নূরীর সন্ধানে
মহারাজা হীরন্ময় সেন রাণীকে লক্ষ্য করে বললেন–তুমি যাকে নিজ সন্তানরূপে আঁকড়ে ধরে। রাখতে চাও সে সাধারণ মানুষ নয়।
রাণী অবাক কণ্ঠে বললেন–তুমি তিলকের কথা বলছো?
হাঁ রাণী। একটু থেমে বললেন মহারাজ-তিলকের কাজ শেষ হয়েছে, আর তাকে তুমি ধরে। রাখতে পারবে না।
একি বলছো তুমি মহারাজ?
হ, তিলক এবার বিদায় নেবে।
না, না, আমি তাহলে বাচবো না। তিলককে ছাড়া আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো, বলো?
রাণী, কে সে-জানো?
জানি, সে ভীল সন্তান…
না, সে ভীল সন্তান নয়।
তবে কি তার পরিচয়?
তার পরিচয় তুমি জানতে চাও রাণী?
হাঁ, বলো? বলো আমি তিলকের পরিচয় জানতে চাই? বলো মহারাজ।
তিলক বিশ্ববিখ্যাত দস্যু বনহুর!
মহারাণীর দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠে, পাথরের মূর্তির মত যেন জমাট বেঁধে যান। তিনি।
ঠিক সেই মুহূর্তে বিজয়া সেই কক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো, পিতার কথাগুলো তার কানে পৌঁছতেই সে যেন আরষ্ট হয়ে গেলো।
তিলক দস্যু বনহুর-বিশ্ববিখ্যাত দস্যু! একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলো বিজয়া। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে স্থবিরের মতো। তার মনে তখন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে চলেছে মনে। এমন সুন্দর যার চেহারা, এমন পৌরুষদীপ্ত যার কণ্ঠস্বর, গভীর উজ্জ্বল নীল যার দুটি চোখ, যার আচরণে নেই কোনো কুৎসিত লালসার ইংগিত, সেই কিনা স্বয়ং দস্যু বনহুর। বিজয়ার যেন বিশ্বাস হতে চায় না পিতার কথাগুলো।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলো বিজয়া, তারপর সে মনকে প্রস্তুত করে নিলো, পরীক্ষা করে দেখবে সে ঐ তিলককে–সত্যি সে দস্যু বনহুর কিনা।
ফিরে এলো বিজয়া নিজের ঘরে।
সুন্দর করে সাজলো সে। মুক্তাখচিত হারছড়া পরলো সে গলায়। কক্ষের উজ্জ্বল আলোতে ঝকঝক করে উঠলো হারছড়া বিজয়ার কণ্ঠে। এ হার বহু মূল্যবান। সহসা এ হার বিজয়া পরতে না। কোনো রাজকীয় উৎসবে এ হার পরতো সে। তখন পাহারা পরিবেষ্টিত থাকতো তার চারপাশে। আজ বিজয়া হারছড়া পরে বিনা পাহারায় এগিয়ে চললো তিলকের কক্ষের দিকে।
বনহুর তখন নিজ কক্ষে শয্যায় শুয়ে একটি বই পড়ছিলো। গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ছে সে একটা অদ্ভুত কাহিনী। অন্যান্য দিনের মত আজও বিজয়া তিলকের কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ালো আজ পা দু’খানা যেন তার আটকে গেছে দরজার ওপাশে। পিতার কণ্ঠস্বর ভাসছে তার কানের কাছে……তিলক স্বাভাবিক মানুষ নয়,…..সে বিশ্ববিখ্যাত দস্যু বনহুর! তিলক স্বাভাবিক মানুষ নয়……
বিজয়ার যেন বিশ্বাস হতে চায় না কথাটা। দস্যু বনহুর–সে নাকি ভয়ঙ্কর এক দস্যু। তার দেহে নাকি অসুরের শক্তি। হিংস্র জন্তুর মত নাকি তার আকৃতি–কিন্তু তার চেহারায় তো নেই কোনো পশুত্বের ছাপ। বিজয়া অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে বনহুরের দিকে।
হঠাৎ কি যেন মনে করে বিজয়া ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই দরজায় শব্দ হয়।
চমকে উঠে বনহুর, বই থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। বিজয়া চলে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে ডাকে সে-বিজয়া!
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বিজয়া।
বনহুর বলে–শোনো।
বিজয়ার মনে আজ এ কণ্ঠস্বর নতুন এক অনুভূতি জাগায়, ধীর-মন্থর গতিতে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে এগিয়ে আসে। চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে বনহুরের চোখের দিকে, বিস্ময় ঝরে পড়ছে তার দৃষ্টির মধ্যে।
বনহুর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে–বিজয়া, কি দেখছো অমন করে?
তিলক তুমি……তুমি……
বলো?
তুমি, না না থাক……বিজয়া নিজকে সংযত করে নেয়। কারণ সে এসেছে তিলককে পরীক্ষা। করে দেখবে সত্যি সে দস কিনা। তাই তো সে এই মূল্যবান হারছড়া পরে এসেছে।
বিজয়া নিজকে স্বাভাবিক করে নিতে চেষ্টা করে। পূর্বে যে যেমন করে তিলকের সঙ্গে মিশতো তেমনি করে ঘনিষ্ঠভাবে সরে আসে সে, আজও মন থেকে সব দ্বিধা মুছে ফেলে, বলে–তিলক একটা কথা তোমায় বলবো, রাখবে?
রাজকন্যার কথা না রেখে পারি? বলো?
বিজয়া গলার স্বর চাপা করে নিয়ে বলে–শুনলাম বিশ্ববিখ্যাত-দস্যু বনহুর নাকি নীল দ্বীপে আগমন করেছে।
বনহুর চেহারায় ভীতিভাব ফুটিয়ে বলে উঠে—-সত্যি বলছো বিজয়া?
বিজয়া বললো-হাঁ।
আমার কিন্তু বড় ভয় করছে। বিজয়া মনে মনে হাসে, তিলকই যে স্বয়ং দস্যু বনহুর এ কথা জানতে বাকি নেই তার। অথচ বনহুর নিজেই যেন নিজ নাম শুনে আতঙ্কে শিউরে উঠেছে। চমৎকার অভিনয় জানে সে। বিজয়া মনোভাব গোপন করে বলে-তিলক, তুমি বীরপুরুষ। একটি নয়, কতকগুলো ভয়ঙ্কর কাপালিককে তুমি হত্যা করেছে। তারপর মন্ত্রী পরশু সিং-এর মত একজন কুচক্রী শয়তানকে তুমি শায়েস্তা করেছো, আর দস্যু বনহুরের নামে তুমি এতোটুকু হয়ে গেলে?
বনহুর শয্যায় সোজা হয়ে বলে, মুখোভাবকে চিন্তাযুক্ত করে বলে উঠেকাপালিক হত্যা, তারপর মন্ত্রী পরশু সিংকে শায়েস্তা করা–সে তো সামান্য ব্যাপার। দস্যু বনহুরকে কাবু করা—- সেতো কম কথা নয়..
এমন ভীরু পুরুষ তুমি তিলক!
সত্যি আমি বড্ড ভীরু!
আর আমি এসেছি তোমার কাছে আমার একটি মূল্যবান জিনিস গচ্ছিত রাখতে।
তা তা-খুব পারবো। কি জিনিস বিজয়া?
আমার এই হারছড়া। গলার হারছড়া হাতে খুলে নেয় বিজয়া, তারপর বলে–এই রাজপ্রাসাদে এটা আমি তোমার কাছেই সবচেয়ে নিরাপদ মনে করি।
ঢোক গিলে বলে বনহুর–এ যে অতি মূল্যবান হার।
সেজন্যই তো এত ভয়! দস্যু বনহুর যখন নীল দ্বীপে আগমন করেছে তখন রাজবাড়িতে একবার তার আগমন ঘটবেই।
আমারও কিন্তু সেই রকম মনে হচ্ছে।
হারছড়া তোমার কাছেই থাক, কেমন?
বেশ থাক্। তবে হঠাৎ যদি দস্যুটা আমার ঘরে হানা দিয়ে বসে?
আমার বিশ্বাস, তোমার সঙ্গে পারবে না–দস্যু বনহুরও নয়। তিলক, তুমি অদ্ভুত বীর পুরুষ!
বিজয়া, তোমার ধারণা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।
বিজয়া হারছড়া বনহুরের হাতে দেয়, তারপর বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।
পরদিন বিজয়ার ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে।
চোখ রগড়ে শয্যায় উঠে বসতেই মনে পড়লো তিলকবেশী দস্যু বনহুরের কথা, মনে পড়লো তার মূল্যবান হারছড়ার কথা। সত্যিই তিলক দস্যু কিনা পরীক্ষা করার জন্যই সে হারছড়া কাল রাতে দিয়ে এসেছিলো তিলকের কাছে। বিজয়ার সমস্ত মনপ্রাণ তিলককে সানন্দে গ্রহণ করেছে, অন্তর দিয়ে সে ভালবেসেছে ওকে। তার ভালবাসার কাছে ঐ মূল্যবান হারছড়ার মূল্য কিছু নয়। তাই বিজয়া নিজ কণ্ঠের হার দিয়ে তিলককে যাচাই করে দেখতে চায়। আরও সে যাচাই করে। দেখতে চায়, তিলকের কাছে কোনটার মূল্য বেশি রাজকন্যা বিজয়া না মহামূল্য ঐ হারছড়া। তিলক যদি হারছড়ার মোহ ত্যাগ করতে না পারে, সে যদি ঐ হার নিয়ে নীল দ্বীপ ত্যাগ করে চলে যায়, বিজয়ার দুঃখ নেই।
হঠাৎ বিজয়ার দৃষ্টি চলে গেলো সম্মুখস্থ আয়নায়, চমকে উঠলো সে নিজের গলায় তার মহামূল্য হারছড়া দেখতে পেয়ে। বিস্ময়ে যেন আরষ্ট হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। ধীর পদক্ষেপে আয়নার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, হারছড়ায় হাত বুলিয়ে অনুভব করলো সত্যিই তার গলায় সেই হারছড়া, যে হারছড়া সে কাল রাতে তিলকের কাছে জমা রেখে এসেছিলো।
বিজয়া অবাক না হয়ে পারলো না স্বয়ং দস্যু বনহুরের লোভহীন মনোভাব দেখে। আনন্দও হলো, কারণ দস্যু বনহুর এসেছিলো তার কক্ষে, নিজ হাতে সে হারছড়া পরিয়ে দিয়েছে তার গলায়। একটা অনাবিল খুশিতে মন ভরে উঠলো বিজয়ার।
ভোরে উঠার পর বিজয়া সখীদের নিয়ে বোজ দীঘিতে স্নান করতে যেতো। আজ আর সখীদের ডাকে সাড়া দিলো না, পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো সে অতি সন্তর্পণে। মনে তার রঙিন স্বপ্নের মায়াজাল। তিলক দস্যু জেনেও বিজয়ার মনে তার প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয়নি, বরং একটা উজ্জ্বল দীপ্ত মনোভাব জেগেছে তার মনে–দস্যু হলেও তিলকের হৃদয় অনেক বড়, অনেক উচ্চ।
বিজয়া অতি লঘু পদক্ষেপে এসে দাঁড়ালো তিলকের কক্ষের দরজায়। দরজা ভেড়ানো এখনও তবে নিদ্রাভঙ্গ হয়নি তিলকের। চুপি চুপি যাবে সে কক্ষমধ্যে, নিদ্রিত তিলককে সে চমকে দেবে এত ভোরে।
কক্ষের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে বিজয়া। থমকে দাঁড়ালো সে, দু’চোখে ফুঠে উঠলো বিস্ময়কই, তিলক তো নেই তার শয্যায়! কোথায় গেলো সে এত ভোরে। মুহূর্তে বিজয়ার আনন্দ যেন দপ করে নিভে গেলো প্রদীপের আলোর মত।
তিলকের শয্যা শূন্য।
কক্ষমধ্যে সব কিছুই সাজানো রয়েছে থরে থরে। এমনকি তিলকের রাজকুমারের পোশাক পর্যন্ত আছে আলনায়। মহামূল্যবান কণ্ঠ হারছড়াগুলোও ঝুলছে একপাশে দেয়াল আলনায়। তিলক রাজকুমারের পোশাক যখন সজ্জিত হয়ে রাজদরবারে যেতো তখন এসব মূল্যবান হার তার কণ্ঠে শোভা বর্ধন করতো। মূল্যবান জুতো জোড়াও তেমনি পড়ে রয়েছে। সব রয়েছে-শুধু নেই তিলক।
বিজয়া চঞ্চলভাবে খুঁজলো তিলককে। কোথাও নেই সে। নাম ধরে ডাকলো–তিলক! তিলক! তিলক……..
বিজয়া যখন ব্যস্তভাবে তিলকের সন্ধান করে চলেছে তখন তার পাশে এসে দাঁড়ালো বিজয়ার নতুন সহচরী নূপুর। বিজয়ার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে ফিরে তাকালো বিজয়া।
নূপুর একটু হেসে বললো–প্রিয়া, যাকে খুঁজছো তাকে আর পাবে না।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো বিজয়া-নূপুর, তুই কি করে জানলি ওকে আর পাবো না?
জানি, সে নীল দ্বীপ ত্যাগ করে চলে গেছে।
তিলক নীলদ্বীপ ত্যাগ করে চলে গেছে!
হা।
নূপুর, তুই কি করে জানলি এ কথা?
জানি।
বল, বল কি করে তুই জানলি? বিজয় নূপুরের জামার অংশ চেপে ধরে ঝাঁকুনি দেয়।
নূপুর বলে–ছাড়ো সব বলছি।
তিলক আমাকে কিছু না জানিয়ে তোকে বলে চলে গেলো? না, আমি বিশ্বাস করি না তোর কথা।
স্থির হয়ে শোনো, সব বলবো তোমাকে।
বিজয়া নূপুরের মুখের দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। নূপুর তার পুরান সহচরী নয়, কিছুদিন হলো তাকে সে সহচরী হিসেবে গ্রহণ করেছে। নূপুরকে তার বড় ভাল লেগেছিলো প্রথম থেকেই। যেমন নম্র তেমনি ভদ্র মেয়েটি। তাছাড়া বড় সুন্দর–অপূর্ব সুন্দরী, দেখলে সহসা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
বিজয়া তাই বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করেছিলো ওকে। ওর ব্যবহার তাকে আরও বেশি মুগ্ধ করেছিলো। অল্পদিনেই বিজয়ার মনকে জয় করে নিয়েছিলো নূপুর। সহচরীদের মধ্যে তাই সবার চেয়ে প্রিয় ছিলো সে ওর কাছে। বিজয়া নূপুরের কথায় অবাক হয়ে বলে-তিলক, তোকে বলে গেছে নূপুর?
না।
তবে কি করে জানলি?
আমি সব জানি। রাজকুমারী, তিলকের সঙ্গে আমার অন্তরের গভীর আকর্ষণ আছে……
নূপুরের কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে বিজয়া-নুপুর; তুই জানিস তিলক আমার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন। ওকে আমি ভালবাসি……
বিজয়ার ক্রুদ্ধ ভাব লক্ষ্য করে নূপুর মোটেই বিচলিত হয় না বরং তার মুখে একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে, বলে সে-বিজয়া, তোমার চেয়ে আমি অনেক গুণ বেশি ভালবেসেছি তাকে……
নূপুর! এত স্পর্ধা তোর!
স্পর্ধা নয় রাজকুমারী, এটা প্রত্যেক নারীর নিজস্ব সম্পদ। ভালবাসা কোনোদিন লোকসমাজ, জাতিভেদ বা সময়-কাল বিচার করে না। তুমিও যেমন নিজের অজ্ঞাতে তিলককে ভালবেসে ফেলেছো, আমার অবস্থাও তাই। জানি…একটা নিশ্বাস ত্যাগ করে বলে আবার নূপুর–জানি, যাকে আমি অন্তর দিয়ে ভালবেসে ফেলেছি তাকে কোনোদিন পাবো না।
বিজয়ার ক্রুদ্ধ রাগত ভাব পূর্বের ন্যায় তীব্র রয়েছে, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো সে–তবে অমন দুরাশা করেছিলি কেন?
যেমন তুমি।
তুই কি বলতে চাস তিলককে পাবার আশা আমার দুরাশা? তাকে ভালবেসে আমি…
হাঁ, তাকে ভালবেসে তুমি ভুল করেছে, কারণ তাকে পাবার আশা সম্পূর্ণ দুরাশা।
নূপুর!
সত্যি বলছি রাজকুমারী।
একটা ভীল যুবক, একটা নগণ্য দস্যুকে….
বিজয়া, তুমি জানো না, তাকে পাবার জন্য কত রাজকন্যা, কত বিদূষিণী, কত মহিষী, কত সুন্দরী নারী পাগলিনী কিন্তু কেউ তাকে পায়নি আজও…….
বিজয়া বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে শুনে যাচ্ছেনপুরের কথাগুলো। ওকে তো কোনোদিন এমন করে কথা বলতে শোনেনি সে। নূপুর তবে তিলক সম্বন্ধে জানে? তিলকের সঙ্গে কি তার সম্পর্ক?
নূপুর বিজয়ার মনোভাব বুঝতে পারে, হেসে বলে-রাজকুমারী, তুমি ভাবছো আমার সঙ্গে কি তার সম্পর্ক! আমি কি করেই বা তার সম্বন্ধে এত জানলাম, তাই না?
হ! তুই বল তিলকের সঙ্গে কি করে তোর পরিচয় হলো? আর কি করেই বা তোদর মধ্যে গড়ে উঠলো গভীর ভালবাসা?
এবার নূপুরের মুখমণ্ডল ম্লান হলো, একটা বেদনাভরা হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে, বললো-গভীরভাবে ভালবেসেছি তাকে কিন্তু তার কোনো প্রতিদান পাইনি। তার প্রতিদান কোনোদিন পাবো না, তাও জানি।
তাহলে…..
তার সঙ্গে আমার পরিচয় আজও ঘটেনি তেমন করে। আমি শুধু তাকে ভালবেসেছি, সে আমাকে জানে না–কে আমি, কি আমার পরিচয়……
সেকি কথা?
হা বিজয়া, অদ্ভুত আমার ভালবাসা। একটা নিশ্বাস ত্যাগ করে নূপুর—জানি তাকে কোনোদিন পাবো না, তবু আমি ভালবেসে যাবো।
কি লাভ এতে হবে?
জানি না।
তিলক তোকে তাহলে দেখেনি কোনোদিন?
আমাকে সে দেখেছে কিন্তু জানে না কে আমি।
আশ্চর্য!
হাঁ, আশ্চর্যই বটে। কারণ সে আমাকে জানে না চেনে না। আর আমি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। শুধু তাই নয় বিজয়া, আমি তাকে সর্বক্ষণ ছায়ার মত অনুসরণ করি। যেখানে সে সেখানেই আমি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না রাজকুমারী।
নূপুর, তবে কি আমার ভালবাসা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে?……বিজয়া নূপুরের হাত মুঠায় চেপে ধরে, বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে তার কণ্ঠস্বর।
বিজয়ার মুখোভাব লক্ষ্য করে নূপুরের বড় মায়া হলো, তার চোখ দুটোও অশ্রু ছলছল হলো, বললো সে–রাজকুমারী, ওকে যে নারী ভালবেসেছে, সেই ব্যর্থ হয়েছে– তুমিও ব্যর্থ হয়েছে বিজয়া।
না না, আমি ভাবতে পারছি না তিলক একেবারে চলে গেছে, এ কথা আমি ভাবতে পারছি না। ঐ তো ওর জামা-কাপড় সব সাজানো রয়েছে। ঐ তো পায়ের জুতো তাও রয়েছে……
তার নিজস্ব পরিচ্ছদ পরেই সে চলে গেছে। রাজকীয় পোশাক তার প্রয়োজন নেই। বিজয়া, এবার আমিও বিদায় চাই।
নূপুর!
হ রাজকুমারী, আর আমি নীল দ্বীপে থাকতে চাই না। কাজ আমার শেষ হয়েছে।
সেকি, চলে যাবি নূপুর?
হা।
নূপুর!
আমি নূপুর নই…
তবে তুমি-তুমিই কি আশা?
হাঁ, আমার একনাম আশা।
তুমিই আশা? তুমিই তবে তীর নিক্ষেপ করতে?
হাঁ, আমিই সেই আশা। আচ্ছা, এবার আমি চলি রাজকুমারী বিজয়া?
নূপুর, আমার কাছেও তুমি আত্মগোপন করে চলে যাবে? পরিচয় দেবে না আমাকে?
তুমি আমাকে তোমার সহচরী নূপুর বলেই জানবে। আচ্ছা, আসি রাজকুমারী। নূপুরবেশিনী আশা বেরিয়ে যায়।
বিজয়া পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বনহুর আস্তানায় ফিরে এলো।
বনহুরের অনুচরগণ তাকে অভ্যর্থনা জানালো। কিন্তু সবার মুখমণ্ডল বিষণ্ণ ম্লান দেখতে পেয়ে বনহুর একটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় আশঙ্কিত হয়ে উঠলো। আস্তানার মধ্যে এগুতে এগুতে বললো রহমান, আস্তানার সব কুশল তো?
রহমান কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নত করে নিলো।
কায়েসও এগুচ্ছিলো তাদের সঙ্গে, বললো সে–সর্দার, কাউকে কিছু না বলে নূরী কোথায় চলে গেছে..
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বনহুর, দু’চোখ স্থির করে তাকালো সে কায়েসের মুখে-শূরী আস্তানায় নেই?
না।
বনহুর এবার তাকালো রহমানের দিকে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–রহমান?
বলুন সর্দার?
নূরী কোথায় গেছে? কেন গেছে সে?
যতদূর মনে হয়, নূরী আপনার সন্ধানে চলে গেছে। এক দিন গভীর রাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে জাভেদকে নাসরিনের শয্যায় শুইয়ে রেখে কোথায় অন্তর্ধান হয়েছে, কেউ জানে না।
বনহুরের মুখোভাব ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠলো; একটি কথাও সে উচ্চারণ করলো না। নিজ বিশ্রামকক্ষের দিকে এগিয়ে চললো।
একটু পরে নাসরিন জাভেদকে কোলে করে প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।
বনহুর পদশব্দে মুখ তুলে তাকালো, জাভেদের মুখে দৃষ্টি পড়তেই তার মুখোভাব করুণ হয়ে উঠলো।
জাভেদ তখন ফিক ফিক করে হাসতে শুরু করেছে। হাত-পা-নাড়ছে সে আর অস্ফুট শব্দ করছে……আব্বা-ব্বা-ব্বা..
বনহুর এগিয়ে এলো নাসরিনের পাশে। হাত বাড়াতেই জাভেদ ঝাঁপিয়ে পড়লো পিতার কোলে।
বনহুর জাভেদকে বুকে চেপে ধরলো, অতি কষ্টে নিজের অশ্রুবেগ সংরক্ষণ করে পুনরায় জাভেদকে ফিরিয়ে দিলো নাসরিনের কোলে।
নাসরিন যেমন নিঃশব্দে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেছিলো, তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো।
বনহুর শয্যায় অর্ধ শায়িত অবস্থায় বসে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করতে লাগলো।
আস্তানায় বনহুর যখন নূরীর কথা ভাবছে তখন নূরী নীল দ্বীপে ক্যাপ্টেন রণজিৎ লালের কাছে বন্দিনী অবস্থায় রয়েছে। তাকে পাগলিনী মনে করে আটক রেখেছে সে।
নূরীর সুন্দর চেহারা রণজিৎকে মুগ্ধ করেছে, তাই সে ওকে আটক রেখে চিকিৎসা চালানোর ব্যবস্থা করলো।
নূরী অবশ্য পাগল বা অপ্রকৃতিস্থ হয়নি, সে রীতিমত সুস্থ আছে। ক্যাপ্টেন রণজিতের কুৎসিত মনোভাব বুঝতে পেরে পাগলিনীর অভিনয় করে চলেছে।
সেদিন জাহাজে সে ক্ষুধার্ত অবস্থায় যখন গোগ্রাসে খাচ্ছিলো তখন তাকে খালাসীরা ধরে ফেলে এবং নিয়ে যায় তাদের ক্যাপ্টেনের কাছে।
ক্যাপ্টেন নুরীকে দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো, নূরীর সৌন্দর্য তাকে অভিভূত করে ফেলেছিলো একেবারে। প্রথমে ক্যাপ্টেন রণজিৎ নূরীকে করুণার দৃষ্টিতে দেখলেও পরে তার প্রতি কেমন যেন একটা লোলুপ ভাব নিয়ে তাকাচ্ছিলো। নূরী ভাবলো, এই লোকটার হাত থেকে তাকে বাঁচতে হবে এবং কৌশলে নীল দ্বীপেও পৌঁছতে হবে।
ক্যাপ্টেন রণজিৎ একসময় নূরীকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলো-এই, তোমার নাম কি?
নূরী রণজিতের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে পেট দেখালো, আর মুখে হাত গুঁজে কিছু খেতে চাইলো।
রণজিৎ সঙ্গে সঙ্গে খাবার এনে দিলো, প্রচুর খাবার।
নূরী পেট পুরে খেলো, কতক সে ছড়ালো চারপাশে। কখনও খিল খিল করে হাসলো, কখনও কাঁদলো সে সত্যি সত্যি জাভেদের কথা মনে করে।
রণজিৎ মনে করলো মেয়েটা বদ্ধ পাগল।
নিয়ে এলো সে ওকে নীলদ্বীপে।
নূরীর মনে একটা আশার আলো উঁকি দিয়ে গেলো–নীলদ্বীপে সে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে এবার সে যেমন করে হোক তার হুরকে খুঁজে বের করবেই।
কিন্তু নূরীর আশা সফল হলো না, তাকে আটক করে রাখলো রণজিৎ অতি সাবধানে। সে মনে করলো, মেয়েটি পাগল–কাজেই সে কোথাও চলে যেতে পারে। সাবধানে রেখে তার চিকিৎসা চালালে মন্দ হয় না। এমন সুন্দরী তরুণী সে কোনোদিন দেখেছে কিনা সন্দেহ।
রণজিৎ সব সময় নূরীর দিকে খেয়াল রাখলো। ওকে আকৃষ্ট করার জন্য সে নানারকম উপায় অবলম্বন করতেও ছাড়লো না।
নূরী এতে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলো কারণ তার প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটা যুগ বলে মনে হচ্ছিলো।
ক্যাপ্টেন রণজিৎ শত শত টাকা ব্যয় করে চললো নুরীর জন্য। নীল দ্বীপের ডাক্তার সবাই নূরীকে সুস্থ করে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো।
নূরী বিপদে পড়লো, তাকে নিয়ে রণজিতের মাথাব্যথার কারণ সে জানে। তাই সে পাগলিনীর। অভিনয় করে চলেছে। ডাক্তারগণ তাকে পরীক্ষা করে কোনো রোগ খুঁজে পেলো না।
একদিন রণজিৎ নূরীর কক্ষে প্রবেশ করে ওকে ধরে ফেললো এই, তোকে আমি খুব ভালবাসি!
নূরী তখন বিশ্রাম করছিলো, কক্ষমধ্যে অন্য কোনো জনপ্রাণী নেই। রণজিৎ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এসেছে। শিউরে উঠলো নূরী। আজ এর কবল থেকে তার রক্ষার কোনো উপায় নেই। এতোদিন নানা ছলনায়, নানা কৌশলে নিজকে সে ঐ কামাতুর ক্যাপ্টেনটার হাত থেকে রক্ষা করে এসেছে, আজ বুঝি আর হলো না।
নূরী ক্যাপ্টেন রণজিতের বাহু দুটোকে এক ঝটকায় মুক্ত করে নিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো, তারপর বললো–আমাকে ভালবাসি!
হাঁ, খুব ভালবাসি রাণী।
ক্যাপ্টেন রণজিৎ নূরীর নাম খুঁজে না পেয়ে তাকে রাণী বলে ডাকতো। রাণী বলে ডাকলে নুরীও জবাব দিতে ঠিকমত।
রণজিৎ নেশাভরা চোখে তাকিয়ে আছে নূরীর যৌবনভরা দেহের দিকে। নূরী নিজকে ওর দৃষ্টির আড়ালে নেবার জন্য ঘাটের ওপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
নুরী হঠাৎ হাসতে শুরু করলো ভীষণভাবে, সে হাসি যেন থামতে চায় না। তারপর বললো আমাকে তুই খুব ভালবাসিস, তাই না?
হাঁ, হাঁ রাণী। আমি তোকে অনেক গহনা দেবো, অনেক শাড়ি-জামা দেবো, অনেক টাকা দেবো……
আর কি দিবি?
যা নিবি তাই দেবো। কথার ফাঁকে রণজিৎ নূরীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
নূরীর বুকটা অজানিত একটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সে চারিদিকে। বন্ধ কক্ষে শুধু সে, সে আর ক্যাপ্টেন রণজিৎ।
নূরী ভাবছে এর আর সে নিজকে বাঁচাতে পারলো না। সে মনেপ্রাণে খোদাকে স্মরণ করে চলেছে। হঠাৎ নূরীর দৃষ্টি চলে গেলো ওপাশে একটা ত্ৰিপয়ার উপর। সেখানে কিছু পূর্বে তাকে খাবার দিয়ে গিয়েছিলো, থালা এবং গেলাসটা তখনও পড়ে রয়েছে।
নূরী এগিয়ে গেলো, দ্রুত হস্তে তুলে নিলো গেলাসটা।
রণজিৎ তখন নেশাগ্রস্ত মাতালের মত নূরীর দিকে এগিয়ে আসছে। দু’চোখে লালসাপূর্ণ ভাব। দু’হাত প্রসারিত করে দিয়েছে সে সামনের দিকে। এবার সে ধরে ফেলবে নূরীকে।
নূরী এবার হাতের গেলাসটা ছুঁড়ে মারলো প্রচণ্ডভাবে।
রণজিৎ ভাবতে পারেনি পাগলিনী রাণী তাকে এভাবে মারতে পারে। গেলাসটা রণজিতের কপালে লেগে ছিটকে পড়লো ওপাশে। সঙ্গে সঙ্গে দর দর করে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো।
রণজিৎ এবার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো, সে হাতের পিঠে রক্ত মুছে নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললো– রাণী তুই পাগল! আমরা তোকে পাগল মনে করি! হাঃ, হাঃ, হাঃ, এবার বুঝেছি সব তোর নেকামি। পাগল হলে তার এত জ্ঞান থাকে……..কথার ফাঁকে রণজিৎ ধরে ফেলে নূরীকে।
নূরী এবার মরিয়া হয়ে উঠে। ভীষণভাবে ধস্তাধস্তি শুরু হয়।
এমন সময় সেই কক্ষে প্রবেশ করে মুখোশ পরা এক নারী, তার দক্ষিণ হস্তে রিভলভার। কঠিন কণ্ঠে বলে—-ওকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বলছি।
হঠাৎ এক নারীর আবির্ভাব ক্যাপ্টেন রণজিৎ ঘাবড়ে গেলো ভীষণভাবে-কে এই নারী? বিশেষ করে তার হস্তের রিভলভার তাকে ভীত করে তুললো। মুক্ত করে দিলো সে নূরীকে।
নূরী ছাড়া পেয়ে ছুটে এলো সেই নারীর পাশে। চোখেমুখে তার ভয়-ভীতি আর কৃতজ্ঞতা।
নারীটি বললো-এসো তুমি আমার সঙ্গে।
নূরী যেন এতক্ষণে বুকে সাহস পেলো, অনুসরণ করলো। সে নারীটিকে।
নারীটি রিভলভার ক্যাপ্টেন রণজিতের বুকে লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে পিছু হটে বেরিয়ে এলো বাইরে।
বাইরেই অপেক্ষা করছিলো একটি ঘোড়া, নারীটি নূরীকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে নিজেও চেপে বসলো।
উল্কা বেগে ছুটতে লাগলো অশ্বটি।
নূরীর অভ্যাস আছে অশ্বপৃষ্ঠে চাপা, তাই তার কোনো অসুবিধা হলো না।
ক্যাপ্টেন রণজিতের লোক পিছু ধাওয়া করেও আর পেলো না তাদের।
নুরীসহ নারীটি তার অশ্ব নিয়ে এক পোড়োবাড়ির সম্মুখে এসে থামলো।
নেমে পড়লো নারীটি, নূরীও নামলো অশ্বপৃষ্ঠ থেকে।
নারীটি বললো-এসো, আর তোমার ভয় নেই।
নূরীর চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠেছে।
নারীটি নূরীসহ এসে দাঁড়ালো পোড়াবাড়ির অভ্যন্তরে।
নূরী বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। সেখানে কোনো জনমানব বাস করে বলে মনে হয় না। নির্জন ভাঙ্গাচুরো বাড়ি। কোনো আসবাবও নেই সেখানে, শুধু আগাছা আর জঙ্গল। কতকগুলো বাদুড় এদিক ওদিক উড়তে শুরু করেছে।
নারীটি তার মুখের মুখোশটি খুলে ফেললো। প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভারখানা বের করে একটা তাকের উপর রাখলো, তারপর বললো–এবার বলো কে তুমি? আর যে তোমাকে আক্রমণ করেছিলো সেই বা কে?
নূরী তখনো নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলো নারীটির দিকে।
নারীটি হেসে বললো–আমাকে তোমার কোনো ভয় নেই, কারণ আমিও নারী! বলো বোন, তোমার কাহিনী আমাকে বলো, আমি তোমাকে যতদূর পারি সাহায্য করবে।
নূরী একে কোনোদিন দেখেনি, কোনোদিন পরিচয়ও ছিলো না ওর সঙ্গে। ওর কথাগুলো বড় মিষ্টি লাগে তার কানে। নূরী অন্ধকারে আলোর সন্ধান পেয়েছে, একটা নিরাপদ স্থান যেন পেয়েছে সে। খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ জানায় নূরী মনে মনে।
নারীটি বলে আবার–কি ভাবছো?’
না, কিছু ভাবছি না। ভাবছি আপনি যদি ঠিক সময় আমাকে ওর কবল থেকে উদ্ধার না করে নিতেন তাহলে কি যে হতো! সত্যি, আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
নারীটি হেসে বললো-কৃতজ্ঞতা জানাবার প্রয়োজন নেই বোন, তুমি তোমার কাহিনী বলে?
নূরী পারলো না ওর কাছে নিজের পরিচয় গোপন করতে, বলতে শুরু করলো সে–আমি বোন একজনের সন্ধানে এই নীল দ্বীপে এসেছি। জানি না সে কোথায়–তাকে খুঁজে পাবো কিনা, তাও জানি না।
তুমি আমার কাছে সব খুলে বলো, যদি সম্ভব হয় তোমাকে সহায়তা করবো এবং তোমার সাথীকে খুঁজে বের করে দেবো……
পারবেন আপনি আমার সাথীকে খুঁজে বের করতে? পারবেন আপনি?
নিশ্চয়ই পারবো।
নূরী সব খুলে বললো, তবে তার স্বামীর নাম সে গোপন করে গেলো।
সুচুতরা নারীর মন মুহূর্তে বিষণ্ণ হয়ে উঠলো, একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে, সে বললো,-বোন, তুমি যাকে খুঁজছে সে ফিরে গেছে তার আবাসে। তুমি ভুল করেছো তার খোঁজে এসে।
আপনি তাকে চেনেন? দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে বলে নূরী।
নারীটি স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে বলে–বোন, আমিও যে তাকেই খুঁজে ফিরছি।
আপনি……আপনি তাকে,
হা বোন, আমিও তাকে……
তুমি……তুমি কে, কে তুমি? নূরীর চোখ দুটোতে এক রাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে। ওর পা থেকে মাথা অবধি তাকিয়ে দেখে সে স্থির দৃষ্টি মেলে।
নারীটি বুঝতে পারে নূরী মনে মনে ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। মৃদু হেসে সে ওর দিকে তাকিয়ে।
নূরী বলে উঠে–আমার স্বামীকে তুমি কি করে চিনলে? আর তাকে তুমি কেনই বা খুঁজে চলেছো? বলো জবাব দাও?
নারীটি এবার হেসে উঠে খিল খিল করে, তারপর হাসি থামিয়ে বলে-কারণ আমি তাকে ভালবাসি।
বিদ্যুৎ গতিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায় নূরী, কুঞ্চিত করে বলে উঠে–কোন অধিকারে তুমি তাকে ভালবাসো?
নারীটি তেমনি স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে–জানি তাকে ভালবাসার কোনো অধিকার আমার নেই, তবু ভালবাসি। যততদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন…..
চুপ করো। কে তুমি বলো?
আমি কে জানতে চাও?
হা।
পরিচয় দেবার মতো আমার কিছু নেই। শুধু জেনে রাখো, আমি তোমার স্বামীর মঙ্গলকামী এক নারী।
নূরীর দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময়…..কে এই নারী, কিই বা এর পরিচয়? আর সে তার স্বামীকে চেনে। শুধু চেনেই না, তাকে সে রীতিমত ভালও বাসে। তবে নিশ্চয়ই এ নারী তার স্বামীর আসল পরিচয়ও জানে। নূরীর চোখমুখে একটা ভীত ভাব প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে নম্র হয়ে আসে তার মুখমণ্ডল।
নারীটি বুঝতে পারে নূরীর মনোভাব, মৃদু মৃদু হাসে সে–তারপর বলে–বোন, আমি সব জানি।
আমার স্বামীর পরিচয় তুমি জানো?
হাঁ।
কে, কে তুমি?
বলেছি আমার পরিচয়ে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার স্বামীও আমাকে চেনে না, জানে না আমার পরিচয়।
তবে কি করে তুমি তাকে,
হাঁ, তবু আমি তাকে ভালবাসি। তাকে ভালবেসেই যাবো আমি চিরকাল, প্রতিদান আমি চাই না।
কি লাভ তাতে তোমার?
একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠে নারীটির ঠোঁটের কোণে। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে–লাভ জানি না। তবে আমার মন যা চায় আমি তাই করি। আমি চাই তার মঙ্গল।
নূরী পূর্বের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক এবং শান্ত হয়ে এসেছে। বললো নূরী–আমাকে তুমি মাফ করে দাও বোন।
নারীটি বললো–তোমার তো কোনো দোষ নেই। যে-কোন নারীই চায় তার স্বামী তারই ভালবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। আমার কথায় তুমি রাগান্বিত হয়েছিলে, এ তোমার দোষ নয় বরং আমিই অপরাধী তোমাদের কাছে।
এবার নুরী বললো–পরিচয় দেবে না জানি কিন্তু একটা কথা আমাকে বলবে ঠিক করে?
বলবো, বলো? ঐ শয়তান ক্যাপ্টেনার কবল থেকে আমাকে ঠিক সময় কিভাবে তুমি..
মানে কিভাবে আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে তোমাকে উদ্ধার করে নিয়েছি, এইতো?
হুঁ।
তবে শোনো, আমি আজই নীল দ্বীপ ত্যাগ করার বাসনায় নীল দ্বীপ বন্দরে যাই। সেখানে গিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাক্ষাৎ আশায় তার অফিসরুমে যাই। সেখানে তাকে না পেয়ে বিশ্রাম ক্যাবিনের দিকে অগ্রসর হই। এবার বুঝতেই পারছো আমার আগমন অবস্থার কথা, তারপর সবতো তুমি অবগত রয়েছে। আমি জানতাম না কে তুমি, তোমার কথায় সব জানতে পেরেছি। আজ আমি পরম আনন্দিত তোমাকে সেই দুশ্চরিত্র ক্যাপ্টেনের কবল থেকে রক্ষা করতে পেরেছি বলে।
নূরীর মন সচ্ছ হয়ে আসে, দীপ্ত হয়ে উঠে তার মুখমণ্ডল।
নারীটি বলে–আমাকে আজই যেতে হবে। বোন, তুমি এখানে অপেক্ষা করবে, তোমার জন্য আমি খুঁজে আনবে তাকে। হাঁ, ঐ পাশের কামরায় সব আছে–খাবে, শোবে, বিশ্রাম করবে।
আমি একা এই নির্জন পোড়োবাড়িতে..
কোনো ভয় নেই, এখানে কেউ তোমার সন্ধান পাবে না। যাও বোন, পাশের কক্ষে যাও।
হঠাৎ সেদিন মনসুর ডাকুর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তার লৌহ প্রাচীরে ঘেরা শয়নকক্ষে শিয়রে দাঁড়ানো এক নারীমূর্তিকে দেখতে পেলো সে, আরও দেখলো তার দু’হস্তে দুটি রিভলভার।
মনসুর ডাকু চমকে উঠলো ভীষণভাবে, গর্জন করে বললো-কে, কে তুমি?
আমি আশা!
আশা! অস্ফুট শব্দ করে উঠে মনসুর ডাকু।
হ। মনসুর, আজ তুমি যে গোপন বৈঠক করেছে সব আমি শুনেছি।
এ্যা, আমার গোপন বৈঠকের সব আলোচনা তুমি শুনেছো?
হাঁ, মনে রেখো তোমার ভবিষ্যৎ তুমিই অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। যে দস্যু বনহুর তোমাকে বারবার হত্যা করতে গিয়েও হত্যা করেনি, তোমাকে সে ক্ষমা করেছে, আর তুমি তাকে হত্যার নেশায় মেতে উঠেছো? তোমার কন্যা ইরানীর উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছো! তোমার বেঈমানী আর তোমার কন্যার শয়তানি আমি খতম করে দেবো জনের মত।
মনসুর ডাকু ভীত নজরে তাকাচ্ছে আশার হাতের উদ্যত রিভলভারের দিকে আর এক একবার তাকাচ্ছে তার মুখোশপরা মুখখানায়।
খিল খিল করে হেসে উঠে আশা, দক্ষিণ হস্তের রিভলভারখানা মনসুর ডাকুর বুকে চেপে ধরে বলে-দস্যু বনহুর তোমাকে ক্ষমা করলেও আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না। কাল ভোরে তোমার অনুচরগণ তোমার লাশ দেখতে পাবে এই কক্ষে।
এবার মনসুর ডাকুর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো।
আশা বললো—কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। চেপে ধরলো সে রিভলভারখানা আরও শক্ত করে।
মনসুর ডাকু দেখলো আজ তাকে মরতেই হবে। দস্যু বনহুর হস্তে মৃত্যু হলে তবু তার এত দুঃখ ছিলো না। আজ তাকে তার নিজ শয়নকক্ষে একটা নারীহস্তে মৃত্যুবরণ করতে হবে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এমন লজ্জা, এমন অপমান তাকে মৃত্যুর পথে টেনে নেবে। স্তব্ধ হয়ে কিছু ভাবছে মনসুর ডাকু, তার চোখের সম্মুখে ভাসছে কাল ভোরের দৃশ্যটা। কিভাবে তার লাশ এই কক্ষে পড়ে থাকবে, কিভাবে তার অনুচরগণ এসে তার লাশ দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হবে, কিভাবে তারা ভীত আতঙ্কিত হয়ে পড়বে……সব যেন ছায়াছবির মত উদয় হয় তার মনের আকাশে বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে বলে মনসুর ডাকু—আশা, জানি না তুমি কে! আমি তোমার কাছে খোদার নামে শপথ করছি, আর আমি দস্যু বনহুরের হত্যা নিয়ে ষড়যন্ত্র চালাবো না।
তোমার শপথ আমি বিশ্বাস করি না। তোমার জীবন বাঁচাতে পারো এক শর্তে–তুমি এই মুহূর্তে রাতের অন্ধকারে তোমার আস্তানা ত্যাগ করে চলে যাও! এতোকাল যা সঞ্চয় করেছে তার এক কণা তুমি গ্রহণ করতে পারবে না।
আমি–আমি কোথায় যাবো?
জীবন চাও না অর্থ-ঐশ্বর্য চাও?
জীবন……ঢোক গিলে বললো মনসুর ডাকু।
বেশ, তাই হলো। তোমাকে জীবন ভিক্ষা দিলাম।
কোথায় যাবো?
বনে।
বনে?
হা।
কি করবো?
তোমার মন তোমাকে পথ বলে দেবে। যাও, বেরিয়ে যাও আস্তানা থেকে। আর কোনোদিন এখানে ফিরে এসো না।
আমার মেয়ে ইরানী,..
তার জন্য তোমার ভাবতে হবে না।
কিন্তু
কোনো কিন্তু নয়। ইরানী শিশু বা বালিকা নয়-সে সব বুঝতে শিখেছে, কাজেই তার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না মনসুর, যাও।
মনসুর ডাকু রাতের অন্ধকারে মন্থর গতিতে তার আস্তানা ত্যাগ করে চলে গেলো।
সেদিনের পর থেকে মনসুর ডাকুর মধ্যে এলো বিরাট এক পরিবর্তন। যে ডাকু ছিলো ভয়ঙ্কর এক পৈশাচিক নরশয়তান, সেই হলো এক মহৎ দরবেশ।
বন জঙ্গল হলো তার আবাসভূমি।
মুখে দাড়ি-গোফ ছেয়ে গেলো। মাথায় চুল লম্বা হয়ে কাঁধের উপর ঝুলে পড়লো। গায়ে ছেঁড়া জামা, পরনে ছেঁড়া পায়জামা, একটা মোটা কম্বল কাঁধে নিয়ে সব সময় সে বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। ক্ষুধা হলে গাছের ফল খায়, পিপাসা পেলে নদী বা ঝর্ণার পানি পান করে। রাত হলে কম্বল গায়ে জড়িয়ে গাছ তলায় শয়ন করে।
অদ্ভুত এক শক্তি লাভ করলো মনসুর ডাকু, তাকে কোনো হিংস্র জন্তু আক্রমণ করে না, তাকে দেখলে বন্যপশু ধীরে ধীরে সরে যায়।
মনসুর ডাকু রাতের অন্ধকারে কোথায় চলে গেলো তার অনুচরগণ কেউ আর তাকে খুঁজে পেলো না। সবাই সন্ধান করে ফিরতে লাগলো এখানে সেখানে শহরে বন্দরে।
ইরানীতে কেঁদে-কেটে অস্থির হয়ে পড়লো। এ পৃথিবীতে তার একমাত্র পিতা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। ইরানী নিজে পিতার সন্ধানে ব্যাকুলভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। অনুচরদের মধ্যে ঘোষণা করে দিলো, তার পিতাকে যে খুঁজে আনতে পারবে তাকে সে বহু অর্থ পুরস্কার দেবে।
গত রাতে যে ষড়যন্ত্র হয়েছিলো তাদের মধ্যে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ইরানী বললো– আমার বাবা যখন নিরুদ্দেশ তখন আস্তানার সব কাজ বন্ধ থাকবে।
সর্দার-কন্যা ইরানীর আদেশ অমান্য করার সাহস কারো ছিলো না, সবাই মিলে তারা দস্যুতা ত্যাগ করে সর্দারের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
কান্দাই শহরে এমন শান্তিভাব কোনোদিন আসেনি বনহুরের হত্যালীলার পর অসৎ ব্যবসায়ীদল একেবারে কুঁকড়ে গিয়েছিলো। যেন কেউ কোনো রকম কুকর্ম আর মন্দ কাজ করতে সাহসী হয়নি।
পুলিশ মহল অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েও আর তেমন কোনো রাহাজানি, দস্যুতা বা হত্যাকাণ্ডের খোঁজ পায়নি। তারা অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে পড়েছে।
মার্কিন ডিটেকটিভ মিঃ লাউলং এসেছিলেন দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে কৃতিত্ব অর্জন করতে কিন্তু তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কান্দাই আসার পর তিনি নানাভাবে এই বিখ্যাত দস্যুকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু তার বাসনা সফল হয়নি বরং দস্যু বনহুরের কাছেই তিনি নাকানি-চুবানি খেয়েছেন। পুলিশ সুপার মিঃ আরিফের অবস্থাও তাই, তিনিও আপ্রাণ চেষ্টায় দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে আগ্রহান্বিত হয়েও কৃতকার্য হতে পারলেন না। রাগে-ক্ষোভে তিনি ভিতরে ভিতরে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষ করে দস্যু বনহুর তার বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলো এতো দুঃসাহসী দস্যুকে তিনি শায়েস্তা করতে না পারায় তার আফসোসের সীমা ছিলো না।
পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন সরকারি চাকরি হলে কি হবে কোনোদিনই দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য উৎসাহী ছিলেন না। তিনি জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন দস্যু বনহুর কোনোদিন মানুষের অমঙ্গলকামী ব্যক্তি নয়। সে যত দস্যুতাই করুক বা যত হত্যাই করুক, এ সবের পিছনে রয়েছে মানুষেরই কল্যাণ। তাই মিঃ ইয়াসিন দস্যু বনহুর সম্বন্ধে একটা সুন্দর মনোভাব পোষণ করতেন।
মিঃ কাওসারী, মিঃ হাসান এরা বনহুরের কাছে রীতিমত অপদস্থ হয়েছিলেন, তাই তারা আজও বনহুর গ্রেপ্তারে সর্বক্ষণ উন্মুখ রয়েছেন। এখনও তারা পূর্বের মত শহরের বিভিন্ন স্থানে সন্ধানকার্যে লিপ্ত আছেন। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে পারলে তারা শুধু সুনামই অর্জন করবেন না, মোটা পুরস্কার লাভে সক্ষম হবেন।
শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের পাহারাদারগণ ছদ্মবেশে পাহারার কাজ চালিয়ে চলেছে।
যত অসৎ ব্যবসায়ী এবং ঘুষখোর ব্যক্তিই হোক তবু তাদেরকে হত্যা করা অপরাধ–সেই অপরাধেই অপরাধী দস্যু বনহুর আর সেই কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা পুলিশ বাহিনীর কর্তব্য।
পুলিশ বাহিনী যত ব্যস্ততটস্থ হয়ে দস্যু বনহুরকে সন্ধান করে চলুক না কেন, তাকে পাওয়া সাধ্য কি তাদের। দস্যু বনহুর তখন নীল দ্বীপে কাপালিক হত্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।
অনেক দিন পর বনহুর কান্দাই ফিরে এসেছে, অনেক কিছু খোঁজ-খবর নেওয়া তার দরকার।
প্রথম দিনই নূরীর কথা শুনে মনটা তার বড় বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে সে কোথায় চলে গেছে কে জানে!
