এক শ্রাবণী রাতে
দূর্গাপূজার তখনও মাস দেড়েক বাকি, একটা বিশেষ কাজে কলকাতা এসেছিলাম, কাজ শেষ করে শিয়ালদহ স্টেশনে ঢোকার মুখেই ভাগিরথী এক্সপ্রেস বেড়িয়ে গেল। অগত্যা সাতটা কুড়ির লালগোলা মেমু ছাড়া আর উপায় নেই। ঠিক সময়েই নয় নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ট্রেনটা ছাড়লো আমরা কয়েকজন বহরমপুর কাশিমবাজার জিয়াগঞ্জের যাত্রী একটা কামড়ায় উঠেছি। সামান্য সময় পরেই আলাপ পরিচয় মোটামুটি হয়ে গেলে একজন তাসের প্যাকেট বের করে বললো আসুন সময় কাটাই। সাড়ে চার ঘন্টার জার্নিতে সময় কাটানোর এর চেয়ে ভালো আর কিইবা হতে পারে? জমিয়ে খেলা শুরু হলো। মাঝে একবার চা খেয়েছি তারপর কখন যে কৃষ্ণনগর পেড়িয়ে এসেছি খেয়াল নেই।
দেবগ্রাম স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছে মিনিট দু তিন আগে হঠাৎ দেখি বছর চল্লিশের এক ভদ্রলোক আমাদের পাশে এসে বসলেন। অপরিচিত মুখ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই কেমন আড়ষ্ট হাসি হাসলেন। তারপর বললেন ওদিকটায় ছিলাম দেবগ্রামে সবাই নেমে গেল তাই আপনাদের কাছে চলে এলাম বড্ড একাএকা লাগছিলো। আমাদের ভেতর একজন জিজ্ঞেস করলো আপনি কোথায় যাবেন? ডদ্রলোক বললেন আমার নাম বিশ্বনাথ চৌধুরী বাড়ি কাশিমবাজার ওই চৌধুরী বস্ত্রালয় দেখেছেন বাজারে? ওটা আমার, আপনাদের ভেতরে কেউ কি কাশিমবাজার নামবেন? হ্যাঁ আমি নামবো জানলার পাশে বসা সনাতন দা বললেন, একটু উপকার করবেন? একটা বিশেষ কাজে আমাকে বেলডাঙ্গা নেমে যেতে হবে, আজ আর বাড়ি যেতে পারবো না। আমার মোবাইল ফোনটা একটু আগে নষ্ট হয়ে গেছে, একটা অনুরোধ করছি এই নম্বরে একটা ফোন করে বলে দেবেন আমি আগামীকাল বাড়ি যাবো, বলে একটা চিরকুট এগিয়ে দিলো সনাতনদার দিকে। আপনিই বলে দিন বিষ্ণু দাস ওর ফোনটা বের করে দিলো ভদ্রলোকের দিকে। আমার সময় নেই এখুনি নেমে যেতে হবে আমাকে! বলতে বলতে ভদ্রলোক দ্রুত উঠে গেল, ট্রেনের গতি কমে এসেছে কথায় কথায় আমরা পলাশী রেজিনগর পার হয়ে বেলডাঙ্গা চলে এসেছি।
বেলডাঙ্গায় মিনিট খানেক দাঁড়ায় ট্রেনটা কিন্তু দশ মিনিট পার হয়ে গেল ট্রেনটা দাঁড়িয়েই আছে। এতক্ষণে একজন হকারকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার ট্রেন ছাড়ছে না কেন? হকারটা বললো জানেন না বেলডাঙ্গা হোম সিগনালের কাছে একটা লোক কাটা পড়েছে, জি আর পির লোকজন গেছে ডেডবডি আনতে এই ট্রেনেই বহরমপুর নিয়ে যাবে পোষ্টমর্টেমের জন্য।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর দুজন লোক আর তিন চারজন জি আর পি একটা ডেডবডি চাদরে মুড়ে আমাদের বগিতেই তুললো। কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করায় জি আর পি দের একজন বললো ভাগিরথী এক্সপ্রেস থেকে পরে গিয়ে মৃত্যু। ভদ্রলোকের বাড়ি কাশিমবাজার কিসের যেন ব্যবসা করেন। একটা চিরকূট পাওয়া গেছে ওনার পকেটে। আমরা সবাই উঠে এলাম ডেডবডির কাছে। চাদরের বাইরে মুখটা দেখা যাচ্ছে, কি আশ্চর্য এই লোকটাইতো এতক্ষণ আমাদের সাথে গল্প করতে করতে আসছিলো। আমার শরীর হিম হয়ে আসছে সনাতনদার হাতে তখনও লোকটার দেওয়া চিরকূটটা বাতাসে কাঁপছে।