গোলাপের জন্য গোলাপ
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটা একবার দেখে নিল সুনীল। না, কোথাও কোনও খুঁত নেই। ভালোবাসায় হাবুডুবু খাওয়া এক দিগভ্রান্ত যুবক। আজ সকাল থেকেই ওর বুকের ভেতরে উলটোপালটা শব্দ হচ্ছে। কেমন একটা ভয়ও আঁকড়ে ধরেছে একইসঙ্গে। গোলাপ ওর কথা শুনবে তো!
এই তো সেদিন…সন্ধেবেলা…ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের হ্রদের কিনারে বসে গোলাপের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল।
ঝগড়ার সূত্রপাত খুবই সামান্য ব্যাপার থেকে।
গোলাপ বলছিল, নানারঙের পাখি পুষতে ওর ভীষণ ভালো লাগে। সেই কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে সুনীল বলেছিল, ‘পাখির মাংস খেতে আমার খুব ভালো লাগে।’
এই কথায় চোখ কপাল তুলে গোলাপ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিল সুনীলের দিকে। তারপর চাপা গলায় নিমর্ম সুরে বলেছে, ‘ছিঃ! তুমি পাগল না রাক্ষস!’ এবং উঠে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় আঁচল ঘুরিয়ে হনহন করে হাঁটা দিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলের রোদ গোলাপের পিঠে মোলায়েম হাত রেখে পৌঁছে দিয়েছে বাগানের এলাকা ছাড়িয়ে পিচের রাস্তায়।
তার পর থেকে গোলাপ আর ফিরে আসেনি সুনীলের কাছে।
সুনীল কত চেষ্টা করেছে ওর সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু গোলাপ দেখা করেনি। সুনীল কতবার যে টেলিফোন করেছে ওর বাড়িতে! কিন্তু গোলাপ একটিবারের জন্যেও ‘বাড়ি ছিল না।’
সুনীল একা-একা বিছানায় মুখ গুঁজে কত দিন কত রাতে চোখের জল ফেলেছে। তারপর ও ঠিক করেছে গোলাপকে রাস্তায় খুঁজবে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গোলাপের খুব প্রিয়। হয়তো কোনও একদিন সন্ধেবেলা ও চলে আসবে সেখানে। নয়তো উলটোদিকের নৃত্যরত ফোয়ারার রঙিন আলোর ছ’টায় হঠাৎই একদিন দেখা যাবে গোলাপকে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রয়েছে চঞ্চল জলধারার দিকে। সুন্দর সবসময়েই গোলাপকে টানে—চুম্বকের মতো টানে।
তাই প্রতি শনিবার সন্ধেবেলা সুনীল গোলাপকে খুঁজতে বেরোয়। গোলাপের পছন্দ মতো সেজেগুজে একগুচ্ছ গোলাপ হাতে নিয়ে ও ছায়া-নেমে-আসা রাস্তায় আকুল হয়ে খোঁজে অভিমানী মেয়েটাকে। একগুচ্ছ টাটকা গোলাপের সঙ্গে থাকে সুন্দর হাতের লেখায় আঁকা কয়েকটি লাইন। সাদা কার্ডের মোলায়েম আস্তরে নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে সুনীল লিখেছে:
বন্ধুত্ব করব বলে শত্রুতা করেছিলাম,
ভাব করব বলেই আমি সেদিন আড়ি করেছিলাম,
নতুন করে বাঁচব বলে সেদিন আমি মরেছিলাম।
গোলাপের দেখা পেলেই সুনীল ওর পথ আগলে দাঁড়াবে। গোলাপফুলের গুচ্ছ আর কবিতার কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বলবে, ‘গোলাপ, এই দ্যাখো, তোমার জন্যে গোপাল ফুল নিয়ে এসেছি। আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না, লক্ষ্মীটি। এতদিন মরে ছিলাম…এখন আমাকে দয়া করে বাঁচিয়ে তোলো। তুমি কি জানো, যাকে ভালোবাসি তাকে ভালোবাসতে না-পারলে কী কষ্ট!’
সুনীল জানে তারপর কী হবে।
গোলাপ টানা-টানা চোখ মেলে ধরবে সুনীলের করুণ মুখের ওপর। ওর চোখের কোণে অশ্রুর ফোঁটা চিকচিক করে উঠবে। গাছের ছায়ার আড়ালে সুনীলের বুকের ওপরে আছড়ে পড়বে গোলাপ। ওর বুকে মুখ ঘষতে-ঘষতে বলে উঠবে কান্না মেশানো গলায়, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে আর কখনও চলে যেয়ো না। যাবে না তো?’
প্রত্যেক শনিবার সুনীল যখন পরিপাটি সেজেগুজে তৈরি হয়ে রাস্তায় পা রাখে তখন ওর বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়তে থাকে। আজ নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যাবে গোলাপের সঙ্গে। গোলাপের অভিমান ভাঙবে তো! গোলাপ শুনবে তো সুনীলের কথা! তারপর…তারপর শুধুই রঙিন ফোয়ারার মতো জীবন, যে-জীবনে কান্না নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। বাতাসে ভর করে ভালোবাসার ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দেবে ওরা দুজনে। চিরদিনের জন্য।
আজও ঠিক এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সুনীল। পকেটে হাত দিয়ে কবিতার কার্ডটা একবার অনুভব করল। তারপর একটা ফাঁকা ট্রামে চড়ে বসল।
ধর্মতলায় নেমে নিউ মার্কেট থেকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ কিনল সুনীল। সোনালি রাংতা দিয়ে সেটাকে সুন্দর করে মুড়ে দিল ফুলের দোকানদার। তারপর সেলোফেন পেপারে মুড়ে গোলাপের তোড়াটা তুলে নিল নবীন যুবকের হাতে।
প্রৌঢ় দোকানি চশমার পুরু কাচের ভেতর দিয়ে ঘোলাটে চোখে দেখছিল সুনীলকে। ভালোবাসার বয়েসটাকে সবাই ভালোবাসে। কী সুন্দর চেহারা ছেলেটার! প্রাণবন্ত টগবগে যুবক। মনে হচ্ছে, ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে এক্ষুনি ছুট লাগাবে ওর ভালোবাসার মেয়ের কাছে। মেয়েটা যত দূরেই থাক, এই যুবকের কাছে সেটা মোটেই দূর নয়। গোটা পৃথিবী এখন ওর হাতের মুঠোয়।
দোকানদারকে ফুলের দাম মিটিয়ে দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে রাস্তায় নেমে এল সুনীল। কী অপরূপ সুন্দর এই গোপাল ফুলগুলো! তবে গোলাপের চেয়ে বেশি সুন্দর নয় মোটেই। সুনীল ফুলের তোড়াটাকে নাকের কাছে নিয়ে এল। আলতো করে ঘ্রাণ নিতে চাইল তাজা গোলাপের। ওর মনে পড়ে গেল গোলাপের কথা। দুই গোলাপ যখন মুখোমুখি হবে তখন কী দারুণ হবে! সময় থেমে যাবে আচমকা। পাখিরা গাছের পাতার ফাঁকে ঘুম ভেঙে সুরেলা শিস দিয়ে উঠবে। গাঢ় অন্ধকার ছায়া-ছায়া পথ চোখের পলকে ভেসে যাবে পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদে। বারবার সূর্য উঁকি দেবে পুব আকাশে। সূর্যাস্ত বলে আর কিছু থাকবে না।
সন্ধে গাঢ় হয়েছে। রাস্তার এপাশে-ওপাশে বিদ্যুতের আলোর ঝিলিক। সার বেঁধে ধীরে-ধীরে গড়িয়ে চলেছে অসংখ্য গাড়ির চাকা। গাড়ির হেডলাইটের আলো, গাড়ির সারের ফাঁক-ফোকর দিয়ে চকিতে রাস্তা পার হয়ে যাওয়া ব্যস্ত পথচারী, নানা সুরের অধৈর্য হর্ন, আর অজস্র মানুষের ভিড়—সব মিলিয়ে এক গোলকধাঁধা। সুনীলের কেমন পাগল-পাগল লাগছিল। ও চটপট পা চালিয়ে লিন্ডসে স্ট্রিট পিছনে ফেলে পৌঁছে গেল চওড়া রাস্তায়। রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথ ধরে পার্ক স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে শুরু করল ও। এদিকটায় ভিড় অনেক কম। ও বেশ নিশ্চিন্তে গোলাপের কথা ভাবতে-ভাবতে এগিয়ে চলল। ওর কোনও তাড়া নেই। সন্ধে আরও ঘন হোক, আঁধার হোক। তখনই গোলাপকে খুঁজে পেতে সুবিধে হবে। সুনীলের ঠোঁটে তখনও গুনগুন গানের কলি: ‘…ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলই যাতনাময়…’।
বিড়লা তারামণ্ডলের কাছে পৌঁছে ফুটপাথের কিনারায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করল সুনীল। ওকে অতিক্রম করে চলে যাওয়া প্রতিটি মেয়েকে খুঁটিয়ে নজর করে দেখল। না, গোলাপ নেই। তখন…কতক্ষণ পর কে জানে…ও হাঁটতে শুরু করল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে। বড়-বড় গাছপালায় সাজানো রাজপথ এখন আরও অন্ধকার, আরও রহস্যময়।
হঠাৎই দূর থেকে হেঁটে আসা একটি মেয়েকে দেখতে পেল সুনীল। মেয়েটি একা নয়। তার সঙ্গে একজন পুরুষ রয়েছে। হালকা শীতের বাতাস কেটে যেন ভেসে-ভেসে ওরা এগিয়ে আসছে। মেয়েটি গোলাপ নাকি? এরমধ্যেই সুনীলকে ভুলে গিয়ে অন্য পুরুষকে পছন্দ করে ফেলেছে! অসম্ভব! একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল সুনীল। আরও একটু কাছাকাছি এগিয়ে আসুক ওরা। তখন ভালো করে দেখা যাবে।
কিন্তু ওরা দুজনে আরও এগিয়ে আসতেই তৃতীয় একজন পুরুষকে দেখতে পেল সুনীল। লোকটার ভাবভঙ্গি এমন, যেন বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনকে অনুসরণ করছে সে।
কে ওই লোকটা? সুনীলের মতোই কেউ…যে তার নিজের গোলাপকে খুঁজছে! না কি…।
হঠাৎই ভয় পেল সুনীল। ওই লোকটা সেই লোকটা নয় তো!
গত তিন বছরে চারজন মানুষ খুন হয়ে গেছে এই এলাকায়। তিনজন তরুণী, একজন যুবক। অচেনা অজানা কোনও বিকৃত মনের নৃশংস মানুষ ধারালো ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে খতম করেছে ওই চারজন হতভাগাকে। পুলিশ অনেক ফাঁদ পেতেও ধরতে পারেনি খুনিকে।
মনটা কু-ডাক ডেকে উঠল সুনীলের। গোলাপের কিছু হয়নি তো!
ঠিক তখনই সেই পুরুষ ও রমণী সুনীলের কাছে পৌঁছে গেল। অচেনা দুটো মুখ। নিজেদের কথাতেই ওরা বিভোর। সুনীলকে ওরা খেয়ালই করল না। সহজ ছন্দে পা ফেলে ওরা সুনীলকে পেরিয়ে গেল।
না, অনুসরণ করে আসা লোকটাকেও ওরা দেখতে পায়নি।
কিন্তু ওই লোকটা দেখতে পেল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সুনীলকে।
অনুসরণের কাজ বন্ধ রেখে সে চকিতে সরে এল গাছের গুঁড়ির দিকে—সুনীলের খুব কাছে।
লোকটার চেহারা পেটানো। অন্ধকারে মুখচোখ স্পষ্ট ঠাহর করা যাচ্ছে না। পরনে ফুলহাতা শার্ট, কালচে রঙের প্যান্ট। লোকটার বাঁ-হাতে নলের মতো পাকানো কিছু কাগজ—হয়তো খবরের কাগজ।
সুনীল ভয় পেয়ে হকচকিয়ে গেল।
লোকটা একটু রুক্ষ অথচ চাপা গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার, এখানে একা-একা ঘুরঘুর করছেন কেন?’
‘না…মানে…এমনই…মানে একজনের আসার কথা আছে…।’
সুনীলের নিষ্পাপ বিমূঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটার কেমন মায়া হল। আশ্চর্য! কত বয়েস হবে এই ছেলেটার? বাইশ, তেইশ…নয়তো বড়জোর চব্বিশ। এর মনে কি এতটুকু ভয়ডর নেই?
তখনই সুনীলের হাতে-ধরা ফুলের তোড়াটা দেখতে পেল সে। লোকটার ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি খেলে গেল। ছেলেটার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছিল, বেচারা নবীন প্রেমিক। ফুলের তোড়াটা দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল। প্রেমে পড়লে ভয়ডর নির্ঘাত কমে যায়।
লোকটা পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ বের করে সুনীলের মুখের ওপরে আলো ফেলল। ভয়ে সুনীলের বুক কেঁপে উঠল।
‘নাম কী? কোথায় থাকেন?’ প্রশ্ন দুটো শেষ হওয়ামাত্রই আলো নিভে গেল।
সুনীলের গলা শুকিয়ে কাঠ। তবু অনেক চেষ্টায় কোনওরকমে যা-হোক-কিছু উত্তর দিল ও।
সেটা শুনে লোকটা বলল, ‘এখানে বেশিক্ষণ থাকবেন না। জায়গাটা ভালো নয়। কাগজে পড়েননি, এদিকটায় তিন-চারটে মার্ডার হয়ে গেছে।’
কথা বলার সময় আধো-আঁধারিতে লোকটার দাঁত দেখা গেল।
সুনীল ঠোঁটের ওপরে জিভ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি…আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। মানে…এই ফুলটা দিয়েই…।’
লোকটা হাসল, বলল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি। সেটা না-বুঝলে আপনাকে এক্ষুনি অ্যারেস্ট করতাম। আমরা সন্ধের পর থেকে এই এলাকায় রেগুলার ওয়াচ রাখছি। যান, যান—জলদি কেটে পড়ুন।’
লোকটা আর দাঁড়াল না। জোর পায়ে হেঁটে চলে গেল বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামের দিকে।
সুনীলের বুক ঠেলে স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ওঃ, ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও। ফুলের তোড়াটাই আজ বোধহয় ওকে বাঁচিয়ে দিল।
গোলাপ ফুলের তোড়াটার কথা মনে পড়তেই ওর মনে পড়ে গেল অন্য গোলাপের কথা। সঙ্গে-সঙ্গে রওনা হয়ে পড়ল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে।
অন্ধকার পথে পা চালিয়ে যাওয়ার সময় সুনীলের বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত বাজনা শুরু হয়ে গেল। গোলাপের খোঁজে যখনই ও এখানে আসে তখনই এই বাজনার শব্দ শুনতে পায়।
নির্জন শুনশান এলাকা পেরিয়ে সুনীল চলে এল আরও নির্জন এলাকায়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সদর দরজা, নাচনি-ফোয়ারা সব পিছনে ফেলে ও এগিয়ে এসেছে। রাস্তার ওপরে ছড়িয়ে রয়েছে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের কমলা রঙের আলো। তারই কিছু অংশ শুয়ে আছে ফুটপাথে।
অনুসন্ধানী চোখে এদিক-ওদিক তাকাল সুনীল। কোথায় গোলাপ? ওই তো! আনন্দে চোখে জল এসে গেল সুনীলের। এতদিনে তা হলে অপেক্ষা শেষ হল!
রাস্তার ওপারে গাছের ছায়ার আড়ালে ধীরে-ধীরে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটি। কমলা রঙের আলো ওর সুঠাম শরীরে লুকোচুরি খেলছে।
চট করে রাস্তা পার হয়ে ওর কাছাকাছি চলে গেল সুনীল। একটা গাড়ি গর্জন তুলে ঝড়ের বেগে ছুটে গেল রাস্তা দিয়ে। তারপর আবার সব চুপচাপ।
‘গোলাপ!’ সুনীল ভালোবাসার গলায় ডেকে উঠল।
গোলাপের ফাঁপানো হর্স টেইল করা চুল। চুলের গোড়ায় রঙিন বো। এ ছাড়া পারফিউমের গন্ধও যেন ভেসে এল সুনীলের নাকে।
‘গোলাপ, আমি এসেছি—।’
মেয়েটি ঘুরে তাকাল। পাউডারে-পাউডারে মুখ ফ্যাকাসে, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিকের রং। নাকে নাকছাবি, কপালে কাচপোকা টিপ।
সুনীলের দিকে কটাক্ষ হেনে তাকিয়ে পেশাদারি গলায় ও বলল, ‘পঞ্চাশ টাকা লাগবে। বারগেইনিং চলবে না।’
‘গোলাপ!’ গাঢ় স্বরে বলল সুনীল।
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল, বলল, ‘গোলাপ বলে ডাকো আর জবা কি শেফালি বলে ডাকো—ওই পঞ্চাশ টাকাই লাগবে।’
সুনীলের বুকের ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠল। ও কার জন্য গোলাপ নিয়ে এসেছে! এ তো গোলাপ নয়! এ তো একটা খারাপ মেয়ে! গোলাপ, গোলাপ তুমি কোথায়?
গোলাপের তোড়াটা হাত থেকে ফেলে দিল সুনীল। অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় দু-পা ফেলে পৌঁছে গেল মেয়েটির প্রায় গায়ের ওপরে। কড়া পারফিউমের গন্ধে সুনীলের গা গুলিয়ে উঠল। প্যান্টের পকেট থেকে চোখের পলকে ও একটা ছুরি বের করে নিল। বোতাম টিপতেই ঝকঝকে ফলাটা ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে এল সামনে।
মুহূর্তে মেয়েটির চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। চিৎকার করার জন্য বিশাল মাপের হাঁ করে ফেলল ও। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
এতবড় আস্পর্ধা! চিৎকার করতে চাইছে! একলহমায় সুনীলের ছুরি নিষ্ঠুরভাবে ছোবল মারল মেয়েটির গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল, কিন্তু সুনীল থামল না। আবার ছুরি চালাল, ছুরি চালাল, ছুরি চালাল…।
মেয়েটি লুটিয়ে পড়েছে ধুলোর ওপরে, তবে একফোঁটা চিৎকার করতে পারেনি। ও গোলাপ নয়, তাই ওর বেঁচে থাকার মানে হয় না। সুনীলের শুধু গোলাপকে চাই, আর কাউকে না, কাউকে না! তিনটি বছর ধরে ও একনাগাড়ে গোলাপকে খুঁজে চলেছে, কিন্তু পায়নি।
সুনীলের সারা শরীরে উত্তেজনায় কাঁপছিল। ছুরিটা ভাঁজ করে আবার পকেটে রেখে দিল ও। ওর জামাকাপড় রক্তে ভেসে গেছে। কিন্তু তাতে কোনও ক্ষতি নেই। গাছের আড়ালে গিয়ে জামাকাপড় খুলে সেগুলো লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেবে সুনীল। তারপর শুধু অন্তর্বাস পরে ও চলে যাবে নিরাপদ জায়গায়। তবে যাওয়ার আগে গোলাপের তোড়াটা নিয়ে যেতে ও ভুলবে না। কারণ, পুলিশের জন্য কোনও সূত্রই ও রেখে যেতে চায় না।
ওকে যে এখনও অনেকবার গোলাপের খোঁজে আসতে হবে!