ওপার হতে এপার পানে খেয়া-নৌকো বেয়ে
ভাগ্য নেয়ে
দলে দলে আনছে ছেলে মেয়ে ।
সবাই সমান তারা
এক সাজিতে ভরে-আনা চাঁপা ফুলের পারা ।
তাহার পরে অন্ধকারে
কোন্ ঘরে সে পৌঁছিয়ে দেয় কারে!
তখন তাদের আরম্ভ হয় নব নব কাহিনী-জাল বোনা —
দুঃখে সুখে দিনমুহূর্ত গোনা ।
একে একে তিনটি মেয়ের পরে
শৈল যখন জন্মাল তার বাপের ঘরে ,
জননী তার লজ্জা পেল ; ভাবল কোথা থেকে
অবাঞ্ছিত কাঙালটারে আনল ঘরে ডেকে ।
বৃষ্টিধারা চাইছে যখন চাষি
নামল যেন শিলাবৃষ্টিরাশি ।
বিনা-দোষের অপরাধে শৈলবালার জীবন হল শুরু ,
পদে পদে অপরাধের বোঝা হল গুরু ।
কারণ বিনা যে-অনাদর আপনি ওঠে জেগে
বেড়েই চলে সে যে আপন বেগে ।
মা তারে কয় ‘ পোড়ারমুখী ‘ , শাসন করে বাপ —
এ কোন্ অভিশাপ
হতভাগী আনলি বয়ে — শুধু কেবল বেঁচে-থাকার পাপ ।
যতই তারা দিত ওরে গালি
নির্মলারে দেখত মলিন মাখিয়ে তারে আপন কথার কালি ।
নিজের মনের বিকারটিরেই শৈল ওরা কয় ,
ওদের শৈল বিধির শৈল নয় ।
আমি বৃদ্ধ ছিনু ওদের প্রতিবেশী ।
পাড়ায় কেবল আমার সঙ্গে দুষ্টু মেয়ের ছিল মেশামেশি ।
‘ দাদা ‘ বলে
গলা আমার জড়িয়ে ধরে বসত আমার কোলে ।
নাম শুধালে শৈল আমায় বলত হাসি হাসি —
‘ আমার নাম যে দুষ্টু , সর্বনাশী! ‘
যখন তারে শুধাতেম তার মুখটি তুলে ধরে
‘ আমি কে তোর বল দেখি ভাই মোরে ? ‘
বলত ‘ দাদা , তুই যে আমার বর! ‘ —
এমনি করে হাসাহাসি হত পরস্পর ।
বিয়ের বয়স হল তবু কোনোমতে হয় না বিয়ে তার —
তাহে বাড়ায় অপরাধের ভার ।
অবশেষে বর্মা থেকে পাত্র গেল জুটি ।
অল্পদিনের ছুটি ;
শুভকর্ম সেরে তাড়াতাড়ি
মেয়েটিরে সঙ্গে নিয়ে রেঙ্গুনে তার দিতে হবে পাড়ি ।
শৈলকে যেই বলতে গেলেম হেসে —
‘ বুড়ো বরকে হেলা করে নবীনকে , ভাই , বরণ করলি শেষে ? ‘
অমনি যে তার দু-চোখ গেল ভেসে
ঝরঝরিয়ে চোখের জলে । আমি বলি , ‘ ছি ছি ,
কেন , শৈল , কাঁদিস মিছিমিছি ,
করিস অমঙ্গল । ‘
বলতে গিয়ে চক্ষে আমার রাখতে নারি জল ।
বাজল বিয়ের বাঁশি ,
অনাদরের ঘর ছেড়ে হায় বিদায় হল দুষ্টু সর্বনাশী ।
যাবার বেলা বলে গেল , ‘ দাদা , তোমার রইল নিমন্ত্রণ ,
তিন-সত্যি — যেয়ো যেয়ো । ‘ ‘ যাব , যাব , যাব বই কি বোন । ‘
আর কিছু না বলে
আশীর্বাদের মোতির মালা পরিয়ে দিলেম গলে ।
চতুর্থ দিন প্রাতে
খবর এল , ইরাবতীর সাগর-মোহানাতে
ওদের জাহাজ ডুবে গেছে কিসের ধাক্কা খেয়ে ।
আবার ভাগ্য নেয়ে
শৈলরে তার সঙ্গে নিয়ে কোন্ পারে হায় গেল নৌকো বেয়ে
কেন এল কেনই গেল কেই বা তাহা জানে ।
নিমন্ত্রণটি রেখে গেল শুধু আমার প্রাণে ।
যাব যাব যাব , দিদি , অধিক দেরি নাই ,
তিন-সত্যি আছে তোমার , সে-কথা কি ভুলতে পারি ভাই ।
আরো একটি চিহ্ন তাহার রেখে গেছে ঘরে
খবর পেলেম পরে ।
গালিয়ে বুকের ব্যথা
লিখে রাখি এইখানে সেই কথা —
দিনের পরে দিন চলে যায় ওদের বাড়ি যাই নে আমি আর ।
নিয়ে আপন একলা প্রাণের ভার
আপন মনে
থাকি আপন কোণে ।
হেনকালে একদা মোর ঘরে
সন্ধ্যাবেলায় বাপ এল তার কিসের তরে ।
বললে , “ খুড়ো একটা কথা আছে ,
বলি তোমার কাছে ।
শৈল যখন ছোটো ছিল , একদা মোর বাক্স খুলে দেখি
হিসাব-লেখা খাতার ‘ পরে এ কী
হিজিবিজি কালির আঁচড় । মাথায় যেন পড়ল ক্রোধের বাজ ।
বোঝা গেল শৈলরি ই এ কাজ ।
মারা-ধরা গালিমন্দ কিছুতে তার হয় না কোনো ফল —
হঠাৎ তখন মনে এল শাস্তির কৌশল ।
মানা করে দিলেম তারে
তোমার বাড়ি যাওয়া একেবারে ।
সবার চেয়ে কঠিন দন্ড! চুপ করে সে রইল বাক্যহীন
বিদ্রোহিণী বিষম ক্রোধে । অবশেষে বারো দিনের দিন
গরবিনী গর্ব ভেঙে বললে এসে , ‘ আমি
আর কখনো করব না দুষ্টামি । ‘
আঁচড়-কাটা সেই হিসাবের খাতা ,
সেই কখানা পাতা ,
আজকে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে তারি চোখের মতো ।
হিসাবের সেই অঙ্কগুলার সময় হল গত
সে শাস্তি নেই , সে দুষ্টু নেই ;
রইল শুধু এই
চিরদিনের দাগা
শিশু-হাতের আঁচড় কটি আমার বুকে লাগা । ”