠিকানা জোগাড় করে, বি.সি.এল.-এর অফিসে পৌঁছতে খুব একটা কষ্ট হল না।

আজ সকাল থেকেই কিছুটা মেঘলা আকাশ, তাই গরমের দাপট কম। তবু বর্ষা এলে ভালো লাগত। দু-বর্ষার কথাই বলছি।

একে-ওকে জিগ্যেস করে যখন ভারত কসমেটিক্স লিমিটেড-এ পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় দুটো।

চিৎপুরের এক ঘিঞ্জি রাস্তায় একটা বাড়ির দোতলায় ওদের অফিস। তবে অফিস-বাড়িটার যা চেহারা তাতে মনে হতেই পারে ওরা ট্যালকম পাউডার নয়, টুথ পাউডার তৈরি করে। নোনা ধরা জীর্ণ বাড়ির একতলায় নানারকম কারখানা ছাপাখানা, খাঁটিয়া তৈরির কারখানা, কোথাও বই বাঁধাই হচ্ছে, টিনের কৌটো তৈরি করছে কেউ। দু-তিনটে রেডিয়োর গান কানে আসছে। আর গোটা একতলাটা বিড়ি আর বাথরুমের গন্ধে ম-ম করছে।

নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেড়ে উঠলাম। সিঁড়ির যা ছিরি তাতে মনে হচ্ছিল তেনজিং নোরগে বোধহয় এই সিঁড়িতেই ট্রেকিং-এ হাতেখড়ি দিয়েছিলেন।

বি.সি.এল.-এর অফিসের বাইরে প্লাস্টিকের ছোট সাইনবোর্ড। তার পাশের কাচের দরজায় কোম্পানির তিনরকম প্রোডাক্টের রঙিন স্টিকার।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। কাচক্যাচ শব্দ হল। সামনের টেবিলে বসা পাকা-চুল ভদ্রলোক একটা লেজার থেকে মুখ তুলে তাকালেন। তার চোয়াল নড়ছিল। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেলের ট্রাইব সিরিয়ালে বোধহয় এ-মুখ আমি দেখেছি। এ-মুখ দেখে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ডারউইনসাহেব ঠিকই বলেছিলেন : বানর থেকে মানুষ। যার গাছে থাকার কথা সে একটা চেয়ারে বসে আছে। অবশ্য চেয়ার আর গাছ–দুটোই বেসিক্যালি কাঠ।

কী চাই? পাউডার, সাবান, না ক্রিম? কাক যদি মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারত, তা হলে বোধহয় এরকমটাই শোনাত।

ঘরের মাপ বড়জোর ছফুট বাই আট ফুট। মাথায় কাঠের সিলিং। আর আসবাব বলতে একটা পোস্টাল ফ্যান, দুটো টেবিল, দুটো চেয়ার, আর একটা টুল। টেবিল-চেয়ারের যা রং-চটা দুর্দশা তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় এদের ফাঁক ফোকরে ছারপোকার দল ওনারশিপ ফ্ল্যাট কিনে স্থায়ী আস্তানা গেড়েছে। তবে অফিসের যা চেহারা তাতে মনে হয় না লোকজন এখানে খুব একটা আসে, আর ছারপোকাগুলো রেগুলার ব্লাড সাপ্লাই পায়।

অফিসে আর কেউ নেই। সুতরাং যা বলার এই বৃদ্ধ মানুষটিকে বলা যাক।

আপনারা সিসিসিএন চ্যানেলে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন…।

ওই অ্যাডভেটাইজে অ্যাকশন হয়েছে তা হলে! একগাল হাসলেন বৃদ্ধ। হাসি তো নয়, যেন দাঁতের বিজ্ঞাপন–যদিও এদিক-ওদিক কয়েকটা পিস মিসিং।

না, মানে…আমার একটা কসমেটিক্স কোম্পানি আছে…।

ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল, ঘোলাটে চোখে সন্দেহ দেখা দিল। আমার দিকে তীব্র নজর মেলে চুপচাপ কিছু একটা চিবোনোর কাজ করে চললেন।

অনেকক্ষণ পর জিগ্যেস করলেন, কী তৈরি করা হয়? আমরা অনেক প্রোডাক্ট সাব-কন্ট্রাক্ট এ তৈরি করি। লেবেল আমাদের থাকে।

ভদ্রলোক আমাকে এখনও বসতে বলেননি। তাই মনে-মনে বেশ রাগ হচ্ছিল। কিন্তু দরকারটা আমার–তাই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলাম। এখন ওঁর লোভ চকচকে চোখ দেখে মনে হল লোভটাকে একটু উসকে দিই।

আমরা এখন ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের একটা ঘামাচির পাউডার তৈরি করছি…।

ঘামাচির পাউডার!

আজ্ঞে হ্যাঁ। জাপানের সুঘামাচি কর্পোরেশনের সঙ্গে আমরা টেকনিক্যাল কোলাবোরেশান করেছি।

তা হলে তো ফরেন গুডস! খুশিতে বিকশিত হলেন বৃদ্ধ। ওঁর দাঁতে সূর্যমুখী দেখা গেল। বললেন, দারুণ! দারুণ! ওই অ্যাডভেটাইজে এই টাইপের অ্যাকশন পাব ভাবিনি।

আমার টোটাল প্রোডাকশন আপনাদের হাতে আমি তুলে দেব। কথা দিলাম। তবে তার আগে একটা ছোট্ট খবর চাই। আপনাদের ওই দারুণ অ্যাডটা কোন এজেন্সিকে দিয়ে করিয়েছেন? আমি ওদের দিয়ে কয়েকটা অ্যাড করাতে চাই। তাতে আপনাদের নামও দেব।

আরে, বসুন, বসুন। হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বলে বৃদ্ধ একটা পুরোনো ডায়েরির পাতা হাঁটকাতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি এবং চোয়াল নাড়ার পর এজেন্সির নাম-ঠিকানাটা আমাকে দিলেন। গলার স্বর যথাসম্ভব মিষ্টি করার চেষ্টা করে অনেক বড়-বড় লাভের লোভ দেখালেন আমাকে। ওঁর কথার চেয়ে গলায় স্বর আমাকে বেশি আগ্রহী করে তুলছিল। কারণ, কাক যখন কোকিলের গলায় কথা বলার চেষ্টা করে তখন ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায় সেটা জানার কৌতূহল আমার বহুদিনের।

কাজ শেষ করে পুরোনো বাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে দেখি রাগি সূর্যকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মেঘ কখন যেন পিঠটান দিয়েছে। গনগনে রোদে ভাজা-ভাজা রাস্তায় যখন হাঁটতে শুরু করলাম তখনও কসমেটিক্স কোম্পানির বাড়িটার বিড়ি আর বাথরুমের গন্ধ আমার নাকে লেগে রয়েছে।

রাস্তার ধারের একটা দোকানে বসে টিফিন করলাম। একটা ঠান্ডা কোক গলায় ঢালোম। খানিকটা জিরিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম অভিযানে।

এখন যেতে হবে ওয়েলিংটন স্কোয়ার অঞ্চলে, স্পেকট্রাম অ্যাড-এর অফিসে।

বাসস্টপে একা-একা দাঁড়িয়ে যখন দরদর করে ঘামছি তখন আর-একবার মনে হল বর্ষা এলে ভালো হত। এবারও দু-বর্ষার কথাই বলছি।

.

স্পেকট্রাম অ্যাড-এর অফিসটা বি.সি.এল.-এর ঠিক উলটো। ইন্ডিয়ান মিরার স্ট্রিটে ওদের ছোট্ট অফিস। কাচ আর প্লাস্টিক দিয়ে দারুণ মড স্টাইলে সাজানো। রিসেপশান কাউন্টারে বসে আছে ফরসা স্লিম একটি অল্পবয়েসি মেয়ে। পরনে হলুদ চুড়িদার। ওর কপালে চুলের ঝালর নেমে এসেছে। তার নীচেই টানা-টানা চোখ। মুখে একটা এসো এসো ভাব।

এসি থাকায় ভীষণ আরাম লাগছিল। আমেজে চোখ বুজে আসতে চাইছিল। কিন্তু এখন চোখ বুজলে চলবে না। চোখ খোলা রাখতে হবে। নইলে হয়তো একেবারে বুজতে হবে– দত্তগুপ্তের মতো।

রিসেপশানের মেয়েটিকে আমার ছদ্ম-পরিচয় জানিয়ে বললাম যে, আমি একটা টিভি অ্যাড দিতে চাই। আর তাতে মডেল হিসেবে ভারত কসমেটিক্স লিমিটেড-এর ড্রিম ট্যালকাম পাউডারের অ্যাডের মেয়েটিকে চাই।

রিসেপশানের মেয়েটি বোধহয় চাকা-ক্লাগানো চেয়ারে বসেছিল। কারণ, আমার কথা শোনামাত্রই কাউন্টারের একপাশে বসানো কম্পিউটারের কাছে প্রায় ভেসে চলে গেল। ওর সুন্দর আঙুল ব্যস্তভাবে নড়ে উঠল কিবোর্ডে। তারপরই আমার দিকে মুখ তুলে বলল, আপনি ভেতরের ঘরে যান। সেখানে মিস্টার করের সঙ্গে কথা বলুন। ভারত কসমেটিক্স লিমিটেড-এর নাম বলবেন। কম্পিউটারে দেখলাম, ওদের অ্যাডটা মিস্টার কর ডিল করেছিলেন।

আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরের ঘরের দিকে রওনা হতে যাব, ঠিক তখনই আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

পকেট থেকে ফোনটা বের করে কথা বললাম। ব্যবসার ফোন। ওরা জানে না, ব্যবসা এখন আমার মাথায় উঠেছে।

ফোনে কথা বলা শেষ করে ভেতরের ঘরে ঢুকলাম।

ঘরটা ছোট কিন্তু চমৎকার। প্রয়োজনের বাইরে বাড়তি কোনও আসবাবপত্র নেই। ধোপদুরস্ত পোশাকে ফিটফাট তিনজন কর্মী–একজন মহিলা, দুজন পুরুষ তিনটে টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। আমি ওঁদের একজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ভদ্রলোক আমার দিকে না তাকিয়েই হাতের ইশারায় সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করে চললেন।

চেয়ারটা আধুনিক–মোল্ডেড প্লাস্টিক আর লোহার কায়দাকানুন দিয়ে তৈরি। সাধারণ অবস্থায় এ ধরনের চেয়ারে বসলে এমন আরাম হয় যে, নিতম্ব নিত্যানন্দ হয়ে বারবার ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু এখন অবস্থা স্বাভাবিক নয়। তাই পেছনে পিন ফুটতে লাগল? কোথায় দত্তগুপ্তের তৃপ্তি নিকেতনের মানসী? কোথায়? কোথায়?

ভদ্রলোক কাজের ঝোঁক সামান্য কমিয়ে কয়েকটা কাগজের গোছা একপাশে সরিয়ে রেখে এই প্রথম আমার দিকে তাকালেন : বলুন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর য়ু…।

আমি মিস্টার করের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

মুখে সুন্দর পেশাদারি হাসি ফুটিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমিই সঞ্জিত কর। বলুন, কী হেল্প করতে পারি।

ভারত কসমেটিক্স লিমিটেড-এর ড্রিম ট্যাঙ্ক-এর অ্যাডটা আপনারা করেছেন। রিসেপশানের ম্যাডাম এ-ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে বললেন…।

বলুন, কী বলবেন–। চোখের চশমাটা সামান্য অ্যাডজাস্ট করে কর টেবিলের কাগজপত্রের দিকে তাকালেন। ভাবটা এমন যেন আমি ওঁর কাজের সময় অকারণে নষ্ট করছি।

একটু নার্ভাস হয়ে গেলাম আমি। কিছুটা সময় নিয়ে ইতস্তত করে বললাম, আমার একটা ছোট কোম্পানি আছে, মিস্টার কর। তার একটা টিভি অ্যাড দিতে চাই। আর তাতে মডেল হিসেবে একজনকে আমার পছন্দ–তাকে চাই।

সঞ্জিত কর আমার চাহিদা আঁচ করে বললেন, তার মানে ভারত কসমেটিক্স-এর ড্রিম ট্যাঙ্ক-এর মডেলকে চাই। ও. কে., নো প্রবলেম…।

আমার বুক ঠেলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। আমার তদন্ত তা হলে ঠিক পথেই এগোচ্ছে!

কর গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজতে-ভঁজতে বাঁ-দিকে ঘাড় ঘোরালেন। ওঁর টেবিলের পাশেই একটা সুন্দর কাঠের র‍্যাক ছিল। র‍্যাকে সার বেঁধে অনেকগুলো ভিডিয়ো ক্যাসেট সাজানো। তাদের লেবেলগুলো খুঁটিয়ে দেখে কর একটা ক্যাসেট টেনে নিলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, আসুন, প্রোজেকশান রুমে একবার ক্যাসেটটা চালিয়ে দেখে নিই।

কর আমাকে একটা অ্যান্টিরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে ভিসিআর, টিভি, প্রোজেক্টার সব তৈরি। আমাকে বসতে বলে ক্যাসেটটা রেডি করে ভিসিআর-এর প্লে বোতাম টিপে দিলেন মিস্টার কর। টিভির পরদায় নানান বিজ্ঞাপনের মেলা শুরু হয়ে গেল।

একটু পরেই দেখতে পেলাম ওঁকে।

সেই বিজ্ঞাপন, সেই মুখ, সেই হাসি।

আমি একটু উত্তেজিতভাবেই করকে বললাম, এই ভদ্রমহিলা–এই মডেল! ওঁর নাম কী?

শর্মিলা বোস–গড়পাড়ে থাকেন–আমরা শর্মিলাদি বলি। আমার দিকে খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় কথাগুলো বললেন কর।

ওঁর ডিটেইল্ড অ্যাড্রেসটা আমাকে দিতে পারেন?

কেন বলুন তো? করের কপালে ভাঁজ পড়েছে।

না, মানে, আমার ওই অ্যাডটা নিয়ে একটু ডিসকাস করতাম। আমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলাম।

কর হাসলেনঃ যা ডিসকাস করার আমাদের সঙ্গে করতে পারেন। মডেলদের সঙ্গে ক্লায়েন্টদের জেনারালি কথা বলতে দেওয়া হয় না–তাতে কাজের প্রবলেম হয়।

ওঁর সঙ্গে একবার দেখা করা যেতে পারে? জাস্ট একবার? আমি মরিয়া।

মিস্টার কর ভালো করে আমাকে জরিপ করলেন। বোধহয় ভাবতে চাইলেন কেসটা কী ও প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া, নাকি প্রেম-প্রতিজ্ঞা?

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো?

আমি দাগা খাওয়া প্রেমিক সাজার ভান করে মনমরা গলায় বললাম, কিছু মাইন্ড করবেন না। ওঁর সঙ্গে…ওঁর সঙ্গে একসময় আমার…ইয়ে, মানে…একটা অ্যাফেয়ার…মানে, পরিচয় ছিল। একবার দেখা হলে খুব ভালো হত।

কর আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ ভালো করে দেখলেন। তারপর ঠোঁটের কোণে হেসে ভিসিআর থেকে ক্যাসেটটা বের করে নিয়ে ভিসিআর, টিভি, সব অফ করে দিলেন।

আমি ওঁর উত্তরের অপেক্ষা করছিলাম।

আপনমনেই হাসলেন কর। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন। বিড়বিড় করে নিজেকেই বললেন, বাব্বাঃ, এই বয়েসেও শর্মিলাদিকে ইয়াং বয়ফ্রেন্ড সামাল দিতে হচ্ছে!

তারপর আমাকে ইশারা করে অ্যান্টিরুমের বাইরে আসতে বললেন। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন, শর্মিলাদি আমাদের অফিসে প্রায়ই আসেন নতুন কাজের খোঁজ নিতে। আজও হয়তো আসবেন। সময় হয়ে গেছে।

আমার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ শুরু হয়ে গেল।

আপনার ওই অ্যাড-ফ্যাডের ব্যাপারটা তা হলে বোগাস! শুধু-শুধু আমার টাইম নষ্ট করলেন। করের মন্তব্যে হতাশা আর বিরক্তি ছিল।

তাই নিজের মান বাঁচাতে বললাম, না, না! সত্যিই একটা অ্যাড আমি তৈরি করতে চাই। ইচ্ছে হলে অ্যাডভান্স নিতে পারেন। তবে বড় অ্যাড নয় দশ সেকেন্ডের কুইকি।

ঠিক আছে। বলে আমাকে রিসেপশানের কাছে নিয়ে এলেন করঃ আপনি এখানে ওয়েট করুন–শর্মিলাদি হয়তো এসে যাবেন।

রিসেপশানের সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম, আর শর্মিলা বোসের কথা ভাবতে লাগলাম।

কী কুক্ষণে যে কৌতূহলের তাড়নায় দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। এখন এই ঘোলাজলের ঘূর্ণি থেকে কী করে উদ্ধার পাব কে জানে! তবে লাভের মধ্যে এই হয়েছে যে, আমি আর বর্ষা দুজনেই একই বিপদে জড়িয়ে পড়েছি। এর ফলে আমরা কাছাকাছি এসে পড়েছি। কিন্তু বর্ষা সত্যিই আমাকে সব কথা খুলে বলেছে তো! এরকম বিপদে পড়লে মাথার ঠিক থাকে না। তখন যাকে-তাকে সন্দেহ হয়। আমার অবস্থাটাও বোধহয় তাই। নইলে বর্ষাকে সন্দেহ করব কেন?

একটা সিগারেট ধরাতে যেতেই রিসেপশানের মেয়েটি এক্সকিউজ মি, স্যার বলে আমার দিকে তাকাল। তারপর ইশারা করল একটা স্টিকারের দিকে থ্যাংক য়ু ফর নট স্মোকিং।

সিগারেট আবার পকেটের প্যাকেটে ঢুকে গেল। সিগারেট ছাড়া সময় কাটানো মুশকিল। চোখ তন্দ্রায় জড়িয়ে আসতে চাইছে।

অফিসের দরজা ঠেলে যখনই কেউ ঢুকছে তখনই আমি চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়ে তাকাচ্ছি। নাঃ, শর্মিলা বোস নয়।

সত্যিই, কী অদ্ভুত ব্যাপার! শর্মিলা বোসের বদলে অনেক তরুণী এবং অনেক সুন্দরী মেয়েরা স্পেকট্রাম অ্যাড-এর অফিসে ঢুকলেও ওরা আমাকে একচুলও টানতে পারছে না। আমার কাছে। ওরা স্রেফ নন-ম্যাগনেটিক মেটিরিয়াল। এখন, এই মুহূর্তে, শর্মিলা বোসই আমার একমাত্র মহান চুম্বক।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে উঠে পড়তে হল। সাড়ে তিন ঘণ্টা মতো অপেক্ষা করেও শর্মিলা বোসের দেখা পেলাম না। তখন সোফা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ঢুকে পড়লাম অফিসের ভেতরে।

সঞ্জিত করের কাছে গিয়ে কিন্তু-কিন্তু ভাব নিয়ে দাঁড়ালাম।

তিনি ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, কী আর করবেন…দরকার মনে হলে কাল একবার আসুন…।

আচ্ছা, ওঁর অ্যাড্রেসটা আমাকে দেওয়া যায় না? কিংবা ফোন নাম্বার?

উঁহু-ট্রেড সিক্রেট।

ওঁর সঙ্গে দেখা করাটা ভীষণ জরুরি…।

সঞ্জিত কর ভুরু কুঁচকে সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর বললেন, ইচ্ছে হলে আপনি কাল আর-একবার আসতে পারেন, চান্স নিতে পারেন। দ্য চয়েস ইজ ইওরস। নাউ, ক্যান উই ফিনিশ দিস ডায়ালগ?

অপমানে গা চড়চড় করছিল, কিন্তু উপায় নেই। আমার ঘাড়ের ওপর দত্তগুপ্তের ডেডবডি ঠান্ডা নিশ্বাস ফেলছে।

সুতরাং স্পেকট্রাম অ্যাড-এর অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। আসার সময় রিসেপশানের মেয়েটিকে বলে এলাম যে, আমি আবার কাল আসব।

হতাশ মন নিয়ে যখন বাড়ির দিকে রওনা হলাম, তখনও জানি না আর-এক বিপদ সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

.

০৫.

দরজার কড়া নাড়তেই মিলি দরজা খুলে দিল।

মিলি খুব ফরসা। কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের ম্লান আলোয় ওকে ভীষণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল।

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ সরু হয়ে এল।

মিলি ফিসফিস করে বলল, দাদা, থানা থেকে পুলিশ এসেছে। তোর জন্যে অপেক্ষা করছে।

পুলিশ!

আমার মুখের রক্ত বোধহয় কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিল, কারণ মিলির মুখে ভয়ের ছাপ পড়ল। ও অস্পষ্ট গলায় বলল, প্রায় একঘণ্টার ওপর ওরা বসে আছে।

পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে, ঘাড়ে, গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। ওঁদের প্রশ্নগুলো মনে মনে কল্পনা করে উত্তরগুলো ঝালিয়ে নিতে লাগলাম।

কী ব্যাপার, দাদা! পুলিশ তোর খোঁজ করছে কেন? মা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। কাঁদছে।

আমি আপনমনেই একবার মাথা নাড়লাম। তারপর মিলিকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। কেমন যেন দম আটকে আসছিল। একগাদা শুকনো ছাতু মুখের মধ্যে কেউ যেন জোর করে গুঁজে দিয়েছে।

বাইরের ঘরটাতেই ওঁরা দুজনে বসেছিলেন। সামনের টেবিলে দুটো খালি চায়ের কাপ আর প্লেট। তার পাশে একটা হলদে রঙের ফ্ল্যাট ফাইল।

ওঁদের একজন গাঁট্টাগোট্টা। পরনে ইউনিফর্ম। আপাদমস্তক পুলিশ-পুলিশ ভাব। আর-একজন সিঁড়িঙ্গে চেহারার। গায়ে সাদা পোশাক। গালে, কপালে অসংখ্য ভাঁজ। মাথায় টাক। ঠোঁটের কোণে একটা মজার হাসি সবসময় লেগে রয়েছে।

আমি ঘরে ঢুকেই ওঁদের আলতো নমস্কার জানিয়ে বললাম, আমার নাম রীতেন মিত্র।

হু বসুন। গাঁট্টাগোট্টা চেহারার ভদ্রলোক বললেন, আপনার জন্যেই এতক্ষণ ওয়েট করছি।

আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।

মিলি আমার পাশ দিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গেল। ও চলে যাওয়ার সময় দরজার পরদাটা কেঁপে গেল। তখনই পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মা-কে দেখতে পেলাম।

আমি ইন্সপেক্টর সেন–মুচিপাড়া থানায় আছি। প্রথমজন বললেন। তারপর সঙ্গীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, আর ইনি কড়েয়া থানার অফিসার দ্বিজেন বিশ্বাস…।

আমি সৌজন্য দেখালাম। তারপর প্রথম প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ইন্সপেক্টর সেন টেবিলে রাখা ফাইলটা হাতে তুলে নিলেন। সেটা ওলটাতে-ওলটাতে একটা পৃষ্ঠায় গিয়ে থামলেন।

ফাইলের দিকে চোখ রেখেই প্রথম প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন তিনিঃ আপনার মোবাইল নাম্বার ৯৮৩০০-৪৩২৮১?

হ্যাঁ–।

আপনি গণেশ অ্যাভিনিউর সক্ট কর্পোরেশন-এ প্রোগ্রামারের চাকরি করেন?

হ্যাঁ। ওরা বাড়ির কাজ বেশ গুছিয়ে শেষ করে তারপর পরীক্ষা দিতে সরি, নিতে– এসেছে দেখছি। কিন্তু আমার মোবাইল নাম্বার ওরা কী করে পেল? অফিসের হদিস, বাড়ির ঠিকানা? তা হলে কি কম্পিউটার ছাড়াও অন্য কোথাও আমার মোবাইল নাম্বার আর নাম-টামের হার্ড কপি ছিল?

আমার বুকের ভেতরে এমন জোরে গুমগুম শব্দ শুরু হল যে, আমার ভয় হচ্ছিল পুলিশ অফিসাররা সেই শব্দ শুনতে পাবেন।

পিনাকী দত্তগুপ্তকে আপনি চিনতেন?

না। এই প্রথম নাম শুনছি।

পার্কসার্কাসে ওঁর ফ্ল্যাটে আপনি কখনও যাননি?

অসংখ্য মিথ্যে বলার জন্যে মনে-মনে তৈরি হয়ে উত্তর দিলাম, যার নাম কখনও শুনিনি তার ফ্ল্যাটে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে কী করে!

দ্বিজেন বিশ্বাস গলাখাঁকারি দিয়ে নড়েচড়ে বসলেন, বললেন, সত্যিই আপনি মিস্টার দত্তগুপ্তকে চেনেন না? ওঁর ফ্ল্যাটে কখনও যাননি? কোশ্চেনটা খুব ইমপর্ট্যান্ট–উত্তরটাও।

কেন, ওঁকে আমার চেনার কথা? একটু খোঁচা মেরেই প্রশ্নটা করলাম।

বিশ্বাস হাসলেন, বললেন, চেনার তো কথা–নইলে মিস্টার দত্তগুপ্তের ফোন থেকে আপনার মোবাইল ফোনে মেসেজ আসবে কেন!

প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। ঠিক কতটা জানে ওরা?

ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার সময় চাই। তাই প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, ব্যাপারটা কী বলুন তো? পিনাকী দত্তগুপ্তকে নিয়ে এত কোশ্চেন করছেন কেন?

এবারে সেন উত্তর দিলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন, পিনাকী দত্তগুপ্ত ওঁর ফ্ল্যাটে মার্ডার হয়েছেন। কেসটা আমরা ইনভেস্টিগেট করছি। দত্তগুপ্ত একটা টেলিফোন-মধুচক্র চালাতেন। তবে আমাদের কাছে খবর আছে ব্যাপারটা এত ইনোসেন্ট ছিল না। ওঁর রোরিং বিজনেস ছিল। ক্লায়েন্টের লিস্ট ছিল কয়েক মাইল লম্বা…।

আর সেই লিস্টেই আমরা আপনার নাম পেয়েছি। হেসে বললেন দ্বিজেন বিশ্বাস।

ওঁদের ভদ্রলোকের মতো সাফাই দেওয়া দরকার। তাই একটা লম্বা শ্বাস ফেলে মাথা নীচু করে দত্তগুপ্তের কোম্পানির মেসেজ পাঠানোর কথা বললাম। তারপর এও বললাম যে, আমি ওঁদের ওখানে কখনও ফোনও করিনি, যাইওনি।

বিশ্বাস করুন। আমার মাথার ওপরে অনেক ফ্যামিলি বার্ডেন ইনকামও তেমন নয়। এসব বিলাসিতা আমাদের মতো লোকের কাছে স্বপ্ন। অনেস্টলি বলছি। গলায় বেশ খানিকটা আবেগ জড়িয়ে কথা শেষ করলাম।

অফিসার দুজন কয়েক লহমা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোধহয় বুঝতে চাইলেন আমার অনেস্টিতে শতকরা জলের পরিমাণ কত।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ইন্সপেক্টর সেন বললেন, ও.কে., মিস্টার মিত্র। আজ আমরা উঠি। আপনি আমাদের না জানিয়ে কলকাতা ছেড়ে যাবেন না। উই হোপ য়ু আর টেলিং দ্য ট্রুথ।

ওঁরা চলে যেতেই মা পরদার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। আমাকে প্রায় জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলল, রতু, রতু…আমার বড় ভয় করছে রে…।

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, কোনও ভয় নেই, মা, কোনও ভয় নেই। আমি এমন কিছু করিনি যাতে পুলিশ আমার কিছু করতে পারে।

আমার দু-হাতের বাঁধনে মায়ের ক্ষীণজীবী রোগা শরীরটা ভেজা পাখির ছানার মতো থরথর করে কাঁপছিল।

মায়ের আশঙ্কা অনুভব করে আমার চোখে জল এসে গেল।

.

