কাকাবাবু দারুণ চটে গেলেন
কাকাবাবু দারুণ চটে গেলেন নিপুদার ওপর।
নিপুদা মানুষটি খুব আমুদে ধরনের, সব সময় বেশ একটা হৈ-চৈ-এর মধ্যে থাকতে ভালবাসেন, আর কথাও বলেন জোরে-জোরে।
নিপুদা আমার জামাইবাবুর ছোট ভাই। গত বছর আমার ছোড়দির বিয়ে হয়ে গেল। ছোড়দি আর জামাইবাবুরা এখন থাকে মধ্যপ্রদেশের ভূপাল শহরে। নিপুদাও ভূপালেই পড়াশুনা করেছে, চাকরিও করে সেখানে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস।
অফিসের কাজে নিপুদাকে প্রায়ই আসতে হয়। কলকাতায়। এসেই চার-পাঁচ দিনের মধ্যে অন্তত পাঁচ-ছটা বাংলা সিনেমা-থিয়েটার দেখে ফেলে। আমাদের খাওয়াতে নিয়ে যায় পার্ক স্ত্রীটের ভাল ভাল হোটেলে। নিপুদা এলে আমাদের সময়টা বেশ ভালই কাটে।
কিন্তু নিপুদার কথা শুনে যে কাকাবাবু প্রথমেই এতটা চটে যাবেন, তা আমিও বুঝতে পারিনি।
কাকাবাবু নিজের ঘরে বসে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে কিছু একটা পুরনো দলিল পরীক্ষা করছিলেন। আর অন্যমনস্কভাবে পাকাচ্ছিলেন বা দিকের গোঁফ। নিপুদা সে-ঘরে ঢুকেই কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করতে গেল। কাকাবাবু তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, আরে, আরে ও কী, না, না, দরকার নেই।
কাকাবাবু পছন্দ করেন না কেউ তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করুক। কাকাবাবুর একটা পা অকেজো বলেই বোধহয় তাঁর বেশি সঙ্কোচ। নিপুদা তবু জোর করে প্রণাম সেরে নিয়ে বসল। তারপর বলল, কাকাবাবু, কেমন আছেন? ওঃ, নেপালে তো আপনারা একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করে এলেন, পুরো একটা গুপ্তচর-চক্রকেই ধরে ফেললেন। ভুপালের কাগজেও খবরটা খুব বড় করে বেরিয়েছিল। আমরা অবশ্য ওখানে বোম্বের খবরের কাগজও পাই-প্রথমে ওরা খবর দিয়েছিল, আপনি বুঝি সেই অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান, ইয়েতি যাকে বলে…তাই আবিষ্কার করে ফেলেছেন! আচ্ছা কাকাবাবু, ইয়েতি বলে সত্যিই কি কিছু আছে?
কাকাবাবু মুখখানা একটু হাসি-হাসি করে বললেন, কী জানি!
নিপুদা আবার বলল, আর ঐ যে লোকটা, কেইন শিপটন, ও কি পালিয়েই গেল? ওকে আর ধরা গেল না?
কাকাবাবু দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, না!
আমি বুঝতে পারলুম কাকাবাবু নিজের কোনও একটা চিন্তা নিয়ে মগ্ন আছেন, কথা বলার মুডে নেই।
নিপুদা আবার জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনি কখনও ভূপাল গেছেন? একবার চলুন না, দারুণ জায়গা, আপনার খুব ভাল লাগবে?
কাকাবাবু বললেন, ভুপাল আমি গেছি। দুবার বোধহয়। না, তিনবার।
নিপুদা তবু খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, আর একবার চলুন। এবারেই আমার সঙ্গে চলুন, একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছে!
এখন তো আমার যাওয়া হবে না। অন্য কাজে ব্যস্ত আছি।
জানেন, ভূপালে গত এক মাসের মধ্যে তিনটে সাঙ্ঘাতিক খুন হয়েছে। পুলিশ কিছু করতে পারছে না।
এবার কাকাবাবু মুখ তুলে সোজা তাকালেন নিপুদার দিকে।
নিপুদা বলল, ওখানকার পুলিশগুলো কোনও কম্মের না! আপনি গেলে ঠিক খুনিকে খুঁজে বার করতে পারবেন। ওখানকার একজন পুলিশ অফিসারকে আমি বলেছি, তুমি মিঃ রায়চৌধুরীর নাম শুনেছি, তাঁকে ডেকে তাঁর বুদ্ধি নাও…।
কাকাবাবুর চোখ দুটি স্থির, মুখখানা লাল হয়ে গেছে। তখনই আমি বুঝতে পেরেছি যে, কাকাবাবু বিরক্ত হয়েছেন। তাঁর অত রাগের কারণটা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম। পরে। কাকাবাবু সাধারণ ডিটেকটিভ নন, খুনের তদন্ত করাও তাঁর পেশা নয়। কোনও বড় শিল্পীকে যদি সিনেমার পোস্টার আঁকতে বলা হয়, তা হলে তিনিও কাকাবাবুর মতনই চটে যাবেন নিশ্চয়ই।
রেগে গেলে কাকাবাবু বকবিকি, চ্যাঁচামেচি কিছুই করেন না, শুধু তাঁর মুখখানা কী রকম চৌকো মতন হয়ে যায়।
কাকাবাবু চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর নিপূদার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন, তোমাদের সব খবরটাবর ভাল তো? রুমি ভাল আছে নিশ্চয়ই?
নিপুদা তাও মহা উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগল, প্রথম খুনটার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয় খুন-ডেড বডিটা পাওয়া গেল। আরেরা কলোনিতে একটা পার্কের মধ্যে-
কাকাবাবু আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, নিপু, তুমি এখন ভেতরে যাও, অন্যদের সঙ্গে কথা-টথা বলে–
কাকাবাবু রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে পেছনের একটা দেয়াল-আলমারি খুলে বই ঘাঁটতে লাগলেন খুব মনোযোগ দিয়ে।
নিপুদা বলল, তারপর শুনুন, কাকাবাবু, থার্ড খুনটা–আমি এবার চুপিচুপি নিপুদাকে বললুম, চলো নিপুদা, আমরা ভেতরে যাই।
নিপুদা কী রকম যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কী ব্যাপার, উনি আমার কথা শুনলেনই না!
কিন্তু পরপর তিনটে নৃ-নৃ-নৃ, মানে ঐ যে কী যে বলে লোমহর্ষ খুন-হ্যাঁগো, সন্তু, এই লোমহর্ষ কথাটার মানে কী গো? হৰ্ষ মানে তো আনন্দ!
আমি বললুম, লোমহর্ষ না, রোমহর্ষক। যা শুনলে ভয়ে সারা গায়ের রোম খাড়া হয়ে ওঠে।
নিপুদা বলল, হ্যাঁ, সেই রকম ঘটনাই বটে। কাকাবাবু যদি কেসটা হাতে নেন, আমাদের মধ্যপ্রদেশে ওঁর খুব নাম হয়ে যাবে।
আমি কাকাবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট। আগে তো আমায় বলতে হবে কেন্সটা। আমি যদি মনে করি নেওয়া যেতে পারে, তা হলে কাকাবাবুকে রাজি করবে।
কিন্তু কাকাবাবুর সহকারী হিসেবে নিপুদা আমায় বিশেষ পাত্তা দিল না। ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি ছেলেমানুষ, তুমি কী বুঝবে! এমন নৃ-নৃপুংসক ব্যাপার!
নূপুংসক? ওঃ হো, নৃশংস! আমি কত সাঙ্ঘাতিক নৃশংস ব্যাপার দেখেছি, তুমি ধারণাই করতে পারবে না! জানো, আন্দামানে কী হয়েছিল
নিপুদা বলল, চল, তা হলে আজ সন্ধেবেলা হীরক রাজার দেশে সিনেমাটা দেখে আসি।
তা তো যাব। খুন তিনটের কথা বলবে না?
নিপুদা আমাদের বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ও কে! তোমরা বাড়িতে নেপালি দারোয়ান রাখলে কবে?
আমি বললুম, নেপালি দারোয়ান না তো! ও তো মিংমা, আমাদের বন্ধু। ওর জন্য কাকাবাবু আর আমি প্ৰাণে বেঁচে গেছি। ও কদিন আগে নেপাল থেকে বেড়াতে এসেছে আমাদের এখানে।
তাই বলো। কী সুন্দর চেহারা ছেলেটির। খুব স্মার্ট, নয়?
মিংমা দুবার এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিল।
ও, শেরপা? হ্যাঁ, হ্যাঁ, একজন শেরপার নামও কাগজে বেরিয়েছিল বটে। এই-ই সেই? এ তো তা হলে খুব বিখ্যাত!
মিংমা গেটের কাছে আমার কুকুরটাকে নিয়ে খেলছিল। এই প্রথমবার কলকাতায় এসেছে মিংমা। কলকাতার রাস্তায় ও এক-একা বেরুতে ভয় পায়। তাই আমাদের সঙ্গে ছাড়া বাড়ির বাইরে বিশেষ কোথাও যায় না। আমার কুকুরটার সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়ে গেছে। বেশ বাংলাও শিখে গেছে এর মধ্যে। শিস দিয়ে ডাকছে, র-কু-কু! ইধার এসো! দৌড়কে এসো!
মিংমাকে ডেকে আমি আলাপ করিয়ে দিলুম নিপুদার সঙ্গে।
নিপুদা ওকে জিজ্ঞেস করল, তুম তো নেপালক আদমি হ্যায়, ভূপাল কভি দেখা? ভুপাল নেপালসে ভি আচ্ছা!
মিংমা ভূপাল জায়গাটার নামই শোনেনি। সে অবাক হয়ে তাকোল আমার মুখের দিকে।
নিপুদা মিংমার বুকে টোকা মেরে বলল, তুম নেপালি, হাম ভূপালি! তুমি ভি হামলোগক সাথ সিনেমা চলো।
সন্ধেবেলা সিনেমা দেখার পরই অবশ্য আমাদের বাড়ি ফিরে আসতে হল, বাইরের হোটেলে আর খাওয়া হল না। কারণ মা আজকে তিন বকম মাছ রান্না করেছেন মিংমার জন্য। মিংমা মাছ খেতে খুব ভালবাসে। বিশেষত ইলিশ আর চিংড়ি।
খাবার টেবিলে নানারকম গল্প-গুজব হচ্ছে, হঠাৎ নিপুদা দুম করে কাকাবাবুকে বলল, কাকাবাবু, আপনি ভুপালে গেলে খুব ভাল হত। আমি ধীরেনদাকে প্ৰায় কথাই দিয়ে ফেলেছি যে, আপনাকে এবার সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
কাকাবাবু খাওয়া বন্ধ করে অকারণেই একবার বাঁ হাত দিয়ে গোঁফটা মুছে গন্তীর গলায় বললেন, নিপু, আমি জানি না। ধীরেন।দাটি কে? আর আমাকে জিজ্ঞেস না করে আমার সম্পর্কে কারুকে কথা দেওয়ার অভ্যোসটিও মোটেই ভাল নয়।
এমন কী, মা পর্যন্ত বুঝতে পেরে গেলেন যে, কাকাবাবু খুবই রেগে গেছেন নিপুদার ঐ রকম কথা শুনে। তাড়াতাড়ি অন্যদিকে কথা ঘোরাবার জন্য বললেন, নিপু, তুমি আর একটা ইলিশ মাছ নাও। একটা পেটি নাও, তোমাদের ওখানে তো ইলিশ পাওয়া যায় না! তোমরা চিংড়ি মাছ পাও?
নিপুদা মায়ের কথা গ্রাহ্য না করে আবার বলল, বুঝলেন না, তিন-তিনটে খুন, তিনজনই শিক্ষিত লোক, তাদের একেবারে গলা কেটে ফেলেছে। একটা ডেড বডি তো আমি নিজেই দেখেছি, ওঃ কী রক্ত?
কাকাবাবু বললেন, খাওয়ার সময় ওসব রক্তারক্তির কথা বলতে নেই, তাতে হজমের গণ্ডগোল হয়। মন দিয়ে খেয়ে নাও বরং, বৌদি খুব সুন্দর রান্না করেছেন।
কাকাবাবু নিজে আর বিশেষ কিছু খেলেন না। প্রায় তক্ষুনি উঠে পড়লেন। আমি শুনতে পেলাম কাকাবাবু ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। অথাৎ এর পদেও যেন নিপুদা গিয়ে ওকে বিরক্ত করতে না পারে।
অবশ্য নিপুদার মুখে খুনের কথা শুনে আর সবাই খুব কৌতূহলী হয়ে উঠল।
বাবা বললেন, তোমাদের ওখানেও খুন-জখম শুরু হয়ে গেছে নাকি?
মা বললেন, কোথাও আজকাল আর একটুও শান্তি নেই। খালি খুন। আর খুন। তুমি নিজের চোখে দেখলে নিপু? কী রকম দেখলে, গলা কাটা?
নিপুদা বলল, খুন তো সব জায়গাতেই হয়, কিন্তু এই খুনগুলো একদম অন্যরকম। তিন জনই নিরীহ ভদ্রলোক, লেখা-পড়ার চাচা নিয়ে থাকতেন। একজন তো আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। ভদ্রলোকের নাম অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তব, আমি কতদিন দেখেছি মাঝরাতের পরেও ওঁর ছাদের ঘরে আলো জ্বলছে। সারারাতও নাকি জেগে কাটাতেন মাঝে মাঝে। যেদিন ঘটনোটা ঘটল সেদিনও রাত দুটোর সময় নাকি পাড়ার একটি ছেলে ওঁর ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছিল, আর ভোরবেলা দেখা গেল, পার্কে একটা বেঞ্চের ওপর পড়ে আছে ওঁর দেহটা, আর মুণ্ডুটা গড়াচ্ছে ঘাসের ওপর।
মা বললেন, উফ! মানুষ, এত নিষ্ঠুর হয়!
নিপুদা বলল, শ্রীবাস্তবজী অতি শান্তশিষ্ট মানুষ, পাড়ার কারুর সঙ্গে তাঁর বিশেষ ভাবও ছিল না, ঝগড়াও ছিল না, নিজের মনে থাকতেন। এ রকম লোককে কে যে মারবে-।
আমি বললুম, নিপুদা, তুমি বারবার শুধু দ্বিতীয় খুনটার কথা বলছ কেন। প্রথম খুনটা কীভাবে হয়েছিল?
দ্বিতীয় খুনটার পরই প্রথম খুনটার কথা ভালভাবে জানা গেল। খবরের কাগজে লিখল যে, অর্জুন শ্ৰীবাস্তবেব মতনই ভূপাল মিউজিয়ামের কিউরেটর সুন্দরলাল বাজপেয়ীকেও কেউ ঐ রকমভাবে গলা কেটে খুন করেছে। মাসখানেক আগে। তাঁর দেহ পাওয়া গিয়েছিল একটা কবরখানায়। সুন্দরলাল বাজপেয়ী অনেকদিন বিলেতে ছিলেন, খুব সাহেব ধরনের মানুষ, তাঁর চেহারাও ছিল বিশাল, ঐ রকম একজন তাগড়া লোকের গলা কেটে খুন করাও তো সহজ কথা নয়।
আর তৃতীয়টা?
তৃতীয় ঘটনোটা একটু অন্যরকম। সেটা তো ঘটল আমি আসবার মাত্র চার দিন আগে। এর নাম মনোমোহন ঝাঁ। বেশ বয়স্ক লোক, চাকরি থেকে কিছুদিন আগে রিটায়ার করেছিলেন। ইনি থাকতেন একা একটি ফ্ল্যাটে। সঙ্গে একজন চাকর। একদিন সকালে দেখা গেল ওঁর ফ্ল্যাটের দরও হাট করে খোলা! মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কেউ মনোমোহন ঝাঁকে খুন করে গেছে। তাঁর মুখের ওপর তখনও বালিশটা চাপা দেওয়া রয়েছে।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আর সেই চাকরটা?
নিপুদা বলল, সবারই প্রথমে চাকরিটার কথাই মনে হয়েছিল। পুলিশও ভেবেছিল, চাকরটাই খুন করে পালিয়েছে। যদিও ঘরের জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি, আর ঐ চাকরীটিও নাকি মনোমোহন ঝাঁ-র কাছে কাজ করেছে। প্রায় তিরিশ বছর ধরে। পরদিন চাকরিটাকে পাওয়া গেল ভূপাল থেকে দশ মাইল দূরে এক মাঠের মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায়, তার জিভটা কাটা।
মা বললেন, অ্যাঁ?
কেউ তার জিভটা কেটে নিয়েছে সম্পূর্ণভাবে। বুঝলেন না, একেবারে লোমহর্ষক ব্যাপার! চাকরিটার চিকিৎসা হচ্ছে হাসপাতালে, বাঁচবে। কিনা সন্দেহ?
তারপর কী হল?
তারপর পুলিশ ভূপাল শহর একেবারে তোলপাড় করে ফেলেছে। কিন্তু কে বা কারা যে এমন খুন করে চলেছে, তার কোনও হদিশই পাওয়া যাচ্ছে না।
মা ভয়ে ভয়ে বললেন, রুমিরা বেশি রাত্তির করে আবার বেড়াতে-টেড়াতে যায় না তো?
নিপুদা বলল, থার্ড খুনটা হওয়ার পর অনেকেই বেশ ভয় পেয়ে গেছে। একটু রাত্তির হলেই রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। সবচেয়ে আশ্চর্য কী জানেন, যে তিনজন খুন হয়েছে, তাদের কারুর বাড়ি থেকেই কোনও জিনিসপত্র বা টাকাকড়ি খোয়া যায়নি। মনে হয় কোনও পাগলের কাণ্ড!
বাবা বললেন, সাধারণ পাগল হলে কি আর এতদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে? পাগল-টাগল নয়, তোমাদের মধ্যপ্রদেশে তো অনেক বড় বড় ডাকাতের গ্যাং আছে।
নিপুদা বলল, ডাকাতরা নিরীহ সাধারণ লোকদের মারে না, আর তারা শহরেও আসে না। এই খুনের উদ্দেশ্যটাই তো বোঝা যাচ্ছে না।
মা বললেন, হাত শুকনো হয়ে যাচ্ছে, এবার তোমরা উঠে পড়ে। হাত ধুয়ে নাও।
নিপুদা হঠাৎ আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, চল সন্তু, আমার সঙ্গে ভুপাল যাবি নাকি?
নিপুদা জিজ্ঞেস করার আগেই আমি সব ঠিক করে ফেলেছি অনেকটা। আমার এখন ছুটি। অনায়াসেই ছোড়দির বাড়িতে কিছুদিন থেকে আসতে পারি। খালি একটা ব্যাপার আছে। আমি জানি, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য সমাধান করার জন্য যে আন্তজাতিক তদন্ত কমিশন বসেছে, তাতে কাকাবাবুকে সদস্য করা হয়েছে। সানফ্রানসিসকো আর বারমুডার মাঝখানে সমুদ্রের একটা জায়গায় বড় বড় জাহাজ হঠাৎ ড়ুবে যায়। এমন কী, আকাশ থেকে অনেক এরোপ্লেনকেও যেন চুম্বকের মতো টেনে নেয়। কত যে এইভাবে ড়ুবেছে তার ইয়াত্তা নেই। এই তদন্ত কমিশনের কাজ শুরু করার জন্য কাকাবাবু নেমন্তন্ন পেয়েছেন আমেরিকা থেকে। কিন্তু কাকাবাবু লিখে জানিয়েছেন যে, তিনি কমিশনের সদস্য হতে আগ্রহী নন। তাঁকে যদি কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে তিনি একাই ঐ রহস্য সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে পারেন।
কাকাবাবুর এই চিঠির উত্তর এখনও আসেনি। যদি ওরা রাজি হয়, তাহলে কাকাবাবু তো আর একদম একা যাবেন না, নিশ্চয়ই আমাকেও নিয়ে যাবেন। ভুপাল গেলে যদি সেটা ফস্কে যায়?
অবশ্য আমেরিকা যেতে হলেও তো কাকাবাবু এক্ষুনি যাচ্ছেন না। অনেক কিছু ব্যবস্থা করতে হবে এখানে। এর মধ্যে আট-দশ দিনের জন্য আমি ভূপাল থেকে ঘুরে আসতে পারি। নিশ্চয়ই কাকাবাবু আমাকে ফেলে চলে যাবেন না। এর আগে সব কটি অভিযানে আমি কাকাবাবুর সঙ্গে গেছি।
নিপুদার প্রশ্নের উত্তরে আমি বললুম, হ্যাঁ, যাব?
মিংমা এতক্ষণ মুখ নিচু করে মাছের কাঁটা বেছে খেয়ে যাচ্ছিল, এবার মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে।
আমি বললুম, মিংমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। ওর বেশ বেড়ানো হবে।
মা বললেন, না, না, এখন ভূপাল যেতে হবে না! খুনে গুণ্ডারা ঘুরে বেড়াচ্ছে!
নিপুদা হা-হা করে হেসে উঠে বলল, আপনি ভয় পাচ্ছেন নাকি? আমরা তো রয়েছি। আমাদের বাড়িতে লাইসেন্সড় বন্দুক আছে, আজেবাজে লোক আমাদের বাড়ির ধার ঘেঁষতে সাহস করে না।
বাবা বললেন, যাক না, ঘুরে আসুক না, এখন তো ছুটি রয়েছে।
পরদিন সকালে আমি কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলুম, কাকাবাবু, আমি কি নিপুদার সঙ্গে ভূপাল যাব। কদিনের জন্য? খুব করে বলছেন–
কাকাবাবু আজও ম্যাগনিফায়িং গ্লাস নিয়ে পুরনো কাগজপত্র পরীক্ষা করছিলেন। মুখ তুলে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও, ঘুরে এসো! কবে যাচ্ছ? আজই?
মনে হল, যেন আমরা আজকে গেলেই কাকাবাবু খুশি হন। তাহলে নিপুদা আর ওঁকে বিরক্ত করতে পারবে না।
হ্যাঁ, আজকেই রাত্তিরের ট্রেনে। মিংমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব?
এবার একটু ভেবে কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। মিংমাও ঘুরে আসুক। তবে ঐসব খুন-টুনের ব্যাপারে নাক গলাতে যেও না!