বনহুর দরবারকক্ষে তার আসনে উপবেশন করে রহমান ও অন্যান্যের কাছে জেনে নিলো কান্দাইর সমস্ত খবর। এখন দেশে কোনো অন্যায়-অনাচার চলছে কিনা……পুলিশ মহল কিভাবে কাজ করে চলেছে…মনিরা ও নূরের সংবাদ কি……সব শুনে নিলো বনহুর। এমন কি মাহমুদার স্বামী পুলিশ সুপার মিঃ আমিনুর খানের বিষয়েও অবগত হলো।
আমিনুর খান বনহুর গ্রেপ্তারের জন্য এখনও উন্মুখ, সে কথাও জানতে পারলো বনহুর তার অনুচরগণের মুখে। বিশেষ করে ইশরাৎ জাহানের বড় ভাই আহসানও যোগ দিয়েছে তার সঙ্গে।
কথাটা শুনে বনহুরের মুখে একটা ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি ফুটে উঠলো। বললো বনহুর রহমান, তুমি আজই আহসান ও লাহারার পুলিশ সুপার আমিনুর খানকে আমার শহরে আস্তানায় হাজির করবে।
সর্দার, আপনার নির্দেশমত কাজ হবে।
যাও, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে শহরের আস্তানা অভিমুখে রওনা হবো।
দরবার শেষ হলো।
বনহুর ফিরে এলো নিজের বিশ্রামকক্ষে।
গভীর মনোযোগ সহকারে পায়চারী করে চললো সে। কি যেন ভাবতে লাগলো আপন মনে। একসময় তার কানে ভেসে এলো জাভেদের কান্নার শব্দ।
বনহুরের চিন্তা জাল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, পায়চারী বন্ধ করে সে কান পেতে শুনতে লাগলো। জাভেদের কান্নার আওয়াজ তার কাছে বড় অসহায় করুণ মন হলো। ধীর পদক্ষেপে বনহুর এগিয়ে চললো যেদিক থেকে কান্নার শব্দটা ভেসে আসছিলো।
কখন সে নিজের অজ্ঞাতে নাসরিনের কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
নাসরিন কিছুতেই জাভেদকে চুপ করাতে পারছিলো না। অবিরত সে একটানা কেঁদে চলেছে। নাসরিন চেষ্টা করছে তাকে শান্ত করার জন্য।
বনহুর দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে জাভেদের দিকে।
হঠাৎ নাসরিনের দৃষ্টি চলে যায় বনহুরের দিকে। বলে উঠে নাসরিন-সর্দার, একে কিছুতেই রাখতে পারছি না।
বনহুর এগিয়ে এলো, হাত বাড়ালো জাভেদের দিকে।
জাভেদ ঝাঁপিয়ে পড়লো পিতার কোলে।
বনহুর বুকে চেপে ধরলো জাভেদকে।
আশ্চর্য, বনহুরের কোলে জাভেদ চুপ হয়ে গেলো, সে যেন তার আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়েছে। ওর পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো বনহুর-নাসরিন, জানি না নূরী কোথায় গেছে, কেমন আছে তাও জানি না……কণ্ঠ ধরে আসে তার।
নাসরিন কোনো জবাব দেয় না, সে মাথা নিচু করে থাকে। তার মুখমণ্ডল করুণ বিষণ্ণ। নূরীর জন্য তারই কি কম ব্যথা! হাজার হলেও একসঙ্গে ওরা দুজন ছোট থেকে বড় হয়েছে। একসঙ্গে খেলা করেছে, একসঙ্গে বনে বনে ঘুরে ফিরেছে। আজ যেন সে সাথীহারা হয়ে পড়েছে। নাসরিন তাকালো সর্দারের গম্ভীর বিষণ্ণ মুখের দিকে, বললো–সর্দার, নূরী নিশ্চয়ই নীল দ্বীপে গেছে।
বনহুর বললো-হয়তো হবে। আমি সেখানে যাবো কিন্তু সে যদি সেখানে ঠিকমত পৌঁছে থাকে তবেই পাবো।
সর্দার, আপনি আর বিলম্ব করবেন না।
হাঁ, যত শীঘ্র পারি যাবো। বনহুর জাভেদকে এবার নাসরিনের কোলে ফিরিয়ে দেয়। জাভেদ ততোক্ষণে পিতার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
বেরিয়ে যায় বনহুর।
মিঃ আমিনুর খান ও মিঃ আহসানকে বনহুরের সম্মুখে এনে দাঁড় করানো হলো। দু’জনার চোখেই পট্টি বাধা। বনহুরের ইঙ্গিতে বন্দীদ্বয়ের চোখের পট্টি খুলে দেওয়া হলো।
চোখ দুটো মুক্ত হওয়ায় আমিনুর খান ও আহসান সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বিস্ময়ে চমকে উঠলো। বনহুরের মাথার পাগড়ির কিছু অংশ দিয়ে মুখের নিচের দিকটা ঢাকা ছিলো। তার দু’পাশে দণ্ডায়মান রহমান ও কায়েস।
বনহুরের হাতে রিভলভার, একখানা পা তার আসনে রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। দক্ষিণ হস্তের রিভলভারখানা দোলাচ্ছিলো সে মাঝে মাঝে।
আমিনুর খান ও আহসান ভয়-বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো বনহুরের মুখের দিকে। হয়তো বা তখনও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি কোথায় তাদেরকে আনা হয়েছে, আর যে সম্মুখে দন্ডায়মান সেই বা কে।
বনহুর মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেললো।
সঙ্গে সঙ্গে আমিনুর খান আর আহসানের চোখ কপালে উঠলো। ঢোক গিললো তারা, কিন্তু কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না।
বনহুর বললো–চিনতে পেরেছো, আমিই আপনাদের সেই নগণ্য ব্যক্তি। যাকে আপনারা অহরহঃ সন্ধান করে ফিরছেন সেই দস্যু বনহুর আপনাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান। কই, গ্রেফতার করুন?
আমিনুর খান এবং আহসানের মুখে একটা হতভম্ব ভাব ফুটে উঠেছে। দু’চোখে বিস্ময়, ভয় ভীতি আর কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাব। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে তারা বনহুরের মুখের দিকে।
বনহুর বললো–টাকার লোভে না কৃতিত্বের লোভে আপনারা দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে চান? বলুন, জবাব দিন?
আমিনুর খান এবার কথা বললো–অপরাধীকে শাস্তি দেওয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
বনহুর এবার হেসে উঠলো– হাঃ হাঃ হাঃ, বড় সুন্দর উদ্দেশ্য! বেশ, তাই হবে, কিন্তু তার। পূর্বে বিচার করতে হবে অপরাধী কি রকম শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। বসুন পুলিশ সুপার মিঃ আমিনুর খান, ঐ চেয়ারে বসুন।
আমিনুর খান মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।
আহসান তাকাচ্ছে এদিকে-সেদিকে চোখেমুখে অপদস্থ ভাব।
বললো বনহুর-বসুন বিচার করুন। আচ্ছা না বসলেন, দাঁড়িয়ে সব শুনুন। যারা দেশের শত্রু, জনগণের শত্রু, আমি তাদেরকেই শাস্তি দিয়ে থাকি। যে ব্যক্তিগণ দেশের জনগণের সর্বনাশ করে থাকে আমি তাদের সর্বনাশ করি। যারা নিজের স্বার্থে আত্নহারা হয়ে পরের অমঙ্গল করে আমি তাদের অমঙ্গল করি। যারা পরের রক্ত শুষে নিয়ে নিজেদের হাত তাজা করে, আমি তাদেরই রক্ত শুষে নেই। হাঁ, এসব আমার কাজ আর এই কাজগুলোকে আপনারা যদি অপরাধ বলে মনে করেন তবে নিন, এই মুহূর্তে আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে যেখানে খুশি নিয়ে চলুন। বনহুর ওপাশ থেকে একটা হাতকড়া তুলে নিয়ে হাত দুখানা এগিয়ে ধরলো মিঃ আমিনুর খানের সম্মুখে।
আমিনুর খান কি যেন ভাবছিলো, হঠাৎ সে বনহুরের হাত দু’খানা মুঠায় চেপে ধরে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে–আমি……আমিই অপরাধী, আমাকে ক্ষমা করো ভাই! আমাকে ক্ষমা করো……
আহসানও হাতজুড়ে বলে উঠলো–আমিও দোষী। আপনার অন্তরের আসল রূপ আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি, তাই আমরা ভাল নজরে দেখিনি আপনাকে। আজ আমাদের সে ভুল ভেঙ্গে গেছে। আপনি শুধু মহৎজন নন, আপনি মহান।
বনহুর হাসলো–দেখুন, আমি মহৎ বা মহান কোনোটাই নই। তবে আমি চাই, এ পৃথিবীর সবাই হবে মহৎ ও মহান। অন্যায়, অনাচার, অসৎ কাজকে সব সময় পরিহার করে চলবে! মানুষ হয়ে মানুষ ভালবাসবে মানুষকে।
পুলিশ সুপার মিঃ আমিনুর খান ও আহসান নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে দেখে বনহুরকে।
বনহুর নিজে তাদের দু’জনাকে গাড়ি করে পৌঁছে দেয় তাদের নিজ নিজ বাড়িতে।
আহসান আর আমিনুর খান মুক্তি পেয়ে নতুন জীবন লাভ করলো যেন। দস্যু বনহুরের হাতে বন্দী হয়ে তারা যে ছাড়া পাবে সে আশা ছিলো না। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলো তারা দুজনা, কারণ তাদের পূর্বে যারা দস্যু বনহুর হস্তে আটকা পড়েছে তাদের যে অবস্থা হয়েছে তারা সব স্বচক্ষে দেখেছে-পথে-ঘাটে পাওয়া গেছে তাদের বিকৃত লাশ।
সেদিনের সেইসব হত্যালীলা দেখার পর মিঃ আমিনুর খান ও আহসান ভাবতে পারেনি জীবন নিয়ে ফিরে আসবে বা আসতে পারবে। আজ তারা বনহুরকে আন্তরিক মোবারকবাদ না জানিয়ে পারে না।
বনহুরের একান্ত অনুগ্রহেই বেঁচে গেলো তারা।
মনিরা এবং মায়ের সঙ্গে দেখা করার সময় আর হয়ে উঠলো না বনহুরের, সে নূরীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো। সঙ্গে রহমান বা কাউকে নিলো না সে সাথী হিসাবে।
ফিরে এলো বনহুর নীল দ্বীপে।
নীল দ্বীপে এসে বনহুর সমগ্র দ্বীপটা চষে ফেলল তন্ন তন্ন করে। কোথাও নূরীকে খুঁজে পেলো না।
নানা বেশে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতে লাগলো বনহুর কিন্তু নূরীর সন্ধান পেলো না। কোথায় গেলো তবে সে, বনহুর মুষড়ে পড়লো একেবারে।
একদিন ক্লান্ত অবসন্ন দেহে একটা গাছের নিচে বসে আছে বনহুর, এমন সময় একদল সাপুড়ে সেই পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো দ্বীপের শহরাঞ্চলের দিকে। পিঠে সাপের ঝাঁকা, কারো বা কাঁধে।
বনহুর গাছের নিচে বসে নূরীর কথা ভাবছিলো…..তাকে খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। না জানি সে এখন কোথায় কেমন অবস্থায় আছে। নীল দ্বীপের বহু স্থানে খুঁজেছে সে তাকে কিন্তু কোথাও পায়নি। তবে সব জায়গা এখনো তার খুঁজে দেখা হয়নি। নীল দ্বীপের প্রত্যেকটা বাড়িতে তার যাওয়া সম্ভব নয়। ভাবে বনহুর, হয়তো নূরী কোনো বাড়ির মধ্যে আটক পড়েছে, কাজেই দ্বীপের প্রতিটি বাড়িতে সন্ধান দেওয়া উচিত। বনহুর উঠে দাঁড়ালো, সাপুড়েদের দিকে এগিয়ে গেলো সে—ভাই, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? ১৭০ ৩ –৪
সাপুড়ে দল বনহুরকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো, একজন বললো–কে তুমি বাছা আমাদের পিছু ডাকছ?
বনহুর এসে দাঁড়ালো সাপুড়েদের সম্মুখে, বললো বনহুর-আমাকে তোমাদের দলে নেবে?
তুমি আমাদের দলে আসবে?
হাঁ, আমার কেউ নেই তাই……
তুমি সাপ খেলা জানো?
জানি।
বেশ এসো। কিন্তু কাজ করতে হবে।
সাপুড়ে দলের একজন বৃদ্ধা বলে উঠলো–অমন যোয়ান মানুষ খেটে খেতে পারো না?
পারি কিন্তু কাজ খুঁজে পাচ্ছি না।
আমাদের সঙ্গে এলে অনেক কাজ করতে হবে, পারবে তো?
পারবো।
সাপের বোঝা বইতে হবে……
তারপর?
সাপ খেলা দেখাতে হবে……
তারপর?
বন থেকে মাঠ সংগ্রহ করতে হবে……
তারপর?
মাঝে মাঝে রান্না করতে হবে……
সব পারব।
বেশ চল তবে আমাদের সঙ্গে হাঁ, আর একটা কথা–তোমার এ পোশাক চলবে না, পোশাক পাল্টাতে হবে। সাপুড়ের পোশক পরতে হবে।
বেশ, তাই পরবো। বললো বনহুর।
বনহুর মিশে গেলো সাপুড়ে দলের সঙ্গে।
বাড়ি বাড়ি সাপ খেলা দেখানো হলো তার কাজ, কখনও কখনো বনে গিয়ে কাঠ কেটে আনতে হয় তাকে। সাপুড়ে বৃদ্ধা তাকে ছেলের মতো আদর করতে লাগলো।
বনহুর সব বাড়িতে খেলা দেখায়, বিশেষ করে মেয়েদের দিকে তার লক্ষ্য। হঠাৎ নূরীর যদি সন্ধান পায় সেই আশায় তার চোখ দুটো ঘুরে ফিরে চারিদিকে।
একদিন বনহুর পথের মধ্যে সাপ খেলা দেখাচ্ছিলো। মাথায় গামছা বাঁধা, কানে বালা, হাতে বালা, গলায় তাবিজ। ওকে দেখলে ঠিক সাপুড়ে, বলেই মনে হচ্ছে।
ওর চারপাশ ঘিরে অগণিত লোক সাপখেলা দেখছে।
এমন সময় একখানা পাল্কী এসে থামলো সেই ভিড়ের এক পাশে।
পাল্কীর সম্মুখে এবং পিছনে কয়েকজন রাজকর্মচারী। দু’জন রাজকর্মচারী এগিয়ে গেলো সাপুড়ের দিকে, বললো একজন–এই সাপুড়ে, তোমাকে রাজকুমারী ডাকছে।
চমকে মুখ তুললো বনহুর।
রাজকর্মচারীটি বললো–আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না?
বললো বনহুর–পাচ্ছি।
তবে অমন হা করে কি দেখছো?
কোথায় তোমাদের রাজকুমারী?
ঐ তো পাল্কীর মধ্যে।
চলো দেখি। বনহুর রাজকর্মচারীর সঙ্গে এগিয়ে চললো।
পাল্কীখানার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো বনহুর।
রাজকর্মচারীটি বললো–রাজকুমারী, এই যে সাপুড়ে এসেছে।
রাজকুমারী বিজয়া মুখ না তুলে বললো—ওকে বলে দাও রাজপ্রাসাদে যেতে। আমি সাপখেলা দেখতে চাই।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো-কারো হুকুমের চাকর আমরা নই। রাজকুমারী সাপখেলা দেখতে ইচ্ছা করলে এখানেই দেখতে পারেন।
রাজকুমারী বললো–যত টাকা নাও তাই পাবে।
টাকার মোহ আমাদের নেই। যা প্রয়োজন তা হয়েছে, এবার বাড়ি ফিরে যাবো।
রাজকুমারী এবার ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো–সহজে যেতে না চাও, বন্দী করে নিয়ে যাবো।
হো হো করে হেসে উঠলো বনহুর, তারপর বললো–বন্দী করতে হবে না, চলো এমনি যাচ্ছি।
রাজকর্মচারীরা ভাবলো সাপুড়ে এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। সাপুড়ে সাপের ঝুঁড়ি কাঁধে তুলে নিলো।
পাল্কী বাহকগণ পাল্কী তুলে নিলো কাঁধে।
রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছলে ওরা।
রাজকুমারী সাপ-খেলা দেখবে এটা কম কথা নয়। রাজান্তপুরের প্রাচীর ঘেরা এক জায়গায় সাপু ডেকে নিয়ে আসা হলো।
রাজকুমারীর আদেশে সাপুড়ের আদর-যত্নের কোনো ত্রুটি হলো না।
সাপ-খেলা দেখা শেষ হলো, বিদায় চাইলো সাপুড়েবেশী বনহুর।
রাজকুমারী ওকে ডেকে আনলো নির্জন বাগানবাড়ির মধ্যে।
বনহুরকে রাজকুমারী চিনতে পেরেছিলো, নিভতে তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো-তিলক, তুমি সাপুড়ে সেজে আমার চোখে ধূলো দিতে চেয়েছিলে, কিন্তু পারলে না আমার কাছে আত্নগোপন করতে।
বনহুর মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।
বিজয়া বললো—কি, কথা বলছে না যে?
এ্যা।
বল তোমার এ ছদ্মবশে কেন?
বিজয়া, আমি তোমার কাছে পরাজিত হয়েছি, কারণ তুমি আমার ছদ্মবেশ ধরে নিয়েছে।
তোমার এ ছদ্মবেশের কারণ জানতে পারি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে বনহুর—আমি একজনকে হারিয়েছি, যাকে খুঁজে বের করার জন্য আমার এই সাপুড়ে ছদ্মবেশ।
কাকে খুঁজতে গিয়ে তুমি এ বেশ ধারণ করেছো তিলক, বলো?
আমার সঙ্গিনী……
বিজয়ার মুখখানা কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে গেলো, আনমনা হয়ে কিছু ভাবলো সে, তারপর বললো–তোমার স্ত্রী?
হা।
তিলক তুমি……না না থাক, আর কোনো কথা আমি জানতে চাই না।
বিজয়া, ওকে হারিয়ে আমি বড় মর্মাহত হয়ে পড়েছি। জানি না সে এখন কোথায়?
বিজয়া তাকিয়ে দেখলো বনহুরের চোখেমুখে একটা বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে। অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলো সে তার ব্যথা, বললো–তিলক, আমি তোমাকে ভালবাসি, তাই তোমার মননা কষ্ট আমাকেও দিচ্ছে। আমিও তোমার ব্যথায় ব্যথিত।
সত্যি বলছো রাজকুমারী?
হা তিলক।
তবে আমাকে পারবে সাহায্য করতে?
বলো কি করতে হবে?
এই নীলদ্বীপেই আছে সে যাকে আমি খুঁজে ফিরছি বিজয়া।
তুমি কি করে বুঝলে সে নীলদ্বীপেই আছে?
জানি, কাল সে আমার সন্ধানে নীলদ্বীপে রওনা দিয়েছিলো।
সে নীলদ্বীপে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে কিনা তাও তো তুমি জানো না।
তা ঠিক, আমিও জানি না।
তবে নীলদ্বীপে সন্ধান করে কি করবে তুমি?
বনহুর আজ কেমন যেন বোবা বনে যায় একেবারে। সত্যি, নূরী নীলদ্বীপে এসে পৌঁছেছে। কিনা সে জানে না। বিজয়ার কথায় মনটা তার দমে যায় মুহূর্তে।
বিজয়া বলে–তিলক, তুমি কিছু ভেবো না, বাবাকে বলে আমি একটা জাহাজ চেয়ে নেবো, সেই জাহাজে চেপে তোমার সঙ্গিনীর সন্ধান করো। কিন্তু একটা শর্ত থাকবে, যতদিন তুমি তোমার প্রিয়াকে খুঁজে না পাবে ততদিন আমি তোমার সঙ্গে থেকে তোমাকে সহায়তা করবো।
বনহুর বিজয়ার কথায় খুশি হলো, কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো তার মন, বললো-রাজকুমারী, তোমার ইচ্ছামতোই আমি কাজ করবো।
নিশ্চয়ই তুমি খুঁজে পাবে তাকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে আড়াল থেকে সরে গেলো আশা। এতক্ষণ সে একটা গাছের অন্তরালে দাঁড়িয়ে বনহুর ও বিজয়ার কথাগুলো শুনছিলো, হাসলো সে মনে মনে।
রাজকুমারী বিজয়ার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না মহারাজ হীরন্ময় সেন। তিনি একটি জাহাজ দিলেন তিলককে এবং রাজকুমারীর জিদে তাকেও ওর সঙ্গে যাবার অনুমতি দিলেন। মহারাজের বিশ্বাস আছে, দস্যু বনহুর কোনোদিন তার কন্যার প্রতি কোনো অন্যায় করবে না। বিজয়ার ধাত্রীমাতা সঙ্গে সঙ্গে গেলেন, তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য।
বনহুরের মনের অবস্থা ভাল না থাকায় বিজয়া যেভাবে তাকে বললো সেইভাবেই কাজ করে চললো, কারণ তার মনে একটা দারুণ হতাশা দানা বেঁধে উঠেছিলো। নীল দ্বীপে অনেক সন্ধান করেছে তবু সে পায়নি নূরীকে। বনহুরের ধারণা, নূরী নীল দ্বীপ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারেনি।
বনহুরের জাহাজ যখন নীল দ্বীপ ত্যাগ করলো তখন একটি নারী নীল দ্বীপ বন্দরে একটা স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে হাসলো। জাহাজখানা অদৃশ্য হলে নারীটি তাদের স্টিমার ছাড়ার জন্য আদেশ দিলো।
স্টিমার চলেছে।
নারীটি এসে দাঁড়ালো একটি ক্যাবিনের দরজায়, বললো–এসো বোন, এবার বেরিয়ে এসো।
নারীটির আহ্বানে বেরিয়ে এলো নূরী ক্যাবিনের ভিতর থেকে। ডেকে দাঁড়িয়ে বললো আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তোমাকে যে খুজছে তার কাছে।
বললো নূরী–সত্যি তুমি বড় হেঁয়ালিভরা মেয়ে। কতোদিন হলো তোমার সঙ্গে মিশছি কিন্তু আজ পর্যন্ত….
আমাকে বুঝতে পারলে না, এই তো?
শুধু তোমাকে নয়, তোমার একটি কথাও আমি ঠিকমতো বুঝতে পারি না। তুমি বড় আশ্চর্য মেয়ে!
তোমার স্বামীর মতো আশ্চর্য নই তবু।
আচ্ছা বোন, একটা কথা আমাকে বলবে?
বলো?
তুমি আমার স্বামীকে কি করে চিনলে আজও কিন্তু বললে না?
একদিন বলবো।
কিন্তু সেদিন কবে আসবে?
হাসলো নারীটি।
নূরীসহ নারীটি এক দ্বীপে এসে পৌঁছলো।
নূরী অবাক হয়ে দেখলো দ্বীপবাসীরা নারীটিকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা জানালো। অদ্ভুত সে দ্বীপবাসিগণু। সভ্য সমাজের কোনো ছোঁয়াই এ দ্বীপে এসে পৌঁছায়নি এখনো। এ দ্বীপের পুরুষরা গাছের ছাল পরে মাথায় এবং কোমরে পাখির পালক দিয়ে আবরণ তৈরি করে পরে।
এ দ্বীপের নারীদের পরনেও গাছের ছাল আর পাখির পালকে তৈরি আবরণ। বুক পিঠ সম্পূর্ণ খোলা, গলায় ঝিনুকের মালা। মাথার চুলগুলো ঝুটি করে বাঁধা।
এ দ্বীপের নারী-পুরুষ সকলেরই চেহারা জমকালো। এরা নূরী এবং নারীটিকে অত্যন্ত প্রীতির চোখে দেখলো। একটা পাতায় তৈরি কুটিরের মধ্যে নূরীকে আশ্রয় দিলো তারা।
জংলী অসভ্য জাতি হলেও এদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধটা অত্যন্ত সজাগ রয়েছে। নূরী খুশি হলো কিন্তু বুঝতে পারলো না তাকে এ দ্বীপে কেন আনা হয়েছে।
নূরী সেই নারীটির নাম জানতে চাইলে বলেছিলো তার নাম চম্পা। নুরী তাকে চম্পা দিদি বলেই ডাকতো।
চম্পাও ওকে বান্দবীর মত স্নেহ করতো।
নূরী মাঝে মাঝে ভাবতে কে এই মেয়েটি যে তাকে এভাবে রক্ষা করে নিলো, তাকে আশ্রয় দিলো, তার সঙ্গে বান্ধবীর মত ব্যবহার করে চলেছে।
নূরী যখন আনমনা হয়ে ভাবতো, তখন চম্পা হাসিমুখে তার কাছে আসতো, নানাভাবে ওর মুখে হাসি ফোঁটাতে চেষ্টা করতো।
এখানে চম্পা জংলী মেয়ের বেশেই নূরীর পাশে পাশে। সুন্দর বাঁশী বাজাতে জানতে চম্পা। নূরীর জেদে সে ওকে কখনও কখনও বাঁশী বাজিয়ে শোনাতো।
কিন্তু কোনো কোনো সময় চম্পা কোথায় যে উধাও হয়ে যেতো নুরী ওকে খুঁজে পেতো না। হয়তো বা কয়েকদিন তার কোনো সন্ধানই থাকতো না।
নূরী এই সময় নিজকে বড় অসহায় মনে করতো। হাঁপিয়ে উঠতো সে, ভাবতো চম্পা তাকে মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিয়ে রাখতে চায়।
সেদিন দুপুর বেলা নূরী বসে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছিলো, এমন সময় কে যে কাঁধে হাত রাখলো তার।
চমকে চোখ তুললো নূরী, অস্ফুট কণ্ঠে বললো–চম্পা!
চম্পা বসলো নূরীর পাশে, ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে এলো আরও কাছে—নূরী, এতে করে বলছি তুমি ভেবো না।
নূরী ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো, বললো–চম্পা, আর যে আমি পারছি না! সব তত তোমাকে বলেছি…
সত্যি নুরী, তোমার দুঃখে আমিও দুঃখিত! না জানি তোমার জাভেদ কেমন আছে…..
জাভেদ নাসরিনের কাছে ভালোই আছে চম্পা, কিন্তু আমার হুর না জানি কোথায় কেমন আছে, কোথায় হারিয়ে গেছে সে। আবার ফুঁপিয়ে উঠে নূরী।
নূরীর অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে চম্পার চোখ দুটো ছলছল হয়ে আসে, নূরীকে সে ইচ্ছা করে বনহুরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। উদ্দেশ্য বনহুরকে নিয়ে তার খেল খেলা! যে দস্যুর ভয়ে সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তটস্থ সেই দস্যুকে সে নানাভাবে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ছে। সে বনহুরকে ভালবাসে এবং তাই সে ওকে নিয়ে এবোরকম করতে চায়।
চম্পার চোখেমুখে ফুটে উঠে একটা ব্যর্থ প্রেমের করুণ প্রতিচ্ছবি। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে সে–বোন, তুমি যার জন্য এতো ভাবছে সে ঠিকই একদিন এসে হাজির হবে। তুমি বিশ্বাস করো সে না এসেই পারে না।
নূরী ওর কথায় সান্তনা খুঁজে পায় না, কতোদিন আর সে প্রতীক্ষা করবে তার জন্য!
এখানে যখন নুরী আর চম্পা বনহুরকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে চলেছে তখন নীল সাগরে মহারাজা হীরন্ময় সেনের দেওয়া জাহাজে স্বয়ং দস্যু বনহুর আর বিজয়া নূরীর সন্ধানে চলেছে।
কোথায় চলেছে জানে না বনহুর দিশেহারার মতো জাহাজখানা এগিয়ে যাচ্ছে।
বিজয়া বনহুরকে আবেষ্টনীর মত ঘিরে রাখতে চায়, সর্বক্ষণ ওকে আনন্দমুখর করে রাখতে চায় সে।
বিজয়া চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখছে-অসীম আকাশ, সীমাহীন জলরাশি; দূরে বহু দূরে একটি জাহাজ এগিয়ে আসছে। বনহুর গম্ভীর উদাস মনে দাঁড়িয়ে ছিলো, এগিয়ে এলো বিজয়া ওর পাশে–তিলক।
বলো?
ঐ দেখো একটি জাহাজ এদিকে এগিয়ে আসছে।
বনহুর বিজয়ার হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে দূরে ষ্ট নিক্ষেপ করলো। সত্যি একখানা জাহাজ নীলনদ অতিক্রম করে এগিয়ে আসছে।
বিজয়া বললো–তিলক, আমার মনে হয় ঐ জাহাজে সে আছে, যাকে তুমি খুঁজছে।
বনহুর কোনো জবাব দিলো না, সে বাইনোকুলারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে ছিলো সম্মুখে।
জাহাজখানা এগিয়ে আসছে।
বনহুর জাহাজের ক্যাপ্টেনকে ডেকে বললো জাহাজের গতি কমিয়ে দিতে, কারণ যে জাহাজখানা এগিয়ে আসছে সেটা তাদের জাহাজের পিছন থেকেই আসছে।
ক্যাপ্টেন বনহুরের আদেশ অনুযায়ী জাহাজের গতি কমিয়ে দিলো।
পিছনে জাহাজখানা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে দেখা যেতে লাগলো। বিজয়া ক্যাপ্টেনকে বললো– ক্যাপ্টেন, আপনি পিছনের জাহাজখানাকে থামার জন্য ইংগিত করুন।
ক্যাপ্টেন কথাটা শুনে ভাল মনে করলো না, কারণ এসব জায়গায় মাঝে মাঝে জলদস্যুগণ এভাবে জাহাজে চেপে দস্যুতা করে চলে।
বিজয়া ক্যাপ্টেনকে কড়া আদেশ দিলো।
অগত্যা ক্যাপ্টেন বাধ্য হয়ে পিছনের জাহাজখানাকে থামার জন্য ইংগিত জানালো।
সম্মুখস্থ জাহাজের ইংগিত পেয়ে পিছনের জাহাজখানার গতি মন্থর হয়ে এলো। তাদের জাহাজের কাছে এসে থেমে পড়লো জাহাজখানা।
বিজয়া বনহুরসহ জাহাজটায় গমন করলো। কিন্তু অবাক হলো তারা, সমস্ত জাহাজে একজন। আরোহী বা যাত্রী নেই শুধু জাহাজের খালাসি ও চালকগণ ছাড়া।
বিজয়া বললো-তোমাদের জাহাজে কেউ নেই?
বললো একজন খালাসি—আছে, আমাদের রাণী।
রাণী! বললো বনহুর।
খালাসি জবাব দিলো–হ।
বিজয়া বললো–কোথায় তোমাদের রাণী চলো তার কাছে আমরা যেতে চাই। এসো তিলক!
খালাসি এগুলো।
তাকে অনুসরণ করলো বনহুর আর বিজয়া।
বনহুর ইচ্ছা করেই বিজয়ার কাছে নিরীহ বেচারী বনে থাকে, নিজকে সে প্রকাশ করতে চায় না ওর কাছে। বিজয়ার অনুগত বান্দার মতোই থাকে সে।
বিজয়া তিলকসই খালাসীর পিছু পিছু এগিয়ে চললো।
একখানা ক্যাবিনের সম্মুখে এসে থামলো খালাসি, বিজয়া আর বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো—- আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।
ভিতরে চলে যায় খালাসি, একটু পরে ফিরে আসে–চলুন।
বিজয়া আর বনহুর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো একবার।
বিজয়া প্রথমে পরে বনহুর ক্যাবিনে প্রবেশ করলো। অবাক হয়ে দেখলো তারা, ক্যাবিনে সুসজ্জিত শয্যায় অর্ধশায়িত এক যুবতী–মাথায় মুকুট, গলায় মুক্তার মালা, সমস্ত দেহে মূল্যবান অলঙ্কার। কিন্তু আশ্চর্য, যুবতীর মুখমণ্ডল বিকৃত, এক চক্ষু মুদ্রিত, মুখে অসংখ্য গুটির দাগ।
ক্ষুদে চোখ মেলে পিট পিট করে তাকালো রাণী, হঠাৎ হেঁড়ে গলায় বলে উঠলো–কে তোমরা? কি চাও আমার কাছে?
বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখছিলো ভয়ঙ্করী নারীমূর্তিটাকে।
বিজয়াই জবাব দিলো–আমরা পথ হারিয়েছি, তাই আপনার জাহাজ থামিয়ে…
আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পথের নির্দেশ জানতে এসেছো? বললো সেই অদ্ভুত রাণী।
এবারও জবাব দিলো বিজয়া-হাঁ, আপনি যদি……
বুঝেছি, সব তোমাদের চালাকি। বলো কোন্ সাহসে তোমরা আমার জাহাজের গতিরোধ করেছো?
এবার বনহুর কথা বললো–আমরা জানতাম না এ জাহাজখানা আপনার।
জানতে না! কেন, জাহাজের সম্মুখে যে পতাকা উড়ছে তাও ভোমরা চেনো না।
এতক্ষণে মনে পড়লো বনহুর এবং বিজয়ার, জাহাজখানার সম্মুখে একটি পতাকা পত পত্ করে উড়তে দেখেছে তারা।
বললো বনহুর-হা দেখেছি কিন্তু আমরা চিনি না।
চেনো না, এবার মজাটা টের পাবে। আমার চলার পথে বাধা দিয়ে কেউ বাঁচতে পারে না।
বিজয়া অদ্ভুত নারীটির কথা বলার ভঙ্গী দেখে না হেসে পারলো না।
বনহুর গম্ভীর হয়ে বললো–মাফ করে দিন, আমরা ভুল করেছি….
ভুল করেছে–এ্যা, কি বললে ভুল করেছে। হঠাৎ রাণী শয্যার শিয়রে একটা সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর আর বিজয়ার চরপাশে একটা লৌহ সিক পরিবেষ্টিত দেয়াল ঘিরে ফেললো।
এতো দ্রুত দেয়ালটা বনহুর আর বিজয়ার চারপাশে উঁচু হয়ে উঠেছিলো যে ওরা চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে বন্দী হয়ে পড়লো।
বনহুর আর বিজয়ার বস্ত্রাভ্যন্তরে অস্ত্র লুকানো থাকা সত্ত্বেও তারা কিছু করতে পারলো না।
এইবার বনহুর বুঝতে পারলো যতো সহজ মনে করেছিলো তারা এই নারীকে তত সহজ সে নয়। বনহুর অধর দংশন করলো।
বিজয়ার মুখমণ্ডল রক্তশূন্য হয়ে পড়লো মুহূর্তে।
হঠাৎ তার কানে এলো নারীকণ্ঠের হাস্যধ্বনি। বিজয়া তাকিয়ে দেখলো সেই অদ্ভুত নারী হেসে চলেছে তাদের অবস্থা লক্ষ্য করে।
বনহুরও চোখ তুললো কিন্তু কোনো কথা বললো না।
বীভৎস নারীটি তখনও হেসে চলেছে।
কিন্তু আশ্চর্য, পরক্ষণেই লক্ষ্য করলো নারীটি যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখানে নেই। সব শূন্য, চারিদিকে নীরব। সম্মুখে কোনো শয্যা বা কোনো নারী দণ্ডায়মান নেই।
বিজয়া আর বনহুর বুঝতে পারলো, যেখানে নারী ও তার শয্যাটি অবস্থিত ছিলে সেই স্থানসহ মেঝেটা জাহাজের নিচের তলায় নেমে গেছে, সেখানে দ্বিতীয় আর একটি মেঝে স্থানটিকে পূর্বের ন্যায় সমতল করে দিয়েছে। তারা আরও লক্ষ্য করলো, তাদের নিয়ে জাহাজখানা দ্রুত চলতে শুরু করেছে।
বনহুরের ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে উঠলো, ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠলো। তার মুখমণ্ডল, বনহুর এবার বুঝতে পারলো তাকে বন্দী কারার জন্যই এই জাহাজখানা এভাবে এগিয়ে এসেছে এবং তাকে কোনরকমে তাদের জাহাজে এনে কৌশলে বন্দী করেছে।
বিজয়া ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে, তার চোখেমুখে ভীতিভাব ফুটে উঠেছে। সে বনহুরের দিকে তাকিয়ে দেখলো। বনহুরের মুখে একটা কঠিন ভাব লক্ষ্য করলো। সে এমন ভাব লক্ষ্য করেনি কোনোদিন তার মুখে একটা কঠিন পৌরুষ ভাব বনহুরের মুখখানাকে দৃঢ় করে তুলেছে।
বিজয়া এতো বিপদেও মুগ্ধ বিস্ময়ে বনহুরের দিকে তাকিয়ে রইলো, সহসা সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলো না। সে দেখলো বনহুরের ললাটে রেখাগুলো দড়ির মত শক্ত হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। দক্ষিণ হস্তখানা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে। অধর দংশন করছে বনহুর বারবার, যেমন হিংস্র জন্তু খাঁচায় আবদ্ধ হলে তার অবস্থা হয় ঠিক তেমনি।
বনহুর তাকালো বিজয়ার দিকে।
বিজয়ার সঙ্গে বনহুরের দৃষ্টি বিনিময় হতেই বিজয়া স্তম্ভিত হলোকই, সে তো কোনোদিন তাকে এমন কঠিন হতে দেখেনি। সে দেখেছে তিলকের মতো সুন্দর অপূর্ব কোনো পুরুষ হয় না, অমন কোমলপ্রাণও বুঝি কারো নেই। কিন্তু আজ বিজয়ার সে ভুল ভেঙ্গে গেলো–তিলক শুধু মানুষই নয়, সে একটি পৌরুষদীপ্ত পুরুষ। আজ বিজয়ার মন দস্যু বনহুরের কাছে নত হয়ে এলো। ধীরে ধীরে সরে এলো বনহুরের কাছে–তিলক, একি হলো?
বিজয়ার কথায় বনহুর কোনো জবাব দিলো না, সে মনে মনে ভীষণভাবে ফুলছিলো।
জাহাজখানা তখন স্পীডে এগিয়ে চলেছে
কোথায় কোন দিকে চলেছে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।
বদ্ধ খাঁচায় বন্দী হিংস্র সিংহের মত ফোঁস ফোঁস করছে বনহুর। এমনভাবে হঠাৎ সে বন্দী হবে ভাবতেও পারেনি। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো বনহুর-বিজয়া, এ আমার চরম পরাজয়।
বিজয়া বলে—এমন হবে ভাবতে পারিনি তিলক। আমি জানতাম না, এ জাহাজে আমাদের জন্য এমন একটা বিপদ ওঁৎ পেতে ছিলো। কি ভয়ঙ্কর ঐ নারীটি……
যত ভয়ঙ্করই হোক আমি তাকে……
বনহুরের কথা শেষ হয় না, একটা নারীকণ্ঠের হাস্যধ্বনি জেগে উঠে সেখানে।
চমকে ফিরে তাকায় বিজয়া আর বনহুর, তারা দেখতে পায় সেই বিকৃত মুখাকৃতি নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তাদের শিকঘেরা দেয়ালের পাশে।
বনহুর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকায়।
নারীমূর্তিটি এবার হেঁড়ে গলায় বলে উঠে—কেমন জব্দ হলো? আমার জাহাজে এলে তাদের এই অবস্থা হবে। জানো আমি কে?
বনহুর কিছু বলার পূর্বেই বলে উঠে বিজয়া-জানি তুমি একটি শয়তানী।
না, আমি হিন্দের রাণী।
বনহুর ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকালো সেই নারীমূর্তির দিকে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–হিন্দ!
হাঁ, আমি সেই দ্বীপের রাণী।
বললো বনহুর–আমাদের এভাবে বন্দী করে তোমার লাভ কি?
হিন্দে পৌঁছেই বুঝতে পারবে। হাঁ, উপযুক্ত লোক এবার পেয়েছি।
তুমি কি বলছো হিন্দ রাণী?
বলছি আমদের পুরোহিত ঠাকুর তোমাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনকে পেলে খুব খুশি হবেন।
পুরোহিত ঠাকুর।
হাঁ, তিনি তোমাদের পেলে তার পূজার কাজ সমাধা করবেন। কারণ তিনি একজোড়া স্বামী স্ত্রীর সন্ধান করে চলেছেন অনেক দিন থেকে।
বিজয়া বনহুরের মুখের দিকে তাকালো।
বনহুর বুঝতে পারলো তাদের স্বামী-স্ত্রী বলায় সে একেবারে বিস্মিত হয়ে পড়েছে।
বনহুর চাপা কণ্ঠে বললো–ও আমাদের সম্বন্ধে কিছু জানে না তাই!
চলে গেলো সেই অদ্ভুত নারী।
বিজয়া বললো–এখন কি হবে তিলক?
মরতে হবে!
দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বিজয়া।
বনহুর বলে–আমার উপকার করতে এসে তোমার এই অবস্থা হলো বিজয়া।
তিলক, আমার জন্য আমি ভাবছি না, ভাবছি তোমার জন্য। সত্যি তোমার এই দেব সমতুল্য জীবনটা বিনষ্ট হবে..
বনহুর হাসলো একটু।
কিন্তু কতক্ষণ এভাবে বন্দী হয়ে থাকা যায়।
অস্থির হয়ে উঠে বনহুর। শিকগুলো সে পরীক্ষা করে দেখে, তারপর মেঝের তক্তার উপর বসে পড়ে।
জাহাজখানা তখন স্পীড়ে চলেছে।
একটানা ঝকঝক্ শব্দ আর নীলনদের জলোচ্ছাসের আওয়াজ এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
বনহুরের অদূরে বসে আছে বিজয়া, ম্লান, বিষণ্ণতার মুখমণ্ডল।
বিজয়ার অবস্থা দেখে বনহুরের মায়া হয়। কারণ এ অবস্থার জন্য বনহুরের নিজের তেমন কিছু এসে যায় না, বহুবার তাকে এর চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর বিপদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু বিজয়া যে রাজকন্যা, চিরকাল সে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিপালিত–এ কষ্ট তার সহ্য হবে কেন?
বনহুর ভাবছে কিভাবে বিজয়াকে এদের কবল থেকে উদ্ধার করা যায়। তাদের জাহাজখানা কত দূরে আর কোথায় আছে কে জানে।
জাহাজের একটানা ঝাঁকুনি আর ঝকঝক শব্দে বিজয়ার তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো, কখন যে শিকের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে খেয়াল নেই তার।
বনহুরের চোখে কিন্তু ঘুম নেই, সে নীরবে ভাবছে এখন সে কি করবে। নূরীর সন্ধানে এসে নিজে আটকা পড়ে গেলো। না জানি নূরী এখন কোথায় কিভাবে আছে। নূরীর কথা মনে পড়তেই তার দৃষ্টি চলে গেলো বিজয়ার দিকে। সেই মুখখানা ভেসে উঠলো তার দৃষ্টি সম্মুখে। কতোদিন নূরীকে দেখেনি বনহুর। ধীরে ধীরে উঠে বনহুর এগিয়ে আসে বিজয়ার পাশে।
নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে বনহুর তাকিয়ে দেখছে বিজয়ার মুখ, ভুলে যায় বনহুর তার বন্দী অবস্থার কথা। ডান হাতখানা রাখে সে বিজয়ার চিবুকে।
সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ার ন্দ্রিা ছুটে যায়।
সোজা হয়ে বসে বলে বিজয়া–তিলক!
মুহূর্তে নূরীর মুখখানা মুছে গিয়ে বিজয়ার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠে বনহুরের চোখে, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যায় বনহুর।
বিজয়া বনহুরের হাত ধরে বলে–যাচ্ছো, বসো?
না, তুমি ঘুমাও।
তিলক!
তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বিজয়া?
বড় ঘুম পাচ্ছে আমার।
ঘুমাও।
কিন্তু কি করে ঘুমাবোবালিশ নেই, বিছানা নেই…….. বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে বিজয়ার কণ্ঠ।
সত্যি তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। রাজকুমারী তুমি, কোনোদিন এ অবস্থায় পড়োনি কিনা!
বিজয়া নীরবে বসে রইলো, নিদ্রায় চোখ দুটো মুদে আসছে তার।
বনহুর বললো–বিজয়া, যদি তোমার কোনো অসুবিধা না হয় তবে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারো।
তোমার কষ্ট হবে না?
একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো বনহুরের ঠোঁটের কোণে, বললো-পুরুষ মানুষের আবার কষ্ট! আমরা সব সহ্য করতে পারি।
বিজয়ার বড় ঘুম পাচ্ছিলো, সে নিজকে আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলো না, বনহুরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
গভীর আবেশে চোখ মুদলো বিজয়া, এতো বিপদেও সে যেন নিশ্চিন্ত হলো। ঘুমিয়ে পড়বে ভেবেছিলো কিন্তু বিজয়া ঘুমাতে পারলো না আর। একটা অপূর্ব অনুভূতি তার সমস্ত মনে আর শিরায় শিরায় আলোড়ন জাগালো। চোখ মুদে থাকলেও ঘুম আর এলো না তার।
বিজয়া ভাবতে লাগলো আজ তার জীবন সার্থক হলো, চিরদিন যদি সে এমনি করে তিলকের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারতো-পৃথিবীর সবকিছু সে ত্যাগ করতে পারতো, রাজ-ঐশ্বর্যের মোহ তাকে অভিভূত করতে পারতো না কোনোদিন।
বিজয়া যখন এসব কথা ভাবছে তখন বনহুর ভাবছে কেমন করে এখান থেকে বেরুনো যায়। তাকে কেউ কোনোদিন আটকে রাখতে পারেনি আর আজ সে বন্দী হয়ে থাকবে!
একসময় ঘুমিয়ে পড়ে বিজয়া।
বনহুরও শিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
জাহাজের একটানা ঝকঝক্ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
হঠাৎ ঘুম ভেংগে যায় বিজয়ার, চোখ মেলে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তিলক ঘুমিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ও কোল থেকে মাথাটা তুলে নেয় সে, উঠে বসে নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকায় ওর মুখের দিকে।
বিজয়া উঠে বসতেই বনহুরের নিদ্রা ছুটে যায়, সে চোখ রগড়ে সোজা হয়ে বসলো, বললো ঘুম হলো?
বিজয়া বললো–হ
কতক্ষণ নীরবে কাটলো উভয়ের।
রাত এখন গভীর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বনহুর বললো–বিজয়া, তুমি সাঁতার জানো?
বিজয়ার মুখ কালো হয়ে উঠলো, বললো সেনা, আমি সাঁতার জানি না তিলক।
হেসে বললো বনহুর–জানি রাজকুমারীরা সাঁতার জানে না। কিন্তু আমাদের পালানোর একটিমাত্র পথ সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়া……..
ওঃ, কি ভয়ঙ্কর কথা!
ভয় পাচ্ছো বিজয়া, কিন্তু এ ছাড়া বাঁচবার কোনো উপায় নেই।
বিজয়া কি যেন ভাবলো, তারপর বললো–এ লৌহশিক বেষ্টিত দেয়াল কি করে ভেদ করবে। তিলক?
আমি যা বলবো যদি করতে পারো তাহলে……..
পারবো।
এই গভীর রাতে সাগরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে রাজকুমারী?
পারবো তিলক, তোমার হাত ধরে আমি আগুনের আত্নসমর্পণ করতে পারবো।
বনহুর বললো–বেশ, তাহলে তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও-হয় মৃত্যু, নয় জীবন।
বনহুর উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেলো সে তাদের চারপাশে ঘেরা শিকের দেয়ালের দিকে।
বিজয়াও উঠে পড়েছে, সে তাকিয়ে দেখছে কি করে তিলক।
বনহুর শিকগুলোর উপর হাত রেখে পরীক্ষা করে দেখলো তারপর দুহাতে ভীষণ জোরে চাপ দিলো, ধীরে ধীরে শিকগুলো বাঁকা হয়ে আসছে।
বিজয়ার দু’চোখ বিস্ময়ে গোলাকার হয়ে উঠলো। তিলক মানুষ না কি! এতো শক্তি কোনো মানুষের শরীরে হয়। অবাক হয়ে দেখলো শিকগুলো বাঁকা হয়ে গেছে একপাশে।
বনহুর বললো–বিজয়া, শীঘ্র চলে এসো।
বিজয়া বনহুরের কথামতো কাজ করলো।
বনহুর আর বিজয়া বেরিয়ে এলো ক্যাবিনের বাইরে। অন্ধকারে আত্নগোপন করে এগুতে লাগলো পিছনে ডেকের দিকে।
বনহুর আর বিজয়া অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে দাঁড়ালো পিছনের ডেকে।
বিজয়ার মুখমণ্ডল বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।
সম্মুখ ডেক থেকে কিছুটা আলো পিছন ডেকের কিছু অংশ আলোকিত করেছিলো। বনহুর আর বিজয়া সতর্কভাবে সেই আলো পরিহার করে ডেকের কিনার ধরে যেখানে কয়েকটা বোট বাঁধা আছে, সেখানে এসে দাঁড়ালো।
আধা অন্ধকারে বনহুর দ্রুতহস্তে বোটগুলোর মধ্য হতে একটি খুলে রশিদ্বারা নামিয়ে দিলো নিচে।
বিজয়া অবাক দৃষ্টি নিয়ে দেখছে বনহুরের কার্যকলাপগুলো। যতো দেখছে ততোই যেন বিজয়া অভিভূত হয়ে পড়ছে। আরও বেশি করে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে সে।
বনহুর বোট নামিয়ে নিয়েছে, এবার বললো–বিজয়া, তুমি এই রশি ধরে ধীরে ধীরে বোটে নেমে চল, আমি তোমাকে সাহায্য করছি…….
বনহুরের কথা শেষ হয় না একটা হাসির শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর আর বিজয়ার চারপাশ ঘিরে দাঁড়ালো প্রায় বিশ-পঁচিশ জন লোক, সকলের হাতেই বল্লম আর বর্শা।
বনহুর ভাবতে পারেনি এমন একটা অবস্থা হবে।
সে ভড়কে না গেলেও একটু হতভম্ব হয়ে পড়লো। জাহাজের ডেক না হয়ে যদি ভূপৃষ্ঠ হতো। তাহলে বনহুর এতো দমে যেতো না। বুঝতে পারলো এদের কবল থেকে সে পালাতে পারে, এদের কাবু করাও তার পক্ষে খুব কষ্টকর হবে না, কিন্তু তার সঙ্গে রয়েছে একটি নারী। বিজয়াকে বিপদের মুখে ফেলে তার পালানো কিছুতেই সম্ভব নয়। বিজয়া তার মঙ্গল কামনা করেই সঙ্গে এসেছিলো, তার জন্যই সে বিপদে পড়েছে। কিন্তু এসব ভাববার সময় নেই বনহুরের। সম্মুখ তাকিয়ে দেখলো সেই নারীটি তার ক্ষুদে একটি চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।
বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো এবার হিন্দরাণী-খুব তো পালানো হচ্ছিলো—এবার মজাটা কেমন টের পাবে! এই, তোমরা ওকে আর সঙ্গিনীটিকে বন্দী করে ফেলো।
সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করলো ওরা।
হিন্দরাণী আবার হেসে উঠলো, বললো—কেমন মজা হলো দেখো! আর পালাবে?
বনহুরের হাতে এবং মাজায় লৌহশিকল পরিয়ে তাকে বেঁধে ফেলা হলো।
বিজয়ার হাতেও শিকল পরিয়ে বেঁধে ফেললো হিন্দরাণীর অনুচরদল।
বনহুর আর বিজয়া সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছে, এই শূন্য জাহাজে কোথায় এতোগুলো অনুচর আত্নগোপন করেছিলো! কি মতলব নিয়েই বা ওরা নীলনদে এমন অভিযান চালিয়ে চলেছে।
বনহুর আর বিজয়াকে নিয়ে হিন্দরাণীর অনুচরগণ এবং স্বয়ং হিন্দরাণী ফিরে এলো সেই ক্যাবিনে যে ক্যাবিন থেকে ওরা পালাতে সক্ষম হয়েছিলো।
বনহুর আর বিজয়াকে এনে দাঁড় করানো হলো।
হিন্দরাণী হেঁড়ে হলায় কঠিন কণ্ঠে বললো–আমার এই লৌহখাঁচার শিক কি করে তুমি বকালে বলো?
বনহুর হাত দু’খানা দেখিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললো–এই হাত দিয়ে।
আশ্চর্য তোমার হাত দু’খানা যুবক।
বনহুর আবার জবাব দেয়–শুধু আমার হাত দু’খানাই আশ্চর্য নয় হিন্দরাণী, আমি নিজেও আশ্চর্য মানুষ……
বটে!
হা।
কারণ?
কারণ তোমার সাধ্য নয় আমাকে বন্দী করে রাখো।
কি বললে তুমি?
যা বললাম সত্য।
আচ্ছা দেখা যাবে কি করে তোমরা এবার পালাও। শুধু লৌহখাঁচার আবদ্ধ নয়, লৌহশিকলে তোমার হাত দু’খানা শক্ত করে বাঁধা থাকবে, আর থাকবে তোমার চারপাশে মজবুত লৌহদেয়াল।
কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলো হিন্দরাণী।
হিন্দরাণীর অনুচরগণ লৌহশিকলে আবদ্ধ বনহুর আর বিজয়াকে বন্দী করে রাখলো। বনহুরের হাত দু’খানা লৌহশিকলে মজবুত করে বাধা, মাজায় লৌহশিকল। এবার যেন পালাতে না পারে সেজন্য হিন্দরাণীর সর্তকতার সীমা রইলো না।
এক রাত এক দিন কেটে গেলো।
খাবার নিয়ে এলো একজন খালাসি।
ক্যাবিনে বন্দী করার পর বিজয়ার বন্ধন মুক্ত করে দিয়েছিলো হিন্দরাণী।
খাবার এনে বনহুরের সম্মুখে রাখলো বিজয়া, নিজের খাবার খেতে শুরু করলো সে। কিছুটা খাবার খাওয়ার পর মুখ তুলতেই দেখলো বনহুর নীরবে বসে আছে। খাবার সে খাচ্ছে না।
বিজয়া বললো–তিলক, তুমি খাচ্ছো না কেন?
বনহুর তার লৌহশিকলে আবদ্ধ হাত দু’খানার দিকে তাকালো।
বিজয়া বুঝতে পারলো ওর হাত দু’খানা বন্ধ থাকায় সে খেতে পারছে না। বিজয়া এগিয়ে এলো বনহুরের পাশে, ওর খাবারের থালাটা তুলে নিলো হাতে, বললো-তিলক, আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
থাক, তোমার কষ্ট করতে হবে না বিজয়া। তুমি নিজে খাওগে, যাও!
আমি খাবো আর তুমি না খেয়ে থাকবে?
ক্ষুধা আমার নেই বিজয়া।
জানি ক্ষুধা তোমার আছে কিনা, কাল থেকে কিছু মুখে দাওনি।
তুমিও তো কিছু খাওনি।
আমরা মেয়েমানুষ, অনেক সহ্য করতে পারি। নাও, এবার খাও দেখি। বিজয়া খাবার তুলে দিতে থাকে বনহুরের মুখে।
বনহুর অগত্যা খেতে শুরু করলো। বিজয়ার হাতে খাবার খেতে খেতে বনহুরের মনে পড়লো মনিরার কথা। এমনি করে মনিরাও তাকে কতোদিন খাবার মুখে তুলে খাইয়েছে। ওর চোখের সামনে মনিরার মুখখানা ভেসে উঠলো।
বনহুর নিষ্পলক নয়নে বিজয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
বিজয়া মনে করে তিলক বুঝি তাকে ভালবেসে ফেলেছে। এর পূর্বেও সে এমনি একটা ভাব লক্ষ্য করেছে ওর মধ্যে। তিলক ওকে কাছে পেলে কেমন যেন অভিভূত হয়ে যায়, তবে কি সত্যি সে তাকে ভালবাসে?
বিজয়া বলে-তিলক, অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখছো?
বিজয়ার প্রশ্নে বনহুরের সম্বিৎ ফিরে আসে, তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে সে–কিছু না বিজয়া।
তিলক, সত্যি করে একটা কথা বলবে?
বলো?
তুমি আমাকে ভালবাস কিনা আমি জানতে চাই তিলক?
বনহুরের চোখ দুটো স্থির হলো বিজয়ার মুখে, কোনো জবাব দিলো না সে বিজয়ার প্রশ্নের।
বিজয়াও এরপর আর কিছু বললো না। সে নীরবে ওর মুখে খাবারগুলো তুলে দিতে লাগলো।
খাওয়া শেষ হলো বনহুরের।
এবার বিজয়া নিজের খাবারে হাত দিলো।
নির্জন ক্যাবিনে এমনি করে কতক্ষণ কাটবে ওদের! বনহুরের সান্নিধ্য বিজয়ার মন্দ লাগে না, কিন্তু দুঃখ হয় বনহুরের লৌহশিকলে আবদ্ধ হাত দুখানার দিকে তাকিয়ে।
বনহুরের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালো রেখা পড়ে গেছে। এমনভাবে বন্দী হয়ে থাকার জন নয় বনহুর। সে অস্থির হয়ে পড়ে একেবারে। কি করে এখান থেকে সে মুক্ত হবে, এ নিয়ে তার গভীর চিন্তা।
বিজয়া তেমন করে দুশ্চিন্তায় ভেঙ্গে পড়েনি, তিলক পাশে থাকলে সে সবকিছু মাথা পেতে গ্রহণ করতে পারে। তিলক যে ওর মনোবল, অনাবিক সুখ-শান্তি–তিলক যেন তার সবকিছু।
বিজয়া জানে, তিলককে সে পাবে না কোনোদিন তবু ওতে ভাল লাগে ওর। বিজয়া রাজকুমারী হয়েও শুধু তিলকের জন্য আজ এই কষ্ট-ব্যথা-বেদনাকে আনন্দে গ্রহণ করেছে। পিতার কাছে অনুমতি চেয়ে নিয়েছিলো সে করজোড়ে।
মহারাজ হীরন্ময় কন্যার আব্দার মেনে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি জানেন তিলকের আসল পরিচয়। শুধু পরিচয় নয়, সে কেমন তাও তিনি মনেপ্রাণে জানতেন। আর জানতেন বলেই তার সঙ্গে কন্যাকে ছেড়ে দেবার সৎসাহসী হয়েছিলেন। তবু বিজয়ার ধাত্রীমা এবং পুরোন দাসীটিকেও সঙ্গে দিয়েছিলেন। তারা সর্বক্ষণ বিজয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকতো।
আজ তারা কেউ নেই, তারা সেই জাহাজে যে জাহাজ থেকে তারা এই অজানা জাহাজখানায় পা বাড়িয়েছিলো। ঐ জাহাজে কয়েকজন বান্ধবীও ছিলো বিজয়ার কিন্তু সবাই রয়ে গেছে, আজ তার পাশে কেউ নেই একমাত্র তিলক ছাড়া।
বিজয়া তিলককে পাশে পেয়ে ভুলে গেছে সব বিপদের কথা। একান্ত নিবিড় করে পেয়েছে আজ সে ওকে, এমন করে সে ওকে কাছে পাবে কোনোদিন ভাবতে পারেনি। তিলকের প্রতি তার গভীর বিশ্বাস আছে।
দু’হাতে লৌহশিকল, মাজায় লৌহশিকল, বড় কষ্ট হচ্ছে তোমার, না? বললো বিজয়া।
একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো বনহুর-এসব আমার অভ্যাস আছে বিজয়া, কাজেই। কোনো কষ্ট হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে তোমার?
না আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না।
বিজয়া, রাত অনেক হয়েছে, এবার ঘুমাও। যদি অসুবিধা হয় আমার কোলে মাথা রেখে শুতে পারো।
রোজ তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো আর তুমি লৌহশিকের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে ঘুমাবে। একদিন তুমি আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাও তিলক।
না, তা হয় না।
কেন? কেন হয় না তিলক?
আমার তো কোনো অসুবিধা হয় না ঘুমাতে।
জানি। আমি সব জানি। তিলক, এসে আমার কোলে মাথা রেখে তুমি ঘুমাও, এসো……
বনহুর নীরব।
বিজয়া বনহুরের কাঁধে হাত রাখলো—শোও।
এবার বনহুর না করতে পারলো না। যদিও সে ভিতরে ভিতরে বেশ একটু অস্বস্তি বোধ করছিলো, বিশেষ করে বিজয়ার কোলে মাথা রেখে শোয়াটা তার মোটেই উচিত হচ্ছে না, তবু সে বাধ্য হয়েই চোখ বন্ধ করে রইলো।
বিজয়া ধীরে ধীরে বনহুরের চুলে আঙ্গুল চালিয়ে চললো।
একসময় বনহুর ঘুমিয়ে পড়লো।
বিজয়ার চোখে ঘুম নেই, সে বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নিস্পলক দৃষ্টি মেলে। কতোদিনের কো কথা ভেসে উঠে তার মনের আকাশে। তিলক যেদিন প্রথম এসেছিলো তাদের রাজপ্রাসাদে……তার পিতা যখন প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ওর সঙ্গে……প্রথম দৃষ্টি বিনিময়েই বিজয় আত্মসমর্পণ করেছিলো ওর কাছে। সেদিন বিজয়া জানতো না তিলককে পাওয়া এতো কষ্টকর। ভেবেছিলো ওকে সে সহজেই আপন করে নেবে। জয় করে নেবে ওর সমস্ত সত্তাকে….কিন্তু কদিন পরই বিজয়া বুঝতে পেরেছিলো তিলককে যতো সহজ মনে করেছিলো, সে ততো সহজ নয়। তিলকের পরিচয় বিজয়া জানতে পারলো যখন তখন সে তিলককে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছিলো। কিন্তু সে তখনো জানতো না ওকে সে পাবে না কোনোদিন…..
বিজয়ার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে।
বনহুর চোখ মেলে তাকায়–বিজয়া, তুমি কাঁদছো?
তাড়াতাড়ি চোখের পানি হাতের পিঠে মুছে নিয়ে বলে বিজয়া-কই, না তো?
বনহুর নিজের ললাট থেকে বিজয়ার চোখের গড়িয়ে পড়া পানি হাতের তালুতে মুখে তুলে ধরে–এই তো; তাছাড়া চোখ মুছলে কেন বলো? বুঝেছি তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব।
না।
এবার আমি বসি তুমি ঘুমাও বিজয়া।
ঘুম আমার পায়নি তিলক।
কতো রাত হয়েছে তবু ঘুম পায়নি?
না।
মিছে কথা বলছে বিজয়া।
সত্যি আমার ঘুম পায়নি।
বনহুর তবু বিজয়ার কোল থেকে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে, তারপর বলে– বিজয়া, একটা কথা বলবো কিছু মনে করবে না তো?
বলো?
জানি তুমি আমাকে ভালবাসো বিজয়া, আমিও তোমার ভালবাসাকে অভিনন্দন জানাই। তোমার পবিত্র ভালবাসার কথা আমি কোনোদিনই ভুলবো না।
বিজয়ার গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে অশ্রুধারা।
একসময় জাহাজখানা একটা দ্বীপে এসে পৌঁছে যায়।
জাহাজখানা দ্বীপে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা ঢাকের আওয়াজ কানে ভেসে এলো বনহুর আর বিজয়ার।
অল্পক্ষণেই সেই হিন্দরাণী এসে দাঁড়ালো, তার পিছনে বেশ কিছুসংখ্যক হিন্দ অনুচর। প্রত্যেকের হাতেই সূতীক্ষ্ণধার বল্লম আর বর্শা।
হিন্দরাণীর আদেশ অনুযায়ী তার অনুচরগণ বনহুরকে লৌহশিকলে মজবুত করে বেঁধে চারপাশ পরিবেষ্টিতভাবে নামিয়ে নিয়ে চললো। বিজয়াকেও সতর্ক দৃষ্টি রেখে জাহাজ থেকে নামানো হলো।
অবাক হয়ে দেখলো বনহুর আর বিজয়া, অসংখ্য হিন্দ দ্বীপবাসী জাহাজখানার পাশে দাঁড়িয়েছে।
হিন্দরাণী নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে অগণিত হিন্দবাসী মাথা নত করে অভিনন্দন জানালো।
হিন্দরাণী এক চক্ষু মেলে তাকালো তার হিন্দদ্বীপবাসী ভক্তগণের দিকে, তারপর হাত তুলে আশীর্বাদ জানানোর মতো ভঙ্গী করলো।
বনহুর আর বিজয়া অবাক হয়ে দেখতে লাগলো তাদের কার্যকলাপগুলো।
হিন্দ দ্বীপবাসী নারী-পুরুষ সবাই জংলীদের মতো অসভ্য। কারণ তাদের দেহে তেমন কোনো পোশাক-পরিচ্ছদ নেই। একখণ্ড কাপড় নেংটা আকারে পরা, গায়ের স্থানে স্থানে লোহা এবং তামার অলঙ্কার শোভা পাচ্ছে। মাথার চুলগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে কাটা।
বিজয়া আর বনহুর অবাক হলো হিন্দ দ্বীপের নারীগণকে দেখে। নারীগুলো প্রায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ বলা চলে। সামান্য গাছের ছাল দিয়ে শুধু লজ্জা নিবারণ করেছে। বুক এবং শরীর খোলা। মাথার চুলগুলো পুরুষদের মতো ছোট ছোট করে ছটা। প্রায় নারীরই একটি চোখ মুদিত এবং মুখে অসংখ্য দাগ। ঠোঁটগুলো কারো বা বাটির মতো মোটা, কারো বা থালার মত চ্যাপ্টা।
বিজয়া অবাক হয়ে গেছে একেবারে। বিশেষ করে হিন্দ রাণীর সঙ্গে এদের বেশ মিল রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিস্ময় জাগলো তাদের মনে, এ দ্বীপের নারীরা সবাই এক চক্ষুহীন।
কোনো কোনো নারীর ঠোঁটের মধ্যে বিরাট ফুটো বা ছেদ।
কারো কারো ঠোঁট ঝুলে বুকের উপর নেমে এসেছে। সেকি বীভৎস ভয়ঙ্কর চেহারা!
বনহুর আর বিজয়াসহ হিন্দরাণী রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছলো। সে প্রাসাদ ইট-বালি-চুন সিমেন্টে তৈরি নয়, গাছের মোটা মোটা গুঁড়ি দিয়ে তৈরি বিরাট জায়গা।
বনহুর আর বিজয়াকে একটা কাঠের ঘেরাও করা জায়গায় আটকে রাখা হলো।
একচক্ষু বিশিষ্ট হিন্দরাণী কড়া পাহারার ব্যবস্থা করে চলে গেলো রাজ-অন্তঃপুরে।
বিজয়া বললো-তিলক, এসব কি দেখছি?
বনহুর বললো-এরা হিন্দ দ্বীপবাসী। এরা জংলীদের চেয়েও বেশি অসভ্য। এদের পুরুষ এবং নারী অদ্ভুত ধরনের। যে নারীর দেহে যতো বেশি ক্ষতচিহ্ন থাকবে সে ততো বেশি সুন্দরী। এদের বিশেষ একটা জিনিস লক্ষ্য করার আছে, প্রায় নারীরই একটি চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমন কি হিন্দরাণীরও একটি চোখ তুলে নেওয়া হয়েছে।
কি সর্বনাশ!
তুমি এটাকে সর্বনাশ বলছে বিজয়া, কিন্তু এটা ওদের আনন্দের কথা। ওরা সুন্দরী হবার জন্য যে কোনো কষ্টকে মাথা পেতে গ্রহণ করতে পারে।
কি ভয়ঙ্কর নৃশংস কথা!
ঐ দেখছো না ওদের মুখে অসংখ্য ফুটে ছিদ্রের মত দাগ, ওগুলো ওরা মুখে ইচ্ছে করে তৈরি করে নিয়েছে। আর ওদের ঠোঁটে যে বড় ছিদ্র দেখছে ওগুলো তৈরি করতে এসব মেয়ের আরো কষ্ট করতে হয়।
অবাক হয়ে বললো বিজয়া-তার মানে?
মানে যখন ওরা ছোট বা শিশু থাকে তখন ওদের ঠোঁটে অগ্নিদগ্ধ সরু লৌহশলাকা দিয়ে ক্ষুদ্র ফুটে বা ছিদ্র করে তার মধ্যে কাঠি প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।
তারপর?
তারপর কয়েক মাস পরে সেই কাঠি বের করে পুনরায় ওর চেয়ে একটু মোটা কাঠি সেই ফুটোর মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এমনি করে মাসের পর মাস ওরা ঠোঁটের ছিদ্রপথে একটু করে মোটা কাঠি প্রবেশ করাতে থাকে।
সত্যি বলছো তিলক?
হাঁ, তার প্রমাণ দেখতেই পাচ্ছো। পরিশেষে, এইসব নারীর নিচের ঠোঁট ঝুলে বুকের নিচে নেমে আসে এবং তারাই হয় এদের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী।
এতো দুঃখেও হাসি পায় বিজয়ার।
বন আর বিজয়াকে ওরা কাঠের প্রাচীরঘেরা বন্দীশালায় বন্দী করে রাখলো। ফলমূল খেতে দিলো ওরা, কিন্তু বনহুরের হাত এবং মাজার লৌহশিকল মুক্ত করে দিলো না।
বিজয়ার মনে ভীষণ ব্যথা জাগলো, বিশেষ করে বনহুরকে বন্ধন অবস্থায় দেখতে মন তার চায় না। বনহুরকে সে নিজ হাতে তুলে খাওয়ায়, নিজের হাতে ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়, বনহুর যখন ঘুমায় তখন ওর মাথাটা বিজয়া তুলে নেয় নিজের কোলে।
এক বন্দীশালায় ওরা দু’জনা।
বনহুর সব সময় নিজেকে কঠিনভাবে সংযত করে রাখে। বিজয়ার প্রেম-ভালবাসা তাকে আকৃষ্ট করলেও সে মনকে শক্ত করে ফিরিয়ে রাখে বিপরীত মুখে। বনহুর বুঝে, বিজয়া তাকে পাবার জন্য উন্মুখ, কিন্তু সে চায় না একটা নারীর জীবন বিনষ্ট করতে।
বিজয়া অবলা অবুঝ নারী, ওর জন্য মায়া হয় কিন্তু কি করবে, সে পারে না ওকে সান্ত্বনা দিতে। তবু সে বিজয়ার কাজে বাধা দেয় না! বিজয়া ওর মুখে খাবার তুলে দিয়ে আনন্দ পায়, ওর চুলে হাত বুলিয়ে খুশি হয়, ওর মাথাটা কোলে রেখে তৃপ্তি লাভ করে–এসবে বনহুর নিজকে ছেড়ে দিয়েছে বিজয়ার হাতে।
একদিন বনহুর কাঠের খুঁটিতে ঠেশ দিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। হঠাৎ বুকে কারো নিশ্বাস অনুভব করলো সে, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো বিজয়া তার বুকে মাথা রেখে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। বনহুর বিজয়াকে না জাগিয়ে নিশ্চুপ রইলো, একটা অনুভূতি তার ধমনীর রক্তকে উষ্ণ করে তুললো। হাত দু’খানা তুলে বিজয়াকে গভীর আবেগে আকর্ষণ করতে গেলো, কিন্তু হাত দু’খানা তার মুক্ত না থাকায় ব্যর্থ হলো সে। বনহুর তখনই বুঝতে পারলো তার হাত দু’খানা বন্ধন অবস্থায় থাকায় খোদার ইংগিত ছিলো নইলে সে হয়তো নিজকে সংযত রাখতে পারতো না।
পরদিন হিন্দরাণী এসে দাঁড়ালো বন্দীশালার পাশে। তার পাশে কয়েকজন অদ্ভুত ধরনের মানুষ। এরা আকারে অত্যন্ত বেঁটে, কিন্তু ভীষণ মোটা ও বলিষ্ঠ। এক একজন যেন এক একটা ক্ষুদ্র গরিলা।
বিজয়া শিউরে উঠলো, ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল।
বনহুর বুঝতে পারলো, এরা এবার তাদের বিচারে এসেছে। প্রস্তুত হয়ে নিলো বনহুর কঠিন কোনো অবস্থার জন্য। বিজয়ার মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার অবস্থা অনুভব করলো। দুঃখ হলো ওর জন্য, কারণ বিজয়া রাজকুমারী, সে কোনোদিন এমন অবস্থায় পড়েনি, এমন কষ্টও সে কোনোদিন পায়নি। বনহুর বিজয়ার চোখে চোখ রেখে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো।
ততোক্ষণে কয়েকজন বেঁটে লোক বন্দীখানার ভিতরে প্রবেশ করলো, হিন্দরাণীর নির্দেশে বনহুরকে তারা টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চললো।
বিজয়া আর্তনাদ করে উঠলো-তিলক!
বনহুর বললো–বিজয়া, আমার জন্য ভেবো না….
বিজয়া তবু আর্তনাদ করে চললো–তিলক,…..তিলক, আমি একা কি করে থাকবো, তিলক……।
বনহুরকে বন্দীশালা থেকে বের করে ওরা একটা গাছের নিচে নিয়ে এলো, তারপর গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধলো মজবুত করে।
বনহুরের হাত দু’খানা বাঁধা থাকায় এবং মাজায় লৌহশিকল আবদ্ধ থাকায় সে ওদের কোনোরকম বাধা দিতে পারলো না। ওরা কঠিনভাবে বনহুরকে বেঁধে ফেললো গাছটির সঙ্গে। বিজয়া তখন বন্দীশালায় মাথা ঠুকে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
বিজয়ার হাত-পা মুক্ত করেই সে ফাঁক খুঁজতে লাগলো কি করে বন্দীশালা থেকে পালানো যায়।
কাঠের ফাঁকগুলো সে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো কোনোক্রমে বের হওয়া যায় কিনা। বের হতে পারলে সে চেষ্টা নেবে তিলককে রক্ষা করতে পারে কিনা।
এখানে বিজয়া যখন কাঠের গুঁড়ির ফাঁকে পালানোর পথ খুঁজছে তখন বনহুরকে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে তাকে তীরবিদ্ধ করে হত্যার চেষ্টা চলছে।
হিন্দরাণী একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক চোখেই তীব্র প্রতিহিংসার বহ্নিশিখা যেন জ্বলছে।
তিনজন ক্ষুদ্রাকার বেঁটে মানুষ তীর হাতে দূরে একটু উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। হিন্দরাণীর নির্দেশ পেলেই তারা তীর নিক্ষেপ করবে।
সব প্রস্তুত।
হিন্দরাণী বললো–দেখো বিদেশী, তোমার দুঃসাহসের জন্য তোমাকে হত্যা করা হচ্ছে! তুমি আমার চলার পথে বাধার সৃষ্টি করেছিলে।
হঠাৎ বিজয়া ছুটে আসে, বনহুরকে পিছনে রেখে তীব্র কণ্ঠে বলে উঠে-ওর কোনো দোষ নেই! ওকে আমি জোর করে তোমার জাহাজে নিয়ে গিয়েছিলাম। হত্যা করতে হয় আমাকে করো!
এমন সময় একজন পুরুষ এগিয়ে এলো, সে হিন্দরাণীর মত স্পষ্ট বাংলায় বললো–ওকে হত্যা করো না, ওর স্বামীকে হত্যা করো। আমি ওকে বিয়ে করবো হিন্দ্রাণী!
হিন্দরাণী বললো-বেশ, গুরুদেবের আশাই পূর্ণ হোক। ওকে সরিয়ে নাও।
বনহুর অধর দংশন করলো।
বিজয়া বললো-না, ওকে হত্যা করতে পারবে না তোমরা।
বিজয়ার কথা অন্য কেউ হয়তো বুঝতে পারলো না। শুধুমাত্র বুঝলো হিন্দরাণী, তার গুরুদেব ও আর দুচারজন।
এরা সবাই বাংলা ভাষা বুঝে না এবং বলতেও পারে না।
বনহুর এবং বিজয়া প্রথম দিনই জাহাজে হিন্দরাণীর বিকৃত চেহারা ও তার হাবভাব দেখে ভেবেছিলো এ বাংলা জানে না, কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই তার সে ভুল ভেঙ্গে গিয়েছিলো।
আজও বনহুর আর বিজয়া অবাক না হয়ে পারেনি কারণ এরা কি করে বাংলা শিখলো? এদের ভাষা খাঁটি হিন্দ-ভাষা, কতকটা জংলীদের মত বিদঘুঁটে ধরনের।
বিজয়ার কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো হিন্দরাণী ও তাদের গুরুদেব।
গুরুদেবের চেহারা বড় কুৎসিত কদাকার। ছোটখাটো গরিলা বলা চলে। মাথাটা সম্পূর্ণ নেড়ে, মস্তবড় পেঁপের মতো দেহের উপর একটা খুদে হাড়ির মতো মাথাটা খাড়া রয়েছে।
বিজয়ার কথায় গুরুদেব বলে উঠলো–বেশ, ওকে হত্যা করা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে যদি মেয়েটা আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়।
বিজয়া উপায়হীনভাবে বলে উঠলো–হ, আমি রাজি আছি।
হিন্দরাণী হাত তুলে তীরধারীদের লক্ষ্য করে একটা অদ্ভুত উক্তি উচ্চারণ করলো, সঙ্গে সঙ্গে নেমে দাঁড়ালো তীরধারী লোকগুলো।
বনহুর বললো-বিজয়া, তুমি একি করলে?
তিলক, তোমার মৃত্যুর চেয়ে ওকে স্বামীরূপে গ্রহণ করা আমার পক্ষে শ্রেয়। তিলক…..ছুটে গিয়ে বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বিজয়া।
বনহুরের হাত-পা বাধা, কাজেই সে নীরব থাকা ছাড়া আর কোনো কিছুই করতে পারে না। বিজয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলে।
হিন্দরাণীর আদেশে বনহুরকে গাছের গুঁড়ি থেকে মুক্ত করা হলো, কিন্তু হিন্দরাণী অত্যন্ত চালাক নারী, সে তার হাত এবং মাজার বন্ধন মুক্ত করে দেবার আদেশ দিলো না।
বনহুরকে পুনরায় সেই কাঠের বন্দীশালায় বন্দী করে রাখা হলো।
কিন্তু বিজয়াকে সেখানে আসতে দেওয়া হলো না। তাকে বাইরে একটা কুটিরের মধ্যে আটকে রাখলো।
বিজয়া কুটিরের মধ্যে ছটফট করতে লাগলো। এতোদিন তার বন্দী অবস্থা কষ্টকর হলেও তিলকের সান্নিধ্য তার সব ব্যথা, সব কষ্টকে মুছে দিয়েছিলো, ভুলে ছিলো বিজয়া সব কিছু। এমন কি পিতামাতার স্নেহও তাকে আকর্ষণ করেনি। বিজয়া বনহুরের পাশে যাবার জন্য বন্দী হরিণীর মতো অস্থির হয়ে উঠলো। কুটিরের মধ্যে বসে ভাবতে লাগলো তিলকের কথা। তার হাত দুখানা বাধা আছে–নিশ্চয়ই সে খেতে পারছে না, কতো কষ্ট হচ্ছে তার!
বিজয়ার চিন্তা বৃথা নয়, বনহুরকে ওরা যা খেতে দিয়েছে অমনি পড়ে আছে সেগুলো। সিদ্ধ জিনিসগুলো অখাদ্য বলা চলে, ওগুলো বনহুর বা বিজয়া মুখে দিতে পারে না। ফলমূল যা তাই ওরা খায়।
যে বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য কান্দাই পুলিশবাহিনী হিমসিম খেয়ে গেছে, যাকে পাকড়াও করার জন্য বিশ্ব পুলিশবাহিনী হন্তদন্ত হয়ে পড়েছে, যাকে বন্দী কারার জন্য আমেরিকার শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা মিঃ লাউলং বিফল হয়েছেন, যাকে ধরার জন্য মিঃ জাফরী হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, যার গ্রেপ্তারের জন্য কান্দাই পুলিশ লাখ টাকা ঘোষণা করেছে, সেই দস্যু বনহুর আজ এক জংলী রাণীর হস্তে বন্দী। নিরীহ বেচারী মতো শান্ত লাগছে বনহুরকে।
একদিন দু’দিন করে কয়েকটা দিন কেটে যায়।
বিজয়া কোনো ফাঁক খোঁজে কেমন করে বের হবে সে, যাবে সে বনহুরের পাশে।
সুযোগ এলো।
বিজয়াকে যখন খাবার দেয়ার জন্য একটি জংলী মেয়ে সেই কুটিরে প্রবেশ করেছে তখন বিজয়া একটা লাঠি দিয়ে তার মাথায় ভীষণ জোরে আঘাত করে, সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় সেই জংলী মেয়েটি।
বিজয়া সেই ফাঁকে বেরিয়ে যায় কুটিরের মধ্য হতে, ছুটতে থাকে সেই কাঠের তৈরি বন্দীশালার দিকে। অল্পক্ষণেই বন্দীশালায় প্রবেশ করে বিজয়া। সে জানতো, কাঠের বেড়ার এক স্থানে ফাঁক আছে যে ফাঁকে সে একদিন বের হয়েছিলো।
বিজয়া বন্দীশালায় প্রবেশ করে ছুটে যায় বনহুরের পাশে, ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে–তিলক।
বনহুর বসেছিলো, বিস্মিত দৃষ্টি মেলে উঠে দাঁড়ায়।
বিজয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে বনহুরের বুকে তিলক, আমি এসেছি।
বনহুর ভুলে যায় বিজয়া তার কেউ নয়, ভুলে যায় বিজয়ার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। গভীর আবেগে বনহুর বিজয়াকে আলিঙ্গন করতে যায় কিন্তু হাত দু’খানা বন্ধন অবস্থায় থাকায় সে ওকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিতে পারলো না।
হচ্ছে তোমার?
খেতে খেতে বলে বনহুর–আমার চেয়ে বেশি কষ্ট তোমার হচ্ছে বিজয়া।
না, তুমি বেশি কষ্ট পাচ্ছো। বিজয়া বনহুরের বুকে মাথা রাখে।
বনহুর পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কে যেন ওর কানে কানে বলে……বনহুর, তুমি দিন দিন বিজয়ার ভালবাসায় গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছো……..
বনহুর আপন মনেই বলে উঠে না না, মোটেই না..
বিজয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে-কি হলো তিলক?
না, কিছু না।
তুমি যে বললে–না না, মোটেই না?
ও কিছু না, হঠাৎ কি যেন মনে পড়েছিলো।
জানি তুমি তোমার প্রিয়া সেই নূরীর জন্য..
হাঁ বিজয়া, ওর কথা মনে হলে আমি সব কিছু বিস্মৃত হই।
বিজয়ার মুখখানা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে, সরে দাঁড়ায় বনহুরের পাশ থেকে একটু দূরে! বনহুর বিজয়ার মুখোভাব লক্ষ্য করে ব্যথা পায়। দুঃখ হয় বিজয়ার জন্য, বিজয়া তাকে কতোখানি ভালবেসে ফেলেছে, সে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে।
বনহুর বসে পড়ে বলে–বসো বিজয়া।
বিজয়া বসে।
বনহুর বলে–বিজয়া তুমি রাজকুমারী হয়েও আজ আমার জন্য যা করছো সত্যি অপূর্ব। বিজয়া, তোমার ভালবাসার প্রতিদানে আমি কিছুই দিতে পারিনি তোমাকে……তবু তুমি আমার জন্য এতো করছো; আমারই জন্য আজ তোমার এ অবস্থা।
বিজয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, তার গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রু। বিজয়া ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকায় বনহুরের মুখমণ্ডলের দিকে, কোনো কথা সে বলতে পারে না।
বনহুর বলে আবার–বিজয়া আমার মৃত্যুই কি শ্রেয় ছিলো না? বলল, তুমি কেন ঐ গুরুদেবকে বিয়ে করতে রাজি হলে?
এবার বলে বিজয়া–বিয়ে করবো কিন্তু আরও একটা শর্তে!
তার মানে?
তোমাকে যদি মুক্তি দেয় তাহলে আমি ঐ অসভ্য কুৎসিত লোকটাকে বিয়ে করবো, নচেৎ নয়।
তুমি যে কথা দিয়েছো?
আমি তা স্বীকার করি না তিলক। ওরা তোমাকে মুক্তি না দিলে আমি কিছুতেই ঐ বিদঘুঁটে লোকটাকে স্বামী বলে গ্রহণ করবো না।
বিজয়া! বনহুর লুট কণ্ঠে উচ্চারণ করে।
ঠিক সেই মুহূর্তে হিন্দরাণী ও সেই গুরুদেব এবং কয়েকজন বল্লম ও বর্শাধারী বেঁটে লোক বন্দীশালায় প্রবেশ করে।
হিন্দরাণী বলে উঠে–ঐ দেখো মেয়েটি এখানে।
গুরুদেবের কুৎসিত মুখে বিদঘুঁটে হাসি ফুটে উঠে। ওরা ভেবেছিলো মেয়েটি তাদের কুটির থেকে কোথাও পালিয়ে গেছে। অনেক জায়গা খোঁজা খুঁজি করে তবেই ওরা বন্দীশালায় এসেছে।
হিন্দরাণী তার অনুচরদের আদেশ দিলো মেয়েটিকে ধরে বের করে নিয়ে যেতে।
সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করলো ওরা।
বিজয়াকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চললো।
বনহুর রাগে অধর দংশন করতে লাগলো কিন্তু কোনো উপায় পেলো না বিজয়াকে ওদের কবল থেকে উদ্ধার করতে।
বিজয়াকে ধরে নিয়ে গেলো ওরা।
বনহুরের কানে তখনও ভেসে আসছে বিজয়ার করুণ কণ্ঠস্বর……তিলক,…..আমাকে বাঁচাও…তিলক……তিলক…
হঠাৎ নুরীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো, তার কানে গেলো কারো কণ্ঠস্বর। নূরী পাশে তাকিয়ে দেখলো বিছানা শূন্য, চম্পা নেই। এবার নূরী শয্যা ত্যাগ করে বেড়ার পাশে এসে দাঁড়ালো, সে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো। তার কানে ভেসে এলো চম্পার ক্রুদ্ধ এবং উদ্বিগ্ন গলার আওয়াজ……হিন্দ রাণী হস্তে তারা বন্দী হয়েছে, বলো কি?
পুরুষ কন্ঠ……হ।
চম্পার গলা……..আজ রাতেই আমি রওনা দেবো। তুমি স্টিমারের চালকদের প্রস্তুত হতে বলো।
পুরুষের গলার স্বর……আপনার আদেশ ঠিক মতোই পালন হবে।
যাও বিলম্ব করো না। চম্পা কথা শেষ করলো বলে মনে হলো।
নূরী তাড়াতাড়ি এসে শয্যায় শুয়ে পড়লো। সে বুঝতে পারলো, চম্পার বিশেষ কেউ হিন্দরাণী হস্তে বন্দী হয়েছে। কারণ তার কথাবার্তায় একটা দারুণ উকুণ্ঠার ভাব ফুটে উঠছিলো, তাছাড়া এই রাতেই সে হিন্দদ্বীপ অভিমুখে রওনা দিচ্ছে। নিশ্চয়ই তার পরম আপন জন হবে। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করলো।
চম্পা পাশের একটা খুপড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলো।
নূরী চুপ চাপ শুয়ে সব দেখতে লাগলো।
চম্পা যখন বেরিয়ে এলো সেই খুপড়ীর মধ্য হতে তখন তাকে অদ্ভুত ড্রেসে সজ্জিত দেখলো নূরী। চম্পা তার কাছে জংলী মেয়ের ড্রেসে থাকলেও আসলে সে জংলী নয় তা বুঝতে পেরেছে। সে এ কদিনেই।
ঠিক সেই মুহূর্তে নূরী শয্যা ত্যাগ করে তার পাশে এসে দাঁড়ালো।
চমকে উঠলো চম্পা, সে ভেবেছিলো নূরীকে কিছু না বলে সে বেরিয়ে যাবে, ফিরে এসে সব বলবে কোথায় এবং কেন গিয়েছিলো সে। নূরীকে দেখে বলে উঠলো-হঠাৎ ডাক পড়েছে তাই এক জায়গায় যাচ্ছি। তুমি দুটো দিন সাবধানে থাকবে কিন্তু।
নূরী চোখ রগড়ে বললো–আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।
অসম্ভব।
কেন?
নূরী আমি যেখানে যাচ্ছি সে স্থানে নিরাপদ নয়।
তবে তুমি যাচ্ছো কেন?
আমি কেন যাচ্ছি পরে বলবো।
না, তোমাকে বলতে হবে চম্পা দিদি!
সময় নেই নূরী, পরে সব জানতে পারবে।
আমি জানি, তুমি কোনো বন্দীকে উদ্ধার করতে যাচ্ছে।
হা।
কিন্তু কে সে, বলতে হবে।
এখন এই মুহূর্তে সে কথা বলা সম্ভব নয় নূরী।
তোমার কোনো আত্নীয় হবে নিশ্চয়ই।
হাঁ, আমার পরম আত্নীয়, আমার পরম আপনজন কিন্তু থামলে কেন বলো চম্পা?
না, থাক আজ নয়। নূরী তুমি সাবধানে থাকবে। আমার লোকজন আছে তারা তোমাকে সব সময় দেখাশোনা করবে। আচ্ছা চলি……দোয়া করো বোন, আমি যেন তাকে উদ্ধার করতে পারি।
নূরী দেখলো চম্পার চোখ দুটো অশ্রুছলছল হয়ে এসেছে, গলার স্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এসেছে। বললো নূরী-খোদা তোমাকে জয়ী করুন।
চম্পা ততক্ষণে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়েছে।
নূরী আর তাকে দেখতে পায় না।
ফিরে আসে নূরী তার কুটিরের মধ্যে, আজ সে নিজকে বড় একা অসহায় মনে করে। চম্পা তাকে ধোঁকা দিচ্ছে না তো! সে বলেছে তার হুরকে খুঁজে এনে দেবে—কই, কতোদিন চলে গেলো কোথায় তার হুর। সে যে ওর জন্য পাগল হয়ে যাবে। আর কতোদিন সে চম্পার কথায় ভরসা নিয়ে থাকবে। জাভেদ শিশু, তাকে ছেড়ে কতোদিন কেটে গেলো; না জানি সে কেমন আছে। নূরীর গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা।
নূরী যখন নির্জন কুটির মধ্যে নানারকম ভাবনার জাল বুনে চলেছে তখন চম্পা তার অশ্ব নিয়ে স্টিমারের দিকে ছুটে চলেছে।
অদূরে নীলনদের একটি শাখা।
এখানে অপেক্ষা করছে চম্পার ষ্টিমার।
স্টিমারে বেশি নয় মাত্র কয়েকজন খালাসি এবং চালক মাত্র। একজন ক্যাপ্টেন বা নেতা ধরনের লোক আছে, তার নাম হুসাইন।
চম্পার অশ্বের পদশব্দ শুনে হুসাইন স্টিমার থেকে সিঁড়ি নামিয়ে দিলো নিচে এবং আলো ফেললো সিঁড়ির মুখে।
চম্পা অশ্ব ত্যাগ করে স্টিমারের পাশে এসে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে আলোর ছটা ইংগিপূর্ণভাবে একবার চম্পার চার পাশে চক্রাকারে ঘুরে নিলো।
চম্পা বুঝতে পারলো সব প্রস্তুত আছে। সে এবার সিঁড়ি বেয়ে স্টিমারে উঠে গেলো।
চম্পার সঙ্গে আরও দু’জন জংলী লোক এসেছিলো, তারাও অশ্ব ত্যাগ করে স্টিমারে উঠে পড়েলো।
চম্পা বললো–হুসাইন, সব ঠিক আছেতো?
আছে। এবার স্টিমার ছাড়ার নির্দেশ দেবো?
হা দাও। স্পীড়ে স্টিমার চালাতে বললো।
স্টিমার অন্ধকারে নীলনদের বুক চিরে তীরবেগে অগ্রসর হলো।
চম্পা ডেকে রেলিংএ ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঙ্গুলের ফাঁকে তার ধূমায়িত সিগারেট। দৃষ্টি তার সম্মুখে সীমাবদ্ধ। শরীরে তার তীরন্দাজের পোশাক। চম্পাকে বড় সুন্দর লাগছে। মাথার একরাশ কোঁকড়ানো চুল বাতাসে উড়ছে। একটা হিমেল হাওয়া বইছে। ভোর হবার এখনো অনেক দেরী।
মাঝে মাঝে চম্পা সিগারেট থেকে ধুম্র নির্গত করছিলো।
এমন সময় অন্ধকারে পাশে এসে দাঁড়ায় হুসাইন।
চম্পা বলে–কে?
আমি!
হুসাইন?
হ।
তুমি এখানে কেন?
একটু হাসে হুসাইন।
চম্পা সোজা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ হুসাইনের হাসিটা তার কাছে কেমন রহস্যময় বলে মনে হয়।
হুসাইন তার প্রধান অনুচর হিসেবেই তার পাশে স্থান পেয়েছে। বয়স ওর খুব বেশি নয় যুবক মাত্র। তবে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত এবং শক্তিশালী, সেই জন্যই সে তাকে নিজের অনুচরদের প্রধান হিসেবে স্থান দিয়েছে। হুসাইনকে বিশ্বাসী বলেও জানতো সে। আজ হুসাইনকে হঠাৎ তার পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে এবং অদ্ভুতভাবে হাসতে দেখে চম্পা অবাক না হয়ে পারলো না। বললো চম্পা-নতুন কোনো সংবাদ আছে?
হুসাইন শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আছে।
বলো? চম্পা সিগারেটটা দূরে নিক্ষেপ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নীলনদের হিমেল হাওয়ায় তার শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে। যদিও অন্ধকারে হুসাইনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না তবু চম্পা তীক্ষ্ম দৃষ্টি হুসাইনের মুখখানাকে দেখার চেষ্টা করলো।
হুসাইন বললো–আর কতোদিন তুমি আলেয়ার আলোর পিছনে ছুটবে রাণী?
চম্পার শরীরে কেউ যেন কশাঘাত করলো। বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে দাঁড়ালো চম্পা, কঠিন কণ্ঠে বললো–তুমি কি বলছো হুসাইন?
ও, রাণী তাহলে বুঝতে পারেননি?
আমি তোমার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা কিছুমাত্র বুঝতে পারছি না।
আমি বলছি অযথা একজনের পিছনে ধাওয়া করে কোনো…
তার মানে?
মানে সবইতো জানো রাণী।
হুসাইন!
আমি আপনার অনুচর বলে কিন্তু……
বলো থামলে কেন?
হুসাইন চম্পাকে কথার মাঝে কখনো ‘আপনি কখনো তুমি, বলে সম্বোধন করে চলেছিলো। রাগে চম্পার মুখখানা কঠিন হয়ে উঠেছে। হুসাইনের এতো সাহস সে তার কাছে এসে তার কাজে প্রতিবাদ জানায়। দাঁতে দাঁত পিষে চম্পা।
হুসাইন বলে–যাকে কোনোদিন পাবে না, কেন তার পিছনে এতো কষ্ট করছো বলোতো? ওকে মরতে দাও।
হুসাইন, মুখ সংযত করে কথা বলো।
ও মরলে তুমি শান্তি পাবে রাণী।
ও মরার আগে তোমাকে মরতে হবে……
রাণী মিছেমিছি এতো করছো যে তোমাকে ভালবাসে তাকে তুমি কেন অবহেলা কর? আর যে তোমাকে ভালবাসে না, যে তোমার আসল পরিচয় জানে না—জানে না তুমি কে। দেখেনি আর দেখলেও তোমাকে সে চেনে না, তুমি তার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত কেন-কেন তুমি নিজকে তার জন্য বিপন্ন করছে রাণী…….
খিল খিল করে হেসে উঠে চম্পা, তারপর দাঁত পিষে বলে-হুঁসাইন, তুমি একজন নরাধম! নাহলে তুমি আমার সঙ্গে এসব নিয়ে আলাপ করতে আসতে না। তবে তোমার যখন এত বাসনা তখন বলো আর কি বলবার আছে তোমার?
রাণী, তুমি যা খুশি তাই বলো। আমি নরাধম, নরপিশাচ যা খুশি বলল। তবু আমি তোমাকে বলবো, আজ বলবো সব কথা। রাণী, আমি তোমাকে ভালবাসি…..
বলো আর কি বলবার আছে তোমার?
ওকে ভুলে যাও, এসো আমরা দু’জনা এক হয়ে যাই।
চমৎকার!
রাণী যেদিন আমি তোমার প্রধান অনুচর হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছি, সেদিন আমার মনে তোমার ছবি গভীরভাবে দাগ কেটেছে।
সুন্দর কথা!
তুমি আমাকে……
হুসাইন, সাবধানে কথা বলো, জানো আমি কে?
জানি! আর জানি বলেই আমি তোমার বিনা অনুমতিতে আজো তোমায় স্পর্শ করিনি।
কি বললে হুসাইন?
তোমাকে ভালবাসি তবু শ্রদ্ধা করি, নইলে তুমি নারী–এই গভীর রাতে নির্জন ডেকে তুমি আমার কবল থেকে রেহাই পেতে না রাণী,
বটে? এতো বড় স্পর্ধা তোমার মনে বাসা বেঁধে আছে। হাঃ হাঃ হাঃ……হাঃ হাঃ হাঃ……হঠাৎ চম্পার হাতখানা তার প্যান্টের পকেট থেকে বেরিয়ে আসে, সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলীর আওয়াজ হয়।
ডেকের উপর লুটিয়ে পড়ে হুসাইনের রক্তাক্ত দেহ।
তৎক্ষণাৎ চারদিক থেকে ছুটে আসে অন্যান্য অনুচরগণ।
তারা ডেকে এসে দাঁড়াতেই চম্পা আঙ্গুল দিয়ে হুসাইনের রক্তাক্ত দেহ দেখিয়ে বললো-ওকে নীলনদে ফেলে দাও!
অনুচরগণ কেউ কোনো কথা বলার সাহসী হলো না। তারা একটু টু শব্দ পর্যন্ত করলো না।
হুসাইনের দেহটা তখন নীরব হয়ে গেছে।
লোকগুলো এবার হুসাইনের প্রাণহীন দেহটা তুলে নিয়ে নীলনদের জলে নিক্ষেপ করলো।
রাতের অন্ধকারে তলিয়ে গেলো হুসাইনের দেহটা অতল গহ্বরে।
বিজয়াকে নব বধুবেশে সজ্জিত করে সাজিয়ে একটা উঁচু মঞ্চের উপর বসানো হয়েছে। ফুল আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে তার সমস্ত দেহটা। মাথায় ফুলের মুকুট, গলায় ফুলের মালা, হাতে ফুলের বালা।
পাশে বরের বেশে টোপর মাথায় হিন্দ গুরুদেব। তার শরীরেও ফুলের পোশাক তবু তাকে বড় বিদঘুঁটে লাগছে। বিপুল দেহের উপর বেলের মত ছোট একটা মাথা। ক্ষুদে চোখ দুটো দিয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছে সে বিজয়ার মুখের দিকে।
সম্মুখে অগ্নিকুণ্ড দপ দপ করে জ্বলছে।
অগ্নি এবং শীলা সাক্ষী করে বিয়ে হবে তাদের।
বিজয়া কেঁদে কেঁদে রাঙা হয়ে উঠেছে।
আজ কদিন সে কিছু মুখে দেয়নি। যেদিন তাকে বনহুরের পাশ থেকে জোর করে ধরে এনে কুঠির মধ্যে বন্দী করে রেখেছিলো। অবিরত শুধু কেঁদেছে বিজয়া তবু হিন্দরাণীর মায়া হয়নি।
মঞ্চের চারপাশে অদ্ভুত ধরনের বাজনা বেজে চলেছে।
ঢোল-সানাই সব আছে তার মধ্যে।
কতকগুলো অসভ্য নারী ধেই ধেই করে নেচে চলেছে। তাদের নাচ দেখলে মনে ভীতির সঞ্চার হয়। সে-কি ভীষণ বিদঘুঁটে এক একজনের চেহারা। মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল, নিচের ঠোঁটগুলো থালার মত ঝুলে নেমেছে গলার নিচে। কারো কারো ঠোঁটে সবেমাত্র ছিদ্র করা হয়েছে। ঠোঁটগুলো যেন এক একটা কলার মত ফুটে উঠেছে। এতো যন্ত্রণা সহ্য করেও ওরা নেচে যাচ্ছে।
সে-কি এক মহা উৎসব শুরু হয়েছে।
ঢাক-ঢোল আর সানাই বাজনার শব্দ আর জংলী অসভ্য নারীদের বিদঘুঁটে চিৎকার সমস্ত বনভূমি প্রকম্পিত করে তুলেছে।
পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করে চলেছে।
ওদিকে তখন বনহুর কাঠের বন্দীশালায় অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। বারবার সে অধর দংশন করছে, আর কিছু বিলম্ব হলেই বিজয়ার বিয়ে হয়ে যাবে সেই ভয়ঙ্কর জংলী গুরুদেবটার সঙ্গে। বিজয়ার জীবনটা বিনষ্ট হয়ে যাবে। না না, তা হয় না, বিজয়ার জীবন এভাবে নষ্ট হতে দেবে না সে। বনহুর হাতের লৌহশিকলে কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে ভীষণভাবে আঘাত করে। হাত কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে তবু লৌহ শিকল মুক্ত হয় না।
ওদিকে তার কানে ভেসে আসছে সানাইয়ের করুণ সুর।
বিজয়ার কান্নার মতোই শোনাচ্ছে সে সুর বনহুরের কানে।
রাত গভীর।
চারিদিকে জমাট অন্ধকার।
দূরে মঞ্চের চারপাশে দপ দপ্ করে মশাল জ্বলছে।
হঠাৎ কেমন যেন এলোমেলো হাওয়া বইতে শুরু করলো। বনহুর তাকালো আকাশের দিকে। ঘন বনের ফাঁকে আকাশ যতটুকু দেখা গেলো জমাট মেঘে ভরে উঠেছে।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
ঝড়ের পূর্বলক্ষণ।
ওদিকে ঢাকের আওয়াজ আরো জোরে জোরে বেজে চলেছে।
মাঝে মাঝে পুরোহিতের কণ্ঠের অদ্ভুত শব্দ ভেবে আসছে। বনহুরের অস্থিরতা বাড়ছে ক্রমান্বয়ে! সে বারবার হাতের বন্ধন মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
ঝড়ো হাওয়ার বেগ বেড়ে এলো।
গাছপালা দুলতে শুরু করেছে।
মশালের আলো বন্দীশালা অবধি এসে না পৌঁছলেও বনহুর মশালের আলোর তীব্ৰছটা বেশ দেখতে পাচ্ছিলো। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছিলো সেদিকে, কারণ ওখানেই সেই বিবাহ মঞ্চ। যেখানে বসে আছে বিজয়া বধু বেশে আর সেই পুরোহিত ঠাকুর।
বনহুর বারবার চেষ্টা করেও লৌহবন্ধন মুক্ত করতে পারছে না, সে এবার প্রাণপনে হাত দু’খানাকে টেনে শিকল ছিঁড়তে গেলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকারে নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলো বনহুর। কে যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বললো–এসো তোমার হাতের বন্ধন আমি মুক্ত করে দেই।
বনহুর বিস্ময় নিয়ে অন্ধকারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, শুধু একটা ছায়ার মতো কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো, হাত দু’খানা নিচু করলো সে যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো।
নারীমূর্তি এক ঝোপা চাবি নিয়ে পরীক্ষা করে চললো। দ্রুতহস্তে কাজ করে চলেছে সে, যদিও চোখে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিলো না তবু তার চেষ্টা অত্যন্ত ক্ষীপ্র গতিতে চলছে।
বনহুরের মনে বিস্ময় কে এই নারী! এ বিজয়া নয়, বিজয়ার কণ্ঠ তার অতি পরিচিত। হিন্দরাণীর গলার স্বরও নয় এটা। এই অজানা-অচেনা দ্বীপে হিন্দরাণীর বন্দীশালায় কে এসেছে তাকে উদ্ধার করতে। বনহুর যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। নারীটি তার হাতের হাতকড়া একটির পর একটি চাবি নিয়ে খোলার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ঝড়ের দাপট তখন ভীষণ আকার ধারণ করেছে।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তীব্রভাবে।
বিদ্যুতের আলোতে বনহুর তাকায় তার পাশে দণ্ডায়মান নারীমূর্তির দিকে, মাত্র ক্ষণিকের জন্য দেখতে পায় কালো আবরণে ঢাকা একখানা মুখ, পিঠে তার তীর-ধনু বাধা, এটাও নজরে পড়ে বনহুরের।
অল্পক্ষণে বনহুরের হাতের লৌহশিকলের তালা খুলে যায়।
বনহুর হাত দু’খানা অন্ধকারে উঁচু করে ধরে, এখন সে মুক্ত। মাজার বন্ধন নিজেই সে খুলে ফেলে কৌশলে। কিন্তু ফিরে তাকাতেই অবাক হয়, কেউ নেই তার পাশে।
বনহুর হঠাৎ শুনতে পায় আবার সেই কণ্ঠস্বর—- আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করো না। বনের দক্ষিণে নীলনদে একটি স্টিমার অপেক্ষা করছে।
বনহুর বলে উঠেকে তুমি? চলে গেলে কেন?
ঝড়ো-হাওয়ায় ভেসে এলো অস্পষ্ট একটা শব্দ আমার নাম আশা….
বনহুর বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এলো কাঠের বেড়ার পাশে, অস্ফুট কণ্ঠে বললো– আশা! কে, কে তুমি আশা ……বনহুরের এখন এ নিয়ে ভাবার সময় নেই তার হাত দু’খানা মুক্ত, সে অল্পক্ষণেই বেরিয়ে এলো কাঠের বন্দীশালা হতে।
বিজয়ার হাতখানা এবার পুরোহিত গুরুদেবের হাতে অর্পণ করে বিয়ে মন্ত্র পাঠ করবে ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এক এক ঘুষিতে এক একজন অসভ্য জংলীকে ধরাশায়ী করে পুরোহিতকে টেনে মঞ্চ থেকে ফেলে দিলো দূরে। গুরুদেব বিজয়ার হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পালাতে যাচ্ছিলো, বনহুর প্রচণ্ড এক লাথি মেরে তাকে ছিটকে ফেলে দিলো নিচে।
হিন্দরাণী উচ্চ আসনে বসেছিলো, সে তার অনুচরদের আদেশ দিলো একে পাকড়াও করে ফেলল, ওকে পাকড়াও করো।
সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য বেঁটে বর্শা আর বল্লম নিয়ে ছুটে এলো।
বনহুর বিজয়ার একখানা হাত হাতের মুঠায় চেপে ধরে আর এক হাতে একটি বর্শা নিয়ে সম্মুখস্থ অসভ্য জংলীদের বাধা দিয়ে চলো। বনহুর অল্পক্ষণেই ওদের পরাজিত করে বিজয়কে নিয়ে দ্রুত ছুটতে লাগলো বনের দক্ষিণ দিকে লক্ষ্য করে।
ঝড়ের তাণ্ডব তখন আরো বেড়ে গেছে।
বনহুর আর বিজয়া ছুটছে।
বিজয়া হাঁপাচ্ছে রীতিমতো, কারণ সে ক’দিন প্রায় না খেয়ে আছে। পা দু’খানা চলছে না তার কিছুতেই।
বনহুর তবু ওকে টেনে নিয়ে চলেছে।
পিছনে অসংখ্য জংলীদের ক্রুদ্ধ চিৎকার। ঝড়ো হাওয়া এবং অন্ধকারে মশালের আলোগুলো দপ দপ করে জ্বলছে, মনে হচ্ছে, আলোগুলো যেন আপনি ছুটে আসছে এদিকে।
বনহুর বললো— বিজয়া, যেমন করে হোক বন পেরিয়ে নীলনদের ধারে আমাদের পৌঁছতেই হবে।
আমি যে আর পারছি না তিলক!
কিন্তু কোনো উপায় নেই। পারতেই হবে তোমাকে। আমার হাত ধরে প্রাণপণে দৌড়াও বিজয়া।
বিজয়া হাঁপাচ্ছে তবু সে দৌড়াচ্ছে জীবন পণ করে।
বিজয়া দৌড়াচ্ছে আর ভাবছে তিলকের অসীম বীরত্বের কথা। আজ সে স্বচক্ষে দেখেছে। তিলকের অদ্ভুত তেজোদ্দীপ্ত মূর্তি। কোনোদিন সে এ দৃশ্য ভুলবে না। তিলক মানুষ না দেবতা ভেবে পায় না বিজয়া।
এক সময় বনহুর আর বিজয়া বন পেরিয়ে বেরিয়ে আসে। সম্মুখে তাকাতেই নজরে পড়ে নীলনদ। জলের উচ্ছ্বসিত কল কল শব্দ কানে এলো তাদের।
বনহুর বললো-বিজয়া, আমরা বেঁচে গেছি, আর ওরা আমাদের ধরতে পারবে না।
ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকালো। ঝড়ো-হাওয়া এখন অনেকটা কমে এসেছে। বনহুর আর বিজয়া বিদ্যুতের আলোতে দেখলো নীলনদের অদূরে একটা স্টিমার দাঁড়িয়ে।
বনহুর বললো–শীঘ্র ঐ স্টিমারে চলো।
বিজয়া বনহুরের হাত ধরে ছুটে চললো স্টিমারের দিকে।
অদ্ভুত যোগাযোগ।
স্টিমারের সিঁড়ি নামানোই ছিলো।
বনহুর বিজয়াকে হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত তুলে নিয়ে এলো স্টিমারে।
ততোক্ষণে হিন্দদ্বীপের অধিবাসীরা বর্শা আর বল্লম হাতে বন থেকে বেরিয়ে এসেছে। অনেকের হাতে বর্শা এবং জ্বলন্ত মশাল।
বনহুর আর বিজয়া তখন স্টিমারের ডেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
আশ্চর্য হলো বনহুর, তারা স্টিমারে উঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ষ্টিমার তীর ছেড়ে চলতে শুরু করলো। এতোক্ষণ স্টিমারখানা যেন তাদেরই জন্য অপেক্ষা করছিলো।
ওরা যখন নীলনদের তীরে এসে দাঁড়ালো তখন স্টিমারখানা নীলনদের ভিতরে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
স্টিমার লক্ষ্য করে জংলীরা বল্লম আর বর্শা ছুঁড়তে লাগলো, কতকগুলো জংলী সাঁতার দিলো নীলনদে কিন্তু স্টিমারের গতি বেড়ে গেছে।
বনহুর আর বিজয়া যখন স্টিমারে এসে পৌঁছেছিল তখন পূর্বদিক ফর্সা হয়ে এসেছে। এবার বনহুর ফিরে তাকালো বিজয়ার দিকে। দেখলো বিজয়ার দেহে নববধূর অদ্ভুত ড্রেস। ললাটে সিদুরের রেখা আঁকা, গলার এবং খোঁপায় তখনো ফুলের মালা দুলছে, হাপাচ্ছে বিজয়া।
বনহুর বললো–মস্তবড় একটা বিপদ কেটে গেলো।
সরে এলো বিজয়া-হাঁ, ওরা যদি এবার আমাদের ধরতে পারতো তাহলে আর রক্ষা ছিলো না। তিলক, তোমাকেও ওরা হত্যা করতো……
আর তোমাকে বিয়ে করে ফেলতে ঐ গুরুদেবটি।
সত্যি, ভাবতে আমার বুকটা এখনও কাঁপছে। ভাগ্যিস, তুমি ঠিক সময় আমাকে উদ্ধার করেছো তিলক, আর একটু হলে ওর সঙ্গে আমার অগ্নিশীলা সাক্ষী করে বিয়ে হয়ে যেতো। জানো না তিলক, হিন্দু শাস্ত্রে কোনো মেয়ের একবার বিয়ে হলে আর কোনোদিন সে…..
কেউ জানতো না বিজয়া, কাজেই তোমারও কোনো চিন্তা ছিলো না।
বিজয়া বলে উঠেতিলক, এ স্টিমারখানা বুঝি……
আমিও জানি না বিজয়া এ স্টিমারখানা কার।
তার মানে?
এ স্টিমার সম্বন্ধে তুমিও যা জানো, আমিও তাই। এসো এবার দেখা যাক।
ইস, তোমার কপালটা কেটে গেছে তিলক, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
হাতের পিঠে কপালের রক্ত মুছে বললো বনহুর-ও কিছু না, চলো দেখি এ জাহাজ কাদের। আবার নতুন কোনো……
বনহুরের কথা শেষ হয় না, একজন খালাসি এসে দাঁড়ায়, বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে বলে– আসুন আপনারা।
বনহুর আর বিজয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
খালাসি বললো–আসুন।
এবার বনহুর পা বাড়ালো, বললো–এসো বিজয়া।
বিজয়া ভীত কম্পিত কণ্ঠে বললো–আবার কোনো বিপদে পড়বো না তো?
উপায় কি আছে বল; বিপদ এলেও তাকে সানন্দে গ্রহণ করতে হবে। এসো দেখা যাক।
বিজয়া বনহুরের সঙ্গে এগিয়ে চলে।
একটা সুন্দর সুসজ্জিত ক্যাবিনে এসে দাঁড়ালো খালাসিটা।
বনহুর আর বিজয়া তাকিয়ে দেখলো ক্যাবিনটা বড় সুন্দর। চারিদিকে রুচিসম্পন্ন আসবাব থরে থরে সাজানো। সুন্দর একটি শয্যা, শয্যায় ধবধবে কোমল বিছানা পাতা। এক পাশে ড্রেসিং টেবিল। টেবিলে প্রসাধনের সামগ্রী। এক পাশে আলনায় নানারকমের পোশাক-পরিচ্ছদ থরে থরে সাজানো।
খালাসি বললো–আপনি এ ক্যাবিনে আরাম করুন। বিজয়াকে লক্ষ্য করে বলে–আপনি আসুন আমার সঙ্গে।
বিজয়া ভয় বিহ্বল চোখে তাকালো বনহুরে মুখে।
বনহুর বললো–যাও বিজয়া।
আমার ভয় করছে তিলক। আমি একা কোথাও যাবো না।
তবে চলো আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।
বনহুর আর বিজয়া খালাসির সঙ্গে অগ্রসর হলো।
খালাসি এবার বেশি দূর না গিয়ে পাশের ক্যাবিনের দরজা খুলে বললো-মেম সাহেব, আপনি এই ক্যাবিনে বিশ্রাম করুন।
খালাসি চলে গেলো।
বনহুর বললো–আশ্চর্য এদের বুদ্ধি-জ্ঞান বিজয়া, দেখছো তোমার জন্য এরা ভিন্ন ক্যাবিনের ব্যবস্থা করেছে।
ক্যাবিনে প্রবেশ করলো বনহুর আর বিজয়া।
প্রথম ক্যাবিনের মতোই সুন্দর করে সাজানো এ ক্যাবিনটাও। সুন্দর শয্যা, ড্রেসিং টেবিল এবং নানারকম প্রসাধনী দ্রব্য সাজানো রয়েছে। মেয়েদের ব্যবহারী জামা-কাপড়ও রয়েছে এ ক্যাবিনে।
খুশি হলো বিজয়া।
বনহুর বললো-বিজয়া, তুমি এ ক্যাবিনে বিশ্রাম করো। আমি পাশের ক্যাবিনে আছি। কিন্তু বিশ্রামের পূর্বে আমি একবার এ স্টিমারখানা পরিদর্শন করে আসি।
আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।
বেশ, এসো।
বনহুর আর বিজয়া স্টিমারখানা ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো। চালক এবং খালাসিগণ ছাড়া এ। জাহাজে কাউকে দেখলো না তারা। বনহুর আর বিজয়া যখন জাহাজখানাকে ঘুরেফিরে দেখছিলো তখন গোপন জায়গা হতে দুটো চোখ তাদের অনুসরণ করছিলো।
বনহুরও খুঁজে ফিরছিলো অজানা-অচেনা একজনকে। কিন্তু তেমন কাউকে নজরে পড়লো না। বনহুর মনে একটা অস্বস্তি বোধ করছিলো, তার সন্ধান যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো। কই, কোথায় সেই আশা, যার কাছে সে আজ কৃতজ্ঞ।
বিজয়াকে তার ক্যাবিনে রেখে ফিরে এলো বনহুর নিজের ক্যার্বিনে। বাথরুমে প্রবেশ করে মুখ-হাত পরিষ্কার করে ধুয়ে নিলো তারপর ফিরে এলো ক্যাবিনে।
ক্যাবিনে ফিরে অবাক হলো বনহুর, টেবিলে তার জন্য খাবার সাজানো।
বনহুর অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলো, সে দ্রুতহস্তে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো। ফলমূল প্রচুর ছিলো, কাজেই বনটি তৃপ্তি সহকারে উদর পূর্ণ করে খেলো। কারণ ফলমূলই বনহুরের প্রিয় খাদ্য। খাওয়া শেষ হলে বনহুর শয্যায় এসে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো, কতোদিন এমন শয্যায় সে শোয়নি। শুয়ে পড়তেই বনহুরের মনে ভেসে উঠলো সেই অদ্ভুত নারীটির কথা, সেই কণ্ঠস্বর-আমার নাম আশা……বনহুর যতো ভাবে ততোই যেন অভিভূত হয়ে পড়ে। আশা……একবার নয়, বারবার সে তাকে নানাভাবে রক্ষা করে চলেছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় বনহুর, আশা যেই হোক কিন্তু সে কি করে তার সন্ধান পেলো! কি করে জানলো বনহুর বন্দী হয়েছে হিন্দদ্বীপ রাণীর হস্তে! আর কি করেই বা সে এই ঝড়োরাতে এ দ্বীপে এসে হাজির হলো অকস্মাৎ! বনহুর যতো ভাবে ততোই যেন চঞ্চল হয়ে উঠে। নিশ্চয়ই সে এই জাহাজেই আছে। কিন্তু সমস্ত জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে তবু তাকে পায়নি সে। ব্যাকুল আগ্রহ জাগে তার মনে, কে এই আশা তাকে এমনভাবে লক্ষ্য করে চলেছে অথচ সে তাকে চেনে না……ভাবতে ভাবতে এক সময় তন্দ্রা নেমে আসে বনহুরের চোখে। কতোদিনের ক্লান্তি আর অবসাদে দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে, একসময় ঘুরিয়ে পড়ে বনহুর।
স্টিমার চলেছে।
একটানা ঝক ঝক শব্দ শোনা যাচ্ছে।
পাশের ক্যাবিনে বিজয়াও নিদ্রিত। তার শরীরও অত্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলো।
বনহুর যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখন ক্যাবিনের মেঝেতে এসে দাঁড়ালো নূরীর সেই জংলী বান্ধবী চম্পা। দেহে তার তীরন্দাজের ড্রেস, মাথায় একরাশ কোকড়ানো চুল, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চম্পা এসে দাঁড়ালো বনহুরের শিয়রে। নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে সে বনহুরের নিদ্রিত মুখমণ্ডলে তাকিয়ে রইলো। হাতখানা ওর ললাটে রাখতে গেলো কিন্তু সে নিজকে সংযত করে নিলো। কে যেন চম্পার কানে কানে বললো……না না, ওর ঘুম ভেঙ্গে যাবে, তুমি ওকে স্পর্শ করো না…
চম্পা হাতখানা সরিয়ে নিলো। তারপর যেমন সন্তর্পণে এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে গেলো সে ক্যাবিন থেকে।
মনসুর ডাকু আজ একজন দরবেশ।
তার মুখে দাড়ি, মাথায় জটাধরা একমাথা চুল। গলায় বড় বড় তসবী। গায়ে কম্বল জড়ানো, মুখে সর্বক্ষণ আল্লাহর নাম।
মনসুর ডাকু বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। আজ এ বন কাল সে বন। একদিন সে হাজির হলো ঝাম জঙ্গলে। অনেক ঘুরেফিরে হঠাৎ সে একসময় পৌঁছে গেলো রাণীদেবীর আখড়ায়।
প্রথমে মনসুর অবাক হলো, কে এই দেবী যার দয়ার সীমা নেই। প্রতিদিন শত শত দীনদুঃখী এসে হাজির হয় এই ঝামজঙ্গলে। আজ এ জঙ্গল এক তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে।
মনসুর ডাকু এখানে এসে স্তম্ভিত হয়।
মনসুর ডাকু দূরে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা নয়নে দেখছিলো এ দৃশ্য। একটা সুউচ্চ স্থানে দণ্ডায়মান এক নারী, তার দেহে শুভ্র পোশাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, একরাশ চুল ছড়িয়ে আছে পিঠের উপর। চোখে অদ্ভুত মায়াময় দৃষ্টি। তার দুপাশে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতে থালাভর্তি স্বর্ণমোহর। পিছনে আরো দু’জনের হাতে কাপড়, আরো দু’জনের হাতে চাউল।
দেবী দু’হাতে এগুলো গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান করে চলেছে। সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছে গরিব অসহায় বেচারিগণ। সবার হাতে দেবী তুলে দিচ্ছে এসব জিনিস, তারা গ্রহণ করে সরে যাচ্ছে যে যার পথে।
হঠাৎ দেবীর দৃষ্টি এসে পড়ে বৃদ্ধ মনসুর ডাকুর উপর। তৎক্ষণাৎ সে তার অনুচরদের বলে– বৎস, যাও ঐ বৃদ্ধকে আমার সম্মুখে নিয়ে এসো। বৃদ্ধ ভিড়ের মধ্যে আসতে পারছে না।
কথাটা শোনামাত্র সেই ব্যক্তি এগিয়ে গেলো মনসুর ডাকুর পাশে। বিনীত কণ্ঠে বললো— আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন আপনাকে দেবী ডাকছেন।
মনসুর ডাকু এগিয়ে গেলো, দেবীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো সে।
দেবীর দিকে নিৰ্ণিমেশ নয়নে তাকালো–শুভ্র বসন, এলো চুল, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, ললাটে চন্দনের আলপনা-অপূর্ব শ্রী, তেজোদ্দীপ্ত মূর্তি, সহসা মনসুর ডাকু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে না।
দেবী হেসে বলে–বাবাজী, অমন করে কি দেখছেন?
দেখছি তোমাকে। কে তুমি মা?
আমার পরিচয়……
হাঁ, আমি জানতে চাই?
পরিচয় আমার কিছু নেই বাবাজী, আমি একজন মানুষ। নিন, আপনি নিন……দেবী দু’হাতে মোহর তুলে মনসুর ডাকুকে দিতে যায়।
মনসুর ডাকু বলে না, ও সব আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
মোহর আপনি চান না?
না।
তবে কি চান আপনি?
আমি ভিখারী নই মা, আমি তোমার মতো একজন মানুষ হতে চাই।
কে, কে আপনি?
আমার পরিচয় পরে বলবো। আমি জানতে চাই তুমি কে মা?
এমনভাবে এ স্থানে আমার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয় বাবাজি। আপনি আমার আশ্রমে যান এবং সেখানে বিশ্রাম করুন, আমি এসে সব বলবো।
দেবী পুনরায় দানকার্যে মনোযোগ দিলো।
অনুচরটি বললো—-আসুন আপনি আমার সঙ্গে।
বৃদ্ধ মনসুর এগিয়ে চললো লোকটির সঙ্গে।
অদূরে এক পর্ণকুটির।
মনসুরসহ লোকটি সেই পর্ণকুটিরের সম্মুখে এসে থামলো। বললো লোকটি–এই কুটিরে আপনি বিশ্রাম করুন বাবাজি, এটাই দেবীর কুটির।
বিস্ময়ে দু’চোখ বড় হলো মনসুরের। যে দু’হাতে স্বর্ণমোহর বিলিয়ে চলেছে সেই দেবীর এই পর্ণকুটির! আশ্চর্য নারী।
মনসুরকে রেখে চলে গেলো লোকটা।
মনসুর ডাকু তখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে দাঁড়াতে পারলো না, পা দু’খানা যেন শিথিল হয়ে আসছে, কারণ সে সমস্ত দিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।
মনসুর ডাকু এবার কুটিরের দাওয়ায় উঠে বসলো।
অল্পক্ষণেই দু’চোখ মুদে এলো তার।
কুটিরের দেয়ালে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লে বৃদ্ধ মনসুর।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, হঠাৎ কোমল কণ্ঠের আহ্বানে নিদ্রা ছুটে গেলো মনসুর ডাকুর। সোজা হয়ে বসলো সে, চোখ মেলে দেখলো, সেই দেবীমূর্তি তার সম্মুখে দণ্ডায়মান।
মনসুর শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালো।
দেবী বললো–আপনি অত্যন্ত ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এবার মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিন।
মনসুর তার কথায় যেমন আনন্দ পেলো, তেমনি তৃপ্তি বোধ করলো সে।
দেবীর কথামতো হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিলো।
এবার বসলো দেবী তার সম্মুখে বলুন, কে আপনি?
মনসুর ডাকুর মুখ ম্লান হলো, বললো-আমার পরিচয় অতি জঘন্য, তুমি ঘৃণা করবে মা।
না, আমি কাউকে ঘৃণা করি না বাবাজি। সবাই মানুষ, এই আমি জানি।
আমি যে মানুষ নামের কলঙ্ক!
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে ত্যাগ করে বলে দেবী–মানুষ কোনোদিন কলঙ্কময় হয় না বাবাজি। তার কর্মফল তাকে একটা মায়ার জালে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তাই মানুষ তখন মনে করে সে মানুষ নামে কলঙ্ক।
তুমি কে আর কোথায় পেলে মা তুমি এমন জ্ঞান?
আমার পরিচয়ও অতি নিকৃষ্ট, আমিও কলঙ্কময়ী নারী…. এ
তুমি কি বলছে দেবী?
হাঁ, যা বলছি সত্য।
দেবী!
দেবী নয়, নর পিশাচিনী। একদিন এই হাতে শত শত মানুষকে আমি হত্যা করেছি বাবাজি। একদিন ঐশ্বর্য আর অর্থের মোহ আমাকে উন্মাদিনী করে তুলেছিলো। হাঁ, আমি সেদিন মানুষ ছিলাম না, আমি ছিলাম এক ভয়ঙ্করী নারী……
মনসুর বিস্ময়ভরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শুভ্র বসন দেবীমূর্তির দিকে। তার চোখেমুখে এক কঠিন রূপ ফুটে উঠেছে।
দাঁতে দাঁত পিষে কথাগুলো বলে চলেছে সে।
মনসুর ডাকু নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে তার কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।
বলে চলেছে দেবী—-অর্থের নেশা আমাকে পিশাচিনী করে তুলেছিলো সেদিন। রাজরাণী হয়েও আমি শান্তি পেতাম না। রাজসিংহাসন আমার কাছে তুচ্ছ মনে হতো। আমার নেশা ছিলো
অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠে মনসুর-তারপর?
আমি রাজসিংহাসন ত্যাগ করে গোপনে দস্যুতা শুরু করি। অসংখ্য হত্যালীলা করি এবং পাই– অসংখ্য অর্থ আর ঐশ্বর্য। আমি মনে করি তখন, আমার মতো আর কেউ নেই যার এমন শক্তি আর সম্পদ আছে।
তারপর?
আমার কানে আসে, একজন আছে সে আমার চেয়ে আরো শতগুণ বেশি শক্তিশালী এবং সম্পদশালী। আমি হাসলাম–আমার চেয়ে কেউ বড় হতে পারে না। একদিন আমি হানা দিলাম তার একটি আস্তানায়। হত্যা করলাম তার সেই আস্তানার প্রধান অনুচরকে। লুটে নিলাম প্রচুর সম্পদ। সেদিন অভূতপূর্ব এক আনন্দে মন আমার ভরে এলো। আমি জয়ী হয়েছি, সে যতবড় শক্তিশালীই হোক তার সম্পদ আমি লুটে নিয়েছি। কিন্তু একদিন আমি যে তার কাছে পরাজিত হবো, এ কথা সেদিন ভাবিনি।
বলো? বলো দেবী তারপর?
সেই শক্তিশালী ব্যক্তি একদিন আমার রাজপ্রাজসাদে এলো ছদ্মবেশে। আমি তাকে চিনতে পারলাম না, তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে ফেললাম……একটু থামলো দেবী, পিতার বয়সী দরবেশের সম্মুখে হয়তো তার লজ্জা হলো।
মনসুর বললো-বলো মা, তুমি বলো, আমি সব শুনবো।
বাবাজি, আমি সেদিন জানতাম না সেই তেজোদ্দীপ্ত অপূর্ব অদ্ভুত যুবক সে-ই-যাকে পরাজিত করার জন্য আমি পাগলিনী হয়ে উঠেছিলাম। সে আমার মনোভাব জানতো, হয়তো সে মনে মনে হাসতো আমার কার্যকলাপ দেখে। আমাকে সে অনেক সময় সাহায্য করতে যাকে আমি নাকানি-চুবানি খাওয়াতে চাই তার সন্ধানে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলাম আমি শুধু তার কাছে নয়, নিজের কাছে নিজেই।
দেবী……..
হাঁ, আমি পরাজিত তার কাছে, আমার নিজের কাছেও।
কিন্তু কে সে, যার কাছে তুমি হেরে গেছে দেবী?
আসুন বাবাজি আমার সঙ্গে, আমি তাকে দেখাচ্ছি..
মনসুর তাকে অনুসরণ করলো।
কুটির মধ্যে প্রবেশ করতেই একটা সুমিষ্ট গন্ধ তাকে অভিভূত করে ফেললো। চারিদিকে ধুম্ররাশি ছড়িয়ে আছে। কেমন যেন দেব মন্দিরের মতো মনে হলো মনসুরের কাছে।
দেবী একটি মোম জ্বালালো।
সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চমকে উঠলো মনসুর। ধুমরাশি ভেদ করে একটা ছবি ফুটে উঠলো তার চোখের সামনে। মনসুর এগিয়ে গেলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেইদিকে। চিত্রার্পিতের মতো তাকিয়ে আছে সে ছবিখানার দিকে।
দেবী বললো–এই সেই মহান ব্যক্তি যার কাছে আমি পরাজিত হয়েছি বাবাজি……
আশ্চর্য কণ্ঠে বলে উঠে মনসুর ডাকু–এ যে দস্যু বনহুর!
আপনি……..আপনি তাকে চেনেন? তাকে দেখেছেন আপনি?
হ দেবী, আমিও যে তার কাছে পরাজিত মা।
বাবাজি আপনি কে, কে আপনি? কি আপনার পরিচয়?
আমি মনসুর ডাকু!
মনসুর ডাকু!
হাঁ মা, আমিও একজন মহাপাপী, দস্যু বনহুরের পিতা কালু খা আমার যেমন বন্ধু ছিলো তেমনি শত্রুও ছিলো। কালু খাঁ আমাকে একবার চরমভাবে অপদস্থ করেছিলো। তার কাছে আমি অপমানিত হই। কিন্তু তাকে আমি পারি না জব্দ করতে। পিতার অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য আমি দস্যু বনহুরের প্রতি কঠিন আকার ধারণ করি। তাকে হত্যা করার জন্য আমি পাগল হয়ে উঠি।
বলুন তারপর?
কৌশলে তাকে বন্দী করতে গিয়ে তার হাতে বন্দী হই। কিন্তু বনহুর আমাকে মুক্তি দেয়। মুক্তি পেয়ে আমি আবার ক্ষেপে উঠি ভীষণভাবে, আবার তাকে বন্দী করার জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাই। আবার আমি বন্দী হই বনহুরের ভূগর্ভ বন্দীশালায়। সেবারও বনহুর আমাকে ক্ষমা করে কিন্তু আমি তাকে ক্ষমা করতে পারি না। একদিন তাকে বন্দী করতে সমর্থ হই।
দেবী বলে উঠে–আপনি তাকে বন্দী করতে পেরেছিলেন?
হাঁ, তাকে আমি বন্দী করি এবং আমার পাতালপুরীর গোপন বন্দীশালায় তাকে আটকে রাখি–শুধু তাই নয়, তার একমাত্র সন্তান নূরকে আমার অনুচরগণ ধরে নিয়ে আসে।
আপনি কি বলছেন দরবেশ বাবাজি?
যা সত্য আমি সব বলছি……মনসুর ডাকু সব কথা আজ বলে যায় দেবীর কাছে। আজ সে মনসুর ডাকু নয়, সে মনসুর দরবেশ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
দেবী ও মনসুর ডাকুর বহুক্ষণ নীরবে কাটে।
বলে উঠে মনসুর–আমিও হেরে গেছি দেবী ওর কাছে……আঙ্গুল দিয়ে মনসুর দেখায় বনহুরের দীপ্তময় ছবিটা।
দেবী তখন নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ওর চোখ দুটো।
মনসুর এবার বলে উঠে—-তুমিই সেই রাণী দুর্গেশ্বরী! তোমায় আমি চিনতে পেরেছি দেবী, তোমায় আমি চিনতে পেরেছি….
স্টিমারখানা নীলনদ অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে।
বনহুর ষ্টিমারের চালককে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলো এই স্টিমারের মালিক একজন জংলী সর্দার। নাম তার ভূজঙ্গ। এরা নাকি তার আদেশেই সেদিন হিন্দদ্বীপে গিয়েছিলো এবং ঝড়ের জন্য। তারা স্টিমার রাতে ছাড়তে না পেরে ভোর রাতে ছেড়েছিলো। তারা এখন নীল দ্বীপের অদূরে সন্ধী দ্বীপে যাচ্ছে। চালক আরও বলেছিলো তাদের সর্দার ভূজঙ্গ বলেছে সব সময় তারা যেন অতিথিকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেখায়।
স্টিমার চালকের কথা শুনে হেসেছিলো বনহুর, বলেছিলো–তোমাদের সর্দারের মহত্বের পরিমাপ হয় না। সেদিন ঝড়ো হাওয়া আর দুর্যোগপূর্ণ রাতে তোমাদের সর্দারের সহানুভূতির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই নাও আমার এই আংটি, এটা তাকে দিও।
হাত বাড়ালো চালক।
বনহুর তার আঙ্গুল থেকে আংটিখানা খুলে চালকের হাতে দিলো।
চালক বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে আংটিটা দেখতে লাগলো। জীবনে সে বহু আংটি দেখেছে কিন্তু এমন উজ্জ্বল দীপ্ত পাথরমুক্ত আংটি সে দেখেনি কোনোদিন।
বনহুর গোপনে অনেক সন্ধান করেছে কিন্তু পরাজিত হয়েছে সে আশার কাছে। আশা কি তবে এ জাহাজে সত্যিই নেই? হয়তো তাই হবে, না হলে সে সমস্ত জাহাজখানা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে। তার নিপুণ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে, এমন জন বুঝি এ পৃথিবীতে নেই।
বনহুর ডেকে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলো সম্মুখে ফেনিল জলরাশির দিকে। প্রচণ্ড প্রচণ্ড ঢেউগুলো আছাড় খেয়ে পড়ছে। নির্বাক নয়নে সেইদিকে তাকিয়ে ছিলো বনহুর। কতকগুলো এলোমেলো চিন্তা তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। নূরীর সন্ধানে এসে একি সব আজগুবি ঘটনার সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ছে। কোথায় নূরী যাকে সে খুঁজে ফিরছে……
তিলক!
বিজয়ার কণ্ঠস্বরে বনহুরের চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফিরে তাকায় সে পাশে।
বিজয়া বলে–সব সময় অমন করে কি ভাবো তিলক?
একটু হাসার চেষ্টা করে বলে বনহুর–যার সন্ধানে এলাম তাকে পেলাম না বিজয়া।
জানি তুমি তার জন্য অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছ।
মিথ্যা নয়।
তিলক, তোমার নূরী সত্যি ভাগ্যবতী…..
তার মানে?
মানে তুমি যার জন্য ভাবছো সেকি কম? আজ এতো করেও তোমার মনে দাগ কাটতে পারলাম না তিলক! একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো বিজয়া।
বনহুর বললো–তুমি তো জানো পাথরে কোনোদিন আঁচড় পড়ে না।
সত্যি তোমার হৃদয় কি পাথরের মতো শক্ত?
তার চেয়েও শক্ত।
হাঁ, তা না হলে তুমি এতো কঠিন হতে পারতে না তিলক। জানি না কেন তুমি এমন কঠিন হয়েছে।
কর্তব্য আমাকে কঠিন করে তুলেছে বিজয়া।
বিজয়া আর বনহুরে যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন অদূরে তক্তার ফাঁকে দু’খানা চোখ ভেসে উঠে, মায়াভরা দুটি চোখ।
বনহুরের কথাগুলো তার কানে এসে পৌঁছলো, দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল। ধীরে ধীরে চোখ দুটো তার নিজের আঙ্গুলে এসে থামলো, সেই আংটিটি তার আঙ্গুলে পরা রয়েছে। যে আংটিখানা দিয়েছিলো বনহুর স্টিমার চালকের হাতে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে চম্পা, আংটিসহ হাতখানা তুলে নিজের কোমল গণ্ডে রাখলো, আপন মনেই বললো–তোমার এ দান আমার জীবনের সম্পদ বনহুর।
সেদিন রাতে ঘুমিয়ে আছে বনহুর।
ক্যাবিনে ডিমলাইট জ্বলছে।
হঠাৎ আলো নিভে গেলো।
সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেলো বনহুরের, চোখ মেলে তাকালো অন্ধকারে। কিন্তু কিছুই নজরে পড়ছে না–শুধু কানে ভেসে এলো একটা লঘু পদশব্দ।
বনহুর নিঃশব্দে পড়ে রইলো, নিশ্চয়ই আশার আবির্ভাব ঘটেছে। এবার সে হাতেনাতে ধরে ফেলবে ওকে। পদশব্দ ধীরে ধীরে তার বিছানার দিকে এগিয়ে আসছে।
বনহুর এবার নিজকে প্রস্তুত করে নিলো। শয্যা ত্যাগ করে খপ করে ধরে ফেললো ওর হাতখানা। বনহুর অনুভব করলো তার কঠিন হাতের মধ্যে একটা কোমল হাতের অনুভূতি। ঠিক সে এবার তাকে ধরে ফেলেছে যে এতোদিন তাকে ধোকা দিয়ে আত্মগোপন করে ফিরেছে। বনহুর বলে উঠে—-আশা, এবার তুমি আমার কাছে আত্মগোপন করতে পারবে না… আমি তমায় ধরে ফেলেছি… বাম হস্তে হাতখানা চেপে ধরে ডান হাতে সুইচ টিপে আলো জ্বালালো, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো–বিজয়া তুমি!
হ।
এই গভীর রাতে এখানে কেন?
জানি না কে আমাকে এখানে টেনে এনেছে। জানি না তিলক! বিজয়া দু’হাতের মধ্যে মুখ লুকায়।
বনহুর গম্ভীর মুখে শয্যায় ফিরে যায়।
বিজয়া দাঁড়িয়ে থাকে।
বনহুর আর বিজয়া নীরব।
একসময় বলে উঠে বনহুর–বিজয়া, জানি তুমি আমাকে ভালবাসো এবং সেই কারণেই তুমি আমাকে ছেড়ে দূরে থাকতে চাও না। জানি তোমার ভালবাসা অতি নির্মল……ফুলের মতোই পবিত্র, কিন্তু
বিজয়া আর দাঁড়াতে পারে না, সে ছুটে বেরিয়ে যায় ক্যাবিন থেকে। নিজের ঘরে প্রবেশ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে সে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
এমন সময় একটা তরুণ খালাসি প্রবেশ করে সেই ক্যাবিনে।
পদশব্দে মুখ তুলে তাকায় বিজয়া, বিস্মিত কণ্ঠে বলে–কে?
তরুণ খালাসি মাথার পাগড়িটা ঠিক করে নিয়ে তার শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালো, বললো আমি এ স্টিমারের একজন নগণ্য খালাসি।
তা এখানে কেন?
আপনার কান্নার শব্দ পেয়ে এলাম। কি হয়েছে আপনার বলবেন কি?
না, আমার কিছু হয়নি, তুমি যেতে পারো।
আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। আপনি আমার বোনের মতো–আমার বড় বোন জ্যাকির মতো ….
এবার বিজয়া ভাল করে তাকালো ওর দিকে। দেখলো তরুণ খালাসিটি নতুনমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
বিজয়া বললো–এই শোনো!
এগিয়ে এলো তরুণ খালাসি। আর একবার সে মাথার পাগড়িটা ঠিক করে নিলো।
বললো বিজয়া-তোমার বোন আমার মতো বুঝি?
হাঁ, ঠিক আপনার মতো! কদিন আপনাকে দেখছি, কিন্তু কাছে এগুবার সাহস পাইনি। আজ আপনার কান্না দেখে আর থাকতে পারলাম না। আচ্ছা দিদি, আজ আপনার স্বামী বুঝি কিছু……
চুপ করো……কে আমার স্বামী!
ঐ সাহেব!
ও আমার কেউ হয় না।
অবাক কণ্ঠে বলে খালাসি–আপনার কেউ হয় না উনি!
না।
তবে যে আপনি তার জন্য……
যাও, আর কথা বাড়াতে হবে না।
আচ্ছা যাচ্ছি দিদি। পা বাড়ায় তরুণ খালাসি।
বিজয়া বলে–শোনো।
ফিরে তাকায় খালাসি।
বিজয়া বলে—তোমার নাম কি ভাই?
আমার নাম আশা। আমার বাবা-মার আমি একমাত্র সন্তান কিনা, তাই আমার উপর তাদের অনেক ভরসা, সেইজন্য আমার নাম আশা রেখেছিলো……
চমৎকার নাম তোমার, আশা। যাক তোমাকে পেয়ে আমার খুব ভাল হলো। গল্প করে সময় কাটানো যাবে। দেখি, দেখি তোমার আংগুলে ও আংটিটা, ওটা তুমি কোথায় পেলে?
হাসলো আশা, বললো–এ আংটি আপনার ঐ সাহেব এ জাহাজের মালিককে দিয়েছে।
তা তোমার আঙ্গুলে কেন?
এখন নয় পরে বলবো। আসি দিদি, কেমন?
বেরিয়ে গেলো তরুণ খালাসি।
বিজয়ার মনে সন্দেহ জাগলো, তিলকের আংটি কি করে তরুণ খালাসির আঙ্গুলে গেলো। নিশ্চয়ই সে চুরি করেছে, না হলেও সে ওটা পেলো কোথায়?
ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজয়া ছুটে গেলো বনহুরের ক্যাবিনে।
বনহুর সবে শয্যা ত্যাগ করে উঠে বসেছে। বিজয়াকে দেখে বলে উঠে–বিজয়া, কি হলো? তিলক, দেখি তোমার হাতখানা? বিজয়া বনহুরের হাতখানা টেনে নিলো হাতের মধ্যে, বললো–তোমার সেই হীরার আংটি কোথায়?
হেসে বললো বনহুর—আছে।
আছে! কি বলছো তুমি?
এ জাহাজের মালিককে আমি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমার সেই আংটিটি দিয়েছি।
মালিক!
হা।
একটি তরুণ খালাসি এ জাহাজের মালিক!
তরুণ খালাসি!
হাঁ, একটি তরুণ খালাসির হাতের আঙ্গুলে আমি সেই আংটি দেখেছি।
কই, সেতো তরুণ খালাসি নয়, সে এ জাহাজের বৃদ্ধ চালক। আমি তার হাতে আংটি দিয়েছি তাকে পরার জন্য নয়। বনহুর উঠে দাঁড়ালো–চলো তুমি কার আঙ্গুলে আংটি দেখেছো দেখাবে। চলো।
বিজয়া অনেক খুঁজেও তরুণ খালাসিকে আর পেলো না।
বনহুর আর বিজয়া এসে দাঁড়ালো সেই বৃদ্ধ চালকের কাছে। বনহুর বললো-তুমি আংটিটা কি করেছো?
হেসে বললো-আছে। আমার কাছেই আছে। পৌঁছে মালিককে দেবো।
বিজয়া বললো–ও মিথ্যা কথা বলছে। কই, দেখি কোথায় সে আংটি?
বৃদ্ধ চালক তার পুটলি খুলে সেই আংটি বের করে বনহুর আর বিজয়ার সম্মুখে মেলে। ধরললা–এই যে দেখুন।
বনহুর তাকালো বিজয়ার মুখের দিকে।
বিজয়া বললো—আশ্চর্য!
বনহুর হাসলো, সে জানে এ জাহাজেই আছে এ জাহাজের মালিক। বিজয়া তারই হাতের আঙ্গুলে আংটিখানা দেখেছিলো। সেই তরুণ খালাসিই……
বনহুর আর বিজয়া বেরিয়ে এলো বাইরে।
অল্পক্ষণেই তীর দেখা গেলো।
চালক জানালো, তারা তাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেছে।
বিজয়ার মনে নতুন জীবন লাভের আনন্দ। বনহুরের মুখমণ্ডল গম্ভীর, কারণ সে যার সন্ধানে। এসেছিলো তাকে পায়নি।
একসময় স্টিমারখানা দ্বীপে এসে ভিড়লো।
নেমে পড়লো বনহুর আর বিজয়া।
কিন্তু কোথায় যাবে তারা, এটা তাদের সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা দ্বীপ।
ওরা এগিয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় একটি জংলী মেয়ে এসে দাঁড়ালো বনহুর আর বিজয়ার সম্মুখে। মাথায় আঁকড়া চুল, বাম পাশে খোঁপা করে বাঁধা। একখানা ছোট্ট কাপড় হাঁটুর উপর উঁচু করে পরা। খোঁপায় চুল গোঁজা! গলায় ফুলের মালা। হাতে ফুলের বালা। কতকগুলো চুল এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে কপালে আর কাঁধে। বনহুর আর বিজয়াকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এলো–এই তোরা কোথায় যাবি বাবু?
বিজয়া বললো—এখানে আমাদের কেউ নেই।
তবে যাবি আমাদের ঘর? জংলী মেয়েটি একমুখ হেসে বললো।
বনহুর বললো–যাবো! এসো বিজয়া ওর বাড়িতেই যাই।
বিজয়া আর বনহুর জংলী মেয়েটার সঙ্গে এগিয়ে চললো।