পরদিন আবার গেলাম স্পেকট্রাম অ্যাড-এর অফিসে।

গতকালের হলুদ চুড়িদার মেয়েটি আজ গোলাপি চুড়িদার পরে আছে। কপালে সেই চুলের ঝালর, তার নীচে টানা-টানা চোখ।

আমাকে দেখামাত্রই সৌজন্যের হাসি হাসল। সোফায় দিকে চোখের ইশারা করল।

সোফায় বসে আমি মেয়েটিকে শর্মিলা বোসের কথা জিগ্যেস করলাম। উত্তরে মেয়েটি বলল যে, শর্মিলা বোস এখনও আসেননি–তবে ওঁর আসার সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি। আমি চাইলে অপেক্ষা করতে পারি।

চাইলে মানে! শর্মিলা বোসকে আমার চাই-ই চাই! গতকালের পুলিশি হানার পর আমি রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছি। মা, ব্রতীন, মিলি যদি একবার জানতে পারে যে, দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে আমি কীসের লোভে গিয়েছিলাম, তা হলে আমাকে হয়তো সুইসাইড করতে হবে।

কী একটা কাজে সঞ্জিত কর অফিসের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। রিসেপশানের মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে আবার ভেতরে চলে যাচ্ছিলেন, আচমকাই আমাকে দেখতে পেলেন।

আরে, আপনি এসে গেছেন! চওড়া করে হাসলেন সঞ্জিত কর।

আমি কাচুমাচু মুখ করে মাথা নাড়লাম–যার অর্থ হল, না এসে উপায় কী!

একটু ওয়েট করুন। শর্মিলাাদি আজ হয়তো আসবেন।

সঞ্জিত করের কথা শেষ হতে-না-হতেই বাইরে থেকে কাচের দরজা ঠেলে একজন ভদ্রমহিলা ভেতরে এসে ঢুকলেন। ফরসা গোলগাল চেহারা, কোঁকড়ানো চুল, চোখে সানগ্লাস। ম্যাচ করা শাড়ি ব্লাউজ দিব্যি মানিয়েছে।

ওঁকে চিনে নিতে অসুবিধে হল না।

মিস্টার করকে দেখে খুশির হাসি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, হাই সঞ্জিত, কোনও ভালো খবর আছে?

সঞ্জিত কর বড় করে হাসলেন। তারপর আমার দিকে ইশারা করে বললেন, দারুণ গুড নিউজ আছে। ইওর ওল্ড ফ্রেন্ড ইজ ব্যাক। আপনি কথা বলুন। আজ আপনার সঙ্গে আমার কোনও কাজ নেই। নেক্সট মানডে বিকেলের দিকে একবার আসবেন।

কথাগুলো বলেই সঞ্জিত কর ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ভদ্রমহিলা ওঁকে কোনও জবাব দিতে পারেননি। শুধু ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বুঝিয়েছেন। কারণ রিসেপশানের সোফায় আমাকে দেখেই ওঁর মুখ সাদা হয়ে গেছে। চোখ পাগলের মতো হয়ে গেছে ভয়ে।

অবশেষে আমি ওঁর দেখা পেলাম। এইবার একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। দত্তগুপ্তকে কে খুন করেছে আমি জানতে চাই।

শর্মিলা বোসের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে আমি একটি কথাও বলিনি। একবার শুধু বলেছি, আমার নাম রীতেন মিত্র। সূর্য সেন স্ট্রিটে থাকি। আপনার সঙ্গে আমার অনেক জরুরি কথা আছে। আর সেটা খুব নিরিবিলি জায়গায় হলে ভালো হয়।

কিছুক্ষণ দোনোমনা করার পর শর্মিলা বোস ছোট্ট করে জিগ্যেস করলেন, আমার বাড়িতে বসে কথা বললে কোনও প্রবলেম আছে?

না। বরং সেটাই ভালো হবে।

কী করে আমার খোঁজ পেলেন?

সংক্ষেপে সব বললাম।

তারপরই ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছ থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে আমরা ছুটলাম গড়পাড়ের দিকে।

ট্যাক্সিতে শর্মিলা একবার কথা বলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে ইশারা করে আমি ওঁকে থামিয়ে দিয়েছি। আমার মনে তখন শয়ে-শয়ে পাগলা ঘোড়া ছুটছে। বহু প্রশ্ন একসঙ্গে ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ঠোঁটের কাছে। আমি বর্ষার কথা ভেবে মনটাকে শান্ত করছিলাম। অফিসে এখন ও কার সঙ্গে গল্প করছে কে জানে! মংপু কিংবা রেইনম্যান নিশ্চয়ই ওর কাছাকাছি আছে।

গড়পাড়ের একটা পুরোনো বাড়ির একতলায় থাকেন শর্মিলা। দেড়খানা ঘরকে জোড়াতালি দিয়ে ফ্ল্যাটের মতো করে নিয়েছেন। মাসছয়েক হল বিয়ে করেছেন, তবে সিঁথিতে রঙের ছোঁয়া নেই। কারণ, যে-ধরনের কাজ তিনি করেন তাতে অসুবিধে হয়।

একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন শর্মিলা। নিজে একটা খাটো টুলের ওপরে বসলেন।

ছোট ঘর। অভাব আর চাহিদা দিয়ে সাজানো। বুঝতে পারছিলাম, ওঁর লড়াইটা বেশ কষ্টের। ওঁকে কষ্ট দিতে আমার খুব কষ্ট হবে।

আমার মুখে বোধহয় তেষ্টা আর ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল। কারণ, পাশের ঘরে গিয়ে আমার জন্যে এক গ্লাস অরেঞ্জ স্কোয়াশের শরবত তৈরি করে নিয়ে এলেন।

কাচের গ্লাসটা হাতে নিয়ে অনুভব করে একটু অবাক হয়ে তাকাতেই শর্মিলা বললেন, সরি, ফ্রিজ নেই।

আমি এক ঢোঁকে গ্লাসটা খালি করে ওঁকে ফেরত দিলাম। হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়েই প্রশ্ন করলাম, দত্তগুপ্তকে কে মার্ডার করেছে?

শর্মিলার হাত কেঁপে গেল। গ্লাসটা মেঝেতে একপাশে রাখতে গিয়ে ঠক করে শব্দ হল। তারপর কয়েকসেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, আমি জানি না।

ম্যাডাম, এখন ছেলেমানুষির সময় নয়। পুলিশ যে-কোনও সময় এসে আপনার বাড়ির কড়া নাড়বে। আমার বাড়িতে ইতিমধ্যেই হানা দিয়েছে।

দেখুন, এখন পাঁচটা বাজে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমার হাজব্যান্ড এসে পড়বে। ও খুব বদরাগি লোক। হয়তো কী-নাকী ভেবে উলটোপালটা কিছু একটা করে বসবে।

আমি কোনও কথা না বলে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। বললাম, আপনি কি চান আমি এই মুহূর্তে কড়েয়া থানায় ফোন করে আপনার নাম-অ্যাড্রেস বলে দিই! তাতে আমি হয়তো মরব, তবে আপনিও বাঁচবেন না।

শর্মিলা মাথা নীচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অভিনয় কি না কে জানে! তবে কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে ভেজা চোখে তাকালেন আমার দিকে ও আমার অবস্থা ঠিক আপনার মতো। মিস্টার দত্তগুপ্ত সাড়ে ছটা নাগাদ আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন। আমি পৌনে সাতটা নাগাদ গিয়ে দেখি উনি বিছানায় মরে পড়ে আছেন। বিশ্বাস করুন, অনেস্ট টু গড।

আপনাকে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়েছিল কে?

শর্মিলা কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। ইতস্তত করে বললেন, রোগা ফরসা মতন একটি মেয়ে। আমাকে দরজা খুলে দিয়ে সে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল…।

আমি হেসে ফেললাম, বললাম, বোধহয় কোল্ড ড্রিস আনতে গিয়েছিল। আবার সেই মেয়েটিকে খোঁজ করে যদি জিগ্যেস করি তা হলে সে-ও নিশ্চয়ই একই গল্প শোনাবে। অন্য আর একটি মেয়ে ওকে দরজা খুলে দিয়েছিল…তারপর ওর জন্যে কোল্ড ড্রিন্স আনতে গিয়েছিল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম ও মিসেস বোস, ব্যাপারটা অনেকটা মুরগি আগে, না ডিম আগে র মতো হয়ে গেল না! আমি লাস্টবারের মতো আপনাকে বলছি, দিস ইজ নট আ জোক। আমি আপনাকে হেল্প করতেই চাই। ডোন্ট মেক মি চেঞ্জ মাই মাইন্ড। মোবাইল ফোনটা উঁচিয়ে ধরে ওঁকে আবার পুলিশের ভয় দেখালাম।

শর্মিলা মাথা ঝুঁকিয়ে দ্বিতীয়বার কেঁদে ফেললেন। ওঁর পিঠটা ফুলে-ফুলে উঠছিল। ফরসা পিঠে গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজটা যেন কেটে বসেছে।

আমি ওঁকে সামলে নেওয়ার সময় দিলাম।

কিছুক্ষণ পরে শর্মিলা যা জানালেন তাতে ব্যাপারটা খুব একটা এগোল না।

শর্মিলা সত্যি-সত্যি পৌনে সাতটা নাগাদ দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আছে। ভেতরে ঢুকে শর্মিলা দরজা বন্ধ করে দেন। কারণ, দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে ওঁর যাতায়াত বহুদিন ধরেই–ফলে কোনও ভয়-টয় ওঁর মনে কাজ করেনি। রিসেপশানে কাউকে না দেখে ওঁর প্রথম খটকা লাগে। তারপর ভেতরে গিয়ে দেখেন দত্তগুপ্ত বিছানায় মরে পড়ে আছেন। ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই। তখন ভীষণ ভয় পেয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরোতে যাবেন ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। শর্মিলা তখন ভয়ে পাগলের মতো হয়ে যান। দিশেহারা অবস্থায় কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমাকে দরজা খোলেন।

তারপর তো আপনি সবই জানেন…। ধরা গলায় বললেন শর্মিলা, আপনাকে চিনি না, জানি না ঠিক কীভাবে কথা বলব বুঝতে পারছিলাম না।…আপনি সেদিন মিস্টার দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে কেন গিয়েছিলেন?

ভেতরের দ্বিধা কাটিয়ে সত্যি কথাই বললাম ওঁকে। তারপর জানতে চাইলাম, আপনি কেন গিয়েছিলেন?

পাশের ঘর থেকে ফোন বেজে ওঠার শব্দ শোনা গেল। শর্মিলা তড়িঘড়ি উঠে ফোন ধরতে চলে গেলেন।

একটু পরেই ফিরে এসে বললেন, এমন প্রফেশনে আছি যে, ফোন না থাকলে চলে না। তবে খুব দরকার ছাড়া ফোন করি না। সবসময় ভয় হয়–এই বোধহয় দেড়শো ফ্রি কল পেরিয়ে গেল।

আপনি ওখানে কেন গিয়েছিলেন? ঠান্ডা গলায় আবার প্রশ্ন করলাম।

শর্মিলা দুবার ঢোঁক গিললেন, তারপর বললেন, মিস্টার দত্তগুপ্তের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া ছিল।

কীসের বোঝাপড়া?

শর্মিলা উদাস চোখে আমার দিকে তাকালেন। ঘরের জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির রং-চটা দেওয়াল দেখা যাচ্ছিল। দেওয়ালে বিকেলের রোদ ঠিকরে পড়ে শর্মিলার ঠিকানায় খানিকটা আলো পাঠিয়ে দিচ্ছিল। সেই আলোয় শর্মিলার ফরসা গোলগাল মুখ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। আর ওর কোকড়ানো চুলে অসংখ্য হাইলাইটের কুচি চিকচিক করছিল।

রীতেনবাবু, আমার জীবনটা ছোটবেলা থেকেই নানান ঝড়ঝাপটায় কেটেছে। সেসব কাহিনি আপনাকে শুনিয়ে আর লাভ নেই। পিনাকী দত্তগুপ্তের ওখানে আমি প্রায় শুরু থেকেই ছিলাম। ওঁর ব্যবসা মেয়েদের নিয়ে–তবে তার নানারকম লেভেল আছে…।

আমি ছোট্ট করে বললাম, জানি।

কী করে জানলেন! শর্মিলা অবাক হয়ে গেলেন? জানেন, লাস্ট লেভেলে কী ধরনের কাজ করতে হয়?

জানি। এই তিন-দিনে আমি প্রচুর খবর জোগাড় করেছি, ম্যাডাম। পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করতে এলে আমাকে তো আগে বাঁচতে হবে! সে যাকগে–আপনি যা বলছিলেন বলুন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শর্মিলা তেতো গলায় বলতে শুরু করলেন, আমি ওঁর কাছে সব লেভেলেরই কাজ করেছি : টেলিফোনে খোশগল্প করা থেকে শুরু করে একেবারে শেষ পর্যন্ত। পরের দিকে শুধু লাস্ট লেভেলের কাজই করতাম। প্রথম প্রথম অভাবের জন্যে…শেষ দিকে হয়তো স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল…কে জানে! শর্মিলা কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললেন, এই করতে করতে সময় গড়িয়ে গেল, বয়েস গড়িয়ে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখুন, যখন জীবনটা একেবারে হোপলেস জায়গায় চলে গেছে বলে ধরে নিয়েছি, যখন সব ফুল ঝরে গেছে, তখনই আনএক্সপেক্টেড একটা ঘটনা ঘটল…।

কী?

