অন্ধকার রঙের কুকুর
বহু বছর আগের ঘটনা হলেও সেই সন্ধেটার কথা আমি ভুলিনি।
আমার সামনে ছিল আঁকাবাঁকা শীর্ণ নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের গাছপালা। ঝাঁকড়া গাছের পাতার ফাঁকে আগুন রঙের সূর্য ঢলে যাচ্ছিল। আর শীতের ঘোলাটে সন্ধ্যা চুপিচুপি সূর্যকে চাদর মুড়ি দিতে আসছিল।
ঠিক সেই সময়েই আমি শিসের শব্দগুলো শুনতে পেয়েছিলাম। জঙ্গলের দিক থেকে ছুটে আসা তীক্ষ্ন শব্দগুলো আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল ওরা ছুটে আসছে।
তারপরই যা হয়েছিল সে-কথা মনে পড়লেই ভয়ে আমার শরীরটা ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায় সেই মুহূর্তেই।
কী করব এখন!
এত বছর পর যখন ছোটবেলার ওই ঘটনাটার কথা ভাবি তখনও যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সেই সন্ধের দৃশ্যটা জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। হিংস্র পশুগুলোর গায়ের বুনো গন্ধ নাকে স্পষ্ট টের পাই।
তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। বয়েস কতই বা হবে! বারো আর তেরোর মাঝামাঝি। শীতের ছুটিতে বড়কদমগাছি বেড়াতে গিয়েছিলাম—আমার বড়মাসির কাছে।
বড়কদমগাছি জায়গাটা রানাঘাট থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে একটা স্কুলে আমার বড়মাসি বাংলার টিচার ছিলেন। আর বড়মেসো জমিজিরেত মাপজোখের কী একটা চাকরি করতেন যেন।
ক্লাস সিক্স থেকেই ডিসেম্বরের শেষে বড়কদমগাছি বেড়াতে যাওয়াটা নিয়মমাফিক শুরু হয়েছিল। বাপি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতেন বড়মাসি আর মেসোর কাছে। বলতেন, ‘শুধুই কি আর খেলাধুলোয় মেতে থাকবি? এই ক’দিনের ছুটিতে তোর মাসির কাছে বাংলাটাও একটু জোরদার করে নে—।’
তো বাংলা জোরদার কতটা করতাম কে জানে! তবে খেলাধুলোর ব্যাপারটায় মোটেও ফাঁকি দিতাম না। আর সেইসঙ্গে মাছ ধরা।
খেলাধুলোর আমার সঙ্গী ছিল রাহুল আর পিংকি। বড়মাসির ছেলে আর মেয়ে।
রাহুল আমার চেয়ে মাসছয়েকের ছোট। আমরা তিনজনের মিলে কী হুড়োহুড়িই না করতাম! আর মাছ ধরার নেশায় আমার মাস্টারমশাই ছিলেন বড়মেসো।
বড়কদমগাছি জায়গাটা গ্রাম হলে কী হবে, ছবির মতো সুন্দর। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। টালির চাল আর টিনের চালের মাটির বাড়িগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে এখানে-ওখানে কতরকমের ছোট-বড় গাছ।
আমরা তিনজনে ঘোর দুপুরে সেইসব গাছের আড়ালে লুকোচুরি খেলতাম, গাছের পেয়ারা, কুল, জারুল পেড়ে ইচ্ছেমতো খেতাম। আর বিকেলে রাহুলের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দল বেঁধে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠতাম।
সবমিলিয়ে দিনগুলো ছিল দারুণ।
বড়কদমগাছিতে একটিমাত্র নদী ছিল। নাম বউনি। বহুকাল আগে গ্রামের এক নতুন বউ বিয়ের সাজগোজসমেত ওই নদীতে ডুবে মারা যায়। তারপর থেকেই ওই নাম—বউনি। লোকজনের কাছেই শুনেছি, এই সরু নদীটা নাকি চুর্নি নদীতে গিয়ে মিশেছে।
বউনি নদীর এপারে আছে শ্মশান। আর ওপারটায় ঘন জঙ্গল। তাই খুব একটা কেউ নদীর দিকে যায় না। আর যদি বা যায়, তা হলে সন্ধের আগেই ফিরে আসে।
বড়মেসোর ভীষণ মাছ ধরার শখ। ছুটির দিন হলেই মেসো টোপ-বঁড়শি নিয়ে বউনির পাড়ে গিয়ে হাজির। কাপড়ের সাদা টুপি মাথায় দিয়ে নদীর পাড়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর দিনের শেষে ছ’ইঞ্চি কি আট ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একপিস মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
কিন্তু তাতেই দেখেছি মেসোর কী আনন্দ! বঁড়শিতে ধরা মাছ নিয়ে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে-গাইতে বাড়ি ফেরেন। তারপর সেই মাছ কী-কী পদ্ধতিতে রান্না করতে হবে তা নিয়ে বড়মাসিকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। তখন মাসি আর মেসোয় তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। আর আমি, রাহুল, পিংকি সেই মজার ‘আলোচনা’-র নীরব দর্শক।
মেসোর কাছেই শুনেছি ছিপের ইংরেজি ‘অ্যাংগল’, আর যারা ছিপ দিয়ে মাছ ধরে তাদের বলে ‘অ্যাংলার’।
মেসো আমাকে সবসময় বলতেন, ‘বুঝলি, মাছ ধরায় যে কী আনন্দ সেটা নিজে হাতে মাছ না ধরলে কখনও বুঝবি না। এ একটা দারুণ পজিটিভ নেশা। এতে কনসেনট্রেশান বৃদ্ধি পায়।’
সে যাই হোক, মেসোর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি একদিন মেসোর সঙ্গে চলে গেলাম বউনি নদীর তীরে। জায়গাটা স্বপ্নের মতো, তবুও কেন যেন গা-ছমছম করে।
বিশাল কয়েকটা চাষের খেত পেরিয়ে তারপর নদীটার দেখা মেলে। নদীর আঁকাবাঁকা পার ধরে আমি আর মেসো হেঁটে চললাম। এবড়োখেবড়ো জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে। শীতের সময় নদীর জল কমে এসেছে। সূর্যের আলোয় বয়ে যাওয়া জলের স্রোত চিকচিক করছে। তারই মধ্যে কয়েক জায়গায় মাছ বুড়বুড়ি কাটছে বলে মনে হল।
নদীর ওপাশে বেশ ঘন জঙ্গল। সেখানে গাঁয়ের কেউ-কেউ কাঠ কাটতে যায়। মেসো বললেন, ওই জঙ্গলে শেয়াল, ভাম, বুনো কুকুর আর ছোটখাটো জন্তুজানোয়ার আছে। ওরা সন্ধের পর বউনি নদীতে জল খেতে আসে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিশাল বটগাছের নীচে আমরা মাছ ধরতে বসলাম। মেসো আমাকে ছিপ, বঁড়শি আর টোপের ব্যাপারে নানান কথা বোঝাচ্ছিলেন। কীভাবে কেঁচোগুলো বঁড়শিতে গাঁথতে হয়, ময়ূরের লেজের পালকের সাদা ‘কাঠি’টা দিয়ে কীভাবে ফাতনা তৈরি করতে হয়, কীভাবে ছিপ বাগিয়ে জলে ভেসে থাকা ফাতনার দিকে নজর রাখতে হয়—এইসব।
আমি হাঁ করে মেসোর কথা গিলছিলাম আর ফাতনার দিকে নজর রাখছিলাম।
হঠাৎই কানে এল ‘বলো হরি, হরিবোল’ ধ্বনি। মুখ ফিরিয়ে দেখি একদল লোক ওপরের মেঠো পথ ধরে খাটিয়া বয়ে নিয়ে আসছে। আমাদের কাছ দিয়ে ওরা চলে গেল।
মেসো কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘ওইদিকে আরও খানিকটা এগিয়ে তারপর শ্মশান—’ আঙুল তুলে সেদিকটা দেখালেন: ‘ওই দিকটায় লোকজন কম যায়…।’
এরই মধ্যে কখন যেন ফাতনা নড়ে উঠেছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে ‘অ্যাংলার’ মেসো ছিপ ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছে।
তখন আমার আনন্দ আর দ্যাখে কে!
কারণ, মেসোর বঁড়শিতে তখন ছটফট করছে ফুটখানেক লম্বা একটা আস্ত রুইমাছ।
সেই মাছটাকে ঘিরে আমার কী উত্তেজনা! বেশ বুঝতে পারছিলাম, নিজের হাতে মাছ ‘শিকার’ করে বাড়ি ফেরার সময় মেসো কেন আনন্দে টগবগ করে ফুটতে থাকেন, কেন চেঁচিয়ে হেঁড়ে গলায় গান করেন।
এমনসময় জঙ্গলের মধ্যে থেকে হিংস্র গর্জন ভেসে এল।
ছটফট করা মাছটা তখন মেসো নাইলনের থলেতে ঢোকাচ্ছিলেন। থলের মুখটা চেপে ধরে মুখ তুলে নদীর ওপারে নজর দিলেন।
আমিও গর্জনের ব্যাপারটা বোঝার জন্যে জঙ্গলের ওপরে চোখ বোলাতে লাগলাম।
হঠাৎই একপাল কুকুর বেরিয়ে এল গাছপালার আড়াল থেকে। গুনে দেখলাম পাঁচটা। ওরা একটা কুকুরকে তাড়া করে ঘিরে ফেলেছে। কুকুরটার রং হালকা বাদামি আর সাদা। তার ওপরে ছোপগুলো যে রক্তের দাগ সেটা নদীর এপার থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
আমি মেসোকে বললাম, ‘ওই কুকুরটা নিশ্চয়ই অন্য এলাকার—তাই ওই কুকুরগুলো ওকে অ্যাটাক করেছে।’
বড়মেসো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ভয়ের গলায় বললেন, ‘কুকুর নয় রে, বুনো কুকুর। এখানকার মানুষরা ঢোল বলে। দেখছিস না, সবক’টা একইরকম দেখতে—।’
সত্যিই তাই। পাঁচটা বুনো কুকুরই একইরকম দেখতে। গায়ের রং গাঢ় বাদামি। মুখটা ছুঁচলো। লেজটা সাধারণ কুকুরের চেয়ে বেশ মোটাসোটা। আর লেজের ডগায় কালো ছোপ।
এরপর চোখের সামনে যা হল তা দেখা যায় না।
নদীর পাড়ে পাঁচটা কুকুর বাদামি-সাদা কুকুরটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর নানান দিক থেকে বেচারা কুকুরটাকে হিংস্র আক্রমণ করতে লাগল। একবার ছুটে গিয়ে এ কামড়ায় তো পরমুহূর্তেই ছুটে গিয়ে আর-একজন কামড় দেয়। একটা তো এক কামড়ে এক চাকা মাংস খুবলে নিল।
আমার চক্রব্যূহে অভিমন্যুর কথা মনে পড়ে গেল।
বুনো কুকুরগুলোর ধারালো দাঁতের পাটি দেখা যাচ্ছে। শিকারের দিকে প্রখর চোখে তাকিয়ে ওরা অদ্ভুত স্বরে গর্জন করছে।
ওদের ফাঁদে পড়া কুকুরটা তখন মরিয়া। সে-ও হিংস্র গর্জন করে পালটা কামড় দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এরকম অসম লড়াই বেশিক্ষণ চলার কথা নয়—তাই চললও না। কামড়ে-কামড়ে বাদামি-সাদা কুকুরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। বুনো কুকুরগুলোর আক্রমণের বৃত্ত ক্রমশ ছোট হয়ে আসতে লাগল। তারপর একসময় পাঁচটা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারের ওপরে। ওদের শরীরে কোণঠাসা কুকুরটার শরীর ঢাকা পড়ে গেল। শুধু শোনা যেতে লাগল ওর মরণ আর্তনাদ।
ততক্ষণে পাঁচটা বুনো কুকুর ওদের হিংস্র মহাভোজ শুরু করে দিয়েছে।
হঠাৎই খেয়াল করে দেখি বড়মেসোর চোখে জল। মাছ ধরার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে তিনি বললে, ‘শিগগির চল, ফিরে যাই। ওই কুকুরগুলো নদী পার হয়ে এপাশে এলেই বিপদ।’
‘ওরা নদী পার হয়ে চলে আসে?’ আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।
‘হ্যাঁ, আসে। একে তো সরু নদী—তার ওপর শীতকাল। কতটুকুই বা জল থাকে! তা ছাড়া ওরা সাঁতারে ওস্তাদ। নদী পার হয়ে ওরা শ্মশানের বেওয়ারিশ মড়া খেতে যায়। তবে সাধারণত রাতে যায়—খুব খিদে না পেলে ওরা দিনের বেলা এপারে আসে না।’
আমরা নদীর পাড় ধরে ফিরে যাচ্ছিলাম। তবে আমি বারবার পেছন ফিরে বুনো কুকুরগুলোকে দেখছিলাম। ওরা তখন খিদে মেটাতে ব্যস্ত। একটা বুনো কুকুরকে দেখলাম জল খেতে নদীর কিনারায় নেমে এসেছে। ওর গায়ে এখানে-ওখানে রক্ত লেগে রয়েছে।
অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর যখন আমরা একটা ধানখেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, ‘মেসো, তুমি তখন কাঁদছিলে কেন?’
মেসো চোখের কোণ মুছে হেসে বললেন, ‘কাঁদছিলাম? আমি? দূর!’
আমি মেসোর হাতে আবদারের ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ কাঁদছিলে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। বলো—তোমাকে বলতেই হবে—।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মেসো নীচু গলায় বললেন, ‘আসলে বিলটুর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।’
‘বিলটু? কে বিলটু?’
‘আমার পোষা কুকুর। ও কুকুর নয় রে—আগের জন্মে আমার কেউ ছিল। ও আমাকে এত ভালোবাসত…।’ মেসোর চোখের কোণ জলে ভরে গেল আবার।
সবুজ ধানখেতের ওপারে সূর্য ঢলে পড়েছে। টিয়াপাখির ঝাঁক উড়ে গেল ঘোলাটে আকাশে। একটু আগেই যে-দৃশ্যটা মন ভরিয়ে দিচ্ছিল এখন সেটাই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। সূর্যের লাল রংটা ওই হতভাগ্য কুকুরটার কথা মনে পড়িয়ে দিল।
চোখ মুছে নিয়ে বড়মেসো আবার বলতে শুরু করলেন।
‘শোন, বিলটুর কথা পিংকি আর রাহুলও জানে না। ওদের কখনও বলিনি। তা ছাড়া এসব ওদের জন্মের আগের ব্যাপার তখন তোর বড়মাসি সবে স্কুলের চাকরিতে ঢুকেছে।
‘বিলটুকে আমি নিয়ে এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। তখন ও এই এত্তটুকুন ছিল। কী সুন্দর দেখতে ছিল, জানিস? আর কী সাহস! ক্রস ব্রিডের কুকুরছানা। ভেলভেটের মতো লোম। ছাইরঙের ওপরে এলোমেলো ছোট-ছোট সাদা ছোপ। ওর কথা বলতে গেলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মানে…।’
‘থাক, তোমাকে তা হলে বলতে হবে না।’
বড়মেসো জেদের গলায় বললেন, ‘না, বলব। তোকে বললে আমার ভেরতটা অনেক হালকা হবে। তা ছাড়া তুই তো নিজের চোখে ঢোলগুলোর কাণ্ড দেখলি। কীরকম নিষ্ঠুরভাবে ওই গোবেচারা কুকুরটাকে শেষ করে দিল। বিলটুকেও ওরা ঠিক এইভাবে খতম করে দিয়েছিল—তবে বিলটু এই কুকুরটার মতো ভিতু ছিল না। ও দলটার সঙ্গে বীরের মতো লড়াই করেছিল। কিন্তু…কিন্তু…শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি।’ কথা বলতে-বলতে মেসোর গলা ধরে এল। একটু সামলে নিয়ে মেসো বললেন, ‘ওর জন্যে আমি আর তোর বড়মাসি কত যে চোখের জল ফেলেছি…।’
আমরা বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। মেসো চোখ মুছে জোর করে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘নাঃ, এখন আর না। আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিলটুর ব্যাপারটা তোকে বলব। শুধু তোকে কেন, একইসঙ্গে পিংকি আর রাহুলকেও শোনাব। আমার যত কষ্ট হয় হোক। বিলটুর সাহসের গল্প ওদেরও শোনা দরকার।’
এরপর বড়মেসো অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। এগারো ইঞ্চি লম্বা রুইমাছটা কী-কী মশলাপাতি সহযোগে রান্না হবে তাই নিয়ে বড়মাসির সঙ্গে তর্কবিতর্ক জুড়ে দিলেন। পিংকি আর রাহুলকে আমি বললাম যে, আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মেসো একটা সত্যি ঘটনা শোনাবেন।
ওরা হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিল। বলল, ওদের বাপিকে ওরা ভালো করে চেনে। ওদের বাপি কখনও ওদের সত্যি ঘটনা কিংবা মিথ্যে ঘটনা—কিছুই নাকি শোনাননি।
কিন্তু সে-রাতে বড়মেসো বিলটুর গল্প আমাদের তিনজনকে শোনালেন।
মাছ ধরা আমার ছোটবেলাকার নেশা। বউনি নদীতে আমি মাছ ধরি প্রায় বিশ বছর ধরে। ছিপ, বঁড়শি, টোপ নিয়ে ওই নদীর পাড়ে ধৈর্য ধরে বসাটা আমার বরাবরের অভ্যেস। বিলটুও ধীরে-ধীরে এই অভ্যাসটা রপ্ত করে নিয়েছিল। ও আমার সঙ্গে বলতে গেলে পায়ে-পায়ে ছুটত। তারপর নদীর পাড়ে গিয়ে যখন আমি ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম তখন ও এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করত। কোনও একটা মাছ ধরে ডাঙায় তুললেই ওর সে কী উত্তেজনা আর লাফালাফি! যেন মাছটা আমি নয়—ও-ই ধরেছে।
এইভাবে বছরখানেকের বেশি কেটে গেল। বিলটু চেহারায় বেশ বড়সড় হয়ে উঠল। ওকে দেখে নেড়িকুকুররা বেশ সমীহ করে—আর লোকজন বেশ ভয়-টয় পায়।
আমাদের গ্রামে একবার চুরির হিড়িক শুরু হয়েছিল। তখন মাঝরাতে বিলটু হঠাৎই এক চোর ধরে ফেলল। তার পায়ে আর ঊরুতে ও এমন বাঘা কামড় বসাল যে, একেবারে প্রাণ নিয়ে টানাটানি। সে-কথা চাউর হতেই গ্রামে চুরি-টুরি সব বন্ধ।
একদিন সকাল বউনি নদীর তীরে ছিপ ফেলে বসে আছি, হঠাৎই ফাতনা নড়ে উঠল। দেখেশুনে মনে হল, বেশ বড় সাইজের মাছ টোপ গিলেছে। তো আমি সেদিকে মনোযোগ দিয়ে ছিপটাকে খেলাচ্ছি, হঠাৎই কানে এল অদ্ভুত শিসের শব্দ। তারপরই কয়েকটা চাপা গর্জন।
ছিপটা বাগিয়ে ধরে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা বুনো কুকুর ওপারে দাঁড়িয়ে। বিলটুকে লক্ষ করে ওরা চাপা গোঙানির শব্দ করছে।
আমি বিলটুকে সাবধান করার আগেই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। বিলটু ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ঘেউঘেউ করতে লাগল। তারপর আমি কিছু করে ওঠার আগেই ভয়ংকর তেজে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে চলে গেল ওপারে।
আমি ছিপ-বঁড়শি সব ছুড়ে দিয়ে বিলটুকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিলটু ওপারে পৌঁছে গেল। এবং শুরু হয়ে গেল দাঁত-নখের প্রচণ্ড লড়াই। বিলটু ঘুরে-ঘুরে ওঁদের আক্রমণ ঠেকাতে লাগল। শূন্যে বারবার লাফিয়ে শত্রুদের মরণকামড় বসাতে লাগল। কুকুরের লোম উড়তে লাগল শূন্যে।
আমি অসহায়ের মতো এপারে দাঁড়িয়ে বারবার বিলটুর নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আর কিছুক্ষণ লড়াই চললেই বিলটুকে ওরা শেষ করে দেবে।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিলটু শেষ পর্যন্ত জিতে গেল। বুনো কুকুরগুলো হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিল। বিলটুর দূরন্ত আক্রমণের মুখে পড়ে ওরা ভয়ের চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে।
বিলটু ওপার থেকে তাকাল আমার দিকে। ওর সারা গা ক্ষতবিক্ষত। কাঁধ আর গলার কাছ থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে বুনো কুকুরের দল। শরীরের নানা জায়গায় লেপটে আছে রক্তের দাগ। ও জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে, ধুঁকছে।
ওই ক্লান্ত অবস্থাতেই আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বিলটু ঘেউঘেউ করে উঠল। মনে হল, ও যেন বলছে, ‘দ্যাখো প্রভু, আমি ওদের হারিয়ে দিয়েছি।’
ওর দিকে তাকিয়ে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি আকুল হয়ে ওকে এপারে আসার জন্যে ডাকতে লাগলাম।
আমার কথা বিলটু বোধহয় বুঝতে পারল। ও নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে চলে এল এপারে। কিন্তু তারপর আমার কাছে না এসে ও চলে গেল বউনির কিনারায় এক কাদার গর্তে। সেখানে থকথকে কাদার ওপরে শুয়ে পড়ে প্রাণভরে গড়াগাড়ি খেতে লাগল।
গ্রামের বয়স্ক মানুষদের মুখে বহুবার শুনেছি এই কাদার নাকি এক অদ্ভুত গুণ আছে। এই কাদা গায়ে মেখে নিলে কাটাছেঁড়া, ঘা, এসব নাকি চট করে সেরে যায়। জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে যায় বা নদীতে যেসব জেলেরা মাছ ধরে তারা কেটে-ছড়ে গেলে এই কাদা গায়ে লেপে নেয়। পোষা গরু-মোষ-ছাগলের জন্যেও তারা এই ‘ওষুধ’ ব্যবহার করে।
কিন্তু বিলটু কী করে এই কাদার গুণের কথা জেনেছিল তা বলতে পারব না। তবে কাদায় লুটোপুটি খেয়ে সর্বাঙ্গে কাদা মেখে যখন ও খোঁড়াতে-খোঁড়াতে আমার কাছে এসে দাঁড়াল, তখন ওর অদ্ভুত চেহারা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম।
ওর কপাল থেকে গলা পর্যন্ত এক লম্বা গভীর ক্ষতচিহ্ন। বুনো কুকুরের নখের টানে বাঁ-দিনের চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে। নাকের পাশে মাংস ফাঁক হয়ে গেছে। চোয়ালের নীচে নরম মাংস ফালা-ফালা হয়ে ঝুলছে।
আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। হাঁটুগেড়ে বসে কাদা-মাখা বিলটুকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর চিৎকার করে লোকজনকে ডাকতে লাগলাম।
বিলটু আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ‘কুঁইকুঁই’ করে চাপা আওয়াজ করতে লাগল।
তারপর আমার আর ভালো করে কিছু মনে নেই। পরে জেনেছি, আমার চিৎকার শুনে দু-চারজন চাষি ছুটে এসেছিল। ওরাই আমাকে আর বিলটুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
না, ওই কাদা বিলটুকে বাঁচাতে পারেনি। আটদিন কষ্ট পাওয়ার পর বিলটু মারা যায়। ওর গায়ের কাটা জায়গাগুলো পেকে ঘা হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে পচা দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করেছিল।
আমি আর তোদের মা—মানে, তোর বড়মাসি—বিলটুকে ওই বউনি নদীর পাড়েই কবর দিয়ে এসেছিলাম।
তারপর থেকে বউনির তীরে মাছ ধরতে গেলে আমার মনে কষ্ট হয়। কিন্তু একইসঙ্গে মনে হয়, এই বুঝি বিলটুকে দেখতে পাব। আমার ধরা ছটফটে মাছ দেখে ও লেজ নাড়তে-নাড়তে খুশিতে ছুটোছুটি করবে। একবার মাছটার কাছে ছুটে আসবে, আর একবার দূরে ছুটে যাবে।
ওর কথা ভাবি বলেই বউনিতে মাছ ধরার অভ্যেসটা ছাড়তে পারিনি।
বড়মেসোর গল্পটা শুনেছিলাম। প্রথমবারে বড়কদমগাছিতে গিয়ে। শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। রাহুল আর পিংকিও খুব দুঃখ পেয়েছিল গল্পটা শুনে। ওরা বড়মেসোর কাছে আবদার করল সেই জায়গাটা দেখতে যাবে—যেখানে বিলটু শেষ লড়াই করেছিল। আর একইসঙ্গে ওই কাদার গর্ত আর বিলটুর কবর দেখবে।
বড়মেসো উদাস গলায় বললেন, ‘চল, কালই চল। তবে সব কী আর আগের মতন আছে রে!’
পরদিন দুপুরে আমরা তিনজনে বড়মেসোর সঙ্গী হলাম নদীর পাড় ধরে হেঁটে-হেঁটে মেসো জায়গাগুলো আমাদের দেখতে লাগলেন। বিলটুর কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আমি কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার জানালাম। যদিও মনে হল, এরকম একজন ‘বীর’কে সেলাম জানালেই বোধহয় বেশি মানানসই হত।
কাদার গর্তটাও দেখলাম আমরা। মেসোর কাছেই শুনলাম, জোয়ারের সময় জল জমে গিয়ে এই গর্তটায় কাদা হয়। শীতকালে সেখানে নেমে গাঁয়ের বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কাদা ঘেঁটে ল্যাটা মাছ, গেঁড়ি, গুগলি, শামুক—এসব খুঁজে বেড়ায়। এখনও নজরে পড়ল তিনটে ছেলে কাদা হাতড়ে-হাতড়ে সেই কাজ চালাচ্ছে। একজনের গায়ে তো বুক পর্যন্ত কাদার ছোপ। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়, কাদা রঙের জামা-প্যান্ট পরেছে।
মেসোর সঙ্গে বেশ ক’দিন মাছ ধরতে গিয়ে আমার মধ্যে মাছ ধরার নেশাটা চারিয়ে গেল। মাছ ধরার প্রথমদিন ওরকম একটা বীভৎস দৃশ্যের সাক্ষী হলেও বিলটুর ব্যাপারটা আমাকে কী করে যেন বউনি নদীর দিকে টেনেছিল। তা ছাড়া মেসোর বলা কথাগুলো ‘দারুণ পজিটিভ নেশা’, ‘কনসেনট্রেশান বৃদ্ধি পায়’ আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
অনেকসময় মেসো না গেলেও আমি রাহুল কিংবা পিংকি—অথবা দুজনকেই সঙ্গী করে ছিপ-বঁড়শি নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসতাম।
মাছ ধরতে বসে ফাতনার দিকে নজর থাকলেও আমার চোখ মাঝে-মাঝেই ছিটকে যেত জঙ্গলের দিকে। যদি কখনও একটা বুনো কুকুরের ছায়াও দেখি তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে ছিপ-টিপ নিয়ে ছুট লাগাব বাড়ির দিকে।
পিংকিটা ছিল রামভিতু। সবসময় রাহুল কিংবা আমার জামা খামচে ধরে বসে থাকত। তবে মাছ ধরার ব্যাপারটা দেখার লোভ ও কিছুতেই ছাড়তে পারত না।
রাহুল তুলনায় বেশ সাহসী। ও আত্মরক্ষার জন্যে একটা পেয়ারা কাঠের গুলতি আর পোড়ামাটির গুলি সবসময় পকেটে রাখত। আমি ছিপ নিয়ে বসলে ও গুলতি বাগিয়ে বসত। আর কখনও যদি ও ছিপ হাতে নিত তা হলে আমাকে পাহারাদারের ভূমিকায় বসাত।
ঘটনাটা ঘটেছিল পরের শীতে—তখন আমি ক্লাস সেভেনে।
দুপুরবেলা নদীতে ছিপ ফেলে বসে আছি। আমার একপাশে পিংকি, আর একপাশে রাহুল।
হঠাৎ ওপারের জঙ্গল থেকে শিসের শব্দ ভেসে এল। আমি চমকে মুখ তুলে তাকালাম। মেসোর কাছেই শুনেছি বুনো কুকুরগুলো শিস দেওয়ার মতন করে অদ্ভুতভাবে ডাকতে পারে। কিন্তু কোনও কুকুর আমার নজরে পড়ল না। তখন আবার ফাতনার দিকে মন দিলাম।
এমনসময় সমু নামে একটা ছেলে হাঁপাতে-হাঁপাতে রাহুলকে ডাকতে এল। বলল, ভীষণ দরকার। কাল সকালের ট্রেনে পরেশদা নামে একজন কলকাতা যাবে। তার হাত দিয়ে ক্লাবের ক্রিকেট ব্যাটটা কলকাতার দোকান থেকে আনানো হবে। তার চাঁদা তোলার জন্যে সুবিন আর তোতন রাহুলকে এক্ষুনি ডাকছে। ওদের সঙ্গে কথা সারতে দশ-পনেরোমিনিটের বেশি লাগবে না।
রাহুল উঠে দাঁড়িয়ে সমুর সঙ্গে রওনা হয়ে গেল।
আমাদের সশস্ত্র পাহারাদার চলে যাওয়াতে পিংকি বেশ ভয় পেয়ে গেল। ও আমার গা ঘেঁষে বসে জামা খামচে ধরল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, ‘কোনও ভয় নেই…।’
কিন্তু আমার কথায় ও খুব একটা ভরসা পেল বলে মনে হল না।
একটু পরেই বেশ কয়েকবার শিসের শব্দ শোনা গেল আবার। ব্যস, তাতেই হয়ে গেল। হঠাৎই পিংকি আমার পাশ থেকে উঠে একেবার দে ছুট।
আমি হকচকিয়ে গিয়ে ওকে চিৎকার করে ডাকলাম, ফিরে আসার জন্যে বারবার বললাম। কিন্তু কোনও লাভ হল না।
রাহুল এক্ষুনি ফিরে আসবে এই ভরসায় আমি ছিপ নিয়ে বসে রইলাম।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল কিন্তু রাহুল ফিরল না। ততক্ষণে আমি একটা চারাপোনা ধরেছি এবং প্রবল উৎসাহে আবার নদীতে ছিপ ফেলেছি।
মাছ ধরার দিকে মনোযোগ দিয়ে মনে-মনে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। চোখ ছিল ফাতনার দিকে, কিন্তু মনে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল। রাহুল বা পিংকি যে ফিরে আসেনি সেটা যেমন খেয়াল ছিল না, তেমনই সূর্য যে জঙ্গলের মাথায় হেলে পড়েছে সেটাও নজর করিনি।
জঙ্গল থেকে হিংস্র ডাকগুলো কানে আসতেই আমার ঘোর কাটল। ডাকগুলো বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। একটানে ছিপ তুলে নিলাম নদী থেকে। নাইলনের থলেটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাব, অমনি পাথর হয়ে গেলাম।
কখন যেন ছ’টা বুনো কুকুর পেছন থেকে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। এতই চুপিসাড়ে ওরা কাজটা সেরেছে যে, আমি একটুও টের পাইনি। মনে হয়, ওরা আধপোড়া মড়ার খোঁজে নদী পেরিয়ে শ্মশানের দিকে এসে উঠেছিল। তারপর শিকারের খোঁজে নদীর পাড় ধরে হেঁটে এদিকটায় চলে এসেছে।
কয়েকটা ঢোল শিস দেওয়ার মতো শব্দ করছিল। আর কয়েকটা হিসহিস শব্দ করছিল। আবার কখনও-বা চাপা গর্জন।
ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কিন্তু শরীরটা পুরো অবশ হয়ে পড়েনি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার জন্যে তৈরি হলাম। আমার হাতের অস্ত্র বলতে পলকা একটা ছিপ।
এগিয়ে আসা কুকুরটাকে ছিপের এক ঘা বসিয়ে দিলাম। ওটা ‘কেঁউ’ শব্দ করে দু-পা পিছিয়ে গেল বটে কিন্তু পাশ থেকে একটা কুকুর সাপের ছোবল মারার ঢঙে আমার ডানপায়ে এক কামড় বসিয়ে দিল।
সেদিকে ঘুরে তাকাতেই বাঁ-দিকে কোমরের কাছটায় একটা কামড় টের পেলাম। প্যান্টের মোটা কাপড় ফুটো করে ধারালো দাঁত বসে গেল শরীরে। আমি যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠলাম। ডান পা থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে মাটিতে। কোনদিক সামলাব আমি? আমাকে ঘিরে হিংস্র কুকুরগুলো যেন ব্যালে নাচছে। একবার ছুটে এসে এ কামড়ায় তো আর-একবার ও কামড় দেয়।
আমি ছিপটাকে এলোপাতাড়ি চালাতে লাগলাম, আর প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু শুকনো গলা দিয়ে যে-স্বর বেরিয়ে এল তা কারও কান পর্যন্ত পৌঁছনো সম্ভব নয়।
বুনো কুকুরগুলো আঁচড়ে-কামড়ে আমাকে ঘায়েল করে চলল। নদীর পাড়ে রক্ত ছিটিয়ে পড়তে লাগল এখানে-ওখানে। আমার মাথা টলে গেল। নিজের ভাঙা গলার চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল আমি নয়, অন্য কেউ চিৎকার করছে।
আর সহ্য করতে পারলাম না। অবশ হাত থেকে ছিপ খসে পড়ল। আমিও কাত হয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। একটা কুকুর আমার বাঁ-পায়ের ডিম থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নিল। মনে হল, আমার শরীরে কেউ একটা গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে দিল।
ঠিক তখনই নদীর পাড় ধরে সে উঠে এল।
সর্বাঙ্গে কাদা-মাখা অন্ধকার রঙের এক বিশাল কুকুর। সে বিদ্যুতের মতো ছুটে এল শিকারি কুকুরগুলোর দিকে। হিংস্র চোয়াল আর ধারালো নখ দিয়ে ওদের শরীর ছিন্নভিন্ন করতে লাগল।
বাতাস লোম উড়তে লাগল। দাঁতে দাঁত লাগার খটাখট শব্দ শোনা গেল। সেইসঙ্গে ছোট-বড় গর্জন।
ছ’জন শত্রুর সঙ্গে একাই লড়তে লাগল সেই অন্ধকার কুকুর। একবার এর ওপর লাফিয়ে পড়ে তো আর-একবার ওর ওপর।
আমি অসাড় শরীরে শুয়ে-শুয়ে সেই আশ্চর্য লড়াই দেখতে লাগলাম। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জল এসে গেল।
তিনটে বুনো কুকুর পড়ে গেল মাটিতে। আর উঠতে পারল না। বাকি তিনটে প্রাণভয়ে ঝাঁপ দিল নদীতে। তখন দেখি আরও তিনটে বুনো কুকুর নদীর ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে। বোধহয় সঙ্গীদের অবস্থা দেখে ওরা আর লড়াইয়ে সামিল হয়নি।
লড়াই শেষ হলে জিভ বের করে বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল কাদা-মাখা কুকুরটা। আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল, অদ্ভুতভাবে তাকাল।
আমি যেন মনে-মনে শুনতে পেলাম, ‘দ্যাখো প্রভু, আমি ওদের হারিয়ে দিয়েছি।’
আর তখনই দেখতে পেলাম, ওর কপাল থেকে গলা পর্যন্ত একটা গভীর ক্ষত। বাঁ-দিকের চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। নাকের পাশে মাংস ফাঁক হয়ে গেছে। চোয়ালের নীচে নরম মাংস ফালা-ফালা হয়ে ঝুলছে।
তারপরই কাদা-মাখা কুকুরটা নদীর পাড় বেয়ে নেমে গেল নীচে। আমার চোখের আড়ালে চলে গেল।
কয়েক সেকেন্ড পরেই শুনতে পেলাম লোকজনের চিৎকার—আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে বড়মেসো আর রাহুলের গলা আমি চিনতে পারলাম।
বোধহয় আমার ভাঙা গলার চিৎকার কেউ শুনতে পেয়েছিল।