হঠাৎ আমার হল মনে
শিবের জটার গঙ্গা যেন শুকিয়ে গেল অকারণে ;
থামল তাহার হাস্য-উছল বাণী ;
থামল তাহার নৃত্য-নূপুর ঝরঝরানি ;
সূর্য-আলোর সঙ্গে তাহার ফেনার কোলাকুলি ,
হাওয়ার সঙ্গে ঢেউয়ের দোলাদুলি
স্তব্ধ হল এক নিমেষে
বিজু যখন চলে গেল মরণপারের দেশে
বাপের বাহুর বাঁধন কেটে ।
মনে হল , আমার ঘরের সকাল যেন মরেছে বুক ফেটে ।
ভোরবেলা তার বিষম গন্ডগোলে
ঘুম-ভাঙনের সাগরমাঝে আর কি তুফান তোলে ।
ছুটোছুটির উপদ্রবে
ব্যস্ত হত সবে ,
হাঁ হাঁ করে ছুটে আসত “ আরে আরে করিস কী তুই ” বলে ;
ভূমিকম্পে গৃহস্থালি উঠত যেন টলে ।
আজ যত তার দস্যুপনা , যা-কিছু হাঁক ডাক
চাক-ভরা মৌমাছির মতো উড়ে গেছে শূন্য করে চাক ।
আমার এ সংসারে
অত্যাচারের সুধা-উৎস বন্ধ হয়ে গেল একেবারে ;
তাই এ ঘরের প্রাণ
লোটায় ম্রিয়মাণ
জল-পালানো দিঘির পদ্ম যেন ।
খাট-পালঙ্ক শূন্যে চেয়ে শুধায় শুধু , “ কেন , নাই সে কেন । ”
সবাই তারে দুষ্টু বলত , ধরত আমার দোষ ,
মনে করত , শাসন বিনা বড়ো হলে ঘটাবে আপসোস ।
সমুদ্র-ঢেউ যেমন বাঁধন টুটে
ফেনিয়ে গড়িয়ে গর্জে ছুটে
ফিরে ফিরে ফুলে ফুলে কূলে কূলে দুলে দুলে পড়ে লুটে লুটে
ধরার বক্ষতলে ,
দুরন্ত তার দুষ্টুমিটি তেমনি বিষম বলে
দিনের মধ্যে সহস্রবার করে
বাপের বক্ষ দিত অসীম চঞ্চলতায় ভরে ।
বয়সের এই পর্দা-ঘেরা শান্ত ঘরে
আমার মধ্যে একটি সে কোন্ চির-বালক লুকিয়ে খেলা করে ;
বিজুর হাতে পেলে নাড়া
সেই যে দিত সাড়া ।
সমান-বয়স ছিল আমার কোন্খানে তার সনে ,
সেইখানে তার সাথি ছিলেম সকল প্রাণে মনে ।
আমার বক্ষ সেইখানে এক-তালে ,
উঠত বেজে তার ই খেলার অশান্ত গোলমালে ।
বৃষ্টিধারা সাথে নিয়ে মোদের দ্বারে ঝড় দিত যেই হানা
কাটিয়ে দিয়ে বিজুর মায়ের মানা
অট্ট হেসে আমরা দোঁহে
মাঠের মধ্যে ছুটে গেছি উদ্দাম বিদ্রোহে ।
পাকা আমের কালে
তারে নিয়ে বসে গাছের ডালে
দুপুরবেলায় খেয়েছি আম করে কাড়াকাড়ি —
তাই দেখে সব পাড়ার লোকে বলে গেছে , “ বিষম বাড়াবাড়ি । ”
বারে বারে
আমার লেখার ব্যাঘাত হত , বিজুর মা তাই রেগে বলত তারে
“ দেখিস নে তোর বাবা আছেন কাজে ?”
বিজু তখন লাজে
বাইরে চলে যেত । আমার দ্বিগুণ ব্যাঘাত হত লেখাপড়ায় ;
মনে হত , “ টেবিলখানা কেউ কেন না নড়ায় । ”
ভোর না হতে রাতি
সেদিন যখন বিজু গেল ছেড়ে খেলা , ছেড়ে খেলার সাথি ,
মনে হল এতদিনে বুড়ো – বয়সখানা
পুরল ষোলো – আনা ।
কাজের ব্যাঘাত হবে না আর কোনোমতে ,
চলব এবার প্রবীণতার পাকা পথে
লক্ষ্য করে বৈতরণীর ঘাট ,
গম্ভীরতার স্তম্ভিত ভার বহন করে প্রাণটা হবে কাঠ ।
সময় নষ্ট হবে না আর দিনে রাতে ,
দৌড়ো বে মন লেখার খাতার শুকনো পাতে পাতে —
বৈঠকেতে চলবে না আলোচনা
কেব লই সৎপরামর্শ কেবল ই সদ্বিবেচনা ।
ঘরের সকল আকাশ ব্যেপে
দারুণ শূন্য রয়েছে মোর চৌকি-টেবিল চেপে ।
তাই সেখানে টিকতে নাহি পারি
বৈরাগ্যে মন ভারি ,
উঠোনেতে করছিনু পায়চারি ।
এমন সময় উঠল মাটি কেঁপে
হঠাৎ কে এক ঝড়ের মতো বুকের ‘ পরে পড়ল আমায় ঝেঁপে ।
চমক লাগল শিরে শিরে ,
হঠাৎ মনে হল বুঝি বিজুই আমার এল আবার ফিরে ।
আমি শুধাই , “ কে রে , কী রে । ”
“ আমি ভোলা ”, সে শুধু এই কয় ,
এই যেন তার সকল পরিচয় ,
আর কিছু নেই বাকি ।
আমি তখন অচেনারে দু-হাত দিয়ে বক্ষে চেপে রাখি ,
সে বললে “ ঐ বাইরে তেঁতুলগাছে
ঘুড়ি আমার আটকে আছে ,
ছাড়িয়ে দাও-না এসে । ”
এই বলে সে
হাত ধরে মোর চলল নিয়ে টেনে ।
ওরে ওরে এইমতো যার হাজার হুকুম মেনে
কেটেছিল নটা বছর , তারি হুকুম আজো মর্ত্যতলে
ঘুরে বেড়ায় তেমনি নানান ছলে ।
ওরে ওরে বুঝে নিলেম আজ
ফুরোয় নি মোর কাজ ।
আমার রাজা , আমার সখা , আমার বাছা , আজো
কত সাজেই সাজো ।
নতুন হয়ে আমার বুকে এলে ,
চিরদিনের সহজ পথটি আপনি খুঁজে পেলে ।
আবার আমার লেখার সময় টেবিল গেল নড়ে ,
আবার হঠাৎ উলটে পড়ে
দোয়াত হল খালি ,
খাতায় পাতায় ছড়িয়ে গেল কালি ।
আবার কুড়োই ঝিনুক শামুক নুড়ি
গোলা নিয়ে আবার ছোঁড়াছুঁড়ি ।
আবার আমার নষ্ট সময় ভ্রষ্ট কাজে
উলটপালট গন্ডগোলের মাঝে
ফেলাছড়া-ভাঙাচোরার ‘ পর
আমার প্রাণের চির – বালক নতুন করে বাঁধল খেলাঘর
বয়সের এই দুয়ার পেয়ে খোলা ।
আবার বক্ষে লাগিয়ে দোলা
এল তার দৌরাত্ম্য নিয়ে এই ভুবনের চিরকালের ভোলা ।