ত্রিদেব সম্বন্ধে বিজ্ঞানশাস্ত্র কি বলে (বিবিধ প্রবন্ধ – ২য় খণ্ড)
মিল্ যে ঈশ্বর স্বীকার করিয়াছেন, তিনি এরূপ অজ্ঞেয় নহেন। মিল্ ইচ্ছাবিশিষ্ট, জগন্নির্ম্মাতা স্বীকার করিয়াছেন। স্বীকার করিয়া ঐশিক স্বভাবের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ঈশ্বরবাদীরা সচরাচর ঈশ্বরের তিনটি গুণ বিশেষরূপে নির্ব্বাচন করিয়া থাকেন—শক্তি, জ্ঞান এবং দয়া। তাঁহাদিগের মতে ঈশ্বরের গুণ মাত্র সীমাশূন্য—অনন্ত। অতএব ঈশ্বরের শক্তি, জ্ঞান এবং দয়াও অনন্ত। ঈশ্বর সর্ব্বশক্তিমান্, সর্ব্বজ্ঞ, এবং দয়াময়। p> প্রচলিত হিন্দুধর্ম্মের শিরোভাগ এই যে, ঈশ্বর এক, কিন্তু তিনটি পৃথক্ পৃথক্ মূর্ত্তিতে তিনি বিভক্ত। এক সৃজন করেন, এক পালন করেন, এবং এক ধ্বংস করেন। এই ত্রিদেব লোক-প্রথিত।
জন্ ষ্টুয়ার্ট মিলের মৃত্যুর পর, ধর্ম্মসম্বন্ধে তৎপ্রণীত তিনটি প্রবন্ধ প্রচারিত হইয়াছে। তাহার একটির উদ্দেশ্য, ঈশ্বরের অস্তিত্বের মীমাংসা করা। মিলের মত যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে যে সকল প্রমাণ ঈশ্বরবাদীরা প্রয়োগ করেন, তাহার মধ্যে একটিই সারবান্। জগতের নির্ম্মাণ-কৌশল হইতে তাঁহার মতে, নির্ম্মাতার অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। এটি প্রাচীন কথা, এবং অখণ্ডনীয়ও নহে। ডার্বিনের মত প্রচারের পূর্ব্বেও ইহার সদুত্তর ছিল; এক্ষণে ডার্বিন্ দেখাইয়াছেন যে, এই নির্ম্মাণ-কৌশল স্বতঃই বটে। মিল্ও ডার্বিনের এই মত অনবগত ছিলেন, এমত নহে; তিনি স্বীয় প্রবন্ধ-মধ্যে তাহার উল্লেখ করিয়াছেন, এবং বলিয়াছেন যে, যদি এই মতটি প্রকৃত হয়, তবে উপরিকথিত নির্ম্মাণ-কৌশল ঈশ্বরের অস্তিত্ব-প্রতিপাদক হয় না। কিন্তু ডার্বিনের মত প্রচারের অল্পকাল পরেই মিলের প্রস্তাব লিখিত হয়। সে মতের সত্যাসত্য পরীক্ষিত এবং নির্ব্বাচিত হওয়ার পক্ষে কালবিলম্বের প্রয়োজন। কালবিলম্বের সে ফল তিনি পান নাই। অতএব তিনি এই মতের উপর দৃঢ়রূপে নির্ভর করিতে পারেন নাই। নির্ভর করিতে পারিলে তাঁহাকে স্বীকার করিতে হইত যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কিছুই প্রমাণ নাই।
এখনও অনেকে ডার্বিনের প্রতিবাদী আছেন—কিন্তু বহুতর পণ্ডিতগণ কর্ত্তৃক তাঁহার মত আদৃত এবং স্বীকৃত। অধিকাংশ বিজ্ঞানবিদ্ এবং দর্শনবিদ্ পণ্ডিতেরা এক্ষণে ডার্বিনের মতাবলম্বী। কিন্তু ডার্বিনের মত প্রকৃত হইলেও ঈশ্বর নাই, এ কথা সিদ্ধ হইল না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রমাণাভাব ঈশ্বরের অনস্তিত্বের প্রমাণ নহে। কোন পদার্থের অস্তিত্বের প্রমাণাভাবে তাহার অনস্তিত্ব প্রমাণ হইবে, যদি বিচারের এরূপ নিয়ম সংস্থাপন করা যায়, তাহা হইলে অনেক স্থানে প্রমাদ ঘটে।
ঈশ্বর আছেন, এ কথা সত্য হউক না হউক, কথা অসঙ্গত কেহ বলিতে পারিবে না। প্রায় এইরূপ মিল্ ঈশ্বর স্বীকার করিয়াছেন। ডার্বিন্ স্বয়ং স্পষ্টতঃ ঈশ্বর স্বীকার করেন।
অতএব প্রমাণ থাক বা না থাক, ঈশ্বর স্বীকার করা যাউক। কিন্তু যদি ঈশ্বর আছেন, তবে তাঁহার প্রকৃতি কি প্রকার? এ বিষয়ে একটি প্রভেদ এ স্থলে স্পষ্টীকরণ আবশ্যক। কতকগুলি ঈশ্বরবাদী আছেন, তাঁহারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াও তৎপ্রতি স্রষ্টা বিধাতা ইত্যাদি পদ ব্যবহার করেন না। অন্যে বলেন ঈশ্বর ইচ্ছাপ্রবৃত্ত্যাদিবিশিষ্ট—এই জগতের নির্ম্মাতা; ইচ্ছাক্রমে এই জগতের সৃষ্টি করিয়াছেন। উপরিকথিত দার্শনিকেরা বলেন, আমরা সে সকল কথা জানি না, জানিবার উপায়ও না; ইহাই কেবল জানি যে, সেই জগৎ-কারণ অজ্ঞেয়। হর্বর্ট্ স্পেন্সর্ এই সম্প্রদায়ের মুখপাত্র।# তাঁহার দর্শনে ঈশ্বর জগদ্ব্যাপক জ্ঞানাতীত শক্তি মাত্র।
————-
* বঙ্গদর্শন, ১২৮২, বৈশাখ। বঙ্গদর্শনে এই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, “মিল্, ডার্বিন এবং হিন্দুধর্ম্ম |” বর্ত্তমান শিরোনামে বিজ্ঞান শব্দের অর্থে Science বুঝিতে হইবে।
#The consciousness of an Inscrutable Power manifested to us through all phenomena has been growing ever clearer, —First Principles, p. 108. ইহা লেখার পর হর্বর্ট্ স্পেন্সরের মতের কিছু পরিবর্ত্তন দেখা যায়।
————-
মিল্ এই মতের প্রতিবাদ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, যেখানে জগতের নির্ম্মাণ-কৌশল দেখিয়াই আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিতেছি, সেইখানেই তাঁহার শক্তি যে অনন্ত নহে, তাহা স্বীকৃত হইতেছে। কেন না, যিনি সর্ব্বশক্তিমান্, তাঁহার কৌশলের প্রয়োজন কি? কৌশল কোথায় প্রয়োজন হয়? যেখানে কৌশল ব্যতীত ইষ্টসিদ্ধি হয় না, সেইখানেই কৌশল প্রয়োজন হয়-যিনি সর্ব্বশক্তিমান্, ইচ্ছায় সকলই করিতে পারেন, তাঁহার কৌশলের প্রয়োজন হয় না। কেবল ইচ্ছা বা আজ্ঞামাত্রে কৌশলের উদ্দিষ্ট কর্ম্ম সিদ্ধ হইতে পারে। যদি মনুষ্যের এরূপ শক্তি থাকিত যে, সে কেবল ঘড়ির ডায়ল্ প্লেটের উপর কাঁটা বসাইয়া দিলেই কাঁটা নিয়মমত চলিত, তবে কখন মনুষ্য কৌশলাবলম্বন করিয়া ঘড়ির স্প্রিঙ্গের উপর স্প্রিঙ্গ্ এবং হুইলের উপ হুইল্ গড়িত না। অতএব ঈশ্বর যে সর্ব্বশক্তিমান্ নহেন, ইহা সিদ্ধ।
এ কথার দুই একটা উত্তর আছে, কিন্তু হিন্দুধর্ম্মের নৈসর্গিক ভিত্তির অনুসন্ধান আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, অতএব সে সকল কথা আমরা ছাড়িয়া যাইতে পারি। সে সকল আপত্তিও মিল্ সম্যক্ প্রকারে খণ্ডন করিয়াছেন।
সর্ব্বজ্ঞতা সম্বন্ধে মিল্ বলেন যে, ঈশ্বর সর্ব্বজ্ঞ কি না, তদ্বিষয়ে সন্দেহ। যে প্রণালী অবলম্বন করিয়া মনুষ্যের কৃত কৌশলের বিচার করা যায়, সে প্রণালী অবলম্বন করিয়া ঈশ্বরকৃত কৌশল সকলের সমালোচনা করিলে অনেক দোষ বাহির হয়। এই মনুষ্যদেহের নির্ম্মাণে কত কৌশল, কত শক্তি ব্যয়িত হইয়াছে, কত যত্নে তাহা রক্ষিত হইয়া থাকে। কিন্তু যাহাতে এত কৌশল, এত শক্তিব্যয়, এত যত্ন, তাহা ক্ষণভঙ্গুর—কখন অধিক কাল থাকে না। যিনি এত কৌশল করিয়া ক্ষণভঙ্গুরতা বারণ করিতে পারেন নাই, তিনি সকল কৌশল জানেন না—সর্ব্বজ্ঞ নহেন। দেখ, জীবশরীর কোন স্থানে ছিন্ন হইলে, তাহা পুনঃসংযুক্ত হইবার কৌশল আছে; উহাতে বেদনা হয়, পুঁয হয়, এবং সেই ব্যাধির ফলে পুনঃসংযোগ ঘটে। কিন্তু সেই ব্যাধি পীড়াদায়ক। যাঁহার প্রণীত কৌশল, উপকারার্থ প্রণীত হইয়াও পীড়াদায়ক, তাঁহার কৌশলে অসম্পূর্ণতা আছে | যাঁহার কৌশলে অসম্পূর্ণ আছে, তাঁহাকে কখন সর্ব্বজ্ঞ বলা যাইতে পারে না।
ইহাও মিল্ স্বীকার করেন যে, এমতও হইতে পারে যে, এই অসম্পূর্ণতা শক্তির অভাবের ফল—অসর্ব্বজ্ঞতার ফল নহে। অতএব ঈশ্বর সর্ব্বজ্ঞ হইলেও হইতে পারেন।
যদি ইহাই বিশ্বাস কর যে, ঈশ্বর সর্ব্বজ্ঞ, কিন্তু সর্ব্বশক্তিমান্ নহেন, তবে এই এক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, কে ঈশ্বরের শক্তির প্রতিবন্ধকতা করে? মনুষ্যাদি যে সর্ব্বশক্তিমান্ নহে তাহার কারণ, তাহাদিগের শক্তির প্রতিবন্ধকতা আছে। তুমি যে হিমালয় পর্ব্বত উৎপাটন করিয়া সাগর-পারে নিক্ষেপ করিতে পার না—তাহার কারণ, মাধ্যাকর্ষণ তোমার শক্তির প্রতিবন্ধকতা করিতেছে। শক্তির প্রতিবন্ধক না থাকিলে, সকলেই সর্ব্বশক্তিমান্ হইত। ঈশ্বর সর্ব্বশক্তিমান্ নহেন, এই কথায় প্রতিপন্ন হইতেছে যে, তাঁহার শক্তির প্রতিবন্ধক কেহ বা কিছু আছে। সেই প্রতিবন্ধক কি? কোন বিঘ্নের জন্য সর্ব্ব তাঁহার অভিপ্রেত কৌশল নির্দ্দোষ করিতে পারেন নাই?
এই সম্বন্ধে দুইটি উত্তর হইতে পারে। কেহ বলিতে পারেন যে, দেখ, ঈশ্বর নির্ম্মাতা মাত্র; তিনি যে স্রষ্টা, এমত প্রমাণ তুমি কিছুই পাও নাই। তুমি তাঁহার নির্ম্মাণপ্রণালী দেখিয়াই তাঁহার অস্তিত্ব সিদ্ধ করিতেছ; কিন্তু নির্ম্মাণপ্রণালী হইতে কেবল নির্ম্মাতাই সিদ্ধ হইতে পারেন, স্রষ্টা সিদ্ধ হইতে পারেন না। ঘটের নির্ম্মাণ দেখিয়া তুমি কুম্ভকারের অস্তিত্ব সিদ্ধ করিতে পার; কিন্তু কুম্ভকারকে মৃত্তিকার সৃষ্টিকারক বলিয়া তুমি সিদ্ধ করিতে পার না। অতএব এমন হইতে পারে যে, ঈশ্বর স্রষ্টা নহেন, কেবল নির্ম্মাতা। ইহার অর্থ এই, যে সামগ্রীকে গঠন দিয়া তিনি বর্ত্তমানাবস্থাপন্ন করিয়াছেন, সে সামগ্রী পূর্ব্ব হইতে ছিল—ঈশ্বরের সৃষ্ট নহে। ঘট দেখিয়া কেবল ইহাই সিদ্ধ হয় যে, কোন কুম্ভকার মৃত্তিকা লইয়া ঘট নির্ম্মাণ করিয়াছে। মৃত্তিকা তাহার পূর্ব্ব হইতে ছিল, কুম্ভকারের সৃষ্ট নহে, এ কথা বলা বিচারসঙ্গত হইবে। সেই অসৃষ্ট সামগ্রীই বোধ হয়, ঐশী শক্তির সীমানির্দ্দেশক—তাঁহার শক্তির প্রতিবন্ধক। সেই জাগতিক জড় পদার্থের এমন কোন দোষ আছে যে, তজ্জন্য উহা ঈশ্বরেরও সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত নহে। সেই কারণে বহুকৌশলময় এবং বহুশক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরও আপনকৃত সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত নহে। সেই কারণে বহুকৌশলময় এবং বহুশক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরও আপনকৃত কার্য্যসকল সম্পূর্ণ এবং দোষশূন্য করিতে পারেন নাই।
আর একটি উত্তর এই যে, ঈশ্বরবিরোধী দ্বিতীয় কোন চৈতন্যই তাঁহার শক্তির প্রতিবন্ধক। যদি নির্ম্মাতার কার্য্য দেখিয়া নির্ম্মাতাকে সিদ্ধ করিলে, তবে তাঁহার কার্য্যের প্রতিবন্ধকতার চিহ্ন দেখিয়াও প্রতিকূলাচারী চৈতন্যেরও কল্পনা করিতে পার। পারসিকদিগের প্রাচীন দ্বৈত ধর্ম্ম এইরূপ—তাঁহারা বলেন যে, একজন ঈশ্বর জগতের মঙ্গলে নিযুক্ত—আর এক ঈশ্বর জগতের অমঙ্গলে নিযুক্ত। খ্রীষ্টধর্ম্মে ঈশ্বর ও সয়তানে এই দ্বৈত মত পরিণত।
ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধীয় প্রবন্ধে মিল্ প্রথমোক্ত মতটি অবলম্বন করারই কারণ দর্শাইয়াছে। কিন্তু তৎপূর্ব্বপ্রণীত “প্রকৃতিতত্ত্ব” সম্বন্ধীয় প্রবন্ধে তিনি মতের পৃষ্ঠরক্ষা করিয়াছেন। সংসার যে অনিষ্টময়, তাহা কোন মনুষ্যকে কষ্ট করিয়া বুঝাইবার কথা নহে—সকলেই অবিরত দুঃখভোগ করিতেছেন—এবং পরের দুঃখভোগ দেখিতেছেন। জীবের কার্য্য মাত্রই কেবল দুঃখমোচনের চেষ্টা। যিনি কেবল জীবের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, তৎকর্ত্তৃক এরূপ দুঃখময় সংসার সৃষ্ট হওয়া সম্ভব। এ সম্বন্ধে কথিত প্রবন্ধ হইতে কয়েক পংক্তির মর্ম্মানুবাদ করিতেছি। মিল্ বলেন—
“যদি এমন হয় যে, ঈশ্বর যাহা ইচ্ছা করেন, তাহাই করিতে পারেন, তবে জীবের দুঃখ যে ঈশ্বরের অভিপ্রেত, এ সিদ্ধান্ত হইতে নিস্তার নাই।* যাঁহারা মনুষ্য প্রতি ঈশ্বরের আচরণের পক্ষ সমর্থন করিতে আপনাদিগকে যোগ্য বিবেচনা করিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে যাঁহারা মতবৈপরীত্যশূন্য, তাঁহারা এই সিদ্ধান্ত হইতে নিস্তার পাইবার জন্য, হৃদয়কে কঠিনভাবাপন্ন করিয়া স্থির করিয়াছেন যে, দুঃখ অশুভ নহে। তাঁহারা বলেন যে, ঈশ্বর দয়াময় বলায় এমত বুঝায় না যে, মনুষ্যের সুখ তাঁহার অভিপ্রেত; তাহাতে বুঝায় যে, মনুষ্যের ধর্ম্মই তাঁহার অভিপ্রেত; সংসার সুখের হউক না হউক, ধর্ম্মের সংসার বটে। এইরূপ ধর্ম্মনীতির বিরুদ্ধে যে সকল আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে, তাহা পরিত্যাগ করিয়াও ইহা বলা যাইতে পারে যে, স্থূল কথার মীমাংসা ইহাতে কই হইল? মনুষ্যের সুখ, সৃষ্টিকর্ত্তার যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে সে উদ্দেশ্য যেমন সম্পূর্ণরূপে বিফলীকৃত হইয়াছে, মনুষ্যের ধর্ম্ম তাঁহার যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে সে উদ্দেশ্যও সেইরূপ সম্পূর্ণ বিফল হইয়াছে। সৃষ্টিপ্রণালী লোকের সুখের পক্ষে যেরূপ অনুপযোগী, লোকের ধর্ম্মের পক্ষে বরং তদধিক অনুপযোগী। যদি সৃষ্টির নিয়ম ন্যায়মূলক হইত, এবং সৃষ্টিকর্ত্তা সর্ব্বশক্তিমান্ হইতেন, তবে সংসারে যেটুকু সুখ দুঃখ আছে, তাহা ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্যে তাহাদের ধর্ম্মাধর্ম্মের তারতম্য অনুসারে পড়িত; কেহ অন্যাপেক্ষা অধিকতর দুষ্ক্রিয়াকারী না হইলে অধিকতর দুঃখভাগী হইত না; অকারণ ভাল মন্দ বা অন্যায়ানুগ্রহ সংসারে স্থান পাইত না; সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন নৈতিক উপাখ্যানবৎ গঠিত নাটকের অভিনয়তুল্য মনুষ্যজীবন অতিবাহিত হইত। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, তাহা যে উপরিকথিত রীতিযুক্ত নহে, এ বিষয়ে কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না; এবং এইরূপ ইহলোকে যে ধর্ম্মাধর্ম্মের সমুচিত ফল বাকি থাকে, লোকান্তরে তাহার পরিশোধন আবশ্যক; পরকালের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ইহাই গুরুতর প্রমাণ বলিয়া প্রযুক্ত হইয়া থাকে। এরূপ প্রমাণ প্রয়োগ করায় অবশ্য স্বীকৃত হয় যে, এই জগতের পদ্ধতি অবিচারের পদ্ধতি, সদ্বিচারের পদ্ধতি নহে। যদি বল যে ঈশ্বরের কাছে সুখ দুঃখ এমন গণনীয় নহে যে, তিনি তাহা পুণ্যাত্মার পুরস্কার এবং পাপাত্মার দণ্ড বলিয়া ব্যবহার করেন, বরং ধর্ম্মই পরমার্থ এবং অধর্ম্মই পরম অনর্থ, তাহা হইলেও নিতান্ত পক্ষে এই ধর্ম্মাধর্ম্ম যাহার যেমন কর্ম্ম, তাহাকে সেই পরিমাণে দেওয়া কর্ত্তব্য ছিল। তাহা না হইয়া, কেবল জন্মদোষেই# বহু লোকে সর্ব্বপ্রকার পাপাসক্ত হয়; তাহাদিগের পিতৃ-মাতৃ-দোষে, সমাজের দোষে, নানা অলঙ্ঘ্য ঘটনার দোষে এরূপ হয়;—তাহাদের নিজদোষে নহে। ধর্ম্মপ্রচারক বা দার্শনিকদিগের ধর্ম্মোন্মাদে শুভাশুভ সম্বন্ধে যে কোন প্রকার সঙ্কীর্ণ বা বিকৃত মত প্রচার হইয়া থাকুক না কেন, কোন প্রকার মতানুসারেই প্রাকৃতিক শাসনপ্রণালী দয়াবান্ ও সর্ব্বশক্তিমানের কৃত কার্য্যানুরূপ বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারিবে না |” !
—————-
*তৎসম্বন্ধে মিলের কয়েকটি কথা ইংরেজিতেই উদ্ধৃত করিতেছি। অবশিষ্ট অংশ
#খ্রীষ্টান্ ইউরোপে এ কথার উত্তর নাই। পুনর্জ্জন্মবাদী হিন্দুর হাতে মিল্ তত সহজে নিস্তার পাইতেন না।
!Mill on Nature, pp. 37-38.
—————
এই সকল কথা বলিয়া মিল্ যাহা বলিয়াছেন, তাহার এমত অর্থ করা যায় যে, এই জগতের নির্ম্মাতা বা পালনকর্ত্তা হইতে পৃথক্ শক্তির দ্বারা জীবের ধ্বংস বা অনিষ্ট সম্পন্ন হইতেছে। এরূপ মত সুসঙ্গত। মিল্ এরূপ মত ইঙ্গিতেও ব্যক্ত করিয়াছেন কি না, তাহা তাঁহার জীবনচরিত যে না পড়িয়াছে, তাহার সংশয় হইতে পারে। এজন্য ইংরেজি হইতে আমরা কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি।
“The only admissible moral theory of Creation is that the principle of good cannot at once and altogether subdue the powers of evil, either physical or moral; could not place mankind in a world free from the necessity of an incessant struggle with the maleficent powers, or make them victorious in that struggle, but could and did make them capable of carrying on the fight with vigour and with progressively increasing success. Of all the religious explanations at the order of Nature, this alone is neither contradictory to itself, nor to the facts for which it attempts to account.” *
যদি এ কথার কোন অর্থ থাকে, তবে সে অর্থ এই যে, জগতের পালনকর্ত্তা এবং সংহারকর্ত্তা স্বতন্ত্র, এমত কথা অসঙ্গত নহে। ইহার উপর যদি একজন পৃথক্ সৃষ্টিকর্ত্তা পাওয়া যায়, তাহা হইলে ত্রিদেবের নৈসর্গিক ভিত্তি পাওয়া গেল।
মিলে তাহা পাওয়া যাইবে না; মিল্ হিন্দু নহেন, হিন্দুর পক্ষসমর্থন জন্য লিখেন নাই। তিনি নির্ম্মাণকৌশল হইতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংস্থাপন করিয়াছেন, নির্ম্মাতা ভিন্ন সৃষ্টিকর্ত্তা মানেন না। কিন্তু বিজ্ঞানে বলে, জীবের জন্ম, নির্ম্মাণ মাত্র; ভৌতিক পদার্থের সমবায়বিশেষ জীবত্ব। এই পৃথিবীতে যাহা কিছু দেখি—জীব উদ্ভিদ্ বায়ু বারি মৃৎপ্রস্তরাদি, সকলই সেইরূপে নির্ম্মিত; পৃথিবীও তাই; সূর্য্য, চন্দ্র, গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু, নক্ষত্র, নীহারিকা, সকলই নির্ম্মিত | অতএব সকলই সেই নির্ম্মাতার কীর্ত্তি—তাঁহার হস্তপ্রসূত। সচরাচর সৃষ্টিকর্ত্তা যাঁহাকে বলা যায়, ঈদৃশ নির্ম্মাতার সঙ্গে তাঁহার প্রভেদ অল্প। যে আকারশূন্য, শক্তিবিশিষ্ট, পরমাণুসমষ্টিতে এই বিশ্ব গঠিত, তাহা নির্ম্মিত কি না—নির্ম্মাতার হস্তপ্রসূত কি না—তাহার কেহ স্রষ্টা আছেন কি না, তদ্বিষয়ে প্রমাণাভাব। এইটুকু স্মরণ রাখিয়া, সৃষ্টিকর্ত্তা শব্দের প্রচলিত অর্থে নির্ম্মাতাকে সৃষ্টিকর্ত্তা বলা যাইতে পারে। তাহা হউক বা না হউক, ঈদৃশ স্রষ্টার সঙ্গেই ধর্ম্ম এবং বিজ্ঞানের নিকট সম্বন্ধ। অতএব তাঁহাকে পাইলেই আমাদিগের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল।
মিল্ বলেন, তাঁহার অস্তিত্ব প্রমাণীকৃত। তবে মিল্, নির্ম্মাতা এবং পালন বা রক্ষাকর্ত্তার মধ্যে প্রভেদ করেন না। ইউরোপে কেহ এরূপ প্রভেদ স্বীকার করে না। এরূপ স্বীকার না করিবার কারণ ইহাই দেখা যায় যে, জন্মও জাগতিক নিয়মাবলীর ফল, রক্ষাও জাগতিক নিয়মাবলীর ফল; যে নিয়মাবলীর ফল জন্ম বা সৃজন, সেই নিয়মাবলীর ফল রক্ষা | অতএব যিনি জন্ম, নির্ম্মাণ বা সৃষ্টির নিয়ন্তা, তিনিই রক্ষা বা পালনের নিয়ন্তা, ইহা সিদ্ধ |
কিন্তু ধ্বংস সম্বন্ধেও সেইরূপ বলা যাইতে পারে। রক্ষাও জাগতিক নিয়মাবলীর ফল; সংহারও জাগতিক নিয়মাবলীর ফল। যে সকল নিয়মের ফল রক্ষা, সেই সকল নিয়মেরই ধ্বংস। যে রাসায়নিক সংযোজন বিশ্লেষণে জীবের দেহ রক্ষিত হয়, সেই রাসায়নিক সংযোজন বিশ্লেষণেই জীবের দেহ রক্ষিত হয়, সেই রাসায়নিক সংযোজন বিশ্লেষণেই জীবের দেহ লয়প্রাপ্ত হয়। যে অম্লজানের সংযোগে জীবের দেহ প্রত্যহ গঠিত ও পরিপুষ্ট হইতেছে—শেষ দিনে সেই অম্লজান সংযোগেই তাহা নষ্ট হইবে। অতএব যিনি পালনের নিয়ন্তা, তিনিই যে সংসারের নিয়ন্তা, ইহাও সিদ্ধ।
———–
*Mill On Nature, pp. 38-39
———–
তবে, পালনকর্ত্তা চৈতন্য সংহারকর্ত্তা চৈতন্য পৃথক্, এরূপ বিবেচনা অসঙ্গত নহে, একথা বলিবার কারণ কি? কারণ এই যে, যিনি পালনকর্ত্তা তাঁহার অভিপ্রায় যে জীবের মঙ্গল, জগতে ইহার বহুতর প্রমাণ দেখা যায়। কিন্তু মঙ্গল তাঁহার অভিপ্রেত হইলেও অমঙ্গলেরই আধিক্য দেখা যায়। যাঁহার অভিপ্রায় মঙ্গলসিদ্ধি, তিনি আপনার অভিপ্রায়ের প্রতিকূলতা করিয়া অমঙ্গলের আধিক্যই সিদ্ধ করিবেন, ইহা সঙ্গত বোধ হয় না। এই জন্য সংহার যে পৃথক্ চৈতন্যের অভিপ্রায় বা অধিকার, এ কথা অসঙ্গত নহে, বলা হইয়াছে।
তবে এরূপ মতের স্থূল কারণ, পালনে ও ধ্বংস দৃশ্যমান অসঙ্গতি। সৃজন ও পালনে যদি এইরূপ অভিপ্রায়ের অসঙ্গতি দেখা যায়, তবে স্রষ্টা ও পাতা পৃথক্, এরূপ মতও অসঙ্গত বোধ হইবে না।
সৃজনে ও পালনে এরূপ অসঙ্গতি আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানের দ্বারা সিদ্ধ হইতেছে। নহিলে ডার্বিনের “প্রাকৃতিক নির্ব্বাচন” পরিত্যাগ করিতে হয়। যে মতকে প্রাকৃতিক নির্ব্বাচন বলে, তাহার মূলে এই কথা আছে যে, যে পরিমাণে জীব সৃষ্ট হইয়া থাকে, সেই পরিমাণে কখন রক্ষিত বা পালিত হইতে পারে না | জীবকুল অত্যন্ত বৃদ্ধিশীল—কিন্তু পৃথিবী সংকীর্ণা | সকলে রক্ষিত হইলে, পৃথিবীতে স্থান কুলাইত না, পৃথিবীতে উৎপন্ন আহারে তাহাদের পরিপোষণ হইত না। অতএব অনেকেই জন্মিয়াই বিনষ্ট হয়—অধিকাংশ অণ্ডমধ্যে বা বীজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যাহাদিগের বাহ্য বা আভ্যন্তরিক প্রকৃতিতে এমন কিছু বৈলক্ষণ্য আছে যে, তদ্দ্বারা তাহারা সমানাবস্থাপন্ন জীবগণ হইতে আহারসংগ্রহে, কিম্বা অন্য প্রকারে জীবনরক্ষায় পটু, তাহারাই রক্ষাপ্রাপ্ত হইবে, অন্য সকলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। মনে কর, কোন দেশে বহুজাতীয় এরূপ চতুষ্পদ আছে যে, তাহারা বৃক্ষের শাখা ভোজন করিয়া জীবনধারণ করে, তাহা হইলে যাহাদিগের গলদেশ ক্ষুদ্র, তাহারা কেবল সর্ব্বনিম্নস্থ শাখাই ভোজন করিতে পাইবে; যাহাদের গলদেশ দীর্ঘ, তাহারা নিম্নস্থ শাখাও খাইবে, তদপেক্ষা ঊর্দ্ধ্বস্থ শাখাও খাইতে পারিবে। সুতরাং যখন খাদ্যের টানাটানি হইবে—সর্ব্বনিম্ন শাখাসকল ফুরাইয়া যাইবে, তখন কেবল দীর্ঘস্কন্ধেরাই আহার পাইবে—হ্রস্বস্কন্ধেরা অনাহারে মরিয়া যাইবে বা লুপ্তবংশ হইবে। ইহাকেই বলে প্রাকৃতিক নির্ব্বাচন। দীর্ঘস্কন্ধেরা প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের রক্ষিত হইল। হ্রস্বস্কন্ধের বংশলোপ হইল।
প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের মূল ভিত্তি এই যে, যত জীব সৃষ্ট হয়, তত জীব কদাচ রক্ষা হইতে পারে না। পারিলে প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের প্রয়োজনই হইত না। দেখ, একটি সামান্য বৃক্ষে কত সহস্র সহস্র বীজ জন্মে; একটি ক্ষুদ্র কীট কত শত শত অণ্ড প্রসব করে। যদি সেই বীজ বা সেই অণ্ড, সকলগুলিই রক্ষিত হয়, তবে অতি অল্পকাল মধ্যে সেই এক বৃক্ষেই বা সেই একটি কীটেই পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়, অন্য বৃক্ষ বা অন্য জীবের স্থান হয় না। যদি কোন কীট প্রত্যহ দুইটি অণ্ড প্রসব করে (ইহা অন্যায় কথা নহে), তবে দুই দিনে সেই কীট সন্তান হইতে চারিটি, তিন দিনে আটটি, চারি দিনে ষোলটি, দশ দিনে সহস্রাধিক, এবং বিশ দিনে দশ লক্ষের অধিক কীট জন্মিবে। এক বৎসরে কত কোটি কীট হইবে, তাহা শুভঙ্কর হিসাব করিয়া উঠিতে পারেন না। মনুষ্যের বহুকাল বিলম্বে এক একটি সন্তান হয়, এক দম্পতি হইতে চারি পাঁচটি সন্তানের অধিক সচরাচর হয় না; অনেকেই মরিয়া যায়; তথাপি এমন দেখা গিয়াছে যে, পঁচিশ বৎসরে মনুষ্যসংখ্যা দ্বিগুণ হইয়াছে। যদি সর্ব্বত্র এইরূপ বৃদ্ধি হয়, তবে হিসাব করিলে দেখা যাইবে যে, সহস্র বৎসর মধ্যে পৃথিবীতে মনুষ্যের দাঁড়াইবার স্থান হইবে না। হস্তীর অপেক্ষা অল্পপ্রসবী কোন জীবই নহে; মনুষ্যও নহে। কিন্তু ডার্বিন্ হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন যে, অতি ন্যূনকল্পেও এক হস্তিদম্পতি হইতে ৭৫০ বৎসর মধ্যে এক কোটি নবতি লক্ষ হস্তী সম্ভূত হইবে। এমন কোন বর্ষজীবী বৃক্ষ নাই যে, তাহা হইতে বৎসরে দুইটি মাত্র বীজ জন্মে না। লিনিয়স্ হিসাব করিয়াছেন যে, যে বৃক্ষে বৎসরে দুইটি মাত্র বীজ জন্মে, সকল বীজ রক্ষা পাইলে, তাহা হইতে বিংশতি বৎসরে দশ লক্ষ বৃক্ষ হইবে। #
—————
#Origin of Species–6th Edition, p. 51.
—————
এক্ষণে পাঠক ভাবিয়া দেখুন, একটি বার্ত্তাকুবৃক্ষে কতগুলি বার্ত্তাকু—পরে ভাবুন, একটি বার্ত্তাকুতে কতগুলি বীজ থাকে। তাহা হইলে একটি বার্ত্তাকুবৃক্ষে কত অসংখ্য বীজ জন্মে, তাহা স্থির করিবেন। সকল বীজ রক্ষা হইলে যেখানে বার্ষিক দুইটি বীজ হইতে বিংশতি বৎসরে দশ লক্ষ বৃক্ষ হয়, সেখানে বৎসর বৎসর প্রতি বৃক্ষের সহস্র সহস্র বার্ত্তাকুবীজে বিংশতি বৎসরে কত কোটি কোটি কোটি বার্ত্তাকুবৃক্ষ হইবে, তাহা কে মনে ধারণা করিতে পারে? সকল বীজ রক্ষা পাইলে, কয় বৎসর পৃথিবীতে বার্ত্তাকুর স্থান হয়?
চেতন সম্বন্ধেও ঐরূপ। যে পরিমাণে সৃষ্টি, তাহার সহস্রাংশ রক্ষিত হয় না। যদি স্রষ্টা এবং পালনকর্ত্তা এক, তবে তিনি যাহার পালনে অশক্ত, তাহা এত প্রচুর পরিমাণে সৃষ্টি করেন কেন? জীবের রক্ষা যাঁহার অভিপ্রায়, তিনি অরক্ষণীয়ের সৃষ্টি করেন কেন? ইহাতে কি অভিপ্রায়ের অসঙ্গতি দেখা যায় না? ইহাতে কি এমত বোধ হয় না যে স্রষ্টা ও পাতা এক, এ কথা না বলিয়া, স্রষ্টা পৃথক্, পাতা পৃথক্, এ কথা বলাই সঙ্গত?
ইহার একটি উত্তর আছে—জীবধ্বংসের জন্য একজন সংহারকর্ত্তা কল্পনা করিয়াছ। সৃষ্ট জীবের ধ্বংস তাঁহার কার্য্য—যত সৃষ্টি হয়, তত যে রক্ষা হয় না, ইহা তাঁহারই কার্য্য। পাতা, এবং সৃষ্টিকর্ত্তা এক, কিন্তু তিনি যত সৃষ্টি করেন, তত যে রক্ষা করিতে পারেন না তাহার কারণ, এই সংহারকর্ত্তার শক্তি। নচেৎ সকলের রক্ষাই যে তাঁহার অভিপ্রায় নহে, এমত কল্পনীয় নহে। যেখানে তিনি সর্ব্বশক্তিমান্ নহেন, কল্পনা করিয়াছ, সেখানে তিনি যে সকলকে রক্ষা করিতে পারেন না, ইহাই বলা উচিত; সকলের রক্ষা যে তাঁহার অভিপ্রেত নহে, ইহা বলিতে পার না। উত্তর এই।
ইহারও প্রত্যুত্তর আছে। জগতের অবস্থা, জগতে যে সকল নিয়ম চলিতেছে সে সকলের অথবা সেই সংহারিকাশক্তির আলোচনা করিলে ইহাই সহজে বুঝা যায় যে, এ জগতে অপরিমিতসংখ্যক জীব রক্ষণীয় নহে—অতএব অপরিমিত জীবসৃষ্টি নিষ্ফল। সামান্য মনুষ্যের সামান্য বুদ্ধি দ্বারা এ কথা প্রাপণীয়। অতএব যিনি স্রষ্টা ও পাতা, তিনিও ইহা অবশ্য বিলক্ষণ জানেন। না জানিলে তিনি মনুষ্যাপেক্ষা অদূরদর্শী। কিন্তু তিনি কৌশলময়—জীবসৃজনপ্রণালী অপূর্ব্ব কৌশলসম্পন্ন, ইহার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। যাঁহার এত কৌশল, তিনি কখনও অদূরদর্শী হইতে পারেন না। যদি তাঁহাকে অদূরদর্শী বলিয়া স্বীকার কর, তাহা হইলে সেই সকল কৌশল যে চৈতন্যপ্রণীত, এ কথা আর বলিতে পারিবে না; কেন না, অদূরদর্শী চৈতন্য হইতে সেরূপ কৌশল অসম্ভব | তবে বলিতে হইবে যে, তিনি জানিয়া নিষ্ফল সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত। দূরদর্শী চৈতন্য যে নিষ্ফল সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত হইবেন, ইহা সঙ্গত বোধ হয় না। কারণ, নিষ্ফলতা বুদ্ধি বা প্রবৃত্তির লক্ষ্য হইতে পারে না।
অতএব ইহা সিদ্ধ, যিনি পালনকর্ত্তা, অপরিমিত জীবসৃষ্টি তাঁহার ক্রিয়া নহে। এজন্য পালনকর্ত্তা হইতে পৃথক্ চৈতন্যকে সৃষ্টিকর্ত্তা বলিয়া কল্পনা করা অসঙ্গত নহে।
ইহাতেও আপত্তি হইতে পারে যে, স্রষ্টা ও পাতা পৃথক্ স্বীকার করিলেও অবশ্য স্বীকার করিতে হইতেছে যে, স্রষ্টা নিষ্ফল সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত; দূরদর্শী চৈতন্য নিষ্ফল কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে পারে না, এ আপত্তির মীমাংসা কই হইল? সত্য কথা, কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখ যে, পাতা হইতে স্রষ্টা যদি পৃথক্ হইলেন, তবে সৃষ্ট জীবের রক্ষা তাঁহার উদ্দেশ্য বলিয়া বিবেচনা করিবার আর কারণ নাই। সৃষ্টি তাঁহার এক মাত্র অভিপ্রায়; এবং সৃষ্টি হইলেই তাঁহার অভিপ্রায়ের সফলতা হইল—রক্ষা না হইলেও সে অভিপ্রায়ের নিষ্ফলতা নাই।
অতএব স্রষ্টা, পাতা এবং হর্ত্তা পৃথক্ পৃথক্ চৈতন্য, এমত বিবেচনা করা অসঙ্গত এবং প্রমাণবিরুদ্ধ নহে—ইহাই হিন্দুধর্ম্মের নৈসর্গিক ভিত্তি, এবং এই স্রষ্টা, পাতা ও হর্ত্তা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বলিয়া পরিচিত। কিন্তু এতৎসম্বন্ধে আমাদের কয়েকটি কথা বলিবার আছে।
প্রথম, আমরা বলিতেছি না যে, এই ত্রিদেবের উপাসনা এইরূপে ভারতবর্ষে উৎপন্ন হইয়াছে। আমরা এমত বিশ্বাস করি না যে, ভারতীয় ধর্ম্মস্থাপকগণ এইরূপ বৈজ্ঞানিক বিচার করিয়া ত্রিদেবের কল্পনায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। ইঁহাদিগের উৎপত্তি বেদগীত বিষ্ণু রুদ্রাদি হইতে। বৈদিক বিষ্ণু রুদ্রাদি বৈজ্ঞানিক সঙ্কল্প নহে, ইহার যথেষ্ট প্রমাণ বেদেই আছে। কিন্তু পাতৃত্ব হর্ত্তৃত্ব স্রষ্টত্বের সূচনাও বেদে আছে। তবে অদ্বিতীয় দর্শনশাস্ত্রবিৎ ভারতীয় পণ্ডিতগণ কর্ত্তৃক এই ত্রিদেবোপাসনা গৃহীত হইয়াছিল, জনসাধারণের উহা বদ্ধমূল, ইহাতে অবশ্য এমত বিবেচনা করা কর্ত্তব্য যে, উহার সুদৃঢ় নৈসর্গিক ভিত্তি আছে। লোকবিশ্বাসের সেই গূঢ় নৈসর্গিক ভিত্তি কি, তাহাই আমরা দেখাইলাম।
আমাদিগের দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে, এই ত্রিদেবোপাসনার নৈসর্গিক ভিত্তি আছে বটে, কিন্তু আমরা এমত কিছু লিখি নাই এবং বিচারেও এমত কোন কথাই পাওয়া যায় না যে তদ্দ্বারা এই ত্রিদেবের অস্তিত্ব বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণীকৃত বলিয়া স্বীকার করা যায়। প্রমাণে দুইটি গুরুতর ছিদ্র লক্ষিত হয়।
প্রথম এই যে জগতের নির্ম্মাণকৌশলে চৈতন্যযুক্ত নির্ম্মাতার অস্তিত্ব প্রমাণ হইতেছে, এই কথা স্বীকার করাতেই ত্রিদেবের অস্তিত্ব সঙ্গত বলিয়া সংস্থাপিত হইয়াছে। কিন্তু প্রথম সূত্রটি ভ্রান্তিজনিত; প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের ফলকেই নির্ম্মাণকৌশল বলিয়া আমাদিগের ভ্রম হয়; সেই ভ্রান্ত জ্ঞানেই আমরা নির্ম্মাতাকে সিদ্ধ করিয়াছি, নচেৎ নির্ম্মাতার অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই। নির্ম্মাতার অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াই আমরা সংহারকর্ত্তা, এবং পৃথক্ পৃথক্ স্রষ্টা পাতা পাইয়াছি। যদি নির্ম্মাতার অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই, তবে ত্রিদেবের মধ্যে কাহারও অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই।
দ্বিতীয় দোষ, সৃজন পালন সংহার, একই নিয়মাবলীর ফল। বিজ্ঞান ইহাই শিখাইতেছে যে, যে যে নিয়মের ফলে সৃজন, সেই সেই নিয়মের ফলে পালন, সেই সেই নিয়মের ফলে ধ্বংস। নিয়ম যেখানে এক, নিয়ন্তা সেখানে পৃথক্ সঙ্কল্প করা প্রামাণ্য নহে। আমরা কোথাও বলি নাই যে, তাহা প্রামাণ্য। আমরা কেবল বলিয়াছি যে, তাহা অপ্রামাণ্য বা অসঙ্গত, নহে, সঙ্গত। যাহা প্রমাণবিরুদ্ধ নহে বা যাহা কেবল সঙ্গত, তাহা সুতরাং প্রামাণিক, ইহা বলা যাইতে পারে না।
আমাদিগের তৃতীয় বক্তব্য এই যে, ত্রিদেবের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা স্বীকার করিলেও, তাঁহাদিগকে সাকার বলিয়া স্বীকার করা যায় না। পুরাণেতিহাসে যে সকল আনুষঙ্গিক কথা আছে, তৎপোষকে কিছুমাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তি পাওয়া যায় না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রত্যেকেই কতকগুলি অদ্ভুত উপন্যাসের নায়ক। সেই সকল উপন্যাসের তিলমাত্র নৈসর্গিক ভিত্তি নাই। যিনি ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে বিশ্বাস করেন, তাঁহাকে নির্ব্বোধ বলিতে পারি না; কিন্তু তাই বলিয়া পুরাণেতিহাসে বিশ্বাসের কোন কারণ আমরা নির্দ্দেশ করি নাই।
চতুর্থ, ত্রিদেবের অস্তিত্বের কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই, ইহা যথার্থ, কিন্তু ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, মহাবিজ্ঞানকুশলী ইউরোপীয় জাতির অবলম্বিত খ্রীষ্টধর্ম্মাপেক্ষা, হিন্দুদিগের এই ত্রিদেবোপাসনা বিজ্ঞানসম্মত এবং নৈসর্গিক। ত্রিদেবোপাসনা বিজ্ঞানমূলক না হউক, বিজ্ঞানবিরুদ্ধ নহে। কিন্তু খ্রীষ্টীয় সর্ব্বশক্তিমান্, সর্ব্বজ্ঞ, এবং দয়াময় ঈশ্বরে বিশ্বাস যে বিজ্ঞানবিরুদ্ধ, তাহা উপরিকথিত মিল্-কৃত বিচারে সপ্রমাণ হইয়াছে। হিন্দুদিগের মত কর্ম্মফল মানিলে বা হিন্দুদিগের মায়াবাদে তাহা বিজ্ঞানসম্মত হয়।
বিজ্ঞানে ইহা পদে পদে প্রমাণীকৃত হইতেছে যে, এই জগৎ ব্যাপিয়া সর্ব্বত্র, সর্ব্বকার্য্যে এক অনন্ত, অচিন্তনীয়, অজ্ঞেয় শক্তি আছে—ইহা সকলের কারণ, বর্হিজগতের অন্তরাত্মাস্বরূপ। এই মহাবলের অস্তিত্ব অস্বীকার করা দূরে থাকুক, আমরা তদুদ্দেশে ভক্তিভাবে কোটি কোটি কোটি প্রণাম করি।