খবরের কাগজটা
খবরের কাগজটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে কাকাবাবু বললেন, কী রে সন্তু, একটু বেড়াতে যাবি?
কথাটা শুনেই সন্তুর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কাকাবাবুর একটু বেড়াতে যাওয়া মানে তো হিমালয় কিংবা আন্দামান। কিংবা আরও দূর বিদেশেও হতে পারে। কয়েকদিন ধরেই কাকাবাবু দক্ষিণ আমেরিকার কথা বলছিলেন।
সন্তু বলল, হ্যাঁ যাব। কোথায় কাকাবাবু?
কাকাবাবু মর্নিং ওয়াক করতে যান, সেই জন্য জামা-জুতো পরেই ছিলেন। ক্রাচটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল না, ট্রেনে করে একটু ঘুরে আসি।
প্লেনে নয়, ট্রেনে যেতে হবে শুনে সন্তু একটু দমে গেল। তা হলে তো বিদেশে যাওয়া হবে না। অবশ্য ট্রেনে চেপে বেড়াতেও সন্তুর ভাল লাগে।
সে বলল, কটার সময় ট্রেন? বাক্সটোক্স গুছিয়ে নিই তা হলে?
কাকাবাবু বললেন, ওসব কিছু নিতে হবে না। চল এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি, স্টেশনে গেলে একটা কোনও ট্রেন পেয়ে যাব। তুই শুধু ওপরের ঘর থেকে আমার হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে আয়, আর বৌদিকে বলে আয় যে, আমাদের ফিরতে একটু রাত হতে পারে।
সন্তু সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে নিল। কিন্তু জোজোকে খবর দেওয়া গেল না। ছুটির দিন, জোজো অনায়াসে সঙ্গে যেতে পারত।
বাড়ির বাইরে এসে কাকাবাবু বললেন, দ্যাখ দেখি, একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় নাকি?
মিনিট পাঁচেক রাস্তা দূরে ছোট পার্ক আছে, সেইখানে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। সন্তু ছুটে গেল সেদিকে। মনে তার বেশ খটকা লেগেছে। একদিনের জন্য ট্রেনে করে বেড়াতে যাওয়া? কাকাবাবুর তো আগে কখনও এরকম শখ হয়নি। কিংবা কাকাবাবু কখনও একদিন দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও সন্তুকে তখন সঙ্গে নেন না। অনেক দূরে গেলেই সন্তুকে তাঁর দরকার হয়।
স্ট্যান্ডে একটা মোটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল, সন্তু সেটার কাছে পৌঁছবার আগেই এক ভদ্রলোক ধাঁ করে সেটায় উঠে বসলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আর ছোট-ছোট পাঁচটি ছেলেমেয়ে। সন্তু একটু নিরাশ হল। আবার কতক্ষণে ট্যাক্সি আসবে কে জানে!
তক্ষুনি একটা সাদা রঙের গাড়ি থামল সন্তুর গা ঘেঁষে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিমান বলল, কী রে সন্তু, কোথায় যাবি? উঠে পড়, গাড়িতে উঠে পড!
বিমানের রং খুব ফস আর মাথাভর্তি বড় বড় চুল, পাতলা লম্বা চেহারা। বিমানের ডাকনাম সাহেব। ছোটবেলায় তাঁকে সবাই সাহেব-বাচ্চা বলে ভুল করত। সবচেয়ে মজার কথা হল, বিমান প্লেন চালায়, এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট। নামের সঙ্গে কাজের এমন মিল খুব কম দেখা যায়। সন্তু বলল, না বিমানদা, আমি একটা ট্যাক্সি খুঁজছি। বিমান বলল, তুই আবার এত সকলে ট্যাক্সিতে কোথায় যাবি? চল, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।
সন্তু আমতা আমতা করতে লাগল। কোথায় যাবে তা তো সে নিজেই জানে না। তারপর ট্রেনে যাবার কথা মনে পড়ায় বলল, কাকাবাবুর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে যাব।
বিমান বলল, কাকাবাবু যাবেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি, এখন আমার কোনও কোজ নেই। আমার দুদিন ছুটি।
কাকাবাবুর নানারকম পছন্দ-অপছন্দ আছে, বিমানদার সঙ্গে যেতে রাজি হবেন কি না কে জানে! কিন্তু বিমানদাকে তো আর ন বলা যায় না। সন্তু তাই উঠে পড়ল গাড়িতে।
বাড়ির সামনে পৌঁছেই সন্তু বলল, একটাও ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে না। কাকাবাবু। সেইজন্যে বিমানদাকে বলে-
কাকাবাবু বললেন, তা বেশ তো, বিমান, তুমি আমাদের একটু শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দেবে নাকি?
বিমান বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন। শিয়ালদা যাবেন? সন্তু যে বলল হাওড়া?
কাকাবাবু বললেন, না, আমরা শিয়ালদা দিয়ে একটু ক্যানিং যাব।
বিমান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যানিং যাবেন? সেখানে কী আছে?
কাকাবাবু কখন কোথায় যেতে চান সে সম্পর্কে সন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। সে ভাবে, সময় হলে তো জানতেই পারবে!
কাকাবাবু একটু হেসে বললেন, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ক্যানিং-এ কোনও মানুষ যায় না! অনেকেই তো। ওদিকে বেড়াতে যায়। আমরা ভাবছি ক্যানিং থেকে সুন্দরবন ঘুরে আসব।
বিমান বলল, সুন্দরবন? সে তো খুব সাংঘাতিক জায়গা। কবে ফিরবেন? আপনাদের সঙ্গে মালপত্র কিছু নেই।
আজই? সুন্দরবন এত কাছে নাকি? আমার ধারণা, সে তো অনেক দূর, সেখানে গভীর জঙ্গল, বাঘ-ভালুক থাকে-
বিমান, তুমি প্লেন চালিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াও, অথচ নিজের দেশের খবর রাখো না। সুন্দরবন কলকাতা থেকে মাত্র সত্তর-আশি মাইল দূরে।
এত কাছে? তা হলে তো গাড়িতেই যখন-তখন যাওয়া যায়। তা হলে আমি কখনও সুন্দরবন দেখিনি কেন? আমার চেনা শুনো কেউই সুন্দরবন যায়নি।
গাড়ি করে পুরোটা যাওয়া যায় না, কারণ মাঝখানে দুএকটা নদী পার হতে হয়, সেখানে ব্রিজ নেই। ক্যানিং বা নামখানা থেকে যেতে হয় লঞ্চে, সেইজন্যই বেশি সময় লাগে।
বিমান তবু বিস্মিত চোখে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, সুন্দরবন এত কাছে? সেখান থেকে বাঘ-ভালুকরাও তো যে-কোনও সময় কলকাতায় এসে পড়তে পারে?
কাকাবাবু বললেন, সুন্দরবনে ভালুক নেই, বাঘ আছে। খুব খিদে পেলে ওখানকার বাঘেরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি গ্রামে উৎপাত করে। কলকাতা পর্যন্ত আসার দরকার হয় না। বাঘেরা শহর পছন্দ করে না।
বিমান বলল, কাকাবাবু আমিও আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি? এই সুযোগে তাহলে সুন্দরবনটা দেখে আসা হবে।
কাকাবাবু বললেন, যেতে পারো কিন্তু তোমার গাড়িটা কী হবে? শিয়ালদা স্টেশনে তোমার গাড়িটা সারাদিন ফেলে রাখবে?
কেন, গাড়ি নিয়েই ক্যানিং পর্যন্ত চলে যাই। ট্রেনে যাওয়ার দরকার কী? কোন রাস্তা দিয়ে ক্যানিং যাওয়া যায় বলুন তো?
আগে গড়িয়ার দিকে চলো। তারপর নরেন্দ্রপুরের রাস্তা ধরবে। বিমান গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। বিমান সঙ্গে যাচ্ছে বলে বেশ খুশি হল সন্তু। বিমানদা খুব আমুদে ধরনের মানুষ। হঠাৎ যদি বিমানদার সঙ্গে দেখা না হত কিংবা সন্তু প্ৰথমেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে যেত, তাহলে এরকমভাবে গাড়ি করে বেড়াতে যাওয়াও হত না।
যাদবপুর ছাড়িয়ে গাড়িটা একটু ফাঁকা রাস্তায় পড়বার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বিমান, তুমি যে চললে, তোমার আজ ডিউটি নেই?
বিমান বলল, আমার আজ আর কাল ছুটি, পরশু একটা নিউইয়র্কের ফ্লাইট আছে। আপনি ঠিকই বলেছেন কাকাবাবু, আমরা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই, অথচ নিজের দেশের অনেক কিছুই দেখা হয় না। কিন্তু সুন্দরবনে যাচ্ছেন, সঙ্গে বন্দুক-টন্দুক কিছু নিলেন না?
কাকাবাবু বললেন, আমরা তো শিকার করতে যাচ্ছি না। তাছাড়া বাঘ মারা এখন নিষেধ।
কিন্তু হঠাৎ যদি সামনে একটা বাঘ এসে পড়ে? বাঘ কি আমাদের ছাড়বে?
সুন্দরবনে সব জায়গাতেই তো বাঘ নেই। এ যাত্রায় আমার বাঘের কাছাকাছি যাবারও ইচ্ছে নেই। আমি যাচ্ছি একটা মোটরলঞ্চ দেখবার জন্য।
মোটরলঞ্চ দেখতে যাচ্ছেন? কিনবেন নাকি?
না লঞ্চ কিনব কেন? একটা ফাঁকা লঞ্চ সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সুন্দরবনের কাছে এসে ঠেকেছে না?
ও, সেইটা?
কদিন ধরেই এই লঞ্চটা নিয়ে খবরের কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছে। সন্তুও পড়েছে। একটা বিদেশি লঞ্চ এসেছে সুন্দরবনে। কিন্তু তার ভেতরে কোনও মানুষ নেই। লঞ্চটি দেখতে ভারী সুন্দর, ভেতরটা খুব সাজানো-গোছানো। শয়নঘর, রান্নাঘর আছে। খাবারের টেবিলে দুটো সসেজ, খানিকটা চিজ আর দু পিস পাউরুটি, পাশে আধিকাপ কফি ছিল, কেউ যেন খেতে খেতে হঠাৎ উঠে গেছে। একটা রেডিও বাজছিল। কিন্তু লঞ্চের মালিকের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমনকী কাগজপত্রও কিছু নেই।
কেউ-কেউ বলছে, ঐ লঞ্চে কোনও বিদেশি গুপ্তচর ছিল, কোনও কারণে হঠাৎ লঞ্চ থেকে নেমে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে আছে। কেউ বলছে, ঐ লঞ্চটা ছিল স্মাগলারদের, সমুদ্রের বুকেই অন্য কোনও স্মাগলারদের দল এদের আক্রমণ করে সব জিনিসপত্র কেড়ে নিয়েছে, লোকগুলোকেও মেরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। আরও অনেক রকম কথাই শোনা যাচ্ছে।
বিমানের গাড়িতে একটা ইংরেজি খবরের কাগজ রয়েছে। সে সেটা তুলে বলল, আজকের কাগজে লঞ্চটার একটা ছবি বেরিয়েছে। পুলিশ এটাকে আটকে রেখেছে।
সন্তু সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়েনি। সে বিমানদার কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল। সাদা ধপধাপে লঞ্চটা। কাছেই কয়েকটা খালি-গায়ে বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সুন্দরবন তো দেখা যাচ্ছে না।
বিমান বলল, আমার মনে হয়, স্পাইটাই সব বাজে কথা। আজকাল কোনও সম্পাই লঞ্চে করে ঘোরে নাকি? অতি সময় কোথায় তাদের? তারা প্লেনে ঘোরাফেরা করে। আমার কী মনে হয় জানেন, ওটা কোনও ফিশিং বোট। জাপান বা কোরিয়া থেকে দুএকটা মাছ ধরার লঞ্চ ঝড়ের মধ্যে পড়ে এদিক-সেদিক চলে যায়। ভেতরের লোকজন বেচারারা নিশ্চয়ই ঝড়ের সময় ছিটকে জলে পড়ে গেছে!
কাকাবাবু বললেন, তা হতে পারে। কিন্তু খাবারের টেবিলে খাবার পর্যন্ত সাজানো আছে, অথচ ভেতরে লঞ্চের লাইসেন্স কিংবা মালিকের পাসপোর্ট বা অন্য কোনও কাগজপত্র কিছুই নেই কেন? সবই কি ঝড়ে উড়ে গেল? তাছাড়া ফিশিং বোটের চেহারা অন্যরকম হয়?
বিমান বলল, স্মাগলারদের ব্যাপার অবশ্য হতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই সমুদ্রের ধারে চোরা-চালানিদের কাণ্ডকারখানা চলে। এখানে তো আবার জঙ্গল রয়েছে, আরও সুবিধে!
কাকাবাবু হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন, আরে, আরে, করছ কী? এটা কি তুমি এরোপ্লেন পেয়েছ নাকি?
একটু ফাঁকা রাস্তা পেয়েই বিমান গাড়িতে এমন স্পিড দিয়েছে, যেন সেটা এক্ষুনি মাটি ছেড়ে আকাশে উড়বে!
বিমান গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে হেসে বলল, মনে থাকে না! জানেন, একদিন চৌরঙ্গিতে খুব জ্যামের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলুম। তখন আমার ইচ্ছে করছিল, আমার গাড়িটা টেক অফ করে অন্য গাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে চলে যাই।
কাকাবাবু খুব হাসতে লাগলেন।
সন্তু বলল, এরকম গাড়ি বার করলেই হয়, যা মাঝে-মাঝে উড়ে যেতেও পারবে। মাটিতেও চলবে, আবার জলের ওপর দিয়েও ভেসে যাবে।
বিমান বলল, হবে, হবে! বিজ্ঞানের যা উন্নতি হচ্ছে, আর দুচার বছরের মধ্যেই এরকম গাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, বিমানদা, তুমি যে এতদিন প্লেন চালাচ্ছ, তোমার প্লেন কোনওদিন হাইজ্যাকিং হয়নি?
বিমান বলল, আমার প্লেনে কখনও হয়নি। কিন্তু হাইজ্যাকিং দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে?
কাকাবাবুও-কৌতূহলী হয়ে বললেন, তাই নাকি? কবে?
বিমানের পাশে সন্তু বসেছে। কাকাবাবু বসেছেন পেছনের সিটে। বিমান এবারে মুখ ঘুরিয়ে বলল, বলছি। তার আগে, কাকাবাবু, আপনার কাছে একটা পারমিশান চাই। আপনার সামনে আমি সিগারেট খেতে পারি?
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, না! আমার সামনে খাওয়া চলবে না!
বিমান বেশ অবাক হয়ে গেল। এরকমভাবে পারমিশান চাইলে সবাই বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খেতে পারে, নিশ্চয়ই পারো। অথচ কাকাবাবু না বলছেন!
কাকাকাবু বললেন, শোনো, আগে আমার পাইপ খাবার দারুণ নেশা ছিল। পাইপ কিংবা চুরুট মুখে না দিয়ে থাকতেই পারতুম না। সেবারে, হিমালয়ে গিয়ে এই নেশাটা প্ৰতিজ্ঞা করে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এখনও কেউ আমার সামনে সিগারেট কিংবা চুরুট বা পাইপ খেলে সেই ধোঁয়ার গন্ধে আমার মনটা চনমান করে। সেইজন্যই বলছি, আমার সামনে খেও না, আড়ালে খেতে পারো। এখন যদি খুব ইচ্ছে করে, গাড়ি থামাও, আমি নেমে বাইরে দাঁড়াচ্ছি!
বিমান লজা পেয়ে বলল, না, না, না, আমার সেরকম নেশা নেই, মাঝে-মাঝে এক-আধটা খাই। আমিও একেবারে ছেড়ে দেব ভাবছি।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কবে তুমি হাইজ্যাকিং দেখলে বিমানদা?
বিমান বলল, বছর দুএক আগে। আমি তখন ছুটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমেরিকার ডেনভার এয়ারপোর্ট থেকে একটা প্যান-অ্যামের প্লেনে উঠেছি, একটা ডি. সি. টেন, যাব ক্যানাডার এডমান্টন শহরে এক বন্ধুর কাছে। সেই প্লেনের কমান্ডারের নাম টেড স্মিথ, আমার সঙ্গে তার আগে থেকেই চেনা ছিল। ককপিটে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে গল্প করছি। এমন সময় দাড়াম করে দরজা খুলে দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে সেখানে ঢুকল। ছেলেমেয়েগুলোর বয়েস হবে বাইশ-তেইশের মতন, দেখে মনে হয় মেক্সিক্যান। দুজনের হাতে দুটো রিভলভার, একজনের হাতে একটা গ্রিনেড। মেয়েটাকেই মনে হল দলের লিডার, সে ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বলল, প্লেন ঘোরাও, কিউবার হ্যাভানা এয়ারপোর্টে চলো? আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ধমকে বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? যাও, ভেতরে যাও! তারপর-
গল্পে বাধা পড়ল। রাস্তার মাঝখানে কিসের যেন একটা ভিড়। দুটো গোরুর গাড়ি আর একটা লরি থেমে আছে রাস্তা জুড়ে।
বিমান বলল, এই রে, অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে মনে হচ্ছে!
বিমান তার গাড়িটা রাস্তার পাশে মাঠে নামিয়ে ফেলল।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ও কী করছ?
পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি!
না, না, তা হয় নাকি? গাড়ি থামাও, দেখি এখানে ব্যাপারটা কী হয়েছে? গাড়ি থেকে ওরা নেমে পড়ল তিনজনে।
একটা গোরুর গাড়ির সঙ্গে একটা জিপগাড়ির ধাক্কা লেগেছে। জিপগাড়িটাই পেছন থেকে এসে মেরেছে। ধাক্কাটা। তার ফলে গোরুর গাড়িটা উল্টে গিয়ে গোরু দুটোর গলায় ফাঁস লেগে যায়। গোরু দুটো মরে যায়নি অবশ্য, কিন্তু নিশ্চয়ই খুব আহত হয়েছে, তারা প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করছে।
সন্তুর বুকটা মুচড়ে উঠল। গোরুর এরকম কাতর আর্তনাদ সে কখনও শোনেনি।
গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানের অবশ্য বিশেষ কিছুই হয়নি। জিপগাড়িটাও রাস্তার পাশে মাঠের মধ্যে আধখানা নেমে পড়েছে, কিন্তু ড্রাইভার অক্ষত। ড্রাইভারের পাশে একজন লোক ছিল, প্রথম ধাক্কাতেই সে ছিটকে বাইরে পড়ে যাওয়ায় মাথায় খুব চোট লেগেছে। সেই লোকটাকে কেউ তুলে এনে রাস্তার মাঝখানে শুইয়ে দিয়েছে, মাথা একেবারে রক্তে মাখামাখি।
একদল লোক সেখানে ভিড় করে দাঁড়িয়ে নানা রকম মন্তব্য করছে শুধু।
কাকাবাবু ব্যাপারটা বুঝে নিয়েই আহত লোকটার কাছে এগিয়ে গেলেন। হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার এক হাত তুলে নাড়ি দেখে অস্ফুট ভাবে বললেন, এখনও বেঁচে আছে।
তারপর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া গলায় বললেন, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে কি মজা দেখছেন সবাই? থানায় খবর দিয়েছেন? এখানে কাছাকাছি হাসপাতাল কোথায়? এই লোকটিকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেননি? চিকিৎসা করলে এখনও ও বেঁচে যাবে।
ভিড়ের মধ্য থেকে কয়েকজন লোক বলল, এখান থেকে থানা অনেক দূরে, হেলথ সেন্টারও বেশ দূরে।
কাকাবাবু বললেন, দূরে বলে কি খবর দেওয়া যায় না? আপনাদের কারুর সাইকেল নেই? মানুষ বিপদে পড়লে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে নেই, একটা কিছু করতে হয়। বিমান, ধরে তো, এই লোকটিকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিই! জিপগাড়ির ড্রাইভারটি এসে কাকাবাবুর পাশে দাঁড়াল। দেখে মনে হয় সে বেশ মারধোর খেয়েছে। জামা-কাপড় ছেড়া। সে বলল, স্যার, আমার গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব।
কাকাবাবু বললেন, আসুন।
লোকটিকে ধরাধরি করে তোলা হল গাড়িতে। পেছনের সিটে তাকে শুইয়ে দেওয়া হল, জিপের ড্রাইভার বসল। তার মাথাটা কোলে নিয়ে। কাকাবাবু সামনের সিটে চলে এলেন।
গাড়ি ছাড়বার পর বিমান জিজ্ঞেস করল, অ্যাকসিডেন্ট হল কী করে? শুধু শুধু একটা গোরুর গাড়িকে ধাক্কা মারতে গেলেন কেন?
জিপের ড্রাইভার বলল, ব্যাড লাক, স্যার, আমার কোনও দোষ নেই। গোরুর গাড়িটা রাস্তার পাশ দিয়ে চলছিল, হঠাৎ চলে এল মাঝখানে। এই সব গোরুর গাড়িগুলোর এই দোষ, কখন যে কোন দিকে যাবে, তার ঠিক নেই। গোরু তো আর ইঞ্জিন নয় যে, সব সময় মালিকের কথা শুনবে! এদিকে আমার হল কী স্যার, আমি খুব জোরে ব্রেক চাপলুম, কিন্তু ব্রেক নিল না। ব্রেক ফেল। আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, আপনি জানেন যে, ব্রেক ফেল করলে আর করার কিছু নেই।
কাকাবাবু বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু গোরু কেন, ইঞ্জিন কিংবা যন্ত্রপাতিও সব সময় মানুষের কথা শোনে না! আপনারা আসছেন কোথা থেকে?
জিপের ড্রাইভার বলল, ক্যানিং থেকে। আমার গাড়ির কন্ডিশান ভাল নয়, অনেকদিন সারভিসিং করানো হয়নি। আমি আসতে রাজি হইনি, স্যার, কিন্তু এই লোকটা দুশো টাকা অফার করে বলল, এক ঘন্টার মধ্যে বারুইপুর পৌঁছে দিতে হবে।
সন্তু পেছন ফিরে আহত লোকটিকে ভাল করে দেখল। অতি সাধারণ একটা শার্ট আর ধুতি পরা। মুখখানা দেখলেও মনে হয় না যে, এই ধরনের লোক দুশো টাকা দিয়ে জিপ ভাড়া করে এক ঘন্টার মধ্যে বারুইপুর পৌঁছতে চাইবে। সন্তু ভাবল, আহা রে, লোকটা অত তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই কোনও জরুরি কাজে বারুইপুর পৌঁছতে চাইছিল। এখন না বারুইপুরের বদলে স্বর্গে পৌঁছে যায়!
পাঁচ-ছ কিলোমিটার যাবার পরেই রাস্তার ধারে একটা হেলথ সেন্টার চোখে পড়ল। আহত লোকটি আর জিপ-ড্রাইভারকে নামিয়ে দেওয়া হল সেখানে।
কাকাবাবু পকেট থেকে একটা নোটবুক বার করে জিপ-ড্রাইভারকে বললেন, আপনাদের দুজনের নাম আর ঠিকানা এতে লিখে দিন।
জিপ-ড্রাইভারের কাছে কলম-টলম নেই। কিন্তু আহত লোকটির বুক পকেটে একটা ডট পেন রয়েছে, ড্রাইভার সেটা তুলে নিয়ে লিখতে লিখতে বলল, স্যার, আমার নাম সুরেনচন্দ্ৰ সাঁপুই, আমার ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, কিন্তু এর নাম তো আমি জানি না। স্যার। আমার সাথে চেনা নেই। স্যার। বলল তো বাসন্তী জাহাজঘাটার কাছে বাড়ি।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে।
কাকাবাবুর কালো ব্যাগটার মধ্যে ছোট্ট ক্যামেরা থাকে। সেটা খুলে তিনি আহত লোকটির মুখের কয়েকটা ছবি তুললেন। জিপ ড্রাইভারেরও একটা ছবি নিয়ে বললেন, আচ্ছা, এবার আমরা চলি, অ্যাঁ?
গাড়ি আবার চলতে শুরু করার পর বিমান জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনি লোক দুটোর ছবি নিলেন কেন?
কাকাবাবু বললেন, অ্যাকসিডেন্ট কেস তো, হয়তো পুলিশ এর পরে আমাদের সাক্ষী দেবার জন্য ডাকতে পারে। লোকদুটোর চেহারা ততদিনে বোধহয় ভুলেই যাব। আচ্ছা, বিমান, যে-লোকটা আহত হয়েছে, তাকে তোমার খুব ইন্টারেস্টিং মনে হল না?
বিমান বলল, কোনদিক দিয়ে বলুন তো?
লোকটির চেহারা বা পোশাক দেখে মনে হয়। সাধারণ একজন গ্রামের লোক। ক্যানিং থেকে ট্রেনে বারুইপুর যেতে দুতিন টাকা লাগে। অথচ লোকটা দুশো টাকা দিয়ে জিপ ভাড়া করে এক ঘন্টার মধ্যে যেতে চেয়েছিল, এটা কি ওকে মানায়?
সন্তু উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমার ঠিক এই কথাই মনে হয়েছিল, কাকাবাবু!
বিমান বলল, এমনও তো হতে পারে যে, এখন কোনও ট্রেন নেই ক্যানিং থেকে। ঐ লোকটা কোনও অসুস্থ লোককে দেখতে যাচ্ছে!
কাকাবাবু বললেন, সে রকম যে হতে পারে না তা নয়! তবে, লোকটার নাড়ি দেখবার জন্য আমি বাঁ হাত ধরেছিলাম। সে হাতে একটা ঘড়ি পরা। অত্যন্ত দামী সুইস ঘড়ি। সুন্দরবনের একজন গ্রামের লোকের হাতে এরকম ঘড়ি যেন মানায় না।
সন্তু বলে উঠল, স্মাগলার!
বিমান বলল, গ্রামের কিছু-কিছু লোক কিন্তু খুব বড়লোক হয়! জোতদার না কী যেন বলে তাদের। অনেক সময় আমাদের প্লেনে এরকম কিছু প্যাসেঞ্জার ওঠে, তারা ইংরিজি বলতে পারে না। কোনওরকম আদব-কায়দা জানে না, কিন্তু পকেটে গোছা-গোছা নোট!
কাকাবাবু বললেন, ক্যানিং থানায় গিয়ে ঘটনোটা রিপোর্ট করতে হবে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, বিমানদা, তারপরে কী হল? সেই যে তোমাদের প্লেনটা হাইজ্যাকিং হল…
গল্পে একবার বাধা পড়লে আর ঠিক সেইরকম জমে না।
বিমান বলল, তারপর আমাদের প্লেনটাকে কিউবার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হল। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম ককপিটেই। একজন হাইজ্যাকার টেড স্মিথের ঘাড়ের কাছে রিভলভার উঁচিয়ে রইল। আমার এক-একবার ইচ্ছে করছিল, ছেলেটাকে এক ঘুষি মারি। কিন্তু মেয়েটির হাতে গ্রিনেড, ওটা যদি একবার ছুঁড়ে মারে, তাহলে গোটা প্লেনটাই ধ্বংস হয়ে যাবে আকাশে, তাই সাহস পেলুম না।
কাকাবাবু বললেন, একবার অ্যারিজোনায় এরকম একটা প্লেন ধ্বংস হয়ে সব যাত্রী মারা গিয়েছিল।
বিমান বলল, হ্যাঁ। তারপর আমরা হ্যাভানায় নামলিম। ছাঁ ঘন্টা প্লেনের মধ্যে বসে থাকার পর আমাদের বাইরে যাবার অনুমতি দেওয়া হল। কিউবার সরকার খুব চালাক। হাইজ্যাকারদের সব কাটা শর্ত মেনে নিল, তারপর তারা প্লেন থেকে নেমে আসতেই বন্দী করা হল তাদের। কিউবার সরকার আমাদের ভাল করে খাইয়ে-দাইয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিল।
সন্তু বেশ হতাশ হল। সে খানিকটা গুলি-গোলা চালানো, মারামারির গল্প আশা করেছিল। সে বলল, মোটে এই!
রাস্তার দুপাশে বাড়ি-ঘর দেখেই বোঝা গেল ক্যানিং শহর এসে গেছে।
বিমান জিজ্ঞেস করল, ক্যানিং কি বেশ বড় জায়গা?
কাকাবাবু বললেন, এককালে এর নাম ছিল ক্যানিং পোর্ট। এখানে জাহাজ এসে থামত। এখন জাহাজ আসে না বটে, কিন্তু প্রচুর যাত্রী-লঞ্চ ছাড়ে এখান থেকে। শহরটা খুব বড় নয়, তবে জায়গাটার খুব গুরুত্ব আছে। ক্যানিংকে বলা হয় সুন্দরবনের গেটওয়ে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, জায়গাটার নাম ক্যানিং কেন? এখানে কি টিনের কৌটো তৈরি হয়?
কাকাবাবু বললেন, না, সেই ক্যানিং নয়। ব্রিটিশ আমলে ভারতের এক বড়লাট ছিলেন লর্ড ক্যানিং। তার নাম থেকে হয়েছে। সন্দেশ-রসগোল্লা-লেডিকেনির মধ্যে লেডিকেনির নামও হয়েছে। এই লর্ড ক্যানিং-এর বউয়ের নাম থেকে।
বিমান বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, একটা কথা আমি তখন থেকে ভাবছি। এই যে খালি লঞ্চটা ভেসে এসেছে, এটা স্পাই কিংবা স্মাগলারদের ব্যাপার। যাই হোক না কেন, তা নিয়ে পুলিশ খোঁজখবর করবে। আপনি তো কখনও এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। আপনি তা হলে এত দূরে ছুটে এলেন কেন?
কাকাবাবু বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, স্মাগলার কিংবা স্পাই ধরা আমার কাজ নয়। তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি এসেছি অন্য কারণে। লঞ্চটা সম্পর্কে আমার একটা অন্যরকম সন্দেহ হচ্ছে, সেটা মিলিয়ে দেখার জন্যই যাচ্ছি।
কী সন্দেহ?
আগে লঞ্চটা দেখি একবার। তারপরে বলব।