কালকূট
সমুদ্র মন্থন করে উঠে আসে অমৃত,সেই সঙ্গে উঠে আসে কালকূট। বিষের তিব্রতাকে অন্তরে ঢেকে রেখে তিনি তুলে এনেছিলেন অমৃত কুম্ভ। সেই অমৃতধারায় আমরা তাঁর কাছথেকে পেয়েছি ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাবো তারে’,’তুষার শৃঙ্গের পদতলে’, ‘খুঁজে ফিরি সেই মানুষে’। এমন বহু অমূল্য লেখা। হ্যাঁ, তিনি ‘কালকূট’! এই ছদ্মনাম ধারণ করেই হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে তার উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি অমৃতের সন্ধান করে গেছেন আজীবন। লেখক হিসেবে সমরেশ বসু আমৃত্যু যে লড়াই করে গেছেন তার কোন তুলনা নেই। তার নিজের জীবনই এক মহাকাব্যিক উপন্যাস।যা তাঁর পুত্র নবকুমার বসু, ‘চিরসখা’ নামে এক বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। ভ্রমর ছদ্মনামে তাঁর লেখা তিনটি উপন্যাস ‘যুদ্ধের শেষ সেনাপতি’, ‘প্রভু কার হাতে তোমার রক্ত’, ‘প্রেম কাব্য রক্ত’ শারদীয়া প্রসাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার বিক্রমপুরে সাহিত্যিক সমরেশ বসু জন্মগ্রহণ করেন (১৯২৪ – ১৯৮৮)। তাঁর কৈশোর জীবন কাটে কোলকাতার উপকন্ঠে নৈহাটি শহরে। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ছিলো তাঁর জীবন। তিনি ‘কালকূট’ এবং ‘ভ্রমর’ ছদ্মনামে বহু অমূল্য উপন্যাস সাহিত্য প্রেমীদের উপহার দিয়েছেন। তবে এটা ভেবে আশ্চর্য হতে হয় যে, একই লেখক সমরেশ বসু নামে এবং কালকূট ও ভ্রমর ছদ্মনামে একই সময় একই কলম দিয়ে ভিন্নধর্মী লেখা লিখে চলেছেন! সমাজের বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে আমৃত্যু একজন সক্রিয় লেখক হলেন সমরেশ বসু। তিনি শতাধিক উপন্যাস, ছোট গল্প, ভ্রমনমূলক উপন্যাস,আমাদের উপহার দিয়েছেন। সমরেশ বসু তাঁর ছোটগল্পে রূঢ় বাস্তব জীবনকে যথাযথভাবে চিত্রায়িত করেছেন। শ্রমিকদের প্রতি গভীর সহানুভূতি এবং অন্তরের অনুরক্তি তার লেখায় স্বচ্ছভাবে প্রকাশ পায়। যা তার লেখাকে স্বতন্ত্রতা এনে দিয়েছে। তিনি রাজনৈতিক তত্ত্বকে গল্পে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। সমরেশ বসু ছিলেন সমাজের প্রতি একজন দায়বদ্ধ সাহিত্যিক। তিনি দেশ পত্রিকায় জানিয়ে ছিলেন “সাহিত্যের যা কিছু দায় সে তো জীবনের কাছে।সাহিত্যের থেকে জীবন বড়ো।এ সত্যের জন্য সাহিত্যককে গভীর অনুশীলন করতে হয় না, তা সততই অতি জীবন্ত।” তার গল্প-উপন্যাসে বাস্তব জীবন প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অলৌকিক বিষয়ের মধ্যেও তিনি মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। এই বিষয়ে তার ‘সেই মুখ ‘ (১৯৫৬) উপন্যাসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি শিশুসাহিত্যেও সমান ভাবে জনপ্রিয়। তাঁর লেখা ‘গোয়েন্দা গোগোল’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশু কিশোর সকলের মনে দাগ কেটেছে। তিনি ১৯৮০ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কারে সম্মানিত হন।
তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প উপন্যাসের নাম নিচে দেওয়া হল –
‘পশারিনী’
‘নয়নপুরের মাটি’
‘উত্তরবঙ্গ’
‘বিবর’
‘প্রজাপতি’
‘কোথায় পাবো তারে’
অমৃত কুম্ভের সন্ধানে
‘শাম্ব’
‘বিটি রোডের ধারে’
‘তিন ভুবনের পারে’
‘মহাকালের রথের ঘোড়া’
‘অমৃত বিষের পাত্র’
‘পূর্ণ কুম্ভ পুনশ্চ’ ইত্যাদি।
তাঁর লেখা ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটিকে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে উপন্যাসটি সমস্ত দায় থেকে মুক্ত হয়। কৃষ্ণ পুত্র শাম্বকে নিয়ে লেখা পৌরানিক উপন্যাস ‘শাম্ব’ তাঁর অনন্য সৃষ্টি। ১৯৮০সালে এই উপন্যাসটির জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি সম্মান লাভ করেন। তিনি শেষ জীবনে শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের জীবন নিয়ে ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করেছিলেন, যা তিনি সম্পুর্ণ করে যেতে পারেননি; পুত্র নবকুমার বসু উপন্যাসটি সমাপ্ত করেন। ১৯৮৮সালের ১২ই মার্চ মাত্র ৬৩বছর বয়েসে তিনি মৃত্যুলোকের মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন। থেকে যায় তার বহু অসমাপ্ত কাজ, থেকে যায় তার অমৃতকুম্ভ।