মরা গাছে ফুল ফুটল। আই ফেল ইন লাভ। জনির প্রেমে পড়ে গেলাম। বিষণ্ণ হাসলেন শর্মিলা : কখনও ভাবিনি এরকম বয়েস-পেরোনো বয়েসে আমি প্রেমে পড়ে যাব–তাও আবার আমার চেয়ে কমবয়েসি কোনও পুরুষের সঙ্গে…।

শর্মিলার মুখে ঠিকরে পড়া আলোটা ক্রমেই কনে-দেখা-আলো হয়ে যাচ্ছিল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক অদ্ভুত ঘোরের ভেতর থেকে শর্মিলা কথা বলে চললেন।

জনির সঙ্গে কাছাকাছি আসার পর আমার সবকিছু বদলে যেতে চাইল। ওর সঙ্গে আমার মেলামেশায় কোনও ফাঁক ছিল না। কিন্তু কোথায় ও ফুর্তি-টুর্তি করে কেটে পড়বে, তা না, আমাকে বিয়ে করার বায়না ধরল। আমার মনটাও কেমন যেন হয়ে গেল…রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু বিয়ের পর আমি কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলতেই দত্তগুপ্ত খেপে গেলেন। জনি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে সিকিওরিটি অফিসারের চাকরি করে। আর টুকটাক মডেলিং করে আমিও দু-পয়সা আয় করি। ফলে সংসার চালাতে কোনও প্রবলেম হওয়ার কথা নয়। সেইজন্যেই ওসব কাজ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দত্তগুপ্ত পরিষ্কার আমাকে বললেন, একটা কেন, দশটা বিয়ে করো– তবে লাইন ছাড়তে পারবে না। আমার বিজনেসের ক্ষতি হবে।

দত্তগুপ্ত এমনিতে ভালো লোক ছিলেন কিন্তু বিজনেসের এক ইঞ্চি ক্ষতি হলেই রাগে পাগল হয়ে যেতেন। আমাকে তো ঘরে ডেকে নিয়ে যা-তা বললেন। যখন দেখলেন আমি সেই এক গোঁ ধরে আছি, তখন বিচ্ছিরিভাবে হেসে একটা বড় খাম বের করলেন। খামের ভেতরে ছইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি মাপের অনেকগুলো কালার ফটোগ্রাফ ছিল। নানান ধরনের কাস্টমারের সঙ্গে আমার ছবি–সবই বেডরুমের…একটাতেও গায়ে সুতো নেই।

আমি তাতে ভয় পাইনি। কারণ, জনি আমার এই লাইফের কথা জানত। সব জেনেই ও আমাকে বিয়ে করেছে। তাই জোর গলায় দত্তগুপ্তের হুমকির প্রতিবাদ করি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখের হাসি হাসলেন শর্মিলা। ছোট করে মাথা নাড়লেন এপাশ-ওপাশ। তারপর বললেন, দত্তগুপ্তকে চিনতে আমি ভুল করেছিলাম। উনি আমার কথায় দমে না গিয়ে হেসে বললেন, শর্মিলা, তুমি বড় ছেলেমানুষ। প্রেম-টেমের ব্যাপারগুলো আমি বুঝি। এই ছবিগুলো আমি তোমার হাজব্যান্ডের কাছে পাঠাব না। ছাপিয়ে বই করে পর্নোগ্রাফির মার্কেটে বিক্রি করব। এত কম দামে বেচব যাতে কয়েকমাসে লক্ষ-লক্ষ কপি উবে যায়। তাতে ছবির সঙ্গে-সঙ্গে তোমার নাম-ঠিকানাও ছাপা থাকবে। কনট্যাক্ট ফোন নাম্বার, আর পার-নাইট রেটও ছাপা থাকবে। তোমার সোসাল লাইফ বলে কিছু থাকবে না। শুধু থাকবে অ্যান্টিসোসাল লাইফ।

এরপর দত্তগুপ্ত প্রাণ খুলে হেসেছিলেন। ভয়ে আমি কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ওঁর ফ্ল্যাট থেকে ফিরে এসেছিলাম। তার পরে বহুবার ওঁকে রিকোয়েস্ট করেছি কিন্তু ওঁকে নড়াতে পারিনি। তখন বাধ্য হয়ে আমি নানাভাইয়ের কাছে যাই…।

কে নানাভাই? আমি জিগ্যেস করলাম।

আড়চোখে হাতঘড়ির দিকে একবার দেখলেন শর্মিলা। তারপর ঢোঁক গিলে বললেন, মিস্টার দত্তগুপ্তের এলাকাটা ওঁর দখলে। দত্তগুপ্ত মাসে-মাসে নানাভাইকে দশহাজার টাকা করে দিতেন।

নানাভাইয়ের কাছে আপনি কবে গিয়েছিলেন?

লাস্ট মান্থে।

তারপর?

নানাভাইকে আমি চিনতাম। দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটেই একবার আলাপ হয়েছিল। আমার কথা শুনে নানা বললেন, কোনও চিন্তা নেই। সব প্রবলেম সম্ভ হয়ে যাবে। তারপর…।

নানাভাইকে আপনি কোনও টাকা দিয়েছিলেন?

না, না! কোনও টাকা দিইনি।

নানাভাই কীভাবে প্রবলেম সলভ করবেন বলেছিলেন?

না বলেননি।

তা হলে কি নানাভাই সবচেয়ে সোজা-সরল পথে প্রবলেমটা সল্ভ করে দিয়েছেন! দত্তগুপ্তের মুখের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে তারপর…।

হঠাৎই শর্মিলা বললেন, নানাভাই মহিলাদের খুব রেসপেক্ট করেন। আমার অবস্থায় কথা শুনে ছোট্ট করে শুধু বলেছিলেন, ম্যাডাম, আপনার কথা যদি সাচ্চা হয় তা হলে ওই বাস্টার্ডটার আমি কাম তামাম করে দেব। আর যদি খোঁজ নিয়ে দেখি আপনি মিথ্যে কথা বলেছেন, তা হলে আমার ছেলেরা আপনাকে পাবলিক প্লেসে বেইজ্জত করে ছাড়বে। তখন…তখন আমি কেঁদে নানাভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরি…।

কিন্তু আপনি এটা খেয়াল করেছেন, দত্তগুপ্তকে মার্ডার করলে নানাভাইয়ের মান্থলি ইনকাম দশহাজার টাকা করে কমে যাবে।

হ্যাঁ জানি। সেইজন্যেই তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না..দত্তগুপ্তকে কে মার্ডার করল…আপনি আমাকে ফর নাথিং সন্দেহ করছেন।

আমার মনের ভেতরে একটা ঘূর্ণি তৈরি হচ্ছিল। এ কোন জটে জড়িয়ে পড়লাম আমি! বর্ষার কথাটা মনে পড়ল? আমরা চুপচাপ থাকি না! আমাদের ঝামেলায় জড়ানোর কী দরকার!

আমি কি তা হলে ভুল করছি?

আপনি এখন কী করতে চান? শর্মিলার আচমকা প্রশ্নে আমি চমকে উঠলাম।

সত্যিই তো! এখন কী করব আমি? কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়লাম।

একটু পরেই মনে হল, পুলিশ বরং পুলিশের কাজ করুক। আমি আর বর্ষা চুপচাপ থাকি। যদি পুলিশ তদন্ত করতে করতে আমাকে কিংবা বর্ষাকে অ্যারেস্ট করে হ্যারাস করে, তখন না হয় কিছু একটা করা যাবে। দরকার হলে নানাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বিপদের কথা বলব।

নানাভাইয়ের ফোন নাম্বারটা আমাকে দিতে পারেন?

কেন, কী করবেন? শর্মিলা যেন ভয় পেয়ে গেলেন।

ফোন নাম্বার নিয়ে লোকে কী করে–ফোন করে। আমিও তাই করব। নানাভাইয়ের ফোন নাম্বারটা আমাকে দিন। আমার শেষ কথাটায় একটু কড়া সুর ছিল।

শর্মিলা আমার চোখে কী যেন দেখলেন। তারপর তড়িঘড়ি উঠে গিয়ে একটা ডায়েরির পাতা উলটে নানাভাইয়ের ফোন নাম্বারটা আমাকে বললেন। আমি মোবাইল ফোনের বোতাম টিপে নাম্বারটা টেলিফোন ডিরেক্টরিতে ঢুকিয়ে নিলাম।

শর্মিলা তখন আমার মোবাইল নাম্বারটা চাইলেন। দিলাম। এবং ওঁর ফোন নাম্বারটাও মোবাইল ফোনে স্টোর করে নিলাম।

মিস্টার দত্তগুপ্ত মার্ডার হওয়ার পর আপনি নানাভাইয়ের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ করেননি?

না– শর্মিলা ইতস্তত করে জবাব দিলেন, পুলিশের অ্যাকটিভিটিটা একটু থিতিয়ে আসুক..তারপর হয়তো কনট্যাক্ট করব। শর্মিলা আবার হাতঘড়ি দেখলেন। কাতর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার উঠুন, প্লিজ। জনি এখুনি এসে পড়বে। তারপর…।

মোবাইল ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, ম্যাডাম, চলি। থ্যাঙ্ক য়ু ফর ইয়োর কোঅপারেশন।

শর্মিলা বোস ভদ্রতার হাসি হাসলেন, বললেন, আপনার খোঁজখবরে নতুন কোনও ডেভেলাপমেন্ট হলে আমাকে জানাবেন। দরকার হলেই বলবেন আমি সবসময় হেল্প করতে রাজি আছি।

ঠিক সেই মুহূর্তে একজন দশাসই চেহারার লোক হুট করে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। তাকে দেখে শর্মিলার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ওঁর ফরসা মুখ থেকে সমস্ত রক্ত কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিল। একবার আমার দিকে, একবার আগন্তুকের দিকে সন্ত্রস্তভাবে তাকাতে লাগলেন। যেন এক্ষুনি কোনও বিপদ হতে পারে।

ঘরে যে ঢুকেছে তার হাবভাবে একটু মালিক-মালিক ছাপ রয়েছে। গায়ের রং রোদে পোড়া তামাটে। চৌকো মুখে অকালে ভাঁজ পড়েছে। কপালে কিছু বেশি। ছোট-ছোট চোখে ঘোলাটে ভাব। চোখের নীচে অ্যালকোহলের ব্যাগ। আর ঠোঁটে কালচে ছোপ। নাকটা পেশাদার বক্সারদের মতো চ্যাপটা। মাথার কালো কুচকুচে চুল তেল মেখে পেতে আঁচড়ানো।

বয়েস পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। পরনে ঘিয়ে রঙের হাওয়াই শার্ট আর নস্যি রঙের ফুলপ্যান্ট। জামাটা ঢোলা হলেও পেশি আর স্বাস্থ্য এখানে-সেখানে জানান দিচ্ছে।

আমার হাজব্যান্ড–জনি। মুখে চেষ্টা করে হাসি ফুটিয়ে শর্মিলা বললেন।

মুখটা চিনতে পারলাম। কারণ, দেওয়ালে টাঙানো একটা রঙিন ফটোগ্রাফে জনি ওর এক রোগাপটকা বন্ধুর সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি হেসে হাত বাড়ালাম জনির দিকে। জনি হাসল। ওর মুখের রুক্ষ সন্দিহান ছাপটা কেটে গেল। আমার সঙ্গে হাত মেলাল।

ওকে উইশ করে আমার পরিচয় দিলাম। তারপর আর কিছু বলার আগেই শর্মিলা বলে উঠলেন, মিস্টার মিত্র একটা অ্যাড ফিল্মে আমাকে দিয়ে কাজ করাতে চান। আজ বিকেলেই স্পেকট্রাম অ্যাড-এর অফিসে ওঁর সঙ্গে কনট্যাক্ট হয়েছে।

ইশারা থেকে বুঝে নেওয়া বুদ্ধিমান লোকের কাজ। তাই একগাল হেসে বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই ওয়েট করছিলাম। ম্যাডাম বলছিলেন যে, আপনি এখুনি এসে পড়বেন…।

জনি একটা মোড়া টেনে নিয়ে আমাদের কাছাকাছি বসে পড়ল। অনুরোধের সুরে বলল, অ্যাডের কাজ-টাজের খোঁজ পেলে ওকে দেবেন। ওর মধ্যে পার্টস আছে কিন্তু ভালো চান্স পায়নি। তবে যারাই ওকে দিয়ে কাজ করিয়েছে দে গট হুন্ড। হোয়াট ডু য়ু সে, হানি? জনি হো-হো করে হেসে উঠল।

হাসতে-হাসতে হঠাৎই ওর খেয়াল হল আমি দাঁড়িয়ে আছি। তাই বলল, আপনি বসুন — শর্মিলার দিকে ফিরে : ওঁকে চা-টা দিয়েছ?

শর্মিলা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে–আর বসব না। আজ চলি–পরে আবার দেখা হবে।

শর্মিলা আমাকে সদর পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

হঠাৎই একটা কথা মনে পড়ায় ওঁকে জিগ্যেস করলাম, ম্যাডাম, দত্তগুপ্ত কি চুরুট খেতেন?

আচমকা এই ধরনের প্রশ্নে শর্মিলা কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। তারপর একটু ভেবে বললেন, হ্যাঁ, মাঝে-মাঝে মিস্টার দত্তগুপ্তকে যেন চুরুট খেতে দেখেছি।

আমার কপালে ভাঁজ পড়ল। কী যে করি এখন! এভাবেই কি আমাকে আঁধারকানা হয়ে ঘুরে-ঘুরে মরতে হবে! বর্ষা যদি ফোন করে তা হলে ওর সঙ্গে একটু আলোচনা করে দেখি।

শর্মিলাদের ঘর থেকে আবছাভাবে ইংরেজি গানের কলি ভেসে আসছিল। জনি গান গাইছে। তারপরই নাম ধরে স্ত্রীকে ডাকল জনি। একবার। দুবার।

শর্মিলা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলেন। তারপর ব্যস্তভাবে বললেন, যাই–পরে আপনাকে ফোন করব। আপনিও দরকার হলে ফোন করতে পারেন। দুপুরে করবেন–জনি তখন থাকবে না।

আবার রাস্তার আমার সঙ্গী হল। তবে সূর্যের পালা এখন শেষ। একটু পরেই চাঁদের পালা শুরু হবে।

.

০৬.

বাড়ি ফেরার পর আমার ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা দেখে মা আঁতকে উঠল। কয়েক লাইন বকুনি দিয়ে তারপর গজগজ করতে করতে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল এনে দিল। প্রায় শাসনের সুরে বলল, এবার একটু বিশ্রাম কর। বাড়ি থেকে আর বেরোস না।

মা কথাগুলো না বললেও পারত। কারণ, আমার শরীর আর বইছিল না। নিজের ঘরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে বিছানায় গা ঢেলে দিলাম। এলোমেলো চিন্তা মনের মধ্যে ঝড় তুলতে লাগল। তারই মধ্যে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

ঘুম ভাঙল মোবাইল ফোনের সুরেলা আওয়াজে।

ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি ঘর অন্ধকার। মোবাইল ফোনটা টেবিলে রাখা ছিল। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সেদিকে এগোতে এগোতেই ফোনের বাজনা বন্ধ হয়ে গেল। ইস, বোধহয় বর্ষার ফোন ছিল।

আলো জ্বেলে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে মিসড কল-এর লিস্টে ফোন নাম্বারটা দেখলাম। না, বর্ষার নাম্বার নয়। আমার চেনা অন্য কোনও নাম্বারও নয়।

এরপর সিগারেট, চা, আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সময় কাটতে লাগল। একসময় আর পেরে না উঠে টেপ রেকর্ডারে গান চালিয়ে দিলাম। ধীরে-ধীরে দত্তগুপ্ত, শর্মিলা, জনি, নানাভাই, সবাই আবছা হয়ে আসতে লাগল।

কিন্তু বর্ষার ফোন এল না।

রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আর থাকতে না পেরে বর্ষাকে ফোন করলাম। বোধহয় ওর মা ধরলেন। ধরেই প্রশ্ন করলেন, কে বলছেন?

আমি নাম বললাম।

বর্ষা এখন নেই। একটু কাজে বেরিয়েছে। আপনি কাল সকাল আটটা নাগাদ ফোন করবেন– পেয়ে যাবেন।

ফোন শেষ হওয়ার পর বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম। এত রাতে কোন কাজে বেরিয়েছে বর্ষা! দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে গিয়ে কোনও বিপদে পড়ল না তো! নাকি মিস রোজির বাড়িতে গেছে!

পরদিন অফিসে গিয়ে আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।

অন্যান্য অস্কার নমিনিকে উপেক্ষা করে বর্ষা সরাসরি চলে এল আমার কাছে। ফ্যাকাসে মুখে বলল, রীতেনদা, কাল আপনি ফোন করেছিলেন? আমি তখন কড়েয়া থানায় গিয়েছিলাম।

শুনে আমার ফ্যাকাসে হওয়ার পালা।

থানায়! তার মানে!

ও নীচু গলায় সব বলল।

কড়েয়া থানা থেকে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল। পাড়ার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে ও থানায় দেখা করতে গিয়েছিল। বর্ষা জানত, সন্ধের পর কোনও মহিলাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে থানায় ডেকে পাঠানো যায় না। কিন্তু কৌতূহল ওকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

সেখানে পুলিশকে ও যা বলার বলেছে। এও বলেছে, খুনের ব্যাপারে ও কিছু জানে না। পুলিশের ধারণা, দত্তগুপ্তকে কেউ বদলা নেওয়ার জন্যে খুন করেছে। কোনও মাফিয়া ডনও খুনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে।

আচ্ছা, বর্ষা, মিস্টার দত্তগুপ্ত কি চুরুট খেতেন?

আমার আচমকা প্রশ্নে ও থতোমতো খেয়ে গেল, বলল, না তো! উনি ক্লাসিক খেতেন। মিস রোজিকে একদিন আমার সামনেই প্যাকেট বের করে অফার করেছিলেন আমি দেখেছি।

আমার মনের ভেতরে ঝড় উঠল। হে নিয়তি, এ তোমার কেমন খেলা!

বর্ষা চাপা গলায় জিগ্যেস করল, আপনার ছুটোছুটির কী রেজাল্ট হল?

ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা। হেসে বললাম, এখন নয়। এক্ষুনি পুরকায়স্থ তোমাকে তলব করে বসবে। চলো, আজ বাইরে লাঞ্চ করব। তখন সব বলব…।

বর্ষা ঘাড় কাত করল। ওর শ্যাম্পু করা চুল বিজ্ঞাপনের মতো দেখাল।

আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখছিলাম, হঠাৎই দেখি প্রকাশ রায়চৌধুরী হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বর্ষাকে বললাম, বর্ষা, এবার একটু প্রকাশের কাছে যাও–বৃষ্টি দাও। নইলে ওর চোখ মুখের যা হিংস্র অবস্থা দেখছি তাতে সামনে যাকে পাবে তাকেই কামড়ে দেবে।

এত সমস্যার মধ্যেও বর্ষা হাসল। হেসে সত্যি-সত্যিই চলে গেল প্রকাশের টেবিলের কাছে।

আমি মাথা নীচু করে কাজে মন দিলাম। প্রেমে গদগদ হায়েনাকে কেমন দেখায় সেটা আমি আর দেখতে চাই না।


রশিদ আমাকে পথ দেখিয়ে নানাভাইয়ের আস্তানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ওর লম্বা-লম্বা চুল, ভাঙা গাল, লিকলিকে ঢ্যাঙা চেহারা দেখলে কে বলবে ও নানাভাইয়ের হিটম্যান–দু-চারটে খুন ওর কাছে কোনও ব্যাপার নয়!

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সঙ্গে ছাতা নেই। তাই দুজনেই অল্পবিস্তর ভিজতে ভিজতে কাদা-জল মাড়িয়ে একটা বস্তির সরু গলি ধরে এগোচ্ছিলাম। কলকাতার কোনও গলিতেই ভদ্রলোকের মতো আলো নেই। এখানেও তাই। কলকাতা চিরকালের জন্যে উন্নয়নশীল রয়ে গেল! সত্যি-সত্যি যদি কোনওদিন কলকাতার উন্নতি ঘটে যায়, তা হলে এখানে উন্নয়নশীল কাজকর্ম যেসব জনগণঅন্তপ্রাণ মহাজন করে থাকেন তাঁরা নিতান্ত বেকার হয়ে পড়বেন।

নানাভাইয়ের অট্টালিকার সামনে পৌঁছে বুকের ভেতরটা ভয়ে মুচড়ে উঠল। বেঘোরে প্রাণ দেওয়ার এই পদ্ধতিটাই যে কেন আমার সবচেয়ে পছন্দ হল কে জানে! ভয় তাড়াতে বর্ষার কথা ভাবতে শুরু করলাম।

পরশুদিন বর্ষার সঙ্গে বিস্তর আলোচনার পর মনে হল, নানাভাইয়ের সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ করতে হবে। আমাকে পুলিশ হাজতে পুরে থার্ড ডিগ্রি দেওয়ার আগে আসল খুনিকে ধরা চাই। আর সেটা নিশ্চয়ই রীতেন মিত্রের কর্ম নয়! অতএব নানাভাই।

গতকাল শর্মিলাকে ফোন করেছিলাম। আমার নাম বলামাত্রই তিনি যে-ধরনের হাসি হাসলেন তাতে যে-কোনও লোকের মনে হতে পারে স্পেকট্রাম অ্যাড-এর সঞ্জিত করের ধারণাটাই ঠিক। আবার দত্তগুপ্ত বেঁচে থাকলে বলতেন, শর্মিলা বোস ফার্স্ট লেভেলের কাজ করছে।

কেমন আছেন, ম্যাডাম?

ভালোই। আপনি?

আপাতত ঠিক আছি–তবে আপনার হেল্প না পেলে আমার ফিউচার টেনস হতে পারে। আর তাই নিয়েই ভীষণ টেনশানে আছি।

বলুন, কী হেল্প করতে হবে।

নানাভাইকে একটু কনট্যাক্ট করতে চাই। আপনি ফোন নাম্বার দিয়েছেন ঠিকই তবে ডায়রেক্টলি ফোন করাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

নানাভাইকে ফোন করে আপনি কী বলবেন?

আবার সেই একই প্রশ্ন! শর্মিলা কি চান না আমি নানাভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি? কিন্তু শর্মিলা তো এও জানেন, আমাকে হেল্প না করে ওঁর উপায় নেই। আমি পুলিশের ঝামেলায় জড়ালে উনিও রেহাই পাবেন না। তাতে হয়তো জনির সঙ্গে ওঁর প্রেমের বিয়েটা চটকে যাবে।

একটু হেসে বললাম, আমি মহিলা হলে কোনও প্রবলেম ছিল না। কারণ, আপনিই তো বলেছেন নানাভাই মহিলাদের খুব রেসপেক্ট করেন। কিন্তু পুরুষদের কী করেন? পিনাকী দত্তগুপ্তের মতো কাম তামাম করে দেন?

শর্মিলা কিশোরীর মতো হেসে উঠলেনঃ দত্তগুপ্তের সঙ্গে আপনার কোনও তুলনা চলে না। একটু থেমে আদুরে গলায় বললেন, আপনি দারুণ অ্যাট্রাকটিভ।

আমার হাত থেকে ফোনের রিসিভারটা আর-একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল। আমাকে এইরকম ভালো-ভালো কথা বলার জন্যে শর্মিলা পরে হয়তো সেল ট্যাক্সসমেত বিল পাঠাবেন।

ম্যাডাম, প্লিজ। আমার অবস্থাটা একবার বুঝুন। নানাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে দিন।

শর্মিলা তখন আমাকে রশিদের কথা বলেন। ওর ফোন নাম্বার দেন। তারপর ও রশিদের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। আমি ওকে ফোন করে আপনার কথা বলে দিচ্ছি। আপনি আধঘণ্টা পরে ওকে ফোন করুন। তবে খুব কেয়ারফুলি কথাবার্তা বলবেন। ও নানাভাইয়ের একনম্বর হিটম্যান।

যখন টেলিফোন ছাড়তে যাচ্ছি তখন শর্মিলা আবার জানতে চাইলেন, নানাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আমি কী করব।

মনে-মনে ভীষণ বিরক্ত হলেও মিষ্টি গলায় উত্তর দিলাম, নানাভাই কেমন আছেন, তাঁর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেমন আছে, সে-কথা জিগ্যেস করব। তারপর জানতে চাইব, দত্তগুপ্তকে মার্ডারের গুপ্তকথা। একটু হেসে যোগ করলামঃ পরে আপনাকে সব জানাব।

এবং রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।

টিন ও টালির তৈরি খুপরি গোছের বেঁকাতেড়া ঘরগুলোর প্রায় গা ঘেঁষে জিরাফের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নানাভাইয়ের প্রাসাদ। বস্তির কারুকার্যের পাশে শ্রাবস্তীর কারুকার্য বড়ই বেমানান ঠেকছিল।

কোলাপসিবল গেটের সামনে জোরালো আলো জ্বলছিল। ভেতরে একটা ঘরের খানিকটা অংশ চোখে পড়ছিল। লোকজনের চাপা কথাবার্তার আওয়াজ কানে আসছিল।

রশিদ পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে ডায়াল করল। চাপা গলায় কী সব কথা বলল। তারপর আমাকে হাত নেড়ে ইশারা করলঃ যাইয়ে, অন্দর যাইয়ে, ভঁয়ে তরফ কা বড়া কামরা। পহেলে আপনা নাম বনা–নানাভাই সমঝ জায়েঙ্গে।

রশিদের নির্দেশমতো ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম। ভয়ে ঠকঠক করে পা কপার ব্যাপারটা যে নেহাতই কথার কথা নয় সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম। বেশ কষ্ট করে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ডানদিকের একটা বড় ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

দরজায় গ্রিলের পাল্লা হাট করে খোলা। তারপর কাঠের পাল্লা। হয়তো বাড়তি নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা। যারা মানুষের কাছে ভয় ফিরি করে বেড়ায় তারাও তা হলে ভয় পায়!

ঘরের ভেতরে ঢুকতেই শৌখিন আতর আর মদের গন্ধ আমার নাকে ঝাপটা মারল। একেবারে পেছনের দেওয়াল ঘেঁষে কাঁচে ঢাকা বড়সড়ো এক্সিকিউটিভ টেবিল। তার ওপিঠে গদিমোড়া ঘূর্ণি চেয়ার। তাতে শরীর এলিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে যিনি আয়েসি ঢঙে বসে আছেন তিনিই বোধহয় নানাভাই।

মাথায় শতকরা নব্বই ভাগ মরুভূমি। মাথার পেছনদিকটায় আর কানের পাশে ছিটেফোঁটা মরূদ্যান। গায়ের রং কালো। বছর পঞ্চাশের থলথলে মুখ। ঠোঁটের ওপরে কাঁচাপাকা গোঁফ আর কাঁচাপাকা চাপদাড়ি। দাড়ির নীচেও চিবুকের ভাঁজ চোখে পড়ছে।

নানাভাইয়ের পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। গলায় পাহাড়ি কাঁকড়াবিছের লেজের মতো মোটা সোনার চেন। ডান হাতের ডুমো ডুমো আঙুলে চারটে পাথর বসানো ভারী সোনার আংটি। ডানহাতের কবজিতে সোনার রিস্ট ব্যান্ড।

নানাভাইয়ের সামনের টেবিলে দুটো মোবাইল ফোন পড়ে আছে। তার পাশে কাটগ্লাসের নকশা তোলা গ্লাসে নেশা টলটল। তার কাছাকাছি নেশার বোতল, সোডার বোতল, চিকেন পকোড়ার প্লেট, আর পাঁচশো পঞ্চান্ন সিগারেটের প্যাকেট।

টেবিলে আরও চোখে পড়ল একটা ডায়েরি, তিনটে পেন, আর ডানদিক ঘেঁষে একটা পারসোনাল কম্পিউটার।

ঘরের বাঁদিকের দেওয়ালে বসানো রয়েছে একটা এয়ারকুলার মেশিন। কিন্তু মেশিন বোধহয় খারাপ–তাই তিনটে সিলিং পাখা ঘুরছে।

নানাভাইয়ের টেবিলের এদিকটায় চারটে গদিমোড়া চেয়ার–গেস্টদের জন্যে। সেখানে মাঝারি চেহারার একজন বসে ছোলা বা বাদাম কিছু একটা চিবোচ্ছে। এ ছাড়া দরজার ডানদিকে লম্বা গদিওয়ালা বেঞ্চে দুজন লোক বসে রয়েছে। ওদের চেহারা আর হাবভাব স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওরা নানাভাইয়ের ছেলে। ওদের মধ্যে একজনকে কেন জানি না, চেনা-চেনা মনে হল।

আমি ইতস্তত পায়ে এগিয়ে গেলাম নানাভাইয়ের টেবিলের কাছে। টের পেলাম নানার ছেলেদের একজন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চয়ই তার ডান হাত পকেটে ঢোকানো এবং সতর্ক নজরে আমার গতিবিধি লক্ষ করছে।

আ-আমার নাম রীতেন মিত্র…।

মুক্তোর মতো ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে নানাভাই হাসলেন। ওঁর ফোলা ফোলা গাল আরও ফুলে উঠল। বললেন, আসুন, আসুন বসুন। রশিদ আপনার ব্যাপারে আমাকে বলছিল।

ওঁর কথায় সামান্য টান টের পাওয়া গেল।

আমি বসলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। আতর আর মদের গন্ধ নাক অবশ করে দিচ্ছিল। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায় কী!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললাম, নানাভাই, একটা প্রবলেমে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।

প্রবলেমে না পড়লে আমার গরিবখানায় কেউ আসে না। হাসলেন নানা : বলুন, কী প্রবলেম?

আমি তখন পিনাকী দত্তগুপ্তের খুনের ব্যাপারটা বললাম। বললাম, পুলিশ আমাকে একবার ইন্টারোগেট করেছে–আবার করতে পারে। ওরা বোধহয় মার্ডারটার ব্যাপারে আমাকেই সন্দেহ করছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ হয়তো আমাকেই অ্যারেস্ট করবে। তবে বর্ষা কিংবা শর্মিলা বোসের কথা বললাম না।

কড়েয়া থানার কে আপনাকে হ্যারাস করছে? মুখার্জিবাবু? দাসবাবু?

আমি তখন ভয় পেয়ে বললাম যে, না, এখনও ঠিক হ্যারাস করেনি। তবে আচমকা হয়তো অ্যারেস্ট করতে পারে। আমি একজন সাধারণ কম্পিউটার প্রোগ্রামার কারও সাতে-পাঁচে থাকি না। এসব ব্যাপার লোক-জানাজানি হলে আমি লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারব না।

ইচ্ছে করেই নানাকে ইন্সপেক্টর বিশ্বাসের নাম বললাম না।

নানা গ্লাসে চুমুক দিলেন, চেয়ারের হাতলে বারকয়েক টোকা মারলেন। কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন।

আমি আর থাকতে না পেরে মরিয়া হয়ে জিগ্যেস করলাম, নানাভাই, দত্তগুপ্তকে কি আপনি…মানে, আপনার কোনও লোক কি ইয়ে…মানে, মার্ডার করেছে?

নানাভাইয়ের চিন্তার ঘোর কেটে গেল। আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে হো-হো করে হেসে উঠলেন। দেখাদেখি ওঁর তিন শাগরেদও হাসতে শুরু করল।

আমি ফ্যালফেলে চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো বসে রইলাম। মনের মধ্যে অপমানবোধ খোঁচা মারছিল।

কিছুক্ষণ পর হাসির দমক কমলে, নানাভাই বললেন, আপ বড়া ভোলা সাদাসিধা আদমি হ্যায়, মিত্তিরবাবু। আমার এরিয়ায় বা ক্লায়েন্টদের কানেকশানে অন্য এরিয়ায় মাসে আমাকে দু-পাঁচ দশটা বডি ফেলতে হয়। কবে কোন বডি ফেলেছি তার ডিটেইল্স কি মুখে-মুখে বলা যায়! কী নাম বললেন যেন?

আমি পিনাকী দত্তগুপ্তের নাম-ঠিকানা আবার বললাম।

হিকপিক–।

এই বিচিত্র শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে পেছন থেকে চেনা-চেনা মনে হওয়া ছেলেটি ইয়েস বস বলে নানার টেবিলের কাছে এগিয়ে এল।

বুঝলাম, হিকপিক ওর নাম। আচার্য সুনীতিকুমার বেঁচে থাকলে এই নামের উৎপত্তি এবং ব্যুৎপত্তি নিয়ে হয়তো একটা নিষ্পত্তি করে ফেলতেন।

হিকপিক, জেরা দেখ তো, ইয়ে ডায়েরিমে ইয়া কম্পুটারমে উও পিনাকী দগুপ্তকা বডিকা হিসাব হ্যায় কি নহি…।

হিকপিক নানার টেবিল থেকে ডায়েরিটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। তারপর একমনে পাতা ওলটাতে লাগল।

আমি চুপ করে বসে রইলাম। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নানাভাই আমার পাশে বসা ছোলা-কিংবা-বাদাম-চিবোনো লোকটার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন।

হিকপিকের ডায়েরি দেখা শেষ হল। আপনমনেই এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে ও বলল, ডায়েরিমে তো নহি মিলা, বস। অব দেখতে হ্যায় কম্পুটারমে…।

হিকপিকের লিকপিকে রুক্ষ চেহারা দেখে ওকে ভিখিরি ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। অথচ এই লোকটা লেখাপড়া জানে, কম্পিউটার অপারেট করতে পারে! আমি ওকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করলাম।

কম্পিউটারে মিনিটখানেক বোতাম টেপাটিপির পর হিকপিক বলল, হমারা ক্লায়েন্ট থা, বস। মাহিনামে দশহাজার…।

ওর সুইচ অফ করে দিল কে? নানাভাই বিড়বিড় করে বললেন।

আমি ব্যাপারস্যাপার ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শর্মিলা আমাকে বলেছেন, পিনাকী দত্তগুপ্তের ব্যাপারটা নানা জানেন। হয়তো নানাই ওঁর কাম তামাম করে দিয়েছেন। অথচ দত্তগুপ্ত মার্ডার হলে নানার আয় মাসে-মাসে দশহাজার টাকা করে কমে যাবে। সবকিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। নানাভাইয়ের কাছে শর্মিলার নাম বলাটা কি ঠিক হবে? নাকি…।

ঠিক আছে, মিত্তিরবাবু। এই মার্ডারের ব্যাপারটা আমি ইনভেস্টিগেট করে দেখছি। তবে আপনার কোনও ভয় নেই। আপনি ভদ্দরলোক–তার ওপর আবার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। আমি কড়েয়া থানায় মেসেজ পাঠিয়ে দেব আপনাকে কেউ ট্রাবল দেবে না। হ্যাঁ, যা বলছিলাম…।

আমি নানার কথার প্রতিবাদ করে বলতে যাচ্ছিলাম যে, আমি ইঞ্জিনিয়ার নই নিতান্তই একজন ছাপোষা প্রোগ্রামার। কিন্তু নানাভাই একটানা কথা বলে যাচ্ছিলেন।

আমি আরও দুটো কম্পুটার কিনছি। এই তিনটে মেশিন এসি রুমে বসিয়ে দেব। আপনি এখন কত করে স্যালারি পান?

আমি বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। নানাভাই কোনদিকে এগোতে চাইছেন? কিন্তু পরিস্থিতি সুবিধের নয়। তাই মিনমিন করে জবাব দিলাম, সাড়ে দশহাজার মতো।

ব্যস! তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন নানাভাই ও এতে কোনও ভদ্দরলোকের মাস চলে! আপনি আমার কম্পুটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যান। মান্থলি বিশহাজার পাবেন–উইথ পার্ক। কিঁউ?

অপমানে আমার মুখে কোনও কথা জোগাচ্ছিল না। ঠোঁটজোড়া যে থরথর করে কাঁপছে সেটা ভালো করেই টের পেলাম। কেন যে মরতে আমি এখানে এলাম! শরীরটা শক্ত করে আমি মাথা নীচু করে বসে রইলাম। বর্ষার কথা ভেবে নিজেকে শান্ত করতে চাইলাম।

নানাভাই মুচকি মুচকি হাসছিলেন। আড়চোখে সে হাসি আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আর ভেতরে-ভেতরে জ্বলছিলাম।

হিকপিক কম্পিউটারের কাছ থেকে পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল আমার কাছে। মা যেমন করে অভিমানী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সেভাবে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, নানাভাইয়ের আপনাকে পছন্দ হয়েছে। তাই এরকম দারুণ অফার দিয়েছেন। রাজি হো যা, লালটু, রাজি হো যা–।

আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। দু-গাল থেকে আগুনের হলকা ঠিকরে বেরোচ্ছিল। হে ভগবান! যদি তুমি সত্যিই থেকে থাকে, তা হলে আমাকে অপমান সহ্য করার শক্তি দাও। আর যদি না থেকে থাকে, তা হলে তো মিটেই গেল!

কা মিত্তিরবাবু, কুছ বোলিয়ে…। নানাভাইয়ের গলা পেলাম।

আরও কিছুক্ষণ সময় নেওয়ার পর মুখ তুললাম। আমার মুখ দেখে নানাভাইয়ের মুখটা একটু বদলে গেল। হিকপিক একটু সরে দাঁড়াল আমার কাছ থেকে।

দাঁতে দাঁত চেপে আমি বললাম, আমার নতুন চাকরির দরকার নেই, নানাভাই। পুরোনোটাতেই বেশ চলে যাচ্ছে।

আপনার তো গুসসা হয়ে গেল দেখছি।

আমি হিকপিকের দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, আপনি যদি রাগ না করেন তা হলে কয়েকটা কথা বলি, নানাভাই…।

হাঁ, হাঁ বলুন, বলুন। হাত নেড়ে আমাকে উৎসাহ দিলেন নানা।

এই যে আপনার শাগরেদ হিকপিক ইশারায় হিকপিককে দেখালাম আমি ও ওর যা চেহারা তাতে ঝোড়ো বাতাসে রাস্তায় বেরোতে পারবে না–হাওয়ায় উড়ে যাবে। ওর বডি এত সরু যে, মেঝেতে কোনও ছায়া পড়বে না। ওর নাম হিকপিকের বদলে লিকপিক হলে মানানসই হত। তা সত্ত্বেও ওর কী সাহস দেখুন–। হাসলাম আমি ও তার কারণ ওর পেছনে আপনি আছেন– আমার পেছনে কেউ নেই। ওর পকেটে হয়তো আমর্স আছে–আমার নেই। খোদা মেহেরবান তো ঢুহা পহেলবান।

আমার কথায় হো-হো করে হেসে উঠলেন নানাভাই। গ্লাসের ওষুধটুকু এক ঝটকায় গলায় ঢেলে দিয়ে ঠোঁট চেটে নিয়ে মজা পাওয়া গলায় বললেন, মিত্তিরবাবু মরদ আছেন দেখছি। তো আমি যদি ওই শালা হিকপিকের পেছনে না থাকি, ওর পকেটে যদি কোনও আর্মস না থাকে, তা হলে আপনি কী করবেন?

আমি উঠে দাঁড়ালামঃ দেখিয়ে দেব যে, আমি লালটু নই। ওরকম তিন-চারটে হিকপিককে পালিশ করার হিম্মত রাখি।

হিকপিক আমার দিকে তেড়ে আসতে যাচ্ছিল, আমি হাত তুলে ওকে থামতে ইশারা করলাম, বললাম, এখনও থামো, নইলে দেরি হয়ে যাবে। তারপর নানাভাইয়ের দিকে ফিরে : আজ চলি, নানাভাই। আমার ব্যাপারটা একটু দেখবেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আমি নানার তিনজন শাগরেদের ম্যাপই মাথায় টুকে নিয়েছিলাম। এই মুখগুলো কখন কোথায় কাজে লাগে কে জানে!

নানার টেবিলে রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

হিকপিক আমার পাশে-পাশে দরজার দিকে এগোচ্ছিল। চাপা গলায় হিসহিস করে বলে উঠল, তেরা হিসাব ম্যায় ফিট কর দুঙ্গা।

আমার মাথার ভেতরে আগুন জ্বলে গেল। রাগে পাগল হয়ে আমি এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়ালাম। খপ করে হিকপিকের চোয়াল চেপে ধরলাম ও অভি ওয়ক্ত হ্যায়, লালটু, সুধর যা।

কথাটা বলেই ওকে পেছনদিকে আলতো করে ঠেলে দিলাম। হিকপিক চার্লি চ্যাপলিনের মতো টাল খেতে-খেতে পেছিয়ে গেল।

নানা কিংবা তার অন্য শাগরেদরা একটি কথাও বলল না, জায়গা থেকেও নড়ল না। বরং মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

বাইরে এসে রশিদকে পেলাম। ওকে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে শুরু করলাম।

.

০৭.

রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে একটা জটিল অঙ্ক মেলাতে চেষ্টা করছিলাম।

নানাভাইয়ের টেবিলে আমি সিগারেটের প্যাকেট দেখেছি, চুরুট নয়। কিন্তু সেটাই কি শেষ কথা? পুলিশ মার্ডার ওয়েপনটা পেয়েছে কি না আমি জানি না–জানার কোনও উপায়ও নেই। যদি পেয়ে থাকে, তা হলে সেটা কি দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গেল, না কি অন্য কোথাও থেকে।

আমি শুরু থেকে অঙ্কটা ভাবছিলাম।

দত্তগুপ্ত হয়তো খারাপ কাজ করত, কিন্তু তাই বলে কি খুনি পার পেয়ে যাবে। তা ছাড়া আসল খুনির হদিস না পেলে হয়তো আমাকেই তার বদলে জেলে গিয়ে প্রক্সি দিতে হবে। বাপি আমাকে বেশিদিন কাছে পাননি, কিন্তু তারই মধ্যে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। আমি যে এখন কী করি!

পিনাকী দত্তগুপ্ত, শর্মিলা বোস, ঘটনার দিন রাতে সিঁড়ি বেয়ে-ওঠা মোটা মতন সেই অবাঙালি ভদ্রলোক, নানাভাই, বর্ষা, এবং আমি। এই খুনের ব্যাপারে কারও গুরুত্বই কারও চেয়ে কম নয়। কিন্তু আমি কি মিথ্যে-মিথ্যে ভয় পাচ্ছি? এমন কি হতে পারে যে, সম্পূর্ণ অচেনা কেউ সম্পূর্ণ অজানা কোনও কারণে পিনাকী দত্তগুপ্তকে খুন করেছে! হতেও তো পারে।

বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। দীর্ঘশ্বাসকে বললাম, তোরা যত খুশি বুক ঠেলে লাইন দিয়ে পরপর বেরিয়ে আয়, কিন্তু আমার প্রবলেমটা সম্ভ করে দে।

বিছানায় উঠে বসে একটা সিগারেট ধরালাম।

সেই মুহূর্তেই মনে হল, কোথায় যেন একটা গরমিলের খোঁজ পেয়েছি আমি। কার একটা কথায় যেন আমার খটকা লেগেছিল। কে যেন বলল কথাটা! কে যেন…।

বহু চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না। কিন্তু আমার মন বলছিল, ওই কথাটা মনে পড়লেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব আমি।

রাতে বাড়ি ফিরতেই মিলি বলেছে আমার অফিস থেকে বর্ষা দাশগুপ্ত নামে একজন ফোন করেছিলেন। আমার মোবাইলে নাকি বহুবার চেষ্টা করেও লাইন পাননি।

অনেকসময় দেখেছি আকাশ মেঘলা থাকলে অথবা বৃষ্টি হলে মোবাইল ফোনের স্যাটেলাইট ঠিকমতো কাজ করে না। ফোনের ডিসপ্লেতে টাওয়ারের সিগনালটা কমজোরি হয়ে নেমে যায়। কাল হয়তো সেইজন্যেই বর্ষা লাইন পায়নি।

আজকের রাতটা খুব ঠান্ডা মাথায় আমাকে চিন্তা করতে হবে। অজস্র ভাঙা কাচ ছড়ানো পথে খুব সাবধানে পা ফেলে হাঁটতে হবে। তারপর গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে।

তাই বর্ষাকে আর ফোন করিনি। অন্ধকার ঘরে শুয়ে-শুয়ে শুধু ভেবে চলেছি। অথচ তারই মধ্যে বর্ষার কথা মনে পড়ছিল।

এইভাবেই নানান কথা ভাবতে-ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।

পরদিন ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকাডাকিতে।

উঠেই দেখি ঘড়ির কাঁটা নয়ের ঘর পেরিয়ে গেছে।

মা বলল, কী রে, আজ অফিসে বেরোবি না?

না, শরীরটা ভালো নেই।

শরীরের আর দোষ কী! দিন-রাত্তির টো-টো করলে কখনও শরীর ভালো থাকে!

কাল বৃষ্টিতে ভিজে আমার একটু ঠান্ডামতন লেগে গিয়েছে। একটা নাক রাত থেকে বন্ধ হয়ে আছে, গা ম্যাজম্যাজ করছে।

মায়ের কথার স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলাম। কলতলায় গিয়ে চোখেমুখে জল দিতে চোখ জ্বলতে লাগল।

ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে আসতেই মিলি খবরের কাগজ আর চা দিয়ে গেল। খবরের কাগজে দত্তগুপ্তকে নিয়ে এ কদিন আর কোনও খবর ছাপা হয়নি–আজও কোনও খবর নেই।

চায়ের পর সিগারেট ধরিয়ে আরও আধঘণ্টা সময় কাটালাম। বিছানার ওপরে খবরের কাগজটা ভোলা ছিল। সেখানে একটা বড় মাপের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ছিল। সিগারেটের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে ওরা দাবি করছে যে, ওদের সিগারেটের তামাকটা খুব হালকাও নয়, খুব কড়াও নয়– ঠিক যেমনটি আপনি চান।

কাল থেকে মনে-না-পড়া কথাটা আমার মনে পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে গেল।

বর্ষাকে অফিসে ফোন করলাম।

ফোন ধরেই ও একলক্ষ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আমার দিকে।

ওর প্রশ্নের জোয়ারে ডুবে যেতে-যেতে আমি বললাম, শরীরটা ভালো নেই। আমি আজ অফিসে যাব না। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। টেলিফোনে নয় সামনাসামনি কথা হওয়া দরকার। আজ সন্ধেবেলা ফ্রি আছ?

অফ কোর্স! সবকিছু জানার জন্যে ছটফট করছি।

সাড়ে ছটার সময়ে জগৎ সিনেমা হলের সামনে আসতে পারবে? আমি পাঁচ মিনিট আগে থেকেই তোমার জন্যে ওখানে ওয়েট করব। দেখা হলে সব বলব…।

ও.কে., রীতেনদা।

সি য়ু অ্যাট সিক্স থার্টি…।

ফোন শেষ করে ভাবতে বসলাম, বর্ষাকে কীভাবে সব বলব। সবকিছু কি ওকে বিশ্বাস করে বলা যায়? ওরও তো দত্তগুপ্তের সঙ্গে কোনও সমস্যা তৈরি হয়ে থাকতে পারে শর্মিলার মতন! তা হলে কতটুকু ওকে নিরাপদে বলা যায়?

এইসব উথালপাথাল ভাবনায় দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেল। সেই সময়ে শর্মিলার ফোন এল।

কৌতূহল বড় বিচিত্র জিনিস–বিশেষ করে মেয়েদের।

মিস্টার মিত্র, শর্মিলা বোস বলছি।

হ্যাঁ–বলুন।

কাল নানাভাইয়ের ওখানে কী হল?

রশিদ আপনাকে বলেনি?

কয়েক সেকেন্ড ও-প্রান্ত চুপচাপ। তারপর ঘনিষ্ঠ অভিমানী গলায়ঃ বলতে না চান বলবেন না–এরকমভাবে ইনসাল্ট করার কী আছে!

শর্মিলা কি আমাকে নিয়ে অন্যরকম কিছু ভাবতে শুরু করেছেন। জনির সঙ্গে ওঁর বিয়ে হয়েছে মাত্র মাসছয়েক। এর মধ্যেই শেকল আলগা হয়ে পড়তে চাইছে! নাকি এটা ওঁর স্বভাব?

পরের দিকে শুধু লাস্ট লেভেলের কাজই করতাম। প্রথম-প্রথম অভাবের জন্যে…শেষ দিকে হয়তো স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল..কে জানে! শর্মিলার কথাগুলো মনে পড়ে গেল আমার।

আমি বললাম, না, না, সেরকম কিছু নয়। ফোনে তো এত কথা বলা যায় না! সামনাসামনি দেখা হলে বলব।

এখনই আমার এখানে চলে আসুন না। বাড়িতে কেউ নেই–একা-একা ভীষণ বোর হচ্ছি। আপনার কথা শুনতে-শুনতে সময় কেটে যাবে…।

শর্মিলার স্বভাব দেখছি পিনাকী দত্তগুপ্তকে অমর করে রাখবে।

না, ম্যাডাম–এখন একটা কাজে ফেঁসে গেছি। পরে সময়মতো গিয়ে আপনাকে বলে আসব।

ঠিক আছে আমার বাড়িতে আসতে হবে না। আমরা অন্য কোথাও মিট করতে পারি…।

এক্ষুনি তো সেটা করা যাবে না। পরে আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঠিক করে নেব। ও হ্যাঁ, রশিদ আপনার কথামতো হেল্প করেছে। আর সংক্ষেপে এটুকু জেনে রাখুন, নানাভাইয়ের ওখানে গিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি।

তার মানে!

তার মানে হল, এখনও আমি অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে আছি।

ফোন অফ করে দিলাম।

গতকালের মেঘলাভাবটা আকাশে থেকেই গিয়েছিল। বিকেল পাঁচটা থেকে বৃষ্টি শুরু হল।

.

প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি আর বর্ষা শর্মিলা বোসের দরজায় কড়া নাড়লাম। বৃষ্টি তখনও থামেনি।

বর্ষার সঙ্গে সময়মতোই আমি দেখা করেছি। আমার সর্দির ভাবটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে কাশি। তাই ছাতা নিয়েই বেরিয়েছি।

ও সময়মতো হাজির হতেই ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ছাতা থাকলেও ওর চুড়িদার বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। পোশাকের পায়ের কাছে কাদার ছিটে। তবে মুখটা টলটল করছে।

ওকে দেখামাত্রই বুকের ভেতরে উলটোপালটা ব্যাপার শুরু হল।

রাজাবাজারের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে আমরা কথা বলছিলাম। প্রথমে খানিকটা অফিসের কথা হল। তারপর দত্তগুপ্ত, নানাভাই–এসব শুরু হল।

পথ চলতে-চলতে কথা বলা খুবই শক্ত ব্যাপার। তার ওপর রাস্তায় জল-কাদা, যানজট, আর মানুষের ভিড়। সায়েন্স কলেজ পেরিয়ে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় আমরা বসলাম।

আমার কাছ থেকে নানাভাইয়ের ব্যাপারটা সংক্ষেপে শোনার পর বর্ষা বেশ হতাশ হল। খানিকটা ভয়ও পেয়ে গেল ও। পুলিশ যদি আবার হ্যারাস করে! ওকে বললাম যে, নানা আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন যে, পুলিশ আমাকে আর বিরক্ত করবে না। তবে ওর কথা নানাকে বলিনি। যদি নিতান্ত দরকার হয়, তা হলে বলতে হবে।

বর্ষা বলল, না, না বলার দরকার নেই। ওর মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ কথা বলার পর ওকে বললাম, বর্ষা, তোমাকে এখন একজনের বাড়িতে নিয়ে যাব–যাবে?

চমকে উঠল বর্ষাঃ কার বাড়িতে!

শর্মিলা বোসের বাড়িতে। কাছেই গড়পাড়ে উনি থাকেন।

হঠাৎ ওঁর বাড়িতে কেন?

একটা ব্যাপারে আমার একটু খটকা লেগেছে। সেই ব্যাপারে একটু কথা বলতে যাব। তুমি সঙ্গে গেলে ভালো হয়। তা ছাড়া তুমি তো ওঁকে কখনও দ্যাখোনি। ওঁর সঙ্গে আলাপও হয়ে যাবে।

আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে।

তোমার কোনও ভয় নেই–আমি তো সঙ্গে আছি!

মাঝারি বৃষ্টির মধ্যেই আমরা রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক তখনই প্যান্টের পকেটে আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

বোতাম টিপে কথা বললাম।

আমার এল.আই.সি.-র এজেন্ট। উনি জানতে চাইছেন, গতবছরে আমি যে বলেছিলাম এ-বছর একটা জীবন সুরক্ষা পলিসি করাব, সেটা করাব কি না।

চমৎকার প্রশ্ন, এবং চমৎকার সময়ে! জীবন সুরক্ষা যদি আমার দরকার না হয়, তা হলে আর কার দরকার হবে।

ওঁকে বললাম, নিশ্চয়ই করাব। উনি যেন নেক্সট উইকে আমার অফিসে আসেন।

মিনিটদশেকের মধ্যেই আমরা শর্মিলা বোসের দরজায় পৌঁছে গেলাম।

দরজা খুলে আমাকে দেখেই তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেনঃ এ কী! আপনি! তারপর চাপা গলায় বললেন, জনি বাড়িতে আছে।

আমি হাসলাম। তারপর একটু পাশে সরে দাঁড়াতেই শর্মিলা আমার পেছনে দাঁড়ানো বর্ষাকে দেখতে পেলেন। দরজার কাছটায় আলো তেমন জোরালো নয়। কিন্তু ওদের দুজনের মুখ আমি স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছিলাম।

না, ওরা একে অপরকে আগে কখনও দেখেনি।

আমি ভেজা ছাতাটা দরজায় পাশে রাখলাম। তারপর শর্মিলাকে একরকম পাশ কাটিয়েই ভেতরে ঢুকে গেলাম।

বর্ষাও দরজায় পাশে ছাতা রেখে বাধ্য মেয়ের মতো আমাকে অনুসরণ করল।

সামনের ঘরের দরজা খোলা ছিল। একটা মোড়া আর একটা এলোমেলোভাবে ভাঁজ করা খবরের কাগজ চোখে পড়ছিল।

ঘরে ঢোকার আগে আমি শর্মিলা আর বর্ষাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বললাম, ম্যাডাম, আপনার ঘাবড়ানোর কোনও কারণ নেই। বর্ষা আমার অফিস কোলিগ। তা ছাড়া দত্তগুপ্তের কাছে ও পার্ট টাইম কাজ করত…ফার্স্ট লেভেলের। দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ ওর ফোন নাম্বার পেয়েছে। হেসে বললাম, আমাদের তিনজনের একই প্রবলেম। সেই প্রবলেম সলভ করার জন্যেই আপনার কাছে এসেছি।

দেখে মনে হল, শর্মিলা খানিকটা যেন ধাতস্থ হলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন, জনি পাশের ঘরে টিভি দেখছে।

জনির ইংরেজি গানের কলি আমার কানে আসছিল। বোধহয় এম টি ভি এনজয় চালিয়ে টিভির গানটাই মুখস্থ করছে।

ঘরটাকে চট করে একটু গুছিয়ে নিয়ে শর্মিলা আমাদের বসতে বললেন। সামান্য দূরে নিজেও বসলেন। ওঁর পরনে ম্যাক্সি। চুলের গোছা কপালে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে। হালকা পারফিউমের গন্ধ নাকে আসছে।

কাল নানাভাইয়ের ওখানে কী হল, মিস্টার মিত্র?

