Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তেরো পার্বণ || Samaresh Majumdar » Page 2

তেরো পার্বণ || Samaresh Majumdar

গলির মুখে ট্যাক্সিটা

গলির মুখে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলো গৌরব। কলেজে পড়ার সময় সে শেষবার এখানে এসেছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকায় এখনও কয়লার ধোঁয়া, রকে আড্ডা একই ভাবে চলছে যা সে দীর্ঘকাল আগে দেখে গিয়েছিল। এই গলিতেই পিসীমার বাড়ি। পিসীমার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এককালে খুব নিবিড় ছিল। শৈশবে সে পিসীমাকে যখনই দেখেছে তখনই একটা স্নেহজ সম্পর্ক যা এখনও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে যখন তাদের অবস্থা ভালো হচ্ছিল, যখন তারা দক্ষিণ কলকাতায় স্থায়ী বাস শুরু করল তখন থেকেই পিসীমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা আলগা হতে আরম্ভ করছিল। ফিরে এসে সে মায়ের কাছে শুনেছিল দাদা বউদি আর ওখানে যাওয়ার সময় পায় না। পিসীমারাও আসে না। পিসেমশাই নাকি একবার দাদার অফিসে গিয়ে তিনশো টাকা ধার নিয়ে এসেছিলেন। সেটা শোধ না করায় বউদি খুব উষ্ণ। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। যখন কেউ ওপরে ওঠার সিঁড়ি পেয়ে যায় তখন তার যেমন নিজের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, নিচের মানুষরাও ঈর্ষায় তাকে এড়িয়ে চলে। গৌরবের ধারণা তাদের এবং পিসীমার সম্পর্ক এইরকম।

পাড়াটা যে অনেককালের তা বাড়িগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। পিসীমাদের বাড়ির সামনে এসে গৌরবের মনে হলো এতগুলো বছরে একটুও পাল্টায়নি। কেউ যত্ন নেয়নি বাড়িটার, রঙ ছোঁয়ানো হয় নি কতকাল। একটি বাচ্চা ছেলে দ্রুত বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল, ওকে দেখে থমকে গেল। গৌরব অনুমান করল দুই দাদার ছেলেমেয়েদের একটি। ততক্ষণে ছেলেটি ভেতরে ফিরে গিয়ে চেঁচাচ্ছে, মা, দেখ, একটা লম্বা লোক আসছে।

গৌরব দাঁড়িয়ে পড়ল। এইভাবে কেউ আগমন ঘোষণা করবে সে চিন্তা করেনি। সে মোটেই বেঁটে নয় কিন্তু এই মুহূর্তে লম্বা হওয়া প্রশংসা না নিন্দের তা বুঝতে পারল না। চিৎকার শুনে একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখল সে মাথায় ঘোমটা খুব সামান্য টানতে টানতে। বড় বউদির শরীরে বয়সের মেদ লেগেছে কিন্তু চেহারা আগের মতো নেই। বড় বউদি একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে আপনি? কাকে চাই?

গৌরব রসিকতা করার লোভ সংবরণ করতে পারল না, চাইব অনেক কিছু, কিন্তু এখন আপনাকে হলেই চলবে। আছ কেমন সব?

রাগ করতে গিয়ে চিনে ফেললেন বড় বউদি। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় মেশানো খুশির হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে, ওমা, তুমি! কি আশ্চর্য! দেখ, আমরিকা থেকে গোরা এসেছে। চিৎকার করে শেষ বাক্যটা ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বড় বউদি এগিয়ে এলেন, কি সুন্দর দেখতে হয়েছ গো, আমি একদম চিনতে পারিনি।

গৌরব উঠে এল, যাই বলো, বারো বছরে তুমি ভুলে যাচ্ছ এটা মোটেই ভালো কথা নয়।

বড় বউদি ওর হাত ধরলেন, কবে এলে? তোমাদের বাড়ির সঙ্গে তো কোনো যোগাযোগ নেই, এখানে না এলে জানতেও পারতাম না তুমি এসেছ। চলো, ভেতরে চলো। খুব অবাক করে দিয়েছ।

এই সময় দরজায় আর একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। বড় বউদি যেন তাকে এই মুহূর্তে আশা করেন নি। ভেতরে ঢুকতে গেলে ওঁর পাশ দিয়েই যেতে হবে। বড় বউদি বললেন, তোমার ছোট বউদি। তুমি অবশ্য যাওয়ার আগে দেখনি। বিয়ে হয়েছে আট বছর।

সঙ্গে সঙ্গে ছোট বউদি হাত তুলে নমস্কার করতেই গৌরব তা ফিরিয়ে দিল। ছোট বউদির বয়স তিরিশের কাছে। স্বাস্থ্য ভালো। শরীরে সুখের আলো মাখামাখি। সেই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েই তিনি বললেন, আমার পরিচয় তো শুনলেন, আট বছরে আটাশবার আপনার গল্প ওঁর কাছে শুনতে শুনতে আপনি আমার খুব চেনা মানুষ হয়ে গেছেন। কবে এলেন আমেরিকা থেকে?

এইতো কদিন হলো। আপনাদের বিয়ের খবর ওখানে বসেই পেয়েছিলাম। ছোটদা বাড়িতে আছে?

ওমা, ছোটদা না থাকলে বুঝি ঘরে আসবেন না? আসুন আমার ওখানে। ছোট বউদি ভেতরে এগিয়ে গেলে বড় বউদি বললেন, তা হবে না গোরা, আমি বড়, আমার ঘরে তোমাকে প্রথমে যেতে হবে। ওঃ, কতদিন পরে দেখছি তোমাকে। কি ভালো লাগছে যে কি বলব!

সঙ্গে সঙ্গে ছোট বউদি বললেন, আমি তো আর ওসব কথা বলতে পারছি না। তবে নতুন মানুষের কথা আগে রাখতে হয়। ছোট বউদি হিসেবে আমার আব্দার আগে গোরা ঠাকুরপো!

ঠিক তখনই বড়দাদা বেরিয়ে এলেন। পরনে লুঙ্গি এবং গলায় গামছা জড়ানো। হয়তো বাথরুমে গিয়েছিলেন ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এসেছেন তড়িঘড়ি, আরে গোরাসাহেব যে! বাঃ, চমৎকার চেহারা করেছিস তো। কবে এলি? আয় আয় ভেতরে আয়।

যাচ্ছি। হারহাইনেস কোথায়? তাঁকে দেখছি না?

বড় বউদি না বুঝে বললেন, কার কথা বলছ?

আরে সেই মহিলা যিনি তোমার শ্বাশুড়ি হন। গৌরব ততক্ষণে বাড়ির ভেতরের লম্বা প্যাসেজটায় চলে এসেছে। প্যাসেজটার শেষে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বাড়িটায় যদি বারো বছরে হাত না দেওয়া তাহলে দোতলায় ছাদে একটিই ঘর। আর বাড়াতে পারেননি পিসেমশাই পয়সার অভাবে। নিচের প্যাসেজের দুপাশে ঘর। সম্ভবত দুই দাদার দুই অংশ।

বড়দা বললেন, বোস না, মাতৃমন্দিরে না হয় পরে যাবি।

মাতৃমন্দির? গৌরব অবাক চোখে তাকাল।

ওই ওপরে। হাত দিয়ে সিঁড়ির প্রান্ত দেখিয়ে দিলেন বড়দা, গৌরব বলল, না বড়দা, আগে পিসিমা পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। তারপর আড্ডা মারা যাবে।

বড় বউদি অখুশি মুখে বললেন, আমি চা করছি আর চিড়েভাজা। তোমার খারাপ লাগবে?

দারুণ। কতকাল চিড়েভাজা খাইনি।

তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এস। বড় বউদির অখুশি ভাবটা সামান্য কমল। সঙ্গে সঙ্গে ছোট বউদি জানালেন, না ঠাকুরপো, নতুন পরিচয় হলো, আজ অন্তত আমার হাতে চা খেয়ে যাও। ঠাণ্ডা হয়ে আসার আগেই নেমে পড়ো কিন্তু।

গৌরব আর দাঁড়াল না। সে এমনভাবে হাত নাড়ল যাতে সবাই যে যার নিজের মতো মনে করে নিতে পারে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ও এটুকু বুঝতে পারল দুই বউদির মধ্যে বোধহয় সম্পর্ক ভালো নেই। রান্না যে আলাদা হয় তা চা-তৈরির ব্যাপারটা থেকে বোঝাই যাচ্ছে।

ছাদে উঠে গৌরব দেখল এখনই এই সন্ধেবেলায় প্রচুর জামা প্যান্ট কাপড় তারে মেলে দেওয়া আছে। সে একটিমাত্র ঘরের দিকে এগোতেই সুইচ বন্ধ করার শব্দ হলো। ততক্ষণে দরজায় পৌঁছে গেছে সে। পিসীমা দ্রুত হাতে হিটারের তারটা খুলছিলেন, ওকে দেখে স্থির হলেন। পিসীমার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল তার। শৈশবের অনেকটা অংশ জুড়ে এঁর স্মৃতি। ওর সমবয়সী একটি মেয়ে ছিল পিসীমার। সুধা। সুধার বিয়ে হয়ে গেছে এখন। কিন্তু গৌরব জন্মাবার পর সরলা খুব শক্ত অসুখে পড়েছিলেন। তখন গৌরবকে কাছে রেখেছিলেন পিসীমা। তার বুকের দুধ ভাগ করে খেয়েছে সুধা আর গৌরব। সেই পিসীমার চেহারা এখন আর তেমন নেই। প্রায় কঙ্কালের ওপর একটু আস্তরণ। গাল বসে গেছে, চোখ কোটরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা স্নেহময়ী ভঙ্গী রয়েছে প্রকাশে। মাথার ঘোমটা টেনে পিসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, কে?

গৌরব জুতো খুলে অন্ধকারে থেকে আলোয় আসার জন্যে ঘরে ঢুকল, আমায় চিনতে পারছ পিসীমা?

সঙ্গে সঙ্গে পাশের খাটে শব্দ হলো। ধীরে ধীরে সেখানে কেউ উঠে বসছে। পিসীমা যেন পাথরের মতো জমে গেছেন। তার দৃষ্টি গৌরবের ওপর স্থির। হঠাৎ ফোয়ারার মুখ থেকে চাপা-পাথর সরে গেল। ওই শীর্ণ শরীর সোজা হয়ে গেল। পিসীমা চিৎকার করে উঠলেন আনন্দে, ওমা, গোরা! দেখ দেখ, গোরা এসেছে, কবে এলি গোরা, তুই কবে এলি? প্রায় ছুটে এসে তিনি জড়িয়ে ধরলেন গৌরবকে।

হৃদয়ের উত্তেজনা যখন শরীর ছড়িয়ে যায় তখন অন্ধও তার প্রকাশ বুঝতে পারে। গৌরব কিছুক্ষণ সময় নিল, কেমন আছ তুমি?

আমি, কেমন দেখছিস?

খুব, খু-উব রোগা হয়ে গেছ তুমি।

না রে ভালো আছি। রোগা হওয়া ভালো। তোকে যে আবার দেখতে পাব ভাবি নি। গৌরব এবার পিসীমাকে প্রণাম করে খাটের দিকে এগিয়ে গেল। পিসেমশাই চশমা হাতড়াচ্ছেন, গৌরব সেটাকে খাটের একপাশ থেকে তুলে ওঁর হাতে দিয়ে বলল, পাদুটো দেখি।

চশমা পরে পিসেমশাই ওর হাত ধরলেন, না না প্রণাম করতে হবে না। শুয়ে থাকা মানুষকে প্রণাম করতে নেই।

এই অসময়ে শুয়ে আছেন কেন?

দেখ না, ঠাণ্ডা জলে স্নান করে তিনদিন হলো জ্বর বাধিয়েছে। আজ একটু কম। পিসীমা আস্তে আস্তে ফিরে হিটারের সঙ্গে তারটি যুক্ত করে সুইচ অন করলেন। গৌরবের খেয়াল হলো তার পায়ের শব্দ টের পেয়ে হিটার অফ করেছিলেন পিসীমা! কেন?

একটা মোড়া টেনে পিসীমার সামনে বসতেই পিসেমশাই খাটের ওপর বসে বললেন, আমেরিকায় এত দিন থেকে গোরা বেশ ফর্সা হয়ে গেছে না?

গৌরব খুব হাসল, আমাকে ফর্সা বললে আমেরিকানদের চোখ কপালে উঠবে। তারপর বলো, তোমাদের খবরাখবর কী?

পিসেমশাই জবাব দিলেন, আমাদের খবর? আছি, বেঁচে আছি।

পিসীমা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অমন করে বলছ কেন? ছেলেটা কত দিন পরে এল, ভাববে তোমার খুব কষ্ট। বুড়ো হলেই এইভাবে কথা বলতে হবে?

না কষ্ট কোথায়। শরীরটা নিয়েই যা। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছেলেরা যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত। তা গোরা, আমেরিকা দেশটা কি রকম? পিসেমশাই প্রশ্ন করলেন।

কী ব্যাপার জানতে চাইছেন?

এই খাবার দাবার, জীবনযাত্রা?

ভালো। এখনও সস্তায় মুরগির মাংস, দুধ পাওয়া যাচ্ছে। সস্তা মানে এখানকার চাইতেও সস্তা। রাস্তাঘাটে ধোঁয়া বা ময়লা নেই। বেড়াবার জায়গা আছে। সামান্য পরিশ্রম করলে ভালো রোজগার করা যায়। সরকার আপনাকে অধিকার দেবে কিন্তু অন্যের অসুবিধে করলে ক্ষমা করবে না। এই আর কি!

বাঃ, আর কি চাই! এইটুকু যদি এখানে পেতাম আমরা! ওখানকার বুড়ো বুড়িদের অবস্থা?

পিসেমশাই প্রশ্ন করা মাত্র পিসীমা বললেন, ওহো, তুমি একাই কথা বলছ। গোরা, চা খাবি তো? তোকে চায়ের সঙ্গে ঘরে ভাজা নিমকি দিতে পারি।

দারুণ। চটপট করো।

কেন, তাড়া কীসের? হ্যাঁরে, বউদি কেমন আছে? সৌরভ?

সবাই ভালো আছে।

আমাদের তো যাওয়াই হয় না। সৌরভের বউ নাকি অন্যরকম।

পিসীমা, সবাই তো আর একরকম হয় না। গৌরব লক্ষ্য করল পিসীমা হিটার অফ করে তার খুলে নিলেন। তারপর সন্তর্পণে চোখের আড়ালে হিটারটাকে চালান করে দিলেন।

গৌরব পিসেমশাইকে আমেরিকার বৃদ্ধদের গল্প করতে পারত। সেখানকার বাবা-মায়েরা সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর যেমন আর কোনো দায়িত্ব বহন করেন না তেমনি সন্তানও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে না। অবসর নেবার পর সেই কারণেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার হাতে পয়সা থাকে। সন্তান বা নাতি-নাতনীদের সম্পর্কে আগ্রহ থাকলেও একসঙ্গে আর বাস করা হয় না। সেই সময় তারা নিজেরাও নির্জনতা পছন্দ করে। কেউ কেউ যদি সন্তানের জন্যে কাতর হন তাহলেও তাকে বিচ্ছেদ সইতে হবে। যেহেতু রাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব অনেকটা বহন করে তাই কোনো বড় বিপাকে পড়েন না। কিন্তু নিঃসঙ্গতা রোগের শিকার হওয়া ছাড়া কোনো উপায় খোলা থাকে না। ওদেশে এখন মাদারস্ ডে ফাদারস্ ডে চালু হয়েছে। সেইদিন সন্তানেরা একটা অভিনন্দন জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। এদেশের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা হয়তো অর্থনৈতিক অসুবিধেয় বাস করেন কিন্তু তারা অন্তত সন্তানদের কাছাকাছি পান আমৃত্যু। এইসব কথা বলতে পারত গৌরব। কিন্তু একজন বৃদ্ধের কাছে আর একজন বৃদ্ধের নিঃসঙ্গ ছবি তুলে ধরতে ইচ্ছে করল না। হোক না সেই বৃদ্ধ অপরিচিত?

ঠিক এই সময় একটি বালক দরজায় এসে দাঁড়াল। তার ভঙ্গিতে কিছু লুকোনোর চেষ্টা। গৌরবকে দেখে কি করবে বুঝতে পারছিল না। গৌরব ওকে চিনতে পারল। সে যখন এই বাড়িতে পা দিয়েছিল তখন এই বালক তাকে দেখে চেঁচিয়ে বড়বউদিকে ডেকেছিল। পিসীমা ছেলেটিকে দেখে উঠে গেলেন, এনেছিস?

ছেলেটি মাথা নেড়ে, হ্যাঁ, বলতে বলতে পকেট থেকে একটার পর একটা আলু বের করতে লাগল। উজাড় করে দিয়ে ছেলেটি বলল, আড়াইশো গ্রাম। কুড়ি পয়সা ফেরত এসেছে।

পিসীমা গৌরবের দিকে পেছন ফিরে আলুগুলো নিয়ে বললেন, লক্ষ্মী ছেলে। তারপর নিজের জায়গায় চলে এসে আলুগুলো বাটিতে রেখে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বড়র ছেলে, রাজা। খুব ন্যাওটা আমার। পকেট থেকে ওইভাবে আলু বের করা, আড়াইশো গ্রাম ওজনের কথা বলা এবং খুচররা পয়সা ফেরত দেওয়া–এসবেই প্রমাণ করে ছেলেটি ওই বস্তু দোকান থেকে এনেছে। কিন্তু ঠোঙায় বা ব্যাগে না এনে পকেটে লুকিয়ে আনল কেন? এবার ছেলেটি যেন কিছুটা ধাতস্থ হলো। এই সময় পিসীমা চা এবং নিমকি এগিয়ে দিলেন গৌরবের সামনে। আর তখনই পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দরজায় বড় বৌদি। হাতে চায়ের কাপ এবং একটা বাটিতে চিড়ে ভাজা, এই যে গোরা ঠাকুরপো, তোমার চা চিড়ে ভাজা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এখানে খেয়ে নাও। এই রাজা, তোর বাবা কাগজ চাইছে। কাগজ নিয়ে গিয়ে পড়তে বসো।

গৌরব জিনিসগুলো নিয়ে সামনে রেখে বলল, বসে পড় বউদি। দাদাকেও ডাকো। জমাট আড্ডা হোক।

না ভাই, নিচে অনেক কাজ পড়ে আছে। তুমি বরং খেয়ে নিয়ে নিচে চলে এস। বউদি ব্যস্ত পায়ে নিচে যাওয়া মাত্র রাজা বলল, তাড়াতাড়ি কাগজ দাও, বাবা বকবে।

পিসেমশাই বললেন, সারা সকাল দুপুর কাগজ রেখেও ছাই কি যে পড়ে ওরা? আমার এখনও এডিটরিয়াল পড়া হয় নি। একটু বাদে দিচ্ছি।

পিসীমা বললেন, আহ! ছেলেটা সারাদিন খেটেখুটে এল। নিশ্চয়ই কোনো দরকারি কিছু দেখতে চাইছে। নিয়ে যা বাবা, ওই ওখানে আছে।

রাজা টেবিলের ওপর থেকে কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই আবার পায়ের শব্দ, এবার ছোট বৌদি। পিসীমা বললেন, এস বউমা। গোরা, তুই ওকে দেখিসনি। ছোটর বউ। ভারি ভালো মেয়ে। ওমা, তুমিও চা নিয়ে এলে যে!

ছোট বউদি ঘরে ঢুকে গৌরবের সামনে একটা চায়ের কাপ আর প্যাস্ট্রি সমেত ডিশ এগিয়ে ধরলেন, আমেরিকায় থেকে সময়টা রাখতে শেখা উচিত ছিল। আমি চা বানিয়ে বসে আছি আর–। হ্যাঁ, ও এসে গেছে। তাড়াতাড়ি নিচে আসা হোক।

গৌরব বলল, কি ব্যাপার, এত চা খাবে কে? তার চেয়ে ছোটদাকেও এখানে ডাক, সবাই মিলে খেতে খেতে গল্প করা যাবে।

ছোট বউদি বললেন, না ভাই, সে নিচে চা খাচ্ছে। একটু বাদেই আমরা বের হব। এসো কিন্তু।

ছোট বউদি চলে গেলে ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল। শেষ পর্যন্ত গৌরব কথা বলার চেষ্টা করল, একেই বলে কম্যুনিকেশন গ্যাপ। আমি ওদের বলে আসিনি চা খাব না। দোষ আমার। ঠিক আছে, তিন কাপ চা আমরা তিনজনেই খাই। পিসীমা, তুমি বড় বউদিরটা নাও, পিসেমশাইকে ছোট বউদির চা আর আমি পিসীমার। দুটো কাপ দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিলো সে। পিসেমশাই খুশি হলেন। এই সময় বোধহয় পিসীমা তাকে চা দিতেন না। বাড়তি পাওয়াটুকু বেশ উপভোগ করতে করতে তিনি বললেন, আমার একবার সৌরভের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি শুধু পেন্সন আনার দিন বাইরে যাই। দেখি। তাকে বলো, কিছু মনে না করতে।

পিসেমশাই যে কথাটা বলতে পারছে না সেটা স্পষ্ট হোক গৌরব চাইল না। তিনশো টাকার জন্যে কোনো সম্পর্ক যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তা নষ্ট হওয়াই উচিত।

পিসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে, কদিন থাকবি?

গৌরব হাসল, ইচ্ছে আছে একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে এখানে থেকে যাই। না জুটলে ফিরে যেতে হবে। ছুটি আছে তেরো সপ্তাহের।

পিসেমশাইম আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন, কত মাইনে পাও ওখানে?

গৌরব জবাব দিলো, বছরে ষাট হাজার ডলার।

পিসেমশাই বিড়বিড় করলেন, তার মানে মাসে পাঁচ হাজার। এক ডলার বারো টাকা। ওরে বাব্বা, মাসে ষাট হাজার টাকা মাইনে? কী বলছ কী?

না পিসেমশাই, ডলারকে টাকায় ট্রান্সফার করবেন না। ওরা মাইনে দিচ্ছে ওখানে খরচ করার জন্যে। ওখানে এক ডলার মানে একটাকাই।

আমি ভাবতে পারছি না। এত টাকা। উফ। চোখ বড় হয়ে গেল পিসেমশাই-এর।

তা কবে বিয়ে করবি? নাকি করে ফেলেছিস? পিসিমা অন্তরঙ্গ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

ফেললে তো বাড়িতে একটা কার্ড আসত, তাই না?

গোপনে গোপনে কোনো মেমসাহেবকে ঘরে আনিসনি তো?

সে ভাগ্য হলো না আমার। বিয়ে করলে আমি দেশের মেয়েকেই করব।

করবি? তাহলে আমি সম্বন্ধ দেখি।

এই সময় পিসীমাকে থামিয়ে দিলেন পিসেমশাই, থাম তো। তুমি যেসব চেন তাদের বাপ দুআড়াই হাজার মাইনে পায়। ষাট হাজারি ছেলের যোগ্য মেয়ের সঙ্গে তোমার আর এ জন্মে আলাপ হবে না।

গৌরব মাথা নাড়ল, না পিসীমা, পিসেমশাই ঠিক বললেন না। বিমর্ষ পিসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে গৌরব বলল, ছেলেবেলায় যাঁর বুকের দুধ খেয়েছি তিনি নিশ্চয়ই আমার জন্যে ভালো কাজ করবেন। হাজারের ব্যাপারটা কোনো বাধাই নয়। যখন সময় হবে তখন ঠিক বলব তোমাকে। গৌরব উঠে দাঁড়াল।

পিসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, চলে যাচ্ছিস?

না, নিচে এল গৌরব। বড়দার ঘরে সে ঢুকল প্রথমে। খাটের ওপর বইপত্র নিয়ে পড়তে বসেছে রাজা। বড়দা খালি গায়ে লুঙি পরে তার পড়া দেখছেন। বড় বউদি এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় তরকারি নিয়ে বসেছেন। তাকে দেখে বললেন, শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেলে? এসো। গৌরব দেখল ছোট ঘরটা জিনিসপত্র ঠাসা। একটুও নড়বার উপায় নেই। আর আসবাব যা আছে তা আদ্যিকালের পুরনো। বড়দা একপাশে সরে ওকে খাটে বসার জায়গা করে দিলেন। স্বভাবতই রাজার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটল। গৌরব বলল, আমি আসার জন্যে ওর পড়ায় ডিস্টার্ব হলো।

বড় বউদি বললেন, না না, আমাদের ঘরের ছেলেকে তো এইভাবেই বড় হতে হবে।

গৌরব বলল, কিন্তু এত ছোট জায়গায় তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে না?

বড় বউদি বললেন, হচ্ছে। ওপাশের ঘরে জিনিসপত্র আছে, তোমার দাদা ওখানেই শোয়। ছেলে আবার ওই ঘরে গিয়ে পড়বে না।

কেন?

বড্ড স্যাঁতসেতে। বহুদিন তো হোয়াইট ওয়াশ করা হয় নি। বড়দা বললেন, পৈতৃকবাড়ি, ছেড়ে কোথাও যাব তার উপায় নেই। আমাদের অফিস কো-অপারেটিভ থেকে গড়িয়ায় জমি দিচ্ছে খুব সস্তায়। আড়াই কাঠা কিনে রেখেছিলাম। বাড়ি করতে গেলে যে টাকা দরকার তা পাব কোথায়? বাবা-মা যদ্দিন আছেন তদ্দিন এই করেই থাকতে হবে। বড়দার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ঝুপ করে আলো নিভে গেল। চারপাশ থেকে একটা হতাশজনক শব্দ উচ্চারিত হলো। আর সবচেয়ে খুশি হলো রাজা। সে বইপত্র রেখে চিৎকার করে উঠল, আমি কিন্তু হ্যারিকেনের আলোয় পড়ব না।

বড়দা বললেন, হ্যারিকেন জ্বালো।

বড় বউদি ঝটপট খাটের তলা থেকে হ্যারিকেন এনে সেটাকে জ্বালতেই গৌরব বলল, তোমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ না?

বড়দা হাসলেন, আমি কিন্তু অন্ধকারে ভালো শুনতেও পাই না। এই সময় বাইরে কাশি শব্দ হলো। তারপরেই ছোটদাদার, গলা, গোরা আছিস।

হ্যাঁ, বলো। গৌরব উত্তর দিলো।

আয়, তোর সঙ্গে কথাই হচ্ছে না।

যাচ্ছি। যা অন্ধকার।

আমার ঘরে আলো আছে। ইনভার্টার। চলে আয়। হাওয়াও পাবি।

বড় বউদি উদাস মুখে বললেন, যাও ভাই, এই গরমে তো মিছিমিছি পচবে। ইনভার্টারের হাওয়া খেয়ে এস। আর কদিন পরেই তো তিনলাখ টাকার ফ্ল্যাটে উঠে যাবে।

গৌরব বলল, না বউদি, বেশ দেরি হয়েছে। ওদের সঙ্গে কথা সেরেই যেতে হবে।

বড়দা বললেন, আর একদিন আসিস।

গৌরব বলল, নিশ্চয়ই।

একই ধরনের ঘর। কিন্তু ঢুকলেই বোঝা যায় রুচি এবং পয়সা আছে। লোডশেডিং-এর তোয়াক্কা না করে ফ্যান-আলো জ্বলছে ইনভার্টারে। ছোটদা বললেন, বাঃ, চমৎকার চেহারা হয়েছে তোর। আয় বোস। চা খাবি আর একবার?

গৌরব মাথা নাড়ল, না। তোমরা তো বেরুচ্ছো।

ছোট বউদি বললেন, হ্যাঁ। নেমন্তন্ন করেছি একজনকে। আমাদের খাইয়েছিল তা তাকে তো পালটা খাওয়ানো উচিত। তাই হোটেলে যাছি।

হোটেলে কেন? এখানে ডাকলে না কেন?

ছোট বউদি বললেন, এখানে? এই ছোট ঘরে ভারি লজ্জা করে।

ছোটদা বললেন, পৈতৃক বাড়ি, ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে হয় না। একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি কিন্তু অত টাকা পাব কোথায়? দাদাও শুনলাম গড়িয়ায় জমি কিনেছে। বাবা মা বেঁচে থাকতে কিছু হবে না।

ছোট বউদি বললেন, ছেড়ে দাও এসব কথা। বিদেশ থেকে কী আনলে? সেন্ট, সাবান, না ইলেকট্রনিক্স!

ছোটদা বললেন, ওর বিদেশি জিনিসের খুব শখ। ওর এক মাসতুতো দাদা থাকে জার্মানিতে, মাঝে মাঝে এনে দেয়।

গৌরব হাসল, কিছুই আনা হয়নি এবার। আচ্ছা দাদা, আজ চলি, যাওয়ার আগে একদিন দেখা করে যাব।

ছোট বউদি বললেন, তুমি সেদিন আমার এই ছোট ঘরে বসে খাবে কিন্তু।

দেখা যাবে। হাসল গৌরব। তারপর আলো ঝলমল থেকে বেরিয়ে প্যাসেজটায় এসে দাঁড়াল। পুরো বাড়িটা অন্ধকারে ডুবে আছে। একবার পিসীমাদের সঙ্গে কথা বলে যাওয়া দরকার।

সে অন্ধকারে সন্তর্পণে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। ওপরে উঠেই সে থমকে দাঁড়াল। একটা চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে। কান্নাটা মহিলার গলায়। খুব সাবধানে পা ফেলে সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটা আধা ভেজানো। কান্নাটা আসছে ভেতর থেকেই, পিসীমার গলায়।

হঠাৎ পিসেমশাই খেঁকিয়ে উঠলেন, কেন আর কাঁদছ। কপালে যা আছে, তা মানতেই হবে। তখন থেকে বলছি হ্যারিকেন জ্বালো সেটা শুনতে পাচ্ছ?

পিসীমার কান্না বন্ধ হলো কিন্তু উত্তর এল না।

পিসেমশাই আবার বললেন, আলো জ্বালো আলো জ্বালো, আমার দম অন্ধকারে বন্ধ হয়ে আসছে।

পিসীমা কাতর গলায় বললেন, তিনদিন ঘর ছেড়ে বের হওনি।

তাতে কী হয়েছে?

ঘরে যে একফোঁটা কেরোসিন নেই, আলো কী দিয়ে জ্বালব!

গৌরব পা টিপে টিপে নিচে নেমে এল। ওই নিঃসঙ্গ দুটি মানুষকে নতুন করে লজ্জিত করতে চাইল না সে। প্যাসেজ দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরের আকাশের তলায় দাঁড়াল সে। এই মুহূর্তে সে উপকার করতে পারে কিন্তু বাকি জীবন পিসীমারা কী নিয়ে থাকবেন তাহলে?

.

বারো বছরে একটা শহরের চেহারা কতটা আর পাল্টাতে পারে? কিন্তু গৌরবের মনে হচ্ছিল এই শহরের মানুষ তার জায়গার মতো বেশ পাল্টে গেছে। একটা পাতাল রেল প্রকল্প নিশ্চয়ই সাময়িক কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যে জায়গায় যে পরিচিত দোকান ছিল তা হয়তো রাস্তা বাড়াবার কারণে নেই কিন্তু তার বেশি কি চোখে ঠেকবে? কিন্তু এই ঘিঞ্জি শহরটায় লক্ষ লক্ষ মানুষ থাকা সত্ত্বেও একটা নিজস্ব আরামবোধ ছিল। সেটাই যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে বড়লোকদের পাড়া বলতে ছিল আলিপুর, নিউ আলিপুর আর অভিজাত এলাকা বালিগঞ্জ। এখন নিও অতিবড়লোক পাড়া তৈরি হয়ে গেছে, সল্টলেক। এই ঘিঞ্জি শহরের নাকের ডগায় কিছু মানুষ আপাতস্বস্তিতে বাস করার জন্য বিরাট এলাকা তৈরি করে নিয়েছে যা অনেকের কাছেই স্বপ্নের বিষয় হবে। দক্ষিণের শেষপ্রান্তে মধ্য উচ্চবিত্তদের জন্যে যে গলফ গ্রীন এলাকা তৈরি সেখানেই কি শেষপর্যন্ত কলকাতার ফুসফুস বাঁচবে? এসব তো ভৌগোলিক বিস্তৃতি। এই বিস্তৃতির উল্টো ক্রিয়া ঘটেছে মানুষের ক্ষেত্রে। মানুষের মনের পরিধি যেন অনেক ছোট হয়ে এসেছে। নিজস্ব সত্তা, নিজস্ব পরিবারের বাইরে কেউ কিছু ভাবতে রাজি নয়। সেই সঙ্গে বহন করে আসছে অতীতের যা কিছু খারাপ সংস্কার, প্রথা এবং মধ্যযুগীয় ধারণা। আর তার পাশেই তৈরি হচ্ছে ছিন্নমূল মানুষের প্রজন্ম এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার আর একটা শ্রেণী যাদের মধ্যে কোনো বোধ কাজ করে না। শিক্ষা-দীক্ষার প্রশ্নই নেই, একটা হিংস্র কঠোর অথচ দিকশূন্য জীবন নিয়ে, সেই প্রজন্ম বেড়ে চলেছে। এই পরিবর্তনটা বড্ড চোখে পড়ে। অথচ এই নিয়ে কেউ ভাবছে বলে মনে হয় না।

বাড়িতে আপাতত শান্তি। যদিও বউদির সঙ্গে মায়ের একটা অদৃশ্য ফাঁক থেকেই গেছে। দাদা অনেকটা স্বাভাবিক। বেচারা মা অথবা স্ত্রী কাউকেই নিজের মতো করে বোঝাতে পারছে না, ক্রমশ পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের দিন যে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে দাদাকে দেখে।

বনিকে বাইকে নিয়ে বেরিয়েছিল গৌরব। মেয়েটা তার খুব ন্যাওটা হয়েছে। ওর মানসিকতায় বাঙালীয়ানা বেশি কিন্তু বউদি ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে জোর করে ঠেলে দিয়ে চাইছেন সেগুলোকে বর্জন করাতে। গৌরব আসার পর মেয়েটা যেন স্বস্তি পেয়েছে। ইদানীং ওর মোটরবাইকে চড়ে বেড়াতে ভালবাসে সে।

বাড়ির সামনে বাইকটা স্টার্ট করার মুখেই একটা গাড়ি চলে যেতে যেতে আচমকা ব্রেক কষল। গৌরব তাকিয়ে দেখতেই চোখাচোখি হলো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, আরে সন্দীপ না? কী খবর?

সন্দীপ তখন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। তারও মুখে বিস্ময় এবং আনন্দ, নাঃ শালা! তোর চেহারা কি হয়েছে রে? কবছরে এতটা বদলে গেছিস? আমেরিকার চালে ভাত বোধহয় অন্যরকম হয়, না?

বনিকে বাইকটা ধরতে ইশারা করে গৌরব কাছে এগিয়ে এল, খুব পাল্টে গেছে চেহারা? কি জানি। কেমন আছিস বল?

ফার্স্ট ক্লাস। কবে এলি? জানালি না পর্যন্ত।

আরে এসেছি কিছুদিন। আর তারপর থেকে নানা ঝামেলায়–।

ওহো আয় তোর সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।

সন্দীপ সামান্য ঝুঁকে গাড়িতে বসে থাকা একজন যুবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই তোমাকে গৌরবের নাম বলেছিলাম মনে আছে? এই সেই গৌরব। আমার–। শেষটায় সে ইশারায় গৌরবকে বোঝাল। গৌরব হাতজোড় করতে ভদ্রমহিলা বললেন, আপনার কথা ওর কাছে অনেক শুনেছি। আসুন না একদিন আমাদের বাড়িতে।

যাব। নিশ্চয়ই যাব। গৌরব আন্তরিকভাবে বলল।

সন্দীপ বলল, কথার কথা নয় কিন্তু। হোয়াট অ্যাবাউট ইউ। বিয়ে থা করেছিস? আমি তো কিছুই জানি না।

সময় পাইনি। ঠিক আছে যাব, নিশ্চয়ই যাব।

সন্দীপরা বারংবার কথা আদায় করে যখন চলে যাচ্ছে তখন গৌরব জিজ্ঞাসা করল চললি কোথায়?

স্টেশানে। আজ আমাদের জীবনের খুব অন্যতম দিন। আমার দাদু মোর দ্যান এইটটি। ছেলেবেলায় আমার তাঁর কাছেই কেটেছে। অনেক বলেছি, এতকাল কিন্তু কিছুতেই গ্রাম থেকে নড়তে চান নি। শেষপর্যন্ত বরফ গলেছে। আজ আসছেন কিছুদিন আমার কাছে থাকতে। সন্দীপ জানাল। জানিয়ে চলে গেল।

বাইকে বসামাত্র গৌরবকে বনি জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধু?

হ্যাঁরে। একসময় আমার খুব বন্ধু ছিলাম।

এখন?

এখনও আছি তবে অনেকদিন পরে দেখা হলে সেটা প্রথমেই বোঝা যায় না।

আচ্ছা কাকু, তোমার সেই বন্ধু, যাঁর খোঁজে আমরা একদিন গিয়েছিলাম, ওই যে যারা বাড়ি পাল্টেছে অথচ ঠিকানা রেখে যায় নি বলে তুমি ঠাকুমাকে বলেছিলে, তার খোঁজ পেয়েছ? বনি জিজ্ঞাসা করল।

গৌরব ঠোঁট কামড়াল। আশ্চর্য ব্যাপার। জয়তীকে কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারছে না সে। যে বাড়িতে ছিল সেটা পাল্টেছে ওরা। কোথায় গেছে কেউ জানাতে পারছে না। পুরনো বন্ধু-বান্ধবরা কেউ ওর খবর রাখে না। কোথায় গেল মেয়েটা। স্কুলে কাজ করত জয়তী। কিন্তু কোন্ স্কুল তা জানে না গৌরব। এই শহর এমন যে কেউ ইচ্ছে করলে চিরকাল জনতার আড়ালে থেকে যেতে পারে। কিন্তু জয়তীকে খুঁজে বের করতেই হবে। ও যখন কলকাতা থেমে আমেরিকায় গিয়েছিল পড়াশোনা করতে তখন যে জয়তীকে রেখে গিয়েছিল সেই জয়তীর মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। প্রথমদিকে নিয়মিত চিঠি যেত আসত। যখন গৌরবের মাসিক রোজগার হাজার ডলারে পৌঁছলো তখনই সে চেয়েছিল জয়তী সব ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসুক। প্রেমের পরিণতি সার্থক হোক বিবাহে। কিন্তু সেখানেই লাগল বিরোধ। জয়তী জানিয়েছিল ব্যক্তিগত সুখের জন্যে সে সংসারের অন্য সবাইকে বঞ্চিত করতে পারবে না। ওর বাবা অসুস্থ, ওকে চাকরি নিতে হয়েছে। এখন তার চলে যাওয়া সম্ভব নয়। গৌরব লিখেছিল, যদি টাকাই বড় কথা হয় তাহলে সে নিয়মিত আমেরিকা থেকে টাকা পাঠাতে পারে। চাই কি জয়তীও সেখানে গিয়ে চাকরি নিয়ে এঁদের সাহায্য করতে পারে। আর যদি কলকাতায় অন্য কোনো আকর্ষণ থাকে তাহলে আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে সরাসরি জানানোই শোভনীয়। তারপর থেকেই জয়তী চুপচাপ হয়ে গেল। গৌরব চিঠি দিয়েছে। একের পর এক, উত্তর পায়নি।

ভেবেছিল, বেলেঘাটার ওর এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে গৌরব যে সম্ভবত জয়তীর খবর রাখে বলে কোনো কোনো বন্ধু জানিয়েছে। কিন্তু তার বাড়িতে সে শুনল বন্ধু অফিসের কাজে বাইরে গেছে। আর একটা ব্যাপার বেশ চোখেই পড়ছে। বত্রিশে একদল বন্ধু বেশ সেটলড হয়ে বিয়ে থা করেছে। কিন্তু কেউ কেউ তো এখনও বেকার। প্রথম দলের সঙ্গে মিশলে কোথায় যেন একটা ফাঁক থাকছে, দ্বিতীয় দলের সঙ্গে একটা আড়াল। দুপক্ষের আচরণে সবসময় এটাই বোঝা যাচ্ছে।

বেলেঘাটায় গৌরবের দূরসম্পর্কের এক কাকা থাকতেন। ছেলেবেলায় ওই বাড়িতে বেশ যাতায়াত ছিল। গৌরব স্মরণশক্তির ওপর নির্ভর করে বনিকে নিয়ে পাড়ায় এল। তার একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল বাড়িটা খুঁজে বের করতে। দুটো নতুন বাড়ি এলাকার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। সে লক্ষ্য করল একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছেলে গুলতানি মারছে। বাইকটা থামাতেই একটা সিটি বাজল। একটি কর্কশ গলা গেয়ে উঠল, দিল দিয়া দরদ লিয়া।

একজন প্রবীণ ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন, তাঁকে কাকার নাম বললে তিনি বাড়িটাকে দেখিয়ে দিলেন। গৌরব বাইকটাকে বাড়ির সামনে রেখে দরজায় কড়া নাড়ল। সেই সময় আরও কিছু মন্তব্য ছুটে এল। আর এই সবই যে বনিকে উদ্দেশ করে তা বুঝতে সময় লাগল না। গৌরবের চোয়াল শক্ত হলো, বনির মুখে রক্ত জমল। সেই সময়, ভেতর থেকে চাপা ক্রোধ ভেসে এল, কেন বিরক্ত করছ। আমি তো বলেই দিয়েছি সম্ভব নয়।

অবাক হয়ে গৌরব ডাকল, কাকাবাবু।

এবার দরজা খুলল। একজন বছর ষাটের মানুষ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে। তার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। তিনি একবার গৌরবের, আর একবার বনির দিকে তাকালেন, কাকে চান?

আমাকে চিনতে পারছেন না কাকাবাবু? আমি গৌরব।

সত্যিই চমকে গেলেন ভদ্রলোক, তারপর সেটাকে সামলে নিয়ে বললেন, আরে কী খবর? এসো এসো, হোয়াট এ সারপ্রাইজ! শুনছ, দেখ কে এসেছে।

গৌরব একবার চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে বনিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কাকা দরজা বন্ধ করে দিলেন। এই সময় ভেতর থেকে কাকিমা বেরিয়ে এলেন। বয়স তার শরীরে ছাপ ফেলেছে, ওমা গোরা না? কী চেহারা হয়েছে তোর? রাস্তায় দেখলে তো চিনতেই পারতাম না। কবে এলি?

এইতো কিছুদিন। কেমন আছেন সবাই।

আমি তো খারাপ থাকি না কখনও। এটি কে?

দাদার মেয়ে। বনানী। গৌরব পরিচয় করিয়ে দেওয়া মাত্র বনি দুজনকে প্রণাম করল। কাকিমা ওর চিবুক ধরে বললেন, বাঃ বেশ মিষ্টি হয়েছে তো। সৌরভের মেয়ে এতবড় হয়ে গেছে আমি জানিই না।

কাকাবাবু বললেন, যাতায়াত না থাকলে জানবে কী করে?

গৌরব বলল, হ্যাঁ, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না এখানে এসে, কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না কেন? মাও বললেন অনেককাল আপনাদের খবর উনি পান না। শুধু বিজয়ার সময় চিঠি দেওয়া পাওয়া ছাড়া।

কাকাবাবু বললেন, তাও বউদি যতদিন আছেন। আসলে আমাদেরও নানান ঝামেলা। ওদিকে সৌরভের স্ট্যাটাস তার আর এক জীবন–এইসব মিলিয়েই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। যাক, ছেড়ে দাও, তুমি যে এলে এতে ভারি খুশি হয়েছি।

ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হলো। কাকিমা বললেন, তুমি একদম রাগারাগি করবে না। এ পাড়ায় থাকতে হলে এসব সহ্য করতেই হবে।

সহ্য করার একটা সীমা আছে। কাকা বিড়বিড় করলেন। বাইরে থেকে চিৎকার এল, সব কি কানে তুলো দিয়েছেন? খামটা এবার শো করুন।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে কাকাবাবু?

কাকা বললেন, পাড়ার মস্তানরা শেতলাপুজো করবে। আমাকে একশো টাকার চাঁদার স্লিপ ধরিয়েছে। আমি বলছি পারব না। তাই ঝামেলা শুরু হয়েছে।

একশো টাকা চাঁদা? শেতলাপুজোর জন্যে? গৌরব অবাক হয়ে গেল।

দরজার শব্দ বাড়ছিল। কাকা দরজা খুলে একটু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই?

সেটা তো আপনি জানেন মেসোমশাই। কেন রেলা করছেন। মালটা ছাড়ুন।

আমি তো তোমাদের বলেছি অত টাকা চাঁদা দিতে পারব না।

আপনি কী বলেছেন সেটা কে শুনবে? আমি যা বলেছি তাই শুনবেন। আমার নাম তিকরি, বেলেঘাটার সব মস্তান আমাকে গুরু বলে এটা নিশ্চয় আপনি জানেন। পাত্তি বের করুন। একটি গলার অনেক রকম হুমকি। এই ভাষা বিদেশে যাওয়ার আগে গৌরব শোনেনি। এটা কি বাংলা?

সে উঠে গিয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, তোমরা এসব কি বলছ? প্রথম কথা তোমরা কি পুজো করার আগে ওঁর সম্মতি আছে কিনা জেনেছ? তা যখন জানাওনি তখন উনি যা দেবেন তাই নাও।

একটি কালো রোগা চোয়াড়ে দেখতে লম্বা চুলের ছেলে বলল, আরে এই লম্বুটা আবার কে? কথা হচ্ছে পাড়ার মধ্যে, বেপাড়ার মাল কেন ওভারটেক করছে?

গৌরব একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, যা বলেছি তার জবাব দাও আগে।

জবাব? ছেলেটা হাসল, মোটরবাইকটা হাপিস করে দেব নাকি? চাম্পুকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন বেড়িয়ে যান আমাদের ঘরোয়া কথায় কান দেবেন না। দিন দাদা, মালটা ফেলুন। বহুৎ সময় খরচ হয়ে যাচ্ছে আপনার জন্যে।

গৌরব ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসে খপ করে ছেলেটার কলার ধরে ফেলেছে, কী বললে? চাম্পুকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি। চাম্পু মানে কী বলে?

প্রথমে ছেলেটার চোখে মুখে অসহায় ভঙ্গি ফুটে উঠল। গৌরবের মুঠোয় আটকে ছেলেটা ছটফট করছে। তার বন্ধুরা ঠিক প্রস্তুত না থাকায় কী করবে বুঝতে পারছে না। এর ঝটকা দিয়ে গৌরব ওই ছেলেটিকে দূরে ফেলে দিয়ে বলল, তোমাদের মতো নোংরা ছেলের গায়ে হাত দিতেও ঘেন্না লাগে।

সঙ্গে সঙ্গে একটা ছুরি বেরিয়ে এল ছেলেটির হাতে। মাটি থেকে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, জান্ নিয়ে নেব শালা তোর। ভোগে যাওয়া থেকে কে তোকে বাঁচায় দেখি। সরে যা তোরা। খুনকা বদলা খুন।

গৌরব ছেলেটার অস্বাভাবিক ছোরা হাতে দেখে একটু অবাক হলো! এবং তখনই একটা চিৎকার ভেসে এল, তিকরিদা, কালো দল নিয়ে অ্যাকশনে আসছে। তাড়াতাড়ি এস।

সঙ্গে সঙ্গে বাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল তিকরি, কালো! শালা কালোর এত হিম্মত! আমার পাড়ায় অ্যাকশন করতে এসেছে? ঠিক হ্যায়। তোমার হিসেব পরে হবে লম্বু। কালোকে দেখে আমি আবার আসছি।

দলটা দৌড়ে চলে গেল গলি দিয়ে।

গৌরব কাকাকে বলল, এরা কারা কাকা?

আমাদের পাড়ার গার্জেন। কাজটা তুই ভালো করলি না গৌরব।

কেন? ওরা আমাকে মেরে ফেলবে?

ওদের অসাধ্য কিছু নেই। বিবেক, ভদ্রতা, শিক্ষা বলে কিছুই নেই ওদের।

দেখা যাক। গৌরব হাসল, কিন্তু তোমরা এখানে আছ কী করে?

কোথায় যাব? পৈতৃক বাড়ি। কলকাতার যেখানেই যাব সেখানেই বাড়িভাড়া আকাশছোঁয়া। আর সেখানেই যে এরা, মানে এদের মতো আর কোনো দল থাকবে না তার বিশ্বাস নেই। এই রক্তবীজরা হু-হু করে বেড়ে যাচ্ছে।

ঘরে ঢুকে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, পুলিশকে খবর দিচ্ছ না কেন?

পুলিশ! বলবে, কেন জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করছেন। তাছাড়া পুলিশ দুদিন না হয় এখানে থাকবে। তারপর? আমাকে তো কাজকর্মে বের হতেই হবে তখন কে বাঁচাবে? তাছাড়া খুকি কলেজে যায়, টিউশনি করে।

খুকি? খুকি এত বড় হয়ে গেছে? গৌরব বিস্মিত হলো।

বাঃ হবে না? ওর একুশ হলো। ওকে নিয়েই তো দুশ্চিন্তা। এইসব ছেলের সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করতে হয়ে ওকে।

কাকিমা বললেন, খুকি কিন্তু ওদের ভয় পায় না, যাক তোমরা ভেতরে এস। চা করতে যাচ্ছি আমি। তুমি এসো মা আমার সঙ্গে।

বনিকে নিয়ে কাকিমা চলে গেলে গৌরব বলল, আমি যাওয়ার আগে কলকাতায় মাস্তান ছিল। কিন্তু এত ব্যাপক হারে এবং এই ভাষায় কথা বলার ছেলে ছিল না। কাকা বললেন, ওদের দোষ নয়। এদের বেশির ভাগই জন্মেছে ছিন্নমূল পরিবারের সন্তান হিসেবে এখানে। বাবা-মায়ের স্নেহ এবং সাচ্ছল্য পায়নি। রাস্তায় বড় হয়েছে। তার ওপর হিন্দি সিনেমার প্রভাবে আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ওদের এই চেহারা দিচ্ছে। লক্ষ্য করে দেখ, প্রত্যেকের একজন ফিল্ম হিরোর মতো কানঢাকা বাবড়ি চুল। আগামীকাল বলে এদের কিছু নেই।

এই সময় খুকি এলো। মাঝারি চেহারার প্রাণবন্ত মেয়ে। পরিশ্রমের চিহ্ন মুখে। এসে অবাক হয়ে তাকাল, গৌরবদা না?

কাকা বললেন, তুই কী করে চিনতে পারলি?

বাঃ, চিনব না কেন? কবে এলে তুমি? ভালো আছ? কতদিন বাদে দেখলাম। কী খবর?

এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে দিতে পারব না। গৌরব হাসল, আমি ভালো আছি। তোর খবর কী?

এই তো। ও হ্যাঁ, বাবা, আমাদের বাড়িতে কি পাড়ার ছেলেরা কোনো ঝামেলা করেছে?

কাকাবাবু উত্তর দিলেন, ওরা একশো টাকা চাঁদা চেয়েছে শীতলা পূজোর জন্যে। আমি দেবো না বলায় যা-তা বলেছে একে। গৌরব বোঝাতে গেলে ওকে অপমান করেছে। তখন গৌরব ছেলেটার কলার ধরেছিল।

খুকি মাথা নাড়ল, জয়দা সেই কথাই বলল। ওরা খুব খেপে আছে। তবে জয়দা বলেছে যে ছেলেটা অপমান করেছিল তাকে নিয়ে এখানে আসবে।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, জয়দা কে?

কাকা বললেন, পাড়ায় থাকে। মাস্তান। তবে একটু ভদ্রতা এখনও আছে। ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বেসিক্যালি হি ইজ এ মাস্তান বাট নট ইয়েট রুইনড। খুকির সঙ্গে ভদ্রগলায় কথা বলে।

খুকি বলল, আসলে গৌরবদা, পাড়ার পরিবেশ যখন এই রকম তখন কারো কারো সঙ্গে যদি একটু ভদ্রভাষায় কথা বলা যায় তাহলে সে অনেক উপকারে আসে। জয়দা মাস্তানি করে ঠিক তবু কোথায় যেন এখনও ভালত্ব লেগে আছে।

কাকা বললেন, তোকে নিয়েই আমায় ভয়। কোনোদিন যদি কিছু করে বসে ওরা।

এই সময় কাছাকাছি বোমের শব্দ শুরু হলো। খুকি বলল, দুদলে লাগল। এবং তখনই দরজার কড়া নড়ল। কাকা দরজা খুলতে একটি ফর্সা স্বাস্থ্যবান ছেলে আর একজনের কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল ভেতরে, ক্ষমা চা এঁদের কাছে। পাড়ার মা-বোনদের ইজ্জত নেই না?

ছেলেটা সেই অবস্থায় কোনরকমে বলল, কাজটা ভালো করছ না জয়দা। আমি বদলা নেবই। সঙ্গে সঙ্গে জয় তার পেটে এমন একটা আঘাত করল সে ককিয়ে উঠে চুপ করে গেল। কাকাবাবুর সামনে ওকে এনে জয় বলল, কিছু মনে করবেন না কাকাবাবু, ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। একে দেখে রাখুন। যদি কোনোদিন কিছু করে আমাকে বলবেন। তারপর কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, যা।

ছেলেটি ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। জয় বলল, ওরা একশো চেয়েছিল? দিতে হবে না। আপনি পঁচিশ দিন। ওদের আমি বুঝিয়ে বলব।

কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে পঁচিশ টাকা বের করে জয়ের হাতে দিলেন। সে টাকাটা নিয়ে খুকিকে বলল, চলি ভাই খুকি।

খানিকক্ষণ বসে চা খাবার খেয়ে গৌরব উঠল। কাকাবাবু তখনও শঙ্কিত ছিলেন। বললেন, সাবধানে যেও।

বাইরে বেরিয়ে মোটরবাইক স্টার্ট দিল গৌরব। বনিকে পেছনে বসিয়ে স্টার্ট দিল সে। খানিকটা যাওয়ার পর সে ব্রেক কষল। সামনের গলিতে একটা ঝামেলা হচ্ছে। গৌরব জয়কে দেখতে পেল।

তাকে ঘিরে কয়েকজন খুব তড়পাচ্ছে। হঠাৎ একজন ছুরি বের করে জয়কে আঘাত করে দৌড়ে পালাল। জয় দেয়াল ধরে মাটিতে বসে পড়েছে। আর তৎক্ষণাৎ গলিটা ফাঁকা হয়ে গেল।

গৌরব ছুটে গেল কাছে। এক হাত দিয়ে তার কাঁধে চেপে ধরেছে। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন। সে তাড়াতাড়ি ওকে ধরে জিজ্ঞাসা করল, উঠতে পারবেন?

জয় চোখ তুলে দেখল। তারপর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। ওর কাঁধ থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। গৌরব বলল, আপনি আমার সঙ্গে হসপিটালে চলুন।

না। ঝটকা দিলো জয়, হাসপাতালে যাব না। এই কেস ওরা পুলিশে রেফার করবে।

কিন্তু আপনি উন্ডেড!

এমন কিছু বেশি নয়। আমার চেনা ডাক্তার আছে।

ও। তাহলে অন্তত খুকিদের বাড়িতে চলুন। ফার্স্ট এইড দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিই।

গৌরবের কথায় জয়ের মুখটা অন্যরকম হয়ে গেল, আপনি খুকিদের বাড়িতে ছিলেন না? ওরা আপনাকে মারতে চেয়েছিল বলে ঝামেলা হলো। আপনি, আপনি আমার উপকার করতে চাইছেন কেন?

আপনি মানুষ বলে।

মানুষ? আমাকে কেউ মানুষ বলে না, জানেন! আপনার কথা আমার মনে থাকবে। টলতে টলতে উল্টোপথে চলে গেল জয়।

মোটরবাইকে ফিরে স্টার্ট দিতেই বনি জিজ্ঞাসা করল, ও তোমাকে কি বলল কাকা?

অন্যমনস্ক গলায় গৌরব বলল, কিছু না।

.

রাত বেশ হয়েছিল। মোটরবাইক নিয়ে বেশ দ্রুতগতিতেই বাড়ি ফিরছিল গৌরব। পার্ক স্ট্রিট থেকে ক্যামাক স্ট্রিট দিয়ে ঢুকে সে থিয়েটার রোডের দিকে আসছিল। রাস্তা ফাঁকা, দুপাশের দোকানপাট বন্ধ। জায়গায় একটু পাল্টায়নি। তবে বারো বছর আগে এলাকাটা অফিস পাড়া আর কিছু ধনওয়ালা বড়লোকদের থাকার জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। এখন প্রচুর মাল্টিস্টোরিড বাড়ি উঠেছে। এতে অবশ্য সন্ধের পরের চরিত্র পাল্টায়নি।

থিয়েটার রোড থেকে মিন্টোপার্কের দিকে যেতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল গৌরবের। একটি অল্পবয়সী মেয়ে ছুটছেই বলা যায়। তার পিছু নিয়েছে দুটো লোক। দূর থেকেই মনে হচ্ছে ওদের পদক্ষেপ সুস্থ নয়। মোটরবাইকে বসে গৌরব ভাবল ব্যাপারটা এ পাড়ায় আগেও ছিল। সন্ধের পরে খদ্দের ধরতে পতিতারা সেজেগুজে এসব এলাকায় ঘোরাফেরা করে। কিন্তু পুলিশের তাড়া ছাড়া ছোটে না কেউ। ব্যাপারটা আমল না দিয়ে সে বাঁদিকে বাঁক ঘুরতে যাবে এমন সময় মেয়েটি ফুটপাত থেকে ছিটকে নেমে এল পথে। প্রায় জোরে ব্রেক কষে নিজের পতন এবং দুর্ঘটনার সামাল দিলো গৌরব। মেয়েটি এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল যে মুখে হাত চাপা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল।

খুব খেপে গিয়ে গৌরব চিৎকার করে উঠল, মরার ইচ্ছে হয়েছে না? দেখে রাস্তায় নামতে পারেন না? আর একটু হলেই–। কথা বলতে বলতেই গৌরবের মস্তিষ্কে যে বোধের জন্ম নিল তা হলো মেয়েটি পতিতা শ্রেণির নয়। পরনে জিনসের প্যান্ট এবং বাগী শার্ট, কাঁধে চামড়ার ব্যাগ। মুখে রঙ নেই। কিন্তু শিক্ষার ছাপ রয়েছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অনুসরণকারীরা দূরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, ওরা কারা? ছুটছিলে কেন? যার বয়স কখনই উনিশের ওপরে নয় তাকে আপনি বলার কোনো মানে হয় না।

মেয়েটি তখনও স্বাভাবিক নয়। কোনোমতে মাথা নেড়ে বলল, জানি না। ওরা আমাকে ডাকছিল।

এত রাত্রে তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?

জানি না। থ্যাঙ্কস। বলে মেয়েটি উল্টো ফুটপাতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই গৌরব বাধা দিলো, দাঁড়াও। কী করো তুমি?

কলেজে পড়ি। ইটস এনাফ, ইজন্ট ইট? আমাকে বাঁচিয়েছেন বলে ধন্যবাদ দিয়েছি। ঘুরে দাঁড়িয়ে তীব্র স্বরে কথাগুলো ছুঁড়ে দিল মেয়েটি।

কিন্তু লোকদুটো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এই নির্জন রাস্তায় এত রাত্রে তুমি সেফ নও।

আমি কী করে জানব যে আপনার কাছে আমি নিরাপদ?

ওয়েল। তা বলতে পার। তবে আমার সঙ্গে আইডেন্টিটি কার্ড রয়েছে। তুমি দেখতে পার। তাছাড়া তোমাকে আমি ছাড়তে পারি না নৈতিক কারণে। উঠে এসো।

কেন?

তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।

না। আমি বাড়িতে এখন যাব না।

এখন? তুমি জানো এখন কটা বাজে?

জেনেই বলছি। আপনি যেতে পারেন। আই ক্যান লুক আফটার মাইসেল।

গৌরব হাসল, তার নমুনা তো একটু আগেই দেখলাম। লোকদুটো আবার পিছু নিলে ভালো লাগবে? ওঠো পেছনে, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

কোথায় পৌঁছে দেবেন?

তোমার বাড়িতে।

বললাম তো আমি এখন বাড়ি ফিরব না।

মেয়েটি যে রকম জেদী গলায় কথাগুলো বলল তাতে ফাঁপরে পড়ল গৌরব। অথচ একে এভাবে ছেড়ে যেতেও ওর ইচ্ছে করছিল না। আমেরিকায় এ রকম প্রচুর মেয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় ঘোরে এবং তাদের সর্বনাশ হতে বেশি সময় লাগে না। এতক্ষণ কথা বলে তার স্পষ্ট ধারণা হয়েছে মেয়েটি অত্যন্ত ভদ্রঘরের এবং পড়াশোনা আছে। সে গলা ভারী করে বলল, দ্যাখো ভাই তুমি যদি আমার কথা না শুনতে চাও তাহলে আমাকে রূঢ় হতে হবে। লোকাল থানার ও.সি. আমার পরিচিত। তোমাকে থানায় যেতে হবে।

আপনি কি আমার মরাল গার্জেন? ফুঁসে উঠল মেয়েটি।

না। কিন্তু তোমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারি না।

মেয়েটি এক মুহূর্তে ভাবল তারপর পাশ কাটিয়ে গৌরবের বাইকের ব্যাক সিটে উঠে বসল, ঘুরিয়ে নিন। মেয়েটি যে দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল এখন তার বিপরীত দিকে যেতে চাইলে গৌরব ইঞ্জিন চালু করল। বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে স্পিড তুলতেই সে বুঝল অনুসরণকারীরা খুব হতাশ হলো। খানিকটা যাওয়ার পর মেয়েটির নির্দেশে বাঁ দিকে বাঁক নিল। একদা সাহেবপাড়া এখন সামান্য বদলালেও রাস্তাঘাট ছায়া ছায়া জনশূন্য। মাঝে মাঝে কোনো উঁচু ফ্ল্যাটের স্টিরিও থেকে বাজনা ভেসে আসছে। সেইরকম একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বলল, থ্যাঙ্কস। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, এখানেই তুমি থাকো?

দ্যাটস নট ইওর প্রব্লেম। বলেই মেয়েটি হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। খুব জেদ চেপে গেল গৌরবের। মেয়েটির মা বাবার সঙ্গে দেখা করে বলা দরকার ব্যাপারটা। সে বাইক একপাশে সরিয়ে রেখে লম্বা পায়ে অনুসরণ করল। ততক্ষণে লিফটটা ওপরে উঠে গেছে। বাইরের ফ্লোর ইনডিকেটর চোখ রেখে সে দেখল আলো জ্বলতে জ্বলতে লিফট থামল ছয় তলায়। বোতাম টিপতে সেটা নিচে নেমে আসতেই গৌরব লিফটে উঠে ছতলায় বোতাম টিপল। এত রাত্রে লিফটম্যান থাকে না। শূন্য লিফটে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে না তো! কিন্তু শেষ দেখে যাওয়ার ইচ্ছাই প্রবল হলো। দরজা খুলে যেতেই বাইরে পা দিয়ে সে একটু হকচকিয়ে গেল। তিনটে ফ্ল্যাটের দরজা তিনদিকে। তিনটেই বন্ধ। মেয়েটি কোন্ ফ্ল্যাটে ঢুকেছে? ঘড়ি দেখল সে। এত রাত্রে দরজায় দরজায় নক করে জিজ্ঞাসা করা আদৌ শোভন নয়। লিফট নেমে গিয়েছিল। গৌরব দেখল ওটা যখন আবার উঠে এল তখন ছতলার দুজন পুরুষ-মহিলা যাত্রী বেরিয়ে এলেন। গৌরবকে একবার বিরক্ত চোখে দেখে চাবি বের করে একটা দরজা খুলে ওরা ভেতরে ঢুকে যেতেই গৌরবের চোখ বাকি দুটো দরজার ওপর পড়ল। সে মরিয়া হয়ে একটি দরজার বেল টিপল। কোনো সাড়া নেই দ্বিতীয়বার টিপতেই দরজাটা খুলল। একটি একুশ বাইশ বছরের ছেলে দরজাটা ধরে রেখে ঈষৎ জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ প্লিজ?

তৎক্ষণাৎ একটু কটু গন্ধ ধক্ করে নাকে লাগল গৌরবের। সে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, একটু আগে যে মেয়েটি এখানে ঢুকেছে তাকে একটু ডেকে দাও।

কেউ এখানে ঢোকেনি। ছেলেটির গলা ওপরে উঠল, ডোন্ট ডিস্টার্ব আস।

কী করছ তোমরা? দ্যাটস নট ইওর বিজনেস।

ভেতর থেকে আর একটি জড়ানো কণ্ঠ ভেসে এল, কী ফালতু বকছিস। বন্ধ করে দে। ছেলেটি দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল কিন্তু গৌরব ততক্ষণে অনেকটাই ঢুকে পড়েছে। এবং তখনই সে দৃশ্যটি দেখতে পেল। কার্পেট পাতা ঘরে উনিশ থেকে বাইশ বছরের গোটা ছয়েক ছেলেমেয়ে আধশোয়া বসা অবস্থায় রয়েছে। একজন গাঁজা খাচ্ছে তখনও। বাকিরা সম্ভবত কোনো ড্রাগে আচ্ছন্ন। গৌরব বলল, এই ব্যাপার? ফ্ল্যাটটা কার?

তখন দরজায় দাঁড়ানো ছেলেটি এবার নরম গলায় বলল, আমাদের।

তোমার বাবা-মা কোথায়?

দে আর আউট ফর দ্য নাইট।

সেই মেয়েটি কোথায়, যে এসেছে একটু আগে।

আপনি কে?

পুলিশ।

সঙ্গে সঙ্গে গাঁজা খাচ্ছিল যে সে সোজা হয়ে বসল। বাকি ছেলেমেয়েগুলোর কোনো প্রতিক্রিয়া হওয়া সম্ভব ছিল না বলেই হলো না। গৌরব আবার বলল, আমি তোমাদের বেশি সময় দেব না, মেয়েটিকে এখানে আসতে বলো। নইলে তোমাদের থানায় যেতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার চেহারা পাল্টে গেল। দরজা ছেড়ে কয়েক পা ভেতরের দিকে গিয়ে সে চিৎকার করে ডাকল, টিনা, এই টিনা বেরিয়ে আয়। উই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি ট্রাবল। কাম আউট প্লিজ। ছেলেটির কথা শেষ হতেই ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটি, এসে প্রতিবাদী ভঙ্গি তে দাঁড়াল। গৌরব মাথা নাড়ল, সত্যি কথাটা বলতে পারতে তো। যাদের ফ্ল্যাট সেই ছেলেটি বলল, টিনা তুই চলে যা। আমরা কোনো ঝামেলা চাই না। তুই খাবি না অথচ এসে ঝামেলা করিস। বাবা যদি জানতে পারে পুলিশ এসেছিল!

ছেলেটির কথা শেষ হওয়ামাত্র মেয়েটি বড় বড় পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে এল। গৌরব বাইরে বেরিয়ে আসতেই সে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। বোতাম টিপল অসহিষ্ণু ভাবে। গৌরব কথা বলল না। লিফট এলে সে মেয়েটির পাশে দাঁড়াল। মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে আছে ওপাশে। লিফট নিচে নামলে হঠাৎ সে হিংস্র চোখে তাকাল আপনি কী চান? কেন আমাকে অপমান করলেন?

গৌরব হাসল, ব্যাপারটা হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি চাই তুমি বাড়ি ফিরে যাও। এই আড্ডায় তুমি রোজ আস?

না। প্রত্যেক শনিবারে এরা এখানে বসে। মেয়েটি আবার মুখ ফেরাল।

এই যে এরা ড্রাগ খাচ্ছে, তুমি খাও?

না। একদিন গাঁজার কল্কেতে টান দিয়েছিলাম বিশ্রী লেগেছিল। ড্রাগ খেতে এখনও সাহস পাচ্ছি না। এসব কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?

এইভাবে এলে একসময় তুমি সাহস অর্জন করে ফেলবে।

তাতে আপনার কী?

আমার কিছুনা। তোমার মতো স্মার্ট সুন্দরী মেয়ের জীবনটা নষ্ট হবে ভেবে একটু খারাপ লাগছে এই মাত্র। এদের বাবা-মা কোথায়?

এত প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।

তাহলে তোমাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

আপনি কী চান?

তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে।

হঠাৎ মেয়েটি গটগট করে হেঁটে গৌরবের বাইকের কাছে পৌঁছে গেল। তারপর ডাকল, চলুন। বাইকে স্টার্ট দিয়ে মেয়েটিকে বলল গৌরব, ডাইরেকশন দাও, কোনো রকম চালাকির চেষ্টা কোরো না। তোমার নাম শুনলাম টিনা, পুরোটা কী?

মেয়েটি কোনো উত্তর দিলো না। সে যে পেছনের সিটে বসে আছে তাও যেন টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে বাঁ দিক কিংবা ডান দিক বলে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। গৌরব ঠিক করল, টিনার বাবা-মাকে সে ডাকবে। সমস্ত ঘটনা খুলে বলবে এবং ভবিষ্যতের জন্যে সতর্ক হতে অনুরোধ করবে। সুযোগ পেলে দুজনকে একটু বুঝিয়ে দেওয়া যাবে এভাবে মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে তাঁরা ভালো কাজ করছেন না। বিশেষ ধরনের নয়, মাল্টিস্টোরিড একটা বাড়ির সামনে টিনা ওকে বাইক থামাতে বলল। ফুটপাতে উঠে জিজ্ঞাসা করল, নামবেন না? আমাকে পৌঁছে দিতে এসেছেন তো!

গৌরব খোঁচাটা বুঝল। সে বাইক বন্ধ করে মেয়েটিকে অনুসরণ করল। এবাড়ির লিফটও এত রাতে নিজেকেই চালাতে হয়। চারতলার একটা ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে টিনা দাঁড়াল, তারপর মিনিটখানেকের মধ্যে তিনবার বেল বাজাল। গৌরব অবাক হলো, কেউ খুলছে না কেন? এবার টিনা নিজের ব্যাগ থেকে চাবি বের করল। দরজা খুলে ভেতরে পা দিয়ে ডাকল সে, আসুন।

ঘরে আলো জ্বলছিল। এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সোফায় শুয়ে আছেন মুখ হাঁ করে। তাঁর পায়ের জুতো টেবিলের ওপরে। টিনা বলল, আমার বাবা। ভদ্রলোক যে অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রতিক্রিয়ায় অচেতন হয়ে রয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। ওপাশের দুটো ঘর থেকে ঘুরে এসে টিনা বলল, এটা পড়ে দেখুন। মা রেখে গেছেন।

এই রকম পরিবেশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল গৌরব। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল, দ্রুত হাতে লেখা রয়েছে, খেয়ে শুয়ে পড়বে। আই অ্যাম গোয়িং আউট ফর দ্য নাইট টু অ্যাটেন্ড এ পার্টি। গৌরব মুখ তুলে টিনাকে দেখল।

টিনা হাসল, আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আপনি। কিন্তু বলতে পারেন আমি কেন বাড়িতে ফিরব? প্রতি শুক্র এবং শনিবার রাতে আমাকে একা থাকতে হয়। বাবার সঙ্গে কথা বলা যায় না, মা থাকে না। আমি একা, একা এই বন্ধ ফ্ল্যাটে হাঁপিয়ে উঠি। মন খারাপ হয়ে যায়।

তুমি ওঁদের একথা বলেছ?

বলেছি কিন্তু কেউ শোনেনি।

ও। কিন্তু তুমি বড় হয়েছ। নিজেকে নষ্ট করো না। পড়াশোনায় মন দাও। গৌরব দরজার দিকে এগোল। হঠাৎ টিনা চিৎকার করে উঠল, না। আপনি আমাকে ফেলে যাবেন না।

কোথায় যাবে তুমি?

যেখানে হোক। কোথাও জায়গা না থাকলে আমার বন্ধুদের ওখানে রেখে আসুন।

এখন কত রাত খেয়াল আছে?

রাত? ভোরের আগে এ বাড়িতে রাত আসবে না।

কিন্তু তুমি বুঝছ না কেন এখন তোমার বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

এখন আমি এখানে থাকলে হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলব।

গৌরব টিনাকে দেখল। এই ফ্ল্যাটে পা দেবার পর থেকেই মেয়েটার আচরণ যেন পাল্টে গিয়েছে। কথার ধরনেই মনে হচ্ছে খুব স্বাভাবিক ও নেই। দ্বিধা কাটিয়ে গৌরব বলল, ঠিক আছে, এসো তুমি।

এখন মধ্যরাত। কলকাতার নির্জন রাস্তায় গৌরব টিনাকে বসিয়ে সমানে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। একটা পুলিশ ভ্যান ওদের থামাতে গিয়েও থামাল না। গৌরব একবার ভাবল টিনাকে নিয়ে মায়ের কাছে যাওয়া যাক। কিন্তু অত রাতে সেটাও একটা নাটকের মতো লাগবে। অথচ ওকে কিছুতেই বন্ধুদের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া যায় না। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধুদের মা-বাবা কিছু বলে না? ওরা রাত্রে বাড়িতে নেই!

জানেই না। আমার বন্ধুদের মা-বাবাও শনিবার রাত্রে বাড়িতে থাকে না। তাই তো এক একদিন এক একটা ফ্ল্যাটে ওদের আসর বসে।

ঠাকুমা কাকারা সেসব ফ্ল্যাটে নেই?

না। এখন সবাই হাম দো আউর হামারা এক।

ভোরের আগে লেকের একটা স্টাচুর ধারে বাইক রাখল গৌরব। বেশ ক্লান্ত লাগছে এখন। অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে। জ্বলন্ত আলোগুলো বেশ হলদে হলদে। লেকের জল কালচে সবুজ। ওরা পাশাপাশি বসেছিল। একটা ধাপের ওপর। হঠাৎ টিনা বলল, আজ আপনাকে খুব কষ্ট দিলাম, না? গৌরব কোনো উত্তর দিলো না। কথাটা সত্যি, কিন্তু কষ্টটা সে যেচে নিয়েছে। এরপর কেউ কোনো কথা বলছিল না। ধীরে ধীরে অন্ধকার উঠে যাচ্ছিল গাছের মাথায়। হঠাৎ বয়স্ক গলায় উচ্চারিত হতে শুনল সে সূর্যবন্দনা। পরিষ্কার সংস্কৃতে। টিনা জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন ভদ্রলোক?

গৌরব হাসল, যাও গিয়ে জিজ্ঞাসা কর। এই জলের ধারেই তো উনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

টিনা উঠল। কাছে গিয়ে দেখল, কেবল একজন বৃদ্ধ হাতজোড় করে পূবাকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। সংস্কৃতের বিন্দুবিসর্গ সে বুঝছে না। কিন্তু পুবের আকাশ ক্রমশ লাল হয়ে এল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল লাল বলের মতো সূর্য। প্রণাম সেরে ভদ্রলোক পিছু ফিরতেই টিনাকে দেখে হাসলেন। আর সেই মুহূর্তে একটি বালক ছুটতে ছুটতে এসে ওঁকে জড়িয়ে ধরে কিছু বলল।

বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বালককে সঙ্গে নিয়ে টিনার পাশে উঠে এলেন।

টিনা বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনি কী করছিলেন?

বৃদ্ধ হাসলেন, সূর্য প্রণাম।

কেন?

যাতে অন্ধকার দূর হয়, পৃথিবীতে আলো আসে। এই যে আমার নাতি, আগামীকালের জন্যে আমি প্রার্থনা করে যাচ্ছি। ও যদি সুখে থাকে তাহলে আমি ভালো থাকব।

ও কী বলল আপনাকে?

ও আমাকে ডাকতে এসেছে। আমার বউমা পাঠিয়েছেন ওকে। চা হয়ে গেছে। বৃদ্ধ চলে গেলেন নাতিকে নিয়ে। আর টিনা এগিয়ে এল গৌরবের কাছে। গৌরব দেখল ওর মুখের চেহারা যেন পাল্টে গিয়েছে। টিনা বলল, আমি বাড়ি যাব।

গৌরব উঠে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা ভোরের বাতাস বইছে। বাইকে স্টার্ট দিয়ে সে বলল, ওঠো।

.

ভোররাতে বৃষ্টি নেমেছিল। আকাশের চেহারা সকাল সাতটাতেও খোলতাই হলো না। ব্যালকনিতে বসে গৌরব চা খাচ্ছিল একা। অনেকদিন বাদে এইরকম একটা সকালের মুখোমুখি হলো সে। মার্কিন মুলুকেও বৃষ্টি নামে, দিনের পর দিন স্যাঁতসেঁতে শীত নিয়ে আকাশ গম্ভীর হয়ে থাকে কিন্তু এই ছবির মতো বর্ষার্ত সকাল দেখেই বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠল। ছেলেবেলা থেকে কলেজ জীবনের অনেক বর্ষার স্মৃতি চলকে উঠে এল মনে। আর তখনই তার জয়তীকে মনে পড়ল।

জয়তীর মুখ, হাত, কাঁধ, লম্বাটে গড়ন, হাঁটার ভঙ্গি, চাহনি এমনকী মজা পেয়ে হেসে ওঠার ভঙ্গিটাও এখন তার সামনে। এতবছর ধরে সে যে মেয়েটার ছবি নিয়ে আমেরিকায় একা থেকেছে অথচ এই কলকাতা শহরে এখনও দেখা হলো না। কোন্ অভিমান মানুষকে এমন অন্ধ করে রাখে? শুধু এই দীর্ঘদিনের অদর্শন থেকে মানুষ ভুল বুঝতে পারে? যদি সে মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে তাহলে প্রশ্ন করবে তার অপরাধ কী? জয়তী আমেরিকায় যেতে চায়নি মা আর বোনকে এখানে একা রেখে। দায়িত্ব অস্বীকার করে গৌরবের স্ত্রী হয়ে সে দেশে সুখী হতে পারবে না বলে জানিয়েছিল। ভালবাসাকে প্রয়োজনের ওপরে স্থান দিতে চায়নি ও। সে জানিয়েছিল গৌরব যদি চায় তাহলে যে কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হতে পারে। বিবেক আছে এমন কোনো মানুষের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। কথাটা জানিয়েছিল গৌরব। এবং তারপর থেকেই যোগাযোগ ছিন্ন। আশ্চর্য, একটা মেয়ে তার পরিবার নিয়ে কলকাতা শহরে কোথায় আছে তা সে এসে অবধি বের করতে পারছে না। ওর আগের বাড়িওয়ালাও নাকি নতুন ঠিকানা জানেন না। বন্ধুবান্ধবরাও অন্ধকারে। গৌরব একটা বড় নিঃশ্বাস নিল। তারপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতেই মাকে দেখতে পেল। ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে মা নিচে নামছিলেন, ওকে একা বসে থাকতে দেখে কাছে এলেন।

তোমার ঠাকুরসেবা হলো? গৌরব পরিহাস করার চেষ্টা করল। মা হাসলেন। তারপর বললেন, এই বাদলায় এখানে বসে কী ভাবছিস? অনেককাল বাদে বাদলা শব্দটা কানে যেতেই মনটা প্রফুল্ল হলো। এমন অনেক শব্দ আছে যে বিশেষ মুহূর্তে বয়স্করাই ব্যবহার করেন। বাংলা জানলেও চট করে তার প্রয়োগ করা সচরাচর সম্ভব হয় না। গৌরব বলল, বসতে ভালো লাগছে।

মা বললেন, আমার বাবা এইরকম মেঘলা দিন দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। কথা ঘোরাল গৌরব, টনি বনি স্কুলে বেরিয়েছে?

হ্যাঁ। তুই ঘুমাচ্ছিলি বলে আর ডাকেনি।

বউদি?

আছে নিচে।

শব্দদুটো মা চাপা গলায় বলতেই গৌরব মুখ তুলে তাকাল, কি হয়েছে মা?

মা মুখ ফেরালেন, ও এমন কিছু নয়।

গৌরবের কপালে ভাঁজ পড়ল, তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ?

মা হাসবার চেষ্টা করলেন, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার বুঝতে গেলে সংসারী হতে হয়।

এটাও উত্তর হলো না।

উঃ। কি নাছোড়বান্দা ছেলে। কাল রাত্রে একটু দেরি করে ফিরেছিল সৌরভ। কোথাও পার্টি টার্টি ছিল বোধহয়। হয়তো বেশি ড্রিংক করে ফেলেছিল। তাই নিয়ে তোর বউদি খুব রাগারাগি করেছে। আজ সকাল থেকে কারো সঙ্গে কথা বলছে না। তিনিও ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

গৌরব একটু থম করে থেকে বলল, আমি বুঝতে পারি না, বউদি যখন পছন্দ করে না তখন দাদার এসব খাওয়ার দরকারটা কী! একসঙ্গে বাস করতে গেলে অন্যের পছন্দের সঙ্গে মানিয়ে চলতেই হবে। আমার ভালো লাগে না।

মা মাথা নাড়লেন, সত্যি, এতবছর আমেরিকায় থেকেও তুই একটুও পাল্টালি না। যাক, এসব কথা তোকে চিন্তা করতে হবে না। যাদের ব্যাপার তারা সামলে নেবে। আমার শুধু খারাপ লাগে বাচ্চা দুটোর কথা ভেবে। মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হলে আগে আঁচ লাগে সন্তানের গায়ে। তোর সঙ্গে জয়তীর এখনও দেখা হলো না?

আচমকা জয়তীর প্রসঙ্গ এসে যাওয়ায় যে গৌরব অবাক হয়েছিল তা বুঝতে দিলো না। সে মাথা নেড়ে নিঃশব্দে না বলল। মা বিরক্ত হলেন একটু, আশ্চর্য! উত্তরটা দিতে তোর একটুও খারাপ লাগছে না?

ভালো লাগছে তা বুঝলে কী করে?

তাহলে খুঁজে বের করছিস না কেন?

যে নিজে থেকে আড়ালে থাকতে চায় তাকে খুঁজে বের করে অস্বস্তিতে ফেলা ঠিক হবে?

আমি তোদের কিছুতেই বুঝতে পারি না কথাটা শেষ করে মা আর দাঁড়ালেন না।

গৌরব আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। এখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি থেমে ইলশেগুঁড়ি নেমেছে। আজ সারাদিনের মতো সূর্যদেব আড়ালে থেকে যাবেন বলে মনে হচ্ছে। বাইরের দিকে তাকালেই আলস্য ভর করে মনে। গৌরব উঠল। দেখল মলি গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে গেল।

বউদিকে এবারে ঠিক বুঝতে পারছে না গৌরব। সবই করছেন কিন্তু কেমন ছাড়া ছাড়া। গৌরব দরজায় এসে দাঁড়াল। মলি শুয়ে পড়েছে এর মধ্যে বালিশে মুখ গুঁজে। শরীরটা স্থির হয়ে রয়েছে। গৌরব অবাক হলো। তারপর ঘরে ঢুকে বলল, তোমার শরীর খারাপ, বউদি?

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মলি। কাপড় ঠিক করে নিয়ে বলল, না। কেন, কিছু বলবে?

চেয়ারটা খাটের কাছে টেনে নিল গৌরব, কী হয়েছে বলো তো?

মলি ঠোঁট কামড়ালো। মুখের কালো ছায়া সরাতে পারল না। কিন্তু কথা বলতেও শক্তি পেল না।

গৌরব ব্যাপারটা বুঝল, থাক। মনে হচ্ছে একা থাকলে তোমার ভালো লাগবে। রেস্ট নাও। সে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু মলি বলল, গোরা একটু বসো।

অবাক হয়ে তাকাল গৌরব। তারপর আবার চেয়ারে ফিরে এল। মলি কপাল থেকে চুল সরাল, তোমার সঙ্গে মায়ের কোনো কথা হয়েছে? আমাদের ব্যাপারে?

গৌরব মাথা নাড়ল, সামান্য।

মলি মুখ নিচু করল, আমি তোমার সাহায্য চাই গোরা।

বলো কী করতে পারি? গৌরব বুঝতে পারছিল না তার ঠিক কী রকম ভূমিকা নেওয়া উচিত।

আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাব। মলি মুখ তুলল না।

চমকে উঠল গৌরব, কী বলছ বউদি?

মুখ তুলল মলি, হ্যাঁ। আমার পক্ষে আর এখানে থাকা অসম্ভব। মায়ের মুখ চেয়ে–! নিঃশ্বাস ফেলল মলি, না, আর না। কিন্তু মাকে ব্যাপারটা জানানো উচিত। এ কাজটা আমার হয়ে তুমি করবে?

কোনো কিছু না জেনে তোমায় কথা দিই কী করে! গৌরব তখনও হদিশ পাচ্ছিল না।

ও! কয়েক মুহূর্ত ভাবল মলি। বড় অস্বস্তিকর সেই সময়টা। শেষ পর্যন্ত সে বলল, তোমাকে আমি বুদ্ধিমান বলেই জানতাম, কিন্তু এত সতর্ক তা কখনও ভাবিনি।

গৌরব হাসল, ব্যাপারটায় প্রশংসা না নিন্দে কোনটা আছে তা যখন ধরতে পারছি না তখন বুদ্ধিমানই বা বলি কী করে। কিন্তু কী এমন হলো যাতে এত বছরের সম্পর্ক, এই বাড়ির অস্তিত্ব তছনছ করে তোমাকে চলে যেতে হবে? ছেলেমেয়ে দুটোর কথা ভেবেছ?

ম্লান হাসল মলি, অস্তিত্ব কারো অভাবে তছনছ হয় না গোরা। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী আর্থিক বিপদে পড়ে কিন্তু একথা কি কখনও শুনেছ কোনো বিধবা ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে মারা গেছে? স্ত্রী মারা গেলে যে শোক তা ভুলতে কদিন লাগে? বাস্তব বড় নির্মম। আর নির্মম বলেই সুবিধে। শোক ভুলে যেতে বেশি সময় লাগে না। আমি চলে গেলেও এই বাড়ি একইরকম থাকবে। কে বলতে পারে, নতুন যে আসবে তার কাছে ছেলেমেয়েরা আরও ভালো থাকবে না।

নতুন যে আসবে! নাঃ, অনেক হয়েছে। এবার পরিষ্কার কথা বলো বউদি।

মুখ তুলে সরাসরি তাকাল মলি, তোমার দাদা প্রায়ই মধ্যরাতে বাড়ি ফেরে। আমি জানতাম তার অফিসে প্রচণ্ড চাপ, মাঝে মাঝে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হয়। মুখে মদের গন্ধ পাই। তা আজকাল তো কলকাতার বেশির ভাগ বাড়িই মদ খাওয়া মেনে নিয়েছে। মাতলামি না করলেই হলো। মাঝে মাঝে মদ খেলে মায়ের মুখোমুখি হবে না বলে তোমার দাদা নাকি দেরি করে ফিরত। আমিও তাই ভেবেছিলাম।

এইটুকুই আমি মায়ের মুখে শুনেছি। তুমি তাই নিয়ে ঝামেলা করেছ। আমি মদ খাই না কারণ আমার খেতে ভালো লাগে না। কোনো সংস্কারে নয়। দাদার যদি খেতে ভালো লাগে যদি মাতলামি না করে এবং এই খাওয়ার ব্যাপারে যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে সমস্যা চুকে গেল। আর আপত্তি থাকলে দুজনের উচিত একটা মাঝামাঝি রফায় আসা। এর জন্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা উনবিংশ শতাব্দীর ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।

গৌরবের মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে মলি শক্ত গলায় বলল, মদ খাওয়ার ব্যাপারে আমি কখনও আপত্তি করিনি, তোমার দাদা আর একটি মহিলাকে ভালবাসেন।

এবার চমকে উঠল গৌরব, মানে?

খুব স্বাভাবিক। আমি পুরনো হয়ে গিয়েছি। আমাতে তাঁর মন ভরছে না। অল্পবয়সী একটি মেয়ে তার সেই সব চাহিদা মিটিয়ে দিচ্ছে যখন তখন আমাকে আর প্রয়োজন কী! মলির মুখ থমথমে।

এত কথা তুমি জানলে কী করে?

জেনেছি।

দাদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে?

হ্যাঁ। উত্তর দিতে চায়নি।

কোথায় যেতে চাও তুমি?

বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে মেয়েরা বাপের বাড়িতে ফিরে যায়। ষোলো বছর কাটিয়ে কেউ যায় কিনা তা জানা নেই। কিন্তু এ ছাড়া আমার তো আর অন্য উপায় নেই।

আচ্ছা বউদি, ধরো দুটো মানুষ পাশাপাশি বাস করতে গিয়ে আবিষ্কার করল তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে অমিল প্রকাশ পাচ্ছে। অ্যাডজাস্ট করতে গিয়েও তারা শেষ পর্যন্ত পারছে না। দুজন দুজনকে প্রায় তখন অপছন্দ করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু যেহেতু হিন্দু বিবাহ মতে তাদের বিয়ে হয়েছিল তাই তাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে হচ্ছে। ওরা পরস্পরকে অশ্রদ্ধা করে সারাজীবন একত্রে বাস করবে না আলাদা হয়ে যেটুকু কোমলতা রয়ে গেছে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবে? গৌরব প্রশ্ন করল।

মলি হাসল, ছেলেমেয়ে থাকলে সিদ্ধান্তটা সহজে নেওয়া যায় না গৌরব।

তুমি তো নিচ্ছ।

আমি আর পারছি না। ইটস টু মাচ ফর মি।

কোনো প্রমাণ দিতে পারবে?

হ্যাঁ। মেয়েটির একটা চিঠি আমি পেয়েছি।

তোমাকে লেখা? বিস্ময় ফুটে উঠল গৌরবের মুখে।

না। তোমার দাদা যখন গতমাসে ট্যুরে গিয়েছিল তখন চিঠিটা এসেছিল। অফিসের পিওন নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার আগেই তোমার দাদা রওনা হয়ে গিয়েছিল।

অফিসের পিওন? ভদ্রমহিলা কি দাদার অফিসেই চাকরি করেন?

করতেন। এখন অফিস চেঞ্জ করেছেন।

কেন?

হয়তো চক্ষুলজ্জায়। তুমি চিঠিটা দেখতে চাও গৌরব?

দেখে আর কী করব। গৌরব অন্যমনস্ক হলো। বউদির সঙ্গে দাদার ব্যবহারে অসুখী হবার কোনো লক্ষণ সে দেখতে পায়নি। সম্পর্কে অসুখ আসলে শুধু বিবাহিত বলে সেটাকে বয়ে বেড়ানোর বিপক্ষে সে। ছেলেমেয়েদের দোহাই দিয়ে একটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা হয় আজকাল। একথাও সত্যি আজ বউদি চলে গেলে তার প্রতিক্রিয়া টনি বনির ওপর পড়বেই। কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়া সামলে নেবার বয়সে পৌঁছে গেছে ওরা। কিন্তু একা বউদি কিভাবে দিনযাপন করবে? এদেশের মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় তারা বাধ্য হয় স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে থাকতে। গৌরব মলিকে দেখল। মলি তখন বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলছে। তারপর একটি বাক্স থেকে সযত্নে রাখা খামটা তুলে নিয়ে এসে গৌরবকে দিলো, তবু পড়ে দ্যাখো।

ভদ্রমহিলার হাতের লেখা সুন্দর। খামের ওপর দাদার নাম ঠিকানা পড়ল গৌরব। চিঠিটা বের করল। ইংরেজিতে লেখা। এদেশের মেয়েরা আজকাল ইংরেজিতে ব্যক্তিগত কথাবার্তা লিখতে এত সহজ হয়েছে তা ওর জানা ছিল না। মোটামুটি অনুবাদ করলে এমন দাঁড়ায়, প্রিয় সৌরভ। সকালে কয়েকবার চেষ্টা করেছি তোমায় টেলিফোনে ধরতে। যখন পেলাম তখন তুমি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছ। আমি খুব বিপাকে পড়েছি। এই মুহূর্তে তোমার সাহায্য ছাড়া কিছুতেই ভাবতে পারছি না। কলকাতা শহরে একা বাস করছি বলে যে গর্ব ছিল তা আর রাখতে পারব বলে মনে হয় না। তোমার কাছে যে উৎসাহ পেয়েছি তার ওপর ভরসা রেখে বলছি চিঠিটা পাওয়া মাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ কর। তোমায় দেখার জন্যে আমি উৎকণ্ঠিত। তোমার লীনা। ইংরেজি ভাষার ইউ শব্দটি তুমি আপনির ভেদাভেদ না রাখলে তার ব্যবহার বুঝিয়ে দেয় কখন আপনি কখন তুমি। এই চিঠিতে সরাসরি প্রেম নিবেদন নেই বটে কিন্তু দুজনের সম্পর্কের নৈকট্য স্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে লীনা নামক মহিলাটি সৌরভের ওপর নির্ভর করেন। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, দাদা তোমাকে এই চিঠির ব্যাপারে কিছু বলেছে?

ওকে আমি বলিনি চিঠির কথা। যে সম্পর্কের অস্বীকার করে তাকে বলে কী লাভ!

তাহলে তুমি কী বলেছ?

বলেছি ওর প্রেমের প্রমাণ পেয়েছি।

জিজ্ঞাসা করেছিল, কী প্রমাণ?

আমি এটা হাতছাড়া করতে চাইনি। তুমি বলো গৌরব, এই চিঠি পড়ার পর আমার এ বাড়িতে থাকা উচিত?

মলি চিঠিটা ফিরিয়ে নিল। নিয়ে আলমারির ভেতরে রেখে দিয়ে চাবি ঘোরাল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, টনি বনিকে কী বলবে?

যা সত্যি তাই। যাওয়ার আগে বলে যাব ওদের বাবার স্বরূপ কী?

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, দাদা কোথায়?

ছাদের ঘরে। কাল রাত্রে সেখানে গিয়ে শুয়েছে। অন্তত এক ঘরে শোওয়ার গ্লানি থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। যাক তুমি মাকে ব্যাপারটা বলতে পারবে? মলি শেষ করতে চাইল প্রসঙ্গ।

গৌরব উঠে দাঁড়াল, না পারার কোনো কারণ নেই। তবে তার আগে আমাকে দুটো দিন সময় দিতে পারবে বউদি? দুদিন বাদে তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো।

সন্দেহের চোখে তাকাল মলি, দুদিন কেন? কী করবে?

দেখি কী করা যায়। চিঠিটা পেয়ে যখন এতটা সময় অপেক্ষা করলে—

আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করো না। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার নড়চড় হবে না।

কিন্তু তুমি চাকরি করো না। এখান থেকে বেরিয়েও তো তোমাকে কারোর ওপর নির্ভর করতে হবে!

চক্ষুলজ্জা চলে গেলে এদেশে মেয়েদের রোজগারের কিছু না কিছু সম্মানজনক রাস্তা আছে। সেই রোজগার যতই কম হোক না কেন কিন্তু তাতে অসম্মানের নোংরা লেগে থাকবে না। ঠিক আছে, তোমার কথামত আমি দুটো দিন মুখ বন্ধ করে থাকছি। গৌরবকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মলি। এই বউদিকে সে চেনে না। প্রতিটি মেয়ের মধ্যে কি আর একটি মেয়ে থাকে যে অপমানিত বোধ করলে এমন নির্মম হয়ে উঠতে পারে, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়? এখনও তো এই ঘরের টেবিলে দাদা বউদির বিবাহ উৎসবে তোলা ছবি বাঁধানো। মা যত অভিমান করেই ভাই-এর বাড়িতে চলে যান না কেন তিনি ওদের বিয়ের দিনটা মনে রেখে ঠিক ফিরে আসেন। এই ঘরটিতে স্বামী-স্ত্রীর দ্বৈত জীবনের নানান প্রমাণ ছড়ানো।

ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে সৌরভকে আবিষ্কার করল গৌরব। ব্যালকনিতে বসে চা খাচ্ছে। ওখানে বসলে ঘরের ভেতরের কথাবার্তা শোনা সম্ভব নয়। তাছাড়া সৌরভের চোখ বাইরের দিকে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এখন ইলশেগুঁড়িতে নেমে এসেছে। আকাশের রঙ কিন্তু ধোঁয়াটে তবু মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা কয়েক ঘন্টার মধ্যে আবার জেঁকে নাও আসতে পারে। চেয়ার টেনে সৌরভের পাশে বসতেই সে চমকে ফিরে তাকাল। তারপর যেন চেষ্টা করে হাসল, দিনটা খুব বিচ্ছিরি কাটবে। তারপর যোগ করল, আমেরিকায় এরকম ওয়েদার প্রায়ই হয় বোধহয়। ইংলন্ডে তো এটাই স্বাভাবিক।

গৌরব বুঝল দাদা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু সে নিজেও কিভাবে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসার পর সে আচমকা বলে ফেলল, বউদির সঙ্গে একটু আগে আমার কথা হয়েছে।

মুখ ফিরিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সৌরভ বলল, ও!

শেষ পর্যন্ত সরাসরি চলে এল গৌরব, তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে ব্যাপারটা অভিপ্রেত নয়।

কোন্ ব্যাপারটা? সৌরভ এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন সে সবে ঘুম থেকে উঠেছে।

বউদি এবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।

আমার কিছু করার নেই গোরা। যদি কেউ বিশ্বাস করে সে ঠিক কাজ করছে তাহলে তাই করুক।

কিন্তু দাদা, আমার বলা উচিত হচ্ছে কিনা জানি না, বউদির অভিযোগটা তোমার ভাবা উচিত।

অভিযোগ? সেরকম চাইলে তো আমিও হাজারটা অভিযোগ করতে পারি। সৌরভ এবার ঘুরে বসল।

কিন্তু তাতে তো সমস্যার সমাধান হবে না।

হবেই না তো। সমস্যা যারা বাড়াতে চায় তারা সমাধান চায় না।

এব্যপারে তোমার কোনো দায়িত্ব নেই বলছ?

একশোবার নয়। তোর বউদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে কিন্তু কোনো প্রমাণ দিতে পারে নি।

হয়তো চায়নি।

তাহলে আমার কিছু করার নেই।

অভিযোগটা তুমি অস্বীকার করতে চাও?

হ্যাঁ। যা সত্য নয় তা আমি মানতে পারি না।

তোমার সঙ্গে আর একজন মহিলার সম্পর্ক নিয়ে বউদি অপমানিত।

আচ্ছা গোরা, এতকাল তুই আমেরিকায় কাটিয়ে এসে গ্রাম্য কথা বলছিস কী করে? ছেলে ছেলের সম্পর্ক যদি সন্দেহজনক না হয় ছেলে মেয়েতে সম্পর্ক হলেই তা সন্দেহজনক হবে? সৌরভ কাঁধ ঝাঁকাল, তোর বউদির কাছে নিশ্চয়ই নামটা শুনেছিস। ও আমার অফিসে কাজ করত। এখন অন্য অফিসে গেছে, কালেভদ্রে দেখা হয়।

তোমার সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের?

অবশ্যই, কিন্তু সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারছি কই।

বউদি কিন্তু অন্যরকম ধারণা করছে।

তোর বউদির ধারণাটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমি সবচেয়ে সুখী হতাম। কিন্তু লীনার সঙ্গে অন্যরকম সম্পর্ক করতে চাওয়া মানে ওকে অপমান করা।

ব্যাপারটা বুঝলাম না।

সব কথা জেনে কি লাভ। কই, আমি তোর বউদির সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি। রাত্রে ড্রিঙ্ক করে এসেছি এবং আমি মনে করি মাতলামি করিনি। আমার ছেলেমেয়েরা বলতে পারবে না যে ওদের মিসবিহেব করেছি। তোর বউদির বিয়ের আগের জীবন নিয়ে আমি কখনও প্রশ্ন করি। নি। এক ভদ্রলোক ওকে এমন ভালবাসত যে বিয়েই করেননি শেষপর্যন্ত। আমি জানি তোর বউদি মানুষটাকে কখনও অ্যাকসেপ্ট করেনি। কিন্তু এই নিয়েও তো আমি ঝামেলা তৈরি করতে পারতাম। সত্যি কথা বলতে কি লীনার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। হাঁপাতে লাগল একটানা কথা বলে সৌরভ।

ভদ্রমহিলা একা থাকেন?

হ্যাঁ। কলকাতা শহরের কোনো চাকরি করা মেয়ের একা থাকার সমস্যা যে কি ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। ডিভোর্সি হলে তো কথাই নেই। সৌরভ একটু চুপ করে থেকে যোগ করল, একা যারা থাকে সেই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দ্যাখে স্বামীপুত্র নিয়ে সংসার করা মেয়েরা। যেটা লীনার ভাগ্যে জুটছে।

কিন্তু বউদি যদি ভুল বুঝে থাকে সেটা শুধরে দিচ্ছ না কেন?

সন্দেহ আর ঈর্ষা মেয়েদের মন থেকে ঈশ্বরও মুছে ফেলতে পারবেন না।

তুমি চেষ্টা করোনি। তোমার আচরণে সেটা আরও জোরদার হয়েছে।

গৌরব না বলে পারল না। কপালে ভাঁজ পড়ল সৌরভের, আমার কোন্ আচরণের কথা বলছিস তুই? বলেই ম্লান হাসল সে, ও বুঝতে পেরেছি। রাত করে বাড়ি ফেরা, মদ্যপান করা, এসব যুক্তি তো মলির।

দ্যাখো দাদা, যদি ওই মহিলার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক নিবিড় না হয়ে থাকে তবে আমি চাই মা বউদি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাক। ব্যাপারটা বাচ্চাদের জন্য তো বটেই মায়ের পক্ষেও সহ্য করা কঠিন হবে। তোমরা নিজেদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাও। গৌরব উঠে দাঁড়াল। এছাড়া সে কিছুই করতে পারে না। সৌরভ ওর দিকে তাকিয়েছিল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে সে-ও সোজা হয়ে দাঁড়াল, যদি বলিস লীনাকে আমি ভালবাসি কিনা তাহলে বলব, ইয়েস, বাসি। যদি জিজ্ঞাসা করিস সেটা কী ধরনের ভালবাসা তাহলে বলব আর যাই হোক প্রেমিক প্রেমিকা কিংবা স্বামী স্ত্রীর মতো নয়। মলির যা ডেফিসিট আছে লীনার তা নেই। ও অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। সহজ। ওকে বোঝা যায়। ওর সঙ্গে কথার বললে আরাম হয়। কারণ ও কথা বোঝে। আর এই ঈর্ষায় মলি যত ছোট হচ্ছে তত আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রচণ্ড শীতেও যেমন উষ্ণতার জন্যে কাদা মাখা কম্বল গায়ে দেওয়া যায় না তেমনি সম্পর্ক বাঁচাতে জোড়াতালিতে বিশ্বাস করি না আমি। এ নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই গোরা।

মন তেতো হয়ে গেল। আধুনিক জীবনের সম্পর্কের এই ব্যাপারটি ভারতবর্ষে যেমন একটি পাঁচিলের মধ্যে হাঁসফাস করে বন্দী হয়ে, পশ্চিমে তার কোনো সমাধান না পেয়ে শুধু ছিন্ন করেই স্বস্তি পেতে চায়। দুটোকেই মেনে নিতে পারে না গৌরব। নিজের ঘরে এসে সে কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছিল না। তখন বউদির কাছে সময় চেয়ে নেওয়ার পেছনে যে মতলব কাজ করছিল সেটাও অসাড় হয়ে গেছে। হঠাৎ তার সেই মহিলাকে দেখতে ইচ্ছে করল। কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন তা ওর জানা নেই। এখন দাদাকে জিজ্ঞাসা করলে সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

দুপুরের পর বৃষ্টি নামল। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও রাস্তায় হাঁটা যাবে। গৌরব দাদার অফিসে টেলিফোন করল। অপারেটর লাইনে আসতেই সে পরিষ্কার বলল, নমস্কার, আমি একটু বিরক্ত করব। আমি সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছি। আপনাদের অফিসে এক ভদ্রমহিলা কাজ করতে যার নাম লীনা। দুঃখের কথা আমি উপাধিটা ভুলে গেছি। উনি এখন কোন্ অফিসে জয়েন করেছেন বলতে পারেন?

ভদ্রমহিলা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির নাম বলে লাইনটা ছেড়ে দিলেন। এখন বাড়ি নিঝুম। টনি বনিরা ফেরেনি। তৈরি হয়ে গৌরব নিচে নেমে দেখল মা এর মধ্যেই বাগানে নেমে গিয়েছেন। সারা রাত-সকালের জলে ভেজা গাছের ডাল ঠিকঠাক করে দিলেন। হঠাৎ গৌরবের মনে হলো নিজের ছেলেদের জীবনের ব্যাপারে একটা বয়সের পর মায়ের আর কোনো হাত থাকে না। তখন ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে শুধুই আফসোস করা ছাড়া আর কিছু উপায় থাকে না। সে তুলনায় এই ফুলের গাছগুলো বরং অতি বাধ্য হয়ে থাকবে। ওরা কখনও অনাত্মীয় হবে না।

ডাল সরিয়ে ডান দিকে তাকাতেই মা ওকে দেখতে পেলেন, এই মেঘ মাথায় নিয়ে কোথায় চললি? যে কোনো সময়ে বৃষ্টি আসতে পারে।

গৌরব হেসে ফেলল, বৃষ্টি তো এখন নেই কিন্তু ভেজা ডালের জলে তো তুমি ভিজে যাচ্ছ। আমি একটু বেরুচ্ছি মা, বেশি দেরি করব না।

মা বললেন, আজ তাহলে মোটরবাইক নিস না।

কেন?

বৃষ্টি এলে ভিজবি। তাছাড়া রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, গাড়ি স্লিপ খেতে কতক্ষণ!

অনুরোধটা রাখল গৌরব। রাখতেই দেখল মায়ের মুখে একধরনের অমল সুখের আলো জ্বলল। গত প্রজন্মের মানুষ কত অল্পে সুখী হয় অথচ সেটুকু দিতে এ প্রজন্মের মানুষ কেন যে অঙ্ক করে!

কলকাতায় ফিরে একমাত্র সকালবেলা ছাড়া বাসে ওঠার চেষ্টা করেনি গৌরব। বারো বছর আগে যা ছিল অভ্যাসে এখন আতঙ্কে পৌঁছে গেছে। একটি সভ্য দেশের শিক্ষিত মানুষেরা এমন ছাগল মুরগির মতো নিয়মিত যাওয়া আসা করতে বাধ্য হয় এবং সরকার চোখ বুজে থাকেন নিশ্চিন্তে! এ নিয়ে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয় না। কালিকটে গুলি চললে কলকাতায় বিক্ষোভ হয় কিন্তু কলকাতার মানুষের একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ব্যাপারে কোনো আন্দোলনে কোন রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসবে?

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল গৌরব। এই সময়ে শহরতলির রাস্তায় যদিও ট্যাক্সি পাওয়া যায় কিন্তু ডালহৌসি অঞ্চলে পেতে হলে ভাগ্যবান হতে হয়। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে একবার মনে হয়েছিল দাদাকে ফোন করে অন্তত ভদ্রমহিলার উপাধিটা জেনে নেবে। কিন্তু একটা জেদ থেকে সে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর সব দেশেই সম্ভবত মানুষের নিজস্ব নামের গুরুত্ব দ্বিতীয় পর্যায়ে। প্রথমে উপাধি থাকলেই কাজ দেয়। কোম্পানিটির নামকডাক আছে। দামী কার্পেট ডিঙিয়ে রিসেপশনে পৌঁছাল গৌরব। যে মহিলাটি ডেস্কের ওপাশে তিনি মগ্ন হয়ে হ্যারল্ড রবিন্স পড়ছেন। ওঁর সাজগোজে বোঝা যায় কোম্পানি যেমন ওকে স্বাচ্ছন্দ দিয়েছে তেমনি বিনিময়ে অতিথিদের জন্যে চোখের আরাম চায়। গৌরব সামনে পৌঁছাতেই মহিলা বই থেকে মুখ তুলে হাসলেন, ইয়েস! যেন যন্ত্রের মতো ব্যাপার।

গৌরব বলল, মিস লীনা আছেন?

পুরো নামটা বলুন।

সেটাই তো সমস্যা। আমার এক বন্ধু আমেরিকা থেকে টেলিফোনে ওঁকে একটা খবর দিতে বলেছিলেন। কিন্তু ওঁর টাইটেলটা আমি মিস করেছি। কথাগুলো নিজের কানেই নির্বোধের মতো শোনাল। রিসেপশনিস্ট অপলক দেখলেন। তারপর বললেন, রেফারেন্স না দিতে পারলে আমার পক্ষে আপনাকে সাহায্য করা সম্ভব হবে না।

ফাঁপরে পড়ল গৌরব। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না, আমি শুধু এটুকু জানি যে উনি সম্প্রতি এই কোম্পানিতে জয়েন করেছেন। সে দাদার কোম্পানির নামটা যোগ করল।

এবার মহিলা সম্ভবত এস্টাব্লিশমেন্ট সেকশনে টেলিফোন করলেন। ওঁদের কথাবার্তায় গৌরব বুঝল মহিলার নাম লীনা চ্যাটার্জি। তার টেবিলে টেলিফোন করে জানা গেল তিনি অফিসে আসেন নি। তিনদিনের ছুটি নিয়েছেন। গৌরব হতাশ হলো। বউদির কাছে চেয়ে নেওয়া সময় পেরিয়ে যাবে তিনদিন অপেক্ষা করতে হলে। রিসেপশনিস্ট মহিলা এর মধ্যে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। ওকে আর ঘাটানোর সাহস পাচ্ছিল না সে। হঠাৎ মহিলাই বললেন, আপনি ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে পারেন যদি খবরটা খুব জরুরি হয়।

অবশ্যই জরুরি কিন্তু মুশকিল হলো আমি ওঁর বাড়ির ঠিকানা জানি না।

গৌরব ম্লান হাসল। কি বুঝলেন তিনিই জানেন, দেখা গেল মহিলা আবার উদ্যোগ নিচ্ছেন, রেকর্ড সেকশনে ফোন করে তিনি লীনা চ্যাটার্জির বাড়ির ঠিকানা উদ্ধার করে একটা কাগজে লিখতে লিখতে বললেন, এঁকে আপনি আগে কখনও দ্যাখেননি বলেছিলেন, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ। গৌরব বিনয়ে গলে গেল যেন।

কী করেন আপনি?

কিছু না, বেকার। আপাতত।

চোখ ছোট করলেন মহিলা। কাঁধ নাচিয়ে বললেন, কারো বাড়ির ঠিকানা দেওয়া সম্ভবত ঠিক নয়। তাই আপনার নাম ঠিকানা এখানে লিখে দিন।

কলম আর একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা। অভ্যেসে নিজের নামের নিচে আমেরিকার ঠিকানাটা লেখার পর কাটতে গিয়েও মন পাল্টাল সে। তারপর কলকাতার ঠিকানাটা জুড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এবার যেতে পারি?

খুব অনাগ্রহ নিয়ে চিরকুট চোখের সামনে ধরেই মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল, আপনি আমেরিকায় থাকেন? ইঞ্জিনিয়ার?

ওই আর কি? গৌরব আর দাঁড়াল না। সে বুঝতে পারছিল মহিলার দৃষ্টি ওর পিঠের ওপর আঠার মতো সেঁটে আছে। আমেরিকার রাজনীতি সম্পর্কে বাঙালির একটা বিরক্তি আছে। খুব বড়লোককে যেমন সহ্য করা মুশকিল হয়। কিন্তু কোনো বাঙালি ছেলে আমেরিকায় বেঁচে বর্তে থাকলে তার সম্পর্কে এক ধরনের রোমান্টিক আগ্রহ তৈরি হয় কেন? কলকাতায় যার চার হাজার টাকা মাইনে আমেরিকায় সে তিন হাজার ডলার পেলে সেটা সেখানে ছত্রিশ হাজার টাকা হয়ে যায় না। পঞ্চাশ পয়সায় এখানে বাসে চেপে শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলায় পৌঁছানো যায় কিন্তু এই দূরত্ব আমেরিকান বাসে পৌঁছাতে ভারতীয় টাকায় বারো টাকা লাগে। কিছু উন্নত মানের সুবিধে যা জীবনযাত্রায় প্রয়োজন হয় তাছাড়া অন্য কোনো মোক্ষলাভ আমেরিকায় চাকরি করলে হয় না। হ্যাঁ, যেটা ব্যক্তিগত লাভ সেটা হলো যে যার নিজস্ব কাজ নিশ্চিন্তে করতে পারে এবং তাকে সবরকম সুবিধে দেওয়া হয়। কিন্তু তার সঙ্গে সাংসারিক জীবনযাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই।

রাস্তাটার নাম ফার্ন রোড। গোলপার্কের একটা মুখ থেকে ভেতরে ঢুকল গৌরব। আজ অসময়ে সন্ধে নামব নামব করছে। বৃষ্টি আর নামেনি কিন্তু মেঘেরা অনেক নিচে নেমে এসেছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। নম্বর মিলিয়ে সে যখন বাড়িটার কাছাকাছি তখন কয়েকটি ছেলেকে গল্প করতে দেখল। উত্তর কলকাতার মতো রকে বসে না এরা কিন্তু মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েক ঘন্টা চমৎকার কাটিয়ে দেয়। বাড়িটার সঠিক হদিশ এরাই দিতে পারে ভেবে গৌরব ওদের সামনে এগিয়ে গেল। নম্বরটা শুনে একজন জিজ্ঞাসা করল, নামটা বলুন?

মিসেস লীনা চ্যাটার্জি।

সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টিগুলো পাল্টে গেল। একটি ছেলে বেশ রহস্যময় হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করল, দাদা কি ওঁর রিলেটিভ?

গৌরব মাথা নেড়ে না বলতেই আর একজন বলল, ধান্দাটা কী?

গৌরবের কান লাল হলো, কী বলতে চাইছেন?

পাড়ার মধ্যে একটা মেয়ে একা থাকে। উল্টোপাল্টা পার্টিরা যাওয়া আসা করছে। এটা আমরা অ্যালাউ করব ভাবছেন কী করে?

দ্বিতীয় জন বলে উঠল, ছেড়ে দে। বাড়িওয়ালা তো নোটিস দিয়েই দিয়েছে। সোজা চলে যান। বাঁ দিকের ওই তিনতলার ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায় থাকেন উনি।

কথা বাড়াল না গৌরব। সে হাঁটা শুরু করতেই পেছনে কিছু ইতর হাসি ভেসে উঠল। মিসেস লীনা চ্যাটার্জি নিশ্চয় খুব আরামে নেই। একা কোনো মেয়ে যদি ভদ্রভাবে বাস করে তাহলে পাড়ার ছেলেরা তার পেছনে লাগবে কেন? নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা ওদের সুযোগটা করে দিয়েছেন।

বাড়িটায় ঢুকতেই এক বৃদ্ধের মুখোমুখি হলো গৌরব। ভদ্রলোক ছাতি নিয়ে বেরুচ্ছিলেন। গৌরব দাঁড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন?

মিসেস লীনা চ্যাটার্জি এখানে থাকেন?

এখন পর্যন্ত আছেন।

কোন্ দিকে ওঁর ফ্ল্যাট?

ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান হাতে। আপনাকে তো আগে দেখিনি।

আমি আজ প্রথম আসছি।

অ।

আপনি?

এই বাড়িটা দুর্ভাগ্যক্রমে আমার। বৃদ্ধ আর দাঁড়ালেন না। গৌরব বুঝল ঘরে এবং বাইরে পরিবেশ খুব প্রতিকূল হয়ে রয়েছে। সে দোতলায় উঠে দরজায় গায়ে কলিং বেল খুঁজল। বোঝা যায় একটা বস্তু ছিল কিন্তু এখন খুলে নেওয়া হয়েছে। অতএব আঙুলের টোকা দিলো দরজায়। তৃতীয় বারের পর দরজায় দেখল গর্ত দিয়ে জরিপ করছে কেউ বলে মনে হলো। তারপর দরজাটা খুলল। ঘরে আলো জ্বলছে। সেটাকে পেছনে রেখে দরজার পাল্লা ধরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার ফাঁপা চুল কাঁধ ছোঁওয়া, গায়ের রঙ মাজা, পরনে ম্যাক্সি, চোখে মুখে শুকনো ক্লান্তি। দাঁড়াতে যেন কষ্ট হচ্ছে ওঁর।

গৌরব নমস্কার করল, নমস্কার। আপনি আমাকে চিনবেন না কিন্তু কিছু কথা বলার দরকার।

কোত্থেকে আসছেন? খুব ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল লীনা চ্যাটার্জি।

আমার নাম গৌরব। গৌরব বসু। আমার দাদাকে আপনি চেনেন।

ও! পরিচিত ভঙ্গি ফুটে উঠল লীনার মুখে। আপনি কি আমেরিকায় থাকেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। অর্থাৎ মহিলা দাদার কাছে ওর কথাও শুনেছেন।

আসুন ভেতরে আসুন। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে গৌরবকে ভেতরে আসার পথ করে দিয়ে ওটাকে বন্ধ করে দিলো লীনা। গৌরব দেখল শোভন বসার ঘরে সোফাসেট ছাড়া রুচিম্মত কিছু আসবাব রয়েছে। গৌরবকে বসতে বলেই লীনা নিজেও বসে পড়ল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে খুবই অসুস্থ মনে হচ্ছে!

তেমন কিছু না। কথাটা বললেও ভাবে সেটা ফুটে উঠল।

আমার এভাবে আসা উচিত হয়নি। আপনি বরং বিশ্রাম করুন, পরে একদিন আসব।

-না। আপনি সঙ্কোচ করবেন না, আমি ঠিকই আছি। একটু আধটু জ্বরজ্বারি তো মানুষ মাত্রেই হয়। কিন্তু আপনাকে আমার এখানে দেখতে পাব তা ভাবতে পারিনি।

আপনার জ্বর কত?

থার্মোমিটার দিইনি।

ওষুধপত্র?

যদি কমে যায় তাহলে আর দরকার হবে না। লীনা হাসার চেষ্টা করল, বলুন, কী ব্যাপার?

গৌরবের অস্বস্তি শুরু হলো। শিক্ষিত মহিলারা যখন গ্রাম্য মানসিকতার নকল করে কথা বলেন তখন যে অভিমান স্পষ্ট হয় তাতে বরফের স্পর্শ থাকে।

গৌরব সরাসরি কথায় চলে আসতে চাইল, আপনার ঠিকানা দাদার কাছে থেকে নিইনি আমি। আপনার নতুন অফিসে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এখানে এলাম।

কেন? সৌরভকে বললেই তো জেনে যেতেন।

বুঝতেই পারছেন আমি ইচ্ছে করেই ওকে জিজ্ঞাসা করিনি।

তাহলে বলুন কেন এসেছেন?

না। আজ আপনার শরীরের যা অবস্থা তাতে এসব কথা আলোচনা করা ঠিক হবে না।

সেকি! নানা। কোনোটাই বেঠিক নয়। শরীর খারাপ বলে আমি কি কিছু রান্না করে খাচ্ছি না। এক গ্লাস জল চাইলেও তো কেউ দেবার নেই। কাজের মেয়েটি না আসা পর্যন্ত নিশ্চয়ই গলা শুকিয়ে বসে থাকছি না। যাকে একা থাকতে হয় তাকে সব কিছুই মেনে নিতে হয়। আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন।

বেশ। আপনি তো দাদার বন্ধু!

তাই জানতাম।

বুঝতে পারলাম না।

শুনলাম আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকায় সৌরভের বাড়িতে প্রব্লেম তৈরি হয়েছে। চোখ বন্ধ করল লীনা, বন্ধু যদি সমস্যা তৈরি করে তাহলে সে কীসের বন্ধু।

আপনি সমস্যাটার কথা জানেন?

সৌরভ বলেছে।

ও।

আপনি মনে হয় ওই ব্যাপারেই এসেছেন। আমি সৌরভকে বলেছি আমার জন্যে ওকে বিব্রত হতে হবে না। আর কিছু বলবেন? লীনা সরাসরি তাকাল।

দাদার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক যে শুধুই বন্ধুত্বের তা বউদি মানতে রাজি নন।

ঠিকই করেছেন উনি, নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের সীমারেখা এত সূক্ষ্ম যে চোখে দেখা যায় না।

কিন্তু দাদা বউদির সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাইছেন না।

গৌরববাবু এটা সৌরভের সমস্যা।

অবশ্যই। আমি এসেছিলাম আপনার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে।

কী কথা? আমি যেন আর সৌরভের সঙ্গে দেখা না করি, সৌরভের সংসার আমার জন্যে ভেঙে যাচ্ছে অতএব আমি যেন নিজেকে সরিয়ে নিই। আঃ। গৌরববাবু, আপনি তো এতদিন বিদেশে ছিলেন, এরকম অনুরোধ নিয়ে এদেশের মানুষেরাই আসে।

একটু পরিষ্কার করুন।

নিজের ঘরের মানুষকে সংশোধন, যদি অবশ্য সংশোধনের প্রয়োজন হয়, না করে বাইরের মানুষকে ধমকানো বা তার কাছে ভিক্ষে চাওয়াটা কি হাস্যকর নয়!

আমি কিন্তু সেসবের জন্যে আসিনি।

তাহলে কেন এসেছেন?

জানি না কেন আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।

ক্লান্ত লীনা অবাক হয়ে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, সৌরভের সঙ্গে যদি আমার প্রেমের সম্পর্ক থাকত তাহলে আমি কিছুতেই ওকে ছেড়ে দিতাম না। কারণ ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারতাম না। নিজের ভালবাসাকে দান করে দেওয়ার মতো উদার অথবা দুর্বল মানুষ আমি নই। চারপাশের লোভী মানুষগুলোর থেকে সৌরভকে আমার আলাদা মনে হয়েছিল বলে ওর সঙ্গে এক ধরনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে বন্ধুত্ব এক ধরনের নির্ভরতা দেয়।

আপনি দাদাকে চিঠি দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। সৌরভ সেই চিঠি পায়নি। লীনা অবাক হলো, আপনি জানলেন কী করে?

বউদি ওটা পেয়ে এত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে দাদাকে দেননি।

ও। ওয়ান্স এগেইন আই অ্যাম সরি। সেদিন আমার বাড়িওয়ালা নোটিস দিয়েছিলেন যাতে তিনদিনের মধ্যে আমি এই ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠে যাই। চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম তাই ওর অফিসে টেলিফোন করি। অফিস বলল সৌরভ ট্যুরে যাচ্ছে। ভাবলাম বাড়িতে পাব তাই পিওন দিয়ে চিঠি পাঠাই। সৌরভ এল না। অনেক চেষ্টায় বাড়িওয়ালার কাছে দুমাস সময় নিয়েছি।

ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে কেন?

মুখে বলছেন ওর ঘরের প্রয়োজন। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। সত্যি কথাটা বলতে চাইছেন না উনি। একা আমার বয়সের মেয়েকে উনি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন কিন্তু সে তার বন্ধুদের এ বাড়িতে আসতে বলবে তা ভাবেননি। এ ব্যাপারে আঠারো আর আটত্রিশের মধ্যে কোনো পার্থক্য এদের কাছে নেই। আমি একা থাকি, চাকরি করি, আমার কোনো আত্মীয় নেই সুতরাং আমার সম্পর্কে এ পাড়া সমস্ত মানুষের অগাধ কৌতূহল। সবাই আমার মধ্যে নোংরা আবিষ্কার করতে ব্যস্ত। আমার কাছে যে আসবে তার সঙ্গেই একটা নোংরা সম্পর্ক তৈরি করে নিতে চায় সবাই। ঘেন্না ধরে গেল। এই যে আপনি এলেন, আপনিও বাদ যাবেন না।

সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। কিন্তু কেন বলুন তো?

আমার যদি একজন স্বামীদেবতা থাকতেন তাহলে রোজ পাঁচটা করে ছেলে এলেও সবাই চোখ বন্ধ করে থাকতেন। যেহেতু পাড়ার কারো সঙ্গে মিশি না তাই জ্বালা হয়ে দাঁড়িয়েছে বোধহয়। ছেড়ে দিন আমার কথা। আপনি তো অনেক দিন পরে দেশে এলেন। আপনার কেমন লাগছে?

অদ্ভুত। আর নয়। এবার আপনি শুয়ে পড়ুন। কোনো ওষুধপত্র আনতে হবে?

না নিজের দেখাশোনা আমি নিজেই করতে পারি।

জানলাম। তবু যদি মনে হয় অসঙ্কোচে বাড়িতে ফোন করতে পারেন। দাদার ফোন নাম্বার নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। আর যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে মাঝে মাঝে দেখা করে যাব। নমস্কার। গৌরব হাত জোড় করে উঠে দাঁড়াল। তারপর সোজা দরজা খুলে সেটা বন্ধ করে নিচে নামতে লাগল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *