বোকা হরির কান্ড
হরি প্রায়ই শোনে ‘চায়ের কাপে ঝড়, কফির কাপে ঝড়’ কথাটা। কিন্তু গ্রামের মুখ্যু সুখ্যু মানুষ হরির ওই টুকু মাথায় কিছুতেই ঢোকে না কাপে ঝড় কি করে ওঠে! ও দেখেছে ফি বছর ঝড়ে গ্রামের গাছপালা ভেঙে পড়ে, মাটির বাড়ি-ঘর ভেঙে যায়। মাঠের ফসলের ক্ষয় ক্ষতি হয়। কিন্ত কাপে ঝড়! না, হরি কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু মনে মনে খুব ইচ্ছে একবার কাপের ঝড় দেখতেই হবে। মনের কথাটা হরি জানাবে কাকে?
ঠিক করলো ঘোষবাড়ির কালু ঘোষকে কথাটা বলবে। ও তো রোজ কলকাতা যায় দুধ বিক্রি করতে, ও নিশ্চয়ই জানবে কাপের ঝড় কেমন হয়। এমনিতেও কালুর পাড়ায় খুব নাম চালাকচতুর ছেলে হিসেবে। ও লোকের কাছথেকে টাকা ধার নিয়ে শেয়ারের ব্যাবসায় খাটায়। হরির কাছথেকেও তো বেশ কিছু টাকা নিয়েছে। কিন্তু শোধ দেওয়ার বেলায় আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু এই করে যাচ্ছে। তা যাকগে, হরি ঠিক করলো কালু’কে-ই জিজ্ঞেস করবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ…
” আরে! হরিকাকা যে! তা আমার কাছে কি মনে করে? আমি কিন্তু তোমাকে আগেই বলেছি তোমার টাকা আমি বছরের শেষে ঠিক ফিরিয়ে দেবো।”
“আরে না না আমি টাকার জন্য আসিনি।”
“তবে কিসের জন্য এসেছো কাকা? দুধ লাগবে?কাল কোলকাতায় যাওয়ার পথে কাকিমার কাছে দুধ রেখে যাবো।একেবারে খাঁটি দুধ রেখে যাবো। খেয়ে বলবে কেমন।”
“আরে না না, দুধ টুধ কিছু চাই না। তুমি আমাকে একটা কথা শুধু বলোতো, তুমি কাপে ঝড় উঠতে দেখেছো?”
“কাপে…ঝড়..? সেটা আবার কি?”
“তুমিও দেখো নি? ওই যে সেদিন খবরে বলছিল কলকাতার কফি হাউস না কি আছে ওখানে নাকি চা কফির কাপে ঝড় উঠেছে!”
“ও এই কথা। ওই ঝড় তো…”
কালুর মাথায় হঠাৎ দুষ্টবুদ্ধি চাপলো; ও বলল-
“কাকা তুমি ঠিক শুনেছো; সে যা ঝড়! কি বলব কাকা! সবাই সেই ঝড়ে উড়ে যায় আরকি; তুমি দেখবে নাকি সেই ঝড়?”
“আমি?আ..আমি কি করে দেখবো? আমিতো ও সব জাগা চিনি নে।”
“আরে কাকা চিন্তা কিসের? আমি তো আছি নাকি?আমি নিয়ে যাবো তোমাকে কাপের ঝড় দেখাতে।”
” ওই ঝড়ের কথাও কি রেডিও-তে আগের থিকে বইলে দেয়? “
“হ্যাঁ বলে দেয়তো! কাকা তোমার ভাগ্যটা কিন্তু হেব্বি! কালকেই ওই ঝড়ের পূর্বাভাস আাছে। তুমি কালকেই আমার সাথে চলো আমি তোমাকে কফির কাপে ঝড় দেখিয়ে আনবো। কিন্তু এর জন্য একটু খরচাপাতি আছে। আর এই কথা কিন্তু পাঁচকান করলে হবে না। নয়তো সবাই যেতে চাইবে বুঝলে কিনা?”
“না না, আমি কাউকে কিচ্ছু বইলবো নে। আর কালকের সব খরচ আমি কইরবো, তোমার চিন্তা নাই।”
হরি মহা আনন্দে আছে কালকে কলকাতা গেলেই কফির কাপের ঝড় দেখতে পাবে।
পরদিন সকাল সকাল হরি বৌ কে বলল “আজ আমি একটু কইলকেতা যাচ্ছি রেতেই ফিরে আইসবো। “
হরির বৌ জানে তার বরটি একেবারে সহজ সরল মানুষ। ওকে বোকা বানানো খুব সহজ। তাই যখনই শুনলো হরি কালুর সঙ্গে যাচ্ছে হরির বৌ তো প্রমাদ গুনল।কিন্তু হরি এমন জেদি ও বৌয়ের কথা শুনবে না। যাবেই।অগত্যা হরির বৌ চুপ করে থাকলো।
কলকাতায় পৌঁছে কালু বলল
“এটাই কফি হাউস। চলো আমরা এই বাড়িটার মধ্যে ঢুকে বসি। দেখবে চারিদিকে কতো লোক, কতো চেয়ার টেবিল।”
“ও বা..বা এ..তো লোক এখেনে ঝড় দেইখতে এসিছে? “
“হ্যাঁ তো, সবাই এরা ঝড় দেখতে এসেছে।”
দুজনে কোণের দিকে একটা টেবিলে বসলো। কালু বেয়ারাকে ডেকে প্রথমে বেশ কিছু ভালো ভালো খাবারের অর্ডার দিলো। পরের ঘাড় ভেঙে খাওয়ার এমন সুযোগ তো রোজ রোজ আসবে না।
খাওয়া হলে হরি কালুকে জিজ্ঞেস করে
“কালু, ঝড় কখন উইঠবে কিছু তো বুঝা যাইচ্ছে না। অনেক সময় তো হইলো! আমাগের আবার বাড়ি ফিরতি হবেতো!”
“এইতো কাকা এবার কফির অর্ডারটা করবো আর তার পরেই ঝড় উঠবে। কাকা তুমি কফিটা খাও আর ঝড় দেখো, আমি একটা কাজ সেরে একটু পরেই ফিরে আসছি। আর হ্যাঁ, কফির কাপটা নিয়ে তুমি ঘুরে ঘুরে কফি খেও, এখানে এভাবেই কফি খাওয়ার নিয়ম। আমি আসছি কাকা।”
বলেই কালু কফি হাউস থেকে চলে গেলো। বেয়ারা কফির কাপ হরির টেবিলে নামিয়ে রেখে একটা বিল ধরিয়ে দিলো। বিল দেখে হরির চক্ষু চড়কগাছ! ‘এতো টাকা দিতি হবে!পাজি হতচ্ছাড়া কালু আমাকে এই ভাবে বোকা বানাইলো! বৌ ঠিকই বলে আমার মতো মুখ্যু লোককে বোকা বানানো খুব সোজা।’
কি আর করা!এখন কিল খেয়ে কিল হজম করতে হবে। হরি টাকা মিটিয়ে দিয়ে কফির কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ‘এখানে আবার নাকি নিয়ম কাপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে কফি খেতি হবে।কই ঝড় তো এখনও উইঠলো না।তবে কি কালু আমাকে এটাতেও বোকা বানালো?’
হরি কফির কাপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাপে চুমুক দিচ্ছে, একটা বড়ো পেডেস্টাল ফ্যানের কাছে যেই গেছে, হরির কাপের কফি হাওয়ায় তোড়ে সামনের টেবিলে বসা দম্পতির চোখে মুখে গিয়ে ছিটকে লাগলো। ওই দম্পতি তো হরিকে এই মারে কি সেই মারে। হরি কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলল “আজ্ঞে আমি গেরামের মুখ্য সুখ্য মানুষ, দিদিমুনি বুইঝতি পারিনাই। আমি কলকেতা এইছিলাম কফির কাপের ঝড় দেইখবো বলে। আমার খুব শিক্ষে হইয়েছে। আর আমি ওই কালুটার কথায় কোনোদিন কোনো কাজ কইরবো নে। আমায় ক্ষমা কইরে দিন দিদিমুনি। এই আমি নাক কান মইলছি।”
তারপর থেকে হরি আর কোনোদিন কালুর কাছে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। ও হ্যাঁ, কালু এখনও হরির কাছথেকে ধার নেয়া টাকা শোধ করেনি। খুব সাবধান কালু ঘোষকে কেউ টাকা ধার দেবেন না। দিলে কিন্তু আর ফেরত পাবেন না।