জলসা (Jalsha)
সকলেই তাকিয়ে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে।
কোম্পানির লাইনের সামনের ময়দানে একদিন আগে থেকেই তোড়জোড় চলেছে জলসার।
বিরাট মঞ্চের ওপর গান্ধীজির প্রতিমূর্তিওয়ালা নতুন সিন্ খাটানো হয়েছে। সুবৃহৎ সুবর্ণমণ্ডিত পটে গোলাকার ধাঁধানো আলোর মধ্যে দুদিকে দুখানি মুখ। একখানি পণ্ডিত জওহরলাল, অপরটি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। একধারে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মূর্তি। কোষোম্মুক্ত তরবারি নিয়ে সামরিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। তা ছাড়া খাটানো হয়েছে বহু রকমের ছবি। গান্ধীজি থেকে শুরু করে অরুণা আসফ আলী পর্যন্ত।
বাবু সাহাব কর্পূর সিং দেখাশোনা করছেন। লিবার অক্সর বোনার্জি সাহাব দেখিয়ে শুনিয়ে দিচ্ছেন কোথায় কী সাজাতে হবে।
আগামী কালকের জলসার প্রস্তুতি হচ্ছে।
লাইনের লোকেরা সব নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে—আর দেখছে।
কাজ থেকে ফিরে এসে মৌজ করছে সব বসে, আর আগামীকালের জলসা সম্বন্ধে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে। কি হবে না হবে তারা না জানলেও জলসা সম্বন্ধে একটা ধারণা তাদের আছে। আর সেই ধারণাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে এক একজন এক একরকম করে বলছে।
মিস্তিরি হারু ঘোষ বুদ্ধিমানের মতো সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে দিচ্ছে। কি হবে না হবে সে নাকি সব আগে থেকেই জেনে ফেলেছে।
বনোয়ারী পথ-চলা গুটিকয়েক বিলাসপুরী মেয়েকে দেখে গোঁফ পাকাচ্ছিল। মনে মনে খানিকটা রস-সিক্ত কল্পনার আবেগে চাপা গলায় একটা দেহাতি গান গুনগুনিয়ে উঠল সে। মেয়ে কটা চলে যেতেই একটা প্রশ্ন হঠাৎ তার মনে এল। জিজ্ঞেস করল এ মিস্তিরিজি, কাল একঠো নাচওয়ালি ভি আসবে?
জবাব দিল রামাবতার, শালা বুঢ়বক হ্যায়। এ ধরম কা জলসা। গান্ধীবাবা কী তসবির দেখা নেই? কি বোলো মিস্তির ভাই-বাঈজী হিয়া ক্যায়সে আসবে?
তুই ব্যাটার বুদ্ধির ওরকম। হারু হেসে বলে বনোয়ারীকে, তোকে বাঈজীর নাচ দেখাবার জন্যে লেবারবাবু আর বাবুসাহেব খাটছে।
একটা রসালো খিস্তি করে হেসে উঠল হারু।
.
মুসলমান লাইনটার চা-খানাতেও কথা উঠেছে এই জলসার ব্যাপারেই।
শরীফ মাথার ঝাঁকড়া চুলের গোছা থেকে পাটের ফেঁসো ঝাড়তে ঝাড়তে বললে—সহি আদমি যায়ে গো তো, হিন্দু মুসলমান দুনো? কাঁ হো সোলেমান্?
সোলেমানও তাকিয়েছিল মঞ্চটার দিকে। অন্যমনস্কের মতো জবাব দিল, সে, ক্যায়া মালুম! হোগা সায়েদ। জলসা তো হ্যায়।
গোলাম মহম্মদের বিবি ঘরের সামনে চটের পরদাটা সরিয়ে বারে বারে দেখছে মঞ্চটার দিকে—এ বড়া গান্ধীবাবার তসবির কখনও দেখেনি সে। কিন্তু লাল লাল ড্যাব ড্যাবা মাতোয়ালের মতো চোখওয়ালা লোকটা খালি তার দিকে দেখছে চা-খানা থেকে। আচ্ছা বেয়াদপ কমিনা আমি তো!
হাফিজ খানিকটা গুম খেয়ে বসে আছে ঘরের মধ্যে। লেড়কাটার বিমারি আজ তিনমাস থেকে। ডাগদার হেকিম ঘাঁটাঘাঁটি করল নিয়ে অনেকদিন। সারবার নামটি নেই। কাজ থেকে ফিরে রোজানা ওই একই দৃশ্য ঘরের মধ্যে। তবিয়ত চায় না আর এসব দুখ তখলি সইতে। ফের ডগদরের কাছে যেতে হবে। ভাবতে ভাবতে ওঠা আর হয়ে উঠছে না। দাওয়াইয়ের পয়সা নেই। বিরক্ত হয়ে জলসামঞ্চের দিকে ফিরে তাকায় সে। খানিকটা গম্ভীর হয়েই ভাবতে হয় তাকে আজাদ হিন্দুস্থানের কথা। লিবারবাবু জলসা-খাতির কাজ দেখিয়ে শুনিয়ে দিচ্ছে। কোম্পানির লউরি করে জলসার মালপত্র আসছে। খুব ভারী জলসা হবে সন্দেহ নেই।
বিবির দিকে তাকাল সে। বিবি রুটি বানাচ্ছে। তা রাত্রের অন্ধকারে ঘরের দরজাটা খুলে বসে বিবি জলসা দেখতে পারে। লেড়কাটা খুঁত খুঁত করবে হয় তো। তবিয়ত ভাল থাকলে হাফিজ না হয় একবার গদিতে তুলে নিয়ে ঘুরেই আসবে। খুব ভারী জলসা হবে। লেড়ালোক না দেখলে মানবে কেন? ঘরের সামনে জলসা! তবিয়তটা ভাল থাকলে লেড়কাটা ফুর্তি করে দেখতে পাবে জলসা।
দুএকটা টাকার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল সে। দাওয়াই একটু না আনলে নয়।
ফুল মহম্মদ থেকে থেকে খানিকটা সন্দেহে জলসার দিকে তাকিয়ে বুড়ো বাপ রহমতকে জিজ্ঞেস করে, ই লোগকা মতলব ক্যায়া?
তোবা তোবা! বুড়ো রহমত বিরক্ত হয় লেড়কাটার এ সন্দেহে। এখন হিন্দুস্থানে লিগ পাট্টি নেই, নেই দাঙ্গা। এখন এত সংশয়ের কী আছে?
ফুল মহম্মদ তা জানে। তবে কপূর সিং লোকটাকে সে কোনওদিনই ভাল চোখে দেখে না, দাঙ্গার টাইমে গোয়ালা-লোকদের খেপিয়ে ওই লোকটা দাঙ্গা বাঁধিয়ে ফেলেছিল আর কী।
তবে জলসা সম্বন্ধে সে বঢ়ি সজাগ। গাওনা বাজানা চিরকালই সে ভালবাসে। বিশেষ করে কাওয়ালি। সে নিজেই একজন গায়ক। একটা ছোটখাটো কাওয়ালির দলও আছে তার।
কিন্তু তাকে কি ওখানে ডাকবে? কেনা বড়া বড়া আদমি, গানেওয়ালা বাবু সাহাবরা আসবে সব! যা-নে দেও, হইচই করা যাবে খানিকটা।
মুসলমান লাইনটার পরেই বিলাসপুরী লাইন। ছুটির পর রান্নাবান্নার আয়োজন চলেছে সেখানে। বিশেষ করে চলেছে জেনানা লোকদের প্রসাধন। ভগৎ ওর মেহেরারুকে গদিতে বসিয়ে চুল বেঁধে দিচ্ছে। এটা ওদের বিশেষ কোনও রেওয়াজ নয়। তবে চলে এরকম। একটা বিশেষ ধরনের কাপড় পরার ভঙ্গিতে ওদের শক্ত সমর্থ শরীরগুলো আদমিদের কাছে একটা লোভনীয় বস্তুই বটে। মনগুলোও তাই। মহব্বতের ব্যাপারে ওরা ভয়ানক দরাজ। বোধ হয় স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যে ওরা হার মানিয়েছে মদীনা লোকদের, তাই ওদের নিয়ে টানাটানি বেশি, কাড়াকাড়ি হয় প্রায়ই।
আসলে ওরা খাটতে পারে খুব আর বেপরোয়াও তাই বেশি। ফলে ওদের মদানাগুলো হয় নিরীহ নির্জীব গোছের। শরীরে না হলেও মনে মনে।
ঘরের কাজকর্ম তাড়াতাড়ি সারবার দিকে আজ ঝোঁক বেশি ওদের। কাপড়-চোপড় সাফ করতে হবে। জাঁকিয়ে বসে জলসা দেখতে হবে কাল।
চুল বাঁধার পর ভগৎ বাজারে চলল ওর মেহেরারুর জন্য কাচপোকার টিপ আনতে। বৈজুর বউ কুথি একপাল ছেলে নিয়ে বসেছে খাওয়াতে। তা শয়তানের বাচ্চাগুলো কি খেতে চায়? খালি জলসার কথাই ওরা বকবক করে চলেছে। কুথিকে আবার নাইতে যেতে হবে। হারামজাদাগুলো খেয়ে না উঠলে যাওয়া হবে না তার। কয়েকবার তাড়া দিয়ে যখন হল না, একটা লকড়ি নিয়ে বড় ছেলেটাকে এক ঘা কষিয়ে দিল সে। হাঁ, শুধু নাহলে তো হবে না, পুরনো লাল শাড়িটায় খুব হুঁশিয়ার করে আবার সাবুন লাগাতে হবে। অমন ভারী জলসাটা দেখতে যেতে হবে তো।
বিধবা ছেদি লাইনের মদনাদের সঙ্গে ইয়ারকি করতে করতে খিলখিল করে হাসছে আর নিজের বাঁধানো রোয়াকে একটা নতুন শাড়িকে বাসন্তী রঙে ছেপাচ্ছে। হোলি চলে গেলেও প্রাণের উচ্ছলতা আছে। কাপড় ছোপানোটা হোলি ছাড়াও চলে তার। তাকে হিংসা করে এ লাইনের আর সব কমিনামাগীগুলোতা সে জানে। তাই হাসির ঘটা সামান্য কারণে তার ফেনার মতো ছিটিয়ে পড়ে চারিদিকে। আগামীকাল জলসা দেখবার জন্য শাড়িটা ছেপাচ্ছে সে। একটু বেশি সাজগোজ না করলে তার চলে না। সর্দার মিস্তিরিরা তাকেই আবার একটু বেশি কদর করে কিনা। পাটঘরে কাজ করে সে। পাটঘরের সর্দার তো ছেদিকে গিলে খাওয়ার জন্য জুলুম শুরু করেছে প্রায়। মদানাগুলোর আদেখলেপনা আর আহামুকি দেখলে না হেসে পারে না সে। তাই হাসি তার কারণে অকারণে লেগেই আছে। আগামীকালের জলসায় লিবারবাবু থেকে শুরু করে সর্দার মিস্তিরি কুলি কামিনেরা আগে তাকেই দেখবে। সে কথা মনে করে মনের মতো করে শাড়ি ছেপায় সে। সঙ্গে আবার একটা ছোট্ট হাফশার্টও ছোপায়। জাত তো খুইয়ে বসে আছে সে, একথা সবাই জানে। তাই নাম-গোত্রহীন কুড়িয়ে পাওয়া একটা কালো কুকুতে ছেলেকে পোষে সে। সেই ছেলেটার জামাও ছুপিয়ে নেয়। জলসা তো সেও দেখবে।
মনোহরের মেহেরারু পালিয়ে গেছে। সেই থেকে ও একলাই থাকে। বড় ক্ষীণজীবী আর খেকুঁড়ে সে। ডগদর তাকে দাওয়াই খেতে বলেছিল। খাচ্ছিলও সে। কিন্তু এখন আর খাওয়া হয় না। তখন ওর বহু কাজ করত, পয়সা দিত দাওয়াইয়ের। কিন্তু হারামজাদীর তা সইল না। এমন মদীনার ঘর ছেড়ে—জোয়ান একটা ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে নতুন ঘর বেঁধেছে সে। মনোহর রোজ কাজ থেকে এসে খাটিয়াটায় গা ঢেলে দেয়। আজ মাঠের দিকে মুখ করে শুয়েছে সে। জলসার সাজগোজ দেখছে। খুব ভারী জলসা হবে, আয়োজন দেখে বুঝতে পারে। অনেকদিন লোকজনের সঙ্গে মেশামেশি ছেড়ে দিয়েছে মনোহর। কিন্তু জলসার বিচিত্র রংদার সাজানো দেখে কালকে যাবে বলে এনতাম করতে থাকে। একটা কটুক্তি করে মনে মনে ভাবে যে সেই রেন্ডিটাও কাল আসবে হয় তো। অর্থাৎ ওর পালিয়ে যাওয়া বউ। আসুক, কস্বীটার দিকে সে ফিরেও তাকাবে না। কিন্তু জলসায় সে যাবে। কেন না জলসার এমন আয়োজন সেই পাো আগস্ট ছাড়া আর হয়নি।
ভারী ভারী আদমিদের তসবিরগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সে। গান্ধীবাবা, জওহরলাল, সর্দার বল্লভভাই পাটিল।
সবচেয়ে বেশি খুশিয়ালি ভাবটা বিহারি লাইনে।
ধুলো-মাখা নেংটি পরা একদল ছেলে একটা পুরনো জংধরা টিনের ওপর লাঠি দিয়ে পিটছে আর রঘুপতি রাঘব রাজারাম গাইছে। আগে ওরা সিনেমার দু-এক কলি গাইত, অথবা রামলীলার একআধ কলি। আজকাল গান্ধীবাবার ওই গানটাই শিখে নিয়েছে। ও ছাড়া গান নেই এখন। কালকে জলসার ওখানে খানা মিলবে, এ আলোচনাও হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। পুরিতরকারির একটা রসালো আয়োজনের কল্পনায় ওরা ছাগলবাচ্চার মতো লাফাতে মশগুল।
বাটনা বাটতে বাটতে বদন জিজ্ঞেস করে শুকালুকে কাঁ হো শুকালু, গান্ধী বাবাকি তর্পণকে লিয়ে জলসা হো রাহা হ্যায়?
শুকালু একটু ধার্মিক গোছের লোক। জাতে সে মুচি, তাই ধর্মের গোঁড়ামি তার বেশি। পণ্ডিতের মতো গম্ভীরভাবে বলে সে, হাঁ। রোহিতাসকে গানা ভি হোগা। অর্থাৎ হরিশ্চন্দ্রের পুত্র রোহিতাশের আখ্যানও গীত হবে। এটা হল শুকালুর পাণ্ডিত্যের আন্দাজি কথা। কারণ রোহিতাকে গানা অনেকে তার কাছে শুনতে আসে। বদন গোয়ালা হলেও মুচির কথায় তার অখণ্ড বিশ্বাস। রোহিতাশ্বের গান হবে শুনে সে খুব খুশি। ভুলেই গেল যে, এতক্ষণ সে শঙ্কিতচিত্তে শাহুজির অপেক্ষা করছিল। সুদের টাকা জোগাড় হয়নি। জিজ্ঞেস করল, তুম্ গাওগে?
শুকালু ঠোঁট কুঁচকে এমন ভাব করল যে তেমন বেতমিজ সে নয়।
কানের পিঠে হাত দিয়ে মহাদেবও গান ধরেছে, কালী কেলকাত্তামে বৈঠল বারম্বার ভারতমে। মা কালী বার বার কলকাতাতেই আস্তানা গড়ে বসলেন, সে কথা শোনার জন্যে এ গান গায়নি মহাদেও। তার খুশির কারণ, কাল শুক্র হপ্তার দিন আর জলসা, পরশু শনিবার আধবেলা কাম, তারপর এতোয়ারজংলা ঘুমে যাওয়ার দিন। মানে, শহর ছেড়ে মাঠে ঘাটে বেড়াতে যাওয়াকে ওরা বলে জংলা ঘুমে যাওয়া। চিরকালের গেঁয়ো মেঠো চাষী সে। নোকরি খাতিরে এখানে এসেছে। তাই এতোয়ার এলেই জংলা ঘুমতে যাওয়াটা তার পক্ষে খানিকটা অভিসারে যাওয়ার মতো।
চন্দ্রিকা লকড়ি কাটতে কাটতে এক একবার জলসামঞ্চের দিকে দেখছে আর তার জেনানা সুভদ্রার সঙ্গে খাপছাড়াভাবে দুচারটে কথা বলছে। সুভদ্রার এখন ভরা পেট। অর্থাৎ অভি লেড়কাহেনেবালি। যে কোনওদিন যে কোনও মুহূর্তে দরদ উঠে বেঁকে দুমড়ে পড়লেই হল। তাই চন্দ্রিকাই এখন কাজকর্ম দেখাশোনা করে। ওর বহু এই পয়লা লেড়কাহেনেলি। ভয়ের কারণ তো একটু আছেই তা ছাড়া চন্দ্রিকার উদাস্ মনটাও আজকাল একটু চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বেহা হওয়ার বহুদিন পরে ওকে একটা বাচ্চা দিতে তৈরি হয়েছে ওর বহু। আদর আর কৃত্রিম ক্রোধে ধমকে ওঠে চন্দ্রিকা—নেহি। সুভদ্রার এখন ও-সব জলসা উত্স দেখতে যাওয়া চলবে না। জাহ্নবী মাতার ভরা বর্ষার মতো পেটের অবস্থা, এখন উজবুকের মতো যেখানে সেখানে যাওয়া চলে?
সুভদ্রা এইটুকুতেই দমে যায়। আসলে চন্দ্রিকা ভয়ানক গোঁয়ার বলে কৃত্রিমতাটুকু ধরা পড়ল না ওর চোখে। মুখ বুজে, আটার ভুসি চালতে থাকে সে। কিন্তু জলসাটা খুব বঢ়িয়া হবে। তার নিজেরও একটা আকর্ষণ রয়েছে সেদিকে। লড়ি ফাঁড়তে ফাঁড়তে খুব অবহেলাভরেই আপনমনে বলে সে, অবস্থা সমঝে ব্যবস্থা হবে। নিতান্তই যদি কালকেই সুভদ্রা কাত না হয়ে পড়ে তবে না হয় ভিড় গোলমাল বাঁচিয়ে একবার ঘুরে আসা যাবে।
নারদ ঘরের মধ্যে হাততালি দিয়ে নাচছে। লোকে দেখলে তাজ্জব ববে তো বটেই, পাগলও মনে করবে নারদকে। ওর বাড়ি হল বিহারের সীমান্তে। আর সীমান্তের লোকেরা সাধারণত বেপরোয়া গুণ্ডা প্রকৃতির লোক হয়। নারদের লম্বা চওড়া চেহারাটা দেখেও সেই রকমই মনে হয়। বিহারিরাও ওকে সেই চোখেই দেখে। নারদ খানিকটা বিদ্রোহী আর রুক্ষ মেজাজের লোক। হাসতে সে জানে না, কথা বলে খুব কম আর আস্তে। ওর প্রতি লোকের ঘৃণা যত আছে, ভয় আছে তার চেয়ে বেশি। বিশেষ করে ওর ওই সর্পচক্ষুকে। চোখের পলক পড়ে না ওর।
কিন্তু নারদও হাসে নাচে গায় বোধ হয় আর সকলের চেয়ে একটু বেশিই। তবে সকলের সামনে নয়। ঘরের মধ্যে, ওর মেয়ে পাতিয়ার সামনে। আজ ষোলো সাল মেয়েটাকে জন্ম দিয়ে বহু মরেছে। আর শাদি করেনি সে। একমাত্র মেয়েটার জন্যেই। পূর্বজন্মে রামজির কাছে কী পাপ করেছিল সে কে জানে, তার লেড়কিটা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিয়েছে। কোমর থেকে মাথা অবধি অপূর্ব সুগঠিত চেহারা পাতিয়ার। ষোলো বছরের উজ্জ্বল যৌবন সর্বাঙ্গে সুস্পষ্ট। একমাথা কোঁকড়ানো চুল। কিন্তু কোমরের পর থেকেই কোন পিশাচ দেবতা যেন সব চেঁছে নিয়েছে। ঠ্যাং দুটো নেমেছে ঠিক পাকানো দুগাছি দড়ির মতো। লতানো দুমড়ানো লিলিকে। মুখ দিয়ে হারবখত নাল কাটে। নড়তে চড়তে পারে না, কথা বলতে পারে না। সারাদিন ঘরে পড়ে থাকে। বাপ এলে তার অদ্ভুত শিশুসুলভ মুখটিতে অপূর্ব হাসি ফুটে।
কালকে জলসায় নিয়ে যাবে একথাটা অনেকবার বলবার পর একটু সমঝে পাতিয়া যখন হেসে উঠল তখন নারদও উঠল নেচে। অর্থাৎ আমরা বাপ বেটিতে মিলে কাল খুব ফুর্তি করব। বলে ছমাসের বাচ্চার মতো টুক করে পাতিয়াকে কোলে নিয়ে একটু আদর করে তাকে বোয়াকে বসিয়ে দিয়ে বালতি নিয়ে নারদ জল আনতে যায়। পাতিয়া একমুখ গড়ানো নাল নিয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে জলসামঞ্চটার দিকে।
নারদের মনে পড়ে, পাতিয়াকে নিয়ে নিতে চেয়েছিল এখানকার ধনী মহাজন শয়তানের রাজা ওই শাহুজি। অত্যন্ত ঘৃণায় প্রত্যাখান করেছিল সে। কথাটা শুনে কেউ কেউ বলেছিল—শাহুজির নাঙ্গা ফকির দিয়ে ভিখ মাঙা দলের ব্যবসা আছে। সেই জন্যই ও পাতিয়াকে চায়। আবার কেউ বলেছিল আসলে শাহুজির মতো বিদঘুটে শয়তান পাতিয়াকে বহুর মতো ঘরে নিয়ে রাখতে চায়। নারদের ইচ্ছা হয়েছিল হাতুড়ি দিয়ে বেতমিজ কমিনাটার মাথাটা টুটাফাটা করে দেয়। তার বড় আদরের, বড় বেদনার লাল ওই পাতিয়া। তার দিল দরদ সমস্ত আচ্ছন্ন হয়ে আছে ওই পাতিয়াকে ঘিরে। জলসার বঢ়িয়া আয়োজন দেখে ভারী খুশি সে। নাল মোছর গামছাটা এক কাঁধে আর পাতিয়াকে এক কাঁধে নিয়ে সে যাবে কাল জলসা দেখতে। ভারী খুশি হবে পাতিয়া।
.
বিহারি লাইনটার পরই মাদ্রাজি লাইন।
কাঁচা হলুদ মাখা মুখে মেয়েদের আর মুখে চুরুট গোঁজা পুরুষের ভিড় এখানে। লাইনের নর্দমায় দশ বারোটি ছেলেমেয়ে সারি সারি বসেছে মলমূত্র ত্যাগ করতে আর আলোচনা চলেছে জলসার।
জোয়ানের দল নিজেদের তেলেগু ভাষায় কালকে সীতা-উদ্ধার নাটক করবে ভেবেছিল। কিন্তু জলসার আয়োজন দেখে বন্ধ করে দিয়েছে। নাটক মানে শুধু গান। মুখে রং মেখে রাম, সীতা, রাবণ ইত্যাদি সেজে যে যার ভূমিকায় খানিকটা হম্বিতম্বি করবে আর ঘুরে ঘুরে গান করবে। কিন্তু জলসার ব্যাপারেই আজ তারা মেতে উঠেছে বেশি। ওদের মধ্যে আপ্পারাওয়ের গুল ওড়াতে ওস্তাদির খ্যাতি আছে। জলসা সম্বন্ধে নানানরকম কথা শুনতে শুনতে খুব গম্ভীর হয়ে বলে ফেলল সে যে বাবুসাহাব অর্থাৎ কপূর সিং কালকে তাকে জলসায় রাবণের সঙ্গে রামের যুদ্ধাখ্যানটুকু গান করতে বলেছে। আপ্পারাওয়ের বউ সরমা আবার এ সব ঝুটা ইয়ারকি বুঝতে পারে, সইতে পারে না। সে বসে বাসন মাজছিল। হঠাৎ তার ঠোঁটের ওপর ঝুলে পড়া নাকের প্রকাণ্ড নথ নেড়ে মুখ বাটা দিয়ে বলে উঠল, এঃ বাবু সাহাব আর লোক পেল না!
স্বভাবতই ইয়ার-আদমিদের সামনে স্বামীত্বের অপমানবধে রামরাবণের যুদ্ধের পালাটা ওদের স্বামী-স্ত্রীতেই শুরু হয়।
থামাবার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল।
অনুরূপ অবস্থা পাশের লাইনে ওড়িয়াদের মধ্যেও শুরু হয়েছে।
ওড়িয়া লাইনের বিশেষত্ব এখানে মেয়েমানুষ নেই। কারণ ওরা বলে, বিদেশ মুলুকে মেয়েমানুষ আনলেই নাকি খতম্।
ঝগড়া লেগেছে অর্জুনের সঙ্গে গৌরাঙ্গের। থামাবার চেষ্টা করছে জগন্নাথ। অর্জুন বলেছে ভুবনেশ্বরে যে জলোসা হয়েছিল তা এর চেয়ে ভাল কারণ সে নিজের চোখে তা দেখে এসেছে। গৌরাঙ্গের এতে আপত্তি আছে। কারণ অর্জুনের দেশ ভুবনেশ্বর। তাই ভুবনেশ্বরের চেয়ে এ জলোসা অনেক ভাল। নইলে বাবুসাহেব আর লিবারবাবু সাদা টুপি মাথায় দিয়ে খাটতে আসিল কাঁই?
এদের দ্রুত কিচিরমিচির সত্ত্বেও সামনেই বসে বহুকষ্টে কেনা শখের বস্তু হারমোনিয়ামটা কোলের কাছে নিয়ে মাধব তারস্বরে গান ধরছে–নন্দের নন্দন বক্কাকোঁ রাই। মনে তার বহু দুর্ভাবনা। দেশ থেকে চিঠি এসেছে, এ দফায় বেশি টঙ্কা না পাঠাতে পারলে মহাজনের ধার শোধ হবে না। জমি বেহাত হতে পারে। তবু আজ জগরনাথের মন্দিরের মতো জবরজং জলসামঞ্চ দেখে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে সে। কিন্তু গান থেকে নিরস্ত হতে হল তাকে।
কারণ গৌরাঙ্গ ঠাস করে একটা চড় কষিয়েছে অর্জুনের গালে। আর অর্জুন সড়া বলে হুঙ্কার দিয়ে একটা চেলা কাঠ কুড়িয়ে নিয়েছে।
ক্রমশ আন্ধেরা ঘনিয়ে এল। আর অমনি জাদু-ই-নগরীর মতো লাইনের ময়দানটা দিন মাফিক আলোয় উঠল হেসে। রাতভর কাজ হবে তা হলে আজ? জলসা সম্বন্ধে এবার সবাই আরও ঘোড়া বহুত সজাগ হয়ে উঠল। কারখানার মানিজার সাহাব এল মেমসাহাব আর বাবাকে (ছেলেকে) সঙ্গে নিয়ে।
হাত নেড়ে নেড়ে বুঝিয়ে দিতে লাগল লিবারবাবু আর সাহাব, মাথা নেড়ে নেড়ে বুলাড়ি ডাম্ গুড, বহুট আচ্ছা প্রভৃতি বহুৎ খুশিয়ালি বাত করতে করতে হাসতে লাগল। সাহাব আর লিবারবাবুর হাসি দেখে লাইনের খানিকটা ডর তাজ্জবে ঘাবড়ানো মুখগুলোতে দেখা দিল হাসি। সকল তাজ্জব মানল তখন—যখন মানিজার সাহাব বাবুসাহাব কপূর সিংকে দেখে চিল্লিয়ে জোয়হিড বলে সালাম দিল। হাঁ, সাহাবকেও জয়হিন্দ বলতে হয়।
হাঁ হাঁ আপনা কান মে শুনা হম। বলে এ ওর কাছে বঢ়ি একটা বাহাদুরি নেওয়ার ফিকিরে বুক ঠুকতে লাগল।
তারপর রাত্রি তার দুনিয়ার ক্লান্তি নিয়ে ঘুম হয়ে নেমে এল লাইনের বুকে। এখানে সেখানে মারীবীজের মতো লাইনের আনাচে কানাচে খাটিয়া আর চাটাই ভরতি মানুষ। তবু এরই মধ্যে চলেছে বহু প্রবৃত্তির খেলা। হাসি কান্না গান। এমন দুর্বিষহ গুমোট আলোবাতাসহীন পায়রার মতো খোপগুলোতেও নরনারীর আদিম প্রবৃত্তির উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে তবু। অবিকল দুনিয়ার যান্ত্রিক গতির মতো।
পরদিন বিহানে কাজে যাওয়ার সময় সবাই তাজ্জব। হ জলসামঞ্চ বটে! মঞ্চের চার তরফ ঘিরে সাদা আর গৈরিক টোপি শিরে চড়িয়ে ফৌজি কুচকাওয়াজের মতো স্বেচ্ছাসেবকের দল ডাহিনে ঘুম, সামনে চলো করছে। বাবু সাহাব কপূর সিং, মজুদর লিডর বাবু রঘুনাথরাও সব বঢ়ে বঢ়ে আদমি এসেছে।
খুব ভারী জলসা হবে—হাঁ। ন জানে ক্যায়া হো র্যহে, এমনি একটা সশ্রদ্ধ মুখভাবে ছেদি তার কুড়ানো লেড়কাটাকে ছটা পয়সা দিয়ে বলে, যা, চা উ পিলে। কাঁহি যানা মত। বলে কারখানায় ঢুকে পড়ল।
কুনথি জলসামঞ্চের রংদারি আর কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে কোলের বাচ্চাটাকে অন্যমনস্ক ভঁইসের মতো মাই খাওয়াচ্ছিল। হঠাৎ একদম লাস্ট বনশি (ভোঁ) বেজে উঠতেই সামনে বড় লেড়কাটার কাছে তাকে ছেড়ে দিয়ে কারখানায় ঢুকে পড়ল।
শালা কুত্তাকে বাচ্চা! দাঁতে দাঁত ঘষল নারদ বাবুসাহেবের সঙ্গে শাহুজিকে দাঁত বের করে রঙ্গ করতে দেখে। পরমুহূর্তেই জলসার আয়োজন দেখে চিরকালের গোমড়া মুখে হেসে বলে পাশের লোককে হাঁ, ইয়ে হ্যায় জলসা!
আপ্পারাও আর সরমা তো দাঁড়িয়েই পড়ল ফৌজি কুচকাওয়াজের রকম দেখে।
আরে বাপ্প! এর বেশি আর অর্জুনের মুখ দিয়ে বেরুল না।
খানেকা টাইমে (টিফিনে) দেখা গেল একটা যন্ত্র মুখের কাছে নিয়ে মঞ্চের ওপর থেকে একজন অচেনা আদমি চিল্লাচ্ছে বান্, টু, থিরি, ফোর…। আর সে কথাগুলো চতুর্গুণ জোরে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কঁহা কঁহাসে বহুত আদমি এসেছে। প্যাঁ পো করে স্বেচ্ছাসেবকের দল একটা তামার মোটা বাঁশি বাজাচ্ছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে ফৌজি কায়দায়।
উৎসবের উল্লাস জমাট বেঁধে উঠছে প্রতিমুহূর্তে।
কিন্তু বেলা তিনটের সময় হঠাৎ একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো কারখানার ভেতর সহস্র গলার একটা উত্তেজিত গর্জন ফেটে পড়ল।
আভি জলসা শুরু হো রাহে! সেই সময় জলসামঞ্চ থেকে মোটা গম্ভীর গলায় ভেসে এল ঘোষণা। তারপর জলসার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। পাঁড়েজি ফুল বেলপাতা নিয়ে গান্ধীবাবার পায়ে দিয়ে প্রার্থনা মন্ত্রোচ্চারণ আরম্ভ করে। ধূপ আর কর্পূরের পবিত্র গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠল চারো তরফ। করুণ কণ্ঠে গীত ওঠে—হ্যায় বাপুজি, হুঁ কঁহা চলা গ্যায়ে!…।
এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই কারখানার ভেতর থেকে কেমন একটা আক্রমণাত্মক ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো ভেসে এল।
কী ব্যাপার?
মানিজার সাহাবকে ঘেরাও করেছে কুলি কামিনের দল।
মগর কাঁহে?
লিখা পড়ি নেই, বাত পুছু নেই, হাজারো আদমিকে বুঢ়বক বানিয়ে দিয়ে হঠাৎ মালিক লোটিশ ছেড়ে দিল, এগারোশো আদমি ছাঁটাই হল। কারণ, কয়লা নেই, মালিকের আর্ডার নেই, কাম নেই। বেকার আদমি রেখে নাফা কী আছে?
পয়লা ছেদিই হাতের রূপোর ভারী কঙ্কনসুদ্ধ ঠাস করে কষালে এক ঘা সাহাবের কপালে।—আরে এ কমিনা, তোকার নাফা দেখতে, হাম ক্যায়া রেন্ডি বনে গা?
কার একটা খইনির ডিবা এসে পড়ল সাহাবের লাল টুকটুকে নাকের ডগায়।
বাইরে থেকে জলসার মিষ্টি বাদ্যধ্বনি ভেসে এল। তার সঙ্গে গান্ধী মহারাজ কি জয়ধ্বনি।
মানিজার সাহাব থোড়া কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু বেতমিজ কুলি কামিনদের হায় ড়ুবে গেল তা। শেষটায় সাহাব বেশ খানিকটা জোরে হেঁকে উঠল, শুনো, হাম্ বোল্টা হ্যায়, জোয়হিন্ড।
—তেরি জোয়হিন্ডকে-গোঁয়ার চন্দ্রিকা একটা খিস্তি করে রুখে এল।
সেই মুহূর্তেই ঘটল পুলিশের আবির্ভাব। প্রাণ ফিরে পেল মানিজার সাহাব। থানার বড়বাবু এসে ম্যানেজারকে আগলে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, তুম্ লোক যাও। ছুটি হো গয়া।
কেউ কেউ কাঁচা খেউর করে বলে উঠল, সাড়ে চার বাজে তারা ছুটি চায় না, পাঁচটায় তাদের ছুটি-রোজানা যেমন হয়।
আপ্পারাওয়ের বহু সরমা হঠাৎ বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল বড়বাবুর ওপর—রেভিকে বাচ্চা, দালালি করনে আয়া?
অকস্মাৎ এ রকম একটা আঘাতে বড়বাবু টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতেই হীরালালের মেহেরুর পায়ের মোটা বাজুসুদ্ধ ধাঁই করে কষালে তার মুখে এক জবরদস্ত লাথ।
জলসামঞ্চের সেই যন্ত্রটা থেকে উদাত্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল আপলোক চিন্নাইয়ে মত, আভি গান্ধীবাবাকি কহানি শুরু হে রাহে। শারহিয়ে আপলোক।
-বেয়নেট চার্জ কর ব্যাটারা। ককিয়ে উঠল বড়বাবু।
হুকুমমাত্র সশস্ত্র সিপাহিলোক ঝাঁপিয়ে পড়ল খোলা কিরীচ নিয়ে কুলি কামিনদের ওপর।হট যাও, হট চলো!…
হটাতে হটাতে সবাইকে নিয়ে এল একদম লাইনকে অন্দর। তারপর চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল লাইনটাকে সশস্ত্র সিপাহিদল। লাইন ঘিরে তৈরি হল এক অচ্ছেদ্য বহ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। জলসামঞ্চের চার তরফে আলোকমালা হেসে উঠল। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে মজদুর-লিডর বাবুরঘুনাথ রাও গান্ধীবাবার কহানি বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন।
সিপাহি-ব্যুহের ভেতর থেকে লাইনের মানুষগুলো কেমন বোকার মতো ভরপুকে হ করে চেয়ে আসছে মঞ্চটার দিকে। হাঁ, বহুত ভারী জলসা হচ্ছে। পুরিও ভাজা হচ্ছে। ঘিউর মিঠা বাস এসে লাগছে ওদের নাকে।
রাত্রের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই নিঃশব্দে একটা কালোগাড়ি এসে দাঁড়াল লাইনের সামনে। তারপর বেছে বেছে লোক ওঠানো হতে লাগল তার মধ্যে।
চন্দ্রিকার বহু প্রসব-বেদনায় এলিয়ে পড়েছে রোয়াকে। চন্দ্রিকাকে তখন সিপাহিরা জোর করে ঠেলে তুলে দিচ্ছে গাড়িটার মধ্যে।
গান্ধীবাবার কহানি শেষ হতেই জলসামঞ্চ গীত-উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল। আলো ঝলমলে উৎসব।
লাইনের মানুষগুলো যেন কী এক বিভীষিকা দেখছে—এমনি বড় বড় ভয়ার্ত চোখে একবার জলসামঞ্চ আর একবার কালোগাড়িটাকে দেখতে থাকে।
চন্দ্রিকা, হীরালাল, ফুলমহম্মদ, বৈজু, আপ্পারাও, হাফিজ,…বাইকে ঠেলে ঠেলে ওঠাতে লাগল সিপাহি সেই গাড়িটার।
নারদ টুক করে পাতিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে, টাট্টিখানার পেছন দিয়ে মলমূত্র মাড়িয়ে উর্বশ্বাসে ছুটল। এসে উঠল একেবারে শাহুজির মোকামে। শাহুজি চশমা চোখে দিয়ে টাকা পয়সার হিসাব কষছিল। হঠাৎ চমকে তাকাতেই দেখল পাতিয়াকে কোলে নিয়ে নারদ এসে হাজির। নারদ পাতিয়াকে শাহুজির সামনে রেখে দিয়ে বলে উঠল; লে লেও পাতিয়াকো।
শাহুজি আর পাতিয়া সমান বিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে রইল নারদের দিকে। পরমুহূর্তেই হে-হে করে হেসে উঠল শাহুজি।–হাঁ হাঁ, মালুম হো গিয়া, মালুম হো গয়া। ঠিক হ্যায়!…বলে লোলুপ দৃষ্টিতে পাতিয়ার সুগঠিত উদেহটাকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে লাগল সে। উগ্র লোভানিতে জ্বলজ্বল করে উঠল তার শকুনের মতো চোখ দুটো পাতিয়ার বুকটার দিকে চেয়ে। নারদের দম বন্ধ হয়ে এল। রক্ত বেরিয়ে আসবার উপক্রম হল চোখ ফেটে। বলল, উসকো দুবেলা পেট ভকে খানা দেও, ব্যস্ ঔর কুছু নেহি।
এতক্ষণে বিস্ময় কাটিয়ে শাহুজির চোখ দেখে পাতিয়ার মনে একটা ভীষণ সন্দেহ হয়। মুখ দিয়ে নাল আর চোখ দিয়ে জল একসঙ্গে গড়িয়ে এল তার। কথা বলতে পারে না। একটা জানোয়ারের বাচ্চার মতো নারদের দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে আঁউ আউ করে উঠল সে।
ছিনাটা ফেটে যাবার মতো হল নারদের। কানে আঙুল দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল সে সেখান থেকে।
একটা আচমকা গর্জন করে আবার নিঃশব্দে মানুষ ভরতি কালো গাড়িটা লাইনের সামনে থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
জলসামঞ্চে তখন গীতবাদ্যে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়েছে। গায়কেরা যেন খেপে গেছে। বাবু রঘুনাথ রাও ঢোলক পিটছে, বাবু সাহাব গান করছে, আর সবাই দোয়ারকি টেনে চলেছে রঘুপতি রাঘব রাজারাম!…অচেতন খেপা অবস্থায় মঞ্চ কাঁপিয়ে সবাই গেয়ে চলেছে।
ছেদির সেই কুড়ানো কালো কুকুতে ছেলেটা অন্ধকারে নারদকে চলতে দেখে বলে উঠল, হাঁ–বহুত্ ভারী জলসা হোতা হ্যায়! বঢ়িয়া জলসা!…