দুপাশে ধুধু করা মাঠ
দুপাশে ধুধু করা মাঠ, তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। কোনও বাড়িঘর তো দেখাই যাচ্ছে না, মাঠে কোনওরকম ফসল নেই, গাছপালাও প্রায় নেই বলতে গেলে। অনেক দূরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখা। এই অঞ্চলটাকে ঠিক মরুভূমি বলা যায় না, ভাল বাংলাতে এইরকম জায়গাকেই বলে ঊষর প্রান্তর।
রাস্তাটা অবশ্য বেশ সুন্দর, মসৃণ, কুচকুচে কালো যত্ন করে বাঁধানো। গাড়ি চলার কোনও ঝাঁকুনি নেই, রাস্তার দুপাশে কিছু দেখারও নেই, তাই সবারই ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গাড়ি যে চালাচ্ছে, তাকে তো চোখ মেলে থাকতেই হবে, রঞ্জন সেইজন্য নস্যি নিচ্ছে মাঝে-মাঝে। আকাশে একটুও মেঘের চিহ্ন নেই, মধ্য গগনে গনগন করছে সূর্য। মাঝে-মাঝে দু-একটা লরি ছাড়া এ রাস্তায় গাড়ি চলাচলও নেই তেমন।
সামনের সিটে বসে আছেন কাকাবাবু। চলন্ত গাড়িতেও তিনি বই পড়ছিলেন, একসময় হাত তুলে বললেন, খাবার জল আর আছে, না ফুরিয়ে গেছে?
পেছনের সিটের মাঝখানে বসেছে রঞ্জনের স্ত্রী রিঙ্কু, তার দুপাশে জোজো আর সন্তু। দুজনেই জানলার ধার চেয়েছিল, কিন্তু এখন ঘুমে ঢুলছে। রিঙ্কু সোজা হয়ে জেগে বসে আছে, তার কোলের ওপর একটা ম্যাপ ছড়ানো। রঞ্জন এর আগে দু-তিনবার ভুল করে অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়তে যাচ্ছিল, রিঙ্কুই। প্রত্যেকবার তাকে গাড়ি ঘোরাতে বলেছে।
কাকাবাবুর কথা শুনে রিঙ্কু পায়ের কাছ থেকে ওয়াটার বলটা তুলে নেড়েচেড়ে বলল, শেষ হয়ে গেছে! আমাদের আরও দুটো-তিনটে জলের বোতল আনা উচিত ছিল।
ওরা বেরিয়েছে বাঙ্গালোর থেকে খুব ভোরে। সেখানকার আবহাওয়া খুব সুন্দর, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা, পথে যে এত গরম পড়বে সেকথা তখন মনে আসেনি।
কাকাবাবু বললেন, একটা কোনও নদী-টদিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না এদিকে।
রঞ্জন বলল, এর পর যে পেট্রোল-পাম্প পড়বে, সেখানে আমরা জল খাব, গাড়িও জল-তেল খাবে।
কাকাবাবু বললেন, এ-তল্লাটে কোনও পেট্রোল-পাম্প আছে কি? শুধুই তো মাঠের পর মাঠ দেখছি!
রিঙ্কু বলল, ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, আর ১৪ কি… না, না, দাঁড়ান, হিসেব করে বলছি, উ, ইয়ে, প্রায়, তিন ক্রোশ পরে একটা বড় জায়গা আসছে, এর নাম চিত্ৰদুগা! সেখানে গাড়ির পে.. মানে তেল আর খাবার-টাবার পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই!
রঞ্জন অবহেলার সঙ্গে বলল, তিন ক্রোশ? কতক্ষণ লাগবে, পনেরো মিনিটে মেরে দেব! তোমরা সবাই এরই মধ্যে এত ঝিমিয়ে পড়ছ কেন, চিয়ার আপ!
সন্তু ঘুমজড়ানো গলায় বলল, রঞ্জনদা দুবার, কাকাবাবু এবার?
রঞ্জন বলল, এই রে, বিচ্ছুটা সব শুনছে? আমি ভেবেছিলুম ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি!
সন্তু পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বার করে কী যেন লিখল, তারপর আবার চোখ বুজল।
রঞ্জন বলল, আরে, এ-ছেলে দুটো এত ঘুমোয় কেন? আমরা কত ভাল-ভাল জিনিস দেখছি।
সন্তু চোখ না খুলেই বলল, কিছু দেখার নেই।
রঞ্জন বলল, একটু আগে রাস্তা দিয়ে দুটো ছোট-ঘোট বাঘ চলে গেল। এখন যতি দেখতে পাচ্ছি, একটা, দুটো, তিনটে… কাকাবাবু, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?
কাকাবাবু বললেন, আরে, তাই তো রঞ্জন কি ম্যা… ইয়ে জাদুবিদ্যে জানে নাকি? সত্যিই তো হাতি?
কাকাবাবুর কথা শুনে সন্তু ধড়মড় করে উঠে বসল। কোনও সন্দেহ নেই, সোজা রাস্তাটার অনেক দূরে গোটাতিনেক হাতি দেখা যাচ্ছে। সন্তু ধাক্কা দিয়ে জাগাল জোজোকে।
জোজো সামনের দিকে চেয়েই বলল, ওয়াইন্ড এলিফ্যান্টস!
সন্তু পকেট থেকে ছোট খাতাটা বার করতে করতে বলল, জোজো এক!
রঞ্জন বলল, এই ধুধু-করা মাঠের মধ্যে বন্য হস্তী আসিবে, ইহা অতিশয় অলীক কল্পনা। আমার মনে হয়, এই হস্তীযুথ বিক্রয়ের জন্য হাটে লইয়া যাওয়া হইতেছে। সন্তু, একটা হাতি কিনবি নাকি?
গাড়িটা আরও কাছে আসবার পর দেখা গেল হাতিগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু লোজনও আছে, কয়েকজন সানাই বাজাচ্ছে। মাঝখানের হাতিটায় একজন প্যান্ট-কোট পরা লোক বসে আছে, তার গলায় অনেকগুলো মালা, মাথায় সাদা রিবনো পাগড়ি।
রিকু বলল, ওমা, বর যাচ্ছে!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, বউ কোথায়? প্যান্ট-কোট-পরা বর হয় নাকি?
রঞ্জন বলল, হ্যাঁ, হয়। এখানে এরা সুট পরে, পাগড়ি মাথায় দিয়ে বিয়ে করতে যায়। এই লোকটা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
রিকু বলল, এদের দিনের বেলায় বিয়ে হয়। বাঙালিদের বিয়ের মতন আলোটালো জ্বালার খরচ নেই!
জোজো বলল, এরা হচ্ছে গোন্দ নামে একটা ট্রা… মানে, উপজাতি। এদের মধ্যে নিয়ম আছে, হতির বিয়ে দেওয়া খুব ধুমধাম করে। আজ হাতিগুলোরও বিয়ে হবে, তাই ওদের গলাতেও মালা পরানো হয়েছে, দেখেছিস সন্তু।
রঞ্জন ভুরু কপালে তুলে বলল, বাঃ, তোমার তো অনেক জ্ঞান দেখছি!
সন্তু বলল, ও আপনাকেও ছাড়িয়ে যাবে, রঞ্জনদা!
জোজো বলল, আমার মামাবাড়িতে দুটো হাতি ছিল কিনা! সেখানে মাহুতের মুখে শুনেছি। আমার এক মামা সেই মাহুতকে অসম থেকে নিয়ে এসেছিল।
রঞ্জন ঘ্যাঁচ করে গাড়িতে ব্রেক কষে বলল, তা হলে জিজ্ঞেস করা যাক, আজ ওই লোকটার বিয়ে, না হাতিগুলোর বিয়ে?
রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, এই রঞ্জন, পাগলামি করবে না!
রঞ্জন গোঁফ-দাড়ির ফাঁক দিয়ে অনেকখানি হেসে বলল, আমার নতুন-নতুন জিনিস শিখতে খুব ভাল লাগে। হাতির বিয়ে!
বছরখানেক ধরে রঞ্জন দাড়ি রাখছে। শুধু রাখছে না, দাড়ি ইচ্ছেমতন বাড়তে দিচ্ছে, এখন তাকে প্রায় ইতিহাসের নানাসাহেবের মতন দেখায়। তার চেহারাটিও সেরকম বিরাট। কিন্তু তার হাসিতে এখনও একটা দুষ্টু ছেলের ভাব ফুটে ওঠে।
কিছু লোক হাতির পিঠে চেপেছে, কিছু লোক পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। সানাইওয়ালারা গাড়ি দেখে যেন বেশি উৎসাহ পেয়ে জোরে-জোরে বাজাতে লাগল।
রঞ্জন তাল দিতে দিতে বলল, এদের সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে চলে যাব? ভাল খাওয়াবে।
কাকাবাবু অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। এবার বললেন, রঞ্জন, গাড়ি থামলেই গরম বেশি লাগছে। আগে আমার একটু জল খাওয়া দরকার।
রঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে আবার স্টার্ট দিয়েই এই হাতির শোভাযাত্রাটাকে পাশ কাটিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।
রিঙ্কু বলল, এই কী করছ? এত স্পিড দিও না!
সন্তু খাতা বার করে বলল, রিঙ্কুদি এক?
রিঙ্কু বলল, কেন? আমি কী বলেছি? ওঃ হো, স্পিড! না বাপু, আমি এই খেলা খেলতে পারব না!
কাকাবাবু হাসতে লাগলেন। রঞ্জন একটা স্বরচিত গান ধরে দিল, গতি! গতি! যার নাই কোনও গতি, সেই করে ওকালতি! কিংবা সে পথ ভোলে, ভুলুক না, তাহেকী বা ক্ষতি।
সামনেই একটা মোড় এল, ডান দিকে বাঁ দিকে দুটো রাস্তা বেরিয়ে গেছে। রিঙ্কু বলল, পথ ভুল করলে চলবে না! রঞ্জন, এবার লেফট টার্ন নাও, আমরা হাইওয়ে ছাড়ব না। ওইটা হাইওয়ে দেখতে পাচ্ছ না?
সন্তু বলল, রিঙ্কুদি দুই!
জোজো বলল, দুই না, তিন! হাইওয়ে দুবার বলেছে।
রিঙ্কু বলল, অ্যাই, হাইওয়ের বদলে কী বলব রে?
সন্তু বলল, রাজপথ। বাকিগুলো শাখাপথ।
কাকাবাবু বললেন, সামনে ওই যে পাহাড়ের ওপর মন্দির দেখা যাচ্ছে, ওইটাই খুব সম্ভবত চিত্রদুগা। অনেকদিন আগে এখানে একবার এসেছিলাম, ভাল মনে নেই। পাহাড়টার গায়ে একটা দুর্গ আছে। খুব সম্ভবত এই জায়গাটার আসল নাম চিত্ৰ-দুর্গ, ইংরেজি বানান দেখে-দেখে লোকে এখন বলে চিত্রদুর্গা। এসব দিকে দুর্গা মন্দির থাকা অস্বাভাবিক। ওপরের মন্দিরটা বোধহয় শিবমন্দির।
রঞ্জন বলল, আর বেশিদূর গিয়ে কী হবে? ওই পাহাড়টার তলায় যদি কোনও বাংলো-টাংলো পাওয়া যায়, তা হলে সেখানে থেকে গেলেই তো হয়।
রিঙ্কু বলল, মোটই না! রঞ্জন, আজ সন্ধের মধ্যেই আমরা হপি পৌঁছতে চাই।
জোজো বলল, মধ্যপ্রদেশে এরকম একটা পাহাড়ের মাথায় মন্দির দেখেছিলুম, সে-পাহাড়টা অবশ্য আরও অনেক উঁচু, সেখানে নরবলি হয়।
রিঙ্কু একটু চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি দেখেছ মানে? তুমি সেই মন্দিরে নরবলি দিতে দেখেছ?
জোজো বলল আমি যেদিন সেই পাহাড়টার ওপরে উঠি সেদিন শুধু মোষবলি ছিল। তবে আমার মামা নিজের চোখে নরবলি দেখেছে?
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, এটা তোমার কোন্ মামা? যিনি অসম থেকে মাহুত আর হাতি এনেছিলেন?
জোজো বলল, না, সে অন্য মামা!
রঞ্জন আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার কতজন মামা?
জোজো উত্তর দেবার আগেই সন্তু বলল, আমি এ-পর্যন্ত জোজোর এগারোজন মামা আর সতেরোজন পিসেমশাইয়ের হিসেব পেয়েছি।
রঞ্জন একটুও অবাক না হয়ে বলল, তা তো থাকতেই পারে। কারও কারও মামা-মামি, পিসে-পিসির ভাগ্য ভাল হয়। ভাবো তো, যার কোনও মামা নেই, মেসোমশাই কিংবা পিসেমশাই নেই, সে কত হতভাগ্য! আমি মামি, মাসি আর পিসিদের কথা বাদ দিচ্ছি।
রিঙ্কু বলল, কেন, তুমি মাসি-পিসিদের কথা বাদ দিচ্ছ কেন? মাসি-পিসি থাকাটাও তো দুর্ভাগ্য!
রঞ্জন বলল, এইজন্যই বলি রিঙ্কু, যে-কোনও কথা বলার আগে একটু বুদ্ধি খাটাবে! যে-লোকের মাসি নেই, তার কি মেলোমশাই থাকতে পারে? মনে করো, আমার বাবার কোনও বোন নেই, তা বলে কি আমি যার-তার সঙ্গে পিসেমশাই সম্পর্ক পাতাতে পারি। তঁা, একটা কথা তুমি বলতে পারে বটে যে, মামিমা না থাকলেও মামা থাকতে পারে! মামা-শ্রেণীর লোকেরা একটু স্বার্থপর হয়, মামিমাকে বাদ দিয়েও তাদের মধ্যে কেউ-কেউ মামা হিসেবে টিকে যায়। কিন্তু পিসিমা-ই নেই অথচ পিসেমশাই, এ যে সোনার পাথরবাটি!
কাকাবাবু এদের কথা শুনে মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
এখন রাস্তার ধারে দু-চারখানা বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা বাস। তার কাছেই বাজার। রঞ্জন সেখানে গাড়ি না থামিয়ে, কয়েকবার বাঁক নিয়ে একেবারে পৌঁছে গেল পাহাড়ের গায়ে দুর্গের দরজায়।
দরজা মানে সিংহদরজা যাকে বলে, তিন-মানুষ উঁচু কাঠের পাল্লা, তার গায়ে লোহার বন্টু বসানো। দুপাশে দুটি পাথরের সিংহ। তার মধ্যে একটা সিংহের অবশ্য মুণ্ডু নেই।
কাছেই একটা বাড়ির গায়ে লেখা আছে, হোটেল।
রঞ্জন বলল, আগে এখানে ভাত-মাংস খেয়ে নেওয়া যাক। ওহো, মাংস তো এ তল্লাটে পাওয়া যায় না। এটা নিরামিষের দেশ!
কাকাবাবু ক্রাচ বগলে দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, আমার নিরামিষে আপত্তি নেই। তোমাদের কষ্ট হবে। দ্যাখো যদি ডিম পাওয়া যায়।
হোটেল মানে অবশ্য পুরনো একটা চায়ের দোকানের মতন। তবে ভেতরটা খুব পরিষ্কার। পেতলের থালা-গেলাসে খাবার দেওয়া হয়। সেগুলি ঝকমকে করে মাজা। কয়েকজন লোক খেয়ে বেরোচ্ছে, টেবিল সাফ করা হচ্ছে, তাই ওরা অপেক্ষা করতে লাগল বাইরে।
দোকানের বাইরে কয়েকটা ফুলের গাছ। তার মধ্যে একটা বড় গাছ থেকে লম্বা লম্বা লালচে ফুল ঝুলছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে রিঙ্কু বলল, এগুলো কী ফুল জানিস সন্তু? বল তো?
সন্তু মুচকি হেসে দুদিকে ঘাড় নেড়ে বলল, জানি না। তুমি বলো।
বট্ল ব্রাশ। এগুলোকে বলে বট্ল ব্রাশ।
জানতুম। আমি নামটা জানতুম। তবু তোমাকে দিয়ে বললুম। তোমার আরও দুবার জরিমানা হল।
তার মানে? কেন জরিমানা হবে? বল ব্রাশ একটা ফুলের নাম। তার কোনও বাংলা নেই।
কে বলল নেই? বল-এর বাংলা বোতল আর ব্রাশ-এর বাংলা বুরুশ। এই ফুলটার নাম বোতলবুরুশ!
কাকাবাবু হোহো করে হেসে উঠলেন। রঞ্জন বলল, হ্যাঁ, সন্তু ঠিকই বলেছে, যেমন, টেল-এর বাংলা টেবিল আর গ্লাস-এর বাংলা গেলাস
সন্তু পকেট থেকে ছোট্ট খাতাটা বার করল।
সেই খাতার এক-একটা পাতায় এক-একজনের নাম লেখা আছে। কাল রাত্তিরেই ঠিক হয়েছিল যে, আজ সকাল থেকে বেড়াতে বেরোবার পর কেউ একটাও ইংরেজি শব্দ বলবে না। কেউ ভুল করে বলে ফেললেই একটা। ইংরেজি কথার জন্য দশ পয়সা জরিমানা। সন্তু খাতায় সেই হিসেব লিখে রাখছে। কাল সবাই এই খেলা খেলতে রাজি হয়েছিল।
রিঙ্কু বলল, না, আমি আর এই পচা খেলা খেলব না! আই কুইট!
রঞ্জন বলল, অ্যাই, এখন ওসব বললে চলবে না। আজ রাত্তিরে সব হিসেব হবে, জরিমানার টাকাটা দিয়ে তারপর ছুটি। রিঙ্কু, তোমার আরও দুবার
জরিমানা হল।
জোজো বলল, ভেতরটা খালি হয়ে গেছে। চলো গিয়ে বসি। এবার আর-একটা মজা হবে মনে হচ্ছে!
একটাই লম্বা টেবিল, সবাই মিলে কাছাকাছি বসল। একজন সাদা লুঙ্গি-পরা বেয়ারা সবাইকে জলের গেলাস দিয়ে অর্ডার নেবার জন্য দাঁড়াল।
রঞ্জন বলল, ভাই আমরা ক্ষুধার্ত। আমাদের কিছু খাদ্য দাও। ভাত, ডাল, মাংস, ডিম যা খুশি!
লোকটি কিছু বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে রঞ্জনের কাছে ঝুঁকে এসে কী যেন বলল।
রঞ্জন বলল, আমি ভাই তোমার সঙ্গে ইংরিজি বলে জরিমানা দিতে পারব বা। খাবারের দাম সবাই মিলে দেবে, আর জরিমানা আমাকে একলা দিতে হবে। তুমি আমার বাংলা কথা শুনে যা বোঝো তাই দাও।
লোকটি এবার ইংরেজিতে বলল, হোয়াট ডিড ইউ সে সার?
রঞ্জন সবেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, উঁহু, তুমি যতই ইংরেজি বলল, আমি বাংলা ছাড়া কিছু বলব না। আমাদের খাদ্য দাও, খাদ্য!
রিঙ্কু বলল, এইরকম করলে আমাদের আর কিছু খাওয়াই হবে না! আমরা কেউ কন্নড় ভাষা জানি না, এরা কেউ হিন্দিও বোঝে না! বাংলা তো দূরের কথা।
কাকাবাবু উঠে গিয়ে একটা দেওয়ালের পাশে দাঁড়ালেন। সেখানে খাবারদাবারের নামলেখা একটা তালিকা ঝুলছে। কন্নড় আর ইংরেজি দু ভাষাতেই লেখা। কাকাবাবু বেয়ারাটির দিকে ইঙ্গিত করে কয়েকটা নামের ওপর আঙুল রাখলেন। তারপর হাত তুলে পাঁচটা আঙুল দেখিয়ে বোঝালেন যে পাঁচজনের খাবার চাই।
বেয়ারাটি অদ্ভুত মুখের ভার করে ভেতরে চলে গেল।
কাকাবাবু ফিরে এসে বললেন, এতে মোটামুটি কাজ চালানো গেল, কী। বলো? কিন্তু সন্তু তোর নিয়মটা একটু পালটাতে হবে। আমরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজি বলব না, কিন্তু বাইরের লোকদের সঙ্গে বলতেই হবে! অন্য লোকরা
তো আমাদের সঙ্গে এ-খেলায় যোগ দেয়নি।
সন্তু বলল, ঠিক আছে। অন্যদের বেলায় অ্যা-অ্যা-অ্যা, মানে অন্যদের সঙ্গে বলা যাবে।
রিঙ্কু বলল, অন্যদের সঙ্গে অ্যালাউড? বাঁচা গেল!
তারপর কাউন্টারের ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে সে বলল, এক্সকিউজ মি, প্লিজ সেন্ড দা বেয়ারার এগেইন!
সন্তু বলল, রিদি, তুমি অ্যালাউডটা আমাদের বলেছ! তোমার আর একটা…
সবাই হেসে উঠল আবার।
এই দোকানে ইডলি-ধোসাবড়া ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। মাংস তো দূরের কথা, ভাতও নেই। বেয়ারাটি খুব ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে, একটু আগে তার ইংরেজি কথা শুনেও এরা উত্তর দিচ্ছিল না, এখন এদের মুখে ইংরেজির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
ওদের খাওয়ার মাঝখানে দোকানটির সামনে একটা বড় স্টেশন ওয়াগন থামল। তার থেকে নামল চারজন লোক, তাদের মধ্যে একজনের দিকেই বিশেষ করে চোখ পড়ে। এই গরমেও সেই লোকটি পরে আছে একটা চকচকে সুট, চেহারাটি ছোটখাটো একটি পাহাড়ের মতন, তার চোখে সান গ্লাস, মুখে লম্বা চুরুট।
দুপদাপ করে জুতোর শব্দ তুলে লোকগুলো ঢুকল ভেতরে। টেবিলে বসার আগেই একজন জিজ্ঞেস করল, কফি হায়? কফি মিলেগা?
কাকাবাবু খাওয়া বন্ধ করে এই আগন্তুকদের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন।
পাহাড়ের মতন লোকটি কাকাবাবুর দিকে চোখ ফেলেই মহা আশ্চর্যের ভান করে বলল, ওয়েল, ওয়েল, ওয়েল, আপ রাজা রায়চৌধুরী হ্যায় না? আপ ইধার?
বাংলা-অসম-ত্রিপুরা কিংবা বিহার-ওড়িশা বা দিল্লিতে কাকাবাবুকে অনেকে চিনতে পারে, কিন্তু এই কণাটকের একটা ছোট্ট জায়গাতেও যে কেউ তাকে। চিনতে পারবে, তা যেন তিনি আশা করেননি। তিনি লাজুকভাবে একটু হেসে বললেন, এই এদিকে একটু বেড়াতে এসেছি।
লোকটি এগিয়ে এসে বলল, বেড়াতে এসেছেন? এখানে?
কাকাবাবু বললেন, শুধু এখানে না। আশেপাশে কয়েকটা জায়গায়। সঙ্গে এই আমার ভাইপো, সন্তু। ওর কলেজের বন্ধু জোজো। আর ইনি রঞ্জন ঘোষাল আর ওঁর স্ত্রী রিঙ্কু ঘোষাল, আমার বিশেষ পরিচিত।
লোকটি সকলের দিকে হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলল, আমার নাম মোহন সিং। আমাকে চিনেছেন তো? দিল্লিতে দেখা হয়েছিল একবার।
তারপর সে কাকাবাবুর কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, সামুচ বলুন তো, আপনাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কেউ তো পাঠায়নি। আমরা নিজেরাই এসেছি।
মোহন সিং বলল, নিজেরা এসেছেন তো ঠিক আছে, আপনি কার হয়ে কাজ করছেন?
মোহন সিং কাকাবাবুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তখনও তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে আছে।
কাকাবাবু এবার একটু কড়া গলায় বললেন, আপনি ওদিকে গিয়ে বসুন।
মোহন সিং তবু সরল না। চওড়া করে হেসে বলল, ঠিক আছে, আপনি অন্য কারও হয়ে কাজ না করেন তো খুব ভাল কথা। আমি আপনাকে একটা কাজ দেব। আপনার ফি কত?
কাকাবাবু বললেন, আমার গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা আমি পছন্দ করি না। আপনার চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধও আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি, প্লিজ, দূরে গিয়ে বসুন।
মোহন সিং-এর সঙ্গীরা তিনটে চেয়ার টেনে বসে এদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রত্যেকেরই বেশ গড়াপেটা চেহারা।
মোহন সিং কাকাবাবুর কাঁধ থেকে হাত তুলে নিল, কিন্তু সরে গেল না। চুরুটের ছাই ঝেড়ে বলল, আরে মশাই, আপনাকে আমি এমপ্লয় করছি, কম সে কম পঞ্চাশ হাজার খরচ করতে রাজি আছি। আপনাকে এত টাকা কেউ দেবে?
রঞ্জন বলল, শুনুন, মিঃ সিং, কাকাবাবু এখন রিটায়ার করেছেন। আমি ওঁর অ্যাসিস্টান্ট। ওঁকে কী কাজ দেবার কথা বলছেন, সেটা আমাকে দিন না! আমার কিছু টাকা-পয়সার দরকার এখন। তা হা, পঞ্চাশ হাজার পেলে মোটামুটি চলে যাবে।
মশামাছি তাড়াবার মতন বাঁ হাতের ভঙ্গি করে মোহন সিং বলল, আপ চুপ রহিয়ে। আমি মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছি। জরুরি কাজের কথা।
রঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাই না? আমি রিভলভার চালাতে জানি, দড়ির মই বেয়ে উঠতে পারি, গোপন ম্যাপ চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি, এমনকী আমি পিকক করতেও পারি। দেখবেন?
তারপর রঞ্জন সত্যিই মাটিতে দুটো হাত দিয়ে পা দুটো শূন্যে তুলে ফেলল। ঝনঝন করে তার পকেট থেকে খসে পড়ল অনেগুলো খুচরো পয়সা।
সেই অবস্থায় সে হাত দিয়ে হাঁটবার চেষ্টা করল। মোহন সিংয়ের তুলনায় রঞ্জনের চেহারাটাও নেহাত ছোট নয়। একটুখানি এগিয়েই তার পা শূন্যে টলমল করে উঠল, সে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল মোহন সিংয়ের ওপর। মোহন সিংও এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে চিত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে রঞ্জন খুবই কাচুমাচু গলায় বলল, আরে ছি ছি, কী কাণ্ড। আউট অব প্র্যাকটিস, বুঝলেন! আবার দু-একদিন প্র্যাকটিস করলেই ঠিক হয়ে যাবে। আপনার লাগেনি তো? আমি খুবই দুঃখিত!
রঞ্জন মোহন সিংয়ের হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল। তার সঙ্গের লাোেও ছুটে এল দু-দিকে।
মোহন সিং নিজেই উঠে দাঁড়াল কোনওরকমে। রঞ্জন বলল, এক্সট্রিমলি সরি, আমায় মাপ করে দিন, এর পরের বার দেখবেন, কোনও ভুল হবে না!
মোহন সিং কটমট করে তাকিয়ে বলল, বেওকুফ!
তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে অবজ্ঞার সুরে বলল, আপনি রিটায়ার করেছেন? একেবারে বুঢ়া বনে গেছেন! সে কথা আগে বললেই হত!
মোহন সিংয়ের চুরুটটা ছিটকে চলে গেছে অনেক দূরে। সেটা আর না কুড়িয়ে সে গিয়ে বসল একটা চেয়ারে। বেয়ারা এর মধ্যেই কফি দিয়ে গেছে। সে কফিতে চুমুক দিতে লাগল ঘনঘন।
রঞ্জনের কাণ্ড দেখে সন্তু আর জোজোর খুব হাসি পেয়ে গেলেও হাসতে পারছে না। সন্তু হাসি চাপবার জন্য নিজের উরুতে চিমটি কেটে আছে। রিঙ্কুর মুখখানাও লালচে হয়ে গেছে, সেও আসলে প্রাণপণে হাসি চাপছে। রঞ্জনকে সে আগে কোনওদিন পিকক করতে দ্যাখেনি।
মোহন সিং আর কোনও কথা বলল না। কফি শেষ করে দলবল নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পয়সা মিটিয়ে দিয়ে দরজার কাছে চলে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল হঠাৎ।
কাকাবাবুর দিকে আঙুল তুলে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনাদের কি হামপির দিকে যাবার প্ল্যান আছে?
কাকাবাবু মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যা। মোহন সিং বলল, বেলুড় যান, হ্যালিবিড যান, শ্রবণবেলগোলা যান, এই কণার্টকে অনেক দেখবার জায়গা আছে। লেকিন, মপি যাবেন না এখন।
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি কোথায় যাব না যাব, তা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বলুন তো? আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারিনি।
মোহন সিং তবু বলল, আর যেখানে খুশি যান, মপি যাবেন না। তা হলে আপনাদের অনেক অসুবিধেয় পড়তে হবে!
এর উত্তর না দিয়ে কাকাবাবু হাসিমুখে চেয়ে রইলেন। মোহন সিং পেছন ফিরে গটগট করে বেরিয়ে গেল!
জোজো দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এসে চোখ বড় বড় করে বলল, চম্বলের ডাকাত! মোহন সিং! এর নাম আমি অনেকবার আমার পিসেমশাইয়ের মুখে শুনেছি।
রিঙ্কু বলল, মোহন সিং তো কমন নাম। অনেকেরই হতে পারে। আমার মনে হল, সিনেমার ভিলেন! আমজাদ খানের মতন চেহারা।
সন্তু নিজের কাজ ভোলেনি। সে ছোট খাতাটা বার করে বলল, রিঙ্কুদি, বাইরের লোক চলে গেছে, তুমি দুটো ইংরেজি শব্দ বলেছ?
রিঙ্কু সেকথা অগ্রাহ্য করে বলল, রঞ্জন কী কাণ্ডটাই করল!
এবার সকলের চেপে রাখা হাসি বেরিয়ে এল একসঙ্গে। শুধু রঞ্জন হাসল না। সে নিজের দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ইশ, পঞ্চাশ হাজার টাকার কাজটা ফসকে গেল?
কাকাবাবু বললেন, কোথা থেকে লোকটা হঠাৎ এসে উদয় হল বলো তো? আমাকে চেনে কিন্তু আমি ওকে চিনি না। ও গায়ে পড়ে আমাদের মপি যেতে বারণ করলই বা কেন? তা হলে কী করবে, হামপি যাবে, না অন্য কোথাও যাবে?
রিঙ্কু বলল, আমরা হামপি দেখব বলে বেরিয়েছি, সেখানে তো যাবই। ওই লোকটা বারণ করেছে বলে আরও বেশি করে যাব। ও বারণ করবার কে?