Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাড়িয়ে দাও তোমার হাত || Saswati Das

বাড়িয়ে দাও তোমার হাত || Saswati Das

বাড়িয়ে দাও তোমার হাত

রমা আর সুজয় আজয়বাবুকে নিয়ে শহরের একজন নামকরা সাইক্রিয়াটিস্ট এর চেম্বারে বসে আছে। বৃষ্টিতে শহর জলমগ্ন, তবু, যেহেতু খুবই ব্যস্ত ডাক্তার তাই আজকের দিনের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে বলে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই সুজয় আর রমা বাবাকে নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুদিন আগেই ফোন করে এই ডেট নেওয়া। আজ না এলে আবার কবে ডেট পাওয়া যেত তার ঠিক নেই। আর বাবার সমস্যাটা যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে লোকের কাছে আর মান সম্মান থাকবে না। ওই মালতি কতো বাড়ি গিয়ে যে গল্প করেছে তা কে জানে! সুজয় মনে মনে কথাগুলো বলে ঘড়ির দিকে তাকালো।
বাবার কি যে এক ভয়ানক অসুখ হয়েছে তা ওরা কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
ঘটানটা একটু খুলেই বলি-
রমা হাই স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা, আর সুজয় একটা নামি এম. ন. সি. তে কর্মরত। ওদের একমাত্র সন্তান তুলি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস থ্রি’র ছাত্রী, আর অজয়বাবু হলেন সুজয়ের ৭৮ বছরের বৃদ্ধ বাবা। ছ বছর হলো মা গত হয়েছেন। তারপর থেকেই আজয়বাবু কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন। একমাত্র তুলির সাথেই যতটুকু কথা বলেন। এহেন আজয়বাবুর কিছুদিন ধরে মাথায় গন্ডলগোল দেখা দিয়েছে। তা গন্ডগোলটা ঠিক কেমন? না, তিনি কিনা কাজের মেয়ের সব কাজ করে রাখেন। প্রথম প্রথম ওরা স্বামী- স্ত্রী এর কিছুই বুঝতে পারে নি। সেদিন তখনো ভোরের আলো ফোটে নি হঠাৎ রান্নাঘর থেকে একটা কাঁচের বাসন ভেঙে যাওয়ার আওয়াজে ওদের দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেছে। রমা উঠে সুজয় কে বলছে-
‘রান্নাঘর থেকে কিছু একটা ভাঙার আওয়াজ হলো না?’
‘হ্যাঁ তাইতো মনে হলো।কিন্তু এতো সকালে রান্নাঘরে কে হতে পারে? বাবা জল নিতে যায় নি তো?’
‘না; আমি নিজে কাল রাত্রে জলের বোতল আর গ্লাস ওনার খাটের পাশের টেবিলে রেখে এসেছি।
‘তবে এই সকালে কে হতে পারে?’
রমা বলল, ‘চলো গিয়ে দেখি কি হলো!’
দুজনে রান্নাঘরের সামনে পোঁছে দেখে আজয়বাবু থতমত খেয়ে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন।
সুজয় বলল, ‘বাবা তুমি এতো সকালে রান্নাঘরে কি করছ?’
‘ন না মানে আমি এই এইতো জ..জল নিতে এসেছিলাম।’
‘তা তুমি সিঙ্কে কি করছিলে? আর জল তো তোমার ঘরেই দেওয়া আছে! তাহলে?’
‘আ.. আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। ছি ছি কি করে ফেললাম! এতো দামি প্লেট আমি ভেঙে ফেললাম! বৌমা তুমি কিছু মনে করো না। আমার বড্ড অপরাধ হয়ে গেছে।’
এই সব কথাবার্তায় ওদিকে তুলিরও ঘুম ভেঙে গেছে। সে ও রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ও বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে কানে কানে বলল,
‘দাদু তো রোজই বাসন মেজে রাখে। আমি যখন স্কুল থেকে ফিরে ভাত খাই সেই থালাও তো মেজে রাখে।আমাকে দাদু বলেছিলো, “দিদিভাই মা বাবাকে বলো না ওরা জানতে পারলে আমাকে খুব বকবে।” ‘তোমরা দাদুকে বোকো না বাবাই।’
মেয়ের কথা শুনে সুজয়তো আকাশ থেকে পড়লো।
‘সে কি! বাবা বাসন মেজে রাখে? রমা তুমি মালতিকে কি ছাড়িয়ে দিয়েছ?’
‘এ সব তুমি কি বলছ? আমি মালতিকে ছাড়াবো কেন?’
‘না এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এভাবে বাবা কেন রোজ বাসন মেজে রাখে আমাকে জানতেই হবে।’
স্বামী স্ত্রী দুজনেই ঠিক করল আজ কেউ বেরোবে না, মালতির সঙ্গে দেখা করে বিষয়টা জানতে হবে।মাস গেলে মোটা মাইনে নিয়েও কাজ ও ঠিক মতো করে না কেন এটা ওকে জিজ্ঞেস করতেই হবে।
দুপুরবেলা মালতি আসলে ওকে রমা ঘরে ডাকলো,
‘মালতি তুই এ বাড়িতে কত বছর কাজ করছিস?’
‘অজ্ঞে বৌদিমনি তা দশ বছর হয়ে গিল বোধয়। কেন গো কি হইছে? এ কথা জিগাও কেন?’
রমা এবার সরাসরি ওকে প্রশ্ন টা করল,
‘তুই আমাকে বলিসনি কেন বাবা সব এঁটো বাসন মেজে রাখেন? মাইনে নেওয়ার সময় তোর লজ্জা করে না? একটা বুড়ো মানুষ তোর কাজগুলো করে রাখে, আর তুই মাইনের টাকা গুলো গুনে নিস? তার উপর আবার ফী বছর তোর মাইনে বাড়ানোর দাবি থাকে!
তুই কি করে পারলি এই কাজগুলো করতে?’
‘ও বৌদিমনিগো, তুমি বিশ্বেস করো আমি মেসোমশায় কে বাসন মাজতে কোনোদিন বলিনি, উনি নিজে মেজে রাখেন, বললে বলেন, “তাতে কি? তুই তোর বৌদিকে বলিস না। তুই আমার সাথে বসে তোর বাড়ির গল্প কর। তোর মাসিমার কথা মনে আছে? তোর মাসিমা ছিল এ বাড়ির লক্ষ্মী। ও চলে গেল, আমি বড় একা হয়ে গেলাম। সবাইতো এখন ব্যস্ত। তুই এখানে বসে টি ভি দেখ। তারপর তুলি ঘুম থেকে উঠলে তুই চলে যাস।”
‘আমি তাই রোজ এখানে মেসোমশায়ের সঙ্গে গল্প করতাম আর টি ভি দেখতাম। আমার কোনো অন্যায় নেই গো বৌদিমনি।’
‘তা কতো দিন এই ব্যবস্থা চলছে?’
‘তোমায় মিছে কথা বলবো না, প্রায় এক বছর হলো।’
‘হুঁম, আচ্ছা ঠিক আছে তুই কাজে যা।’
রমা আর সুজয় পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে স্থির করে বাবাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখতে হবে।
আজ একজন নামি ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট পেয়ে দুজনে আজয়বাবুকে নিয়ে এসেছেন।
ডাক্তারবাবু আজয়বাবুর সাথে আলাদা করে অনেক্ষন কথা বললেন। তারপর ওদের দুজনকে ডেকে বললেন,
‘আপনারা দুজনের কেউ বাড়ি থাকেন না, ওনার স্ত্রীও মারা গেছে ছ বছর। উনি এখন একাকিত্বে ভুগছেন।ওনার এমনি কোনো অসুবিধা নেই, উনি শুধু একটু সঙ্গ চান। আপনারা একটু ওনার সঙ্গে সময় কাটাবেন। ছুটির দিন একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করুন, যে গল্পে উনিও সক্রিয় অংশ নিতে পারবেন। অফিস থেকে ফিরে কিছুটা সময় ওনাকে দিন, যাতে ওনার নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে না হয়। উনি বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে গল্প করতে চান, কারণ, উনি যেমন গল্প শুনতে চান সেই রকম গল্পই সে বলে। তাই কাজের মেয়েটির সঙ্গ ওনাকে আনন্দ দেয়। দেখুন, এই বয়সটা হলো এমনই, যে বয়সে মানুষ, বিশেষত ছেলেরা নিজেদেরকে ভীষণ অসহায় মনে করেন। মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদেরকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন।কিন্তু ছেলেরা ভাবে, “কিছু বছর আগেও যার কথা ছিল সংসারে শেষ কথা, আজ আর তার কথা কেউ শুনতেই চায় না!” ওনাকে বাড়ি নিয়ে যান, জীবনের বাকি কটা দিন আনন্দে রাখুন, ওনাকে সঙ্গ দিন, দেখুন আস্তে আস্তে সব সমস্যা মিটে যাবে। তার পরও যদি এই রকম চলতে থাকে তখন আসবেন,ওষুধ দেবো।’
আজয়বাবুকে নিয়ে ওরা স্বামী স্ত্রী বাড়ি ফিরে এলো। ডাক্তারের নির্দেশ মতো এখন দুজনেই আজয়বাবুকে অফিস এবং স্কুল থেকে ফিরে সময় দেয়।একসঙ্গে বসে বিকেলের চা খেতে খেতে নানা রকম পুরোনো দিনের গল্পগুজব হয়। তারপর তুলিকে নিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে, টি ভি সিরিয়াল দেখে আজয়বাবুর দিন এখন বেশ আনন্দেই কাটছে। ও হ্যাঁ, এখন মালতিকেই সব বাসন মাজতে হয়, ওর সুখের দিন অসময়ের বৃষ্টির জলের সঙ্গে ধুয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress