পাঁচুমামার প্যাঁকাটির মতন হাত
০১.
পাঁচুমামার প্যাঁকাটির মতন হাত ধরে টেনে ওকে ট্রেনে তুলোম। শূন্যে খানিক হাত-পা ছুঁড়ে, ও বাবাগো মাগো বলে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে শেষে পাঁচুমামা খচমচ করে বেঞ্চিতে উঠে বসল। তার পর পকেট থেকে লাল রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে ফেলে, খুব ভালো করে নিজের হাত-পা পরীক্ষা করে দেখল কোথাও ছড়ে গেছে কি না ও আয়োডিন দেওয়া দরকার কি না। তার পর কিছু না পেয়ে দুবার নাক টেনে, পকেটে হাত পুরে, খুদে-খুদে পা দুটো সামনের বেঞ্চিতে তুলে দিয়ে আমার দিকে চেয়ে চিঁচি করে বলল, “ছোটবেলায় একবার ভুলে বাদশাহি জোলাপ খেয়ে অবধি শরীরটা আমার একদম গেছে, কিন্তু বুকে আমার সিংহের মতন সাহস তা নইলে পদিপিসীর বর্মিবাক্স খোঁজার ব্যাপারে হাত দেব কেন?” বলে ভুরু দুটো কপালে তুলে চোখ দুটো জিজ্ঞাসার চিহ্ন বাজিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তো অবাক।
কোনার বেঞ্চিতে যে চিমড়ে ভদ্রলোক ছেলেপুলে বাক্সপ্যাটরা ও মোটা গিন্নি নিয়ে বসে-বসে আমাদের কথা শুনছিলেন, তিনিও অবাক। পাঁচুমামা বলল, “একশো বছর পরে পদিপিসীর বর্মিবাক্স আমি আবিষ্কার করব। জানিস, তাতে এক-একটা পান্না আছে এক-একটা মোরগের ডিমের মতন, চুনী আছে এক-একটা পায়রার ডিমের মতন, মুক্তা আছে হাঁসের ডিমের মতন! মুঠো-মুঠো হীরে আছে, গোছাগোছা মোহর আছে। তার জন্য শত-শত লোক মারা গেছে, রক্তের সালওয়েন নদী বয়ে গেছে, পাপের উপর পাপ চেপে পর্বত তৈরি হয়েছে–সব আমি একা উদ্ধার করব।”
তখন আমার ভারি রাগ হল। বললাম, “তুমি ইঁদুর ভয় পাও, গোরু দেখলে তোমার হাটু বেঁকে যায়, তুমি কী করে উদ্ধার করবে?”
পাঁচুমামা বলল, “আমার মনের ভিতর যে সিংহ গর্জন করছে।” বলে একদম চুপ মেরে গেল। আমি পাঁচুমামাকে একটা ছাঁচি পান দিলাম, এক বোতল লেমোনেড় খাওয়ালাম, খাবারওয়ালাকে ডেকে মস্ত শালপাতার ঠোঙা করে লুচি, আলুর দম, কপির সিঙাড়া, খাজা আর রসগোল্লা কিনে ওর হাতে গুঁজে দিলাম। বললাম, “ও পাঁচুমামা, পদিপিসীর বর্মিবাক্সটা কোথায় আছে?” পাঁচুমামা আমার এত কাছে ঘেঁষে এল যে তার কনুইটা আমার কোঁকে ফুটতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচুমামার ভুরুর প্রত্যেকটা লোম খাড়া হয়ে দুটো শুয়োপোকার মতন দেখাতে লাগল। ওর মাথাটা ঝুলে আমার এত কাছে এসে গেল যে ঐ শুয়োপোকার সুড়সুড়ি আমার কপালে লাগল। পাঁচুমামা নিচু গলায় কথা বলতে লাগল, আর আমি তাই শুনতে-শুনতে টের পেলাম চিম্ড়ে ভদ্রলোক কখন জানি ওঁর নিজের বেঞ্চি ছেড়ে পাঁচুমামার ওপাশে ঘেষে হা করে কথা শুনছেন, তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেছে আর গলার মধ্যিখানে একটা গুটুলি মতন ওঠানামা করছে। তাই দেখে আর পাঁচুমামার কথা শুনে আমার সারা গা সিরসির করতে লাগল।
০২.
পাঁচুমামা বলতে লাগল, “দেখ, মামাবাড়ি তো যাচ্ছিস। সেখানকার গোপন সব লোমহর্ষণ কাহিনীগুলো তোর জানা দরকার এ কথা কখনো ভেবে দেখেছিস? পদিপিসীর নাম ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা থাকতে পারত তা জানিস? ঠাকুরদার পদিপিসী, অদ্ভুক্ত রাঁধতে পারতেন। একবার ঘাস দিয়ে এইসা চচ্চড়ি বেঁধেছিলেন যে বড়লাট সাহেব একেবারে থ! বলেছিলেন, এই খেয়েই তোমলোককো দেশকো এইসা দশা! থাক গে সে কথা! অদ্ভুত রাঁধুনি ছিলেন পদিপিসী। বেঁটেখাটো বিধবা মানুষ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, আর মনে জিলিপির প্যাঁচা সিংহের মতন তেজও ছিল তার, হাজার হোক, এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি তো তারই বংশধর। বুঝলি, ঐ পদিপিসী গোরুর গাড়ি চড়ে, মাঘীপূর্ণিমার রাতে বালাপোশ গাঁয়ে, নিমাইখুড়োর বাড়ি চলেছেন বত্রিশবিঘার ঘন শালবনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন আর মনে-মনে ভাবছেন নিমাইখুড়োর ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, জঙ্গলে একা থাকেন, মেলা সাঙ্গোপাঙ্গ চেলা নিয়ে, কপালে চন্দন সিঁদুর দিয়ে চিত্তির করা, কথায় কথায় ভগবানের নাম। অথচ এদিকে মনে হয় দেদার টাকা, দানটানও করেন, জিজ্ঞেস করলে বলেন–সবই ভগবানের দয়া! এত লোক থাকতে ভগবান যে কেন ওকেই দয়া করতে যাবেন সেও একটা কথা।
“এই-সব ভাবছেন হঠাৎ হৈ-হৈ রৈরৈ করে একদল লাল লুঙ্গিপরা, লাল পাগড়ি বাঁধা, লাল চোখওয়ালা ডাকাতপানা লোক একেবারে গোরুর গাড়ি ঘেরাও করে ফেললে! নিমেষের মধ্যে গোরু দুটো গাড়ি থেকে খুলে নিল, আর পদিপিসীর সঙ্গে রমাকান্ত ছিল, তাকে তো টেনেহিঁচড়ে গোরুর গাড়ি থেকে বার করে তার ট্যাক থেকে সাড়ে সাতআনা পয়সা আর নস্যির কৌটো কেড়ে নিলে। পদিপিসী থান পরা, রুদ্রাক্ষের মালা গলায়, কোমরে কাপড় জড়িয়ে আর তার উপর দুই হাত দিয়ে রাস্তার মাঝখানে এমন করে দাঁড়ালেন যে ভয়ে কেউ তার কাছে এগুলো না। শেষটা তিনি হাঁক দিয়ে বললেন, “ওরে বাটপাড়েরা, গাড়োয়ান, রমাকান্ত সবাইকে তো আধমরা করে ফেললি, গোরুগুলোরও কিছু বাকি রেখেছিস কি না জানি না। এবার তোরাই আমাকে নিমাইখুড়োর বাড়ি কাঁধে করে পৌঁছে দে! তাই-না শুনে ডাকাতরা জিভ-টিভ কেটে, পদিপিসীর পায়ে একেবারে কেঁদে পড়ে বলল, “নিমাইসর্দার যদি জানতে পারে তার কুটুমকে এরা ধরেছিল– নিমাইসর্দার এদের প্রত্যেকের ছাল ছাড়িয়ে নেবে, হাউমাউ!’ তখন তারা ফের গোরু জুতে, পয়সা ফিরিয়ে, রমাকান্তর গায়ে হাত বুলিয়ে, গাড়োয়ানকে নগদ চারটে পয়সা ঘুষ দিয়ে, নিজেরাই নিমাইখুড়োর বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছিল।
“পদিপিসীও নিমাইখুড়োর কথা জানতে পেরে মহাখুশি!”
পাঁচুমামা ঢোক গিলে চোখ গোল করে আরো কত কি বলল। “পদিপিসীর ভীষণ বুদ্ধি, ধাঁ করে টের পেয়ে গেলেন খুড়োই ডাকাতদলের সর্দার। পদিপিসী খুড়োর বাড়ি দুপুর রাতে পৌঁছেই খুড়োর চোখের ওপর চোখ রেখে, দাঁতে-দাঁত ঘষে বললেন–”শালবনে আমাকে ডাকাতে ধরেছিল, তাড়াতাড়ি গোরুর গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে আমার তসরের চাদর খানিকটা ছিঁড়ে গেছে, পায়ের বুড়ো আঙুলে হোঁচট লেগেছে, আর তা ছাড়া মনেও খুব একটা ধাক্কা লেগেছে। এর কী প্রতিশোধ নেব এখনো ঠিক করি নি। এখন রান্না করব, খাব, তার পর পান মুখে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভেবে দেখব।”
“খুড়োর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, হাত থেকে রুপোবাঁধানো গড়গড়ার নলটা মাটিতে পড়ে গেল; খুড়োমশাই বিদ্যাসাগরী চটি পায়ে তারই উপর একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে গোফ নাড়তে লাগলেন, মুখ দিয়ে কথা বেরোল না! পদিপিসী তাই দেখে প্রসন্ন হয়ে বললেন–”আমার মধ্যে যে-সব সন্দেহরা ঝাঁক বেঁধে অন্ধকার বানিয়ে রেখেছে, তারা যাতে মনের মধ্যেই থেকে যায়, বাইরে প্রকাশ পেয়ে তোমার অনিষ্ট ঘটায়, তার ব্যবস্থা অবিশ্যি তোমার হাতে’ বলে চাদরটা চৌকির উপর রেখে কুঁজো থেকে খাবার জল নিয়ে পা ধুলেন। তার পর রান্নাঘরে গিয়ে খুড়িকে ঠেলে বের করে দিয়ে মনের সুখে গাওয়া ঘি দিয়ে নিজের মতন চারটি ঘিভাত রাঁধতে বসে গেলেন। খুড়োও আস্তে-আস্তে সেইখানে উপস্থিত হয়ে বললেন-–”তোমায় পঞ্চাশ টাকা দেব যদি ডাকাতের কথা কাউকে না বল।”
“পদিপিসী একমনে রাঁধতে লাগলেন। “খুড়ো বললেন—’একশো টাকা দেব।‘ পদিপসী একটু হাসলেন। খুড়ো বললেন–”পাঁচশো টাকা দেব। পদিপিসী একটু কাশলেন। খুড়ো মরীয়া হয়ে বললেন-”হাজার টাকা দেব, পাঁচ হাজার টাকা দেব, আমার লোহার সিন্দুক খুলে দেব, যা খুশি নিয়ো। পদিপিসী খুন্তিকড়া নামিয়ে রেখে সোজা সিন্দুকের সামনে উপস্থিত হলেন। খুড়ো সিন্দুক খুলতেই হীরে-জহরতের আলোয় পদিপিসীর চোখ ঝলসে গেল। খুড়ো ভেবেছিলেন সেইসঙ্গে পদিপিসীর মাথাও ঘুরে যাবে, কী নেবে না-নেবে কিছু ঠাহর করতে পারবে না। কিন্তু পদিপিসী সে মেয়েই নয়। তিনি অবাক হয়ে গালে আঙুল দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন–”ওমা, এ যে আলাদিনের ভাড়ার ঘর। ব্যাটা ঠ্যাঙাড়ে বাটপাড়, কি দাঁওটাই মেরেছিস!” বলে দু হাতে জড়ো করে একটিপি ধনরত্ন মাটিতে নামালেন। আর একটা হাঙরের নকশা-আঁকা লাল বর্মিবাক্সও টেনে নামালেন। খুড়ো হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে বললেন– “আহা, ওটা থাক, ওটাতে যে আমার সব প্রাইভেট পেপার আছে!”