Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নতুন দ্বীপ || Sukanta Gangopadhyay

নতুন দ্বীপ || Sukanta Gangopadhyay

কলেজ স্ট্রিটে জীবনে মাত্র কয়েকবারই এসেছে তপন। এলাকাটা তাই তার কাছে একটু ধাঁধার মতন। চার রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়েছে বাস, বুঝে উঠতে পারছে না খেলার সরঞ্জাম বিক্রির দোকানগুলো কোন দিকে। দিন পাঁচেক আগে এসে ওই দোকানগুলোর একটাতে ট্রফি পছন্দ করে গেছে। মায়ের নাম লিখতে দিয়েছে নীচে। আজ ডেলিভারি নিয়ে সোজা চলে যাবে বসিরহাট। তপনের দেশের বাড়ি। ওখানে যুবক সঙ্ঘের পরিচালনায় ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে, আজ ফাইনাল। বিকেল চারটেয় খেলা শুরু। মায়ের নামে ট্রফিটা কোন দল পাবে রানার্স না উইনার্স, এখনও জানে না তপন। যুবক সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট কাশীদা বলেছে, ট্রফিটা নিয়ে আয় আগে তারপর ঠিক করব। তপনের ইচ্ছে ছিল ফাইনালের আগের দিন মানে শুক্রবার প্রাইজটা নিয়ে দেশের বাড়ি যাবে। দু’দিনের ছুটি পাওয়া গেল না অফিসে। আজকের দিনটাই পেয়েছে। সকালে ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। অনেকটা সময় গেল সেখানে। বাড়ি থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গেছে তপনের। এখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে, খেলা শুরু হওয়ার আগে বসিরহাট পৌঁছাতে পারলে হয়। সময়ের এই টানাটানির মধ্যে দোকানটা আবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আশপাশ দিয়ে গম্ভীরমুখো ব্যস্ত পথচারীদের ভরসা করে জিজ্ঞেসও করে উঠতে পারছে না তপন। রাস্তা ক্রস করে ফাঁকা দেখে একটা দোকান খুঁজছে।

পাওয়া গেল একটা বিয়ের কার্ডের দোকান। তপন দোকানিকে জিজ্ঞেস করল, খেলার জিনিসপত্তরের দোকানগুলো কোন দিকে? যথেষ্ট গোলমেলে উত্তর দিল দোকানি। বলল, ঠিক রাস্তায় এসেছেন। একটু এগিয়ে যান, এপার ওপার দু’পারেই দোকান আছে।

যে ফুটপাতে ছিল তপন, সেটা ধরেই এগোয়, চোখ রাখে দু’পারে। যা প্রায় অসাধ্য কাজ, সরু দোকানটা ইজিলি চোখের বাইরে থেকে যেতে পারে। অ্যাডভান্স দুশো টাকা দেওয়া ছিল। রিসিটও দিয়েছিল দোকানদার। যাতে লেখা ছিল দোকানের নাম। সেটি হারিয়ে বসে আছে তপন। ভেবেছিল, দরকারটাই বা কী, মায়ের নাম লেখা ট্রফি দোকানে একটাই থাকবে। নামটা বলতে পারলে জিনিসটা দিয়ে দেবে দোকানদার। তখন তো জানত না দোকানটা চিনে ওঠাই তার কাছে কতটা সমস্যার হয়ে যাবে। এদিকে টাইম চলে যাচ্ছে হু হু করে।

তপনের বাঁ বাশে এখন পরপর চারটে স্পোর্টস গুডসের দোকান, শোকেসে নানা ধরনের ট্রফি। চোখ বোলাতে বোলাতে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে কে যেন ডেকে ওঠে, সরলাবালা রায়!

মায়ের নাম। ঘুরে তাকায় তপন, পেছনের প্রথম দোকানের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন এক ভদ্রলোক। উনিই নামটা ধরে ডাকলেন। তপন চিনতে পারে দোকান মালিককে। ভদ্রলোক হাসছেন। বললেন, কী হল চিনতে পারছিলেন না দোকান?

তপন হাসিমুখে এগিয়ে আসে, বলে, ভাগ্যিস ডাকলেন। নইলে খুঁজে পেতে আরও দেরি হয়ে যেত।

দোকানে ঢোকার আগে তপন জানতে চায়, জিনিসটা রেডি তো?

একদম রেডি। বলে কাউন্টারের ভেতরের দিকে চলে যান ভদ্রলোক। ট্রফিটা নিয়ে এসে রাখেন তপনের সামনে। ঝকঝক করছে সোনালি রঙের ট্রফি। নীচটা কাঠের, কালো রং করা। মেটাল প্লেটে লেখা, সরলাবালা রায় চ্যালেঞ্জার ট্রফি। কাঠের বেদির ওপর দু’ইঞ্চির পাইপ তারপর গোল প্লেট, সেখানে মায়ের ছবি। আবার পাইপ, ওপরে ফুটবল। সেটাকে ধরে আছে চারটে আলাদা পাত। খরচ পড়ল ন’শো টাকা। ট্রফিটা দেখে দামটা তুচ্ছ লাগছে। নয়তো সাড়ে তিন হাজার মাইনে পাওয়া তপনের কাছে টাকাটা অনেক। দোকান মালিক বলে, পছন্দ হয়েছে? বানান টানানগুলো একবার দেখে নিন।

সব ঠিক আছে। আপনি তাড়াতাড়ি প্যাক করে দিন। বহুৎ দেরি হয়ে গেল আমার। বলে বাকি সাতশো টাকা পার্স থেকে বার করে দেয় তপন।

ট্রফিটা কাগজে মুড়ে তপনের রেখে যাওয়া মায়ের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফটোগ্রাফটা ফেরত দিয়ে দোকান মালিক বলে, আবার আসবেন। চেনাজানাদের বলবেন আসতে। ঘাড় হেলিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে তপন। সামনেই একটা শিয়ালদার বাস, উঠে পড়ে। শিয়ালদায় গিয়ে এখন আর ট্রেন পাওয়া যাবে না। বাসে করেই যেতে হবে দেশের বাড়ি।


বসিরহাটগামী বাসে করে তপন চলে এসেছে বেড়াচাঁপায়। হাতে এখনও এক ঘণ্টা আছে। প্রপার বসিরহাটে নামবে না তপন, একটা স্টপেজ আগেই নেমে পড়বে, খোলাপোতায়। এখানেই তাদের আদি বাড়ি। কলকাতার কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, বাড়ি বসিরহাটে। খোলাপোতা বললে অনেক বোঝাতে হয়। বাড়ি অবশ্য এখন আর নেই। মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাওয়ার পরেই বাড়ি এবং সংলগ্ন চারকাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছিল তপন। মায়ের তেমন সায় ছিল না ভিটেমাটি বিক্রি করার। তপন বুঝিয়ে ছিল, তুমি এবার থেকে কলকাতায় আমার সঙ্গেই থাকবে। এখানে আর কেউ রইল না। ফাঁকা জমি বাড়ি দখল হয়ে যাবে একদিন।

মা মানতে চায়নি। বলেছিল, কেন, গ্রামের লোক, আত্মীয়স্বজন বাড়ি জমি পাহারা দেবে। তারা তো সব আমার আপন জন। ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে এসে এখানে থাকতে পারব।

মা জানত না, ইচ্ছে থাকলেও মায়ের শরীর এখানে এসে পৌঁছোতে পারবে না। ক্যান্সার

হয়েছিল মায়ের। তপন মাকে খোলাপোতা থেকে নিয়ে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে মা মারা যায়। গ্রামের বাড়ি ছাড়তে চাইত না মা। তপন কলকাতায় চাকরি করতে যাওয়ার পর একা একা দশ বছর কাটিয়েছে। ভরসা পাড়ার লোক আর কিছু দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজন। একমাস অন্তর তপন এসে মাকে দেখে যেত। কখনও সঙ্গে আনত ছেলে বউকে। তপন একবার এসে দেখে, মা ভীষণ অসুস্থ। পুরোপুরি বিছানায় শোয়া। পরিচর্যা করছে পাশের বাড়ির কাকিমা। তপন মাকে বলেছিল, এত শরীর খারাপ, তুমি আমায় খবর দিলে না কেন?

বিছানায় শুয়ে থাকা মা কষ্ট করে হেসে বলেছিল, অন্যান্যবার তো সুদর্শনের ওষুধে সেরে যায়। এবার এত বাড়াবাড়ি হবে, কী করে জানব!

সুদর্শন গ্রামের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। চিকিৎসা ভালই করে। মায়ের ঠিক কী হয়েছে জানতে তপন গিয়েছিল ওর কাছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ নিয়ে সুদর্শন তখনই জানায়, মনে হচ্ছে মাসিমার ক্যান্সার হয়েছে, ওষুধ রেসপন্ড করছে না। তুই নিজের কাছে রেখে ডাক্তার দেখা।

তারপরও মা এক বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছে। জানতেও পারেনি অসুখ খেয়ে নিচ্ছে জমি বাড়ির টাকা। হাসপাতালের বেডে শুয়ে বলত, আমি আর সারব না বুঝলি। তুই আমাকে দেশের বাড়িতেই রেখে আয়। ওখানে মরলে শান্তি পাব বেশি। দেশে ফেরা হয়নি মায়ের। আজ ট্রফি হয়ে ফিরছে।

স্বরূপনগরে এসে বাসটা জ্যামে পড়ে গেল। সিটে বসে ঘড়ি দেখে তপন, তিনটে পনেরো। চারটে বাজার দশ-পনেরো মিনিট আগে পৌঁছোনোর দরকার স্টেজে সাজানো হবে ট্রফি, বারবার মায়ের নাম ঘোষণা করবে মাইকে। গ্রামের বয়স্করা মনে মনে বাহবা দেবে তপনকে, জমিবাড়ি বিক্রি করে দিলেও তপন মায়ের নামটা গ্রামের আলোবাতাসে রেখে যেতে পারছে। এই সূত্রে অনেকের মনে পড়ে যাবে, তপন একসময় খুব ভাল ফুটবল খেলত। আন্ডার হাইটে প্রচুর মেডেল পেয়েছে। ছাত্র বয়সে আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় বহুবার তাদের হরিশপুর হাই স্কুলকে চ্যাম্পিয়ন করেছে তপন। খেলত রাইট আউট পজিশনে। খেলায় ছেদ পড়ে গেল আচমকা বাবা মারা যাওয়ায়। খোলাপোতায় এক আড়তদারের হিসাব রক্ষক ছিল বাবা। মাইনে বেশি ছিল না। তবু কোনওরকমে চলে যেত সংসার। বাবা শুধু মাঝে মাঝে মায়ের কাছে অনুযোগ করত, ছেলেকে বলো এবার থেকে একটু রোজগারপাতির চেষ্টা করতে। জিনিসপত্তরের যা দাম বাড়ছে, একা আর টেনে উঠতে পারব না।

মা এ কান দিয়ে কথাগুলো শুনে ও কান দিয়ে বার করে দিত। উলটে তপনের জন্য ডিম, মাছ, দুধ, ছোলার জোগান দিয়ে যেত গোপনে। বলত, আরও ভাল খেলতে হবে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলে খেলবি। কাগজে যেন নাম বেরোয় তোর— তপনের মেডেলগুলো প্রায়শই মোছামুছি করে রাখত মা। নতুন কোনও পুরস্কার পেলে, পাড়ায় দেখাতে নিয়ে বেরোত। বাবা অবাক, আমাদের বংশে কেউ কোনওদিন খেলাধুলো সেভাবে করল না। এই ছেলেটা এত গুণ পেল কোথায়? এত শক্তিই বা পায় কোথা থেকে। এই তো আমাদের খাওয়া দাওয়া।

মা হাসত মিচকি মিচকি। হাসিটা কেড়ে নিল বাবা। চারদিনের জ্বরে চলে গেল দুনিয়া ছেড়ে। হায়ার সেকেন্ডারির মাঝ পথে পড়া ছেড়ে তপন চাকরিতে জুতে গেল। বড়মামা কলকাতার এক ওয়ার হাউস কোম্পানিতে ঢুকিয়ে দিল। তপন এখন গুদাম ঘরের পাহারাদার। বোড়ালের কাছে বাড়িভাড়া করে থাকে। বিয়েটা হয়েছে কলকাতাতেই মামার দেখে দেওয়া মেয়েকে৷ মা বিয়ে দিয়ে ফিরে গিয়েছিল নিজের ভিটেতে। যতদিন খোলাপোতায় ছিল মা, দেশের বাড়ির প্রতি টান ছিল তপনের। মা মারা যাওয়ার পর আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের বাড়ি না থাকলেও তপনের এখানে থাকার জায়গা অনেক। বন্ধু, আত্মীয় পরিজনরা তাকে মাথায় করে রাখে। অভিমান জানায় এখানকার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য। হয়তো আজকের মায়ের নামে ট্রফিটা তাদের অভিমানকে কিছুটা হালকা করে দেবে। ওইসব চেনা পরিচিতিদের কথা ভেবেই তপন গত বারের পুজোতে নবমীর দিন খোলাপোতায় এসেছিল। সরকারবাড়ির ঠাকুরদালানে তখন মিটিং চলছে। সভা ডেকেছে কাশীদা। এলাকার অনেকের ইচ্ছে খোলাপোতায় এবার একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট হোক। বড়সড় খেলাধুলো বেশির ভাগ বসিরহাট, বারাসাতেই হয়। কাশীদা এলাকার বিধায়ক হলেও, রাজনীতির বাইরে তার একটা আলাদা ইমেজ আছে। বিরোধী দলের লোকেরাও তাকে যথেষ্ট পছন্দ করে। কাশীদা কোনও কিছুর উদ্যোগ নেওয়া মানে কাজটা বেশ জাঁকজমক করেই হবে। মিটিং-এ তপনকে পেয়ে কাশীদা যেন আরও এনার্জি পেল, এই তো তপন এসে গেছে। ওর থেকেই জেনে নেওয়া যাক টুর্নামেন্টটা কেমনভাবে সাজানো হবে। এখানে দীর্ঘদিন খেলে গেছে তপন। আশপাশের গ্রামের টিমগুলোর পালস এবং চাহিদার ব্যাপারটা মোটামুটি আন্দাজ দিতে পারবে।

মিটিং এ বসে তপন নিজের সমস্ত অভিজ্ঞতা উজাড় করে দিয়েছিল। সব শেষে বলে আমার একটা অনুরোধ, এই টুর্নামেন্টের উইনার্স কাপটা আমার মায়ের নামে হোক। ট্রফিটা আমি দেব।

প্রস্তাবটা শুনে ভাবতে একটু সময় নিয়েছিল কাশীদা। মিটিং-এর অন্যান্যরা ততক্ষণে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। কাশীদা বলল, উইনার্স কাপটা হাতে থাক। এমন হতে পারে এখানকার কোনও ব্যবসায়ী ওটা দিতে রাজি হল, সঙ্গে থোক কিছু ডোনেশান। সেই টাকাটা টুর্নামেন্ট

চালাতে কাজে লাগবে। আলাদা ডোনেশান দেওয়া চাপের হয়ে যাবে তোর পক্ষে। কাশীদা ঠিকই বলেছিল। তপন তখন বলে, মায়ের নামের ট্রফিটা তা হলে রানার্সদের জন্য থাক।

মোটামুটি ধরে নে তাই। টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার এক মাস আগে আমাকে একটা ফোন করিস। তখন তোকে সিদ্ধান্ত কী হল জানিয়ে দেব।

সেই মিটিং-এ ঠিক হয় টুর্নামেন্ট শুরু হবে মে মাসে। মাঠের ধান কাটা হয়ে গিয়ে গ্রামের লোক তখন ফ্রি। ফাইনাল হবে জুনে। এপ্রিল মাসে মনে করে কাশীদাকে ফোন করেছিল তপন। কাশীদা তখন বলে, এখনও উইনার্স কাপের পার্টি পাওয়া যায়নি। হয়তো তোর কাপটাই উইনার্সদের কাছে যাবে। তুই আমাকে ফাইনালের পনেরো দিন আগে একবার ফোন কর।

করেছিল তপন। কাশীদা বলল, দুটো পার্টি পেয়েছি। ডোনেশান নিয়ে টালবাহানা চলছে। তপন জানতে চায়, কাপটার নীচে আমি তা হলে কী লেখাব?

সরলাবালা রায় চ্যালেঞ্জার ট্রফি লিখিয়ে নিয়ে আয়। রানার্স উইনার্স যে-কোনও দলকেই দেওয়া যাবে। বলেছিল কাশীদা। তপন কথা মতো কাজ করেছে। ধরেই নিয়েছে মায়ের নামের কাপটা রানার্সরাই পাবে। পাক। একটা টুর্নামেন্টে রানার্স হওয়াও কম বড় কথা নয়। অনেক দলকে হারিয়ে ফাইনালে আসতে হয়। কিন্তু চিন্তা হচ্ছে একটাই তপনের কাপটা যদি উইনার্স কাপের চেয়ে বড় হয়ে যায়, কাশীদা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বে। কাপটা কিনতে কোনও কার্পণ্য করেনি তপন।

গঞ্জের হাটবাজারে এসে পড়ল বাস। বাতাসের গন্ধ নাকে আসতেই তপন টের পায় খোলাপোতা এসে গেছে। কন্ডাক্টারও স্টপেজের নাম ধরে চেঁচাতে শুরু করল। কাগজ মোড়া ট্রফি সুদ্ধ বাস থেকে নেমে এল তপন।

বাজার এলাকাটা আজ একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যেহেতু পাইকারি বাজার, এটা দুপুরেও খোলা থাকে। সবাই কি খেলা দেখতে চলে গেল? হাতে এখনও কুড়ি মিনিট। হাওয়ায় ভাসছে মাইকের গান, মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হল বলিদান। লেখা আছে অশ্রুজলে… সুরের হাত ধরে স্কুলমাঠের দিকে এগোতে থাকে তপন। এখনই হয়তো অ্যানাউন্সমেন্ট হবে, যুবক সঙ্ঘের পরিচালনায় ফুটবল টুর্নামেন্ট আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। অমুক চন্দ্রের স্মৃতি রক্ষার্থে উইনার্স কাপ, সরলাবালা রায় চ্যালেঞ্জ ট্রফি পাবে রানার্সরা… এত ডিটেলে ঘোষণা হচ্ছে না। গান থামিয়ে ক্লাবের নামটাই বারবার বলছে ওরা। বলুক। একটা সময় কাপ শিল্ডের কথা তুলতেই হবে।

হরিশপুরের রাস্তায় ঢুকতেই স্কুলবাড়ির সামনের মাঠটা দেখা গেল। থিকথিক করছে ভিড়। বেশ বড় করে তৈরি হয়েছে পুরস্কার মঞ্চ। বসিরহাটের নেতাজি সঙ্ঘের টুর্নামেন্টও এত জাঁক করে হয় না। এই হল কাশীদার ক্যারিশমা।

রাস্তা থেকে নেমে মাঠ ধরে এগিয়ে যায় তপন। ডানহাতে যত্ন করে ধরা আছে মায়ের নামাঙ্কিত ট্রফি। স্টেজের কাছে গিয়ে প্রথমেই যেটা দেখতে হবে ট্রফিটা রানার্স পাবে, নাকি উইনার্স?

ভিড় ঠেলে মঞ্চের সামনে এসে পুরোপুরি ধাঁধা লেগে গেল তপনের। স্টেজের ওপর কাপড় ঢাকা বেঞ্চ, তার ওপর ছোট বড় অনেক ক’টা ট্রফি। কোনটা কার উদ্দেশে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ছোট ছোট অনেক মেডেলও দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে আবার ডিভিডি, প্রেশার কুকার… এত সব দেখে কেমন একটু হীনম্মন্যতা জাগে তপনের। তার ট্রফিটা কি পাত্তা পাবে ওই বেঞ্চে? একটাই শুধু আশার কথা, সবচেয়ে বড় যে ট্রফিটা দেখা যাচ্ছে তার পাশেরটা বেশ ছোট। অন্তত তপনের হাতের ট্রফির থেকে তো বটেই। এর থেকেই আন্দাজ করে নেওয়া যায় কাশীদা তপনের ট্রফিটা রানার্সদের জন্যই ধরে রেখেছে। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে ফাইনালে ওঠা দুটো ক্লাবের নাম, মদিনা খোলাপোতা বনাম দোলা নবারুণ। দুটোই অচেনা নাম, শুনতেও অদ্ভুত। তপনদের সময় এ ধরনের নাম শোনা যেত না। তপন খেলত খোলাপোতা বালক সঙ্ঘে।

ঘোষণায় কান না দিয়ে তপন খুঁজতে থাকে কাশীদাকে, ট্রফিটা হ্যান্ডওভার করার পর নিশ্চিন্ত হবে। মঞ্চের আশপাশে চোখ বোলাতেই দৃষ্টির মধ্যে এসে পড়ে কাশীদা। কোন এক অতিথিকে স্টেজে তুলে দিচ্ছে। দৌড়ে যায় তপন। গেস্ট মঞ্চে উঠে যাওয়ার পর কাশীদার কনুই ধরে টানে। ঘাড় ফিরিয়ে তপনকে দেখে কাশীদা বলে, ও তুই এসে গেছিস। যা গেস্টের চেয়ারে গিয়ে বস। একসময় এখানকার নাম করা প্লেয়ার ছিলি তুই।

সে না হয় হল। ওটাও তো এনেছি। বলে তপন।

কাশীদা অবাক হয়ে জানতে চায়, কোনটা?

মায়ের নামে ট্রফিটা

হঠাৎ খেয়াল পড়েছে ভঙ্গিতে কাশীদা নিজের কপালে চাপড় মেরে বলে, দেখেছ কাণ্ড, তোকে ফোন করব ভেবেও ভুলে মেরে বসে আছি।

তপন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাশীদার মুখের দিকে। কাশীদা ফের বলে, প্রবলেম কী হয়েছে জানিস। মাসিমার ট্রফিটা তো কাউকেই দেওয়া যাবে না। সেটাই তোকে ফোন করে বলতাম।

কেন দেওয়া যাবে না কেন? অসহায় বিস্ময়ে জানতে চায় তপন।

কাশীদা বলতে থাকে, উইনার্স কাপ দিচ্ছে বটতলা মোড়ের বাইকের ডিলার। সঙ্গে পাঁচ হাজার ডোনেশান। রানার্স ট্রফি তেলকলের মালিক অধীর ঘোষের প্রয়াতা স্ত্রীর নামে। ডোনেশান তিন হাজার। বুঝতেই তো পারছিস এ সব অনুষ্ঠান করতে কত খরচা। বিজনেসম্যানদের হেল্প না নিলে…।

কাশীদার কথা কান রিফিউজ করছে, এই পরিস্থিতিতে তপন যে খুব ভেঙে পড়েছে, তাও নয়। বড়লোকদের কাছে হেরে যাওয়ার অভ্যাস তার আছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে বলে, তুমি লুজার ট্রফিটা মায়ের নামে দাও। সেমি ফাইনালে যে দুটো দল হেরে গেছে, তাদের মধ্যে যারা জিতবে…।

সেটাও বুক হয়ে গেছে রে। দিচ্ছে এল আই সি এজেন্ট প্রশান্ত পাল। এক হাজার টাকা চাঁদা।

পড়ে রইল লুজার রানার্স ট্রফি। তাদেরকেই মায়ের ট্রফিটা দেওয়ার প্রস্তাব দেবে কিনা ভাবছে তপন। কাশীদা সেই রাস্তাও বন্ধ করে দিল বলল, সেমি ফাইনালিস্টদের ম্যাচে যে দল হারবে, মাসিমার ট্রফিটা তাদেরই দেব ভেবে রেখেছিলাম। শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এসে খুব করে ধরল। ট্রফিটা যদিও খুব ছোট দিয়েছে, তবে আজ গেস্টদের মিষ্টির প্যাকেটের দাম নেবে না।

ম্যাচের শুরুতেই গোল খেয়ে যাবার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে তপন। কাশীদা ওর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার কণ্ঠে বলে, মন খারাপ করিস না। সামনের বছর মাসিমার ট্রফিটার একটা ঠিক বন্দোবস্ত করে ফেলব। তুই এখন স্টেজে বসে খেলাটা দেখ। তোর ক্লাবই তো উঠেছে ফাইনালে।

কপালে ভাঁজ পড়ে তপনের। বলে, কই, মাইকে তো নাম বলছে না। অ্যানাউন্স করছে মদিনা খোলাপোতা বনাম দোলা নবারুণ।

কাশীদা চওড়া হেসে বলে, আরে বাবা খোলাপোতা বালক সঙ্ঘই এখন মদিনা খোলাপোতা।

কেন নাম পালটাল হঠাৎ? জানতে চায় তপন।

কাশীদা বলে, মদিনা বিড়ি কোম্পানি ওদের জার্সি, বুটফুট দিয়েছে। শর্ত, ক্লাবের নামের সঙ্গে প্রোডাক্টের নাম জুড়তে হবে।

সূত্র মিলিয়ে তপন বলে, তা হলে কি দোলা হচ্ছে সেই নবারুণ ক্লাব? যাদের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই ফাইনালে দেখা হত।

একেবারে ঠিক ধরেছিস। দোলা সাবান ওদের খেলার সরঞ্জাম দিচ্ছে। শর্ত মদিনা বিড়ির মতোই।

মাঠে রেফারি হুইস্‌ল মেরে দুটো দলকে ডাকছে। অফিস থেকে ফেরার পথে এখনও কোনও মাঠ থেকে যদি এই আওয়াজ ভেসে আসে, রোঁয়া খাড়া হয়ে যায় তপনের। এখন হল না। কাশীদা বলল, তুই গিয়ে বস। আমি একটু ওদিকটা দেখি।

কাগজ ঢাকা মায়ের ট্রফিটা হাতে নিয়ে মঞ্চে উঠে যায় তপন। একদম শেষ সারির চেয়ারে বসে। চেনাজানা দু’-চারজনের সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে। তারা হাসছে, উৎসবের হাসি। তপনের মুখের হাসি নবমীর রাতের মতো। দেখতে দেখতে দুটো দল নেমে পড়ল মাঠে। খোলাপোতা ক্লাবের জার্সির পেছনে মদিনা বিড়ির ছবি। নবারুণ স্পোর্টিং-এর জার্সিতে দোলা সাবানের ছাপ। খেলা শুরু হল। বিড়ির ছাপের জন্যই কিনা কে জানে, খোলাপোতা ক্লাবকে একটু দমছুট লাগছে। নবারুণ স্পোর্টিং-এর প্লেয়ারগুলোও পদের নয়। জড়ামড়ির মধ্যে খেলা হচ্ছে। কোনও ভাল পাস নেই, শট নেই। কীরকম একটা গা জোয়ারি ভাব। তপনদের সময় খেলার স্ট্যান্ডার্ড অনেক ভাল ছিল। তখন কলকাতার মাঠেও জ্বলজ্বল করছে গ্রেট সব প্লেয়ার। তপনদের আইকন ছিল তারা। চেষ্টা করত তাদের মানে খেলতে। দশ মিনিটের বেশি দেখা গেল না খেলাটা। স্টেজ থেকে চুপিচুপি নেমে এল তপন। কেউ লক্ষ করেনি। সবার চোখ মাঠের দিকে।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তপন ভাবছে, কী করবে। ট্রফিটা নিয়ে ফেরত যাবে বাড়ি? খুবই অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হবে বউ মাধবীর কাছে। টানাটানির সংসারে ন’শো টাকার ট্রফিটা যখন অর্ডার দেয় তপন, মাধবীকে অজুহাত হিসেবে বলেছিল, কী করব বলো, গ্রামের লোক এমন করে ধরল, না বলতে পারলাম না। মাকে খুব ভালবাসত ওরা। মায়ের একটা স্মৃতি থাক ওদের কাছে।

এখন কী বলবে? মাকে ভুলে গেছে ওরা। বেখেয়ালে হেঁটে যাচ্ছে তপন। হাওয়ায় জলের গন্ধ। নদীর কাছে এসে পড়ল কি? হ্যাঁ, ঠিক তাই। তপন মুখ তুলে দেখে দূরে বয়ে যাচ্ছে ইছামতী। তপনদের গ্রামের নদী। খেলাধুলোর পর কতবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইছামতীর বুকে। ব্যথিত তপনকে সান্ত্বনা দিতে নদীই বোধহয় হাওয়ার মাধ্যমে ডেকে আনল।

ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় তপন। এখন জল কম। নদীর বুকে ইতস্তত জেগে উঠেছে চরা। তপনের চোখ যায় পার ঘেঁসে দূরের এক চরায়। বেশ কিছু বাচ্চা ছেলে ফুটবল খেলছে।

বারপোস্টও আছে তাদের। একজন বয়স্ক লোককেও দেখা যাচ্ছে মাঠের ধারে। হাত নেড়ে বাচ্চাগুলোকে নির্দেশ দিচ্ছেন।

কৌতূহলবশে তপন এগিয়ে যায় চরার দিকে। মিনিট দশেক হাঁটার পর জলে গোড়ালি ডুবিয়ে নতুন ঘাস গজানো চরায় এসে ওঠে। বাচ্চাগুলোকে যিনি কোচিং দিচ্ছেন, তপনেরই বয়সি। তপনকে দেখে এমনিই হাসেন। হাসি বিনিময় করল তপন। খানিকক্ষণ বাচ্চাদের খেলা দেখার পর তপন বুঝতে পারে এদের কোচ যথেষ্ট যোগ্য। ভদ্রলোকের উদ্দেশে তপন বলে, আপনি কি এ গ্রামে নতুন?

ঠিক নতুন নয়, বছর চারেক হয়ে গেল। হরিশপুর স্কুলের গেমটিচার হয়ে এসেছি। তপন বলে, স্কুল মাঠে তো আজ ফাইনাল খেলা চলছে, আপনি এখানে।

ধুর ধুর, ওটা কোনও ফুটবল খেলা নাকি? এতটুকু শিল্পের ছাপ নেই। ধুমধাড়াক্কা শট, গায়ের জোরের ফুটবল। আমার ছাত্ররা ওই খেলা দেখে ভুলভাল শিখবে বলে এখানে এসে ট্রেনিং দিচ্ছি। কথাগুলো বলে যাচ্ছেন ভদ্রলোক, শ্যেনদৃষ্টি কিন্তু মাঠের দিকে। কার উদ্দেশে যেন চেঁচিয়ে উঠলেন, এটা কোনও পাস হল। গাধা কোথাকার।

একটা ছেলে বল রিসিভে গন্ডগোল করে ফেলল। ভদ্রলোক বলে উঠলেন, শুভেন্দু, কান ধরে মাঠ থেকে বেরিয়ে আয়।

শুভেন্দু অবশ্য এল না। মুখের ভাবে বোঝাল সরি। ভদ্রলোক এবার তপনকে বললেন, আপনার পরিচয়টা তো জানা হল না।

আমি ছেলেবেলায় এই গ্রামেই কাটিয়েছি। হরিশপুর স্কুলে পড়তাম। নাম তপন রায়। আরে, আপনার কথা তো আমি শুনেছি। এখনও গ্রামের লোক বলাবলি করে, দারুণ

খেলতেন আপনি। তা আপনি স্কুল মাঠের খেলা ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন কেন? তপন বলে, আমারও ভাল লাগেনি ওদের খেলা। একটু বিরতি নিয়ে তপন ফের বলে, আপনাকে একটি রিকোয়েস্ট করব?

রিকোয়েস্টের কী আছে। কী বলবেন বলুন না। বলেন গেমটিচার।

কাগজের মোড়ক খুলে ট্রফিটা বার করে তপন। বলে, এটা আমার মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে বানিয়ে ছিলাম। স্কুলমাঠে এর জায়গা হল না। আপনি এটা রেখে দিন। যদি কোনওদিন কোনও ছোটখাটো টুর্নামেন্ট আশপাশের গ্রামে হতে দেখেন, এটা সেই ক্লাবকে দিয়ে দেবেন।

ট্রফিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন গেমটিচার। বললেন, দারুণ ট্রফি তো? ইনফ্যাক্ট আমিই ভাবছিলাম এ গ্রামে একটা আন্ডারহাইট টুর্নামেন্ট করব। ছোট বয়স থেকেই প্লেয়াররা আসলে উঠে আসে। ইদানীং আন্ডারহাইট টুর্নামেন্ট প্রায় হয়ই না।

বেশ তো, করুন না আপনি। বলে তপন।

গেমটিচার বলেন, ভালই হল। এই ট্রফিটা পেয়ে টুর্নামেন্টটা করার উৎসাহ পেলাম। কিন্তু আপনাকে খবর দেব কীভাবে? তপন বলে, আমিই স্কুলে ফোন করে খবর নিয়ে নেব। এখন চলি।

এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন?

হ্যাঁ, সেই কলকাতার শেষ প্রান্ত বোড়ালে ফিরতে হবে। বলে তপন ফের গোড়ালি ভিজিয়ে পারে গিয়ে ওঠে। বেশ কিছুটা দূর হেঁটে যাওয়ার পর একবার পেছন ফেরে, কী অপরূপ লাগছে চরাটা। বিকেলের হলুদ আলোয় ছোটাছুটি করে খেলছে বাচ্চা ছেলেগুলো। চরাটাকে মনে হচ্ছে যেন সোনালি মেডেল। নদী যেন তপনের মা। শুয়ে আছে স্বপ্নের মেডেল পরে। ওই দ্বীপ থেকে নিশ্চিত ভাবে উঠে আসবে আগামী দিনের প্লেয়ার।

শারদীয় কিক-অফ ২০০৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *