মণিমানিক্যের জাহাজ
পথে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে ফ্রান্সিস, হ্যারি আর শাঙ্কো সারাদিন ঘোড়া ছোটাল। পথপ্রদর্শকটি পাঁচ দিনেই ওদের গেরুয়া পাহাড়ে পৌঁছে দিল। তারপর চলে গেল নিজের দেশে।
গেরুয়া পাহাড়ে ওরা যখন পৌঁছল তখন বিকেল। একটু দূরেই সমুদ্রে জাহাজ ভাসছে। শাঙ্কো একটা ছোট পাথররের ওপর উঠে চিৎকার করে ডেকে বলল–ভাইসব, আমরা এসেছি। জাহাজের ডেক-এ দুতিনজন ভাইকিং দাঁড়িয়েছিল। তারা শাঙ্কোর ডাক শুনল। ফ্রান্সিসদের দেখতে পেল। ওরা চীৎকার চাঁচামেচি করে বাকি বন্ধুদের ডাকাডাকি শুরু করল। ফ্রান্সিসের শরীরের দুর্বলতা তখনও কাটেনি। তার ওপর এত দূর পথ ঘোড়া ছুটিয়ে আসা। ও একটা পাথরের ওপর শুয়ে পড়ল। হ্যারিও বসল ওর পাশে। একটু পরেই কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু এল। দুর্বল ফ্রান্সিসকে দুতিনজন ধরে নিয়ে চলল। পেছনে হ্যারি আর শাঙ্কো। জলে নামতে হলো সবাইকে। কারণ জাহাজে ফেলা কাঠের পাটাতন মাটিপাথর পর্যন্ত আসেনি। ফ্রান্সিসকে কাঁধে করে নিয়ে চলল। পাটাতন দিয়ে হেঁটে চলল।
ফ্রান্সিসরা জাহাজে উঠতেই ওরা কী এনেছে দেখবার জন্যে বন্ধুরা সবাই ওদের ঘিরে ধরল। শাঙ্কো থলে থেকে বের করে কোয়েতজাল দেবতার অতি সুন্দর মূর্তিটা দেখাল। সবাই অবাক। বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল মূর্তিটা। তারপরই চিৎকার করে উঠল—ও-হো-হো। সবাই জানতে চায় সমস্ত ঘটনা। ফ্রান্সিস বলল–আমরা ভীষণ পরিশ্রান্ত। পরে তোমাদের সব বলবো। এবার কিছু খাবার ব্যবস্থা করো। প্রায় উপোস করে আছি।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি কেবিনঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওখানেই ওদের খেতে দেওয়া হলো। শাঙ্কো কিন্তু তখনও বেশ সতেজ। ওকে ঘিরে ধরল সবাই। শাঙ্কো বিপুল উৎসাহে ওদের বিষাক্ত উপত্যকার গল্প শোনাতে লাগল।
পরদিন সকালেই জাহাজের নোঙর তোলা হলো। পাল খাটানো হলো। জোর হাওয়া বইছে তখন। পালগুলো ফুলে উঠল। জাহাজ চলল ভাইকিংদের দেশের দিকে।
মাসখানেক পরে জাহাজ ভাইকিংদের রাজধানীর জাহাজঘাটায় ভিড়ল।
তখন সকাল। জাহাজঘাটায় লোকজন কম। কেউ ফ্রান্সিসদের জাহাজ লক্ষ্যই–গল না। কত জাহাজ তো আসে। রাজাকে সংবাদ দিতে একজন ভাইকিংকে পাঠানো হলো। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি চড়ে রাজা, রানী, মারিয়া, মন্ত্রী ও অমাত্যরা এলেন। এইবার জাহাজঘাটায় লোকজন জমতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই জনারণ্যের সৃষ্টি হলো। ওদিকে জাহাজে রাজা, রানী, মারিয়া, মন্ত্রী ও অমাত্যরা রূপোর থাম, কোয়েতজাল দেবতার মূতি দেখে সবাই বিস্মৃত হলেন। রাজা ঐ মণিমাণিক্যের জাহাজ জাহাজের ডেকেই বললেন–ফ্রান্সিসরা জাহাজ চুরি করেছিল। ওদের সে অপরাধ আমি মার্জনা করলাম। ফ্রান্সিসের বাবা মন্ত্রীমশাই শুধু মুখে মৃদু শব্দ করলেন–হুম্।
রূপোর থাম দুটো রাখা হলো রাজার জাদুঘরে। ফ্রান্সিসের অনুরোধে রাজবাড়ির সামনের চত্বরের কোণায় তৈরি হলো শ্বেতপাথরের একটা ছোট মন্দিরমতো। তাতে স্থাপিত হলো কোয়েতজাল দেবতার মূর্তি। ফ্রান্সিস আর মারিয়া মাঝে মাঝেই আসে মূর্তি দর্শন করতে। ভক্তি জানাতে।
দিন কাটে। খাওয়া ঘুম। তবে এর মধ্যেই যখন বন্ধুরা আসে তখন ফ্রান্সিসের ভালো লাগে। গল্পগুজবে আড্ডা জমে ওঠে। যে সব অভিযানে ওরা গিয়েছিল সেই সব অভিযানের গল্প হয়। উৎসাহে উদ্দীপনায় চঞ্চল হয়ে ওঠে ওরা। হ্যারি এমনিতেই কম কথা বলে। কিন্তু বিস্কো শাঙ্কোদের উৎসাহ প্রবল। অধৈর্য হয়ে ওঠে ওরা। বলে–চলো ফ্রান্সিস আবার বেরিয়ে পড়ি। ফ্রান্সিস হাসে। বলে–উদ্দেশ্যহীন বেড়িয়ে বেড়ানো আর এই ঘরে বসে থাকা–একই। একটা লক্ষ্য তো চাই। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকায়। বলে–কী হলো হ্যারি? হ্যারি একটু মাথা নেড়ে বলে–দেখা যাক চেষ্টা করে–অভিযানে বেরোবার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। বন্ধুদের এই আড্ডায় মারিয়াও আসে মাঝে মাঝে। কিন্তু নতুন অভিযানের ব্যাপারে কোনো কথা বলে না।
এভাবেই দিন কাটছিল। ফ্রান্সিস কোনোদিনই দুপুরে ঘুমোতো না। এখন ঘুমোয়। আশ্চর্য! সেটাই অভ্যেস হয়ে গেল। অবশ্য বেশিক্ষণ নয়। আধ ঘণ্টা মতো ঘুমিয়ে উঠতে লাগল। কিছুদিন হলে মারিয়াও এসময় বাড়ি থাকে না। কোথায় যায় কে জানে।
মারিয়া থাকলে তবু গল্প করে সময় কাটতো।
সেদিন বিকেলের দিকে মারিয়া বাড়ি ফিরতে ফ্রান্সিস বলল–তুমি দুপুরে কোথায় যাও বলোতো?
–রাজবাড়িতে। মারিয়া বলল?
–কেন?
–রাজবাড়ির গ্রন্থাগারে পড়তে যাই। মারিয়া বলল?
–তা বইগুলো নিয়ে এসে পড়লেই পারো। ফ্রান্সিস বলল।
–নিয়ম নেই। মারিয়া বলল।
–তোমাদের বাড়িতে গ্রন্থাগার। তেমাকেও নিয়ম মানতে হবে?
–হ্যাঁ, নিশ্চয় মানাতে হবে। তাছাড়া ভেড়ার চামড়ায়, পার্চমেন্ট কাগজে লেখা, আঁকা বই। টানা হ্যাঁচড়া করলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
–হুঁ। তা এখন কী বই পড়ছো?
ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–আইসল্যান্ডের এক একটা বই। প্রায় একশ বছর আগের লেখা। জানো তো আইসল্যান্ডের অধিবাসীরা গীতিকাব্য গল্পকাহিনী ভীষণ ভালোবাসে। আসলে আইসল্যান্ডের অধিবাসীরা তো বেশির ভাগই ভাইকিং–আমাদের দেশের মানুষ। কিছু আছে আয়ারল্যান্ডের আর অন্য দেশের লোক। ওখানকারই একজন কবি নাম থরগিলমন আরি। সংক্ষেপে কবি আরি নামে পরিচিত। তার বই আইসল্যান্ডিগা বক বা আইসল্যান্ডবাসীদের বই। সেটাই পেয়েছি।
–বইটা পড়া হয়ে গেছে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
–প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভাইকিংরা দলে দলে আইসল্যান্ডে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। সমুদ্রের খাড়িতে, নদীতে প্রচুর মাছ। বহুবিস্তৃত তৃণভূমি। কবি আরি বলেছেন, সেই তৃণের প্রতিটি পাতা থেকে যেন মাখন ঝরে পড়ছে। তাহলেই বুঝতে পারছো কী উর্বর সেইসব দিগন্তবিস্তৃত তৃনভূমি। ভাইকিংরা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল ঘোড়া, গরু, ভেড়া যন্ত্রপাতি, অস্ত্র, ধর্মীয় মূর্তি আর আগুন।
-হ্যাঁ, অনেকদিন আগে থেকেই অনেক ভাইকিং আইসল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেছে। তোমাদের আত্মীয়স্বজনও তাদের মধ্যে আছেন।
–ঠিক বলেছো। তাঁরাই এক একজন এক একটি অঞ্চলে রাজ্য স্থাপন করে রাজা হয়েছেন। একটু থেমে মারিয়া বলল–ওসব ইতিহাস থাক। শুধু একজনের কথা বলি। তার নাম ফ্রোকি। তিনি রেভকজাভিক-এ রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। রাজা হলেও তিনি জীবন শুরু করেছিলেন জলদস্যু হিসেবে। রাজা হয়েও জলদস্যুতা ছাড়েননি। দীর্ঘকাল আইসল্যান্ডের দক্ষিণ সমুদ্রে বিদেশী জাহাজ দখল করেছেন। নির্বিচারে লুঠ করেছেন। এই জলদস্যুতা করে তিনি প্রচুর সোনা মণিমাণিক্য পেয়েছিলেন। কবি আরি বলেছেন–রাজা ফ্লোকি সেই সোনা দিয়ে একটা ছোট্ট জাহাজ রৈী করিয়েছিলেন। সেই ছোট্ট জাহাজটি বোঝাই করেছিলেন মণিমাণিক্য দিয়ে। তারপর মণিমাণিক্যসুদ্ধ সেই সোনার জাহাজ যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন তা কেউ জানে না।
ফ্রান্সিস এতক্ষণ বিছানায় আধাশোয়া হয়ে মারিয়ার মুখে গল্প শুনছিল। মণিমাণিক্যসুদ্ধ সোনার জাহাজের রহস্যের কথা শুনে ও লাফিয়ে উঠে বসল। বলল-দাঁড়াও–দাঁড়াও। সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলো তো?
–আমি আর নতুন কী বলবো? কবি আরি যা তার বইতে লিখে গেছেন তাই বলছি। মারিয়া বলল।
–বেশ, বলে যাও।
–এই সোনার জাহাজ রাজা ফ্রোকি কেন লুকিয়ে রেখেছিলেন তা কবি আরি সঠিক বলতে পারেননি। তবে অনুমান করেছেন সে সময় নরওয়ে থেকে অনেক ডাইকিং সমুদ্র পেরিয়ে রেভকজাভিক-এ বসবাস শুরু করেছিল। পাছে সেই সোনার জাহাজের কথা ছড়িয়ে পড়ে, পাছে চুরি হয়ে যায় তাই রাজা ফ্লোকি সেই জাহাজটা শুকিয়ে ফেলেছিলেন।
–এই সোনার জাহাজের কথা তখন কি আর কেউ জানতো না।
–কবি আরি এই সম্পর্কে কিছু বলেননি। তবে যে স্বর্ণকার সেই জাহাজের নক্সা তৈরি করেছিল, তৈরি কবি আরি ঘটনাচক্রে তার খোঁজ পেয়েছিলেন। সেই স্বর্ণকারের নাম থরবার্গ। থরবার্গ তখন মৃত্যুশয্যায়।
–আচ্ছা রাজা ফ্লোকি কি তখন বেঁচে ছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
–না। ফারো দ্বীপপুঞ্জের কাছে এক জলযুদ্ধে রাজা ফ্লোকি হঠাৎ মারা যান। মারিয়া বলল।
তাহলে থরবার্গ তো সেই নিখোঁজ সোনার জাহাজ উদ্ধার করতে পারতো। ফ্রান্সিস বলল।
মণিমাণিক্যের জাহাজ–হয়তো পারতো। কিন্তু তার উপায় ছিল না। কারণ তখন থরবার্গ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার প্রায় বারোধ হয়ে গিয়েছিল। কাউকে সব গুছিয়ে বলে যাবার মত অবস্থা তার ছিল না। তাছাড়া সংসারে থরবার্গের কেউ ছিলও না।
–হুঁ। তারপর? ফ্রান্সিস বলল।
–মূমূর্ষ থরবার্গ কবি আরিকে দিয়েছিল একটু মসৃণ ভেড়ার চামড়া। তার এক পিঠে একটা জাহাজের মুখ নানারঙে আঁকা। অন্য পিঠে একটা ত্রিভুজের মতো আঁকা।
–দাঁড়াও দাঁড়াও–ফ্রান্সিস বলে উঠল–তুমি দেখেছো সেই ছবি আঁকা চামড়াটা?
–হ্যাঁ। কবি আরির ঐ পুরনো বইয়ের মধ্যে আছে।
–বইটা তো রাজবাড়ির গ্রন্থাগারে। ফ্রান্সিস বললো?
–হ্যাঁ?
–আচ্ছা-থরবার্ক ঐ ক্ষুদে জাহাজটার মাপ বলেছিল?
–না। তবে ছবিটায় মাপ লেখা আছে পাঁচ ফুট।
ফ্রান্সিস দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে এল। বলল–তৈরি হয়ে নাও। আমরা এক্ষুণি রাজবাড়ির গ্রন্থাগারে যাবো।
–কী বলছো? সন্ধ্যে হয়ে গেছে। গ্রন্থাগার কখন বন্ধ হয়ে গেছে। মারিয়া বলল।
–তুমি চলো। গ্রন্থাগারিককে অনুরোধ করবো। কিছুক্ষণের জন্য গ্রন্থাগারের মধ্যে যেন যেতে দেন।
মারিয়া হেসে বলল–তোমার মাথায় মাঝে মাঝে এমন ভূত চাপে না যে কী বলবো। মারিয়া এবার উঠতে উঠতে বলল তোমার অনুরোধ গ্রন্থাগারিক ফেলতে পারবেন না। কিন্তু তুমি তো সবটা শুনলে না।
–যেতে যেতে শুনবো। জলদি তৈরি হয়ে নাও। ফ্রান্সিস বলল।
ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে দুজনে রাজবাড়ি চলল। ফ্রান্সিস বলল–এবার বলো।
মারিয়া বলতে লাগল–কবি আরি লিখেছেন–মুমূর্ষ থরবার্গ কী যেন বলতে চেয়েছিল। কবি আরি থরবার্গের মুখের কাছে অনেকক্ষন কান পেতে দুটো কথা খুব অস্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছিলেন।
–সেই কথা দুটো কী? সাগ্রহে ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল?
–সপ্তম স্তম্ভ। মারিয়া বলল।
ফ্রান্সিস কথা দুটো কয়েকবার আওড়াল–সপ্তম স্তম্ভ। তারপর বলল–আচ্ছা আইসল্যান্ডে স্তম্ভ কোথায় আছে?
–রেভকজাভিকেই আছে। জানো–-রেভকজাভিকের চারপাশে সুন্দর পাহাড়। উত্তরের পাহাড়ের নিচে একটা বিস্তৃত সমতলভূমি। সেখানে কয়েকটা স্তম্ভ পোঁতা আছে। রাজা ফ্রোকি সেই স্তম্ভ পুঁতিয়েছিলেন। সেখানে প্রত্যেক মাসের পনেরো তারিখে নাচগানের আসর বসে। এই জায়গাটার নাম লোগবার্গ। কত মানুষ আসে। মেলা বসে যায় যেন। অনেক রাত পর্যন্ত নাচগান চলে। মারিয়া বলল।
–আচ্ছা–ঐ জায়গায় স্তম্ভ কেন পোঁতা হয়েছিল?
–কবি আরি বলেছেন–হয়তো রাজা ফ্রোকির ইচ্ছে ছিল ওখানে একটা উপাসনা মন্দির তৈরি করার।
–কটা স্তম্ভ পোঁতা আছে ওখানে? ফ্রান্সিস বলল?
–আমি তত যাইনি। ঠিক জানি না? মারিয়া বলল। রাস্তায় লোকজন। গাড়ি চলেছে। পথের ধারে দোকানপাট, বাড়িতে আলো জ্বলছে। ফ্রান্সিস বলল-গ্রন্থাগারের চাবি কার কাছে থাকে?
–গ্রন্থাগারিকের কাছে?
–কোথায় থাকেন উনি?
–রাজবাড়ির পূর্বকোণায়।
ফ্রান্সিস গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কোচোয়ানকে সেখানে যেতে বলল।
খবর পেয়ে গ্রন্থাগারিক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মাথা নুইয়ে ফ্রান্সিসকে মারিয়াকে সম্মান জানালেন। বারবার বলতে লাগলেন–আমি–মানে আপনারা–বুঝতে পারছি না–
ফ্রান্সিস হেসে বলল–আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। গ্রন্থাগারের চাবিটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন। গ্রন্থাগারে আমরা একটু পড়াশুনা করবো।
–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। গ্রন্থাগারিক প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। ছুটলেন চাবি আনতে।
গ্রন্থাগারের পাহারাদার দরজার কাছেই পাহারা দিচ্ছিল। ফ্রান্সিসদের দেখে অবাক। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল। গ্রন্থাগারিক ওকে আলো নিয়ে আসতে বললেন। পাহারাদার একটা মোটা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে এল। বিরাট দরজার বড় তালাটা গ্রন্থাগারিক খুললেন। ঘরঘর শব্দে দরজাটা খুলল। সকলে ভেতরে ঢুকল। গ্রন্থাগারিক বললেন–কি বই পড়বেন আপনারা?
–আইসল্যান্ডের কবি আরির বই। ফ্রান্সিস বলল?
–কবি আরি ছাড়াও আইসল্যান্ডের লেখক পলিরিয়াস, স্ত্র্যাবো,–
বাধা দিয়ে ফ্রান্সিস বলে উঠল–না না–শুধু আরির বই পড়বো। মারিয়া জানে বইটা কোথায় আছে। আলোটা রেখে আপনারা কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে যান।
–নিশ্চয়-নিশ্চয়–। গ্রন্থাগারিক বললেন। তারপর পাহারাদারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
মারিয়া মোমবাতিটা হাতে নিয়ে এগোল। চারপাশে কাঠের পাটাতনে নানা আকাবের হাতে লেখা বই রয়েছে। মারিয়া একটা বড় আকারের চৌকোণা বইয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। মোমবাতিটা রাখল। দেখা গেল বইটা সিন্ধুঘোটকের মোটা চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা। মারিয়া মোটা মলাট ওল্টাল। বইয়ের নাম লেখা–আইসল্যান্ডিগা বক। মোটা পার্চমেন্ট কাগজের বেশ কিছু পাতা উল্টে সেই ভেড়ার সাদা চামড়ায় আঁকা রঙ করা ছবিটা বের করল। ফ্রান্সিস খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। এটা একটা জাহাজের মুখ। নানা রঙে আঁকা। ছবিটা দেখতে এরকম–নিচে লেখা দীর্ঘ সৰ্প। পাঁচ ফুট লম্বা এক ফুট চওড়া। ফ্রান্সিস বুঝল ঐ জাহাজটার ক্ষুদে মাপ এটা। জাহাজের মুখের ছবিটার পেছনের পাতায় আঁকা একটা ত্রিভুজের মতো।
ফ্রান্সিস খুব মনোযোগ দিয়ে ছবির ত্রিভুজটা দেখল। জাহাজের ব্যাপারটা বুঝল। জাহাজটার নাম দীর্ঘ সৰ্প। জাহাজের পুরো ছবি নেই। আছে শুধু সামনের মুখটা। কিন্তু অন্য পিঠের ত্রিভুজটার কোনো অর্থই বুঝতে পারল না। এই ত্রিভুজটা আঁকার মানে কি? ফ্রান্সিস ছবি দুটো বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। মারিয়া ঐ ছবি দুটো আগেই দেখেছিল। এবার বলল–চলো–দেরি হয়ে যাচ্ছে; গ্রন্থাগারিক মশাই অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।
ফ্রান্সিস ছবিটা থেকে মুখ তুলল। কোনো কথা না বলে মারিয়ার মাথার চুলে। হাত দিয়ে কি দেখতে লাগল। মারিয়া অবাক।
–কী ব্যাপার? মারিয়া বলল।
তোমার মাথার চুলে গাঁথা এই কাটাটা খুলে দাও তো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর চ্যাপ্টামতো সোনার কাঁটাটা দেখাল। মারিয়া আর কিছু বলল না। কাটাটা চুল থেকে খুলে দিল। ফ্রান্সিস দিয়ে বইয়ের পাতলা চামড়াটা কাটতে লাগল। চ্যাপ্টা মত কাটাটা মারিয়া ওর কান্ড দেখে চাপা স্বরে বলে উঠল—এই–কী করছো?
–চুরি। বইয়ের এই ছবির পাতাটা আমার চাই। ফ্রান্সিস বলল। ততক্ষণে পাতাটা কাটা হয়ে গেছ। ফ্রান্সিস বলল–এটা তোমার পোশাকের আড়ালে নিয়ে চলো।
–কী কান্ড—তুমি–। মারিয়া কথাটা আরা শেষ করতে পারল না।
ফ্রান্সিস বলল–চুপ। চলো।
ওরা দরজার কাছে এল। গ্রন্থাগারিক ও পাহারাদার এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল-দেখুন–সব পড়া হলো না। পরে আসবো।
–অবশ্যই, অবশ্যই। গ্রন্থাগারিক বললেন। এদিকে মারিয়া কোনোরকমে ছবির ছেঁড়া পাতাটা পোশাকের আড়ালে চেপে ধরে আছে। এই শীতেও মারিয়া ঘেমে উঠেছে। যদি ছবিসুদ্ধ ধরা পড়ে, লজ্জা অপমানের আর শেষ থাকবে না।
গাড়িতে উঠে মারিয়া ছবির পাতাটা ফ্রান্সিসকে দিল। বলল–উফ–কী কান্ড! তুমি শেষ পর্যন্ত আমাকে চোর বানালে? ফ্রান্সিস হো হো করে হেসে উঠল।
–কী দরকার ছিল চুরি করার? বাবাকে বললেই পারতে। মারিয়া বলল।
-আমি এখন কাউকে এই ছবির কথা জানাতে চাইনা। তাই–। ফ্রান্সিস বলল-তাছাড়া ছবি আর ত্রিভুজটা নিয়ে ভাবতে হবে তো। তাই হাতের কাছে রাখবো।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস ও মারিয়া শোবার ঘরে এল। ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া, তুমি ঘুমোও।
–তুমি শোবে না?
–না–আমাকে এই ছবিটা খুব ভাবিয়ে তুলেছে।
–তুমি এটা নিয়ে ভাববে, ঘুমুবে না আর আমি নাক ডাকিয়ে ঘুমুবো? অসম্ভ। মারিয়া বলল।
–বেশ, তাহলে এসে সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা যাক। দুজনে বিছানায় বসল।
ফ্রান্সিস ছবিটা বিছানায় পাতল। রূপোর ঝকঝকে মোমবাতিদানটা বিছানায় রাখল। এবার খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। একটু পরে বলল আচ্ছা মারিয়াকবি আরি স্তম্ভ সম্পর্কে কী লিখছে?
লিখেছেন যে মণিমাণিক্য বোঝাই সেই সোনার জাহাজের সঙ্গে স্তম্ভগুলোর একটা সম্পর্ক আছে। কারণ, স্বর্ণকার থরবার্গ মরবার আগে–সপ্তম-স্তম্ভ এই কথা দুটো বহুকষ্টে বলতে পেরেছিল। কিন্তু সম্পর্কটা যে কী তা কবি আরি নিজে বুঝে উঠতে পারেননি। সবটাই অনুমান। মারিয়া বলল।
–হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর বলল—দেখো জাহাজের মুখের ছবিটায় কোনো রহস্য আছে কি নেই এটা ঠিক এখুনি বলা যাচ্ছে না। তবে আমার মনে হয় পেছনের ত্রিভুজটার রহস্য খুব গভীর। মণিমাণিক্য-বোঝাই ঐ ক্ষুদ্র জাহাজটা কোথায় গোপনে রাখা হয়েছে তার হদিস পাওয়া যাবে ঐ ত্রিভুজটা থেকে।
এবার মারিয়া ঝুঁকে পড়ে। ত্রিভুজের মতো ছবিটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলল–একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো?
–হ্যাঁ, দেখেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না ঐ তিনটে চিহ্নের অর্থ কি? ফ্রান্সিস বলল।
এবার মারিয়া বলল–সাপের মুখের মতো এই ছবিটায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো?
–কী? ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া বলল-ত্রিভুজের ওপরের দিকে তিনটে চিহ্ন।
–হ্যাঁ, দেখেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না ঐ তিনটে চিহ্নের অর্থ কী? ফ্রান্সিস বলল।
এবার মারিয়া বলল–সাপের মুখের মতো এই ছবিটায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো.
–কী?
–সাপের মাথার দিকে সাতটা মণির মতো চিহ্ন?
–বলো কী? ফ্রান্সিস চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি ছবিটা নিয়ে দেখতে দেখতে
বলল–মারিয়া-আশ্চর্য–দেখো সাপের দাঁতও সাতটা।
–সত্যিই তো। মারিয়া বলে উঠল।
–স্বর্ণকার থরবার্গ বলেছিল-সপ্তম স্তম্ভ। তাহলেই বোঝা যাচ্ছে সাত সংখ্যাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া বলে উঠল–ঠিক বলেছো।
ফ্রান্সিস বিছানা থেকে নেমে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। মারিয়া কিছুক্ষণ তাই দেখল। তারপর বলল–কী ভাবছো?
–আবার সমুদ্রযাত্রা। ফ্রান্সিস বলল।
–মানে? মারিয়া বলল।
–এবার আইসল্যান্ড সপ্তম স্তম্ভের রহস্য উদ্ধারে?
–বাবা তোমাকে আর যেতে দিলে তো? মারিয়া বলল?
–তবে সেই পুরোনো পথ—
–অর্থাৎ জাহাজ চুরি?
–হ্যাঁ।
–এবার আমিও যাবো। মারিয়া বলল।
–অ্যাঁ? ফ্রান্সিস পায়চারি থামিয়ে মারিয়ার দিকে তাকাল?
–দেখো–তোমার বাবাকে সব বুঝিয়ে বলবো। তারপর বলবো আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। তাহলে উনি আর আপত্তি করবে না। মারিয়া বলল।
-বেশ–তাহলে কালকেই অনুমতির বাপারটা মিটিয়ে ফেলতে হবে। তারপর বন্ধুদের খবর দেবো।
.
পরদিন রাতে ফ্রান্সিসের বাবা মন্ত্রীমশাই খেতে বসেছেন। ফ্রান্সিসও খাচ্ছে। মারিয়া খাবারদাবার পরিবশন করছে। তখনই মারিয়া আস্তে আস্তে আইসল্যান্ডের কবি আরি, রাজা ফ্লোকি, তার মণিমাণিক্য-বোঝাই ক্ষুদে জাহাজ, স্তম্ভ এসবের গল্প বলতে লাগল। মন্ত্রীমশাই খেতে খেতে শুনতে লাগেলন। সবশেষে সপ্তম স্তম্ভের রহস্যভেদ করতে ফ্রান্সিস আইসল্যান্ড যেতে চায় সে কথা বলল। মন্ত্রীমশাই খাওয়া থামিয়ে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর চোখ ফেরালেন ফ্রান্সিসের দিকে। ফ্রান্সিস খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে তাকাল। মন্ত্রীমশাই একবার কাশলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন–তোমার জ্বালায় তোমার মা অকালে দেহ রেখেছেন। এবার এই মেয়েটাকেও মেরে ফেলতে চাও।
ফ্রান্সিস বলল–বাবা–তুমি ব্যাপারটা–
ফ্রান্সিসকে থামিয়ে দিয়ে মন্ত্রীমশাই বললেন–তোমার কোথাও যাওয়া হবে। না। এই আমার শেষ কথা।
মারিয়া মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলল–বাবা–একটা কথা বলছিলাম।
–হুঁ। বলো। মন্ত্রীমশাই বললেন।
–মানে–আইসল্যান্ড তো বেশি দূরে নয়, কাছেই। তাই ভাবছি আমিও ওদের সঙ্গে যাবো। মারিয়া মৃদুস্বরে বলল।
–এ্যাঁ? মন্ত্রীমশাই বেশ চমকে উঠলেন।
মারিয়া একই ভঙ্গিতে বলল–বাবা–আপনি ভাববেন না। ওখানে তো ভাইকিংদেরই বসত। কোনো বিপদ হবে না আমাদের। নিরাপদে ফিরে আসবো।
মন্ত্রীমশাই মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন-দেখো মারিয়া–তোমার জন্যেই আমি ফ্রান্সিসকে যেতে দিতে চাইছিলাম না। এখন তুমি যদি সঙ্গে যাও–আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে তোমাদের কোনো বিপদ ঘটলে আমাকে দোষ দিও না।
ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল–বাবা, তুমি কিচ্ছু ভেবো না।
–হুঁ, এবার বসো। খাওয়া শেষ করো। মন্ত্রীমশাই বললেন।
ফ্রান্সিস শান্ত ছেলের মতো আবার বসে পড়ল। খেতে লাগল।
ফ্রান্সিসের আর তর সইছিল না। খুব ভোরে উঠে পড়ল। মারিয়াকে ডাকল। ঘুম ভেঙে মারিয়া ওর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল-শীগগিরি তৈরী হয়ে নাও। তোমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে যাবো।
ওরা ঘোড়ায় টানা গাড়ি চড়ে যখন রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছল তখন সবে সকাল হয়েছে। রাজামশাই তখনও বিছানায় শুয়ে। রাজার শোবার ঘরে ঢুকল দুজনে। রাজামশাই তো ওদের দেখে অবাক। বললেন–কী ব্যাপার? তোমরা এত সকালে?
মারিয়া বাবার পাশে বিছানাতেই বসল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া একে একে সব কথা বলতে শুরু করল। তখনই পাশের ঘর থেকে রানী এলেন। বললেন–মারিয়ার গলা শুনলাম। কী ব্যাপার? তোমরা এ সময়? মারিয়া তখন বাবা-মা দুজনকেই সব কথা বলল। রাজামশাই বললেন–দ্যাখো মারিয়া ফ্রান্সিসের বাবাই এখন তোমার অভিভাবক। উনি যদি সম্মতি দিয়ে থাকেন আমাদের বলার কিছু নেই। মারিয়া খুশিতে হাততালি দিয়ে ফেলল। রানীর গলা জড়িয়ে ধরল। বলল–মা, তুমি? রানী হাসলেন। বললেন–তোমার বাবা তো বললেনই। তাহলে আর আমি অমত করবো কেন? রাজামশাই বললেন-আইসল্যান্ডের কথা তো বিশেষ জানো না তোমরা। ওখানে কিন্তু সূর্যের উত্তরায়ণ দক্ষিণায়নের জন্যে বছরে ছমাস রাত ছমাস দিন।
-এখন তো ওখানে শীতকাল। ফ্রান্সিস বলল–তার মানে রাত চলছে। এ সময়টায় কি আকাশ নিকষকালো!
-না–তা নয়। খুব নরম আলো যাকে এ সময়। কাছের সবকিছু আবছা দেখা যায়। তবে শীতটা বেশি। রাজা বললেন।
–তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। ফ্রান্সিস বলল?
–কিন্তু একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছি। রাজা বললেন?
–কী ব্যাপার? মারিয়া জানতে চাইল। রাজা বললেন–ফ্রান্সিস, তোমার বোধহয় মনে আছে তুমি যখন সোনার ঘন্টা আনতে গিয়েছিলে তখন আমার সেনাপতি ছিল গুমন্ড। সে তোমাদের বিপদে ফেলতে চেয়েছিল।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে বৈকি। ফ্রান্সিস বলল?
–সেই গুমন্ডকে আমি আইসল্যান্ডে নির্বাসিত করেছিলাম। এখন গুমন্ড থিংভেলিরে লোকজন জড় করে রাজা হয়ে বসেছে। রাজা বললেন।
–কিন্তু আমরা তো যাচ্ছি রেভকজাভিকে। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ, রেভকজাভিকের রাজা এখন ইনগলফ। ইনগলফ আমাকে বরাবরই সম্মান করে। ওকে আমি চিঠি লিখে তোমার হাতে দেবো, ও তোমাদের সমাদর করবে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে সপ্তাহখানেক আগে ইনগলফ আমাকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে যে গুমন্ড নাকি ওর রাজ্য আক্রমণ করার জন্যে তোড়জোড় করছে। এ সময় তোমরা যাবে তাই ভাবছি তোমরা না বিপদে পড়ো। রাজা বললেন।
–আমরা যাতে যুদ্ধে না জড়িয়ে পড়ি সে চেষ্টাই করবো। ফ্রান্সিস বলল?
–ঠিক আছে–তোমরা যা ভালো বুঝবে করবে?
–আমাদের একটা ভালো জাহাজ দিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। রাজামশাই বললেন?
–যাত্রার দিনটা পরে আপনাকে জানাবো। ফ্রান্সিস বলল?
–আচ্ছা–রাজা বললেন। ফেরার পথে ফ্রান্সিস হ্যারির বাড়ি গেল। হ্যারি সব শুনে লাফিয়ে উঠল–আবার অভিযান। ঠিক হলো হ্যারি বিস্কো, শাঙ্কো আর অন্য বন্ধুদের খবর দেবে। পরদিন বিকেলে ফ্রান্সিসের বাড়িতে মিলিত হবে সবাই।
বিকেলে প্রায় সব বন্ধুই এল। গল্পগুজবে আড্ডা জমে উঠল। একসময় ফ্রান্সি উঠে দাঁড়াল। সবাই চুপ করল। ফ্রান্সিস বলল–ভাইসব–আবার অভিযানে বেরুবো আমরা। এবারের গন্তব্যস্থল–আইসল্যান্ড। তারপর ফ্রান্সিস কবি আরির বই, ছবি নকশা, রাজা ফ্রোকির গুপ্তধন, মণিমাণিক্য-বোঝাই জাহাজ, সপ্তম স্তম্ভ সব কথাই বলল। সবশেষে বলল–ভাইসব, দুটো সুসংবাদ দিচ্ছি–এক রাজামশাই আমাদের জাহাজ দেবেন–ভাল জাহাজ, আর দুই–এই অভিযানে মারিয়াও আমাদের সঙ্গে যাবে। সব ভাইকিং বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো-। তারপর আলোচনা করে স্থির হলো, পাঁচ তারিখে ওরা জাহাজ নিয়ে অভিযানে বেরুবে।
দেখতে দেখতে পাঁচ তারিখ এসে গেল। এর মধ্যে সবাই গরম জামাকাপড় কিনল। খাদ্য অস্ত্রশস্ত্র সব যোগাড় করে রাখল। গ্রীনল্যান্ডে ওরা এর আগে এক অভিযানে গিয়েছিল। কাজেই শীতের দেশ সম্পর্কে ওদের অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া–আইসল্যান্ড গ্রীনল্যান্ডের মতো সবসময় বরফে ঢেকে থাকে না।
যাত্রার দিন একটা সুদৃশ্য মজবুত জাহাজ জাহাজঘাটায় আনা হলো। ফ্রান্সিসরাও তখন সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস কুড়ুল, বেলচা, দড়ি এসব জাহাজে রাখল। তারপর খাদ্য-জল।
জাহাজঘাটায় একটা সুন্দর সামিয়ানা টাঙিয়ে তার নিচে রাজবাড়ি থেকে আনা চেয়ার-টেবিল রাখা হলো। মারিয়া, ফ্রান্সিস ও বন্ধুরা জাহাজে উঠল। ডেক-এ এসে দাঁড়াল। রাজা,মন্ত্রী ও অন্যান্য গণ্যমান্য অমাত্যরা সামিয়ানার নিচে এসে বসলেন। কামান দাগা হলো। ঘর ঘর শব্দে নোঙর তোলা হলো। ফ্রান্সিসদের জাহাজ গভীর সমুদ্রের দিকে ভেসে চলল।
দিন সাতেকের মধ্যে জাহাজ ফারো দ্বীপে পৌঁছল। সেখান থেকে দক্ষিণ আইসল্যান্ডের বন্দর অলিপ্টাজর্ড-এ পৌঁছল।
আলোর দেশ ছেড়ে এবার ফ্রান্সিসরা অন্ধকারের দেশে পৌঁছল। সত্যি চারিদিকে নিকষ অন্ধকার নয়, শেষ বিকেলের ম্লান আলোর মত আকাশে মাটিতে আলো ছড়ানো। তাতে কাছাকাছি সবকিছুই অস্পষ্ট হলেও দেখা যায়। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। সবাই বাড়তি গরম পোশাক গায়ে পরে নিল।
কিছুদিন পরে ফ্রান্সিসদের জাহাজ রেভকজাভিক বন্দরে পৌঁছল। রেভকজাভিক বেশ বড় বন্দর। বেশ কটা জাহাজ নোঙর করা। মারিয়া ফ্রান্সিসকে বলল রেভজাভিক কথাটার অর্থ হলো বাষ্পচ্ছন্ন উপসাগর।
ফ্রান্সিস বিস্কোকে ডাকল। ওর হাতে রাজার চিঠিটা দিল। বলল–এখানকার রাজা ইনগলফের হাতে চিঠিটা পৌঁছে দাও। বিস্কো চিঠি নিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা জাহাজ থেকে নেমে জায়গাটা দেখতে লাগল। বেশ কিছু বাড়িঘর আছে। বাড়িঘর সবই পাথরে তৈরি, ছাদ মোটা ঘাসের আস্তরণে তৈরি, রাস্তায় লোকজনের ভিড়। প্রায় সবাই ভাইকিং। দোকানপাট, কড মাছের গুদাম এসব আছে। বাড়িগুলো লম্বাটে। লম্বা ঘর। দুপাশের দেয়ালে কাঠের পাটাতন। শোয়া, রান্না করা ঐ পাটাতনেই। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা ঘুরেফিরে বন্দরটা দেখতে লাগল। তখনই ওরা দেখল পথ দিয়ে ঘোড়ায় টানা একটা বেশ জমকালো গাড়ি আসছে। গাড়ির কালো চকচকে কাঠে সোনালী লতাপাতার কাজ। ওরা বুঝল রাজা ইনগলফ চিঠি পেয়ে আসছেন। ওরা তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরে এল।
রাজার ঘোড়ার গাড়ি জাহাজঘাটায় এসে থামল। রাজা ইনগলফ আর রাণী দুজনেই এসেছেন। ফ্রান্সিস আর মারিয়া জাহাজ থেকে নেমে এল। রাজা ও রানীকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। রাজা ইনগলফ ফ্রান্সিসকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন–ফ্রান্সিস, চারণ কবিদের গানে তোমার নানা বীরত্বের কাহিনী শুনেছি। তুমি আমাদের দেশে এসেছো এ জন্যে আমরা গর্ব অনুভব করছি। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে চুপ করে রইল। ওদিকে রানীও মারিয়ার সঙ্গে নানা কথা বলতে লাগলেন। কেমন লাগছে এ দেশ–আসতে কষ্ট হয়েছে কিনা–এসব।
একটু পরে রাজা-রানীর সঙ্গে গাড়িতে চড়ে ফ্রান্সিস ও মারিয়া রাজবাড়িতে এল। রাজবাড়িটাও পাথরের। বেশ বড়। চারদিকে পাথরের দেয়াল।
একটা ঘর ফ্রান্সিস ও মারিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হলো। খুব সাজানো-গোছানো পাথরের ঘর। দেয়ালে পাথর কেটে ফুল লতাপাতার কাজ।
একসময় ফ্রান্সিসদের খাবারঘরে আসার জন্যে বলতে একজন পরিচারক এল। ওরা তার সঙ্গে চলল।
ওরা দুজনে খাবার ঘরে ঢুকল। একটা লম্বাটে বেশ বড় মসৃণ পাথরের খাবার টেবিল। ধারে ধারে কারুকাজ করা ও কাঠের চেয়ার পাতা। রাজা-রানী তাদের পাশেই ফ্রান্সিস আর মারিয়াকে বসালেন। মন্ত্রী, সেনাপতি ও অন্য অমাত্যরাও এসে বসলেন। পরিবেশনকারীরা খাবার পরিবেশন করতে লাগল। খাওয়া-দাওয়া চলল। রাজা ইনগলফ ফ্রান্সিসকে কথাপ্রসঙ্গে বললেন–রাজামশাইর চিঠিতে তোমরা আসছো এটা জেনেছি। কিন্তু তোমরা কেন এসেছে সেটা উনি লেখেননি।
ফ্রান্সিস তখন আস্তে আস্তে কবি আরির আইসল্যানিগা বক–এর কথা রাজা ফ্লোকি কর্তৃক গোপনে লুকিয়ে রাখা মণিমাণিক্য-বোঝাই সোনার জাহাজ এসবের ঠিক বুঝল না এগুলো কী? ফ্রান্সিসকে ডেকে বলল–এই চৌকোণো থামের মতো এগুলো কী? ফ্রান্সিস কাছে এল। চৌকোণো থামগুলো দেখল। কিন্তু ও নিজেও বুঝতে পারল না। মাথা নাড়ল।
ওরা দুজনে ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগল। তখনই ফ্রান্সিস দেখল কিছুদূরে পাহাড়ের নিচে একটা পাথরের ঘর। ঘোট ঘর। ঘরটায় ছাউনি এখানকার রীতি অনুযায়ী মোটা শুকনো ঘাসের। ফ্রান্সিস তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘরটা থেকে একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে এল। লোকটার মুখের দাড়ি-গোঁফ, মাথার চুল সব সাদা। একটা লম্বা কাঠের মাথায় আঁটা বাঁধা। সেটা নোকটার কাঁধে। বৃদ্ধটি ঝটা নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে ফ্রান্সিস আর মারিয়ার কাছে এল। একবার ওদের দেখল। তারপর স্তম্ভপোঁতা জায়গাটা আঁটা দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল। মারিয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল–এ জায়গাটা পরিষ্কার করছেন কেন?
বৃদ্ধটি সাদা ভুরু কুঁচকে মারিয়ার দিকে তাকাল। পাকা দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে হাসল। বলল–তোমরা বুঝি নতুন এসেছো?
-হ্যাঁ। মারিয়া বলল।
–আজকে পনেরো তারিখ। ঘন্টাকয়েক পরে এখানে নাচগানের আসর বসবে। বৃদ্ধ বলল।
প্রত্যেক পনেরো তারিখই নাচগান হয় এখানে তাই না? মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ–আর আমার কাজ হলো সেদিন এই জায়গাটা ঝটটাট দিয়ে পরিষ্কার রাখা আর উৎসবের সময় প্রদীপ জ্বালানো।
কথাটা শুনে ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। বলল–এখানে প্রদীপ কোথায়?
বৃদ্ধটি আঙুল দিয়ে চৌকোণো থামগুলো দেখাল। বলল–ঐ তিনটে প্রদীপ। মোটা কাপড় পেঁচিয়ে পলতে তৈরি করি। তারপর প্রদীপগুলোর মাথায় শীল মাছের তেল ঢালি। প্রদীপ জ্বালিয়ে দিই। এই কাজগুলো করাই আমার চাকরি। বৃদ্ধটি আবার ঝাট দিতে লাগল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে পাথরের প্রদীপগুলো দেখল। দেখল সত্যিই বড় প্রদীপের মতো ওগুলো। ওগুলোর মাথায় তেলকালি লেগে আছে।
-আপনি কতদিন এই কাজ করছেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধটি সাদা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল–সেই কতদিন থেকে–মনে নেই।
–আচ্ছা আপনি কি বরাবর এই ছটা স্তম্ভই দেখেছেন?
–হ্যাঁ?
–সপ্তম স্তম্ভের কথা শুনেছেন কখনও?
বৃদ্ধ একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল–আমার আগে যে এখানে কাজ করতো, কথায় কথায় সে একদিন বলেছিল এখানে রাজা ফ্লোকি আর একটা স্তম্ভ পুঁতেছিলেন। তবে সেটা পাথরের না, সোনার।
কথাটা শুনে ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল–আর কী বলেছিল?
বৃদ্ধ মাথা নাড়লনা, আর কিছু না। তারপর নিজের কাজ করতে লাগল।
ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ স্তম্ভ, প্রদীপ, ঘাসে ঢাকা জায়গাটা দেখল। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। এই স্তম্ভগুলোর সঙ্গে মণিমাণিক্য-বোঝাই সোনার জাহাজের সম্পর্ক কী? আরো একটা সোনার স্তম্ভ নাকি আছে। সেটাই বা কোথায়? তবে একটা কথা ফ্রান্সিস বুঝল যে এই স্তম্ভগুলোর সাহায্যেই সপ্তম স্তম্ভটা খুঁজে বার করতে হবে। তাহলেই রাজা ফ্লোকির গুপ্তধনের হদিস পাওয়া যাবে।
দুজনে গাড়িতে চড়ে রাজবাড়িতে ফিরে এল।
খাওয়া-দাওয়ার সময় ফ্রান্সিস রাজা ইনগলফকে বলল–এবার আমরা জাহাজে ফিরে যাবো।
রানী বলে উঠলেন–উই–তোমরা এখানেই থাকবে।
–তাহলে এক কাজ করা যাক–ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া এখানে আপনার কাছে থাক। আমাকে জাহাজে বন্ধুদের সঙ্গে থাকতেই হবে।
–বেশ–তাতে আমাদের আপত্তি নেই। রাজা বললেন?
–আজকে লোগবার্গের উৎসবে তোমরা যাবে না? রানী বললেন।
-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবো। বন্ধুদেরও নিয়ে যাবো। মারিয়া এখান থেকে আপনাদের সঙ্গে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
রাজার দেওয়া গাড়িতে চড়েই ফ্রান্সিস জাহাজঘাটায় এল। জাহাজে উঠতেই বন্ধুরা ওকে ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস বলল–সবাই তৈরি হয়ে নাও। একটু পরেই আমরা লোকবার্গ যাবো। আজ ওখানে উৎসব। নাচগানের আসর বসবে।
সব ভাইকিংরা হৈ হৈ করে উঠল। সবাই খেয়েদেয়ে তৈরি হতে চলে গেল।
স্থানীয় চাষীদের কয়েকটা শস্যটানার গাড়ি যোগাড় করা হলো। ঘোড়াও পাওয়া গেল। ফ্রান্সিস আর ওর বন্ধুরা গাড়িতে আর ঘোড়ায় চড়ে হৈ হৈ করতে করতে চলল লোগবার্গের দিকে। যাবার সময় দেখল এই বন্দর নগরের রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে উৎসবে যোগ দিতে। চারদিকে উৎসবের আবহাওয়া।
ওরা লোগবার্গ পৌঁছল। তখন অল্প অন্ধকারে পাথরের তিনটি বড় প্রদীপ জ্বালাবার কাজ চলছে। সেই বৃদ্ধটি সাদা মোটা লম্বা কাপড় পেঁচিয়ে পলতে তৈরি করল। তারপর একটা ছোট কাঠের মই প্রদীপস্তম্ভের গায়ে লাগাল। মইয়ে উঠে লম্বা আর মোটা পলতে প্রদীপে রাখল। পলতের মুখটা বাড়িয়ে রাখল। এবার লোকটি একটা শীল মাছের তেলের পিঁপে নিয়ে এল। মই দিয়ে উঠে তিনটে প্রদীপেই তেল ঢালল। তারপর চমকি ঠুকে একটা মশাল জ্বালল। মশালের আগুন দিয়ে প্রদীপগুলো জ্বেলে দিল। প্রদীপগুলো ভালো করে জ্বলে উঠতেই জায়গাটা আলোয় আলোময় হয়ে উঠল।
অনেক লোক এসেছে। পাহাড়ের খাঁজকাটা পাথরে বসেছে সবাই। ওই পাথরগুলোতে বসে সাধারণ দর্শকরা। ওখানেই সামনের দিকে একটা বড় পাথরের বেদীমতত। বেদীতে পাথর কুঁদে ফুল পাতা পাখির ছবির অলঙ্করণ। একটু পরেই খয়েরী রঙের সুদৃশ্য একটা মাথা খোলা গাড়িতে চড়ে রাজা ইনগলফ ও রানী এলেন। রানীর পাশে মারিয়া। রাজা-রানী উৎসবের সাজে সেজে এসেছেন। মারিয়াও একটা হালকা সবুজ রঙের নতুন পোশাক পরে এসেছে। রাজা-রানী ও মারিয়া সেই কাজ-করা বেদীতে বসল। দর্শকরা সমস্বরে রাজার জয়ধ্বনি দিল। ততক্ষণে ফ্রান্সিসরাও খাঁজকাটা পাথরের আসনে বসে পড়েছে।
সেই বৃদ্ধ লোকটি আরো দুতিনজনের সাহায্যে একটা লতাপাতা বোনা মোটা বিরাট কাপড় নিয়ে এল। স্তম্ভগুলোর পেছনে ঘাসের জমিতে সেটা পেতে দিল ওরা।
স্তম্ভের একপাশে তিন-চারটে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাদ্যযন্ত্রীরা বসল। শুরু হলো বাজনা। আইসল্যাণ্ডের নানা রঙের সুতোয় কাজ-করা পোশাক পরে একদল মেয়ে এসে দাঁড়াল নাচের জায়গায়। একটি মেয়ে এগিয়ে এসে সুরেলা গলায় বাজনার সঙ্গে গান ধরল। শুরু হলো নাচ। অন্য মেয়েরা দল বেঁধে, কখনও হাত ধরাধরি করে, কখনও হাত ছাড়িয়ে নাচতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসর জমে উঠল। দর্শকরা মাঝে মাঝে চিৎকার করে নাচিয়েদের উৎসাহিত করতে লাগল। একসময় নাচ গান থামল।
এবার রাজা-রানী আসন ছেড়ে উঠলেন। সবাই উঠে দাঁড়াল। রাজা ও রানী তাদের ঘোড়ার গাড়ির দিকে চললেন। পেছনে মারিয়া। তারা গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি চলল। সুন্দর পোশাক পরা চারজন দেহরক্ষী ঘোড়ায় চড়ে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলল।
আবার শুরু হলো বাজনা-নাচগান। দর্শকদের মধ্যে থেকেও কিছু লোক গিয়ে নাচের আসরে যোগ দিল। আনন্দ হর্ষধ্বনি উঠল দর্শকদের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নাচগান চলল। তারপর উৎসব শেষ হলো। দর্শকরা উঠে দলে দলে গাড়িতে . চড়ে, পায়ে হেঁটে ফিরে চলল। ফ্রান্সিসরাও ফিরে চলল বন্দরের দিকে।
ওদিকে লোগবার্গের উৎসব থেকে রাজা-রানী ও মারিয়া ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ফিরে আসছে রাজবাড়িতে।
রাজা ইনগলফের গাড়ি চলেছে। সামনে দুজন ও পেছনে দুজন অশ্বারোহী দেহরক্ষীও চলেছে। রানী হেসে মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন–কী? উৎসব কেমন লাগল?
খুব ভালো। বিরাট পাথরের প্রদীপের আলোয় এরকম নাচগান–অপূর্ব। মারিয়া বলল।
অল্প আলোয় গাড়ি চলেছে। একটু কুয়াশার জটলা এখানে ওখানে। গাড়ি একটা মোড়ে এল। এখানে দুটো রাস্তা। একটা চলে গেছে বন্দর শহরের দিকে। রাজবাড়ির দিকে। অন্য রাস্তাটা সোজা চলে গেছে এ রাজ্যের সীমান্তের দিকে। সীমান্ত পেরিয়েই থিংভেলির রাজ্য। সেই রাস্তাটা খুব ভালো নয়। এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে রাস্তা। এ রাস্তাটায় লোকজন গাড়িঘোড়ার চলাচলও কম। রাস্তার মাঝখানে দুপাশে কোথাও কোথাও তুষার জমেছে।
ঠিক মোড়টায় হঠাৎ ঘন কুয়াশা গাড়িটাকে ঘিরে ধরল। একে আলো কম, তার ওপর কুয়াশা। গাড়ির চালক গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। গাড়িটা শহর ও রাজবাড়ি যাওয়ার পথটা ধরবে, ঠিক তখনই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এল একদল অশ্বারোহী সৈন্য। গাড়িটাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলল। গাড়ির চালক ঘোড়ার রাশ টেনে গাড়ি থামিয়ে ফেলল। রাজা ইনগলফ সেই সৈন্যদের পোশাক দেখেই চিনলেন-এরা রাজা গুমণ্ডের সৈন্য। রাজার দেহরক্ষী চার অশ্বারোহী সৈন্য প্রথমে কুয়াশার মধ্যে ঠিক বুঝল না গাড়ি থামল কেন। এবার দেখল রাজা গুমণ্ডের সৈন্যদের। কিন্তু ততক্ষণে রাজা গুমণ্ডের সৈন্যরা ওদের ঘিরে ফেলেছে। দেহরক্ষী চারজন সঙ্গে সঙ্গে কোমরের খাপ থেকে তরোয়াল উঁচিয়ে লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হলো। শত্রুসৈন্য সংখ্যায় কুড়ি-পঁচিশজন। দেহরক্ষীরা মাত্র চারজন। রাজা ইনগলফ ওপরখোলা গাড়ি থেকে সবই দেখলেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে দেহরক্ষীদের শান্ত হতে বললেন। দেহরক্ষী সৈন্যরা তরোয়াল নামাল। রানীর ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল। উনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মারিয়াও ভীত হলো। তবে একেবারে ভেঙে পড়ল না। মনে সাহস সঞ্চয় করল। ভাবল–দেখা যাক না কী হয়। মারিয়া রানীকে জড়িয়ে ধরল। .স্পষ্ট বুঝল রানীর সারা শরীর কাঁপছে। মারিয়া মৃদুস্বরে বলল–কাঁদবেন না। ভয়ের কিছু নেই। রাজা এবার শত্রুসৈন্যদের দিকে তাকালেন। বেশ দৃঢ়স্বরে বললেন–তোমরা কী চাও?
শত্রুসৈন্যের দলপতি এগিয়ে এল। বলল–আমাদের রাজা গুমণ্ডের হুকুম-রাজকন্যা মারিয়াকে বন্দী করে নিয়ে যেতে হবে।
–অসম্ভব। রাজা চিৎকার করে বললেন–মারিয়াকে বন্দী করে নিয়ে যেতে হলে আমাদেরও তার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
দলপতি বেশ চিন্তায় পড়ল। একটু ভেবে বলল–বেশ। আপনাদেরও সঙ্গে যেতে হবে।
–আমরা প্রস্তুত। রাজা বললেন।
দলপতি বলল–তার আগে আপনার দেহরক্ষীদের অস্ত্রত্যাগ করতে হবে।
–বেশ। রাজা দেহরক্ষীদের দিকে তাকিয়ে অস্ত্রত্যাগের ইঙ্গিত করলেন। দেহরক্ষীরা অস্ত্রত্যাগ করল। পাথুরে রাস্তায় তরোয়াল ফেলে দিল ওরা। একজন সৈন্য তরোয়াল কুড়িয়ে নিল। ঝনঝনাৎ শব্দ উঠল। এবার শত্রুসৈন্যের দলপতির নির্দেশে দেহরক্ষী সৈন্যদের ঘিরে ফেলা হলো। গাড়িও ঘিরে ফেলা হলো। তারপর শত্রু-দলপতি গাড়ির চালককে হুকুম নিল–এই রাস্তা ধরে গাড়ি চালাও। যত তাড়াতাড়ি পারো। সীমান্ত পেরিয়ে থিংভেলির দিকে। জলদি। গাড়ি চলল। গাড়ি আর দেহরক্ষীদের ঘিরে শত্রুসৈন্যেরাও চলল। এবড়োখেবড়ো তুষার-জমা পাহাড়ি রাস্তা। চালক গাড়ি খুব জোরে চালাতে পারছিল না।
গাড়ি চলছে। শত্রুসৈন্যরাও ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে হঠাৎ আবার একটা কুয়াশার আস্তরণ সবাইকে ঢেকে ফেলল। একজন দেহরক্ষী ঘোড়া থেকে লাফ দিল রাস্তার ধারে খাদের তুষারের মধ্যে। ঠিক তখনই কুয়াশার আস্তরণ সরে গেল। পেছনের একজন শত্রুসৈন্য সেই অল্প আলোয় সঙ্গে সঙ্গে পলায়নপর দেহরক্ষীকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়ল। নির্ভুল নিশানা। বর্শা ওর পিঠে গেঁথে গেল। দেহরক্ষীটি আর পালাতে পারল না। উবু হয়ে খাদের তুষারের মধ্যে পড়ে গেল। রাজা সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে বাকি তিনজন দেহরক্ষীকে বললেন–তোমরা পালাবার চেষ্টা করো না। রাজা বসলেন। আবার গাড়ি চলল। শত্রুসৈন্যরাও চলল ঘোড়া ছুটিয়ে। গাড়ির সামনে পেছনে।
মারিয়া রানীকে ধরে রইল। রানী আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। রাজা মৃদুস্বরে বললেন–কাদছো কেন? আমি তো এখনো বেঁচে আছি।
ঘণ্টা দুয়েক পরে দূরে আলোয় দেখা গেল কালো রঙের টানা নিচু পাহাড় একটা। এই নিচু পাহাড়টাই রেভঞ্জাভিক ও থিংভেলির রাজ্যের সীমানা। পাহাড়টার ওপরে জমা বরফ। শীতার্ত হাওয়া ছুটে আসছে ঐ সীমানা পাহাড়ের দিক থেকে।
ওদিকে খাদের মধ্যে পড়ে থাকা আহত দেহরক্ষীটি তখনও বেঁচে ছিল। পিঠে গাঁথা বর্শাটা খুলে ফেলেছিল। রক্তাক্ত দেহে সে কোনোরকমে খাদের তুষার থেকে শরীরটাকে হিচড়োতে হিচড়োতে উঠেছিল পাথুরে রাস্তাটায়। তারপর রাস্তাতেই পড়ে রইল সে।
.
উৎসবে হৈ-হল্লা আনন্দ করে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা তখন খুবই ক্লান্ত। ওরা জাহাজে উঠে যে যার কেবিনঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল না। কেবিনঘরে ঢুকে মোটা মোমবাতিটা চমকি পাথর ঠুকে জ্বালল। তারপর বিছানার তলা থেকে কবি আরির সেই ছবি ও নক্সা আঁকা কাগজটা নিয়ে বসল। ছবি আর নক্সাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। দীর্ঘ সর্প জাহাজের মুখের ছবি এটা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সাপটার মুখে সাতটা দাঁত, মাথায় সাতটা মণি কেন? ত্রিভুজের নক্সাটার অর্থ কী? ফ্রান্সিস গভীরভাবে এইসব ভাবছে তখনই হ্যারি ওর ঘরে ঢুকল। বলল–আলো জ্বলছে দেখে এলাম। কী ব্যাপার? ঘুমুবে না?
-হ্যাঁ, এইবার শোব। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি ওর পাশে এসে বসল?
–এই ছবি নক্সা তো দেখেছো? ফ্রান্সিস বলল?
–হুঁ দেখেছি। হ্যারি বলল?
–কিছু বুঝতে পারছো? ফ্রান্সিস বলল।
–নাঃ। তা তুমি তো ঐ স্তম্ভ, জায়গাটা ভালো করে দেখে এসেছো। তুমি কিছু বুঝলে? হ্যারি বলল।
–উঁহু। সাদাটে পাথরের স্তম্ভ। স্তম্ভ যেমন হয়। খুব সরুও নয়, খুব মোটাও নয়। সাধারণ স্তম্ভ। ফ্রান্সিস বলল।
–হুঁ। হ্যারি নক্সাটা ভালো করে দেখল। হঠাৎ বলে উঠল–আচ্ছা ত্রিভুজের ওপরে দেখো তিনটি চিহ্ন রয়েছে। প্রত্যেকটি রেখার শেষে। কীসের চিহ্ন এগুলো?
–দেখেছি। আমার মনে হয় ওগুলো সূর্য। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস-এটা আইসল্যান্ড। ছমাস সূর্যের দেখাই পাওয়া যায় না। তাও আবার একটা নয় তিনটে সুর্য। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস একটু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–না, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তারপর বলল–লক্ষ্য করে দেখো নিচের একটা বিন্দু থেকে তিনটে সরলরেখা উঠে গেছে। এভাবেই একটা ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে।
–আর একটা জিনিস লক্ষ্য করো–নিচের বিন্দুর কাছে কিন্তু সূর্যের মতো ঐ চিহ্নটা নেই। হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ, সেটাও লক্ষ্য করেছি। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
হ্যারি উঠে দাঁড়াল। বলল-নাও এবার ঘুমোও। পরে ভাবা যাবে। হ্যারি চলে গেল। ফ্রান্সিস ছবির কাগজটা বিছানার নিচে রাখল। তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। ঐ নক্সা ছবির কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না। হঠাৎ হ্যারির ডাকাডাকিতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ও হ্যারির মুখের দিকে তাকাল। হ্যারি বলল–শীগগির ওঠো। রাজার প্রাসাদের দুজন পাহারাদার এসেছে। তারা তোমাকে কী বলতে চায়।
ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। রাজবাড়ির পাহারাদার সৈন্য দুজন এগিয়ে এল। একজন বলল–আপনিই ফ্রান্সিস।
হ্যাঁ,–ফ্রান্সিস বলল।
পাহারাদার সৈন্যটি বলল–সেনাপতি একটা সংবাদ আপনাকে জানাতে বলেছেন।
–বলো।
–রাজা-রানী ও রাজকন্যা মারিয়া লোগবার্গের উৎসব থেকে ফিরছিলেন। পথে রাজা গুমণ্ডের সৈন্যরা তাদের বন্দী করেছে। তারপর থিংভেলিরে নিয়ে গেছে। সৈন্যটি বলল।
ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে একলাফে উঠে দাঁড়াল। বলল–সব খুলে বলল।
সৈন্যটি বলতে লাগল–আমরা দুজন রাজবাড়ির সদর দেউড়ি পাহারা দিচ্ছিলাম। লোগবার্গে উৎসব শেষ হয়ে গেল। লোকজন সব ফিরে এল। ঘরে ঘরে আলো নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়ল। রাস্তাঘাট নির্জন হয়ে গেল। অথচ রাজা রানী আর রাজকন্যা মারিয়াকে নিয়ে তখনও গাড়ি রাজবাড়ি ফিরল না। আমরা ভাবলাম হয়তো রাজা-রানী, রাজকন্যা মারিয়াকে উষ্ণ প্রস্রবণ, আগ্নেয়গিরি এসব দেখাতে নিয়ে গেছেন। আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু গাড়ি ফিরল না। আমাদের কেমন সন্দেহ হলো। আমরা দুজন ঘোড়ায় চেপে লোগবার্গে গেলাম। উৎসব অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়ে গেছে। যে দুচারজন লোক পাহাড়ের খাঁজে শুয়ে বসে ছিল তাদের কাছে জানলাম রাজা-রানী রাজকন্যা মারিয়াকে নিয়ে অনেকক্ষণ আগেই গাড়িতে চলে এসেছেন। আমরা অন্য যে পাথুরে পথটা থিংভেলির দিকে গেছে সে পথ দিয়ে ঘোড়া ছোটালাম। এই পথের ধারেই দুটো উষ্ণ প্রস্রবণ আর হেকলা আগ্নেয়গিরি আছে। কিছুদূর আসতেই দেখলাম রাজার এক দেহরক্ষী ভীষণ আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। মুমুর্ষ রক্ষীটি কোনোরকমে বলতে পেরেছিল–বন্দী-রাজা গুমণ্ড–থিংভেলির। তারপরই রক্ষীটি মারা গেল। আমরা ফিরে এসে সেনাপতিকে খবর দিলাম। তিনি আপনাকে খবর দেবার জন্যে আমাদের পাঠিয়েছেন।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ঘরের কাঠের মেঝেয় কয়েকবার পায়চারি করল। পায়চারি থামিয়ে বলল–হ্যারি–বোঝাই যাচ্ছে তিনজনেই রাজা গুমণ্ডের হাতে বন্দী হয়েছে। একটু থেমে বলল–আমরা রাজা গুমণ্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে চাইনি। কিন্তু এখন তো রাজা-রানী আর মারিয়াকে মুক্ত করতেই হবে। কাজেই প্রয়োজনে যুদ্ধে নামতেই হবে। এদিকে খবরটা জাহাজে ছড়িয়ে পড়ল। সব ভাইকিংরা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–যাও–সবাইকে ডেক-এ আসতে বলো।
সব ভাইকিং ছুটে এল। জাহাজের ডেক-এ জড়ো হলো। ফ্রান্সিস হারিকে সঙ্গে নিয়ে ডেক-এ উঠে এল। সকলের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব–তোমরা নিশ্চয়ই জেনেছে যে থিংভেলির রাজা গুমণ্ড রাজা ইনগলফ, রানী ও মারিয়াকে বন্দী করেছে। আমরা চাইনি যুদ্ধে জড়াতে। কিন্তু এখন প্রয়োজনে লড়াইতে নামতেই হবে। রাজা-রানী ও মারিয়াকে মুক্ত করতে হবে। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল–আমি আর হ্যারি সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে রাজবাড়ি যাচ্ছি। তোমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে রাজবাড়িতে এসো। সেনাপতির সঙ্গে কথা বলে আমরা ইতিকর্তব্য স্থির করবো।
সব ভাইকিং চিৎকার করে উঠল—ও-হো-হো। তারপর অস্ত্রঘরের দিকে ছুটল। যুদ্ধের উন্মাদনা জাগল ওদের মধ্যে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি গাড়ি চড়ে রাজবাড়িতে এল। সেনাপতি দরবার কক্ষে ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ফ্রান্সিস ও হ্যারি ঘরে ঢুকল। সেনাপতি ওদের ভেলভেটে মোড়া কাঠের আসনে বসতে ইঙ্গিত করলেন। ওরা বসল। সেনাপতি বললেন–সবাই তো শুনেছেন। এখন রাজা-রানী ও রাজকন্য মারিয়াকে মুক্ত করতে গেলে যুদ্ধ করতেই হবে।
-ঠিক আছে। আমাদের কিছু ঘোড়া দিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-তার সব ব্যবস্থা হবে। প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনী যাবে। পেছনে যাবে পদাতিক বাহিনী। সীমান্ত পেরিয়ে প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনী থিংভেলির আক্রমণ করবে। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে যাবে পদাতিক বাহিনী। সেনাপতি বললেন।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–আমার বন্ধুরা এখুনি এসে পড়বে। আপনি আপনার সৈন্যদের একত্র করুন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ভাইকিংরা রাজবাড়ির সামনের বিস্তৃত প্রান্তরে এসে উপস্থিত হলো। রাজা ইনগলফের সৈন্যরাও অস্ত্র নিয়ে প্রান্তরে এসে মিলিত হলো। অশ্বারোহী ও পদাতিক দুভাগে সৈন্যদের ভাগ করা হলো। সমস্ত বাহিনীর সামনে রইল সেনাপতি, ফ্রান্সিস আর তীরধনুক হাতে শাঙ্কো।
রেভক্জাভিকের মানুষেরা এসে জড়ো হলো এই যুদ্ধযাত্রা দেখতে। রাজা-রানী ও মারিয়া রাজা গুমণ্ডের হাতে বন্দী হয়েছে এ সংবাদ ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে।
সেনাপতি থিংভেলির দিকে তরোয়াল তুলে ইঙ্গিত করলেন। সব সৈন্য চিৎকার করে উঠল। ভাইকিংরাও ধ্বনি তুলল-ও-হো-হো-যুদ্ধযাত্রা শুরু হলো।
মাথার ওপরে স্বল্পালোকিত আকাশ, মাটিতেও কুয়াশা আর অন্ধকার আর এখানে ওখানে জমা তুষার। তার মধ্যে দিয়ে সৈন্যরাহিনী থিংভেলির দিকে এগিয়ে চলল। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে জোর ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে তখন।
সবার আগে চলেছে দশ-বারোজন মশালধারী। মশালের আলোয় ওরা পথ দেখিয়ে দিয়ে চলল।
বেশ কয়েক ঘন্টা পর দূরে অস্পষ্ট দেখা গেল টানা পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় বরফ। ওটাই সীমান্ত। নিচু টানা পাহাড়ের চড়াই পেরোলেই থিংভেলির রাজ্যের শুরু।
হঠাৎ দেখা গেল সীমান্ত পাহাড় থেকে নেমে আসছে দুটো আলোর বিন্দু। একটু এগিয়ে আসতেই বোঝা গেল দুটো চলন্ত মশাল। আর একটু পরে আলোছায়ায় দেখা গেল একটা ঘোড়ার গাড়ি আসছে। গাড়িটায় মশালের আলো পড়েছে। দেখা গেল রাজা ইনগলফের গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতি তরোয়াল আকাশের দিকে তুলে থামবার ইঙ্গিত করলেন। সৈন্যবাহিনী আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে পড়ল।
গাড়িটা কাছে এল। থামলে দেখা গেল গাড়িতে রাজা ও রানী। মারিয়া নেই। ছাতখোলা গাড়িটায় উঠে দাঁড়ালেন রাজা ইনগলফ। গাড়ির দুপাশের মশালের আলো পড়েছে তার মুখে। দুহাত ওপরে তুলে রাজা ইনগফ বলতে লাগলেন–আমার বীর যোদ্ধারা–আমাকে আর রানীকে রাজা গুমণ্ড মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু বন্দী করে রেখেছে রাজকন্যা মারিয়াকে। রাজা গুমণ্ড এক শর্তে আমাদের মুক্তি দিয়েছে। শর্তটা হচ্ছে আমাকে আর রানীকে রেভজাভিক ছেড়ে দক্ষিণ পূর্বে স্কালহন্টে চলে যেতে হবে। মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা সময় দিয়েছে রাজা গুমণ্ড। আমি ও রানী স্কালহন্টে পৌঁছে রাজা গুমণ্ডকে সংবাদ পাঠালে সে রাজকন্যা মারিয়াকে মুক্তি দেবে। রাজা থামলেন।
সমস্ত সৈন্যরা নীরব। শুধু শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে। দুএকটা ঘোড়ার ডাক শোনা যাচ্ছে। রাজা ইনগলফ আবার বলতে লাগলেন–আমি এই শর্তে সম্মত হয়েছি। রাজকন্যা মারিয়ার জীবন রক্ষা করা আমার কর্তব্য। তাই আমি আর রানী রাজবাড়িতে যাবো এখন। সব ব্যবস্থা করে স্কালহল্টেচলে যাবো। তোমরাও আমার সঙ্গে চলল। আমি রক্তপাত চাই না। বিনা রক্তপাতে রাজকন্যা মারিয়াকে মুক্ত করার জন্য অন্য কোনো পথ নেই। আমাকে এই নির্বাসন মেনে নিতেই হবে।
এবার ফ্রান্সিস ঘোড়া নিয়ে রাজার সামনে এসে দাঁড়াল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–রাজা ইনগলফ–আমাদের একবার সুযোগ দিন। চেষ্টা করে দেখি রাজকন্যা মারিয়াকে মুক্ত করতে পারি কিনা।
–বেশ। দেখো চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোরম রক্তক্ষয় নয়। রাজা বললেন। ফ্রান্সিস এবার সেনাপতির কাছে এল। বলল-থিংভেলির রাজবাড়ির পথঘাট সম্পর্কে খুব ওয়াকিবহাল একজন কাউকে আমাদের দিন।
সেনাপতি চারদিকে তাকিয়ে একজন অশ্বারোহী সৈন্যকে ইঙ্গিতে ডাকল। লোকটি এগিয়ে এল। লোকটার মুখে দাড়ি-গোঁফ, একটু রোগামতো, লম্বা। সেনাপতি লোকটাকে দেখিয়ে বললেন–এর নাম প্লিনি। থিংভেলির সব জায়গা ওর নখদর্পণে। ও আপনাদের সাহায্য করতে পারেবে।
বেশ। এসো প্লিনি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর হ্যারিকে বলল–বিস্কো আর শাঙ্কোকে নিয়ে আমি থিংভেলির যাচ্ছি। যদি পঞ্চাশ ঘণ্টার মধ্যে না ফিরি তবে তোমরা থিংভেলিরে আমাদের উদ্ধারে যেও।
বিস্কো আর শাঙ্কো এগিয়ে এল। প্লিনিও এল। তখনই ফ্রান্সিস রাজার গাড়িতে রানীকে দেখল। মশালের আলোয় দেখল রানীর মুখ ভয়ার্ত, ফ্যাকাশে। গাড়িতে নিথর বসে আছেন।
সেনাপতির ইঙ্গিতে সৈন্যদল ফিরে চলল। ভাইকিংদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। একটা যুদ্ধ হতে হতে হলো না। আর কী করা যাবে। ওরাও ফিরে চলল।
মাথার ওপর টিমটিমে তারার আলোর আকাশ। সামনে কুয়াশা আর তুষারে ঢাকা অন্ধকার পথ। চলল ফ্রান্সিসরা ঘোড়া ছুটিয়ে।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পর থিংভেলির নগরের কাছে ওরা পৌঁছল। একটা ছোট পাথুরে টিলার পেছনে ফ্রান্সিস ঘোড় থামাল। বিস্কোরাও থামল। ফ্রান্সিস বলল–ঘোড়া ছুটিয়ে নগরে ঢোকা যাবে না। সহজেই লোকের নজরে পড়ে যাবো। ঘোড়া এখানে রেখে নগরে ঢুকতে হবে।
টিলার এপাশেই একটা ছোট ওক গাছ। সেই গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঘোড়াগুলো বাঁধা হলো।
ফ্রান্সিস বলল–প্লিনি–ঘরবাড়ি পাথরের আড়ালে আড়ালে আমাদের রাজবাড়ি নিয়ে চলো।
-ঠিক আছে। আমার পেছনে পেছনে আসুন। প্লিনি বলল। ফ্রান্সিসরা প্লিনির পেছনে পেছনে নগরে ঢুকল।
থিংভেলির খুব বড় নগর নয়। তবে খুব ছোটও নয়। সারা নগরের বাড়িঘর অন্ধকার। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। পথের এখানে ওখানে পাথরের খাঁজে জ্বলন্ত মশাল। সেই মশালের আলোতেই পথ দেখে ওরা চলল। পাথরের বাড়িঘরের আড়ালে আড়ালে, কখনও ফাঁকা রাস্তা দৌড়ে পেরিয়ে ওরা রাজবাড়ির সামনে এল। পাথরের বাড়ির আড়াল থেকে দেখল রাজবাড়ির সদর দেউড়িতে অনেক মশাল জ্বলছে। দ্বাররক্ষীরা সংখ্যায় আট দশজন। খোলা তরোয়াল হাতে প্রধান প্রবেশ পথ পাহারা দিচ্ছে। প্লিনি একটু চিন্তিত স্বরে বলল–কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না।
–কেন? কী হলো? বিস্কো বলল?
–এত পাহারাদার তো দেউড়িতে থাকে না। প্লিনি বলল?
–তার মানে তুমি বলতে চাইছো এত পাহারাদার এখানে সাধারণত থাকে–এই তো? ফ্রান্সিস বলল?
–হ্যাঁ। প্লিনি মাথা, ঝাঁকাল।
–যাক এতে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল?
–কী ব্যাপারে? শাঙ্কো বলল।
–অর্থাৎ মারিয়াকে এই রাজবাড়িতেই বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাই এত জোরদার পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর প্লিনির দিকে তাকিয়ে বলল–সদর দেউড়ি ছাড়া অন্য কোন পথে ভেতরে ঢোকা যাবে? প্লিনি একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল–রাজবাড়ির পেছনে একটা গোপন পথ আছে। চলুন সেটা দেখা যাক। আবার পাথরের বাড়ির আড়ালে আড়ালে ওরা চলল। রাজবাড়ি ঘুরে প্লিনি ওদের রাজবাড়ির পেছনে নিয়ে এল। পাথুরে দেয়ালের একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল প্লিনি। ওরাও দাঁড়িয়ে পড়ল। প্লিনি চৌকো পাথর দিয়ে গাঁথা দেয়াল হাত দিয়ে দেখাতে লাগল। একটা জায়গায় চৌকো পাথর ধরল একটা। দুহাতে পাথরটা আস্তে আস্তে টানতে লাগল। পাথরটা নড়ল। এবার প্লিনি পাথরটার দুদিকে অল্প নাড়া দিয়ে দিয়ে খুলে আনতে লাগল। কয়েকবার এপাশ ওপাশ নেড়ে টানতেই পাথরটা খুলে এল। প্লিনি পাথরটা মাটিতে রাখল। পাথুরে দেয়ালে একটা খোঁদল মত হলো। প্লিনি খোঁদলটায় হাত ঢোকাল। ওপাশের দেয়ালে দুটো মশাল আটকানা ছিল। তার আলোয় দেখা গেল খোঁদলটায় একটা গোল কাঠের চাকতি। প্লিনি চাকতিটা আস্তে আস্তে ঘোরাতে লাগল। একটু মৃদু গোঁ গোঁ শব্দ উঠল। দেয়ালে একটা কাঠের দরজা লম্বালম্বি ফাঁক হলো। প্লিনি চাকা ঘোরাতে লাগল। ফাঁকটা বড় হতে লাগল। একসময় একজন মানুষ ঢোকার মত ফাঁক হলো। এখানেই প্লিনি একটা সাংঘাতিক ভূল করল। দরজার ফাঁকটা আরো বড় করল না। তাতে মাত্র একজন মানুষ ঢুকতে বা বেরোতে পারে এরকম বড় রইল। প্রথমে প্লিনি ঢুকল। ফ্রান্সিসরা এখানেও ভুল করল। ভেতরের অবস্থা কেমন অর্থাৎ নিরাপদ কিনা এটা প্লিনির কাছ থেকে না জেনেই ওরা তিনজন ঢুকে পড়ল। ঠিক তখনই প্লিনি চাপাস্বরে বলে উঠল–পালাও। ফ্রান্সিস দেখল গুমণ্ডের প্রায় দশ বারোজন প্রাসাদরক্ষীর দল মশাল হাতে দেয়ালের ধার ঘেঁষে পাহারা দিচ্ছে। ফ্রান্সিসরা ওদের প্রায় মুখোমুখি পড়ে গেল। ফ্রান্সিসরা ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু প্রাসাদরক্ষীরা ততক্ষণে ওদের দেখে ফেলেছে। ওরা খোলা তরোয়াল হাতে চিৎকার করতে ছুটে এল। ফ্রান্সিসরা ঐ ছোট দরজা দিয়ে একসঙ্গে বেরোতে পারল না। ফ্রান্সিস দেখল প্রাসাদরক্ষীদের চিৎকার শুনে আরো অনেক রক্ষী খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে আসছে। বিস্কো কোমর থেকে তরোয়াল খুলল। শাঙ্কো তীরধনুক বাগিয়ে ধরল। প্লিনির মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ফ্রান্সিস দুহাত তুলে চিৎকার করে উঠল–বিস্কো শাঙ্কো-লড়াই নয়। বিস্কো তরোয়াল নামাল। শাঙ্কো ধনুক নামাল। প্রাসাদরক্ষীরা চারপাশ থেকে ওদের ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস কোমর থেকে তরোয়াল খুলে পায়ের কাছে পাথরের চত্বরে তরোয়াল ফেলে দিল। ঝনাৎ করে শব্দ হলো। দেখাদেখি বিস্কো আর প্লিনিও তরোয়াল ফেলে দিল। শব্দ হলো ঝনাৎ-ঝনাৎ। এবার চিবুকে ছুঁচোলো গোঁফ-ওলা একজন রক্ষী এগিয়ে এল। বোধহয় প্রাসাদরক্ষীদের দলনেতা। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল–তোমরা কে?
ফ্রান্সিস বুঝল প্রকৃত পরিচয় দিতে গেলে বিপদ বাড়বে। রাজা গুমণ্ড ওর পুরনো শত্রু। যদি রাজা গুমণ্ড শোনে যে ফ্রান্সিসকে বন্দী করা হয়েছে তাহলে শুধু ফ্রান্সিসের নয় ওদের সকলেরই জীবন বিপন্ন হবে। রাজা গুমণ্ড এই সুযোগ সহজে ছাড়বে না। মারিয়ার জীবনও বিপন্ন হবে। কোনমতেই ওদের আসল পরিচয় দেওয়া চলবে না। ফ্রান্সিস এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল–আমরা রাজা ইনগফের সৈন। দলনেতা ছুঁচলে দাড়ি গোঁফে হাত বুলিয়ে বলল-কিন্তু তোমাদের মধ্যে মাত্র একজনের পরনে রাজা ইনগফের সৈন্যদের পোশাক।
–আমরা ছদ্মবেশে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল?
–কেন?
–রাজকুমারী মারিয়াকে উদ্ধার করতে। ফ্রান্সিস বলল।
ছুঁচলো দাড়ি গোঁফওয়ালা হো হো করে হেসে উঠল। বলল–এবার তোমাদের কে উদ্ধার করে দেখ। তারপর অন্য রক্ষীদের দিকে তাকিয়ে বলল–সব কটাকে কয়েদঘরে ভর। একজন রক্ষী ফ্রান্সিসদের তরোয়ালগুলো তুলে নিল। ফ্রান্সিসদের কোমর থেকে তোয়লের খাপগুলোও নিল। শাঙ্কোর কাঁধ থেকে ধনুক তীরভরা তৃনীর নিয়ে নিল। তারপর রাজবাড়ির পুবকোণার দিকে ধীর পায়ে চলল। অন্য রক্ষীরা ফ্রান্সিসদের ধাক্কা দিয়ে বলল–চল। ঐ রক্ষীর পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসরা চলল। ওদের পেছনে পেছনে চলল সাত আটজন রক্ষী। সবার হাতেই খোলা তরোয়াল। বিস্কো আর শাঙ্কো রাগে ফুঁসতে লাগল। এভাবে লড়াই না করে বন্দীত্ব মেনে নিতে হলো? কিন্তু উপায় নেই। ফ্রান্সিসের আদেশ মানতেই হবে। যেতে যেতে ফ্রান্সিস চারদিকে নজর রেখে চলল। দেখল–দেয়ালের এখানে ওখানে মশাল জ্বলছে। অনেক প্রাসাদরী এখানে ওখানে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় এখন পালাবার চেষ্টা করলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। ফ্রান্সিস চলল। চারদিকে ঠিক নজর রাখল। রাজবাড়ির পুবকোণায় একটা পাথরের ঘরের সামনে ওরা এল। ঘরটার কাঠের দরজার দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে। দরজার সামনে দুজন রক্ষী খোলা তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সবার সামনে যে রক্ষীটি ফ্রান্সিসদের তরোয়াল আর শাঙ্কোর তীর ধনুক নিয়ে যাচ্ছিল সে ঐ ঘরটার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজার ধারে দাঁড়ানো একজন রক্ষী কোমর বন্ধনী থেকে লম্বা একটা চাবি বের করে দরজার বড় তালাটা খুলে দিল। রক্ষীটি ফ্রান্সিসদের তরোয়াল আর শাঙ্কোর তীর ধনুক নিয়ে ঘরটায় ঢুকল। ফ্রান্সিস বুঝল–এই ঘরটা অস্ত্রাগার। এখানেই ওদের অস্ত্রগুলো রাখতে হবে। ঘরটার মাথায় একটা শীলমাছের ছবিওয়ালা পতাকা উড়ছে। রাজা গুমণ্ডের পতাকা। ঐ অস্ত্রাগার ছাড়িয়ে পাথুরে চত্বর। তারপরেই আর একটা পাথরের লম্বাটে ঘর। সেই ঘরের বাইরে অনেকগুলো মশাল জ্বলছে। পাঁচ ছজন রক্ষী খোলা তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ঘরের সামনে ফ্রান্সিসদের দাঁড় করানো হলো। ফ্রান্সিস বুঝল–এটাই কয়েদঘর। ছুঁচোলো দাড়ি গোঁফওয়ালা রক্ষীদলের নেতা গলা চড়িয়ে বলল–দরজা খোল। একজন রক্ষী ছুটে বন্ধ দরজার কাছে গেল। কোমর থেকে একটা লম্বা চাবি বের করল। বেশ বড় একটা তালা ঝুলছে দরজায়। রক্ষীটি সেই তালা খুলল। দরজাটায় ধাক্কা দিল। ঘর ঘর শব্দ করে লোহার দরজাটা খুলে গেল। ফ্রান্সিসরা খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস দেখল দরজাটায় খাড়া খাড়া লোহার গারদ বসানো। দরজার চৌকোণো চারদিক মোটা লোহার। হাত খোলা থাকলেও এই লোহার দরজা ভাঙা অসম্ভব। রক্ষীরা ওদের প্রায় ঠেলে গারদঘরে ঢুকিয়ে দিল। ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস দেখল ঘরটা বেশ লম্বা। ঘরটায় চারটে মশাল জ্বলছে। মশালের আলোয় দেখা গেল ছোট ছোট কাঠের খুঁটিতে হাত বাঁধা অবস্থায় রয়েছে কয়েকজন বন্দী। দরজা খোলার শব্দে তাদের মধ্যে দুএকজন মুখ তুলে ফ্রান্সিসদের দেখল। বন্দীদের মধ্যে কয়েকজনের গায়ে রাজা গুমণ্ডের সৈন্যাবহিনীর পোশাক। হয়তো কোন অপরাধে ওদের বন্দী করা হয়েছে।
চার জন রক্ষী এগিয়ে এল ফ্রান্সিসদের দিকে। অন্য বন্দীদের বাঁধা হাতের মধ্যে দিয়ে একটা লম্বা মোটা দড়ি টানা দেওয়া। সেই দড়ির একটা মুখ বাঁদিকের পাথুরে দেয়ালে গাঁথা একটা লোহার আংটার সঙ্গে বাঁধা। অন্য দিকটা ডানদিকের দেয়ালে গাঁথা আর একটা লোহার আংটার সঙ্গে বাঁধা। একজন রক্ষী সেইদিকের আংটা থেকে দড়ির মুখটা খুলে হাতে নিল। অন্য রক্ষীরা ফ্রান্সিসদের জোর করে এক একেকটা খুঁটির সামনে বসিয়ে দিল। ওদের হাত দুটো ছোট দড়ি নিয়ে বেঁধে দিল। এবার লম্বা দড়ি হাতে রক্ষীটি এসে ফ্রান্সিসদের বাঁধা হাতের মধ্যে দিয়ে দড়িটা টেনে নিল। তারপর ডানদিকের দেয়ালের লোহার আংটার সঙ্গে বেঁধে দিল। লম্বা দড়িটার মধ্যে সব বন্দীদের বাঁধা হাতও বাঁধা পড়ল। অন্য বন্দীদের মত ফ্রান্সিসদেরও হাত কাঠের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হলো। সব দেখে ফ্রান্সিসের মুখ গম্ভীর হলো। ওর মনে তখন একটাই প্রশ্ন–এই কয়েদঘর থেকে কি পালানো যাবে না? ফ্রান্সিসদের এভাবে বেঁধে রেখে রক্ষীরা চলে গেল। ওরা লোহার দরজা বন্ধ করে দিল। শব্দ হলো–চটাং-ঢং। তালা লাগিয়ে দিল। একটু পরে বিস্কো ডাকল–ফ্রান্সিস?
–উঁ? ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল?
–এখান থেকে পালানো অসম্ভব। বিস্কো বলল?
–হুঁ। দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল?
–এবার বন্ধুদের খবর পাঠাতে হয়। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস হাসল। বলল–খবর পাঠাবে কী করে? খবর পাঠাতে হলেও তো আমাদের মুক্তি পেতে হবে।
–তাহলে উপায়? বিস্কো বেশ ভীতস্বরে বলল।
–দাঁড়াও-সব দেখিটেখি। তারপর পালানোর উপায় বার করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। খুব ক্লান্তি বোধ করল ফ্রান্সিস। খুঁটিতে হাতবাঁধা অবস্থায় ও মেঝেয় শুয়ে পড়ল। খুব পুরু করে না হলেও মেঝেয় খড়বিছানো ছিল। ফ্রান্সিস খড়ের ওপর শুয়ে মাথার ওপর মোটা ঘাসে তৈরী চালার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর চোখ বুজল। ভাবতে লাগল–এভাবে মাত্র চারজনের আসা উচিত হয়নি। সব বন্ধুদের নিয়ে আসা উচিত ছিল। তার মানেই লড়াই। রক্তপাত। মৃত্যু। কিন্তু রাজা ইনগলফ রক্তপাত চান না। মৃত্যু চান না। লড়াই রক্তপাত না চাইলে বুদ্ধির লড়াই চালাতে হয়। সেজন্যেই ওদের একটু সাবধান হয়ে সজাগ থাকা উচিত ছিল। প্লিনির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে গিয়ে এই বিপদ হলো। ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ডাকল–প্লিনি।
–বলুন। প্লিনি বলল।
–তুমি কি জানতে না ঐ গোপন দরজার কাছেও প্রাসাদরক্ষীরা থাকতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–বিশ্বাস করুন–এর আগেও দুদবার যুদ্ধের সময় ঐ গোপন পথ দিয়ে ঢুকে আমাদের সৈন্যদের উদ্ধার করেছি। আজকে এত প্রাসাদরক্ষী পাহারা দিচ্ছে আমি ভাবতেও পারিনি। আমিই আপনাদের এই বন্দী দশার জন্যে দায়ী। আমাকে মাফ করুন। প্লিনি বলল। ফ্রান্সিস চোখ খুলে হাসল। বলল–তুমি এই নিয়ে দুঃখ করো না। আমাদের খুব সতর্ক থাকা উচিত ছিল। আমাদের সকলেরই, অভুল হয়েছে। ফ্রান্সিস বলল। আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।
এখানে তো দিন বলে কিছুই নেই। শুধু রাত। কাজেই দিন-রাতের কোন হিসেব নেই। সময় ধরে হিসেব। প্রায় ঘণ্টা দুতিন পরে হঠাৎ লোহার দরজায় শব্দ উঠল ঢং-ঢং। শব্দ শুনে ফ্রান্সিস উঠে বসল। পাঁচ-ছজন রক্ষী ঢুকল। ওদের হাতে একটা বড় কাঠের পাত্র। একজনের হাতে বড় কাঠের থালার মত। তাতে মোটা মোটা পোড়া রুটি। রক্ষীরা বন্দীদের হাতের বাঁধন খুলে দিল। সবার সামনে রাখল বড় বড় পাতা। কোন গাছের পাতা কে জানে। পাতায় রুটি দিল। কাঠের হাতায় করে হেরিং মাছ সেদ্ধ আর আলু সেদ্ধ ভঁটা লতাপাতার তরকারী। বন্দীরা খেতে লাগল। ফ্রান্সিস খেতে খেতে বলল–পেট পুরে খাও। খেতে ভালো না লাগলেও খাও। খাবার খুব বিস্বাদ লাগল না। বিস্কো ও প্লিনি শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কথামত চেটেপুটে খেল। ফ্রান্সিস আরো রুটি তরকারী চাইল। সব খেল। কয়েদঘরের একপাশে রাখা মাটির বড় জালা। তাতে জল রাখা আছে। সবাইকে নারকোলের মালায় জল ভরে এনে খাওয়ানো হলো। বন্দীদের খাওয়া শেষ হতে রক্ষীরা চলে গেল। ঢং-ঢং শব্দে লোহার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। যাবার আগে ওরা অবশ্য বন্দীদের হাত বেঁধে দিতে ভুলল না।
ফ্রান্সিস খুঁটিতে হাতবাঁধা অবস্থায় আবার খড়ের গাদায় শুয়ে পড়ল। বলল–এখানে তো রাত-দিন বোঝার উপায় নেই। তবে মনে হয় আমাদের দেশে। এখন রাত।
–কী করে বুঝলে? বিস্কো বলল।
–কারণ আমার ঘুম পাচ্ছে। ফ্রান্সিস হেসে বলল–বিস্কো–তোমরাও ঘুমিয়ে নাও। যতটা পারো বিশ্রাম নাও। শরীরটা। ঠিক রাখো। বিস্কোরা জানে ফ্রান্সিস অনেক ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কথা বলে। বিস্কোও ফ্রান্সিসের মত খড়ের গাদায় শুয়ে পড়ল। দেখাদেখি শাঙ্কোও। শুধু প্লিনি বসে রইল। প্লিনি তো এই দেশের মানুষ। হয়তো ওর এখনও ঘুমের সময় হয়নি। শাঙ্কো একসময় ডাকল–ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকাল। বিস্কো ফি [ করে বলল–রক্ষীরা আমাকে ধরবার আগেই আমি আমার বড় ছোরাটা জামার নিচে লুকিয়ে ফেলেছিলাম। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল-সাবাস। ওটা অনেক কাজে লাগবে।
দিনের হিসেবে ফ্রান্সিসদের বন্দীদশার দুদিন কেটে গেল। ফ্রান্সিসরা কেউই বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে পালাবে। ফ্রান্সিস শুয়ে বসে সারাক্ষণ পালানোর ফন্দী ভাবে। কিন্তু কোনটাই কাজের মনে হয় না।
ওদিকে রেভঞ্জাভিকে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা ভীষণ চিন্তায় পড়ল। দুদিন কেটে গেল অথচ ফ্রান্সিসরা কেউ ফিরল না। নিশ্চয়ই কোন বিপদে পড়েছে ওরা। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা ভেবে পাচ্ছে না কী করবে এখন। ওরা দল বেঁধে হ্যারির কাছে এল। হ্যারির মনও দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। ওরা হারিকে প্রশ্ন করল এখন কী করবে?
হরি বলল–দেখ–আমার মনে হয় ফ্রান্সিসরা ফিরে আসবে। যদি ওরা ধরা পড়েও ফ্রান্সিস ঠিক পালাতে পারবে। কিন্তু আমি ভাবছি-ধরা পড়লেই ফ্রান্সিসের জীবন বিপন্ন হবে। হয়তো ও পালাবার সময়টুকুও পাবে না।
–কেন? ও কথা বলছো কেন? বন্ধুরা বলে উঠল।
–তোমরা জানো না থিংভেলির রাজার পরিচয়। ওখানকার রাজা গুমণ্ড আমাদের রাজার সেনাপতি ছিল। তোমাদের অনেকেরই মনে আছে সোনার ঘন্টা আনার সময় এই সেনাপতি গুমণ্ড আমাদের কী বিপদের মুখে ফেলেছিল? কাজেই একবার যদি গুমণ্ড ফ্রান্সিসকে চিনতে পারে তাহলে ফ্রান্সিসকে ও সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করবে। আমার ভীষণ দুশ্চিন্তার কারণ এটাই। তবে ফ্রান্সিস যথেষ্ট বুদ্ধিমান। ধরা পড়লেও ও আত্মপরিচয় দেবে না। বন্ধুদের কেউ কেউ বলে উঠল–তাহলে আমরা আজই থিংভেলির আক্রমণ করবো। ফ্রান্সিসদের আর মারিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসবো। হ্যারি হেসে বলল–ওটা করা আত্মহত্যার সামিল। আমরা সংখ্যায় পঞ্চাশজনের মত। রাজা গুমণ্ডের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে শুধু আমরা লড়াই করে পিরবো না। হেরে যাবো। আমাদের অনেককে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তারই চেয়ে–আরো একটা দিন অপেক্ষা করি। যদি এর মধ্যে ফ্রান্সিসরা ফিরে না আসে তবে রাজা ইনগলফের কাছে আমরা যাবো। একজন বন্ধু বলল–হ্যারি আর একটা কথা ভাববার আছে। রাজা গুমণ্ড রাজা ইনগলফ ও রানীকে মুক্তি দিয়েছিল একটি শর্তে যে রাজা ইনগলফ রেভজাভিক ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্বে স্কালহল্টে চলে যাবেন। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে। তিনি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্কালহল্টে চলে গেছেন এই সংবাদ পেলে তবেই রাজা গুমণ্ড রাজকুমারী মারিয়াকে মুক্তি দেবে। রাজা ইনগলফ এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন।
–হ্যাঁ–হ্যারি বলল–আমিও সংবাদ পেয়েছি। রাজ ইনগলফ রেভজাভিক ছেড়ে স্কালহল্টে চলে যাবার জন্যে সৈন্যদের প্রস্তুত হতে বলেছেন। একজন ভাইকিং-বন্ধু বলল–তাহলে তো রাজকুমারী মারিয়ার মুক্তির ব্যাপরটা সহজ হয়ে গেল। হ্যারি হাসল। বলল–ব্যাপারটা অত সহজে ভেবো না। রাজা ইনগলফ তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্কালহল্ট চলে গেলেই গুমণ্ড এসে এই রেভকজাভিকে রাজা হয়ে বসবে। তার রাজত্ব বাড়বে। কিন্তু রাজকুমারী মারিয়াকে কখনো মুক্তি দেবে না। গুমণ্ডকে আমি ভালভাবেই চিনি। ওর মত শয়তান ধুরন্দর এত সহজে এই সুযোগ ছেড়ে দেবে না। গুমণ্ড রাজকুমারী মারিয়ার মুক্তিপণ হিসেবে এরপর আমাদের রাজার কাছে আরো অনেক অর্থ সুবিধা এসব দাবী করে বসবে। তাই বলছিলাম আরো একটা দিন দেখি। যদি ফ্রান্সিসরা না ফেরে আর মারিয়াকেও রাজা গুমণ্ড মুক্তি না দেয় তবে রাজা ইনগলফের কাছে যাবো। বলবো–আপনার স্কালহল্টে যাওয়া চলবে না। আপনাকে রাজা গুমণ্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হবে। আপনার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে থেকে আমরাও যুদ্ধ করবো।
–কিন্তু রাজা ইনগলফ কি তাতে রাজি হবেন? একজন বন্ধু বলল।
–রাজি করাতেই হবে–হ্যারি বলল–রাজ গুমরে চালের কাছে আমরা বিনা যুদ্ধে হার স্বীকার করবো না। এখন আর কয়েকদিন আমরা অপেক্ষা করি। দেখা যাক কী হয়।
হ্যারির বুদ্ধিমত্তার ওপর ওর বন্ধুদের অগাধ বিশ্বাস। ওরা আর কোন কথা না বলে নিজেদের কেবিনে চলে গেল।
ওদিকে ফ্রান্সিসদের একঘেয়ে দিন কাটছে। থিংভেলির কয়েদঘরে। সেদিনও ফ্রান্সিস খুঁটিতে হাত বাঁধা অবস্থায় খড়পাতা মেঝেয় শুয়ে আছে। তাকিয়ে আছে ঘরটার ওপরের ঘাসের আচ্ছাদনের দিকে। এখানে এক ধরনের মোটা ঘাস প্রচুর জন্মায়। সেই ঘাস শুকিয়ে নিয়ে বাড়িঘরের মাথায় লোক আচ্ছাদন করে। ফ্রান্সিস এরকম আচ্ছাদনের বাড়ি নিজেদের দেশে দেখেনি। ওর মনে একটা চিন্তা খেলে গেল–আচ্ছা–এই ঘাসের চাল কি খুব শক্ত হয়? ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। ডাকল–নিলনি–
-বলুন। প্লিনি ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।
ফ্রান্সিস বলল–আচ্ছা তুমি তো এই দেশের লোক। বলো তো ঐ মোটা ঘাসের চাল কি খুব শক্ত হয়? প্লিনি চালটা একবার দেখে নিয়ে বলল–গাছের সরু ডাল কাঠ এসব দিয়ে খাঁচা মত তৈরী করা হয়। তাতে চেপে শুকনো ঘাস বসিয়ে এই চাল করা হয়। তা একটু শক্ত হয় বৈকি। তুষার বৃষ্টি জমা–বরফের চাপ তো পড়ে। কিন্তু ভেঙে পড়ে না।
–হুঁ। ফ্রান্সিস আরো মনোযোগ দিয়ে ঘাসের চালটা দেখতে লাগল। অনেক উঁচু। ঘরটার মাথার কাছে এপাশের দেয়ালে আর ওপারের দেয়ালে লোহার গারদ বসানো দুটো ছোট জানালামত আছে। কাঁচের জানলা। অসম্ভব। অত উঁচুতে তো ওঠাই যাবে না। তখনই দেখল–ঘাসঢাকা চালের নিচে টানা টানা কড়ি কাঠের মত। গাছের ডাল ফালা করে ওগুলো লম্বালম্বি বসানো। কড়িকাঠগুলো থেকে ঘাসের চালের মধ্যে হাত তিনেক ফাঁক। যদি কোনভাবে ঐ কড়ি কাঠ পর্যন্ত ওঠা যায়–ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিস্কো ফ্রান্সিসকে লাফিয়ে উঠতে দেখে বলে উঠল–কী হলো ফ্রান্সিস?
–মুক্তি। ফ্রান্সিস হেসে মৃদুস্বরে বলল। কথাটা সকলের কানে গেল না। কিন্তু বিস্কো, শাঙ্কো, প্লিনির কানে গেল। ওরা অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলতে চায় ফ্রান্সিস? বিস্কো শাঙ্কো, ফ্রান্সিসকে ভালো করেই চেনে। ফ্রান্সিস কখনো বাজে কথা বলে না। নিশ্চয়ই মুক্তির কোন পথ ও খুঁজে পেয়েছে। প্লিনি ভাবল–লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই কয়েদঘর থেকে এই পাহারাদারদের হাত থেকে মুক্তি? অসম্ভব। ফ্রান্সিস ফিস ফিস করে বলল–খাওয়াদাওয়ার পর কাজে লাগবে। সব তৈরী থেকো। এবার ফ্রান্সিস বসে পড়ল। কিন্তু শুয়ে পড়ল না। চোখ খুঁজে ভাবতে লাগল।
ঘণ্টা কয়েক পরে লোহার দরজায় ঢং-ঢং শব্দ উঠল। রক্ষীরা খাবার নিয়ে ঢুকল। ফ্রান্সিসদের খাওয়াদাওয়া শেষ হতে রক্ষীরা ওদের হাত বেঁধে দিয়ে চলে গেল। ঢঢং-ঢং শব্দ তুলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। বাইরে পাহারাদারদের বিশেষ সাড়া শব্দ নেই। ফ্রান্সিস বসা অবস্থাতেই বিস্কোর যতটা কাছে আসা সম্ভব এল। তারপর বাঁধা হাত দুটো বিস্কোর জামার তলায় ঢুকিয়ে দিল। আস্তে আস্তে বিস্কোর বড় ছোরাটা বের করে নিয়ে এল। ছোরাটা বিস্কোর হাতে দিল। বিস্কো বাঁধা হাত দুটো দিয়ে ছোরাটার বাঁট ধরল। তারপর ফ্রান্সিসের হাতবাঁধা দড়িটা কাটতে লাগল। উত্তেজনায় বিস্কোর হাত কাঁপছে। ও ঠিকমত ছোরাটা ঘষতে পারছিল না। ছোরার ফলাটা এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে ফ্রান্সিসের হাতে কব্জিতে বসে যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটা জায়গা কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল। ফ্রান্সিস ওসব গায়ে মাখল না। শুধু দাঁতচাপা স্বরে বলল–জলদি। একটুক্ষণের মধ্যেই দড়ি কেটে গেল। ফ্রান্সিস খোলা হাত নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছোরাটা নিয়ে বিস্কোর হাতের বাঁধার দড়িটা কেটে ফেলল। বিস্কোকে ছোরাটা দিল। বলল–সবাইর দড়ি কাটো। কিন্তু লম্বা দড়িটা কেটো না। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল দরজার দিকে। লোহার দরজায় কান পাতল। বাইরেরটা নিঝুম। শুধু দুজন পাহারাদারের জুতোর মৃদু খট খট শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস দরজা থেকে সরে এসে ঘরটার মাঝামাঝি দাঁড়াল। বিস্কো ততক্ষণে প্রায় সব বন্দীর হাতের দড়ি কেটে দিয়েছে। অন্য বন্দীরা অবাকচোখে ফ্রান্সিসের কাণ্ড দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস এবার লম্বা দড়িটা যে লোহার কড়ার সঙ্গে বাঁধা সেখানে গেল। কড়া থেকে দড়ির বাঁধনটা খুলতে লাগল। ফ্রান্সিসরা জাতিতে ভাইকিং। জাহাজের ব্যাপারে ওরা সুদক্ষ। জাহাজে পাল খাটানো থেকে শুরু করে নানা কাজে দড়ি দড়া বাঁধতে হয় খুলতে হয়। ওরা এসব ব্যাপারে নিপুণ। খুব সহজেই ফ্রান্সিস দুটো লোহার আংটা বাঁধা দড়ি খুলে ফেলল। এবার লম্বা দড়ির একটা মাথা নিয়ে বিস্কোর কাছে এল। বিস্কোর দড়ি কাটার কাজ শেষ। সব বন্দীরা হাত খোলা। ফ্রান্সিসরা ছাড়া অন্য বন্দীরা তখনও অবাক। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে আছে। এখনও সম্পূর্ণ মুক্তি পায়নি। তবু হাত দুটো তো খোলা। এটাই বা কম কি। বিস্কোর হাত থেকে ফ্রান্সিস ছোরাটা নিল। লম্বা দড়ির এক কোণায় ছোরাটা বাঁধল। তারপর ওপরে কড়িকাঠের দিকে তাকাল। ছোরাটা দড়ির সঙ্গে দোলাতে দোলাতে কড়িকাঠের দিকে ছুঁড়ে দিল। বার তিনেক ফসকে গেল। তারপর দড়ি বাঁধা ছোরা কড়িকাঠের ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে নিচে ঝুলে পড়ল। ফ্রান্সিস একপাশের দড়ি ছাড়তে লাগল। আস্তে আস্তে ছোরা বাঁধা দড়ির মুখটা নিচে নেমে আসতেই ফ্রান্সিস ধরল। ছোরাটা খুলে কোমরে গুজল। বিস্কোদের দিকে তাকিয়ে বলল–দড়ির একটা দিক তোমরা টেনে ধর। অন্য দিকটা ধরে আমি উঠবো। বিস্কো ইঙ্গিতের সব বন্দীকে ডাকল। সব বন্দীরা এগিয়ে এল। ওরা সবাই দড়ির একটা দিক টেনে ধরল। দড়ির অন্য দিকটা ধরে ফ্রান্সিস কড়িকাঠের দিকে লক্ষ্য করে দড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগল। জাহাজে দড়ি ধরে ওঠা নামায় ফ্রান্সিসরা সুদক্ষ। একটুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস কড়িকাঠটা ধরে ফেলল। শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কড়িকাঠের ওপর বসল। মাথা নিচু করে বসতে হলো। কারণ কড়িকাঠ আর ঘাসের চালের ফাঁক তিন ফুট মত। এবার ফ্রান্সিস কোমর থেকে ছোরাটা বের করল। মাথার ওপর মোটা ঘাসের ছাউনি। ছাউনির আঁটি বাঁধা ঘাসের আস্তরণ শক্ত করে একটা কাঠের খাঁচার সঙ্গে বাঁধা। ফ্রান্সিস প্রথমে খাঁচাটার বাঁধা দড়িগুলো কাটতে লাগল। বেশ কয়েকটা খাঁচার দড়ি কাটতেই ঘাসের আঁটিগুলো আলগা হয়ে গেল। খাঁচার কাঠগুলোও তখন আঙ্গগা হয়ে গেছে। কাঠগুলো ফ্রান্সিস দুহাতে সরাতে লাগল। একটুক্ষণের মধ্যে খাঁচার কাঠের টুকরোগুলো একেবারে আলগা হয়ে গেল, ফ্রান্সিস এবার ওপরের ঘাসের ছাউনি দুহাত দিয়ে টেনে টেনে সরাতে লাগল। একটুক্ষণের মধ্যে খাঁচার কাঠের টুকরোগুলো একেবারে আলগা হয়ে গেল, ফ্রান্সিস এবার ওপরের ঘাসের ছাউনি দুহাত দিয়ে টেনে টেনে সরাতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাসের আঁটি সরে গিয়ে মাথার ওপরে কুয়াশা ঢাকা আকাশ দেখা গেল। একজন মানুষ বেরুতে পারে এরকম ফাঁক হয়ে গেল। নিচে দাঁড়ানো বিস্কো শাঙ্কো আর অন্যান্য বন্দীরা অবাক চোখে ফ্রান্সিসের কাণ্ড দেখতে লাগল। ছাউনি ফাঁক হতে, আকাশ দেখা যেতে বন্দীরা পালাবার জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠল। ফ্রান্সিস ছোরা কোমরে গুঁজে তাড়াতাড়ি দড়ি ধরে নেমে এল। ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল চেপে চাপাস্বরে বলল–চুপ। তারপর ইশারায় সবাইকে কাছে ডাকল। ফিস্ ফিস্ করে বলল–ওপরে ঘাসের ছাউনিতে ফোকর করেছি। কিন্তু ছাউনি হাল্কা। সবাই একসঙ্গে দাঁড়াতে পারবো না। কাজেই একজন একজন করে দড়ি বেয়ে উঠে ছাউনি যে পাথরের দেয়ালের ওপর গাঁথা সেই দেয়ালের সঙ্কীর্ণ মাথায় দাঁড়াতে হবে। সবশেষে আমি উঠবো। তারপর কড়িকাঠে বাঁধা মোটা-দড়িটা নিয়ে ছাউনির দেয়াল থেকে পেছনে, নিচে মাটিতে নামিয়ে দেব। আর দড়ি ধরে ধরে একজন করে মাটিতে নেমে যাবে। এতে সময় বেশি লাগবে। কিন্তু উপায় নেই। দুতিনজন একসঙ্গে নামতে গেলে দড়ির টানে কড়িকাঠ ভেঙে যাবে। এবার কাজে নামো, যা বললাম মনে রেখো। ফ্রান্সিসের নির্দেশমত সবাই একজন একজন করে দড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। ছাউনির ফোকর দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দেয়ালের অল্প জায়গায় দাঁড়াতে লাগল। সবশেষে ফ্রান্সিস উঠল। ও দড়িটা তুলে নিয়ে পেছনের দেয়ালের গা লাগিয়ে দড়িটা মাটিতে নামিয়ে দিল। এবার একজন একজন করে পাথর বাঁধানো চত্বরে নামতে লাগল। ফ্রান্সিস ফিস ফিস করে ওদের কানে কানে বলে দিল–দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াবে। সবাই নেমে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। সবশেষে ফ্রান্সিস নামতে যাবে–দেখল পূবদিকের একটা পাথরের বাড়ি পাশ ছাড়িয়ে ছয় সাতজন প্রাসাদরক্ষী পাথরের চত্বর দিয়ে আসছে। দুজনের হাতে মশাল। ফ্রান্সিস নামল না। চুপ করে দড়ি ধরে বসে রইল। রক্ষীদের মশালের আলো এতদূর এলো না। বিস্কোরা অন্ধকারে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে রইল। রক্ষীরা পাথরের চত্বরে থপ থপ শব্দ তুলে চলে গেল। চলে গেল রাজবাড়ির দিকে।
এবার ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে দড়ি ধরে নেমে এল। নেমেই দ্রুতহাতে কোমর থেকে ছোরাটা বের করল। তারপর হাত পাঁচেক দড়ি কেটে নিল। দড়িটা কোমরে জড়িয়ে রাখল। , যদি পরে কোন কাজে লাগে। ফ্রান্সিসরা ছাড়া অন্য বন্দীরা যারা ছিল তারা এবার ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফিস ফিস করে একজন বলল–আপনি আমাদের বাঁচালেন। রাজা গুমণ্ডর কয়েদঘরে যে একবার কয়েদ হয় সে আর কোনদিন জীবন্ত বেরিয়ে আসতে পারে না। কত নিরীহ প্রজাদের যে গুমণ্ড হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। আমরা রাজা গুমণ্ডের সৈন্যবাহিনীতে ছিলাম। রাজার আদেশে একদল নিরীহ নারী-শিশুকে হত্যা করার আদেশের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের কয়েদঘরে বন্দী করা হয়েছিল। আপনার জন্যে মুক্তি পেলাম। এবার আমরা পালাই। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। বলল–না ভাই-তোমাদের আমাদের সঙ্গেই পালাতে হবে। তোমরা নিরস্ত্র। যদি ধরা পড় তোমরা লড়াইও করতে পারবে না। তোমরা গুমরে সৈন্যদের হাতে বিনাযুদ্ধে মারা যাবে। ততক্ষণে রাজা গুমণ্ডের পাহারাদার সৈন্যরাও জেনে যাবে যে আমরা পালিয়েছি। নিরস্ত্র আমরাও ধরা পড়বো। আমরাও বাঁচবো না।
-তাহলে এখন কী করবেন? বন্দী সৈন্যদের মধ্যে থেকে একজন বলল। ফ্রান্সিস সবাইকে কাছে আসতে ইঙ্গিত করল। সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস নিচুস্বরে বলল–আর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করা চলবে না, আমরা এখন অস্তঘরে যাবো। অস্ত্রঘর থেকে আমাদের অস্ত্রগুলো উদ্ধার করবো। তারপর প্লিনি যে গোপন দরজা দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করেছিল সেই গোপন দরজা খুলে পালাবো। এবার চলো অস্ত্রাগারে। সবাই পাথরের বাড়ির দেয়ালের আড়ালে আড়ালে চলল। সৈন্যরা যখন ফ্রান্সিসদের ধরে নিয়ে আসছিল তখন ফ্রান্সিস অস্ত্রাগারটি ভালো করে দেখে রেখেছিল। অস্ত্রাগারের মাথায় শীলমাছ আঁকা পতাকাটা উড়ছিল। ফ্রান্সিস দেখেই চিনল। ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে সবাইকে দাঁড়াতে বলল। তারপর অস্ত্রাগারের পাথরের দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে দেখল–অস্ত্রাগারের দরজায় দুজন সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে দুজন দরজার সামনে ঘুরছে, দরজার দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–বিস্কো–আমি বাঁদিকেরটা। তুমি ডানদিকেরটা। গলা চেপে ধরেই চোখ-মুখ ঢেকে বেঁধে ফেলবে। অন্যদের দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে বলে ফ্রান্সিস আর বিস্কো কুয়াশা ঢাকা চত্বর মাথা নিচু করে পেরিয়ে পাহারাদার দুজনের কাছাকাছি পৌঁছে অস্ত্রাগারের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল। একুট দম নিল। তারপর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ছুটে গিয়ে দুজন পাহারাদারের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। পাহারাদার দুজনের হাতের তরোয়াল ছিটকে গেল। কুয়াশায় আস্তরণের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস আর বিস্কো এত দ্রুত বেরিয়ে এল যে পাহারাদার দুজন হকচকিয়ে গেল। ততক্ষণে ফ্রান্সিস একটা পাহারাদারের গলা হাত দিয়ে চেপে ধরল। পাহারাদারটি টু শব্দ করতে পারছে না। পাহারাদারদের কোমরের ফেট্টিটা ফ্রান্সিস অন্য হাতে খুলে ফেলল। তারপর ফেট্টিটায় পাহারাদারের চোখ-মুখ ঢেকে মুখ বেঁধে দিলে। নিজের কোমর থেকে দড়িটা বের করে পাহারাদারটির হাত পা বেঁধে ফেলে রাখল। কোমর থেকে ছুরি বের করে বাকি দড়িটা কেটে বিস্কোর দিকে এগিয়ে ধরল। বিস্কোও একই কায়দায় অন্য পাহারাদারটির মুখ হাত পা বেঁধে ফেলে রাখল। ফ্রান্সিস আগেই দেখেছিল মোটা পাহারাদারটির কোমরে চাবির গোছা ঝুলছে। ও চাবির গোছাটা নিল। চাবিটাও আগে দেখেছিল। সেই লম্বা চাবিটা খুলে দরজার বড় তালাটায় লাগাল। এক মোচড়েই তালাটা খুলে গেল। ওদিকে শাঙ্কো, প্লিনি আর অন্য সদ্য মুক্ত সৈন্যরাও ছুটে এল। সবাই অস্ত্রাগারে ঢুকল। দেখল দেয়ালে জ্বলন্ত মশাল আটকানো। সেই আলোয় দেখা গেল সারি সারি তরোয়াল বর্শা ঢাল এসব সাজানো। ফ্রান্সিস নিজেদের তরোয়ালগুলোর খোঁজে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। দেখল ঘরের ডানকোণায় ওদের তরোয়াল রাখা হয়েছে। সঙ্গে শাঙ্কোর তীর ধনুক। শাঙ্কো ছুটে গিয়ে তীরের খাপ ধনুক তুলে নিল। ফ্রান্সিস, বিস্কো, প্লিনি নিজের নিজের তরোয়াল তুলে নিল। সদ্যমুক্ত সৈন্যরাও তরোয়াল ঢাল হাতের কাছে যেমন পেল নিয়ে নিল। ফ্রান্সিসের কানে এল বন্দী পাহারাদার দুজনের গোঙানি। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল–জলদি–বাইরে চলো। সবাই দ্রুত ছুটে অস্ত্রাগারের বাইরে এল। ফ্রান্সিস দরজায় তালা লাগাল। তারপর চাবির তোেড়াটা অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিল। চাপাস্বরে ডাকল–প্লিনি। প্লিনি এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–সেই গোপন দরজার কাছে নিয়ে চলো। ঐ দরজা দিয়েই আমরা পালাবো। প্লিনি মাথা ঝাঁকিয়ে আগে আগে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ছুটল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। একটা লম্বাটে পাথরের বাড়ির পেছনে এসে প্লিনি দাঁড়াল। সবাই একটু হাঁপাচ্ছে। তখন। প্লিনি সামনের পাথুরে চত্বরের পরে পাথরের দেয়ালে যেখানে দুটো মশাল জ্বলছে সেইদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল–ঐ দুটো মশালের মাঝখানে সেই গোপন। দরজাটা। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস সেই মশাল দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল। রক্ষী সৈন্যরা যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে। এক মুহূর্তও দেরী করা চলবে না। ফ্রান্সিস দ্রুত চিন্তা করে নিল। ঐ মশাল দুটো আগে নেভাতে হবে। জায়গাটা অন্ধকার করে ফেলতে হবে। তারপর দরজা খুলে পালাতে হবে। ফ্রান্সিস সকলের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল–আমি আর প্লিনি আগে যাচ্ছি। মশাল দুটো নিভিয়ে দেব। মশাল নিভলেই তোমরা কোন শব্দ না করে দেয়ালটার কাছে চলে যাবে। ফ্রান্সিস প্লিনিকে ইঙ্গিত করল।
তারপর মাথা অনেকটা নিচু করে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে পাথরের চত্বর পেরিয়ে চলল। ফ্রান্সিসের দেখাদেখি প্লিনিও মাথা নিচু করে চলল। দেয়ালের কাছে পৌঁছেই ফ্রান্সিস তরোয়াল খুলল। দুটো লোহার আংটায় মশাল দুটো রাখা। ফ্রান্সিস মাথা নিচু অবস্থাতেই তরোয়ালের ডগার এক খোঁচায় একটা জ্বলন্ত মশাল পাথরের চত্বরে ফেলে দিল। চত্বরে জমা বরফ জলে পড়ে জ্বলন্ত মশালটা নিভে গেল। ফ্রান্সিস এবার সতর্ক দৃষ্টিতে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চারিদিকে তাকাল। না। রক্ষীদলের মশালের আলো কোনদিকে দেখা যাচ্ছে না। এবার তরোয়ালের খোঁচায় আর একটা জ্বলন্ত মশাল ফেলে দিল। ওটাও নিভে গেল। জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গেল। ওদিকে মশাল নিভতেই বিস্কো শাঙ্কো ওরা দল বেঁধে দ্রুতগতিতে পাথুরে চত্বর পেরিয়ে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। প্লিনি গোপন দরজা খোলবার জন্য পাথরের ছোট চাইটা সরাচ্ছে তখনই দূরে কুয়াশা ঢাকা কয়েকটা মশালের আবছা আলো দেখা গেল। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল–প্লিনি–জলদি। প্লিনি ততক্ষণে পাথরটা খুলে ফেলেছে। কাঠের চাকতিটা ঘঘারাতে শুরু করেছে। একটা মৃদু গোঁ গোঁ শব্দ তুলে লোহার দরজাটা খুলে যেতে লাগল। মশাল হাতে প্রাসাদরক্ষীরা তখন অনেকটা কাছে চলে এসেছে। একজনের বেরোবার মত ফাঁক হতেই ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল–এক এক করে বেরিয়ে যাও। প্রথমে সদ্যমুক্ত গুমণ্ডের সৈন্যরা বেরোতে লাগল। তারপর বিস্কো, শাঙ্কো, তারপর প্লিনি আর ফ্রান্সিস। রক্ষী-সৈন্যরা ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে। গোপন দরজা খোলা হয়েছে। বন্দীরা পালাচ্ছে। ওরা জ্বলন্ত মশাল হাতে ছুটে আসতে লাগল। এবার প্লিনি দেয়ালের ওপাশের চৌকোণণা ফোকরের পাথরটা খুলল। কাঠের যন্ত্রটা ভেঙে দিল। পাথরের কয়েকটা ঘা মেরে কাঠের যন্ত্রটা ভেঙে দিল। দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। তখন দেয়ালের ওপাশে প্রাসাদ রক্ষীদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল। কিন্তু ওরা বন্ধ দরজা খুলতে পারল না। ফ্রান্সিসরা তখন কিছুটা এগিয়ে গেছে। প্লিনি ছুটে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিল। ফ্রান্সিস তখন কিছুটা এগিয়ে গেছে। প্লিনি ছুটে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিল। ফ্রান্সিস একটা উষ্ণ প্রস্রবণের পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে বলল–প্লিনি, যেখানে ঘোড়া রেখে এসেছি সেখানে নিয়ে চলো। প্লিনি উত্তর মুখে ঘুরল। তখনই রাজা গুমণ্ডের সদ্যমুক্ত সৈন্যদের একজন বলল–আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। এবার আমরা যাই। ওরা পর পর ফ্রান্সিসের ডানহাত ধরে ঝাঁকুনি দিল। তারপর কুয়াশা আর অল্প অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সিস বিস্কো আর শাঙ্কো প্লিনির পেছনে পেছনে ছুটল অল্প অন্ধকার কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একদিকে লোকবসতি কম। কয়েকটা বাড়ি পড়ল। দরজা জানলা বন্ধ! অন্ধকার। প্লিনি ওদের পথ দেখিয়ে সেই ঝরাপাতার বনে নিয়ে এল। বনের ধারের ওক গাছের সঙ্গে ঘোড়াগুলো বাঁধা আছে দেখা গেল। যাক্ ঘোড়াগুলো চুরি হয়নি। এখন এই ঘোড়াই ভরসা। তিনজনে গাছে বাঁধা দড়ি খুলে লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল। প্লিনি ঘোড়া ছোটাল। ফ্রান্সিসরা প্লিনির পেছনে পেছনে ঘোড়া ছোটাল।
শীতার্ত হাওয়া এলোমেলো বইছে। চোখের সামনে কুয়াশা সেই হাওয়ায় কখনো সরে যাচ্ছে কখনো জট পাকাচ্ছে। চোখেমুখে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাঁপটা লাগছে। ওরা ঘোড়া ছুটিয়ে চলল। মাথার ওপরে আকাশও সাদাটে কুয়াশায় ঢাকা। গুঁড়ি গুঁড়ি তুষার পড়ছে। বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘোড়া ছোটাল ফ্রান্সিসরা। ঘোড়াগুলোর মুখে ফেনা জমেছে। ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিসরাও ক্লান্ত। কয়েদঘরে খাওয়া ঘুম কোনটাই যথেষ্ট হয়নি। ফ্রান্সিস ভাবল–কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজন। নিজেদের ঘোড়াগুলোরও। ফ্রান্সিস ডাকল-প্লিনি।
–বলুন। প্লিনি ওর দিকে তাকাল।
–আমাদের কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজন। এখানে কোথাও লোকবসতি আছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–আর আধঘণ্টা ঘোড়া ছোটালে একটা ছোট্ট গ্রাম পাওয়া যাবে। ছোট্ট গীর্জা আছে। সেখানে একজন পাদ্রী আছেন। বেশ কয়েকঘর বসতিও আছে। প্লিনি বলল।
–তাহলে ওখানেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব। ফ্রান্সিস বলল।
কিছুক্ষণ পরেই দূর থেকে একটা ছোট্ট গীর্জার তিনকোণা মাথা দেখা গেল। কাছে গীর্জার কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল গীর্জার পাশে বেশ কয়েকটা বাড়ি। ওরা গীর্জাটার সামনে এসে ঘোড়া থামাল। দেখল ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। তাহলে এই ছোট্ট গাঁয়ের লোকেরা জেগে আছে।
ঘোড়া থেকে ওরা নামল। গীর্জার পাশেই একটা ন্যাড়া গাছ। গাছটায় ঘোড়ার দড়ি বাঁধল। গীর্জার পাশেই যে পাথর আর কাঠের ঘরটা আছে তার পাথুরে বারান্দায় ফ্রান্সিস উঠে এল। কাঠের দরজায় ধাক্কা দিল। ঘরের ভেতর থেকে এক বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আসছি। দরজা খুলে গেল। পাদ্রীর পোশাক পরা এক বৃদ্ধ মোটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে এগিয়ে এলেন। ফ্রান্সিসরা মাথা নীচু করে শ্রদ্ধা জানাল। বৃদ্ধ ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন
–তোমরা কোত্থেকে আসছে ভাই?
–আমরা থিংভেলির থেকে আসছি। রেভকজাভিক যাবো। ঘোড়াগুলোর জন্যে দানাপানি আর আমাদের জন্য সামান্য কিছু খাবার। পাদ্রী হাসলেন। বললেন–তোমরা আমাদের অতিথি। তোমাদের খাদ্য দেওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য। ভেতরে এসো।
ফ্রান্সিসরা ঘরের মধ্যে ঢুকল। দেখল–ঘরটা লম্বাটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একপাশে একটা বিছানা। ওদিকের দেয়ালের কাছে একটা চৌকোনো গর্তে আগুন জ্বলছে। তাতেই ঘরটা বেশ গরম হয়ে আছে। বাইরের ঠাণ্ডা থেকে ঘরের গরমে ঢুকে সকলেরই ভালো লাগল। একটা কাঠের টেবিল আর টানা বেঞ্চমত দেখিয়ে পাদ্রী বলল–তোমরা বসো। আমি লোকজনকে খবর দিতে যাচ্ছি। তোমাদের খেতে দেবার মত যথেষ্ট খাদ্য পানীয় তত আমার ঘরে নেই।
ফ্রান্সিসরা বেঞ্চমত জায়গাটায় বসল। পাত্রী টেবিলে জ্বলন্ত মোমবাতিটা রেখে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।
একটু পরেই পাদ্রী ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকলে। তার পেছনে দাড়িগোঁফঅলা একটি স্বাস্থ্যবান যুবকও ঢুকল। যুবকটি হেসে বলল–আপনারা আমাদের অতিথি। একটু অপেক্ষা করুন। আপনাদের খাবার আসছে।
আমাদের ঘোড়াগুলো খুব পরিশ্রান্ত। বিস্কো বলল। যুবকটি হেসে বলল-ঘোড়াগুলোর দানাপানির ব্যবস্থা করেছি। আপনারা নিশ্চিন্ত হোন।
ফ্রান্সিসরা সকলেই খুব ক্লান্ত। এতক্ষণে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পেরে একটু আরাম পেল। পাদ্রী আপনমনেই বলতে লাগলেন–এখানে পাঁচ সাত ঘরের বাস। আমরা সবাই বড় ভয়ে ভয়ে আছি।
-কেন বলুন তো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–রাজা গুমণ্ড অত্যন্ত অত্যাচারী রাজা। তার রাজত্বে আমরা কেউ সুখে নেই সারাক্ষণ ভয় কখন রাজা গুমণ্ডের সৈন্যরা এসে হাজির হয়। খুন জখম লুঠপাট ওদের কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার। রাজার কাছে নালিশ করতে গেলে কারো রেহাই নেই, রাজা গুমণ্ড তাকে ফাঁসিয়ে দেয়। সে কোন অভিযোগ অনুযোগ কানেই তোলে না। সৈন্যরা যা খুশী করে বেড়ায়। পাদ্রী আস্তে আস্তে বললেন।
–তাহলে তো এখানে এক অরাজক অবস্থা চলছে। বিস্কো বলল। পাদ্রী কোন কথা না বলে আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকালেন। ফ্রান্সিস বলল–আপনাদের উচিত সব প্রজাদের নিয়ে রাজা গুমণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
অসম্ভব পাদ্রীমশাই হেসে মাথা নাড়লেন। ফ্রান্সিস বলল–আপনি এখানে কতদিন আছেন?
–অনেকদিন। সাদা ভুরু কুঁচকে পাদ্রী বললেন। দেখছেনই তো ছোট্ট গ্রাম এটা। এক তুষার ঝড়ে পথ হারিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছিলাম। কতদিন আগের কথা। এই ছোট্ট গ্রামের মানুষেরা সেবাযত্ন করে আমাকে বাঁচিয়েছিল। নইলে আমার বাঁচার কোন আশাই ছিল না। তারপর কী করে এখানকার মানুষদের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম কী এক বন্ধনে। প্রথমে এদের ছেলেমেয়েদের জন্য পাঠশালা খুললাম। তারপর আস্তে আস্তে অনেক অনাথ ছেলেমেয়েকে আশ্রয় দিলাম। একটা আশ্ৰমমত গড়ে তুললাম।
–আশ্রমের খরচ চালান কী করে? বিস্কো জিজ্ঞেস করল।
–ভিক্ষে করে। মাঝে মাঝে থিংভেলির নগরে চলে যাই। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করি। অবশ্য কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তি আছেন তারা বরাবর আমাকে অর্থ সাহায্য করেন।
–রাজা গুমণ্ড সাহায্য করেন না? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস কর : পাদ্রীমশাই হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন–কিছু না। কয়েকবার গেছি সাহ-, চাইতে। উনি একটা কথাই বলেছেন–এসব অনাথ বাচ্চাকাচ্চার বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। মরুক সব। কথাটা শুনে ফ্রান্সিসরা অবাক হয়ে গেল। একজন দেশের রাজা এ ধরনের কথা বলতে পারে?
দাঁড়ি গোঁফঅলা যুবকটি বলল–এই পাদ্রীমশাই আমাদের কাছে দেবতার মত। গীর্জার কাজ চালান আবার পাঠশালা, হাতের কাজের শিক্ষাকেন্দ্রও চালান। কত অনাথ ছেলে মেয়ে কী সুন্দর কম্বল, গরম পোশাক বোনে। ফ্রান্সিস এসব শুনে খুব খুশী হল। পাদ্রীমশাইকে বলল–আপনার মত মানুষেরা যত বেশী থাকবেন আমাদের ততই মঙ্গল। কথাটা বলে বিস্কোকে বলল–বিস্কো দেখতো তোমার থলিতে কটা স্বর্ণমুদ্রা আছে। বিস্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা রেশমী থলি বের করল। থলি খুলে দেখল চারটে স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। ফ্রান্সিস স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে পাদ্রীমশাইর হাতে দিল। বলল–এর বেশী তো নেই। যা আছে দিলাম।
পাদ্রীমশাই হেসে বললেন–আপনাদের এই দানই আমার কাছে অনেক। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। বলে পকেটে স্বর্ণমুদ্রা রাখলেন। তখনই কাঠের দরজা ঠেলে দুজন স্ত্রীলোক ঘরে ঢুকল। তাদের হাতে বড় বড় কাঠের পাত্র। তারা সেসব টেবিলে রাখল। তারপর ছোট ছোট কাঠের থালা ফ্রান্সিসদের সামনে পেতে দিল। থালায় পরিবেশন করল গরম গরম গোল রুটি আর ভেড়ার মাংস। খাবার দেখে এতক্ষণে ফ্রান্সিস বুঝল যে ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। বিস্কোদের অবস্থাও তাই। সবাই খেতে লাগল। পাত্রীও খেতে লাগলেন। যুবকটিও খেতে বসল।
সবাই খাচ্ছে। স্ত্রীলোক দুজন চলে গেল। তখনও সবার খাওয়া শেষ হয় নি। হঠাৎ ফ্রান্সিসের কানে ঘোড়ার ডাকের শব্দ এল। ওদের ঘোড়া বাঁধা বারান্দার পরেই। ওদের ঘোড়ার ডাক নয়। খুব মৃদু শব্দ। দূর থেকেই এল শব্দটা। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। খাওয়া ফেলে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বিস্কো শাঙ্কো ওর দিকে অবাক চোখে তাকাল। বিস্কো বলে উঠল-কী ব্যাপার ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল–রাজা গুমণ্ডের সৈন্যরা আমাদের পিছু ছাড়েনি। শিগগির পালাও। জলদি। কথাটা বলেই ফ্রান্সিস দরজার দিকে ছুটল। বিস্কো শাঙ্কোও খাওয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। ছুটল ফ্রান্সিসের পেছনে। কিন্তু দরজা খুলতে গিয়েই ফ্রান্সিস থমকে গেল। বাইরের তুষারগলা জলে কাদায় ঘোড়ার থপ থপ শব্দ উঠল। ফ্রান্সিস দ্রুত ফিরে দাঁড়াল।
এক ছুটে পিছিয়ে এল। টেবিলে রয়েছে ওদের আধখাওয়া খাবারের কাঠের পাত্রগুলো। ফ্রান্সিস দুহাতে ওদের পাত্রগুলো টেবিল থেকে মেঝেয় ফেলে দিল। ঘরটার আর একপাশে তাকাল। দেখল পেছনে একটা কাঠের আগল দেওয়া কাঠের ছোট দরজা। ফ্রান্সিস ওদিকে কয়েকপা ছুটে বলল এদিকে। আগল খুলে দরজাটা খুলল। ঢুকে পড়ল অন্ধকার ঘোট ঘরটায়। পেছনে পেছনে বিস্কোরাও। ওদিকে পাদ্রীমশাই আর যুবকটি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না ফ্রান্সিসরা পেছনের ঘরে আত্মগোপন করল কেন। একটু পরেই দরজায় ধাক্কার শব্দ শোনা গেল সেই সঙ্গে উঁচুগলায় চীৎকার, দরজা খোল। খোল দরজা। গুমণ্ডের সৈন্যরা এসেছে। পাদ্রীমশাই আর যুবকটির মুখভয়ে সাদা হয়ে গেল। ওরা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। আবার দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা আর চীৎকার–খোল দরজা!
ফ্রান্সিস অন্ধকারে ঘরটার চারিদিকে তাকাল যদি বাইরে বেরোবার কোন দরজা পাওয়া যায়। না-নেই। ঘরটায় গম আটার বস্তা। বড় বড় কাঠের থালা। আরো অন্য বস্তা সাজানো। বোঝা গেল ভাড়ার ঘর এটা। ফ্রান্সিস এবার ছোট কাঠের দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে লাগল গুমণ্ডের সৈন্যরা কী করছে। ধাক্কার চোটে দরজা প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা। এসব দাড়িগোঁফঅলা যুবকটি ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গেল। তারপর দরজার আগলটা খুলে দিল। গুমণ্ডের সৈন্যরা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল। সবার হাতে খোলা তরোয়াল। সংখ্যায় ওরা পাঁচজন। প্রথমেই রয়েছে সেই ছুঁচোলো দাড়িগোঁফঅলা দলনেতাটি। সে ঢুকেই এক ধাক্কায় যুবকটিকে মেঝেয় ফেলে দিল। দুচোলো দাড়িগোঁফঅলা দলনেতা তরোয়ালের ডগাটা যুবকটির বুকের ওপর ঠেকাল। বলল–এখানে পলাতক কয়েদীরা এসেছিল? যুবকটি মেঝেয় শোওয়া অবস্থাতেই মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিসরা যে পলাতক কয়েদী একথা তো সত্যিই যুবকটি জানতো না। ও সত্যি কথাটাই মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে জানাল। দলনেতা তরোয়াল সরাল। যুবকটি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দলনেতা একবার পাদ্রীমশাইর দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর ঘরের চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল–দুজন চলে যা। অন্য বাড়িগুলো দ্যাখ। দুজন সৈন্য তরোয়াল হাতে বাইরে বেরিয়ে গেল। দলনেতা এবার টেবিলের ধারে কাঠের থালা ছিটোনো খাবার দেখতে পেল। তারপর সন্দেহ দৃঢ় হল। ও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুবকটিকে বলল–তুই মিথ্যে কথা বলছিস। ওরা এখানে এসেছিল। তোরা ওদের ছেড়ে দিয়েছিস। মর তবে। দলনেতা যুবকটির বাঁ কাঁধে তরোয়ালের কোপ বসাল। রক্ত বেরিয়ে এল। যুবকটি কাঁধে হাত চেপে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেয় বসে পড়ল। গোঙাতে লাগল।
ফ্রান্সিস দরজার ফোকর দিয়ে সব দেখছিল। ও এবার একটানে কোমর থেকে তরোয়াল খুলে ফেলল। চাপা স্বরে বলল–বিস্কো শাঙ্কো তৈরী হও। বিস্কো আর প্লিনি সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে তরোয়াল খুলল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে ধনুকে তীর চড়াল। দলনেতার এবার নজরে পড়ল আঁড়ার ঘরের কাঠের ঘোট দরজাটার দিকে। ও এক পা এক পা করে তরোয়াল উঁচিয়ে দরজাটার দিকে আসতে লাগল। পাদ্রীমশাই হঠাৎ দুহাত তুলে ছুটে এসে দলনেতার সামনে। দাঁড়ালেন। কান্নাভেজা গলায় বলে উঠলেন–না–না। দলনেতা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর বিদ্যুৎবেগে তরোয়াল বসিয়ে দিল পাদ্রীমশাইর বুকে। বৃদ্ধ দুহাত তোলা অবস্থায় টেবিলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লেন। তারপর গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে গেলেন।
ফ্রান্সিস চীৎকার করে উঠল–লড়াই। তারপর পায়ের এক লাথিতে দরজা খুলে ছুটে গিয়ে দলনেতার ওপর আঁপিয়ে পড়ল। দলনেতা এত হঠাৎ আক্রান্ত হবে স্বপ্নেও ভাবে নি। ও কোনরকমে ফ্রান্সিসের তরোয়ালের মার ঠেকাল। তারপরেই শুরু হল দুজনের তরোয়ালের লড়াই। ততক্ষণে শাঙ্কোর ছোঁড়া তীর একজন সৈন্যের বুকে বিধে গেছে। সেও মারা পড়ে গেছে। অন্য সৈন্যটির ওপর তরোয়াল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিস্কো আর প্লিনি। দুজনের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা সৈন্যটার ছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই কপালে তরোয়ালের ঘা খেয়ে টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তখনই পাশের বাড়িগুলো থেকে নারী ও শিশু কণ্ঠের চীৎকার ও কান্নার রোল উঠল। ফ্রান্সিস তরোয়াল চালাতে চালাতে বলল–বিস্কো–ওদের বাঁচাও। বিস্কো প্লিনি আর শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
তখনও ফ্রান্সিস আর দলনেতার তরোয়ালের লড়াই চলছে। ফ্রান্সিস তরোয়াল চালাতে চালাতে বুঝল ও যে কোন মুহূর্তে দলনেতাকে হত্যা বা আহত করতে পারে। কিন্তু ও তা করলনা। একবার হঠাৎ আক্রমণের চাপ বাড়িয়ে দিল। পরক্ষণেই এত জোরে তরোয়াল চালাল যে দলপতির হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে মেঝেয় ঝন্ ঝন্ শব্দে পড়ে গেল। নিরস্ত্র দলনেতা তখন হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ওর মুখে মৃত্যুভয় ফুটে উঠল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে তরোয়ালের ডগাটা বুকে চেপে ধরল। বলল–তোমাকে আমি হত্যা করবো না। শুধু কয়েকটা কথা বলি শোন। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল–কী জীবন তুমি কাটিয়েছ? রাজা গুমণ্ডের আদেশ পালন করেছে। ভালো খেয়ে পরে আনন্দ করেছে। আর নির্বিচারে নারী শিশুদের নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছে। এই পৃথিবীতে তোমার মত নরপিশাচের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। অথচ দেখ–যে বৃদ্ধ পাদ্রীমশাইকে তুমি হত্যা করলে তিনি সারাটা জীবন এই বসতির মানুষদের প্রাণ দিয়ে ভালো বেসেছেন। তাদের মঙ্গলের জন্যে নিজের সব আনন্দবিলাস সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়েছেন। এমন একজন দেবতুল্য মানুষ মরে যাবেন আর তোমার মত নরপশু বেঁচে থাকবে এ তো হয় না। দলনেতা হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে ফ্রান্সিসের পায়ে পড়ল। দুহাতে ফ্রান্সিসের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল–
–আমাকে মারবেন না–আমাকে মারবেন না!
–না–তোমাকে মারবো না–ফ্রান্সিস বলল–আমার কর আমি যা বলবো তুমি তাই করবে।
–হ্যাঁ করবো–নিশ্চয়ই করবো। দলনেতা কাঁদতে লাগল।
–এই পাদ্রীমশাই এখানে যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন সেইভাবে তোমাকে বাকী জীবন কাটাতে হবে। উনি যা যা কাজ করতেন সেই সব কাজ তোমাকে করতে হবে। এখানকার সবাইকে ভালোবাসতে হবে। তাদের মঙ্গল ছাড়া তুমি আর কিছু ভাববে না। কী? রাজী? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ–আপনি যা বলবেন আমি সে সব করবো। দলপতি বলল। ফ্রান্সিস তরোয়াল নামাল। বলল–অবশ্য তোমার মত নরপশুর প্রতিশ্রুতিকে আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করিনা। তবু তোমাকে বেঁচে থাকার একটা সুযোগ দিলাম।
তখনই দরজা দিয়ে বাকি দুজন সৈন্য ঢুকল। পেছনে বিস্কো ওরা। সবাই হাঁপাচ্ছে। সৈন্য দুটির সারা গায়ে রক্তের দাগ। ফ্রান্সিস ওদের দিকে তাকিয়ে বলল–এই দুজন কি কাউকে হত্যা করেছে?
–না–তার আগেই আমরা পৌঁছে গেছিলাম। তবে দুএকটা বাড়িঘর লুঠ করেছে। বিস্কো বলল।
–তবে ওদের বন্দী করে রাখো। ফ্রান্সিস বলল। বিস্কো সৈন্য দুজনকে টেনে নিয়ে ভাড়ার ঘরে ঢোকাল। তারপর ভঁড়ার ঘরের কাঠের হুড়কোটা টেনে বন্ধ করে দিল।
এবার ফ্রান্সিস সৈন্যদের দলপতির দিকে তাকাল। বলল-এই আহত যুবকটির চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। তোমাদের দুজন সৈন্য যদি মরে গিয়ে না থাকে তাদেরও চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। পাদ্রীমশাইকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে গীর্জার পাশের বাগানে কবর দেবে। পাদ্রীমশাইর পোশাকের পকেটে চারটে স্বর্ণমুদ্রা পাবে তাই দিয়ে এইসব ব্যবস্থা করবে। তারপর যে পরিমাণ অর্থ থাকবে তা আশ্রমের কাজে ব্যয় করবে। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল–আমরা এখন রেভকজাভিক ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার এখানে আসবো। দেখবো তুমি যে প্রতিজ্ঞা করলে তা পালন করেছো কিনা। যদি দেখি তুমি এখান থেকে পালিয়ে গেছে। দলপতি দুহাত নেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল–না-না আমি প্রতিজ্ঞা করছি পালাবো না।
–দেখা যাক। তবে যদি পালাও তাহলে আমি তোমাকে একদিন খুঁজে বার করবোই। তখন তোমাকে যে অবস্থায় পাবো যেখানে পাবো তোমাকে হত্যা করবো। মনে রেখো আমার নাম ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে পাদ্রীমশাইর মৃতদেহের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। দুহাতে মৃতদেহের ডানহাতটা তুলে নিল। শ্রদ্ধার সঙ্গে চুম্বন করল। আস্তে আস্তে হাতটা নামিয়ে রাখল। তারপর উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। জামার হাতায় চোখ মুছে বিস্কোদের দিকে তাকাল। কান্নাভেজা গলায় বললো–চলো। সবার আগে ফ্রান্সিস পেছনে বিক্ষো, শাঙ্কো ও প্লিনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। ঘরের গরম থেকে বাইরে বেরোতেই শীতার্ত হাওয়া ছুটে এল। ফ্রান্সিসের শরীরটা কেঁপে উঠল। গাছে বাঁধা ঘোড়াগুলোর কাছে ওরা এল। ঘোড়ায় চড়ল সবাই। ঘোড়া ছোটাল রেভকজাভিকের দিকে। সবার আগে প্লিনি পথ দেখিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলল।
ফ্রান্সিসরা ঘোড়া ছুটিয়ে চলল রেভকজাভিকের উদ্দেশ্যে। চারদিকের সাদাটে কুয়াশা ঘন হতে শুরু করল। ঘণ্টাকয়েক পরেই শুরু হল তুষার ঝড়। সেই সঙ্গে তুষারবৃষ্টি। তুষারের ঝড় বৃষ্টিতে ফ্রান্সিসরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছল না। তুষারঝড়ের সাঁই সাঁই শব্দের মধ্যে ফ্রান্সিস চীৎকার করে ডাকল–প্লিনি? একটু দূর থেকে প্লিনি উত্তর দিল-বলুন।
–আর কতদূর? ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলল।
–ঠিক বুঝতে পারছি না। প্লিনিও চীৎকার করে বলল। এবার বিস্কোর উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–ফ্রান্সিস থামো নইলে আমরা দলছুট হয়ে যাবো। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ফ্রান্সিস বলল–চলবে না। শুধু ঘোড়ার গতি কমিয়ে দাও। তারপর ফ্রান্সিস গলা জড়িয়ে বলল–প্লিনি–তুমি সবার সামনে থাকো। মুখে শব্দ করতে থাকো। সেই শব্দ লক্ষ্য করে আমরা ঘোড়া ছোটাব। তখন প্লিনি চীৎকার করে একটা গান গাইতে লাগল। সেই গানের শব্দ লক্ষ্য করে ফ্রান্সিস বিস্কো আর শাঙ্কো ঘোড়া ছোটাতে লাগল। প্লিনি ঘুরে ফিরে সেই গানটাই গাইতে লাগল। এখানকার ঘাসের উপত্যকায় ভেড়া চরাবার সময় ভেড়া চালকরা যে গান গায় সেই গান।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তুষার ঝড় থেমে গেল। বৃষ্টির জোর কমল। তারপর বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। তখনই পাতলা কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল টানা পাহাড়ের চড়াই। রেভকজাভিকের সীমান্ত। ফ্রান্সিস টানা পাহাড় দেখেই বুঝল সেটা। ও চীৎকার করে উঠল–ও হো-হো। বিস্কো আর শাঙ্কোও চীৎকার করে উঠল–ও হা-হো। তুষারের ঝড়বৃষ্টিতে ফ্রান্সিসদের সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। হাওয়ার তেজ কমলেও ফ্রান্সিসরা ঠান্ডায় কাঁপতে লাগল।
টানা পাহাড়ের চড়াই পেরিয়ে ঘোড়া ছোটাল ফ্রান্সিসরা। এখন চারদিক পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কুয়াশার আস্তরণও পাতলা। দূর থেকে আলোর বিন্দু দেখা গেল। রেভকজাভিক নগরের আলো।
ওরা যখন নগরে ঢুকল তখন পথঘাট প্রায় জনশূণ্য। ঘরে ঘরে আলো নেভাননা। পথে দুএকজন পথচারী। ওরা ঘোড়া ছুটিয়ে রাজবাড়ির সামনে এল। ঘোড়া থামাল। সবাই হাঁপাচ্ছে তখন। ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো শাঙ্কো তোমরা জাহাজে চলে যাও। প্লিনি তুমিও বাড়ি যাও আমি রাজা ইনগলফের সঙ্গে কথা বলে জাহাজে ফিরবো। বিস্কো শাঙ্কো আর প্লিনি চলে গেল! দ্বাররক্ষী একজন ফ্রান্সিসের কাছে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–রাজা ইনগলফকে খবর দাও।
রাজা ঘুমিয়ে আছেন। দ্বাররক্ষী বলল।
ঘুম ভাঙাও। খবর দাও যে ফ্রান্সিস থিংভেলির থেকে ফিরে এসেছে। দ্বাররক্ষী আর কোন কথা বলল না। দ্রতপায়ে রাজবাড়িতে ঢুকে পড়ল।
ফ্রান্সিস রাজবাড়ির চত্বর আস্তে আস্তে হেঁটে পেরিয়ে এল। রাজবাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। এতদূর ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে। পেটপুরে খেতেও পারেনি। একটু পরেই সেই দ্বাররক্ষী ছুটে এল। বলল–রাজা আপনাকে ডাকছেন। ফ্রান্সিস দ্বাররক্ষীর পেছনে পেছনে রাজবাড়ির অভ্যন্তরে ঢুকল। কয়েকটা ঘর পার হয়ে রাজার শয়নকক্ষে ঢুকল। দ্বাররক্ষী শয়নকক্ষে ঢুকল না। ফ্রান্সিস কঁচকা আলোতে দেখল রাজা ইনগলফ পাখির পালকের বিছানায় বসে আছেন। রাজা ইনগলফ ফ্রান্সিসের পেছন দিকে তাকালেন। মারিয়াকে না দেখে তিনি হতাশার ভঙ্গী করলেন।
বললেন–ফ্রান্সিস বলেছিলে রাজকুমারী মারিয়াকে মুক্ত করে আনবে। ফ্রান্সিস একটু মাথা নত করে বলল–না-পারলাম না। রাজার মুখ চিন্তাকুল হল। একটু মাথা নেড়ে বললেন–তাহলে তো আমাদের সৈন্যদের নিয়ে স্কালহল্টে চলে যেতেই হবে। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল–আপনি কি মনে করেন সৈন্যবাহিনী নিয়ে আপনি স্কালহল্টে চলে গেলে গুমন্ড তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে?
–জানি না। কিন্তু এছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। রাজা হতাশস্বরে বললেন। ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। আসলে ও এত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে ভালো করে গুছিয়ে কিছু ভাবতে পারছিল না। ও একটু মাথা নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
ফ্রান্সিস বন্দরে এল ঘোড়ায় চড়ে। অনেক চিন্তা ওর মাথায়। জাহাজে উঠতেই বন্ধুরা ওকে ঘিরে ধরল। বিস্কো শাঙ্কোর কাছে সবই শুনেছে ওরা। ফ্রান্সিসের অভিযান ব্যর্থ। মারিয়াকে ওরা মুক্ত করে আনতে পারে নি। ফ্রান্সিস বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল–সবই শুনেছো তোমরা। আমি খুবই পরিশ্রান্ত। খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম করবো। তবে একটা কথা জেনে রেখো–মারিয়াকে আমি মুক্ত করে আনবই। আজ অথবা কাল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ওর কেবিনঘরে চলে গেল।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস প্রায় ঘণ্টা চারেক ঘুমোল। এর মধ্যে হ্যারি বার দুয়েক ফ্রান্সিসকে দেখে গেছে। ও ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙায় নি।
ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙল। কিন্তু ও শুয়েই রইল। ভাবতে লাগল এরপরে কী করবে। হ্যারি কেবিনঘরে ঢুকল। কোন কথা না বলে ফ্রান্সিসের পাশে বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি–এখন আমরা কী করবো বলোতো?
–রাজা ইনগলফ কী বললেন? হ্যারি বলল?
–উনি স্কালহল্টে যাবার জন্যে মনস্থির করে ফেলেছেন?
–তুমি বোধহয় জানোনা না স্কালহল্টের রাজা হজরলিফ রাজা ইনগলফের ভাই হ্যারি বলল।
–না আমি জানতাম না। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজ পরিবার ওখানে সুখেই থাকবেন। কিন্তু ভাবনার কথা হল আমরা কি করবো? এখানে রাজা ইনগলফের সৈন্যরা থাকবে না। গুমন্ড এসে এখানকার রাজা হয়ে বসবে। সে তার সৈন্যবাহিনীও নিয়ে আসবে। এখনকার চেয়েও আমাদের বিপদ হবে আরো বেশী। কাজেই আমাদেরও স্কালহল্টে চলে তারপর যেতে হবে। হ্যারি বলল। ফ্রান্সিস হ্যারির কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। বলল–হ্যারি, সবাইকে জাহাজের ডেকে জমায়েত হতে বললো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে। আমি যাবো।
হ্যারি সবাইকে জমায়েতের খবর দিতে চলে গেল।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজের ডেকে এসে জড়ো হল। একটু পরেই ফ্রান্সিস এল সঙ্গে হ্যারি। এতক্ষণ সবাই কথাবার্তা বলছিল। ফ্রান্সিস আসতেই সবাই চুপ করল। ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলতে লাগল–ভাইসব–তোমরা জানো থিংভেলির রাজা গুমন্ড অতীতে আমাদের দেশের সেনাপতি ছিলেন। আমাদের রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে তাকে এখানে নির্বাসিত করা হয়। সে থিংভেলির রাজা হয়ে বসে। এখন সে এক চাল চেলেছে। রাজকুমারী মারিয়াকে সে কৌশলে অপহরণ করিয়াছে। মারিয়ার মুক্তিপণ হিসেবে সে দাবী করেছে রাজা ইনগলফকে রেভকজাভিকের রাজত্ব ছেড়ে স্কালহল্টে চলে যেতে হবে। সোজা কথায় বিনা যুদ্ধে বিনা রক্তপাতে গুমন্ড রেভকজাভিকের রাজা হয়ে বসবে। তার রাজত্বের সীমানা বাড়বে। ফ্রান্সিস থামল। ভাইকিংরা কেউ কোন কথা বলল না। মাথার ওপর পাতলা কুয়াশার আবরণের মধ্যে দিয়ে আকাশে কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে উত্তরে শীতার্ত হাওয়া বইছে। ফ্রান্সিস আবার বলতে লাগল–আমি রাজা ইনগলফের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা চারজন মারিয়াকে মুক্ত করতে পারি নি এই জেনে তিনি স্থির সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন যে তিনি পরিবারসহ এবং সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে স্কালহল্ট চলে যাবেন। তাহলেই রাজা গুমন্ড মারিয়াকে মুক্তি দেবে। কিন্তু আমি গুমন্ডকে ভালো করেই চিনি। সে তার প্রতিশ্রুতি কক্ষণো রাখবে না। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলতে লাগল–্যারির সঙ্গে এই নিয়ে কথা হয়েছে। আমি স্থির করেছি আমরাও জাহাজে চড়ে স্কালহল্টে গিয়ে থাকবে। এবার এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত বলল। ফ্রান্সিস থামল। সবাই চুপ করে রইল। নীরবতা ভাঙল বিস্কো। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস–আমরা যদি এখানে থাকি? লড়াই করি? গুমন্ডের সৈন্যবাহিনীকে যদি এখানকার অধিকার নিতে না দি? ফ্রান্সিস বলল–সেক্ষেত্রে দুটো সমস্যা আছে। এক রাজা ইনগফের সৈন্যবাহিনী এখানে থাকবে না। লড়তে হলে আমাদের জনা পঞ্চাশেককে একটা বড় সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। মরণপণ লড়াই করলেও আমরা পারবো না। দ্বিতীয়ত-মারিয়া এখনও থিংভেলির বন্দী হয়ে আছে। আমরা এখানে যুদ্ধে নেমেছি এই সংবাদ–গুমন্ড পেলে মারিয়ার বিপদ বাড়বে। বলা যায় না হয়তো রাজত্বের লোভে গুমন্ড মারিয়াকে হত্যার হুমকি দিতে পারে। তখন আমাদেরই যুদ্ধ থামাতে হবে। কাজেই সবদিক বিবেচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা এখানে থাকবো না রাজা ইনগলফের সঙ্গে আমরাও স্কালহল্টে আশ্রয় নেব। ফ্রান্সিস থামল। সমবেত ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। দুএকজন বলে উঠল–তবু আমরা যুদ্ধ করবো। কিন্তু আর কাউকে সমর্থক না পেয়ে ওরা চুপ করে গেল। একজন ভাইকিং বলে উঠল–কিন্তু রাজকুমারী মারিয়ার মুক্তি কী হবে? ফ্রান্সিস বলল–আমরা স্কালহল্টে জাহাজ নিয়ে থামবো। যদি কোনভাবে রাজা গুমন্ড মারিয়াকে মুক্তি না দেয় তবে আবার চেষ্টা করবো মারিয়াকে মুক্ত করতে। যদি কোনভাবেই না পারি তবে রাজা ইনগলফকে বাধ্য করবো যুদ্ধে নামতে। রাজা ইনগলফের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে আমরাও যুদ্ধ করবো। মারিয়াকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমরা কেউ আইসল্যান্ড ছেড়ে যাবো না। ভাইকিংরা সবাই উল্লাস চীৎকার করে উঠল—ও-হো-হো-হো।
-এবার তোমরা বলো এখন কী করবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল একজন ভাইকিং বন্ধু বলে উঠল–তুমি যা বলবে আমরা তাই করবো। সবাই প্রায় একসঙ্গে কথাটা সমর্থন করল।
–তাহলে বলছি–আমরা জাহাজ নিয়ে স্কালহন্টে গিয়ে থাকবো। রাজাকেও আমাদের জাহাজে আসতে অনুরোধ জানাবো। তিনি আমাদের সঙ্গী হলে ভালোই। তারপর রাজা গুমন্ড কী করে সেটা দেখবো। তারপর প্রয়োজনে লড়াইয়ে নামবো। ফ্রান্সিস বলল। সভা ভেঙে গেল। ভাইকিংরা কথা বলতে বলতে নিজেদের কেবিনে চলে গেল। ফ্রান্সিস আর হ্যারিও নিজেদের কেবিনে চলে এল। ফ্রান্সিস বিছানায় আধশোয়া হয়ে ভাবতে লাগল–এবার কী করবে? বন্ধুদের মতামত জানা গেল। এবার রাজা ইনগলফের সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে।
দিনের হিসেবে পরদিন ফ্রান্সিস রাজা ইনগলফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেল। সঙ্গে হ্যারিকে নিয়ে গেল। ওরা যখন রাজবাড়ি কাছে গেল দেখল দক্ষিণে সৈন্যদের ছাউনি থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে আসছে। রাজবাড়ির ওপাশের প্রান্তরে সৈন্যরা জড়ো হচ্ছে। এরা পদাতিক সৈন্য। রাজবাড়ির সামনের বিরাট চত্বরে জড়ো হচ্ছে অশ্বারোহী সৈন্যরা। চারিদিকে সাজ সাজ রব। সবাই ব্যস্ত। বোঝাই যাচ্ছে রাজার আদেশে সৈন্যরা স্কালহল্টে যাবার জন্যে তৈরী হচ্ছে।
দ্বাররক্ষীকে দিয়ে রাজাকে সংবাদ পাঠিয়ে ওরা দুজনে মন্ত্রণাকক্ষে ঢুকল। পাথরের টেবিলের চারপাশে রাখা বাঁকানো পায়াঅলা ওককাঠের চেয়ারে বসল। তখনই সেনাপতি কক্ষে ঢুকল। সেনাপতিও বসল। একটু পরে রাজা ইনগলফ কক্ষে প্রবেশ করলেন। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল।
রাজা তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলেন। রাজার মুখ দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল রাজা খুবই চিন্তান্বিত। নিজের রাজত্ব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। চিরশত্রু গুমন্ড তার প্রতিশ্রুতি রাখবে কিনা, মারিয়াকে মুক্তি দেবে কি না, এসব চিন্তা তো রাজার হবেই।
প্রথমে রাজা সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন–
–আপনার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে?
–সৈন্যদলের জমায়েত এতক্ষণে হয়ে গেছে। এবার আপনার অনুমতি। সেনাপতি বলল।
–আপনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্কালহন্টের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করুন। পথে কোথাও যদি রাজা গুমন্ডের সৈন্যদের মুখোমুখি পড়ে যান–সংযত থাকবেন। অযথা সংঘর্ষ ও রক্তপাত আমি পছন্দ করি না এটা আপনি জানেন। সেনাপতি উঠে দাঁড়াল। মাথা নীচু করে সম্মান জানিয়ে বলল–জানি মহামান্য রাজা। সেনাপতি চলে গেল।
এবার ফ্রান্সিস বলল-মহামান্য রাজা–আপনি কখন যাবেন?
–ঘণ্টা কয়েক পরেই। রাজা বললেন?
–যদি কিছু না মনে করেন তাহলে একটা অনুরোধ জানাই?
–বলো।
–আমরা তো আমাদের জাহাজ চালিয়ে স্কালহল্টে যাচ্ছিই। যদি আপনারা আমাদের জাহাজে চড়ে যান তাহলে আমরা নিজেদের ভাগ্যমান মনে করবো। রাজা ইনগল কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন–হ্যাঁ তা যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তোমাদের কোন অসুবিধা হবে নাতো।
তাহলে শোন–আমি ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে তোমাদের জাহাজে যাবো।
ফ্রান্সিস ও হ্যারি উঠে দাঁড়াল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে ফ্রান্সিস বলল–আমরা এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করছি।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি জাহাজে ফিরে এল। সবাইকে ফ্রান্সিস বলল–ভাইসব–রাজা ইনগলফ আমাদের জাহাজে চড়ে স্কালহল্টে যেতে সম্মত হয়েছেন। সকলেই খুব খুশী হল। এবার হ্যারি বলল–রাজপরিবারের বসবাসের উপযোগী কর। সব ভাইকিং হৈ হৈ করে কাজে লেগে পড়ল।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জাহাজের চেহারা ফিরে গেল। জাহাজের ডেক, সিঁড়ি, মাস্তুল কেবিনঘর সব ঝকঝক করতে লাগল। এমনিতেই জাহাজটা ছিল নতুন আর খুব ভালো। কাজেই ভাইকিংদের খুব খাটতে হল না।
রাজপরিবারে থাকার জন্যে কেবিন ঘরটাও খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হল। মোটা মোটা কম্বলের বিছানা, পরিষ্কার বিছানার ঢাকনা, পরিচ্ছন্ন বালিশ সব ব্যবস্থা করা হল। এবার রাজপরিবারের আসার জন্যে প্রতীক্ষা।
ঠিক সময়মতই রাজার মাথা খোলা গাড়ি এল। সেই কালো রঙের গাড়ির গা চকচক করছে। তাতে সোনালি ফুল লতাপাতার কাজ। রাজা রানী ও সাত আট বছর বয়েসের রাজকুমার। রাজারানী ও রাজকুমারের পরনে খুব একটা জমকালো পোশাক নয়। রাজার গাড়ির পেছনে আর একটা সাধারণ গাড়িও এল। দেখা গেল সেটাতে একটা কাঠের লম্বামত শক্ত সিন্দুক। বোঝা গেল–ওটা রাজকোষ। স্বর্ণমুদ্রা হীরে মণিমাণিক্য আছে ওটাতে। আরো দুটো বাক্স। জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস ওদুটোতে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি বেশ ভালো পোশাক পরে জাহাজঘাটে দাঁড়িয়েছিল। রাজার গাড়ি এসে থামতেই ফ্রান্সিস আর হ্যারি এগিয়ে গেল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। রাজা, রানী রাজপুত্র গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তারপর পাতা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে জাহাজে উঠলেন। বিস্কো তাদের পথ দেখিয়ে নির্দিষ্ট কেবিন ঘরে পৌঁছে দিল। জাহাজ দেখে কেবিন ঘর দেখে রাজপুত্র খুব খুশী। সে সারা জাহাজে ছুটোছুটি করতে লাগল। রাজা ও রানী কেবিনঘরে ঢুকে চুপ করে বসে রইলেন। দুজনের কারোর মন ভালো নেই।
ফ্রান্সিস সেই কেবিন ঘরে ঢুকল। বলল–মহামান্য রাজা–আপনাদের কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? রাজা মৃদু হেসে বললেন না। তারপর বললেন–ফ্রান্সিস আমার রাজকোষ একটা সিন্দুকে রাখা আছে। ঐ সিন্দুকটা একটা নিরাপদ জায়গায় রেখো।
-ওটা আমরা অস্ত্রঘরে রেখেছি। দুজন করে ভাইকিং সারাক্ষণ ঐ ঘর পাহারা দেয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ফ্রান্সিস বলল-দরজায় দুজন পাহারাদার রয়েছে। আপনাদের যখন যা প্রয়োজন চাইবেন। তখনই রানী মৃদুস্বরে বললেন–মারিয়া থাকলে কত খুশী হত। কথাটা শুনেও ফ্রান্সিসও দুঃখ পেল। বন্দিনী মারিয়ার কথা তখনই মনে পড়ল। ও বলল–মহা মাননীয়া আপনি যে মারিয়াকে সত্যি ভালোবাসেন এটা আপনার কথা থেকেই প্রমাণিত হল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কথাটা বলে ফ্রান্সিস মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে চলে এল।
জাহাজ চলেছে। রাজা ও রানী নিজেদের কেবিন ঘর থেকে বড় একটা বেরোন না। সারাক্ষণ কেবিন ঘরেই থাকেন। দুজনেরই মন খারাপ! মারিয়া এখনও মুক্তি পেল না। রাজা ইনগলফ ভাবেন মারিয়ার যদি কোন বিপদ হয় তাহলে ভাইকিংদের রাজার কাছে কী জবাবদিহি করবেন? রাজা গুমন্ডের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবো? এই চিন্তাটাও রাজা ইনগলফের মাথায় মাঝে মাঝে আসে। কিন্তু তিনি রক্তক্ষয় চান না। এর আগে রাজা গুমন্ড দুদুবার তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেছিল বলেই তিনিই যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দুবারই রাজা গুমন্ড হেরে গেছে। এবার তাই তাকে বিপদে ফেলতে মারিয়াকে অপহরণ করেছে। রাজা গুমণ্ড ভালো করেই জানে এবার রাজা ইনগলফকে চাপ দিয়ে সে শুধু তার রাজত্বই পাবে না আরো কিছু সুবিধেও আদায় করে নেবে। কিন্তু রাজা ইনগলফ এ অবস্থায় একেবারে অসহায়। কিছুই করার নেই তাঁর। তাই রাজা রানী দুজনেই চিন্তিত। তাদের মনে আনন্দ নেই।
এদিকে রাজপুত্র খুব খুশী। সারাক্ষণ জাহাজের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়ায়। ছটোছুটি করে আর মাঝে মাঝেই ফ্রান্সিসের কেবিন ঘরে-ঢুকে গল্প শোনবার বায়না ধরে। ফ্রান্সিসের মন চিন্তাকুল। তবু রাজপুত্র এলেও খুশীই হয়। ওকে সোনার ঘণ্টা, হীরের পাহাড়ের গল্প বলে। রাজপুত্র গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে সেসব গল্প শোনে। গল্প বলতে বলতে ফ্রান্সিসের মনে পড়ে যায় মার কথা, মারিয়ার কথা। মাও অবাক চোখে শুনতেন এইসব গল্প।–বলতেন–হ্যারে তুই এতসব কান্ড করেছিস-এ্যাঁ! ফ্রান্সিস হাসতো। বলতো–তোমার ছেলে কি ঘরে বসে দুধ পনীর খাওয়ার ছেলে? মা বলতেন–আমার দরকার নেই অত দুঃসাহসী ছেলে। বাড়িতে আমার চোখের সামনে থাক তুই আমার, তাতেই সুখ, তাতেই আনন্দ। মারিয়াও কী গভীর মনোযোগর সঙ্গে ওর মুখে গল্প শুনতো! তাই গল্প বলতে বলতে ওর মনটা উদাস হয়ে যায়। গল্প বলা থামিয়ে ও মার কথা মারিয়ার কথা ভাবে। রাজকুমার তাগাদা দেয়–তারপর কী হল বলল না। ফ্রান্সিস আবার গল্প বলতে শুরু করে।
দিনের হিসেবে দুদিন পর সাদাটে ধোঁয়া কুয়াশার মধ্যে স্কালহল্ট বন্দরের অস্পষ্ট আলো দেখা গেল। আস্তে আস্তে জাহাজ এসে বন্দরে ভিড়ল। জাহাজ থেকে ঘাটের গায়ে তক্তা ফেলা হল। দেখা গেল দুটো গাড়ি বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। রাজা ইনগলফের সেনাপতি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। বোঝা গেল সে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আগেই পৌঁছে গেছে। একটা মাথা ভোলা গাড়ি থেকে রাজা হজরলিফ ও রানী নেমে এলেন। ও দিকে রাজা ইনগলফ ও রানী রাজপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজঘাটায় নামলেন। রাজা হজরলিপ তো রাজা ইনগলফের ছোট ভাই। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। ভাইকিংরা ধরাধরি করে রাজা ইনগলফের রাজকোষ সেই লম্বা সিন্দুকটা অন্য গাড়িটায় তুলে দিল। রাজা রানীরা ও রাজপুত্র সামনের গাড়িটায় চড়ল। গাড়োয়ান চাবুকের শব্দ করে প্রথম গাড়িটা ছেড়ে দিল। পরের গাড়িটিও ওটার পেছনে পেছনে চলল। সেই গাড়িতে বসল রাজা ইনগলফের সেনাপতি। রাজা হজরলিফের দুই সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে পেছনে পেছনে চলল।
রাজবাড়ির সদর দেউড়িতে পৌঁছল গাড়ি। দ্বাররক্ষীরা বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছিল। রাজাদের গাড়ি আসতেই ওরা মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানাল। গাড়ি রাজবাড়িতে ঢুকল। রাজা হজরলিফের বাড়ি তেমন বড় না। তবে মোটামুটি সাজানো গোছানো।
রাজবাড়ির অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন সবাই। রাজা ইনগলফ একটু বিশ্রাম নিলেন। তারপর মোমবাতির আলোর সামনে বসে মোটা পার্চমেনট কাগজে রাজা গুমন্ডকে চিঠি লিখতে বসলেন। লিখলেন–আমি প্রতিশ্রুতিমত সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্কালহল্টে চলে এসেছি। এবার আপনার প্রতিশ্রুতিমত রাজকুমারী মারিয়াকে মুক্তি দিয়ে প্রেরিত দূরে সঙ্গে এখানে পাঠিয়ে দিন। রাজা ইনগল তার সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন। চিঠি থিংভেলিরে পৌঁছে দিতে বললেন। সেনাপতি চিঠি এনে প্লিনিকে খবর দিল। প্লিনি এলে তাকেই চিঠি পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিল। প্লিনি তখনই ঘোড়ায় চড়ে রওনা হল থিংবেলিরের উদ্দেশ্য।
দিনের হিসেবে পরদিন প্লিনি ঘোড়ায় চড়ে ফিরে এল। কিন্তু সঙ্গে মারিয়া নেই। প্লিনি রাজবাড়িতে ঢুকল। রাজা ইনগলফকে একজন রক্ষী খবর দিতে গেল। রাজা ইনগলফ বেশ ব্যস্ত হয়ে বাইরের ছোট ঘরটায় ঢুকলেন। প্লিনি মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–রাজা গুমন্ড কোন চিঠি দেন নি। আপনাকে জানাতে বলেছেন যে তিনি প্রথমে রেভকজাভিক যাবেন। নতুন রাজ্যের অধিকার বুঝে নেবেন। তারপর আপনাকে চিঠি দেবেন। ততদিন মারিয়াকে বন্দিনী থাকতে হবে। রাজা ইনগলফ মাথা নিচু করে একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন–ঠিক আছে তুমি যাও। ফ্রান্সিসকে সংবাদটা দিয়ে যেও।
প্লিনি জাহাজে উঠে ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করল। সব কথা বলল। পাশে হ্যারিও ছিল। সব শুনে ফ্রান্সিস বলল বুঝলে হ্যারি আমি এই আশঙ্কাই করছিলাম। রাজা গুমন্ড দাঁও মারার এই সুযোগ সহজে ছেড়ে দেবে না। মারিয়ার মুক্তির বিনিময় ও অনেক কিছু চাইবে।
–তাহলে এখন কী করবে? হ্যারি বলল। ফ্রান্সিস শ্বাস ছেড়ে হতাশার ভঙ্গীতে দুহাত ছড়িয়ে বলল–কিচ্ছু করার নেই। এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকা।
প্লিনি বলল–রাজা গুমন্ডের কাছে আমাদের রাজার দূত হয়ে এর আগেও আমি গেছি। কথা বলে দেখেছি–অত্যন্ত ধুরন্ধর লোক। সব সময় প্যাঁচ কষছে কী করে আমাদের রাজাকে বিপদে ফেলা যায়।
–প্লিনি–ফ্রান্সিস বলল–যা বুঝতে পারছি গুমন্ডের বিরুদ্ধে রাজা ইনগলফকে কিছুতেই যুদ্ধে নামাতে পারবো না। কাজেই শেষ পর্যন্ত আবার আমাদের অভিযানে বেরোতে হবে। মারিয়াকে মুক্ত করতে হবে। তুমি তৈরী থেকো।
–নিশ্চয়ই। প্লিনি বলল। তারপর প্লিনি চলে গেল। দিনের হিসেবে কয়েকদিন পরেই প্লিনি সংবাদ নিয়ে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। রাজা গুমন্ড তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে রেভকজাভিকের দখল নিয়েছে। তারপর সমস্ত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি হানা দিতে সৈন্যদের ঢালাও হুকুম দিয়েছে। সৈন্যরা অবাধে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়ি হানা দিয়ে স্বর্ণমুদ্রা, দামী পাথর, গয়নাগাঁটি লুঠ করছে। কেউ বাধা দিতে এলে বা প্রতিবাদ করলে নির্দ্বিধায় হত্যা করছে। সাধারণ মানুষদের ওপরও সৈন্যরা নির্বিবাদে অত্যাচার উৎপীড়ন চালাচ্ছে। ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল–আমি জানতাম এটাই হবে। এখানেই শেষ নয়। গুমন্ড আরো স্বর্ণমুদ্রা দাবী করবে। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।
সত্যিই তাই ঘটল। রাজা গুমন্ডের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে দুজন দ্রুত এল রাজা ইনগলফের কাছে। রাজা গুমন্ড লিখেছে–আপনি রাজকোষ স্কালহল্টে নিয়ে গেছেন। ঐ রাজকোষ প্রেরিত দূতদের দিয়ে এখানে পাঠিয়ে দেবেন। রাজকোষ পেলেই রাজকুমারী মারিয়ার মুক্তি কথা বিবেচনা করা হবে।
রাজা ইনগলফ দূত দুজনকে বসিয়ে রেখে ছোটভাই রাজা হজরলিফ এর সঙ্গে কথা বলতে অন্দরমহল এলেন। সব শুনে রাজা হজরলিফ বললেন–রাজকুমারী মারিয়ার মুক্তির জন্য রাজকোষ এখন দিয়ে দাও।
রাজকুমারী মক্তি পাক তারপর দুজন মিলে সমস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিংভেলির আক্রমণ করবো।
–না-না-রক্তক্ষয় আমি চাই না। রাজা ইনগলফ বললেন?
–ঠিক আছে–সে সব পরে ভাবা যাবে। তুমি এখন রাজকোষ দিয়ে দাও।
–বেশ। রাজা ইনগলফ তার দেহরক্ষীদের আদেশ দিলেন। দেহরক্ষীরা ধরাধরি করে সেই লম্বাটে কালো ফুল লতাপাতার কাজ করা সিন্দুকটা অন্দরমহল থেকে নিয়ে এল। রাজা হজরলিফের একটা মাথাখোলা গাড়িতে তুলে দিল। রাজা গুমন্ডর দূত দুজনের একজন গাড়িতে বসে রইল। অন্যজন গাড়ি চালাল রেভকজাভিকের উদ্দেশ্যে।
ফ্রান্সিসরা প্লিনির কাছ থেকে এই সংবাদ পেল। ফ্রান্সিস পাশে বসা হ্যারির মুখের দিকে একবার তাকাল। কিন্তু কোন কথা বলল না। ভাইকিং বন্ধুরাও শুনল এই সংবাদ। তারা এসে ফ্রান্সিসকে বারবার বলতে লাগল–ফ্রান্সিস যুদ্ধ ছাড়া রাজকুমারী মারিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। তুমি রাজা ইনগলফকে বল–আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। বলল উপায় নেই। আমাদের হাত পা বাঁধা। মারিয়ার বাঁচামরা এখন রাজা গুমন্ডের হাতের মুঠোয়। আমরা নিরুপায়। হ্যারিও ভাইকিং বন্ধুদের একই কথা বুঝিয়ে বলল। বন্ধুরা রাগে ফুঁসে উঠল। কিন্তু নিজেদের অসহায়তার কথা ভেবে চুপ করে রইল।
আইসল্যান্ডে তো এখন শুধুই রাত। দিন বলে কিছু নেই। কাজেই দিন রাতের মোট হিসেবে কয়েকদিন পরেই প্লিনি এসে খবর দিল–রাজা গুমন্ড রেভজাভিক লুঠকরা ধনসম্পদ আর রাজকোষ নিয়ে থিংভেলিরে ফিরে গেছে। রেভকজাভিক রাজ এখন তার সেনাপতির অধীনে। তার হুকুমে রেভকজাভিকে অত্যাচার নিপীড়ন চলছে।
দিনকয়েক পরে থিংভেলির থেকে রাজা গুমন্ডের একজন দূত এল। সঙ্গে রাজা ইনগলফকে লেখা গুমন্ডের চিঠি। চিঠিতে গুমন্ড লিখেছে–আপনার রাজকোষ পেয়েছি। এবার আপনার বন্ধু ভাইকিংদের রাজাকে বলুন যেন উনি সোনার ঘণ্টা তার যাদুঘর থেকে বের করে আমাকে দিয়ে দেন। কারণ সোনার ঘণ্টা আমারই প্রাপ্য। তাহলেই তার মেয়ে মুক্তি পাবে। নইলে মুক্তির কোন আশা নেই।
রাজা ইনগলফ সমস্যায় পড়লেন। ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। অন্দরমহলে এলেন। ছোটভাই রাজ হজরলিফকে সব জানিয়ে বললেন এখন কী করবেন তিনি। দুজনেই সমস্যাটা নিয়ে ভাবলেন। কথা বললেন। তারপর রাজা হজরলিফ বললেন–দাদা তুমি চিঠি দাও। লেখ যে ভাইকিংদের রাজাকে সব জানিয়ে চিঠি দিচ্ছি। রাজা ইনগলফ দূতের হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠালেন। লিখলেন–আপনার দাবী জানলাম। আমি সবকিছু জানিয়ে একটা চিঠি দূত মারফৎ ভাইকিংদের রাজাকে জানাচ্ছি। মনে হয় মেয়ের মুক্তিপণের এই দাবী তিনি মেনে নেবেন। এজন্যে কিছু সময় যাবে। এরমধ্যে রাজকুমারীর যেন কোন ক্ষতি না হয়। দূত চিঠি নিয়ে চলে গেল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজে এসে প্লিনি সব সংবাদ ফ্রান্সিসকে জানাল। ফ্রান্সিস বিছানায় বসে ছিল। সব শুনে হ্যারিকে ডেকে বলল–চলো রাজা ইনগলফের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করব। একটু পরেই রক্ষী ওদের মন্ত্রণাকক্ষে নিয়ে এল। গদীআঁটা চেয়ারে ওরা বসল। একটু পরেই রাজা ইনগলফ কক্ষে ঢুকলেন। তিনজনেই উঠে দাঁড়িয়ে রাজাকে সম্মান জানাল। রাজা ইনগলফ হাতের ইংগিতে ওদের বসতে বললেন। বসল ওরা। রাজা চেয়ারে বসলে ফ্রান্সিস বলল–প্লিনির মুখে আমরা সব শুনলাম।
–তোমাদের রাজার মতামত জানাবার জন্যেই আমাকে সময় চাইতে হল। রাজা বললেন। বেশ চিন্তাভারাক্রান্ত দেখা দিল রাজাকে।
–আপনি সময় চেয়ে ভালোই করেছেন। এতে আমাদের কাজের সুবিধা হল। ফ্রান্সিস বলল।
–কোন কাজের কথা বলছো। রাজা জানতে চাইলেন।
–আমরা কয়েকজন মিলে আবার থিংভেলির যাবো। যে কেরই হোক মারিয়াকে মুক্ত করে আনবো। ফ্রান্সিস বলল। রাজা ইনগলফ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। মাথা তুলে বললেন–ফ্রান্সিস তুমি যথেষ্ট সাহসী বুদ্ধিমান। তোমাকে কিছু বলার নেই। কিন্তু এভাবে বিপদের মুখে এগিয়ে যাওয়া, যদি তোমাদের কিছু হয়?
–আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন হ্যারি বলল–ফ্রান্সিসরা বিপদে পড়লে আমরা সব ভাইকিং যাবো উদ্ধার করতে।
–তবু তোমাদের রাজা কী উত্তর দেন সেটা জানবার জন্যে তোমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত। রাজা বললেন।–না মাননীয় রাজা–ফ্রান্সিস বলল–এখনই ঠিক সময় অভিযানে বেরুবার। কারণ রাজা গুমন্ড এখন অনেক নিশ্চিন্ত। ও ভালো করেই জানে আমাদের রাজা তাঁর মারিয়াকে প্রাণের চেয়েও বেশী স্নেহ করেন ভালোবাসেন। সুতরাং আমাদের রাজা নিশ্চয়ই কন্যার জীবনের বিনিময়ে সোনার ঘণ্টা দিয়ে দিতে ইতস্তত করবেন না। কাজেই রাজা গুমন্ড এখন মারিয়াকে পাহারা দেবার ব্যাপারে একটু ঢিলে দেবেন। আমরা যে আবার হানা দিতে পারি–মারিয়াকে আবার মুক্ত করার জন্যে যেতে পারি এটা সে ভাবতেই পারবে না। তাই এই সুযোগ হাত ছাড়া করা চলবে না। রাজা ইনগলফ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–বেশ–দেখ চেষ্টা করে। ফ্রান্সিসরাও উঠে দাঁড়াল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে ওরা চলে এল।
সেইদিন জাহাজে ফিরেই ফ্রান্সিস হ্যারি, বিস্কো শাঙ্কো আর প্লিনিকে নিয়ে আলোচনায় বসল। কীভাবে অভিযান চালানো হবে বিপদের হাত থেকে বাঁচতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে–এই সব নিয়ে আলোচনা হল।
দিনের হিসেবে পরদিনই ফ্রান্সিস বিস্কো শাঙ্কো আর প্লিনি ঘোড়ার পিঠে চডে যাত্রা শুরু করল থিংভেলিরের উদ্দেশ্যে। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল প্লিনি।
পথে ওফাস নদী পড়ল। নদীর পাড়ে আছে একটা কাঠ বাঁধা ভেলার মত। বেশ বড়। নদীটি খুবই শান্ত। খুব বেশী বড়ও নয়। নদীর এপারে ওপারে এখানে ওখানে বরফ জমে আছে। দুটো ঘোড়া নিয়ে ফ্রান্সিস আর বিস্কো কাঠের ভেলাটায় উঠল। লম্বা কাঠের লগি বিস্কো ঠেলতে লাগল। আস্তে আস্তে নদী পার হয়ে ঘোড়া দুটো নিয়ে ওরা ওপারে নামল। কাঠের ভেলাটার সঙ্গে একটা লম্বা দড়ি বাঁধা ছিল। দড়ির মুখটা এপারে একটা ছোট গাছের সঙ্গে বাঁধা। প্লিনি এবার সেই দড়িটা ধরে টানতে লাগল। শূন্য ভেলাটা এপারে এল। এবার শাঙ্কো আর বিস্কো একইভাবে দুটো ঘোড়া নিয়ে নদী পার হল। এবার একটা পাতাঝরা বড় গাছের নিচে বসল ওরা। সঙ্গে আনা খাবার খেল। একটুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু।
কুয়াশা কোথাও ঘন কোথাও পাতলা। মাথার ওপর সাদা ধোঁয়াটে আকাশ। তারা ঢাকা পড়ে গেছে। স্নান আলো চারদিকে। সেই আলোয় পথ দেখে ওরা ঘোড়া ছোটাল।
পথে আর একবার বিশ্রাম নিল ওরা। খাওয়া দাওয়া করল। তারপর আবার ঘোড়া ছোটাল।
ঘণ্টা দশ-বারো কাটল। তারপর ওরা থিংভেলির নগরের দেয়ালের কাছে পৌঁছল। ঘোড়া থেকে নামল। ঘোড়াগুলোর লাগাম একটা গাছের গায়ে বেঁধে দিয়ে পায়ে হেঁটে নগরে প্রবেশ করল। দেখল কোন বাড়িতে আলো জ্বলছে না। তার মানে সবাই ঘুমুচ্ছে। পথে এখানে ওখানে পাথরের দেয়ালে জ্বলন্ত মশাল। এ পথ সে পথ ঘুরে দেয়ালের আড়ালে প্লিনি ওদের রাজবাড়ির পেছনে নিয়ে এল। এখানেই দেয়ালের গায়ে আছে সেই গোপন দরজাটা। চৌকোনো পাথরটা খুলল প্লিনি। খোঁদলে হাত বাড়িয়ে দেখল সেই কাঠের চাকাটা আছে। ও চাকাটা আস্তে আস্তে ঘোরাতে লাগল। অস্পষ্ট গোঁ গোঁ শব্দ তুলে কাঠের দরজাটা খুলে গেল। তার মানে ভাঙা চাকাটা মেরামৎ করা হয়েছে। ফ্রান্সিস কোমর থেকে বোয়াল খুলে খুব সন্তর্পণে পা ফেলে দরজা পেরিয়ে ঢুকল। দেখল এখানে ওখানে মশাল জ্বলছে বটে কিন্তু কোন প্রাসাদরক্ষী নেই কোথাও। ফ্রান্সিস মনে মনে হাসল। রাজা গুমন্ড এখন সোনার ঘণ্টার স্বপ্নে বিভোর এখন নিশ্চিন্তও। কাজেই আগের বারের মত প্রসাদরক্ষীর সংখ্যা বাড়ায় নি। তাছাড়া তাকে রেভকজাভিকে রাখতে হয়েছে। ফ্রান্সিস দরজা দিয়ে বাইরে এল। প্লিনি বলল।
-কী দেখলেন?
–একজন রক্ষীও চোখে পড়ল না। ফ্রান্সিস বলল?
–তাহলে চলো ঢুকে পড়ি। বিস্কো বলল।
–না এখন না। ফ্রান্সিস বলল। তারপর প্লিনির দিকে তাকিয়ে বলল–সৈন্যদের আস্তানা কোথায়।
প্লিনি আঙুল তুলে একটু দূরে উত্তর দিকে বেশ কয়েকটা টানা লম্বা পাথরের ঘর দেখাল। ঘরগুলোর ছাউনি এদেশীয় রীতি অনুযায়ী মোটা শুকনো ঘাসের।
ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে সবাইকে আসতে বলল। রাস্তা পেরিয়ে সবাই একটা দেয়ালের কাছে এল। দেয়ালের পাথরের খাঁজে দুটো মশাল আড়াআড়ি বসানো ছিল। দুটো জ্বলন্ত মশালই ফ্রান্সিস খাঁজ থেকে তুলে নিল। এবার একটা মশাল পাথরে ঘা মেরে নিভিয়ে ফেলল। অন্য জ্বলন্ত মশালটা হাতে নিয়ে উবু হয়ে বসল। মশালটা বিস্কোর হাতে দিল। তারপর নেভানো মশালটার মাথার দিক থেকে জড়ানো কাপড়ের লম্বা ফালি খুলতে লাগল। বেশ গরম। আস্তে আস্তে চারটে ফালি খুলে নিল। উঠে দাঁড়িয়ে শাঙ্কোকে বলল–শাঙ্কো, এগুলোর চারটে তীরের ফলায় জড়াও। শাঙ্কো এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ও দ্রুত হাতে চারটে তীরের ফলায় কাপরের ফালি জড়িয়ে ফেলল। ফ্রান্সিস বলল–তীরগুলোতে জ্বলন্ত মশাল থেকে আগুন ধরাও। তারপর সৈন্যদের ছাউনির ওপর ছুঁড়ে দাও। শাঙ্কো একটা তীরের ফলার কাপড়ে জ্বলন্ত মশাল থেকে আগুন ধরাল। তারপর নিশানা ঠিক করে ছুঁড়ল। কুয়াশার মধ্যে তীরটা উড়ে গিয়ে পড়ল। শুকনো মোটা ঘাসের ছাউনিতে সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে গেল। তারপর শাকো পরপর তিনটে জ্বলন্ত তীর ছুঁড়ল। সৈন্যদের সব ছাউনিতেই আগুন লেগে গেল। কিছু সৈন্য বোধহয় জেগেছিল। তারা আগুন আগুন বলে চিৎকার চাঁচামেচি শুরু করল।
এদিকে ফ্রান্সিস বলল–খোলা দরজা দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকবো। ঘোট সবাই, জলদি। চারজনে দ্রুত ছুটে অন্ধকার রাস্তাটা পেরিয়ে রাজবাড়িতে ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সিস ছুটতে ছুটতে বলল–প্লিনি, অন্দরমহলে নিয়ে চলো। রাজার শয়নকক্ষে। জলদি। ছুটল চারজন।
ওদিকে সৈন্যদের ছাউনিতে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সৈন্যরা সব বেরিয়ে এসেছে ছাউনি ছেড়ে। কাঠের বড় বড় বালতি নিয়ে অনেকেই ছুটে যাচ্ছে কাছের উষ্ণ প্রস্রবণের দিকে। ওখান থেকে জল এনে জল ছিটিয়ে আগুন নেভাবার চেষ্টা চলেছে। কুয়াশাভরা আকাশে আগুনের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে কালো ধোঁয়া।
রাজবাড়ির অন্দরমহলের রক্ষীরা ছুটে জানালার কাছে চলে এসেছে। সবাই আগুন দেখছে। অন্দরমহলের কাছে কোনো রক্ষী নেই।
ফ্রান্সিসরা রক্ষীদের দুটো ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা। চারজন রক্ষীর একেবারে সামনে পড়ে গেল। রক্ষীরা অবাক। এরা কোত্থেকে এল? ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল-শাঙ্কো-বিস্কো–ওদের প্রাণে মেরো না। আহত করো। বিস্কো আর শাঙ্কো তরোয়াল খুলে রক্ষীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো তরোয়ালের লড়াই। শাকো আর বিস্কো নিপুণ হাতে তরোয়াল চালাতে লাগল। একটুক্ষণের মধ্যেই দুজন রক্ষী হাতে কাঁধে তরোয়ালের ঘা খেয়ে মেঝেয় পড়ে গেল। বাকি দুজনের সঙ্গে লড়াই চলল। ফ্রান্সিস প্লিনির হাত ধরে টানল–চলো।
দুজন ঘরের পর ঘর পেরিয়ে চলল। একটা ঘরে দরজার সামনে দেখল দুজন রক্ষী। একজন ভোলা তরোয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যটি দরজায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে ঘুমোচ্ছ। হাতে ঠিক তরোয়াল ধরে আছে। ফ্রান্সিসদের দেখে জাগ্রত রক্ষীটি হকচকিয়ে গেল। পরক্ষণেই তরোয়াল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্লিনিও তরোয়াল হাতে এগিয়ে গেল। শুরু হলো দুজনের তরোয়ালের লড়াই। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে ঘুমন্ত রক্ষীটির হাত থেকে তরোয়ালটা ফেলে দিল। পাথরের মেঝেতে ঝনাৎ করে তরোয়ালটা পড়ে যাওয়ার শব্দে রক্ষীটি ঘুম ভেঙে চমকে চোখ চাইল। ফ্রান্সিস ততক্ষণে ওর গলায় নিজের তরোয়ালের ফলাটা ঠেকিয়ে বলল–রাজকন্যা মারিয়াকে কোন ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে? রক্ষীটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস তরোয়ালে আরো একটু চাপ দিল। বলল–বল–রাজকন্যা মারিয়া–কোথায়? রক্ষীটি এবার তাড়াতাড়ি দরজাটা দেখিয়ে বলল–এই ঘরে, ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীটির ঘাড়ের কাছে তরোয়ালের বাঁটটা দিয়ে একটা ঘা মারল। রক্ষীটি উঃ শব্দ করে মেঝেয় পড়ে গেল। ওদিকে প্লিনি তখনও অন্য রক্ষীটির সঙ্গে লড়াই করে চলেছে।
ফ্রান্সিস ঘরটার মধ্যে ঢুকল। বাইরের আগুন-আগুন চিৎকার আর লোকজনের হৈ-হল্লায় মারিয়ার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ও শুয়ে শুয়েই ভাবছিল কোথায় আগুন লেগেছে? এমন সময় ফ্রান্সিসের চাপা স্বরের ডাক শুনল–মারিয়া–মারিয়া।
মারিয়া দ্রুত বিছানায় উঠে বসল। দেখল সামনেই ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে। মারিয়া বিছানা থেকে নেমে এল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–এক মুহূর্ত দেরী নয়। শিগগির চলো। বলেই ও দরজার দিকে ছুটল। মারিয়াও পেছনে পেছনে ছুটল। ঘরের বাইরে এসে দেখল যে প্লিনি তখনও রক্ষীটির সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। প্লিনির পোশাক এখানে ওখানে তরোয়ালের ঘায়ে ছিঁড়ে গেছে। সারা দেহ রক্তাক্ত। ফ্রান্সিস বুঝলপ্লিনি আর আত্মরক্ষা করতে পারবে না। ফ্রান্সিস বুঝল রক্ষীটি তরোয়াল চালনায় নিপুণ। ফ্রান্সিস মনে মনে ওর প্রশংসা করল। কিন্তু হাতে সময় কম। ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘায়েল করতে হবে। ফ্রান্সিস দুএকবার আত্মরক্ষার ভান করেই দ্রুত লাফিয়ে উঠে নোকটার ডান কাঁধের কাছে তরোয়ালের কোপ বসিয়ে দিল। রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা তরোয়াল ফেলে কঁধ বাঁ হাতে চেপে ধরল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে রক্ষীটিকে বলল–আমাদের রাজার শয়নকক্ষে নিয়ে চলো। জলদি। বলেই হাতের তরোয়ালটা রক্ষীটির পিঠে চেপে ধরল। রক্ষীটি একটা কাতর শব্দ করে এগিয়ে চলল। ফ্রান্সিসরা ওর পেছনে পেছনে চলল। আহত প্লিনিও চলল।
রাজার শয়নকক্ষের দরজায় দুজন রক্ষী খোলা তরোয়াল হাতে পাহারা দিচ্ছিল। ঝোলানো মোমবাতির আলোয় ফ্রান্সিসদের আসতে দেখে তরোয়াল উঁচিয়ে ছুটে এল। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল–তোমরা যদি আমাদের আক্রমণ করো তাহলে তোমাদের এই বন্ধুটিকে আমি নিকেশ করে দেবো। রক্ষী দুজন থমকে দাঁড়াল। এবার ভালভাবে দেখল যে ফ্রান্সিস ওর তরোয়ালের ফলা রক্ষীটির পিঠে চেপে ধরেছে। রক্ষীটির কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে। ওরা তরোয়াল নামিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল।
সবাইকে নিয়ে ফ্রান্সিস রাজা গুমণ্ডের শয়নকক্ষে ঢুকল। দুতিনটে কাঁচ ঢাকা মোমবাতি জ্বলছে শয়নকক্ষে। দামী কাঠের সুদৃশ্য কারুকাজ-করা পালঙ্ক। পাখির পালকের নরম বিছানা। কিন্তু ফ্রান্সিসের তখন এসব দেখার সময় নেই। ও বিছানার দিকে তাকাল। রাজা গুমণ্ড বিছানায় নেই। রাজা গুমণ্ড কাঁচের কারুকার্য করা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে তাকিয়ে আগুন দেখছিল। সৈন্য ও লোকজনের আগুন-আগুন চিৎকার হৈ-হল্লায় রাজার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঐ জানালার কাছটা একটু অন্ধকারমতো। ফ্রান্সিস ঘরের চারদিকে তাকিয়েও বুঝতে পারল না রাজা কোথায় আছে। তখনই জানালার অন্ধকার জায়গাটি থেকে রাজা গুমণ্ড গলা চড়িয়ে বলল–তোমরা কে? কী চাও তোমরা? ফ্রান্সিস এবার রাজা গুমণ্ডকে দেখতে পেল। বলল–সেনাপতিমশাই–আপনার এখানে নির্বাসন হয়েছিল। এখন থিংভেলির রাজা হয়েছেন। রাজা তখনও ফ্রান্সিসকে চিনতে পারেননি। বলল–তুমি কে?
ফ্রান্সিস আলোর কাছে এগিয়ে এল।
এখন যদি নিরস্ত্র আপনাকে হত্যা করি? হেসে বলল–এবার চিনতে পারছেন?
–ও–ফ্রান্সিস। রাজা গুমণ্ড মৃদুস্বরে বলল।
–হ্যাঁ। সোনার ঘন্টা আনতে যাবার সময় আমাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে ছিলেন। এখন যদি নিরস্ত্র আপনাকে হত্যা করি? রাজা গুমণ্ড কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করল। যাকগে–ফ্রান্সিস বলল–আক্রান্ত না হলে আমি আক্রমণ করি না। নিজের জীবন বিপন্ন না হলে আমি নরহত্যা করি না। সামনে এগিয়ে আসুন।
রাজা গুমণ্ড এগিয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস দেখল অতীতের সেনাপতির মুখে চোখে বয়েসের ছাপ পড়েছে। কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে এখনও ধূর্তামি। ফ্রান্সিস বলল–আপনি আমার সামনে থাকবেন। আপনার পিঠে তরোয়ালের ফলা ঠেকিয়ে রাখবো আমি। এইভাবে আমরা নিরাপদে রাজবাড়ি থেকে বেরুবো। তারপর একইভাবে আপনাকে গাড়িতে চড়িয়ে রেভজাভিকে নিয়ে যাবো। কোনোরকম চালাকি করতে গেলে আপনাকে আমি তৎক্ষণাৎ হত্যা করবো। মনে থাকে যেন। কথাটা শেষ করেই ফ্রান্সিস এক লাফে রাজা গুমণ্ডের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। রাজার পিঠে তরোয়ালের ফলা চেপে বলল–চলুন। কিন্তু ধোঁকা দেবার চেষ্টা করবেন না।
রাজা মণ্ড বুঝল ফ্রান্সিসের কথামতোই তাকে এখন চলতে হবে। ওর কথার অবাধ্য হলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। কাজেই রাজা ধীরপায়ে শয়নকক্ষের দরজার দিকে চলল। ঠিক পেছনেই তরোয়াল ধরে ফ্রান্সিস। তারপর মারিয়া ও প্লিনি।
দরজার বাইরে আসতেই ফ্রান্সিস দেখল বিস্কো আর শাঙ্কোকে চার-পাঁচজন সৈন্য ঘিরে ধরেছে। তরোয়ালের প্রচণ্ড লড়াই চলছে। দুই বন্ধুরই গায়ের পোশাক তরোয়ালের ঘায়ে ছিন্নভিন্ন। কাঁধে, হাতে, বুকে রক্তের ছোপ।
রাজা গুমণ্ড ও ফ্রান্সিসকে দেখে সৈন্যরা লড়াই থামাল। মাথা নিচু করে রাজাকে সম্মান জানাল। ফ্রান্সিস বলল–ওদের অস্ত্রত্যাগ করতে বলুন। রাজা গুমণ্ড ডান হাত তুলে অস্ত্রত্যাগের ইঙ্গিত করল। সৈন্যরা তরোয়াল ফেলে দিল। পাথরের মেঝেয় শব্দ উঠল–ঝনাৎ-ঝনাৎ। হাঁপাতে হাঁপাতে বিস্কো আর শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। ফ্রান্সিস বলল–পেছনে পেছনে এসো। তারপর রাজাকে বলল–সৈন্যদের বলুন–গাড়ি তৈরি করে সিঁড়ির সামনে রাখতে। সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে সেই কথা বলল। ফ্রান্সিস বলল, জলদি। তিনজন সৈন্য ছুটে চলে গেল। দ্বাররক্ষী আর সৈন্যরা বুঝল-রাজার জীবন বিপন্ন। এখন ফ্রান্সিসদের আক্রমণ করলে রাজার প্রাণ যাবে। কাজেই ওরা সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। রাজাকে সামনে রেখে ফ্রান্সিসরা চলল বাইরের সিঁড়ির দিকে।
বাইরে রাজবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফ্রান্সিস দেখল রাজার ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কালো কাঠে সোনালি লতাপাতার কাজকরা গাড়ি। গাড়ির দুদিকে বসার আসন। চার ঘোড়ার খোলা গাড়ি।
.
রাজাকে সামনে রেখে ফ্রান্সিসরা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বলল–একটা আসনে মারিয়া বসবে। অন্যটায় আহত প্লিনিকে শুইয়ে ওর মাথা কোলে নিয়ে বিস্কো বসবে। রাজা গাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার পেছনে পিঠে তরোয়াল ঠেকিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো। শাকো তীর-ধনুক বাগিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। এবার ওঠো সবাই।
সবাই গাড়িতে উঠল। ফ্রান্সিসের নির্দেশমতো সবাই যে যার জায়গা করে নিল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে কোচওয়ানকে বলল–স্কালহল্ট চলল। বেচাল করেছে কি তোমাকে শেষ করে দেবো।
গাড়ি চলল। রাজবাড়ির প্রধান দরজার সামনে তখন বেশ কিছু সৈন্য নগরবাসী ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস রাজা গুমণ্ডের পিঠে তলোয়ারের চাপ দিয়ে। বলল–সৈন্যদের বলুন–কেউ যেন আমাদের বাধা দেবার চেষ্টা না করে। রাজা গুমণ্ড ডান হাত ওপরে তুলে সৈন্যদের লক্ষ্য করে সেকথা বলল। গাড়ি রাজবাড়ির থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ল। তারপর চলল স্কালহল্টের দিকে। পথের লোকজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে এই ঘটনা দেখল। একসময় নগর শেষ হলো। উন্মুক্ত প্রান্তর পড়ল। সেই প্রান্তরের টুকরো পাথর ছড়ানো রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটল রেভঞ্জাভিকের দিকে।
আকাশ-দিগন্তে অল্প আলো। সেই আলোও প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে নীলচে কুয়াশায়। রাস্তার এখানে ওখানে তুষার জমেছে। তার মধ্যে দিয়েই অল্প আঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি ছুটল।
ঘণ্টা কয়েক কেটে গেল। গাড়ি থামানো, বিশ্রাম, খাওয়া এসব কথা কারো মনেই পড়ল না। ফ্রান্সিস বার বার কোচোয়ানকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলছিল। চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কালহল্টে পৌঁছুতে। বলা যায় না রাজা গুমণ্ডের সৈন্যরা যদি একসঙ্গে ছুটে এসে ওদের ঘিরে ধরে তাহলে বিপদে পড়তে হবে। কাজেই গাড়ি ছোটাও যত জোরে পারো।
একসময় দূর থেকে কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে ওফাস নদী দেখা গেল। নদীর এই পারে এসে গাড়ি থামল। কাঠের ভেলাটা এপারেই ছিল। প্রথমে কোচোয়ান আর শাঙ্কো, প্লিনি, বিস্কো গাড়িটা তুলে ভেলায় ওঠাল। বিস্কো লগি ঠেলে নৌকোটা পার করল। দড়ি ধরে টেনে, কাঠের ভেলাটা আবার এপারে আনা হল। ঘোড়া চারটে পার করা হল। সঙ্গে প্লিনি আর কোচোয়ান। ঘোড়াগুলো ওপারে পৌঁছলো। ঘোড়াগুলো নামিয়ে আনল বিস্কো। কোচোয়ান ঘোড়াগুলো গাড়ির সঙ্গে জুড়তে লাগল। ততক্ষণে রাজা গুমণ্ড আর মারিয়া ভেলায় চড়ে এপারে এসে পৌঁছল গুমণ্ডের সামনে খোলা তরোয়াল হাতে প্লিনি দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। এবার ফ্রান্সিস ও শাঙ্কো ভেলায় চড়ে পার হতে লাগল। ভেলাটা নদীর মাঝামাঝি এসেছে এমনই সময় একটা ছোট বরফের চাঁই ভেসে এসে ভেলাটায় জোর ধাক্কা মারল, ভেলাটা লাফিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস টাল সামলাল কিন্তু শাঙ্কো পারল না। ছিটকে নদীর জলে পড়ে গেল। ওদিকে এই ঘটনা দেখে প্লিনি দুহাত তুলে লাফিয়ে উঠল। রাজা গুমণ্ডও এই সুযোগের প্রতীক্ষা করছিল। সে পেছন থেকে সেই হাত তোলা অবস্থায় প্লিনিকে এক ধাক্কা দিল। ও মুখ থুবড়ে কাদা বরফের মধ্যে পড়ে গেল। রাজা গুমণ্ড বিস্কো ছুটে আসার আগেই এক লাফে ছুটে গিয়ে তরোয়ালটা তুলে নিল। তারপর বিদ্যুৎবেগে গাড়িটায় লাফিয়ে উঠল। তরোয়লের ধারালো জায়গাটা মারিয়ার গলার কাছে ঠেকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল–তোমরা কেউ এক পা এগিয়ে এলে আমি মারিয়াকে হত্যা করবো। এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাবে ফ্রান্সিসরা কেউ কল্পনাও করেনি। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি লগি ঠেলে নদীর এপারে এসে পড়ল। কিন্তু আর এগোেল না। দাঁড়িয়ে পড়ল। ও ধরেই নিয়েছিল শাকো নদীর জল থেকে ভেলায় উঠে পড়েছে। কিন্তু শাঙ্কো জলে থেকেই সব ঘটনাটা দেখল। তারপর কাঁধের তৃনীরটা এক হাতে ধরে রেখে ডুব সাঁতার দিয়ে এপারে চলে এসেছে ততক্ষণে। মাথা না তুলে বরফ কাদা জলের মধ্যে দিয়ে সাদা কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে বুক হিঁচড়ে আস্তে আস্তে একটা বড় বরফ ঢাকা পাথরের চাইয়ের পেছনে গিয়ে আড়াল নিল। উত্তেজনার মাথায় রাজা গুমণ্ড শাঙ্কোকে লক্ষ্যই করতে পারল না। গুমণ্ড চেঁচিয়ে কোচোয়ানকে ডাকল। কোচোয়ান গাড়িতে উঠে নিজের আসনে বসল। গাড়ি জোতা হয়ে গেছে তখন। গুমণ্ড গলা চড়িয়ে হাঁকল–গাড়ি চালাও-জোরে। কোচোয়ান ঘোড়াগুলোর গায়ে চাবুক হাঁকাল। গাড়ি চলতে শুরু করল। ওদিকে ফ্রান্সিস, প্লিনি, বিস্কো সব পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না ওরা। যদি ওদের এগিয়ে যেতে দেখে রাজা গুমণ্ড মারিয়ার গলায় তরোয়াল বসিয়ে দেয়।
ওদিকে শাঙ্কো বরফ ঢাকা পাথরের আড়ালে বসে তীর পরিয়ে ধনুক বাগিয়ে ধরল। গাড়িটা হাত কুড়ি এগিয়েছে তখন। শাঙ্কোর নাক মুখ দিয়ে জোরে জোরে শাস পড়ছে তখন। মাত্রা একটা তীরে রাজা গুমণ্ডকে ঘায়েল করতে হবে। নিশানা নিখুঁত হওয়া চাই। ছিলা টেনে গভীর মনোযোগের সঙ্গে রাজা গুমণ্ডের তরোয়াল ধরা ডান বাহু লক্ষ্য করে শাঙ্কো তীর ছুঁড়ল। পাকা হাত শাঙ্কোর। সাদা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে তীরটা ছুটে এলো। লাগল ঠিক রাজা গুমণ্ডের ডান বাহুর ওপরের দিকে। রাজা গুমণ্ড আঃ শব্দ করে লাফিয়ে উঠল। হাত থেকে তোয়াল ছিটকে গাড়ির ভেতরেই পড়ল। মারিয়া নিচু হয়ে দ্রুত হাতে তরোয়ালটা তুলে নিয়ে বরফ কাদা জলে ফেলে দিল। রাজা গুমণ্ড বাঁ হাত দিয়ে টেনে তীরটা খুলে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। ও সামনের আসনে বসে পড়ল। গোঙাতে লাগল। মারিয়া চিৎকার করে ডাকল–ফ্রান্সিস–বিস্কো-শিগগির এসো। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিসরা কিছু দেখতে পারছিল না। কিন্তু মারিয়ার চিৎকার ওদের কানে পৌঁছাল। মারিয়া চিৎকার করে কোচোয়ানকে বলল–গাড়ি থামাও। কোচোয়ান গাড়ি থামাল। ফ্রান্সিসরা ছুটে এল। খোলা তরোয়াল হাতে গাড়ি ঘিরে দাঁড়াল। রাজা গুমণ্ড তখনও ডান বাহু বাঁ হাতে চেপে গোঙাচ্ছে। ফ্রান্সিস বুঝল শাঙ্কো তীর ছুঁড়ে গুমণ্ডকে ঘায়েল করেছে। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে শাঙ্কোকে খুঁজতে লাগল। একটু পরেই দেখল জলেভেজা পোশাক নিয়ে শাঙ্কো ক্লান্ত পায়ে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গেঁটে ওর দিকে আসছে। ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে শাঙ্কোকে জড়িয়ে ধরল। বিস্কোও গিয়ে জড়িয়ে ধরল।
আবার সবাই গাড়িতে উঠল। ক্লান্ত শাঙ্কো মারিয়ার পাশে বসল। রাজা গুমণ্ডের পাশে বসল বিস্কো। ফ্রান্সিস আর প্লিনি খোলা তরোয়াল হাতে গুমণ্ডের সামনে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে কোচোয়ানকে বলল–গাড়ি ছাড়ো–যত জোরে পারো চালাও। গাড়ি দ্রুত ছুটল। ফ্রান্সিস দেখল রাজা গুমণ্ডের পোশাকের ডান হাতের কাঁধের কাছে রক্তে ভিজে উঠেছে। গুমণ্ড অল্প অল্প গোঙাচ্ছে।
কুয়াশাও বরফ কাদা জলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি জোরে ছুটল। শপাং–শপং–চাবুকের শব্দ শোনা গেল। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে গাড়ি চলল।
বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে গাড়ি চলল। একসময় ম্লান আলোয় দূর থেকে দেখা গেল জ্বলন্ত মশালের আলোর বিন্দু। স্কালহল্ট আর দূরে নয়। গাড়ি চলল। ফ্রান্সিস এতক্ষণ এক মুহূর্তের জন্যে তরোয়াল নামায়নি। শাঙ্কোও তীর-ধনুক একভাবে ধরে আছে। বলা যায় না পথের ধারে তুষার ঢাকা পাথরের আড়ালে রাজা গুমণ্ডের সৈন্যরা ওৎ পেতে আছে কিনা।
কিছুক্ষণ পরে স্কালহল্ট নগরে গাড়ি প্রবেশ করল। এইবার ফ্রান্সিস তরোয়াল নামিয়ে কোমরের কোষে রাখল। শাঙ্কোও কাঁধে ধনুক ঝোলাল তীর রাখল কাঁধের তূনীরে।
বিস্কো আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল–ফ্রান্সিস, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ। বসো৷ ফ্রান্সিসও এতক্ষণে ভীষণ ক্লান্তিবোধ করল। ও আসনে বসে পড়ল। প্লিনি এখন অনেকটা সুস্থবোধ করছিল।
স্কালহল্ট নগরে বন্দরে তখন মানুষের কর্মচঞ্চল জীবন বয়ে চলেছে। দোকানে বাজারে নগরবাসীদের ভিড়। প্রায় সকলেই দেখল গাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা রাজা গুমণ্ডকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলন্ত গাড়ির পেছনে মানুষের জটলা ছুটে এল। রাজবাড়ির সামনে যখন গাড়ি এল তখন চারদিকে মানুষের ভিড়ে ছয়লাপ। সবাই ফ্রান্সিসদের দেখছে–দেখছে গাড়িতে আহত রাজা গুমণ্ডকে। কিন্তু ওরা কেউই বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কী?
রাজবাড়ির সদর দেউড়ি খোলাই ছিল। দ্বাররক্ষীরা পথ ছেড়ে দিল। গাড়ি রাজবাড়ির চত্বরে ঢুকল। থামল এসে সিঁড়ির সামনে। এর মধ্যে রাজবাড়ির অন্দরমহলে সংবাদ পৌঁছে গেছে যে, ফ্রান্সিসরা মারিয়াকে মুক্ত করে রাজা গুমণ্ডকে বন্দী করে নিয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস একজন দ্বাররক্ষীকে ডেকে রাজামশাইকে আসার জন্য বলে পাঠাল।
একটু পরেই রাজা ইনগল হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। উনি খবরটা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি। বন্দী রাজা গুমণ্ডকে দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ফ্রান্সিস গাড়ি থেকে নেমে রাজা ইনগলফকে সম্মান জানিয়ে বলল–মারিয়া এখন মুক্ত। রাজা মণ্ডকেও বন্দী করে এনেছি। এবার আপনার চিরশত্রুর ব্যবস্থা কী করবেন করুন।
–তোমরা ভেতরে আসবে না? রাজা বললেন।
–না। আমরা খুব পরিশ্রান্ত। আমাদের এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। মারিয়াকে নিয়ে এই গাড়িতেই আমরা জাহাজে ফিরে যাবো। তবে প্লিনি থাকবে। ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিন।
বেশ। রাজা ইনগলফ বললেন। তারপর রাজা গুমণ্ডকে বললেন–আপনি নেমে আসুন। আপনার বিচার হবে। রাজা গুমণ্ড কোনো কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। প্লিনিও নামল। তারপর রাজা ইনগলফের পেছনে পেছনে রাজা গুমণ্ড ও প্লিনি রাজপুরীতে প্রবেশ করল। ফ্রান্সিস কোচওয়ানকে গাড়ি জাহাজঘাটায় নিয়ে যেতে বলল।
গাড়ি চলল জাহাজঘাটার দিকে।
জাহাজঘাটায় গাড়ি এসে থামল। ফ্রান্সিসদের দেখে ওদের বন্ধুদের আর তর সইল না। ওরা ছুটে জাহাজ থেকে পাটাতনের ওপর দিয়ে নেমে এল। গাড়ি থেকে ফ্রান্সিস নামতেই হ্যারি ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। হ্যারির চোখে জল এল। ফ্রান্সিস হ্যারির পিঠে মৃদু চাপড় দিতে দিতে বলল–এই–ছেলেমানুষি করো না। তারপর হ্যারিকে ছেড়ে দিয়ে ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল–সব বলবো। তার আগে জাহাজে চলো। গরম গরম ভেড়ার মাংস আর রুটির ব্যবস্থা করো।
দল বেঁধে সবাই জাহাজে উঠে এল।
দিনের হিসেবে পরদিনই রাজা ইনগলফ প্লিনিকে ফ্রান্সিসের কাছে পাঠাল। প্লিনি বলল–মহামান্য রাজা ইনগল আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়িতে এল। মনাকক্ষে রাজা এসে বসলেন। সঙ্গে সেনাপতি। রাজা ইনগলফ বললেন–ফ্রান্সিস-এখন তো আর এখানে থাকার মানে হয় না। ভাবছি–ঘণ্টা কয়েক পরে সৈন্যদের নিয়ে আমি, রানী ও রাজপুত্র রেভজাভিক ফিরে যাবো।
–না মাননীয় রাজা–এখনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে রেভজাভিক যাবেন না। বরং আপনি, মহামান্যা রানী ও রাজপুত্র আমাদের জাহাজে ফিরে চলুন। বন্দী রাজা গুমণ্ডকেও আমরা পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবো। রেভকজাভিক পৌঁছে রাজা গুমণ্ডের সেনাপতি ও সৈন্যদের অস্ত্রত্যাগে বাধ্য করাবো। যদি তার আগেই আপনার সৈন্যবাহিনী রেভঞ্জাভিক পৌঁছে যায় তাহলে সাংঘাতিক যুদ্ধ লেগে যাবে। কারণ রেভঞ্জাভিকে রাজা গুমণ্ডের সেনাপতি ও সৈন্যরা এখনও জানে না যে রাজা গুমণ্ড আমাদের হাতে বন্দী, কাজেই আপনার সেনাপতিকে আদেশ দিন তিনি যেন দিনের হিসেবে চারদিন পর তার অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে রেকজাভিক যাত্রা করেন। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস ঠিকই বলেছে মাননীয় রাজা। হ্যারি বলল।
রাজা ইনগলফ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন–সেনাপতি আপনি কী বলেন?
–হ্যাঁ মহামান্য রাজা–ফ্রান্সিস সঠিক পরামর্শই দিয়েছেন। সেনাপতি বলল।
–বেশ তাই হবে। রাজা চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ফ্রান্সিসরাও উঠে দাঁড়াল। রাজাকে সম্মান জানিয়ে ওরা জাহাজে ফিরে এল। ফ্রান্সিস সব ভাইকিং বন্ধুদের ডেকে বলল–রাজপরিবার আমাদের জাহাজে চড়ে রেভঞ্জাভিক দিয়ে যাবেন। বন্দী রাজা গুমণ্ডকেও আমরা এই জাহাজেই নিয়ে যাবো। একটা নির্দিষ্ট কেবিন ঘরে তাকে বন্দী করে রাখা হবে। হুঁশিয়ার গুমণ্ড যেন আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে না পারে।
জাহাজে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। আগেই সেই বড় কেবিন ঘরটাই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হল। বন্দী রাজা গুমণ্ডের ঘরটাও তৈরি রাখা হল। এবার প্রতীক্ষা–রাজপরিবার কখন আসে। গুমণ্ডকে কখন নিয়ে আসা হবে।
দিনের হিসেবে পরদিন রাজা হজরলিফের রাজকীয় গাড়ি চড়ে রাজা ইনগলফ রানী ও রাজপুত্র এল। নির্দিষ্ট ঘরে তাদের আপ্যায়ণ করে নিয়ে আসা হল। রাজকীয় গাড়ির পেছনে এল একটা সাধারণ গাড়ি। তাতে হাত বাঁধা অবস্থায় রাজা গুমণ্ড। গুমণ্ডর ডানবাহুতে কাঁধে কম্বলের ফেট্টি জড়ানো। রাজার চারজন সৈন্য খোলা তরোয়াল হাতে সেই গাড়িটা পাহারা দিতে দিতে নিয়ে এল। রাজা গুমণ্ডকে তার নির্দিষ্ট কেবিনঘরে রাখা হল। পাহারাদার সেই চারজন সৈন্য তো রইলই ভাইকিংরাও সব সময়ের জন্য দুজন রইল।
নোঙর তোলা হল। জাহাজ চলল রেভকজাভিকের উদ্দেশ্যে। রাজা ইনগলফ আর রাণীর মন এখন অনেক ভালো। তারা মাঝে মাঝে ডেকে উঠে আসেন। ফ্রান্সিস, হ্যারি এবং তাদের ভাইকিং বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-টল্প করেন। সবচেয়ে খুশী রাজকুমার। সে সারা জাহাজ টহল দিয়ে বেড়ায়। ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হলেই চলে আসে ফ্রান্সিসের কেবিনে। বলে গল্প বলো। ফ্রান্সিসের জীবনে তো ঘটনা কম নেই। ও সেইসব গল্প বলে। গল্প শেষ হলেই রাজকুমার ছোটে টহল দিতে।
জাহাজ রেভজাভিক বন্দরে পৌঁছল। রেভজাভিক এখন রাজা গুমণ্ডের সেনাপতি সৈন্যদের দখলে। কাজেই ফ্রান্সিসরা আগে থেকেই অস্ত্রহাতে তৈরী হল। জাহাজঘাটায় জাহাজ ভিড়ল। ভাইকিংরা পাটাতন ফেলল। বন্দরে রাজা গুমণ্ডের সৈন্যরা পাহারায় ছিল। জাহাজ দেখে এবং সশস্ত ভাইকিংদের দেখে ওদের মনে সন্দেহ হল। ওরা পরস্পরকে ডাকাডাকি করে একত্র করল। প্রায় দশ পনেরোজন সৈন্য জাহাজঘাটায় খোলা তরোয়াল হাতে সারি দিয়ে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসও এটাই চাইছিল। রাজা গুমণ্ড এখন বন্দী এবং ওদের কজায় এটা গুমণ্ডের সৈন্যরা ও সেনাপতি জানুক। ফ্রান্সিস ওর তরোয়ালটা হ্যারিকে রাখতে নিল। তারপর পাতা পাটাতন দিয়ে নেমে জাহাজঘাটে এল। গুমণ্ডের সৈন্যরা খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে এল। ফ্রান্সিস দুহাত ওপরে তুলে চিৎকার করে বলল–আমি নিরস্ত্র। আমি যুদ্ধ করতে আসেনি। একজন মোটামত সৈন্য এগিয়ে এল
–তোমরা কোত্থেকে এলে?
–স্কালহল্ট থেকে। ফ্রান্সিস বলল।
–কী চাও তোমরা? সৈন্যটি বলল।
–তোমরা তোমাদের সেনাপতিকে সংবাদ দাও যে রাজা গুমণ্ড তাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। আমি সেই চিঠি দিতে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল। তখনই একটি সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে সেখানে এল। মোটা সৈন্যটি অশ্বারোহী সৈন্যকে বলল চিঠির কথা। সৈন্যটি ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–চিঠিটা আমাকে দিন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।
–না–সেনাপতিকে এখানে আসতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। অশ্বারোহী সৈন্যটি আর কোন কথা না রলে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছোটাল। ফ্রান্সিস জাহাজে উঠে এল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজা ইনগলফের কালো রঙের সোনালি লতাপাতার কাজ করা গাড়িটায় চড়ে সেনাপতি এল।
এবার ফ্রান্সিস রাজা গুমণ্ডকে হাতবাঁধা অবস্থায় এনে ডেকে দাঁড় করালা। পেছন থেকে তরোয়ালের ডগাটা রাজা গুমণ্ডের পিঠে ঠেকিয়ে রাখল। সেনাপতি রাজা গুমণ্ডের এই বন্দীদশা দেখে হতবাক। ততক্ষণে জাহাজঘাটায় অনেক লোক জড় হয়েছে। তারাও কম আশ্চর্য হল না। রেভজাভিকের অধিবাসীদের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে তোক জাহাজঘাটায় এসে ভীড় করতে লাগল।
এবার ফ্রান্সিস বলল–রাজা গুমণ্ড–আপনার সেনাপতিকে হুকুম দিন সব সৈন্য যেন এক্ষুণি অস্ত্রত্যাগ করে। রাজা গুমণ্ড একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সেনাপতিকে লক্ষ্য করে বলল–সব সৈন্যকে অস্ত্রত্যাগ করতে বলল। সেনাপতি রাজা গুমণ্ডের অবস্থাটা সহজেই বুঝল। সে গাড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল–সৈন্যগণ–রাজা গুমণ্ডের জীবন বিপন্ন। তোমরা অস্ত্রত্যাগ কর। উপস্থিত সব সৈন্যরা হাতের তরোয়াল, কাঁধের তীর ধনুক পাথর বাঁধানো জাহাজঘাটায় ফেলে দিল। শব্দ উঠলঝন্ ঝন্ ঝনাৎ। তখনই বিস্কো তরোয়াল হাতে–আর শাঙ্কো ধনুক বাগিয়ে দ্রুত জাহাজ থেকে নেমে এল। পাথুরে জাহাজঘাটা থেকে সব অস্ত্র তুলে নিয়ে একপাশে জড়ো করে রাখল। তারপর দুজনে অস্ত্রগুলি পাহারা দিতে লাগল।
ফ্রান্সিস রাজা গুমণ্ডকে বলল–সেনাপতিকে হুকুম দিন সব সৈন্য জড়ো করে উনি যেন এক্ষুণি রাজবাড়ির উত্তরের প্রান্তরে চলে যান। একজন সৈন্যও যেন রেভাভিক নগরে না থাকে। রাজা গুমণ্ড চেঁচিয়ে সেই কথা সেনাপতিকে বলল। উপস্থিত সৈন্যরা দল বেঁধে উত্তরের প্রান্তরের দিকে চলল। সেনাপতি গাড়ি থেকে নেমে একটা ঘোড়ায় চড়লো। ছুটল সৈন্যদের ছাউনিতে রাজা গুমণ্ডের এই আদেশ জানাতে।
ফ্রান্সিস প্লিনিকে ডেকে বলল–নেমে গিয়ে একটা সাধারণ ঘোড়ায় টানা গাড়ি নিয়ে এসো। প্লিনি জাহাজ থেকে নেমে গেল গাড়ির খোঁজে। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–যাও রাজপরিবারকে নিয়ে এসো। হ্যারি চলে গেল।
একটু পরেই রাজা ইনগলফ রানী আর রাজকুমার জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালেন। রাজা রানী ও রাজকুমারকে দেখে জাহাজঘাটায় জড়ো হওয়া রেভজাভিকের অধিবাসীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। সত্যিই তারা রাজাকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করে। তারা উল্লাসে করতালি দিতে লাগল। রাজা ইনগলফ মৃদু হেসে ডান হাত তুলে কয়েকবার নাড়লেন। তারপর রানী ও রাজকুমারকে নিয়ে পাটাতন দিয়ে নামতে লাগলেন। জনতা সোল্লাসে ধ্বনি দিল–আমাদের রাজার–জয় হোক। আমাদের রাজা–দীর্ঘজীবী হোন।
রাজা, রানী, রাজকুমার কালো গাড়িটায় গিয়ে উঠলেন। লোকেরা সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দিল। গাড়ি চলল রাজবাড়ির উদ্দেশে।
ততক্ষণে প্লিনি একটা সাধারণ গাড়ি নিয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে রক্ষী সেই চারজন সৈন্যকে ডাকল। বলল–রাজা গুমণ্ডকে ঐ গাড়িতে চড়াও। পাহারা দিয়ে রাজবাড়িতে নিয়ে যাও। সাবধান–পালাতে না পারে।
এবার চারজন সৈন্যের পাহারায় রাজা গুমণ্ড পাতা পাটাতন দিয়ে নেমে এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলল। মাঝখানে রাজা গুমণ্ডকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। চারপাশে চারজন সৈন্য খোলা তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে রইল।
জনতা স্তব্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। রাজা গুমণ্ড এই রেভজাভিকে কিছুদিন রাজত্ব করে গেছে। তার হুকুমেই তার সৈন্যরা যে নিষ্ঠুর নিপীড়ন চালিয়েছিল রেভাভিকের মানুষদের ওপর তা তারা ভুলতে পারেনি। হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে কে চিৎকার করে উঠল খুনী শয়তান রাজা গুমণ্ড। তারপরই একজন রাস্তা থেকে একটা পাথরের টুকরো ছুঁড়ল রাজা গুমণ্ডকে লক্ষ্য করে মুহূর্তে জনতা উন্মত্তের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই গাড়ির ওপর। চারজন সৈন্য বহুকষ্টে ভীড় ঠেকাল। এইবার শুরু হল রাজা গুমণ্ডের ওপর পাথর বৃষ্টি। সৈন্যরা আত্মরক্ষার জন্যে গাড়িতে বসে পড়ল। পাথরের ঘায়ে রাজা গুমরে কপাল মাথা ফেটে গেল। দর দর করে রক্ত পড়তে লাগল। সারা শরীর রক্তাক্ত হল। রাজা গুমণ্ড জ্ঞান হারিয়ে গাড়ির মধ্যে পড়ে গেল। পাথর ছোঁড়া বন্ধ হল। গাড়ির কোচোয়ান এবার জোর গাড়ি চালাল। গাড়ির পেছনে পেছনে আরও কিছু লোক ছুটে আসতে লাগল চিৎকার করতে করতে।
গাড়ি রাজবাড়ির সদর দেউড়ি পেরিয়ে খোলা চত্বরে ঢুকল। তারপর রক্ষী সৈন্যদের নির্দেশ অনুযায়ী–পূবকোনায় কয়েদ ঘরের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। রাজা গুমণ্ডের তখন জ্ঞান ফিরেছে। একে বাহুতে শাকোর তীরের ক্ষত তারপর এই পাথর বৃষ্টি রাজা গুমণ্ডের তখন উঠে দাঁড়াবার শক্তিও অবশিষ্ট নেই। সৈন্যরা ধরাধরি করে রাজা গুমণ্ডকে কয়েদ ঘরে ঢুকিয়ে দিল। রাজা গুমরে নাক মুখ থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। •
দিনের হিসেবে পরদিন প্লিনি ফ্রান্সিসদের জাহাজে এল। রাজা ইনগলফ ফ্রান্সিস ও মারিয়াকে ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করেছেন। এ নিমন্ত্রণ জানাতেই রাজা প্লিনিকে পাঠিয়েছিলেন। প্লিনির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফ্রান্সিসের মনে পড়ল সেই ছোট্ট গীর্জাটা ঘিরে ছোট্ট গ্রামটার কথা। মারিয়া পাশেই বসে ওদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার ফ্রান্সিস সেই ছোট্ট গ্রামটার কথা, সেই ছুঁচলো দাড়ি গোঁফঅলা দলপতির কথা সব মারিয়াকে বলল। মারিয়া সব শুনে বলল–চলো না সেই ছোট্ট গ্রামটা দেখে আসি।
–বেশ চলল। ফ্রান্সিস বলল। ওর নিজেরও খুব ইচ্ছে করছিল সেই গ্রামটায় যেতে। তাই প্লিনিকে বলল।
–প্লিনি–তিনটি ভালো ঘোড়ার ব্যবস্থা করো। আমরা তিনজনে ঐ ছোট্ট গ্রামটায় যাবো। প্লিনি উঠে দাঁড়াল।
বলল–আমি এক্ষুনি ঘোড়া নিয়ে আসছি। আপনারা তৈরী হোন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লিনি ঘোড়া নিয়ে জাহাজঘাটায় এল। তারপর ফ্রান্সিস মারিয়া ও প্লিনি ঘোড়া ছোটাল সেই ছোট্ট গ্রামটার উদ্দেশ্যে। প্লিনি সামনে থাকল। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
মাথার ওপর আকাশ। আকাশে ম্লান আলো। চারপাশে পাতলা সাদাটে কুয়াশার আস্তরণ। তার মধ্যে দিয়ে ওরা ঘোড়ায় চড়ে চলল।
বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। এক সময় ওরা সেই ছোট্ট গ্রামটায় পৌঁছল। দেখল সেই ছোট গীর্জাটা। গীর্জাটাকে ঘিরে পাথরের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। বোঝা গেল সবাই জেগে আছে।
ঘোড়া থেকে নামল ওরা। গীর্জার লাগোয়া পাদ্রীমশাইয়ের সেই ঘরের দরজায় এসে ওরা দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বন্ধ দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে দাঁড়াল সেই চালো দাড়ি গোঁফওলা দল নেতা, দাড়ি গোঁফ আছে, তবে মোম দিয়ে মেজে চালো করা নেই। লোকটা মোমবাতির আলোয় একটা মোটা চামড়ার বই পড়ছিল। বোধহয় বাইবেল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে বলল–চিনতে পারো? লোকটা সঙ্গে ফ্রান্সিসকে চিনল। ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিসও হেসে ওকে জড়িয়ে ধরল। ওর পিঠে আদরের চাপড় দিল। আলিঙ্গন আলগা করে ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখিয়ে বলল–মারিয়া–আমার স্ত্রী। লোকটি মারিয়াকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। বলল–বসুন–বসুন। তিনজনে বেঞ্চিতে বসল।
–তোমার নাম কী ভাই? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
ইসলিফ। তারপর ইসলিফ বলল–আপনার নাম আমি জানি না। কিন্তু আপনি আমার সমস্ত জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। আমি আজ অন্য মানুষ। ফ্রান্সিসও ভালো করে ইসলিফকে দেখল। সত্যি ইসলিফের পরনে চাষীদের পোশাক। চোখে মুখে শান্ত ভঙ্গী। ইসলিফ একটা ছেলেকে ডাকল। বলল–সবাইকে বল আমার পরম বন্ধু এসেছেন। ছেলেটা চলে গেল। একটু পরেই কিছু লোকজন এল। সেই স্ত্রীলোক দুজনও এল। তারা ফ্রান্সিস আর প্লিনিকে দেখে চিনল। বার বার বলতে লাগল–আপনারা সেদিন আমাদের সকলের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। আপনারা বসুন। না খাইয়ে আপনাদের ছাড়বো না।
অল্পক্ষণের মধ্যেই স্ত্রীলোকেরা খাবারের আয়োজন করল। গরম গরম গোল রুটি, ভেড়ার মাংস আর নানা সজির তরকারির মত। ওরা খেতে লাগল। খুব সুস্বাদু রান্না। ফ্রান্সিস গোগ্রাসে খেতে লাগল। হঠাৎ ইসলিফ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্না ভেজা গলায় বলল
ভাবলে আমার দুঃখে কষ্টে বুক ভেঙে যায়–কী অশান্ত কী বিশ্রী জীবন আমি কাটিয়েছি। বিশ্বাস করুন–আজ আমার মনে অপার শান্তি অসীম তৃপ্তি। আমার বাকী জীবন আমি উৎসর্গ করেছি এই ছোট্ট গ্রামটার মানুষদের জন্যে। কথাটা শুনে ফ্রান্সিস খুশী হল। মৃদু হেসে ইসলিফের পিঠ চাপড়াল। মারিয়া খেতে খেতে স্ত্রীলোকদের সঙ্গে গল্প করতে লাগল।
ওরা যখন ফিরে আসার জন্যে ঘোড়ায় উঠল ছোট্ট গ্রামের মানুষগুলো ওদের ঘিরে ধরল। বারবার বলতে লাগল–আবার আসবেন।
ফ্রান্সিসরা ঘোড়া ছোটাল রেভজাভিকের উদ্দেশ্যে। ঘোড়া চালাতে চালাতে ফ্রান্সিস ডাকল–মারিয়া।
–বলো। মারিয়া বলল।
–দেখ–জীবনে অনেক মূল্যবান জিনিস আমি অনেক কষ্টে আবিষ্কার করেছি উদ্ধার করেছি। তাতে খুশী হয়েছি। কিন্তু ইসলিফের জীবনধারা বদলাতে পেরেছি দেখে আমার সমস্ত মনপ্রাণ কী এক আনন্দে তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
মারিয়া একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল–তোমার আনন্দে আমিও আনন্দিত। তোমার তৃপ্তিতে আমারও তৃপ্তি। ফ্রান্সিস বলল–প্লিনি–ভেড়া চড়ায় যারা তাদের সেই গানটা গাও না। প্লিনি হাসল। তারপর গলা চড়িয়ে সেই গানটা গাইতে লাগল। একটু পরে ফ্রান্সিস প্লিনির গলার সঙ্গে গলা মেলাল। মারিয়াও যোগ দিল। তিনজনের মিলিত কণ্ঠের গানের সুর দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
একসময় দূর থেকে রেভজাভিক নগরের আলো ওরা দেখল। নগরে প্রবেশ করল ওরা। ফ্রান্সিস বলল–প্লিনি–রাজা গুমণ্ড যে কয়েদঘরে বন্দী আছে সেখানে আমাদের নিয়ে চলল।
–বেশ চলুন। প্লিনি বলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজবাড়িতে প্রবেশ করল ওরা। চত্বর পেরিয়ে প্লিনি ওদের কয়েদ ঘরের দরজায় নিয়ে এল ওদের। দরজার দুপাশে চারটে মশাল জ্বলছে। রক্ষীরা খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে। ঘোড়া থেকে তিনজনে নামল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে একজন রক্ষীকে বলল-দরজা খোল। রাজা গুমণ্ডের সঙ্গে আমার কথা আছে। রক্ষীরা ফ্রান্সিসকে চিনল। প্লিনিও বলল ওদের। একজন গিয়ে দরজার বড় তালাটা খুলল। লোহার গারদ বসানো দরজাটা খুলল। তিনজনে ভেতরে ঢুকল। মশালের আলোয় দেখল একটা লম্বাটে পাথরের ওপর রাজা গুম কম্বল গায়ে শুয়ে আছে। ওদের ঢুকতে দেখে গুমণ্ড উঠে বসল। ফ্রান্সিস বলল–আপনার চিকিৎসা হয়েছে? গুমণ্ড কোন কথা না বলে মাথা নেড়ে বোঝাল চিকিৎসা হয়েছে।
ফ্রান্সিস বলল–রাজা গুমণ্ড–আপনার রাজত্বের নমুনা আমরা থিংভেলিরে দেখে এসেছি। আপনার সৈন্যদের অত্যাচারে নিপীড়নে আপনার নিরীহ প্রজারা জর্জরিত। মাত্র কয়েকদিন এই রেভজাভিকে রাজত্ব করে গেছেন। সেই কয়দিন যে অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন তার স্মৃতি এখানকার মানুষ ভুলে যায়নি। তাই জাহাজঘাটায় আপনার প্রতি তীব্র ঘৃণায় ওরা আপনাকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। ফ্রান্সিস থামল। রাজা গুমণ্ড মুখ নিচু করে রইল। ফ্রান্সিস বলল–এই ঘটনা দেখে সহজেই অনুমান করতে পারছেন থিংভেলিরে আপনার প্রজাদের মনোভাব। তাই বলছিলাম–সারা জীবন তো নিষ্ঠুর উল্লাসে শুধু মানুষ হত্যা করেছেন আর নিপীড়ন অত্যাচার চালিয়েছেন। আজা আপনার ভাববার সময় এসেছে বাকী জীবনটা আপনি কীভাবে কাটাবেন। ফ্রান্সিস থামল। এতক্ষণে রাজা গুমণ্ড মুখ তুলে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস থামল। এতক্ষণে রাজা গুমণ্ড মুখ তুলে ফ্রান্সিসের দিকে
তাকাল। ফ্রান্সিস বলল–আপনার কি এর জন্য কোন অনুশোচনা হয় না? রাজা গুমণ্ড একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন–সেদিন জাহাজঘাটে যেভাবে আমাকে অপমানিত লাঞ্ছিত করল এখানকার অধিবাসীরা তাতে একটা কথা বুঝলাম যে আমাকে আমার প্রজারা কী ঘৃণা করে। একটু থেমে রাজা গুমণ্ড বলল–আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। কিন্তু আমার তো জীবন শেষ হয়ে যাবে এই কয়েদঘরেই।
–না ফ্রান্সিস বলল–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করববা আপনার মুক্তির জন্যে যদি আপনি প্রতিশ্রুতি দেন যে প্রজাদের মঙ্গল ছাড়া বাকী জীবন আপনি আর কিছু ভাববেন না।
–যদি সত্যিই আমি থিংভেলির রাজ্যের রাজপদ ফিরে পাই আমি সর্বতোভাবে প্রজাদের কল্যাণসাধন করবো। রাজা গুমণ্ড বলল।
–বেশ। ফ্রান্সিস বলল–আমি বিশ্বাস করি আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি সতোর সঙ্গে রক্ষা করবেন। আপনাকে মুক্তি দেবার জন্যে আমি রাজা ইনগলফকে অনুরোধ করবো। মনে হয় তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করবেন। ফ্রান্সিস ফিরে দাঁড়াল। মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এল।
তারপর ফ্রান্সিসরা জাহাজে ফিরে এল। দিন কাটতে লাগল। ফ্রান্সিস ঘুমোনোর আগে পর্যন্ত কবি আরির বইয়ে পাওয়া ছবি আর নক্সাটা দেখে। কিন্তু তার রহস্য আর উদ্ধার করতে পারে না।
দুএকদিন পরে পরে মারিয়া অথবা হ্যারিকে নিয়ে লোগবার্গে যায়। ঘুরে ঘুরে স্তম্ভগুলো দেখে, প্রদীপ দেখে, ঘাসে ঢাকা জায়গাটা দেখে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। ফ্রান্সিস এখানে এলেই সেই বৃদ্ধ লোকটির ঘরে যায়। বৃদ্ধটির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। বৃদ্ধটির নাম হ্রোলগ। সে আইসল্যাণ্ডের পুরোনো দিনের অনেক গল্প করে। কিন্তু সপ্তম স্তম্ভের ব্যাপারে ফ্রান্সিস আর নতুন কিছু জানতে পারে না। হ্রোলগ সেই পুরোনো কথাটাই বলে–আর একটা স্তম্ভ রাজা ফ্রোকি নাকি পুঁতেছিলেন। পাথরের নয়–সোনার স্তম্ভ। কিন্তু সে জানে না সেটা কোথায় পোঁতা হয়েছিল।
দেখতে দেখতে উৎসবের দিন এসে গেল। নগর থেকে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে উৎসবের সাজে সেজে পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চলেছে লোগবার্গে। ফ্রান্সিস, মারিয়া আর বন্ধুরাও চলল লোগবার্গে।
স্তম্ভগুলোর কাছে ওরা যখন পৌঁছল তখন দেখল প্রদীপ জ্বালানো হয়ে গেছে। আলোয় ভরে গেছে নাচগানের আসর। ওরা পাহাড়ের গায়ে খাঁজকাটা আসনগুলিতে বসল। একটু পরেই গাড়ি চড়ে রাজা ইনগলফ ও রানী এলেন। নিজেদের নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। সেদিন দর্শকের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে বেশি।
উৎসব শুরু হলো। একদল মেয়ে রঙচঙে বাহারি পোশাকে সেজে স্তম্ভগুলোর পেছনে যে নক্সা-ভোলা মোটা কাপড় বিছানো হয়েছে তাতে এসে দাঁড়ালী বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠল। দুটি মেয়ে এগিয়ে এসে গান ধরল। গানের বিষয়ুরাজা ফ্লোকির বীরত্বের কাহিনী। ওরা দুজন গান শেষ করতে চারদিকে করতালির শব্দ শোনা গেল। এবার সব মেয়েরা মিলে গাইতে লাগল ভেড়াচালকদের গান। পাহাড়ের সবুজ ঘাসে লোকেরা ভেড়া চরিয়ে বেড়ায় এটা তাদের গান। এই গান শেষ হতে রাজা-রানী চলে গেলেন। আবার গান আর সেই সঙ্গে নাচ শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুহূমুর্হ করতালির মধ্যে আসর জমে উঠল। পুরুষ দর্শকরাও অনেকে নাচের আসরে যোগ দিল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নাচগান চলল। প্রদীপের আলো কমে গেল। একসময় নাচগানের উৎসব শেষ হলো।
দর্শকরা নগরে ফিরে যেতে লাগল। ফ্রান্সিসের বন্ধুরাও ফেরার জন্যে একত্র হলো। ফ্রান্সিস মারিয়াকে বলল তুমি ওদের সঙ্গে ফিরে যাও। আমি আর হ্যারি কিছুক্ষণ পরে যাচ্ছি।
মারিয়া মাথা নেড়ে বলল–তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমিও থাকবো। তোমাদের সঙ্গেই ফিরবো।
ফ্রান্সিস বলল–বেশ। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে রেলল–তোমরা চলে যাও। আমরা পরে যাবো।
বন্ধুরা হৈ হৈ করতে করতে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই উৎসবপ্রাঙ্গণ জনহীন হয়ে গেল। সেদিনের মতো আজও কয়েকজন তোক পাহাড়ের খাঁজে এখানে ওখানে ভেড়ার লোমের মোটা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে দেখা গেল।
ফ্রান্সিস পাথরের আসন ছেড়ে স্তম্ভগুলোর কাছে এল। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। সঙ্গে মারিয়া আর হ্যারি। একটুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফ্রান্সিস যে নক্সা বোনা মোটা কাপড়টা পাতা ছিল তার ওপরে বসে পড়ল। তারপর হাতে মাথা রেখে আধশোয়া হলো। পাথরের প্রদীপের আলো কমে গেছে। ফ্রান্সিস তাকিয়ে রইল ছটা স্তম্ভ আর পাথরের প্রদীপগুলোর দিকে। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল মাটিতে পাতা মোটা কাপড়ের নক্সাগুলোর ওপর খুব আবছা স্তম্ভের ছায়া পড়েছে। ছায়াগুলো লম্বা হয়ে নেমে এসেছে। তবে স্পষ্ট নয়। কাপড়ের নক্সার জন্যে আর প্রদীপের আলোগুলোও কমে এসেছে বলে। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে ছায়া তিনটে ত্রিকোণ। নক্সাটাও তো ত্রিকোন! ফ্রান্সিস শরীরে এক ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে ডাকলারি।
হ্যারি আর মারিয়া ছুটে এল। হ্যারি বলল–কি ব্যাপার?
–এই নক্সাকাটা কাপড়টা সরাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
তারপর তিনজনে মিলে কাপড়টা সরাতে লাগল। তখনই দেখল, হ্রোলগ আস্তে আস্তে আসছে। ও আসার আগেই কাপড়টা ভোলা হয়ে গেছে। দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে হেসে হ্রোগল বলল–তোমরা কেন তুলছো! ওটা তো আমার কাজ।
ফ্রান্সিস সে কথায় কান দিল না। ও তখন মাথা নিচু করে ঘাসের জমিতে স্তম্ভের যে অস্পষ্ট ছায়া পড়েছে তাই দেখছিল। এবার মুখ তুলে বলল–হ্রাগল–আপনি প্রদীপ তিনটের পলতে উস্কে দিন তো। যতটা পারেন প্রদীপের আলোটা উজ্জ্বল করুন।
হ্রোগল চলল প্রদীপের পলতে উস্কে দিতে। বিড়বিড় করে মাথা নেড়ে বলতে লাগল–ছেলেটার মাথঅ খারাপ হয়ে গেছে।
হ্রোগল মই বেয়ে উঠল। লম্বা কাঠের লাঠিটা দিয়ে পরপর তিনটে পাথরের প্রদীপের পলতে উস্কে দিল। উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল চারদিক।
ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলে উঠল–হ্যারি মারিয়া-দেখো স্তম্ভের তিনটে ছায়া মিলছে কিনা।
হ্যারি আর মারিয়া দেখল–সত্যিই তাই। স্তম্ভ ছটির ছায়া একটা বড় ত্রিভুজের সৃষ্টি করেছে। তিনটে ছায়াই মিলেছে নিচে একটা বিন্দুতে।
ফ্রান্সিস এখানে যতবার আসে–ছবি আর নক্সার কাগজটা সঙ্গে করে নিয়ে আসে। আজকেও এনেছিল। ও ঢেলা জামার তলা থেকে নক্সাটা বের করল। নক্সার কাগজটা ঘাসে ঢাকা মাটিতে পাতল। বলল–হ্যারি, মারিয়া-দেখোনক্সার ওপরের দিকের তিনটি আলোর চিহ্ন। এগুলো ঐ তিনটে পাথরের প্রদীপ। তার নিচের বিন্দুগুলোতে যদি ছটা স্তম্ভের কল্পনা করে তাহলে নক্সাটা এরকম দাঁড়াবে কিনা, অর্থাৎ প্রদীপশিখাগুলো থেকে তিনটে ছায়ার দাগ কল্পনা করো। সেই ছায়াগুলো ঠিক নিচে একটা বিন্দুতে মিলে ত্রিভুজের সৃষ্টি করবে। দেখো ভালো করে–
মারিয়া ও হ্যারি ঝুঁকে পড়ে দেখল–ঠিক তাই। ফ্রান্সিস বলল–ঐ দেখো-স্তম্ভের ছায়াগুলো ঐ জায়গায় মিশে গেছে। দেখা গেল সত্যিই তিনটি ছায়া ঐ জায়গাটায় মিশে গিয়ে একটা ত্রিভুজের সৃষ্টি করেছে। ফ্রান্সিস ঐ মিশে যাওয়া বিন্দুতে মাটিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে দুহাত ওপরে তুলে বলে উঠল–এইখানে আছে সেই রহস্যময় সপ্তম স্তম্ভ।
হ্যারি একটুক্ষণ ভাবল। সত্যিই তো। নক্সাটা তো এই নির্দেশই দিচ্ছে। হ্যারি ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। চিৎকার করে বলতে লাগল–সাবাস–সাবাস ফ্রান্সিস। মারিয়া তখনও রহস্যভেদ করার ব্যাপারটা সঠিক বুঝতে পারিনি। হ্যারি এসে আস্তে আস্তে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। মারিয়া আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল। তিনজনেই প্রায় নাচতে লাগল।
বৃদ্ধ হ্রোলগ এসব দেখে বলে উঠল–ছেলেমেয়েরা নাচ অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে।
হ্যারি ছুটে এসে হোলগকে জড়িয়ে ধরে নাচতে লাগল। এদিকে ওখানে যারা কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল তাদের এই চাঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। ওরা উঠে বসল কেউ কেউ। হ্যারিদের নাচ দেখতে লাগল।
ফ্রান্সিস হোলগকে বলল–আপনাকে সেদিন আপনার বাগানে বেলচা নিয়ে মাটি খুঁড়তে দেখেছিলাম। আছে তো ওটা?
-তা, থাকবে না কেন।
–আপনি হ্যারিকে নিয়ে যান। বেলচাটা ও নিয়ে আসবে। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি একটু পরেই বেলচাটা নিয়ে এল। ফ্রান্সিস বেলচাটা হাতে নিল। তিনটে ছায়া যে বিন্দুতে মিশেছে সেখানে বেলচাটা বসিয়ে দিল। বলল–এই জায়গাটা খুঁড়তে হবে। তারপর নিজেই বেলচা দিয়ে জায়গাটা খুঁড়তে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ খুঁড়ল। তারপর হ্যারিকে ডাকল। হ্যারিও খুঁড়তে লাগল। তবে হ্যারি বরাবরই শরীরে দিক থেকে দুর্বল ও অল্পেতেই হাঁপিয়ে উঠল। তখন ফ্রান্সিস হাত লাগাল। চলল গর্ত খোঁড়া।
ওদিকে যারা শুয়ে বসে ছিল তারা তো অবাক। হলো কি এই পুরুষ দুটোর আর মেয়েটির। এতক্ষণ হৈ হৈ নাচানাচি করে এখন মাটি খুঁড়তে শুরু করেছে? দিল গর্ত খুঁড়ে উৎসবের নাচগানের জায়গাটা নষ্ট করে। ওরা দুতিনজন কাছে এল। মাটি কাটা দেখল। একজন বলল–কী ব্যাপার? এখানে গর্ত খুঁড়েছেন কেন?
ফ্রান্সিস বেলচা চালতে চালতে বলল–এখানে ঐ স্তম্ভগুলোর মতো একটা স্তম্ভ আছে কিনা খুঁড়ে তাই দেখবো।
–বেশ, একটা পাথরের স্তম্ভ না হয় পেলেন। কিন্তু তাতে হবেটা কী? আর একজন বলল।
হ্যারি বলল–সেটা এখনই ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে একটা রহস্যের সমাধান হবে।
লোকগুলো পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল–এগুলো কি পাগল নাকি? ততক্ষণে আর বাকি সবাই এসে ওখানে জড় হয়েছে। নানা মন্তব্য করতে লাগল ওরা। ফ্রান্সিস মাটি খুঁড়ে চলল। হ্যারি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাই, তোমরাও একটু সাহায্য করো না।
ওরা সব গাঁয়ের চাষী। এসব কাজ ওদের কাছে কিছুই না। সবাই রাজী হলো না। দুজন শুধু বোধহয় কৌতূহলবোধ করল। মজার খেলা। দেখাই যাক না। একটি যুবক ফ্রান্সিসকে থামতে বলল। ফ্রান্সিস খোঁড়া থামিয়ে হাঁপাতে লাগল। যুবকটি বেলচা হাতে নিল। বলল–এসব আপনাদের কাজ নয়। তারপর নিপুণ ভঙ্গীতে বেলচা চালাতে লাগল। একটুক্ষণের মধ্যেই হাঁটুসমান গর্ত করে ফেলল।
হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস–কোনো কিছুর হদিস তো পাওয়া যাচ্ছে না।
ফ্রান্সিস চিন্তিতস্বরে বলল–হুঁ, তাই তো দেখছি। দেখা যাক আর হাত কয়েক খুড়ে। এবার যুবকটি বেলচা রেখে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল–তুমি উঠে এসো। আমি খুঁড়ছি।
অন্যজন এগিয়ে এসে বলল–না–আপনি বিশ্রাম করুন। আমি হাত লাগাচ্ছি।
এই লোকটি একটু বয়স্ক। যুবকটি গর্ত থেকে উঠে এল। বয়স্ক লোকটি খুঁড়তে লাগল। হাত খানেকও খোড়েনি, হঠাৎ বেলচায় কী লেগে ঠং করে শব্দ হলো। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে গর্তের মধ্যে তাকাল। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা গেল না। বয়স্ক লোকটি হাত দিয়ে দিয়ে ওখানকার মাটি সরিয়ে সরিয়ে জিনিসটা দেখল। বলল–মনে হচ্ছে লোহার ডাভার মতো কিছু।
ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি, শীগগিরি হোলগের ঘর থেকে একটা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে এসো।
হ্যারি ছুটে চলে গেল। বয়স্ক লোকটি ঐ লোহার ডান্ডাটার চারপাশে খুঁড়তে লাগল। কাটা মাটি সরাতে লাগল।
হ্যারি জ্বলন্ত মশাল নিয়ে এল। ফ্রান্সিস বয়স্ক লোকটিকে বলল–তুমি ভাই এসো। আমি খুঁড়ছি।
লোকটি গর্ত থেকে উঠে এল। ফ্রান্সিস মশাল হাতে গর্তে নামল। যেটাকে লোকটা লোহার ডান্ডা বলছিল সেটার গায়ে তখনও মাটি লেগে আছে। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে ওটার গা থেকে মাটি মুছে ফেলল। মশালের আলোয় দেখল-লোহা নয়–সোনা। সোনার দন্ড মতো। তার গায়ে সবুজ নীল মীনে করা। এইবার ফ্রান্সিস বিপদ আঁচ করল। যদি লোকগুলো জানতে পারে যে ওটা লোহা নয় সোনা, তাহলেই বিপদ। সোনার লোভে মানুষ উন্মত্ত হয়ে যায়। তখন মানুষ মানুষকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাছাড়া এরা গরিব চাষী। সোনার জন্যে নিজেরাই খুনোখুনি শুরু করে দেবে। ফ্রান্সিসদের তো খুন করবে প্রথমেই।
ফ্রান্সিস কোনো কথা না বলে মশালটা খোঁড়া মাটির মধ্যে গুঁজে দিল। মশাল নিভে গেল। গর্তটা অন্ধকার হয়ে গেল। ফ্রান্সিস মশাল নিভিয়ে ফেলল যাতে চাষী লোকগুলোর সোনার দন্ড দেখতে না পায়। গর্তের ওপরে উঠে এল। বয়স্ক লোকটি জিজ্ঞেস করল–ওটা লোহার ডান্ডা তাই না?
ফ্রান্সিস হেসে বলল–হ্যাঁ, এত খাটুিনি বৃথাই গেল। বোধহয় ফ্রান্সিসদের পাগলামির ব্যাপারেই কথা বলতে লাগল ওরা।
হ্যারির কাছে এসে ফ্রান্সিস দাঁড়াল। হ্যারি বলল-লোহার একটা ডান্ডাকে তুমি সোনার স্তম্ভ বলবে?
ফ্রান্সিস ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল–চুপ। তারপর হ্যারি কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল-হরি-লোহার নয়–সোনার দন্ড মতো। তাতে মীনের কাজ করা।
–বলো কি? হ্যারি চমকে উঠল।
–আস্তে। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল-হোলগের একটা আধভাঙা ঘোড়া গাড়ি আছে দেখেছি। গোড়াটা তেজীয়ান না হলেও মোটামুটি ছুটতে পারবে। তুমি গাড়িটায় চড়ে বন্দরে চলে যাও। বিস্কো শাঙ্কো আর জনার দশেক বন্ধুকে দিয়ে এসো। সবাই যেন অস্ত্র নিয়ে আসে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
হ্যারি চলে গেল। মারিয়া সন্দেহ করল কিছু একটা হয়েছে। কাছে এসে বলল–কী হয়েছে ফ্রান্সিস
-পরে বলবো। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল। অন্য মেয়ে হলে হয়তো কী হয়েছে সেটা জানবার জন্যে অস্থির হয়ে পড়ত। কিন্তু মারিয়া খুব বুদ্ধিমতী। সে বুঝল যে এখন চুপ করে থাকাই ভাল। সময় এলে ফ্রান্সিস নিজে থেকেই সব বলবে। ফ্রান্সিস বলল–খুব পরিশ্রান্ত-বুঝলে? চলো–ঐ স্তম্ভে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিই।
একটা স্তম্ভে হেলান দিয়ে ফ্রান্সিস শরীর ছড়িয়ে আধশোয়া হলো। মারিয়াও কাছে বসল। অস্পষ্ট আলোয় ওরা দেখল একটা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে হ্যারি চলেছে সঙ্গে বৃদ্ধ হ্রোগল।
ফ্রান্সিস একবার চারদিকে তাকাল। দেখল চাষী শ্রেণীর সেই লোকগুলো ভেড়ার লোমের মোটা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে সবাই। পাথরের প্রদীপের আলো নিভে এসেছে। আকাশে দিগন্তে ম্লান আলো। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল–মারিয়া–সপ্তম স্তম্ভের রহস্যের সমাধান মরেছি। মারিয়া খুশীতে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে ফ্রান্সিসের ইঙ্গিতে থেমে গেল। ফ্রান্সিস নিম্নস্বরে বলল–একটা সবুজ মনে করা সোনার দন্ড পেয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওটা জাহাজের মাস্তুল অর্থাৎ দীর্ঘ সর্প জাহাজটা ওখানেই পুঁতে রাখা হয়েছে। সপ্তম স্তম্ভ যেটা থরবার্গ বলেছিল সেটা আসলে সোনার মাস্তুল। স্তম্ভ নয়।
–এখন কী করবে? মারিয়াও নিচু স্বরে বলল।
–এখানে যে চাষীরা ঘুমিয়ে আছে তারা কিছু বোঝার আগেই আমাদের বন্ধুদের এখানে নিয়ে আসতে হবে। তাই হ্যারিকে গাড়ি করে পাঠালাম। বন্ধুরা এলেই নিশ্চিন্ত। ঐ চাষী লোকগুলোর মনে সন্দেহ হয় এমন কোনো কথা আমরা এখন বলবো না। তেমন কোনো কাজও করবো না। চুপ করে বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করবো। মারিয়া কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
অনেকটা সময় কেটে গলে। ফ্রান্সিস মনে মনে অস্থির হয়ে উঠল। তখনই দেখল দূরে রাস্তার ওপর অল্প অন্ধকার আর কুয়াশার মধ্যে মশালের আলোর বিন্দু পর পর কয়েকটা। গাড়ি আসছে। একটুক্ষণের মধ্যেই গাড়ির চাকার শব্দ শোনা গেল। কয়েকটা ঘোড়ায় টানা চাষীদের গাড়ি বোঝাই হয়ে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা এল। সবার পেছনে হোলগের গাড়ি।
গাড়ি থেকে নেমে বন্ধুরা হৈ-হৈ করতে ছুটে এল। সকলের হাতেই খোলা তরোয়াল। শুধু শাঙ্কোর কাঁধে ধনুক ও তুনীর। ওরা ধরেই নিয়েছিল-এবার লড়াই হবে। নইলে ফ্রান্সিস অস্ত্রশস্ত আনতে বলবে কেন।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–ঐ গর্তটা খুঁড়ে আরো বড় করতে হবে। হাত লাগাও। ভাইকিং বন্ধুরা হাতের তরোয়াল স্তম্ভগুলোর কাছে জমা করে রাখল। হ্যারি বুদ্ধি করে চারটে বেলচা হ্রোলগের গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিল। পাঁচজন ভাইকিং বেলচা চালিয়ে গর্ত গভীর করতে লাগল। তবে লড়াই হলো না বলে সকলেই বেশ মনমরা হয়ে গেল।
আরো হাতখানেক খুঁড়তেই দেখা গেল পাথরের ছোট ছোট চাই দিয়ে বাঁধানো একটা জায়গা। সেই চাঁইগুলোর একটা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে সোনার দন্ডটা।
ওরা ফ্রান্সিসকে ডাকল। ফ্রান্সিস ঘোড়ার গাড়িতে রাখা মশাল নিয়ে গর্তে নামল। মশালের আলোয় দেখল নিচেটা পাথর দিয়ে বাঁধানো। ফ্রান্সিস বুঝল–ঐ বাঁধানো জায়গাটাতেই রাখা আছে ক্ষুদে দীর্ঘ সপ সোনার জাহাজ। দেখা গেল বাঁধানো জায়গাটা লম্বাটে। ফ্রান্সিস গর্ত থেকে উঠে এল। বলল–ঐ বাঁধানো পাথরগুলো খুলে ফেল। দেখা যাক কী আছে ওর মধ্যে।
খুঁড়তে খুঁড়তে প্রায় সাত ফিট বাঁধানো জায়গাটা পাওয়া গেল। এবার পাথরগুলো খুলতে হবে। গাঁইতি চাই। হ্রোগলই ওর ঘর থেকে একটা গাঁইতি নিয়ে এল। একে একে পাথরের ছোট ছোট চাইগুলো জোড়ামুখে চাড় দিয়ে খোলা হতে লাগল। কয়েকটা চাই খুলতেই দেখা গেল চকচকে গাড় নীল রঙের কাপড়ে কী যেন ঢাকা। সব ই খুলতেই দেখা গেল একটা পাঁচ ফিট লম্বা সোনার জাহাজ। তার মাস্তুলটা তো আগেই দেখা গিয়েছিল। ক্ষুদে জাহাজের মুখটা অবিকল সেই ছবির সাপের মুখের মতো। মশালের আলো পড়তে জাহাজের সোনার গা ঝিকিয়ে উঠল। ক্ষুদে জাহাজটা পাথরের চাঁইয়ের বাক্সের মধ্যে ছিল বলেই মাটি লাগেনি। এবার ফ্রান্সিস গর্তে নামল। বিস্কো মশাল হাতে নামল। ফ্রান্সিস গাড় নীল কাপড়টা সরাল। ঝম করে উঠল জাহাজের এক ফুট চওড়া খোল বোঝাই মণিমাণিক্য, দামী পাথরের টুকরো।
ততক্ষণে ভাইকিংরা আর কয়েকজন চাষী সবাই ঝুঁকে পড়েছে গর্তটার ওপর। ফ্রান্সিস ক্ষুদে জাহাজটা তুলতে গেল। তুললও কিছুটা। কিন্তু বেশ ভারী। তাছাড়া তুলতে গেলে জাহাজটা কাত হবে। খোল থেকে মণিমাণিক্য দামী পাথরগুলো ছড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে। ফ্রান্সিস বললো-বিস্কো-মশালটা ওপরে কারো হাতে দাও। তারপর জাহাজের ওপাশটা ধরো। দুজনে মিলে তুলতে হবে।
মশাল গর্তের ওপরে একজন নিল। ফ্রান্সিস আর বিস্কো মিলে ক্ষুদে সোনার জাহাজটা তুলতে লাগল। আস্তে আস্তে ওপরে তুলতেই এতক্ষণে মশালের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল সোনার ক্ষুদে জাহাজ, মাস্তুল। অপরূপ সবুজ নীল মীনে করা জাহাজের ঝকঝকে গা, মাস্তুল। জাহাজের খোলভর্তি মণিমাণিক্য দামী পাথরের স্তূপ। তার মধ্যে কিছু দামী হীরের সোনার গয়নাগাটিও আছে।
এই দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণ কারো মুখে কথা নেই। তারপাই শুরু হলো ভাইকিংদের চিৎকার—ও-হো-হো-হো-।
ওদিকে চাষী লোকশুলোর সকলেরই ঘুম ভেঙে গেছে। ওরা ছুটে এল। সোনার জাহাজ, মণিমাণিক্য দেখে ওরা বিস্ময়ে হতবাক। হাঁ করে দেখতে লাগল জাহাজটা।
গর্ত থেকে উঠে আসতেই ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। শুরু হলো ফ্রান্সিসকে কাঁধে তুলে নাচ। মারিয়াও খুশিতে নেচে উঠল। ছুটে এসে জাহাজের সোনার গায়ে হাত ঘষতে লাগল, মণিমাণিক্য তুলে নিয়ে দেখতে লাগল। তখনই ও দেখল জাহাজটার গায়ে লেখা–দীর্ঘ সৰ্প।
ক্ষুদে সোনার জাহাজটা রাখা হলো স্তম্ভগুলোর কাছে। ফ্রান্সিসের নির্দেশ হ্যারি গাড়ি নিয়ে ছুটল নগরের দিকে–রাজা ইনগল কে এই সংবাদ জানাতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা রেভাভিক নগরে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। রাজা ইনগলফ ও রানী ততক্ষণে গাড়িতে চলে এসেছেন। রেভজাভিকনগরের লোকেরাও ছুটে আসতে লাগল লোগবার্গের দিকে যেন আবার নাচ-গানের উৎসব হবে।
রাজা ইনগলফ জাহাজ ও মণিমাণিক্য দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন। আনন্দে ফ্রান্সিসকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রানীও খুশি। মারিয়াকে বুকে টেনে নিলেন। রাজা ফ্রান্সিসের মুখ থেকে শুনলেন মণিমাণিক্যের জাহাজ উদ্ধারের গল্প।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই জায়গাটা লোকারণ্য হয়ে গেল। সবাই অবাক চোখে দেখতে লাগল সেই অপরূপ সোনার জাহাজ, মণিমাণিক্য।
এবার রাজা ইনগলফ ফ্রান্সিসকে বললেন–এই মহামূল্য জাহাজ নিয়ে এখন কী করবে?
–এই গুপ্তধন তো এই দেশেরই রাজা ফ্লোকির। কাজেই এই দেশেই থাকবে। রাজা ইনগলফ বললেন–তা ঠিক। তুমি তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ। কিন্তু ফ্রান্সিস–মারিয়াকে উদ্ধার করতে, আমার রাজ্যকে শত্রুর হাত তেকে বাঁচাতে এই গুপ্তধন উদ্ধার করতে যে সাহস, বুদ্ধি ও শৌর্যের পরিচয় তুমি দিয়েছে তাতে এই দীর্ঘ স তোমারই প্রাপ্য।
ফ্রান্সিস কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। হ্যারির দিকে তাকাল।
হ্যারি নম্বরে বলল–রাজা ইনগলফ–আপনি আপনার যে উদার মনের পরিচয় দিলেন তা আমরা কোনদিন ভুলবো না। আমার প্রিয় বন্ধু ফ্রান্সিস সোনার ঘণ্টা, হীরে-মুক্তো এসব এনেছে আর সেসব আমাদের রাজার জাদুঘরে রক্ষিত আছে এই দীর্ঘ স জাহাজ আইসল্যান্ডবাসীদের রাজা ফ্লোকির সম্পত্তি। তাই এটা আপনার প্রাসাদেই থাক। বরং মণিমাণিক্যগুলো ফ্রান্সিসকে দিন।
রাজা একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন–বেশ তাই হবে। তারপর বললেন-ফ্রান্সিস, মণিমাণিক্য রেখে দাও। শুধু জাহাজটা আমাদের গাড়িতে তুলে দাও। গাড়ি আস্তে আস্তে যাবে আমার দেশবাসী এই মহামূল্যবান গুপ্তধন স্বচক্ষে যেন দেখতে পায়।
রাজা ইনগলফের কথামতো মারিয়া একটা চামড়ার থলিতে মণিমাণিক্য গয়নাগাঁটি ভরে রাখল। জাহাজটা তুলে দেওয়া হলো রাজার গাড়িতে। রাখা হলো সামনের আসনের ওপর। রাজা-রাণী গাড়িতে উঠলেন।
ফ্রান্সিস কী ভেবে গাড়িতে বসা রাজা ইনগফের দিকে এগিয়ে গেল। বলল–মহামান্য রাজা-আপনার কাছে আমার দুটো অনুরোধ আছে।
–বেশ-বলল। রাজা বললেন।
–প্রথম অনুরোধ–ফ্রান্সিস বলল–আপনি রাজা গুমন্ডের প্রতি দয়া প্রদর্শন করুন। রাজা গুমন্ডকে মুক্তি দিন এবং তার হারানো রাজ্য থিংভেলির তাকে ফিরিয়ে দিন।
রাজা ইনগলফ একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন–ফ্রান্সিস তুমি এই অনুরোধ করছে কেন?
কারণ আমি রাজা গুমন্ডের মনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। তিনি অনুতপ্ত। আমাকে তিনি বলেছেন আবার থিংভেলির রাজ্যের রাজা হলে তিনি বাকি জীবন প্রজাদের কল্যাণ সাধন করবেন। গুম আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাকে একবার তার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিন। ফ্রান্সিস বলল। রাজা ইনগলফ দ্বিধায় পড়লেন। একদিকে চিরশত্রু রাজা গুমন্ডের প্রতি সমস্তজীবন কারাবাসের আদেশ অন্যদিকে স্নেহাস্পদ ফ্রান্সিসের অনুরোধ। একটু ভেবে নিয়ে রাজা ইনগলফ বললেন–ফ্রান্সিস–তোমার অনুরোধ কি আমি রক্ষা না করে পারি? ঠিক আছে রাজা গুমন্ডকে আমি মুক্তি দেব। তার রাজত্বও তাকে ফিরিয়ে দেব।
–অশেষ ধন্যবাদ মহামান্য রাজা। ফ্রান্সিস মাথা নুইয়ে বলল?
–তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ? রাজা বললেন;
ফ্রান্সিস এবার মারিয়ার হাত থেকে মণিমাণিক্য গয়নাভরা চামড়ার থলিটা নিল। থলিটা এগিয়ে ধরে বলল–আপনি দয়া করে এই মণিমাণিক্য অলঙ্কার নিল। এসব রাজা গুমন্ডকে মুক্তির সময় দেবেন। রাজা আবার চিন্তায় পড়লেন। বললেন–কিন্তু ফ্রান্সিস–রাজা গুমন্ড ভীষণ স্বার্থপর লোভী অর্থ পিশাচ।
–জানি। তবু তাকে আমি অনুরোধ করবো–এই সমস্ত মণিমাণিক্য বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে তা যেন উনি প্রজাদের কল্যাণে ব্যয় করেন। ফ্রান্সিস বলল। এবার রাজা চামড়ার থলিটা নিলেন। রানীর হাতে দিলেন। বললেন–বেশ–এইসব মণিমাণিক্য অলঙ্কার রাজা গুমন্ডকে দেব। তোমারই এই গুপ্তসম্পদ উদ্ধার করেছে। নইলে এই গুপ্তধন মাটির নিচেই পড়ে থাকতো। কাজেই এ ব্যাপারে তুমি যা চাইবে তাই হবে। ফ্রান্সিস মারিয়া ও হ্যারি মাথা নুইয়ে রাজা রানীকে সম্মান জানাল। রাজা কোচওয়ানকে গাড়ি চালাতে ইঙ্গিত করলেন। গাড়ি চলল।
গাড়ি ধীরগতিতে চলল বেভকজাভিকের দিকে। রাজার গাড়ির মশালের আলো পড়েছে দশ ফুট দীর্ঘ সোনার জাহাজে। ঝকঝক করছে জাহাজের গা-মীনে করা মাস্তুল। উপস্থিত মানুষেরা অবাক হয়ে দেখতে লাগল। জনতার মধ্যে থেকে অনেকে নিঃশব্দে গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটতে লাগল। সোনার জাহাজ সোনার মাস্তুল। কী অপূর্ব সুন্দর। দেখে দেখে ওদের যেন সাধ মিটছে না। আস্তে আস্তে রাজার গাড়ি কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল।
ফ্রান্সিস মারিয়া, হ্যারি ও বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–চলো সবাই। সবাই ধ্বনি তুলে আনন্দোচ্ছাস প্রকাশ করল—ও—হো–হো।
ফ্রান্সিস মারিয়া ও হ্যারি একটা গাড়িতে উঠল। অন্য গাড়িগুলোয় উঠল ভাইকিং বন্ধুরা সব গাড়ি চলল রেভকজাভিকের উদ্দেশ্যে।
গাড়ি নগরে প্রবেশ করলে ফ্রান্সিস কোচওয়ানকে বলল–কয়েকঘরের কাছে নিয়ে চলো। গাড়ি রাজবাড়ির চত্বরে ঢুকল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল কয়েদুঘরের সামনে। ফ্রান্সিসরা গাড়ি থেকে নামল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে একজন রক্ষীকে। বলল–রাজা গুমন্ডের সঙ্গে দেখা করবো। দরজা খুলে দাও। একজন রক্ষী বড় তালাটা খুলল। লোহার দরজা খুলল। ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরে ঢুকল। রাজা গুমন্ড আজকে শুয়ে ছিল না দাঁড়িয়ে পায়চারী করছিল। মুখ ফিরিয়ে ফ্রান্সিসকে দেখল। বলল–রাজা ইনগলফকে আমার কথা বলেছেন?
–বলেছি। আপনি খুব শিগগিরই মুক্তি পাবেন।
থিংভেলির রাজ্য আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–সত্যি? রাজা গুমণ্ড দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে গভীর বিস্ময়। গলায় বলে উঠল–সত্যি আমি মুক্তি পাবো?
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল। রাজা গুমও কিছুক্ষণ দুহাত তুলে ওপরের দিকে তাকিয়ে রইল। যখন মুখ নামাল ফ্রান্সিসরা দেখল–রাজা গুমরে চোখে জল। কান্না ভেজা গলায় গুমও বলল–ফ্রান্সিস-তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
–কিন্তু আপনার প্রতিশ্রুতি? ফ্রান্সিস বলল?
–অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। গুমন্ড ম্লান হেসে বলল।
–এই আইসল্যান্ডের একজন রাজা ছিলেন ফ্লোকি। তার নাম শুনেছেন? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ। উনি ছদ্মবেশে জলদস্যুতাও করতেন। গুমন্ড বলল?
–সেই রাজা ফ্লোকির গুপ্তধন আমরা উদ্ধার করেছি?
–বলল কি? গুমন্ড বেশ আশ্চর্য হল।
—হ্যাঁ। দশ ফুট লম্বা একটা সোনার জাহাজ আর জাহাজের খোল ভর্তি মণিমাণিক্য অলঙ্কার। ফ্রান্সিস বলল। রাজা গুমন্ড বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
–এই সব মণিমাণিক্য অলঙ্কার আপনাকেই দেওয়া হবে। ফ্রান্সিস বলল?
–আমাকে? গুমন্ড আরও আশ্চর্য হল।
–হ্যাঁ–দেওয়া হবে একটি শর্তে–সেই মণিমাণিক্য অলঙ্কার বিক্রি করে একটি অর্থভান্ডার আপনি গড়ে তুলবেন। সেই অর্থ ব্যয়িত হবে শুধুমাত্র আপনার প্রজাদের কল্যাণে। অন্য কোন কারণে একটি স্বর্ণমুদ্রাও আপনি ব্যয় করতে পারবেন না। রাজা গুমন্ড নিঃশব্দে কিছুক্ষণ ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–ফ্রান্সিস–সত্যিই তুমি মহান। ফ্রান্সিস শুধু বলল–আপনার শরীর এখন কেমন?
–আমি অনেকটা সুস্থ। ফ্রান্সিস তোমাকে ধন্যবাদ। গুমন্ড বলল। ফ্রান্সিসরা জাহাজে ফিরে এল। জাহাজের ডেকে উঠতেই বন্ধুরা ওদের ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–জাহাজ ছাড়ো। এবার মাতৃভূমিতে ফেরা। সব ভাইকিং বন্ধুরা ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। তারপর যে যার কাজে লেগে পড়ল। দড়িদড়া টেনে বিরাট বিরাট পাল খাটানো হল। ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর তোলা হল। একটা পাক খেয়ে জাহাজ মহাসমুদের দিকে জল কেটে চলল। পাশে দাঁড়ানো মারিয়াকে ফ্রান্সিস হেসে বলল–তোমার কি দুঃখ হচ্ছে মারিয়া?
-কেন বলো তো? মারিয়া বলল?
–অত মূল্যবান মণিমাণিক্য রেখে এলাম। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল–দুঃখ নয় তোমার জন্যে আজ আমি গর্ববোধ করছি। ফ্রান্সিস হেসে হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–হ্যারি–তোমার? হ্যারি কোন কথা না বলে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া হ্যারি–আগের অভিযানগুলোর শেষে কত মূল্যবান জিনিস নিয়ে দেশে ফিরেছি। আজ না হয় শূন্য হাতেই ফিরলাম–কী বলো? কেউ কোন কথা বলল না। নিস্তেজ আলো আর কুয়াশা ঢাকা আকাশের নিচে সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে ওরা তাকিয়ে রইল। জাহাজ চলল।