একদা পুলকে প্রভাত-আলোকে
গাহিছে পাখি ,
কহে কণ্টক বাঁকা কটাক্ষে
কুসুমে ডাকি —
তুমি তো কোমল বিলাসী কমল ,
দুলায় বায়ু ,
দিনের কিরণ ফুরাতে ফুরাতে
ফুরায় আয়ু ;
এ পাশে মধুপ মধুমদে ভোর ,
ও পাশে পবন পরিমল-চোর ,
বনের দুলাল , হাসি পায় তোর
আদর দেখে ।
আহা মরি মরি কী রঙিন বেশ ,
সোহাগহাসির নাহি আর শেষ ,
সারাবেলা ধরি রসালসাবেশ
গন্ধ মেখে ।
হায় কদিনের আদর-সোহাগ ,
সাধের খেলা
ললিত মাধুরী , রঙিন বিলাস ,
মধুপ-মেলা ।
‘ওগো নহি আমি তোদের মতন
সুখের প্রাণী —
হাব ভাব হাস , নানারঙা বাস
নাহিকো জানি ।
রয়েছি নগ্ন , জগতে লগ্ন
আপন বলে ;
কে পারে তাড়াতে , আমারে মাড়াতে
ধরণীতলে ।
তোদের মতন নহি নিমেষের ,
আমি এ নিখিলে চিরদিবসের ,
বৃষ্টি-বাদল ঝড়-বাতাসের
না রাখি ভয় ।
সতত একাকী , সঙ্গীবিহীন —
কারো কাছে কোনো নাহি প্রেম-ঋণ ,
চাটুগান শুনি সারা নিশিদিন
করি না ক্ষয় ।
আসিবে তো শীত , বিহঙ্গগীত
যাইবে থামি ,
ফুলপল্লব ঝরে যাবে সব —
রহিব আমি ।
চেয়ে দেখো মোরে , কোনো বাহুল্য
কোথাও নাই ,
স্পষ্ট সকলি আমার মূল্য
জানে সবাই ।
এ ভীরু জগতে যার কাঠিন্য
জগৎ তারি ।
নখের আঁচড়ে আপন চিহ্ন
রাখিতে পারি ।
কেহ জগতেরে চামর ঢুলায় ,
চরণে কোমল হস্ত বুলায় ,
নতমস্তকে লুটায়ে ধুলায়
প্রণাম করে ।
ভুলাইতে মন কত করে ছল —
কাহারো বর্ণ , কারো পরিমল ,
বিফল বাসরসজ্জা , কেবল
দুদিন-তরে ।
কিছুই করি না , নীরবে দাঁড়ায়ে
তুলিয়া শির
বিঁধিয়া রয়েছি অন্তর-মাঝে
এ পৃথিবীর ।
‘আমারে তোমরা চাহ না চাহিতে
চোখের কোণে ,
গরবে ফাটিয়া উঠেছ ফুটিয়া
আপন মনে ।
আছে তব মধু , থাক্ সে তোমার
আমার নাহি ।
আছে তব রূপ মোর পানে কেহ
দেখে না চাহি ।
কারো আছে শাখা , কারো আছে দল ,
কারো আছে ফুল , কারো আছে ফল ,
আমারি হস্ত রিক্ত কেবল
দিবসযামী ।
ওহে তরু , তুমি বৃহৎ প্রবীণ ,
আমাদের প্রতি অতি উদাসীন —
আমি বড়ো নহি , আমি ছায়াহীন ,
ক্ষুদ্র আমি ।
হই না ক্ষুদ্র , তবুও রুদ্র
ভীষণ ভয় —
আমার দৈন্য সে মোর সৈন্য ,
তাহারি জয় ।’