Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো || Buddhadeb Guha

ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো || Buddhadeb Guha

০১.

ঋজুদার সঙ্গে এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের অনেকই জঙ্গলে গেছি কিন্তু এইরকম প্রচণ্ড গরমে কখনও আসিনি কোথাওই। আর গরম বলে গরম? মধ্যপ্রদেশের গরম। তার ওপরে মে মাসের শেষ।

ঋজুদা বলে, যখনই মনে হবে খুব গরম বা শীত লাগছে অমনি মনে করার চেষ্টা করবি এর চেয়েও বেশি গরম আর শীত কোথায় পেয়েছিস এর আগে। আর যেই সে কথা মনে করবি অমনি মনে হবে যে এ গরম বা শীত সেই তুলনাতে কিসসুই নয়।

ঋজুদার এই টোটকা অন্য জায়গাতে যে কাজে লাগেনি তা বলব না কিন্তু মধ্যপ্রদেশের এই সিধি জেলার গহন অরণ্য আর পাহাড়ঘেরা বনে সেই ধন্বন্তরী টোটকাও পুরোপুরি বিফল হয়েছে।

তবে একথা ঠিক যে, ঋজুদা বা আমি কেউই শখ করে এখানে আসিনি। সিধি জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তো বটেই, মধ্যপ্রদেশের চিফ সেক্রেটারি শর্মা সাহেব এবং প্রিন্সিপাল কনসার্ভেটর পরিহার সাহেবের সনির্বন্ধ অনুরোধেই এই পাহাড় জঙ্গলের কালাপানি’ অঞ্চল এই ব্যয়রান’-এর মধ্যের একটি অখ্যাত জায়গার ফরেস্ট-বাংলোতে ডেরা করেছি আমরা ঝিঙ্গাঝিরিয়ার কুখ্যাত মানুষখেকো বাঘটি মারবার জন্যে। রেওয়ার মহারাজ আগেকার দিনে এই সব অঞ্চলে খুনি ও অন্য অপরাধীদের নির্বাসন দিতেন, ইংরেজরা যেমন দিতেন আন্দামানে। তাই এই ‘ব্যয়রান’ও কালাপানি হিসেবে বিখ্যাত।

বাঘের সঙ্গে ঋজুদার যেরকম প্রেম তা সম্ভবত নয়না মাসির সঙ্গেও ছিল না। যখন ঋজুদার সঙ্গে প্রথমবার ওড়িশার টিকরপাড়াতে যাই, নয়না মাসি, মেসোর সঙ্গে সেখানে দু’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল। তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম, ঋজুদা যদিও বলে, তুই এখনও ছোটই আছিস। ছোট হলেও ঋজুদার মধ্যে নয়না মাসি সম্বন্ধে ভারি আশ্চর্য এক আচ্ছন্ন ভাব লক্ষ করেছিলাম। হয়তো তাকেই ভালবাসা বলে। জানি না। সেই ভাবটির কার্যকারণ পরে আরও বড় হয়ে হয়তো বুঝব।

বাঘের সঙ্গে গভীর প্রেম বলেই ‘The wide hearted gentleman বাঘকে ঋজুদা এমনি কখনওই মারতে চায় না। মানুষখেকো বাঘও নয়। বলে, আরে! বেচারি তো আর শখ করে মানুষখেকো হয়নি! মানুষের অত্যাচারেই হয়েছে। পাপ করলে মানুষকে তার প্রায়শ্চিত্ত তো করতে হবেই। খাকই না কিছু মানুষ। মানুষের মতো বংশবৃদ্ধি তো আজকাল গিনিপিগ বা নেংটি ইঁদুর বা শুয়োরেরাও করে না। তোক কিছু মানুষের বংশনাশ।

তবে সুন্দরবনের বাঘেদের উপরে কিন্তু ঋজুদার একটুও দরদ নেই। ঋজুদা বলে, পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগ যতই বাতেল্লা করুন না কেন সুন্দরবনের বাঘমাত্রই যে মানুষখেকো সে বিষয়ে আমার কোনওই সন্দেহ নেই। ওই সব মানুষখেকো বাঘ বাঁচাবার জন্যে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড যে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে গত কয়েক বছর ধরে সরকারের মাধ্যমে এবং ক’ বছরে বাঘ কত বেড়েছে সুন্দরবনে তা সঠিক কারও জানা না থাকলেও অসমসাহসী সব মউলে, জেলে, বাউলে গরিবস্য গরিব কত মানুষেরা ওই কয়েক বছরে যে সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘেদের পেটে গেছে তা নিয়ে একটি গবেষণা হওয়া দরকার। ভবিষ্যতে হয়তো হবেও। তখন যেসব মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে এত মানুষ ‘খুন’ হয়েছে তাদের যথাযোগ্য শাস্তিবিধানও হবে হয়তো। ওয়ার্লড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের উচিত তাঁদের দেয় টাকার কিছু অংশ এই গরিব মানুষদের বেঁচে থাকার জন্যে বরাদ্দ করা।

এখন বিকেল সাড়ে চারটে। রোদের তাপ এখনও প্রচণ্ড। গত রাতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সন্ধে সাতটা থেকে বারোটা জিপে করে আমরা ঘুরছি স্পটলাইট নিয়ে রাইফেল-বন্দুক রেডি পজিশনে ধরে। যদি মানুষখেকোর সঙ্গে অচানক মোলাকাত হয়ে যায়, এই আশাতে। কিন্তু হয়নি।

প্রায় ছ’দিন অন্তর একজন করে মানুষ মেরে চলেছে এই ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো। সবসুদ্ধ, আজ অবধি, যে সব মৃত্যু বনবিভাগ এবং জেলাপ্রশাসনের খাতাতে নথিবদ্ধ হয়েছে, তাতে জানা গেছে যে বত্রিশ জন মানুষ খেয়েছে বাঘটা। বনের গভীরতম জায়গার অনেক মৃত্যুর খবর নথিবদ্ধ হয়ওনি। মানুষই চলে গেলে, তা খাতায় লিখিয়ে কী লাভ তা ভেবে পায়নি এই গরিব-গুরবোরা।

আমরা গতকালই সকালে রেনুকুটে ট্রেন থেকে নেমে এখানে এসে পৌঁছেছি দুপুরবেলাতে। আজ দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে সারারাত জাগতে হবে জেনে বিকেল চারটেতে এককাপ চা খেয়ে বেরিয়ে পড়েছি নিজের নিজের জলের বোতল, রাইফেলবন্দুক, গুলি, এবং টর্চ নিয়ে।

আজই একেবারে শেষরাতে একটি রায়শোয়র মেয়েকে ধরেছিল বাঘটা। মেয়েটির নাম সুখমন্তি। সে প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া দিতে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েছিল। মেয়েটির ডানদিকের বুক এবং পেছনের বাঁদিকের কিছুটা খেয়ে তাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে একটা আলগা পাথরে ভরা ছোট টিলার অগভীর গুহার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল বাঘটা যাতে শকুনেরা ওপর থেকে না দেখতে পায়।

মেয়েটির বয়স হবে আঠারো-উনিশ। বিয়ে হয়েছিল নাকি তিন বছর। একটি ছেলেও আছে এক বছরের। তার স্বামী ও বিধবা মা কাকুতি-মিনতি করেছিল ওর অর্ধভুক্ত শবটি নিয়ে যাবার জন্যে। তাকে কবর দেবে ওরা। দুর্ঘটনা অথবা ওইরকম অপমৃত্যু ঘটলে অধিকাংশ আদিবাসীরাই মৃতদেহ কবর দেয়, পোড়ায় না। তাই। কিন্তু ঋজুদা নিষ্ঠুরের মতো তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। কাল সকালে তাদের বনবাংলোতে আসতে বলেছে শবটি ওদের হাতে তুলে দেবে বলে। বলেছে, তোমাদের কপালে যদি থাকে তবে তোমাদের মেয়ে আর বউ-এর শবের সঙ্গে তাকে যে খুন করেছে তার শবকেও দেখতে পাবে। আজকের দিন আর রাতের জন্যে ওকে দাও আমাদের। ও তো চলেই গেছে। যাতে অন্য আরও অনেককে বাঁচানো যায় ওই বাঘের হাত থেকে তারই একটা চেষ্টা করে দেখি আমরা।

এই রুখু জায়গাতে মে মাসের শেষে প্রকৃতি যেন তৃষিত তিতিরের মতো হাঁফাচ্ছে। তার প্রতিটি শ্বাসে-প্রশ্বাসে, তার হাঁ করা মুখ, গলার শিরা-ফুলানো আর ঠেলে বাইরে বেরিয়ে-আসা চোখ দুটিতে তীব্র তৃষ্ণা যেন বিকিরিত হচ্ছে। লাল পোড়া মাটি, পর্ণমোচী বনের পাতাঝরা, প্রায় বিবস্ত্র, কালো, রোদ-পোড়া শরীর থেকে এমন একটা ঝাঁঝ উঠছে যে সে ঝাঁঝ আমার প্রশ্বাসের সঙ্গে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে আর মনে হচ্ছে, মাথা ঘুরে পড়েই যাব বুঝি। ছাতার, তিতির, কালতিতির, বটের, ময়ূর, মুরগি সবাই একটু ছায়া খুঁজে বসে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। তিতির আর মুরগিরা গরম লাগলে কুকুরদের মতোই মুখ হাঁ করে শ্বাস নেয়।

এখন বাঘটা ধারেকাছে নেই। আমরা মেয়েটির রক্তের ছিটে আর বাঘের তাকে মাটিতে, পাথরে, পুটুসের ঝোপের আর ঝাঁটি-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবার দাগ দেখে মৃতদেহের হদিশ করেছি।

টিলাটার পায়ের কাছে কিছুটা জায়গার মাটি নরম ঝুরঝুরে। হয়তো শুয়োর বা শজারু স্বল্পদিন আগে মুল খুঁড়ে খেয়ে গেছে অথবা শিঙাল হরিণ বা শম্বর মারামারি করেছে নিজেদের মধ্যে। তাই মাটি আলগা হয়ে গেছে। তারই ওপরে বাঘের থাবার দাগ দেখতে পেলাম আমরা। অন্য সব জায়গাতেই শক্ত মাটি। তাই দাগ নেই। থাবার দাগ বাঘেরই, বেশ বড় বাঘ।

টিলাটার প্রায় গা ঘেঁষেই একটা গামহার গাছ উঠেছে। বেশ বড় ও ঝাঁকড়া গাছ। ঋজুদার শরীর, এই বয়সেও আমার শরীর থেকে অনেকই বেশি ফিট আছে।

মাচা-টাচা বাঁধা যায়নি। দুটি ডালের মাঝে ঋজুদা বসেছে, মাটি থেকে হাত দশেক ওপরে। মানুষখেকো বাঘ মারতে এসে আরও উপরে বসতে পারলে আমার মতো শিকারি নিশ্চিন্ত হতাম কিন্তু ঋজুদার ভয়-ডরটা কম। কিন্তু আমার মনে হল গাছটা টিলাটার এতই কাছে যে, ধূর্ত বাঘ যদি ঋজুদার অবস্থান বুঝতে পেরে টিলার অন্যদিক থেকে গিয়ে টিলার মাথায় উঠে আসে তবে সহজেই গামহার গাছের মোটা ডাল বেয়ে সামান্য নামলেই ঋজুদাকে ধরে ফেলতে পারে। চিন্তাটা যখন আমার মাথাতে এল তখন আর কথা বলার উপায় নেই। কাল সকালের আগে দু’জনের মধ্যে কোনও কথাবার্তা হবে না। একে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে দিনে বুলবুলির আর রাতে পেঁচার ডাক ডেকেই তা করতে হবে। এমনই ঠিক হয়েছে।

আমি বসেছি একটি মস্ত চাঁর বা চিরাঞ্জিদানার গাছে। বাঘটা মেয়েটিকে টিলার গুহাতে লুকিয়ে রেখে যে পথ দিয়ে ফিরে গেছে তার ডেরার দিকে, মানে, আমাদের যা অনুমান, সেই পথেরই বাঁ পাশে পড়ে এই মস্ত চাঁর গাছটি। ঋজুদা নিজে হাতে, আমরা যখন দুপুরে এখানে এসেছিলাম, দূর থেকে দু-তিনটি অন্য গাছের ডাল সাঙ্গোপাঙ্গদের দিয়ে কাটিয়ে এনে আমার বসার জন্যে সেই গাছে একটি শক্তপোক্ত মাচা বানিয়ে দিয়েছিল। তাতে বসে, একটি মোটা ডালে হেলান দিয়ে আরাম করার বন্দোবস্তও ছিল। কিন্তু আরামের আধিক্য হলে ঘুমিয়ে পড়া এবং গাছ থেকে বাঘের মুখে খসে পড়ার ভয়ও ছিল। যাই হোক, বাঁ পাশে ভিজে ফ্ল্যানেল জড়ানো তামার তৈরি সেনাবাহিনীর জলের বোতল আর ডানদিকে পয়েন্ট থ্রি ফিফটি সিক্স ৯.৩ ম্যানলিকার শুনার রাইফেলটি শুইয়ে আমি মোটা ডালে হেলান দিয়ে বসেছিলাম।

বাঘ দিনমানেই আসুক কি রাতে, বনের পশুপাখি তার আগমন বার্তা আমাদের জানিয়ে দেবেই যে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই ছিল না আমার। তা ছাড়া অন্ধকার নামতে এখনও ঘণ্টাদুয়েক বাকি। এমনকী সূর্যও হেলেনি এখনও পশ্চিমে। এত তাড়াতাড়ি এসে বসার কী দরকার ছিল আমি জানি না। আরও একটু ঘুমিয়ে নিয়ে তারপরই এলে হত। সারাটা রাত তো জাগতেই হবে। বাঘ আসুক আর না আসুক মানুষখেকো বাঘের হেডকোয়ার্টারে কৃষ্ণপক্ষের রাতে গাছ থেকে নেমে হরজাই জঙ্গলে ভরা কাঁচা বনপথ দিয়ে দেড় কিমি মতো হেঁটে ‘মারা’র বনবাংলোতে পৌঁছবার চেষ্টা করা নেহাত দায়ে না পড়লে, আত্মহত্যারই নামান্তর হবে। অতএব পা এবং কোমর যতই ব্যথা করুক, যত ঘুমই পাক, সারারাত ওই চিরাঞ্জিদানা গাছের ডালে বাঁধা মাচার ওপরেই বসে থাকতে হবে।

বাঘটা যে এই টিলার গুহাতে এনে মেয়েটিকে রেখেছে তার আরও একটি কারণ আছে। ঝিঙ্গাঝিরিয়া নালার ব্যাকওয়াটারের মতো একটি জলা আছে ওই টিলার সামনে, আমি যে গাছে বসেছি তা থেকে পঞ্চাশ গজ মতো দূরে। তাতে জল যা আছে তা গভীর নয়। এখন আর বিশেষ প্রাধান্য নেই তবে বাঘ ও অন্যান্য প্রাণীদের পানীয় জলের তৃষ্ণা এতেই মিটতে পারে। এবং মেটেও। এইখানে যখন জল বেশি ছিল তখন হরিণ, শম্বর সব জলে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকত। বাঘও অনেক সময়ে বেশি গরম লাগলে এমনি করে গা ডুবিয়ে বসে থাকে। যদিও সাধারণত জলকে বিড়াল-পরিবার বিশেষ পছন্দ করে না। কিন্তু হলে কী হয়! ঠেলার নাম বাবাজি! গরম, বলে গরম। তবে বাঘ যখন জলে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকে, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘wallowing’, তখন বলাই বাহুল্য, শম্বর বা হরিণদের যতই গরম লাগুক তারা ওই জলের ত্রিসীমানাতেও আসে না।

ব্যাকওয়াটারের জলটা যেখানে, সে জায়গাটা আমার এবং ঋজুদার দু’জনেরই আগ্নেয়াস্ত্রর পাল্লার মধ্যে। ঋজুদার ধারণা যে, বাঘ গুহাতে রাখা মেয়েটির দিকে যাবার আগে ওই জলে তার তৃষ্ণা মিটিয়ে যাবে এবং খাওয়া শেষ হবার পরেও আবার ওখানেই জল খেতে আসবে। ওই জলের তিনপাশে ঝোপঝাড় বিশেষ নেই। ছোট গাছ-গাছালিও বলতে বিশেষ কিছু নেই তাই বাঘ যদি সত্যিই জলে আসে তবে নিশানা নিয়ে গুলি করতে সুবিধা হবে।

কৃষ্ণপক্ষের রাত। সপ্তমী কি অষ্টমী হবে। চাঁদ উঠবে। তবে দেরি করে। চাঁদের বা তারার আলো জলে প্রতিফলিত হয় বলে জলা জায়গাকে অন্য জায়গা থেকে অনেক বেশি আলোকিত করে। চাঁদ যদি নাও ওঠে তবুও তারার আলোতেও গুলি করা যাবে ও টার্গেট দেখা যাবে। যদি হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় তবে মুশকিল। গতকালও সন্ধের পর অনেকক্ষণ ঝড়ের তাণ্ডব চলেছিল। মে মাসের শেষ, বর্ষা বুঝি তড়িঘড়িই এসে গেল। এমনিতেই সারা পৃথিবীর আবহাওয়াই তো ওলট পালট হয়ে গেছে। ঋতুচক্র আর নিয়ম মেনে আদৌ ঘোরে না।

দেখতে দেখতে ঘণ্টা দেড়েক সময় কেটে গেল। আলো একটু নরম হয়েছে। ভাবছি, পাটা খুব আস্তে আস্তে একটু ছড়িয়ে দিই এমন সময়ে চোখ পড়ল জলের দিকে। মিশকালো, অত্যন্ত লম্বা একটি সাপ, প্রায় তিনমানুষ লম্বা হবে, জলের দিকে চলেছে জল খেতে। তার মিশকালো গায়ের ওপরে সাদা কালো পটি দেওয়া। পেটের দিকে কালো রং হালকা হয়ে প্রায় সাদাটে হয়ে গেছে। সাপটা জলের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ ফণা তুলে দাঁড়াল। মাটি থেকে প্রায় তিন সাড়ে তিন ফিট মতো উঁচু ফণা। ফণার উপরে ইংরেজি v চিহ্নকে উলটে দিলে যেমন দেখায় তেমনই একটা চিহ্ন। কেন অমন করল, কে জানে। কোনও কিছু তাকে বিরক্ত করেছে কি? ঠিকই তাই। যা ভেবেছিলাম। একটা বিরাট বিরাট দাঁতওয়ালা শুয়োর ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ করতে করতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জল খেতে আসছিল। শুয়োরের লেজটা উত্তুঙ্গ হয়ে রয়েছে, বুনোদের যেমন হয়। দিশি শুয়োরের লেজ শায়ানো থাকে। বরাহ বাবাজি ওই সাপের চেহারা, দৈর্ঘ্য এবং ফণা তোলার বহর দেখে আর না এগিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সাপটা জলের প্রান্তে মাথা নিয়ে গিয়ে জল খেল তারপর অতি দীর্ঘ শরীরটাকে ভারি চমৎকার এক চকিত ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে নিয়ে যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে গেল। সাপটা ফিরে গেলে বরাহ বাবাজি জলে এসে সামনের দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে জল খেল। তার দাঁতের বাহার আছে বটে। বাঁকানো দাঁত দুটি। যার পেট চিরবে, সে অভিশাপ দেবার সময়ও পাবে না। তার আগেই পঞ্চত্বলাভ করবে।

সাপটা কী সাপ হতে পারে তাই ভাবছিলাম। আমি সাপ তেমন চিনি না। চিনতে চাইও না। আফ্রিকান গাবুন ভাইপারই হোক কি উত্তর আমেরিকার র‍্যাটল-স্নেক কি আমাদের দিশি গোখরো, কেউটে, কি শঙ্খচূড় তাদের থেকে দূরে থাকতেই ভালবাসি আমি। সাপ দেখলেই গা ঘিনঘিন করে আমার। সব সাপকেই বিষধর বলে মনে হয়। ঋজুদা অনেকই বুঝিয়েছে আমাকে যে আমাদের দেশের অধিকাংশ সাপই নির্বিষ। কিন্তু আমার সাপকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে যায় না। কামড়ালে তবেই না বোঝা যাবে বিষধর না নির্বিষ। অমন এক্সপেরিমেন্টে কাজ নেই আমার।

বরাহ বাবাজি জল খেয়ে ফিরে যেতেই দূর থেকে বাতাসে কীসের যেন এক গুঞ্জরণ ভেসে এল। যেন কোনও মনো-ইঞ্জিন টাইগার মথ বা বনাঞ্জা প্লেন উড়ে আসছে। আওয়াজটা কাছে আসতেই বোঝা গেল একটি আওয়াজ নয়, আওয়াজের সমষ্টি। প্রায় শ’ পাঁচেক কমলা রঙা প্রজাপতির একটি ঝাঁক উড়ে আসছে এদিকে। কাছাকাছি আসতেই তারা নীচে নেমে এল এবং তারপর ঝিঙ্গাঝিরিয়া নদী থেকে যে তিরতিরে স্রোত বেয়ে ব্যাকওয়াটারের জল এসেছে সেই তিরতির করে যাওয়া স্রোতের পাশের ভিজে বালিতে একবার বসে আবার উড়ে তারা জল খেতে লাগল। আশ্চর্য এক দৃশ্য। গেরুয়া মাটি, সাদা জল সবকিছু প্রজাপতিদের ডানার কমলা রঙের আভাতে ঢেকে গেল। ফ্লেমিংগো পাখিরা আমাদের ওড়িশার চিলিকা হ্রদ-এ বা আফ্রিকার লেক মানিয়ারা বা গোরোংগোরোর মৃত আগ্নেয়গিরির গহ্বরের হ্রদে বসে থাকলে জলে যেমন কমলা ছায়া পড়ে তেমনই ঝিঙ্গাঝিরিয়ার নালার জলে কমলা ছায়া পড়ল। ঠিক সেই সময়েই একটা কোটরা হরিণ খুব ভয় পেয়ে ডাকতে ডাকতে আমার পেছন দিকের জঙ্গলের গভীরে দৌড়ে গেল আর এক জোড়া রেড-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ ডিড-ড্য-ডু-ইট ডিড-উ-ডু-ইট করে ডাকতে ডাকতে ঝিঙ্গাঝিরিয়া নালার প্রায় শুকনো বুক ধরে উড়তে উড়তে তাদের লম্বা লম্বা পা দুটি দোলাতে দোলাতে এদিকে উড়ে আসতে লাগল।

আমি, ঋজুদা যেখানে বসে আছে গামহার গাছটার ওপরে, সেদিকে তাকালাম। বাঘ কি এসে গেল দিন থাকতেই?

একটা কাঠঠোকরা পাখি ঋজুদার ডানদিকে ঝিঙ্গাঝিরিয়া নালার দিকে একটা বড় গাছে বসে ঠক ঠক করছিল, তিতিরেরা চিহাঁ চিহাঁ চিহাঁ করছিল, তারা হঠাৎই যেন মন্ত্রবলে থেমে গেল। শেষ বিকেলের কাকলিমুখর প্রকৃতির মুখে কে যেন হঠাৎই কুলুপ এঁটে দিল। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা বন্ধ্যা হল। তা নিস্তব্ধতাই প্রসব করল শুধু। তার পরেও ঘটনার মতো কোনও ঘটনা ঘটল না।

ঋজুদা আজকে হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ডের প্যারাডক্স নিয়ে বসেছে। প্যারাডক্স ব্যাপারটা যে কী তা অনেক শিকারিও জানেন না। আপনারা যাঁরা রুদ্র রায়ের লেখা এই ঋজুদা কাহিনী পড়ছেন তাঁরা যে জানবেন না তাতে আর আশ্চর্য কী! প্যারাডক্স আগেকার দিনের রাজা-মহারাজদের এবং সচ্ছল রহিস শিকারিদের অতি প্রিয় স্পোর্টিং ওয়েপন ছিল। ডবল ব্যারেল বন্দুকের মতোই দেখতে কিন্তু তার ব্যারেল পয়েন্ট বারো বোরের। স্মথ বোর শটগান। আর অন্য ব্যারেলটাতে রাইলিং করা। ফলে, প্যারাডক্স দিয়ে বন্দুক এবং রাইফেল দুয়েরই কাজ একই সঙ্গে করা যায়। তবে এসব ওয়েপন আমার মতো সাধারণ ঘরের শিকারিরা অনেকেই দেখেননি। ঋজুদার কথা আলাদা। সে একধারে মহারাজা অন্যধারে ফকির।

বন একেবারেই নিস্তব্ধ হয়ে যেতেই হঠাৎ খেয়াল হল আমার যে, সূর্য, ঋজুদা যে টিলার কাছে বসেছে সেই টিলাটির পেছনের পশ্চিমের উঁচু পাহাড়টার আড়ালে ডুবে গেল। অন্ধকার হতে যদিও তখনও অনেক দেরি ছিল। দিনভর রোদে-পোড়া বনের গা থেকে একটা তীব্র উগ্র কটুকষায় গন্ধ উঠতে লাগল। তখন বোধহয় গ্রীষ্মবনের গা-ধুতে যাবার সময়। পর্ণমোচী গাছেদের কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখার পোড়া পোড়া গন্ধ, পাথরের বগলতলি আর উরুর ভাঁজে ভাঁজের খাঁজে খাঁজের শিলাজতুর গন্ধ, পিটিসবনের উগ্র গন্ধ, বনপথের ঝাঁঝা রোদে তন্দুরি হওয়া লাল মাটির গন্ধ সব মিলেমিশে এক আতরের কারখানাই খুলে গেল যেন হঠাৎ আর ওমনি তীব্রস্বরে মনের কামনা বয়ে হাওয়াটা বইতে লাগল দিনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে।

বলতে ভুলে গেছি, সাপটা চলে যেতেই পাখিরা এসেছিল। কেউ একা একা। কেউ কেউ দোকা দোকা। আবার কেউ ঝাঁক বেঁধে। কত না তাদের রঙের বাহার, গলার স্বরের বৈচিত্র্য। কোকিল, পাহাড়ি ময়না, বেনেবউ, কুবো, তাদের মস্ত বড় কালো লেজ আর বাদামি শরীর নিয়ে, ময়ূর, বন-মুরগি, তিতির, পাপিয়া, ফুলটুসি, মৌটুসি, দুর্গা টুনটুনি, টিয়া, নীলকণ্ঠ, বড়কি ও ছোটকি ধনেশ এবং মোহনচূড়া। আরও কত পাখি। সকলের নাম কি জানি আমি। এই বন যেন পাখিরই রাজ্য।

সবই ভাল, কিন্তু যখনই গুহার মধ্যে বিবস্ত্রা, বাঘের নখদন্তে ক্ষতবিক্ষত, ছেদিত-অঙ্গ মেয়েটির কথা মনে পড়ছে, ভারি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখতেও পারিনি আমি। তার শরীরে যে একটা সুতোও ছিল না। ভারি লজ্জা করেছিল। গায়ের রং কালো যদিও, কিন্তু ভারি সুন্দর তার গড়ন শরীরের। এক মাথা চুল, কোমর ছাপানো।এখন রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। জটা বেঁধে গেছে। রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। তার মুখটি দেখেছিলাম। পাশ ফেরানো। ভারি মিষ্টি মুখ। ভাবছিলাম, তার মা-বাবা আর স্বামীর বুকের মধ্যে কীই না বুঝি হচ্ছে এখন, যদি আমার বুকের মধ্যেই এমন ঝড় ওঠে। তবে গরিবদের কষ্ট সইবার ক্ষমতা অসীম। তাদের সব কিছুই সয়ে যায়। অন্তত আমরা তাই ভাবি।

সাপটা কী সাপ কে জানে। ঋজুদাও নিশ্চয়ই দেখেছিল। পরে ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

এবারে আকাশে যে গোলাপি আভাটি ছিল তাও দ্রুত সরে যাচ্ছে। একটা কুটুরে ব্যাঙ ডেকে উঠল। অনেক দূর থেকে বনের গভীরতম কেন্দ্রবিন্দু থেকে কালপেঁচা ডাকল একটা। দুরগুম-দুরগুম-দুরগুম করে। ওই আলো আঁধারিতেই একজোড়া নেকড়ে বাঘ এবং একটি হায়না জল খেয়ে গেল তাদের জিভে চক-চক-চকচক শব্দ করে। ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোরও এতক্ষণে জল খেয়ে সেই গুহাটির দিকে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে এল না। কেন এল না, কে জানে। সে যদি নাই এসে থাকে তবে কোটরা হরিণটা অমন ভয় পেয়ে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে গেল কেন কিছুক্ষণ আগে? রেড-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গরাই বা উড়তে উড়তে কাকে পাইলটিং করে নিয়ে আসছিল এদিকে?

এটা বুঝতে পারছি যে এই বাঘকে মারা অত সহজ হবে না আমাদের পক্ষে। কারণ একে মারার অনেকই চেষ্টা করেছেন রেনুকুট, মির্জাপুর, সিঙ্গরাউলি, রবার্টসগঞ্জ, বেনারস এবং সিধির শিকারিরা। যাঁরা কেউই হয়তো আমার তো বটে, ঋজুদার চেয়েও খারাপ শিকারি নন। অথচ কেউই মারতে পারেননি তাকে। সেই বাঘকে খুব সহজে আমরাও মারতে পারব না।

এর আগে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো তিনজন শিকারিকে মেরেছে। তার মধ্যে একজনকে খেয়েওছে। সিঙ্গরাউলির কয়লা খাদানের একজন আদিবাসী মেট। আসলে আমলোরির। সে খুব ভাল শিকারি ছিল। তবে ওই তিন শিকারিই বাহাদুরি করে মাটিতে অথবা বড় পাথরের আড়ালে বা টিলার ওপরে বসেছিল। মাচা বাঁধায়নি। ঠিক কী যে হয়েছিল তা বলতে পারত একমাত্র তারা নিজেরাই। কিন্তু তারা তো আর কথা বলতে পারবে না।

মনে হচ্ছে, অন্ধকার গাঢ় হবার পরেই বাঘ আসবে মড়িতে। তবে সে যদি যে পথ দিয়ে এসে মড়ি এখানে রেখে ফিরে গেছিল সে পথ দিয়েই আসে, তবে অন্ধকারেও অন্ধকারতর তাকে চোখে পড়বেই। আমার চোখকে ফাঁকি দিলেও সে ঋজুদার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। কিন্তু তার কি পিপাসা পায়নি একটুও। ‘মারা’ বনবাংলোর ফরেস্ট গার্ড ভাইয়ালাল শর্মা যা বলেছিল তাতে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার ওই জল ছাড়া এ তল্লাটে জল আর কোথাওই নেই। বাঘ যে অন্যত্র জল খেয়ে আসবে এমনও নয়। তবে? সে এল না কেন? সে কি আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে?

এতসব প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করছি আর জবাবগুলো নিজের বুকের মধ্যেই গুমরোচ্ছে। ঋজুদা যদি আমার মাচাতেও বসত, মানে, দু’জনে একই মাচাতে, তাহলেও ওই সব প্রশ্নর একটিও এখন করা যেত না। কারণ, কোনও জানোয়ারের মড়ি বা মানুষের মৃতদেহ যার উপরেই বসা হোক না কেন, মানুষখেকো বাঘ শিকারে এলে শিকারিকেও মড়ার মতোই বসে থাকতে হয়। অনেক বছরের শিক্ষা লাগে ভাল শিকারি হতে। চোখ, কান, নাক তো বটেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কেও জাগিয়ে তুলতে হয়। চোখের দৃষ্টিকে একশো আশি ডিগ্রি বিস্তার করতে শিখতে হয়। এর জন্যে অনেকই শিক্ষানবিশি লাগে। এই কারণেই অনেক কঁদুনি গাওয়া সত্ত্বেও ঋজুদা ভটকাইকে এবারে নিয়ে আসেনি সঙ্গে। বুঝতেই পারছি যে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘকে ঋজুদা বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখছে। কারণটা এই যে, সে সত্যিই খুব ধূর্ত এবং বিপজ্জনক। নইলে ঋজুদার সঙ্গে কম মানুষখেকো বাঘ তো আমরা এ পর্যন্ত কবজা করিনি! নিনিকুমারীর বাঘ, পুরাণাকোটের বাঘ, আরও কত জায়গার বাঘ।

এখন গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। রাত-পাখির ডাক, পেঁচাঁদের ঝগড়া, দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসা শম্বরের দলের হঠাৎ একপ্রস্থ ঢাঙ্ক ঢাঙ্ক ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দই নেই। অন্ধকার ক্রমশই গাঢ় হয়ে উঠেছে। গাঢ় থেকে গাঢ়তর। এমনই যে, চোখের পাতা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। অন্ধকার যেন হঠাৎ তরলিমা লাভ করেছে। জলের তলাতে চোখ খুলতে দুই চোখের পাতাকে যেমন জল সরাতে হয়, জল সইতেও হয়, তেমনই করে এই অন্ধকারকে সরাতে হচ্ছে চোখের পাতা দুটির। তবে জলের তলায় চোখ একবার খুললে সবুজ নীল সোনালি কত রঙের আলোর সুতো দিয়ে কোনও অদৃশ্য তাঁতির তাঁত বোনা দেখা যায় কিন্তু এই অন্ধকারের গভীরে, অন্ধকার সরিয়ে চোখের পাতা মেললে শুধু অন্ধকারই। গভীর, গভীরতর, গভীরতম। নাঃ চোখ এখন পুরোপুরিই অকেজো হয়ে গেছে। এখন শুধু কান আর নাকেরই ভরসা।

কতক্ষণ সময় কেটে গেল কে জানে! যে-ঘড়িটা এবারে পরে এসেছি তার ডায়ালে রেডিয়াম নেই। টর্চ জ্বালানোর প্রশ্নই ওঠে না। আমার কাছে টর্চ নেইও। যা আছে তা একটি পেনসিল টর্চ, ক্ল্যাম্পের সঙ্গে রাইফেলের ব্যারেল-এর গায়ে ফিট করা। ব্যাকসাইটের একটু পেছনে। বাঁ হাত দিয়ে ব্যারেলের নীচে যেখানে রাইফেলকে ধরব নিশানা নেবার সময়ে, সেই বাঁ হাতেরই বুড়ো আঙুল দিয়ে ওই টর্চ-এর লম্বাটে সুইচটিতে চাপ দিলেই রাইফেলের নলের ওপরে লাগানো টর্চের নিশানা নিয়ে গুলি করতে সুবিধে হবে। কিন্তু সে টর্চ তো ব্যারেলের সঙ্গেই লাগানো। তা খোলা যাবে না। যতক্ষণ অন্ধকার থাকে, মানে রাতের বেলা খোলা যদি যেতও তবেও অবশ্য মাচাতে বসে তা জ্বেলে ঘড়ি দেখা যেত না আদৌ।

হঠাৎই একটা ফিস ফিস আওয়াজ উঠল, প্রায়-পত্রহীন বনে বনে, পথের ধুলোতে, ঘাসে, পাতায়। একটা হাওয়া ছাড়ল ঝুরু ঝুরু করে। ঘাস পাতা পুটুসের ঝোপ আন্দোলিত হতে লাগল। দেখতে দেখতে হাওয়াটা জোর হল এবং জোর হতেই তখনই বোঝা গেল যে, অন্ধকার হয়ে যাবার পরেই আমার অজানিতে পরতে পরতে মেঘ জমেছে আকাশে। সেই জন্যেই হয়তো এত গুমোট লাগছিল এতক্ষণ। সে কারণেই তারাও দেখা যাচ্ছিল না এবং অন্ধকার অত গাঢ় হয়েছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওয়াটার জোর বাড়ল এবং পুবের পাহাড়গুলির দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে আসতে লাগল। তার মানে ওদিকে বৃষ্টি নেমেছে। তারও কিছুক্ষণ পরে গোমো থেকে বাড়কাকানাতে আসা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের মতো ধীরে-সুস্থে বৃষ্টি এল চিটির-পিটির শব্দ করে। তপ্ত কড়াইয়ে জল পড়লে যেমন বাষ্প ওঠে, গন্ধ ছোটে বাষ্পর, তেমনই রোদেপোড়া লাল মাটির পথে জল পড়তেই গন্ধ উঠল চারদিকে। আর শুধু পথের ধুলোর গন্ধই তো নয়, সারি সারি দাঁড়িয়ে-থাকা ঊর্ধ্ববাহু নাগা সন্ন্যাসীদের মতো হরজাই জঙ্গলের গাছেদের কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা থেকেও গন্ধ উড়তে লাগল। গন্ধ উড়তে লাগল চাঁপা ফুলের। বনের বুকের কোন গোপনে যে তারা ফুটে ছিল এতক্ষণ বোঝা পর্যন্ত যায়নি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি বনের বুকের ওই গন্ধ-জরজর বৃষ্টির ফিসফিসানির মধ্যে। একেবারে ভুলেই গেলাম যে আমি বসে আছি একটি সুন্দরী মেয়ের অর্ধভুক্ত-লাশ পাহারা দিয়ে মানুষখেকো বাঘ মারার জন্যে। এই আমার দোষ। আমি যে কবি নই শিকারি, এই বাস্তব কথাটাই মনে থাকে না আমার ঠিক যখন সেই কথাটা মনে রাখা খুবই জরুরি।

বেশ অনেকক্ষণ পরে বৃষ্টি যেমন হঠাৎই এসেছিল তেমন হঠাৎই থেমে গেল এবং তারপর দামাল হাওয়াটা রাখালের মতো এক আকাশ বিক্ষিপ্ত মেঘকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল অন্য বনের দিকে। তারারা ফুটল একে একে। তাদের নরম স্নিগ্ধ নীল সবুজ দ্যুতির নরম ছায়া কাঁপতে থাকল ঝিঙ্গাঝিরিয়ার ব্যাকওয়াটারের জলে। একটা কুটুরে ব্যাঙ ডেকে উঠল অদৃশ্য একটি গাছের কোটর থেকে। যে বড় বড় ঝিঁঝিরা অসহ্য গরমে দিনের বেলাতেই করতাল বাজানোর মতো করে ডাকে তারা বনের প্রথম বৃষ্টিকে স্বাগত জানিয়ে ডেকে উঠল সমস্বরে আর এক জোড়া পিউকাহা কঁকি দিয়ে দিয়ে ডেকে কলুষহীন রাতের আকাশকে চষে বেড়াতে লাগল। আকাশ তারাদের আলোতে আলোকিত হওয়াতে টিলাটাকে আরও বেশি কালো ও ভুতুড়ে মনে হতে লাগল। ঋজুদা যে গামহার গাছটাতে বসেছিল সেটাকে আলাদা করে চেনা গেল না আর। সেটা যেন টিলাটারই অঙ্গীভূত হয়ে গেল।

আমার খুব পিপাসা পেয়েছিল। খুব আস্তে আস্তে ওয়াটারবটলটা বাঁ পাশ থেকে তুলে ছিপি খুলে প্রায় নিঃশব্দে গলাতে যখন জল ঢালছি ঠিক তখনই দেখলাম পুবের জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে আধখানা চাঁদ উঠল বৃষ্টিস্নাত পাহাড় বনকে রুপোঝুরি করে। জলের বোতলটা ছিপি বন্ধ করে যথাস্থানে রেখে দিয়ে এবার দু’চোখ ভরে সেই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য দেখতে লাগলাম। এতক্ষণ যেন অন্ধ হয়েই ছিলাম। এই আধখানা চাঁদ এসে চক্ষুদান করল আমায়। দুঃখ হল রায়শোয়ার মেয়েটির জন্যে। কী যেন নাম তার? সুখমন্তি। হ্যাঁ সুখমন্তি। কিন্তু সুখ ছিল না তার কপালে। সুখমন্তি বেচারি জানতেও পেল না যে প্রচণ্ড দাবদাহর পরে বৃষ্টি নেমেছে ঝিঙ্গাঝিরিয়া এলাকাতে। সে এমন বৃষ্টিভেজা বনের রূপ দেখতে পেল না। পাবে না, আর কোনওদিন।

আরও কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে। রাত তখন ন’টা-দশটা হবে। জলের দিকে চেয়ে আছি আমি। ঋজুদা আমাকে ভার দিয়েছে বাঘ যদি ফিরে যাবার পথ ধরেই গুহার দিকে আসে এবং জলও যদি খায় তবে যখন সে আসবে তখনই তাকে ধড়কে দিতে হবে। তাই আমার এলাকাতেই আমি জোর নজরদারি চালাচ্ছি। এখন যদি বাঘ আসে তবে তাকে আর মানুষ খেতে হবে না। গর্ব করে বলছি না, কিন্তু এই রাইফেলের একটিও গুলি আজ অবধি ফসকাইনি আমি। বাঘ আজ এলে, তার আর নিস্তার নেই।

একই দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উদগ্রীব, উৎকর্ণ, উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে এক ধরনের ক্লান্তি আসে শিকারির অজান্তেই। জানি না, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কি না। একটি কোটরা হরিণ জল খেতে এসেছিল যে কখন, খেয়ালই করিনি কারণ চোখের পাতা নিশ্চয়ই জুড়ে গেছিল। হঠাৎই তার হিস্টিরিয়া-রোগীর মতো চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে টিলার উলটোদিকে দৌড়ে যাওয়াতে চমক ভাঙল আমার। চমকে উঠে টিলার দিকে চেয়ে দেখি আলগা পাথর একের পর এক থরে থরে সাজিয়ে রাখা কালো ভুতুড়ে টিলাটার আকৃতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে।

কী পরিবর্তন?

ভাল করে নজর করে দেখি টিলার কাছিম-পেঠা মাথাটির আকৃতি যেন আগের মতো নেই। কী ঘটল? নিজেকে প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরও পেলাম এবং পেয়েই রাইফেল তুললাম সেইদিকে। বাঘটা পেছন দিক থেকে টিলার মাথাতে উঠে এসেছে নিঃশব্দে। উঠে, টিলার মাথা থেকে ঋজুদা যে গামহার গাছটিতে বসে আছে তাতে নামার মতলব করছে। অতদূর থেকে গুলি করলে গুলি হয়তো লাগত কিন্তু গুলি করতে হলে রাইফেলটাকে তুলে ধরে গুলি করতে হবে কারণ টিলাটার উচ্চতা আমার মাচা থেকে অনেকখানি এবং তা করতে গেলে আমার রাইফেলের গুলি চিরাঞ্জিদানা গাছের কোনও ডালপালাতে লেগে প্রতিসরিত হয়ে যাবার খুবই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে কিছু একটা না করতে পারলে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো ঋজুদাকে আচমকা ধরে ফেলে তার মাথাটা চিবিয়ে দেবে। বাঘ মারার চেয়েও ঋজুদাকে বাঁচানো আমার কাছে অনেকই বেশি জরুরি বলেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ঋজুদা! বাঘ! তোমার মাথার উপরে বসে।

আমার গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই একটা চাপা বিরক্তির ওঁয়াও আওয়াজ তুলে বাঘ মুহূর্তের মধ্যে টিলার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি ভেবেছিলাম, ঋজুদা বলবে, থ্যাঙ্ক ইউ রুদ্র। আজ তোর জন্যেই জীবন পেলাম আমি। কিন্তু তা না বলে, ঋজুদা প্রচণ্ড এক ধমক দিল আমাকে। বলল, ইডিয়েট!

আমি থ হয়ে গেলাম। ঠাকুমা যে বাক্যটি প্রায়ই বলেন, সেই বাক্যটিই মনে পড়ে গেল আমার? যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর।

.

০২.

সকালে মারা বাংলোতে ডিমের ভুজিয়া, দিশি ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর লেবুর আচার দিয়ে যখন আমরা ব্রেকফাস্ট সারছি তখন নীগাঁহি থেকে সুরাবলী সিং রেঞ্জার তাঁর জিপ নিয়ে এসে হাজির। বললেন যে, নর্দার্ন কোলফিল্ডসের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর এস. কে. সেন সাহেব আর ফিনান্স ডিরেক্টর এ. কে, দাস সাহেব আপনার খোঁজখবর করতে এসে পৌঁছোবেন একটু পরেই, কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে। সঙ্গে বিশ্বজিৎ বাগচীকেও নিয়ে আসবেন, সুপারিনটেনডিং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, তিনি নাকি ঋজুদা কাহিনীর খুব ভক্ত এবং নিজেও কবি।

আমি আর ঋজুদা সারারাত যার যার গাছে বসেছিলাম চুপ-চাপ। পুবে আলো ফুটতেই মাচা থেকে আমরা দুজনেই নামলাম। থুড়ি, ঋজুদা তো মাচাতে বসেনি, গামহার গাছের ডালেই বসেছিল।

সুখমন্তিকে সেখানেই ফেলে আমরা কিছুটা এগোতেই দেখি সুখমন্তির বাবা ও স্বামী এবং মারা গ্রামের বেশ কয়েকজন লোক হাতে টাঙ্গি, গাদা বন্দুক, তীর-ধনুক ইত্যাদি নিয়ে দল বেঁধে এ দিকেই আসছে। রাতে কোনও গুলির শব্দ না শুনতে পেয়ে ওরা বুঝতেই পেরেছিল যে বাঘ মরেনি। তবে এও বুঝতে পারেনি যে, শিকারিরাও বেঁচে আছে কিনা। তেমন মনে করার পেছনে যুক্তিও ছিল। কারণ, এ বাঘ তো শিকারি-খেকো হিসেবেও খুবই নাম, কিনেছে। ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো চুপিসাড়ে দুই শিকারিকে খেয়ে সাফ করে দিয়ে থাকলেও তো অতদূরের গাঁয়ে বসে তার শব্দ শোনা যেত না। তা ছাড়া কমবয়সি আমার চেহারা-ছবি গ্রামবাসীদের বিশেষ ভাল যে লাগেনি তা প্রথমেই আমি বুঝেছিলাম। ওদের মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন বলতে চাইছে, হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল?’ নেহাত ঋজুদার ল্যাংবোট হয়ে এসেছি বলেই আমাকে ওরা মেনে নিয়েছিল।

ওরা সকলে আমাদের মুখোমুখি আসতেই ঋজুদা বলল, সুখমন্তি যেমন ছিল তেমনই আছে। তোমরা ওকে কবর দিতে পারো। ওকে আর আমাদের দরকার নেই। বাঘ ওকে আর ছোয়নি।

ওরা সঙ্গে করে একটি ছোট খাঁটিয়া এবং নীলরঙা মোটা একটা খদ্দরের চাদর নিয়ে এসেছিল। সুখমন্তির বড় জা যে সেও এসেছিল ভাসুরের সঙ্গে। গতকাল তাকে খুবই কাঁদতে দেখেছিলাম। আজকে কিছুটা সামলেছে। ওর জা সুখমন্তির কাছে গিয়ে তার শরীর চাদরে ঢেকে তারপরই চৌপাইয়ে তুলে নিয়ে আসবে। পুরুষদের নগ্না সুখমন্তির কাছে যেতে লজ্জাও করত খুবই। আমার তো মনে হয়েছিল এই বুঝি সুখমন্তি চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেয়েই লজ্জাতে ধড়ফড় করে উঠে বসবে। কথায় বলে না, লজ্জা যায় না মলেও।

ওরা তারপর ‘রাম নাম সত্ হ্যায়। রাম নাম সত্ হ্যায়’ ধ্বনি দিতে দিতে সুখমন্তিকে নিয়ে গিয়ে কবর দেবে ওদের কবরভূমিতে।

ওরা আমাদের পেছনে ফেলে টিলাটার দিকে এগিয়ে গেলে ঋজুদা আমাকে বলেছিল, আজই আমরা কলকাতাতে ফিরে যেতে পারতাম যদি তুই অমন কেলো না করতিস।

আমি বললাম, আমি জানব কী করে!

কী জানবি?

ঋজুদা বিরক্তির সঙ্গে বলল।

তারপর বলল, তুই কি আমার সঙ্গে জঙ্গলে এই প্রথমবার এলি? তুই কোন আক্কেলে ভাবলি যে বাঘ টিলার উপরে উঠে এসেছে আর আমি তা জানতেই পারিনি।

তারপরে, পাইপটাতে ভাল করে আগুন ধরিয়ে বলল, তোকে বলিনি আগে, কারণ, বলার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আমি যে টিলাটার গায়ের সঙ্গে প্রায় লেগে-থাকা গামহার গাছটাতে বসেছিলাম তা তো ওই জন্যেই। গাছটাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল গরমের সন্ধেতে নানা পশু-পাখি-সরীসৃপের ভিড় ঠেলে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘ ওদিক দিয়ে হয়তো গুহাতে আসবে না। উলটোদিক দিয়েই আসবে। এবং এলে, এই কাছিম-পেঠা টিলাটার মসৃণ মাথা থেকে প্রায় চল্লিশ ফিট লাফিয়ে নামার চেয়ে গামহার গাছের মোটা ডাল বেয়ে নেমে আসাটাই ওর পক্ষে সুবিধের হবে। কেন মনে হয়েছিল জানি না, কিন্তু হয়েছিল। আমার এরকম মনে হয় সময়ে সময়ে, মনে হয় ভিতর থেকে কেউ মনে করিয়ে দেয়।

তারপর বলল, বাঘটা টিলার মাথাতে এসে প্রথমে গুঁড়ি মেরে বসেছিল অনেকক্ষণ সমস্ত পরিবেশ প্রতিবেশ ভাল করে নিরীক্ষণের জন্যে। তখনই তাকে মারতে পারতাম কিন্তু একটা গাছের ডালের আড়ালে ছিল তার গলা ঘাড় এবং বুক। অত কাছ থেকে ওই রকম বড় ও কুখ্যাত বাঘকে তো বেজায়গাতে গুলি করা যেত না। এক গুলিতেই তাকে ধরাশায়ী না করতে পারলে সে আমাকে ছ্যাদরা-ভ্যাদরা করে দিত। তাই অপেক্ষা করছিলাম, কখন সে উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা এগিয়ে এসে গামহার গাছে পা রাখবে। উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আমি মুথব্যারেলের অ্যালফাম্যাক্স-এর পৌনে তিন ইঞ্চি এল. জি. দিয়ে ঘাড়ে মারতাম আর মারলেই সে টিলার মাথাতেই থিতু হয়ে যেত। কিন্তু কী আর করব।

আমি চুপ করে রইলাম।

ঋজুদা বলল, এই জন্যেই বলে, Man proposes God disposes’। বাঘটা যেই উঠে দাঁড়াতে যাবে, আমি গুলি করব, ঠিক সেই সময়েই তোর আর্তনাদ। নিমেষের মধ্যে সে এক ডিগবাজিতে ভাগলবা হল। ওই ডিগবাজির উপরেই যে গুলি করতে পারতাম না, তা নয়। করলে, হয়তো গুলি লাগতও তার শরীরে। কিন্তু শরীরে যেসব জায়গাতে লাগাতে চাইছিলাম সেইসব জায়গাতে লাগত না। হয়তো পেটে বা পেছনের পায়ে লাগত। সেই ঝুঁকি এই বাঘের বেলা নেওয়া যেত না।

তারপর প্যারাডক্সটাকে ডান কাঁধ থেকে বাঁ কাঁধে কাঁধ বদল করে বলল, এই বাঘের জন্যে, যদি আহত করে তাকে ছেড়ে দিতাম, জবাবদিহি আমাকে যেমন করতে হত, তেমনই করতে হত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অনুপ কুমারকে। বনমন্ত্রীকেও মধ্যপ্রদেশে বিধানসভায় কৈফিয়ত দিতে হত।

আমি অবাক হয়ে বললাম, বিধানসভায়?

হ্যাঁ। ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোর প্রসঙ্গ এমনিতেই মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায় প্রায় দৈনিকই উঠেছে গত কয়েকমাস হল। এই বাঘের জন্যে নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর কোনও কোনও ওপেন-কাস্ট মাইনের কাজ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাঘ যদি এই অঞ্চল ছেড়ে সেদিকে দয়া করে একটু এগিয়ে যায়, তাহলেই চিত্তির। তাই নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর কর্তাদেরও মাথা-ব্যথা শুরু হয়েছে। মানে, prevention is better than cure বুঝলি না।

তারপর বলল, বাঘ মারা তো বে-আইনি বাহাত্তর সাল থেকেই। প্রথমত, এ বাঘ মানুষখেকো হয়েছে, এবং এত মানুষ খেয়েছে বলে এবং দ্বিতীয়ত, এর দেখা পাওয়াই অতি দুরূহ বলে বনবিভাগও ট্রাঙ্কুলাইজার গান ব্যবহার করে বা অন্য উপায়ে একে কবজা করতে পারেনি এতদিনেও। তাই না মানুষখেকো ঘোষণা করিয়ে আমাকে তলব দিয়েছেন। এই বাঘ আর অন্য কোনও মানুষকে মারার আগেই একে মারতে না পারলে এই প্রথমবার আমি বে-ইজ্জত হব। এতদিনের সুনাম সব জলে যাবে। এদিকে আমি চারদিনের বেশি থাকতেও পারব না। সাহারা এয়ারওয়েজ-এর একটা ফ্লাইট আছে বেনারস-কোলকাতা। হপিং ফ্লাইট যদিও। সিঙ্গরাউলি থেকে বেনারস গাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে শুক্রবার ফ্লাইট ধরে কোলকাতা ফিরতেই হবে আমাকে কারণ শনিবার সকালে দিল্লি যেতেই হবে।

আমি অপরাধীর মতো বললাম, সরি ঋজুদা। আমার জন্যেই মানুষখেকোটাকে তুমি মারতে পারলে না।

ঋজুদা বলল, ঠিক আছে। তবে তুই কী করে ভাবলি যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি বা বাঘকে দেখতেই পাইনি। যে-শিকারি মানুষখেকো বাঘ মারতেই এসে বাঘে-মারা মানুষের kill-এর ওপরে বসে ঘুমিয়ে পড়ে তার অবশ্যই বাঘের পেটে যাওয়া উচিত।

ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়ে যেতেই ঋজুদা বাংলোর বারান্দার কাঠের টেবলের উপরে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজের শিট বিছিয়ে সুরাবলী সিং রেঞ্জার, শম্ভুপ্রসাদ ত্রিপাঠী এবং ভাইয়ালাল শর্মা দুই ডেপুটি রেঞ্জারের সঙ্গে বসে একটা ম্যাপ এঁকে ফেলল।

আগে এই সমস্ত এলাকাই নাকি রেওয়া করদ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। খুব উঁচু উঁচু অতি দুর্গম ঘন জঙ্গলাবৃত পাহাড়, গভীর সব ভয়াবহ খাত ও উপত্যকা। পানীয় জলের সাংঘাতিক অভাব। ভয়াবহ সব বন্য প্রাণীর, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, এবং নানারকম অসুখের আগার এই সব ব্যয়রান’ অঞ্চলকেই রেওয়ার রাজা Open Air Jail হিসেবে ব্যবহার করতেন। যে সব প্রজা এবং শত্রুকে এই অঞ্চলে নির্বাসন দিতেন তারা কেউ কেউ পাগল হয়ে যেত, কেউ কেউ জানোয়ারের জীবন যাপন করত, তবে অধিকাংশই তাদের জ্বালা জুড়োত এই নির্বাসনে মরে গিয়ে। তাই এই অঞ্চলের ভয়াবহতার সঙ্গে এরা পরিচিত ছিল বহুদিন থেকেই। বড় বড় বাঘ, ভাল্লুক, বাইসন, বুনোমোষ, শম্বর, নানারকম বিষাক্ত সাপে ভরা ছিল এই সব বন। তবে আশ্চর্যের কথা, হাতি ছিল না। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ইত্যাদি সব জায়গার বনেই হাতি আছে কিন্তু মধ্যপ্রদেশে বিন্ধ্য, সাতপুরা এবং মাইকাল পর্বতশ্রেণী থাকা সত্ত্বেও হাতি যে কেন নেই এটা ভেবে অবাক লাগে আমার। হাতি কেন নেই? এর সদুত্তর কারও কাছেই পাইনি। এমনকী আমার জঙ্গলের এনসাইক্লোপিডিয়া ঋজুদার কাছেও নয়।

এই বন থেকেই রেওয়ার রাজা সাদা বাঘ বা Albino বাঘ ধরে নিয়ে গিয়ে নিজের রাজধানী রেওয়াতে সাদা বাঘের বংশবৃদ্ধি করেছিলেন।

ওদের সকলের কাছে শুনে যা বোঝা গেল এবং সেই মতো ঋজুদাও আঁকল ম্যাপটা যে, সবসুদ্ধ পঞ্চাশ বর্গ মাইল এলাকাতে বাঘটার ক্রিয়াকাণ্ড আপাতত সীমিত আছে। কাঁচেন নদী, লাউয়া নালা, গাড্ডা নালা, ভুলি নালা, রাবণমারা গুম্ফা, ঝিঙ্গাঝিরিয়া নালা, পাতঝর, রাজমিলান, বিন্দুলের পথে, মেয়ার নদী এবং বিন্দুল হল এই বাঘের beat’। এই অঞ্চলেরই সব ছোট ছোট গ্রাম থেকে অনবরত মানুষ নিচ্ছে বাঘটা।

ঋজুদা ওঁদের সকলকে জিজ্ঞেস করল বাঘটাকে কেউ নিজচোখে দেখেছেন কি ? আর সে মানুষখেকো হল কেন সে সম্বন্ধে কিছু জানেন কি না?

ভাইয়ালাল বললেন, মাছবান্ধা নালার পাশে একটি দশবারো বছরের কেওট ছেলে বাঘটাকে দেখেছিল সে যখন শেষ বিকেলে তার দিদিকে ধরে। বসন্তশেষে ওর দিদি মাছবান্ধা নালাতে পোলো দিয়ে মাছ ধরছিল আর ও আওলা গাছে উঠে তখন আমলকী পাড়ছিল। ছেলেটি বলেছিল যে বাঘটি চলার সময়ে গোঙানির মতো শব্দ করে এবং তার সামনের বাঁ পায়ে একটা চোট আছে। খুঁড়িয়ে হাঁটে।

কেওটটা কী ব্যাপার?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ঋজুদা বলল, ইন্টারাপট করিস না। কেওট মানে জেলে।

সুরাবলী সিং রেঞ্জার বললেন, বাঘটার পায়ে যদি চোট থাকেও বাঘটাকে কিন্তু এই অঞ্চলের কোনও শিকারি আহত করেনি। ব্যয়রানেই ও চোট পেয়ে হয়তো সেই চোটেরই পর পালিয়ে এদিকে চলে আসে। প্রথম দিকে নাকি মাছ ধরে খেত তারপর হঠাৎই কোনও মানুষ, ওই ছেলেটির দিদিরই মতো, মেরে ফেলে এবং খেয়ে বুঝতে পারে যে মানুষ মারা সবচেয়ে সোজা আর তারপর থেকেই শুধু মানুষই মারতে থাকে। যত মানুষ সে মেরেছে তার মধ্যে নব্বই ভাগই মেয়ে। কেন যে, তা সেই জানে।

ভাইয়ালাল শর্মা বললেন যে, বাঘটা হুজুরু পাহাড়ের একটা গুহাতে থাকে। যদি কোনও শিকারি দিনমানে সাহস করে তার ডেরায় গিয়ে তার সঙ্গে টক্কর দিতে পারে তাহলে নির্ঘাৎ সে মারা পড়বে। অন্য ভাবে তাকে মারা ভারি মুশকিল। মানুষের মৃতদেহের মড়ির উপরে যদি শিকারি বসে থাকে তবে এই বাঘ মড়ির প্রতি কোনও ঔৎসুক্য না দেখিয়ে শিকারিকেই ধরার চেষ্টা করে। তিনজন শিকারিকে তো সে ধরেছে। এইরকম সাংঘাতিক দুঃসাহসী মানুষখেকো বাঘের কথা বাপ-দাদাদের মুখেও কখনও শুনিনি। সারা জীবন তো আমার বাপ-দাদার জঙ্গলেই কাটল।

আমি ভাবছিলাম, গতরাতে চতুর্থ শিকারিকে ধরার চেষ্টা করেছিল।

একজন শিকারিকে তো খেয়েইছে। অন্যদের মাথাগুলো, আমরা যেমন করে পাহাড়ি পাড়হেন মাছের মাথা চিবাই তেমন করে চিবিয়ে ফেলে দিয়ে গেছে। ওর ওই দুঃসাহসের জন্যেই স্থানীয় শিকারিরা একে একে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন সকলেই। যদিও পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে মধ্যপ্রদেশ সরকার এই বাঘ মারার জন্যে।

ঋজুদা শুধোল, যদি হুজুরু না, কি পাহাড়ে তার বাস এবং সে গুহাও যদি সকলে চেনে তবে একদিন সকলে মিলে ছুলোয়া করে তাকে মারবার চেষ্টা কেন করা হল না?

সুরাবলী সিং বললেন, ওই গুহার পেছনেও অন্য একটা মুখ আছে। এই তো হোলির কদিন আগেই দশগাঁয়ের মানুষ মিলে চোদ্দটা দোনলা ও পাঁচটা একনলা গাদা বন্দুক নিয়ে ছুলোয়া করা হয়েছিল। আড়াইশো মানুষ শামিল ছিল সেই ছুলোয়াতে। ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘ পেছনের পথ দিয়ে বেরিয়ে একজন ছুলোয়াওয়ালাকে এক থাপ্পড় মেরে তাকে বেড়াল যেমন মাছ মুখে করে চলে যায় তেমনই করে উপত্যকাতে নেমে গেছিল। অতজন শিকারি ও মানুষের চোখের সামনে। শিকারিরা গুলি করতে পারেনি পাছে লোকটারই গায়ে লাগে। সে তো হাত-পা ছুড়ছিল তখনও। গুহাটার পেছনেও যে একটা মুখ ছিল তা তারা জানত না তাই পেছন দিকে কোনও শিকারি ছিল না। তবু শিকারিরা বাঘের পেছন পেছন কিছুটা দৌড়ে গেছিল কিন্তু বাঘ ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। হুজুরু পাহাড়ের ওই গুহাটা একটা ভুলভুলাইয়া।

আমরা সবাই চুপ করে রইলাম। ব্যয়রানের দুষ্ট আত্মা বা হুজুরু পাহাড়ের ভুলভুলাইয়ার কথা কোলকাতায় বসে শুনলে আমরা হয়তো হাসতাম। হয়তো কেন নিশ্চয়ই হাসতাম। কিন্তু ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোর কীর্তিকলাপ শুনে এবং এই মারা বনবাংলোতে বসে অবিশ্বাস করতে খুবই মনের জোর লাগে।

কবে এই ঘটনা ঘটেছিল?

ঋজুদা কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করল।

বললাম না, হোলির কিছুদিন আগেই। ইতোয়ার ছিল সেদিন।

ভাইয়ালাল বললেন, ঋজুদার প্রশ্নের উত্তরে।

ফাগুন মাসের মাঝামাঝি।

শম্ভুপ্রসাদ বললেন।

সেতো অনেকদিনের কথা। তারপরে এই দু-আড়াই মাসে কোনও শিকারি আর ওই বাঘকে মারার চেষ্টা করেননি?

ঋজুদা বলল অবাক হয়ে।

কেন। করেছিলেন তো। তারপরেই তো গর্বীর খাদানের জি. এম. এর একমাত্র দামাদ রেনুকুট থেকে এলেন বাঘ মারবার জন্যে। আমেরিকা-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার, বয়স কম, উৎসাহ বেশি। দু’লাখ টাকা দামের রাইফেল নিয়ে এলেন।

ভাইয়ালাল বললেন, অভিজ্ঞতা কম কিন্তু বাহাদুরি একটু বেশিই ছিল। ভেবেছিলেন হয়তো যে, রাইফেলের দাম শুনেই বাঘ ঘাবড়ে যাবে।

বাঘ একটি খারশোয়ার ছেলেকে ধরে রাবণমারা গুম্ফার পেছনের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে কিছুটা খেয়ে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে গেছিল। সেই জি. এম. এর দামাদ সাহেব গুম্ফার পেছনে মড়ির কাছে একটি পাথরের স্তূপের উপরে বসেছিলেন। পেছনেই একটা শিমুল গাছ ছিল। তাই ভেবেছিলেন যে তার পিছন দিকটা সুরক্ষিত আছে। সেই দামাদকেও তো বাঘ বিকেল বিকেলই ধরে খেয়ে ফেলল। বিকেলের নাস্তা বানাল তাঁকে। দু’লাখি রাইফেল ধুলোতে গড়াগড়ি গেল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, সে কী। শিমুলের খোদলের মধ্যে ঢুকে বসা সত্ত্বেও বাঘ তাকে ধরল কী করে?

ভাইয়ালাল বললেন, পেছন দিয়ে তো আসেনি বাঘ। দামাদ সাহেব ভাবতেও পারেননি যে বাঘ দিনমানেই এসে হাজির হবে। তিনি রাইফেল শু্যটিং-এ চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। অনেক মেডেল-টেডেলও ছিল। কিন্তু টার্গেটে রাইফেল-শু্যটিং আর মানুষখেকো বাঘ মারা যে এক জিনিস নয় তা সম্ভবত তিনি জানতেন না। শিকারে যা দরকার হয় তা নার্ভ, সাহস, টার্গেট শু্যটার তা কোথায় পাবেন? তিনি রাইফেলটাকে পাথরের উপরে ডানহাতের কাছেই শুইয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরিয়ে মড়ির দিকে চেয়ে বসেছিলেন। ভেবেছিলেন, অন্ধকার হলেই রেডি হয়ে বসবেন। কিন্তু বাঘ তিন লাফে সেই পাথরের স্তূপের বাঁদিক দিয়ে উঠে তাকে কাঁক করে ধরে গভীর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে কোট-পাতলুন খুলে নাঙ্গা করে মজাসে খেল। টু শব্দটা করতে পারল না জি. এম. সাহাবের আমেরিকা ফেরত বহত পড়ে-লিখে দামাদ।

ভাইয়ালাল বললেন, ‘অকল’ এর নানারকম হয় বোস সাহেব। বই পড়ে যা শেখা যায় তা তো বনে-জঙ্গলে কাজে লাগে না। সব জিনিসই শিখতে হয়। না হলে, এত লোক থাকতে আপনাকে কোলকাতা থেকে নিয়ে এলেন কেন এঁরা?

দামাদ মানে কী?

আমি বললাম।

ঋজুদা বলল, ওই তো! ভটকাইটা এখানে থাকলে তোকে সঙ্গে সঙ্গে মানে বলে দিত। তুই বুঝি হিন্দি টিভি সিরিয়াল দেখিস না? দামাদ মানে যে জামাই আর জিজাজি মানে জামাইবাবু তাও জানিস না?

জানতাম। কিন্তু ভুলে গেছিলাম।

আমি বললাম, লজ্জিত হয়ে। শম্ভুলাল প্রসাদ বললেন, রুদ্রবাবু জঙ্গলের অনেক হিসাব-কিতাব তো জানেন, দামাদ আর জিজাজির মানে না হয় নাই জানলেন।

তারপরেও একজন শিকারি উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর থেকে এসেছিলেন। আরেকজন এসেছিলেন মুঘলসরাই-এর কাছের রবার্টসগঞ্জ থেকে।

প্রথমজনকে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো ধরেছিল মাচায় ওঠার সময়েই। বিকেলবেলা। অন্যজনকে ধরেছিল সকালবেলা, রোদ উঠে যাবার পরে, শিকারি যখন মাচা থেকে মাটিতে নামছিল তখন। পরপর তিনজন বড় বড় শিকারিকে এরকম বেপরোয়াভাবে মারার পরে স্থানীয় শিকারিদের আর কেউই তাকে ঘাঁটাবার সাহস পায়নি। ফলে, বাঘ এই এলাকাতে কাফু আইন জারি করে দিয়েছে। সন্ধের পরে তো কেউ বাড়ি থেকে বেরোয়ই না, দিনমানেও একা বেরোতে খুবই ভয় পায়। দল বেঁধে ছাড়া বেরোয় না।

ভাইয়া বললেন, এত দামি দামি বন্দুক-রাইফেল হাতে শিকারিদেরই যে বাঘ খেয়ে যেতে পারে দিনের বেলাতেই, তার সঙ্গে গাদা বন্দুক হাতে টকরাবার হিম্মত দেহাতি শিকারিদের হবে কী করে!

সুরাবলী সিং বললেন, এই দেখুন না, আজকে হাটবার। মারা’তে বরাবরই মস্ত হাট বসত। এই তো ফরেস্ট অফিসের লাগোয়া ময়দানেই বসে সেই হাট। হাট জমত বিকেল দুটোর পরে আর চলত সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তারপর হাঁড়িয়া-টাঁড়িয়া খেয়ে সবাই মস্ত হয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি যেতে যেতে রাতের দু’পহর করত। কত হাসি, গান, তামাশাকি অন্ধকার রাত আর কি উজলা রাত, কোনও তফাতই ছিল না। কত দূর-দূর গ্রাম থেকে সবজি, মোরগা, আন্ডা, বকরি, শুয়োর, জামাকাপড়, রুপোর গয়না, কাঁচের চুড়ি, চুলবাঁধা রিবন, মাথায় মাখা সুগন্ধি তেল, চাল ডাল তেল-এর দোকান, নানারকম নোন্তা ও মিষ্টি খাবারের দোকান বসত সার সার।

আর এখন?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

এখন বেলা বারোটা থেকে চারটের মধ্যেই বেচাকেনা সেরে সূর্য ডোবার অনেক আগেই মস্ত মস্ত দলে ভাগ হয়ে মেয়ে-মরদেরা যে যার গ্রামে চলে যায়।

পথে ভয়ে কাটা হয়ে থাকে। তবু তো দলে থেকেও নিস্তার নেই। ইচ্ছে হলে সে দলের মধ্যে থেকেও কারওকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

ওদের হাতে টাঙ্গিও কি থাকে না?

ঋজুদা বলল।

থাকে। সবই থাকে। কিন্তু ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো সামনে এসে দাঁড়ালে সকলের প্যারালিসিস হয়ে যায়। এখানের মানুষদের ধারণা, ওটা আসলে বাঘ নয়, ব্যয়রানে মারা-যাওয়া কোনও খারাপ মানুষের দুষ্ট-আত্মা। রেওয়ার রাজার বিরুদ্ধে তো প্রতিশোধ নিতে পারে না। তাই তার একসময়ের প্রজাদের উপরে প্রতিশোধ নিয়ে গায়ের ঝাল মেটায়। মেয়েদের উপরে বাঘটার জাতক্রোধ আছে নইলে বেছে বেছে মেয়েদেরই ধরে কেন?

ভাইয়ালাল বলল, এই দেখুন না! আর কিছুদিন পরেই বর্ষা নামবে। বাইগা ও গোন্দদের সকলেরই হোরিয়ালি একটা বড় উৎসব।

আমি জিজ্ঞেস করলাম হোলি?

হোলি তো চলে গেছে। না, হোলি নয়, হোরিয়ালি।

সুরাবলী সিং বললেন, সাহাব হোলি বা হোরি তো বসন্তোৎসব। হোরিয়ালি হচ্ছে চাষবাসের উৎসব। আমাদের ক্ষেত-জমিতে বছরে প্রথমবার হাল দিয়ে যখন আমরা বর্ষা এলে বীজ বুনি, তখন হোরিয়ালি করি আমরা।

ঋজুদা বলল, শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব দেখিসনি তুই? সেইরকমই আর কি?

ও বুঝেছি। বিজ্ঞের মতো বললাম, আমি।

ঋজুদা বলল, হোরিয়ালি সম্বন্ধে কী বলছিলেন?

বলছিলাম, এ বছর হোরিয়ালিও হবে না। চাষবাসও হবে না। মানুষগুলো সব না খেয়ে মরবে। এমনিতেই তো আধপেটা খেয়ে থাকে। গভর্নমেন্টের কয়লা খাদান সিঙ্গরাউলি হয়েছিল এবং সেখানকার সাহেবরা খুব দয়ালু বলেই অনেক মেয়েমরদ সেখানে কাজ পেয়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু প্রত্যেক গ্রামীণ মানুষেরই একটি নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। ধর্ম-কর্ম, নাচ-গান, ক্ষেতি-জমিন, গ্রামীণ আনন্দ উৎসব, রামায়ণ মহাভারত নিয়ে এই স্বল্পে সুখী জীবনে যারা অভ্যস্ত যুগের পর যুগ, তাদের পক্ষে কয়লা খাদানের কুলিকামিন হয়ে কয়লা মাখা ভূত-পেতিন হয়ে বেঁচে থাকতে কি ভাল লাগে সাহেব? বেশি টাকা রোজগার অবশ্যই করে। কিন্তু নিজেদের শিকড় উপড়ে গেলে বুকের মধ্যেটা হু-হু করে না কি? এই এক শালা বাঘ এতগুলো গ্রামের মানুষজনের জীবনযাত্রাই উলট-পালট করে দিল কিছু দিনের মধ্যে। আপনারা যদি একে মেরে দিয়ে যান সাহেব তবে এই পুরো তল্লাটের মরদ-আওরাত আপনাদের গোলাম হয়ে থাকবে চিরদিন। এই বাঘকে মারার সব তরিকাই এ পর্যন্ত ফেল করেছে। কেউই তো পারল না। এখন আপনারা যদি পারেন।

ঋজুদা পাইপের পোড়া-টোবাকো খুঁচিয়ে ফেলতে ফেলতে বাংলোর বাইরে লাল মাটির পথের দিকে চেয়ে অন্যমনস্ক গলাতে বলল, এ তো বড় আশ্চর্যের কথা। এইসব জঙ্গল পাহাড়ের শিকারিরা তো আমাদের কানে ধরে শিকার শিখিয়ে দিতে পারেন! তারাই যখন পারলেন না তখন কী করতে পারব আমরা, ভগবানই জানেন।

সব চেষ্টাই হয়েছে বোস সাহেব। মানুষের শব বা মড়ির মধ্যে ঊরুর ও পেটের মাংস কেটে নিয়ে তাতে ফলিডল পুরে দেওয়া হয়েছে। জয়ন্ত’-এর নতুন হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরও শিকারের শখ ছিল। সাভারকার সাহাব, মানে সার্জন সাহাব, তিনি পোটাসিয়াম সাইনাইড না কি, তাও মড়ির মধ্যে দিয়ে দেখেছিলেন। নিজে জিপ গাড়িটি মড়ির কাছে রেখে সারারাত রাইফেল হাতে বসেছিলেন। কিন্তু বাঘ কখন যে চুপিসাড়ে এসে পটাকসে সেই পটাসিয়াম সায়নাইড শুদ্ধ মড়ি টেনে নিয়ে গিয়ে সাবড়ে দিল তা সার্জন সাহেব বুঝতে ভি পারলেন না। তার সঙ্গে জয়ন্ত হাসপাতালেরই আরও দু’জন শিকারি সাহাব ভি ছিলেন।

ঋজুদা চিন্তান্বিত গলাতে বলল, হুঁ-উ-উ।

এমন সময়ে দূরে দেখা গেল সিঙ্গরাউলির দিক থেকে একটি মোটরকেড আসছে এদিকে। কাল বৃষ্টি হওয়াতে যে পরিমাণ ধুলো ওড়ার কথা ছিল চার পাঁচটি গাড়ি ও জিপের চাকাতে, তা উড়ছে না। দুটি গাড়ির মাথাতে লাল আলো।

সাহেবরা এসে ঋজুদাকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন এখানে আসবার জন্য। মারা’ বনবাংলোতে থাকতে আমাদের যে খুবই কষ্ট হচ্ছে, এখানে খাওয়া-দাওয়াও একেবারে দেহাতি, এয়ারকন্ডিশনার নেই, এই সবকিছুর জন্যেই ক্ষমা চাইলেন বার বার করে ওঁরা। আমাদের জন্যে নানারকম টিনের খাবার ‘কেলগ’-এর নানারকম স্যুপ, সিরিয়ালস, টিনের মাছ, টিনের আনারস ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। বাংলোর বাগানের গাছ থেকে পাড়া বড় বড় পেঁপে, টাটকা মাছ, ঝুড়ি-ভরা কঁক-কঁক করা মুরগি, নানা তরকারি ইত্যাদি।

ঋজুদা বলল, মানুষ তো জামাই-এর জন্যেও এত করে না সেন সাহেব। কিন্তু যে কর্মে এখানে আমাদের আসা, তাতে খাওয়ার অবকাশই যে নেই! খিচুড়িই আমাদের জন্যে যথেষ্ট।– তারপরে বলল, এবারে বলুন তো, আমি যে লিস্টটা দিয়ে এসেছিলাম আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারির কাছে, সেই জিনিসগুলো এসেছে কি না?

দাস সাহেব বললেন, হ্যাঁ। হ্যাঁ। সব এসেছে।

সেই লিস্ট এর মধ্যে ছিল দুটি পেট্রোম্যাক্স আলো, দু’জেরিক্যান পেট্রল, খুব লম্বা দুটি সরু কিন্তু শক্ত নাইলনের দড়ি, দু’ডজন ব্যাটারি–এভারেডি রেড। দু’শিশি কার্বলিক অ্যাসিড। এবং একটি জিপ।

সেন সাহেব বললেন, ঋজুদাকে, এই এয়ারকন্ডিশনড গাড়ি আর এই ড্রাইভার রইল আপনার জিম্মাতে। বলেই ডাকলেন, বাবুলাল।

একজন স্মার্ট প্রৌঢ় উর্দিপরা ড্রাইভার গাড়ির পেছনে মাটিতে দাঁড়িয়েছিল। সে এসে সেলাম করল।

সেন সাহেব বললেন, এর নাম বাবুলাল পাসোয়ান। বিহারের নওয়াদাতে বাড়ি এর। খুব ভাল ড্রাইভার।

ঋজুদা বলল, এই গাড়িতে আমাদের চলবে না। আজ তো আর হবে না, কাল সকাল সকাল একটি নন এসি, মাহিন্দ্র-জিপ, চারদিক ভোলা হলে আরও ভাল হয়, আমাদের জন্যে পাঠিয়ে দেবেন। আর ড্রাইভারকে আমরা রাখব না। যেখানে নিজেদের জীবনের জিম্মাদারি নেওয়াই কঠিন কাজ সেখানে অন্য কারও জীবনের দায়িত্ব না-নেওয়াই ভাল।

তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, এই আমার সঙ্গী রুদ্র রায়। এর লেখা হয়তো আপনারা পড়েছেন। এই তো লিখে লিখে আমাকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। তা রুদ্র শিকারি তো আমার চেয়েও ভাল। বহুবার, শুধু এ দেশেই না, আফ্রিকাতেও আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। জিপটাও ও আমার চেয়েও ভাল চালায়। জিপ দিলেই হবে। আমরাই চালিয়ে নেব। তবে ট্যাঙ্ক ফুল করে পাঠাবেন। এবং পেট্রলের জিপ। পরশু রাতে সুরাবলী সিং সাহেবের জিপে করে ঘুরেছিলাম। ডিজেলের জিপ। ডিজেলের জিপ ধাড়ি শুয়োরের মতো ধড়ফড় আওয়াজ করে। শিকারে, পেট্রোলের জিপই ভাল হবে।

সেন সাহেব বললেন, অ্যাজ উ লাইক ইট। নর্দার্ন কোলফিল্ডস ক্যান অ্যাকর্ড টু ডু আ লট অফ থিংগস ফর ইও। পাবলিক সেকটর কোম্পানি বলেই ভাববেন না যে আমরা লুজিংকনসার্ন। এ বছরে তো ইনকামই হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ তবু ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট এমন ভাব করে আমাদের সঙ্গে যেন আমরা মোমফুলিওয়ালা।

সুরাবলী সিং সাহেব নর্দার্ন কোলফিন্ডস-এর সঙ্গেই যুক্ত এখন। কয়লা খাদানের জন্যে উপরের মাটি সরিয়ে ওপেনকাস্ট মাইনিং করে কয়লা বের করতে হয়। খাদানের জন্যে হাজার হাজার একর জঙ্গল কেটে ফেলতে হয়। সরকার নিয়ম করেছেন যত গাছ কাটা হবে তার অনেকগুণ বেশি গাছ লাগাতে হবে। এই বনসৃজনের ব্যাপারে সঠিক পরামর্শ যাতে পান নর্দার্ন কোলফিল্ডস সে জন্যে বনবিভাগ একজন রেঞ্জারকে খাদানেই পোস্টিং করে দিয়েছেন। অবশ্য। উপরওয়ালারাও দেখভাল করেন।

ফিন্যান্স ডিরেক্টর দাস সাহেব ঋজুদাকে ব্যাখ্যা করে বললেন।

সুরাবলী সিং, ভাইয়ালাল, শম্ভুপ্রসাদ সবাই মিলে রেনকুটের ড্যাম থেকে আনা বড় লাল রুই মাছ ফটাফট কেটে বড় বড় পিস করে কড়া করে ভেজে চিলি সস দিয়ে সেন সাহেব ও দাস সাহেবকে দিলেন। সঙ্গে ওঁদেরই আনা নেসকাফের টিন এবং ব্রিটানিয়ার তরল দুধের প্যাকেট খুলে কফি বানিয়ে দিলেন।

ভাইয়ালাল বললেন, কী দুঃখের কথা হুজৌর, এই মারার দুধ বিখ্যাত। আর এই মানুষখেকো বাঘটার জন্যে জঙ্গলের মধ্যে যে বাথান-টাথান ছিল সব চৌপাট হয়ে গেছে। আপনাদের ব্রিটানিয়া কোম্পানির দুধ খেতে হচ্ছে।

ঋজুদা বলল, ব্রিটানিয়া কোম্পানির দুধ খারাপ কীসে? ওদের নানারকম চিজ, নানারকম বিস্কিট আমার তো খুবই ভাল লাগে। ছেলেবেলাতে খেয়েছি, বিলেত থেকে আসত হান্টলি পামার কোম্পানির বিস্কিট। কোয়ালিটি প্রায় সেরকমই করেছে ব্রিটানিয়া।

আমি বললাম, তখন বুঝি দেশে বিস্কিট তৈরি হত না?

ঋজুদা বলল, হত। তবে লিলি বিস্কুট। লিলি বিস্কুট খারাপ ছিল না খেতে। আমার কিন্তু পুরো দিশি বিস্কিট–শুকনো লঙ্কা দেওয়া, ছোট ছোট চারকোনা চারকোনা শক্ত হঁটের মতো, কামড়াতে গেলে কটরকটর করে লাগত দাতে– খুব ঝাল-খুব ভাল লাগত।

সবসুদ্ধ আধঘণ্টাখানেক থেকে ওঁরা সবাই চলে গেলেন। কথা দিয়ে গেলেন যে, সকালে আটটার মধ্যে জিপ এবং ঋজুদার আরও অন্যান্য সব রিকুইজিশান ওঁরা পাঠিয়ে দেবেন। সেগুলো কী, তা আমি জানি না। লিস্ট ঋজুদাই বানিয়েছিল।

ঋজুদা বলল, আমাদের প্লেনের টিকিট দিয়ে একটি গাড়ি পাঠাবেন রবিবার ভোরে। রবিবারে ফিরতেই হবে। এ কদিনের মধ্যে কি পারব বাঘের মোকাবিলা করতে?

সিঙ্গরাউলি গেস্ট হাউসে লাঞ্চ করে যাবেন তো ফেরার সময়ে?

সেন সাহেব বললেন।

প্লিজ। ওসব ঝামেলা একদম করবেন না। আমরা সোজা এখান থেকে বেরিয়ে যাব।

ঋজুদা বলল।

যা বলেন। এয়ারকন্ডিশনড টাটা সাফারি পাঠিয়ে দেব আপনাদের জন্যে, যাতে কষ্ট না হয়। উইশ ঊ্য অল দ্য লাক মিস্টার বোস।

সেন সাহেব বললেন।

দাস সাহেব বললেন, গুড হান্টিং।

ঋজুদা ও আমি ওঁদের গাড়ি অবধি এগিয়ে দিলাম। ওঁদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম। বললাম, থ্যাঙ্ক ঊ্য ভেরি মাচ।

ওঁরা সকলে চলে গেলে ঋজুদা সুরাবলী সিংকে জিজ্ঞেস করল হুজুরু পাহাড়টা এখান থেকে কত দূরে?

আমি ঠিক বলতে পারব না। আপনি বরং ভাইয়ালালকে শুধোন।

সাহেবরা চলে যাবার পরে ভাইয়ালাল ও শম্ভুপ্রসাদ একটু জম্পেশ করে চা খাচ্ছিলেন বাবুর্চিখানাতে গিয়ে। সুরাবলী সিং সাহেব তাদের চেঁচিয়ে ডাকলেন, বললেন, হিয়া ক্যা খানেপিনেকি লিয়েই আয়া হ্যায় আপলোগোঁনে?

ঋজুদা ওঁদের মুখ রক্ষার জন্যে বলল, বেগর খানা আদমি জিয়েগা কৈসে? অজীব বাঁতে করতে হ্যায় আপ সিং সাহেব।

ভাইয়ালাল ও শম্ভুপ্রসাদ এসে বারান্দাতে দাঁড়ালে ঋজুদা শুধোল, হুজুরু পাহাড় এখান থেকে কতদূরে? আর এমন কাউকে আমাদের সামনে হাজির করতে পারেন কি যে সেদিন হুজুর পাহাড়ে ছুলোয়ার সময়ে সেখানে ছিল এবং যে ওই ভুলভুলাইয়া গুহাটা আমাদের দেখিয়ে দিতে পারবে?

ভাইয়ালাল একটু ভেবে বললেন, যে ছুলোয়য়ালাকে সেদিন বাঘে ধরে নিয়ে গেছিল গুহার পেছন দিক থেকে, তার ছেলে সম্ভবত একটু পরেই হাটে আসবে বিক্রির সামগ্রী সব নিয়ে। এলেই ওকে ধরব। ও ছিল সেদিন ছুলোয়াতে।

শম্ভুপ্রসাদ বললেন।

কী বিক্রি করতে আসবে ও?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ওরা রায়শোয়ার। ওদের ধড়কারও বলে।

কী জীবিকা ওদের? চাষবাস করে?

তাও করে না যে তা নয়। তবে ওরা খুবই গরিব। জমি-জমা থাকেই না বলতে গেলে। বাঁশের টুকরি, ধামা ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করে ওরা।

ঋজুদা বলল, ছেলেটার বয়স কত?

এই পনেরো-ষোলো হবে। খুবই সাহসী ছেলে। ওর নাম প্রেমলাল।

হাটে কতটাকার জিনিস বিক্রি করবে ও আন্দাজ? মানে, রোজগার কত হবে?

কত টাকার আর। এখন তো ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোর জন্যে হাট লাগেও দেরি করে, উঠেও যায় তাড়াতাড়ি। লোকজনও খুব কমই আসে। তাই পনেরো বিশ টাকার বিক্রি হলেও অনেক বিক্রি হবে।

ঋজুদা বলল, ও হাটে এলেই ওকে ডেকে পাঠাবেন। ওকে নিয়ে হুজুরু পাহাড়ে যাব। ও যেতে রাজি হবে? ভয় পাবে না তো?

ভয়-ডর ও ছেলের নেই। ও একাই ওর পিতৃহন্তা বাঘকে মারার জন্যে বিষের তীর আর ধনুক নিয়ে বাঘের চলাচলের পথে উজলা রাতে গাছে বসে থাকে। কোনদিন যে ও ওর বাবারই মতো বাঘের পেটে যাবে তা শংকর ভগবানই জানেন।

তাই? বাঃ। তাহলে আমরা এখানে আসামাত্রই ওই ছেলের সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দেননি কেন? যখন এ তল্লাটের সব মেয়ে-মরদের হাত-পা বাঘের ভয়ে পেটে সেঁধিয়ে যাচ্ছে তখন অতটুকু ছেলের এমন সাহস তো অবশ্যই প্রশংসার।

সুরাবলী সিং সাহেব দার্শনিকের মতো বললেন, খ্যয়ের ইস দুনিয়ামে সবহি কিসিম কি ইনসান হোতা হ্যায়। ডরপোক ভি হোতে হেঁ ওর বাহাদুর ভি হোতে হেঁ৷

সুরাবলী সিং সাহেব ফরেস্ট গার্ডকে পাঠালেন হাটে বলে আসতে যে, প্রেমলাল এলেই এখানে পাঠাতে।

আমি ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলাম আজই কি যাবে হুজুরু পাহাড়ে?

হ্যাঁ। আজই যাব। স্কাউটিং করতে। আজ ফিরে এসে রাতে ঘুমোব। তারপর বাকি বাহাত্তর ঘণ্টা ঘুম নেই। দিন-রাত ঘুরব ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোর খোঁজে। এত মানুষে এতদিন রাতে ঘুমোতে পারে না, হাটে আসতে পারে না, গান গাইতে পারে না, আমরা না হয় তাদের স্বার্থে তিন রাত্তির নাই ঘুমোলাম।

আমি বললাম, তুমি যেমন বলবে।

সুরাবলী সিং এবং অন্যদেরও অবাক করে দিয়ে ঋজুদা বলল, আমি আর রুদ্র একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি। বেলা আড়াইটে নাগাদ আমাদের তুলে দেবেন। মাছের ঝোল ভাত খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। প্রেমলালকে বলবেন যে, আমরা যে-কদিন এখানে আছি ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে। মজুরি হিসেবে ওকে দিনে একশো টাকা করে দেব আমি। আর খাবে-দাবেও আমাদেরই সঙ্গে।

সিং সাব বললেন, কিন্তু ও যে ছোট জাত।

ঋজুদা বলল, আমি তো শখ করে বোস লিখি। আসলে আমি মুসলমান। আমার আসল নাম বাহারুদ্দিন বসির।

সিং সাহেব এমন করে তাকালেন ঋজুদার দিকে যেন সাংঘাতিক পাপ করেছে। ঋজুদা পরিচয় গোপন করে। কিন্তু কিছু বলতেও পারলেন না নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর বড় সাহেবরা যখন ওঁকে এত খাতির করছেন। কী করেই বা বলেন।

এখানে দু’জনের দুটি ঘর জোটেনি আমাদের। বাঘের ভয়ে বাইরে কেউই শোয় না। নইলে এই মে মাসের শেষে সকলেই তাই বারান্দায় বা উঠোনে চৌপাই লাগিয়েই শুত হয়তো। এখন এত লোক সব গাদাগাদি করে একটি ঘরে রাত কাটায়। জানালার শিক আবার কাঠের। তাই ভরসা করে জানালা খুলেও শুতে পারে না কারণ বাঘ ইচ্ছে করলেই এক থাবড়াতে কাঠের শিক ভেঙে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসতে পারে। এই অসহ্য গরমে সব জানালা-দরজা বন্ধ করে এতজন মানুষে কী করে রাত কাটাচ্ছে কে জানে! তার চেয়ে বাঘের হাতে মরাও ভাল ছিল। তবে কাল বৃষ্টিটা হওয়াতে আজ অনেক ঠাণ্ডা হয়েছে।

ঘরে যেতে যেতে ঋজুদা বলল, রেনুসাগরের রুই মাছের চেহারাটা দেখলি? আহা! যেন ব্রহ্মপুত্রের মহাশোল মাছ। এমন মাছের তেল ভাজা, মুড়িঘণ্ট আর দই-মাছ গদাধরদা যা রাঁধত না। এরা মাছ কাটতেই জানে না। তা ছাড়া, এমন করে রাঁধবে, দেখবি মুখেই দেওয়া যাচ্ছে না।

আমি বললাম, আহা গদাধরদার কথা মনে করিয়ে দিও না। মাথা দিয়ে টকটা কেমন রাঁধত বলো তো?

হুঁ।

ঋজুদা বলল।

তারপর ঘরের দরজা লাগানোর আগে সিং সাহেবকে বলল, বারান্দাতে গোলমাল একটু কম করতে বলবেন আর টেবিলে খাবার লাগিয়ে ঠিক আড়াইটে, না, দুটোতেই আমাদের ডেকে দেবেন সিং সাহেব।

রাইট স্যার।

চান, আমরা দু’জনেই সকালে এসেই করে নিয়েছিলাম। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেই ছিলাম। শুতে না শুতেই ঋজুদা নাক ডেকে ঘুমোতে লাগল। বড় মানুষদের এই লক্ষণ। ইচ্ছে-ঘুম এঁদের। সবসময়েই এঁরা নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করে নিচ্ছেন যাতে জীবনীশক্তির প্রতিটি বিন্দু কাজে লাগাতে পারেন।

হঠাৎ নাকডাকা থামিয়ে ঋজুদা বলল, দুপুরের খাওয়ার পরে যখন বেরোব তখন তুই তোর রাইফেলটা নিস না, গ্রিনার বন্দুকটা নিস, বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের। আর দু’ব্যারেলই এল. জি. রাখবি। আর আমি নেব পয়েন্ট ফোরফিফটি-ফোরহান্ড্রেড ডাবল ব্যারেল রাইফেলটা। দ্যাখ, কপালে থাকলে আজই বাঘবাবাজিকে তার স্বভূমেই পটকে দিয়ে আসব আমরা। একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। বুঝেছিস, রুদ্র। এতগুলো গরিব অসহায় নিরপরাধ মানুষ আমাদের মুখ চেয়ে আছে। এই বাঘটাকে এই বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের মারতে হবে।

কাল রাতেই তো কম্মো ফতে হয়ে যেত যদি না তোমার জন্যে আমার প্রেম উথলে উঠত।

ঋজুদা হেসে ফেলল।

আমি বললাম, বাঘটা খুব লজ্জা পেয়েছে কিন্তু।

কেন? কেন?

ঋজুদা বলল।

তুমি যা জোরে বলেছিলে ইডিয়ট! ও তো আর জানে না যে তুমি আমাকে বলছ। এই বাঘকে অনেক গালাগালি অনেক গুলির নৈবেদ্য অনেকেই দিয়েছে। আজ অবধি, কিন্তু ইডিয়ট বলে গাল পাড়েনি এর আগে নিশ্চয়ই কেউ। তার ওপর আবার ইংরেজি শব্দ। বাঘ তো আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র নয় যে ইডিয়ট শব্দের মানে বুঝবে।

অনেক হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে নে একটু।

ঋজুদা কথাকটি বলেই নাক ডাকাতে লাগল, ফরাসি দেশের জগৎবিখ্যাত পরমবীর নৃপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্টে যেমন ঘোড়ার পিঠে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়তে পারতেন।

ভাবছিলাম বড় বড় মানুষদের মধ্যে কত মিল। সত্যি! যখনই ইচ্ছে হবে তখনই একটু ঘুমিয়ে নিতে পারা, ট্রামে, বাসে, গাড়িতে, প্লেনে এবং ঘোড়ার পিঠেও, এক ধরনের যোগাভ্যাস। খুব বড় মাপের সাধক না হলে এমনটি করা কারওর পক্ষেই সম্ভব নয়।

.

০৩.

ঠিক দুটোর সময়েই ওঁরা আমাদের দরজা ধাক্কা দিয়ে তুলে দিয়েছিলেন। খাবারও তৈরি ছিল। খাবার তো নয়, যেন ফাঁসির আসামীর খাওয়া। এতরকম পদ রাক্ষসের পক্ষেও খাওয়া সম্ভব নয়, তাও যদি বা মনোমত রান্না হত। তা ছাড়া, তখন খাওয়ার দিকে মন ছিল না আমাদের আদৌ।

বারান্দায় সেই রায়শোয়ার ছেলেটি, যার বাবাকে হুজুরু পাহাড়ে বাঘ ধরে নিয়ে গেছিল, এবং যার নাম প্রেমলাল, দাঁড়িয়েছিল। চেহারা তো নয়, যেন কেষ্ট ঠাকুরটি। প্রথম দর্শনেই তাকে আমাদের খুব ভাল লেগে গেল। সে খেয়ে এসেছে বলা সত্ত্বেও ঋজুদা তাকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে খাবার ঘরের টেবলে আমার আর ঋজুদার মধ্যে খেতে বসাল। তাতে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণরা বেশ ক্ষুণ্ণ হলেন। এসব ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে দেশভাগের পরে অনেকটা দায়ে ঠেকেও, বিহার ওড়িশা উত্তরপ্রদেশ বা আসামের চেয়ে অনেকই ভাল। মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’ সত্যিই রবীন্দ্রনাথের এই ভবিষ্যদ্বাণী বঙ্গভূমিতে সফল হয়েছে। অন্য অনেক রাজ্য ঠেকে শেখেনি বলেই হয়তো এখনও তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি এ বাবদে।

প্রেমলালকে একটা ভাল টাঙ্গি দিতে বলল ঋজুদা। তারপর ড্রাইভারকে বাংলোতে থাকতে বলে, প্রেমলালকে অ্যামবাসাডার গাড়িটার পেছনে বসিয়ে আমি স্টিয়ারিং-এ বসলাম। আর ঋজুদা ঘর থেকে আমার টুয়েলভ বোর-এর গ্রিনার বন্দুকটা আর নিজের ফোরফিফটি-ফোরহান্ড্রেড ডাল ব্যারেল রাইফেলটা নিয়ে আমার পাশে এসে বসল সামনের সিটে। সুরাবলী সিং সাহেব এবং ভাইয়ালালও এসে উঠছিল গাড়িতে কিন্তু ঋজুদা ওঁদের আসতে মানা করল। কিন্তু ওঁদের পাঁচ ব্যাটারির টর্চ দুটো চেয়ে নিল।

আমি এঞ্জিন স্টার্ট করলে, ঋজুদা বলল, রাত দশ বাজিতক হামলোগোনে জরুর লওটকে আবেগা। নেহি আনেসে, আপলোগ খানা খা লিজিয়েগা, ইন্তেজারি মে মত রহিয়েগা সিংজি। ঔর জরা সামালকে রহিয়েগা। আজ তো হাটিয়া না হ্যায়, বাঘোয়া ইসতরফ আ ভি শকতা।

বাংলোর হাতাটা খুবই ছোট। সচরাচর বনবাংলোর যতখানি হাতা থাকে ততখানি জায়গা আদৌ নেই এখানে। কেয়ারি করা ফুলের বাগান আছে, তাও এই প্রখর গ্রীষ্মে তার বাহার নেই। বড় গাছ নেই বললেই চলে।

গেট থেকে বেরিয়ে বিন্দুল-এর পথে আমরা যখন বাঁদিকে ঘুরলাম তখন ঘড়িতে দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ। হাট পুরো জমে গেছে। মোরগা-লড়াই, বকরির ব্যাঁ-ব্যাঁ আওয়াজ, গোরুর গাড়ির বলদের হাম্বা-আ আর হাটে-আসা মেয়ে-মরদের গলার নানা গ্রামের ওঠা-নামা করা কলস্বর মহড়া না-দেওয়া শিল্পীদের বিভিন্ন স্কেলে গাওয়া সমবেত কণ্ঠের সংগীত বলে মনে হচ্ছে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শব্দের জগতকে পিছনে ফেলে আমরা নৈঃশব্দ্যের জগতে ঢুকে পড়লাম। প্রেমলালকে বলাই ছিল যে, হুজুরু পাহাড়ের পথ চিনিয়ে সে নিয়ে যাবে আমাদের।

এই দুপুরবেলাতেই যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা বনে। ঝিঙ্গাঝিরিয়া নালা পেরিয়ে গেলাম আমরা। জল এখন নেইই বলতে গেলে। লাল মাটির পথের দু’পাশে গভীর জঙ্গল। যদিও পাতা নেই অধিকাংশ গাছে। আবার বহু গাছে আছেও। আমাদের দেশের সমতলের বন পর্ণমোচী হলেও সবরকম গাছের পাতাই একই সঙ্গে ঝরে না। তাই, সারা বছরই বনের রূপ দেখার মতো থাকে, বিশেষত হরজাই জঙ্গলে, যেখানে অনেকরকম গাছ-গাছালি একই সঙ্গে অবস্থান করে। চিরসবুজ গাছ সমতলে তো বিশেষ দেখা যায় না!

সুন্দরী মেয়ার নদী আমাদের বাঁদিকে পথ বরাবর বয়ে চলেছে। প্রত্যেক নদীর রূপই আলাদা আলাদা। কারও সঙ্গেই কারও মিল নেই। প্রত্যেক নদীর গায়ের গন্ধও আলাদা। যাদের নাক আছে, তারাই এ কথা জানে। তবে এ কথা সত্যি যে, চোখ-নাক-কান এ সবেরই ব্যবহার শিখেছি আমি ঋজুদার কাছে। ড্যাবা-ড্যাবা চোখ, গাধার মতো বড় বড় কান এবং ইন্দিরা গান্ধীর মতো নাক থাকলেই যে তিনি সবই দেখতে বা শুনতে বা শুঁকতে পাবেন এমন কোনও কথা নেই। সমস্ত ইন্দ্রিয়কেই ধার দিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়াতে শিখতে হয়। গুরুর মতো গুরু পেয়েছিলাম, তাই আমার কথা আলাদা। খুবই ভাগ্যবান আমি।

একদল ময়ূর সামনে দিয়ে পথ পেরোল। পথ পেরিয়েই ভারী ভারী নীলচে চিকন ডানায় দুপুরের লালরঙা রোদকে চারিয়ে দিয়ে পেঁয়া কেঁয়া কেঁয়া করে ডাকতে ডাকতে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভারী শরীর নিয়ে গাছে উঠে পড়ল। অল্পবয়সি, শাড়ি-পরতে অনভ্যস্ত মেয়েরা যেমন মায়েদের শাড়ি পরে হিমসিম খায়, ময়ূরেরাও তাদের মস্ত মস্ত লেজগুলো নিয়ে চলাফেরার সময়ে তেমনই হিমসিম খাচ্ছিল।

এই পথটা কোথায় গেছে প্রেমলাল?

আমি শুধোলাম।

বিন্দুল।

তারপরই ও ডানদিকে হাত তুলে দেখাল ও বলল, ডানদিকে একটু ভিতরে গেলেই রাবণমারা গুম্ফা। ছোট টিলার উপরে অতিকায় কালো পাথরে খোদাই করা। এখানে ষোলোভুজা দুর্গা মায়ের মূর্তি আছে। প্রণাম করে যাবেন সাহেব? ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘের ডেরাতে যাচ্ছেন।

তোমার বাবাকে যেদিন হুজুরু পাহাড়ে বাঘে ধরে সেদিনও তো প্রণাম করে গেছিলে তোমরা যাবার সময়ে। যাওনি?

না সাহেব। প্রণাম করে যাইনি বলেই তো অঘটনটা ঘটল।

তাই?

তারপর ঋজুদা বলল, কালকে আবার আসব প্রেমলাল। তখন প্রণাম কোরো তুমি। রুদ্রও করবে। আমি আকাশ বাতাস জঙ্গল সমুদ্রকে পুজো করি, মন্দিরের দেবদেবীকে করি না, কোনওদিনও করিনি। তাবলে এমন ভেবো না যে, যারা করে, তাদের আমি বাধা দিই কখনওই। এসব নিজের নিজের বিশ্বাস, ভালোলাগার ব্যাপার!

প্রেমলাল বলল, ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘের ডেরা হুজুরু পাহাড়ে যাচ্ছি, পুজো দিয়ে গেলে ভাল হত সাহেব।

ছাড়ো তো প্রেমলাল। কালকেই হবে।

ঋজুদা বলল।

যা বলবেন সাহেব।

বলল, প্রেমলাল।

আমি বুঝলাম যে, ও অখুশি হল।

আরও মিনিট দশেক গাড়ি চালিয়ে যাবার পরে প্রেমলাল বলল গাড়িটা এখানে রাখতে হবে। আর যাবেনা। জিপ হলে আরও কিছুটা যেত। এবারে বাঁদিকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে।

আমরা কথাবার্তা আস্তে আস্তেই বলছিলাম।

আমি বললাম, কতদূর?

খুব বেশি নয়। কাছেই।

প্রেমলালের গলাতে জলের বোতল দুটো আড়াআড়িভাবে ঝুলিয়ে দিয়ে টর্চ দুটোও ওরই জিম্মাতে দিয়ে যার যার বন্দুক রাইফেল লোড করে গাড়ি থেকে নামলাম আমরা। লক্ষ করলাম যে, প্রেমলালের মুখে কোনও ভাবান্তর ঘটল না। যখন এ তল্লাটের মানুষে এই পথকেই বলতে গেলে ত্যাগ করেছে তখন দু’জন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সে এক হাতে টাঙ্গি, অন্য হাতে দুটি টর্চ এবং গলাতে জলের বোতলের মালা নিয়ে পায়ে হেঁটে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোর ডেরা হুজুর পাহাড়ের দিকে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে একটুও ভয় পেল না। যার আর্ত-চিৎকার করা বাবাকে তার চোখের সামনেই এই বাঘ কোমরে কামড়ে ধরে জ্যান্ত অবস্থাতে নিয়ে গেছে, সেই বাঘের সঙ্গে এই পনেরো বছরের অসীম সাহসী ছেলেটির যেন কিছু বোঝাঁপড়া ছিল। ওর যদি একটা ভাল বন্দুক বা রাইফেল থাকত আর ও যদি তা চালাতে জানত তবে ও নিজেই হয়তো মেরে দিত তার পিতৃহন্তাকে। কারণ আমরা দু’পাতা ইংরেজি পড়লেও, বনজঙ্গলের খবর ও বনজঙ্গলকে ও আমাদের চেয়ে অনেকই ভাল জানে। আমাদের দেশে আজও যাদের যা-কিছুরই প্রয়োজন তীব্র, তার কোনও কিছুতেই হাত দেওয়ার সামর্থ্য দেশের সেই সাধারণ মানুষদের নেই। কবে যে হবে, তাও অজানা। দুঃখ হয়।

এদিকটাতে শালই বেশি, প্রাচীন মহুয়া ও জংলি আমও আছে কিছু। একটু এগিয়েই হুজুরু পাহাড়টাকে দেখা গেল। কালো পাথরের পাহাড়। ঘন জঙ্গলাবৃত। অনেক গুহা আছে উপরে নীচে। পাহাড়ের গায়ে যে সব গাছ আছে, তাদের অধিকাংশরই পাতা ঝরেনি। গরমে তাদের পাতা ঝরে না, শরতে বা হেমন্তে বা শীতে ঝরে। তাই পাহাড়টা এই আদিগন্ত ঝলসে-যাওয়া পটভূমিতে একটা ছায়াঘেরা মরূদ্যানের মতো। দুপুরের উথাল-পাতাল হাওয়ায় গাছেদের হাজার হাত যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

মৃত্যুই ডাকছে কি?

প্রেমলালই গাড়িতে আসতে আসতে বলছিল যে, রবার্টসগঞ্জের কোনও এক পাগলা সাহেব নাকি এখানে একটা বাংলো করে থাকবেন বলে প্রতি বর্ষায় মুঘলসরাই মির্জাপুর বানারস ইলাহাবাদ এসব জায়গা থেকে নানা গাছের বীজ ও চারা এনে এখানে পুঁতে দিতেন। কুড়ি বছর পুঁতেছিলেন। গাছগুলো সব বড়ও হয়ে গেল কিন্তু রিগান সাহেব রিটায়ার করার এক বছর আগে নিজেই কালাজ্বরে মারা গেলেন। গাছ রইল, পাহাড় রইল, সাহেবের স্বপ্ন রইল ঠিকঠাক কিন্তু সাহেবই রইল না। এসব গল্প প্রেমলাল তার বাবার কাছে শুনেছে। সাহেবদের মধ্যে তবু অনেক সুন্দর পাগলা দেখা যেত, আমাদের মধ্যে পাগল কেউই নেই, সবাই সেয়ানা, সবাই শুধু নিজের লাভটুকুই বোঝে। এই গুহাগুলোকে অক্ষত রেখে তাদের ব্যবহার করে এক দারুণ জঙ্গলের বাড়ি করতে চেয়েছিলেন সাহেব। এই গুহাগুলোর মধ্যে নাকি একটা ঝর্নাও আছে। অল্প হলেও, সারা বছর জল থাকে তাতে। সে কারণে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো এখানে আস্তানা গাড়ার অনেকদিন আগে থেকেই এই হুজুর পাহাড় বড় বাঘ ও বড় বড় ভাল্লুকের প্রিয় জায়গা ছিল। নানা জাতের সাপও আছে এখানে অসংখ্য।

প্রেমলালের কথা শুনে বোঝা গেল সুখমন্তির কাছে আসার আগে বাঘ কেন সামনের জলাটাতে জল খেতে আসেনি কাল রাতে।

সাপের কথাতে কালকের সাপটার কথাও মনে পড়ে গেল আমার। ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাল যে সাপটা জল খেয়ে গেল, কী সাপ ছিল সেটা ঋজুদা? বাবাঃ প্রায় ষোলো ফিট লম্বা হবে। আর কী জেল্লা তার!

ষোলো ফিট কেন, তারা আঠারো ফিটও হয়। কী সাপ চিনতে পারলি না? সাপদের মধ্যে কুলীন। শঙ্খচুড়। যার কামড়ে প্রাপ্তবয়স্ক হাতিও শুয়ে পড়ে। হাতির শরীরের মধ্যে আর কোথায় বাঁধন দেবে লোকে, এই তো কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়ার পিলখানার মধ্যে একটা হাতির গুঁড়ে শঙ্খচুড় ছোবল মারতে হাতিটা চার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে মরে যায়।

ও তাই বুঝি মধ্যপ্রদেশের বনে হাতি থাকে না।

আমি বললাম।

ঋজুদা হেসে ফেলল।

বলল, নাঃ। তুই সত্যিই দিনকে দিন একটা ক্লাস-ওয়ান-গ্রেড-ওয়ান ইডিয়ট হয়ে উঠছিস। ভটকাইটা সঙ্গে না এলে তোর বুদ্ধিতে ধার দেওয়ার কেউ থাকে না তো। তাই তোর এই অবস্থা। মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল ছাড়া অন্য অনেক রাজ্যের জঙ্গলেই তো আছে শঙ্খচূড় সাপ। তবে? সে সব জায়গাতে হাতি থাকে কী করে। তবে এটা ঠিক যে, মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে হাতি নেই অথচ বিন্ধ্য, মাইকাল, সাতপুরা এই তিন পর্বতশ্রেণী আছে এখানে। তবু হাতি কেন থাকে না তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। হয়তো করবেনও কখনও কেউ।

আমি প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললাম, আমরা যে কথা বলছি পাহাড়ের কাছে এসে, তা কি ভাল হচ্ছে?

হচ্ছে। আরও জোরে জোরে কথা বল। এ বাঘ তো মানুষকে ভয় পায় না। এ শিকারি-খেকো বাঘ। আমরা যে এসেছি তার সঙ্গে টকরাতে তা তাকে জানানো দরকার। এ বাঘকে মারা কিন্তু সত্যিই কঠিন নয়, যদি না সে আমাকে বা তোকে আগেই মেরে দেয়। যাই বলিস আর তাই বলিস রুদ্র, দুশমন হো তো অ্যায়সা।

শেষ বাক্যটি মনে হল প্রেমলালের খুব পছন্দ হল!

ঋজুদা তাকে পাইপের সুগন্ধি টোব্যাকো দিয়েছিল একটু। ওইটুকুকে খইনির মতো বাঁ হাতের তেলোতে মেরে জিভের নীচে দেওয়ার পর থেকেই প্রেমলালের ঘূর্তি বেড়ে গেছে। কী যে সুন্দর সুগঠিত চেহারা ছেলেটার। একটা কদম গাছ পেলে তাকে তার নীচে দাঁড় করিয়ে দিতাম কেষ্ট করে।

হঠাৎই প্রেমলাল এবং ঋজুদা দুজনে একসঙ্গেই থমকে দাঁড়াল। নাক টেনে গন্ধ নিল যেন কীসের।

একদল ছাতারে পাখি, ইংরেজিতে যাদের বলে ব্যাবলার, সবসময়েই babble করে বলে, অথবা সেভেন-সিস্টারস, ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা করে নাচতে নাচতে ডাকছিল কতগুলো পিটিস ঝোপের সামনে। পাখিগুলো হঠাৎই ভয় পেয়ে উড়ে পূর্বদিকে চলে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ময়ূরের তীক্ষ্ণ, তীব্র ডাক ভেসে এল হুজুরু পাহাড়ের উপরের একটি শিমুল গাছ থেকে।

আমি গন্ধটা পাবার চেষ্টা করলাম এবং আশ্চর্য! পেলামও। কুকুর বৃষ্টিতে ভিজলে তার গা থেকে যেমন বোঁটকা একটা গন্ধ বেরোয় গন্ধটা তেমনই তবে কুকুরের যে নয় তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। গন্ধটা তীব্র এবং উৎকট।

ঋজুদা মুহূর্তের মধ্যে প্রেমলালকে ইঙ্গিত করল সামনেরই একটা মহুয়া গাছে উঠে যেতে। টর্চ এবং জলের বোতল দুটো মাটিতে নামিয়ে রেখে, ভারমুক্ত হয়ে প্রেমলাল তড়িঘড়ি টাঙ্গিটাকে কাঁধে ফেলে বাঁদরের মতো তরতরিয়ে গাছে উঠে গেল। কিন্তু সামান্য উঠতেই ঋজুদা তাকে ইঙ্গিতে থামতে বলল। কোনও বড় বাঘ পেছনের দু’পায়ে ভর করে মাটিতে দাঁড়িয়েই ইচ্ছে করলেই প্রেমলালকে ধরতে পারে এখন। ঋজুদা আমাকে আমার বাম বাহু ধরে বাঁদিকে ঠেলে দিল আর নিজে ডানদিকে চলে গেল, গিয়ে একটা বড় শালগাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে এদিকে মুখ করে দাঁড়াল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে তাই করলাম। মনে হল, বাঘটা কাছেই আছে। ঋজুদা প্রেমলালকে, টোপ দিচ্ছে বাঘকে। বাঘ যে ক্ষুধার্ত তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, সুখমন্তির শরীরের কিছু অংশ পরশুদিন খাওয়ার পরে আজ দুপুর অবধি সে কোনও মানুষ ধরেনি। মানুষ ছাড়া সে আর কিছুই ধরছে না। বন্য প্রাণীর কথা ছেড়েই দিলাম, গৃহপালিত কোনও পশুও ধরছে না। বিপদ তো সে জন্যেই। পরশু তার খাওয়াটাও ভরপেট হয়নি। কিন্তু প্রেমলাল-এর বাবাকে খেল ও বাঘ আর ঋজুদা প্রেমলালকেই টোপ দিল। যদি সত্যিই মেরে ফেলে বাঘ প্রেমলালকে তবে মুখ দেখাতে পারব না আমরা আর কারও কাছে। এ কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম যে বাঘ যদি তার চেহারার একটুও দেখায় আজকে তবে হয় ইসপার নয় উসপার। সে মহা ধুরন্ধর হতে পারে কিন্তু ঋজু বোস আর তার চেলাও কোলকাতা থেকে এতদূরে তার হরক দেখে তাকে হাততালি দিতে আসেনি। নিশ্বাস বন্ধ করে একটা বড় আমগাছে পিঠ ঠেকিয়ে, পিছন দিকটা সুরক্ষিত করে বন্দুকের স্মল অফ দ্য বাট ডান হাতের পাতায় শক্ত করে ধরে ট্রিগার-গার্ড-এর উপরে আঙুল রেখে, ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি সাইড-লক এর উপরে ছুঁইয়ে, বাঁ হাত দিয়ে বন্দুকের লক এর নীচের অংশ এবং উপর দিয়ে ব্যারেল শক্ত করে ধরে একেবারে তৈরি হয়ে রইলাম।

বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেল। একটা হুপি পাখি হই হই করে ডেকে উঠল। বুবঁবুইই করে একটা কাঁচপোকা উড়তে লাগল প্রেমলালের মাথার ওপরে। হাওয়াটা ঘুরে গেছে। সেই গন্ধটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। চারদিক থেকে এখন স্বাভাবিক গলাতেই পাখিরা ডাকাডাকি করছে। একজোড়া কপারস্মিথ টুক টুক টুক টুক করে ডাকছে। সে ডাকছে পাহাড়তলি থেকে। তার দোসর সাড়া দিচ্ছে। মাছবান্ধা নালার দিক থেকে। সমস্ত বন কাকলিমুখর হয়ে উঠছে। যদিও সন্ধে হতে এখনও দেরি অনেক।

প্রেমলালকে নেমে আসতে ইশারা করল ঋজুদা। ও গাছ থেকে নেমে আমাদের সম্পত্তি সব তুলে নিয়ে আবার এগোল। সামান্য কিছুটা গিয়েই একটা জানোয়ারচলা পথে এসে পড়লাম আমরা। কাল বৃষ্টি হওয়াতে নানা জানোয়ারের পায়ের ক্ষুরের ও থাবার দাগ সহজেই খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না আমাদের কারওরই।

এবারে নিজের ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে আমাদের চুপ করে থাকতে বলে ঋজুদা নিজেও চুপ করে এগোতে লাগল। সেই পথের উপরে শুয়োর, চিতল হরিণ, শম্বর, এবং কোটরা হরিণ, শজারু ইত্যাদির পায়ের দাগ পেলাম। কিন্তু বাঘের পায়ের দাগ পেলাম না। আশ্চর্য। বাঘ কাল বৃষ্টির পরে এ পথ দিয়ে এলে বা গেলে তার পায়ের দাগ নরম মাটিতে অবশ্যই পাওয়া যেত, মাছবান্ধা নালার পারেও পাওয়া যেত।

প্রেমলাল এবারে আগে আগে যাচ্ছিল পথ দেখিয়ে। আমরা যখন হুজুরু পাহাড়ের সেই কুখ্যাত গুহাতে গিয়ে পৌঁছলাম তখন বিকেল চারটে বাজে। গুহার মুখটা মস্ত বড়। সামনে একটা বিরাট চ্যাটালো পাথর, কোনও প্রাগৈতিহাসিক আদিবাসী ছেলের বুকের পাটার মতো। তার উপরে একশোজন মানুষ শুয়ে-বসে হাত-পা ছড়িয়ে পিকনিক করতে পারে। কিন্তু পিকনিক করে এখানে বাঘ একলাই। নানা জানোয়ারের হাড় পড়ে আছে এদিকে-ওদিকে। গুহার মধ্যে টর্চ ফেলল ঋজুদা। দুটি নরকঙ্কালও রয়েছে তার মধ্যে। চামচিকের গায়ের গন্ধর মতো বিটকেল গন্ধ তার সঙ্গে বাঘের গায়ের তীব্র গন্ধ মিশে এক তীব্র মিশ্র গন্ধ বেরুচ্ছে গুহার ভিতর থেকে।

ঋজুদা ফিসফিস করে প্রেমলালকে জিজ্ঞেস করল, গুহার পেছনের মুখটা কোন দিকে?

প্রেমলাল হাত তুলে দেখাল।

গুহাটা লম্বা কতখানি হবে?

এবারে আমি শুধোলাম।

প্রেমলাল ফিসফিস করে বলল, ছেলেবেলাতে আমরা এর মধ্যে খেলা করেছি। কত। এক সাধুবাবা থাকতেন তখন এই গুহাতে। শিবরাত্রির দিনে এখানে তখন ছোট মেলাও বসত। পাঁচ বছর আগে সাধুবাবা দেহ রাখেন। তার পরই এই গুহা অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে কয়েক বছর। গত তিন-চার বছর হল বাঘ ভাল্লুকেরা দখল নিয়েছে। ইদানীং এই ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো ডেরা করেছে এখানে। এখানে একজোড়া ভুত আর পেতনিও থাকে। তারা ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোর মরা মানুষদের হাড় দিয়ে ডাংগুলি খেলে।

ঋজুদা বলল, শোন রুদ্র। এই আসল ভারতবর্ষ। তোরা হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরলে আর বাড়িতে ইন্টারনেট বসালে কী হবে। এখনও আমাদের দেশের আশি ভাগ মানুষ এই ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো, ব্যয়রানের কোনও মৃত দাগী আসামীর আত্মার প্রতিভূ আর মানুষের হাড় দিয়ে ডাংগুলি-খেলা ভূত পেতনির রাজত্বেই বাস করে। এরাই আসল ভারতবর্ষ। যতদিন না এদের উন্নতি হচ্ছে, এরা আলোক প্রাপ্ত হচ্ছে, ততদিন আমাদের অগ্রগতির সব আস্ফালন মিথ্যে হয়েই থাকবে।

গুহাটা লম্বা কতদূর?

তারপরই ঋজুদা শুধোল।

বেশি নয়। আমরা যতদূর এসেছি হাঁটা পথে গাড়ি থেকে তার দশভাগের একভাগ মতো হবে। তবে ভিতরটা সোজা নয়। আঁকাবাঁকা। পেছনে একটা নয়, তিনতিনটে মুখ আছে। তাই আমরা এই ভুলভুলাইয়াতে চোর-পুলিস খেলতাম।

ঋজুদা বলল, হুঁ। চলো এবারে ফিরি। বাঘ এখানে নেই আজ।

তবে গন্ধটা?

প্রেমলাল বলল।

আমিও গলা মেলালাম ওর সঙ্গে।

গন্ধটা গন্ধগোকুলের।

গন্ধগোকুল কওন চিজ হ্যায় স্যাব?

ভাম।

ভাম কওনসি চিজ?

ঋজুদা বলল, বিপদে ফেলল প্রেমলাল। ভাবতাম হিন্দিটা মোটামুটি জানি। এখন দেখছি জানি না।

ভাম তো বঙ্গভূমের প্রাণী। এই মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলেও কি থাকে?

আমি বললাম।

না থাকার কী?

বলেই, ঋজুদা বলল, বড্ড বেশি কথাবার্তা হচ্ছে। চারদিকে নজর রেখে সাবধানে এগো। পেছনেও নজর রাখবি। আমাকে বা তোকে বাঘে খেলে ক্ষতি নেই প্রেমলালকে পাহারা দিয়ে চল।

হঠাৎ ঋজুদার মধ্যে একটু ছটফটানি লক্ষ করলাম। এরকম করে ঋজুদা। তবে কারণ থাকলেই করে। আমি ভাবছিলাম, কারণটা কী হতে পারে।

আর কথাবার্তা না বলে আমরা তিনজনেই গাড়িতে এসে উঠলাম। গাড়িটা খোলাই ছিল। মানে লক করে যাইনি যাবার সময়ে। এইসব অঞ্চলে, থাকলে, সাইকেল-চোর থাকতে পারে। গাড়ি-চোর নেই। আমি স্টিয়ারিং-এ বসলাম। ঋজুদা আমার পাশে। পেছনে প্রেমলাল টর্চ ও জলের বোতল নিয়ে।

জলের বোতলটা নিয়ে ঋজুদা জল খেল। আমি বললাম, আমাকে দাও একটু। আমি খেয়ে প্রেমলালকে জিজ্ঞেস করলাম।

ও বলল, খাব না। তারপরই বলল ও ছোট জাত, একই বোতলে মুখ দিয়ে জল খাবে কী করে। অন্য বোতলটা ওকে দিলাম, কিছু না বলে।

গাড়ি ঘুরিয়ে নিতেই ঋজুদা বলল, সোজা মারার বাংলোতেই চল।

এদিক-ওদিক দেখে যাবে না? বিন্দুলের পথে একটু গেলে হত না?

আমি বললাম।

নাঃ ফিরেই চল। ঋজুদা বলল।

মাইলটাক গিয়েই একটা বাঁক ঘুরতেই যখন মস্ত মস্ত দুটো সাহাজ গাছ আর দুটো অমলতাস গাছের নরম হলুদ ছায়াতে মারা’র বাংলোটা দেখা গেল, চোখে পড়ল বাংলোর সামনে ছোটখাটো একটি ভিড় জমেছে। ঋজুদা স্বগতোক্তি করল, কী হল আবার?

গাড়ি সেখানে গিয়ে পৌঁছতেই সকলে একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল ওরা। হাটুরে মানুষেরা সব। এমন সময়ে সুরাবলী সিং সাহেব বাংলোর বারান্দা থেকে নেমে এসে বললেন, খতরা বন গ্যায়ে ঋজু বোস সাব।

কী হল?

সিং সাহেব বললেন, হাট সেরে এক বুড়ো আর তার যুবতী মেয়ে যাচ্ছিল নইনগরে। তারা মারা থেকে কোয়ার্টার কিমি দূরে রাস্তাটা যেখানে একটা অশ্বখ গাছের নীচে বাঁদিকে হঠাৎ বাঁক নিয়েছে, সেখানে পৌঁছতেই পথের পাশের একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বাঘ মেয়েটাকে ধরে মুখে করে নিয়ে চলে গেছে ডানদিকের জঙ্গলে। বুড়ো টাঙ্গি নিয়ে বাঘের পেছন পেছন দৌড়েওছিল কিছুটা কিন্তু মেয়েকে মাটিতে নামিয়ে রেখে যখন তাকেই ধরবার জন্যে তেড়ে এল বাঘ, তখন প্রাণভয়ে বুড়ো বাংলোতে দৌড়ে এসেছে।

আমি ভাবছিলাম, নিজের প্রাণকে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে বোধহয়। নিজের চেয়ে বেশি ভাল আর কাউকেই বাসি না আমরা কেউই।

কতক্ষণ আগে ঘটেছে এ ঘটনা? ঋজুদা শুধোল।

এক্ষুনি। গোল বুড়ো-এসে পৌঁছোল এই দশ মিনিটও হয়নি।

ঋজুদা একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, একটা টর্চ নে৷ দুটো নেওয়ার দরকার নেই।

তারপর সুরাবলী সিংকে বলল, আপনার বাবুলাল কোথায়? তাকে বলুন, আমাদের দু’জনকে ওখানে একটু পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসবে আবার এখানে।

আপনারা ফিরবেন কখন? হেঁটে ফিরবেন? রাতে মোরগা বানাতে বলব তো? আর পরাঠা?

ভাইয়ালাল জিজ্ঞেস করলেন।

একসঙ্গে অনেকগুলি প্রশ্ন করলেন ঋজুদাকে ভাইয়ালাল।

ঋজুদা কখন খুব রেগে যায় তা আমি মুখ দেখেই বুঝতে পারি। ভাইয়ালালের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে বসে পড়ল। আমিও উঠলাম অন্যদিকের দরজা দিয়ে। বাবুলাল ততক্ষণে তার গাড়ি ফেরত পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। কোনও ভাল ড্রাইভারই, তা তিনি গাড়ির মালিকই হন, কি কর্মচারী, নিজের গাড়িতে অন্য ড্রাইভার হাত লাগান তা পছন্দ করেন না।

ঋজুদা বলল, চলো ভাই। হাম দোনোকো ছোড়কর গাড়ি লেকর বাংলামে লওট আনা।

তারপর প্রেমলালকে বলল, প্রেমলাল তুম বাংলামে ড্রাইভার সাহাবকি সাথ খা পি কর বাংলামেই রহ যানা।

প্রেমলাল বলল, ম্যায় চলে আপলোগোকি সাথ।

ঋজুদা ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, এখুনি সন্ধে নেমে যাবে। অন্ধকারে ওই বাঘের হাত থেকে নিজেদের প্রাণই বাঁচানো মুশকিলের। তার ওপর তোমার দায়িত্ব নেওয়া যায় না। যদি কাল সকালে আবারও ওই বাঘের পেছনে যেতে হয়, যদি আমাদের মধ্যে একজনও অক্ষত অবস্থাতে আজ ফিরে আসি, তবে কালকের কথা কালকেই ভাবব।

ড্রাইবার বাবুলাল মোটাসোটা সুখী মানুষ। এবং মনে হল আক্কেলও কম আছে। একটু। সে বলল, কোথায় যাবেন স্যার এই বাঘের পেছনে অন্ধকারে। সিংসাহেব তো ঠাররার বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। রাতে পরাণ্ঠা আর মোরগা বানাচ্ছে। প্যাহলেওয়ান। নিম্বুকা আচারভি আছে। আর রিকমচ।

প্যাহলেওয়ানটা কে?

সে তো বাওয়ার্চি। জয়ন্তর গেস্ট হাউস থেকে এসেছে।

ঋজুদা কোনও কথা বলল না।

আমি বললাম, ঠাররাটা কী জিনিস?

দিশি মদ। হাটিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে।

আর রিকমচ?

ঋজুদা বলল, আরে বোকা। ডালের ধোকাকে বলে রিকমচ।

আমি বাবুলাল ড্রাইভারের বেয়াদপি দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। ঋজু বোস কে? তার পরিচয় এবং কাদের সঙ্গে তার ওঠাবসা কিছুই জানে না বাবুলাল বা রেঞ্জার সাহেবও। তাই এতবড় ধৃষ্টতা সে করতে পারল।

ততক্ষণে সেই বড় বড় ঝুরি-নামা প্রাচীন অশ্বথের কাছে পৌঁছে গেছি আমরা। পথটা ঠিক তার তলাতেই নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেছে বাঁদিকে। জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন। ডানদিকে ছোট বড় কতগুলো পাথর আছে। পিটিস আর বেশরম এর ঝোপ। এখানেই বাঘটা লুকিয়ে ছিল সম্ভবত।

ঋজুদা দরজা খুলে নেমে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। হাতের ইশারাতে ওকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে বলল ঋজুদা। বাবুলালকে তাড়াতাড়ি যাবার জন্যে নির্দেশ দিতে হল না। সে এমনিতেই একেবারে টিকিয়া-উড়ান চালিয়ে চলে গেল মারা বাংলোর দিকে।

গাড়ি চলে গেল, ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, ডানদিকে রয়েছে বাঘ। তাই তো বলল। না?

হ্যাঁ।

ঋজুদা বলল, শোন রুদ্র। ব্যাপারটা বড় বেশি গড়িয়ে যাচ্ছে। আর গড়াতে দেওয়া যাবে না। যে আগে দেখতে পাবে সেই গুলি করবে। সে ভাইটাল জায়গা পাওয়া যাক আর নাই যাক। আহত হলে তারপর নিজেরা মরেও তাকে তার পিছু নিয়ে গিয়ে শেষ করতে হবে। চোখের সামনে যা খুশি তা করে বেড়াবে ও আর সহ্য করা যায় না।

ঠিকই বলেছ।

আমি বললাম, দাঁতে দাঁত চেপে।

অন্ধকার হতে তখনও আধঘণ্টাটাক দেরি ছিল। পথের উপরে বাঘ যেখানে মেয়েটিকে ধরেছিল সেখানে মাটিতে তার থাবার দাগ এবং মেয়েটির হেঁচড়ে যাওয়া পায়ের দাগও ছিল।

ঋজুদা বলল, টর্চটা তোর বেল্টের সঙ্গে গুঁজে নে। বলেই, চিতার মতো ক্ষিপ্রতায় এক লাফ দিয়ে ঋজুদা পথ থেকে ডানদিকের জঙ্গলে উঠে গেল। পেছন পেছন আমিও উঠলাম। ঋজুদা বলল চুপিসাড়ে, ডানদিকে ছোটবড় কতগুলো পাথর আছে। পিটিস আর বেশরম এর ঝোপ। এখানেই বাঘটা লুকিয়ে ছিল সম্ভবত হাত দশেক বাঁদিকে। সিঙ্গল ফর্মেশানে যাব না। বাঘ জানুক যে আমরা তার পিছু নিয়েছি। লুকোচুরির কিছু নেই। তবে খুব সাবধান। এ বাঘ নয়, সাক্ষাৎ যম।

ঠিক আছে। আমি বললাম।

আর কথা নয়। দেখতে পেলেই গুলি করবি। আগে গুলি, তারপর কথা।

ঠিক আছে।

আমি বললাম, চোয়াল শক্ত করে।

জায়গাটাতে জঙ্গল খুব গভীর। পাতা ঝরে গেলেও কিছু কিছু গাছে পাতা আছে তা ছাড়া পিটিস আর বেশরম-এর ঝাড়ে ভর্তি। জঙ্গলের তুলাটা প্রায় দেখাই যায় না। এদিকে বাঁদর-হনুমান সম্ভবত নেই। থাকলে, আমাদের খুবই সুবিধে হত বাঘের অবস্থান জানতে। জঙ্গল ঘন বলে এখানে রেড বা ইয়ালো-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গও নেই যে তারা আমাদের সাবধান করবে। ওরা সাধারণত ফাঁকা জায়গায়, ব্লাড়-নদীর চরে উড়ে উড়ে বেড়ায়। জঙ্গলের গভীরে না থেকে সীমানা পাহারা দেয়। একটা কুবো পাখি, ইংরেজিতে যাকে বলে Crow-Pheasant, ওড়িয়াতে বলে কাটুয়া, ঢাব ঢাব ঢাব ঢাব করে ডেকে আসন্ন সন্ধ্যার বনকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। আসলে জায়গাটা একটা পাহাড়তলি। সামনেই কিছুদূরে একটা পাহাড় উঠে গেছে। তাকে আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি না বটে কিন্তু তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি।

কয়েক পা যেতেই মেয়েটির রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন নীল রঙা শাড়িটা দেখা গেল। একটা কাঁটাঝোপে আটকে আছে। শাড়িটা মোটা বলে এবং ওরা খুব গরিব বলেই বোধহয় শাড়ির নীচে শায়া পরেনি। তার পাশেই খুলে যাওয়া পুঁটলি৷ যে পুঁটলিতে করে হাট থেকে রসদ কিনে ফিরছিল। বোঝা গেল যে, মেয়েটি সেটাকে বাঘে ধরার পরেও ছাড়েনি। গরিবের সপ্তাহের বাজার ছিল তাতে। কিছু শুখা মহুয়া, জওয়ার, খেসারির ডাল, একটা লাউ, নুন, শুকনো লঙ্কা, কয়েকটা আলু, ছোট শিশিতে সরগুজার তেল–সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে চারদিকে। আর একটা বোতলে কেরোসিন তেলও। আশ্চর্য। বোতলটা ভাঙেনি। তার মুখে একটা ছিপি, বাঁশের গোড়া কেটে তৈরি।

ঋজুদা কী মনে করে কেরোসিনের তেলের বোতলটা বাঁ হাতে তুলে নিল, নিয়ে নিজের জিনস-এর হাঁটুর কাছে মস্ত বড় পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। কেন? কে জানে। আর একটু এগোতেই মেয়েটির, বোম-ছেঁড়া রক্তমাখা ছোট হাতার ছিটের ব্লাউজ, ভাঙা কাঁচের চুড়ি, দেখা গেল, পড়ে আছে। কাঁটাঝোপে আটকে আছে করৌঞ্জের সুগন্ধি তেলমাখা চকচকে লম্বা চুলের গোছ। মেয়েটির খুব লম্বা চুল ছিল মনে হয়। আর সেই চুলের সে খুব যত্নও করত বলে মনে হয়। আহা! দেখতে সে কেমন ছিল কে জানে!

আর একটু এগোতেই বাঘের গুড়গুড়ানি শোনা গেল, দূরাগত মেঘগর্জনের মতো। আমাদেরও যেমন ধৈর্য ফুরিয়ে এসেছিল হয়তো ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকোরও তাই। নইলে বাঘ কখনওই শিকারিকে তার অবস্থান জানায় না। বিশেষ করে, মানুষখেকো বাঘ।

আওয়াজটা শুনে, বাঘের অবস্থানের দিক এবং দূরত্বর একটা অনুমান আমরা করতে পারলাম।

ঋজুদা আমার দিকে চাইল। আমি, ঋজুদার দিকে। তারপরই ঋজুদা। আওয়াজটার বাঁদিকে, সামনে এগিয়ে গেল আর আমি ডানদিকে। তারপরই নিজের নিজের আগ্নেয়াস্ত্র ডান হাতে ধরে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে যত কম সম্ভব শব্দ করে এগোতে লাগলাম। পশ্চিম দিকে এগোচ্ছি আমরা। অস্তগামী ম্লান রোদ গাছপালার মধ্যে দিয়ে এসে চোখে লাগছে। তবে তা আর কয়েক মিনিটই লাগবে মাত্র। তারপরই সূর্য পশ্চিমের পাহাড়টার আড়ালে চলে যাবে।

আমরা বড় জোর পঁচিশ-তিরিশ পা এগিয়ে গেছি এমন সময়ে বাঘ জোরে একবার হুংকার দিয়ে উঠল। এমনই জোরে, মনে হল যেন শালগাছগুলোকে সেই গর্জন মাটি থেকে উপড়ে ফেলে দেবে। বাঘও আমাদের ‘ডোন্টকেয়ার’ করছে। আর আমরা তো করছিই। যা হবার তা হোক।

বাঘ এখনও যতদূরে আছে, বেশ দূরেই আছে, সেখানে শটগান দিয়ে মারা যাবে না। তবে রাইফেলের রেঞ্জে অবশ্যই আছে। আরও তিনচার পা এগিয়ে গিয়ে আমরা ফ্রিজ করে গেলাম। আমরা যে শিকারি, বাঘ তা জানে না। মেয়েটির বাবা যেমন তার পেছনে টাঙ্গি হাতে ছুটে গেছিল তেমনই একাধিক মানুষ তার কাছ থেকে মেয়েটির মৃতদেহটি নিয়ে যাবার জন্যে এসেছে, এমনই মনে করেছে বাঘ সম্ভবত। আমরা তাই স্ট্যাচুর মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে আরও কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। বাঘ আর কোনও আওয়াজ করল না কিন্তু চপ-চপ শব্দ করে মাংসর টুকরো যে মুখে পুরছে, কটাং কটাং করে যে হাড় ভাঙছে তার শক্ত চোয়াল দিয়ে, সেই শব্দ শোনা যেতে লাগল। বোঝা গেল যে, তার খিদে পেয়েছে খুবই। দেরি করার মতো ধৈর্য তার নেই আর।

ঋজুদা আমাকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজে রাইফেল রেডি-পজিশনে ধরে সেই দিকে নিঃশব্দে সাবধানে শুকনো পাতা এড়িয়ে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। ঋজুদা আমার থেকে পনেরো কুড়ি হাত এগিয়ে গেছে, ঠিক এমন সময়ে কী যে হল তা বোঝার আগেই দেখলাম, চকিতে রাইফেল তুলে গুলি করল ঋজুদা। পাহাড়তলির ঘনবনের মধ্যে সেই চাপা জায়গাতে পয়েন্ট ফোরফিফটি-ফোরহান্ড্রেড রাইফেলের আওয়াজ গমগম করে উঠে সামনের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। এবং প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই ধনুকের মতো অর্ধচন্দ্রাকার হয়ে বাঘ লাফ দিয়ে উঠল উপরে। অনেকখানি উপরে। প্রায় পঁচিশ-তিরিশ ফিট উপরে। তারপরই ধপ আওয়াজ করে বাঘ মাটিতে পড়ল ঝোপঝাড়, শালের চারা সব ভেঙে-ভুঙে।

তারপরই মৃত্যুর মতো নীরবতা।

কিন্তু তা স্থায়ী হল এক মুহূর্ত।

নীরবতার পরই পাটকিলে-রঙা উল্কার মতো উড়ে এল বাঘ আমার দিকে। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, একটা বিজা গাছের নীচে, সে জায়গাটা একটু উঁচু মতন ছিল। বাঘ ঋজুদাকে দেখতে পায়নি, সম্ভবত, আমাকেই দেখতে পেয়েছিল এবং ভেবেছিল গুলিটা আমিই তাকে করেছি। তাই আমাকেই আক্রমণ।

গুলি পেটে লাগলে সাধারণত অমন করেই লাফিয়ে ওঠে উপরে বাঘ বা চিতা। পেটে গুলি লাগলে যন্ত্রণাও খুবই হয় কিন্তু সামনের ও পেছনের দুটি পাই অক্ষত থাকে এবং অক্ষত থাকে মুখও, তাই তখন বাঘ শিকারি এবং ছুলোয়াওয়ালাদেরও যম হয়ে যায়। দুই লাফে বাঘ এসে মাটিতে পড়ল আমার থেকে হাত পনেরো সামনে। বন্দুক রেডিই ছিল। আমি ডানব্যারেল ফায়ার করলাম অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কিন্তু কিছুটা ভয় পাবার কারণে এবং কিছুটা সময়াভাবে বন্দুকটা কাঁধে তোলার সময় পেলাম না, যেমনভাবে গান-ক্লাবে স্কিট-শুটিং করি আমরা, তেমন করে বন্দুক কোমর অবধি উঠিয়েই ট্রিগার টেনেছিলাম।

গুলি তো করলাম কিন্তু বাঘকে রোখা গেল না। বাঘ উড়ে এসে পড়ল আমার উপরে। এত তাড়াতাড়ি ঝড়ের বেগে সে আমার উপরে এসে গেল যে বাঁদিকের ব্যারেল ফায়ার করার সময় আর পেলাম না। কিন্তু বন্দুকটা আড়াআড়ি করে ধরে বাঘ যাতে আমার মাথা বা ঘাড় কামড়াতে না পারে সেই শেষ চেষ্টা করে লক্ষমান বাঘের গতিজাড্যতে এবং ওজনের অভিঘাতে আমি চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। বাঘের দিকে বন্দুকের নল ঘোরাবার উপায় না থাকলেও ট্রিগার-গার্ডে ছোঁয়ানো আঙুলকে নীচে নামিয়ে এনে আমি শূন্যে বাঁদিকের ব্যারেল ফায়ার করলাম। বাঘের নাকের এক হাতের মধ্যে এল. জি.-র দানাগুলো কর্ণবিদারী শব্দ করে বেরিয়ে যেতে বাঘ চমকে উঠে কী ভাবল কে জানে, সে আমাকে এক ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে আরেক লাফে রাস্তার দিকে চলে গেল। বাঘ আমাকে ছেড়ে যেতেই ঋজুদা দৌড়ে এল আমার কাছে। আমার ডান হাত ও ডান বুকে বাঘের বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় পড়েছিল। মাংস খুলে পড়েছিল এবং রক্তে বুক এবং হাত ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু তখন আমি কোনও রকম যন্ত্রণা অনুভব করিনি। হতভম্ব হয়ে ছিলাম। শক লেগেছিল দারুণ। ঋজুদা বাঘের পেছনে কয়েক পা দৌড়ে গিয়ে দূরে চলে যাওয়া বাঘের উদ্দেশে তার দ্বিতীয় ব্যারেলটিও ফায়ার করল। সে গুলি লাগল কি না বোঝার উপায় ছিল না। অবশ্যই বাঘকে মারার জন্যে নয়, কারণ বাঘ তখন প্রায় অদৃশ্যই হয়ে গেছিল, বাঘকে ভয় দেখাবার জন্যেই ছুঁড়েছিল গুলিটা, যাতে সে আর ফিরে না আসে। গুলি করেই রাইফেলটা সঙ্গে সঙ্গে রিলোড করে নিল ঋজুদা।

আমার মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে আমার গলাতে বা ঘাড়ে বা মাথায় যে বাঘের থাবা বা কামড় পড়েনি সে সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে ঋজুদা বলল, এখানে শুয়ে থাক, রুদ্র। তোর কিসসু হয়নি। আমি এই গেলাম আর এলাম।

দৌড়ে ঋজুদা পথের দিকে চলে গেল। ততক্ষণে পরপর অতগুলো গুলির আওয়াজ শুনে, বাঘ মরে গেছে ভেবে গাড়ির সব কাঁচ তবুও তুলে সুরাবলী সিং সাহেব, ভাইয়ালাল, এবং শম্ভুপ্রসাদের প্রেমলালকে সঙ্গে নিয়ে বাবুলালকে দিয়ে জোরে গাড়ি ছুটিয়ে এদিকেই আসছিলেন।

ততক্ষণে ঋজুদা পথে নেমে এসেছে। ওঁদের নিয়ে ঋজুদা আমার কাছে ফিরে এল তক্ষুনি। আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ঋজুদা ওখান থেকে আসার আগে কেরোসিনের বোতলটা একটা ফাঁকা জায়গাতে ঢেলে দিয়ে পাইপের লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটির বাবা গোন্দবুড়ো আরও কয়েকজনকে মেয়েটির লাশ আনতে যখন পাঠিয়েছিল পরে তখন বুঝলাম যে আগুনটা ওদের পথ নির্দেশের জন্যে।

মারাতে পৌঁছে ঋজুদা আমার চিকিৎসাতে লাগল। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে বেঞ্জিন ঢেলে দিল ক্ষততে। মনে হল, জ্বালাতে মরে যাব। মনে হল ঋজুদাকে থাপ্পড় মারি, এমনই জ্বালা করতে লাগল।

ঋজুদা বলল, মরবি না, ভয় নেই। খুব জোর বেঁচে গেছিস। অবশ্য কোলকাতাতে ফিরে ভটকাই-এর হাতে তোর অন্যরকম মৃত্যু যে অনিবার্য তাতে কোনওই সন্দেহ নেই। এখুনি মরলে কি চলে রুদ্রবাবু? এখনও কত অ্যাডভেঞ্চার, কত রহস্যভেদ করা বাকি।

আমি এই কষ্টের মধ্যেও হেসে উঠলাম। গাড়িটা মেয়েটির লাশ নিয়ে ফিরে আসতেই ঋজুদা আমাকে তাতে তুলে ড্রাইভার আর সুরাবলী সিং সাহেবকে নিয়ে রওয়ানা হল। আমারও মেয়েটির রক্তে নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর সাদা সিট-কভার লাগানো গাড়িটার যে কী অবস্থা হল কী বলব।

ওঁরা বললেন, জয়ন্ত-এ খুব বড় ও আধুনিক হাসপাতাল হয়েছে নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর। সিঙ্গরাউলি, জয়ন্ত, গর্বী, নীগাঁহি, বীনা এই সব নাম খাদানের। অনেকগুলো খাদান। ওখানে নিয়ে যেতে পারলে আর চিন্তা নেই।

জয়ন্ত-এ পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগল তা আমার মনে নেই। ঋজুদা ব্যাগ থেকে ভি. এস. ও. পি.কনিয়াক এর বোতলটা বের করতেই সুরাবলী সিং বললেন, জারা ঠাররা পিলা র্দু উনকো?

নহি, নহি।

বলল, ঋজুদা, একটু বিরক্ত হয়েই। তার ব্র্যান্ডির বোতলটা আমার হাতে দিয়ে বলল, একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খা। ধন্বন্তরী ওষুধ। সর্বরোগহারী।

আমি বললাম, মদ খাব? বাবা জানতে পারলে…

ঋজুদা ধমকে বলল, চুপ কর তো। এটা ওষুধ। তোর বাবার সঙ্গে আমি বুঝে নেব। ভারি বাবা দেখাচ্ছে। তোর বাবাকে কখনও বাঘে কামড়েছিল? যত সব ন্যাকামো।

জয়ন্ত-এর হাসপাতাল সত্যিই বিরাট। সেখান থেকে সিঙ্গরাউলিতে ফোন করে দিলেন সুরারলী সিং সাহেব। ঋজুদার সব রিকুইজিশান, পেট্রলের জিপ সুদ্ধ জয়ন্ত-এ এসে হাজির হল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। সঙ্গে সেন সাহেব, দাস সাহেব এবং তিনচারজন সি.জি.এম. এবং জি.এম.। আমাকে কীসব ইঞ্জেকশানটিনজেকশান দিলেন ডাক্তারসাহেবরা। টেডভ্যাকও। সার্জন এসে ক্ষত ড্রেস করে নানা বিদঘুঁটে গন্ধের ওষুধ লাগালেন ক্ষততে। তারপর পেইন কিলার ইঞ্জেকশান দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন ওঁরা। আর কিছু মনে নেই আমার। আমার নাকে তখনও বাঘের মুখের দুর্গন্ধ লালা লেগেছিল, স্পিরিট দিয়ে সিস্টারেরা যতই আমার মুখ পরিষ্কার করে দিন না কেন। আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার বোধ।

উল্কার মতো উড়ে-আসা ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘের সেই রূপ কি জীবনে কোনওদিনই ভুলতে পারব? জানি না।

জ্ঞান হারালাম আমি।

.

০৪.

সি. এম. ডি. সেন সাহেব এসেছিলেন বেনারস এয়ারপোর্টে আমাদের তুলে দিতে। মাসখানেক আমাকে নার্সিংহোমে থাকতে হবে কোলকাতাতে। কোল ইন্ডিয়া থেকে কোলকাতাতে অ্যাম্বুলেন্স-এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। হুইলচেয়ারে করে প্লেনে তোলা হল আমাকে। আমার পেটেও থাবার চোট লেগেছে। তখন আমি বুঝতে পারিনি। পেটের উপরের দিকেও অনেকখানি জায়গা ইংরেজিতে যাকে বলে ল্যাসেরেটেড, তাই হয়ে গেছে। পেটের মধ্যের যন্ত্রপাতি কী বিকল হয়েছে না হয়েছে আমাকে কিছুই বলা হচ্ছে না।

হ্যান্ডশেক করে সেন সাহেব নেমে গেলেন প্লেন থেকে। প্লেনের মধ্যে আমি হিরো হয়ে গেলাম। জিরো যদি হিরো হয় তবে জিরোই জানে কীরকম এমব্যারাসড লাগে তার।

মধ্যপ্রদেশের সব খবরের কাগজে, দূরদর্শনে, বেতারে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো যে মারা গেছে সেই খবর প্রচারিত হচ্ছে গত রাত থেকে। বাঘটা মারল ঋজুদা কিন্তু যেহেতু আমিআহত হয়েছি আমাকেই হিরো বানানো হয়েছে শুনলাম। আমাদের পুতুপুতুকরা দেশের এই নিয়ম।

প্লেনটা টেক-অফ করলে আমি বললাম, এবার বলল তো ঋজুদা, বাঘটা যে মরেছে তা তুমি জানলে কী করে?

ঋজুদা বলল, চামড়াটাতো সঙ্গেই আছে। যখন কোলকাতাতে গিয়ে কাথবার্টসন অ্যান্ড হার্পারে ট্যান করানোর পর বাঘটা আসবে, তখনই দেখবি। মুখটাকে আর মাথাটাকে মাউন্ট করাবো। তোকেই দেব মাথাটা। নইলে তুই তো ভুলেই যাবি তাকে। তোকে চুমু খেতে চাইল, আর তুই এতই বাজে লোক, যে দিলি না খেতে।

কোথায় পেলে বাঘকে? আরও গুলি করতে হয়েছিল নাকি?

না না। ফোরফিফটি-ফোরহানড্রেডের গুলি তার পেট এফেঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল। তার উপরে তোর ছোঁড়া এল. জির দানাগুলোর কিছু লেগেছিল ওর বুকে ও ডান কাঁধে।

বাঘটাকে পেলে কোথায়?

যেখানে পাব ভেবেছিলাম।

কোথায়?

হুজুর পাহাড়ে। তার গুহাতে। মানুষ যেমন মরবার সময়ে নিজের বাড়িতেই মরতে চায় জানোয়ারেরাও বিশেষ করে বাঘ বা চিতা, উপায় থাকলে, আহত হলেই, ওদের ডেরায় ফিরে যেতে চায়।

তারপর বলল, তবে গুহাতে ঢুকতে পারেনি। গুহার মুখে যে চ্যাটালো পাথরটা দেখেছিলি, সেখান অবধি গিয়েই তার উপরে পড়ে গেছিল। বেচারি। আমি জানতাম ওখানেই ও যাবে। কালাহাণ্ডিতে জনসন সাহেবের মারা একটি বাঘও ঠিক এইরকম ভাবেই পেটে গুলি খেয়ে তার গুহার ঠিক বাইরে অবধি পৌঁছে পড়ে গেছিল। কিন্তু তার চামড়া জনসন সাহেব পাননি।

কেন পাননি?

শকুন পড়ে গেছিল। ছুলোয়াওয়ালারা যখন রক্তের দাগ দেখে দেখে পৌঁছেছিল সেখানে তখন বেলা প্রায় এগারোটা।

তোকে হাসপাতালে ঘুম পাড়িয়েই আমি ফিরে গেছিলাম জিপ চালিয়ে মারা’তে। সুরাবলী সিং ঠাররা খেতে খেতে গাড়িতে এসেছিলেন আস্তে আস্তে। তবে পরে শুনেছি উনিও ওসব খান না। উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্যেই খেয়েছিলেন। আমার সঙ্গে VSOP আছে তা উনি জানবেনই বা কী করে!

তারপর? পরাঠা আর মোরগা খেলে ডিনারে?

ওরা খেয়েছিল। তুই হাসপাতালে পড়ে আছিস আর আমি ভোজ খাব? কী যে বলিস। তবে ওখানে কাজের মানুষের চেয়ে তো খাওয়ার মানুষই বেশি ছিল।

তারপর বলল, কিছুই খাইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। আমিও তোরই মতো কনিয়াক খেয়েছিলাম একটু মুরগির মাংসের সঙ্গে। তুই কী চিন্তাতেই যে ফেলেছিলি! তোর কিছু হয়ে গেলে তোর মা-বাবাকে মুখ দেখাতাম কী করে বলত?

হয় তো নি।

তবে একটা কথা ভেবে ভাল লাগছে। তুই আমাকে অনেকবার বাঁচিয়ে ফিরেছিস। এই প্রথমবার তুই আহত হলি আর অক্ষত আমি তোর খিদমদগারি করলাম।

তারপর বলল। শেষটুকু বলো।

রাত থাকতে থাকতে আমি প্রেমলালকে নিয়ে আমার রাইফেল এবং তোর বন্দুক দুই নিয়ে হুজরু পাহাড়ের নীচে জিপ নিয়ে যতখানি যাওয়া যায় ততখানি গিয়ে, প্রেমলালকে কী করে বন্দুক ধরতে হয়, কী করে বন্দুকে নিশানা নিতে হয় তা ভাল করে বুঝিয়ে, সাইড সেফটি ক্যাচটা দেখিয়ে গুলি ভরে ওর হাতে তোর বন্দুকটা দিলাম। পুবের আকাশ ফরসা হওয়া মাত্র জিপ থেকে নেমে ওকে বললাম, আগে আগে যেতে। গুলিভরা বন্দুক হাতে আনাড়ির সামনে থাকাটা হাইলি ডেঞ্জারাস।

পাহাড়ে পৌঁছেই অবশ্য আমি আগে আগে চললাম। খুবই সাবধানে। পাহাড়ে গুহার কাছে পৌঁছে আমি দেখার আগেই বাঘের লেজটা দেখতে পেয়েছিল প্রেমলাল। আনন্দে চিৎকার করে উঠল ও। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, বাঘ লম্বা হয়ে শুয়ে আছে আরামে, স্বস্তিতে। বেচারির অনেক দুঃখের জীবন অনেক মানুষের দুঃখের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হল।

চামড়া যখন ছাড়ানো হচ্ছিল তখন দেখলাম যে গাদা বন্দুকের একটা মস্ত সিসের গুলি বেচারির ডান পা আর কাঁধের সংযোগস্থলে হাড়ের মধ্যে আটকে আছে আর ডান পায়ের পেশিতে সফিসটিকেটেড শটগান থেকে ছোঁড়া এল, জি.-র দুটি দানা। সাধে কি বেচারি তার স্বাভাবিক খাদ্য তো বটেই গৃহপালিত গোরু-টরুও ধরতে পারত না। যে অবিবেচক মানুষেরা তাকে এমন শাস্তি দিয়েছিল তাদেরই জ্ঞাতি-গুষ্টিকে খেয়ে সে সেই শান্তি ফিরিয়ে দিত এতদিন। তবে কাঁধের ঘাটার এমনই অবস্থা হয়েছিল যে ও আর বেশিদিন মানুষও ধরতে পারত না। না-খেয়েই হুজুর পাহাড়ের গুহার মধ্যে মরে থাকত। বাঘের মতো মহান জানোয়ারের পক্ষে সেরকম মৃত্যু বড় মর্মান্তিক হত। তাও সে মরার সময়ে। যুদ্ধ করে যে মরেছে, এইটুকুই সান্ত্বনার।

এই বাঘের জন্যে যে পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন মধ্যপ্রদেশ সরকার সেটা নেবে না তুমি?

আমি বা তুই নিয়ে কী করব বল? যে ওটা পেলে জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং যার বীরত্বর জন্যেও সেই পুরস্কার প্রাপ্য সেই প্রেমলালকেই দিয়ে দিতে বলেছি। সেই চিঠি দিয়ে দিয়েছি সেন সাহেবের কাছে। ও খালি হাতে যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে তাতে ওরই ন্যায্য অধিকার ওই পুরস্কারে। অতটুকু ছেলে। ওরাই তো আসল ভারতীয়। ওকে বলেছি জওয়ান হতে। আর্মিতে জয়েন করতে। তা ছাড়া, ওর বাবাকে তো ওই ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘই খেয়েছে। ওই পুরস্কারে তাই ওর ডবল অধিকার।

আমি বললাম, খুবই ভাল করেছ কাজটা ঋজুদা তুমি।

আমি তো ভালই করি কিন্তু কোলকাতা ফিরলে মিস্টার ভটকাই তোর ভাল করে কি করে না সেটাই এখন দেখার। তারা তো সব আসছে দমদম-এ, থুড়ি নেতাজি সুভাষ এয়ারপোর্টে, তোকে রিসিভ করতে।

তারা মানে? কারা?

হোল ব্যাটালিয়ান, তোর মাবাবাও আসছেন। এমনকী তিতির আর গদাধরও।

তুমি কী যে করো না! এত সিন ক্রিয়েটেড হবে।

শুধু কি ওঁরাই। মিডিয়াও থাকবে। সব কাগজের রিপোর্টারেরা, টিভির বিভিন্ন চ্যানেলের লোকেরা, ক্যামেরা বাগিয়ে। আফটার অল, ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো নিজেই তো পুরো দেশের মিডিয়ার খবর হয়েছিল গত ন’মাস, তুই তার হাত থেকে ওই গরিব মানুষদের বাঁচালি তাতে তুই খবর হবি না?

আমি বাঁচালাম? না তুমি!

তুইই তো বাঁচালি! তোর স্যাক্রিফাইসই বেশি।

ও। তোকে একটা কথা বলা হয়নি। আমি যখন প্রেমলালকে নিয়ে শেষরাতে হুজুরু পাহাড়ে দিকে যাই তখন কিন্তু ও রাবণমারা গুম্ফাতে নেমে অন্ধকারেই ষোলোভুজা দুর্গাকে প্রণাম করে গেছিল। আসলে কে যে বাঁচালেন বা বাঁচাল, তা নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। বাঘ যদি তখনও বেঁচে থাকত, রাতভর রক্তক্ষরণে মারা না যেত, তবে এই গল্পের শেষ তো অন্যরকমও হতে পারত!

তা অবশ্য ঠিক।

আমি বললাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress