নেশা
ছাদে বসে দুই বাল্যবন্ধুতে সুখদুঃখের গল্প হচ্ছিল। গল্পের মাঝখানে খেয়াল হল, আমিই বেশি কথা বলছি, বিশ্ব তেমন কিছু বলছে না, চুপচাপ শুনছে। আমার এক-তরফা কথা শুনে ও কী মনে করছে ভেবে কেমন যেন অপ্রস্তুত হলাম। বললাম, ”কই, তুমি তো কিছু বলছ না, আমি একাই বকবক করছি।”
বিশ্ব হেসে বলল, ”তোমার কথা আমি মন দিয়ে শুনছি। তুমি সংসারী মানুষ, থাকো শহরে। কত রকম দেখছ, শুনছ। আমার ভাই সংসারও নেই আর দেখাশোনার মতনও তেমন কিছু নেই। কোথায় পড়ে আছি দেখছ তো। একেবারে দেহাতে। আমরা হলাম কুয়োর ব্যাঙ।”
কথাটা মিথ্যে নয়। বিশ্ব এমন জায়গায় পড়ে আছে যেখানে ছোটো এক রেলস্টেশন, একটা মাত্র বাস সারভিস, অল্প কিছু ঘরবাড়ি ছাড়া কিছু নেই। থাকার মধ্যে যা দেখলাম—তা শুধু মাঠ, জঙ্গল, সামান্য কিছু খেতখামার আর দূরে এক পাহাড়।
আমি বললাম, ”দেখো বিশু, আমি হলাম ছাপোষা মানুষ। সেই চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সে বাবা মারা যাবার পর সংসারের ঘানিতে ঢুকেছি, আর আজ আটান্নয় এসেও রেহাই পাইনি। আমার চাকরি-বাকরি, পেটের আলসারের বৃত্তান্ত থেকে গিন্নীর ক্যার্ডিয়াক অ্যাজমা, মেয়ের বিয়ের পাত্র খোঁজা, ছেলের কথা সবাই শুনলে। আর নয়। এবার তোমার কথা শুনব।”
এমন সময় নীচে ‘মহারাজ’ ‘মহারাজ’ ডাক শুনলাম। মনে হল, মেয়েলি গলা, সামান্য মোটা। অবাক হলাম। কৌতূহলও হল। বললাম, ”কে?”
”আমায় ডাকছে” বিশ্ব বলল।
”তোমায়? তুমি আবার মহারাজ হলে কবে?” অবাক হয়ে বললাম, হাসির গলায়।
”যে যেমন ডাকে, ভাই। ও মহারাজ বলেই ডাকে।”
কৌতূহল হচ্ছিল। ”তা ও-টি কে?”
”তারা। তারকেশ্বরী।”
”তারকেশ্বরী! নামের তো ঘটা খুব হে। বাঙালি?”
”পুরোপুরি নয়।…ডাকি ওকে?”
”এখানে?”
”আপত্তি কি? ও এসে এখানেই বসে। রোজই আসে।”
”তাহলে ডাকো।”
বিশ্ব তার চেয়ার ছেড়ে উঠল। ডাকতে গেল তারকেশ্বরীকে।
একটা সিগারেট ধরালাম। আশপাশ চমৎকার লাগছিল। ছোটো ছাদ, ঘুলঘুলি-করা সেকেলে আলসে। চারদিক পরিষ্কার। সারা ছাদে শ্যাওলা শ্যাওলা রঙ ধরে আছে। এখন খুব হাওয়া। খানিকটা এলোমেলো। চৈত্রের শেষ। মাথার ওপর তারায় ভরা আকাশ। এক পাশে আধফালি চাঁদ উঠে আছে। পাহাড়টা মেঘের মতন দাঁড়িয়ে চাঁদের তলায়।
বিশ্বর সঙ্গে আমার আচমকা দেখা। চল্লিশ বছর পরে। কলকাতার অফিস আমায় কিছু কাজেকর্মে পাঠিয়েছিল এদিকে। পটারির কারখানা খোলা হবে। পাঁচরকম সুবিধে অসুবিধে তদারকি করে যাবার কথা। দিন দুই এখানে ওখানে ঘুরে কলকাতায় ফেরার জন্যে বাস ধরে রেলস্টেশনের দিকে এগুচ্ছি, কোথা থেকে এসে বিশ্ব আমায় ধরল। ছেলেবেলার বন্ধু। অন্তত পনেরো ষোলোটা বছর একসঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে কাটিয়েছি, তারপর কে কোথায় ছিটকে পড়েছি কোনো খবর রাখা হয়নি। বিশ্ব আমায় চিনতে পেরেছিল, আমি পারিনি। ও আমায় ধরে নিয়ে এল। ‘দু একটা দিন জিরিয়ে যাও। কাজ তো সারা জীবনই করছ।’ ক্লান্তি জমেছিল যথেষ্ট, বললাম—’বেশ চলো, তবে দুদিন নয়, একদিন। বাড়িতে ভাববে।’
এসেছিলাম বেলায়। দুপুর কেটেছে আহার-নিদ্রায়। বিকেলে বিশ্ব কিছুক্ষণের জন্যে কোথাও গিয়েছিল। সন্ধের শুরু থেকে আমরা দুই বন্ধু ছাদে এসে বসেছি।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হল।
এ-বাড়ির কাজের লোক ফাগুয়া এসে বাড়তি বেতের চেয়ার রেখে গেল। সামান্য পরেই বিশ্ব এল তারকেশ্বরীকে নিয়ে।
কাছে এসে বিশ্ব পরিচয় করিয়ে দিল। তারকেশ্বরীকে বলল ”আমার ছেলেবেলার বন্ধু রেবতী। একই জায়গায় মানুষ হয়েছি। প্রায় চল্লিশ বছর পরে ওকে পাকড়াও করলাম।” বলে বিশ্ব আমার দিকে তাকাল। ”আর এ হল তারা। এখানেই থাকে, খানিকটা তফাতে।”
আমার হাত পুরোপুরি উঠল না, আধা-আধি নমস্কারে কাজ সেরে তারকেশ্বরীকে দেখেছিলাম। তারকেশ্বরী মাথা নুইয়ে হাসল।
”বসো।” বিশ্ব তারকেশ্বরীকে বসতে বলে নিজে বসল।
তখনও আমি দেখছিলাম মহিলাকে। ওই যে বলে, কালোয় ঢেকেছে আলো—অনেকটা সেইরকম। তারকেশ্বরীর গায়ের রঙ কালো, কেমন কালো, কত কালো অন্ধকারে বোঝা গেল না, শুধু বোঝা গেল, রঙের তলায় তার কি-যেন রয়েছে যা চোখে ধরা নেয় অথচ স্পষ্ট করে বলা যায় না। লম্বা গড়নের মুখ, নাক খাড়া, পটের মতন টানা চোখ যদিও তবু চোখের গোল চওড়া চওড়া নয়, কেমন চাপা চাপা দেখায়। বয়েস হয়েছে ওর। কত তা অনুমান করা মুশকিল। চল্লিশ হবে হয়ত। শরীরের অন্য সব গড়ন এই বয়েসে যেমন হয়, তার চেয়ে ভালো। বোধ হয় বেশি ভালো।
কিছু কিছু খুঁতও চোখে পড়ল। মনে হল জল বসন্তের কয়েকটা দাগ রয়েছে মুখে। একটা চোখের পাতা একটু বেশি ভারী। কপাল ঘটের মতন ঠেলে উঠেছে।
তারকেশ্বরীর সাজপোশাকও আমায় গোলমালে ফেলেছিল। বুঝতে পারছিলাম না, ও সধবা না বিধবা। ফিনফিনে সাদা থান পরনে, গায়ের জামাও সাদা। পাতলা এক উড়ুনি পিঠের দিকে। খোঁপা আড়াল হয়ে আছে। টান করে বাঁধা চুল। কপালে চন্দনের মস্ত টিপ।
বিশ্ব হেসে বলল, ”তারাকে দেখে বুঝতে পারছ না ও বাঙালী না বেহারী?”
”না, একটু গোলমাল লাগছে।…কই, আপনি বসুন।”
”আপনিতে দরকার নেই, তুমিই বলো ওকে।” বিশ্ব বলল, ”তোমার মুখে আপনি শোনার বয়েস এখনও হয়নি।”
তারকেশ্বরী বসল হাসি-হাসি মুখ। কিছু বলল না।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, ”বিশু কবে মহারাজ হল আমার জানতে ইচ্ছে করছে। হ্যাঁ, ওর চেহারাটা পাণ্ডার মতনই হয়েছে অবশ্য। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া, ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল। কপালে তেলক কাটে কিনা জানি না। বলুন তো তারকেশ্বরীজী, ও কেমন করে মহারাজ হল?”
বিশ্ব কিছু বলতে যাচ্ছিল, তারকেশ্বরীর হাসিতে চাপা পড়ে গেল কথা। মুখ নিচু করে হাসতে লাগল তারকেশ্বরী।
বিশ্ব বলল, ”সে না হয় আমি বলব। কিন্তু তুমি বেচারীকে আপনি আজ্ঞে নাই বা করলে। আর আমার মতন ওকে তারা বলা তাতেই সুবিধে।”
”আপনি আমাকে তারাই বলুন,” তারকেশ্বরী বলল।
কথা শুনে বুঝলাম, বাংলা বুলিতে তারার কোনো খুঁত নেই। জিবে যৎসামান্য বিহারী টান আছে। বোধ হয় জল-বাতাসের গুণে।
আমি হেসে বললাম, ”বেশ তাই বলব।…বিশু কি বড়ো মহারাজ না ছোটো মহারাজ?”
তারা বলল, ”বড়ো কে, ছোটো কে?”
”বড়ো হল সাধন ভজনের দল, আর ছোটো হল ধুনি কলকের দল।”
তারা হেসে উঠল।
বিশ্ব হেসে বলল, ”আমি তা হলে ছোটোর দলে। ধুনি জ্বালাই না, তবে নেশা করি। এই সময়টা আমার নেশার সময়। তোমার যদি আপত্তি না থাকে, রেবতী—তা হলে একটু বসতে পারি।”
আমি তারার দিকে তাকালাম। কোনোরকম অস্বস্তি নেই। বিশ্ব কি তারাকে সামনে রেখে নেশায় বসে?
বিশ্ব বলল, ”তুমি নেশাটেশা করো তো?”
”নেশা?… না ভাই, সে-রকম কিছু করি না। তবে ন মাসে ছ মাসে বন্ধুদের সঙ্গে বসে দু এক চামচে হয়।”
”তাহলে আজ আমার সঙ্গে বসে একটু করো। ভয় নেই। কিছু হবে না।”
”কি নেশা, ভাই?”
”মদ গাঁজা নয়। দেহাতী নেশা।…তারার হাতে তৈরি, ওই জানে কী দিয়ে তৈরি করে।” বলে বিশ্ব তারার দিকে তাকাল, ”যাও তারা নিয়ে এসো।”
”ওই খেয়ে একটা কেলেঙ্কারি করব না তো?” ভয়ে ভয়ে বললাম।
”না না, কেলেঙ্কারি করবে কেন? ভাল লাগবে …আমি বরং তোমায় আমার মহারাজ হবার গল্পটা বলব।”
তারা উঠে গেল নেশা আনতে।
আমি নীচু গলায় বললাম, ”বিশ্ব সত্যি করে বলো তো, ওই তারা তোমার কে?”
বিশ্ব হাসিমুখে বলল, ”গল্পটা শুনলেই বুঝতে পারবে।”
”ও সধবা না বিধবা?”
”কোনোটাই নয়।”
”কুমারী? এত বয়েসেও।”
বিশ্ব কথার জবাব দিল না।
দুই
আমরা তিনজনে মুখোমুখি বসে। সামনে বেতের টেবিলে তিন গ্লাস সরবত, কাচের বড়ো প্লেটে কালোজাম ধরনের কিছু মিষ্টি, শ্বেতপাথরের বাটিতে কবিরাজীগুলির মতন কালচে রঙের নেশার বস্তু। এককুঁজো জল মাটিতে রাখা আছে।
বিশ্বই শুরু করল। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্বেতপাথরের বাটি থেকে একটা গুলি তুলে নিয়ে বলল, ”নাও রেবতী, শুরু করো। ভয়ের কিছু নেই। এটা বিষ নয়।”
বিশ্ব গুলিটা খেয়ে ফেলল।
আমার তখনও ভয় ভয় করছিল। কিসের নেশা কে জানে। খেয়ে মরব নাকি।
তারা বলল, ”নিন। কিছু হবে না।”
অগত্যা নিতে হল। মুখে দিলাম। কর্পূরের গন্ধ লাগল। সামান্য ঝাঁঝ রয়েছে, স্বাদ মিষ্টি মিষ্টি। মধু আছে নাকি?
তারাও নেশার গুলি মুখে দিল।
বিশ্ব বলল, ”তুমি নির্ভয়ে খেতে পার, রেবতী। তোমাকে তোমার স্ত্রীর কাছে নিরাপদে ফেরত পাঠানো আমার কর্তব্য।” হাসল বিশ্ব। ”তবে ধীরে সুস্থে খাও, মাঝে মাঝে সরবত খেয়ো। ওটা ভাঙের সরবত নয়।”
সামান্যক্ষণ তিনজনই চুপচাপ।
খারাপ লাগল না নেশার বস্তুটা। মিষ্টির সঙ্গে সামান্য টকের ভাবও আছে বোধ হয়। এক চুমুক সরবত খেলাম। বাদামের সরবত। বললাম, ”কই, তোমার মহারাজ হবার গল্পটা শুরু করো।”
”হ্যাঁ, করছি। বিশ্ব তারার দিকে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে। সামান্য পরে বলল, ”সব শুনে তোমার লাভ নেই। সে এক মহাভারত হবে। মাঝখান থেকে শুরু করি। আগের কথা বলতে হলে ছোটো করে বলা যায়, আমার তখন কেউ কোথাও নেই। বাবা অনেক আগেই গিয়েছে, মা গিয়েছিল অর্ধযোগে স্নান করতে প্রয়াগে, আর ফেরেনি, মানে মারা গিয়েছে জলে ডুবে। আমার এক ছোটো বোন ছিল তার বিয়ে হয়েছিল পূর্ণিয়ায়। শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। আমি সব দিক দিয়েই নিশ্চিন্ত।”
বিশ্ব আবার একটা নেশার গুলি খেয়ে এক চুমুক সরবত খেল।
”আমার তখন বছর পঁয়ত্রিশ বয়েস,” বিশ্ব বলল, ”করেছি অনেক কিছু। ছেলে পড়ানো, কোলিয়ারির চাকরি, ভঁয়সা ঘিয়ের ব্যবসা, কাপড়ের দোকান, মাছ সাপ্লাই, ইটের ভাটি, মাইকার খুচরোর কারবার। এমন কি ঝাণ্ডাবাজি। দু দুটো চাকু-কেসে আমাকে আসামীও করেছিল। এই সব করতে করতে বয়েসটা গেল বেড়ে। রক্তের তেজ কমতে লাগল। আজ রামগড়, কাল রাঁচি, পরশু গিরিডি, পরের দিন গয়া—এ আর পোষাচ্ছিল না। তখন আমি বকোদরে। সেখান থেকে রাঁচির দিকে সরে গিয়ে চামড়ার ব্যবসা শুরু করলাম। স্বদেশি ট্যানারি। গোরুমোষের, ছাগলের চামড়া নিয়ে কারবার। বামুনের ছেলে, ব্যবসা করি চামড়ার, লোকে আঁতে ঘা দিত। বলত ‘ব্রাম্হানকা লাড়কা—তুমনে শালে বাপদাদাকি জাতভি নষ্ট কর ডালা।’ আমার ব্রাহ্মণত্ব তাতে যে লজ্জা পেত তা নয়, আমি বলতাম—’মৃত পশুকো চামড়া, ইসমে জাত ক্যায়সা নষ্ট হো গা? ইয়ে তো ভাণ্ডারমে যাতা হ্যায়, ভাই।’ আসলে কি জানো, ওই চামড়ায় জুতো তৈরি হত। তুমি যদি আগে শহরের বড়োসড়ো খাদির দোকান থেকে জুতোটুতো কিনে থাকো, দেখবে জুতোর বাক্সের ওপর লেখা থাকত—’মৃত পশুকো চামড়াসে বানায়া।’ মৃত জন্তুর চামড়ায় জুতো বানাতে যেখানে দোষ নেই, গান্ধীজী বারণ করেননি কোথাও, তখন মরা জন্তুর চামড়ার ব্যবসা করতে দোষ হবে কেন, বলো?”
আমি হেসে উঠলাম। বিশ্ব দেখছি জীবনে অনেক করেছে।
বিশ্বও হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে আবার একটা নেশার গুলি নিয়ে মুখে পুরল, বলল, ”নাও, নাও। হাত গুটিয়ে বসে কেন! এক কাজ করো, আগে দুটো মিষ্টি খেয়ে নাও। তাতে ভাল হবে।”
তারা ঝুঁকে পড়ে মিষ্টির প্লেট বাড়িয়ে দিল। ওর মাথা আমার নাকের কাছাকাছি আসতে, গন্ধ পেলাম। চুলের গন্ধ। তেলের। কী তেল বুঝলাম না। বোধ হয় আমলা। একটু বেশি ঝাঁঝ।
মিষ্টি খেয়ে আবার দু চুমুক সরবত খেলাম। একটা গুলি। নেশার কিছু দেখছিলাম না। তারাও খেল। তবু অল্প বিস্তর নেশা হয়েছে কিনা দেখার জন্যে আকাশের দিকে তাকালাম। অজস্র তারা একপাশে, অন্যপাশে কালো গগনে আধফালি চাঁদ। পাহাড়টা মেঘের মতন দূরে আকাশ আড়াল করে দাঁড়িয়ে।
বিশ্ব বলল, ”চামড়ার ব্যবসায় কিছু পয়সাকড়ি হল; বুঝলে রেবতী। আগে যাতে হাত দিয়েছি ফেল মেরেছি। দেখলাম ভাগ্যটা ফিরছে। চামড়াতেই আমার পয়। তখন ঠিক করলাম, এবার একটা বিয়ে করব। একলা থাকি। মাধববাবুর ভাঙা কাছারি বাড়িতে আমার ট্যানারি। তারই একপাশে পড়ে থাকি। চারদিকে দেহাত, বনজঙ্গল। থাকার মধ্যে একটা ভাঙা জিপ। শুকনো চামড়া নিয়ে স্টেশনে যেতে কাজে লাগত।…আমার এক বন্ধু ছিল অযোধ্যাপ্রসাদ। সে বলল, আগে একটা বাড়ি করো, তারপর বিয়ে। কাছারি বাড়ির পাশে খাপরার চাল দেওয়া এক বাড়ি করলাম। ইটের গাঁথনি, মেঝেতে সিমেন্ট, মাথার ওপর খাপরার চাল। ছোটো কটেজ টাইপের বাড়ি। বিয়ের সব ঠিকঠাক। মেয়ে, দিনক্ষণ। মেয়েটা ছিল রামগড়ের দিকে। নাম—ঊর্মিলা। তার বাপ ছিল না, মামা কুষ্ঠ হাসপাতালের ডাক্তার। বিয়ের ক’দিন আগে মেয়েটা বেঘোর জ্বরে মরে গেল। মনে বড়ো দুঃখ হল। আবার স্বস্তিও পেলাম। বিয়ের পর পর ও যদি মারা যেত, অযথা একটা বউ-মরা মদ্দা হয়ে থাকতাম। অযোধ্যা বলল, হাজারিবাগে কোন কাছারিবাবুর মেয়ে আছে, দেখতে পরী, তার সঙ্গে বিয়ে লাগিয়ে দেবে। বললাম, বেশ তবে তাই করো, তবে তাড়াতাড়ি। অযোধ্যা বলল, এক মাসের মধ্যে ব্যবস্থা করবে। তিন মাস কেটে গেল—বেটা কোনো ব্যবস্থাই করল না। ওকে কতবার বোঝালাম, দাবানল আর কামানল এই দুইয়ের সঙ্গে চালাকি মেরো না। কামানলে পুড়েছি আমি। বেটা ভেগে গেল। শেষে আমিই একদিন কাজকর্মে হাজারিবাগ টাউনে গিয়েছিলাম, শুনলাম কাছারিবাবুর মেয়েকে অযোধ্যা নিজেই কামানলে পুড়িয়েছে। বুঝলাম, বেটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলেই বেপাত্তা হয়েছে।…আমার দু নম্বর বিয়েও ফসকাল, ভাই।”
হাসতে হাসতে মরি আর কি! তারাও হাসছিল।
নেশা কিনা জানি না, মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠছিল। চমৎকার লাগছিল সব। আকাশ, বাতাস, হালকা জ্যোৎস্না, ঘুলঘুলি করা ছাদ। তারা উড়ুনি খুলে ফেলেছে। মাথায় কাপড় নেই। তার টান করে বাঁধা চুলের কয়েক গুচ্ছ কপালে পড়েছে। ওর মস্ত খোঁপাটা চোখে পড়ছিল।
আবার নেশা নেওয়া হল। তারা সরবত খেল অনেকটা।
তিন
বিশ্ব বলল, ”এবার শোনো আমার ভাগ্য পতনের কাহিনি। চামড়ার কারবার নিয়ে ছিলাম ভালই, হঠাৎ অন্য এক কারবারী এসে জুটল। আমার গায়ের পাশে তার ট্যানারি খুলল না বটে কিন্তু ওটা ওর জাত ব্যবসা, জানেশোনে বেশি, তার ওপর বেটার হাত ছিল নানা দিকে। আমার ব্যবসার ক্ষতি হতে লাগল। বছরখানেক তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বুঝলাম, আমার চেয়ে তার মাথা ভালো, কাজ ভালো, সাহস বেশি। ভাবলাম ব্যবসা অনেক দিন হল, এবার ছেড়ে দি। টিকে থাকার হলে থাকতে পারতুম। ইচ্ছে হল না। ঠিক করলাম কারবার বেচে দিয়ে চলে যাব। ওর নাম ছিল মুসা। মুসলমান। গিয়ে বললাম, আমি কারবার বেচে দেব, কিনবে? মুসা রাজি হয়ে গেল।
”মাস খানেক কি তার একটু বেশি হবে চামড়ার কারবার বেচে দিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নগদ বেশি রাখিনি হাতে, হাজারিবাগ টাউনের মহাজনের নামে হুণ্ডি কেটে নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল বেনারস যাব। আগে বার দুই গিয়েছি। আমার পছন্দসই জায়গা। বেনারসে মাসখানেক গা-গতর ঢিলে করে আবার ফিরে আসব।
”বেনারসেই যাচ্ছিলাম; ট্রেনে মারদাঙ্গা লেগে গেল। একদল যাচ্ছে মেলায়, তাদের কোন জানানার কে ইজ্জত নষ্ট করেছে। সে এক হইহই ব্যাপার! লাঠালাঠি, রক্তারক্তি। পুলিশ এসে মেলার দলটাকে নামিয়ে দিল। সেই সঙ্গে আমাকেও। ভাবল আমি বোধ হয় ওদের লিডার। চেহারাটা সেইরকম হয়ে উঠেছিল প্রায়।
”পরের গাড়িতে আমাদের তুলে দিল। মেলা-অলারা আমায় মহারাজজী মহারাজজী করতে লাগল। বেটাদের যত বলি আমি মহারাজ নই, ততই বেটারা আমার ন্যাওটা হয়ে পড়ে। ওদের দলে পড়েই যেতে হল মেলায়। ভাবলাম, দুটো দিন না হয় ঘুরেই যাই মেলায়—ক্ষতি কি। যেখানে সেখানে পড়ে থাকার অভ্যেস আমার যথেষ্ট ছিল, এখনও খানিকটা আছে।”
”দোহাতী মেলা আমি অনেক দেখেছি কিন্তু যেখানে গিয়ে হাজির হলাম, তেমন মেলা আমি ভাই আগে কখনও দেখিনি। বিরাট মেলা। সেখানে না আছে কি? গোরু-মোষ বেচাকেনা হচ্ছে, ফড়ের দল বস্তা বস্তা ডাল কিনছে, লোহার দশরকম জিনিস—বাঁটি, কাটারি, হাতা খুন্তি, কড়াই; ওরই অন্য পাশে কাচের চুড়ি, লুগা আর গামছা, মিলের ধুতি-শাড়ি, লাল নীল রঙের সরবত; আবার আর-এক দিকে চোলাই—সেই সঙ্গে পাঁচ সাত গণ্ডা বেশ্যা মেয়েছেলে। নাগরদোলা, রামলীলা, বাঁদর নাচ—এসব বাদই দিলাম।”
”ওই মেলায় একজনকে দেখলাম তাঁবু খাটিয়ে জন দুই ডোম ক্লাসের লোক নিয়ে বাসে আছেন। বয়েস হয়েছে খানিকটা। বস্তা পাঁচেক ব্লিচিং পাউডার, দু টিন ফিনাইল, কলেরার টিকে দেবার তোড়জোড় সামনে। একটা নড়বড়ে টেবিল নিয়ে বসে আছেন ‘স্যানটারিবাবু’। তাঁর দুটো তাঁবু। একটাতে তাঁর বয়ে আনা মালপত্তর আর লোক থাকে। অন্যটাতে থাকেন তিনি। সঙ্গে মেয়ে। মেয়েকে মেলায় নিয়ে এসেছেন।”
আলাপ হল। বললেন, ”এবারের মেলা বেশ জমজমাট হয়েছে। গোরু মোষের দরও বেশি। পুলিশ সাহেব তদারকি করে গিয়েছেন সব। আরও কিছু পুলিশ আসবে।”
”রাতটা মেলায় কাটালাম। পরের দিন পালাব পালাব করছি, শুনলাম উলটি লেগে গিয়েছে। তার মানে কলেরা। শীত তখন শেষ। শীতের কলেরা নাকি বড়ো খারাপ। মেলায় খাবার জল বলতে গোটা দুয়েক কুয়োর জল। বাকি সব-কর্ম নদীর জলে, কলেরার আর দোষ কি! শীতের ধুলো, বাসী মেঠাই মণ্ডা, মাছি, যত্রতত্র পেচ্ছাপ পায়খানা, গোরুমোষের আবর্জনা—সব ব্যবস্থাই মজুত।”
”পালাতে গিয়েও পালানো হল না ওই স্যানিটারি বাবুটির জন্যে। বললেন, ”ভাগবেন না বাবুজি আমার মাত্র দুজন লোক। আমাকে মদত দিন। এত মানুষ মরে যাবে—তা কি হয়! ভগবান পাপ দেখেন, পুণ্যও ভি দেখেন।”
”লোকটির কথা শুনে আমার বুক কাঁপেনি, কিন্তু ওর চোখমুখ দেখে আর ছোটাছুটি দেখে মনে হল, মানুষটা হয় পাগল না হয় নিজেই ভগবান।…পালাতে পারলাম না। থেকে যেতে হল। ভাবলাম, আমার কিই বা আছে, মরি যদি মদত দিয়েই মরব।”
”দু দিনেই সব অন্যরকম। অমন সাজানো আসর ভেঙে গেল। কলেরা ছড়িয়ে গিয়েছে। পালাও পালাও রব। গোরু আর মোষ আর বেশ্যা নিয়ে তাদের মালিকরা পালাতে লাগল, দোকানদাররা পালাচ্ছে, নাগারদোলার লোকটা আগের রাতেই মরেছে। তার নাগরদোলা পড়ে থাকল। খবর পেয়ে পুলিশ এসে সব ভাঙতে লাগল, তারা কিছু রাখতে দেবে না, ভাগো ভাগো শালা। ভাগ যাও।”
”আমার ভাগা হল না। স্যানিটারিবাবু মেলাতেই মারা গেলেন। যাবার সময় তিনি একবারও বলেননি মেয়েটিকে আপনি দেখবেন। বোধহয় তিনি ভেবেছিলেন, ভগবানের রাজত্বে কিছু না কিছু আছে যা আমাদের নিজের হাতকেই এগিয়ে দেয়।”
”ওই যে তারা, ওকে আমি মেলার ভিড়ে, উলটির মধ্যে হঠাৎ পেয়ে গেলাম। আমার হাত নিজের থেকেই এগিয়ে গেল।”
”তারার বাবাকে কোনোরকমে পুড়িয়ে, নদীর জলে চিতার ছাই ধুয়ে আমি অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। তারপর তারাকে বললাম, যাবে আমার সঙ্গে?…তারা মাথা হেলিয়ে জানাল, সে আসবে।”
”মেলা থেকে তারাকে নিয়ে আমি চলে এলাম।…তা বলে ভেব না গল্পটা এখানেই শেষ হল; আরও একটু আছে।…কই তুমি তো আর খাচ্ছো না? খাও। তারা, তুমি?”
বিশ্ব কথা বলতে বলতে আরও একটা দুটো নেশার গুলি খেয়েছিল। সরবতও।
আমার যে ঠিক নেশা লাগছিল তা নয়, তবে চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে এসে আবার ঠিক হয়ে আসছিল। কি যেন মাথার মধ্যে দলছিল। সামান্য ঘুম ঘুম লাগছিল। অথচ কোনো ক্লান্তি বা অবসাদ নয়। বরং নরম কোনো আলস্যে যেন গা ডুবে যাচ্ছিল।
চার
তারা বলল, ”আমার কেউ ছিল না। মহারাজ আমায় উদ্ধার করলেন।”
বিশ্ব বলল, ”কে যে কাকে উদ্ধার করে রেবতী, বলা মুশকিল। তারার যে কেউ নেই এটা আমার মনে হয়েছিল। যদি কেউ থাকত, ওই স্যানিটারিবাবু অমন করে ওকে মেলায় নিয়ে আসতেন না। কেন এনেছিলেন তা আমি পরে বুঝতেও পেরেছিলাম। আজ তুমি যাকে দেখছ তার বয়েস ছত্রিশ সাঁইত্রিশ, আমি যখন প্রথম দেখেছি, ওর বয়েস ছিল উনিশ কুড়ি। হ্যাঁ, ওর গায়ের রঙ আজ যেমন দেখছ এইরকমই ছিল, কিন্তু রঙ বাদে আর যা ছিল তাতে…ওকে চোখে চোখে না রাখলে—সব কিছুই হতে পারত।”
তারা হেসে বলল, ”মহারাজ বাড়িয়ে বলছেন।”
বিশ্ব হাসল। বলল, ”না রেবতী, আমি বাড়িয়ে বলছি না। শীতের দিনে সকালের হিমে ভেজা কচি শালগাছ দেখেছ? রোদ ঠিকরে কেমন দেখায় গাছের পাতাগুলো, জান? তারা ছিল সেইরকম। ওকে আমি কেমন অবস্থায় প্রথম দেখেছিলাম জান? তাঁবুর দরজা আধ-গোটানো; দড়ির খাটিয়ায় বসে চুল বাঁধছিল নিজের মনে, কোমরের কাপড় আলগা, পিঠে আড়াল প্রায় নেই, মুখের সামনে কোলের ওপর আয়না। বুকের কাছে ভোমরা উড়ছে। আর আমি তো বরাবরের কামাচারী।”
তারা হেসে উঠল কিন্তু আমার কেমন যেন লাগল কানে। হাসিটা চারদিকে বৃষ্টির মতন শব্দ হয়ে বাজতে লাগল। নেশা নাকি?
বিশ্ব বলল, ”আমার যাবার কথা বেনারস। আর যাওয়া হল না। তারাকে নিয়ে কোথায় যাই কোথায় যাই করে চলে গেলাম রাজগির। সেখানে গিয়ে আমার হল ভীষণ অবস্থা। কোথাও কিছু নেই, হল অসুখ। অদ্ভুত এক অসুখ ভাই। সারাদিন বমি বমি লাগত, অনর্গল বমি আসত। আর বিশ্রী এক গন্ধ পেতাম বাতাসে। কিসের গন্ধ বুঝতাম না। মনে হত, কাঁচা চামড়া পুড়ছে কোথাও।
”আমার শরীর স্বাস্থ্য দেখতে দেখতে ভাঙতে লাগল। কিছু খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না, কোথাও বসে থাকাও দায় হয়ে উঠল। তারা চাইছিল রাজগির ছেড়ে চলে যেতে। দেখলাম, রাজগিরে থাকলে আমার কোনো লাভও হচ্ছে না।”
”রাজগির ছেড়ে চলে এলাম। টাকা পয়সায় টান ধরেছে। বিষণগড়ে এসে আমার মনে হল আর আমি বাঁচব না। একদিন যেন আর সহ্য করতে না পেরে মরতে গেলাম। মরা হল না। তারা আমায় মরতে দিল না। না দিয়ে এই নেশা আমায় এগিয়ে দিল। বলল, খাও। দেখো—উপকার হবে। খেয়ে দেখলাম। কাজ হল। বমির ভাব গেল, দুর্গন্ধ গেল। ভাঙা শরীর আবার ভালো হতে লাগল।”
”তুমি বলবে নেশাটা তারা কোথায় শিখল তৈরি করতে। আমি অবশ্য তা জানি না। তারাও বলে না। তবে এইমাত্র জানি, তারার বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন। অবশ্য ওই যে স্যানিটারিবাবু উনি তারার বাবা নন, তারাকে তিনি পালন করেছিলেন। কে যে তারার মা তারা জানে না। বাবাকে জানে। বাবা তারাকে মিশনারিদের অনাথ আশ্রমে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। স্যানিটারিবাবু সেখান থেকে তারাকে নিয়ে আসেন। আট দশ বছর তাঁর কাছে ছিল, তারা। তাই না?”
”দশ বছর।” তারা বলল।
”আমার কাছেও পনেরো ষোল বছর হল,” বিশ্ব বলল। বলে চুপচাপ থাকল। হাত বাড়াল। নেশার পাত্রে আর মাত্র একটি কি দুটি গুলি অবশিষ্ট। সরবত ফুরিয়ে গিয়েছে। বাকি নেশাটুকু মুখে ফেলে বিশ্ব জল চাইল।
তারা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দিল বিশ্বকে।
জল খেয়ে আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বিশ্ব বলল, ”রেবতী, তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো তো, ও কেন আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে? যে-বয়সে ভয় ছিল, সেই বয়েস তো কবে কেটে গিয়েছে। এখন ওর ভয়ও নেই ভাবনাও নেই। তবু কেন আমার সঙ্গে এমন করে জড়িয়ে আছে? কেন?”
আমি তারার দিকে তাকালাম। কেমন যেন লাগল! আমার কি খুব নেশা হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে নেশার ভাব ছড়িয়ে গিয়েছে সমস্ত চেতনায়? কিন্তু আমার তো অস্বস্তি হচ্ছে না, মাথা দপদপ করছে না। কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, চোখের সামনে কেমন সব পালটে যাচ্ছে। তারাকেও এত কাছে দেখছি যে হাত দিয়ে ছুঁতে পারব। তার চোখমুখ কাঁচা মাটির মতন নরম ভিজে ভিজে দেখাচ্ছিল। কপাল টলটল করছে নাক কাঁপছে, চোখের তারা বড়ো হয়ে উঠছিল।
বিশ্বর দিকে তাকালাম। বিশ্বকে দেখে আমার কেমন চমক লাগল। একেবারে পালটে গিয়েছে। মাথায় জটা, মুখে কত রকম দাগ, ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে যেন, চোখভরা যন্ত্রণা।
এ-রকম কেন দেখছি? কেন? আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ কতটুকু, তবু কত আলো আলো লাগছে। ছাদের ঘুলঘুলি করা আলসেটা যেন দুলছিল।
”বিশু আমি কেমন অন্যরকম দেখছি সব” আমি বললাম, ”নেশা হয়েছে বোধ হয়।”
”কষ্ট হচ্ছে?”
”না।”
”এতে কষ্ট হয় না। …বাকিটুকু শোনো। দেখো রেবতী, আমি অনেক ভেবেছি। জীবনে কত কি করলাম, বলো! একেবারে নচ্ছারের মতন শুরু করেছিলাম। অনেক ঘাটের অনেক জল খেলাম। কিন্তু ওই মেলা আমার সর্বনাশ করল। তোমায় সত্যি করে বলি, তারাকে যখন আমি মেলায় আচমকা পেয়ে গেলাম তখন আমি যে খুব একটা দুঃখে গলে পড়েছিলাম তা নয়। যেখানে গণ্ডায় গণ্ডায় গোরু-মোষ বেচা হয় সেখানে একটা মেয়েকেও তো কেনা যায়। না না, কথাটা ও-ভাবে নিয়ো না। সব উদারতা স্বার্থশূন্য নয়। কোনো উদারতা কিন্তু একরকম কিনে নেওয়া। অসহায় তারাকে আমি কিনেছিলাম। ওর যা ছিল তার লোভ আমি কেমন করে সামলাব। বলতে পার, মড়ক মহামারী এসে আমায় খুব সহজে ওকে দিয়ে গেল। হ্যাঁ দিল। কিন্তু তারপর? যে সুখের জন্যে ওকে নিয়ে এলাম সেই সুখ কেন পেলাম না? কেন আমার অমন অসুখ করল? অমি মরা জন্তুর চামড়ার কারবার করেছি। কাঁচা চামড়া ট্যান করেছি। গন্ধ আমার নাকে লাগত না, বমি আসত না। আর ওই জ্যান্ত চামড়া—যার তলায় রক্ত মাংস টনটন করছে সেই চামড়ার গন্ধ কেন আমার অসহ্য হচ্ছিল! তোমায় সত্যি বলছি, একবার আমার সন্দেহও হয়েছিল তারা আমায় বিষ খাওয়াচ্ছে। ও ডাইনী। …কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখো, ওর তৈরি নেশা দিয়ে ও আমায় বাঁচিয়ে তুলল। আর এই বাঁচার জন্যে আবার আমায় ঘরবাড়ি ব্যবসাপত্র ছড়িয়ে বসতে হল।… তা ধরো পনেরো ষোল বছর এমন করে গেল। তারাকে বলি, শোধবোধ তো হয়ে গিয়েছে। আমি যদি সত্যিই তোমায় মড়কের সময় উদ্ধার করে থাকি, তুমিও আমায় মরণ থেকে বাঁচিয়েছ। আর কেন! এবার তুমি যাও। …ও যায় না। আমার কাছে পড়ে থাকবে! কেন?”
আমি তারার দিকে তাকালাম। তারা আবার দেখি দূরে সরে গিয়েছে। সে আর বসে নেই। দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ের উড়নি বাতাসে উড়ে গিয়ে আলসের গায়ে আটকে আটকে আছে। গায়ের বসন আরও সাদা, যেন দুধের ফেনা ওর সর্বাঙ্গে মাখানো। মাথার চুল উড়ছে বাতাসে। সেই চুলও সাদা।
আমি বিশ্বর দিকে চেয়ে দেখি, বিশ্বর সমস্ত কিছু পাংশু, নিঃসাড়। তার চোখের পাতা বোজা, মুখ বিবর্ণ। চুল ধবধব করছে। পরনে একটু কাপড়।
এমন নেশা আমার কখনও হয়নি। কী দেখছি আমি? স্বপ্ন? না, অলৌকিক দৃশ্য? একি আমার মতিভ্রম?
বিশ্ব বলল, ”তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো, রেবতী। ও কেন আমাকে জড়িয়ে পড়ে আছে?”
তারা বলল, ”জানার দরকার কি, মহারাজ?”
”তুমি ভাবছ, তুমি না থাকলে আমার এই নেশা থাকবে না!” মাথা নাড়ল তারা।
বিশ্ব বলল, ”ও আমার মরণের কথা ভাবে, রেবতী। ভাবে, এই নেশাই আমার এতকাল বাঁচিয়ে রেখেছে। ও চলে গেলে আমি মরব।”
তারা বলল, ”কে মরবে কেউ জানে না, মহারাজ।”
”যদি আমি মরি?”
তারা কোনো জবাব দিল না। না দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলল।
বিশ্বও আর কথা বলছিল না।
তিনজনেই আমরা নীরব, নিঃসাড় হয়ে বসে থাকলাম। চৈত্রের বাতাস বইতে লাগল খেপার মতন। আকাশে কেমন জ্যোৎস্নার ঢেউ লাগল।
তারা গুনগুন করে কি যেন গাইছিল, বুঝলাম না। এর ভাষা, সুর—সবই গ্রাম্য, দেহাতী। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু ‘ধুনায়িয়া’ শব্দটা কানে বাজছিল। গানের সুরটা বড়ো অদ্ভুত। শুনতে শুনতে মনে হল, শীতের দিন গাছতলায় বসে কোনো ধুনুরি যেন তুলো ধুনছে আপন-মনে, আর ধনুর শব্দটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ওই সুর শুনতে শুনতে কি যে হল জানি না, দেখি অনেক দূরে এক মেলা বসেছে মস্ত। মানুষে মানুষে ঠাসা। গোরু মোষ ভরতি। ধুলোয় সব ধুলোময়। কার্বাইডের সার সার আলো। নানারকম দোকান। কাচের চুড়ি পরে মেয়ের দল ঘুরছে। কোথায় যেন রামলীলার আসর বসেছে, ঢোলক বাজছে। অন্যদিকে নাগরদোলা। সাবিত্রী সত্যবান সিনেমা হচ্ছে, ডায়নামো চলছে শব্দ করে। মাতালরা হাসছে, খড়ের গাদায় বসে বেশ্যার দল রঙ্গ করছে গা ঢলিয়ে।
হঠাৎ দেখি মেলা উধাও। সব ফাঁকা। মাঠঘাঠ খাঁ-খাঁ। খড় উড়ছে, শালপাতা আর ভাঙা মাটির হাঁড়ি চতুর্দিকে ছড়ানো। পোড়া কাঠকুঠো। শকুনি আর চিলে আকাশ ভরে গেল।
ওই মড়কের অন্য সীমানায় নদীর ধারে বিশ্ব। গাছতলায় শুয়ে আছে। তার চারপাশে বুনো লতাপাতা, ঝোপঝাড়, মাথার ওপর আকাশ। মনে হল, বিশ্ব মরে গেছে।
”বিশু?”
”উঁ!”
”আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি।”
”নেশায় দেখছ?”
”হয়ত।”
”কী দেখছ?”
”তুমি মরে পড়ে আছ।”
”তারা কোথায়?”
তাঁরাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কোথায় তারা? কারা যেন ঝোপজঙ্গলের পাশ থেকে ‘রাম নাম স্যাত হ্যয়’ ধ্বনি দিচ্ছে। কোথায় তারা?
আচমকা দেখি, ওই তো তারা। বিশ্বর পাশে বসে আছে। নিরাবরণ, সিক্ত। তারা তার বুকের কাছে হাত রেখে কি যেন ধরে রেখেছে। কী আছে তার তালুতে? নেশা?
”তারা কোথায়?” বিশ্ব বলল।
”তোমার পাশে।”
দূরের মেলা দূরেই হারিয়ে গেল।
বিশ্বকে দেখলাম। তারাকেও। কাছাকাছি, পাশাপাশি বসে আছে। ছাদজোড়া ঝাপসা জ্যোৎস্নার মধ্যে আমরা তিনজন। মনে হল, তারা কোনোদিনই উপকরণ জুটিয়ে কোনো নেশা তৈরি করেনি। সব নেশাই তার বুকের তলায় জমানো।