আমি হাত তুলে ওঁকে ইশারা করলামঃ পরে বলছি। আগে আপনি বলুন, দত্তগুপ্ত কি চুরুট খেতেন?

শর্মিলার ভুরু কুঁচকে গেল।

কাছেই কোথাও টিনের চালের ওপরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে রিমঝিম শব্দ হচ্ছিল। বৃষ্টির কেমন একটা গন্ধও নাকে আসছিল।

মাঝে-মাঝে মিস্টার দত্তগুপ্তকে যেন চুরুট খেতে দেখেছি। থেমে-থেমে বললেন শর্মিলা।

আগেও এই কথাই আমাকে তিনি বলেছিলেন।

বর্ষা সঙ্গে-সঙ্গে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলাম। বর্ষা কী বলেছে আমার স্পষ্ট মনে আছে। দত্তগুপ্ত ক্লাসিক সিগারেট খেতেন।

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, ম্যাডাম, আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বলছেন কেন? দত্তগুপ্ত চুরুট খেতেন না–ক্লাসিক সিগারেট খেতেন। দত্তগুপ্ত যখন মার্ডার হন তখন আমি ওঁর ফ্ল্যাটে চুরুটের গন্ধ পেয়েছিলাম। নানাভাইও চুরুট খান না।…তা হলে কে চুরুট খায়? নিশ্চয়ই আপনি নন?

আমার ঠাট্টায় শর্মিলা হাসবেন কি না ভাবছিলেন। ঠিক তখনই একটা গর্জন শোনা গেল।

আমি চুরুট খাই। সো হোয়াট–সো ব্লাডি হোয়াট?

টের পাইনি কখন দরজায় জনি এসে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতে সরু ধরনের একটা জ্বলন্ত চুরুট। পরনে গাঢ় ছাইরঙের বারমুডা আর সাদা পোলো নেক টি-শার্ট। টি-শার্টের বুকের ওপরে লেখা : দিস সিটি রান্স অন লাভ।

জনি চোখ ছোট করে আমাকে দেখছিল। দৃষ্টিটা এমন যেন যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও কিছু করে বসতে পারে।

শর্মিলা ভয়ের চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বর্ষার মুখেও কখন যেন আশঙ্কার ছাপ পড়েছে।

আমি ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। চুরুটের গন্ধটা শুঁকে দেখার জন্যে জনির দিকে এক পা এগোলাম।

ঠিক তখনই দেওয়ালে টাঙানো ফটোতে আমি হিকপিককে দেখতে পেলাম। জনির পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। এইজন্যেই হিকপিককে আমার চেনা-চেনা মনে হয়েছিল।

জনির চুরুটের গন্ধ নাকে আসতেই সব অঙ্ক মিলে গেল।

সো ইট ওয়াজ য়ু। জনির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, মার্ডার ওয়েপনটা তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?

উত্তরে জনি নোংরা খিস্তি করে উঠল। চুরুটটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমার তলপেটে লাথি চালাল।

বর্ষা ভয়ের চিৎকার করে উঠল। শর্মিলা জনি! বলে ডেকে উঠলেন।

আমি পলকে শরীরটা ঘুরিয়ে নিয়েছি বটে, তবে লাথিটা পুরোপুরি এড়াতে পারলাম না। ওটা আমার কোমরে এসে লাগল। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম।

সামলে নিয়ে উঠে বসার আগেই জনি এগিয়ে এল আমার কাছে, কলার ধরে এক হ্যাঁচকা টানে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল। হিংস্র জন্তুর মতো দাঁত বের করে বলল, নোবডি মেসেস অ্যারাউন্ড উইথ মাই ওয়াইফ। দত্তগুপ্ত আমার ওয়াইফকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল। ওর হিসেব আমি চুকিয়ে দিয়েছি। এখন তুই আমার ওয়াইফকে লাফড়ায় জড়াতে চাইছিস!

জনি আমাকে দেওয়ালে ঠেসে ধরল। ওর ডানহাত আড়াআড়িভাবে চেপে বসল আমার গলায়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, চোখের নজর ঝাপসা হয়ে এল। সেই ঝাপসা নজরেই আমি জনি আর হিকপিকের রঙিন ফটোটা দেখতে পাচ্ছিলাম।

আমার ভেতরে একটা পাগল করা রাগ টগবগ করে ফুটতে শুরু করল। কিন্তু জনি হিকপিক নয়। ওঁকে সামলাতে আমার মতো অন্তত দুজন লোক দরকার। এখন আর-একজন পাব কোথায়!

বর্ষা আর শর্মিলা জনির হাত ধরে টি-শার্ট ধরে যেমন-তেমনভাবে টানাটানি করছিল। ওকে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল। আর একইসঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল।

জনির কিন্তু কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ও আমার মুখের কাছে মুখ এনে তোড়ে গালাগাল দিচ্ছিল। ওর থুতুর কণা বৃষ্টির মতো আমার মুখে ছড়িয়ে পড়ছিল।

ঠিক তখনই আমার খড়কুটো-আঁকড়ে ধরতে-চাওয়া হাত মোবাইল ফোনটা খুঁজে পেল।

এক মুহূর্তও দেরি না করে আমি মোবাইল ফোনটা হাতুড়ির মতো বসিয়ে দিলাম জনির বাঁকানের ওপরে।

গরম তেলে গোটা লঙ্কা ফেললে যেমন ফেটে যায় সেরকম একটা শব্দ হল। ফোনের খাটো অ্যানটেনাটা জনির কানের গর্তে ঢুকে গেল কি না কে জানে! তবে জনি হুড়মুড় করে খসে পড়ে গেল মেঝেতে। নিথড় হয়ে পড়ে রইল। ওর বাঁ কানের পাশ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল।

আমি মোবাইল ফোনটা আবার উঁচিয়ে ধরেছি দেখে শর্মিলা বুকফাটা চিৎকার করে ছুটে এসে আমাকে একেবারে জাপটে ধরলেন। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মোবাইল ফোনটা আমার হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।

আমি শর্মিলাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ধীরে-ধীরে মেঝেতে বসে পড়লাম। ঘোলাটে চোখে বর্ষার দিকে তাকিয়ে হাঁফাতে লাগলাম। বর্ষা তখন ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

এর মধ্যেই আশপাশের দু-চারজন বাসিন্দা ঘরের দরজায় এসে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। আমি ইশারায় ওদের চলে যেতে বললাম। তাতে ওরা ইতস্তত করছে দেখে ধমকের গলায় বললাম, এসব ফ্যামিলি ম্যাটার। আপনারা চলে যান, প্লিজ।

এবার কাজ হল।

আমি গলায় হাত বোলাতে-বোলাতে উঠে দাঁড়ালাম। বর্ষা ছুটে এসে আমাকে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে আমি অন্যরকম হয়ে গেলাম। অনেক ভুলে যাওয়া কবিতার লাইন পলকে মনে পড়ে গেল।

শর্মিলা তখন জনির ওপরে ঝুঁকে পড়ে ওর মুখে জলের ছিটে দিচ্ছিলেন।

আমি বর্ষাকে বললাম, দরজাটা ভেজিয়ে দাও।

ও দরজা ভেজিয়ে দিতেই শর্মিলাকে বললাম, ম্যাডাম, জনিকে এখন একটু ঘুমোতে দিন। সেই ফাঁকে আপনাকে দুটো কথা বলে নিই…।

শর্মিলা আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। আমার ডান হাতে ধরা অ্যানটেনা ভাঙা মোবাইল ফোনটার দিকে চোখ পড়তেই ওঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি জনির কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরে গেলেন।

জনি আগে নানাভাইয়ের দলে ছিল? ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলাম।

হ্যাঁ। ও-ই মিস্টার দত্তগুপ্তের কাছে মাসে-মাসে টাকা আনতে যেত। সেই থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়…তারপর ফ্রেন্ডশিপ…।

জনির রিভলবারটা এখন কোথায়?

ওটা জনির নয়– কাঁদতে কাঁদতে শর্মিলা বললেন, মিস্টার দত্তগুপ্তকে শায়েস্তা করার জন্যে রিভলভারটা ও হিকপিকের কাছ থেকে জোগাড় করেছিল। সেদিন ও আমার সঙ্গে পিনাকী দত্তগুপ্তের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল নেহাতই ওঁকে ভয় দেখাতে। শুরুতে কথাবার্তা বেশ ঠান্ডা মাথাতেই হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই মিস্টার দত্তগুপ্ত আমার নামে একটা নোংরা কথা বলায় জনি রাগে ফেটে পড়ে। ওঁকে লেফট অ্যান্ড রাইট মারধর করে বিছানায় কাত করে দেয়। তারপর আমি কিছু করে ওঠার আগেই আচমকা ওর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে গুলি করে দেয়।

ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। দিশেহারার মতো এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকি। ওকে একরকম ধাক্কা দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিই। তারপর তাড়াহুড়ো করে দত্তগুপ্তের ঘর সার্চ করে আমার ফটোর খামটা খুঁজে বের করি। দত্তগুপ্তের লাইটার নিয়ে বাথরুমে চলে যাই–সেখানে খামটা পুড়িয়ে কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করে দিই। লাইটারটা শাড়ির আঁচলে মুছে দত্তগুপ্তের ঘরে সবে রেখেছি, তক্ষুনি ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি আপনি… কান্নার দমকে শর্মিলার গলা কেঁপে গেল, আপনাকে আমি চিনি না, ফ্ল্যাটে কেন এসেছেন তাও জানি না। কী বলব ভাবছি তখন আপনিই নিজে থেকে সব ইনফরমেশান জানিয়ে আমাকে হেল্প করলেন।

পিনাকী দত্তগুপ্ত খুব নোংরা লোক ছিল। বহু মেয়ের লাইফ ও শেষ করে দিয়েছে। অতগুলো লাইফের পাশে ওর একটা লাইফের কী দাম আছে, বলুন! জনি আমার জন্যে নানাভাইয়ের দল ছেড়ে দিয়েছিল। দল ছাড়তে চাইলে নানাভাই কাউকে আটকান না। শুধু কন্ডিশান হচ্ছে, সে যেন নানাভাইয়ের ডার্ক অ্যাক্টিভিটির ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। তা হলে নানাভাই বা তার গ্যাঙের কেউ তার নামও কোনওদিন উচ্চারণ করবে না। কিন্তু কন্ডিশান ব্রেক করলেই সেই লোকটির গল্প শেষ। শর্মিলা কান্নায় ভেঙে পড়লেন? এবার তা হলে জনির গল্প শেষ…আমার গল্পও শেষ। বিশ্বাস করুন রীতেনবাবু, জনিকে আমি ভালোবাসি–ও-ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।

আমার মুখে বোধহয় একটু অবিশ্বাসের ছায়া পড়েছিল। সেটা লক্ষ করে আমার পায়ের কাছে এসে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন শর্মিলা। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় বললেন, আপনার সঙ্গে যে ইনটিমেট কথাবার্তা বলেছি সেটা স্রেফ নিজেরা বাঁচার জন্যে। আমাদের এই নতুন সংসারকে বাঁচাতে আমি আরও পাঁচ-সাতজনের সঙ্গে শুতে রাজি আছি। কিন্তু আমি জনিকে ছেড়ে থাকতে পারব না…বিশ্বাস করুন…।

শর্মিলার পরের কথাগুলো কান্নায় জড়িয়ে গিয়ে আর বোঝা গেল না।

আমি একটু ইতস্তত করে ওঁকে ধরে তুললাম। অবাক চোখে দেখলাম ওঁর মুখের দিকে। ভালোবাসা, তোমার মধ্যে এমনকী আছে যে, বারবার তুমি জিতে যাও!

বর্ষার মুখের দিকে তাকালাম আমি। তারপর শর্মিলাকে বললাম, ম্যাডাম, পুলিশকে আমরা কিছু জানাব না–আপনাকে কথা দিলাম। পুলিশ যদি আমাকে হাজার প্রশ্ন করে তা হলেও ওদের আমি আপনার কথা বলব না। বলব না যে, আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি।

শর্মিলা কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন।

জনি ততক্ষণে সামান্য নড়তে শুরু করেছে।

আমি জনির দিকে ইশারা করে বললাম, ওকে একটু অ্যাটেন্ড করুন। পরে সব বুঝিয়ে বলবেন। আমরা এখন যাই…।

শর্মিল কৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আমি আর বর্ষা ওঁর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বৃষ্টি তখনও পড়ছে।

বর্ষাকে বাড়ি পৌঁছে দেব বলে একটা ট্রামে উঠলাম। একেবারে ফাঁকা ট্রাম। সামনের দিকের জোড়া সিটে পাশাপাশি বসলাম দুজনে।

বর্ষা আলতো সুরে জিগ্যেস করল, গলায় এখনও ব্যথা আছে?

আমি বললাম, না। যদিও গলাটা বেশ ব্যথা করছিল।

বর্ষা আড়ালে আমার হাত চেপে ধরল।

ট্রাম এন্টালি পৌঁছনো পর্যন্ত আমরা একটিও কথা বলিনি। শুধু বর্ষার হাতটা আমার হাতের মধ্যে ধরা ছিল।

ওকে বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়ে চলে আসার সময় জিগ্যেস করলাম, বর্ষা, আমি কি এখনও স্রেফ একজন অস্কার নমিনি?

বর্ষা উত্তরে শুধু হাসল। কিন্তু হাসিটা এমন যে আমার ভীষণ বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *