Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আবু হামিদের রোজনামচা || Anil Bhowmick

আবু হামিদের রোজনামচা || Anil Bhowmick

বিকেল হয়ে এসেছে। সূর্য পশ্চিম দিগন্তের কাছাকাছি নেমে এসেছে। মারিয়া সূর্যাস্ত দেখবে বলে ডেক-এ উঠে এসেছে। ক্লান্ত ফ্রান্সিস তার কেবিনে আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। হ্যারি ওর কাছে এল। বলল, তাহলে আজ রাতটা এখানেই থাকি। কালকে না হয় জাহাজ ছাড়া যাবে।

না। এখানে আরও দু’একদিন থাকব। ফ্রান্সিস বলল।

কেন বলো তো? হ্যারি জানতে চাইল।

ভুলে যেও না ইয়ুসুফ সাংঘাতিক ধুরন্ধর। রাজা নেভেলের সঙ্গে তার খুব ভাব। হাজার হোক–ইয়ুসুফ যথেষ্ট ধনী। ও ঠিক রাজা নেভেলকে বলে তার সৈন্য নিয়ে জাহাজে চড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের খোঁজে নিশ্চয়ই বেরিয়ে পড়েছে। এই খাঁড়ি থেকে বেরোলেই আমরা ধরা পড়ে যাব। কাজেই এখন এই খাঁড়িতে জাহাজ রেখে দু’একদিন অপেক্ষা করতে হবে। বাইরের সমুদ্রে আমাদের জাহাজের হদিস না পেলে ওরা হতাশ হয়ে ফিরে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

কিন্তু ইয়ুসুফ তো আমাদের খোঁজে জাহাজ নিয়ে এই খাঁড়িতেও ঢুকতে পারে। হ্যারি বলল।

সেই জন্যেই দিনের বেলা আমরা জাহাজে থাকব। কিন্তু রাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এই স্লাভিয়া গ্রামে আশ্রয় নেব। সারারাত সজাগ থাকব। জাহাজের ডেক-এ লড়াই করার চেয়ে গ্রামে থেকে লড়াই করা সহজ হবে। কারণ ওখানে আমরা বাড়িঘর গাছগাছালির আড়াল পাব। লড়াই করার অনেক সুবিধে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি একটু ভেবে নিয়ে বলল, বরাবরই দেখেছি তুমি আগে থেকে অনেক কিছু ভেবে নাও।

সেটাই তো বুদ্ধিমানের লক্ষণ। অবশ্য তুমিও কম বুদ্ধিমান নও। কিন্তু ইদানিং দেশে ফিরে যাওয়ার আনন্দে তুমি বড় দ্রুত জাহাজ চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

হ্যারিও হাসল। বললে, তুমি ঠিকই বলেছ।

হ্যারি, সভ্য তারাই যারা আগে থেকে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তৈরি থাকে। অসভ্য জাতিরা কিন্তু সেটা পারে না। বর্তমানের কথাই ভাবে শুধু। ফ্রান্সিস বলল।

বৃদ্ধ ক্রেন চুপ করে এতক্ষণ দু’জনের কথাবার্তা শুনছিল। এবার বলল, ফ্রান্সিস, সত্যি তুমি বুদ্ধিমান আবার সাহসীও। অবশ্য বলা উচিত দুঃসাহসী।

হ্যারি হেসে বলল, আপনি আর ক’দিন ফ্রান্সিসকে দেখছেন। ওর কত দুঃসাহসিক বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী আমরা।

ফ্রান্সিস মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে বলল, ক্রেভান–ঐ গাঁঠরিটা তো দেখেছেন। ওটাই রাজা ম্যাগনামের গুপ্ত সম্পদ।

কিন্তু এসব কীভাবে উদ্ধার করলে তা তো বললে না। ক্রেভান বলল।

হ্যারিকে পাঠাচ্ছি শাঙ্কোকে ডেকে দিতে। শাঙ্কো এসব ঘটনা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বলতে পারে। বন্ধুদের মুখে শুনেছি। ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া তখনই ঢুকল। বলল, এত কিছু ঘটল ফ্রান্সিস, তুমি তো কিছুই বললে না।

অপেক্ষা করো। শাঙ্কো আসবে। সব বলবে। এখন আমার বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে চলি। হ্যারি বেরিয়ে গেল। মারিয়া বিছানায় বসতে বসতে বলল, আমি জাহাজে থাকব না।

তাহলে কোথায় থাকবে? ফ্রান্সিস একটু অবাক চোখে মারিয়ার মুখের দিকে তাকাল।

দেখো, শুধু তোমাদের সঙ্গে থেকে থেকে আমি যে মেয়ে সেটাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই।

ফ্রান্সিস জোরে হেসে উঠল। বলল, বেশ বলেছ।

আমি এই শ্লাভিয়া গ্রামের কারো বাড়ির অন্দরে মেয়েদের মধ্যে থাকব। একটু হাঁপ ছাড়তে পারব। মারিয়া বলল।

খুব ভালো কথা। তবে এখানকার মেয়েরা আমাদের ভাষায় পরিষ্কার কথা বলতে পারে কিনা জানি না। ফ্রান্সিস বলল।

যেটুকু বলতে পারবে তাই শুনে সব বুঝে নিতে পারব। মারিয়া বলল।

তা পারবে। কিন্তু গরিব চাষি বৌ-মেদের কথা কি তোমার–মানে রাজবাড়ির অন্তঃপুরেই তো তোমার দিন কাটত, ওদের কথাবার্তা কি তোমার ভালো লাগবে? ফ্রান্সিস বলল।

কেন লাগবে না? ঘর-সংসার ছেলে-মেয়ের কথা সব মেয়েদেরই ভালো লাগে, সে রাজকুমারীই হোক আর গরিব ঘরের মেয়েই হোক। মারিয়া বলল।

মারিয়া, আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমরা কিন্তু এখনও নিরাপদ নই। যে কোনো সময় আমরা আক্রান্ত হতে পারি। তাই রাতে আমাদের এই স্লাভিয়া গ্রামেই থাকতে হবে। গরিব চাষি এরা। পাথুরে জমিতে চাষের মাটি বেশি পাওয়া যায় না। অন্য সময় নিশ্চয়ই এই খাঁড়িতে ওরা মাছ ধরে। ওদের বাড়ি-ঘরে থাকার মতো বাড়তি জায়গাও বেশি নেই। কাজেই তুমি জাহাজেই খাওয়া সেরে সারাদিন ওদের বাড়িতে থাক। রাতে তোমাকে জাহাজে এসে থাকতে হবে। ভেন থাকবে আর অসুস্থ ক্রেভান থাকবে। ওকেও তো দেখাশোনার জন্যে লোক চাই। বলল, এই ব্যবস্থা তোমার পছন্দ কি না। ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া একটু ভেবে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। তাই হবে।

দু’জনে যখন কথা বলছে তখনই শাঙ্কো এল।

শাঙ্কো, সমস্ত ঘটনাটা বলো তো এদের। ফ্রান্সিস বলল।

কিন্তু ফ্রান্সিস, সব ঘটনা তো আমি দেখিনি। শাঙ্কো বলল।

সেসব আমি বলব এখন। ফ্রান্সিস বলল।

শাঙ্কো উৎসাহের সঙ্গে হাত-পা নেড়ে সে যতটুকু ঘটনা জানে সব বলতে শুরু করল। চুপ করে মারিয়া আর ক্রেভান শুনল। বাকিটুকু ফ্রান্সিস খুব সংক্ষেপে বলল। ক্রেভান বলে উঠল, সত্যি ফ্রান্সিস, ভাইকিং জাতির গৌরবগাথায় তোমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে পাশ ফিরে শুল।

সন্ধে হল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে শাঙ্কো নোঙর তুলল। ফ্রেজার জাহাজটা চালিয়ে স্লাভিয়া গ্রামের ঘাটে এনে ভেড়াল। নোঙর ফেলা হল। হ্যারিকে ডেকে ফ্রান্সিস বলল, জাহাজে শুধু মারিয়া, ভেন আর ক্রেভান থাকবে। বাকি সবাইকে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে তীরে নামতে হবে। সবাইকে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বললো।

হ্যারি ডেক-এ উঠে এল। সবাইকে ডেকে ফ্রান্সিসের নির্দেশ জানাল।

রাঁধুনি বন্ধুরা তাড়াতাড়ি রান্না সারল। সবাই খেয়ে নিল। তরোয়াল নিয়ে ফ্রান্সিস ও হ্যারি সবার আগে জাহাজের ডেক-এ উঠে এল। ততক্ষণে পাটাতন পাতা হয়ে গেছে। দু’জনে পাটাতন দিয়ে হেঁটে তীরে নামল। একটু খাড়াইতীর দিয়ে উঠে গ্রামের বাড়িগুলোর কাছে এল। যে বয়স্ক লোকটির বাড়িতে ওরা রাজা ম্যাগনামের পুরনো এক পাটি জুতো পেয়েছিল সেই বাড়িটার সামনে এল দু’জনে। গাছের কাটা ডালের টুকরো দিয়ে তৈরি দরজাটা বন্ধ। হ্যারি এগিয়ে গিয়ে দরজায় হাত দিয়ে ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে বোধহয় বয়স্ক লোকটিই বলে উঠল, কে?

দরজাটা খুলুন। কথা আছে। হ্যারি বলল।

ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেল। বাইরের ম্লান জ্যোৎস্নায় ফ্রান্সিসদের চিনতে পেরে হাসল লোকটি বলল, আপনারা জাহাজ নিয়ে ঐ পাহাড়ের কাছে গেলেন, ফিরে এলেন, কী ব্যাপার?

সব পরে বলব। আপনার নামটা যদি বলেন। ফ্রান্সিস বলল।

আমার নাম লায়েন্ড। অর্থ-পরিচ্ছন্ন। লায়েন্ড হেসে বলল।

দেখুন লায়েন্ড কোনো কারণে কয়েকটা রাত আমরা আপনাদের এই গ্রামের সকলের বাড়িতে থাকব।

কারণটা পরে বলব। তবে ঘরে বেশিক্ষণ একসঙ্গে সবাই থাকব না। রাতে দফায় দফায় কয়েকজন করে থাকব। বেশির ভাগই বাইরে থাকবে। জানি আপনাদের ঘর বেশি নেই। থাকার জায়গারও খুব অভাব। তবে কথা দিচ্ছি–কোনো ভাবেই আপনাদের অসুবিধে ঘটাব না। আপনারা নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন। ভেতরের ঘরে কেউ থাকবে না। ফ্রান্সিস বলল।

কিন্তু আপনারা কষ্ট করে এই বাড়িগুলোয় থাকবেন কেন? আপনাদের জাহাজ তো ঘাটেই নোঙর করা আছে! লায়েন্ত বলল।

কারণ আছে বললাম তো–সেসব পরে বলব। এখন আপনি আমার এই বন্ধু হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে আপনার প্রতিবেশীদের আমাদের অনুরোধ জানান। ফ্রান্সিস বলল।

আপনারা ভালো মানুষ সন্দেহ নেই। তার ওপর ক্রেন, যাঁকে আম খুব শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, তিনি আপনাদের সঙ্গে এসেছেন। কেউ আপত্তি করবে না। লায়েন্ড বলল।

সে তো ভালো কথা। তাহলে হ্যারিকে নিয়ে আপনি বলে আসুন। ফ্রান্সিস বলল।

বেশ। হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে লায়েন্ড চলে গেল। ততক্ষণে অন্য বন্ধুরা এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। সবার কোমরেই তরোয়াল ঝুলছে। সিনাত্রা শাঙ্কোর তীর ধনুকও নিয়ে এসেছে।

বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল, ভাইসব, এই গ্রামের মানুষরা সৎ আর অতিথিবৎসল। কিন্তু এরা গরিব। বাড়িঘর খুবই ছোট। তোমাদের পালা করে এদের ঘরে রাতে থাকতে হবে। সাবধান, তোমরা বেশি কথার্বাতা বলবেনা। এদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে না। ঘুমিয়ে পড়লেও সবাই সতর্ক থাকবে। এখানকার কোনো একটা উঁচু গাছের মাথায় নজরদার পেড্রো সারারাত পাহারায় থাকবে। ওর হাঁক শোনা মাত্র সবাই এই বাড়ির সামনে এসে জড়ো হবে। কারণ এক মহা ধুরন্ধর লোক–ইয়ুসুফ জাহাজভর্তি সৈন্য নিয়ে এই খাঁড়ি দিয়ে এসে আমাদের আক্রমণ করতে পারে। এই আক্রমণ রাতের অন্ধকারেই হতে পারে বলে আমার মনে হয়। কাজেই সবাইকে সারারাত সর্তক থাকতে হবে। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল, হ্যারি ফিরে এলে বাড়িগুলোয় আশ্রয় নিতে যাবে। হ্যারি এসে তোমাদের চারটে দলে ভাগ করবে। দু’দল শুতে যাবে। দু’দল পাহারা দেবে মাঝরাত পর্যন্ত। তারপর অন্য দুই দল যাবে পাহারা দিতে।

বন্ধুরা বুঝল লড়াই হতে পারে। ওরা ভীত হল না। বরং খুশিই হল। জাহাজে নিরুপদ্রবে হেসে-খেলে সময় কাটাতে ওরা বাধ্য হয়। লড়াইয়ের উন্মাদনা ওরা পছন্দ করে। যেন বেঁচে থাকার একটা অর্থ খুঁজে পায়। লড়াই করা এবং লড়াইয়ে জেতার আনন্দই আলাদা এদের কাছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই লায়েন্ডকে নিয়ে হ্যারি ফিরে এল। ফ্রান্সিসকে বলল, সবার সঙ্গেই কথা হয়েছে। সবাই সাগ্রহে রাজি হয়েছে। তবে সবাই এর কারণ জানতে চাইছিল।

স্বাভাবিক। জাহাজ থাকতে আমরা গ্রামের বাড়িগুলোয় রাতে আশ্রয় নিচ্ছি কেন এর কারণ তো জানতে চাইবেই। যাক গে, এবার দুটো করে দল করো। কীভাবে পাহারার কাজ চলবে বন্ধুদের বলেছি। কাজে লাগো সবাই। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি দল গড়তে তৎপর হল। এর মধ্যে পেড্রো খুঁজে খুঁজে একটা বেশ উঁচু চেস্টনাট গাছ পেল। গ্রামের ভেতরেই। ও গাছে চড়তে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই গাছটার মগডালে উঠে গেল। গাছটার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে দু’টো মোটা ডালের গোড়ায় বসার জায়গা বানাল। তারপর বসে পড়ল। ম্লান জ্যোৎস্নার আলোয় খাঁড়ির যতদূরে দৃষ্টি যায় ততদূরে তাকিয়ে রইল। চারদিক নিস্তব্ধ। দু’একটা রাতজাগা পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেল। হাওয়ায় গাছের পাতায় সরসর শব্দ হতে লাগল। রাত বাড়তে লাগল।

হ্যারি বন্ধুদের দুটি ভাগ করে বিভিন্ন বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। বাকি দু’দল তখন গ্রামের আশেপাশে তীরভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাহারা দিতে শুরু করল। সবারই চোখ মূল সমুদ্রের দিকে। ওখান দিয়েই কোনো জাহাজ খাঁড়ির দিকে আসছে কিনা। অবশ্য গাছের ওপর থেকে পেড্রো নজর রাখছে। তবু আবছা জ্যোত্সার আলোয় ওরা তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলল।

ফ্রান্সিস, হ্যারি আর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে লায়েন্ড-এর বাইরের অন্ধকার ঘরে ঢুকল। ছোট ঘর। অন্ধকারে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। লায়েন্ড অন্ধকারের মধ্যে থেকে বলল, দাঁড়ান। আলো জ্বেলে দিচ্ছি।

ফ্রান্সিস আপত্তি করল, আপনার ঠাকুর্দার ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে।

না, না, ঠাকুর্দা সব সময় শুয়েই থাকে। কখন ঘুমোয় কখন জাগে আমরা মোটামুটি বুঝতে পারি। অন্ধকারে আপনাদের নড়াচড়া করতে অসুবিধে হবে। লায়েন্ড বলল।

খুব বেশি আলো হবে না তো? হ্যারি জিগ্যেস করল।

না না। সামুদ্রিক এক ধরনের মাছের তেল। মৃদু আলো হয়। ওতেই রাতের কাজ চালাই আমরা। লায়েন্ড বলল। তারপর চকমকি পাথর ঠুকে আলো জ্বালল। সত্যিই মৃদু আলো। এখন ফ্রান্সিসরা সবকিছুই মোটামুটি স্পষ্ট দেখতে পেল। এক কোনায় বৃদ্ধটি বিছানায় শুয়ে আছে। বাকি জায়গা থেকে লায়েন্ড সংসারের জিনিসপত্র সরিয়ে নিল। বেশ কিছুটা জায়গা কঁকা হল। পাথুরে মাটির কিছুটা এবড়ো-খেবড়ো মেঝেয় ফ্রান্সিস বসে পড়ল। হ্যারিরাও বসল। ফ্রান্সিস হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ল। হ্যারি পা মুড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেসে বসল। সবার শোয়ার মতো জায়গা নেই। তবু কয়েকজন। গুটিসুটি মেরে শুল। বাইরে নিশুতি রাত। দূরের সমুদ্রের হাওয়া ধারে-কাছের গাছপালার পাতা ও ডালের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মৃদু শব্দ হচ্ছে। আর কোনো শব্দ নেই চারিদিকে।

রাত বাড়তে লাগল। ফ্রান্সিসরা কোনো কথা বলছে না। মাঝে মধ্যে বৃদ্ধের কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সারারাত পালা করে পাহারা দেওয়া চলল। খাঁড়ির জলে কোনো জাহাজকে আসতে দেখা গেল না।

রাত শেষ হল। ফ্রান্সিস হ্যারি সারারাতই জেগে ছিল। দূরের গাছপালায় পাখির ডাকাডাকি শুরু হতে ফ্রান্সিসের তন্দ্রার ভাবটা কেটে গেল। কাছের গাছে কয়েকটা পাখির স্পষ্ট ডাক শোনা গেল।

ভোর হল। বন্ধুরা আস্তে আস্তে নিজেদের জায়গা থেকে বেরিয়ে বাড়ির সামনে এসে জড়ো হতে লাগল। ফ্রান্সিসরা উঠে বসল। কয়েকজন বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চলে এল। বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে কথা বলতে লাগল।

লায়েন্ড এসে ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি উঠে দাঁড়াল। আড়মোড়া ভেঙে হ্যারি বলল, আপনি রাতে ঘুমোননি?

কী করে ঘুমোই! বেশ বুঝতে পারছিলাম কোনো আশঙ্কা নিয়ে আপনারা একরকম জেগে আছেন। আমারও একটু চিন্তা হচ্ছিল। লায়েন্ড হেসে বলল।

শুনুন, আজকের রাতটাও আমাদের এই গ্রামেই থাকতে হবে। দুশ্চিন্তায় রাত জাগা এসবে আমরা অভ্যস্ত। আপনি মিছিমিছি রাত জাগবেন না। নিশ্চিন্তে ঘুমুবেন। ফ্রান্সিস বলল।

বেশ। লায়েন্ড হেসে মাথা কাত করল।

একটা কথা। আমার স্ত্রী সকালের খাবার খেয়ে এখানে আসবেন। আপনার আর অন্য কোনো কোনো বাড়ির অন্দরমহলে গল্পগুজব করবেন। দুপুরে খেয়ে এসেও থাকবেন। বিকেলে জাহাজে ফিরে যাবেন। আপনাদের কোনো অসুবিধে হবে না তো? ফ্রান্সিস বলল।

না, না। এ তো আমাদের সৌভাগ্য। খুব খুশি হয়ে লায়েন্ড বলল।

আমরা এখন জাহাজে ফিরে যাচ্ছি, হ্যারি বলল, আপনাকে ধন্যবাদ।

বন্ধুদের নিয়ে ফ্রান্সিসরা এক এক করে জাহাজে উঠে এল। ডেক-এ উঠে একজন বন্ধু সখেদে বলল, রাত জাগাই সার। কোনো জাহাজও এল না। লড়াইও হল না। পেছনেই ছিল হ্যারি। মৃদুস্বরে বলল, বন্ধু হে, লড়াইয়ের দিন এখনও শেষ হয়নি।

ডেক-এ উঠে ফ্রান্সিস দেখল রেলিং ধরে মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস কাছে এসে বলল, সেকি–তুমি রাতে ঘুমোওনি।

হ্যাঁ হ্যাঁ। খুব ভোরে পাখির বিচিত্র ডাকাডাকি শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সমুদ্রে তো ডাঙার পাখির ডাক শোনা যায় না। এত ভালো লাগছিল উঠে পড়লাম। মারিয়া বলল।

সামুদ্রিক পাখির ডাক তো শোনো। ফ্রান্সিস বলল।

সে তো বন্দরের কাছে এলে। তাও কী তীক্ষ্ণ ডাক। ডাঙার পাখির ডাক কত সুন্দর। কত বিচিত্ররকম।

তা ঠিক। ফ্রান্সিস সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলল।

কেবিনে ঢুকে দেখল ক্রেভান বিছানার একপাশে চুপ করে বসে আছে। ফ্রান্সিস বলল, কী? ঔষুধ খেয়েছ তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ। মারিয়া বড় লক্ষ্মী মেয়ে। আমার হাত-মুখ ধুইয়ে ওষুধ খাইয়ে গেছে। কিন্তু তুমি সারারাতে ফিরলে না। কী ব্যাপার? ক্রেভান বলল।

ক্রেভান, ফ্রান্সিস তরোয়ালটা বিছানার নীচে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ইয়ুসুফ যে কী সংঘাতিক লোক কল্পনাও করতে পারবে না। ইয়ুসুফ সৈন্যভর্তি জাহাজ নিয়ে আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাদের খোঁজে এই ফাঁড়িতে ঢুকেও হামলা চালাবে। তাই আমরা গ্রামেই ছিলাম। রাত জেগে পাহারা দেওয়া চালিয়েছি।

সত্যি, চিন্তার কথা, ক্রেভান বলল। ফ্রান্সিস বিছানায় বসে পায়ের দিকে তাকাল। ছোট্ট ঘর। প্রায় পায়ের কাছে রাখা হ্যারল্ডের লুঠ করা ধনসম্পদের সিন্দুকটা। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফ্রান্সিসের মনে হল কী হবে এই লুঠেরার সম্পদ নিয়ে? দেশের রাজাকে গিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু রাজা ম্যাগনামের সম্পদের গাঁঠরিটাও তো রয়েছে। এত মূল্যবান সম্পদ জাহাজে রাখা কি উচিত হবে? জলদস্যুর পাল্লায় পড়লে তো আমাদের জীবন বিপন্ন হবেই। এইসব ধনসম্পদও লুঠ হয়ে যাবে। এত ধনসম্পদ জাহাজে রাখা বিপজ্জনক নয় কি? তখনই মারিয়া ঢুকল। পেছনে সকালের খাবার হাতে রাঁধুনি বন্ধু। তিনজনে বিছানায় বসে খেতে লাগল। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বলল, মারিয়া, যার বাড়িতে আমরা রাজা ম্যাগনামের এক পাটি জুতো পেয়েছিলাম তার নাম লায়েন্ড। তাকে বলে এসেছি তুমি যাবে।

আমি এখনই যাব। খুশিতে বলে উঠল মারিয়া।

ঠিক আছে। কিন্তু দুপুরে জাহাজে এসে খাবে। ওরা কিন্তু দরিদ্র। বাড়তি লোকের খাবার জোগাড় করা ওদের পক্ষে কষ্টকর হবে। ফ্রান্সিস বলল।

না, না। ওরা খেতে অনুরোধ করলেও আমি শুনব না। চলে আসব। কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যাব। ওদের দেব। মারিয়া বলল।

একটু চমকে উঠে ফ্রান্সিস বলে উঠল, ঠিক। এ কথাটা এতক্ষণ আমার মাথায় আসেনি।

মারিয়া অবাক। বলল, হঠাৎ এ কথা বলছ?

হ্যাঁ মারিয়া। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। অবাক মারিয়া বলল।

শোন। হ্যারল্ডের লুঠ করা ধনসম্পদের অর্ধেক এই স্লাভিয়া গ্রামবাসীদের জন্যে লায়েন্ডকে দিয়ে যাব। যে অর্থ ওরা এসব বিক্রি করে পাবে তাই দিয়ে চাষবাসের কাজে লাগাতে পারবে, বাড়িঘর মেরামত করতে পারবে, মাছ ধরবার ভালো ভালো জাল কিনতে পারবে, নৌকো কিনতে পারবে। এই দারিদ্র্য সবটা না হলেও কিছু তো ঘুচবে। জীবনে কোনোদিন এই গ্রামে আর আসব না। কিন্তু ওরা তো আমাদের মনে রাখবে। কত মানুষ, নারী, শিশুর রক্ত লাগা এই অভিশপ্ত সম্পদ সকাজে তো ব্যয় হবে।

সত্যি ফ্রান্সিস, তুমি কত কিছু ভাবো। মারিয়া বলল।

ভাবায় বলেই ভাবি। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

আমি তাড়াতাড়ি যাব। মারিয়া বলল।

নিশ্চয়ই। যাও।

মারিয়া উঠতে উঠতে বলল, ফ্রান্সিস, দোরেস্তাদ বন্দরে যে নতুন পোশাকটা তৈরি করিয়েছিলাম সেটা তো একবারও পরিনি। ওটা পরে যাব?

না, না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল, ঐ দামি পোশাক পরে গেলে ওরা তোমাকে আপন করে নিতে পারবে না। আর একটা কথা, তুমি যে আমাদের দেশের রাজকুমারী এ কথা কক্ষনো বলবে না। যা পরে আছ তাই পরে যাও। ওদের ঘর রাজপ্রাসাদের আলোকোজ্জ্বল অন্তঃপুর নয়।

বেশ, তোমার কথা তো অমান্য করতে পারি না। মারিয়া বলল। তারপর মাথার চুলে চিরুনি বুলিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। বৃদ্ধ ক্রেভান এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার বলল, ফ্রান্সিস, আমি তোমাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। তুমি সত্যিই ভাইকিং জাতির গর্ব।

ক্রেভান, মানুষের প্রতি ভালোবাসা পেতে গেলে নিজের আচার-আচরণকে পবিত্র রাখতে হয়। বলো, তাই কিনা? ফ্রান্সিস বলল।

অবশ্যই। এই বৃদ্ধ বয়েসেও তোমার কাছে আমার অনেক কিছু শেখার আছে। ক্রেভান বলল।

থাক ওসব। আজকের রাতটাও আমাদের প্রায় জেগেই কাটবে। যদি বিপদ না ঘটে তাহলে কালকে দুপুরেই জাহাজ ছাড়ব। এখন বলুন, আপনি কী করবেন? আমাদের সঙ্গে থাকবেন? ফ্রান্সিস বলল।

না, না। তোমরা আমার জন্যে অনেক করেছ। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। দোরেস্তাদ বন্দরে আমাকে নামিয়ে দিও। তোমাদের বোঝা হব না। ক্রেভান বলল।

মুশকিল হয়েছে দোরেস্তাদ বন্দরে জাহাজ ভেড়ালে আমাদের জীবন বিপন্ন হবে। বরং আমাদের সঙ্গে চলুন। পরে যে দেশের বন্দরে থামব সেখানে আপনাকে বেশকিছু সোনার চাকতি দিয়ে নামিয়ে দেব। তারপর আপনার যা মন চায় করবেন। ফ্রান্সিস বলল।

ঠিক আছে। সেটাই ভালো হবে। তোমাদের যেন কোনো বিপদ না হয়, ক্রেভান বলল। ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা আমার।

দুপুরে খুশিতে উচ্ছল মারিয়া এল। ফ্রান্সিসকে বলল, উফ, যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রায় সব বাড়ির মেয়েরা এসে জড়ো হয়েছিল। কত কথা, কত গল্পগুজব–কী আনন্দে যে সময়টা কাটল। মারিয়াকে এত খুশি, এত উচ্ছল দেখে ফ্রান্সিসের মনও প্রসন্ন হল। ও সব সময়ই চায় মারিয়া আনন্দে থাকুক, খুশিতে উচ্ছল থাকুক। খেয়ে নিয়ে আবার যাও কিন্তু বিকেলেই ফিরে এসো ফ্রান্সিস বলল।

ওদিকে বন্ধুরা কয়েকজন মিলে দূর সমুদ্র-মুখের দিকে নজর রেখে চলেছে। পেড্রো তো সকাল থেকেই ওর নজরদারির জায়গায় বসে আছে।

দুপুরে গড়িয়ে বিকেল হল। কোনো বিপদ ঘটল না। মারিয়া ফিরে এসে রেলিং ধরে সূর্যাস্ত দেখতে লাগল।

সন্ধের পরেই গত রাতের মতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সব বন্ধুরা তীরভূমিতে নেমে এল। গত রাতের মতোই পাহারা দেওয়ার কাজ শুরু হল। ফ্রান্সিস, হ্যারিরা কয়েকজন। লায়েন্ডের বাড়ির বাইরের ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাত কাটাল। প্রায় কেউই সারারাত ঘুমোবার সুযোগ পেল না।

ভোর হতে সবাই জাহাজে ফিরে এল।

জাহাজের ডেক-এ উঠে ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল, নীচে এসো কাজের কথা আছে। কাল রাতে পাছে বৃদ্ধের ঘুম ভেঙে যায় তাই তোমাকে বলা হয়নি। শাঙ্কোকে ডেকে নিয়ে এসো।

ফ্রান্সিস কেবিনে ঢুকল। একটু পরেই হ্যারি আর শাঙ্কো এল। ফ্রান্সিস বলল, শাঙ্কো, ছেঁড়া পালের একটা বড় টুকরো নিয়ে এসো। শাঙ্কো চলে গেল। একটু পরেই শাঙ্কো ছেঁড়া পালের একটা বড় টুকরো, নিয়ে এল। ফ্রান্সিস ওটা মেঝেয় পাতল। তারপর হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যারি, আমি স্থির করেছি হারন্ডের অভিশপ্ত ধনভাণ্ডারের অর্ধেক এই স্লাভিয়া গ্রামের মানুষদের কল্যাণের জন্য দিয়ে যাব।

খুব ভালো কথা। এটা একটা কাজের কাজ হবে। হ্যারি আনন্দে বলে উঠল।

শাঙ্কো, সিন্দুকটা খুলে সবকিছু এই কাপড়টায় ঢালো। দুটো ভাগ করবে। ফ্রান্সিস বলল।

শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়ল। সিন্দুক খুলে সব অলঙ্কার মুদ্রা সোনার চাকতি মণিমুক্তো কাপড়টার ওপরে ঢালল। তিনজনে মিলে দেখে দেখে দু’টো ভাগ করল সব। এক ভাগ কাপড়টায় রেখে গাঁঠরি মতো বাঁধা হল। বাকি ভাগ সিন্দুকে তুলে রাখা হল।

হ্যারি বলে, এখনই কাজটা সেরে আসি। শাঙ্কো গাঁঠরিটা নাও। শাঙ্কো গাঁঠরিটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর ডেক-এ উঠে এল। ফ্রান্সিস হ্যারিও এল। তিনজনে। একে একে পাটাতন দিয়ে হেঁটে তীরে নামল। উঁচু পাড়ে উঠল। চলল লায়েন্ডের বাড়ির দিকে। লায়েন্ড দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের দেখে হেসে বলল, এখন এলেন?

ভেতরে চলুন, কথা আছে ফ্রান্সিস বলল। ভেতরে ঢুকে মেঝেয় গাঁঠরিটা রেখে। শাঙ্কো বলল, আমাদের রাজকুমারী কোথায়?

ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল, আঃ শাঙ্কো! লায়েন্ড তো অবাক। বলল, উনি রাজকুমারী? আপনাদের দেশের? ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে বলে, আরে না না। উনি গরীব ঘরের মেয়ে। আমরা ঠাট্টা করে রাজকুমারী বলে ডাকি।

ও। তাই বলুন। লায়েন্ড হাসতে হাসতে বলল।

শাঙ্কো, ফ্রান্সিস বলল, মুখটা খোলো। শাঙ্কো গাঁঠরির মুখটা খুলল। অত অলঙ্কার, সোনা দেখে লায়েন্ড হাঁ করে সেই দিকে চেয়ে রইল। বিস্ময়ে হতবাক।

লায়েন্ড, এসব কোথা থেকে কী করে পেলাম আপনার জানার দরকার নেই। এই সব সম্পদ আপনাকে দিলাম। কিন্তু শর্ত আছে। এই সম্পদ বিক্রি করে যে অর্থ পাবেন গ্রামের সব পরিবারকে সমানভাবে ভাগ করে দেবেন সতোর সঙ্গে। এই সব কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে আপনি কিছু বেশি অর্থ নেবেন। আমরা চাই আপনাদের গ্রামের মানুষেরা দুঃখ-দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক। এটা কিন্তু দয়া দেখানো নয়। কৃতজ্ঞতার উপহার। ফ্রান্সিস বলল।

এতক্ষণে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে লায়েন্ড বলল, আপনাদের যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব। সত্যি, বড় কষ্টে দিন কাটে আমাদের।

ঠিক আছে। এবার অর্থের বিনিময়ে উন্নতির সুযোগ কাজে লাগান। কিন্তু রাজকুমারী কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।

ওপাশের এক ধার্মিক বুড়ি রাজকুমারীকে প্রায় জোর করে নিয়ে গেছে। বোধহয় ধর্মকথা শোনাতে। লায়েন্ড হেসে বলল।

ঠিক আছে। চলি। আজ দুপুরেই আমরা জাহাজ ছাড়ব। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিসরা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। জাহাজে ফিরে ডেক-এ দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, ভাই সব, কাছে এসো আমার কিছু বলার আছে। বন্ধুরা অনেকেই ডেক এর এদিকে-ওদিকে কাজে ব্যস্ত ছিল অনেকে ডেক-এও বসেছিল। ফ্রান্সিস বলতে লাগল, শোন, এখন মনে হচ্ছে বিপদ কেটে গেছে। দুপুরেই আমরা জাহাজ চালাব। কিন্তু দাঁড়ঘরে যারা থাকবে তারা ছাড়া বাকি সবাই ডেক-এ তরোয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই এলাকা ছেড়ে যত দ্রুত সম্ভব পালাতে হবে। সবাই তৈরি হও। গভীর সমুদ্রে পড়ে যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ চালাতে হবে। যাও।

বন্ধুদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। পাল খোলা, হালের দড়িদড়া পরীক্ষা করা, কাজ তো কিছু কম না।

দুপুরে নোঙর তোলা হল। একদল দাঁড় টানতে দাঁড়ঘরে চলে গেল। কয়েকজন পালের কাঠামোয় উঠে বেশি বেশি হাওয়া ধরার জন্যে পাল ঠিক করতে লাগল। ফ্রেজার জাহাজ চালাতে শুরু করল। জাহাজের গতি বাড়তে লাগল। ফাঁড়ির মুখে জাহাজ এল। দিকচিহ্নহীন সমুদ্রে পড়ে জাহাজ উঁচু উঁচু ঢেউ ভেঙ্গে ছুটল। জাহাজের দুলুনির মধ্যেও ভাইকিংরা যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল জাহাজের গতি বাড়াতে।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ দ্রুত চলল। সন্ধেবেলা ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এল। ফ্রেজারের কাছে এসে বলল, দিক ঠিক রেখেছ তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তবে কোনো ছোট-বড় বন্দর পেলে বুঝতে পারব কত দূরে এলাম।

ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। ভেবে নিশ্চিন্ত হল ইয়ুসুফের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে আসা গেছে।

সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে জাহাজ চলল। এতদিন ভাইকিংরা সমুদ্রে যাত্রীবাহী বা মালবাহী জাহাজ খুব কমই দেখেছে। কিন্তু এখন ইউরোপে এসে মাঝেমাঝে জাহাজগুলোর মাস্তুলের মাথায় বিভিন্ন দেশের পতাকা উড়ছে। ওদের দেশের জাহাজও একটা দেখেছে। কিন্তু বেশ দূরে। সেই জাহাজের কাছে যেতে ফ্রান্সিস খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। হ্যারল্ডের মতো আবার যদি কোনো লুঠেরা দস্যুদলের পাল্লায় পড়তে হয়!

সেদিন শেষ বিকেলে মারিয়া রেলিং ধরে সূর্যাস্ত দেখছে। সূর্য এখনও অস্ত যায়নি। নজরদার পেদ্রোর চিৎকার শোনা গেল, ডাঙা দেখা যাচ্ছে। বন্দর শহর। ওদিক থেকে। একটা জাহাজ আসছে। মনে হচ্ছে আমাদের দিকে।

শাঙ্কো সিঁড়িঘরের কাঠের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেলিং ধরে পুব দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারি আর মারিয়া ওর পাশে এসে দাঁড়াল। একটু পরেই ফ্রান্সিস বুঝল জাহাজটা ওদের জাহাজ লক্ষ্য করেই আসছে। হতে পারে জাহাজটা ওদের জাহাজের পাশ দিয়েই চলে যাবে। কাছে না এলে বোঝা যাবে না। জাহাজটা অনেক কাছে চলে এল। সূর্যাস্তের শেষ আলোর আভায় দেখা গেল মাস্তুলে একটা পতাকা উড়ছে। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল, পতাকাটা কোন দেশের ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ক্রেভানকে ডেকে আন তো।

হ্যারি দ্রুত ছুটে গিয়ে ক্রেভানকে নিয়ে এল। ক্রেভান এখন বেশ সুস্থ। একাই হেঁটে এল। মনোযোগ দিয়ে জাহাজের পতাকাটা দেখতে লাগল। জাহাজটা তখন অনেক কাছে এসে গেছে। সেই জাহাজের ডেকে দেখা গেল সশস্ত্র যোদ্ধাদের। গায়ের রং কালো। আঁটোসাঁটো কালো পোশাক। কোমরে চামড়ার চওড়া বেল্ট। তাতে তরোয়াল ঝুলছে।

এরা মুর। মুরদের টহলদারি জাহাজ। হয় পর্তুগাল নয় তো স্পেনের কাছে এসেছি আমরা। দুই দেশের বেশ কিছু এলাকায় মুররা রাজত্ব করছে। ক্রেভান বলল।

ফ্রান্সিস, কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল।

দেখি ওরা আমাদের কাছে আসে কিনা। এলে কী বলে শুনি। ফ্রান্সিস একটু চিন্তিত স্বরে বলল। ক্রেভান মৃদুস্বরে বলতে লাগল, আমি এইসব জায়গায় আগে এসেছি। মুররা হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একটি মুসলিম জাতি। পোর্তুগাল, স্পেনের বেশ কিছু অঞ্চল জয় করে রাজত্ব করছে। যুদ্ধে পারদর্শী। কিন্তু পরধর্ম-অসহিষ্ণু। তবে এই মুর শাসকদের মধ্যে শিল্পানুরাগী, সাহিত্যপ্রেমিকও আছেন। এদের কবলে পড়লে কিন্তু মারিয়ার বিপদ হতে পারে।

বেশ চমকে উঠে ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, মারিয়া তুমি চলে যাও। আগে সব দেখি বুঝি। মারিয়া ঠিক বুঝল না কিছু। তবে নেমে কেবিন ঘরে চলে এল।

এবার সন্ধ্যার আবছা আলোয় জাহাজের সব কিছুই দেখা গেল। মুর যোদ্ধারা বেশ তৎপর দেখা গেল। ফ্রান্সিসদের জাহাজটাই যে ওদের লক্ষ্য বোঝা গেল এবার। জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। আঁকুনি খেল দুটো জাহাজই। মুর যোদ্ধারা লাফিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেক-এ উঠে এসে সারি দিয়ে দাঁড়াল। জলদস্যুর দল হলে লড়াইয়ের কথা ভাবা যেত। কিন্তু মুরদের উদ্দেশ্য কি তা তো স্পষ্ট নয়।

মুরদের জাহাজ থেকে এবার যে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এল সে যোদ্ধা নয়। বেশ দামী কাপড়ের ঢোলা গভীর নীল রঙের পোশাক পরা। বেশ সুগঠিত শরীর। মুর যোদ্ধারাও বলিষ্ঠ চেহারার। লোকটির মাথায় পেঁচিয়ে বাঁধা লাল রঙের দামী কাপড়। মুখে দাড়ি-গোঁফ। বেশ ভারিক্কি ভঙ্গি চলাফেরায়। ফ্রান্সিসদের কাছে এসে পর্তুগিজ ভাষায় বলল, তোমরা কারা? ফ্রান্সিস লোকটির চোখের দিকে তাকাল। বেশ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি চোখে। বেশ ক্ষমতাধর মানুষের চাউনি।

আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।

এখানে এসেছ কেন? লোকটি জানতে চাইল।

তার আগে বলুন আপনার পরিচয় আর এটা কোন বন্দর? ফ্রান্সিস বলল।

লোকটা এই প্রশ্নে খুশি হল না। বোঝা গেল প্রশ্ন করা পছন্দ করে না। তবে বিরক্তি চেপে বলল আমি উজীর ইয়েপুদা। এটা পোর্তুগালের একটি বন্দর শহর পোত। কিছুদূরে রাজধানী পৌরো। শাসকের নাম খলিফা হাকিম। একনাগাড়ে বলে গিয়ে উজির ইয়েপুদা এবার বলল, তোমাদের পরিচয় বলল।

আমরা ভাইকিং। দেশ থেকে বহুদিন আগে জাহাজে চড়ে বেরিয়েছি। কত দ্বীপদেশ ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।

হুঁ। কিন্তু লুঠেরা দস্যুর বদনাম আছে তোমাদের। উজির বলল।

আমাদের সঙ্গে লড়াই করে যারা হেরে যায় তারা এই দুর্নাম দেয়। আর কিছু ভাইকিং জাতির কলঙ্ক ভাইকিং নিশ্চয়ই আছে। তাদের দলেরএক সর্দারকে আমি আমার স্বদেশবাসী হওয়া সত্ত্বেও হত্যা করেছি। বাকিদের বিন্দুমাত্র করুণা না করে তাড়িয়ে দিয়েছি। ফ্রান্সিস বলল।

হুঁ। প্রথম শুনলাম। সমুদ্রের ধারে টহলদারি করি আমরা। আমি উজির, মাঝে মধ্যে আসি টহলদারির কাজ দেখতে। যাক গে, তোমাদের সঙ্গে দরবারে পরে কথা হবে। কিন্তু আমাদের জাহাজের সঙ্গে তোমাদের জাহাজ বাঁধা হবে। পোতো বন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। জাহাজ তল্লাশি করা হবে। কালকে সকালে খলিফা হাকিমের দরবারে হাজির হন। করা হবে। খোঁজখবর করা হবে। উজির বলল।

তাহলে কি আমাদের বন্দি করা হল? হ্যারি বলল।

সেটা সব খোঁজখবর নিয়ে পরে স্থির হবে। উজির বলল।

ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল, আমাদের জাহাজ বাঁধার দরকার নেই। আপনার জাহাজের পাশে পাশেই বন্দরে যাব।

বেশ। উজির ইয়েপুদা বলল। তারপর চলে যেতে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, সাবধান! পালাবার চেষ্টা করবে না। একবার লড়াইয়ে নামলে আমরা শত্রুদের কাউকে বেঁচে থাকতে দিই না। শুনেছি তোমরা সাহসী, লড়াইয়ে দক্ষ। অনেক লড়াইয়ে বোধহয় জিতেছও। কিন্তু তবু সাবধান! উজির ইয়েপুদা নিজেদের জাহাজে চলে গেল। চারজন মুর যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের পাহারায় রইল। বাকিরা চলে গেল।

ফ্রান্সিস বেশ চিন্তায় পড়ল। আজ রাতেই যদি তল্লাশি হয় তাহলে মারিয়াকেলুকিয়ে রাখা অসম্ভব। মারিয়ার বিপদ হতে পারে অভিজ্ঞ ক্রেভানের এই আশঙ্কা অমূলক নয়। একটা উপায় বের করতেই হবে এবং আজ রাতের মধ্যেই। কিন্তু তল্লাশি হলে কখন হবে, কতটা সময় হাতে পাবে তাও তো ফ্রান্সিস বুঝতে পারছে না। তবে কথায় ব্যবহারে– ইয়েপুদাকে যা দেখল তাতে এটা ভালো করেই বুঝল ঐ লোকটাকে চটানো চলবে না। বরং বিনাবাক্যে ওর হুকুম প্রত পালন করতে হবে। এটা ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিস ফ্রেজারের কাছে এল। মুর যোদ্ধা ক’জনকে দেখল ডেক-এর এদিক-ওদিক পায়চারি করছে। ফ্রান্সিস দেশীয় ভাষায় বলল, ফ্রেজার, এক্ষুনি জাহাজ ঐ জাহাজের সামনে নিয়ে যাও। তারপর ঐ বন্দর লক্ষ্য করে আস্তে চালাও। তাহলে ঐ জাহাজও আমাদের। পাশে পাশে আসবে। শুনলে তো ঐ উজিরের কথা।

আমাদের ভাগ্য খারাপ, ফ্রেজার বলল।

দুর্ভাগ্য-টুর্ভাগ্য বাজে কথা। ভাগ-টাগ্য বলে কিছু নেই। ঘটনা ঘটে। কখনও আমাদের স্বপক্ষে কখনও বিপক্ষে। বিপক্ষে গেলে লড়তে হয়। যাক ওসব কথা। এখন অনেক চিন্তা। জাহাজ ছাড়ো। ফ্রান্সিস দ্রুত হ্যারিদের কাছে এল। মৃদুস্বরে বলল, হ্যারি এসো। কথা আছে।

কেবিন ঘরে ঢুকে দেখল মারিয়া চুপ করে বসে আছে। ঘর অন্ধকার।

আলো জ্বালো। ভয়কে জয় করতে হয়। ফ্রান্সিস আস্তে কথাটা বলে অভ্যেস মতো বিছানায় শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। ক্রেভান নিশূপ। আস্তে আস্তে একপাশে বসল। হ্যারি চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া আলো জ্বালল। কোনো কথা বলল না। ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়েই রইল। ঘর নিস্তব্ধ। কেউ কোনো কথা বলছে না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস চোখ খুলে দ্রুত উঠে বসল। একবার মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। তারপর বলল, হ্যারি, ছক কষা হয়ে গেছে। শুধু দুটো সুযোগ চাই। এক, আজকের রাতটা আর এই বন্দর এলাকায় নৌকো চলাচল করে কিনা। তারপর বলল, সন্দেহ নেই ঐ উজির ইয়েপুদা অর্থপিশাচ। প্রবল ক্ষমতালোভী। -ওকে বাগে আনতে হবে। হ্যারি। চুপ করে রইল। এবার ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ওর সমস্ত পরিকল্পনা সংক্ষেপে বলল। হ্যারি অল্পক্ষণ ভেবে নিয়ে বলে উঠল, সাবাস ফ্রান্সিস।

ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, পারবে তো যা করতে বললাম?

কেন পারব না। এমন কি কঠিন কাজ? হ্যারি তো সঙ্গেই থাকবে। মারিয়া বলল।

এবার বন্দরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা। হ্যারি, তুমি, মারিয়া আর শাঙ্কো তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবে। উপোসি পেটে কোনো কাজ হয় না। একটু চুপ করে থেকে বলল, হ্যারি, এবার শাঙ্কোকে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলো। মুর যোদ্ধারা আছে। দেশীয় ভাষায় বলবে। যাও। হ্যারি কোনো কথা না বলে চলে গেল। ক্রেভান মৃদুস্বরে বলল, ফ্রান্সিস, তুমি শুধু দুঃসাহসী নও, বুদ্ধিমানও। ফ্রান্সিস কোনো কথা না বলে আবার শুয়ে পড়ল। মারিয়া বলল, তাহলে আমার বিপদ হবে না, কিন্তু তোমাদের কী হবে? চোখ বন্ধ করে ফ্রান্সিস বলল, পরের ঘটনা কী ঘটে তা দেখে বাকি ছক ভাবব।

উজির ইয়েপুদার টহলদারি জাহাজের পাশে পাশে ফ্রান্সিসদের জাহাজ বন্দরের কাছে এল। ফ্রান্সিস ততক্ষণে ডেক-এ উঠে এসেছে। পাশে দাঁড়ানো হ্যারিকে মৃদুস্বরে বলল, পেড্রোকে ডাকো। হ্যারি দ্রুত গিয়ে পেড্রোকে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস আগের মতোই মৃদুস্বরে বলল, পেড্রো, মাস্তুলে ওঠো। কেউ. এই অন্ধকারে দেখবে না। জাহাজঘাটে মালের আলো আছে। ওপরে উঠে যতটা সম্ভব নজর দিয়ে দেখবে তীরের কাছে কোথাও নৌকো আছে কিনা। ঘাটে পৌঁছবার আগেই নেমে আসবে। তাড়াতাড়ি যাও।

পেড্রো এ ব্যাপারে অভ্যস্ত। মুর যোদ্ধাদের দেখল। দু’জন সিঁড়িঘরের কাঠের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। অন্য দু’জনের একজন জাহাজের মাথার দিকে, অন্য জন হালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পেড্রো নিঃশব্দে দ্রুত মাস্তুলের মাথায় উঠে গেল। নিজের জায়গায় বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জাহাজঘাট ও দু’পাশ দেখতে লাগল। ঘাটে বেশ কয়েকটা মশাল জ্বলছে। কয়েকজন প্রহরীকেও দেখল। ডানদিকে তীরভূমিতে কিছু বাড়ি-ঘর অস্পষ্ট দেখল। বাঁদিকে তাকাতেই দেখল বেশ দূরে কয়েকটা নৌকোর কালো ছায়া মতো। বালিয়াড়িতে কয়েকটা খুঁটিও।

তার মানে ওগুলো মাছ-ধরা জাল টাঙানোর খুঁটি। ওটা জেলেপাড়া। পেড্রো নিঃশব্দে দ্রুত নেমে এল। তারপর কোনো ব্যস্ততা না দেখিয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এসে মৃদুস্বরে বলল, বাঁদিকে জেলেপাড়া, নৌকো কয়েকটা বাঁধা। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল, হ্যারি, মূল্যবান তথ্য। এবার রাতের তল্লাশি আটকানো।

দুটো জাহাজই জাহাজঘাটে ভিড়ল। মুর যোদ্ধা চারজন নামার জন্যে তৈরি হল। ফ্রান্সিস দ্রুত ওদের কাছে এল। বলল, আমাদের জাহাজের নোঙর ফেলব। তবু তীরের কোনো খুঁটির সঙ্গে শক্ত কাছি দিয়ে আমাদের জাহাজের হালটা বাঁধা। কাজটা করে মান্যবর উজিরকে গিয়ে বলবে আর আমাদের একটা অনুরোধ জানাবে। উনি মান্যবর উজির, সম্মানিত মানুষ তাকে তো এখানে আসতে বলতে পারি না। তাকে বলবে যে আমরা অনেকটা সমুদ্র এলাকা একটানা চলে এসেছি। আজকের রাতটা বিশ্রাম করতেই হবে। নইলে কালকে উঠে দাঁড়াতে পারব না। কাজেই উনি যেন কাল সকালে তল্লাশির ব্যবস্থা করেন। অনুরোধ, আমার কথাগুলো বুঝিয়ে বলো, কেমন?

একজন যোদ্ধা মোটামুটি স্পষ্ট পোর্তুগিজ ভাষায় বলল, ঠিক আছে, বলব। তবে মাননীয় উজির বড়ো মেজাজের মানুষ। তোমার অনুরোধ রাখবে কিনা জানি না।

তুমি ভাই বলল তো, তারপর যা হবার হবে। ফ্রান্সিস বেশ বিনয় দেখিয়ে বলল। যোদ্ধা চারজন নেমে গেল।

ওদিকে একটা ঘোড়ায় টানা সুদৃশ্য গাড়ি এসে থামল জাহাজঘাটে। মশালের আলোয় দেখা গেল ঘাটের প্রহরীরা সার বেঁধে গাড়িটার দুপাশে দাঁড়াল। উজির ইয়েপুদা আস্তে আস্তে পাটাতন দিয়ে নেমে গাড়িটার দিকে চলল। ফ্রান্সিস গভীর মনোযোগ দিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিসের তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সেই যোদ্ধাটিকে খুঁজতে লাগল। হ্যাঁ, সেই যোদ্ধাটি উজিরের কাছে গিয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান দেখিয়ে কিছু বলতে লাগল। উজির দাঁড়িয়ে পড়ে শুনল। বোধহয় কিছু বলল। তারপর গাড়িতে গিয়ে উঠল। গাড়ি চলে গেল। ফ্রান্সিস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটু আগেই পাতা পাটাতন দিয়ে। চারজন যোদ্ধা নেমে গিয়েছিল। প্রায় আট-দশজন যোদ্ধাকে দেখা গেল পাটাতনের দিকে আসতে। সবার সামনে বেশ জবরজং পোশাক পরা একজন। মাথায় শিরস্ত্রাণ। সবাই যখন উঠে আসছে হ্যারি চাপাস্বরে ডাকল, ফ্রান্সিস!

দাঁড়াও তল্লাসি ঠেকাতেই হবে। ফ্রান্সিসও বেশ চাপা স্বরে বলে উঠল।

যোদ্ধাদের নিয়ে সামনের জন ফ্রান্সিসদের কাছে এল। কোমরে সোনারুপোর কাজ করা চওড়া বেল্ট। তরোয়ালের হাতলে সোনারুলোর গিল্টিকরা। বোঝা গেল সেনাপতি। সেনাপতি কাছে এসে বলল, তোমাদের অস্ত্রঘরে যত অস্ত্রশস্ত্র আছে নিয়ে এসো। সব বাজেয়াপ্ত করা হবে।

খুব ভালো কথা। ফ্রান্সিস দ্রুত বলে উঠল, সত্যিই তো আমরা বিদেশী। লুঠেরা। দস্যু বলে আমাদের বদনামও আছে। কখন কী করে বসি। এক্ষুনি সব অস্ত্রশস্ত্র জমা দিচ্ছি। আপনারা অপেক্ষা করুন। শাঙ্কো যাও তাড়াতাড়ি। মাননীয় উজিরের হুকুম মানতেই হবে। শাঙ্কোর সঙ্গে আরো কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেল। ফ্রান্সিস বলল, কিন্তু একজন যোদ্ধাকে তো বলেছিলাম আমরা অনেকটা দূর থেকে জাহাজ চালিয়ে আসছি। খুব পরিশ্রান্ত আমরা।

হুঁ। মান্যবর উজিরের হুকুম-কাল সকালে জাহাজ তল্লাশি হবে। সেনাপতি বলল।

খুব অনুগৃহীত হলাম। মহামান্য উজির দীর্ঘজীবী হোন। ফ্রান্সিস খুব খুশির ভঙ্গিতে বলে উঠল। হ্যারিফ্রান্সিসের এইবিগলিতভাব দেখে কেশআশ্চর্যইহল। তবেমনেমনেফ্রান্সিসের কেশ প্রশংসাই করল। উজিরের বিশ্বাস উৎপাদনে এই কৃতার্থভাব দেখাতেই হবে।

শাঙ্কোরা সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এল। ডেক-এ জড়ো করল।

কোনো অস্ত্রশস্ত্র পড়ে নেই তো? ফ্রান্সিস বলল।

না–না। সব এনেছি। এমনকি তীরধনুকও। শাঙ্কো বলল। সেনাপতি অস্ত্রের পরিমাণ দেখে খুশিই হল। সে ইঙ্গিতে যোদ্ধাদের সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেতে বলল। যোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলে যেতে লাগল। সেনাপতি বলল, কালকে তোমাদের মহামান্য খলিফার দরবারে হাজির করা হবে।

খুব আনন্দের কথা, ফ্রান্সিস বলল। সেনাপতি ও যোদ্ধারা নেমে গেল। ঘাটে নেমে সেনাপতি পিছু ফিরে পাটাতন তুলে নিতে ইঙ্গিত করল। শাঙ্কো, বিনোলা ছুটে গিয়ে পাটাতন তুলে ফেলল। ফ্রান্সিস ছুটে এসে রেলিং থেকে ঝুঁকে গলা চড়িয়ে বলল, মাননীয় সেনাপতি, নোঙর ফেলা হয়েছে, কিন্তু মোটা কাছি দিয়ে ঘাটের ঐ খুঁটির সঙ্গে কাছিটা বাঁধা হয়নি। সেনাপতি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর হাত নেড়ে কথাটার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে চলে গেল। পেছনে যোদ্ধারাও চলল।

হ্যারি, দুটো সিঁড়ি পেরোলাম। এবার তৃতীয় সিঁড়িটা। তোমরা শিগগির এসো।

ফ্রান্সিস ও হ্যারি চলে আসে কেবিনঘরে। মারিয়া চিন্তাগ্রস্ত মুখে তখন থেকে বসে আছে। ক্রেভানও কম চিন্তিত নয়। ফ্রান্সিস কোনোদিকে না তাকিয়ে দ্রুত গিয়ে সিন্দুকের ডালাটা খুলল। হিসেব করে দেখল সিন্দুক যতটা ফাঁকা হয়েছে তাতে বেশ কিছু কাপড় চোপড় আঁটানো যাবে। শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল, দোরেস্তাদ বন্দরে তোমাদের যেনতুন পোশাকগুলি তৈরিকালেতারই গোটা সাত-আট পোশাক নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি। শাঙ্কোরা কয়েকজন প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নতুন পোশাকটা বের করো। আর একটা তুলে রাখা মানে কম ব্যবহার করেছএমন পোশাকআর একটা গায়ে দেবার চাদর বের করে আনো।

সেই চাদর তো গরম চাদর। ফুল-পাতার কাজ করা। দামি। মারিয়া বলল।

ক্ষতি নেই। বের করো তাড়াতাড়ি। মারিয়া ছুটে গিয়ে ওর সবচেয়ে শৌখিন চামড়ার ঝোলা থেকে দুটোই বের করে আনল। ফ্রান্সিস সেই দামি চাদরটা একবার দেখল। তারপর মেঝেয় পাতল। মারিয়াই পাততে সাহায্য করল। ততক্ষণে শাঙ্কো নতুন পোশাকগুলি নিয়ে এল।

মারিয়া, সব পোশাক দ্রুত পরিপাটি করে ভাঁজ করে সিন্দুকে সাজিয়ে দাও। মারিয়া সব পোশাক তাড়াতাড়ি পরিপাটি করে ভাঁজ করে সিন্দুকে ভরল। ফ্রান্সিস বলল, তোমার নতুনপোশাকটা একেবারে ওপরে রাখো। মারিয়া পোশাকটা ভাঁজ করতে করতে ভাবল পোশাকটা একবারও পরা হয়নি। কিন্তু এই ভাবনাটা আমল দিল না। ওটা ভরা হলে ফ্রান্সিস ডালাটা নামাল। দেখলআঙুল তিনেকজুহয়ে আছে ডালাটা। ফ্রান্সিস ডাকলশাঙ্কো তোমরা হাতলাগাও। জোরে চেপে ডালা বন্ধ করো। শাঙ্কোরা এগিয়ে এসে চেপে চেপে ডালা লাগাল। ফ্রান্সিস ডালাটার কড়া নেড়ে নীচের গোল ছাদাটায় ঢুকিয়ে জোরে সিন্দুকটা বন্ধ করল। তারপর শাঙ্কোদের দিকে তাকিয়ে আরো কিছু পোশাক নিয়ে আসতে বলল। নতুন না হলেও চলবে। শাঙ্কোরা আগের মতোই ছুটে চলে গেল। আরো কিছু পোশাক নিয়ে এল। মেঝেয় পাতা চাদরটা দেখিয়ে ফ্রান্সিস মারিয়াকে বলল, ভালো ভাবে ভাজ করে পোশাকগুলি ওখানে রাখো তাড়াতাড়ি। মারিয়া অল্পক্ষণের মধ্যেই কাজটা সারল।

এবার একটা চৌকোনো গাঁঠরি করো। শাঙ্কো, এসো।

মারিয়া আর শাঙ্কো মিলে বেশ সুন্দর একটা গাঁঠরি করল।

গাঁঠরি বাঁধা হচ্ছে তখনই রাঁধুনি বন্ধু এল। বলল, তাড়াতাড়ি খাবে চলে এসো।

হ্যারি, শাঙ্কো, যাও তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।

চলো, আমিও খেয়ে নেব। ক্রেভান উঠে দাঁড়াল।

আমি একেবারে পোশাক পাল্টে খাব। মারিয়া বলল।

ঠিক আছে। আমিও যাচ্ছি। তোমার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি, শাঙ্কো আর মারিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সিসরাও খেয়ে নিল। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল, একটু ভালো পোশাক পরে নাও তুমি আর শাঙ্কো। তারপর শুয়ে বিশ্রাম করো। ঘুমিয়ে পড়ো না। আমি সময়মতো ডাকতে যাব।

তিনজনে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। শেষ ধাপটা পেরোতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। মারিয়া নিরাপদে থাকবে। কী করতে হবে ফ্রান্সিস আগেই হরিদের বলে রেখেছে।

বন্দর এলাকা, রাস্তাঘাট আস্তে আস্তে নির্জন হয়ে গেল। দু’জন প্রহরী এতক্ষণ ঘাটের পাথুরে চাতালে ঘোরাঘুরি করে বোধহয় পরিশ্রান্ত হয়ে জাহাজ-বাঁধা খুঁটির কাছে বসে গল্পগুজব করছে।

রাত একটু বাড়ল। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু তীরে ঢেউ ভাঙার শব্দ আর সমুদ্রের হাওয়ার শব্দ।

এবার পায়চারি থামিয়ে ফ্রান্সিস বেরিয়ে গেল হ্যারি আর শাঙ্কোকে ডাকতে। দু’জনেই তাড়াতাড়ি চলে এল। নতুন নয় তবে বেশ ভালো পোশাকই পরেছে দু’জনে। মারিয়া তো আগে থেকেই পোশাক পরে তৈরি। ফ্রান্সিস গাঁঠরিটা কাঁধে তুলে নিয়ে হ্যরি ও শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল, সিন্দুকটা ধরাধরি করে নিয়ে চলো ডেক-এ। পারবে তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ, শাঙ্কো বলল। গাঠরিটা কাঁধে নিয়ে ফ্রান্সিস সিঁড়ির দিকে চলল। পেছনে ক্রেভান বিড়বিড় করে কী বলতে লাগল। বোধহয় ঈশ্বরের কাছে সকলের জন্যে আশীর্বাদ চাইছিল। বেশ ভারী সিন্দুকটা। তবুশাঙ্কো আর হ্যারি দুদিকের লোহার কড়া ধরে নিয়ে চলল। ডেক-এ উঠে ফ্রান্সিসের কাছে, সে হ্যারি বলল, সিন্দুকটা নৌকোসুদ্ধু ডুবে যাবে না তো?

না। আমার দেখা হয়ে গেছে। সমুদ্র আজ শান্ত। ঢেউয়ের বড়রকম ঝাপ্টা লাগার সম্ভাবনা নেই। তবু তোমরা তীরের কাছাকাছি থেকে নৌকো চালিয়ে যাবে। যদি নৌকো ডুবে যায় চিৎকার-চাচামেচি করবে না। মারিয়া ভালো সাঁতার জানে। মারিয়া জলে ভেসে থাকবে। তোমরা দু’জন নৌকো সোজা করে জলের তলা থেকে সিন্দুক আর গাঁঠরি নৌকোয় তুলে নেবে। তবে মনে হয় এত সব করতে হবে না। শাঙ্কো, সাবধানে নৌকো চালাবে। দেরি হোক। ভোর হবার একটু আগেই যা বলেছি সেভাবে কাজ সারবে। সকালের মধ্যেই শাঙ্কো নৌকো নিয়ে ফিরে আসবে। শেষ রাতে এই অঞ্চলে জেলেদের নৌকো মাছ ধরতে চলাচল করে। কাজেই কারো মনে সন্দেহ হবে না। খুব অন্ধকার আজ। নজরে পড়তে পড়তে তীরে নেমে যেতে পারবে। ফ্রান্সিস কথাগুলি যেতে যেতে বলে গেল।

হালের কাছে এসে ওরা দেখল বিনোলারা কয়েকজন ডেক-এ শুয়ে আছে। শাঙ্কো চাপাস্বরে ডাকল, বিনোলা! বিনোলা ঘুমোয়নি। রাতের অভিযানের কথা শাঙ্কোর কাছে আগেই শুনেছে। বিনোলা আর এক বন্ধুকে নিয়ে মাথা নিচু করে শাঙ্কোদের কাছে এসে। সিন্দুকটা ধরে নিয়ে চলল।

ততক্ষণ ফ্রান্সিস হালের কাছে চলে এসেছে। চারদিক ভালো করে নজর বুলিয়ে নিয়েছে। জাহাজঘাটের মশালের আলোয় অস্পষ্ট দেখে নিয়েছে প্রহরী দু’জন তখনও ঘাটের ওপর ঘোরাঘুরি করছে। বন্দর শহরের রাস্তা, বাড়িঘর ঘন অন্ধকারে ডুবে আছে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হল ফ্রান্সিস। এবার গাঠরি, সিন্দুক নিয়ে নিঃশব্দে নীচে জাহাজে বাঁধা নৌকোটা নামাবে বন্ধুদের সাহায্যে। শাঙ্কো দড়ির সিঁড়ি বেয়ে সিন্দুকটা আস্তে আস্তে ঢেউয়ের ঠেলায় দুলতে থাকা নৌকোর মাঝখানে রাখল। অন্ধকারে খুব অস্পষ্ট দেখল নৌকোর গলুই থেকে জল অন্তত ছ’সাত আঙুল নীচে। ও অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। বিনোলা গাঁঠরিনামিয়ে আনল। মারিয়া আর হ্যারিও আস্তে আস্তে নিঃশব্দে নৌকোর মাঝখানে নামল। শাঙ্কো চাপাস্বরে বলল, দুজন একপাশে। হ্যারি ও মারিয়া সে ভাবেই বসে পড়ল। জাহাজে বাঁধা দড়ি ধরে ধরে অন্ধকারে দড়ির মুখটা খুলে দিয়েই শাঙ্কো নৌকোর আর এক কানায় বসে পড়ল। টাল খেয়ে নৌকোটা সরে এল। শাস্কো দাঁড় তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে এতটুকু নড়াচড়া না করে নিঃশব্দে বইতে লাগল। নৌকো জাহাজ থেকে দূরে সরে এল। হ্যারি, মারিয়ার কাছে নৌকো চড়ার অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। ওরা দুজনে চুপ করে নিথর বসে রইল। নৌকো শান্ত সমুদ্রের ওপর দিয়ে চলল জেলেদের ঘাটের দিকে। আজও জেলেদের নৌকো জলে নামানো হয়নি। তীরের কাছাকাছি নৌকো আনল শাঙ্কো। তারপর খুব সাবধানে দাঁড় বাইতে লাগল। জেলেপাড়ার এলাকা ছাড়িয়ে আসতেই অন্ধকারে আবছা দেখল দুটো জেলেদের নৌকো গভীর সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। জেলেরা শাঙ্কোদের দেখতে পেল না। অস্পষ্ট দেখলেও মাছধরা নৌকো বলেই ভাবত। তীরের ধার দিয়ে নৌকো চলল। হাওয়াও বেশ নিস্তেজ। মারিয়া আকাশের দিকে তাকাল। লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলছে। টুকরো টুকরো সাদাটে মেঘ স্তব্ধ হয়ে আছে ফিসফিস করে বলল, হ্যারি, দেখো ওপরে। কী সুন্দর আকাশ!

হ্যারি মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলল, এ তো আমাদের পরিচিত দৃশ্য। তবু যতবার দেখি আশ্চর্য হয়ে যাই। এই বিরাট বিশ্বে নিজেকে কত ক্ষুদ্র মনে হয়। অথচ দুঃখ এই পৃথিবীর সব মানুষই তো এই রহস্যময় উদার আকাশ দেখে। অথচ ক্ষুদ্র স্বার্থ প্রবঞ্চনা হত্যা লুঠ রক্তপাত নিয়ে ব্যস্ত তাদের মনে কোনো দাগই কাটে না।

সত্যি। মারিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

শাঙ্কোরা এবার তীরভূমির একটু জংলা এলাকায় তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলল। বেশ কিছুটা আসার পর আবছা দেখল উঁচু তীরভূমিতে পাশাপাশি দুটো বড় পাথর পড়ে আছে। তার মাঝখানে ঘাস নেই। শাঙ্কো নৌকো উল্টোদিকে বেয়ে প্রায় নিশ্চল করে ফেলল। ফিসফিস করে বলল, হ্যারি, দেখো তো এইটা কি একটা ঘাট? মনে হচ্ছে এখান দিয়ে তোক চলাচল করে।

হ্যারিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বলল, হ্যাঁ, একটা সাদাটে জায়গা দেখা যাচ্ছে। মনে হয় কাছেই মানুষের বসবাস আছে। নৌকো ভেড়াও।

শাঙ্কো আস্তে আস্তে নৌকো ভেড়াল। তারপর নৌকো থেকে হাত দশেক দূরের বালিয়াড়িতে নামল। দ্রুত ওপরের দিকে ছ’সাত পা গিয়ে আবার দ্রুত ফিরে এল। ফিসফিস করে বলল, পায়ে-চলা পথের আভাস দেখলাম।

এখানেই নামব। হ্যারি বলল।

শাঙ্কো হাত বাড়িয়ে বলল, রাজকুমারী, নেমে আসুন। মারিয়া আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর শাঙ্কোর বাড়ানো হাত ধরে তীরের বালিকাদার মধ্যে নামল। তারপর হ্যারিও একইভাবে নামল।

শাঙ্কো ডান হাত দিয়ে সিন্দুকের একপাশের কড়াটা ধরল। অন্য পাশে হরি ধরল। তারপর উঁচু তীরভূমির দিকে আবছা অন্ধকারে উঠতে লাগল। পেছনে মারিয়া। দুটো পাথরখণ্ডের মাঝখান দিয়ে উঠে অস্পষ্ট দেখল একটা সাদাটে পায়ে-চলা রাস্তা পুবমুখো চলে গেছে। দু’পাশে কালো কালো গাছ-গাছালি। কিছুটা দূরে ডানদিকের অন্ধকারে ডুবে আছে একটা বাড়ি। পাথরের বাড়ি। সামনে টানা বারান্দা। ফুলের বাগান। বোঝা গেল অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি। হ্যারি বলল, এই বাড়িতে নয়। এরা বড়লোক। সাবধানী নানা প্রশ্ন করবে। এগিয়ে চলল। ঐ বাড়িটা পার হয়ে কিছুটা এগোতে বাঁ দিকে একটা বাড়ি দেখা গেল আবছা অন্ধকারে ডুবে আছে। ছাউনি শুকনো ঘাস পাতার। তবে খুব শক্ত করে সমান করে বাঁধা। হ্যারি ঐ বাড়ির দিকে চলল। ছোট ছোট গুল্মের বেড়া। কয়েকটা ফুলগাছ। ওসব পার হয়ে হ্যারি বন্ধ দরজার সামনে সিন্দুকটা রেখে একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বন্ধ দরজায় আঙুল ঠুকেশব্দকরল। একবার। ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। আর একবার আঙুল ঠুকতেই ডান পাশের কাঠের জানালাটা খুলে গেল। এক বৃদ্ধ চাদর গায়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন। বললেন, কে?

একটু বাইরে আসবেন। কিছু বলব। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল।

ভদ্রলোকটি মাথা সরালেন। একটু পরেই দরজা খুলে বাইরে এলেন। অন্ধকারে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী চাই?

দেখুন আমরা বিদেশি বণিক। কাপড়ের তৈরি পোশাকবিক্রি করতে এসেছি। হ্যারি বলল।

জাহাজে চড়ে? ভদ্রলোক বললেন।

হ্যাঁ। হ্যারি মাথা নেড়ে বলল।

বন্দরে তো থাকার মতো সরাইখানা আছে। ভদ্রলোক বললেন।

তা আছে। কিন্তু মুস্কিলে পড়েছি প্রহরীদের নিয়ে। বেশ কিছু মেকালেশ মানে স্বর্ণমুদ্রা চায়। আগেও তো ব্যবসার কাজে এসেছি। এখানকার সরাইখানায় থেকেছি। কিন্তু প্রহরীদের অন্যায় দাবি মেটাতে গিয়ে ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। তাই জাহাজ থেকে কিছু মালপত্র নৌকোয় চাপিয়ে লুকিয়ে এখানে এসেছি। কয়েকদিন থাকব। যদি আপনি আশ্রয় দেন তাহলে বাধিত হব। হ্যারি বলল।

একটু ভেবে নিয়ে বৃদ্ধ বললেন, আসুন, তবে এখানে উজির ইয়েপুদার প্রহরীরা। কিন্তু মাঝে মাঝে টহল দিয়ে যায়। বিদেশী দেখলে সন্দেহ করে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন।

তখন না হয় লুকিয়ে পড়ব। হ্যারি বলল।

ঠিক আছে। আসুন। গৃহস্থ ভদ্রলোক বললেন। উনি সরে দাঁড়ালেন। তিনজনে সিন্দুক, গাঁঠরি নিয়ে ঢুকল। অন্ধকার ঘর। ভদ্রলোক চকমকি ঠুকে ঘরের এককোণে একটা তেলের দীপ জ্বাললেন। ছোট ঘর। একপাশে একটা কাঠের পাটাতনে ছোট বিছানামতো। একটু অগোছালো। আলোতে এবার মারিয়াকে দেখে একটু চুপ করে থেকে বললেন, ইনি কে?

আমার স্ত্রী। ব্যবসার জন্যে তো অনেক জায়গায় যেতে হয়, উনি সঙ্গে থাকেন। আমাদের দেখাশুনো করেন। হ্যারি বলল।

ছেলেপুলে? ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন।

মাদ্রিদের শহরতলিতে আমার কাপড়ের ব্যবসা। ওখানেই দিদিমার কাছে ওরা থাকে। হ্যারি বলল।

স্পেনই তো আপনাদের দেশ। পোর্তুগিজ ভাষা তো ভালোই বলছেন।

পাশাপাশি দেশ। ব্যবসা করি। কথাবার্তা তো চালাতে হয়।

তা ঠিক। ভদ্রলোক বললেন।

তা আপনার নামটা জানতে পারি? হ্যারি বলল।

নিশ্চয়ই। আমার নাম সার্মেন্তো। মুস্কিল হল আমার তো বেশি বাড়তি ঘর নেই। আপনারা তিনজন মানে–এখানে–

না না। শাঙ্কোকে দেখিয়ে হ্যারি বলল, ও শাঙ্কো আমাদের কর্মচারী। ব্যবসার মালপত্র ওই সব দেখেটেখে। শাঙ্কো এখুনি জাহাজে ফিরে যাবে। আরও মালপত্র তো আছে। সেসবও তো আনতে হবে। আর এই ঘরে আমরা বেশ থাকতে পারব। উনি মারিয়া, অন্দরে কোথাও থাকবেন। কোন অসুবিধে নেই। হ্যারি বলল।

হ্যাঁ হ্যাঁ যদি ওর কোনো অসুবিধে না হয়। সার্মেন্তো বললেন।

না না। কয়েকটা দিন তো! ভালই থাকবেন। হ্যারি বলল। তারপর শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল, শাঙ্কো, ডন সার্মেন্তোকে দুটো স্বর্ণমুদ্রা দাও। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে দুটো স্বর্ণমুদ্রা বের করল।

সেকি! আপনারা আমাদের অতিথি। সার্মেন্তো বললেন।

এ দুটো আপনাকে নিতেই হবে। ব্যবসা করি তো। এরকম আতিথেয়তা তো মূল্য দিয়েও সরাইখানায় পাব না। এই সামান্য খরচের মূল্য আপনাকে নিতেই হবে। হ্যারি বলল।

ঠিক আছে। এত করে বলছেন। সার্মেন্তো তারপর মুদ্রা দুটো নিয়ে বললেন, আপনারা বিশ্রাম করুন। ভোর হতে খুব দেরি নেই। তারপর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ভিতরে এসে শুতে পার।

একটু পরে যাচ্ছি। বিছানাটা একটু গুছিয়ে দিয়ে যাই। মারিয়া বলল।

বেশ। সার্মেন্তো বেশ খুশি হলেন। উনি চলে গেলে মারিয়া বলল, বিছানা ঢাকা, চাদরটাদর তো কিছু আনতে পারিনি।

দরকার নেই। যে কাপড়টা আছে ওটাই একটু গুছিয়ে দিন। হ্যারি বলল।

তাহলে আমি যাচ্ছি। ভোর হবার আগেই জাহাজে পৌঁছতে হবে। শাঙ্কো বলল।

হ্যাঁ হ্যাঁ। চলে যাও। ফ্রান্সিসকে বলো ভালো আশ্রয় পেয়েছি। হ্যারি বলল।

শাঙ্কো বাইরের আবছা অন্ধকারে বেরিয়ে এল। দ্রুত পায়ে সমুদ্রতীরের দিকে চলল।

নৌকো চালাতে চালাতে শাঙ্কো দেখল আকাশের তারাগুলি উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই পুব আকাশ ফর্সা হয়ে গেল। যখন নৌকো জাহাজে বেঁধে দড়িদড়া বেয়ে জাহাজে উঠছে তখন পুব দিগন্তে কমলা রঙ ছড়িয়ে সূর্য উঠল। শাঙ্কো এসে ফ্রান্সিসকে সব বলল। ফ্রান্সিস অনেকটা নিশ্চিন্ত হল।

ভাইকিংদের সকালের খাবার খাওয়া সবে শেষ হয়েছে। সেই সেনাপতির সঙ্গে সাত আটজন যোদ্ধা জাহাজঘাটে এসে সার বেঁধে দাঁড়াল। সেনাপতি ফ্রান্সিসদের জাহাজের, কাছে এসে দাঁড়াল। সিনাত্রা রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বলল, পাটাতন ফেল। তল্লাশি হবে। ততক্ষণে আরও দু’জন বন্ধু এসে দাঁড়িয়েছে। ওরা তাড়াতাড়ি পাটাতন তীরে পেতে দিল। যোদ্ধাদের নিয়ে সেনাপতি জাহাজের ডেক এ উঠে এল। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে চড়া গলায় বলল, তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালাও। মূল্যবান কিছু পেলেই এসে আমাকে বলবে। যোদ্ধারা তল্লাশির কাজে নেমে পড়ল। জোর তল্লাশি শুরু হল। ছোট্ট কেবিন ঘরগুলি, রান্না ও খাবার ঘর, বাতিল পাল-দাঁড় রাখার ঘর, ফাঁকা অস্ত্রঘর, কাঠের তক্তা-পেরেক রাখার স্থান, মেরামতির কাজের জন্যে ব্যবহৃত ঘর। দু’জন যোদ্ধা এল ফ্রান্সিসের ছোট্ট কেবিন ঘরে। ফ্রান্সিস আর ক্রেভান বিছানায় চুপ করে বসেছিল। মারিয়ার ব্যাগ, ঝোলা-টোলা খুলে মেয়েদের পোশাক পেল। একটু অবাক চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাতেই ফ্রান্সিস বলল, ওসব আমার স্ত্রীর পোশাক। গত মাসে মারা গেছেন। এবার সেই ময়লা ছেঁড়া পালের গাঁঠরি দেখল। কাছে গিয়ে একজন যোদ্ধা ফ্রান্সিসকে জিগ্যেস করল, এটা কী?

অভিশপ্ত ধনসম্পদ। ফ্রান্সিস নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল। যোদ্ধাটি অবাক। কথাটার অর্থ ঠিক বুঝল না। কোমরে ঝোলানো তরোয়াল বার করল। গাঁঠরিতে কয়েকটা খোঁচা দিল। ছোট্ট ছেঁড়া দিয়ে কিছু বেরিয়ে এল না।

ঠাট্টা করছ, আঁ? যোদ্ধাটি বলল।

যদি ঠাট্টা মনে কর তবে তাই। ফ্রান্সিস একইরকম উদাস ভঙ্গিতে বলল।

যত্ত সব। নাক কুঁচকে বলে উঠল। তারপর চলে গেল। সব যোদ্ধা তল্লাশির শেষে ডেক-এ বসে জড়ো হল।

দামি কিছু পেলে? সেনাপতি বলল।

কিছুই না। একজন বলল।

ভিখিরির দল। আর একজন বলল।

কোমরবন্ধনীগুলো খুলিয়ে হয়তো কিছু মুদ্ৰাটুদ্রা পাওয়া যেত। তবে সোনার নয়। আর একজন বলল।

যে দু’জন ফ্রান্সিসের কেবিন ঘর তল্লাশি করেছিল তাদের একজন বলল, একটা ময়লা ছেঁড়া পালের গাঁঠরি দেখলাম।

তাতে কী আছে? সেনাপতি জানতে চাইল।

ছেঁড়া কাপড়জামা বোধহয়। যোদ্ধাটি বলল।

খুলে দেখেছ? সেনাপতি বলল।

ঐ নোংরা কাপড়ের বস্তা?

বস্তা নয়। কিছু বেঁধে রাখা হয়েছে। চলো তো। সেনাপতি সিঁড়ির দিকে চলল। পেছনে ঐ যোদ্ধা দু’জনও চলল। ফ্রান্সিস একই ভাবে বিছানায় বসেছিল। ক্রেভান মৃদুস্বরে ডাকল, ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস কিছু বলল না। ঘরে ঢুকে সেনাপতি বলল, এই গাঁঠরি ঘরের মধ্যে রেখেছ কেন?

পছন্দ হলে আপনি নিয়ে যেতে পারেন। ফ্রান্সিস নির্বিকারভাবে বলল।

ঠাট্টা রাখো। কী আছে এতে যে বেঁধে রেখেছ?

বলেছি তো অভিশপ্ত ধনসম্পদ-রক্তে ভেজা। ফ্রান্সিস নির্বিকার।

সেনাপতি চড়া গলায় বলে উঠল, অ্যাই, খোল গাঁঠরিটা।

দু’জন যোদ্ধা লাফিয়ে এসে গাঁঠরির মুখ টেনে টেনে খুলে ফেলল। দু’চারটে অলঙ্কার গড়িয়ে পড়ল। অন্য যোদ্ধাটি টান মেরে মুখটাই খুলে ফেলল। কাঠের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল সোনার চাকতি, মুদ্রা, অলঙ্কার, মণি-মুক্তো। ঝিকিয়ে উঠল হীরে বসানো গলার হার। সেনাপতি, যোদ্ধা দু’জন হাঁ করে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। অল্পক্ষণ। তারপরই ফ্রান্সিসের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে সেনাপতি বলল, মিথ্যে বলে পার পাবে ভেবেছিলে?

আমি তো মিথ্যে বলিনি। যা সত্য তাই বলেছি। ফ্রান্সিস বলল।

এই সোনাটোনা, অলঙ্কার–তোমরা যে জলদস্যুতা কর এটাই তো বড় প্রমাণ। সেনাপতি বেশ গম্ভীর গলায় বলল।

লুঠ-ডাকাতি করলে এসবের ওপর মায়া থাকত নিশ্চয়ই, লুকোবার চেষ্টা করতাম। এভাবে সকলের চোখের সামনে ঘরে রেখে দিতাম না। ফ্রান্সিস বলল।

ওসব দরবারে গিয়ে শুনিও। তোমাদের সবাইকে বন্দী করা হল। দু’জন যোদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল, গাঁঠরি বেঁধে নিয়ে চলো।

ফ্রান্সিস এবার উঠে দাঁড়াল। বলল, একটা অনুবোধ। সবাইকে বন্দী করে বেঁধে নিয়ে চলুন। কিন্তু এই বৃদ্ধ এখানেই নেমে যাবে। অন্য একজন আমাদের বৈদ্য-বয়স্ক। তাকে এই জাহাজেই থাকতে দিন। তাকে ফেলে তো আমরা পালাতে পারব না।

একটু ভেবে নিয়ে সেনাপতি বলল, তোমাদের অনুরোধ মাননীয় উজিরকে জানাব। তিনি যা বলবেন তাই হবে।

বেশ। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।

সবাই ডেক-এ উঠে এসো। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বলে উঠল। ফ্রান্সিসরা ওপরে ডেক-এ উঠে আসতে লাগল। দু’একজন ফ্রান্সিসকে মৃদুস্বরে বলল, এভাবে হার মানবে?

অস্ত্রঘরে একটা ছোরাও পড়ে নেই। আমার একটা মাত্র তরোয়াল বিছানার নীচে লুকোনো আছে। খালি হাতে লড়াই হয়? চলো, দেখা যাক সব।

আগে-পিছে যোদ্ধাদের পাহারায় ফ্রান্সিসরা জাহাজ থেকে নেমে এল। সদর রাস্তা দিয়ে পুবমুখো চলল। পোতো বন্দর শহর ছাড়িয়ে হেঁটে চলল সবাই। রোদের তেজ বাড়ছে। দু’পাশে গম জলপাইয়ের ক্ষেত-খামার। রাস্তার লোকজন কেউ কেউ ওদের দিকে তাকিয়ে দেখল। ভাইকিংরা কোনো কথা বলছিল না। হেঁটে চলল।

বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর কাঠ আর পাথরের ঘর-বাড়ি দেখা গেল। রাজধানী পৌরো শহরে এসে পৌঁছল সবাই। বাঁ দিকে কিছুদূরে দেখা গেল একটা মাথাভাঙা পাথরের দুর্গ। আগে অটুট ছিল উঁচু দুর্গা। রাস্তায় ঘোড়ায় টানা গাড়ি, বাজার এলাকায় দোকানপাট, লোকজনের ভিড়। কেনাকাটা চলছে। বেশ গুঞ্জনধ্বনি। ডান দিকে একটা লম্বাটে পাথর ও কাঠের বড় বাড়ি। তার সামনে এসে সেনাপতি সবাইকে থামবার ইঙ্গিত করল। বিরাট কাঠের দরজা। তার কোথাও কোথাও কুঁদে কুঁদে নানা নকশা তোলা। বোঝা গেল খলিফা হাকিমের প্রাসাদ। প্রবেশপথের ধারেকাছে কোনো প্রহরী নেই। লোজন ঢুকছে বেরোচ্ছে নির্বিবাদে। ফ্রান্সিস একটু অবাকই হল। সেনাপতি আছে। যোদ্ধারা আছে। অথচ প্রাসাদে কোনো দ্বাররক্ষী নেই। এবার ফ্রান্সিসরা সবাই অবাক হল যখন দেখল মূল দরবারের প্রবেশদ্বারেও কোনো দ্বাররক্ষী নেই। অদ্ভুত ব্যাপার। শাসক খলিফা হাকিম আত্মরক্ষার ব্যবস্থা রাখেননি? ফ্রান্সিস চারদিকেতাকাল। পাথরের গাঁথনিতে তৈরি লম্বাটে বড় ঘর। দু’পাশে বড় বড় জানালা। জানালার চারপাশে দেয়ালে সুন্দর কারুকাজ। নানা রঙের। কালো কাঠের গদিপাতা আর তাতে সোনা রুপোর গিলটি করা। একটি আসনে খলিফা হাকিম বসে আছেন। একটু মোটা। মুখে অল্প দাড়ি গোঁফ। পরনে ঢোলা হাতা ঘন হালকা সাটিন কাপড়ের পোশাক। মাথায় নীল কাপড়ের পাগড়ির মতো। কপালের ওপরেই পাগড়িতে বসানের একটা বড় গোল হীরে। আসনের নীচে একপারে সুন্দর কাজ করা আলবোলা রাখা লম্বা নলটায় সোনা রুপোর কাজ করা। খলিফা আলবোলার নল মুখে নিমীলিত চোখে বসে আছেন। পাশের আসনে ইয়েপুদা, অন্য আসনে সেনাপতি বসে আছে। বেশ ভিড় দরবারে। একজন মোটা মতো লোক ঢোলা কালো পোশাক, মুখে অল্প দাড়ি-গোঁফ। গানের সুরেলা সুর টেনে থেমে থেমে বলে থামতেইদরবারে প্রশংসার ঢেউ উঠল। কিহচ্ছে ফ্রান্সিস বুঝল না। সিনাত্রা থাকলে হয়তো বলতে পারত। ক্রেভান আর ভেনকেও ফ্রান্সিসদের সঙ্গে আসতে হয়েছিল। ফ্রান্সিস ক্রেভানের কাছে সরে এল। বলল, ক্রেন, কী ব্যাপার বলুন তো?

আরবী ভাষায় মুখে মুখে কবিতা বলার আসর চলছে। ঐ দেখো আর একজন কবিতা বলা শুরু করল। এইসব কবি তাকে বলে গিজেল। খলিফা হাকিমদের সম্মান করেন। বলেছিলাম না কোনো কোনো মুর শাসক গান, কবিতা ভালোবাসেন। অর্থাৎ যাকে বলে কাব্য-প্রেমিক। ক্রেভান মৃদুস্বরে বলল। পর পর কয়েকজন এইভাবে মুখে মুখে গিজেল বলে গেল। প্রশংসার উঠল শ্রোতাদের মধ্যে।

ফ্রান্সিস ভাবল হ্যারি, মারিয়া থাকলে খুশি হত। কবিতার অর্থ হ্যারি কিছু কিছু বুঝত। এই সুন্দর পরিবেশটা ভালো লাগত ওদের। শাঙ্কো বলল, ফ্রান্সিস, এ কেমন রাজদরবার? অভিযোগ নেই, বিচার নেই, শাস্তি নেই। একজনের বলা শেষ হলে ইয়েপুদা আসন থেকে উঠে দাঁড়াল। চোখেমুখে প্রচণ্ড বিরক্তি। খলিফা হাকিমের কাছে এসে মাথা নিচু করে একনাগাড়ে কিছু বলে গেল।

খলিফা হাত তুললেন। আস্তে আস্তে শ্রোতারা বেরিয়ে গেল। দরবারে ভিড় কমে গেল। খলিফা ফ্রান্সিসদের এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করলেন। তারপর পোর্তুগিজ ভাষায় বললেন, তোমরা ভাইকিং দেশ থেকে এসেছ। তোমাদের জাহাজে মূল্যবান ধনসম্পত্তি পাওয়া গেছে। তোমরা লুঠ কর, ডাকাতি কর। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে বলল, মাননীয় খলিফা, এই অভিযোগ সত্য নয়। তারপর ফ্রান্সিস অল্প কথায় হ্যারল্ডের ঘটনাটা বলল।

বিশ্বাস করলাম। আমি কাউকে অবিশ্বাস করি না। আচ্ছা, একটা কথা, তোমাদের দেশে কবিতা, গানের প্রচলন আছে? খলিফা জানতে চাইলেন।

দেখুন মান্যবর খলিফা–আমি কাঠখোট্টা মানুষ। সিনাত্রাকে দেখিয়ে বলল, ও আমার বন্ধু সিনাত্রা। আমাদের দেশের গান গায়। নিজে গানও বাঁধে।

খলিফা হাকিম খুব খুশি হয়ে বলে উঠলেন, তাহলে তো শুনতে হয়। সিনাত্রার দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনাও তো সিনাত্রা। অসহায় ভাবে ফ্রান্সিসের দিকে একবার তাকিয়ে সিনাত্রা বলল, মহামান্য খলিফা, আমাদের ভাষা তো আপনি বুঝবেন না।

সুরটা তো বুঝব। আর অর্থটা পোর্তুগিজ ভাষায় বলবে। খলিফা বললেন।

সিনাত্রা বলল, আমার অল্প বয়সে আমাদের বাড়ির কাছে একজন কবি ছিল। সকলে তাকে পাগল বলত। তার একটা কবিতা বলছি। সিনাত্রা মনে করে নিয়ে আস্তে আস্তে কবিতাটা সুর করে বলে গেল। খুশি হয়ে খলিফা বলে উঠলেন, বাঃ। সুন্দর তো! বড় সুরেলা তোমার কণ্ঠ। এবার অর্থটা বলো।

সিনাত্রা আস্তে আস্তে অর্থটা বলল–

সূর্য আছে চন্দ্র আছে।
অস্তে গেলে অন্ধকারও আছে,
সুখও আছে দুঃখও আছে।
বন্ধু হে, কোনটা নেবে?
আমি বলি–দুটোই নাও।
সবই তো ঈশ্বরের দান।

খলিফা হাকিম আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, বাঃ বাঃ! সুন্দর কবিতা তো!

এবার ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। একটু মাথা নুইয়ে বলল, মান্যবর, একটা আর্জি।

বলো। খলিফা বললেন।

আমাদের সঙ্গে একজন বৃদ্ধ আছেন তিনি এখানে এই দেশেই থাকবেন। অন্যজন আমাদের চিকিৎসক। বয়স্ক মানুষ। আমাদের বিচারের জন্যে বন্দী করা হোক, কিন্তু তাকে জাহাজে থাকতে দেওয়া হোক।

খলিফা ইয়েপুদার দিকে তাকালেন। ঠিক আছে। তাই হবে।

ইয়েপুদা কেন জানি আপত্তি করল না। ফ্রান্সিস এত সহজে মিটবে ব্যাপারটা কল্পনাও করেনি। খলিফা হাকিম বলে গেলেন। সেনাপতিকে ডেকে ইয়েপুদা কী সব নির্দেশ দিল। সেনাপতি ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল, চলো।

কোথায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

গেলেই দেখতে পাবে। সেনাপতির গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

বেশ। ফ্রান্সিসরা প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এল। আগে-পিছে যোদ্ধার দল।

ক্রেভানকে ডেকে সেনাপতি বলল, এই বুড়ো, তুই যেখানে খুশি চলে যা। ভেনকে ডেকে বলল, তুই জাহাজে গিয়ে থাকবি। পালাবার চেষ্টা করবি না। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো সব।

প্রাসাদের বাইরে এসে দাঁড়াল সবাই। ক্রেভান হাতে একটা কাপড়-চোপড়ের ঝোলা এনেছিল। সেটা শাঙ্কোর হাতে দিয়ে প্রায় ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ক্রেভানের দু’চোখ জলে ভরে উঠল। অরুদ্ধ স্বরে বলল, ফ্রান্সিস, তোমার মতো মানুষ এই বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত দেখিনি। ঈশ্বরের কাছে তোমার দীর্ঘজীবন প্রার্থনা করি। ফ্রান্সিস আস্তে ক্রেভানের পিঠে চাপড় দিল। বলল, আমরা তো এখন জাহাজ থেকে নির্বাসিত। কী অবস্থায় পড়ব জানি না তবু এখানে থাকতে অসুবিধে হলে নিশ্চয়ই আমার কাছে আসবেন। চোখ মুছে ক্রেভান ঝোলা হাতে আস্তে আস্তে চলে গেল। ভেনও এগিয়ে এসে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। চড়া রোদের মধ্যে যোদ্ধাদের পাহারায় ফ্রান্সিসরা হাঁটতে লাগল।

রাস্তায় লোকজনের ভিড়। দোকানপাটে কেনাবেচা চলছে। ভাইকিংরা এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে চলল। কিছুদূর যেতেই আগে-দেখা সেই পাথর গাঁথা আধভাঙা দুর্গা দেখল। তার পাশেই পারপর দুটো পাহাড়। খুব উঁচু নয়। গাছ-গাছালি আছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়। চুড়োয় অবশ্য বেশি গাছ-গাছালি নেই। কাছাকাছি আসতে দেখা গেল পাহাড় দুটোর মাঝখানে একটা সরু গিরিসংকট। উপত্যকার মতো। বিস্তৃত নয়। সেই গিরিসংকটের কাছে এসে সেনাপতি বলে উঠল, দাঁড়াও সব। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। এখানে কিন্তু দু’জন সশস্ত্র প্রহরীকে দেখা গেল। দুজনের পেছনে লোহার বেশ কয়েকটিা গরাদ পোঁতা। মাঝখানে লোহার দরজা মতো। তাতে একটা বড় তালা ঝুলছে।

ফ্রান্সিস, মনে হচ্ছে কয়েদ ঘর। শাঙ্কো বলল।

ঘর নয়। অদ্ভুত ব্যবস্থা কয়েদ রাখার। এর মধ্যেই বন্দীজীবন কাটাতে হবে। নীচের মেঝে পাথুরে, ঝড়বৃষ্টির সময় মাথার উপরে থাকবে শুধুদু’পাশের ঝুঁকে পড়া গাছের ডাল-পাতা। কী অদ্ভুত ব্যবস্থা! ফ্রান্সিস ঐ গিরিসংকটটা দেখতে দেখতে বলল।

এখান থেকে পালানো যাবে না ফ্রান্সিস। সিনাত্রা বেশ ভীত গলায় বলল।

আগেই হাল ছেড়ো না। দেখা যাক সব ব্যবস্থা। ফ্রান্সিস বলল।

একজন প্রহরী এগিয়ে এসে কোমর থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দিল। তারপর ফ্রান্সিসদের ঢুকতে ইঙ্গিত করল।

তাহলে বন্দীই হলাম। বিনোলা মৃদুস্বরে বলল। ফ্রান্সিস বলল, ইয়েপুদাই সর্বেসর্বা। খলিফার কোনো ক্ষমতাই নেই। কবি আর কবিতা নিয়ে মশগুল। তাই মানুষ হিসেবে ভালো। দেখা যাক কয়েকটা দিন। ফ্রান্সিস ঢুকতে ঢুকতে মৃদুস্বরে বলল।

ভেতরে সরাসরি সূর্যালোক পড়েছে। এখানে-ওখানে ঝুঁকে-পড়া গাছের ছায়া। দেখা। গেল আগে থেকে বন্দী আট-দশজন তোক শুয়ে-বসে আছে। দু’জন মুর, বাকিরা শ্বেতকায়। এবড়ো-খেবড়ো পাথরের মেঝে। ফ্রান্সিস সেখানেই বসে পড়ল। ভাইকিং বন্ধুরাও বসে পড়ল। বন্দী রাখার এই ব্যবস্থায় সবাই অবাক। এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। কিছুটা দূরে গরাদ পোঁতা। পালাবার সব রাস্তাই বন্ধ। দু’পাশে প্রায় খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। একটুকরো ঘাসও নেই। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। ওপরে দুপুরের আলোকোজ্জ্বল নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেক চিন্তা মাথায়। হ্যারি, মারিয়া নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে সত্যি কিন্তু বেশি দিন তো থাকতে পারবে না। শাঙ্কোও যেতে পারবে না। ব্যবসার কাজ ফেলে হ্যারি, মারিয়া ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে, কর্মচারীও মালপত্র নিয়ে আসছে না। স্বাভাবিকভাবেই সেই সার্মেন্তো নামের ভদ্রলোকের মনে সন্দেহ হতে পারে। হ্যারিরা বিপদে পড়তে পারে। হাতে সময় খুব কম।

গরাদ বসানো দরজায় শব্দ হল। দু’জন প্রহরী আর একজন রাঁধুনি খাবার নিয়ে ঢুকল। চিনেমাটির বড় প্লেটে হাতে হাতে খাবার দেওয়া হল। বুনো আনাজ-টানাজ নয়। চাষ করা জমির আনাজপাতি। রান্নাও সুস্বাদু। সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ। ফ্রান্সিসরা মোটামুটি পেট পুরে খেল। একটা বেশ বড় মাটির জালা থেকে জল খেল। প্রহরীরা এঁটো প্লেট নিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সিস এবার ভালো করে সব বন্দীদের দেখল। সবার শরীরই বেশ রোগাটে। এমনকি মুর দু’জনেই কেমন রক্তশূন্য চোখমুখ। বুঝল এই পরিবেশে কেউ সুস্থ থাকতে পারে না। ইয়েপুদা অত্যন্ত ধুরন্ধর। ও বন্দীদের হত্যা করে না। কিন্তু এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে, রোদে-জলে, প্রচণ্ড গরমে, শীতে এমনিতেই বন্দীরা অসুস্থ হয়ে মারা যাবে। অসুখে মারা গেলে ওর ঘাড়ে কোনো দোষই পড়বে না।

সারাদিন রোদে পুরে বিকেলে একটু স্বস্তি পেল ফ্রান্সিসরা। খুব হাওয়া ছুটেছে। সন্ধে হল। ফ্রান্সিস পাথরের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসেছিল। পিঠের এখানে-ওখানে ছুঁচোলো পাথর যেন হাড়ে বিধে যাচ্ছিল। ও ডাকল, শাঙ্কো, শোনো। শাঙ্কো শুয়েছিল। উঠে এগিয়ে এল। বন্দীদের দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল, ওদের সঙ্গে কিছু কথা বলো তো। জেনে নাও ওরা কী অপরাধে বন্দী হয়েছে। এখানে থাকতে থাকতে কী অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওদের সব কথা জানতে হবে। শাঙ্কো বন্দীদের কাছে গিয়ে গল্প জমাল। নিজের কথা বলল। তারপর খবরাখবর নিতে লাগল। কিছুক্ষণ শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে ফিরে যাবে বলল, ঐ মুর যুবক দু’জন ভাই। গুপ্তচর এই অভিযোগে উজির বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সবাই মরেছে। ওরা গ্রামের দিকে গিয়েছিল বলে বেঁচে গেছে। কিন্তু পরে ধরা পড়েছে।

হ্যাঁ, গুপ্তচর এই বদনাম সবরকম অত্যাচার চালানো যায় হত্যাকেও অপরাধ বলে গণ্য করবে না। অন্যদের কথা বলো। ফ্রান্সিস বলল।

ওরা কেউ স্পেন, কেউ পোর্তুগালের মানুষ। একজন ফরাসি, নাম আস্তাসো। ঐ আস্তাসোই এখানে সব থেকে বেশিদিন বন্দী হয়ে আছে। শাঙ্কো বলল।

— হুঁ, ওর সঙ্গে কথা বল অনেক কিছু জানা যাবে। প্রহরীদের সামনে নয়। বলে এসো রাতে খাওয়া সেরে ও যেন আমাদের কাছে আসে। তখন কথা হবে।

শাঙ্কো চলে গেল। আস্তাসোকে ফ্রান্সিসের কথা বলল। আস্তাসো বলল বেশ। — তোমার বন্ধু বুদ্ধিমান। প্রহরীদের নজর আমি এড়িয়ে যাব।

ওদিকে বিকেলে হ্যারি ও মারিয়া চুপ করে ছোট বিছানাটায় বসেছিল দু’জনেই বেশ চিন্তান্বিত। শাঙ্কো এল না। ফ্রান্সিসদের কোনো খবরই পাওয়া গেল না। একসময় হ্যারি বলল, সন্দেহ নেই। ঐ উজির ইয়েপুদা ফ্রান্সিসদের জাহাজ তল্লাশি করিয়েছে। হ্যারল্ডের সেই ধনসম্পদ ওরা পেয়েছে। কাজেই ফ্রান্সিসদের রেহাই দেয়নি। নিশ্চয়ই বন্দী করেছে।

চিন্তা হচ্ছে ফ্রান্সিসরা বন্দীদশা থেকে পালাতে পারবে কিনা। মারিয়া বলল।

সব নির্ভর করছে ঐ খলিফা হাকিমের ওপর। তিনি কেমন মানুষ তা তো জানি না যদি উজিরের মতো ক্রূর প্রকৃতির হন তাহলে ফ্রান্সিসদের ভীষণ বিপদে পড়তে হবে। হারি বলল। যাকগে। আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না ফ্রান্সিস, শাঙ্কো নিশ্চয়ই বিপদ-আপদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। মুসকিল হয়েছে। আপনি সমুদ্রতীরে গিয়ে সমস্ত দেখে আসুন।

না। ভালো লাগছে না। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল।

না-না। মন খরাপ করবেন না। বীরের পক্ষে সেটা ভালো না। আপনি নিশ্চিন্ত মনে যান। বেশি দূরে তো নয়। জানেনও। তবে সাবধান। মুর যোদ্ধারা নাকি এদিকে টহল দিতে আসে। কেউ যেন আপনাকে দেখতে না পায়। আর অন্ধকার হবার আগেই চলে আসবেন। দুশ্চিন্তা করবেন না। রাত জাগবেন না। নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন। শরীরটা সুস্থ রাখতেই হবে। যান। হ্যারি বলল।

মারিয়া আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে বাইরের বাগানটা ছাড়িয়ে পায়ে চলা রাস্তায় এল। চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখল। একজন লোক দূরে পায়ে চলা পথটা দিয়ে চলেছে। আর কোনো মানুষ দেখল না। মারিয়া একটু পা চালিয়ে সমুদ্রতীরের দিকে চলল। সেই দুটো পাথরখণ্ডের একটাতে বসে পশ্চিমের দিগন্তের দিকে তাকাল। সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। দু’পাশে গাছ-গাছালিতে ঘরে ফেরা পাখিরা ডাকছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর কমলারঙের আলোয় দিগন্ত মায়াময় হয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তার মধ্যেও মারিয়ার মন আনন্দে ভরে উঠল। কত পরিচিত দৃশ্য। যতবার দেখে আনন্দ যেন বাঁধ মানে না।

.

রাত হল। প্রহরী আর রাঁধুনি এসে ফ্রান্সিসদের খাবার দিল। সেই আনাজ মাছের ঝোলমতো, মোটা সুস্বাদু রুটি। এঁটো প্লেট নিয়ে ওরা চলে গেল। গরাদের দরজা বন্ধ হল।

শাঙ্কো শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে রইল। আস্তাসোর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। চারদিক নিস্তব্ধ। মাথার ওপর কালো আকাশে তারাগুলি জ্বলজ্বল করছে।

কিছু পরে আস্তাসো নিঃশব্দে ফ্রান্সিসের কাছে এল। গলা নামিয়ে বলল–আপনিই ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস চোখ বুজে ছিল। চোখ খুলে তাকিয়ে বলল–হ্যাঁ। আস্তাসোর গায়ে এখানে-ওখানে ছেঁড়া পোশাক। মুখে অল্প লালচে দাড়ি-গোঁফ। মাথার চুলও লালচে। ফ্রান্সিস দেখেই বুঝল–একসময় বলিষ্ঠ শরীর ছিল। কিন্তু এখানে রোগা হয়ে গেছে। বেশ শুকনো চোখ মুখ। তবে চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল। বুদ্ধিদীপ্ত।

সংক্ষেপে বলুন তো আপনার সব অভিজ্ঞতার কথা। আপনি তো ফ্রান্সের মানুষ। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ। ক্রুসেডের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু ধর্মের নামে অযথা খুনোখুনি রক্তপাত মৃত্যু দেখে অল্পদিনের মধ্যেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লাম। জানেন তো সৈন্যবাহিনী থেকে পালানো কত কঠিন। ধরা পড়ে গেলে সহযোদ্ধাদের হাতেই অবধারিত মৃত্যু। তবু জীবন বিপন্ন করেই পালালাম। এদেশ-ওদেশ উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এই পৌরোয় এসে পড়লাম। নানা বিপদ-আপদের কথা থাক। মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানোয় ছেদ পড়ল। উজির ইয়েপুদার যোদ্ধাদের কুনজরে পড়লাম। আমাকে এখানে গুপ্তচর সন্দেহে বন্দী করা হল।

পালাবার চেষ্টা করেননি? ফ্রান্সিস বলল।

সেটাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা। এখানে ধারেকাছের দেশের বন্দীদের পেয়েছিলাম। একজন স্পেনীয় যুবকেরসঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হল। খাবার ভাগ করে খেতাম। পাশাপাশি শুতাম। সুখ-দুঃখের কথা হত। খুব দুঃসাহসী ছিল যুবকটি। কী ভাবে জানি না যুবকটি এই পাহাড়ের প্রায় খাড়া গায়ে ওঁচানো পাথরের খোদল ধরে ধরে ওপরে প্রায় পাহাড়ের মাথার কাছে একষ্টা ঝুঁকে পড়া গাছের কাছাকাছি পৌঁছোবার উপায় বের করেছিল। ও বলেছিল প্রায় কুড়ি-পঁচিশ দিন অন্ধকারে রাত জেগে ঐ পথটা ও খুঁজে খুঁজে বের করেছিল। আস্তাসে থামল।

তারপর? আগ্রহে ফ্রান্সিস বলে উঠল।

এক অন্ধকার রাতে ওরা পাঁচজন ঐ পথে অসম্ভব কষ্ট করে ঐ পাহাড়ের মাথার গাছটার কাছে পৌঁছেছিল। ঝুঁকে পড়া গাছটার ডাল ধরে ধরে তিনজন নাকি উঠছিল। পালাবার আনন্দে উত্তেজনায় ওরা তিনজনই ডালটা ধরে একসঙ্গে উঠতে গিয়েছিল বোধহয়। ডাল ভেঙে তিনজনের সঙ্গে বন্ধুটিও একবারে নীচে পাথরের মেঝের ওপর আছড়ে পড়েছিল। কেউ বাঁচেনি।

ফ্রান্সিস খুব মন দিয়ে শুনছিল। বলল–তাহলে ওপরে ওঠার একটা উপায় আছে।

হ্যাঁ। কিন্তু সেইঝুঁকে পড়া গাছটা পরদিনই যোদ্ধারা কেটে ফেলেছিল। আস্তাসো বলল।

ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। বলে উঠল, অবমানে ওপর থেকে নেমে গাছটা পর্যন্ত পৌঁছানো যায়।

নিশ্চয়ই। নইলে ওরা ওপর থেকে নেমে এসে গাছটা কাটল কী করে? আস্তাসো বলল।

ওপরে ওঠার রাস্তাই বলুন আর উপায়ই বলুন–সেটা ওরা নেমে এসে নষ্ট করে দিতে পারেনি। ফ্রান্সিস বলল।

না। তা পারেনি। আস্তাসো অন্ধকারে মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিস আবার ঠেস দিয়ে বসল। দু’চোখ বোজা। একটু অপেক্ষা করে আস্তাসো বলল কী হল?

ছক কষা বোঝেন তো? ছক কষছি। পালাবার ছক। তবে তার আগে ঐ গোড়াকাটা গাছটা পর্যন্ত পৌঁছোত হবে। ফ্রান্সিস থেমে থেমে বলল।

পাগলামি করবেন না। ঐ মৃত্যুর দৃশ্য দেখলে

আস্তাসোকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফ্রান্সিস বলে উঠল–এইখানে এভাবে থেকেও কি বাঁচার আশা রাখেন?

দেখুন–খলিফা হাকিমকে তো দেখেছেন। তাঁর দরবারও দেখেছেন। তার কাছ থেকে উজির কিন্তু সব কিছু গোপন রাখে। আস্তাসো বলল।

তাহলে তো খলিফা হাকিমের কানে আমাদের এই নরকবাসের কথা পৌঁছবেই না। ফ্রান্সিস বলল।

কোনোদিন হয়তো কোনো কারণে শুনতে পারবেন। সেটাই একমাত্র আশার আলো। আস্তাসো বলল।

ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল–দেখুন। আপনার চেয়ে অনেক বেশি দ্বীপ, দেশ আমি ঘুরেছি। নিষ্ঠুর হত্যাকারী প্রবঞ্চক মিথ্যেবাদী হীনমনা মানুষ অনেক দেখেছি। আমি মানুষের মুখ দেখে কথা শুনে সহজেই তার চরিত্র বুঝতে পারি। অবশ্য উদার মনের দয়ালু মানুষও দেখেছি। সংখ্যায় কম। তবে এঁরা আছেন বলেই মানুষের জীবন সুন্দর, পৃথিবী বাসযোগ্য। বলুন–তাই কি না? ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।

আপনার অনেক অভিজ্ঞতা আছে দেখছি। একটু অবাক হয়ে আস্তাসো বলল।

অভিজ্ঞতা থেকে বলছি–উজির ইয়েপুদা ক্ষমতালোভী, অর্থপিশাচ। ও যে কেন খলিফা হাকিমকে মেরে ফেলেনি সেটাই ঠিক বুঝতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে পালাবার জন্যে তো আপনাকে ঐ পথটা খুঁজে বের করতে হবে এবং ছক কষতে হবে। আস্তাসো বলল।

অবশ্যই। খোলা আকাশের নীচে তো কম রাত কাটেনি। দেখেছি–তারার আলো খুব অস্পষ্ট হলেও চোখের সামনে অনেক কিছু দেখা যায়। খোঁজ পাবোই। ফ্রান্সিস বলল।

এক কাজ করুন না। আর তেরো দিন পরে পূর্ণিমা পাবেন। আস্তাসো বলল।

এত নিশ্চিত হয়ে বলছেন? ফ্রান্সিস বলল।

দিনরাত তো ওপরের ঝুঁকে পড়া গাছের ডালপাতার মধ্যে দিয়ে সূর্য-চাঁদের আকাশ দেখে হিসেব রাখতে ভালোবাসি। সময়ও বেশ কাটে। আস্তাসো বলল।

আবার জলঝড়ের আকাশও দেখতে হয়। ফ্রান্সিস একটু হাসল।

তখন পাথুরে মেঝেতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকি। গায়ের ভেজা পোশাক গায়েই শুকোয়। আস্তাসোও অন্ধকারে হাসল।

আস্তাসো আমার অতদিন অপেক্ষা করবার মতো সময় নেই। যত দ্রুত পারি। পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

কী আর বলব? আস্তাসো উঠে চলে গেল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। চোখ বুজল। যাক একটা ক্ষীণ আশার রেখা দেখা যাচ্ছে। কাল রাতের অন্ধকারে কাজে নামতে হবে। দুপুরের কড়া রোদে তেতে ওঠা পাথরের মেঝে যেমন গরম রাতে তেমনি ঠাণ্ডা। ফ্রান্সিস কোমরে ফেট্টির কাপড়টা খুলে গায়ে যতটা পারল জড়াল।

পরের দিন সকালে শাঙ্কো জিগ্যেস করল–আস্তাসোর সঙ্গে কথা হল? ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল। তারপর সব কথা বলল।

তাহলে তো একবার চেষ্টা করতে হয়। শাঙ্কো বলল।

আজ রাতের অন্ধকারে খোঁজ চালাতে হবে। কতদিন এখানে পচে মরব? ফ্রান্সিস বলল।

আমিও থাকব। শাঙ্কো বলল।

না। আমি একাই দেখব। তোমরা কয়েকজন নীচে হাঁটু মুড়ে বসে তৈরি থাকবে। যদি হাত ফসকে পড়ে যাই তোমরা আমাকে ধরবে। খুব সাবধানে আগে পাঁচজন আছড়ে পড়ে মারা গেছে ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে ফ্রান্সিস দরকার নেই এই ঝুঁকি নেওয়ার। শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল।

না শাঙ্কো। একটা চেষ্টা করতেই হবে তোমরা আমাকে ধরে ফেলতে পারবে না? ফ্রান্সিস বলল।

এটা কী বলছ? তোমাকে বাঁচাতে আমরা মরতে রাজি। এটা কি নতুন করে বলতে হবে! শাঙ্কো অভিমানের সুরে বলল।

ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে শাঙ্কোর হাত ধরল। চাপ দিয়ে হেসে বলল–তাই তো আমি এত দুঃসাহসী হতে পেরেছি।

সন্ধে থেকে রাত। কিছুক্ষণ পরে প্রহরী আর রাঁধুনি রাতের খাবার নিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা নিঃশব্দে খেয়ে নিল। প্রহরীরা চলে গেল। শাঙ্কো অন্ধকারে বিনোলাদের কাছে এল। ফ্রান্সিসের রাতের অভিযানের কথা বলল। ওদের কী করতে হবে সেসবও বলল। তারপর ফ্রান্সিসের পাশে এসে শুয়ে পড়ল।

রাত গভীর হল। ভাইকিংরা কেউ ঘুমোল না। একসময় ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উঠে চাপাস্বরে ডাকল, শাঙ্কো। শাঙ্কোও আস্তে আস্তে উঠে পড়ল। চাপাস্বরে ডাক হলেও তা শুনে বন্ধুরাও আস্তে আস্তে উঠে বসল। ফ্রান্সিস মশালের আলোয় গরাদ দিয়ে দেখল দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। অন্য দুজন একটা ছোট পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসে আছে। বোধহয় তন্দ্রাচ্ছন্ন। প্রহরীদের সংখ্যা বেড়েছে। তবু এই সুযোগ ছাড়া হবে না। শাঙ্কোকে মৃদুস্বরে বলল-যাও, আস্তাসোকে নিঃশব্দে নিয়ে এসো। মাথা নিচু করে যাবে আসবে।

অন্ধকারে শাঙ্কো আস্তাসোকে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল, আস্তাসো, সেই। ওপরে ওঠার জায়গাটা দেখিয়ে দাও তো।

তাহলে উঠবেন? আস্তাসো একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল।

আমার সংকল্প বড় দৃঢ়, আস্তাসো। মাথা নিচু করে চলো৷ ফ্রান্সিস বলল।

আস্তাসো আর কিছু বলল না। প্রায় হামা দিয়ে সে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ভেতরের দিকে গেল। অন্ধকারে একটা জায়গায় এল। পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসও এল। অন্ধকারে আস্তাসো উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে একটা ওঁচানো পাথরের মাথায় হাত দিয়ে বলল এই পাথরটা ধরে উঠতে হবে। নীচে একটা খোদল আছে। ওখানে পা চেপে উঠুন।

ফ্রান্সিস হাত বুলিয়ে খোদলটা পেল। ও পায়ের চাপে উঠে ওঁচানো পাথরটা ধরে পাহাড়ের গায়ে বুক চেপে উঠতে লাগল। ততক্ষণে শাঙ্কোরা চার-পাঁচজন ঠিক নীচে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে। ফ্রান্সিস হাত দিয়ে খুঁজে খুঁজে আর একটা বেশ উঁচিয়ে থাকা পাথর পেল। ওটা ধরে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ের পাথরে বুক চেপে চেপে শরীরের ভর রেখে রেখে সেই সঙ্গে শরীরের ভারসাম্য রেখে রেখে উঠতে ভাবল, সেই দুঃসাহসী যুবকটি কত রাত জেগে প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে এই পথটা বের করতে পেরেছে। হয়ত পাথর সরিয়ে ঘষে ঘষে এই পথ করেছে। সেই পাঁচ মৃত বন্দী কী কষ্ট করেই না উঠেছিল।

ফ্রান্সিস একটু থেমে দম নিল। হাঁপ ধরা ভাবটা একটু কমল। ওপরে তাকিয়ে তারার আলোয় দেখল ঝুঁকে পড়া কাটা গাছের কাণ্ডের অনেকটা আবছা দেখা যাচ্ছে। তখনও ওখানে পৌঁছতে হাত পাঁচেক উঠতে হবে। ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে একটা ওঁচানো পাথর পেল ওপরে ডানদিকে। পাথরটার পাশেই হাতে ঠেকল একটা লম্বাটে মোটা দড়ির মতো। বুঝল, গাছটার শেকড় নেমে এসেছে। শেকড়টা আস্তে টেনে দেখল বেশ শক্ত। ভাবল, এই শেকড়ের সবটা টেনে বের করতে পারলে বাকি পাঁচ হাত পার হয়ে অনায়াসে কাটা কাণ্ডটা ধরা যাবে। অত সতর্ক ঠান্ডা মাথার ফ্রান্সিসও মুক্তির আনন্দে ভুল করে বসল। শেকড়টা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল। শেকড় বেশ কিছুটা বেরিয়ে এল সত্যি, কিন্তু ওঁচানো পাথরটা খুলে এসে পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে জোরে গড়গড় শব্দ তুলে পাথরটা গিয়ে পড়ল ঘুমন্ত কোনো বন্দীর ওপর। মুর যুবকটি ঘুম ভেঙে চিৎকার করে উঠল–মাথাটা গেল! ও-ও মাথাটা গেল! মুহূর্তে ফ্রান্সিস হাত-পা ছেড়ে দিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নেমে এল। পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দে সচকিত বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত ফ্রান্সিসকে হাত বাড়িয়ে আটকাল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল–শুয়ে পড়ো। ওদিকে মুর যুবকটিও চাঁচামেচি শুরু করেছে। অনেক বন্দীই ততক্ষণে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। একটু পরেই প্রহরীরা গরাদের কাছে ছুটে এল! একজন গলা চড়িয়ে বলল–ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়েছে। একজনের মাথায় পড়েছে। পাথর গড়িয়ে পড়া দেখিনি কোনোদিন।

ও। ঠিক আছে। শুয়ে পড়ো৷ প্রহরীটি বলল।

তোমাদের বৈদ্যিকে ডাকো।

বৈদ্যি নয়। হেকিম। হেকিম তোমাদের জন্যে রাত জেগে বসে আছে না? প্রহরী বলল।

খুব লেগেছে। শাঙ্কো বলল।

ঠিক আছে। কাল সকালে দেখা যাবে। প্রহরী সরে গেল।

শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এসে বলল–প্রহরীদের বললাম। কানেই নিল না।

ওরা এরকমই। শুধু হুকুম তামিল করতে পারে আর বন্দীকে পালাতে দেখলে নির্দ্বিধায় হত্যা করতে জানে।

তখনই আস্তানো ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–কেমন আছেন?

মনটা ভালো নেই। একজন নিরীহ মানুষকে আহত করলাম। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

আপনি তো ইচ্ছে করে পাথর ছুঁড়ে মারেননি। এ তো দুর্ঘটনা। নিজেকে দোষী মনে করবেন না।

ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল–যাও, আহত লোকটিকে দেখে এসো।

শাঙ্কো তাড়াতাড়ি সেই মুর যুবকটির কাছে এল। অন্ধকারে মাথায় হাত বুলিয়ে দেখে বুঝল ফেটে যায়নি। ও তাড়াতাড়ি ওর কোমরবন্ধনী ছিঁড়ে যুবকটির মাথায় বেশ শক্ত করে বেঁধে দিল। যুবকটি একটু আরাম পেল। গোঙানি বন্ধ হল।

সকালে শাঙ্কো গরাদের সামনে গিয়ে তাগাদা দিল। কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলা হল। লম্বাটে, রোগা, সাদা দাড়ি-গোঁফ-ওয়ালা তালিমারা ঝোলা কাঁধে হেকিম ঢুকল। শাঙ্কো হেকিমকে আহত যুবকটির কাছে নিয়ে এল। ও ফেট্টি খুলে ফেলল। আস্তে ক্ষত জায়গাটার চারপাশে চাপ দিয়ে দেখল। চোখ দেখল। তারপর শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে আরবি শব্দ মেশানো পোর্তুগীজ ভাষায় বলল–ফাটেনি। সেরে যাবে। বলে ঝোলা থেকে বোয়াম বের করল। ভেন-এর মতোই দু’হাতে একটা কালো দলামতো নিল। ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। তারপর হাতের তালুতে অন্য বোয়াম থেকে কী নিয়ে চেপে চেপে ঘুরিয়ে কয়েকটা বড়ি বানাল। বোয়াম ঝোলায় ভরে উঠে দাঁড়াল। বলল– ভয় নেই। চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। হেকিম চলে গেল। শাঙ্কো যুবকটির পাশে বসে বলল–সব কথা তো ভাই বলা যাবে না। এটাকে দুর্ঘটনা বলেই মনে করো। কোনো অসুবিধে হলে আমাকে ডেকো। এখন শুয়ে বিশ্রাম করো।

শাঙ্কো ফ্রান্সিনের কাছে এল। কথাটা মনে হতেই বলল–তুমিও দেখিয়ে নিলে পারতে।

কী যে বল! ওরা অভিজ্ঞ বৈদ্যি। বুকে, কনুইয়ে, হাঁটুতে হাচড়ানোর দাগ থেকে সব বুঝে ফেলবে।

খুব কেটেছে? শাঙ্কো বলল।

ফ্রান্সিস বলল, দু-তিনটে জায়গায় পাথরের খোঁচায় বেশ কেটে গেছে। বুঝতে পারছি রক্ত বেরিয়ে এসেছে। বাকি জায়গা ছড়ে গেছে। ভীষণ জ্বালা করছে। কিন্তু আমার কোনো শব্দ করার উপায় নেই। প্রহরীদের কানে গেলে সন্দেহ করবে। একটু থেমে বলল–আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে না। একটা নিরীহ মানুষকে আহত করলাম।

এটা একটা দুর্ঘটনা। শাঙ্কো বলল।

ঘটিয়েছি তো আমি। যাক গে, তোমাদের কারো লাগেনি তো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

সে সামান্য। শাঙ্কো বলল।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। ফ্রান্সিস চুপ করে বসেছিল। পাথর গড়িয়ে পড়ার আগে ফ্রান্সিস আবছা একটা মোটা শেকড় দেখেছিল। শেকড়টা ধরতে চেয়েছিল তাড়াতাড়ি। বিপত্তি ঘটল। শেকড়টা কত লম্বা সেটাই দেখা হল না। অগত্যা দু’একদিন চুপ করে থাকতে হবে। পরে আবার উঠতে হবে।

এসময় একজন প্রহরী গরাদে মুখ চেপে গলা চড়িয়ে বলল–মহামান্য খলিফার দরবারে তোমাদের মধ্যে কে নাকি কী শুনিয়েছ। সে এগিয়ে এসো।

সিনাত্রা ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল–চলো তো ব্যাপারটা দেখি।

দুজনে গরাদের কাছে এলো। দেখল সেদিন দরবারে যে রোগামতন লোকটি মুখে মুখে কবিতা বলছিল সে দাঁড়িয়ে আছে। সিনাত্রাকে দেখে বলে উঠল, হ্যাঁ আপনি। শুনুন মহামান্য খলিফার আজ শরীর ভালো নেই। দরবারেও আসেননি। আজ রাতে মহামান্য খলিফার প্রাসাদেই গিজেলের এক মেহফিল হবে। সময়মতো মহামান্য খলিফার দুজন দেহরক্ষী আসবে। আপনাকে মেহফিলে নিয়ে যাবে। আবার পৌঁছে দেবে। আপনার গিজেল মহামান্য খলিফার খুব ভালো লেগেছে।

ওর নাম সিনাত্রা। খুব ভালো গান গায়। আমাদের দেশের ভেড়া-পালকদের গান ও জানে। ওর গলা খুব সুরেলা–ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে তো শুনতেই হবে। লোকটি বেশ উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল।

বুঝবেন না তো। ফ্রান্সিস বলল।

সুর তো বুঝব। পর্তুগীজ ভাষায় অর্থ বললে আরও ভালো লাগবে। ভেড়া পালকদের গান, মাটি-পাহাড়ের গান সরল সুন্দর। তাই কিনা? লোকটি হেসে বলল।

আপনার নামটা? ফ্রান্সিস বলল।

গরিবের নাম রামাদ্দি।

আপনি কবি?

আমি আর কী কবি! আমার কবিগুরু আবিদি রব্বাহি! কতো বছর আগেকার কবি! আজও বাজারে-ঘাটে-মাঠে লোকে সেইসব কবিতা সুর করে শোনায়। অনেক আরবী কবিতা তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। আমি তার দীন ভক্ত। রামাদ্দি হেসে বলল।

ফ্রান্সিস বলল–দেখুন রামাদ্দি, আমরা এখানে বড়ো কষ্টে আছি। আপনি যদি

ফ্রান্সিসকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই একটু যেন ভীত স্বরে রামাদ্দি বলে উঠল–এসব মান্যবর ইয়েপুদার হুকুম। এসব ব্যাপার আমাকে কিছু বলবেন না। আমি মুখে মুখে গিজেল বানাই, মেহফিলে বলি–ব্যস! এতেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করি।

ফ্রান্সিস বুঝল রামাদ্দিকে বিরক্ত করা উচিত হবে না।

রামাদ্দি এবার একটু দুঃখের সঙ্গে বলল–আমার কবিগুরু দরবারের গিজেল শুনিয়ে প্রচুর ধনসম্পদ পেয়েছিলেন। কিন্তু কী যে হল, তার শেষ জীবনটা স্বেচ্ছানির্বাসনে কেটেছে। যখন তার কবিখ্যাতি দেশকাল ছাড়িয়ে গেছে তখন এক গভীর রাতে সব ধনসম্পত্তি নিয়ে আর এক আবাল্যবন্ধু আবু হামিদকে সঙ্গে নিয়ে ঐ যে প্রায় ভেঙে পড়া দুর্গা দেখছেন তারই একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর তার ও আবু হামিদের যে কী হল কেউ জানে না।

আর তার ধনসম্পদ? ফ্রান্সিস সাগ্রহে জিগ্যেস করল।

নিখোঁজ। কেউ জানে না কোথায় গেল সেই ধনসম্পদ। রামাদ্দি বলল।

একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে। পরে আপনার কাছ থেকে যতটা আপনি জানেন শুনব। সিনাত্রা যাবে, সানন্দে যাবে। এ তো কত সম্মানের ব্যাপার।

তাহলে চলি।

রামাদ্দি চলে গেল। কেমন এক আত্মভোলা চলার ভঙ্গি। একবার পাহাড়ের দিকে তাকাচ্ছে, একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। ফ্রান্সিস অনেকক্ষণ রামাদ্দির দিকে তাকিয়ে রইল।

রামাদ্দি সত্যিই কবি। অন্যরকম মানুষ। সিনাত্রা মৃদুস্বরে বলল।

ফ্রান্সিস বলল–সিনাত্রা, এসো কথা আছে।

ভেতরে ঢুকে দুজনে বসল। ফ্রান্সিস বলল–তুমি তো যাবে, যেভাবে হোক খলিফাকে বলবে আমরা বন্দী হয়ে পড়ে আছি। খুব কষ্ট আমাদের। আমাদের মুক্তি দিন।

ঠিক আছে। সুযোগ পেলেই বলব।

ফ্রান্সিস সরে এসে শুয়ে পড়ল।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হল। কিছুক্ষণ পরে গরাদের পাশে মশাল জ্বালানো হল। প্রহরীর সংখ্যাও বাড়ল। তখনই খলিফার দুই দেহরক্ষী এল। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা। গায়ে অন্যরকম জমকালো পোশাক। মাথায় শিরস্ত্রাণ। সিনাত্রা যে পোশাক পরেছিল, সেটা পরেই প্রহরীর সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছে, ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–যা বলেছিলাম। সিনাত্রা মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল। দেহরক্ষীদের সঙ্গে চলল।

গরাদ ধরে ফ্রান্সিস তাকিয়ে রইল। একটু আশান্বিত হল। হয়তো খলিফা এসব জানলে ওদের মুক্তি দিতে পারেন।

বেশ রাতে সিনাত্রা ফিরে এল। হাসিমুখে ফ্রান্সিসদের খলিফার দেওয়া পারিতোষিক নতুন সুন্দর পোশাক, পাঁচটা স্বর্ণমুদ্রা দেখাল।

ঠিক আছে। খলিফা হাকিম গুণীদের সম্মান দিতে জানেন। এবার আসল কথাটা বলো। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস, কড়া পাহারায় নিয়ে গেছে আমাকে। রক্ষীরা যেতে যেতে বলেছে পথে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। যে বিরাট ঘরটায় কবিগানের আসর বসেছিল সেখানে বেশ লোকজন জড়ো হয়েছিল। মুখে মুখে কবিতা বলা, গানটান চলল। শ্রোতারা সবাই। উৎসাহ দিয়ে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছে। কিন্তু উজিরের সেদিকে কোনো নজর নেই। উৎসাহও নেই। সে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। আমি তো খলিফার কাছে যাবারই সুযোগ পাইনি। ফেরার পথেও কড়া পাহারা। সিনাত্রা বলল।

হুঁ। উজির ইয়েপুদা ধুরন্ধর লোক। যাগে, প্রাসাদ কেমন দেখলে?

অপূর্ব। পাথরের থামে কত কারুকাজ। ছাদে, দেওয়ালে কী সুন্দর ভাস্কর্য। রঙিন ছবি আঁশ। কবি রামাদ্দি বলল খলিফা নিজেও নাকি অবসর সময়ে এসবে হাত লাগিয়েছেন।

হুঁ। খলিফা হাকিম শিল্পী মানুষ। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, ক্রেন ঠিকই বলেছিল।

জানো ফ্রান্সিস, রামাদ্দি খলিফা হাকিমের সভাকবি।

বলো কী! ফ্রান্সিস বেশ অবাক হয়ে বলল।

হ্যাঁ। অথচ কী বিনয়ী। কী ভদ্র! কোনো গর্ব নেই। ফিরে আসার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কত প্রশংসা করল। বলল আল্লার কাছে প্রার্থনা করেছি তিনি যেন আপনাকে দীর্ঘজীবন দান করেন। আর একটা কথা, আমি একটা কবিতার পুঁথি লিখেছি, সেটা আপনাকে সসম্মানে উপহার দেব। শুনে আমি তো অবাক।

সত্যি, রামাদ্দি অন্যরকম মানুষ। ফ্রান্সিস বলল।

.

পরদিন সকালে খাবার খাওয়া সবে শেষ হয়েছে, একজন প্রহরী গরাদের কাছ এ থেকে গলা বাড়িয়ে বলল–সিনাত্রা কে? এদিকে এসো।

সিনাত্রা উঠে গরাদের কাছে গেল। ফ্রান্সিস, শাঙ্কোও উঠে এল। গরাদের কাছে এসে দেখল রামাদ্দি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরা কালো সুতোয় বাঁধা পার্চমেন্ট, কাগজের একটা পুঁথি। সিনাত্রার দিকে পুঁথিটা বাড়িয়ে ধরে বলল কবিবন্ধু, আপনার জন্য এই সামান্য প্রীতি উপহার কাল সারারাত জেগে পর্তুগীজ ভাষায় অনুবাদ করেছি। আপনার বুঝতে সুবিধে হবে।

ভালো করেছেন। আরবী ভাষা তো সিনাত্রা বুঝত না। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

জানেন, পর্তুগীজ ভাষায় অনেক আরবী শব্দ মিশে গেছে। রামাদ্দি বলল।

সবই বুঝলাম। কিন্তু এই নরকে থাকলে আপনার কবিবন্ধু আর কতদিন বেঁচে থাকবেন? ফ্রান্সিস বলল।

রামাদ্দির মুখ একটু গম্ভীর হল। বলল–বলেছি তো এসব ব্যাপার থেকে আমি দূরে থাকি। আমার মনের শান্তি আমি নষ্ট হতে দিতে রাজি নই।

কিন্তু মাননীয় খলিফাকে যদি আমাদের এই দুঃখকষ্টের কথা জানানো হয়–

কোন লাভ নেই। এসব ব্যাপারে মহামান্য খলিফা উদাসীন। তাই তো দেশের সব ধর্মের সব মানুষ মহামান্য খলিফাকে এত ভক্তি করে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। শুনলে আশ্চর্য হবেন মহামান্য খলিফা যতদিন এখানে শাসনক্ষমতায় আছেন কোনো শত্রুর দ্বারা এদেশ আক্রান্ত হয়নি। তাঁর দরবারে বিচার-টিচার হয়, সব মানুষ তো লোভ ক্রোধ হিংসা থেকে মুক্ত নয়; কিন্তু অপরাধ খুব অল্পই হয় এখানে। রামাদ্দি বলল।

আচ্ছা, আপনি কবি আবিদি রব্বাহির নিখোঁজ ধনভাণ্ডারের কথা বলছিলেন। আমরা এরকম বহুদিন আগের নিখোঁজ গুপ্তধন উদ্ধার করেছি চিন্তা করে বুদ্ধি খাটিয়ে। যদি মহামান্য হাকিম আমাদের সেই সুযোগ দেন তবে

কোনও লাভ নেই। ধনসম্পদের প্রতি মহামান্য খলিফার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। রামাদ্দি মাথা নেড়ে বলল।

তবে মান্যবর উজিরকেই বলুন। ফ্রান্সিস বলল।

অত কথা আমি বলতে পারব না। আমি শুধু মান্যবর উজিরকে বলতে পারি ভাইকিংরা আপনাকে কিছু বলতে চান। এর বেশি আমি কিছু বলতে পারব না। রামাদ্দি বলল।

বেশ। তাই বলুন। কিন্তু শুধু এটুকু বললে উনি ভাববেন আমরা মুক্তির জন্য অনুরোধ করব। উনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে কোনো আগ্রহই বোধ করবেন না। ফ্রান্সিস বলল।

ঠিক আছে। আমি বলব একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। এর বেশি একটি কথাও বলব না। রামাদ্দি বলল।

ওতেই হবে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ফ্রান্সিস বলল।

রামাদ্দি হেসে হাত বাড়িয়ে সিনাত্রার হাত ধরল। বলল–চলি কবিবন্ধু। তারপর রামাদ্দি আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে রাস্তায় উঠল। সেই উদাস ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল।

অদ্ভুত মানুষ। ফ্রান্সিস অস্ফুট স্বরে বলল।

যাই বল ফ্রান্সিস–এরকম কবিতা-পাগল মানুষ আমি মাত্র একজনকে দেখেছি। সেই পাগল কবিকেই দেখেছিলাম। সিনাত্রা বলল।

কবিতার পুঁথিটার চামড়ার মলাটে আরবী ভাষায় নাম লেখা। নীচে পর্তুগীজ ভাষায় অর্থটা লেখা-বিষাদ। ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন নাম কেন? কী বেদনা কবি রামাদ্দির?

বিকেলের দিকে গরাদের কাছ থেকে একজন প্রহরীর হাঁক শোনা গেল–মান্যবর উজির এসেছেন। ভাইকিংরা এখানে এসো। ফ্রান্সিস পাথুরে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল। উঠে তাড়াতাড়ি উজিরের কাছে এল। দেখল উজির ইয়েপুদা দাঁড়িয়ে। প্রহরীরা সন্ত্রস্ত। ইয়েপুদা বলল, তুমিই তো দলনেতা?

হ্যাঁ মান্যবর। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে ইয়েপুদা বলল কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে শুনি?

সে অনেক কথা। শুধু এইটুকু বলি যে আগে আমরা অনেক গুপ্তভাণ্ডার আবিষ্কার করেছি ছড়া নকশা পাণ্ডুলিপি এসবের সাহায্যে। সভাকবি রামাদ্দির কাছে শুনলাম অনেকদিন আগে আপনাদের বিখ্যাত কবি আবিদি রব্বাহির ঐশ্বর্য সম্পদ নিখোঁজ হয়ে গেছে। উনি নাকি ঐ আধভাঙা দুর্গের একটি কুঠুরিতে তার এক দীর্ঘদিনের সহচর আবু হামিদকে নিয়ে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।

হুঁ। ঠিকই শুনেছো। তারপর বলো। উজির বলল।

আপনি যদি দয়া করে অনুমতি দেন তবে আমরা কয়েকজন মিলে সেই ঐশ্বর্যভাণ্ডার উদ্ধার করতে প্রস্তুত। ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে উজির জোরে হেসে উঠল। বলল– জানো কয়েকজন শাসক জ্ঞানী পণ্ডিতদের নিয়ে ঐ স্বর্ণভাণ্ডার দীর্ঘদিন খুঁজেছিলেন। আমিও দরবারের দুই পণ্ডিতকে নিয়ে কম চেষ্টা করিনি। আর শোনামাত্র তুমি তা উদ্ধার করবে? পাগলের প্রলাপ।

ঠিক আছে। আপনি আমাদের অনুমতি দিন। ফ্রান্সিস বলল।

তার মানে পালাবার ফিকির। উজির সেঁতো হাসি হাসল।

বন্ধুদের জন্য আমরা জীবন বিসর্জন দিয়ে থাকি। তাদের ফেলে রেখে হাজার প্রলোভনেও আমরা সরে পড়ি না। আমাদের এটুকু বিশ্বাস করতে পারেন। ফ্রান্সিস বলল।

ঠিক আছে। এবার আসল কথাটা বলো তো। সেই ঐশ্বর্য ধরো উদ্ধার করলে। তারপরে? উজির মৃদু হেসে জানতে চাইল।

মহামান্য খলিফা হাকিমকে সব ঐশ্বর্য সম্পদ দিয়ে দেব। আমরা একটা স্বর্ণমুদ্রাও নেব না। ফ্রান্সিস বলল।

আশ্চর্য! তোমরা এত নির্লোভ? উজির একটু অবাক হয়ে বলল।

হ্যাঁ মান্যবর। যে সম্পদ কষ্ট করে ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে সঞ্চিত করিনি, তার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র লোভ নেই।

বিশ্বাস হল না। উজির মাথা নাড়ল।

আপনিই প্রথম নন। এর আগেও অনেকেই আমাদের বিশ্বাস করেনি। তারপরে গুপ্ত ধনভাণ্ডার যখন উদ্ধার করেছি, তাঁরা উল্লসিত হয়ে অনেকে অর্ধেক ধনসম্পদ আমাদের দিতে চেয়েছেন। আমরা একটা সাধারণ সোনার আংটিও নিইনি। আর যদি আমাদের বিশ্বাস না করেন তবে মহাকবির ঐ স্বর্ণভাণ্ডার চিরদিনের জন্য নিখোঁজই হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

বেশ। তোমার আর কী বলবার আছে? উজির বলল।

আর দুটো কথা। এক সভাকবি রামাদ্দি আমাদের সঙ্গী হবেন। কারণ আরবী ভাষা আমরা জানি না। কবি রামাদ্দি নানাভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন। ফ্রান্সিস বলল।

হুঁ। আর একটা? উজির জানতে চাইল।

যদি আমরা ঐ নিখোঁজ সম্পদ উদ্ধার করতে পারি তাহলে আমাদের সবাইকে মুক্তি দিতে হবে। ফ্রান্সিস বেশ জোর দিয়ে বলল।

ভেবে দেখি। উজির বলল।

আমারও তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে চাই। কাজেই কাল সকালের মধ্যে আমাদের খবর পাঠান। আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে পারব না। ফ্রান্সিস বলল।

আমরাও একটা শর্ত আছে। উজির বলল।

বলুন।

ঐ সম্পদ উদ্ধার হলে সব তোমাদের গোপন রাখতে হবে। কাউকে বলা চলবে না। উজির আস্তে বলল যাতে প্রহরীরা শুনতে না পারে।

কিন্তু কবি রামাদ্দি তো আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। ফ্রান্সিস বলল।

রামাদ্দি? ওটা উটের মতোই বোকা। উজির বিরক্তির সঙ্গে বলল।

তাহলে আমাদের নজরে রাখতে কেউ কি থাকবে না? ফ্রান্সিস বলল।

দরকার নেই। আমার লোকজনকে ফাঁকি দিতে পারবে না।

উজির ঘুরে দাঁড়াল। প্রহরীরা সার বেঁধে দাঁড়াল। উজির চলে গেল।

ফ্রান্সিসের বুঝতে অসুবিধা হল না উজিরের লক্ষ্য কী। খলিফাকে অন্ধকারে রেখে সব সম্পদ গোপনে আত্মসাৎ করবে। উজির আগে থেকে অনেকদূর ভেবে রেখেছে। উজির একই সঙ্গে বুদ্ধিমান আর ধূর্ত। এটা বুঝল। উজির চলে গেল ফ্রান্সিসদের সুযোগ দেওয়া যাবে কিনা এসব ভাবতে ভাবতে। রাতে চোখ বুজে ভীষণ ঠাণ্ডা পাথুরে মেঝেয় শুয়ে শুয়ে ফ্রান্সিস ভাবছিল উজির ওর প্রস্তাবে রাজি হবে কিনা। ও বুঝে নিয়েছে উজিরের সঙ্গে কথায় আর ব্যবহারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। উজির সন্দেহবাতিক। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই উজির বেঁকে দাঁড়াবে। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। মৃদুস্বরে বলল-ঘুমোওনি?

অনেক চিন্তা শাঙ্কো, ঘুম কী আসে! ফ্রান্সিস বলল।

কী ভাবছো? শাঙ্কো জিগ্যেস করল।

আকাশ-পাতাল। মৃদু হেসে ফ্রান্সিস বলল।

সাবধান ফ্রান্সিস। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে—

মায়েদের মতো উপদেশ দিও না তো। শোনো, মনে হয় কাল সকালেই জানতে পারব উজির কী সিদ্ধান্ত নিল। আর একটা কথা, উজিরের সামনে বেস কিছু বলে কি বসো না। তোমরা চুপ করে থাকবে, যা কথা বলার আমি বলব।

শাঙ্কোর একটু অভিমান হল। কিন্তু কিছু বলল না। পাশ ফিরে শুল।

সকালে গরাদে মুখ চেপে একজন প্রহরী হেঁড়ে গলায় বলল–রামাদ্দি এসেছেন। ফ্রান্সিস কে? এখানে এসো।

ফ্রান্সিস তখন বসেছিল। বেশ দ্রুতই গরাদের কাছে এল। দেখল রামাদ্দি দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি নেই। ফ্রান্সিসকে দেখে বলে উঠল–এ কী ঝামেলায় ফেললেন আমাকে?

কোনও ঝামেলায় আপনাকে ফেলা হবে না। এবার বলুন মাননীয় উজির কী বললেন? ফ্রান্সিস সাগ্রহে বলে উঠল।

আপনাদের মধ্যে নাকি কী সব শর্তটর্ত হয়েছে। যাকগে, ওসব নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। মাননীয় উজির বললেন, আপনারা কী সব খোঁজাখুঁজি করবেন, আমাকে আপনাদের সঙ্গে থাকতে হবে অর্থাৎ সাহায্য করতে হবে।

হ্যাঁ, আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমাদের কাজ আমরা করব। প্রয়োজনে আপনার কাছে নানা বিষয় জানতে চাইব। ব্যস। আপনাকে একটা আঙুলও নাড়তে হবে না। ফ্রান্সিস বলল।

কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। রামাদ্দি দ্বিধান্বিত সুরে বলল।

সময় আসুক, সব জানবেন–বুঝবেন–দেখবেন। আমরা দেরি করব না। তাড়াতাড়ি দেশে ফিরব। আমরা আজ এখনই কাজে নামব।

বেশ, চলুন। কিন্তু উজিরের হুকুম, মাত্র দু’জন ছাড়া পাবেন।

মুশকিল হল। ঠিক আছে। প্রথমে দু’জনই থাকব। পরে আরও লোকজন লাগবে কিনা দেখি। ফ্রান্সিস বলল।

কোথায় যাবেন? রামাদ্দি জিগ্যেস করল।

ঐ আধভাঙা দুর্গে।

ওটা তো একটা পরিত্যক্ত দুর্গ। কখন ভেঙে পড়ে। রামাদ্দির আবার দ্বিধা।

বন্ধু রামাদ্দি, দুর্গের গাঁথনি অত পলকা হয় না। থাকগে, আমরা দুজন এখন বেরোতে চাই।

রামাদ্দি আর কথা না বাড়িয়ে প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে বলল–মাননীয় উজিরের হুকুম দু’জন বন্দীকে ছেড়ে দিতে হবে। আমার সঙ্গে যাবে ওরা।

একজন প্রহরী এগিয়ে এল। গরাদের তালা খুলে দিল। শাঙ্কোকে নিয়ে ফ্রান্সিস বেরিয়ে এল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল উজ্জ্বল রোদে ভরা এক সুন্দর সকাল। কিন্তু এই সৌন্দর্য দেখার বা মুগ্ধ হবার সময় কোথায়? সামনে তো অনিশ্চিত ঘটনার অন্ধকার। সেই অন্ধকারে খুঁজে বের করতে হবে মুক্তির আলো।

প্রথমে কোথায় যাবেন? রামাদ্দি জানতে চাইল।

প্রথমে যাব ঐ ভাঙা দুর্গে। কারণ, ওখানেই কোনও একটা কক্ষে কেটেছে কবি আবিদির শেষ নির্বাসিত জীবন। তাই কিনা? ফ্রান্সিস বলল।

বেশ, চলুন। রামাদ্দি হাঁটতে শুরু করল।

পাথুরে পথ দিয়ে কিছুদূর এসে একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে রামাদ্দি আঙুল তুলে ভাঙা দুর্গা দেখাল। কালচে শক্ত পাথরে গাঁথা দুর্গ যেমন হয়। দুর্গে যাবার পথটা একসময় নিশ্চয়ই বড় ছিল। পাথরে বাঁধানো ছিল। এখন পরিত্যক্ত। ভাঙা পাথর ছড়িয়ে আছে। তার ওপর দিয়ে দেখেশুনে হেঁটে চলল তিনজনে। এখানে-ওখানে বুনো ঝোঁপঝাড়। পাথরের ফঁক-ফোকরে সবুজ ঘাস গজিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা প্রবেশদ্বারের কাছে এল। এখানে-ওখানে ভেঙে পড়লেও অর্ধচন্দ্রের মতো দেউড়িটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। দেউড়ি পার হয়ে তিনজনে ভেতরে ঢুকল। উজ্জ্বল রোদে সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুর্গ ঘিরে আধভাঙা প্রাকার দেখা গেল পেছনে। তাও সবটা দেখা গেল না। কারণ, মূল দুর্গের প্রায় গা ঘেঁষে শুরু হয়েছে বিরাট বিরাট গাছের জঙ্গল। খুব ঘন জঙ্গল নয়। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে নানারকম গাছ। বোঝাই যাচ্ছে অনেক বছর ধরে এই গাছগুলো গজিয়েছে। বড় হয়েছে। বিনা যত্নেই।

রামাদ্দি, কবি আবিদি কোন কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

এখানেই তো রহস্য। কেউ জানত না। তখন দুর্গা ছিল প্রায় জনশূন্য। শোনা যায়, তৎকালীন মুর শাসকের কিছু সৈন্য, কর্মচারী নাকি বিভিন্ন কক্ষে থাকত। তারা জানতই না যে অত বিখ্যাত একজন কবি সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতেন না। একমাত্র আবু হামিদ ছিল তার নিত্যসঙ্গী। শোনা যায়, আবু হামিদ ছিল নিরক্ষর। কবিই তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। প্রভুভক্ত আবু হামিদের কোনও পিছুটান ছিল না। ঘরসংসার বলেও কিছু ছিল না। সে নাকি কবিকে খাদ্য-পানীয় এনে দিত। তাও নাকি গভীর রাতে। রামাদ্দি বলল।

কিন্তু যেখান থেকে খাদ্য-পানীয় আনত তারা তো জানত। ফ্রান্সিস বলল।

মাত্র একজন খোঁড়া দোকানদারের কাছ থেকে আনত। আবু হামিদ নাকি অনেক মেতাশমেস মানে স্বর্ণমুদ্রা তাকে দিয়ে গেছিল। সেই খোঁড়া দোকানি কোনোদিন জানতেও পারেনি আবুহামিদ কে? জানতেও চায়নি কেন সে গভীর রাতে খাদ্য-পানীয় নিতে আসে। অত স্বর্ণমুদ্রা পেয়েই সে খুশি ছিল।

হুঁ, চলুন। যতখানি দেখা যায় আগে দেখে নিই। ফ্রান্সিস বলল।

চলুন। রামাদ্দি ওপরে ওঠার ভাঙা সিঁড়িটা। দেখিয়ে বলল।

ভারসাম্য বজায় রেখে ওরা ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। এপাশে-ওপাশে কয়েকটা ভেঙে পড়া মেঝে দেখে বোঝা গেল সেখানে থাকবার ঘর ছিল। তারপর ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে ছোট বারান্দা মতো। তারপরেই ভাঙা মেঝের চিহ্ন। ওখান থেকে পেছনের প্রাকার পর্যন্ত বনজঙ্গল স্পষ্ট দেখা গেল। খুব মন দিয়ে চারপাশে তাকাতে তাকাতে ফ্রান্সিস বলল–এখানেও একটা ঘর ছিল। তবে মেঝেসুষ্ঠু ভেঙে পড়েছে। ওপরে তাকিয়ে খোলা আকাশ দেখল। এর পরে সিঁড়িটা অর্ধেক মতো উঠে একেবারে ভেঙে পড়েছে। আর ওপরে কিছু নেই। নীচের দিকে দেখল পাথরের পাটার। স্তূপ। ভাঙা-আস্ত মেশানো।

আর কিছু আস্ত নেই। রামাদ্দি বলল।

হ্যাঁ, চলুন।

তিনজনে নেমে আসতে লাগল। এবার ফ্রান্সিস লক্ষ করল একেবারে নীচে মোটামুটি আস্ত পাথুরে দেওয়ালে বন-জঙ্গলের দিকে একটা চৌকোনা ভাঙা ফোকর। ফ্রান্সিস ঐ ফোকরটার কাছে গেল। ফোকরটা ভালো করে দেখেটেখে বুঝল এখানে একটা জানলা ছিল। নীচে ভাঙা পাথরের স্থূপে দেখল একটা লোহার ডাণ্ডা কিছুটা উঁচিয়ে আছে। রামাদ্দির দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল–তাহলে এই দুর্গের জানলাগুলিতে লোহার গরাদ বসানো ছিল।

আস্ত দুর্গা-যারা দেখেছে তারা তো কেউ বেঁচে নেই যে বলবে জানলা ছিল কি না। তবে এব্রো উপত্যকার একটা খুব পুরোনো দুর্গে মোটা মোটা গরাদ বসানো জানলা দেখেছি। বেশির ভাগই অবশ্য ভাঙা। রামাদ্দি বলল। তারপর বলল–ফিরে চলুন। এই ভাঙা দুর্গে কেউ আসে না। এই দুর্গে জঙ্গলে বড় সাপের উপদ্রব। বিষধর সব সাপ।

তিনজনে সাবধানে নেমে এল আধভাঙা সিঁড়ি দিয়ে।

পেছনের বন-জঙ্গলটা একবার দেখে আসি। ফ্রান্সিস বলল।

রামাদ্দি আঁতকে উঠে বলল–মাথা খারাপ! সাপের আড্ডা ওখানে।

কী করে জানলেন?

বাঃ! ভাঙা দুর্গে তো অনেক সময় দামি ধনরত্ন গোপনে রাখা হয়। অন্তত পাঁচজন চোর সেই ধনরত্ন খুঁজতে এসে নাকি সাপের কামড়ে মারা গেছে। রামাদ্দি বলল।

রামাদ্দি ফ্রান্সিস হেসে বলল–ধনরত্ন যেটুকু ছিল তা আগেই লোপাট হয়ে। গিয়েছিল। মনে হয় ওরা রাতের অন্ধকারে এসেছিল বলেই সাপের মুখে পড়েছিল। এখন তো উজ্জ্বল রোদের দিন। চলুন, যতটা দেখা যায়।

রামাদ্দি বেজার হয়ে বলল, চলুন।

দুর্গের পাথুরে দেওয়ালে প্রায় গা লাগিয়ে জঙ্গল শুরু হয়েছে। ফ্রান্সিস একবার মাথা উঁচু করে যে ধসে-পড়া ঘর আর ভাঙা জানলাটা দেখেছিল সেটার বরাবর জঙ্গ লে ঢুকল। বেশ ঘন বন এদিকটায়। বনের নীচে এই দুপুরেও আবছা অন্ধকার। সাবধানে চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বেশ কিছুটা চলে আসতেই দেখল দুটো জোড়া খেজুর গাছ। গাছ দুটোর মধ্যে মাত্র হাতখানেক দুরত্ব।

তাহলে এসব জায়গায় খেজুর গাছও হয়? ফ্রান্সিস রামাদ্দিকে জিগ্যেস করল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। মরুভূমিতে হয় আর এখানে হবে না? খেজুর গাছ বাঁচেও অনেক বছর। রামাদ্দি বলল।

ফ্রান্সিস মুখ তুলে দেখল বেশ উঁচু গাছ দুটো। ছুঁচোলো পাতাগুলো অনেকটা ছড়ানো। খেজুরও হয়েছে। তবে পাকা নয়, কাঁচা।

এগুলো কেমন জাতের খেজুর গাছ? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে নিয়ে রামাদ্দি বলল, খুব ভালো জাতের খেজুর গাছ। এসব গাছের খেজুর খুব মিষ্টি হয়। এবার ফিরে চলুন। রামাদ্দি একটু বিরক্ত হয়েই বলল।

সাপের ভয়? তাই না? ফ্রান্সিস হেসে বলল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কখন দুটো-একটা ফোঁস করে ওঠে তার কি ঠিক আছে?

ঠিক আছে, চলুন। পরে না হয় আসা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

বন-জঙ্গল, ঝোঁপঝাড় ঠেলে তিনজন বেরিয়ে এল।

আর কিছু দেখার আছে? আমার তো মনে হয়

রামাদ্দিকে থামিয়ে ফ্রান্সিস বলল, দেখি ভেবে।

পাটা-ভাঙা, পাথর-ছড়ানো রাস্তাটা দিয়ে তিনজনে পাহাড়ি রাস্তাটায় উঠল। চলল সেই গিরিসংকটের দিকে। বেলা বেড়েছে। খিদেও পেয়েছে। রামাদ্দি দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, আমি তাহলে চলি?

কালকে সকালে আসবেন কিন্তু। ঐ দুর্গে যাব।

ঠিক আছে। বেশ ব্যাজার মুখে রামাদ্দি বলল। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেল।

ঘেরা জায়গার বন্দীশালায় আসতে বিনোলারা কয়েকজন এগিয়ে এল। শাঙ্কো ভাঙা দুর্গ দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগল।

.

রাতে ওপরের তারাজ্বলা কালো আকাশ আর ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস ভাবতে লাগল–হাতে সময় বেশি নেই। যত দ্রুত সম্ভব ঐ ধনৈশ্বর্যের ভাণ্ডার খুঁজে বের করতে হবে। মারিয়া, হ্যারি আর কতদিন ঐ বাড়িতে থাকতে পারবে? কিন্তু কোনও সূত্রই তো আজ পাওয়া গেল না।

পরের দিন সকালে রামাদ্দি এল। আবার তিনজন দুর্গের দিকে চলল। রামাদ্দির মুখে হাসি নেই। ফ্রান্সিস আড়চোখে ওর মুখ দেখে বুঝল, কবিতার ভাবনা ছেড়ে এইসব ধনৈশ্বর্যের সন্ধান ওর কবিস্বভাবের বিরোধী। কিন্তু উজিরের হুকুম। ও নিরুপায়।

ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পণে ওপরে উঠতে উঠতে ফ্রান্সিস ভাবল, প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে কোন ঘরে কবি আবিদি স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন। ফ্রান্সিস আবার সেই ধসে পড়া মেঝে আর ভাঙা জানলাটার কাছে এল। ভাঙা প্রায় চৌকোনা খোঁদলটা দিয়ে পেছনের বন-জঙ্গলের দিকে চেয়ে রইল। আবার সেই জোড়া খেজুর গাছ দুটো অন্য গাছগুলির মধ্যে দিয়ে বেশ দেখা যাচ্ছে। বোধহয় ছড়ানো থাকায় খেজুর গাছের পাতাগুলিও দেখা যাচ্ছে। এবার ফ্রান্সিস নীচে ভাঙা পাথরের পাটাগুলির দিকে তাকাল। ভালো করে হিসেব করে দেখল মেঝের পাথরের পাটাগুলি ভেঙে পড়লেও সব একেবারে নীচে পড়ে যায়নি। কারণ, নীচের ঘরের মেঝেটা অটুট আছে। সেখানেই ভাঙা পাথরের পাটাগুলি পড়েছে। কিছু লোকের সাহায্য পেলে সরানো যাবে। যদি ধরে নেওয়া যায় এখানে একটা ঘর ছিল তাহলে এই ঘরে যা কিছু ছিল, যেমন খাওয়ার বাসন-কোসন, জলের জায়গা, শোবার জন্য কাঠের কোনও আসবাব সবই চাপা পড়ে গেছে পাথরের পাটার তলায়। ফ্রান্সিস রামাদ্দিকে বলল, ঐ তলার পাথরের ভাঙা পাটাগুলি সরাতে হবে। আপনি উজিরকে গিয়ে বলুন আমাদের কিছু লোক লাগবে। আমরা মাত্র তিনজন ওসব সরাতে গেলে সাত-আটদিন লেগে যাবে।

কিন্তু ওসব সরিয়ে কী হবে? রামাদ্দি কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।

ঠিক আছে। আগে তো জায়গাটা পরিষ্কার করা হোক। ফ্রান্সিস বলল।

কী যে পাগলামি! রামাদ্দি বিরক্ত হয়ে বলল।

ফ্রান্সিস হেসে বলল, আমার পাগলামি বলেই ধরে নিন না। তারপর বলল, কাজটা আমি এখনই শুরু করতে চাই। দেশে ফিরব। খুব তাড়া আমাদের।

কিন্তু এখন উজিরের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তো উনি খেপে যাবেন। আপনাদের ছেড়ে চলে এলাম কেন তার জবাবদিহি তো করতে হবে। রামাদ্দি বলল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। উনি খুব বুদ্ধিমান মানুষ তো। ধরে নিতে পারেন এটা আমাদের দুজনের পালাবার ফিকির। ফ্রান্সিস বলল।

কী জানি! রামাদ্দি কথাটা ঠিক বুঝল না।

ফ্রান্সিস হেসে বলল, কাল থেকে এখানে আসা-যাওয়ার সময় পাগড়িপরা একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। উজিরের নজরদারিতে কোনও ফাঁক নেই। এক কাজ করুন–ঐ লোকটিকে বলুন এখানে এসে আমাদের নজরে রাখতে। সুবিধে পেলে আমরা পালিয়ে যেতে পারি একথাও বলবেন।

একটু ভেবে নিয়ে রামাদ্দি বলল, ঠিক আছে, যাচ্ছি। এসব ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি মিটে যায় ততই ভালো।

কথাটা বলে রামাদ্দি নীচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পরে সেই পাগড়িপরা লোকটি এল। কোনও কথা না বলে একটা লম্বা পাথরের পাটাতনে চুপ করে বসে রইল। ভাবভঙ্গি নির্বিকার।

রাজি হবে? শাঙ্কো দেশের ভাষায় মৃদুস্বরে বলল।

আলবৎ রাজি হবে! ধনৈশ্বর্য পাবে অথচ একটা আঙুল নাড়ার কষ্টও হবে না এ হয়? ফ্রান্সিসও দেশিয় ভাষায় বলল।

ফ্রান্সিস অপেক্ষা করতে লাগল। বেশ কিছু সময় গেল। রাস্তার দিকে পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে তোকজনের চলার শব্দ হল। একটু পরেই একদল যোদ্ধা উঠে এল। পেছনে রামাদ্দি।

নিন–লোকজন আনা হয়েছে। আপনার ইচ্ছে পূরণ করুন। একটু বিরক্তির সঙ্গেই রামাদ্দি বলল।

ফ্রান্সিস হেসে বলল–কবিরা বোধহয় একটু অভিমানী হয়। এবার রামাদ্দি হেসে বলল–সত্যি, এভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। মাফ চাইছি।

ফ্রান্সিস যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলল–নীচে যে ভাঙা পাটা পাথরের স্তূপ পড়ে আছে, ওগুলো সব হাতে হাতে ফেলে দিতে হবে।

যোদ্ধারা কিছুই বুঝল না কেন ঐ সব ধসে-পড়া ভাঙা পাথর তুলে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু যোদ্ধা তো। প্রশ্ন করতে ওরা অভ্যস্ত নয়। ওরা ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল। বন-জঙ্গলের দিকে পাথরের দেওয়ালটা ভেঙে গেলেও সবটা ভেঙে পড়েনি। ওরা পাথরের ভাঙা ও আস্ত পাটাগুলো তুলে সেই ভাঙা জায়গাটা দিয়ে বাইরে ফেলতে শুরু করল। নিস্তব্ধ জায়গাটায় পাথর ফেলার শব্দ শুরু হল। বেশ কিছু পাটা ফেলা হতেই পাথরের মধ্যে একটা কাঠের পায়া উঁচু হয়ে আছে দেখা গেল। সেখানকার পাথর ফেলে দিতেই একটা শোবার আসবাব দেখা গেল।

খুব সাধারণ আসবাব। ধুলো-কাদায় মাখামাখি। ফ্রান্সিস খুশির চোখে শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল, শাঙ্কো, এবার আমি নিশ্চিত। এর ওপরে একটা ঘর ছিল। কবি আবিদি সেই ঘরেই স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন।

ভাঙা দেওয়ালের দিকটায় দেখা গেল বেশ কয়েকটা ময়লা চামড়া মেশানো হলদেটে কাগজ। ফ্রান্সিস বলে উঠল, শাঙ্কো, যাও, খুব সাবধানে কাগজগুলো তুলে আনো। আর কাউকে হাত লাগাতে দিও না। শাঙ্কো খুব একটা বিস্মিত হল না। ফ্রান্সিসের অনেক বিস্ময়কর আবিষ্কারের প্রত্যক্ষদর্শী শাঙ্কো। ও একছুটে গিয়ে খুব সাবধানে কাগজগুলো তুলতে লাগল। তবুজীর্ণ পাতাগুলোর এখানে-ওখানে ছিঁড়ে গেল। রামাদ্দির বিস্ময়ের শেষ নেই। শাঙ্কো সব কটা কাগজ সাবধানে তুলে এনে ফ্রান্সিসের হাতে আস্তে আস্তে একটা একটা করে দিতে লাগল। প্রথমটায় খুব অস্পষ্ট কিছু লেখা দেখে ফ্রান্সিস বুঝল আরবি অক্ষর। ওর বোধগম্য নয়। তখনই বাইরে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা গেল। ফ্রান্সিস কোথাও কোথাও খসে পড়া পাতাগুলির একটা রামাদ্দির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল সাবধানে ধরুন। রামাদ্দি সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে পাতাগুলি নিতে লাগল।

পরে পড়বেন। সাবধানে, ঘেঁড়ে না যেন। ফ্রান্সিস মৃদু স্বরে বলল।

রামাদ্দি যন্ত্রচালিতের মতো পাতাগুলি হাতে জড়ো করতে লাগল। তখনই সেনাপতি উঠে এল। যোদ্ধারা সন্ত্রস্ত হয়ে কাজ থামাল।

কাজ চলছে? যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে সেনাপতি গম্ভীর গলায় বলল। দু’একজন যোদ্ধা বলে উঠল-হা, জনাব।

ফ্রান্সিস বলল–রামাদ্দি, ভালো করে দেখুন তো, কিছু লেখা আছে মনে হচ্ছে।

একটা কাগজ আলতো হাতে নিয়ে একটুক্ষণ অস্পষ্ট হয়ে আসা অক্ষরগুলো দেখে রামাদ্দি বলল, আপনার অনুমান ঠিক।

কী লেখা আছে? ফ্রান্সিস সাগ্রহে জিগ্যেস করল।

ভালো পড়া যাচ্ছে না। যা পড়া যাচ্ছে সেটুকু পড়ে মনে হল, কেউ রোজনামচা মতো কিছু লিখেছে। তবে সন-তারিখ কিছু নেই।

রামাদ্দি, ওসব কবি আবিদির ছায়াসঙ্গী আবু হামিদের লেখা রোজনামচা। তাড়াতাড়ি পাঠোদ্ধার করুন। এই লেখাগুলো থেকে অনেক কিছু জানা যাবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব। ফ্রান্সিস বল।

দেখছি বানান-টানান ভুল আছে। রামাদ্দি বলল।

স্বাভাবিক। আবু হামিদ খুব উচ্চশিক্ষিত ছিল না। এক কাজ করুন, বাইরে চড়া রোদে গিয়ে বসুন। সাবধানে পাতাগুলো পরপর সাজাবার চেষ্টা করুন। আস্তে আস্তে। পাঠোদ্ধার করুন। দেখবেন, কোনও কাগজ যেন একেবারে ছিঁড়ে না যায়। একটু তাড়াতাড়ি করুন।

বিস্মিত রামাদ্দি কাগজগুলো নিয়ে ভাঙা ঘরের বাইরে চলে গেল। একটা লম্বাটে পাথরের পাটায় বসে আলতো হাতে কাগজগুলো নিয়ে নিয়ে পরপর সাজাল। তারপর পড়তে লাগল। সেনাপতি কোনও কথা না বলে ফ্রান্সিসের কাণ্ড দেখছিল। তার বিরক্ত মুখ দেখেই শাঙ্কো বুঝল, সেনাপতি এসবের কোনও অর্থই বুঝে উঠতে পারছে না। যোদ্ধারা কাজ থামিয়ে দাঁড়িয়ে একটু একটু হাঁপাচ্ছিল। ফ্রান্সিস ওদের দিকে তাকিয়ে বলল–মেঝের কোনার দিকটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। হাত লাগাও ভাই। ওরা সেনাপতির মুখের দিকে তাকাল। সেনাপতি মাথা তুলে সম্মতির ইঙ্গিত করল। শুরু হল পাথর সরানোর কাজ। ভাঙা দেওয়ালের বাইরে পাথরের ভাঙা আস্ত পাটা পড়তে লাগল। আবার ঠক্ঠকাশব্দ শুরু হল। তখনই দেখা গেল কোনার দিকটা ভেঙে পড়েছে। ফ্রান্সিস দ্রুত এগিয়ে এসে ভাঙা জায়গাটা দিয়ে নীচের দিকে তাকাল। বাইরে কড়া রোদ। কিন্তু ওখানটা খুব অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অস্পষ্ট একটা উঁচিয়ে থাকা গোল লোহার কড়ামতো দেখল ভাঙা পাথরগুলির মধ্যে। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হল। ও উজিরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সব গোপন রাখবে। দু’তিনজন যোদ্ধাও ঐ লোহার কড়াটা অস্পষ্ট দেখেছিল। তাদের একজন ফ্রান্সিসকে বলল–ওটা কী? ফ্রান্সিস প্রশ্নটার কোনও গুরুত্ব না দিয়ে বলল–তেমন কিছু না। দেওয়ালে গাঁথা থাকে মশাল রাখার যে কড়া তেমনই কিছু। তোমরা ভাই কাজ বন্ধ রাখো।

যোদ্ধারা ওখান থেকে সরে ওপরের ভাঙা সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল। সেনাপতি কাছেই দাঁড়িয়েছিল। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলল–কী ব্যাপার? ওখানে কী আছে? একজন যোদ্ধা হাত নেড়ে বলল–কিছু না। একটা ভাঙা লোহার কড়া।

ও। সেনাপতি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল। তখনই রামাদ্দি কাগজগুলো নিয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–আপনি ঠিকই বলেছেন। এগুলো আবু হামিদেরই লেখা রোজনামচা। যথাসম্ভব পরপর সাজিয়েছি। অনেক শব্দ পড়া যায়নি। সবই কেমন ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে।

আসুন। ফ্রান্সিস সরে এসে সিঁড়িতে বসল। রামাদ্দিকে পাশে বসতে ইঙ্গিত করল। রামাদ্দি পাশে বসল।

.

এবার পরপর বলে যান। যতটুকু পড়তে পেরেছেন, সাজাতে পেরেছেন–পড়ুন। রামাদ্দি পাতাগুলো একটা একটা করে নিয়ে পড়তে লাগল

শহরে জোর গুজব-সীমান্তে শত্রুসৈন্য-কদিন ধরেই গুজবের পর গুজব আতঙ্ক। গভীর রাত। ঘুম ভেঙে–জনাব রব্বাহিকে– রব্বাহি প্রচণ্ড উত্তেজিত পায়চারি–ভীষণ বিপদজনাব রব্বাহিকে–অনেক রাতে–মুখে মুখে গিজেল– লুকিয়ে লিখি–এরকম দেখিনি। আজ দেখছি–অন্যরকম–দেখছি–হামিদ–সব ধনসম্পদ–পালাবলুঠ হয়ে যাবে। রামাদ্দি থামল। বলল–পাতা নেই। তারপর আবার লেখা–চোরকুঠুরি থেকে কাঠে গিল্টিকরা–ভার–জনাব তৈরি–অন্ধকার পথবঁধ ভেঙে আসছিল–জনশূন্য চারদিক–আমাকেই দুর্গে ঢোকার ব্যবস্থা পরিত্যক্ত ঘর– রামাদ্দি থামল। বলল–পাতা নেই। একটা পাতা পড়াই যাচ্ছে না।

ফ্রান্সিস উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল–তারপর? রামাদ্দি পড়তে লাগল–খাদ্য-পানীয়–গভীর রাতে–খোঁড়া সুলেমান–সব জমা করি। রামাদ্দি থামল। বলল–পড়া যাচ্ছে না।

যা পড়তে পারছেন বলে যান। ফ্রান্সিসের গলায় স্পষ্ট উত্তেজনা। রামাদ্দি পড়তে লাগল–একটা বিষধর সাপ–মেঝেয় ঘোরে–মারতে দিলেন না সিন্দুক রাখা ফোঁস ফোঁস শব্দ–ঘুম-ভয়–আদর করেন–পোকামাকড়-বনজঙ্গল ঘুরে জমাই–জানালার গরাদে-রাত জাগেন গিজেল শুনি–গোপনে লিখি–জমিয়ে রাখি–এক গভীর রাতে–চিৎকার–অর্থহীন ঐশ্বর্য ছুঁড়ে ফেলে দেব সিন্দুক ওঠা–গরাদ–বাইরে জোড়া খেজুর গাছ–খেজুর গাছ দীর্ঘজীবী মানুষের জীবন–ফেলে দেব সব ছুঁড়ে-ঈশ্বরের আরাধনাই–শ্রেষ্ঠতম সঞ্চয়ে শান্তি নেই–ছুঁড়ে ফেলে দেব। মহা শান্তি খুঁসে উঠল সাপ– রামাদ্দি থামল। বলল আর কোনও কাগজ নেই। হয়তো আরও কিছু গুছিয়ে লেখা ছিল। ফ্রান্সিস উত্তেজনার মধ্যে কথাগুলির ফাঁকগুলো মনে মনে সাজিয়ে ভেবে নিচ্ছিল। হ্যারির কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। হ্যারি থাকলে ঠিক সব সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে পারত। কিন্তু হতাশ হওয়া চলবে না। ও বলে উঠল-রামাদ্দি, মান্যবর উজিরকে খবর পাঠান, আর সব যোদ্ধাকে চলে যেতে বলুন। ওদের কাজ শেষ।

রামাদ্দি এ কথার কোনও অর্থই বুঝল না। ও ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শাঙ্কো পাশে বসে সব শুনছিল। মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস যখন বলছে জানবেন এর পেছনে কোনও মানে–গোপন কারণ আছে। ও যা বলছে তাই করুন।

রামাদ্দি উঠে দাঁড়াল। কাগজগুলো রেখে সেনাপতির কাছে এল।

কী সব বকবক করছিলেন? গিজেল বানাচ্ছিলেন? বিরক্ত সেনাপতি বলল।

ঐ রকমই। তবে লেখা গিজেল। এক্ষুনি মান্যবর উজিরকে খবর দিন। উনি যেন তাড়াতাড়ি আসেন। রামাদ্দি বলল।

সেনাপতি চলে গেল। বাইরে পাথুরে রাস্তায় ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল– ঠক্ ঠকা। রামাদ্দি যোদ্ধাদের কাছে গেল। বল–ভাই, কাজ শেষ। মান্যবর উজির আসছেন। তোমাদের ছুটি। মান্যবরকে আমি যা বলার বলব।

যোদ্ধারা আস্তে আস্তে চলে গেল। শাঙ্কো দেশের ভাষায় মৃদুস্বরে বলল-উনি আসছেন। তুমি কি নিশ্চিত?

নীচে একটা গোল লোহার কড়া দেখেছ তো? ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

হ্যাঁ, খুব অস্পষ্ট। শাঙ্কো বলল।

ওটা একটা গিল্টিকরা সিন্দুকের কড়া। ওটাতেই রয়েছে কবি আবিদি রব্বাহির গুপ্ত ঐশ্বর্যভাণ্ডার। অবশ্য এখনও সঠিক সেটা বলার সময় আসেনি। অপেক্ষা করি।

সাবাস ফ্রান্সিস! তোমার সব অনুমান সত্যি। শাঙ্কো খুশির স্বরে বলে উঠল।

ওদের মৃদুস্বরে কথা বলতে দেখে রামাদ্দি কাছে এল। বলল–কী কথা হচ্ছিল?

এই ঘরের ওপরের ঘরেই কবি আবিদি রব্বাহি তার স্বেচ্ছা নির্বাসনের শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর বিশ্বস্ত ছায়াসঙ্গী আবু হামিদ। সাপ পোষ মানে কিনা জানি না। তবে এক বিষধর সাপের কামড়ে আবিদি মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আবু হামিদের মৃত্যুর কারণ বা সময় এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ফ্রান্সিস বলল।

তবে তো তাদের পবিত্র দেহাবশেষ এইখানেই পাওয়া যাবে। রামাদ্দি বলল।

নিশ্চয়ই পাবেন। যদিও এতদিন পরেকতটা অক্ষত আছে বলতে পারব না। ফ্রান্সিস বলল।

আর কী সব খুঁজছিলেন সে সব? রামাদ্দি জানতে চাইল।

মান্যবর উজির এলে সবই জানবেন, দেখবেন। ফ্রান্সিস বলল।

একটু পরেই ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল পাথুরে রাস্তায়। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। দ্রুতপায়েই উঠে এলেন উজির। একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–কী ব্যাপার? উদ্ধার করতে পেরেছ সেই ঐশ্বর্যভাণ্ডার?

না। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।

শুনে উজির দু’হাত ছড়িয়ে হতাশার ভঙ্গি করলেন। বললেন–তাহলে আমাকে কেন এভাবে ছুটিয়ে মারলে?

সেনাপতিকে বলুন একটা শক্তদড়ি আর জাহাজের একটা নোঙর আনতে। ফ্রান্সিস বলল।

কী হবে ও সবে? উজির অবাক।

একটু তাড়াতাড়ি আনতে বলুন। ফ্রান্সিস শান্ত স্বরে বলল।

বিরস মুখে উজির সেনাপতিকে শক্ত দড়ি আর একটা নোঙর আনতে বললেন। রামাদ্দি তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে। ও তখন ভাবছে। লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! পরক্ষণেই ভাবল, ফ্রান্সিস তো কবি আবিদির মৃত্যুর ঘটনা বেশ গুছিয়ে বলে গেল। এটা কী করে সম্ভব? এত কথা যে বলতে পারে সে কখনওই পাগল নয়। সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল। শুধু উজির হাতে ধরা ঘোড়া চালানোর চাবুকটা হাতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আবার ছেড়ে দিচ্ছিলেন। বেশ অসহিষ্ণু ভঙ্গি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দড়ি আর নোঙর নিয়ে সেনাপতি এল। এত তাড়াতাড়ি কী করে আনল সেটা আর কেউ জিগ্যেস করল না। ফ্রান্সিস বলল, মান্যবর, এবার সেনাপতিকে চলে যেতে বলুন। ওঁকে আর দরকার নেই।

উজির আর কারণ জানতে না চেয়ে সেনাপতিকে চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন। সেনাপতি ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

ফ্রান্সিস চুপ করে কান পেতে রইল। বাইরে সেনাপতির ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ শোনা গেল। সেটাও মিলিয়ে গেল এক সময়। ফ্রান্সিস উজিরের দিকে তাকিয়ে বলল–সব গোপন রাখব। কথা দিয়েছিলাম। তাই সবাইকে সরিয়ে দিলাম। কবি রামাদ্দিকে আপনি কোনও গুরুত্বই দেননি। তাই উনি থাকুন। উনি অন্যরকম মানুষ। এবার আমার সঙ্গে আসুন।

ফ্রান্সিস ধীর পায়ে সেই ভেঙে পড়া জায়গাটায় এসে দাঁড়াল। উজির পাশে এসে– দাঁড়ালেন। ফ্রান্সিস সেই কড়াটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল–ওটা একটা কাঠের গিল্টিকরা সিন্দুক। ওটার মধ্যেই আছে বিখ্যাত কবি আবিদি রব্বাহির ঐশ্বর্যভাণ্ডার।

উজির ভীষণভাবে চমকে উঠে বললেন–বলো কী? তার তখন দু’চোখ কপালে।

ওটা তুলতেই দড়ি-নোঙর আনিয়েছি। ওখানে নামতে গেলে যে কোনও মুহূর্তে মেঝে ভেঙে পড়তে পারে। তাতে প্রাণহানি ঘটবে। এবার কাজে নামা যাক। শাঙ্কো, : দড়ি নিয়ে এসো। রামাদ্দিও আসুন।

শাঙ্কো তো এসব ব্যাপারে অভ্যস্ত। ও দড়ি এনে নোঙরের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল। ওরা দক্ষ নাবিক। দুড়ির নানারকম গিঁট বাঁধতে ওস্তাদ। তারপর ঐ ভাঙা গর্তের মতো জায়গাটায় নোঙরটা নামিয়ে দিল। আবছা আলোয় লক্ষ্য স্থির করে নোঙরের বঁড়শির মতো মুখটা আস্তে আস্তে ঐ কড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর টেনে ধরল।

রামাদ্দি, হাত লাগান। ফ্রান্সিস দড়িটা ধরে বলল–খুব বেশি ভার হবে না। আবু হামিদ একাই কাঁধে করে এতখানি পথ এসেছিল।

বিস্ময়াভিভূত রামাদ্দিযন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে এসে দড়িটা ধরল। দেখে উজিরও এগিয়ে এসে ধরলেন। চারজনে মিলে টানতে লাগল। একটু পরেই ভাঙা-আস্ত পাথরের পাটাতনে ঢাকা-পড়ে-যাওয়া সিন্দুকটা উঠে আসতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওটা তোলা হল। সত্যি কাঠের ওপর সোনা রুপোর সুন্দর কাজ করা সিন্দুক। কিন্তু কোনও তালা ঝুলছেনা। উজির একলাফে এগিয়ে এসে ডালা ধরে টান দিলেন। বেশ শক্তভাবে আঁটা কতদিন আগের সিন্দুক! দু’একবার টানাটানি করে জোরে শ্বাস ফেলে সরে দাঁড়ালেন। এবার শাঙ্কো এগিয়ে এসে জোরে একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই ডালাটা খুলে গেল। কিন্তু এ কী? –ভেতরটা শূন্য! পড়ে আছে চামড়া মেশানো কাগজের একটা বান্ডিল মতো। পাশে ওল্টনো একটা পাথরের দোয়াত আর ছুঁচোলো করে কাটা কলম। দোয়াতের কালো কালি কাগজের কোনায় আঠার মতো সেঁটে আছে। উজির স্তব্ধ হয়ে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু রামাদ্দি উল্লাসে আনন্দে দু’হাত তুলে লাফিয়ে উঠল। দ্রুত হাত বাড়িয়ে তুলে নিল কাগজগুলো। ওপরের কাগজটায় আরবি ভাষায় : লেখা কয়েক লাইন পড়েই সব কাগজগুলি বুকে চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। চরম বিরক্তিতে নির্বাক উজির সেই কান্নার শব্দে সচকিত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন–থাম্ উজবুক।

কিন্তু কে থামাবে রামাদ্দিকে? রামাদ্দি কেঁদেই চলল। উজির অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে যেন। উজির উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন–এই তোমার আবিষ্কার! কতকগুলো বস্তাপচা কাগজ!

শাঙ্কোও বিস্ময়ে নির্বাক। ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়েই রইল।

এই রামাদ্দি, এই সিন্দুক তোল–তোল।

কাকে বলা? রামাদ্দি তখন বাহ্যজ্ঞানশূন্য। কাগজগুলো বুকে জড়িয়ে বসে বসে কেঁদে চলেছে।

ঠিক আছে, আমিই ছুঁড়ে ফেলছি। উজির কথাটা বলে ছুটে এসে ভারী সিন্দুকটা তুলে নিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে ভাঙা দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে সেটাকে বাইরে ফেলে দিলেন। খুব জোরে শব্দ হল না। কতদিন আগেকার সিন্দুক। হয়তো ভেঙে কাঠের ডালা ছিটকেই গেল। সেই শব্দে ফ্রান্সিস চমকে উঠে ভাঙা দেয়ালের দিকে তাকাল। গরাদ থাকলে উজির কি পারতেন ঐ সিন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলতে? সঙ্গে সঙ্গে রামাদ্দির পড়া শেষ দিকটা মনে পড়ল–সব ছুঁড়ে ফেলে দেব–মহা শান্তি! ফ্রান্সিসের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুখে হাসি ফুটে উঠল। উজিরের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল–বাইরে ঐ জঙ্গলের দিকে চলুন।

তার মানে? উজিরের বিস্ময়ের শেষ নেই।

ওখানেই ছড়িয়ে আছে কবি আবিদির ঐশ্বর্যভাণ্ডার। চলুন। ফ্রান্সিস একই ভাবে শান্ত স্বরে বলল। উজির বিস্ময়ে বারুদ্ধ হয়ে গেলেন। লোকটা বলে কী?

ফ্রান্সিস ভাঙা সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলল–আসুন। উজির কী বুঝল কে জানে। ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। পেছনে শাঙ্কো। ফ্রান্সিসের উজ্জ্বল চোখ-মুখ দেখেই বুঝল–ফ্রান্সিস এবার ঠিক খুঁজে পেয়েছে।

তিনজন পেছনের জঙ্গলের কাছে এল। দুর্গের ভাঙা জানালাটা দেখিয়ে ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডেকে বলল–ওই জানালা বরাবর জোড়া খেজুর গাছ পর্যন্ত এলাকাটা ভালো কের খুঁজতে হবে। সাবধান–বিষধর সাপ আছে। বুনো ঝোঁপ-জঙ্গল, গাছের নীচে পাবে মূল্যবান মণিরত্ন, সোনা রুপো। রামাদ্দি থাকলে খুঁজতে সুবিধে হত। কিন্তু উনি এখন হিসেবের বাইরে। এসো। উজির কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো ঝোঁপ-জঙ্গল কখনো উপড়ে ফেলে কখনো ডাল-টাল ভেঙে ফেলে নীচের পাথরকুচি মেশানো মাটি দু’হাতে সরিয়ে সরিয়ে দেখতে দেখতে এগোতে লাগল। কিছু পাওয়া গেল না। ফ্রান্সিস বুঝল প্রায় দেড়শো বছর আগের ঘটনা। পাথরকুচি মাটি জমে উঁচু হয়েছে। খুঁড়ে না ফেললে কিছু পাওয়া যাবে না। তখন জোড়া খেজুর গাছের কাছে এসে একটা ছোট বুনো গাছ হ্যাঁচকা টান দিয়ে উপড়ে ফেলল। এক চাপড়া পাথরকুচি মেশানো মাটি উপড়ে এল সেই সঙ্গে। দেখল চৌকোনা কিছুর একটা কোনা বেরিয়ে আছে। শাঙ্কো দ্রুত বসে পড়ে দু’হাতে ঘাস ছিঁড়ে মাটি সরিয়ে দেখল একটা ধুলো-মাটি মাখা চৌকোনা কিছু। ওটাও কয়েকটা টানে তুলে ফেলে ডাকল–ফ্রান্সিস, দেখো তো এটা কী? ফ্রান্সিস দ্রুত পায়ে শাঙ্কোর কাছে এল। কোমর থেকে ফেট্টিটা খুলে চেপে চেপে মাটি, ঘাস, ঘষে তুলে ফেলতে ফেলতে দেখল সোনার লম্বাটে চৌকোনা পাটা মতো। তাতে কিছু লেখা। কিন্তু ভাষাটা বুঝল না। ওটা হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস উজিরের কাছে এল। উজিরের হাতে দিয়ে বলল– দেখুন তো, সোনার ওপরে কী যেন কুঁদে লেখা? উজির নিরেট সোনার জিনিসটা দেখে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেল। মাটিমাখা লেখাগুলো দেখতে দেখতে সবিস্ময়ে বলে উঠল কবি আবিদি রব্বাহিকে দেওয়া মানপত্র। হিব্রু ভাষায় লেখা। নীচে একজন খলিফার নাম রয়েছে। সন-তারিখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

এবার ওই জোড়া খেজুর গাছ পর্যন্ত সমস্ত এলাকাটারই জঙ্গল, ঘাস খুঁড়ে ফেলুন। কিন্তু এখন নয়। গোপনে। রাত্রে। কয়েকজন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে খুঁড়বেন। কারণ আপনি সব গোপন করবেন বলেছিলেন।

–সব ধনৈশ্বর্য এখানে আছে? উজির আগ্রহে অধীর।

ফ্রান্সিস বলল–অবশ্যই আছে। একটা নমুনা তো আপনার হাতে। তারপর শান্তস্বরে বলল–এবার আমার শর্ত মনে করুন। আমাদের সবাইকে মুক্তি দিন।

আগে সব উদ্ধার করি। উজির বলল।

–তাহলে আজ রাতেই কাজে নামুন। সারারাতে কিছু সম্পদ তো পাবেনই। তাহলে কাল সকালে আমাদের মুক্তি দিন। ফ্রান্সিস বলল–আমরা তাড়াতাড়ি পোত বন্দরে গিয়ে জাহাজে উঠবো।

একটু ভেবে নিয়ে উজির বলল–কয়েকটা দিন থাকো। কিছু ভাগটাগ তো নেবে।

–একটি স্বর্ণমুদ্রাও চাই না। আমরা শুধু মুক্তি চাই। ফ্রান্সিস দৃঢ় স্বরে বলল।

–ঠিক আছে। কাল সকালে দেখা যাবে। উজির বলল।

তখনই দেখা গেল রামাদ্দি ওদের দিকে ছুটে আসছে। ওর দু’গাল, বুকের কাছে পোশাক চোখের জলে ভেজা। ছ্যাকড়া ছ্যাকড়া কালি লেগে আছে। উজির দ্রুত সোনার মানপত্রটা ঢোলা আলখাল্লার বুকের কাছে লুকিয়ে ধরে রইল। রামাদ্দি ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ফ্রান্সিসের কাঁধে মুখ ঘষতে ঘষতে কান্নাভেজা গলায় বলল–কী অমূল্য সম্পদ যে আমাকে দিলেন! ফ্রান্সিস বুঝল ওর কাঁধের কাছে পোশাক রামাদ্দির চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে। হেসে বলল–বানান ভুল আছে কিন্তু। রামাদ্দি সে কথা কানেই তুলল না। বলল–আমার মহা সৌভাগ্য গুরুদেবের শেষ লিখিত গিজেলের আমিই প্রথম পাঠক। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে! ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ওর আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে ওর আনন্দ উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তখনই রামাদ্দি বলে উঠল–আপনি কি এই মহা-সম্পদ খুঁজছিলেন?

এর কাছে সেসব তুচ্ছ। ফ্রান্সিস হেসে বলল। উজিরের দিকে তাকিয়ে বলল তাহলে বন্দীশালায় ফিরে যাচ্ছি।

কাল সকালেই আমরা মুক্তি চাই।

রাতটা তো হাতে আছে। সকালেই খবর পাবে। উজির বলল।

–চলো শাঙ্কো। ফ্রান্সিস বলল–আমাদের কাজ শেষ।

উজিরের কাছে ফ্রান্সিসদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। রাস্তায় এসে দেখল সেই লোকটা আজ দাঁড়িয়ে নেই। দুজনে হাঁটতে লাগল। শাঙ্কো বলল–অত মূল্যবান সম্পদ জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলল?

–মানুষের মন বড় বিচিত্র শাঙ্কো। কতরকম মানুষই তো দেখলাম।

–অত দামি দামি জিনিস কারো নজরে পড়ল না? শাঙ্কো বলল।

–দুর্গে সাধারণ লোকের প্রবেশ নিষেধ। তখনও সামান্য হলেও গাছ-গাছালি ছিল। সেই সময় যোদ্ধারাও বোধহয় বেশি থাকতো না দুর্গে। তারা জঙ্গলে যাবে কেন? তবে চোরটোর হয়তো গিয়েছিল। কিন্তু সব মূল্যবান সামগ্রী তো পায়নি। রাতের অন্ধকারে হাতের কাছে তাড়াতাড়ি যদি পেয়েও থাকে কিন্তু ভয়ে বাইরে প্রকাশ করেনি। তবে লোকমুখে হয়তো কিছু গল্পটল্প চালু ছিল। নইলে এখানে চোরেরা আসবে কেন? — গভীর রাতে সাপের কামড় খেয়ে মরতে লেকে কি যায়?

আধভাঙা দুর্গের বাইরে এল সবাই। উজির তো খুশিতে ডগমগ। সোনার মানপত্র লুকিয়ে নিয়ে দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘোড়ায় উঠল। জোরে ঘোড়া ছোটাল। রামাদ্দি সেই গিজেল লেখাগুলো নিয়ে ফ্রান্সিসদের কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিল। সেই মন্থর গতিতে হেঁটে চলল পাথুরে রাস্তা দিয়ে। সে-ও আনন্দিত। তবে ধনসম্পদের চেয়েও অনেক মূল্যবান গুরুদেবের লিখিত গিজেল পেয়ে।

একজন প্রহরী এসে গরাদ দেওয়া দরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিস ও শাঙ্কো ঢুকতেই বিনোলারা দ্রুত ছুটে এল। শাঙ্কো একটু ক্লান্ত স্বরে বলল-খাওয়ার সময় সব বলবো। এখন খিদেয় পেট জ্বলছে। খেতে খেতে শাঙ্কো হাত ঘুরিয়ে চোখ-মুখে নানা ভাব প্রকাশ করে ফ্রান্সিসের কৃতিত্বের কথা বলতে লাগল।

রাতে ফ্রান্সিসের পাশে শুয়ে শাঙ্কো বলল–কী মনে হয় তোমার? উজির আমাদের মুক্তি দেবে?

–অবশ্যই। ধনসম্পদ রাত জেগে খুঁজে পাবেই। দু’এক রাত লাগতে পারে সব উদ্ধার করতে। উজিরের কাছে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। কাজেই আমাদের মুক্তি দিতে আপত্তি করবে না। কারণ তাতে ওর কোনো লাভ নেই।

ভোর হল। সকালের খাবার খাওয়া হয়েছে সবে। গরাদে মুখ রেখে:চড়া গলায় এক প্রহরী বলল-শুধু ভাইকিংরা বাইরে বেরিয়ে এসো। বাকিদের কয়েদ চলবে। মান্যবর উজিরের হুকুম।

শাঙ্কো লাফিয়ে উঠে পড়ল। গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব, উঠে এসো! আমরা মুক্তি পেয়েছি। ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এসে গরাদের সামনে জড়ো হল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াতেই আস্তাসো ছুটে এসে ফ্রান্সিসের দু’হাত জড়িয়ে ধরল। খুশি তবু দু’চোখে দুঃখ, কাতরতা। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে আস্তে আস্তে বলল–ভাই আস্তাসো, দুঃখিত। তোমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারলাম না। আমরাও যে এত তাড়াতাড়ি মুক্তি পাব ভাবিনি। উজির ইয়েপুদা মানুষটা বড় ধূর্ত। একটু থেমে বললঈশ্বরের কাছে তোমাদের দ্রুত মুক্তি কামনা করছি। আর কোনো কথা বলতে পারল না।

শব্দ করে গরাদের দরজা খেলা হল। বাইরে এসে ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। উজ্জ্বল রোদের আকাশ। সাদাটে খণ্ড মেঘ নিথর দাঁড়িয়ে। আঃ মুক্তি! পৃথিবী কী সুন্দর!

ভাইকিংরা দল বেঁধে পাথর ছড়ানো রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সদর রাস্তায় উঠে এল। হাঁটতে লাগল পোত বন্দরের দিকে।

রোদের তাত বাড়ছে। জোরে হাওয়া বইছে। ধুলো-বালি, শুকনো পাতা উড়ছে। রাস্তায় লোকজন। দু’পাশের বাড়ি-ঘর শেষ হল। শুরু হল চাষ-আবাদের এলাকা।

হঠাৎ শাঙ্কো বলে উঠল–ফ্রান্সিস, ওই দেখো কবি রামাদ্দি ছুটে আসছে। দেখা গেল রামাদ্দি ছুটতে ছুটতে আসছে। ওদের কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল– তোমরা মুক্তি পেয়েছো শুনে ছুটে আসছি। বলেই সিনাত্রাকে জড়িয়ে ধরল। বলল কবি-বন্ধু, কাল সারারাত জেগে কবিগুরুর গিজেলগুলো পড়েছি। কবি-বন্ধু, তোমাকে ছাড়া আর কাকে শোনাবো সেসব? কী অপূর্ব সেইসব গিজেল!

কিন্তু আমরা যে দেশে ফিরে যাব। বড় তাড়া আমাদের ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ে বলল সবাইদাঁড়াও। রামাদ্দির দিকে তাকিয়ে বলল–ঠিকআছে। একটা গিজেল বলুন। ওই রোদ, ধুলো-পাতা ও পরিবেশ রামাদ্দিকেদমাতে পারল না। ও সুর করে একা গিজেল বলল অর্থাৎ পোর্তুগীজ ভাষায় বলল কবে শুনেছিলাম ইবন্ মনজিরের গিজেল–

ঐশ্বর্য সবার জন্য নয়। বিশ্বাস করেছিলাম। সঞ্চয় করেছি ঐশ্বর্য, খ্যাতি, সম্মান। আজ আমি সেই বিশ্বাস হারিয়েছি। উপলব্ধি করেছি ঐশ্বর্য সবার জন্য। খ্যাতি, সম্মান তুচ্ছ। ঐশ্বর্য আজ আমার কাছে তুচ্ছ।

–ব্বাঃ কী সুন্দর! মুগ্ধস্বরে সিনাত্রা বলে উঠল।

কবি রামাদ্দি, রাত জেগে আপনি এখন ক্লান্ত। এবার ফিরে যান। বিশ্রাম করুন। ফ্রান্সিস শান্তস্বরে বলল।

না না। আমার অভ্যাস আছে রাত জাগার। কত রাত

–তবু আপনার মতো মানুষ যত দীর্ঘজীবী হয় আমাদের ততই মঙ্গল। ফিরে যান।

বেশ। আপনার কথা রাখতেই হবে। আপনি শুধু বুদ্ধিমান নন, হৃদয়বানও। রামাদ্দি বলল।

সিনাত্রার দিকে তাকিয়ে রামাদ্দি বলল–কবি-বন্ধু, গায়ক-বন্ধু, তাহলে বিদায়। রামাদ্দি ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ধুলো-পাতা ওড়া পথ দিয়ে ফিরে চলল।

চলো। ফ্রান্সিস বলল। আবার চলা শুরু হল। সিনাত্রা মৃদুস্বরে বলল–আশ্চর্য মানুষ। কেউ কোনো কথা বলল না।

জাহাজের ডেকে উঠে ফ্রান্সিস বলল শাঙ্কো, এখুনি নৌকোয় চড়ে চলে যাও। মারিয়া, হ্যারিকে নিয়ে এসো। তোমরা এলে সবাই একসঙ্গে খাবো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে হালের দিকে ছুটল। ভেন হাসিমুখে এগিয়ে এল।

–ভেন, তোমার কোনো কষ্ট হয়নি তো? ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল।

-না না। ভালো কথা, কয়েকজন যোদ্ধা এসেছিল। সব বাজেয়াপ্ত করা অস্ত্রশস্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। ওই যে ডেকে জড়ো করা।

ফ্রান্সিস হেসে বলল–যাক, নতুন অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্যে কিছু সোনার চাকতি বাঁচল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব, হ্যারিরা ফিরে এলে আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে জাহাজ চালাবো। মাতৃভূমির দিকে।

বন্ধুরা সমস্বরে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।

[তথ্যসূত্র : ১। দ্য ভাইকিংস–নিপোর্ড পি পোর্তুগাল– পান্ডি আর।

২। ওরাল ট্র্যাডিশান অব অ্যানসিয়েন্ট অ্যারাবিক পোয়েট্রি– ব্ৰিকাকি পি. জে.

৩। স্প্যানিশ অ্যান্ড পোর্তুগীজ মনাস্টিক হিস্ট্রি–বিশকো সি. জে.]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress