Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আঁধারে মায়ার খেলা (ভূতনাথের ডায়েরি) || Anish Deb

আঁধারে মায়ার খেলা (ভূতনাথের ডায়েরি) || Anish Deb

ভূতনাথের ডায়েরি : আঁধারে মায়ার খেলা

প্রিয়নাথ বসবার ঘরে ঢুকতেই ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

সৌজন্য দেখিয়ে হাতজোড় করে প্রিয়নাথ বললেন, ‘সরি, আপনাদের অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। আসলে এ-সময়টা আমি পুজো করি।’

‘না, না—তাতে কী আছে!’ ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘আমরাই আধঘণ্টা আগে চলে এসেছি।’

ওঁরা সোফায় বসে পড়লেন আবার। প্রিয়নাথও বসলেন।

ভদ্রমহিলা খানিকটা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনি…আপনি ঠাকুর মানেন?’

হাসলেন ভূতনাথ। পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে বেশ সময় নিয়ে সিগারেট ধরালেন। তারপর লাইটার পকেটে রেখে জড়ানো গলায় বললেন, ‘দুটোতেই বিশ্বাস করি, ম্যাডাম।’

‘দুটো মানে?’ এবার ভদ্রলোক জানতে চাইলেন।

‘বুঝে নিন—।’ রহস্যময় হাসলেন ভূতনাথ।

আজ সকালে ওঁরা—মানে এই ভদ্রলোক—প্রিয়নাথকে ফোন করেছিলেন। ওঁদের বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, তাই ভূতনাথের পরামর্শ চান। রেফারেন্স হিসেবে ভদ্রলোক এ-পাড়ার শান্তি কমিটির সেক্রেটারি বিজন সরকারের নাম করেছিলেন।

প্রিয়নাথ ওঁকে সন্ধে সাতটায় আসতে বলেছিলেন। কিন্তু ওঁরা সাড়ে ছ’টা নাগাদ এসে পড়েছেন। প্রিয়নাথ তখন পুজো করছিলেন। রোজ সকাল-সন্ধে ঠাকুরের আসনের সামনে বসে পুজো করা ওঁর বহু বছরের অভ্যেস।

দরজা খুলে ওঁদের বসতে বলে প্রিয়নাথ আবার অসমাপ্ত পুজোয় ফিরে গিয়েছিলেন। তারপর পাজামার ওপরে একটা শার্ট চাপিয়ে ওঁদের সামনে এসেছেন।

ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা নিজেদের পরিচয় দিলেন।

ভদ্রলোকের নাম প্রমথেশ নাহা, সঙ্গে ওঁর স্ত্রী মাধুরী। ওঁরা দমদম স্টেশনের কাছে ঘুঘুডাঙায় থাকেন।

কিছুদিন ধরে ওঁরা ওঁদের এক বছরের মেয়েকে নিয়ে অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়েছেন।

প্রিয়নাথ ওঁদের দেখছিলেন।

পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়েসি প্রমথেশের মাথায় কোঁকড়ানো চুল। তাতে কোথাও-কোথাও পাক ধরেছে। চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা। ফরসা কপালে-দু-তিনটে ভাঁজ। গোঁফ কলপ করা। পোশাক-আশাকে উচ্চবিত্তের ছাপ। জামার বুকপকেট থেকে মোবাইল ফোন উঁকি মারছে।

মাধুরী দেখতে সাধারণ হলেও রুচিসম্মত পোশাক পরেছেন। সাজগোজ চড়া মাপের নয়। বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলে চকোলেট রঙের নেলপালিশের ছোঁয়া। কপালে-সিঁথিতে প্রথাগত সিঁদুর—যা আজকাল খুব কম চোখে পড়ে।

হালকা পারফিউমের গন্ধ প্রিয়নাথের নাকে আসছিল। কিন্তু সেটা প্রমথেশ না মাধুরীর শরীর থেকে—সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।

প্রিয়নাথ বুঝতে পারছিলেন, বাইরে ওঁরা শান্ত ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে-ভেতরে বেশ উদ্বিগ্ন। হয়তো মেয়েকে নিয়েই।

সিগারেটে টান দিয়ে প্রিয়নাথ বললেন, ‘আপনাদের কথা শুনছি। আগে দোকানে একটু চা বলে আসি—’ উঠে দাঁড়ালেন, হেসে যোগ করলেন, ‘আমার চা-পাতা ফুরিয়ে গেছে।’

প্রমথেশ হাত নেড়ে ভূতনাথকে বাধা দিলেন : ‘কোনও প্রয়োজন নেই, মিস্টার জোয়ারদার। আমরা চা খেয়েই এসেছি। আপনি নিশ্চিন্তে বসুন। বসে আমাদের প্রবলেমটা কাইন্ডলি শুনুন।’

মাধুরীর চোখ ঘরের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সর্বত্র ছন্নছাড়া ছাপ। বোঝাই যায়, এ-আস্তানার মহিলার ছোঁয়া পড়ে না। সোফা-টেবিল-চেয়ার সবই বেহাল। একপাশে দেওয়াল-তাকে গাদা-গাদা বই। সেই বইয়ের ঢল বর্ষার জলের মতো এলোমেলোভাবে নেমে এসেছে টেবিলে, সেখান থেকে গড়িয়ে মেঝেতে। তারপর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেছে। বইগুলোকে বাঁচাতে মেঝেতে অবশ্য একটা পুরোনো বেডশিট ভাঁজ করে পাতা আছে।

মাধুরী অবাক চোখে মাঝবয়েসি প্রিয়নাথকে দেখছিলেন। এই সাধারণ মানুষটা কি ওঁদের অসাধারণ সমস্যা থেকে বাঁচাতে পারবে?

হঠাৎ কী মনে হওয়াতে প্রিয়নাথ প্রমথেশবাবুকে সিগারেট অফার করতে গেলেন। কিন্তু স্মিত হেসে প্রমথেশ বললেন, ‘ব্যস্ত হবেন না। আমার কাছে আছে—তবে আমি আজকাল একটু কম স্মোক করছি। মাস আস্টেক আগে আমার একটা ছোট্ট স্ট্রোক মতন হয়ে গেছে।

‘যাকগে, এবার কাজের কথায় আসি। আমার কম্পিউটারের ব্যবসা আছে। ”এন-কম্পিউটার” নামে একটা ব্র্যান্ডও চালু করেছি। ক্যামাক স্ট্রিটে আমার অফিস। আর ফ্যাক্টরি দমদমে—বাড়ির কাছাকাছি। রিসেন্টলি আমি সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্টেও হাত দিয়েছি। আমার কোম্পানিতে সাতজন বি. ই., বি. টেক., এনজিনিয়ার কাজ করে।

‘এতসব কথা বলার কারণ—আমি টেকনোলজির লোক, ভূত-প্রেতে এক ইঞ্চিও বিশ্বাস আমার নেই। যে-জিনিসের অস্তিত্বই নেই তার ওপর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটাই তো হাস্যকর। কিন্তু…’ প্রমথেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘কিন্তু গত একমাস ধরে আমার ধারণাটা চিড় খেয়ে গেছে। আমি পাজলড হয়ে গেছি।’

প্রিয়নাথ আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন। পাশের ঘরের ঠাকুরের আসন থেকে ধূপের গন্ধ ভেসে আসছিল। ঠুনঠুন ঘন্টি বাজিয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে একটা টানা-রিকশা চলে গেল। তারপরই মালাইবরফওয়ালার সুরেলা হাঁক শোনা গেল।

‘ব্যবসা দাঁড় করাতে গিয়ে আমি বিয়ে করার ব্যাপারে বেশ লেট করে ফেলেছি, মিস্টার জোয়ারদার। তাই এ-বয়েসে পৌঁছেও আমাদের একটিমাত্র ইস্যু—মাত্র এক বছরের একটি মেয়ে। নাম প্রথমা। তবে আমরা মাম্পি বলে ডাকি।

‘আমাদের প্রবলেমটা মাম্পিকে নিয়েই…।’ ঘরের সিলিংয়ের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে শেষ কথাটা বললেন প্রমথেশ। তারপর : ‘আমাদের নিজের বাড়ি। বাবা প্রায় ন’বছর আগে এক্সপায়ার করেছেন। আর মা মারা গেছেন মাত্র মাসতিনেক আগে। বাড়িতে এখন আমরা তিনজন—আর আমার একমাত্র বোন সাবিত্রী আমাদের কাছে থাকে। সাবিত্রী উইডো। ওর হাজব্যান্ড আর্মিতে ছিল—এনকাউন্টারে বছর চারেক আগে মারা গেছে।

‘আমি বিজনেসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকি। মাধুরী আর সাবিত্রীই সবকিছু দেখাশোনা করে। মাম্পি ওদের দু-চোখের মণি। মাধুরী মা—ওর তো টান থাকবেই। তবে সাবিত্রীর টান বোধহয় তার চেয়েও বেশি—’ আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন প্রমথেশ।

প্রিয়নাথের মনে হল না স্বামীর কথায় মাধুরী অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

একটু থেমে প্রমথেশ আবার বললেন, ‘মাম্পিকে সারাটা দিন ওরা দুজনে আগলে-আগলে রাখে। কিন্তু এত আগলে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি। মাম্পি মনে হয় কোনও বিপদে জড়িয়ে গেছে। আর সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেককেও জড়িয়ে ফেলেছে।’

‘এইটুকু মেয়ে আবার বিপদে জড়াবে কেমন করে!’ অবাক হয়ে বললেন ভূতনাথ।

চোখ নামালেন প্রমথেশ। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে তারপর স্ত্রীর দিকে তাকালেন : ‘এবারে তুমি বলো—আমি একটু আনইজি ফিল করছি…।’

মাধুরী একটু কেশে নিলেন, প্রিয়নাথ এবং স্বামীকে একপলক করে দেখলেন, তারপর বেশ নীচু গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের মেজর প্রবলেম হল মাম্পি হঠাৎ কথা বলতে শুরু করেছে। আপনি তো জানেন, এক বছর বয়েসের বাচ্চার পক্ষে কথা বলাটা কীরকম অস্বাভাবিক! মাসখানেক আগে একদিন হঠাৎ মাম্পি কথা বলতে শুরু করে। তখন প্রায় মাঝরাত্তির। আচমকা এক অস্বস্তিতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, আর তখনই শুনি মাম্পি কথা বলছে।’

‘কার সঙ্গে?’

‘প্রথমটা মনে হয়েছিল বোধহয় আপনমনে কথা বলছে। আমি বেশ অবাক হয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওর ঘুম ভাঙাই—’ ইশারায় স্বামীর দিকে দেখালেন মাধুরী : ‘তারপর অন্ধকারে চুপটি করে আমরা মাম্পির কথা শুনতে থাকি। কিছুক্ষণ শোনার পর বুঝতে পারি, ও আপনমনে কথা বলছে না—কারও সঙ্গে কথা বলছে।

‘একটু পরে আমি ভয় পেয়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিই। আলো জ্বালতেই দেখি মাম্পি চোখ বুজে আঘোরে ঘুমোচ্ছে। সেই অবস্থাতেই ওর ঠোঁট নড়ে উঠল। ও বলল, ”আলো নিভিয়ে দে—অসুবিধে হচ্ছে।” তক্ষুনি আমি আলো নিভিয়ে দিই। তার মিনিটকয়েক পর মাম্পির কথা বন্ধ হয়ে যায়। আর পরদিন সকাল থেকেই ও আবার স্বাভাবিক। সেই দু-একটা আধো-আধো কথা : মা…বা…পিচি…এইরকম। তারপর…।’

হঠাৎই পাখির ডাকের শব্দে প্রমথেশের মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

প্রমথেশ পকেট থেকে ফোন বের করে কথা বললেন। ব্যবসার কাজের ফোন। সংক্ষেপে কথা শেষ করে প্রমথেশ বললেন, ‘এখন আমাকে ফোন করে ডিসটার্ব কোরো না। একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে জরুরি কথা বলছি।’

প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে আলতো গলায় ‘সরি’ বলে সেলফোনটা বুকপকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন।

আগের কথার খেই ধরে মাধুরী আবার বলতে শুরু করলেন।

‘তারপর—দু-চারদিন সবে কেটেছে—মাম্পি আবার ওইরকম কথা বলল। সেদিকের কথায় স্পষ্ট বোঝা গেল ও কারও সঙ্গে কথা বলছে। আর মাঝে-মধ্যেই প্রথমদিনের মতো তুই-তোকারি করে মন্তব্য করতে লাগল। তখনও আমরা বুঝতে পারিনি মাম্পি ঠিক কাকে তুই-তোকারি করছে—ওকে, না আমাকে। সেটা বোঝা গেল আরও কিছুদিন পর।

‘একদিন রাতে ওইরকম কথা বলতে-বলতে হঠাৎই ও বলল, ”পিনু যে লুকিয়ে নন্দা নামে ইস্কুলের ওই দিদিমণির সঙ্গে প্রেম করে সে আমি বহু আগেই টের পেয়েছি।” এ-কথা শুনে ও একেবারে চমকে উঠল—’ প্রমথেশের দিকে ইশারা করলেন মাধুরী। তারপর মাথা সামান্য হেঁট করে বললেন, ‘পিনু আমার হাজব্যান্ডের ডাক নাম।’

প্রিয়নাথ সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন। কয়েকবার ঘন-ঘন টান দিয়ে সিগারেটটা শেষ করে ফেললেন। সিগারেটের টুকরোটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন, ‘মাম্পি কি তা হলে ওই ঘোরলাগা অবস্থায় আপনার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলে?’

উত্তরে শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রমথেশ। বেশ হতাশ

ভঙ্গিতে বললেন, ‘হ্যাঁ—ঠিকই ধরেছেন। কারণ, বয়েসকালে নন্দা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার ইয়ে—মানে, একটা অ্যাফেয়ার ছিল। মেয়েটি পাড়ার করপোরেশন স্কুলে পড়াত। একেবারেই ছেলেমানুষি ব্যাপার।’ বিষণ্ণ হাসলেন প্রমথেশ : ‘কী বলব বলুন! মাম্পি এই টাইপের আরও সব এমন-এমন কথা বলছে যে, মাধুরীর সঙ্গে আমার রিলেশানটাই বিষিয়ে যাচ্ছে। আপনিই বলুন, এইসব পুরোনো ইস্যুর জের টেনে অশান্তি করার কোনও মানে হয়! নিজেকে আমার ভীষণ অকওয়ার্ড লাগছে। একে তো বিজনেসের টেনশান—তার ওপরে এই বাড়তি অশান্তি। বলুন তো কার ভালো লাগে!’

এ-ধরনের কথায় প্রিয়নাথ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলেন। তাই লৌকিক ব্যাপার থেকে অলৌকিক প্রসঙ্গ ফিরিয়ে নিয়ে এলেন।

‘তার মানে আপনার মায়ের প্রেতাত্মা আপনার মেয়েকে ডিসটার্ব করছে?’ প্রমথেশকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন প্রিয়নাথ।

‘এ ছাড়া আর কী বলব বলুন! অস্বীকার করার তো কোনও পথ নেই…।’

‘আপনার মা মাম্পিকে খুব ভালোবাসতেন?’

উত্তর দিলেন মাধুরী : ‘প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। বলতেন, ”মাধুরী, ও তোমারও মেয়ে, আমারও মেয়ে। ভাগ্যচক্রে আমার নাতনি হয়ে জন্মেছে।” মাম্পিকে ছেড়ে মা একটা মিনিটও থাকতে পারতেন না। প্রায়ই বলতেন, ”মায়ার টান বড় সাঙ্ঘাতিক। কিছুতেই ছেড়ে যেতে দেয় না।” শেষ দিকটায় মা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতেন না। উনি বুঝতে পেরেছিলেন, সময় ফুরিয়ে এসেছে। তাই এ-কথাটা আরও বেশি করে বলতেন। আর…আর মারা যাওয়ার ঠিক আগে মা বলেছিলেন…।’

মাধুরী কথা শেষ না-করে চুপ করে গেলেন।

‘কী বলেছিলেন?’ প্রিয়নাথ আগ্রহ চেপে রাখতে পারছিলেন না। শিকারের গন্ধ-পাওয়া চিতাবাঘের মতো ভেতরে ভেতরে ছটফটিয়ে উঠছিলেন।

মাধুরী আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। নীরব প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন

যেন : বলব, নাকি বলব না?

প্রমথেশ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘তুমি বলো—আমি কিছুই মাইন্ড করব না। বাচ্চাটাকে তো যে-করে-হোক বাঁচাতে হবে!’

শাড়ির আঁচলটা সামান্য ঠিক করে নিয়ে মাধুরী বললেন, ‘মারা যাওয়ার ঠিক আগে মা বলেছিলেন, ”মাম্পিকে ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে। দেখো, মাধুরী, এই মায়ার টান আমাকে কিছুতেই তোমাদের ছেড়ে যেতে দেবে না। আবার আমাকে ফিরিয়ে আনবে…মায়ার টান আবার আমাকে ফিরিয়ে আনবে…তোমরা দেখো…।” ‘

মাধুরী হঠাৎই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।

প্রমথেশ ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, মাধুরী ছোট্ট একটা রঙিন রুমাল চোখে চেপে ধরে হাত তুলে স্বামীকে ব্যস্ত না-হতে ইশারা করলেন।

প্রিয়নাথ আর প্রমথেশ অপেক্ষা করতে লাগলেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাধুরী চোখ মুছে সহজ হলেন। দু-একবার নাক টেনে তারপর সামান্য ধরা গলায় অনুনয় করে বললেন, ‘আমাদের বাচ্চা মেয়েটাকে আপনি বাঁচান, প্রিয়নাথবাবু। অনেক আশা নিয়ে আমরা আপনার কাছে এসেছি।’

প্রিয়নাথ গম্ভীর হয়ে খানিকক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘দেখি চেষ্টা করে। আচ্ছা, আপনারা কি মাম্পির কথাবার্তা টেপ করেছেন?’

‘হ্যাঁ, করেছি—’ উত্তর দিলেন প্রমথেশ, ‘ঘটনাটা শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই টেপ করার চিন্তাটা আমার মাথায় আসে। তখন আমি একটা ক্যাসেটে মাম্পির কথাবার্তা টেপ করি—মানে, একটানা পারিনি—একটু স্ক্যাটার্ডভাবে টেপ করতে পেরেছি। তাতে মাম্পির দু-চারদিনের কথাবার্তার টুকরো ধরা আছে। স্ক্যাটার্ড হলেও ব্যাপারটা বেশ বোঝা যায়। আর…আর টেপটা প্লে-ব্যাক করে শুনলে কেমন যেন ভয়-ভয় করে। মাধুরী তো একদিন চিৎকার করে উঠেছিল।’

‘মাম্পিকে আমার দেখা দরকার…ওর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার।’

‘অফ কোর্স!’ জোর দিয়ে বললেন প্রমথেশ, ‘আপনি চাইলে এখনই আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন—আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।’

একপলক ভেবে প্রিয়নাথ বললেন, ‘না, এক্ষুনি হবে না। আমি বরং কাল বিকেলে আপনাদের বাড়িতে যাব। আপনি অ্যাড্রেসটা আমাকে দিয়ে যান—।’

‘তার কোনও দরকার নেই। কাল পাঁচটায় আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। তাতে কাজটা সহজ হয়ে যাবে।’

প্রিয়নাথ মাথা নাড়লেন : ‘ঠিক আছে। আমি তৈরি হয়ে থাকব।’

মাধুরী চোখের ইশারায় স্বামীকে কিছু বলতে চাইছিলাম। সেটা লক্ষ করে প্রমথেশ একটু ইতস্তত করে প্রিয়নাথকে বললেন, মিস্টার জোয়ারদার, আপনাকে কী…মানে, আপনার ফিজটা…অ্যামাউন্টটা যদি কাইন্ডলি বলেন…।’

হাসলেন প্রিয়নাথ। বললেন, ‘ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। যদি মাম্পিকে নরমাল করে দিতে পারি তা হলে দু-হাজার টাকা দেবেন।’

প্রমথেশ প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাতে যাচ্ছিলেন, প্রিয়নাথ বললেন, ‘উঁহু, পেশেন্টকে সারাতে না পারলে আমি টাকা নিই না।’

অপ্রস্তুত হাসি হাসলেন প্রমথেশ আর মাধুরী। তারপর আরও বারকয়েক অনুরোধ-অনুনয় করে উঠে পড়লেন।

ওঁদের সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন ভূতনাথ। সামান্য ঠান্ডা বাতাস ওঁর মুখ-চোখ ছুঁয়ে গেল। বুঝতে পারলেন, শীত বেশ কিছুদিন হল চলে গেলেও এখনও পুরোপুরি মায়া কাটাতে পারেনি।

মায়া বড় অদ্ভুত জিনিস।

‘ঠাম্মা—।’

‘কী বল।’

‘তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’

‘পাগল!’ অদ্ভুত খলখল হাসি : ‘তোকে ছেড়ে কখনও যেতে পারি।’

‘তুমি কোথায়?’

‘সোনামণি আমার, আমি তো তোর ভেতরেই আছি। তোর আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। শঙ্খ-লাগা সাপ যেমন একটা আর-একটাকে জড়িয়ে থাকে, আমি ঠিক সেরকম করে তোর আত্মাকে জড়িয়ে আছি।’ আবার আকুল অট্টহাসি। যেন কেউ হেসে কুটিকুটি হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

তারই মধ্যে শোনা গেল এক ভয়ের আর্তচিৎকার। তারপরই কান্না। কান্না-ভাঙা গলায় মাধুরী চেঁচিয়ে বললেন, ‘মা! মা! আপনি মাম্পিকে ছেড়ে দিন! আপনার দুটি পায়ে পড়ি, আমার মেয়েটাকে বাঁচান! দোহাই আপনার…।’

উত্তরে রক্ত-হিম-করা হাসি শোনা গেল। যেন বহু উঁচু জলপ্রপাত থেকে জলের বদলে রাশি-রাশি ভাঙা কাচের টুকরো গড়িয়ে পড়ছে।

তারপর আর কোনও শব্দ নেই।

প্রিয়নাথ জোয়ারদার টেপ রেকর্ডার বন্ধ করলেন। আপনমনেই নানা কথা ভাবছিলেন তিনি। টেপের সব কথাবার্তাই মাম্পির গলায়। তবে ঠাকুমার সংলাপগুলো বলার সময় অদ্ভুত এক বুড়োটে ঢং ফুটে উঠেছে। আর হাসিটা? একটা বাচ্চা কি সত্যিই ওভাবে হাসতে পারে?’

প্রিয়নাথের মুখোমুখি বসে ছিলেন প্রমথেশ আর মাধুরী—প্রমথেশ একটি সুদৃশ্য মোড়ায়, আর মাধুরী বিছানায়। বিছানার একপাশে দাঁড়িয়ে সাবিত্রী। পরনে রঙিন শাড়ি। গায়ের রং ময়লা। বয়েস পঁয়তিরিশ-ছত্তিরিশ হবে। লম্বাটে মুখ, গাল সামান্য বসা, চোখের নজরে সতর্ক ভাব।

ওঁরা গেস্টরুমে বসে কথাবার্তা বলছিলেন। সামনের টেবিলে প্রমথেশদের একশো ওয়াট বিপিএল টেপরেকর্ডার।

প্রিয়নাথ ওঁর ঝোলাব্যাগ নিয়ে ঠিক সময়েই এসে পৌঁছেছেন। ঝোলাব্যাগে রয়েছে প্রেত-পিশাচ ইত্যাদির তদন্তের নানারকম যন্ত্রপাতি আর হাতিয়ার। মাধুরী জানিয়েছেন, মাম্পি এখনও ঘুমোচ্ছে—তবে একটু পরেই উঠে পড়বে। তখন প্রিয়নাথ ওকে দেখতে পারবেন। সেইজন্যই প্রিয়নাথ শুরুতেই প্রমথেশের রেকর্ড করা ক্যাসেট শুনতে বসে গেছেন।

ক্যাসেটের প্রথম অংশটা শোনার পর প্রিয়নাথ ভাবতে বসলেন।

ব্যাপারটাকে কি ‘ভূতে-ধরা’ গোছের বলা যায়? ইংরেজিতে এ-ধরনের ব্যাপারকে ‘পোল্টারগাইস্ট ফেনোমেনন’ বলে। মাম্পির ঠাকুমা তো মাম্পিকে খুব ভালোবাসতেন। তা হলে বাচ্চাটাকে তিনি এ-ভাবে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? এমন কি হতে পারে যে, বাচ্চাটার কষ্ট তিনি বুঝতে পারছেন না! তা নইলে বাচ্চাটার আত্মার সঙ্গে নিজের প্রেতাত্মাকে তিনি কেন জড়িয়ে রাখতে চাইছেন?

‘আপনার মায়ের কোনও ফটো থাকলে আমাকে দিন।’ প্রমথেশকে লক্ষ্য করে বললেন ভূতনাথ।

প্রমথেশ তাকালেন সাবিত্রীর দিকে : ‘সাবি, বেডরুমের বড় বাঁধানো ফটোটা নিয়ে আয়।’

সাবিত্রী চলে গেলেন।

এবং ফিরে এলেন একটু পরেই। হাতে প্রমাণ মাপের বাঁধানো একটা ফটো।

ফটোটা টেবিলে চিত করে নামিয়ে রাখতেই ভূতনাথের সেদিকে চোখ গেল। তিনি যেন সম্মোহিতের মতো ফটোটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফটোর নীচে নাম লেখা : নয়নপ্রভা নাহা। আর তার দু-পাশে জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ।

বছর সত্তর-বাহাত্তরের এক বৃদ্ধা উজ্জ্বল চোখে প্রিয়নাথকে দেখছেন। তাঁর মাথায় শোনপাপড়ির মতো ধবধবে সাদা অঢেল চুল। ফরসা কপালে বাঁদিকে একটা কালো আঁচিলের মতন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।

সব মিলিয়ে বৃদ্ধাকে কেমন যেন জীবন্ত বলে মনে হচ্ছিল।

ঝোলাব্যাগ থেকে আতসকাচটা বের করে ফটোটার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন প্রিয়নাথ। ওটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে আতসকাচটা ঝোলাব্যাগে ঢুকিয়ে মাধুরীকে জিগ্যেস করলেন, ‘এই ফটোটা আপনাদের বেডরুমে থাকে?’

মাধুরী মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন।

প্রিয়নাথ ফটোটা সাবিত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা আবার জায়গামতো টাঙিয়ে দিন।’

সাবিত্রী ফটো নিয়ে চলে গেলেন।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই পাশের কোনও ঘর থেকে বাচ্চার কান্না ভেসে এল।

মাধুরী উঠে দাঁড়ালেন : ‘আমি যাই। মাম্পি উঠে পড়েছে। ওকে খাওয়াতে হবে।’

মাধুরী চলে যেতেই প্রিয়নাথ আবার টেপ চালু করলেন। কিছুক্ষণ খালি টেপ চলার ঘসঘস শব্দ হল। তারপরই মাম্পির গলা পাওয়া গেল।

‘ঠাম্মা, ঠাম্মা, তুমি কী করছিলে?’

‘অন্ধকারে এক্কা-দোক্কা খেলছিলাম?’

‘কার সঙ্গে?’

‘তুই চিনবি না—অন্ধকার-অন্ধকার সব লোকজনের সঙ্গে।’

‘আমি মায়ের সঙ্গে খেলা করি।’

‘তোর মা বাজে।’

‘কেন?’

‘তোর বাবাকে নিয়ে সবসময় দরজা বন্ধ করে দেয়। ভাবে আমি কিছু বুঝি না! আমার দিকে কোনও খেয়াল নেই, শুধু নিজেদের ফুর্তি। দিন-রাত শুধু ওই নিয়েই ব্যস্ত। পিনুকে আমি চিনি না! ওর জীবনে অনেক নোংরা-নোংরা ব্যাপার আছে। সেই যে ওই স্কুলের দিদিমণি…।’

‘না, আমার মা-বাবা ভালো।’

‘মোটেই না! তোমার মা-বাবা বাজে, বাজে, বাজে! তোমার ঠাম্মা খুব ভালো। সোনামণি লক্ষ্মীটি আমার। তোমার ঠাম্মা খুব ভালো, খুব ভালো খুব ভালো…।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ। ঠাম্মা ভালো। মা বাজে। বাবা বাজে। পিসি বাজে। সবাই বাজে। শুধু ঠাম্মা ভালো।’

‘ভালো…ভালো…ভালো।’

তারপরই মাম্পির গলায় কান্না শোনা গেল। তবে শুনে মনে হচ্ছিল, কোনও বৃদ্ধা যেন ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

তারপর সব চুপচাপ।

প্রমথেশ মাথা নীচু করে বসেছিলেন। প্রিয়নাথ টেপ বন্ধ করে বললেন, ‘আরও যে রেকর্ড করেছেন সেসব কথাবার্তা কী টাইপের?’

হতাশ ভঙ্গিতে হাত উলটে প্রমথেশ বললেন, ‘ওই একই টাইপের। ছলছুতো পেলেই আমাকে আর মাধুরীকে অপদস্থ করার চেষ্টা। অথচ বিশ্বাস করুন, মায়ের জন্যে আমরা কী না করেছি!’

প্রিয়নাথ হাত নেড়ে প্রমথেশকে শান্ত করতে চাইলেন : ‘আত্মা আর প্রেতাত্মায় অনেক তফাত আছে, প্রমথেশবাবু। কেউ লোক ভালো হলেই তার প্রেতাত্মা ভালো হয় না। এরকম বহু গরমিল আমি দেখেছি। আপনার মায়ের প্রেতাত্মা কিন্তু আপনার মা নন—এটা মনে রাখবেন!’ টেপরেকর্ডারের বোতাম টিপে ক্যাসেটটা বের করলেন : ‘এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। কাজ হয়ে গেলে ফেরত দেব। এবারে চলুন, মাম্পির সঙ্গে একটু দেখা করি—।’

প্রমথেশদের বেডরুমের দরজায় পা দিয়েই প্রথমাকে এই প্রথম দেখলেন প্রিয়নাথ।

বিছানার ওপরে মায়ের কোলে বসে ছিল মাম্পি। পশ্চিমের জানলা দিয়ে অবাধ্যভাবে ঢুকে পড়া মরণাপন্ন সূর্যের কমলা রং ওর মুখে-গালে-মাথায় মাখামাখি। ওর মিষ্টি মুখ, ডাগর চোখ, আর ফুলো-ফুলো গাল যে-কোনও রত্নাকরকে পলকে বাল্মীকি করে দিতে পারে। এক বছরের এই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে প্রিয়নাথ তক্ষুনি ওর প্রেমে পড়ে গেলেন। এই মেয়েটির আত্মার সঙ্গে ওর ঠাকুমার প্রেতাত্মা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে এ-কথা ভাবলেই কেমন গা শিরশির করে ওঠে। সন্ধ্যা ছুঁই-ছুঁই গোধূলির আলোয় প্রিয়নাথ হঠাৎই শিউরে উঠলেন।

নিজেকে সামলে নিয়ে মাম্পিকে আদর করে ডাকলেন, ‘মাম্পি সোনা…মাম্পি…প্রথমা…।’

বাচ্চাটা মায়ের কোলে বসে-বসেই ঘাড় ফেরাল প্রিয়নাথের দিকে। আর ঠিক তখনও ওর মাথায় একটা অদ্ভুত জিনিস প্রিয়নাথের নজরে পড়ল। সূর্যের আলো মরে এলেও ভূতনাথের দেখতে কোনও ভুল হল না।

মাধুরীকে ইশারা করে তিনি মেয়েটাকে কাছে নিয়ে আসতে বললেন। মাধুরী বসে-বসেই মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে এলেন বিছানার কিনারায়।

প্রিয়নাথ বাচ্চাটার মাথা বেশ ভালো করে দেখলেন।

না, তিনি ভুল দেখেননি। মাম্পির মাথায় দু-গাছা শনের মতো সাদা চুল চিকচিক করছে। এরকম লম্বা সাদা চুল ওর মাথায় কেমন করে এল!

‘ওর মাথার এই পাকা চুল দুটো আপনারা খেয়াল করেননি?’

প্রিয়নাথের প্রশ্নের উত্তরে মাধুরী মেয়ের মাথার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। প্রমথেশ আর সাবিত্রী তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলে এলেন মাম্পির কাছে। ওঁরা তিনজনে অবাক হয়ে লম্বা সাদা চুল দুটো দেখতে লাগলেন।

মাধুরী ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘কখন এই চুল দুটো এল!’

তারপর সবাই চুপচাপ। শুধু মাম্পি হাত-পা নেড়ে অর্থহীন সব শব্দ করছিল।

ঘর অন্ধকার হয়ে আসছিল। সাবিত্রী আলো জ্বেলে দিলেন। ঠিক তখনই ঘরের ইলেক্ট্রনিক ঘড়ি মিষ্টি শব্দ করে জানিয়ে দিল ছ’টা বাজে।

মাম্পির তিনজন অভিভাবক ফ্যাকাসে মুখে প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্তভাবে অপেক্ষা করছিলেন। প্রিয়নাথের চোখ একবার মাম্পিকে দেখছিল, আর-একবার দেওয়ালে টাঙানো নয়নপ্রভার ফটোর দিকে দেখছিল। বৃদ্ধা কি চাইছেন তাঁর শরীরের ছায়া মাম্পির ওপরে পড়ুক? দু-গাছা সাদা চুল দিয়েই কি তার শুরু?

সাবিত্রী প্রায় ফিসফিস করে উচ্চারণ করলেন, ‘কী হবে এখন!’

প্রিয়নাথ যেন আপনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, ‘আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আজ রাতেই একবার চেষ্টা করে দেখি…।’

মাধুরী প্রিয়নাথকে জিগ্যেস করলেন, ‘পাকা চুল দুটো তুলে দেব?’

প্রিয়নাথ তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, ‘না, না—একদম না! আমাদের কপাল ভালো হলে ওগুলো নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবে।’

তারপর প্রিয়নাথ কিছুক্ষণ সময় কাটালেন মাম্পির সঙ্গে। ওকে আদর করলেন, ওর সঙ্গে কথা বললেন।

ওঁরা তিনজন ভূতনাথের এই আচরণে একটু অবাক হলেন। কিন্তু প্রিয়নাথ আসলে নিজের ভেতরের টেনশানটা কাটাতে চেষ্টা করছিলেন।

একটু পরে তিনি বললেন, ‘আজ রাতে আমরা সবাই এ-ঘরে থাকব। একটা টেবিল আর চারটে চেয়ারের ব্যবস্থা করুন। তারপর আপনাদের সঙ্গে কিছু কথা আছে।’

প্রমথেশ সাবিত্রীকে বললেন সব ব্যবস্থা করতে।

এমন সময় বেডরুমের দেওয়াল-তাকে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। প্রমথেশ তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোন ধরলেন, কথা বললেন।

প্রিয়নাথ মাধুরীকে জিগ্যেস করলেন, ‘মারা যাওয়ার পর নয়নপ্রভাকে আপনারা কখনও দেখেছেন?’

মাধুরী মাম্পিকে মেঝেতে ছেড়ে দিয়ে স্বামীর দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন।

প্রমথেশের কথা বলা হয়ে গিয়েছিল। রিসিভার নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, ‘একবারই মাত্র দেখেছিলাম। দিন-দশ-বারো আগে মাঝরাতে হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না। তখন একটা সিগারেট ধরিয়ে ওই জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎই মাকে দেখতে পেলাম। সাদা থান-পরা একটা ছায়া যেন অন্ধকারে শূন্যে ভাসছে। তবে স্পষ্ট করে দেখতে পাইনি। একটা কালো রঙের বিশাল ফ্যানের ব্লেড যেন মায়ের সামনে ধীরে-ধীরে ঘুরছিল। তার আড়াল দিয়ে আমি মাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। মায়ের ধবধবে সাদা চুল বাতাসে উড়ছিল। হঠাৎই মা দু-হাত সামনে বাড়িয়ে দিল—যেন কোনও বাচ্চাকে কোলে নিতে চাইছে। তারপরই ছবিটা মিলিয়ে গেল। সেটাও বেশ পিকিউলিয়ারভাবে। যেন পাউডার দিয়ে কেউ মায়ের ছবিটা তৈরি করেছিল। হঠাৎ করে জোরে ফুঁ দিয়ে পাউডারের গুঁড়োগুলো উড়িয়ে দিল বাতাসে।’

প্রমথেশ থামলেন।

মাম্পি টলোমলো পায়ে মেঝেতে হাঁটতে চেষ্টা করছিল। থেকে-থেকেই মায়ের শাড়ি খামচে ধরছিল।

প্রিয়নাথ অবাক চোখে বাচ্চাটাকে দেখছিলেন। ওকে নিয়েই যত গোলমাল যত কাণ্ড—অথচ ওর কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই।

সাবিত্রী কাজের লোকদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। টেবিল-চেয়ার ঠিকমতো সাজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই আবার চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে ফিরে এলেন। সেগুলো টেবিলে রেখে প্রমথেশকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘দাদা, তোমরা চা খেতে-খেতে কথা বলো।’ তারপর প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে : ‘আপনি আজ আমাদের এখানে খাবেন—আর রাতে তো থাকছেনই। গেস্ট-রুমে আপনার শোওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’

প্রমথেশ হেসে বললেন, ‘শুধু আজ কেন! যদি দরকার মনে করেন তা হলে পাঁচ-সাত দিনও থাকতে পারেন। উই ডোন্ট মাইন্ড অ্যাট অল।’

প্রিয়নাথ বেশ চিন্তিতভাবে বললেন, ‘কে জানে, ব্যাপারটা আজ রাতে মিটবে কি না!’

সাবিত্রী বোধহয় রান্নাবান্নার তদারকি করতে চলে গেলেন। মাধুরী ওঁকে বললেন, ‘তুমি যাও, আমি একটু কথা বলেই যাচ্ছি—।’

চা খেতে-খেতে নয়নপ্রভা সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন মাধুরী আর প্রমথেশ। প্রিয়নাথ মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। ঝোলাব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে মাঝে-মাঝে নোট নিলেন। তারপর চায়ের পাট চুকলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘চলুন, নয়নপ্রভা দেবীর ঘরটা একবার দেখে আসি।’

প্রমথেশ মাধুরীর দিকে তাকালেন।

মাধুরী বললেন, ‘মা সাবিত্রীর সঙ্গে থাকতেন। মা চলে যাওয়ার পর ও-ঘরে সাবিত্রীই একা থাকে। ওখানে তো মায়ের চিহ্ন বলতে সেরকম কিছু নেই—শুধু পুরনো আমলের একটা কাঠের আলমারি ছাড়া…।’

প্রিয়নাথ তবু যেতে চাইলেন।

মাধুরী স্বামীকে বললেন, ‘তুমি মাম্পিকে দেখো—আমি ওঁকে ঘরটা দেখিয়ে নিয়ে আসছি।’

মাধুরী প্রিয়নাথকে নিয়ে চলে গেলেন সাবিত্রীর ঘরের দিকে।

কিন্তু সেখানে প্রিয়নাথকে হতাশ হতে হল। মনে দাগ কাটার মতো নতুন কিছুই চোখে পড়ল না।

সুতরাং একটু পরেই ওঁরা দুজনে ফিরে এলেন। প্রমথেশ মাম্পিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রিয়নাথ ফিরে আসামাত্রই জানতে চাইলেন, ‘কিছু পেলেন?’

প্রিয়নাথ সিগারেটে আলতো টান দিয়ে বললেন, ‘নাঃ…।’ তারপর মাম্পির কাছে এগিয়ে এসে ওর গাল টিপে দিয়ে বললেন, ‘আজ রাত দশটা নাগাদ আমরা ওই টেবিল ঘিরে বসব। মাধুরী দেবী,’ মাধুরীর দিকে ফিরে তাকালেন ভূতনাথ, ‘আপনার শাশুড়ির ছবিটা আমি দেওয়াল থেকে নামাচ্ছি। ওটা টেবিলে একটা পাশ ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে রাখব। ওঁর ওপরে কনসেনট্রেট করার জন্যে ছবিটা দরকার।’

ছবিটা দেওয়াল থেকে খুলে নিলেন প্রিয়নাথ। বৃদ্ধার তীব্র চোখ প্রিয়নাথকে যেন বিদ্ধ করল।

কয়েক ঘণ্টা পর অন্ধকারে বসেও প্রিয়নাথকে বৃদ্ধার তীব্র দৃষ্টির চাপ সহ্য করতে হচ্ছিল। কারণ, টেবিলে দাঁড় করানো ছবির ওপরে প্রিয়নাথের টর্চ একটা আলোর বৃত্ত এঁকে দিয়েছিল। আর ওঁরা চারজন হাতে হাত ধরে একমনে নয়নপ্রভার কথা ভাবছিলেন।

অন্ধকারে ওঁদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পশ্চিমের খোলা জানলা দিয়ে মরা চাঁদের আলো আর বাতাস ঢুকে পড়ছিল ঘরের ভেতরে।

টেবিল ঘিরে বসার আগে প্রিয়নাথ কয়েকটা কথা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মাধুরী, প্রমথেশ ও সাবিত্রীকে।

‘আমি যা বলব সেটা অক্ষরে-অক্ষরে মানতে হবে। এর যেন একফোঁটা নড়চড় না হয়। কেউ কোনও কথা বলবেন না, বা আননেসেসারি কোনও আওয়াজ করবেন না। আর সবাই একমনে নয়নপ্রভার কথা ভাববেন—যেন উনি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই। যদি আচমকা নয়নপ্রভার প্রেত-শরীর ঘরে দেখা দেয় তা হলে আপনারা যেন ভয় পেয়ে চিৎকার-টিৎকার করবেন না। তাতে কাজের অসুবিধে হবে। আর লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল ইনস্ট্রাকশন হল : কোনও অবস্থাতেই চেয়ার ছেড়ে কেউ উঠবেন না।’

কথাগুলো বলার সময় প্রিয়নাথকে কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছিল। এতক্ষণ দেখা নিপাট ভদ্রলোক-ভদ্রলোক চেহারাটা বদলে গিয়ে জেগে উঠল আত্মবিশ্বাসে টগবগ করা প্রেতসিদ্ধ এক নিষ্ঠুর মানুষ।

মাধুরীর কেমন ভয়-ভয় করছিল। চেয়ারে বসে বারবার চোখ ফেরাচ্ছিলেন বিছানার দিকে। মাম্পি সেখানে অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে। ওকে অন্য ঘরে রেখে আসতে চেয়েছিলেন মাধুরী, কিন্তু প্রিয়নাথ আপত্তি করেছেন। বলেছেন, ‘মাম্পি এই ঘরে না থাকলে প্রেতচক্র বসানোর কোনও মানেই হয় না।’

সাবিত্রীও ভয় পাচ্ছিলেন। তবে যা কিছু করা হচ্ছে সবই মাম্পির ভালোর জন্য—এই বলে মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলেন।

প্রমথেশের মনে খানিকটা আশঙ্কা যে ছিল না তা নয়। তবে তার চেয়ে বেশি হচ্ছিল কৌতূহল। তাঁর যুক্তিবাদী মন অবাক কৌতূহল নিয়ে বিচিত্র মানুষটার বিচিত্র কার্যকলাপ লক্ষ করছিল।

ইলেকটনিক পেন্ডুলাম ঘড়ির শব্দে অসুবিধে হবে বলে ঘড়ির ব্যাটারিগুলো খুলে রাখতে চেয়েছিলেন প্রিয়নাথ। তখন প্রমথেশ বলেছেন, তার দরকার নেই। কারণ, ঘড়ির ঘণ্টার শব্দটা লাইট অ্যাকটিভেটেড। ঘরের আলো জ্বললে ঘণ্টা বাজে, নইলে নয়।

ঝোলাব্যাগ হাতড়ে দুটো মোমবাতি বের করে ঘরের এক কোণে সে-দুটো জ্বেলে দিলেন প্রিয়নাথ। একটা খড়ির ডেলা বের করে টেবিলে একটা ত্রিভুজ এঁকে সেই ত্রিভুজের মাঝখানে একটা বড়সড় কড়ি বসিয়ে দিলেন। তারপর ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিলেন।

আবছা আঁধারে চেয়ারে এসে বসলেন প্রিয়নাথ। ঝোলাব্যাগ থেকে একটা সরু টর্চ বের করে জ্বাললেন। জ্বলন্ত টর্চটা টেবিলে এমনভাবে রাখলেন যাতে আলোর বৃত্তটা সরাসরি নয়নপ্রভার মুখের ওপরে গিয়ে পড়ে। তারপর বিড়বিড় করে মন্ত্রের মতো কীসব আওড়াতে শুরু করলেন।

মন্ত্র পড়া শেষ হলে প্রিয়নাথ চাপা গলায় বললেন, ‘স্টার্ট। আর কেউ কোনও কথা বলবেন না।’

অন্ধকারে প্রেতচক্র শুরু হল।

চুপচাপ বসে নয়নপ্রভাব কথা ভাবতে-ভাবতে সময়ের হিসেব যখন গুলিয়ে গেছে ঠিক তখনই একটা শব্দ হল। তারপর আবার…আবার।

টেবিলের ওপরে রাখা কড়িটা নড়ছে।

সবার কেমন শীত-শীত করে উঠল। প্রিয়নাথ থার্মোমিটারে না দেখেই বুঝলেন ঘরের উষ্ণতা কমছে। সেইসঙ্গে জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া বাতাসও কেমন যেন উদ্দাম মাতাল হয়ে উঠল।

হঠাৎই মাম্পি কেঁদে উঠল।

প্রিয়নাথের বাঁদিকে বসেছিলেন মাধুরী। প্রিয়নাথ টের পেলেন, ওঁর হাত কেমন যেন শক্ত হয়ে গেছে।

আরও কয়েকবার কাঁদল মাম্পি। তারপর বড়দের মতো গলায় বলে উঠল, ‘পিনু, তোরা কী চাস?’

প্রিয়নাথের ডানদিকে বসা প্রমথেশ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। সেটা বুঝতে পেরে প্রিয়নাথ ওঁর হাতে চাপ দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে টর্চটা নিভে গেল।

এতক্ষণ একটা আলোর আভা আবছাভাবে ঘরময় ছড়িয়ে ছিল। এখন সেই আলোকে ঝাঁট দিয়ে কেউ যেন জড়ো করে দিল মোমবাতিগুলোর কাছে।

প্রশ্নটা ভেসে এল আবার : ‘তোরা কী চাস?’

এবার জবাব দিলেন ভূতনাথ, ‘মাম্পিকে ফেরত চাই।’

‘তুই কে?’ মাম্পির গলায় যেন সন্দেহের বিষ ঝরে পড়ল।

‘আমি ভূতনাথ। মাম্পিকে ফেরত নিতে এসেছি।’ বজ্রস্বরে বললেন প্রিয়নাথ।

‘আ-হা! আহ্লাদ!’ ব্যঙ্গ করে উঠল কণ্ঠস্বর। তার পরই শুরু হল খলখল হাসি।

প্রিয়নাথ বিছানায় শোয়া মাম্পির দিকে দেখলেন। বাচ্চাটা নিথর হয়ে ঘুমোচ্ছে।

মাধুরী আর কান্না চাপতে পারছিলেন না। সাবিত্রী থরথর করে কাঁপছিলেন।

হাসি থামলে পর শোনা গেল : ‘মাম্পিকে আমি ছাড়তে পারব না—ওর ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে। মায়ার টান কি সহজে কাটানো যায়!’

আচমকা প্রিয়নাথ মাধুরী আর প্রমথেশের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দু-হাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে বললেন, ‘মাম্পি মানুষ—আর তুই পিশাচ। পিশাচের আবার মায়ার টান কীসের! তোর টানে মাম্পি খতম হয়ে যাবে। মাম্পিকে তুই ছেড়ে দে!’

‘আ-হা! ছেড়ে দে বললেই হল!’ ব্যঙ্গের ধারালো টান ফুটে উঠল কণ্ঠস্বরে। তারপর একটু হেসে : ‘পিনু, এই লোকটাকে বাড়ি থেকে বের করে দে!’

প্রমথেশ আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। কাতর গলায় বলে উঠলেন, ‘মা, তোমার জন্যে আমরা শেষ হয়ে গেলাম…আমরা সব্বাই শেষ হয়ে গেলাম…।’

মাধুরী এবার জোরে কেঁদে উঠলেন।

‘মায়ার টান রে, মায়ার টান! আমি কী করি বল!’ প্রেত-কণ্ঠস্বর স্নেহ-মাখা গলায় বলল।

প্রিয়নাথ হাত-পা ছুড়ে প্রায় উন্মত্তের মতো লাফিয়ে উঠলেন। ওঁর শরীরের ধাক্কায় চেয়ারটা পিছনে উলটে পড়ে গেল। খোলা জানলা দিয়ে হাড়-কাঁপানো বাতাস ধেয়ে এল। ঘরের উষ্ণতা পলকে আরও কয়েক ডিগ্রি নেমে গেল।

প্রিয়নাথ ছুটে গেলেন বিছানার কাছে। সবাইকে অবাক ঘরে ঘুমন্ত মাম্পিকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলেন। তারপর ঘরের সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে বললেন, ‘তোর মায়ার টানে ফুলের মতো এই শিশুটা দিনকে-দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তুই ওকে ছেড়ে দে! ছাড়তে তোকে হবেই! নইলে তোর নিস্তার নেই!’

প্রিয়নাথের গর্জনে মাম্পির ঘুম ভাঙল না। তবে মাধুরী আর সাবিত্রী ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুমন্ত মাম্পি খলখল করে হেসে উঠল। কানের ঠিক পাশেই হঠাৎ ওরকম হাসির শব্দ হওয়ার ভূতনাথ চমকে উঠলেন।

আর তখনই বটগাছের ঝুরির মতো অসংখ্য ধবধবে সাদা চুল নেমে এল ঘরের সিলিং থেকে। ঘূর্ণি বাতাসে শনের মতো সেই চুল এদিক-ওদিক উড়তে লাগল। কোথা থেকে এক অলৌকিক আলো ছড়িয়ে পড়ল ভেসে বেড়ানো সেই চুলের ওপরে। সেখানে রামধনুর সাত রং খেলে বেড়াতে লাগল।

চুলের তন্তুজালে প্রিয়নাথ দিশেহারা হয়ে পড়লেন। এক হাতে বাচ্চাটাকে আঁকড়ে রেখে অন্য হাতে মুখে-চোখে ঢলে পড়া সাদা চুলগুলো সরাতে চাইলেন।

মাধুরী, সাবিত্রী আর প্রমথেশ—ওঁরা তিনজনে তখন আতঙ্কে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন। অন্ধকারে চুলের মায়াজালে দিশেহারা হয়ে ওঁরা যেখানে-সেখানে ধাক্কা খেতে লাগলেন। মাধুরী আর সাবিত্রী ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন বারবার। আর তারই মধ্যে মাম্পির নাম ধরে ডাকছিলেন।

প্রমথেশ দম-বন্ধ-করা গলায় ডেকে উঠলেন, ‘মিস্টার জোয়ারদার! প্রিয়নাথবাবু!’

প্রিয়নাথ তখন রাগে পাগল হয়ে গেছেন। এক প্রেতের সঙ্গে এক প্রেতসিদ্ধের চ্যালেঞ্জ যেন চকমকি পাথরের ঠোকাঠুকি…তা থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের ফুলকি।

কয়েক লাফে প্রিয়নাথ ছিটকে চলে এলেন প্রেতচক্রের টেবিলের কাছে। মাম্পিকে টেবিলে শুইয়ে দিলেন। ঝোলাব্যাগ হাতড়ে বের করে নিলেন একটা মাঝারি মাপের ছুরি। তারপর সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বাঁ-হাতে মাম্পির চুলের মুঠি ধরে ছুরিটা ছোঁয়ালেন ওর গলায় কাছে।

হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন প্রিয়নাথ, ‘তুই যখন ওকে ছাড়বি না, তখন আমিই ওকে শেষ করে দেব!’

মাধুরী ছুটে এলেন প্রিয়নাথের কাছে। কাঁদতে-কাঁদতে ওঁর হাত চেপে ধরতে চাইলেন।

প্রিয়নাথ এক ঝটকায় ছিটকে ফেল দিলেন মাধুরীকে। ভয়ংকর গলায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘তোর হাতে তিলতিল করে মরার চেয়ে এ অনেক ভালো। এই দ্যাখ, তোর আদরের মাম্পিকে আমি খতম করে দিচ্ছি!’

মাম্পি এতক্ষণ অসাড়-অচেতন ছিল। হঠাৎই ওর মুখ দিয়ে কান্নার শব্দ বেরিয়ে এল।

প্রেত কণ্ঠস্বর কাঁদছে।

‘না! না! ওকে মারিস না। আমি ওকে বড় ভালোবাসি…ওকে মারিস না…।’

তুই যদি সত্যিই ওকে ভালোবাসিস তা হলে এই মুহূর্তে ওকে ছেড়ে দে! তোর মায়ার টানে ও শেষ হয়ে যাচ্ছে…।’

ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না শোনা গেল। সাত রঙের আঙায় রঙিন চুলের ঢল ভেসে বেড়াতে লাগল ঘরের বাতাসে। বাতাস আরও কয়েক গুণ হিম হয়ে গেল যেন।

ইনিয়েবিনিয়ে কান্নার মাঝেই শোনা গেল : ‘আমি চলে যাচ্ছি…আমি চলে যাচ্ছি…।’

আর ঠিক তখনই নয়নপ্রভাব বাঁধানো ফটোটা টেবিল থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। ঝনঝন শব্দে কাচ ভেঙে গেল।

সাবিত্রী চিৎকার করে উঠেই টাল খেয়ে পড়ে গেলেন। বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

প্রিয়নাথ লক্ষ করলেন, চুলের ঢল ক্রমে আবছা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘরের উষ্ণতা বেড়ে উঠেছে আবার।

ঘরের দরজায় কারা যেন ধাক্কা দিচ্ছিল, কিন্তু সে-শব্দ এতক্ষণ কারও কানে যায়নি।

মাম্পি হঠাৎই যেন ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল। তবে এ-কান্না কোনও বাচ্চার স্বাভাবিক কান্না।

প্রিয়নাথ ছুরিটা ফেলে দিলেন। মাম্পিকে তুলে নিয়ে মাধুরীর কোলে দিলেন।

মোমবাতির অদ্ভুত আলোয় ওঁদের ছায়া-শরীরগুলো নড়ে বেড়াচ্ছিল।

মাধুরী মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। মাম্পিকে তিনি অনেক আদরের কথা বলছিলেন কিন্তু কান্না মিশে গিয়ে কথাগুলো কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।

অবসন্ন ভূতনাথ ঘরের মেঝেতে বসে পড়লেন। ক্লান্ত ভাঙা গলায় বললেন, ‘প্রমথেশবাবু, আলো জ্বেলে দিন। আর দরজাটা খুলে দিন। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে…।’

হতভম্ব প্রমথেশ শিথিলভাবে হেঁটে গেলেন আলোর সুইচের কাছে।

তিনি আলো জ্বালতেই প্রিয়নাথের চোখ গেল মেঝেতে পড়ে-থাকা নয়নপ্রভার ছবির দিকে। সেটা দেখিয়ে প্রিয়নাথ বললেন, ‘এ-ছবিটা নষ্ট করে ফেলবেন। ওঁর কোনও ছবি বাড়িতে না রাখাই ভালো। আশা করি মাম্পিকে আর কখনও উনি বিরক্ত করবেন না।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রিয়নাথ। ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে আবার বললেন, ‘আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে…।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *