প্রভাতসঙ্গীত – Tenida Samagra
টেনিদা অসম্ভব গম্ভীর। আমরা তিনজনও যতটা পারি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করছি। ক্যাবলার মুখে একটা চুয়িং গাম ছিল, সেটা সে ঠেলে দিয়েছে গালের একপাশে–যেন একটা মার্বেল গালে পুরে রেখেছে এই রকম মনে হচ্ছে। পটলডাঙার মোড়ে তেলেভাজার দোকান থেকে আলুর চপ আর বেগুনী ভাজার গন্ধ আসছে, তাইতে মধ্যেমধ্যে উদাস হয়ে যাচ্ছে হাবুল সেন। কিন্তু আজকের আবহাওয়া অত্যন্ত সিরিয়াস–তেলেভাজার এমন প্রাণকাড়া গন্ধেও টেনিদা কিছুমাত্র বিচলিত হচ্ছে না।
খানিক পরে টেনিদা বলল, পাড়ার লোকগুলো কী বলদিকি?
আমি বললুম, অত্যন্ত বোগাস।
খাঁড়ার মতো নাকটাকে আরও খানিক খাড়া করে টেনিদা বললে, পয়সা তো অনেকেরই আছে। মোটরওলা বাবুও তো আছেন কজন। তবু আমাদের একসারসাইজ ক্লাবকে চাঁদা দেবে না?
না–দিব না।–হাবুল সেন মাথা নেড়ে বললে, কয়–একসারসাইজ কইর্যা কী হইব? গুণ্ডা হইব কেবল!
হ, গুণ্ডা হইব!–টেনিদা হাবুলকে ভেংচে বললে, শরীর ভালো করবার নাম হল গুণ্ডাবাজি! অথচ বিসর্জনের লরিতে যারা ভুতুড়ে নাচ নাচে, বাঁদরামো করে, তাদের চাঁদা দেবার বেলায় তো পয়সা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে। প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে
বাধা দিয়ে বললুম, আবার আমাকে কেন?
ইউ শাটাপ।–টেনিদা বাঘাটে হুংকার ছাড়ল : আমার কথার ভেতরে কুরুবকের মতো-খুব বিচ্ছিরি একটা বকের মতো বকবক করবি না–সেকথা বলে দিচ্ছি তোকে। প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে পাড়ার ছেলেগুলো দুটো ডাম্বেল-মুগুর ভাঁজুক, ডন দিক–এই তো আমরা চেয়েছিলাম। শরীর ভালো হবে, মনে জোর আসবে, অন্যায়ের সামনে রুখে দাঁড়াবে, বড় কাজ করতে পারবে। তার নাম গুণ্ডাবাজি। অথচ দ্যাখ-দু-চারজন ছাড়া কেউ একটা পয়সা ঠেকাল না। আমরা নিজেরা চাঁদা-টাদা দিয়ে দু-একটা ডাম্বেল-টাম্বেল কিনেছি, কিন্তু চেস্ট একসপ্যান্ডার, বারবেল
ক্যাবলা আবার চুয়িং গামটা চিবোতে আরম্ভ করল। ভরাট মুখে বললে, কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।
হাবুল মাথা নাড়ল : দিব না। ক্লাব তুইল্যা দাও টেনিদা।
তুলে দেব? কভি নেহি টেনিদার সারা মুখে মোগলাই পরোটার মতো একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা ফুটে বেরুল : চাঁদা তুলবই। ইউ প্যালা!
আঁতকে উঠে বললুম, অ্যাঁ?
আমাদের নিয়ে তো খুব উষ্টুম-ধুষ্টুম গপ্পো বানাতে পারিস, কাগজে ছাপাটাপাও হয়। একটা বুদ্ধি-টুদ্ধি বের করতে পারিস নে?
মাথা চুলকে বললুম, আমি–আমি
হাঁ-হাঁ, তুই-তুই।–টেনিদা কটাং করে আমার চাঁদিতে এমন গাঁট্টা মারল যে ঘিলুটিলু সব নড়ে উঠল এক সঙ্গে। আমি কেবল বললুম, ক্যাঁক।
ক্যাবলা বললে, ওরকম গাঁট্টা মারলে তো বুদ্ধি বেরুবে না, বরং তালগোল পাকিয়ে যাবে সমস্ত। এখন ক্যাঁক বলছে, এর পরে ঘ্যাঁক-ঘ্যাঁক বলতে থাকবে আর ফস করে কামড়ে দেবে কাউকে।
গাঁট্টার ব্যথা ভুলে আমি চটে গেলুম।
ঘ্যাঁক করে কামড়াব কেন? আমি কি কুকুর?
টেনিদা বললে, ইউ শাটাপ–অকর্মার ধাড়ি।
হাবুল বললে, চুপ কইর্যা থাক প্যালা–আর একখান গাট্টা খাইলে ম্যাও-ম্যাও কইর্যা বিলাইয়ের মতন ডাকতে আরম্ভ করবি। অরে ছাইড়া দাও টেনিদা। আমার মাথায় একখান বুদ্ধি আসছে।
টেনিদা ভীষণ উৎসাহ পেয়ে ঢাকাই ভাষা নকল করে ফেলল : কইয়্যা ফ্যালাও।
হাবুল বললে, আমরা গানের পার্টি বাইর করুম।
গানের পার্টি? মানে-সেই যে চাঁদা দাও গো পুরবাসী? আর শালু নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব?–টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, আহা-হা, কী একখানা বুদ্ধিই বের করলেন। লোকে সেয়ানা হয়ে গেছে, ওতে আর চিঁড়ে ভেজে? সারা দিন ঘুরে হয়তো পাওয়া যাবে বত্রিশটা নয়া পয়সা আর দুখানা ছেঁড়া কাপড়। দুদ্দুর!
ক্যাবলা টকাৎ করে চুয়িং গামটাকে আবার গালের একপাশে ঠেলে দিলে।
টেনিদা–দি আইডিয়া!
আমরা সবাই একসঙ্গে ক্যাবলার দিকে তাকালুম। আমাদের দলে সেই-ই সব চেয়ে ছোট আর লেখাপড়ায় সবার সেরা–হায়ার সেকেন্ডারিতে ন্যাশনাল স্কলার। খবরের কাগজে কুশলকুমার মিত্রের ছবি বেরিয়েছিল স্ট্যান্ড করবার পরে, তোমরা তো সে-ছবি দেখেছ। সেই-ই ক্যাবলা।
ক্যাবলা ছোট হলেও আমাদের চার মূর্তির দলে সেই-ই সবচেয়ে জ্ঞানী, চশমা নেবার পরে তাকে আরও ভারিক্কি দেখায়। তাই ক্যাবলা কিছু বললে আমরা সবাই-ই মন দিয়ে তার কথা শুনি।
ক্যাবলা বললে, আমরা শেষ রাত্রে–মানে এই ভোরের আগে বেরুতে পারি সবাই।
শেষ রাত্তিরে-হাবুল হাঁ করে রইল :শেষ রাত্তিরে ক্যান? চুরি করুম নাকি আমরা?
চুপ কর না হাবলা– ক্যাবলা বিরক্ত হয়ে বললে, আগে ফিনিশ করতে দে আমাকে। আমি দেখেছি, ভোরবেলায় ছোট-ছোট দল কীর্তন গাইতে বেরোয়। লোকে রাগ করে না, সকালবেলায় ভগবানের নাম শুনে খুশি হয়। পয়সা-টয়সাও দেয় নিশ্চয়।
টেনিদা বললে, হু, রাত্তিরে ঘুমিয়ে-টুমিয়ে ভোরবেলায় লোকের মন খুশিই থাকে। তারপর যেই বাজারে কুমড়োকাঁচকলা আর চিংড়ি মাছ কিনতে গেল, অমনি মেজাজ খারাপ। আর অফিস থেকে ফেরবার পরে তো–ইরে ব্বাস।
আমি বললুম, মেজদা যেই হাসপাতাল থেকে আসে–অমনি সকলকে ধরে ইনজেকশন দিতে চায়।
হাবুল বললে, তর মেজদা যদি পাড়ার বড় লোকগুলারে ধইর্যা তাগো পুটুস-পুটুস কইর্যা ইনজেকশন দিতে পারত।
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : অর্ডার-অর্ডার, ভীষণ গোলমাল হচ্ছে। কিন্তু ক্যাবলার আইডিয়াটা আমার বেশ মনে ধরেছে–মানে যাকে বলে সাইকোলজিক্যাল। সকালে লোকের মন খুশি থাকে–ইয়ে যাকে বলে বেশ পবিত্র থাকে, তখন এক-আধটা বেশ ভক্তিভরা গান-টান শুনলে কিছু-না-কিছু দেবেই। রাইট। লেগে পড়া যাক তা হলে।
আমি বললুম, কিন্তু জিমন্যাস্টিক ক্লাবের জন্যে আমরা হরিসংকীর্তন গাইব?
ক্যাবলা বললে, হরি-সংকীর্তন কেন? তুই তো একটু-আধটু লিখতে পারিস, একটা গান লিখে ফ্যাল। ভীম, হনুমান–এইসব বীরদের নিয়ে বেশ জোরালো গান।
আমি
হাঁ, তুই, তুই।–টেনিদা আবার গাঁট্টা তুলল : মাথার ঘিলুটা আর একবার নড়িয়ে দিই, তা হলেই একেবারে আকাশবাণীর মতো গান বেরুতে থাকবে।
আমি এক লাফে নেমে পড়লুম চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে।
বেশ, লিখব গান। কিন্তু সুর দেবে কে?
টেনিদা বললে, আরে সুরের ভাবনা কী–একটা কেত্তন-ফেত্তন লাগিয়ে দিলেই হল।
আর গাইব কেডা? হাবুলের প্রশ্ন শোনা গেল : আমাগো গলায় তো ভাউয়া ব্যাংয়ের মতন আওয়াজ বাইর অইব।
হ্যাং ইয়োর ভাউয়া ব্যাং।–টেনিদা বললে, এসব গান আবার জানতে হয় নাকি? গাইলেই হল। কেবল আমাদের থান্ডার ক্লাবের গোলকিপার পাঁচুগোপালকে একটু যোগাড় করতে হবে, ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারে–গাইতেও পারে–মানে আমাদের লিড করবে।
হাবুল বললে, আমাগো বাড়িতে একটা কর্তাল আছে, লইয়া আসুম।
ক্যাবলা বললে, আমাদের ঠাকুর দেশে গেছে, তার একটা ঢোল আছে। সেটা আনতে পারি।
গ্র্যান্ড!-টেনিদা ভীষণ খুশি হল : ওটা আমিই বাজাব এখন। দেন এভরিথিং ইজ কমপ্লিট। শুধু গান বাকি। প্যালা-অফ অ্যান আওয়ার টাইম। দৌড়ে চলে যা–গান লিখে নিয়ে আয়। এর মধ্যে আমরা একটু তেলেভাজা খেয়েনি।
মাথা চুলকে আমি বললুম, আমিও দুটো তেলেভাজা খেয়ে গান লিখতে যাই না কেন? মানে–দু-একটা আলুর চপ-টপ খেলে বেশ ভাব আসত।
আর আলুর চপ খেয়ে কাজ নেই। যা বাড়ি যা–কুইক। আধ ঘণ্টার মধ্যে গান লিখে না আনলে ভাব কী করে বেরোয় আমি দেখব। কুইক–কুইক
টেনিদা রোয়াক থেকে নেমে পড়তে যাচ্ছিল। অগত্যা আমি ছুট লাগালুম। কুইক নয়–ক্যইকেস্ট যাকে বলে।
জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান
করিবেন তোমাদের তিনি বলবান।
ও গো–সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম
সেই হয় মহাবীর নানা গুণধাম।
জাগো রে নগরবাসী–ডন দাও, ভাঁজো রে ডামবেল,
খাও রে পরান ভরি ছোলাকলা-আম-জাম-বেল
হও রে সকলে বীর, হও ভীম, হও হনুমান,
জাগিবে ভারত এতে করি অনুমান।
ক্যাবলা গান শুনে বললে, আবার অনুমান করতে গেলি কেন? লেখ–জাগিবে ভারত এতে পাইবে প্রমাণ।
টেনিদা বললে, রাইট। কারেকট সাজেসশন।
হাবুল বললে, কিন্তু মানুষরে হনুমান হইতে কইবা? চেইত্যা যাইব না?
টেনিদা বললে, চটবে কেন? পশ্চিমে হনুমানজীর কত কদর। জয় হনুমান বলেই তো কুস্তি করতে নামে। হনুমান সিং–হনুমানপ্রসাদ, এরকম কত নাম হয় ওদের। হনুমান কি চাড্ডিখানা কথা রে। এক লাফে সাগর পেরুলেন, লঙ্কা পোড়ালেন, গন্ধমাদন টেনে আনলেন, রাবণের রথের চুড়োটা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে দিলেন এক দাঁতের জোরটাই ভেবে দ্যাখ একবার।
তবে কিনা-খাও রে পরান ভরি ছোলাকলা-আম-জাম-বেল চুয়িং গাম খেতে খেতে ক্যাবলা বললে, এই লাইনটা ঠিক
আমি বললুম, বারে, গানে রস থাকবে না? কলা-আম-জামে কত রস বল দিকি? আর দুটো-চারটে ভালো জিনিস খাওয়ার আশা না থাকলে লোকে খামকা ডামবেল বারবেল ভাঁজতেই বা যাবে কেন? লোভও তো দেখাতে হয় একটু।
ইয়া।-টেনিদা ভীষণ খুশি হল : এতক্ষণে প্যালার মাথা খুলেছে। এই গান গেয়েই আমরা কাল ভোররাত্তিরে পাড়ায় কীর্তন গাইতে বেরুব। ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস
আমরা তিনজন চেঁচিয়ে উঠলুম : ইয়াক ইয়াক।
এবং পরদিন ভোরে–
শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের কাছে কাক ডাকবার আগে, ঝাড়ুদার বেরুনোর আগে প্রথম ট্রাম দেখা না দিতেই
জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান—
আগে-আগে গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে পাঁচুগোপাল। তার পেছনে ঢোল নিয়ে টেনিদা, টেনিদার পাশে কর্তাল হাতে ক্যাবলা। থার্ড লাইনে আমি আর হাবুল সেন। টেনিদা বলে দিয়েছে, তোদের দুজনের গলা একেবারে দাঁড়কাকের মতো বিচ্ছিরি, কোনও সুর নেই, তোরা থাক ব্যাকলাইনে।
আহা–টেনিদা যেন গানের গন্ধর্ব। একদিন কী মনে করে যেন সন্ধ্যাবেলায় গড়ের মাঠে সুর ধরেছিল–আজি দখিন দুয়ার খোলা এসো হে, এসো হে, এসো হে। কিন্তু আসবে কে? জন তিনেক লোক অন্ধকারে ঘাসের ওপর শুয়েছিল, দু লাইন শুনেই তারা তড়াক তড়াক করে উঠে বসল, তারপর তৃতীয় লাইন ধরতেই দুড়দুড় করে টেনে দৌড় এসপ্ল্যানেডের দিকে–যেন ভূতে তাড়া করেছে।
আমি বলতে যাচ্ছিলুম, তোমার গলায় তো মা সরস্বতীর রাজহাঁস ডাকে কিন্তু হাবুল আমায় থামিয়ে দিলে। বললে, চুপ মাইর্যা থাক। ভালোই হইল, তর আমার গাইতে হইব না। অরা তিনটায় গাঁ-গাঁ কইর্যা চ্যাঁচাইব, তুই আর আমি পিছন থিক্যা অ্যাঁ-অ্যাঁ করুম।
সুতরাং রাস্তায় বেরিয়েই পাঁচুর হারমোনিয়ামের প্যাঁ-প্যাঁ আওয়াজ, টেনিদার দুমদাম ঢোল আর ক্যাবলার ঝমাঝম কতাল। তারপরেই বেরুল সেই বাঘা কীর্তন :
ওগো সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম
পাঁচুর পিনপিনে গলা, টেনিদার গগনভেদী চিৎকার, ক্যাবলার ক্যাঁক্যাঁ আওয়াজ, হাবুলের সর্দি বসা স্বর আর সেই সঙ্গে আমার কোকিল-খাওয়া রব। কোরাস তো দূরে থাক পাঁচটা গলা পাঁচটা গোলার মতো দিগ্বিদিকে ছুটল :
জাগো রে নগরবাসী, ডন দাও–ভাঁজো রে ডামবেল-
ঘোঁয়াক ঘোঁয়াক করে আওয়াজ হল, দুটো কুকুর সারা রাত চেঁচিয়ে কেবল একটু ঘুমিয়েছে-তারা বাঁইবাঁই করে ছুটল। গড়ের মাঠের লোকগুলো তো তবু এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত দৌড়েছিল, এরা ডায়মন্ড হারবারের আগে গিয়ে থামবে বলে মনে হল না।
এবং তৎক্ষণাৎ
দড়াম করে খুলে গেল ঘোষেদের বাড়ির দরজা। বেরুলেন সেই মোটা গিন্নী–যাঁর চিৎকারে পাড়ায় কাক-চিল পড়তে পায় না।
আমাদের কোরাস থেমে গেল তাঁর একটি সিংহগর্জনে।
কী হচ্ছে অ্যাঁ। এই লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা টেনি-কী আরম্ভ করেছিস এই মাঝরাত্তিরে?
অত বড় লিডার টেনিদাও পিছিয়ে গেল তিন পা।
মানে মাসিমা–মানে ইয়ে এই ইয়ে–একসারসাইজ ক্লাবের জন্য চাঁদা
চাঁদা! অমন মড়া-পোড়ানো গান গেয়ে–পাড়াসুদ্ধ লোকের পিলে কাঁপিয়ে মাঝরাত্তিরে চাঁদা? দূর হ এখেন থেকে ভূতের দল, নইলে পুলিশ ডাকব এক্ষুনি।
দড়াম করে দরজা বন্ধ হল পরক্ষণেই।
কীর্তন পার্টি শোকসভার মতো স্তব্ধ একেবারে।
হাবুল করুণ স্বরে বলল, হইব না টেনিদা। এই গানে কারও হৃদয় গলব না মনে হইতাছে।
হবে না মানে?–টেনিদা পান্তুয়ার মতো মুখ করে বললে, হতেই হবে। লোকের মন নরম করে তবে ছাড়ব।
কিন্তু ঘোষমাসিমা তো আরও শক্ত হয়ে গেলেন–আমাকে জানাতে হল।
উনি তো কেবল চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে পারেন, জিমন্যাস্টিকের কী বুঝবেন! অলরাইট–নেকসট হাউস। গজকেষ্টবাবুর বাড়ি। আবার পদযাত্রা। আর সম্মিলিত রাগিণী :
খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেল–
হও রে সকলে বীর, হও ভীম, হও হনুমান
পাঁচু, টেনিদা, ক্যাবলা তেড়ে কেবল হও হনুমান পর্যন্ত গেয়েছে, আমি আর হাবলা আম পর্যন্ত বলে সুর মিলিয়েছি, অমনি গজকেষ্ট হালদারের দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে
না, চাঁদা নয়। প্রথমে একটা ফুলের টব, তার পরেই একটা কুঁজো। মেঘনাদকে দেখা গেল না, কিন্তু টবটা আর একটু হলেই আমার মাথায় পড়ত, আর কুঁজোটা একেবারে টেনিদার মৈনাকের মতো নাকের পাশ দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গেল।
আমি চেঁচিয়ে বললুম, টেনিদা–গাইডেড মিশাইল।
বলতে বলতেই আকাশ থেকে নেমে এল প্রকাণ্ড এক হুলো বেড়াল-পড়ল পাঁচুর হারমোনিয়ামের ওপর। খ্যাঁচ-ম্যাচ করে এক বিকট আওয়াজ হারমোনিয়ামসুদ্ধু পাঁচু একেবারে চিত–আর ক্যাঁচক্যাঁচাঙ বলে বেড়ালটা পাশের গলিতে উধাও!
ততক্ষণে আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছি। প্রায় হ্যারিসন রোড পর্যন্ত দৌড়ে থামতে হল আমাদের। পাঁচু কাঁদো কাঁদো গলায় বললে, টেনিদা, এনাফ। এবার আমি বাড়ি যাব।
হাবুল বললে, হ, নাইলে মারা পোড়বা সক্কলে। অখন কুজা ফ্যালাইছে, এইবারে সিন্দুক ফ্যালাইব। অখন বিলাই ছুঁইর্যা মারছে, এরপর ছাত থিক্যা গোরু ফ্যালাইব।
টেনিদা বললে, শাট আপ–ছাতে কখনও গোরু থাকে না।
না থাকুক গোরু-ফিক্যা মারতে দোষ কী। আমি অখন যাই গিয়া। হিষ্ট্রি পড়তে হইব।
এঃ–হিষ্ট্রি পড়বেন!–টেনিদা বিকট ভেংচি কাটল : ইদিকে তো আটটার আগে কোনওদিন ঘুম ভাঙে না। খবর্দার হাবলা–পালানো চলবে না। আর একটা চানস নেব। এত ভালো গান লিখেছে প্যালা, এত দরদ দিয়ে গাইছি আমরাজয় হনুমান আর বীর ভীমসেন মুখ তুলে চাইবেন না? এবং মহৎ কাজ করতে যাচ্ছি আমরা কিছু চাঁদা জুটিয়ে দেবেন না তাঁরা? ট্রাই ট্রাই এগেন। মন্ত্রের সাধন কিংবা–ধর, পাঁচু
পাঁচুগোপাল কাঁউমাউ করতে লাগল : একসকিউজ মি টেনিদা। পেল্লায় হুলো বেড়াল, আর একটু হলেই নাকফাঁক আঁচড়ে নিত আমার। আমি বাড়ি যাব।
বাড়ি যাবেন!–টেনিদা আবার একটা যাচ্ছেতাই ভেংচি কাটল : মামাবাড়ির আবদার পেয়েছিস, না? টেক কেয়ার পেঁচো–ঠিক এক মিনিট সময় দিচ্ছি। যদি গান না ধরিস, এক থাপ্পড়ে তোর কান
ক্যাবলা বললে, কানপুরে চলে যাবে।
আমি হাবুলের কানে কানে বললুম, লোকে আমাদের এর পরে ঠেঙিয়ে মারবে, হাবলা। কী করা যায় বল তো?
তুই গান লেইখ্যা ওস্তাদি করতে গেলি ক্যান?
সংকীর্তন গাইবার বুদ্ধি তো তুই-ই দিয়েছিলি।
হাবুল কী বলতে যাচ্ছিল, আবার প্যাঁ-প্যাঁ করে হারমোনিয়াম বেজে উঠল পাঁচুর। এবং :
জাগো রে নগরবাসী–ভজো হনুমান
ঢোলক-করতালের আওয়াজে আবার চারদিকে ভূমিকম্প শুরু হল। আর পাঁচটি গলার স্বরে সেই অনবদ্য সংগীতচর্চা :
করিবেন তোমাদের তিনি বলবান–
কোনও সাড়াশব্দ নেই কোথাও। কুঁজো নয়, বেড়াল নয়, গাল নয়, কিচ্ছু নয়। সামনে কন্ট্রাকটার বিধুবাবুর নতুন তেতলা বাড়ি নিথর!
আমাদের গান চলতে লাগল :
ওগো-সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম-
ডামবেল পর্যন্ত যেই এসেছে, দড়াম করে দরজা খুলে গেল আবার। গায়ে একটা কোট চড়িয়ে, একটা সুটকেস হাতে প্রায় নাচতে নাচতে বেরুলেন বাড়ির মালিক বিধুবাবু।
আমি আর হাবলা টেনে দৌড় লাগাবার তালে আছি, আঁক করে পাঁচুর গান থেমে গেছে, টেনিদার হাত থমকে গেছে ঢোলের ওপর। বিধুবাবু আমাদের মাথায় সুটকেস ছুঁড়ে মারবেন কিনা বোঝবার আগেই
ভদ্রলোক টেনিদাকে এসে জাপটে ধরলেন সুটকেসসুদ্ধ। নাচতে লাগলেন তারপর।
বাঁচালে টেনিরাম, আমায় বাঁচালে। অ্যালার্ম ঘড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, তোমাদের ডাকাত-পড়া গান কানে না এলে ঘুম ভাঙত না; পাঁচটা সাতের গাড়ি ধরতে পারতুম না–দেড় লাখ টাকার কন্ট্রাকটই হাতছাড়া হয়ে যেত। কী চাই তোমাদের বলো। শেষ রাতে তিনশো শেয়ালের কান্না কেন জুড়ে দিয়েছ বলো–আমি তোমাদের খুশি করে দেব।
শেয়ালের কান্না না স্যার–শেয়ালের কান্না না!–বিধুবাবুর সঙ্গে নাচতে নাচতে তালে-তালে টেনিদা বলে যেতে লাগল : একসারসাইজ ক্লাব-ডামবেল বারবেল কিনব–অন্তত পঞ্চাশটা টাকা দরকার—
.
বেলা নটা। রবিবারের ছুটির দিন। চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে আছি আমরা। পাঁচুগোপালও গেস্ট হিসেবে হাজির আছে আজকে।
মেজাজ আমাদের ভীষণ ভালো। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছেন বিধুবাবু। সামনের মাসে আরও পঞ্চাশ টাকা দেবেন কথা দিয়েছেন।
নিজের পয়সা খরচ করে টেনিদা আমাদের আইসক্রিম খাওয়াচ্ছিল। আইসক্রিম শেষ করে, কাগজের গেলাসটাকে চাটতে-চাটতে বলল, তবে যে বলেছিলি হনুমান আর ভীমের নামে কাজ হয় না? হুঁ হুঁ–কলিকাল হলে কী হয়, দেবতার একটা মহিমে আছে না?
পাঁচু বললে, আর হুলো বেড়ালটা যদি আমার ঘাড়ে পড়ত
আমি বললুম, আর ফুলের টব যদি আমার মাথায় পড়ত।
হাবুল বললে, কুঁজাখান যদি দমাস কইর্যা তোমার নাকে লাগত
টেনিদা বললে, হ্যাং ইয়োর হুলো বেড়াল, ফুলের টব, কুঁজো। ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।
আমরা চেঁচিয়ে বললুম, ইয়াক ইয়াক।