Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অগ্নিরথ || Samaresh Majumdar

অগ্নিরথ || Samaresh Majumdar

এই তোমার দেশ

‘এই তোমার দেশ। তোমার সকল অস্তিত্বের পেছনে এই দেশের নানাবিধ দান বিরাজমান। তুমি যদি অকৃতজ্ঞ সন্তান হও তা হলে এই দেশকে তুমি উপেক্ষা করিবে। ইহার অমর্যাদায় তোমার মনে কোনও আলোড়ন হইবে না। যে সমস্ত শহিদ তাঁহাদের প্রাণ এই দেশ-জননীর শৃঙ্খলমোচন করিবার জন্যে উৎসর্গ করিয়াছেন তাঁহারা শুধু শিহরিয়া উঠিবেন। তোমার জননী, জন্মভূমির সেবা করা তোমার অবশ্যই কর্তব্য। যদি মানুষ হও তা হলে স্বদেশভূমিকে ক্লেদমুক্ত করো।’

এই ক্লেদমুক্ত শব্দটিতে আটকে গেল সায়ন। ক্লেদ মানে কী? ভারতবর্ষের শরীরে কী ক্লেদ জমেছে যা মুক্ত করার জন্যে এখানে আবেদন করা হয়েছে। আটচল্লিশ পাতার বইটি বাঁধানো নয়, ছাপাও যত্নে হয়নি। বইটির নাম স্বদেশভূমি, লেখক শ্রীযুক্ত বনবিহারী মাইতি। মেদিনীপুরের ঠিকানাটা ছাপা হয়েছে দ্বিতীয় পাতায়।

এই তোমার দেশ। সায়ন তাকাল জানলার বাইরে। এখন দুপুরবেলা। অনেক দূরে পাহাড়ের মাথায় মাথায়, খাঁজে খাঁজে কুয়াশা লেগে রয়েছে কি নেই। কিন্তু আর কিছুক্ষণ পরে, সূর্য পশ্চিমে ঢললেই পৃথিবীর নিঃশ্বাসগুলো কুয়াশা হয়ে যাবে। তখন নীচের খাদ থেকে সাপের ফণার মতো কুয়াশারা ওপরে উঠে আসবে। কিন্তু এখন আকাশ কী নীল! মায়ের একটা এমন রঙের শাড়ি আছে।

মায়ের কথা মনে আসলেই আগে মন খারাপ হয়ে যেত। খুব কান্না পেত তখন। আর একটু কান্নাকাটি করলেই শরীর খারাপ হয়ে যেত। ডাক্তার আঙ্কল খুব রাগ করতেন তখন। বলতেন মানুষ ছাড়া পৃথিবীর কোনও প্রাণী এভাবে নিজের ক্ষতি করে না। এটাও এক ধরনের আত্মহত্যা। নিজের শরীর ভেঙে পড়বে জেনেও কান্নাকাটি করা বোকামি। কিন্তু তবু কান্না আসে। এই ঘরে তার মায়ের একটা বিশাল ছবি বাঁধানো আছে। চট করে মনে হয় মা-ই বসে হাসছে। চব্বিশ বাই বারো ইঞ্চির ছবি টাঙানোর পর সায়নের অনেক কিছু সহজ হয়ে গেছে। কেবলই মনে হয় কলকাতায় নয়, মা এই ঘরে তার সঙ্গেই আছে।

একটা হিমবাতাস আলতো বয়ে গেল। যদিও তার শরীরে হালকা পুলওভার রয়েছে তবু ঠাণ্ডা লাগানো বারণ। এখন অবশ্য এখানে দিনের বেলায় তেমন শীত পড়ে না। বৃষ্টিও কম হয়। হলে অবশ্য ভারী পুলওভার লাগে। এই মাস দেড়-দুই। তারপর বর্ষার সময় তো বটেই, শীতেও জানলা খুলে রাখা যায় না। কী শীত, কী শীত। পাহাড়, গাছপালাগুলো তখন অন্যরকম হয়ে যায়। এই ছবির মতো পাহাড়, আকাশ, গাছপালা মিলে যে প্রকৃতি সেটা তার দেশ? আর কলকাতার বাড়ির জানলা থেকে শুধু ইটকাঠের বাড়ি ছড়ানো যে শহর ছিল সেটাও তার? তাই। মাথার ওপর হিমালয়, পায়ের তলায় সমুদ্র এমন একটা বর্ণনা কোন গানে শুনেছিল সে? সেই মেঘালয় থেকে কন্যাকুমারী আমার দেশ। আমার সমস্ত অস্তিত্বের পেছনে এই দেশের নানান ধরনের দান রয়েছে? সায়নের মনে পড়ে গেল আনন্দমঠের কথা। হেনাকাকিমা তাকে পড়িয়েছিল। খুব ভাল লেগেছিল তার। হেনাকাকিমা অবশ্য বলেছিল, বঙ্কিমচন্দ্রের এই বই যদিও বিপ্লবীরা পবিত্র গ্রন্থ বলে মনে করতেন কিন্তু তিনি লিখেছিলেন সেই সময়কার ব্রিটিশদের প্রশংসা করতে। তাদের মন রাখতে। বেশিক্ষণ তর্ক করার সুযোগ হয়নি কিন্তু সায়নের মনে হত সেই সব দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা কি মূর্খ? হেনাকাকিমা যা জানে তা তাঁরা বুঝতে পারেননি? আনন্দমঠ পড়ে তার নিজের তো মনে হয়েছে ওই একই কথা। হেনাকাকিমাকে সে বুঝতে পারে না। সন্ধে-নামা বাড়ির ছাদে ওর সঙ্গে দেখা হত। মুখ গম্ভীর ছিল একদিন। প্রশ্নটা তুলতে গিয়েও তাই সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, কী হয়েছে তোমার?

তোর শরীর আজ কেমন আছে?

ভাল।

আমার মন ভাল নেই।

কেন?

আমার নামটাই আমার শত্রু।

ও কি! তোমার তো ফুলের নামে নাম।

হ্যাঁ। কিন্তু মালতী টগর চামেলি নয়, হেনা। কজন চেনে হেনাকে? অ্যাঁ?

চোখ ঘুরিয়ে রাগ প্রকাশ করে হেনাকাকিমা ছাদ ছেড়ে দুপদাপ শব্দে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে।

ঘরের দরজায় শব্দ হল। সায়ন তাকিয়ে দেখল নির্মাল্য দাঁড়িয়ে আছে বাইরে যাওয়ার পোশাকে। এক ঘরে দুজন, এ ঘরে তার সঙ্গী নির্মাল্য। অন্তত ছয় বছরের ছোট নির্মাল্য আজ চলে যাবে কলকাতায়।

চিঠি দেবে তো? কেয়ার অব লিখতে ভুলবে না। কেয়ার অব মানিকলাল দত্ত।

নিশ্চয়ই দেব। বুক ভারী হয়ে গেল সায়নের। দেড় বছর ওরা এক ঘরে রয়েছে। এর মধ্যে যতবার নির্মাল্য অসুস্থ হয়েছে সেই তুলনায় সে হয়েছে খুবই কম। কিন্তু যখনই হয়েছে তখনই নির্মাল্য তার পাশে বসে থেকেছে অনেকক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে।

নির্মাল্য বলল, চিঠি লিখে যদি উত্তর না পাও–।

উত্তর পাব না কেন?

বা রে? আমি না থাকলে কে উত্তর দেবে?

ধ্যাৎ। ডাক্তার আঙ্কল তো বলেছে সব নিয়ম মেনে চললে আমরা অনেক অনেক বছর বেঁচে থাকব। বেঁচে থেকে আমাদের কত কাজ করতে হবে, মনে নেই?

কী জানি? কলকাতায় গিয়ে কী হবে! মোটে তো দুটো ঘর। মা বাবা দুজনেই চাকরি করে, আমাকে সারাদিন একা থাকতে হবে। খাটে বসে দুহাতে মুখ ঢাকল নির্মাল্য।

এই কাঁদবি না। ডাক্তার আঙ্কল জানলে খুব রাগ করবে। তোকে কাঁদতে দেখলে আমিও কেঁদে ফেলব। খুব মন খারাপ করছে, না?

কথা না বলে মাথা নেড়েই হ্যাঁ বলল নির্মাল্য।

আমারও করছিল। তাই আমি মনটাকে ফেরাবার জন্যে এই বইটা পড়ছিলাম। তোর মনে আছে? ডাক্তার আঙ্কলের লাইব্রেরিতে পড়ে ছিল বইটা। সায়ন দেখাল।

মুখ থেকে হাত সরাল নির্মাল্য, এখান থেকে চলে গেলে আমি মরে যাব।

অসহায় চোখে তাকাল সায়ন। নির্মাল্যর ব্যাপারে সে কিছুই করতে পারে না। ওকে ওর বাবা এসে নিয়ে যাবেন শোনামাত্র সে ছুটে গিয়েছিল মাসখানেক আগে ডাক্তার আঙ্কলের চেম্বারে। এ বাড়ির একতলায় লনের পাশেই ওর চেম্বার। ডাক্তার আঙ্কল কথা দিয়েছিলেন নির্মল্যর বাবাকে বুঝিয়ে লিখবেন যাতে তিনি ছেলেকে ফেরত নিয়ে না যান। লিখেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি। আজ সকালে নির্দিষ্ট পরিকল্পনামতো উনি এসেছিলেন। ছেলেকে আদর করে বুঝিয়েছেন। একটু বাদে এসে নিয়ে যাবেন।

নির্মাল্য বলল, আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না।

সায়ন বলল, ডাক্তার আঙ্কল বললেন আর একবার চেষ্টা করবেন। তোর বাবা এলে আবার বোঝাবেন। তখন সবাই যদি গিয়ে তোর বাবাকে বলি?

কিস্যু হবে না, খুব বাজে লোক। মুখ বিকৃত করল নির্মাল্য।

ভীষণ খারাপ লাগল শুনতে। নির্মল্যকে কখনও সে ওইভাবে কথা বলতে শোনেনি। নিজের বাবা সম্পর্কে বলা কখনওই উচিত নয়। হয়তো নিয়ে যাচ্ছে বলে রাগ হয়েছে তাই বলে–। সায়ন দেখল বড়বাহাদুর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, ডাকদারবাবু বোলাতা হ্যায়। চলো।

ওর বাবা এসে গেছেন? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

হাঁ। একটু আগে ছোটবাহাদুর এসে নির্মাল্যর স্যুটকেস বেডিং নীচে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছে, এখন বড়বাহাদুর ওর কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে। সায়ন পাশাপাশি। এখন শরীর অনেক ভাল। ডাক্তার আঙ্কল সারাদিনে দুবার ওপর নীচ করার অনুমতি দিয়েছেন। যদিও সেটা দুয়ের বেশি হয়ে যাচ্ছে রোজ। হোক, তাতে তো শরীরে কোনও কষ্ট তৈরি হচ্ছে না!

চেম্বারের কাছাকাছি পোঁছে বড়বাহাদুর থেমে গেল। ইশারা করে চেম্বার দেখিয়ে দিল। নির্মাল্যর হাত ধরে কয়েক পা এগোতেই একটা বেশ রাগী গলা কানে এল, আমি বুঝতে পারছি না আপনি আমাকে বারংবার একই অনুরোধ করছেন কেন? আমি আমার ছেলেকে আপনার কাছে দিয়েছিলাম, ডক্টর দত্ত সুপারিশ করেছিলেন বলেই দিয়েছিলাম, এতদিন রেখেছি, প্রতি মাসে ঠিক সময়ে টাকা পাঠিয়েছি। ট্রিটমেন্টের এক্সট্রা বিলগুলো মিটিয়ে দিয়েছি। দিইনি? তবে? সেই আমি যখন ওকে ফেরত নিয়ে যেতে চাইছি তার পেছনে কারণ আছে ডাক্তার। আপনি সেটা বুঝতে পারছেন না কেন? ওয়েল, আমি আর ওর ট্রিটমেন্টের খরচ চালাতে পারছি না। কিছু স্বার্থসন্ধানী লোক একটা সাজানো কেস খাড়া করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছে আমি নাকি মোটা টাকা ঘুষ নিই। ডিপার্টমেন্ট সাসপেন্ড করেছে। এই কেস টিকবে না, আই নো দ্যাট, কিন্তু যতক্ষণ কেস চলবে ততক্ষণ আমার রোজগারের অবস্থাটা একবার ভাবুন। ঘুষ! আরে মশাই, এখন কে ঘুষ নেয় না? নিচ্ছে না? দিল্লিতে বোফর্স, হাওলা, সুখরাম, মিসেস ঘোষ, বড় বড় রথী মহারথীরা সবাই তো নিচ্ছে। আমি তো চুনোপুঁটি একটা অফিসার। আমি নিতে না চাইলেও জোর করে টাকা দিয়ে যায় কেন? যারা ঘুষ নিচ্ছে তারা যদি খারাপ লোক হয় তাহলে যারা ঘুষ দেয় তারা কী? তাদের শাস্তি হয় না কেন? যে কোনও ট্রেন ছাড়ার আগে দেখবেন, প্ল্যাটফর্মে টিকিট চেকারের পেছন পেছন একদল লোক সিট কিংবা বার্থের জন্য ঘুরছে। ওরাই বলছে একটা বার্থ দিন আপনাকে পঞ্চাশটা টাকা দেব। এটা অন্যায় নয়? যাক গে! আমার পক্ষে এই খরচ চালানো সম্ভব না। বলতে পারেন, ছেলেটার জীবন বলে ব্যাপার, জমানো টাকা ছিল না? আছে। নিশ্চয়ই আছে। এখন আমার বিরুদ্ধে এনকোয়ারি হচ্ছে। আমি কোথায় কত সরিয়েছি তার হদিস নিচ্ছে। ছেলেকে টাকা পাঠাতে হলে গোপন ফান্ডে হাত দিতে হবে আর তা হলেই ওরা টের পেয়ে যেতে পারে। এমনিতেই ওরা লক্ষ করছে আমি ছেলের খরচের টাকা কীভাবে মেটাচ্ছি। বুঝতে পারছেন আমার অবস্থাটা?

আমার কিছু বলার নেই। যা ভাল মনে করবেন তাই করুন। আমার পক্ষে যদি সম্ভব হত তা হলে বলতাম, থাক ও এখানে। কিন্তু–।

না না। আপনি অনেক করেছেন। আর নতুন করে ঋণী হতে চাই না।

মিস্টার দত্ত। এই খামে নির্মাল্য সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রয়েছে। ওর কী ট্রিটমেন্ট হয়েছে, কী ধরনের হওয়া উচিত, সব। আপনি কাকে দিয়ে ওর চিকিৎসা করাবেন জানি না তবু আমি ডক্টর দত্তকে একটা চিঠি লিখে আমার সাজেশন জানিয়েছি। যদি মনে করেন আপনি আবার ওকে এখানে এনে রাখতে চান তা হলে দ্বিধা না করে নিয়ে আসবেন। আপনি তো জানেন, শুধু শরীর নয়, এখানে ওদের মনের চিকিৎসাও হয়। ভয় হচ্ছে সেটা এখন ওর ক্ষেত্রে ব্যাহত হবে। ঠিক আছে ওই তো ও এসে গেছে। চলুন, আপনাদের আমি স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি। ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন।

সায়ন দেখল মধ্যবয়সী সেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন তাদের সামনে। নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি, বাঃ, বেশ ভাল দেখাচ্ছে তোকে। ভাল হয়ে যাচ্ছিস, বুঝলি?

আমি কলকাতায় যাব না। জেদি গলায় বলল নির্মাল্য।

সায়ন লক্ষ করল নির্মল্যর বাবার মুখ কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেল, সে কী? কেন?

আমি কলকাতায় গেলে মরে যাব। আমার চিকিৎসা ওখানে হবে না বলেই তো তোমরা আমাকে এখানে এনেছিলে। কি না? বেশ জোরে জোরে জিজ্ঞাসা করল নির্মাল্য।

হ্যাঁ। কিন্তু কলকাতাতেও এখন কত ভাল চিকিৎসা বেরিয়ে গেছে। তা ছাড়া তুমি তোমার মায়ের কথা একটু ভাব। তোমার মা তোমাকে না দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কেবলই চিন্তা করে তোমাকে নিয়ে। তাই মায়ের কাছে থেকে চিকিৎসা করালে দুজনেরই লাভ, তাই না? ভদ্রলোক ছেলের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন। বসে কাঁধে হাত রাখলেন। হঠাৎই সায়নের মনে হল লোকটা যা নয় তাই করছে। অর্থাৎ এই হাসি, সুন্দর কথাগুলো, বসার আন্তরিক ভঙ্গি, এসবই বাজে। খুব বাজে লোক শব্দ তিনটেকে এখন খুব খারাপ বলে মনে হল না। সে দ্রুত পা চালিয়ে জিপের পাশে দাঁড়ানো ডাক্তারের কাছে গেল। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডাক্তার ওর কাঁধে হাত রাখলেন, কিছু করার নেই সায়ন। উনি যদি ওঁর ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান তা হলে সে অধিকার ওঁর আছে। আসুন, মিস্টার দত্ত। আপনাদের দেরি হয়ে যেতে পারে।

এবার নির্মাল্যর বাবা সোজা হলেন, একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলেই তো হত।

না। খবর পেলে স্টেশন থেকে তুলে আনার যেমন রীতি আমরা মেনে চলি তেমনই কোনও পেশেন্ট চলে যাওয়ার সময় আমরা তার সঙ্গী হই, যতটা পারি। হাত নাড়লেন ডাক্তার, উঠে বসুন। এসো নির্মাল্য। দেখি তোমার হাতখানা দাও।

হাত বাড়িয়ে নির্মাল্যর হাত ধরতেই কী মনে হওয়ায় নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর পকেট থেকে স্টেথো বের করে বুক পিঠ পরীক্ষা করে জিভ দেখাতে বললেন। সেটা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ স্টুল পরিষ্কার হয়নি বলনি কেন?

নিমাল্য দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। ডাক্তার ওকে কোলে তুলে গাড়ির সিটে বসিয়ে দিতেই সায়ন বলল, আচ্ছা, আমি সঙ্গে যেতে পারি?

তুমি গেলে যে আর সবাই যেতে চাইবে!

না। আমি তো ওর রুমমেট, আমার দাবি আগে। সবাই জানে।

ওয়েল। তা হলে রুমমেটের পাশে উঠে বোসো। মিস্টার দত্ত, আপনাকে তা হলে পেছনে বসতে হয়। কষ্ট হবে একটু, এখন তো নীচে নামার পথ, সামনে ঝুঁকে থাকতে হবে।

জিপ ঘেরা চত্বর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়তেই সমস্ত পৃথিবীটা ঝকঝক করে উঠল। এত সোনারুপো মেশানো আলো, এত নীল মাথার ওপর, কত সবুজ চারপাশে রেখে পৃথিবীর সেরা চিত্রকর মানুষকে কীরকম বিহ্বল করে মজা দেখেন, আচমকা ব্রেক কষলেন ডাক্তার, নির্মাল্যবাবু তাকিয়ে দ্যাখো। এর নাম পৃথিবী।

সঙ্গে সঙ্গে সায়ন বলল, এই আমার দেশ। আমার জন্মভূমি।

পেছন থেকে হেঁড়ে গলায় মিস্টার দত্ত বললেন, না হে। এ সব অঞ্চলে এলে আমার কিছুতেই বাংলা বাংলা বলে মনে হয় না। মনে হয় বিদেশে এসেছি।

ডাক্তার বললেন, বাঃ। আপনি কলকাতায় ফিরে না গিয়ে সুভাষ ঘিষিং-এর কাছে চলে যান, পাবলিসিটি অফিসারের চাকরি পেয়ে যেতে পারেন। এই জায়গাটার নাম ভারতবর্ষ। আজ নয়, ভারতবর্ষের কনসেপ্ট তৈরি হওয়ার সময় থেকেই জায়গাটার ভৌগোলিক অস্তিত্ব ভারতবর্ষের মধ্যেই। এখানে যাঁরা মূল বাসিন্দা ছিলেন তাঁরা আজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে গেছেন। কিন্তু সেটাই তো ভারতীয় দর্শন। দিবে আর নিবে মেলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে। বাংলাদেশ পশ্চিমবাংলার জীবনের সঙ্গে এখানকার মিল না পেলেই বিদেশ হয়ে গেল? তা হলে তো পঞ্জাবে গেলে আপনার বিদেশ বলে মনে হবে। গোয়া তো আরও।

গাড়ি চালাতে চালাতে কথাগুলো বলছিলেন ডাক্তার। তাঁর এই একটানা বক্তৃতায় কোনও ফাঁক খুঁজে না পেয়ে চুপ করে বসেছিলেন মিস্টার দত্ত। নীচে নামছে জিপ ঘুরে ঘুরে। ফলে পেছনের চাপ এসে পড়ছে সামনে।

এই সময় নির্মাল্য বলল, আমার কপাল খারাপ।

এত নিচু স্বরে বলল যে সায়নেরই প্রথমে শুনতে অসুবিধে হল। তারপর সে জিজ্ঞাসা করল, কেন?

আমি ভেবেছিলাম আজ ঠিক নাক দিয়ে রক্ত বের হবে। রক্ত বের হলে নিশ্চয়ই যাওয়া হবে না। গত মাসে এইদিন এক ফোঁটা বেরিয়ে ছিল। তার আগের রাত্রে আমি খাইনি, মনে আছে। সেইজন্যে গত রাত্রেও আমি খাইনি। অথচ রক্ত বের হল না। নির্মাল্যর কথা শেষ হওয়ামাত্র সায়ন ওর হাত জড়িয়ে ধরল। এক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসা মানে জীবন থেকে কতগুলো বছর মুছে ফেলা। এ কথা তাকে কেউ বলেনি, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। নির্মাল্য বয়সে অনেক ছোট হলেও এতদিনে তো ওর বোঝা উচিত ছিল এ কথা।

স্টেশনটা ছোট। সমতল থেকে কখনও ট্রেন আসে কখনও আসে না। অবশ্য দার্জিলিং-এর ট্রেন দিনে দুবার এখানে নেমে আসে, ফিরে যায়। গাড়ি থেকে নামামাত্র ডাক্তারবাবুকে ঘিরে ধরল কয়েকজন। তাদের অসুখ বিসুখের কথা বলতে লাগল হাতের কাছে পেয়ে। নির্মাল্যর বাবা জিনিসপত্র নামিয়ে সায়নের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, কি? ভাল আছ?

ওকে নিয়ে যেতেই হবে? সায়ন শক্ত গলায় প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ বাবা। আমার পক্ষে যা অসম্ভব তা আমি করব কী করে। তোমরা ছোট্ট এ সব কথা ঠিক বুঝবে না। হ্যাঁ রে, হাঁটতে পারবি?

নির্মাল্য উত্তর দিল না। মানিকলাল দত্ত জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁকে বাধা দিলেন ডাক্তার, ও কী করছেন? কোথায় যাচ্ছেন?

প্ল্যাটফর্মে।

সে কী? ট্রেনে যাবেন কেন? আর আজ ট্রেন খুব লেট করে আসছে। এন জি পি-তে গিয়ে মেল ট্রেন পাবেন না। শেয়ারের ট্যাক্সিতে যান। তিনি হাত নাড়তেই ওপাশ থেকে একটা ট্যাক্সি এগিয়ে এল। ড্রাইভার ডাক্তারকে চেনে। হেসে নমস্কার করে দরজা খুলে দিল। মানিকলাল মালপত্র ডিকিতে রাখতে গেলেন। নির্মাল্য উঠে বসল গাড়িতে। সায়ন চট করে তার পাশের জানলায় চলে এল, মিছিমিছি রক্ত খরচ করবে কেন? মনে নেই, ডাক্তার আঙ্কল বলেছেন আমাদের এক ফোঁটা রক্ত এই দেশকে আরও সুন্দর করতে পারে?

সায়ন চোখ বন্ধ করল।

ধীরে ধীরে শেয়ারের ট্যাক্সিটায় লোক ভরে গেল। ডাক্তার এগিয়ে এসে নির্মাল্যর মাথায় হাত রাখলেন, ভাল থাকিস বাবা।

নির্মাল্য কিছু বলল না। সে তার চোখ খুলল না। সায়ন আবিষ্কার করল তার নিজের চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়ছে। ট্যাক্সিটা চলে গেল।

কাঁধে হাত পড়ল, ডাক্তার আঙ্কল তাকে জড়িয়ে ধরেছেন, শক্ত হও। শরীর খারাপ লাগছে?

আমি ভাল আছি। ওইরকম ক্ষীণকায় তরুণের কণ্ঠস্বর এত ভরাট কী করে হয় তা বিজ্ঞানই জানে। ছেলেটার কথাবার্তায় মাঝে মাঝে ব্যক্তিত্ব প্রকট হয়ে ওঠে, প্রথম দিন থেকেই ডাক্তার সেটা লক্ষ করেছিলেন। তিনি বললেন, গুড। তুমি তা হলে জিপে কিছুক্ষণ বসে থাকো, আমি একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। কুরিয়ার সার্ভিসে আজ জরুরি ওষুধগুলো না এলে–। ডাক্তার অন্যমনস্ক হয়ে চলে গেলেন। মানুষটার যাওয়া দেখল সায়ন। ওঁকে তার বড় ভাল লাগে।

সায়ন জিপের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। সামনে অলস ভঙ্গিতে পাহাড়ি মানুষেরা গল্প করছে। ট্যাক্সিওয়ালা, তাদের দালালেরা, মালবইয়ে কিছু মানুষের সঙ্গে বেড়াতে আসা লোকজনও আছে। এই জায়গাটা চমৎকার পাহাড়ি, শীতের সময় প্রচণ্ড শীত পড়ে কিন্তু সায়ন জানে না কেন পর্যটকরা এখানে ভিড় জমাতে পছন্দ করে না। তারা উঠে যায় দার্জিলিং-এ অথবা ওপাশের কালিম্পং অথবা গ্যাংটকে। এই যে স্টেশন চত্বর, এখানে বাসগুলো থামে কিছুক্ষণের জন্যে, যাত্রীরা নেমে চা খেয়ে নেয়, কুয়াশা দেখে আবার গাড়িতে চড়ে বসে। কিন্তু সায়নের জায়গাটা বেশ ভাল লাগে। কেমন ঘুমঘুম, ছবির মতো।

এই যে সাহেব।

গলাটা কানে যেতে মুখ ফেরাল সায়ন। ম্যাথুজ। ওদের নিরাময় থেকে একটু ওপরে ম্যাথুজের দোকান। দোকানটায় গোরুর মাংস বিক্রি হয়। সেই অর্থে ম্যাথুজ কসাই। কিন্তু কসাই বললে যে চেহারা চোখের সামনে আসে তার সঙ্গে ম্যাথুজের কোনও মিল নেই। মাঝারি উচ্চতার রোগা লোকটির বয়স তিরিশের ধারেকাছে হবে। পরনে প্যান্ট কোট, গলায় মাফলার আর মুখে খানিকটা দাড়ি।

ডাকদার সাহেব কোথায়?

কাজে গিয়েছেন। তুমি?

দোকানে মাল নেই। ভাবলাম নীচে নেমে বাজারটা দেখে আসি। তুমি দুদিন আসনি। কী। হল, তবিয়ত খারাপ? ম্যাথুজ ওর পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

না। একটা বই পড়ছিলাম।

কী বই? ডিটেকটিভ থ্রিলার?

নাঃ। অন্য বই। আচ্ছা ম্যাথুজ, তুমি বই পড়তে পারো?

পারব না কেন? ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলাম আমি। কিন্তু টাইম পাই না।

টাইম পাও না? তোমার দোকানে তো আধঘণ্টা পরে পরে একজন খদ্দের আসে। বেশির ভাগ সময় তো ঝাঁপ বন্ধ রাখ। প্রতিবাদ করল সায়ন।

ঠিক। তখন আমি পাথরটার ওপর বসে পাহাড় দেখি। একদিন তোমাকে দেখাব। এতরকম গল্প তখন চোখের সামনে, ছেড়ে দাও। চা খাবে?

না। আমার খাওয়া-দাওয়া সব নিয়মমতো।

ও হ্যাঁ। যাই, দারু খেয়ে আসি।

দারু খেতে তোমার ভাল লাগে?

তা লাগে। মিথ্যে কথা কেন বলব? হাসল ম্যাথুজ। তার দাঁত লালচে।

তুমি আবার গোরু আনতে কবে যাবে?

বুধবার।

আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার সঙ্গে নেপালে যেতে।

ম্যাথুজ সায়নের মাথাটা স্পর্শ করেই ছেড়ে দিল, বহুত কষ্ট। তোমার শরীর ঠিক না হলে যেতে পারবে না। আমি যাই ট্রাকের ওপর বসে, ফিরি গোরু নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, তুমি তা পারবে কেন? আচ্ছা, যদি কোনওদিন গাড়ি জোগাড় করতে পারি তা হলে তোমাকে নিয়ে যাব। যেখানে গোরুদের হাট বসে সেখানে একটা মন্দির আছে। খাঁটি মন্দির।

কীসের মন্দির? কোন ঠাকুরের?

শিব। আচ্ছা, চলি। ম্যাথুজ এগিয়ে গেল।

অদ্ভুত ব্যাপার। সায়ন ম্যাথুজকে পেছন থেকে দেখল। ওরা তিন ভাই। বড় ভাই এখানকার কম্পুটার কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। স্যুট এবং টাই পরে হাতে ছড়ি নিয়ে হাঁটেন। মেজ ভাই জাহাজে চাকরি করে, ওয়্যারলেস অপারেটর। ছুটির সময় আসে। গত মাসে আবার জাহাজে ফিরে গিয়েছে। সেই সময় বিকেলবেলায় ম্যাথুজের দোকানের পাশে এক হাত উঁচু ইটের পাঁচিলের ওপর তিন ভাই পাশাপাশি বসে গল্প করে সিগারেট খেত। গ্রামের অন্য লোকজনও তখন সেখানে এসে খানিকটা আড্ডা মেরে গেছে। ডাক্তার আঙ্কলের সঙ্গে ওই পথ দিয়ে হাঁটার সময় সে কয়েক মাস আগে প্রথম দেখেছিল। ডাক্তারকে দেখে তিনজনই উঠে দাঁড়িয়ে গুড আফটারনুন গুড আফটারনুন বলেছিল। ডাক্তার আঙ্কল ওঁদের খবরাখবর নিয়েছিলেন। এই সময় একজন মোটামতো বৃদ্ধ মানুষ ওপর থেকে নেমে এসে বললেন, যিশু তোমার মঙ্গল করুন ডাক্তার। শরীর কেমন আছে?

ডাক্তার আঙ্কল হাসলেন, ভাল। কিন্তু আপনিই একজন মাত্র লোক যিনি আমার শরীরের খবর নিয়ে থাকেন। কেন বলুন তো?

বৃদ্ধের হাসিটি চমৎকার। দ্যাখো, এই যে আমরা বেঁচে আছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি এ সবই যিশুর লীলা। তাঁর ইচ্ছে। তা প্রয়োজনের সময় তো ওঁকে পাওয়া যায় না। আমাদের শরীরটাকে ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন তোমাদের। তাই তোমরা ঠিক থাকলে আমি, আমরা ঠিক থাকব। এটি কে? একদম রাজকুমারের মতো দেখতে। হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধ সায়নের কাঁধ জড়িয়ে ধরল।

এর নাম শ্রীমান সায়ন রায়। খুব ভাল ছেলে। সায়ন, এঁদের নমস্কার করো।

সায়ন হাত জোড় করতেই বৃদ্ধ হাত টেনে নিল হাতে, যিশু তোমার মঙ্গল করুন।

ফেরার সময় ডাক্তার আঙ্কল ওই তিন ভাই-এর কথা বলেছিলেন। তিনজনই অসম জীবনযাপন করেন। রোজগারও আলাদা আলাদা। কিন্তু কাজের বাইরে নিজেদের সম্পর্ক অটুট রেখেছেন। কসাই-এর কাজ করে বলে ছোট ভাইকে কেউ ঘৃণা করে এড়িয়ে যান না। ডাক্তার আঙ্কল বলেছিলেন, কোনও কাজই ছোট নয়। বিদেশে গেলে ব্যাপারটা স্পষ্ট দেখতে পাবে। এই আমরা, বাঙালিরাই শুধু মিথ্যে অহংকার আর ঠুঁটো দম্ভ নিয়ে নিজের চারপাশে একটার পর একটা দেওয়াল তুলে গিয়েছি। আমাদের তুলনায় এরা অনেক এগিয়ে।

তবু, ম্যাথুজ কেন গোয় কেটে সেই মাংস বিক্রি করে? গোরু হল হিন্দুদের কাছে পবিত্র প্রাণী, অনেকে মা বলে পুজো করে। যে লোক গোরু কাটে তাকে শত্রু বলে মনে করা উচিত। জমে ওঠা এই সব প্রশ্ন সায়ন করেছিল ডাক্তার আঙ্কলকে।

শুনে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, ম্যাথুজকে দেখে খুব খারাপ লোক বলে মনে হল?

না। সাধারণত কসাইরা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে ছুরি হাতে নিয়ে বসে থাকে।

ও সেরকম ছিল না। তাই তো। আচ্ছা, গোরু একটি প্রাণীর নাম। তার নিজস্ব কোনও বিশেষ ক্ষমতা নেই যা শ্রদ্ধা পেতে পারে। গৃহপালিত পশুর মধ্যে একমাত্র সে বেশি দুধ দিতে পারে। তাকে আমাদের প্রয়োজন। মোষেরও দুধ হয়, সেটা কাজেও লাগে কিন্তু গোরুকে পুজো করতে হবে কেন? তা হলে ছাগলের দুধ অসুস্থ মানুষের উপকারী জেনেও তাকে পুজো না করে তার স্বজাতির মাংস খাওয়া হচ্ছে কেন? নিজের মাকে খেতে না দিয়ে সেবা না করে গোরুকে ঘটা করে পুজো দেয় যে জাতি তার দিকে স্পষ্ট চোখে তাকাও সায়ন। স্রেফ রেষারেষি করার জন্যে হিন্দুরা গোরুকে মা বানিয়ে ফেলেছে। আর মজার কথা কী জানো? ওই ম্যাথুজের সঙ্গে কথা বলে দেখবে, সে গোরু কিনতে যায় পাশের হিন্দু রাষ্ট্র নেপালে। সায়ন, সবসময় মনে রাখবে মানুষের চেয়ে পবিত্র মানুষের কাছে আর কেউ নেই।

এ সব অনেকদিন আগের কথা। এখন ম্যাথুজের সঙ্গে সায়নের ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। ওর ব্যবসার নানান গল্প তার জানা। ম্যাথুজ এই ব্যবসাটা আর বেশিদিন করবে না। তার আর পোষাচ্ছে না। নেপাল থেকে গোরু নিয়ে বর্ডার পেরিয়ে চোরাপথে একদিন একরাত হেঁটে তবে এখানে পৌঁছেতে হয়। পথে গোরু হারিয়ে গেলে বা অন্য কিছু হলে সবটাই ক্ষতি। আর এই গ্রামটির মানুষজনের আর্থিক অবস্থা এত ভাল নয় যে সে দাম বাড়িয়ে দেবে মাংসের। অথচ গোরুর দাম বেশি দিতে হচ্ছে, পথে পুলিশকেও টাকা দিতে হয়। এতে কোনও লাভ নেই। তা ছাড়া যে মেয়েটির সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়ার কথা সে-ও চাপ দিচ্ছে অন্য কাজ করার জন্যে। মুশকিল হল, সে ব্যবসা বন্ধ করলে এই গ্রামের মানুষগুলোর মাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। মুরগি বা খাসির মাংস কিনে খাওয়ার ক্ষমতা কজনের আছে। সিদ্ধান্তটা সে ওই কারণে নিতে পারছে না।

এই সময় স্টেশনের লাগোয়া ম্যাগাজিন আর কাগজের স্টলটা খোলা হল। নানান রঙের মলাটের সিনেমার কাগজই বেশি। স্টলটার ওপরে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ছবি। এই ছবিটিকে এর আগেও স্টলে দেখেছে সায়ন। আজ হঠাৎ কৌতূহল হল। এগিয়ে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ওই ছবিটা টাঙিয়েছেন কেন?

দোকানদার বোধ হয় এক সময় রেলে চাকরি করতেন। এখনও কালো কোট পরে থাকেন ধুতির ওপর। মাথা জুড়ে চকচকে টাক। নস্যি নিতে নিতে মাথা নাড়লেন, নট ফর সেল। বিক্রির জন্য নহে। ইচ্ছে হয়েছে তাই টাঙিয়েছি।

ও। রোজ দেখি তাই বললাম।

ছবিটা কার জানো? লাস্ট বাঙালি। তারপর আর বাঙালি নেই। বিধান রায় অবশ্য ছিলেন কিছুটা কিন্তু বটগাছ আর নিমগাছ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র আমার নেতা। নো, আমি ফরোয়ার্ড ব্লক করি না, নো পলিটিকস। উনি আমার নেতা কারণ উনি বাঙালির নেতা। ইংরেজ ওঁকে মারতে চেয়েছিল, জাপানিরা ওঁর ছাই দেখিয়েছে, কিন্তু তিনি মারা যাননি। যে কোনও মুহূর্তে ফিরে এসে ডাক দেবেন, দিল্লি চলো। লোকটি চোখ বন্ধ করে বলে যাচ্ছিলেন এক সুরে, আমরা যাওয়ার জন্য তৈরি। আমি তো বটেই।

ওপাশে দাঁড়ানো একজন নেপালি ভদ্রলোক শব্দ করে হাসলেন, বেঁচে থাকলে ওঁর বয়স নিরানব্বই হবে। কোনও চান্স নেই দাসবাবু।

দাসবাবু চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন লোকটিকে, মূর্খ! নীরদ সি চৌধুরীর নাম শুনেছেন? লেখক। অক্সফোর্ডে থাকেন। এখনও দেশ পত্রিকায় লিখে যাচ্ছেন। নেতাজির সমসাময়িক। তিনি যদি পারেন, তা হলে নেতাজি পারবেন না কেন? হোয়াই? জবাব দিন। আমি বলছি নেতাজি বেঁচে আছেন। শৌলমারির সাধু নন, নেতাজি ইজ নেতাজি। কী দেব ভাই? নতুন খদ্দেরের দিকে তাকালেন দাসবাবু।

আপনাকে প্লেবয় ম্যাগাজিন আনিয়ে রাখতে অ্যাডভান্স করেছিলাম। একটি ছিপছিপে স্মার্ট অনেকটা ড্যানির মতো দেখতে নেপালি ছেলে সামনে দাঁড়াল।

ইয়েস। এনেছি। আজই এসেছে। আরও কুড়িটা টাকা লাগবে ভাই। কালোবাজারে দাম বেশি। আড়াল থেকে সন্তর্পণে একটা প্যাকেট বের করে দাসবাবু ছেলেটির হাতে দিতেই সে কুড়িটা টাকা পেমেন্ট করল।

ডাক্তার কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পায়নি সায়ন, এবার কাঁধে হাত পড়তেই সে একটু চমকে গেল। ডাক্তার বললেন, চলো, ফেরা যাক। গাড়ির দিকে হাঁটার সময় সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, প্লেবয় পত্রিকা কালোবাজারে বিক্রি হয় কেন?

.

০২.

ডাক্তার আঙ্কলকে আজ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, শখের জিনিস না পেলে মানুষ পাগল হয়ে ওঠে। তখন বেশি দাম দিয়ে পেতে চায়। এই ধরো যারা খুব সিগারেট খায় তারা যদি শোনে বাজারের কোনও দোকানে সিগারেট নেই, তখন তাদের কী অবস্থা হবে। যেখানে পাবে সেখান থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে ছুটবে। প্লেবয় ম্যাগাজিনকে অনেকেই পছন্দ করেন না, যাঁরা করেন তাঁরা বেশি দাম দিয়ে কিনতে চান হাতের কাছে না পেলে।

কেন?

ডাক্তার আঙ্কল সায়নের দিকে তাকালেন, তোমার বয়স তো আঠারো হয়ে গেছে, তাই না?

হ্যাঁ। আমি এখন উনিশ।

তাহলে বলা যায়। ওই কাগজে নগ্ন মেয়েদের ছবি ছাপা হয় একটু বেশিমাত্রায়।

কেন? এটা তো খুব অন্যায়। মেয়েরা আপত্তি করে না?

পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত জায়গা সায়ন। তোমার আমার কাছে যা অন্যায় বলে মনে হবে তা অনেকের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা। ডাক্তার আঙ্কল গাড়ির দরজা খুলে ধরেন।

কিন্তু মেয়েদের নগ্ন ছবি দেখার জন্যে বেশি দাম দিয়ে প্লেবয় পত্রিকা কিনতে হবে?

যারা দেখে তারা নিশ্চয়ই দেখে আনন্দ পায়। ইতিহাসে বিকৃত রুচির নানান ধরনের মানুষের কথা বলা হয়েছে। রোম যখন আগুনে পুড়ছিল নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন। সেটাও তো এক ধরনের বিকৃত রুচি। তাই না?

গাড়িতে উঠে বসে সায়ন জিজ্ঞাসা করল, যেসব মেয়েদের ছবি ছাপা হয় তাদের বয়স কি খুব অল্প?

অল্প কেন হবে? ইউরোপ আমেরিকায় প্রচুর মহিলা প্রফেশনাল মডেল হিসেবে কাজ করেন। আর পাঁচটা চাকরিবাকরির মতো এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করেন তাঁরা।

কিন্তু এই সব মেয়েরা নিশ্চয়ই কারও মা নয়?

ডাক্তার এবার সায়নের দিকে তাকালেন, সত্যি কথা শুনলে তুমি কষ্ট পাবে সায়ন।

সায়ন ধীরে ধীরে মুখ সরিয়ে নিল জানলায়। ডাক্তার গাড়ি চালু করলেন। সায়নের চোখের সামনে থেকে এই পাহাড়ি স্টেশন এলাকা মুছে গিয়ে মায়ের মুখ ভেসে উঠল। তার মায়ের নগ্ন শরীরের ছবি কেউ তুলছে সে ভাবতেই পারে না। অসম্ভব, তেমন অবস্থা কখনওই আসতে পারে না। তার মা যখন এইরকম তখন পৃথিবীর কিছু কিছু মায়েরা কেন আলাদা হবে।

চড়াই ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ গাড়িটা থেমে যেতেই কানে এল, যিশু তোমাদের মঙ্গল করুন। গুড আফটারনুন ডাকদার সাব। গুড আফটারনুন মাই ইয়ং ফ্রেন্ড।

ডাক্তার গাড়ি থামালেন, গুড আফটারনুন মিস্টার ব্রাউন। উঠে আসুন।

দরজা খুলে দিতে পেছনের সিটে উঠে বসলেন বৃদ্ধ। দীর্ঘকায়, মোটাসোটা শরীর নিয়ে ওপরে উঠতে যে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল তা মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। নিশ্বাস একটু স্বাভাবিক হতে হাসলেন, অনেক ধন্যবাদ। যিশুর এমনই মহিমা ঠিক সময়ে কাউকে না কাউকে সাহায্যের জন্যে পাঠিয়ে দেন।

গাড়ি চালাতে চালাতে ডাক্তার বললেন, আপনার যখন ওপর-নীচ করতে এত কষ্ট হয় তখন এটা করেন কেন?

ব্রাউন মাথা নাড়লেন, আরে আমি কি করি! আমাকে করিয়ে ছাড়ে। আমাদের ডাক্তার গোমসের বাড়িতে মিটিং ছিল। সমাজসেবী সংঘের মিটিং। না বললে ওরা ভাবে আমি এড়িয়ে যাচ্ছি। অবশ্য ওরা কাজ খারাপ করছে না। একটু দাঁড়াতে পারবেন ডাক্তার!

শোনামাত্র ডাক্তার ব্রেক কষলেন। রাস্তাটা এখানে খানিকটা সমান। গাড়ির দরজা খুলে ব্রাউন নীচে নেমে সামনে তাকালেন। সেখানে একটা দোতলা অসম্পূর্ণ বাড়ি। বাড়িটির গায়ে কালো দাগ, জানলা দরজা নেই।

ব্রাউন বললেন, মন খারাপ হয়ে যায় ওই বাড়িটা দেখলে।

ডাক্তার বললেন, শুনেছি বাড়িটা সরকার নিয়ে নেবে। এভাবে পড়ে থাকার চেয়ে সরকার যদি কোনও ভাল কাজে লাগায় তাহলে মানুষের উপকার হয়।

নিশ্চয়ই। ফাদারকে বলেছিলাম চার্চ থেকে অ্যাপ্রোচ করতে। কিন্তু তারও তো অনেক অসুবিধে।

ব্রাউন কথা বলতে বলতে আবার গাড়িতে উঠে পড়লেন। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা বাড়িটার চেহারা এরকম কেন? পোড়া পোড়া দাগ।

ব্রাউন বললেন, ইয়েস মাই সন, বাড়িটাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল?

হ্যাঁ। বাড়ির মালিক মিস্টার মুখার্জি কলকাতার মানুষ। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় কিছু মানুষের মনে হল মিস্টার মুখার্জি পাহাড়ের লোক না হয়েও এখানে অত সুন্দর বাড়ি কেন করছেন? বাড়িটা তখন প্রায় তৈরি। সে সময় দার্জিলিং জেলার প্রায় সব সরকারি বাংলো, টুরিস্ট বাংলো পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে প্রতিবাদ জানানোর নিদর্শন হিসেবে। কিছু লোক ওই সুযোগ নিয়ে বাড়িটা আগুনে জ্বালিয়ে দিল। একটি নেপালি ছেলে বাধা দিতে গিয়েছিল। বেচারা আগুনে পুড়ে মারা যায়। সেই থেকে বাড়িটা ওই অবস্থায় পড়ে আছে। ব্রাউন ধীরে ধীরে বলছিলেন।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, যে মারা গেল, সে কে?

ওই যে বললাম স্থানীয় মানুষ। নেপালি। তার মনে হয়েছিল কাজটা ভাল হচ্ছে না। প্রতিবাদ করা দরকার। এরকম এখনও কারও কারও মনে হয় বলেই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকাটা কিছুটা সহজ হয়ে যায়।

সায়ন পেছন ফিরে ব্রাউনের মুখটা দেখল। মানুষটাকে তার খুব ভাল লেগে গেল। কিন্তু সেই নেপালি ছেলেটি, কী নাম তার? সে ব্রাউনকে জিজ্ঞাসা করল।

ব্রাউন বলল, ওর নাম ছিল পবন, পবন বাহাদুর।

তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্যদেব চলে গেছেন পশ্চিমের পাহাড়ে। হঠাৎ একটি বাঁক ঘুরে ডাক্তার গাড়ি থামালেন, দ্যাখো, সায়ন। অস্ত যেতে এখনও বেশ দেরি এবং অস্তসুর্যের ছবি আঁকা হয়ে যাচ্ছে আকাশে, পাহাড়ে, গাছপালায়।

অপূর্ব সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সায়ন। তাদের নিরাময়ের জানলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় কিন্তু এমন চারপাশ নরম আলোয় আলোকিত ছবি দেখতে পাওয়া যায় না। ব্রাউন বললেন, কী দেখছ মাই সন।

কী সুন্দর!

যা সুন্দর তাই ঈশ্বর। আমরা সবাই ঈশ্বরদর্শন করছি।

ডাক্তার হাসলেন, সে কী মিস্টার ব্রাউন! আপনি তো যিশুর সেবক!

ঠিকই ডাক্তার। যিশুও তো এই ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোনোর ক্ষমতা আমাদের নেই বলেই যিশু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

মিস্টার ব্রাউনের বাড়ি নিরাময় ছাড়িয়ে সামান্য ওপরে। ডাক্তার তাঁকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হলেন না। বললেন, এই একশো গজ রাস্তায় আমার জন্য কেউ কেউ অপেক্ষা করছে ডাক্তার। তাদের বঞ্চিত করা ঠিক কাজ হবে না।

নিরাময়ের গেটে মিস্টার ব্রাউনের সঙ্গে সায়ন নেমে পড়ল। ডাক্তার গ্যারেজে গাড়ি ঢোকাবার আগে বললেন, তুমি মিনিট কুড়ি বাইরে থাকতে পারো তবে বেশি ওপরে উঠো না। মনে রেখো, মিনিট কুড়ি।

নিরাময় থেকে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে ওপরে যে উঠেছে তা একেবারে খাড়াই নয়। এই পথে হাঁটতে তেমন অসুবিধে হয় না সায়নের। এখন বাতাসের দাঁত আরও একটু ধারালো হয়েছে। মিস্টার ব্রাউনের সঙ্গে কয়েক পা হাঁটতেই একটা কালো কুকুর ছুটে এসে লেজ নাড়তে লাগল প্রবলভাবে। মিস্টার ব্রাউন বললেন, নো, নো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক নইলে কিছুই দেব না। দুবার বলতেই কুকুরটা স্থির হয়ে গেল। মিস্টার ব্রাউন পকেট থেকে একটা দিশি বিস্কুটের দু টুকরো বের করে কুকুরটাকে দিতেই সে খপখপ করে তুলে নিয়ে উল্টো দিকে দৌড়ে চলে গেল। কয়েক পা হাঁটতেই দেখা গেল আর একজন দাঁড়িয়ে আছে, এটির রং সাদা। মিস্টার ব্রাউনকে দেখে সে পা মুড়ে বসে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল। মিস্টার ব্রাউন হাসলেন, ওকে আগে বিস্কুট দিইনি বলে-, হ্যালো হোয়াইটি। কাম হিয়ার।

কুকুরটি নড়ল না। সায়ন দেখল মিস্টার ব্রাউন হোয়াইটির কাছে গিয়ে অনেক সাধ্যসাধনা করে শেষপর্যন্ত ওর মান ভাঙালেন। কুকুরটি বিস্কুট খাওয়া শুরু করলে ফিরে এসে বললেন, এই এরা হল আমার বন্ধু। আমি তো একা থাকি, রাত্রে ওরা আমাকে সঙ্গ দেয়।

আপনি একা থাকেন?

ইয়েস মাই সন। আমার তিন ছেলে। তিনজনই জীবনে প্রতিষ্ঠিত। একজন আছে শিলিগুড়িতে। সে একটা বড় নার্সারি স্কুল চালায়। দ্বিতীয়জন বোম্বেতে। জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করে। আর ছোটটা চার্চে আছে। এখন সিমলায়। ও ধর্মযাজক। আমার স্ত্রী মারা গিয়েছেন অনেকদিন হল। তখন আমি জাহাজে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসার সময় ভারত মহাসাগরে খবরটা পাই। মাথা নাড়লেন মিস্টার ব্রাউন, ওই যে বাড়িটা দেখছ ওটা আমার স্ত্রী তৈরি করেছিলেন। জাহাজ থেকে আমি টাকা পাঠাতাম আর তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একটু একটু করে বানিয়েছিলেন। আমাকে ছেলেরা তাদের কাছে থাকতে বলেছিল। কিন্তু এই বাড়ির মায়া আমি ছাড়তে পারি না। ও নেই, কিন্তু ওই বাড়িতে থাকলে আই ক্যান ফিল হার। কথা বলতে বলতে ওপর থেকে নেমে আসা এক দম্পতির দিকে হাত তুলে বললেন, যিশু তোমাদের মঙ্গল করুন।

ভদ্রলোক খুব কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে নেমে গেলেন।

হঠাৎ সায়ন বলে ফেলল, আপনাকে আমার ভাল লাগছে।

থ্যাঙ্ক ইউ মাই সন। এভাবে আজকাল কেউ ভাল লাগার কথা বলে না। তোমার সঙ্গে আজ আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল, এখন থেকে আমরা অনেক গল্প করতে পারব।

এই সময় একটি মেয়েকে নীচ থেকে উঠে আসতে দেখা গেল। মেয়েটিকে সায়ন এর আগে বেশ কয়েকবার দেখেছে। ছিপছিপে শরীরে জিনস আর পুলওভারে চমৎকার মানিয়েছে। মেয়েটির ফরসা মুখে কিঞ্চিৎ মেচেতার ছোপ রয়েছে। ওকে এগিয়ে আসতে দেখে মিস্টার ব্রাউন বললেন, গুড আফটারনুন সিমি। বাজারে গিয়েছিলে?

ব্যাগ হাতবদল করে সিমি মাথা নাড়ল। এবং একই সঙ্গে ঠোঁট টিপে ধরল। মিস্টার ব্রাউন সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? কোনও গোলমাল হয়েছে।

একটা বড় নিশ্বাস ফেলে সিমি বলল, নাঃ।

ওরা কথা বলছিল নেপালিতে কিন্তু তা বুঝতে সায়নের কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। বড় এবং ছোটবাহাদূরের কল্যাণে নেপালি কথা সে অনেকটাই বুঝতে পারে। সায়নের মনে হল সিমির মনে খুব দুঃখ আছে। দুঃখী মেয়েদের মুখ ওরকম হয়। অন্তত মায়ের মুখ তো হতই।

চিঠি আসেনি?

নাঃ। না আসুক। আমার কী? আমি রোজ রোজ কুরিয়ার অফিস আর পোস্ট অফিস করতে পারব না। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আমার মতো থাকব। এখানে একটা দোকান খুলব। ব্যস। পেটের ধান্দা মিটে গেলে আর কিছু চাই না আমি। বেশ জোরের সঙ্গে কথা বলল সিমি।

মিস্টার ব্রাউন মাথা নাড়লেন, এ তো খুব ভাল কথা। তবে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত।

আর কতদিন অপেক্ষা করব? শেষ চিঠি একজন লিখেছে নয় মাস আগে আর একজন সাত মাস। তারপর আর বাবুদের কোনও পাত্তা নেই। আমি কি ফ্যালনা! রেগে গেল সিমি।

মিস্টার ব্রাউন হাসলেন, দ্যাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। যিশু নিশ্চয়ই তোমার মঙ্গল করবেন। ওহো, এতক্ষণ মনেই ছিল না। একে চেনো? এ আমার ইয়ং ফ্রেন্ড।

সিমি মাথা নাড়ল, দেখেছি। নিরাময়ে থাকে তো, তাই না? প্রশ্নটা সায়নের উদ্দেশে।

সায়ন বলল, হ্যাঁ। আমার নাম সায়ন, সায়ন রায়।

আমি সিমি। সাদা দাঁত ঝকমকিয়ে উঠল সিমির মুখে।

আলো কমে যাচ্ছিল দ্রুত। সায়ন মিস্টার ব্রাউনের দিকে তাকাল, এবার আমি যাই?

মিস্টার ব্রাউন ব্যস্ত হলেন, ও ইয়েস। তোমার এবার ফিরে যাওয়া উচিত। আমি সঙ্গে যাব?

না না। লজ্জা পেল সায়ন।

তাহলে এবার তোমাকে আমার বাড়িতে দেখতে পাব নিশ্চয়ই।

ডাক্তার আঙ্কল যদি অনুমতি দেন।

নিশ্চয়ই দেবেন। হি ইজ এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অফ মাইন। আর একটা কথা, মিস্টার ব্রাউন এগিয়ে এলেন কাছে, তুমি পৃথিবীতে কাকে বেশি ভালবাস? তোমাদের কোন দেবতাকে?

মাথা নাড়ল সায়ন, দেবতা-টেবতা না, আমি আমার মাকে সবচেয়ে ভালবাসি।

গুড। তাহলে তিনিই তোমার দেবতা। রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে তাঁর মুখ মনে করবে আর ভোরবেলায় ঘুম ভাঙামাত্র তাঁর কথা একটু ভাববে। ব্যস, দেখবে তোমার সব অসুখ সেরে যাবে।

শুনে খুব তৃপ্তি পেল সায়ন। সামান্য ঢালু রাস্তা বেয়ে ফিরতে ফিরতে সে খাদ থেকে কুয়াশাদের ওপরে উঠে আসার তোড়জোড় দেখতে পেল। এখন ঠাণ্ডা আরও বেড়েছে। পৃথিবীটা কী মায়াময় হয়ে উঠেছে। মায়াময় শব্দটি তো শুরু হচ্ছে মা দিয়ে। মা এখন কী করছে? সে চারপাশে তাকাল। খোলা আকাশ, নীল পাহাড় আর মরে যাওয়া সুর্যের আলো দেখতে দেখতে হঠাৎ তার কান্না এল। অনেক কষ্টে তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া কান্নাটাকে সে থামাল। ডাক্তার আঙ্কল বলেছেন, চোখের জল রক্তের চেয়ে দামি।

সায়ন মাথা নাড়ল। আমার শরীরে রক্ত কমে যাচ্ছিল। ডাক্তার আঙ্কলের চেষ্টায় আমি যখন হেঁটে বেড়াচ্ছি তখন নিশ্চয়ই কিছুটা রক্ত হয়েছে শরীরে। সেই রক্তের চেয়ে যদি চোখের জল দামি হয় তাহলে তা শরীরে রেখে দেওয়াই উচিত। হঠাৎ নির্মাল্যর কথা মনে এল। নিমাল্য কি এতক্ষণে শিলিগুড়িতে পৌঁছে গিয়েছে! আজ তাকে নির্মাল্যকে ছাড়াই একলা থাকতে হবে ঘরে।

.

মিস্টার ব্রাউনের বাড়িটা দোতলা কিন্তু তার বৈচিত্র্য আছে। পাহাড়ি পিচের পথটা ওপরে উঠে গিয়েছে তার দোতলার বারান্দা ঘেঁষে। একতলার সামনে খানিকটা বাগান যা ভাড়াটেরা করেছে। বাড়ির তিন দিকে জঙ্গল, এবং সেই জঙ্গলে স্কোয়াশের লতাপাতা ছড়ানো। এগুলোর কোনও মালিকানা নেই, যার ইচ্ছে সে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের গরিব মানুষগুলো ভাতের সঙ্গে স্কোয়াশের তরকারি খেয়ে দিব্যি বেঁচে আছে।

মিস্টার ব্রাউনের অবশ্য মাংস না পেলে খাওয়ার ইচ্ছে চলে যায়। এটা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। একটু ওপরে ম্যাথুজের মাংসের দোকান রয়েছে। কিন্তু দোকানটা কাল থেকে বন্ধ বলে আজ বেশি দাম দিয়ে মুরগি কিনতে হয়েছে। ম্যাথুজ যখন নেপালে গোরু কিনতে যায় তখন দোকান বন্ধ রাখে একটা দিন। ম্যাথুজ যে সেটা করতে যায়নি তা জেনেছেন ব্রাউন। জেনে ভেবেছিলেন ওর খবর নিতে যাবেন। কিন্তু আজ ওই মিটিংটার জন্যে সময় পাননি।

রাস্তা থেকে দোতলার বারান্দায় লোহার গেট খুলতেই কুকুরটা চলে এল সামনে। ব্রাউন ডাকলেন, ভুটো! বাদামি রঙের পাহাড়ি কুকুরটা ঝুলে থাকা লোমের ফাঁক দিয়ে তাকে একবার দেখল। দেখে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। ব্রাউন হাসলেন, চিকেনের টুকরো ভুটোর একদম পছন্দ নয়! কুকুরটার খাওয়ার অভ্যেস তিনিই খারাপ করে দিয়েছেন। ওর সলিড মাংস চাই।

একদা স্বাস্থ্য ভাল ছিল ব্রাউনের। নেপালিদের তুলনায় তিনি বেশ বেশি লম্বা, চেহারাও ভারী। ইদানীং মেদ জমেছে শীরে। সত্তর বছর বয়সটা তো কম নয়! স্ত্রী বেঁচে থাকতে প্রায়ই বলত মদ খাওয়াটা এবার ছাড়ো। নইলে মদ তোমাকে খেয়ে নেবে।

জাহাজে চাকরি করার সুবাদে পৃথিবীর অনেক দেশের মদ তিনি খেয়েছেন। তিরিশ বছর ধরে সমুদ্রে ভেসে ভেসে অভ্যেসটা পাকা হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ মদই, তার বেশি কিছু নয়। অন্য নাবিকরা যখন কোনও বন্দরে নামমাত্র মেয়েমানুষের কাছে ছুটত তখন তিনি চার্চে যেতেন। চার্চে গিয়ে যিশুকে বলতেন মদ খেতে আমার এত ভাল লাগে কেন? যদি ভালই লাগে তাহলে সেটা ছাড়তে হবে কেন? এই সব প্রশ্ন-ট্রশ্ন করলে মন হালকা হয়ে যেত। অন্যায়বোধটা আর তেমন তীক্ষ্ণ থাকত না। কিন্তু এটা ঠিক, দামি দামি মদ খেয়ে যে সুখ হত না তা এখানকার পাহাড়ি মদ খেয়ে হয়।

ব্রাউন দেখলেন নবকুমারের মা আসছে হাতে ক্যান ঝুলিয়ে। ওর সঙ্গে তাঁর মাসচুক্তি করা আছে। প্রতিদিন বিকেলে এক ক্যান ঘরে-তৈরি মদ দিয়ে যায় বুড়ি। মাস গেলে টাকা নেয়। ব্রাউন তাড়াতাড়ি দরজা খুললেন। সুন্দর সাজানো বসার ঘর। বাঁ দিকের ঘরটা উপাসনার। ভেতরে দুটো শোওয়ার ঘর, কিচেন আর টয়লেট। টেবিলের ওপর ধোওয়া বোতলগুলো রাখা ছিল। নবকুমারের মা কোনও কথা না বলে ক্যান থেকে মদ বোতলে ঢেলে দিল। সাড়ে তিনটে বোতলের রং পালটে গেলে নবকুমারের মা বলল, সামনের মাসে তিরিশ টাকা বেশি দিতে হবে।

ব্রাউন মাথা চুলকালেন, আবার দাম বাড়াচ্ছে?

আমি বাড়াচ্ছি, না সরকার বাড়াচ্ছে? প্রশ্ন করে উত্তরের জন্যে না দাঁড়িয়ে বুড়ি যেমন এসেছিল তেমনি ফিরে গেল।

এই সময় কুঁই কুঁই ডাক শুনে দেখলেন ভুটো লেজ নাড়ছে। ব্রাউন হাসলেন, ব্যাটা ভুটো, তোরও দেখছি নেশা হয়ে গেছে!

এই সময় রাস্তা থেকে গলা ভেসে এল, যিশু কা বড়াই।

ব্রাউন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, যিশু কা বড়াই।

তারপর বারান্দায় এসে দেখলেন সুন্দর পোশাক পরে ট্যাক্সি ড্রাইভার তামাং তার বউকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। ব্রাউন নেপালিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

ওর বোনের বাড়িতে। বোনের বাচ্চা হয়েছে।

বাঃ। খুব ভাল। কিন্তু ফিরতে তো রাত হবে, সঙ্গে টর্চ নিয়েছ?

বউটি চাদরের আড়াল থেকে টর্চ বের করে দেখিয়ে হাসল। ওরা নেমে গেল।

আকাশের আলো নিবে যাচ্ছে। কুয়াশারা তেড়েফুঁড়ে উঠে আসছে ওপরে। ব্রাউন দরজা বন্ধ করে প্রার্থনার ঘরে ঢুকলেন। যিশুর মূর্তির সামনে বসে মোমবাতি জ্বাললেন। এই মূর্তিটা তিনি কিনেছিলেন অনেক বছর আগে লিভারপুল থেকে। যিশু তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টির সামনে পৃথিবীর কোনও অন্ধকার আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ব্রাউন চোখ বন্ধ করলেন। যিশুর মুখখানা, ওই চাহনি মনে করতেই সমস্ত জগৎসংসার মুছে গেল মন থেকে। প্রায় মিনিট দশেক এক অপার্থিব আনন্দে ভেসে গেলেন তিনি। তারপর ভুটোর ডাক কানে যেতেই চোখ খুললেন তিনি। প্রার্থনায় বসলেই ভুটো ওইভাবে ডাকবে। প্রথম প্রথম বিরক্ত হয়েছিলেন। পরে মনে হয়েছে, এও বোধহয় প্রভুর ইচ্ছা। দশ মিনিটের বেশি তাঁকে বসতে দিতে তিনি রাজি নন।

দরজার বাইরে আসতেই ভুটো লেজ নাড়তে লাগল প্রবলভাবে। এই বাড়ির প্রায় সব ঘরেই কুকুরটির যাতায়াত অবাধ শুধু এই প্রার্থনার ঘরের দরজা কখনও সে ডিঙোয় না। হাত ধুয়ে কিচেনে চলে এলেন তিনি। মাংস নেই কিন্তু একটু কিমার তরকারি পড়েছিল সেটাই গ্যাসে গরম করে নিয়ে শোওয়ার ঘরে চলে এলেন। না, ম্যাথুজের খবর কাল সকালেই নিতে হবে। আচমকা মাংসের দোকান বন্ধ করল কেন?

বিছানার সামনে বেতের আরাম-চেয়ারের পাশে ডিশ রাখলেন ব্রাউন। গ্লাস এবং বোতল নিয়ে এলেন। তারপর উল্টোদিকের ঘরের টিভিটা চালু করলেন। আরাম চেয়ারে বসে গ্লাস ভর্তি করতেই ভুটো কুঁই কুঁই করে উঠল। চুমুক দেওয়ার আগে প্রিয় কুকুরের দিকে তাকালেন, সরি ভুটো! মাংস নেই। একটু কিমা তোকে দিতে পারি। প্লেট নিয়ে আয়।

বলামাত্র ঘরের কোণে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের প্লেটটা মুখে করে নিয়ে এল ভুটো। ব্রাউন নিচু হয়ে তার ওপর দু চামচ কিমার তরকারি ঢেলে দিলেন।

বড় ভাল বানায় বুড়ি। কত দেশ ঘুরলেন এরকম জিনিস কখনও খাননি। বউ বলত, ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে ভাল হত। দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তিনি তাকালেন। বড় ভাল ছিল বউটা। এই যে বাড়িটা, তিনি বসে আছেন, এ ওই বউ-এর জন্যে। জাহাজ থেকে টাকা পাঠাতেন আর তাই দিয়ে ছেলেমেয়ে মানুষ করা থেকে এই বাড়ি বানানো সব ওই বউ করেছে। ভাল মানুষদের যিশু তাড়াতাড়ি কাছে ডেকে নেন। তার মানে, তিনি খারাপ মানুষ। মনে আছে একবার ডারবানে তাঁকে ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্টদের মারপিটের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তিনি প্রাণ বাঁচাতে কখনও ক্যাথলিক কখনও প্রটেস্ট্যান্ট হয়েছিলেন। ভাল লোক হলে তাঁর প্রাণ হয়তো সেদিনই বেরিয়ে যেত। বেরিয়ে যিশুর কাছে কি যেত? কিন্তু মা মেরি না থাকলে যিশু পৃথিবীতে আসতেন কী করে? কে বড় এ নিয়ে যারা বড়াই করে তাদের সঙ্গী না হওয়া কি খারাপ লোকের কাজ! মদ খেতে খেতে ব্রাউন নিজের মুখে হাত বোলালেন। জীবনে কুকর্ম অনেক করেছেন। সারাজীবন মদ খেয়েছেন প্রচুর। জুয়ো খেলেছেন। অন্য জাহাজিদের পাল্লায় পড়ে দু-একবার ক্যাবারে দেখতে গিয়েছিলেন ইউরোপে। দেখে ভাল লাগেনি। মেয়েমানুষের বস্ত্রহীন শরীর দেখে রাতের পর রাত যারা উল্লসিত হয় তাদের কীরকম নির্বোধ বলে মনে হয় তাঁর। গঠনের সামান্য তারতম্য ছাড়া যিশু তো তাদের আলাদা করেনি। একজনকে পরিপূর্ণ মনে দেখার পর আর আকাঙ্ক্ষা কী করে থাকে?

টিভিতে জ্যোতি বসুকে দেখাচ্ছে। খবর হচ্ছে। জ্যোতি বসু বলছেন পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। ওদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু পৃথক রাজ্যের দাবি কিছুতেই মেনে নেওয়া হবে না।

ব্রাউন মাথা নাড়লেন। কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এর চেয়ে ভাল কিছু বলতে পারেন না। হয়তো এই বক্তব্যের প্রতিবাদে আগামীকাল দার্জিলিং জেলায় বনধ ডাকা হবে। একনাগাড়ে দু-তিন মাস বনধের অভিজ্ঞতা যাদের হয়ে গেছে এক-দু দিনের বন্ধ তাদের নতুন কোনও অসুবিধে তৈরি করে না।

দরজায় শব্দ হল। এখন তাঁর কাছে কারও আসার কথা নয়। মাঝে মাঝে ডক্টর তামাং তাঁর রুগি দেখতে এ পাহাড়ে আসেন। ফেরার পথে তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এক গ্লাস খেয়ে নেমে যান। কিন্তু ডক্টর এলে তো তাঁর গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যেত আর ভুটোও চুপচাপ বসে থাকত না। তিনি উঠতেই ভুটো লেজ নাড়তে নাড়তে দরজার দিকে ছুটল। বাইরের আলো জ্বেলে দরজা খুলতেই সিমি বলে উঠল, তাড়াতাড়ি করো, ঠাণ্ডায় মরে যাচ্ছি। উঃ কী ঠাণ্ডা আজকে।

দ্রুত ভেতরে ঢুকে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল, মাল খাচ্ছিলে বুঝি?

সিমির হাতে একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি। উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে বলল, নাও। মা পাঠিয়ে দিয়েছে।

কী আছে ওতে?

খাসির মাংস। বাপ কিনে এনেছে। ব্রাউনের হাতে বাটি ধরিয়ে দিয়ে সে ছুটল শোওয়ার ঘরে, টিভির সামনে। তারপর তার চিৎকার শোনা গেল, ধুস, এসব কী দেখছ! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হিন্দি ছবির উত্তেজক গান কানে এল ব্রাউনের। তিনি কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই ভুটো তাঁর সামনে দু পায়ে ভর রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্রাউন হাসলেন, সাবাস বেটা, বাটির মুখ ঢাকা তবু গন্ধ পেয়ে গেছিস! ঢাকনা খুলে দেখলেন, একজনের পক্ষে একটু বেশি মাংস পাঠিয়েছে সিমির মা। ওই মহিলা তাঁর স্ত্রীর বান্ধবী ছিলেন। মাথা নাড়লেন ব্রাউন। তারপর ভুটোকে তার প্রাপ্য মাংস দিয়ে শোওয়ার ঘরে এসে বসলেন। টিভিতে তখন প্রচণ্ড বেগে শরীর নাচিয়ে চলেছে একটি মেয়ে। তার পোশাকও খুব সংক্ষিপ্ত। সিমি বসে আছে বিছানার ওপর। তার চোখ ওই দৃশ্য গিলছে।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ে হয়ে মেয়েদের শরীর দেখানো নাচ দেখতে তোর ভাল লাগে? মেয়েটিকে তিনি এযাবৎকাল তুমি বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই তাঁর মুখ থেকে তুই বের হল।

বাঃ, দেখার জিনিস দেখব না কেন? আমাদের টিভিতে কেবল নেই। মা কিছুতেই নেবে না। দিনের বেলায় এলে মা কিছু বলে না। রাত্রে যেখানে দেখতে যাব মা না বলে দেবে। আমাকে এক গ্লাস দাও না, চটপট! হাত বাড়াল সিমি।

তুই মদ খাবি?

হুঁ। খুব ঠাণ্ডা লাগছে। এক গ্লাস দাও। তুমি তো রোজ গ্লাসের পর গ্লাস খাচ্ছ। খারাপ লাগলে নিশ্চয়ই খেতে না। দাও, দাও, বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। জলদি! আবদার চোখেমুখে এঁকে ফেলল সিমি। ব্রাউনের প্রথমে মজা লাগছিল। তারপর বিরক্তি থেকে রাগ এল। কিন্তু তবু তিনি হাসলেন, আমার নিজের পায়ে কুড়োল মারার শখ হয়নি। তোকে মদ খাওয়ালে তোর মা আর কখনও আমাকে খাবার পাঠাবে না।

ইস! মা জানতেই পারবে না।

মেয়েরা মদের গন্ধ কুকুরের মতো টের পায়।

এই, তুমি মাকে কুকুর বললে?

কথা বলার ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন ব্রাউন। সেই সময় টিভির পর্দায় নৃত্য এবং সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গত করে পুরুষের শরীরে উপুড় হয়ে নারীটি নিজেকে ঢেঁকির মতো ব্যবহার করছিল। সিমির চোখ বিস্ফারিত হয়ে সেই দৃশ্যে এঁটে গেছে। ব্রাউন মেয়েটিকে দেখলেন। তাঁর নাতনির থেকে সামান্য বড়। কিন্তু–।

এবার দৃশ্যটি পাল্টে যেতেই মাথা নেড়ে সিমি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। অদ্ভুত বোকা বোকা হাসি। ব্রাউন বললেন, এবার তুই বিয়ে করে ফ্যাল।

এক বুক বাতাস নাকমুখ দিয়ে বের করে সিমি বলল, কাকে করব? এখানে কোনও ছেলে আছে নাকি? সবার ধান্দা একবার আমার শরীরকে ঠুকরে কেটে পড়ার।

তোর বয়ফ্রেন্ডরা কি আর ফিরবে না?

কী জানি! আমেরিকায় মেয়েরা তো আমাদের থেকেও ফরসা, তাই না?

আবার কালো মেয়েও রয়েছে সেখানে।

তবে? না, কালোর দিকে ওরা তাকাবে না। ফরসা মেয়ে পেলে আমার কথা কি ওদের মনে থাকবে? না থাকুক। আমি ঠিক করেছি আর চিঠি এসেছে কি না দেখতে যাব না। এই মোড়ের মাথায় দোকান করব। চাল ডাল আটা, আমার দোকান থেকে কিনবে তো?

নিশ্চয়ই কিনব। কিন্তু ওসবের দোকান করে কী লাভ হবে? এই পাহাড়ে অন্তত পাঁচটা ওরকম দোকান আছে। তুই অন্য কিছু ভাব।

কী ভাবব?

ব্রাউন চোখ বন্ধ করলেন, তুই মাংসের দোকান কর।

মাংস!

হ্যাঁ। আমি ম্যাথুজের সঙ্গে কথা বলব। ওর ওখানে প্রচুর জায়গা আছে।

কিন্তু মাংস বিক্রি করতে হলে রক্ত দেখতে হবে যে। আমি রক্ত সহ্য করতে পারি না। উঃ। মাথা দোলাতে লাগল সিমি।

সহ্য করতে পারি না বললে চলবে কেন? মাংস খাওয়ার সময় তো রক্তের কথা মনে থাকে না, থাকে? তবে! নিজে না কাটতে পারিস লোক রাখবি। সে আড়ালে কাটবে। এখানে তো ম্যাথুজের ছাড়া আর কোনও দোকান নেই। দেখবি হু হু করে চলবে। দু বছরের মধ্যে আমেরিকায় যাওয়ার ভাড়া পেয়ে যাবি।

সত্যি বলছ? সিমি খাট থেকে নেমে দাঁড়াল, দেখো, কথা বলে দেখো। ম্যাথুজ তো আমার সঙ্গে কথাই বলে না। লোকটা কসাই না সন্ন্যাসী তাই আমি ঠিক বুঝতে পারি না। সিমি চলে গেল। ভুটো গেল ওর পিছু পিছু। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এল। ব্রাউন মাংসের টুকরো চামচে তুলে মুখে পুরল। ইস, নুন হয়নি একটুও। এই শীতের মধ্যে চেয়ারের আরাম ছেড়ে নুন আনতে যেতে হবে!

.

এখানে ভোর হয় ছটার পরে। রোদ ওঠে তার এক ঘণ্টা বাদে। চারপাশের কাছের পাহাড়গুলো শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে থম মেরে থাকে যতক্ষণ সুর্যের দেখা না মেলে। ব্রাউনের ঘুম ভেঙে যায় চারটের পরেই। পাঁচ ঘণ্টার বেশি বিছানায় থাকতে পারেন না তিনি। তখন চারপাশে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কোথাও কোনও শব্দ নেই। ঘুমন্ত ভুটো বিরক্ত চোখে তার মনিবকে বাথরুমে যেতে দেখে। পরিষ্কার হয়ে প্রার্থনার ঘরে যান ব্রাউন।

ঘুম ভাঙার আগে তিনি আজ অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন। আকাশ থেকে একটি নক্ষত্র দলছুট হয়ে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। দূর মহাকাশ আলোয় মাখামাখি। আর একটি নক্ষত্রের সঙ্গে তার প্রবল সংঘর্ষ হতে সে ছিটকে হারিয়ে গেল কোথাও। কিন্তু তার শরীরের একটি খণ্ড ধীরে ধীরে নেমে আসছিল পৃথিবীর দিকে। একে কি উল্কাপাত বলে! জাহাজে চাকরি করার সময় মাঝসমুদ্রে গভীর রাতে ব্রাউন অনেক উল্কাপাত দেখেছেন। কিন্তু তার সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। ব্রাউন দেখলেন নক্ষত্রের খণ্ডটি ক্রমশ গোলাকার হয়ে ছোট হয়ে আসছে। তারপর তাদের এই পাহাড়ের ওপর চলে এসে ধীরে ধীরে নেমে গেল নিরাময়-এর ওপর। নিরাময় তখন গভীর ঘুমে শান্ত। ব্রাউন প্রথমে ভেবেছিলেন নক্ষত্রখণ্ডটি নিরাময়কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দেবে। কিন্তু তার বদলে তিনি চেয়ে দেখলেন অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে নিরাময়-এর বাড়িটিকে। এমন কী ওর সামনে যেসব শৌখিন গাছগাছালি ডাক্তার পুঁতেছিলেন তাদের এখন দারুণ সজীব দেখাচ্ছে।

এর পরেই ঘুম ভেঙে গেল। এ কীরকম স্বপ্ন? প্রার্থনার ঘরে যিশুর মূর্তির সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে তিনি চোখ বন্ধ করলেন। প্রভু যখন জন্মেছিলেন তখন নক্ষত্র পথ চিনিয়ে দিয়েছিল। নিরাময়ে কেউ জন্মাতে আসে না। রক্তের রোগ যাদের জীবন ক্ষণস্থায়ী করে দেয় তাদের আরাম দিতে ডাক্তার ওই সেবাকেন্দ্র করেছেন। তাহলে ওই আলোকিত আকাশের মায়া ওই বাড়িতে গেল কেন! ব্রাউন শিহরিত হলেন। যিশুর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি অদ্ভুত নাড়া খেলেন। হ্যাঁ, ওই চিবুকের সঙ্গে অদ্ভুত মিল। আর সেই মিলটা খুঁজে পেতেই যিশুর মুখের বদলে ওই মুখ মনে ভেসে উঠছে। ব্রাউন খুব উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। নিজেকে শান্ত করার জন্য তিনি যিশুকে ডাকতে লাগলেন।

তারপর এক সময় অন্ধকার সরে গেল পৃথিবীর শরীর থেকে। সারারাত হিমে ভেজা পাহাড়ের গাছগুলো, রাস্তাটা এখন ছায়ামাখা, স্থির। সমস্ত শরীর গরম কাপড়ে ঢেকে, মাথায় টুপি, গলায় মাফলার জড়িয়ে ব্রাউন বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। নীচে নিরাময় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে। এই পাহাড়ের বাসিন্দাদের মতো নিরাময়ের মানুষদের ঘুম ভাঙেনি। ব্রাউন রাস্তায় নেমে এলেন। ভুটো তাঁর পেছন পেছন কয়েক পা এসে দাঁড়িয়ে গেল।

ধীরে ধীরে নিরাময়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন ব্রাউন। আশ্চর্য! বাড়িটাকে আজ একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে। গির্জার সামনে দাঁড়ালে মনে যে অনুভূতি আসে ঠিক সেইরকম বোধ হচ্ছে। একটা বাচ্চা ইউক্যালিপটাসের গাছ যাকে গতকালও ভাল করে নজরে পড়ত না আজ তাকেও কী গর্বিত দেখাচ্ছে। তাহলে কি তাঁর দেখা স্বপ্নটা শুধুই স্বপ্ন ছিল না। নিরাময়ের গেট বন্ধ। বাড়ির সব কটা জানলা এখনও রাতের রেশ নিয়ে রয়েছে। এই সময় ডাকাডাকি করা অন্যায় হবে। আর ডাকাডাকি করে লোক জাগিয়ে তিনি কী বলতে পারেন! যুক্তি প্রবল হলে আবেগ সঙ্কুচিত হয়। তবু ব্রাউন দাঁড়িয়েছিলেন। এই সময় দেখতে পেলেন কালো অলেস্টার, মাথায় টুপি হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ফাদার জোসেফ উঠে আসছেন। খুব ধীরে ধীরে হাঁটছেন ভদ্রলোক। ব্রাউন চিৎকার করলেন, গুড মর্নিং ফাদার। যিশু কা বড়াই।

গুড মর্নিং। যিশু কা বড়াই। ভাল আছ মিস্টার ব্রাউন?

আমি? আমি তো কখনও খারাপ থাকি না। তা আপনি এই কাকভোরে কোত্থেকে আসছেন? খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। ব্রাউন কাছাকাছি হলেন।

ওই একটু। গত আটচল্লিশ ঘণ্টা একটুও ঘুমোতে পারিনি। ঠিক হয়ে যাবে।

কোনও খারাপ খবর ফাদার?

হ্যাঁ। পরশু নিমা বাহাদূরের মা প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বেচারারা এত গরিব যে ট্যাক্সি জোগাড় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা নেই। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সটাও খারাপ। পরশু সারারাত তাঁর পাশে থাকতে হয়েছিল। সকালে জ্বর কমতেই আমি হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। দিনের বেলায় তো চার্চে নিশ্বাস ফেলার অবকাশ কম। আবার গত রাত্রে খবর এল মিস্টার রায়ের অবস্থা খুব খারাপ।

মিস্টার রায়? ঝোরার পাশে দোতলা বাড়ি?

হ্যাঁ। উনি তো ইদানীং এখানে থাকতেন না। তবে আমাদের চার্চের জন্য একসময় অনেক করেছেন। রাত এগারোটা নাগাদ ওখানে যাই। ডাক্তার তামাংও ছিলেন। তিনি বললেন কিছু করার নেই। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। মিস্টার রায়ের জ্ঞান ছিল। তিনি আমাকে প্রেয়ার করতে বললেন ওঁর জন্যে। আমার ব্যাগে কিছু ওষুধ ছিল। ডক্টর তামাং চলে গেলে আমি তার একটা দিতে চাইলাম। কিন্তু মিস্টার রায় জেদ ধরলেন তিনি আর ওষুধ খাবেন না। লক্ষণ যা ছিল তাতে ওষুধ কোনও কাজ করত না বলেই মনে হয়। ওঁর পাশে বসে প্রে করতে আরম্ভ করলাম। ঠিক ভোর পৌনে চারটের সময় তিনি চলে গেলেন। এখন অনেক কাজ বাকি। বুঝতেই পারছেন–! ফাদার জোসেফ হাসলেন।

কখন বললেন? ভোর পৌনে চারটের সময়?

হ্যাঁ। কেন বলুন তো?

না। কিছু নয়। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ব্রাউন। ঠিক ওই সময় তিনি স্বপ্নটা দেখেছিলেন। মিস্টার রায় যদি পুণ্যবান মানুষ হন তাহলে নক্ষত্রটা ওপর থেকে নীচে নেমে আসবে কেন? তার তো নীচ থেকে ওপরে চলে যাওয়ার কথা।

এই সময় গুড মর্নিং শব্দটা কানে আসতেই ওঁরা দুজন ঘুরে দেখলেন নিরাময়ের গেট খুলে ডাক্তার বেরিয়ে আসছেন মর্নিং ওয়াকের পোশাকে।

ওঁরা দুজনেই একসঙ্গে গুড মর্নিং বললেন।

ডাক্তার কাছে এসে হাসলেন, আমার কী সৌভাগ্য! ভোরবেলায় আপনাদের মতো দুজন মানুষকে দেখতে পেলাম।

ব্রাউন বললেন, নীচে ঝোরার পাশে মিস্টার রায় বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন। আজ ভোরে তিনি মারা গিয়েছেন। ফাদার সারারাত তাঁর পাশে ছিলেন।

ও হো। তাই নাকি! মিস্টার রায়কে আমি দু-একবার দেখেছি। কিন্তু উনি তো শুনেছি কলকাতায় থাকতেন। খারাপ লাগছে শুনে, খুব খারাপ লাগছে।

ফাদার বললেন, তাহলে আমি এবার যাই?

ব্রাউন বললেন, দাঁড়ান। ডক্টর, একটা আবদার করতে পারি?

ডাক্তার হেসে ফেললেন, স্বচ্ছন্দে।

আমার বাড়িতে এসে একটু চা পান করুন।

এ কী কথা? আমার নিরাময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আপনারা, আগে আমার এখানে আসুন তারপর না হয় আপনার ওখানে যাওয়া যাবে। আসুন আসুন। ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ডাক্তার। হাত বাড়িয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।

ফাদার জোসেফের ইচ্ছে ছিল না। চার্চে তাঁর প্রচুর কাজ বাকি। কিন্তু মিস্টার ব্রাউনের অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। অফিসঘরে তাঁদের বসিয়ে ডাক্তার ভেতরে চলে গেলে ব্রাউন উৎসুক চোখে চারপাশে তাকালেন। সামনে একচিলতে সমতল জমি, তার ওপারে দোতলা বাড়িটিতে রুগিরা থাকে। বেশির ভাগেরই বয়স দশ থেকে কুড়ির মধ্যে। ব্রাউন ফাদার জোসেফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ফাদার, এখানে এসে আপনার অন্য কোনওরকম অনুভূতি হচ্ছে কি? একটু আলাদা!

ফাদার বিস্মিত হলেন, না তো! তারপর মনে পড়ে যাওয়ায় বললেন, ও, বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, তা তো হয়ই। এতগুলো ছেলেমেয়ে ওই দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত আর ডাক্তার তাদের বাঁচিয়ে রাখার কী চেষ্টাই না করে চলেছেন! এখানে এলে মন যেমন খারাপ হয় আবার ভালও লাগে। বাড়িতে থাকলে ওরা কেউ এতদিন বাঁচত না। প্রথম যখন ডাক্তার আমার কাছে অ্যাপ্রোচ করেন তখন একটু অবাক হয়েছিলাম। উনি শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং-এর ব্লাড ব্যাঙ্কের ওপর ভরসা না করে সরাসরি ফ্রেশ ব্লাড চান তাঁর পেশেন্টদের জন্যে। আজ প্রায় একশোজন মানুষ তাদের বিভিন্ন গ্রুপের রক্ত দিয়ে ডাক্তারকে চিকিৎসায় সাহায্য করছেন, এও তো ঈশ্বরেরই ইচ্ছায় সম্ভব হয়েছে।

ব্রাউন মাথা নাড়লেন। এসব তথ্য তিনি জানেন। এ নিয়ে একসময় বিরুদ্ধপ্রচারও হয়েছিল। বাঙালি ডাক্তার নেপালিদের রক্ত শুষে নিতে চাইছে। সেইসময় যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। কিন্তু আজ ফাদারের কাছে তিনি অন্য কথা আশা করেছিলেন। এ কথা ঠিক সাধারণ মানুষের থেকে ফাদার জোসেফ অনেক বেশি ঈশ্বরনিবেদিত মানুষ। যিশুর অপার কৃপা ওঁর ওপর বর্ষিত হয়েছে। কোনও সমস্যা নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করলে মন কীরকম ভাল হয়ে যায়। তা সে-ই মানুষের আলাদা অনুভূতি থাকবে না? স্বপ্নে দেখা নক্ষত্রের খণ্ড এই নিরাময়ের ওপর নেমে এসেছিল। ওটা স্বপ্ন হলেও এই বাড়িটার গায়ে জ্যোতি ছড়িয়ে দিল কে? একটুও কি আলাদা মনে হচ্ছে না? এটা জানবার জন্যেই তিনি গায়ে পড়ে চায়ের কথা তুলেছিলেন।

ডাক্তার একটা ট্রেতে তিন কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এলেন।

ফাদার বললেন, আমরা একটা অন্যায় করলাম। আপনার মর্নিং ওয়াকে বাধা পড়ল।

চায়ের কাপ হাতে হাতে তুলে দিয়ে ডাক্তার বললেন, অন্যায় কেন হবে। ঠিক আছে।

না ডাক্তার। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জীবনযাত্রা আছে। ভোরবেলায় নিত্য হেঁটে আপনি শুধু শরীরকে সুস্থ রাখেন না মনেরও আরাম পান। দেখবেন আজ সারাদিন ধরে অস্বস্তি কাজ করবে, না হাঁটার জন্য। বরং চা খেয়ে আপনি একটু ঘুরে আসুন।

ডাক্তার হাসলেন। এবার ব্রাউন প্রশ্নটা না করে পারলেন না, আচ্ছা ডাক্তার, আজ সকালে এই নিরাময়ের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে না চারপাশ বেশ উজ্জ্বল, ঝকঝকে?

ডাক্তার তাকালেন বাড়িটার দিকে, অনেকদিন পর আজ ভোরবেলায় চমৎকার আলো ছড়িয়েছে বলে আপনার কাছে উজ্জ্বল মনে হচ্ছে মিস্টার ব্রাউন। কিন্তু এই বাড়ির বাসিন্দাদের শরীর যদি এমনই আলোকিত হত তাহলে আমি বেশি খুশি হতাম। গত রাতে একটি মেয়ের অবস্থা খারাপ হয়েছিল। তখনই তাকে রক্ত দিতে হয়েছে।

ফাদার জিজ্ঞাসা করলেন, রাতে কাকে পেলেন?

ডাক্তার বললেন, ঘটনাচক্রে আমার গ্রুপের সঙ্গে ওর গ্রুপ মিলে গিয়েছিল। আর আমিও গত ছয় মাসে রক্ত দিইনি। তাই কাল কোনও সমস্যা হয়নি।

ফাদার জোসেফ চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন এই প্রার্থনা। আচ্ছা–!

ব্রাউন বললেন, এক মিনিট। ডাক্তার, গতকাল বিকেলে যে ছেলেটির সঙ্গে আপনি শহর থেকে ফিরছিলেন, কী নাম যেন, ও হ্যাঁ, সায়ন, সে কি এখনও ঘুমোচ্ছ?

ডাক্তার অবাক হলেন, কেন বলুন তো।

তাকে আমি একবার দেখতে পারি কি? অবশ্য যদি তার ঘুম ভেঙে থাকে–।

ঘুম নিশ্চয়ই ভেঙেছে। সুস্থ থাকলে সায়নের এখন পড়াশুনার সময়। আপনি কি বাড়িতে থাকবেন? তা হলে ওর পড়াশুনা হয়ে গেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলতে পারি।

না না তার দরকার নেই। আমিই না হয় পরে একবার আসব। ব্রাউন ফাদারের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ডাক্তার পেছন পেছন আসছিলেন।

ফাদার বললেন, বাঃ। আপনার এখানে প্রচুর ফুল ফুটেছে তো, ডাক্তার গ্রান্ডিফ্লোরা গাছটির দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন, কী আশ্চর্য! গতকাল পর্যন্ত গাছটায় কোনও ফুল ছিল না। কুঁড়ি থাকলেও নজর দিইনি। আজ একসঙ্গে এত ফুল–প্রকৃতির মরজি বোঝা মুশকিল।

ব্রাউন কথাগুলো শুনতে শুনতে উত্তেজিত হলেন। স্বপ্নটির কথা এঁদের বলা যাচ্ছে না কিন্তু এই ফুল ফোঁটা তো সেই স্বপ্নের প্রতিক্রিয়াতে হতে পারে। তিনি বাড়িটার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, ডাক্তার, সায়নের পড়াশুনা কি এত জরুরি যে, তাকে একবার দেখা যাবে না?

ডাক্তার খুব অবাক হয়ে গেলেন, কী ব্যাপার বলুন তো!

আমি ঠিক বোঝাতে পারব না।

খুব জরুরি প্রয়োজন না থাকলে নিয়মটা না ভাঙাই উচিত মিস্টার ব্রাউন।

বেশ। চলুন ফাদার।

ওঁরা দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। ফাদার জোসেফ জিজ্ঞাসা করলেন, সায়নকে আপনার দেখতে চাওয়ার পেছনে কোনও কারণ আছে মিস্টার ব্রাউন?

না, তেমন কিছু নয়। আমি বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।

ফাদার জোসেফ আর একটু এগিয়ে বললেন, আপনার ভুটো কীরকম উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে দেখুন।

দেখা গেল ব্রাউনের বাড়ির সামনে ভুটো মুখ তুলে বসে আছে। ব্রাউন মাথা নাড়লেন, ভুলেও ভাববেন না আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওর গার্ল ফ্রেন্ডের আসার সময় হয়েছে। দুদিন সে আসেনি। ম্যাথুজের কুকুর। সে এলে ম্যাথুজ মাংস কাটবে। মাংস কাটা হলে ভুটো জানে তার খাওয়া-দাওয়া ভাল হবে। একদম সরল হিসেব।

ফাদার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এই সময় একটা মারুতি তীব্রবেগে নীচ থেকে উঠে আসতে আসতে সশব্দে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22
Pages ( 1 of 22 ): 1 23 ... 22পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress