ক্রিকেট সিজনের শুরুতে
ক্রিকেট সিজনের শুরুতেই সি সি এইচ-এর অর্থাৎ ক্রিকেট ক্লাব অফ হাটখোলার নেট পড়ে মহামেডান মাঠের পাশে, মেম্বার গ্যালারির পিছনে।
চার শরিকের মাঠ। সি সি এইচ দেয় বছরে চারশো টাকা। হেড মালী দুর্যোধন মহাপাত্র। পুজো শেষ হলেই মাঠের মাঝে একখণ্ড জায়গার চারকোণে বাঁশ পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘিরে দেয়। জল ঢেলে আর কয়েকদিন রোলার টেনে ডলাই-মলাই করে, দুর্যোধন যখন সগর্বে ঘাসবিহীন পাথুরে পিচের দিকে হাত তুলে বলল, কী একখানা পিচো বনাইছি দেখ ননীবাবু, লরি চালাই দাও কিছু হবেনি।
তখন ননীদা গম্ভীর থেকে আরও গম্ভীর হয়ে উঠলেন। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ক্রিকেট লরি-ড্রাইভারদের খেলা নয়, দুর্যোধন।
মো কি সে কথা বলিছি! গত বৎসর আপোনি বলিলেন, কড়া ইস্তিরি করা শার্টের মতো পেলেন পিচ না হলি ব্যাটোসম্যান স্টোরোক করি খেলিব কেমনে? তাই এবছর ইস্তিরির মতো করি রোলার টানিছি।
ক্রিকেট ধোপাদেরও খেলা নয়, দুর্যোধন।
দুর্যোধন একটু ঘাবড়ে গেল ননীদার আরও ঠাণ্ডা গলার স্বরে। ক্ষুন্ন হয়েই সে বলল, গত বৎসরের আগের বৎসরো বলিলেন, কী পিচ বনাইছিস, এ যে খেতি জমি, ধানো ছড়াই দিলি গাছো হই যিব।
ক্রিকেট চাষাদেরও খেলা নয়, দুর্যোধন।
এবার দুর্যোধন ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত চোখে ননীদার ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিরিকেট তবে কারা খেলে?
ভদ্রলোকেরা। ননীদা আকাশবাণী ভবনের গম্বুজ থেকে শহিদ মিনারের ডগায় উদাস চাহনিটাকে সুইপ করে নিয়ে গেলেন। পিচ হবে স্পোর্টিং, বোলার আর ব্যাটসম্যানকে ফিফটি-ফিফটি সুযোগ দেবে।
দুর্যোধনের বেঁটে শরীরটা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো বেঁকে গেল একটা অদৃশ্য ভারী গদা তুলতে গিয়ে। দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল, তংকা বাড়াও, ইডেন মতো মো পিচো বনাই দিব।
তারপর এই মাঠেই গ্যালারি বসিয়ে টেস্টখেলা হোক আর কী। ননীদা শহিদ মিনারের গা বেয়ে সরসর করে চোখটাকে নামিয়ে এনে হা হা করে ছুটে গেলেন— বাইরে দিয়ে, বাইরে দিয়ে। বাহারসে যাইয়ে।
লোক দুটো থমকে গেল পিচের কিনারে এসে। পরস্পরের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, কাহে বাহার সে যায়গা?
পূজা হোগা। হোম-যজ্ঞকে লিয়ে এই স্থান সাফ কিয়া থা। ননীদা সসম্রমে পিচের দিকে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ক্রিকেট দেওতা কা পূজা হোগা। শুনেই
ওরা অবনত মস্তকে পিচের উদ্দেশে করজোড়ে প্রণাম করে, মহমেডান মাঠের বেড়া। ঘেঁষে হাইকোট মাঠের দিকে চলে গেল, সম্ভবত চিড়িয়াখানা কি ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে।
এতক্ষণ আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ও শুনছিলাম। ননীদা কাছে আসতেই বললাম, এটা কী হল?
ট্যাকটিকস, কুইক আউট করে দিলুম। যদি বলতে ইয়ে হ্যায় ক্রিকেট পিচ, ইসকা উপর সে হাঁটা মানা হ্যায়, তা হলে অনেক তর্ক, অনেক ঝামেলা শুরু হত। ব্যাটসম্যানকে সেটল করতে দেবার আগেই ফিরিয়ে দেবে। মনে রেখো মতি, এবছর তুমি সি সি এইচ-এর ক্যাপ্টেন। তোমাকে ট্যাক্টফুল হতে হবে।
সবিনয়ে ঘাড় নেড়ে বললাম, নিশ্চয়। তা ছাড়া আপনি তো আছেনই, দরকার পড়লে পরামর্শ নিশ্চয় করব। খুশি করার জন্য কথাগুলো বলিনি, বিপদে ননীদাকে সত্যিই দরকার হবে। ননীদার ট্যাকটিকস, যাকে আমরা ননীটিকস নামে আড়ালে অভিহিত করি, কতবার যে সি সি এইচ-কে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে তা লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তবে দুচারটের কথা অবশ্যই উল্লেখ করব।
ননীদা গত বছর পর্যন্ত আমাদের ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। কত বছর ছিলেন সেটা আমার পক্ষে খাতাপত্তর না দেখে বলা শক্ত। সম্ভবত সিকি শতাব্দী। বারো বছর মাত্র এই ক্লাবে আছি। তার মধ্যে ননীদাকে যে রূপে দেখেছি তা বোঝাতে হলে, প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ট্রেজারার, সিলেকটর, স্কোরার, মালী, সাবস্টিটিউট ফিল্ডার, ক্যাপ্টেন প্রভৃতিকে একত্রে একটি লোকের মধ্যে ভরে দিলে যা হয়, উনি তাই। ওঁর মুখের উপর কথা বলতে পারে বা ওঁর কথা অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পারে এমন কাউকে এখনও সি সি এইচ-এ দেখিনি। অনেককে গাঁইগুই করতে শুনেছি, কিন্তু আড়ালে। দুর্যোধনের পোষা নেড়িকুত্তাটা পর্যন্ত ননীদার গলার আওয়াজ পেলে লেজটাকে নামিয়ে সরে যায়। ননীদাকে এল বি ডবল আউট দিয়ে এক আম্পায়ারকে দেখেছিলাম খেলা শেষে উইকেট থেকে তাঁবুতে না ফিরে হনহনিয়ে উলটোদিকে বঙ্গবাসী কলেজ-মাঠ পেরিয়ে একটা চলন্ত বাসে লাফ দিয়ে উঠে পড়তে।
ননীদার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ বারো বছর আগে সি সি এইচ-এর এই নেটে।
আমাদের পাড়ার বিশ্বনাথদা চুয়াল্লিশ সালে মোহনবাগানে ক্রিকেট খেলেছেন, সেই বছর রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা দলের পনেরোজনের মধ্যেও নাকি ছিলেন। আমরা ওঁকে খুব খাতির করি, বিশেষ করে আমি আর চিতু, অর্থাৎ চিত্তপ্রিয়। আমাদের দুজনের ইচ্ছে বিশ্বনাথদার সুপারিশে মোহনবাগানে ঢোকা, তারপর খেলা দেখিয়ে উন্নতি করা। উন্নতি বলতে টেস্ট খেলা।
বিশ্বনাথদাকে বলতেই তো চোখ পিটপিট করে বললেন, মোহনবাগানে? আমাদের আপাদমস্তক বার চারেক দেখে আবার বললেন, খেলবি? বলিস কী! তোদের সাহস তো কম নয়!
চিতুটা টেঁটিয়া ছেলে। ফস করে বলল, আপনি খেলেছেন, আমরা পারব না। কেন?
দুখিরামবাবুর ডাইরেক্ট শিষ্য ফকিরবাবুর কাছে আমি তালিম নিয়ে তবেই মোহনবাগানে খেলার কথা চিন্তা করেছি। আর তোরা? এখনও রাস্তায় ক্যাম্বিসবল পেটাস, ঘাস চিনলি না গড়ের মাঠের, ফুলটস আর ইয়র্কারের প্রভেদ জানিস না, অথচ মোহনবাগানে খেলতে চাস! পিচের উপর একটা আধলা রেখে তার উপর বল। ফেলতে পারতুম। কেন জানিস? এবেলা চারঘণ্টা ওবেলা চারঘণ্টা, নাগাড়ে আন্ডার দ্য ওয়াচফুল আইজ অফ ফকিরবাবু আমি বল করেছি নেটে। যখন আউট অফ হানড্রেড পঁচানব্বইটা বল আধলায় ফেললুম তখন ফকিরবাবু বললেন, এবার তোকে রিজার্ভে আনব। এই রকম ব্যাপার ছিল আমাদের সময়। গুরু ছিল, কঠিন সাধনা ছিল। আর এখন?
চিতু বলল, আমরাও সাধনা করতে রাজি যদি কেউ দেখিয়ে দেন একটু। আপনি দেবেন?
আমি! বিশ্বনাথদা আকাশ থেকে পড়লেন, আমি অফিস ফেলে এখন ক্রিকেট শেখাব? বরং তোরা ননীর কাছে যা। আমার গুরুভাই, গুড কোচ, ক্রিকেট নিয়েই দিনরাত পড়ে আছে, ভেরি হার্ড টাস্কমাস্টার। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি তাই নিয়ে দেখা কর। আগে ছোট ক্লাবে খেলে তারপর বড় ক্লাবে খেলতে হয়, বুঝেছিস।
বিশ্বনাথদার চিঠি নিয়ে আমি আর চিতু এক দুপুরে গড়ের মাঠে ক্রিকেট ক্লাব অফ হাটখোলার তাঁবুতে হাজির হলাম। মাঠে চারটি ক্লাবের চারটি নেট পড়েছে। প্রতি নেটে গড়ে দশজন। চিতু বলল, কোনটা সি সি এইচ-এর হবে বল তো?
আমি অত্যন্ত মনোযোগে চারটি নেট লক্ষ করে শেষে বললাম, ওই ডানদিকেরটা—- যেখানে টাকমাথা, ঢলঢলে প্যান্টপরা, বেঁটে কালো লোকটা কথা বলছে, ওই বোধ হয় ননীদা।
কী করে বুঝলি?
প্যান্টটা দেখ, মনে হচ্ছে নাকি ওটা ফকিরবাবুর আমলের তৈরি? আর কেউ কি অমন প্যান্ট পরে এখানে আছে?
চিতু সারা মাঠে চোখ বুলিয়ে বলল, চল তা হলে ওর কাছে।
আপনিই কি ননীবাবু? চিতু কাছে গিয়ে খুব স্মার্টলি লোকটিকে বলল।
ব্যাট হাতে লোকটি তখন চশমাপরা রোগা ফরসা একটি ছেলেকে নেটের বাইরে থেকে বোঝাচ্ছিল কীভাবে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলতে হয়। ছেলেটি তটস্থ হয়ে শুনছে। লোকটি বাধা পেয়ে বিরক্ত চোখে একবার চিতুর দিকে তাকাল মাত্র। ছেলেটিও তাকাল।
লুক হিয়ার। লোকটির বাজখাঁই কণ্ঠস্বরে ছেলেটির সঙ্গে আমিও চমকে উঠলাম। চিতু এক-পা পিছিয়ে এল।
এই হচ্ছে স্টান্স। লোকটি দেখাতে শুরু করল। লেফট শোলডার থাকবে এইভাবে, আমার পা লক্ষ করো, শরীরের ওজন সমানভাবে দুপায়ে চারিয়ে দিয়েছি, বোলারের দিকে মুখটা…ভাল কথা, তুমি লেফট-হ্যান্ডার না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ছেলেটি ঢোঁক গিলে বলল।
গুড, ভেরি গুড। আমি একটা লেফট-হ্যান্ডারই চাইছি। হ্যাঁ, তা হলে হবে রাইট শোলডার। বোলার বল করতে আসছে…এখন ডেলিভারি স্টাইলে, দ্যাখো ভাল করে দ্যাখো…এইভাবে ব্যাট উঠছে, ব্যাক লিফট কমপ্লিট…তারপর কী করবে?
ফরোয়ার্ড খেলব। ছেলেটি প্রবল উৎসাহে চটপট বলল। লোকটি সেকেন্ড পনেরো ওর মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইল, যেন চাঁদের নুড়ি দেখছে। তারপর ধীরস্বরে বলল, গবেট। ছেলেটির ফরসা মুখ লাল হয়ে উঠল।
আমি কি বলেছি বলের ডেলিভারি হয়েছে? বল এখন তো বোলারের হাতে! উইকেটের পেস কেমন, বাউন্স কেমন তাই জান না, আর আগে থেকেই বলে দিলে ফরোয়ার্ড খেলব?
আপনি ফরোয়ার্ড কীভাবে খেলতে হয় শেখাচ্ছেন তো, তাই বললুম। ছেলেটি প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল। লোকটি আবার সেকেন্ড পনেরো তাকিয়ে থেকে বলল, বলটা শর্ট পিচ কি ওভার পিচ, স্টাম্পের মধ্যে না বাইরে, কতটা সুইং বা কতটা স্পিন, এসব না দেখেই ফরোয়ার্ড খেলবে?
ছেলেটির ভ্যাবাচাকা মুখ দেখে চিতু হাসি সামলাতে পারল না। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের তর্জনীটি চিতুকে লক্ষ্য করে বাঁকিয়ে ঘুড়িতে টুঙ্কি দেবার মতো তিনবার নেড়ে বলল, কাম হিয়ার।
চিতু খুব স্মার্ট ছেলে। সঙ্গে সঙ্গে সে বিশ্বনাথদার চিঠিটা এগিয়ে ধরল। আপনিই যে ননীবাবু, তা দেখেই বুঝে গেছি।
বটে, লোকটি চিঠিটা পড়তে পড়তে বলল, বুঝে গেছ?
আমি নয়, মতিই আপনাকে চিনেছে ঢোলা প্যান্টটা দেখে।
ননীদা সেকেন্ড দশেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেমন ভয়-ভয় অস্বস্তি শুরু হল আমার, চিতুটার উপর রাগও ধরল। ফোঁপরদালালি করে এত কথা বলার কী দরকার! ননীদা কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছেন, চিতু অমনি বলল, আমার নাম চিত্তপ্রিয়, আই অ্যাম এ লেফট-হ্যান্ডার।
ননীদার খোলা ঠোঁট দুটি একটা ফাস্ট ইয়র্কারকে সামাল দেবার মতো ঝটিতি বন্ধ হয়ে গেল।
অ্যান্ড অ্যান ওপেনিং ব্যাট লাইক নরি কন্ট্রাক্টর। চিতু বুক চিতিয়ে বলল। কন্ট্রাক্টর তখন দারুণ খেলছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আগের বছরই একটা সেঞ্চুরি করেছে টেস্টে।
তোমার লোয়েস্ট রান কত?
চিতু একটু থতমত হলেও বেশ দ্রুতই বলল, ঠিক মনে পড়ছে না, তবে দশের কম নয়।
কটা জিরো করেছ?
একটাও না।
লক্ষ করলাম ননীদার ঠোঁট দুটো এবার ফুলটস দেখে ব্যাট তোলার মতো খুলতে শুরু করল এবং সপাটে পুল করল—তার মানে এখনও খেলাই শেখোনি।
অবধারিত বাউন্ডারি, সুতরাং রানের জন্য দৌড়বার দরকার নেই, এইরকম ভঙ্গিতে ননীদা চিতুর দিকে পিছন ফিরলেন এবং এতক্ষণ অপেক্ষমাণ ছাত্রটিকে উদ্দেশ করে বললেন, ব্যাট যখন ওপর থেকে নামবে একদম পারপেন্ডিকুলার, স্ট্রেট নামবে। এসো দেখাচ্ছি।
নেটের মধ্যে ননীদা যখন একটা বল গুড লেংথ বরাবর পিচের উপর রেখে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলার মহড়া দিচ্ছিলেন, তখন চিতুকে বললাম, এখানে পেঁয়াজি করিসনি, লোকটা কড়া আর খেলাও বোঝে। চিতু তাচ্ছিল্যভরে কাঁধ ঝাঁকাল।।
ননীদা নেট থেকে বেরোলেন। তাঁবুর লোহার ফেন্সিংয়ের ধারে একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে ছাত্রটিকে বললেন, ওখানে গিয়ে যেমনটি দেখালুম, ঠিক সেইভাবে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভের শ্যাডো প্র্যাকটিস করো পঞ্চাশবার, যাও। তারপর চিতুর দিকে ফিরে বললেন, ইয়েস মিস্টার নরি কন্ট্রাক্টর, প্যাড অন।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, তোমার নাম মতি, ফাস্ট বল করো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। এবং নিমেষে লিন্ডওয়ালকে হুক করার জন্য প্রয়োজনীয় ফুটওয়ার্কের দ্রুততায় যোগ করলাম, মানে চেষ্টা করি।
দেখি কেন চেষ্টা করো। যাও কন্ট্রাক্টরকে বল করো।
এইবার আমার উভয় সংকট। চিতু আমার বলে সুবিধা করতে পারে না, বিশেষ করে শর্টলেংথগুলো। যদি তেড়ে বল করি তা হলে ননীদার সামনে চিতুর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়বে। হয়তো সি সি এইচ এ ওকে নেবেই না। আবার আমি যদি চিতুর মুখ চেয়ে ঢিলে বল করি, তা হলে আমাকেই হয়তো আউট হতে হবে। মাঝামাঝি পথ নিলাম। যত জোরে পরি উইকেটের বাইরে দিয়ে বল করতে লাগলাম। বলের পেস কেমন ননীদা সেটুকু বুঝলেই হল।
নেটের পিচ খুবই খারাপ। কয়েকটা বল বিশ্রীভাবে লাফিয়ে উঠল, শুট করল। চিতু ডাইনে বাঁয়ে গাঁহতির মতো ব্যাট চালাল। যেগুলো ব্যাটে-বলে হল তার বেশির ভাগই ব্যাটের কানায় লেগে শ্লিপ বা উকেটকিপারের (যদিও নেটে কেউ ছিল না) মাথার উপর দিয়ে নেট টপকে গিয়ে মহমেডান মাঠের বেড়ায় ঠকাস ঠকাস শব্দ করল।
আড়চোখে ননীদার দিকে তাকালাম। দেখি, একদৃষ্টে তিনি নভেম্বর আকাশের শোভা নিরীক্ষণ করছেন। নেটের মধ্যে কী হচ্ছে না-হচ্ছে সে সম্পর্কে উদাসীন। ফেন্সিং-এর ধারে ননীদার ছাত্রটি সমানে টিউবওয়েল হ্যান্ডেল টেপার মতো ব্যাট হাতে সামনে ঝুঁকে ওঠানামা করে যাচ্ছিল। পাম্প করা থামিয়ে এখন সে ফ্যালফেলিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে। ননীদা তাঁর দৃষ্টি আকাশ থেকে আকাশবাণী ভবনের চূড়া এবং তারপর ইডেনের প্রেসবক্স হয়ে মোহনবাগান মাঠের সবুজ গ্যালারির উপর রেখে বাজখাঁই গলায় বললেন, কটা হল?
বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছিলাম। থমকে বললাম, গুনিনি তো!
ননীদা আর একটু গলা চড়িয়ে বললেন, পঞ্চাশটা হয়েছে?
সঙ্গে সঙ্গে ফেন্সিং-এর ধারে দ্রুত টিউবওয়েল পাম্প শুরু হল। ননীদার আঙুলের তিনটি টুঙ্কিতে চিতু নেট থেকে বেরিয়ে এল।
উই ডোন্ট প্লে ফর ফান। ক্রিকেট একটা আর্ট, আয়ত্ত করতে সাধনা লাগে। দুরকমের ক্রিকেটার হয়, একদল ব্যাটকে কোদাল ভাবে, বাকিরা ভাবে সেতার। একদল কুলি, অন্যরা আর্টিস্ট।
পিচ যদি কোদাল চালাবার মতো হয় তা হলে ব্যাটকে কোদালই করতে হয়। প্যাড খুলতে খুলতে চিতু বলল।
ননীদার মুখ থমথমে হয়ে গেল। আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, উইকেট-সোজা। বল করবে আর লেংথে বল ফেলবে, কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো, লেংথ আর ডিরেকশন। এ দুটোয় কমান্ড আনতে না পারলে বোলার হতে পারবে না। শুধু তখনই এই দুটো জিনিস ভুলবে যখন কুলিরা ব্যাট করবে। সোজা মাথা টিপ করে তখন বল ছাড়বে। তুমি কাল থেকে নেটে আসবে রেগুলার। আর, ওহে কন্ট্রাক্টর, তুমি অন্য ক্লাব দেখতে পারো।
ননীদা কথা শেষ করেই তাঁবুর দিকে হনহনিয়ে চলে গেলেন। চিতুর জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়াতে। অপমানে চিতুর মুখটা তখনও বেগুনি হয়ে আছে। ওকে বললাম, চল বরং অন্য ক্লাব দেখি আমরা। ঢের ঢের ক্লাব আছে গড়ের মাঠে।
চিতু গোঁজ হয়ে রইল। ননীদার ছাত্রটি চুপ করে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। চশমার কাচ রুমালে মুছতে মুছতে বলল, প্রথম দিন আমায় বলেছিলেন বছর তিনেক দুর্যোধনের সঙ্গে পিচে জল দেওয়ার কাজ করতে। তাতে যদি ক্রিকেট সম্পর্কে কিছু। জ্ঞান হয়।
তারপর পাঁচ বছর রোলার টানার কাজ! চিতু তিক্তস্বরে মন্তব্য করল। ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমিও খুব বিরক্তিপূর্ণ ভঙ্গিতে বললাম, এই রকম একটা পাগলের কাছে আসতে হবে জানলে, কে আর আসত। ভাবা যায়, ব্যাট নিয়ে পঞ্চাশবার করে করে ওঠানামা করা?
কাল ব্যাক লিফট শিখেছি, গুনে একশোবার ব্যাট তুলতে হয়েছে আর নামাতে হয়েছে।
বলেন কী! আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর ড্রাইভ, হুক, কাট, পুল এসবও কি পঞ্চাশবার একশোবার ওইভাবে করতে হবে?
শিউরে উঠে ছেলেটি বলল, না, না, তারও আগে ফিলডিং শিখতে হবে বলেছে। কমপ্লিট ক্রিকেটার তা না হলে হওয়া যায় না। দুশো থ্রো আর দুশো ক্যাচ লোফা,
রো-ও-জ।
রানিং বিটুইন দ্য উইকেট? আমি ওকে ভয় পাওয়াবার জন্য বললাম। প্যাড পরে ব্যাট হাতে একশোবার ছোটাছুটি করতে হবে না?
চিতু এবার বিরক্ত স্বরে বলল, বাজে কথা রাখ তো, এভাবে উজবুকেরাই খেলা শেখে।
এর পর চিতু আমাকে ফেলেই রেড রোড অভিমুখে চলে গেল। পরদিনই সি সি এইচ এর চির প্রতিদ্বন্দ্বী রূপোলি সঙ্ঘের সম্পাদকের সঙ্গে সে দেখা করল। আমি কিন্তু হাটখোলাতেই রয়ে গেলাম। ননীদার ছাত্রটির সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। ওর নাম অঞ্জন কর। বড়লোকের ছেলে। ক্রিকেটের বই অনেক পড়েছে। ব্র্যাডম্যানের আর্ট অফ ক্রিকেট বইটা পড়ে প্রচুর জ্ঞান সংগ্রহ করে ফেলেছে কিন্তু ক্রিকেট কখনও খেলেনি। তাই প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং নিতে এসেছে ননীদার কাছে, বড় খেলোয়াড় হবার মোটেই ইচ্ছে নেই। ভদ্র এবং লাজুক অঞ্জন আমাকে একবার বলেছিল, খুব ইচ্ছে করে নেভিল কার্ডাসের মতো লেখক হতে। ওর সব বই আমার পড়া হয়ে গেছে। আমি তখনও কার্ডাসের নাম জানতাম না, তাই বোকার মতো শুধু হেসেছিলাম আর মনে মনে বলেছিলাম, ছেলেটা আমারই বয়সি, কিন্তু পণ্ডিত। ওকে আমার ভাল লাগে এইজন্য যে, অনেক জেনেও চালিয়াত নয়, বাজে তর্ক করে না এবং ক্রিকেটে তার যে কিছুই হবে না, অকপটে তা স্বীকার করে। অঞ্জন এরপর এনজিনিয়ারিং পাশ করে বিলেত যায়। ফিরে এসে এখন দুর্গাপুরে বড় চাকরি করছে। সি সি এইচ-এর সঙ্গে ওর সংযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি। ক্রিকেটকে ও সত্যিই ভালবাসে।