Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে শারমিন হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু তুমি কী ভূতে বিশ্বাস করো?”

লাবনী চোখের কোনা দিয়ে মেয়েকে এক নজরে দেখে বলল, “তুই বিশ্বাস করিস?”

শারমিন বলল, “আমি আগে জিজ্ঞেস করেছি। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

লাবণী প্লেটে একটু ভাত নিতে নিতে বলল, “ভূত বিশ্বাস করি কী না জানি না তবে পেত্নী বিশ্বাস করি।”

শারমিন হেসে ফেলল, বছর দুয়েক আগে তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে।

নীলা নামের কমবয়সী যে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্যে শারমিনের বাবা সাজ্জাদ তার স্ত্রী-কন্যাকে ছেড়ে চলে গেছে তাকে। এই বাসায় পেত্নী বলে সম্বোধন করা হয়। নীলার চেহারা খারাপ নয় কিন্তু একজন মানুষকে অপছন্দ করলে তার সবকিছুকেই খারাপ লাগে।

শারমিন বলল, “আম্মু সত্যিকার ভূতের কথা বলছি।”

“সত্যিকার ভূত?”

“হ্যাঁ।”

লাবণী বলল, “তুই যদি এখন আমাকে জিজ্ঞেস করিস যখন লাইট জ্বলছে, ফ্যান

ঘুরছে, টেলিভিশন চলছে, আশেপাশে লোকজন-তখন আমি বলব, ভূত বলে কিছু নাই!

কিন্তু মনে কর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি, রাত্রিবেলা জোছনার আলোতে বারান্দায় বসেছি। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ে বাতাসের শিরশির শব্দ হচ্ছে দূরের গোরস্তান থেকে শেয়াল ডেকে উঠল, তখন যদি জিজ্ঞেস করিস ভূত বলে কিছু আছে কী না তখন আমি বলব, ইয়ে মানে পৃথিবীতে ব্যাখ্যা করা যায় না সেরকম তো কত কিছুই আছে! ভূত তো থাকতেও পারে।”

শারমিন গম্ভীর মুখে বলল, “তার মানে তুমি পরিষ্কার করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।”

লাবণী বলল, “কে বলেছে দিলাম না? আমি বলেছি ভূত বলে কিছু নাই কিন্তু ভূতের ভয় আছে!”

শারমিন হি হি করে হেসে উঠল, বলল, “তুমি যে কী অদ্ভুত কথা বলো আম্মু! একটা জিনিস যদি না থাকে তাহলে তার ভয়টা থাকে কেমন করে?”

“থাকতে পারে না?”

“না।”

“মাকড়সা?”

শারমিন একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে মাকড়সায়?”

“তুই মাকড়সাকে ভয় পাস না? এইটুকুন ছোট একটা। মাকড়সাকে দেখলে তুই চিৎকার করে ছুটে পালাস কি না?

“হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?”

এই রকম ছোট একটা মাকড়সাকে ভয় পাওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি আছে? এই মাকড়সা তোকে খেয়ে ফেলবে?

শারমিন বলল, “সেটা তো অন্য জিনিস। মাকড়সাকে দেখলেই কেমন গা শিরশির করে ওঠে–”

লাবণী বলল, “একই জিনিস। ভয় পেতে হলে তার পেছনে যুক্তি থাকতে হয় না। এইটুকুন মাকড়সাকে ভয় পাবার কিছু নাই কিন্তু তুই ভয় পাস। ভূত বলে কিছু নাই কিন্তু মানুষ ভূতকে ভয় পায়।”

শারমিন হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার যুক্তি হচ্ছে একেবারে উল্টাপাল্টা যুক্তি। তুমি তোমার ছাত্রীদের কী পড়াও খোদাই জানে। সব নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে এসো।”

“ছাত্রী–এত দূরে যাচ্ছিস কেন? তুই কী দোষ করলি। তোকে উল্টাপাল্টা কিছু শিখাই নাই?”

“নিশ্চয়ই শিখিয়েছ, আমি যেটা টের পাই না। আমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই টের পায় আর আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

শারমিন কিছু বলল না, হয়তো আম্মুর কথাই ঠিক। বিচিত্র জিনিস আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা সুন্দর। সবকিছু যদি ছকে বাঁধা নিয়ম মাফিক হতো তাহলে পৃথিবীটা হয়তো একঘেয়ে হয়ে যেত।

এই অক্টোবরে শারমিনের বয়স হবে আঠারো। লাবণী খেতে খেতে মেয়ের দিকে তাকাল, যে বাবা তাকে ছেড়ে চলে গেছে মেয়েটার চেহারায় সেই বাবার চেহারার একটা ছাপ আছে। ঠিক কোথায় সে ধরতে পারে না, হয়তো চোখে কিংবা কথা বলার ভঙ্গিতে। এই কথা বলার ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হয়ে লাবণী এক সময় সাজ্জাদকে পাগল হয়ে বিয়ে করেছে। কে জানে এই কথা বলার ভঙ্গি দেখেই মুগ্ধ হয়েই হয়তো নীলা নামের কমবয়সী মেয়েটাও তার সংসারটা ভেঙে নিয়ে চলে গেছে। দুই বছর আগের ঘটনা কিন্তু এখনো বুকের ভেতর কেমন যেন দগদগে একটা ঘা। এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে সেটা লাবণী স্বপ্নেও বিশ্বাস করত না, অথচ ঠিক তার জীবনেই এটা ঘটে গেল। যে মানুষটার জন্যে সে সবকিছু দিয়ে দিতে পারত তার জন্যে এখন কোনো অনুভূতি নেই।

লাবণী ভেবেছিল সাজ্জাদের জন্যে বুঝি তার বুকের ভেতর একটা তীব্র ঘৃণা থাকবে। কিন্তু সেটিও নেই। কে জানে কোনো অনুভূতি না থাকা হয়তো তীব্র ঘৃণা থেকেও ভয়ংকর।

লাবণীর জন্যে পুরো ব্যাপারটা ছিল খুব কষ্টের কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সামলে নিয়েছে। শারমিন সামলে নিতে পারেনি। সাজ্জাদের সাথে তার ভিন্ন একটা জগৎ ছিল, বাবা এবং মেয়ের ভালোবাসার জগৎ। সেই জগৎটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। শারমিন মাঝে মাঝে সাজ্জাদের সাথে দেখা করতে যায় কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে কিংবা কোনো শপিংমলে কেনাকাটা করতে কিন্তু লাবণী বুঝতে পারে সুরটুকু কেটে গিয়েছে। বাবার জন্যে ভালোবাসাটুকু আছে কিন্তু তার সাথে বিচিত্র একটা বিতৃষ্ণা এসে যোগ হয়েছে। একজন মানুষকে কী একই সাথে ভালোবাসা এবং ঘৃণা করা যায়? দুই বছর আগে স্ত্রী-কন্যাকে ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে শারমিন অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার ওপর বিচিত্র একটা বিষণ্ণতা এসে ভর করে। নিজের ঘরে দিনের পর দিন চুপচাপ বসে থাকে।

লাবণী কী করবে বুঝতে পারে না, বিষয়টা নিয়ে কোনোরকম বাড়াবাড়ি না করে শান্তভাবে মেনে নেবার চেষ্টা করে। মেয়েটা বুদ্ধিমতী তার নিজেকেই এই অবস্থা থেকে একদিন বের হয়ে আসতে হবে।

লাবণী শারমিনের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল, “সে কী! পুরো সবজিটুকু রেখে দিলি মানে?”

“আমি মোটেই পুরোটুকু রাখিনি মা। তুমি আমাকে যেটুকু দিয়েছ সেটা নিয়ে এক পল্টন আর্মিও খেয়ে শেষ করতে পারবে যতটুকু খাওয়া সম্ভব ততটুকু খেয়েছি”

“ব্যস। অনেক বক্তৃতা হয়েছে-খা বলছি। খেয়ে শেষ কর। মাথা ভেঙে ফেলব তা না হলে।

শারমিন মুখটা কুঁচকে সবজিগুলো খুঁটে খুঁটে খেতে চেষ্টা করে। লাবণী খানিকক্ষণ সেটা লক্ষ করে বলল, “এবারে তুই বল।”

“কী বলব?”

“তুই ভূত বিশ্বাস করিস?”

“আমি?” শারমিন চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি ভূত বিশ্বাস করব? তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? আমাকে দেখে কী মনে হয় আমি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি?”

“কেন ক্ষতি কী বিশ্বাস করলে?”

“আম্মু তুমি কলেজের একটা টিচার হয়ে আমাকে ভূত বিশ্বাস করতে বলো?”

“আমি তোকে ভূত বিশ্বাস করতে বলছি না।”

শারমিন বলল, “তাহলে কী বলছ?”

“আমি বলছি মানুষের জীবনে একটু কল্পনা থাকতে হয়। শুধু কাঠখোট্টা মানুষের মতো যেটা সত্যি সেটা বিশ্বাস করলে হয় না-কিছু কল্পনার জিনিসও বিশ্বাস করতে হয়। আইনস্টাইন কী বলেছেন জানিস না?”

“জানি জানি আম্মু। তুমি দিনে দশবার করে মনে করিয়ে দাও, না জেনে উপায় আছে!”

লাবণী বিজয়ীর মতো বলল, “তাহলে?”

“আম্মু, আইনস্টাইন মোটেও ভূত বিশ্বাস করতে বলেননি, বলেছেন ইমাজিনেশন ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান নলেজ। জ্ঞান থেকে কল্পনা বেশি ইম্পরট্যান্ট।”

“একই কথা। ভূত কী আছে? নেই! তাহলে ভূতকে পাব কেমন করে? কল্পনায়। ইমাজিনেশনে। তুই জানিস পৃথিবীতে কতো ফাটাফাটি ভূতের গল্প আছে?”

শারমিন মাথা নেড়ে বলল, “তোমার যুক্তিগুলো খুবই পিকুলিয়ার। পৃথিবীতে ফাটাফাটি ভূতের গল্প আছে, সেই গল্পগুলো

এনজয় করার জন্যে ভূতকে বিশ্বাস করে বসে থাকি!”

লাবণী হেসে বলল, “এই যুক্তিটি তোর কাছে পিকুইলিয়ার মনে হচ্ছে? এটা একেবারে এক নম্বুরী যুক্তি।”

শারমিন বলল, “থাক আম্মু! থাক। তোমার সাথে তর্ক করার থেকে সাদিবের সাথে তর্ক করা সোজা।”

“সাদিবটা কে?”

“আমাদের সাথে পড়ে। একেবারে পাগল। শুধু পাগল না, পাগল এবং ছাগল!”

লাবণী হেসে বললেন, “কেন? কী করেছে?”

“কী করে নাই বলো। একেকদিন তার মাথায় একেকটা ঝোঁক আসে। তুমি বিশ্বাস করবে না মাঝখানে একবার ঠিক করল ঘাস খেয়ে থাকবে।”

“ঘাস?”

“হ্যাঁ। ঘাস। সেই ঘাস খেয়ে সিরিয়াস ডায়েরিয়া, হাসপাতালে থাকতে হলো পুরা এক সপ্তাহ। সেই থেকে সবাই ডাকে ছাগল।”

“আচ্ছা পাগল দেখি।”

“হ্যাঁ। এখন সে ব্ল্যাক আর্ট করে।”

লাবণী ভুরু কুঁচকে বলল, “ব্ল্যাক আর্ট?”

“হ্যাঁ। আমাদেরকেও শেখাচ্ছে।”

“কী শিখাচ্ছে?”

শারমিন মাথা নেড়ে বলল, “অনেক কিছু। সব তোমাকে বলাও যাবে না। যেটা সবচেয়ে সহজ সেটা এরকম। তুমি রাত্রিবেলা বাথরুমে দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়াবে। বাথরুমের লাইট নিভিয়ে এক কোনায় একটা ছোট মোমবাতি জ্বালাবে যেন আবছা অন্ধকার থাকে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাতচল্লিশ বার বলবে ব্লাডি মেরি–”

লাবণী বাধা দিয়ে বলল, “সাতচল্লিশ বার? সাতচল্লিশ বার কেন?”

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, “আমি জানি না। সাদিবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেও জানে না। মনে হয় সাতচল্লিশ প্রাইম নম্বর সেই জন্যে।”

“ভূতেরা তাহলে প্রাইম নম্বর বুঝে?”

“মনে হয় বুঝে।”

“ঠিক আছে। সাতচল্লিশ বার ব্লাডি মেরি বললাম তখন কী হবে?”

“তখন তুমি আয়নার ব্লাডি মেরিকে দেখবে।”

“ব্লাডি মেরিটা কে?”

“একটা ডাইনি। আমেরিকাতে নাকি সালেম নামে একটা শহর আছে সেখানে তাকে পুড়িয়ে মেরেছিল।”

“কে পুড়িয়ে মেরেছিল?”

“জানি না। মনে হয় শহরের লোকজন।”

“কবেকার ঘটনা?”

“তাও জানি না। অনেক আগেরই হবে। আজকাল কী আর কেউ কাউকে পুড়িয়ে মারে!”

লাবণী শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর সাদিব ব্লাডি মেরিকে দেখেছে?”

“এখনো ভালো করে দেখেনি। অবস্থা আবছা নাকি দেখেছে!”

লাবণী পানি খাচ্ছিল শারমিনের কথা শুনে হাসি চাপাতে গিয়ে বিষম খেল। বলল, “ব্লাডি মেরির চেহারা কেমন?”

“চেহারা এখনো স্পষ্ট দেখে নাই। ডাইনি বুড়ির চেহারা আবার কেমন হবে?”

লাবণী মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু চেহারা ভালো হবার কথা। আমেরিকান কমবয়সী ডাইনি রীতিমতো রূপসী হয়। তোর সাদিবকে বলিস আবার প্রেমে-ট্রেমে পড়ে না যায়।”

এইবার শারমিন হি হি করে হাসতে লাগল। বলল, “ভালোই বলেছ আম্মু–এটা সাদিবকে বলতে হবে। আয়নার এইপাশে সাদিব অন্যপাশে ব্লাডি মেরি। দুইজন দুইজনকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে। কিন্তু একজন আরেকজনের কাছে আসতে পারবে না।”

রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে শারমিন বাথরুমে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে বলল “ব্লাডি মেরি,” গুনে গুনে সাতচল্লিশ বার। আয়নায় কিছুই হলো না। কিছু একটা হবে সেটা অবিশ্যি সে আশাও করেনি! রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল তাকে পুড়িয়ে মারার জন্যে শহরের শত শত মানুষ তাকে ধাওয়া করেছে, সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ছুটছে। যখন তার ঘুম ভাঙল তখনো তার বুক ধুকধুক করছে, পুরো শরীর ঘামে ভেজা।

কয়দিন পর শারমিন ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে, লাবণী জিজ্ঞেস করল, “তোদের ব্ল্যাক আর্টের খবর কী? পাগল সাদিবের সাথে ব্লাডি মেরির দেখা হয়েছে?”

শারমিন দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সাদিব এখন তার গল্প পাল্টে ফেলেছে।

“কীভাবে পাল্টেছে?”

“এখন বলছে আসলে হঠাৎ করে বললে হবে না। সাধনা করতে হবে।”

লাবণী চোখ বড় বড় করে বলল, “সাধনা? প্রেতসাধনা?”

“হ্যাঁ। রীতিমতো প্রেত সাধনা।”

“সেটা কী রকম?”

“গরুর মাংস ডিম এসব খাওয়া যাবে না। রসুন খাওয়া যাবে না। সাদা রঙের সেলাই ছাড়া কাপড় পরতে হবে। প্রতি রাত বারোটার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লাডি মেরিকে ডাকতে হবে, টানা সাতচল্লিশ দিন বলার পর অমাবস্যার রাতে নাকি ব্লাডি মেরি আসবে।”

লাবণী হেসে ফেলল, বলল, “এত পরিশ্রম করলে শুধু ব্লাডি মেরি কেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টেরও চলে আসার কথা!”

“ঠিকই বলেছ। সাদিব অবিশ্যি বলছে ব্লাডি মেরি ছাড়া অন্যদেরও আনা যাবে। যার নাম বলবে সেই আসবে।”

তাহলে তো খারাপ হয় না। ইয়াহিয়া খানকে ডেকে আনলে হয়, তারপর ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে সিধে করে দিতাম।”

“না আম্মু ওরা খালি দেখা দিবে। আয়না থেকে বের হতে পারবে না।” লাবণী বলল, “তাহলে আর লাভ কী। বের করে একটা বোতলের ভেতর ভর্তি করে ফেলতে পারতাম তাহলে না মজার হত।”

শারমিন হি হি করে হেসে বলল, “সেটা ঠিকই বলেছ। বোতলে ভর্তি করে যদি ভূত বিক্রি করা যেত কী মজা হতো তাই না?

সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে শারমিন বাথরুমে দাঁত ব্রাশ করছে, হঠাৎ তার ব্লাডি মেরির কথা মনে পড়ল। সে দাঁত ব্রাশ করা শেষ করে বাথরুমের লাইটটা নিভিয়ে দেয়। বাথরুমের জানালা দিয়ে বাইরের এক চিলতে আলো ভেতরে এসে একটা আলো-আঁধারির মতো হয়েছে। আয়নায় নিজেকে আবছায়ার মতো দেখা যায়। শারমিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে সাতচল্লিশবার বলল “ব্লাডি মেরি”।

তারপর চোখ খুলে তাকাল, আয়নায় কিছুই দেখবে না সে খুব ভালো করেই জানে তারপরও নিজের আবছা প্রতিবিম্বটা দেখে একটু আশা ভঙ্গ হলো! ঠিক কী কারণ কে জানে শারমিনের মনে হচ্ছিল সে কিছু একটা দেখে ফেলবে। কী দেখবে সে জানে না কিন্তু আলৌকিক কিছু একটা।

বাথরুমের আলো জ্বালাতে গিয়ে সে থেমে গেল। সাদিব বলেছিল শুধু যে ব্লাডি মেরিকে ডাকা যায় তা নয় অন্য যে কোনো মৃত মানুষকেও ডাকা যায়। বেচারি ব্লাডি মেরিকে নিশ্চয়ই সবাই ডাকডাকি করছে। সারা পৃথিবীর সবার কাছে তার ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। সে তাহলে অন্য কাউকেই ডাকবে। দেখা যাক কী হয়।

শারমিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখ বন্ধ করল, হঠাৎ তার মনে হলে বাথরুমের আবছা অন্ধাকারে তার সাথে অন্য কেউও আছে। জীবনে যেটা হয়নি হঠাৎ করে তার সেটা হলো তার বুকের মাঝে ভয়ের কেমন যেন একটা কাঁপুনি স্পর্শ করে গেল। শারমিন ফিসফিস করে বলল, “যদি এই ঘরে আমার সাথে কোনো বিদেহী আত্মা থেকে থাকো, কোনো অতিপ্রাকৃত প্রাণী, কোনো ভূত কোনো প্ৰেত এসে থাকো তাহলে তুমি দেখা দাও। তুমি আসো তুমি আসো তুমি আসো”

গুনে গুনে সাতচল্লিশ বার বলার পর শারমিন থামল। সে এখন চোখ খুলে তাকাবে হঠাৎ করে তার বুকের ভেতর কেমন জানি ধক করে ওঠে। তার মনে হতে থাকে এই বাথরুমে তার সাথে অন্য কেউ আছে। শুধু তাই নয় তার মনে হয় সে যখন চোখ খুলে তাকাবে তখন আয়নায় সে নিজেকে দেখবে না, অন্য কাউকে দেখবে। শারমিন অল্প অল্প কঁপতে শুরু করে, মনে হতে থাকে বাথরুমটা বুঝি অসম্ভব ঠাণ্ডা, একেবারে হিম শীতল।

শারমিন বিড়বিড় করে বলল, “না। আমি চোখ খুলে তাকাব না। আমি হাতড়ে হাতড়ে লাইটের সুইচটা বের করে আলো জ্বালিয়ে দেব। প্রচণ্ড আলোয় সব কিছু ভেসে যাবে।”

শারমিন হাতড়ে হাতড়ে লাইটের সুইচটা বের করল, সুইচটা টিপে জ্বালানোর আগের মুহূর্তে তার ঠিক কী মনে হলো কে জানে। সে চোখ খুলে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্যে সে অশরীরী একটা আতঙ্ক অনুভব করল, কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যেই, চোখ খুলে সে আয়নায় নিজেকেই দেখতে পেল, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শারমিন আবছা অন্ধকারে নিজের প্রতিবিম্বটির দিকে তাকিয়ে থাকে, এটি তার প্রতিবিম্ব কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছে এখানে কিছু একটা গোলামাল আছে। গোলমালটা কী সে ধরতে পারছে শারমিন ভালো করে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। সে ডান হাতটা দিয়ে দেওয়ালে লাইটের সুইচটা স্পর্শ করে আছে কিন্তু আয়নার প্রতিবিম্বে দেখা যাচ্ছে দুই হাত দুই পাশে দিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কী সত্যিই তার প্রতিবিম্ব? নাকি অন্য কারো?

শারমিন তার মাথাটি ডান থেকে বামে দোলাল–প্রতিবিম্বটি নড়ল না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শারমিন আতঙ্কে একটা চিৎকার দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে লাইট সুইচটা টিপে দিতেই মুহূর্তে তীব্র আলোয় পুরো বাথরুমটা আলোকিত হয়ে যায়।

এতক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর হঠাৎ করে আলো জ্বালানোর ফলে শারমিনের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে আয়নার দিকে তাকাল, না আয়নায় অদ্ভুত কিছু নাই। তার নিজেকেই দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো শক্ত করে বাঁধা, গোলাপি ফুলফুল তার ঘুমের পোশাক। দুই চোখে একধরনের হতচকিত বিস্ময়।

শারমিন বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিল, পুরো বিষয়টা হঠাৎ করে তার কাছে ছেলেমানুষী মনে হতে থাকে। কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সত্যি সত্যি সে ভেবে বসেছিল যে আয়নায় সে অন্য কাউকে দেখছে! সেটা কী কখনো সম্ভব?

শারমিন ট্যাপ খুলে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে নিজের মুখ ভালো করে ধুয়ে নিতে শুরু করে তখনই শুনতে পেল বাইরে থেকে লাবণী ডাকছে, “কী হলো বাথরুমে ঘুমিয়ে গেলি নাকি।”

“এই তো আম্মু আসছি।”

বাথরুমে কী হয়েছিল সেটা বলার জন্যে শারমিন বের হয়ে আসে, আম্মুর সাথে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সে হাসাহাসি করবে ভাবছিল, কিন্তু ঠিক কী কারণ সে বুঝতে পারল না সে আম্মুকে ব্যাপারটা বলতে পারল না। লাবণী তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হলো তোর চোখ-মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন?”

শারমিন নিচু গলায় বলল, “লাল হয়নি আম্মু। চোখ-মুখ কেন লাল হবে?”

‘ঘুমা তাড়াতাড়ি। কত রাত হয়েছে দেখেছিস?”

শারমিন রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকে। তার কেমন জানি একটু অস্থির অস্থির লাগছে। ঠিক কী কারণ সে জানে না, কিন্তু তার ভেতরে একধরনের চাপা ভয়। শুধু ভয় নয় একধরনের চাপা আশঙ্কা। কেন জানি মনে হচ্ছে খুব অশুভ একটা কিছু ঘটেছে কিন্তু সেটা সে ধরতে পারছে না। যতবার সে ঘুমানোর চেষ্টা করছে হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে গেছে, মনে হয়েছে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। শারমিনের একবার মনে হলো সে তার নিজের বিছানা থেকে উঠে গিয়ে লাবণীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বে। আগে কতবার গভীর রাতে আম্মুর পাশে জায়গা করে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়েছে। আম্মু ঘুমের মাঝে জিজ্ঞেস করেছে, “কী হলো শারমিন?” শারমিন বলেছে, “ঘুম আসছে না আম্মু, লাবণী তখন শারমিনকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছে। এত বড় একটা মেয়ে হয়েও সে গুটিশুটি মেরে মায়ের বুকের মাঝে শুয়ে পড়ে প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কিন্তু আজ রাতে সে তার আম্মুর কাছে গেল না, বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগল।

পরদিন ভোরবেলা লাবণী শারমিনকে দেখে ভুরু কুঁচকে বলল, “কী রে শারমিন তোর শরীর খারাপ নাকি?”

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু।”

“তাহলে তোর এরকম চেহারা হয়েছে কেমন করে?”

“কী রকম চেহারা?”

“চোখের নিচে কালি? চোখ-মুখ লাল-জ্বর উঠেছে নাকি? কাছে আয় দেখি।”

শারমিন কাছে এলো। লাবণী শারমিনের হাত ধরে দেখল গায়ে জ্বর বরং নেই, শরীরটা আশ্চর্য রকম ঠাণ্ডা।

শারমিন বিড়বিড় করে বলল, “বললাম তো আমার কিছু হয়নি।”

“কিছু হয়নি তাহলে তোকে দেখতে এরকম লাগছে কেন?”

“রাতে ভালো ঘুম হয়নি।”

লাবণী আরও কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করে কিন্তু শারমিন হঠাৎ চুপ করে গেল, আর কিছু বলল না।

ইউনিভার্সিটিতে শারমিন ক্লাসে মন দিতে পারল না। তাদের ক্যালকুলাস ক্লাস নেয় মাত্র পাস করে আসা একজন শিক্ষক, দেখে মনে হয় বাচ্চা ছেলে। এতগুলো ছেলে-মেয়ের সামনে বেচারা একেবারে নার্ভাস হয়ে থাকে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে এমনভাবে চমকে ওঠে যে দেখে সবাই হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। তবে বেচারা খুব পরিশ্রম করে। ইন্টিগ্রেশন বোঝানোর জন্যে রীতিমতো জান কোরবান করে ফেলে। ক্লাসের পেছন দিকে বসে কয়েকজন মিলে ক্যালকুলাস স্যারকে নিয়ে হাসি-মশকরা করছিল। অন্য যে কোনোদিন হলে শারমিনও তাদের সাথে যোগ দিতো কিন্তু আজকে সে চুপচাপ বসে আছে। ক্যালকুলাস স্যার কোথায় জানি ভুল করে ফেলল এবং সেটা বের করতে গিয়ে স্যার আরো নার্ভাস হয়ে ঘামতে লাগল তখন শারমিন নিচু গলায় পাশে বসে থাকা সাদিবকে ডাকল, “এই সাদিব।”

সাদিব মাথা এগিয়ে বলল, “কী?”

“ব্লাডি মেরি কী সত্যিই কাজ করে?”

“ধুর! সাদিব হাত নেড়ে বলল, “এগুলো ঠাট্টা-তামাশা–”

“ঠাট্টা-তামাশা? তাহলে তুই যে সেদিন বললি–”

সাদিব দাঁত বের করে হাসল, বলল, “ইয়ারকি মারছিলাম।”

“ইয়ারকি মেরেছিস?”

“হ্যাঁ।” সাদিব শারমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই রেগে উঠছিস কেন? তুই কী যারব কমান্ডার হয়ে গেলি নাকি যে তোর সাথে ইয়ারকি মারতে পারব না।”

“আমি রাগী নাই। কিন্তু তুই আমার সাথে ফিউচারে ইয়ারকি মারবি না।”

সাদিব মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে। মারব না।”

ক্যালকুলাস স্যার তার ভুলটা খুঁজে পেয়েছে, খুব উৎসাহ নিয়ে সেটা সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেছে তাই শারমিন চুপ করে গেল।

ক্লাস শেষ হবার পর যখন সবাই ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে আসছে তখন শারমিন সাদিবের শার্টের কোনা টেনে ধরল। সাদিব একটু অবাক হয়ে বলল, “শার্ট ছাড়।”

শারমিন শার্ট ছেড়ে দিয়ে বলল, “সাদিব তুই সত্যি করে বল দেখি এই যে ব্লাডি মেরি-ফেরির কথা বলেছিস এগুলো ইয়ারকি নাকি সত্যি?”

সাদিব মাথা নেড়ে বলল, “আরে বাবা আমি তো ইয়ারকিই জানি।”

“তুই কোথা থেকে এটা শুনেছিস?”

“একটা বইয়ে পড়েছি। ব্ল্যাক আর্ট ফর ইডিয়টস।” সাদিব শারমিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন? কী জন্যে জিজ্ঞেস করছিস?”

শারমিন ফিসফিস করে বলল, “আমার কাছে ব্লাডি মেরি এসেছে। ঠিক ব্লাডি মেরি না তার মতো একজন।”

সাদিব কয়েক সেকেন্ড শারমিনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফাঁকা বাঁশের মতো শব্দ করে হা হা করে হাসতে শুরু করল। শারমিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল, হাসিটা শেষ হওয়া মাত্রই সে সাদিবের মুখে একটা ঘুষি মারবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মারতে পারল না কারণ ঠিক তখন লম্বা পা ফেলে কান্তা তার কাছে এসে হাজির হলো, বলল, “শারমিন।

“কী হলো?”

“তোর আব্বু এসেছে।”

শারমিনের মুখটা শক্ত হয়ে যায়। ফিসফিস করে বলল, “ আব্বু না। বল তোর আম্মুর এক্স হাজবেন্ড।”

কান্তা মাথা নেড়ে বলল, “ছিঃ শারমিন এভাবে কথা বলে না। তাড়াতাড়ি যা।”

“কোথায় যাব?”

“ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।”

ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে সাজ্জাদকে দেখে শারমিন হকচকিয়ে গেল, দেখে মনে হচ্ছে সাজ্জাদের বয়স বুঝি দশ বৎসর কমে গেছে। মাথায় কুচকুচে কালো চুল, চোখে দামি সানগ্লাস, পরনে একটু রংচঙে টি-শার্ট, রং ওঠা জিনসের প্যান্ট এবং পায়ে কেডস। শারমিনকে দেখে সাজ্জাদ সানগ্লাসটা খুলে একটু হাসল, বলল, “কী রে বেটি! ভালো আছিস?”

যখন তার আব্বু সামনে থাকে না তখন শারমিন তার ওপর ভয়ংকর রেগে থাকে, কিন্তু যখন সামনাসামনি থাকে তখন সে রেগে থাকতে পারে না। শারমিন চেষ্টা করেও মুখটা কঠিন রাখতে পারল না, হাসি হাসি মুখে বলল, “আব্বু, তোমার বয়স দেখি দশ বৎসর কমে গেছে।

সাজ্জাদ চুলের ভেতর দিয়ে আঙুলগুলো টেনে নিয়ে বলল, “ চুলগুলি ডাই করে ফেললাম। কেমন হয়েছে।”

“ভালো। তোমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।”

“আর হ্যান্ডসাম!” সাজ্জাদ হাসার চেষ্টা করল, “তুই কী ব্যস্ত? ক্লাস আছে নাকি?”

শারমিনের একটা ক্লাস ছিল কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। বলল, “নাহ! নেই।”

“চল তাহলে লাঞ্চ করি। যাবি কোথাও?”

“কাছাকাছি কোথাও হলে যেতে পারি।”

“আয়। এই কাছেই একটা ফাস্টফুডের দোকান আছে।”

ছোট একটা টেবিলে দুজন সামনাসামনি বসে। কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে সাজ্জাদ বলল, “তোর আম্মু কেমন আছে?”

“ভালো।” বলবে না বলবে না করেও জিজ্ঞেস করে ফেলল, “ তোমার ওয়াইফ কেমন আছে?”

সাজ্জাদ চোখ তুলে মেয়ের দিকে একনজর তাকিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, “ভালো।”

ঠিক তখন শারমিন লক্ষ করল সাজ্জাদের ডান গালে একটা আঁচড়ের দাগ, প্রায় চোখ পর্যন্ত চলে গেছে। এজন্যে কী কালো সানগ্লাস পরে আছে? প্রায় না বুঝেই সে হাত দিয়ে সাজ্জাদের গালে হাত দিয়ে বলল, “আব্বু তোমার মুখে কী হয়েছে?”

সাজ্জাদ মেয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “কিছু না।”

শারমিন কিছুক্ষণ সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “আব্বু। আর ইউ হ্যাপি?”

সাজ্জাদ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “তোর আম্মুকে তো আমি কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারি না। আমার থেকে কিছু নেবে”

“তোমার এতদিনের ওয়াইফ ছিল। তোমার থেকে ভালো করে আর কে আম্মুকে চিনবে?”

সাজ্জাদ আরেকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মানুষ চেনা এত সহজ নয় শারমিন। সারাজীবন পাশাপাশি থেকেও একজন আরেকজনকে চিনতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ মানুষ নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না-আর অন্যকে!”

শারমিন কোনো কথা না বলে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। লাবণীকে ডিভোর্স দিয়ে নীলাকে বিয়ে করে মানুষটা মনে হয় সুখী হতে পারেনি। সুখ জিনিসটা মনে হয় খুব সহজ জিনিস নয়, ধরা দিতে গিয়েও ধরা দেয় না।

সাজ্জাদ হঠাৎ করে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ শারমিন, তোর মা তো আমার কোনো টাকা-পয়সা নিতে চাচ্ছে না। তুই নিবি?”

“আমি?” শারমিন একটু অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকাল।

“হ্যাঁ। তুই। আমি লেখাপড়া করে দিয়ে যাই?”

“দিয়ে কোথায় যাবে?”

“না। যাব আর কোথায়! এটা একটা কথার কথা। যদি হঠাৎ মরেটরে যাই।”

শারমিন শব্দ করে হাসল। বলল, “আব্বু, যত দিন যাচ্ছে তত তোমার বয়স কমছে। তুমি এখন মরেটরে যাবে কেন?”

“এগুলো বাইরের ব্যাপার।” সাজ্জাদ দুর্বলভাবে হাসে, বলে, “ ভেতরে ভেতরে আমি আসলে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।”

“এভাবে বলো না, শুনতে ভালো লাগে না।”

“ঠিক আছে বলব না।” সাজ্জাদ সোজা হয়ে বসে বলল, “ তোর আম্মু রাগ হোক আর যাই হোক আমি আমার প্রপার্টি ভাগাভাগি করে দিয়ে যেতে চাই। তুই আমার মেয়ে, তোকে না দিলে কাকে দেব? তুই তোর আম্মুর সাথে কথা বলিস।”

শারমিন বলল, “বলব আব্বু।”

সাজ্জাদ অন্যমনস্কভাবে তার গালে হাত বুলায়, একটা খামচির দাগ তার গাল থেকে উঠে চোখ পর্যন্ত গিয়েছে। নীলা কি খামচি দিয়ে তার চোখটা তুলে নিতে চাইছে? শারমিন ভেতর ভেতরে একটু শিউরে ওঠে, কী সর্বনাশ।

রাত্রিবেলা শারমিন হঠাৎ একধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। যতই রাত হতে থাকে ততই তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অস্থিরতাটুকু কী নিয়ে সে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু ঘুমানোর আগে সে দাঁত ব্রাশ করার জন্যে বাথরুমে গিয়েই অস্থিরতার কারণটুকু বুঝতে পারে। সে আবার বাথরুমে আবছা অন্ধকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গতরাতের মতো প্রেতাত্মাকে ডাকতে চায়। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তার ভেতরে একধরনের অশুভ আশঙ্কা কাজ করছে কিন্তু একই সাথে তার জন্যে একধরনের তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে। যারা ড্রাগস খায় তারা মনে হয় তাদের ড্রাগসের জন্যে এরকম একধরনের আকর্ষণ অনুভব করে।

শারমিন নিঃশব্দে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাইট নিভিয়ে দিল। জানালা দিয়ে এক চিলতে আলো এসে অন্ধকার বাথরুমে একটা আবছা আলো-আঁধারির জন্ম দিয়েছে। শারমিন আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়, হাত নাড়ালে তার প্রতিবিম্বটুকু হাত নাড়ছে, মাথা ঝাঁকালে প্রতিবিম্বটুকু মাথা ঝাঁকাচ্ছে। শারমিন চোখ বন্ধ করে হাত দুটি বুকের কাছে নিয়ে এসে মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “হে বিদেহী আত্মা, হে পরাজগতের বাসিন্দা, হে অতিপ্রাকৃত প্রাণী তুমি কে আমি জানি না, শুধু জানি তুমি আমাকে দেখা দাও। তুমি এসো। আমি তোমাকে আহ্বান করছি। এসো তুমি এসো। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।”

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে শারমিন আচ্ছন্নের মতো হয়ে গেল। তার মনে হতে থাকে সে এক গভীর অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাচ্ছে। মনে হতে থাকে সে বুঝি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, সে বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তখন সে চোখ খুলে তাকাল এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। বাথরুমের চতুষ্কোণ বড় আয়নাটি থেকে হালকা একটা নীল আলো বের হচ্ছে। সেখানে আবছা কুয়াশার মতো এবং সেই কুয়াশার ভেতর থেকে আবছায়ার মতো একটা মূর্তি স্পষ্ট হয়ে আসছে। মূর্তিটি খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। শীর্ণ মুখ, কোটরের মাঝে ঢুকে থাকা দুটি চোখ, মুখে বয়সের বলিরেখা। মূর্তিটি ফিসফিস করে বলল, “ আমি এসেছি। আমাকে বের হতে দাও”

শারমিন একটা চিৎকার করে লাইটের সুইচটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আলো জ্বেলে দেয়। মুহূর্তে পুরো বাথরুমটা তীব্র আলোতে ভেসে গেল। কিন্তু শারমিন সেটা দেখতে পেল না। সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে চিৎকার করতে থাকে।

লাবণী বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি ভেঙে ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করল শারমিন বাথরুমের মেঝেতে গুটিশুটি মেরে বসে দুই হাতে মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপছে।

লাবণী ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে শারমিন? কী হয়েছে?”

শারমিন কোনো কথা বলতে পারে না, ভয় পাওয়া গলায় গোঙানোর মতো শব্দ করতে থাকে। লাবণী তাকে ধরে বাথরুম থেকে বের করে আনে, তখনো সে থরথর করে কাঁপছে। লাবণী শারমিনকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কী হয়েছে শারমিন? কথা বল।”

শারমিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সে এসেছে আম্মু। সে এসেছে।”

“কে এসেছে?”

“আমি যাকে ডেকেছিলাম।”

“তুই কাকে ডেকেছিলি?”

“আমি জানি না আম্মু-সে এসেছে। সে বের হতে চাইছে।”

লাবণী কিছু বুঝতে পারছিল না, জিজ্ঞেস করল, “কোথা থেকে বের হতে চাইছে?”

লাবণী অপ্রকৃতিস্থের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আয়নার ভেতর থেকে।

হঠাৎ করে লাবণীর কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। অবাক হয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ব্লাডি মেরিকে ডেকেছিস?”

শারমিন মাথা নাড়ল, “না আম্মু। ব্লাডি মেরি না। অন্য কেউ।”

“সে কে? দেখতে কেমন?”

শারমিন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে জিজ্ঞেস করো না আম্মু। আমার ভয় করে। আমার অনেক ভয় করে।”

সে রাতে লাবণী শারমিনকে নিজের বিছানায় নিয়ে ঘুমাল। সারারাত সে শারমিনকে শক্ত করে ধরে রাখল। শারমিন ঘুমের মাঝে ছটফট করে, অস্ফুট গলায় কথা বলে-লাবণী তার কোনো কথা বুঝতে পারে না। সে অবাক হয়ে দেখে তার ঘরটা আশ্চর্য রকম শীতল। শুধু শীতল নয় ঘরে বিচিত্র একধরনের গন্ধ, পুরনো মাটির গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ। লাবণীর বিশ্বাস হতে চায় না কিন্তু তার মনে হয় এ ঘরে অন্য কেউ আছে, যে ফিসফিস করে কথা বলছে, কথাগুলোও যেন বোঝা যায়, মনে হয় যেন বলছে, “আমি এসেছি! আমি এসেছি।”

লাবণী সারারাত শারমিনকে বুকে ধরে রেখে জেগে বসে রইল।

পরদিন শারমিন ঘুম থেকে উঠল বেশ দেরি করে। নাস্তার টেবিলে লাবণী নিজে থেকে গত রাতের বিষয়টা তুলতে চাইছিল না কিন্তু শারমিন কিছু বলতে চাইছে না দেখে শেষ পর্যন্ত লাবণীকে তুলতেই হলো। খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে এরকম ভান করে বলল, “কাল রাতে কী পাগলামো করলি বলবি একটু?”

শারমিন একটু লজ্জা পেয়ে যায়। বলল, “না আম্মু। বলব না।

না বললে হবে কেমন করে। বল শুনি।”

“বলতে লজ্জা করছে আম্মু।”

“লজ্জা করলে হবে না। বল শুনি।

শারমিন তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে লাবণী কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। চিন্তিত মুখে বলল, “দেখ শারমিন আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না ভূত-প্রেত বলে কিছু আছে। কিন্তু তুই যেটা বললি সেটার সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে সত্যিই কোনো ভৌতিক প্রাণী এসেছিল—”

শারমিন শুকনো মুখে বলল, “কিন্তু আম্মু তুমি যদি দেখতে তাহলে বুঝতে—”

“আমার দেখার কোনো শখ নেই। জ্যান্ত মানুষের যন্ত্রণাতেই বাঁচি না। এখন যদি ভূতের যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয় তাহলে তো মুশকিল।” লাবণী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “তবে একটা জিনিস তোকে বলে রাখি।”

“কী জিনিস?”

“বাথরুমে গিয়ে অন্ধকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভূত-প্রেত ব্লাডি মেরিকে ডাকাডাকি বন্ধ। বুঝেছিস?”

শারমিন মাথা নাড়ল, “বুঝেছি।”

“তুই সত্যিই ভূত-প্রেত ডেকে আনিস আমি সেটা বিশ্বাস করি না কিন্তু সেলফ হিপনোটাইজের মতো কিছু একটা হয়ে তুই যে। আজগুবি জিনিস কল্পনা করতে শুরু করিস সেটা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”

শারমিন আবার বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আম্মু।”

লাবণী মুখ শক্ত করে বলল, “ইনফ্যাক্ট আগামী কয়েকদিন তোকে আমি একা বাথরুমেই যেতে দেব না।”

শারমিন চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছ তুমি আম্মু?”

“আমি ঠিকই বলছি। তুই গতরাতে যেভাবে ভয় পেয়েছিস সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার না। তাছাড়া–”

“তাছাড়া কী?”

লাবণীর হঠাৎ গতরাতের কথা মনে পড়ে যায়। কনকনে ঠাণ্ডা ঘরে পচা ভেজা মাটির এবং শ্যাওলার মতো একধরনের গন্ধ, বিচিত্র একধরনের ফিসফিস শব্দ, মনে হচ্ছে কেউ একজন নিঃশব্দে ঘরের মাঝে হাঁটছে, তার মাঝে সারারাত সে শারমিনকে বুকে চেপে ধরে জেগে বসে আছে।

শারমিন আবার জিজ্ঞেস করল, “তাছাড়া কী আম্মু?”

লাবণী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না, কিছু না।”

বিকেলে লাবণী একটা বইয়ের প্যাকেট নিয়ে বাসায় ঢুকল। শারমিন জিজ্ঞেস করল, “কী বই কিনেছ আম্মু?”।

লাবণী একটা ইতস্তত করে বলল, “বই কী কেনার উপায় আছে নাকি! বইয়ের কী দাম জানিস?”

“তবুও তো কিনে ফেলেছ?”

“হ্যাঁ। কিনলাম, ব্ল্যাক আর্টের ওপর দুইটা। আরেকটা প্রেতচর্চার ওপর ইন্ডিয়ান বই।”

শারমিন হেসে ফেলল, বলল, “কী আশ্চর্য আমিও আজকেই সাদিবের কাছ থেকে তার ব্ল্যাক আর্টের বইগুলো নিয়ে এসেছি।”

“দেখি তোর বইগুলো!”

দুজনই তখন তাদের বইগুলো নিয়ে আসে। টেবিলে রেখে ওলটপালট করে দেখে। লাবণী অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কী আশ্চর্য একটা ব্যাপার! এরকম উদ্ভট একটা বিষয়ের ওপর কতগুলো মানুষ কতগুলো বই লিখে ফেলেছে দেখেছিস?”

শারমিন বলল, “এখন তুমি এটাকে উদ্ভট বলছ কেন? কয়দিন আগেই না তুমি আমাকে বোঝাচ্ছিলে এগুলো বিশ্বাস করলে আইনস্টাইন হওয়া যায়!” লাবণী রেগে গিয়ে বলল, “ ফাজলেমি করবি না। আমি মোটেও সেটা বলিনি। সন্ধ্যেবেলা দেখা গেল সোফায় হেলান দিয়ে দুজনেই খুব মনোযোগ দিয়ে ব্ল্যাক আর্টের ওপর বই পড়ছে। রাত্রিবেলা অবস্থার একটু পরিবর্তন হলো। হঠাৎ করে দেখা গেল শারমিনের ভেতর একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তার চোখ-মুখ কেমন যেন লালচে হয়ে গেল এবং সে হঠাৎ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল। দেখে মনে হচ্ছে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। লাবণী একটু অবাক হয়ে বলল, “ তোর কী হয়েছে? শারমিন, তুই এরকম ছটফট করছিস কেন?” শারমিন উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে বলল, “জানি না আম্মু। কেমন যেন অস্থির লাগছে।”

“অস্থির লাগছে মানে কী?”

“মানে ঠিক জানি না। শুধু মনে হচ্ছে-মনে হচ্ছে–”

“শুধু-কী মনে হচ্ছে?”

শারমিন মাথায় চুলগুলো ভেতর আঙুল দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল, “মনে হচ্ছে কিছু একটা করতে হবে”

লাবণী তীক্ষ্ণ চোখে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী করতে হবে?”

“একজনকে ডাকতে হবে।”

লাবণী কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর জিজ্ঞেস করল, “আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে ডাকতে চাস?”

শারমিনের মুখে অপরাধবোধের একটা ছাপ পড়ল। মাথা নেড়ে বলল, “হা আম্মু।”

লাবণী উঠে গিয়ে শারমিনের হাত ধরে টেনে এনে সোফায় তার নিজের পাশে বসাল, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমি জানি

তোর কী হয়েছে শারমিন। তবে যেটাই হয়ে থাক সেটা থেকে তোর বের হয়ে আসতে হবে। বুঝেছিস?”

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ বুঝেছি।”

“আজ সারারাত আমি তোর সাথে থাকব। তোকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যে ছাড়ব না। বাথরুমে গেলেও না।

শারমিন দুর্বলভাবে একটু হাসার চেষ্টা করল। লাবণী দেখল তার ঠোঁটগুলো কেমন যেন কালচে দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে এবং সেখান থেকে জ্বলজ্বল করছে। চুলগুলো এলোমেলো এবং চেহারার মাঝে একধরনের অপ্রকৃতিস্থ ভাব। লাবণী শারমিনের হাত ধরে বলল, “আয় ঘুমাবি।”

শারমিন বলল, “আমার ঘুম পাচ্ছে না আম্মু।”

“ঘুম না পেলেও ঘুমাতে হবে। তোকে একটা সিডেটিভ দিয়ে দিই, খেয়ে মড়ার মতো ঘুমাবি।”

শারমিন আপত্তি করল না। একটা সিডেটিভ খেয়ে লাবণীর বিছানায় লাবণীর পাশে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বিছানায় ছটফট করে শারমিন একসময় শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। লাবণী আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, যখন দেখল শারমিনের নিঃশ্বাস ঘুমন্ত মানুষের মতো নিয়মিতভাবে পড়ছে তখন সে বিছানা থেকে উঠে বাসার সব কয়টা বাথরুমের দরজায় তালা মেরে দিল। রাত্রে ঘুমের মাঝে উঠেও শারমিন যেন গিয়ে নতুন কোনো পাগলামি করে ফেলতে না পারে। লাবণী তার বইগুলো নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। এক হাতে শারমিনকে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে বইটা কোলের ওপর রেখে পড়তে শুরু করে। ব্ল্যাক আর্ট, শয়তানের উপাসনা এবং প্রেতচর্চা নিয়ে যে পৃথিবীতে এত কিছু ঘটে গেছে সেটা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। বইয়ে এমনভাবে লেখা আছে যেন সত্যিই পৃথিবীতে অলৌকিক জিনিস আছে, যেন সত্যিই ভূত-প্রেত আছে, তারা মানুষের কাছে আসতে পারে, মানুষকে বশ করতে পারে। বইগুলো পড়তে পড়তে লাবণী এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

গভীররাতে শারমিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। লাবণী বলেছিল তাকে যে সিডেটিভ খাওয়ানো হয়েছে আগামীকাল ভোরের আগে তার ঘুম ভাঙবে না, কিন্তু তার ঘুম ভেঙে গেল কেন সে বুঝতে পারল না। শারমিনের মনে হলো তাকে কেউ ডেকেছে-কিন্তু কে ডাকতে পারে? তার আম্মু এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে, বুকের ওপর একটা বই। শারমিন তার শরীর থেকে লাবণীর হাতটা সরিয়ে উঠে বসল। তাকে কিছু একটা করতে হবে কিন্তু সেটা কী সে মনে করতে পারল না। কেউ একজন তার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকে তার ডাকতে হবে, পুরো ব্যাপারটি অত্যন্ত ভয়ংকর। অত্যন্ত অশুভ কিন্তু তার কিছু করার নেই। তাকে যেতেই হবে। শারমিন সাবধানে বিছানা থেকে নেমে এলো, তার আম্মু ঘুমাচ্ছে কিছু টের পেল না।

শারমিন বাথরুমের দরজায় হাত দিয়ে দেখে সেটা তালা মেরে বন্ধ করে রাখা। হঠাৎ করে সে নিজের ভেতরে একধরনের ক্রোধ অনুভব করে, অত্যন্ত বিচিত্র একধরনের বিজাতীয় ক্রোধ। ক্রোধটা কার ওপরে সে বুঝতে পারে না, কিন্তু তার হঠাৎ করে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করে, তার মনে হতে থাকে ইচ্ছে করলেই সে বুঝি সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। শারমিন তখনই শোয়ার ঘরে ফিরে আসে। তার আম্মু বিছানায় শুয়ে আছে, মাথার কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, বুকের ওপর একটা বই খোলা। শারমিন মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই ড্রেসিং টেবিলটা চোখে পড়ল, সেখানে একটা বড় আয়না। হঠাৎ শারমিনের চোখগুলো চকচক করে ওঠে, সে পায়ে পায়ে ড্রেসিং টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল, কী আশ্চর্য! তাকে দেখতে একটা অপরিচিত মেয়ের মতো মনে হচ্ছে। সে স্থির দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকায়।

ঠিক তার কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলল, “ আমি এসেছি! আমি এসেছি।”

শারমিনের হঠাৎ মনে হলো ঘরের ভেতর একটা দমকা বাতাস তাকে ঝাঁপটা দিয়ে গেল, হিমশীতল বাতাসে তার সারা শরীর কেঁপে ওঠে। কিছু একটা ঘটবে এখন, কী ঘটবে সে বুঝতে পারছে না। শারমিন আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে দেখে তার চুলগুলো ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। মুখের চামড়ায় বয়সের বলিরেখা দেখা দেয়, চোখগুলো কুঠুরিতে ঢুকে গিয়ে সেগুলো ধকধক করে জ্বলতে শুরু করে। শারমিন দেখল গোলাপি ফুলফুল ঘুমের পোশাকে ছোপছোপ রক্তের ছাপ পড়েছে। শারমিন তার হাতটা ওপরে তুলল-আয়নায় দেখা যায় সেটি কংকালসার শীর্ণ, হাত সেখান থেকে নখ বাঁকা হয়ে বের আছে। শারমিন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটগুলো ঝুলে পড়ছে, ধারালো দাঁত বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। দাঁতের ফাঁক থেকে একটা লাল লকলকে জিব উঁকি দিয়ে ওঠে। চাপা একটু দুর্গন্ধ শারমিনের নাকে ভক করে এসে ধাক্কা দেয়, পচা মাংসের সেই দুর্গন্ধে হঠাৎ করে শারমিনের সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।

আয়নার সেই ভয়ংকর ছায়ামূর্তি শারমিনের দিকে তাকিয়ে হাসল, সেই ভয়ংকর হাসি দেখে শারমিনের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। সে ভয়ংকর আতঙ্কে সেই ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, খুব ধীরে ধীরে সে আয়নার ভেতর থেকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, ঠিক আয়নার সামনে এসে আর বের হতে পারে না। তখন সে ফিসফিস করে শারমিনকে ডাকে, খসখসে চাপা গলায় বলল, “আমি এসেছি! আমাকে বের হতে দাও।”

শারমিন ভয়ানক আতঙ্কে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু তার পা মনে হয় মেঝেতে গেঁথে গেছে সে এখান থেকে নড়তে পারছে না, অবর্ণনীয় একটা আতঙ্কে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ছায়ামূর্তিটি আবার শারমিনকে ডাকে, “কাছে এসো! আমাকে স্পর্শ করো। আমাকে বের হতে দাও।”

শারমিনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে সেটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শারমিনের মুখ হঠাৎ বিকৃত হয়ে ওঠে, তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসে। ছায়ামূর্তিটি ফিসফিস করে তাকে ডাকে, “এসো। এসো আমার কাছে। আমাকে ছোও-মাত্র একটিবার-”

শারমিন কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায়। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে তার কিছুতেই আয়নাটি স্পর্শ করা উচিত না। স্পর্শ করলেই খুব ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। কিন্তু সে বুঝতে পারে তাকে আয়নাটা স্পর্শ করতে হবে। অসহায়ের মতো সে হাত তুলে আয়নাটা স্পর্শ করে, সাথে সাথে হঠাৎ পুরো আয়নাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। বিস্ফারিত চোখে শারমিন দেখল আয়নার ভেতর থেকে কুৎসিত একাটা প্রাণী বের হয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শারমিন চিৎকার করে নিচে পড়ে যায়, তার বুকের ওপর বসে সেই কুৎসিত প্রাণীটি তার লাল জিব বের করে শারমিনের মুখের দিকে এগিয়ে আসে, ধারালো দাঁত বসিয়ে দেয় তার কাঁধে। ভয়ংকর আতঙ্কে শারমিন চিৎকার করতে থাকে, কিছুতেই সে আর থামতে পারে না। মনে হয় চিৎকারে তার গলার মাংসপেশি ছিঁড়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে যাবে কিন্তু তবুও সে থামতে পারে না।

শারমিনের চিৎকার শুনে লাবণী লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠল, বিস্ফারিত চোখে দেখল শারমিন মেঝেতে শুয়ে দুই হাতে অদৃশ্য কোনো একটা প্রাণীকে তার বুকের ওপর থেকে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করছে। সারা ঘরে ভাঙা আয়নার কাঁচ, সেই কাঁচের আঘাতে শারমিনের হাত-পা-মুখ কেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত ঝরে দেখতে দেখতে তার ঘুমের কাপড়ে ছোপছোপ লাল রং লেগে যাচ্ছে না।

লাবণী ছুটে এসে শারমিনের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়, চিংকার কের ডাকতে থাকে, “শারমিন, এই শারমিন।”

শারমিনের শরীর থরথর করে কাঁপছে, তার মাঝে সে চোখ খুলে লাবণীর দিকে তাকাল, অপ্রকৃতিস্থ সেই চোখের দৃষ্টি দেখে হঠাৎ লাবণীর বুক কেঁপে ওঠে। ভয় পাওয়া গলায় সে আবার ডাকল, “শারমিন।”

শারমিনের মুখটা অল্প একটু খুলে যায়, সে ফিসফিস করে স্পষ্ট গলায় বলল, “আমি শারমিন না।”

লাবণী ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তুমি কে?”

শারমিন তীব্র দৃষ্টিতে লাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ আমি কাফ্রীদা।”

তারপর অমানুষিক গলায় খলখল করে হাসতে শুরু করল।

সেই হাসির শব্দ শুনে হঠাৎ করে লাবণীর সমস্ত শরীর শীতল হয়ে যায়।

টেলিফোনের শব্দে সাজ্জাদের ঘুম ভেঙে যায়। সে বালিশের নিচে থেকে তার ঘড়ি বের করে দেখল, রাত একটা তিরিশ মিনিট। এত রাতে তাকে কে ফোন করবে?

পাশে শুয়ে থাকা নীলা ঘুমঘুম গলায় বলল, “ফোনটা ধরো না প্লিজ।” সাজ্জাদ বিছানা থেকে নেমে বাইরের ঘরে গিয়ে ফোন ধরল, বলল, “হ্যালো।”

অন্যপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ শুনতে পায়, “সাজ্জাদ?”

“হ্যাঁ, সাজ্জাদ কথা বলছি।”

“আমি লাবণী।”

সাজ্জাদ সাথে সাথে সোজা হয়ে বসে। তার নীলার সাথে একটা সম্পর্ক আছে জানার পর থেকে লাবণী একটিবারও তার সাথে কথা বলেনি। আজ এই প্রথমবার। এই গভীর রাতে। হঠাৎ একটা অজানা আশঙ্কায় সাজ্জাদের বুক কেঁপে ওঠে। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “‘কী হয়েছে লাবণী?”

“শারমিনের খুব বড় বিপদ। তুমি একটু আসবে?”

“কী হয়েছে শারমিনের?”

টেলিফোনের অন্যপাশে লাবণী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “আমি জানি না। হিস্টিরিয়ার মতো অবস্থা, ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে সারা শরীর কেটেকুটে গেছে কিন্তু সেটা ইম্পরট্যান্ট না।”

“তাহলে কোনটা ইম্পরট্যান্ট।”

“তাকে ধরে বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। চিৎকার করছে, ছটফট করছে আর বলছে-” লাবণী হঠাৎ থেমে গেল।

“সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করল, কী বলছে?”

“বলছে সে শারমিন না। সে অন্য কেউ।”

সাজ্জাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। মাত্র গতকাল শারমিনকে নিয়ে সে ফাস্টফুডের দোকানে গিয়েছে, একসাথে খেয়েছে, গল্প করেছে। হঠাৎ করে তার বুকের ভেতরটা কেমন জানি ওলটপালট হয়ে যায়। শারমিন! তার আদরের শারমিনের কী হয়েছে এটা? সাজ্জাদ বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “লাবণী। আমি আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি।”

“থ্যাংক ইউ সাজ্জাদ।” হঠাৎ লাবণীর গলা ভেঙে যায়, “ আমার খুব ভয় করছে।”

সাজ্জাদ যখন বেডরুমে ফিরে এলো তখন বিছানা থেকে নীলা ঘুমঘুম গলায় বলল, “কে ছিল?”

“লাবণী।”

নীলার কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে লাবণী মানুষটা কে। যখন বুঝতে পারল তখন সে প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল, “লাবণী?”

“হ্যাঁ।”

“এত রাতে? এত রাতে কেন ফোন করেছে?”

“শারমিনের কিছু একটা হয়েছে।”

“কী হয়েছে?”

“ঠিক বুঝতে পারছে না।”

“বুঝতে না পারলে তোমাকে ফোন করেছে কেন? হাসপাতালে নিয়ে যায় না কেন?”

সাজ্জাদ নীলার দিকে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে তার কথা বলার ইচ্ছে করল না। সে স্টিলের আলমারি খুলে একটা প্যান্ট বের করে। নীলা হঠাৎ করে যেন খেপে যায়, চিৎকার করে বলল, “ তুমি কী করছ?”

“কাপড় পরছি।”

“কেন?”

“শারমিনকে দেখতে যাব।”

“এত রাতে?”

“হ্যাঁ।”

“এত রাতে কেন যেতে হবে? কাল সকালে কেন যাও না?”

সাজ্জাদ শান্ত গলায় বলল, “কারণ বিপদটা কাল সকালে হয়নি। বিপদটা হয়েছে এখন। এত রাতে।”

“এত রাতে ড্রাইভার নেই তুমি কেমন করে যাবে?”

“আমি ড্রাইভিং জানি। আমার ড্রাইভারস লাইসেন্স আছে।”

নীলা হঠাৎ মশারি থেকে বের হয়ে এলো, তাকে কেমন যেন খ্যাপা একটা বাঘিনীর মতো দেখাচ্ছে, সে হিংস্র গলায় বলল, “তুমি এখন যেতে পারবে না।”

সাজ্জাদ খানিকটা অবাক এবং অনেকখানি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “আমি এখন যেতে পারব না?”

“না। আমাকে একা রেখে তুমি যেতে পারবে না।”

“একা রেখে? বাসায় দুজন কাজের মানুষ-গেটে দারোয়ান”

“আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে কী মাঝরাতে এক্স-ওয়াইফের কাছে যাবার জন্যে?”।

সাজ্জাদ অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, “আমি মাঝরাতে আমার এক্স-ওয়াইফের কাছে যাচ্ছি না, আমি আমার অসুস্থ মেয়ের কাছে যাচ্ছি।”

“তোমার মেয়ে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেল? আর সাথে সাথে তোমার ওয়াইফ তোমাকে ফোন করল? এত প্রেম কবে থেকে হয়েছে?”

সাজ্জাদ শীতল চোখে বললে, “দেখো নীলা, তুমি এভাবে কথা বলবে না।”

নীলা হঙ্কার দিয়ে বলল, “কী? তোমার এত বড় সাহস? তুমি আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলো?”

“আমি তোমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলিনি। আমি তোমাকে বলছি যে আমার মেয়ে অসুস্থ—”

“তোমার মেয়েই তোমার সব? দিন নেই রাত নেই শুধু মেয়ে মেয়ে মেয়ে–আমি কী বানের জলে ভেসে এসেছি?”

সাজ্জাদ বুঝতে পারল নীলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। যত দিন যাচ্ছে এ মেয়েটি যেন ততই অবুঝ এবং মেজাজি হয়ে উঠছে। ছোট একটা বিষয়কে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে একটা বিশাল ব্যাপারে পাল্টে দেয়, মাঝে মাঝে সাজ্জাদের কাছে অসহ্য মনে হয়। সে নীলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল না, তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিয়ে মানিব্যাগ আর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়। সারাক্ষণ নীলা রাগে ফুঁসছে এবং অর্থহীন কথা বলছে, ঠিক যখন সাজ্জাদ দরজা খুলে বের হবে তখন খপ করে তার বুকের কাপড় খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, “না, তুমি যেতে পারবে না।”

সাজ্জাদ থমথমে গলায় বলল, “কাপড় ছাড় নীলা।”

নীলা চিৎকার করে বলল, “ছাড়ব না আমি ছাড়ব না। তুমি কী করবে?”

হঠাৎ সাজ্জাদের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে শক্ত হাতে নীলার হাত ধরে নিজেকে মুক্ত করে একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিল। তাল সামলাতে না পেরে নীলা বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেখান থেকে ঝট করে উঠে বসে হিংস্র চোখে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ? তুমি জানো আমি প্রেগনেন্ট? তুমি জানো আমার পেটে বাচ্চা?”

সাজ্জাদ একেবারে হকচকিয়ে গেল। অবাক হয়ে বলল, “তুমি প্রেগনেন্ট?”

“হ্যাঁ। তুমি তোমার প্রেগনেন্ট বউয়ের গায়ে হাত তুলেছ?”

“তুমি প্রেগনেন্ট সেটা আমাকে কখনো বলোনি কেন?”

নীলা চিৎকার করে বলল, “আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ, দিয়েছ সুযোগ?”

“সুযোগ?” সাজ্জাদ অবাক হয়ে নীলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। নীলা। আমি এটা নিয়ে তোমার সাথে পরে কথা বলব। এখন আমি যাই–আমার মেয়ে অসুস্থ-”

নীলা চিৎকার করে বলল, “তোমার অসুস্থ মেয়ে যেন কোনোদিন সুস্থ না হয়। সে যেন মুখে রক্ত উঠে মারা যায়।”

সাজ্জাদের মাথার মাঝে একটা বিস্ফোরণ হলো, তার মনে হলো সে গিয়ে নীলার টুটি চেপে ধরবে, কিন্তু সে কিছু করল না, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

লাবণী দরজা খুলে একটু সরে দাঁড়ায়-সাজ্জাদ ভেতরে ঢুকে লাবণীর দিকে তাকাল। গত দুই বৎসর এই প্রথম তারা একজন আরেকজনের সামনাসামনি দাঁড়িয়েছে, অন্য যে কোনো সময় হলে এরকম একটি মুহূর্ত হতো অত্যন্ত অস্বস্তিকর মুহূর্ত, কে কী নিয়ে কথা বলবে তারা বুঝতে পারত না। কিন্তু এখন সেরকম কিছু হলো না। সাজ্জাদ শুকনো গলায় বলল, “কেমন আছে শারমিন?”

আগের মতো। ভয়ানক চেঁচামেচি করছে। দেখে মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। হঠাৎ করে লাবণীর গলা ভেঙে যায়, কাতর গলায় বলল, “আমার খুব ভয় করছে সাজ্জাদ।”

সাজ্জাদ লাবণীর পিঠে হাত রেখে বলল, “ভয় কী লাবণী। সব ঠিক হয়ে যাবে। কী হয়েছে আগে বলো।”

লাবণী ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, সবকিছু শুনে সাজ্জাদ হতবাক হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “আমি বিশ্বাস করি না।”

লাবণী মাথা নেড়ে বলল, “আমিও বিশ্বাস করি না। কিন্তু যেটা ঘটেছে তোমাকে সেটাই বলেছি।”

সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করছে শারমিন?”

“বিছানায় বসে আছে। কেউ কাছে এলেই ভয়ংকর চেঁচামেচি শুরু করে।”

“চলো গিয়ে একটু দেখি।”

শারমিন বিছানায় হাঁটুর ওপর মুখ রেখে বসে ছিল। ঘরটা অসম্ভব শীতল এবং বাতাসে একধরনের দূষিত গন্ধ। ঘরের বাতি নেভানো, পাশের ঘর থেকে যা একটু আলো এসে পড়েছে তাতেই আবছা দেখা যাচ্ছে। সাজ্জাদ লাবণীকে বলল, “একটু লাইট জ্বালাও।”

লাবণী ফিসফিস করে বলল, “জ্বালাচ্ছি। খুব চিৎকার করবে কিন্তু।”

“করুক।”

লাবণী সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই শারমিন দুই হাতে মুখ ঢেকে জান্তব গলায় চিৎকার করতে থাকে। তার মুখে কাটা দাগ, শরীরের নানা জায়গায় রক্তের ছোপ, এলোমেলো চুল এবং চোখেমুখে অপ্রকৃতিস্থ মানুষের ছাপ। সাজ্জাদ এগিয়ে গিয়ে শারমিনের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “শারমিন। মা আমার।”

শারমিন চিৎকার করে বলল, “মড়াখোগা জানোয়ার। আমার কাছে আসবি না। খবরদার।”

সাজ্জাদ বলল, “ছিঃ মা। ছিঃ। এভাবে কথা বলে না।”

“কাছে আসবি না তুই। খবরদার। খুন করে ফেলব তোকে।”

সাজ্জাদ অনুনয় করে বলল, “শারমিন। শোন মা। একটু শান্ত হ। প্লিজ। শারমিন”

শারমিন দুই দিকে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “আমি শারমিন না। না-না-না—”

“তুই তাহলে কে?”

“আমি কাফ্রীদা। কা-ফ-রি-দা!” তারপর সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে খলখল করে হাসতে থাকে। শারমিনের চোখের দৃষ্টি দেখে সাজ্জাদ হতভম্ব হয়ে যায়। দেখে মনে হয় না এটি মানুষের দৃষ্টি।

সাজ্জাদ একটু এগিয়ে গিয়ে শারমিনকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতেই শারমিন বন্য পশুর মতো জান্তব একটা শব্দ করে। সাজ্জাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, সাজ্জাদ প্রস্তুত ছিল না, সে পা বেধে নিচে পড়ে গেল। হিংস্র হায়েনা যেভাবে আক্রমণ করে অনেকটা সেভাবে শারমিন সাজ্জাদকে কামড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। লাবণী ব্যাপারটা দেখেছে সে প্রস্তুত ছিল, ছুটে এসে কোনোভাবে সে শারমিনকে টেনে সরিয়ে নেয়। তার ফলটা হয় আরো ভয়ানক, শারমিন দেওয়ালে মাথা কুটে জান্তব একধরনের শব্দ করতে থাকে, দেখতে দেখতে তার চোখ-মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়।

সাজ্জাদ একধরনের অসহায় আতঙ্ক নিয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এখনও সে পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে বিড়বিড় করে বলল, “মেডিক্যাল হেল্প দরকার। এক্ষুনি মেডিক্যাল হেল্প দরকার।”

লাবণী মাথা নাড়ল, জিজ্ঞেস করল, “হাসপাতালে নেবে?”

“এভাবে হাসপাতালে নেবে কেমন করে? একজন ডাক্তারকে ডাকি। এসে আগে ট্রাংকোয়ালাইজার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিক।”

লাবণী মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”

সাজ্জাদের স্কুলজীবনের বন্ধু, ড. আরশাদ এখন মেডিক্যাল কলেজে নিউরলজির হেড। তাকে সে যখন খুশি ফোন করতে পারে, রাত দুটোর সময়েও। সাজ্জাদ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল, টেলিফোনে যতটুকু সম্ভব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল এবং ড. আরশাদ প্রায় সাথে সাথেই রওনা দিয়ে দিল। এত রাতে রাস্তাঘাটে একেবারে ভিড় নেই, যে পথটুকু আসতে দিনের বেলা এক ঘণ্টা থেকেও বেশি লেগে যায় ড. আরশাদ বিশ মিনিট থেকে কম সময়ে সেটুকু চলে এলো।

ড্রয়িংরুমে সাজ্জাদ আর লাবণী ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় এবং ড. আরশাদ গম্ভীর মুখে পুরোটুকু শুনে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আই হোপ তোরা এটাকে সুপার ন্যাচারাল কিছু ভেবে বসিসনি।”

সাজ্জাদ আর লাবণী দুজনেই দ্বিধান্বিতভাবে মাথা নাড়ল। লাবণী বলল, “না আমি ভাবতে চাই না।”

ড. আরশাদ বলল, “মানুষের মস্তিষ্ক যে কোনো সুপার ন্যাচারাল ফেনোমেনোন থেকে বেশি চমকপ্রদ। কোনো একটা জিনিস তাকে খুব ডিস্টার্ব করছে। তার বয়স কত?”

“আঠারো।”

“খুব সেনসিটিভ বয়স।” ড. আরশাদ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের জানা মতে কোনো ড্রাগের সমস্যা আছে?”

লাবণী মাথা নাড়ল, “না নেই।”

“কোনো এফেয়ার?”

লাবণী আবার বলল, “সেরকম কিছু নেই। আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক ফ্রি, ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু আছে। কিন্তু মনে হয় না কোনো রিলেশনশিপ আছে।”

“শিওর?”

“শিওর। মেয়ে আমার সাথে খুব ফ্রি।”

“আপনাদের ফেমিলিতে কারো মানসিক সমস্যা আছে?”

দুজনেই মাথা নড়ল, “না নেই।”

“আগে কখনো এ ধরনের কোনো কিছু করেছে?”

“না করেনি।”

“ইদানীং কোনো ঘটনা কী খুব এফেক্ট করেছে?”

লাবণী সাজ্জাদের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আপনি হয়তো জানেন আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। সেই ঘটনা তাকে এফেক্ট করেছিল। কিন্তু তারপর দুই বছর হয়ে গেছে। সে বেশ মেনে নিয়েছে।”

“মাথায় কী কখনো কোনো রকম ব্যথা পেয়েছে?”

“না, পায়নি।”

“মাথাব্যথা বা এধরনের কোনো রকম কমপ্লেন করেছে?”

“না করেনি।”

“ঘুম হয় না এ ধরনের কোনো কোনো কমপ্লেন করেছে?”

“না, করেনি।”

“জেনারেল হেলথ কেমন?”

“ভালো। বেশ ভালো।”

ড. আরশাদ চিন্তিত মুখে খানিকক্ষণ মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “আপনার মেয়েকে একটু দেখি।”

“আসুন।”

ঘরে ঢোকামাত্রই শারমিন অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে শুরু করল। শারমিন যে এ ধরনের গালাগাল জানে লাবণী সেটা জানতোই না। ড, আরশাদ খুব বিচলিত হলো না। বেশ সহজভাবে কাছে গিয়ে শারমিনের হাত ধরল, শারমিন ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল কিন্তু ড, আরশাদ তাকে ছাড়ল না। শারমিন ছটফট করতে শুরু করতেই লাবণী আর সাজ্জাদ দুপাশ থেকে তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল। ড. আরশাদ তার পালস দেখল, ব্লাড প্রেশার মাপল, চোখের মণি দেখল, জিবের রং দেখল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এখন একটা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।”

সাজ্জাদ আর লাবণী দুজনেই মাথা নাড়ল। ড, আরশাদ বলল, “কাল ভোরে ওকে একটা ক্লিনিকে ট্রান্সফার করা যাক।”

সাজ্জাদ বলল, “ঠিক আছে।”

“আমি অ্যাম্বুলেন্স আর স্টাফ পাঠিয়ে দেব।”

সাজ্জাদ আবার বলল, “ঠিক আছে।”

ড. আরশাদ ইনজেকশন বের করতে গিয়ে থেমে গিয়ে লাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবী, আপনি বলেছিলেন শারমিন আয়নাতে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছিল?”

“হ্যাঁ।” আপনাদের বাসায় কী বড় আয়না আছে?”

“কেন?”

“একটা জিনিস একটু ট্রাই করতাম। যেহেতু আয়নায় কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে, তাই সামনে বড় আয়না রেখে যদি দেখানো যেত এটা হার্মলেস, হয়তো সে পুরোটা রিকভার করে ফেলত।”

কিন্তু লাবণী ইতস্তত করে বলল, “যদি উল্টো আরো বেশি ভয় পেয়ে যায়? যদি অন্য কিছু ঘটে যায়?”

ড. আরশাদ দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, “এখন যে স্টেজে আছে তার থেকে বেশি আর কী হবে? দেখি চেষ্টা করে। সিমিলার একটা কেসে একবার পেশেন্ট পুরোপুরি রিকভার করেছিল। আছে বড় আয়না?”

লাবণী বলল, “ড্রেসিং টেবিলে যেটা ছিল সেটা তো ভেঙে ফেলেছে। বাথরুমে ফুল লেংথ আয়না আছে, কিন্তু সেটা তো দেওয়ালে লাগানো।”

সাজ্জাদ বলল, “ক্রু ড্রাইভার আছে? ক্লিপ দিয়ে লাগানো থাকে, খুলে আনা যাবে।”

ভ্রু ড্রাইভার খুঁজে পাওয়া গেল না বলে রান্নাঘর থেকে একটা চাকু এনে সাজ্জাদ বাথরুম থেকে বড় একটা আয়না খুলে আনল। ড. আরশাদ সেটা শারমিনের সামনে ধরে বলল, “শারমিন। এদিকে তাকাও। তাকাও এদিকে।”

শারমিন তাকাল না। মাথা সরিয়ে চিৎকার করতে লাগল। ড. আরশাদ বলল, “তাকাও। তাকাও আয়নার দিকে।”

শারমিন তাকাল না। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। মুখ ঢেকে চিৎকার করতে লাগল। ড. আরশাদ বলল, “থাকুক।”

আয়নাটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে ড. আরশাদ তার ব্যাগ হাতে নেয়। ভেতর থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে একটু ছোট কাঁচের অ্যাম্পুল থেকে ঘুমের ওষুধ সিরিঞ্জে ভরে শারমিনের দিকে এগিয়ে গেল। সাজ্জাদ আর লাবণী দুই পাশ থেকে শারমিনকে ধরে রাখল। ড. আরশাদ তখন তার হাতে ইনজেকশনটি দিয়ে দেয়।

ইনজেকশনের প্রায় সাথে সাথেই শারমিন খানিকটা নির্জীব হয়ে যায় এবং চোখ বন্ধ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে শুয়ে থাকে। ড. আরশাদ খানিকক্ষণ শারমিনকে লক্ষ করল। তারপর বলল, “কিছুক্ষণেই এখন ঘুমিয়ে যাবে। ঘুম সহজে ভাঙবে না। একেবারে দুপুর পর্যন্ত ঘুমানোর কথা। আমরা সকালে ক্লিনিকে নিয়ে যাব।

সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল, “থ্যাংকস আরশাদ। তুই না থাকলে যে আমি কী করতাম আমি জানি না।”

“তোরা চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন একটু বিশ্রাম নে।”

ড. আরশাদ চলে যাবার পর দুজন আবার শারমিনের ঘরে ফিরে এলো। তাদের পায়ের শব্দ শুনে শারমিন চোখ খুলে তাকায়, আরশাদ বলেছিল ঘুমিয়ে যাবে কিন্তু শারমিন এখনো ঘুমায়নি। সাজ্জাদ কাছে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় তার পাশে বসল, অন্যবার যেরকম চিৎকার করে গালাগাল শুরু করে দিত এবার সেরকম কিছু করল না। সাজ্জাদ তার মাথায় হাত রাখল, শারমিন দুর্বলভাবে হাতটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। সাজ্জাদ ভালো করে শুনতে না পেয়ে মাথাটা আরেকটু এগিয়ে দিয়ে বলল, “কী বললি, শারমিন?”

“পারবি না। তোরা পারবি না।”

“কী পারব না?”

“এই মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবি না। আমি এই মেয়েটাকে নিব।”

সাজ্জাদ বলল, “ছিঃ এইভাবে কথা বলে না শারমিন।”

“তোর বউ ঠিক কথাই বলেছে।”

সাজ্জাদ চমকে উঠে শারমিনের দিকে তাকাল, শারমিনের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, ফিসফিস করে বলে, “তোর মেয়ে মুখে রক্ত উঠে মরবে। মরবেই মরবে।”

“কী বলছিস তুই।”

শারমিনের মুখে হাসিটা আরও বিস্তৃত হয়, সে খলখল করে হাসতে হাসতে বলল, “তোর বউয়ের পেটে বাচ্চাটা আছে সেটাও

মরে যাবে! কেমন করে মরবে জানিস?”

“কেমন করে?”

“তুই মারবি। তুই তুই!”

সাজ্জাদ বিস্ফারিত চোখে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল। শারমিন ভয়ংকর ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, “কেন মারবি জানিস?”

“কেন?”

“কারণ বাচ্চাটা তোর না! তোর বউ তোকে ঠকিয়েছে। বুড়া হাবড়া কোথাকার–”

সাজ্জাদ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়াল, একধরনের অবিশ্বাস নিয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল। লাবণী একটু দূর দাঁড়িয়েছিল বলে শারমিন কী বলছে শুনেনি। এবারে একটু এগিয়ে। এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সাজ্জাদ?”

সাজ্জাদ কোনো কথা না বলে হতচকিতের মতো একবার শারমিনের দিকে আরেকবার লাবণীর দিকে তাকাল। লাবণী আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী বলেছে শারমিন?”

সাজ্জাদ ফিসফিস করে বলল, “না কিছু না।” তারপর লাবণীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাত দিয়ে শারমিনকে দেখিয়ে বলল, “এ শারমিন নয়।”

“কী বলছ তুমি?”

“হ্যাঁ। আমি জানি এ আসলেই কাফ্রীদা!”

শারমিন বিছানায় নির্জীবের মতো শুয়ে থেকে খলখল করে হাসতে থাকে।

ড. আরশাদ বলেছিল শারমিন কয়েক মিনিটের মাঝে ঘুমিয়ে পড়বে, কিন্তু সত্যি সত্যি যখন শেষ পর্যন্ত সে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন এক ঘণ্টা থেকেও বেশি সময় পার হয়েছে। এ সময়টুকু লাবণী শারমিনের হাত ধরে বসেছিল। শারমিন ফিসফিস করে দুর্বোধ্য প্রলাপ বকেছে, লাবণী সেগুলো শুনেছে, শুনে সেও ফিসফিস করে শারমিনের সাথে কথা বলেছে। কাফ্রীদার ভেতর কোথাও তার আদরের শারমিন লুকিয়ে আছে, সে সেই শারমিনের সাথে কথা বলে গেছে। কাফ্রীদা তাকে বলতে দিতে চায় না কিন্তু সে তবু বলেছে। ভয়ংকর এই দানবের হাতে আটকে পড়া তার ছোট মেয়েটিকে সে সাহস দিয়েছে, সান্ত্বনা দিয়েছে, আদর আর ভালোবাসা দিয়েছে। তার আদরের শারমিন সেটা বুঝতে পেরেছে কী না সে জানে না, কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যেও থামেনি।

শারমিন যখন শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে গেছে তখন লাবণী বাইরের ঘরে এসেছে। সেখানে সোফায় সাজ্জাদ চুপচাপ দুই গালে হাত দিয়ে বসেছিল। লাবণীকে দেখে বলল, “ঘুমিয়েছে?”

লাবণী মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, ঘুমিয়েছে।”

“আরশাদ বলেছিল, কয়েক মিনিটে ঘুমাবে, আসলে কত সময় লেগেছে দেখেছ?”

“আমিও তাকে একটা সিডেটিভ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছিলাম। তারপরেও উঠে গেছে।”

“কোনো একটা কারণে মেটাবলিজম খুব বেশি।”

দুজন চুপচাপ বসে থাকে, দীর্ঘ দুই বছর পর একজন আরেকজনকে দেখছে, দুজনের মনেই ছোটখাটো কথা এসে ভিড় করছে কিন্তু বলতে পারছে না। শারমিনের বিষয়টা এমন একটা চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে যে দুজনের কেউ আর অন্যকিছু ভাবতে পারছে না। সাজ্জাদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি নিজের চোখে না দেখলে এটা বিশ্বাস করতাম না।”

লাবণী বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেও এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।

“এমন কিছু কথা বলেছে যেটা ওর জানার কথা না।”

লাবণী কোনো কথা না বলে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল, “ভয়ংকর ভয়ংকর সব কথা।”

লাবণী বলল, “আমি আজ সারাদিন ভূত-প্রেত-দানব আর ব্ল্যাক আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছি। সেখানে লেখা আছে এরা যখন কোনো মানুষকে বশ করে ফেলে তখন তার মুখ দিয়ে যেসব কথা বলে সেগুলো বেশির ভাগ হয় মিথ্যা। ভয় দেখানোর জন্যে ভয়ংকর ভয়ংকর কথা।”

সাজ্জাদ মাথা নাড়ল, বলল, “আমাকে যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো মিথ্যা না।”

“হতে পারে।” লাবণী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বইয়ে লেখা আছে পশুপাখি, পোকামাকড় নাকি ওদের উপস্থিতি বুঝতে পারে। যখন ওরা আসে তখন নাকি সব জন্তু-জানোয়ার, পোকামাকড় পালিয়ে যায়। এখানে কত মশা কিন্তু ওই ঘরে একটি মশাও নেই। দেওয়ালে টিকটিকি পর্যন্ত নেই।”

সাজ্জাদ বলল, “ঘরটা কেমন ঠাণ্ডা।”

“হ্যাঁ, বইগুলোতে সেটাও লেখা আছে। ঘরে মাংস পচার মতো একধরনের গন্ধ হবে।”

সাজ্জাদ মাথা নাড়ে, বলে, “হ্যাঁ পচা একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না।”

“সবচেয়ে ভয়ংকর কথা কী জানো?”

“কী?”

“এরা শক্তি পায় কোথা থেকে জানো?”

“কোথা থেকে?”

“অন্যের প্রাণ থেকে। একটা করে জীবন্ত প্রাণ নেয় আর তখন সেই জীবনীশক্তিটা পেয়ে যায়। সেজন্যে এরকম সময় ঘরে কোনো জীবিত প্রাণী রাখতে হয়, পাখি, কুকুর, বিড়াল–”

“সেগুলো মেরে ফেলে?”

“তাই পড়েছি। সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মানুষ মারতে।”

“মানুষ?”

“হ্যাঁ।”

“তার মানে চেষ্টা করবে শারমিনের কিছু করতে?”

“না-না-শারমিন হচ্ছে ওর হোস্ট। শারমিনের ওপর ভর করে সে টিকে আছে। তাই শারমিনের কিছু করবে না। অন্যদের করবে। কাছাকাছি মানুষের, আপনজনের।”

“সাজ্জাদ বলল, “তার মানে তোমার কিংবা আমার?”

“হ্যাঁ। তোমার কিংবা আমার।”

লাবণীর কথা শেষ হবার আগেই সাজ্জাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়, চাপা গলায় বলে, “হায় খোদা!”

“কী হয়েছে?” বলে লাবণী সাজ্জাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকায় এবং সাথে সাথে তার শরীর পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়।

শোয়ার ঘরের দরজা দিয়ে শারমিন বের হয়ে আসছে। সে দুই হাতে শক্ত করে একটা চাকু ধরে রেখেছে-চাকুটা লাবণী আর সাজ্জাদ দুজনেই চিনতে পারল। ড. আরশাদের জন্যে বাথরুম থেকে আয়নাটা খুলে আনতে গিয়ে ভ্রু ড্রাইভার খুঁজে না পেয়ে এ চাকুটা সে রান্নাঘর থেকে নিয়ে গিয়েছিল। চাকুটা ভুল করে শোয়ার ঘরে রেখে এসেছিল, শারমিন ভুল করেনি সেটা তুলে এনেছে।

সাজ্জাদ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কী ভয়ংকর চেহারা শারমিনের, মাথার চুলগুলো উড়ছে, চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, মুখে ভয়ংকর একটি ক্রুর হাসি। সাজ্জাদ ছুটে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, লাবণী তাকে থামাল। শারমিন দুই হাতে চাকুটা আরো একটু ওপরে তুলে লাবণীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

লাবণী নিচু গলায় বলল, “শারমিন।”

শারমিন হিসহিস কর ওঠে, “আমি শারমিন না!”

লাবণী তীব্র গলায় বলল, “অবশ্যই তুই শারমিন। আমি জানি তুই শারমিন। তোকে আমি পেটে ধরেছি, বুকে চেপে বড় করেছি। তুই শারমিন!”

শারমিন খ্যাপার মতো দুই পাশে মাথা নাড়ল, বলল, “না-না-না আমি শারমিন না। আমি কাফ্রীদা।”

‘কাফ্রীদা একটা দানব। তার জায়গা হবে দোজখে–” লাবণী চিৎকার করে বলল, “আমার সোনামণি শারমিনের ওপরে কোনো দানব থাকতে পারবে না। যা তুই দানব, দূর হয়ে যা–”

“যাব না। আমি যাব না—”

লাবণী আকুল হয়ে বলল, “সোনামণি শারমিন মা আমার, তুই কারো কথা শুনবি না। তুই শুধু আমার কথা শোন-আমি জানি তুই আমার কথা শুনছিস। আয় মা তুই আমার কাছে। তুই জেগে ওঠ, ঝাড়া দিয়ে এই নোংরা-ময়লা জানোয়ারটাকে, এই দানবটাকে ফেলে দে। আমি জানি তুই পারবি! তুই পারবি–”

শারমিন চাকু হাতে আর দুই পা এগিয়ে আসে, খলখল, করে হেসে ওঠে বলে, “পারবি না তুই! পারবি না আমার সাথে। আমি কাফ্রীদা! অনেকদিন পর আমি ছাড়া পেয়েছি, আমার অনেক খিদে পেয়েছে। আমাকে এখন খেতে হবে, খেতে হবে—”

লাবণী বলল, “শারমিন মা আমার! তুই আমার চোখের দিকে তাকা। একবার তুই আমার চোখের দিকে তাকা। আমি তোর আম্মু! মনে নাই তোর, তোকে আমি বুকে করে মানুষ করেছি! আয় মা তুই আমার কাছে, তোকে বুকে জড়িয়ে ধরব! আমার বুকটা খা খা করছে–”

“তোর বুকে আমি চাকু বসাব। রক্তের বন্যা হবে এখানে–”

“না!” লাবণী চিৎকার করে বলল, “না! না! না! শারমিন তুই তোর মায়ের বুকে চাকু বসাতে দিবি না! তুই জেগে ওঠ, জেগে উঠে দেখ তোক কী করছে! এই দানব তোর হাতে করে চাকু ধরিয়ে আনছে তোর আম্মুকে খুন করার জন্যে। তুই কী পারবি কখনো?

পারবি না–ছুঁড়ে ফেলে দে চাকু, আয় আমার কাছে মা। আয়। আমার চোখের দিকে তাকা! আমি জানি তুই আছিস! আমি জানি তুই আছিস, তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস!”

শারমিনের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে ওঠে। লাবণী তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শূন্যে অপ্রকৃতিস্থ একটা দৃষ্টিতে হঠাৎ একধরনের জীবনের স্পন্দন দেখা যায়। লাবণী সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে শারমিনের ভয়ংকর ক্রুর মুখটিতে হঠাৎ ব্যথার চিহ্ন ফুটে উঠছে। দুই চোখে হঠাৎ গভীর ভালোবাসা আর গভীর বেদনার আভাস দেখা দিতে থাকে। লাবণী এক পা অগ্রসর হয়ে বলে, “আয় মা আমার। বুকে আয় তোর জন্যে আমি পাগল হয়ে অপেক্ষা করছি! আয় মা আমার–“

শারমিন এক পা অগ্রসর হয়, হঠাৎ করে তার পা টলে ওঠে, দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখা চাকুটা হাত থেকে খুলে নিচে এসে পড়ে। শারমিন এক পা এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে, “আম্মু,আম্মু তুমি কোথায় ছিলে?”

শারমিন তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখেমুখে চুমো দিয়ে বলল, “এই তো আমি আছি তোর সাথে। এই দেখ মা—”

“আমার খুব ভয় করছে মা। খুব ভয় করছে–”

“তোর কোনো ভয় নেই। আর কোনো ভয় নেই।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

শারমিনের মুখে একটা সূক্ষ হাসি ফুটে ওঠে এবং হঠাৎ করে সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে যায়। লাবণী বলল, “সাজ্জাদ ওকে একটু ধরো। আমি একা পারছি না।”

সোফায় শুইয়ে রেখে লাবণী শারমিনের মুখে নিজের মুখ স্পর্শ করে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বেডরুম থেকে তুমি একটা চাদর এনে দেবে প্লিজ। শারমিনের মনে হয় শীত করছে–“

চাদর না নিয়েই সাজ্জাদ এক মুহূর্ত পরে ফিরে এলো। তার মুখ ফ্যাকাসে এবং হাত অল্প কাঁপছে। লাবণী অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে।”

“তুমি বিশ্বাস করবে না! তুমি কিছুতেই বিশ্বাস করবে না “

“কী বিশ্বাস করব না?”

“শোয়ার ঘরে যে আয়নাটা ছিল–“

“কী হয়েছে সেই আয়নাটার?”

“সেই আয়নার ভেতরে ভয়ংকর একটি মূর্তি!” লাবণী তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “খবরদার ওটা ছুঁবে না! খবরদার

“কী হবে ছুঁলে?”

“আবার বের হয়ে যাবে।”

“তাহলে কী করব?”

“আরেকটা আয়না খুলে আনো, তারপর এই আয়নাটার ওপর সেটা মুখোমুখি বসিয়ে দাও। তাহলে প্রতিবিম্বের প্রতিবিম্ব হয়ে এই দানব যুগের পর যুগ আটকা পড়ে যাবে! দূর থেকে দূরে চলে যাবে–“

“তুমি কেমন করে জানো?”

“আমি জানি। তুমি যাও দেরি করো না। আমি শারমিনকে ছেড়ে যাব না।”

সাজ্জাদ যখন দ্বিতীয় আয়নাটা খুলে নিয়ে আসে তখন আয়নার ভেতরে আটকা পড়ে থাকা ভয়ংকর মূর্তিটার মাঝে অস্বাভাবিক একটা চাঞ্চল্য দেখা দেয়। সেটি ভেতরে হুটিপুটি খায়, ছটফট করে এবং যখন দুটি আয়না কাছাকাছি এসে প্রতিবিম্বের ভেতর প্রতিবিম্ব দিয়ে একটি অসীম সুরঙ্গের মতো সৃষ্টি হয় সেটি ছটফট করতে করতে সেই সুরঙ্গ দিয়ে অতলে অদৃশ্য হয়ে যায়। সাজ্জাদ তারপরেও কোনো ঝুঁকি নিল না। দুটো আয়না শক্ত করে বেঁধে রাখল। তার পরিচিত এক বন্ধুর সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি আছে। বিশাল ফার্নেসে সেখানে সবকিছু গলিয়ে ফেলা যায়। এ দুটি আয়নাকে এভাবে রেখেই সে গলিয়ে ভস্ম করে দেবে। কাফ্রীদা নামের দানব যেন আর কোনোদিন ফিরে আসতে না পারে।

ভোরবেলা নাস্তার টেবিলে শারমিন খেতে বসেছে। সাজ্জাদ শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে, বলল, “আমি এখন যাই।”

শারমিন বলল, “আমাদের সাথে নাস্তা করে যাও।”

সাজ্জাদ লাবণীর দিকে তাকাল, লাবণী বলল, “হ্যাঁ। নাস্তা করে যাও। আয়োজন খুব ভালো নয়–আগেই বলে রাখছি।”

সাজ্জাদ একসময়ে তার জন্যে নির্ধারিত যে চেয়ার ছিল সেটাতে বসে বলল, “এর চাইতে ভালো আয়োজন কী আমার জন্মে আমি কখনো পাব?”

লাবণী কোনো কথা বলল না। শারমিন বলল, “পাবে আব্বু। তুমি পাবে। তুমি ইচ্ছে করলেই পাবে।”

সাজ্জাদ লাবণীর দিকে তাকাল। লাবণী খুব সাবধানে তার চোখের কোনা মুছে নিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে সাজ্জাদের দিকে তাকাল, বলল, “কী খাবে তুমি? চা না কফি?”

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *