Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ২৫০% || Tarapada Roy

২৫০% || Tarapada Roy

২৫০%

আমাদের এই রাজ্যেরই কোনও এক জেলায় পাশাপাশি দুটি অঞ্চলে, দক্ষিণ রামপুর এবং উত্তর রামপুর। নামেই মালুম দক্ষিণ রামপুরের লোকেরা খুবই প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিবাদী, মৌলবাদী ইত্যাদি, ইত্যাদি। উত্তর রামপুরের লোকেরা, স্বভাবতই, প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী।

দক্ষিণ রামপুরের অঞ্চলপ্রধান হলেন, কান্তচন্দ্র রায়। আর উত্তর রামপুরের অঞ্চলপ্রধান হলেন চন্দ্রকান্ত রায়।

কান্তচন্দ্রের আর চন্দ্ৰকান্তের লোকেরা পরস্পর শত্রু। তারা দুটি বিপরীতমুখী লড়াকু দলের সদস্য।

দক্ষিণ রামপুর আর উত্তর রামপুরের মধ্য দিয়ে পুরনো বাদশাহি সড়ক গেছে, এখনকার ন্যাশনাল হাইওয়ে। সেই হাইওয়ে অতিক্রম করে উত্তরের লোক কদাচিৎ দক্ষিণে যায়, দক্ষিণের লোক কদাচিৎ উত্তরে আসে।

একেবারেই যে আসে না, সে কথা বলা যাবে না। এই তো গত মাসে দক্ষিণের লোকেরা উত্তরে এসে লুঠপাট করে বাড়ি-ঘর সব পুড়িয়ে দিয়ে গেল। তার বদলায় উত্তরের লোকেরা গত সপ্তাহে দক্ষিণের হাসপাতাল ও ইস্কুলে আগুন দিয়েছে।

আগেরবার দক্ষিণের লোকেরা উত্তরের চুয়াল্লিশটি ছাগল ভেড়া সমেত পঁচিশটি গোরু-বাছুর লুট করে নিয়ে যায়। এবার উত্তরের লোকেরা ঝুঁকিজাল নিয়ে এসে দক্ষিণের বড় বিলের সমস্ত মাছ ধরে নিয়ে চলে গেল।

দুই অঞ্চলের দুই প্রধান কান্তচন্দ্র এবং চন্দ্রকান্ত কিন্তু পরস্পর বন্ধুভাবাপন্ন। কেউ কারও শত্রুতা করেন না। তাদের দুজনের মধ্যে গালাগালি, মারামারি, লাঠালাঠি, বোমাবাজি নেই। সে যা করে, তাদের লোকেরা করে। তাদের মাথা ফাটে, বাড়ি পোড়ে, তারা জেল খাটে। কখনও সখনও দুয়েকজন যে খুন হয় না তাও নয়।

কিন্তু এসবের ফলে কান্তচন্দ্র এবং চন্দ্ৰকান্তের সৌহার্দ্যের কোনও ঘাটতি হয় না। দুজনার মধ্যে তলায় তলায় গলায় গলায় ভাব। এই তো সেদিন গোরু ছাগল লুট করে নিয়ে যাওয়ার পরের রবিবারে একজন অচেনা লোক এক থলেভর্তি, তা প্রায় কেজি দশেক হবে, পাঁঠার মাংস চন্দ্রকান্তকে দিয়ে গেল, বলে গেল, কান্তবাবু পাঠিয়েছেন।

চন্দ্রবাবুও সামাজিকতায় পিছিয়ে রইলেন না। দক্ষিণের বিলের মাছ লুট করে নিয়ে আসার দিন সন্ধ্যাতেই এক বালতিভর্তি বড় মাছের টুকরো কান্তবাবুকে পাঠিয়ে দিলেন।

এহেন বন্ধুত্ব কিঞ্চিৎ গোপনে রাখতে হয়। অঞ্চলের লোকেরা ধরতে পারলে পিটিয়ে তক্তা করবে, তদুপরি সামনের ভোটে জামানত জব্দ হয়ে যাবে।

কাছেই একটা ছোট শহর আছে। দক্ষিণ রামপুর থেকে কান্তবাবু কোনও কিছু চন্দ্রবাবুকে পাঠালে কিংবা বিপরীতক্রমে চন্দ্রবাবু কান্তবাবুকে কিছু উপহার দিলে ওই শহর ঘুরে উলটো পথ দিয়ে যায়।

এতকাল এইভাবেই দুই প্রধানের লৌকিকতা চলছিল। দেখাসাক্ষাৎ ছিল না বললেই চলে। কালেভদ্রে জেলা সদরে কাজে-কর্মে দেখা হত, সেখানেও দুজন দুই মারমুখী দলের, সামনা সামনি মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

অথচ চন্দ্রকান্ত এবং কান্তচন্দ্র বাল্যবন্ধু। ইস্কুলে একসঙ্গে পড়েছেন, একসঙ্গে বিড়ি খাওয়া শিখেছেন। একসঙ্গে লাইন দিয়ে দেড় টাকার টিকিট কিনে সিনেমা দেখেছেন। নষ্ট চন্দ্রের রাতে একসঙ্গে গৃহস্থবাড়িতে চুরি করেছেন। একসঙ্গে চুলু খেয়ে সাবালক হয়েছেন।

কিন্তু রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে দুজনের মধ্যে এখন বিরাট দূরত্ব, প্রাণ খুলে মনের কথা হয় না। কতকাল।

অবশেষে একদিন সাহস করে চন্দ্রকান্ত শহর ঘুরে একটা অটো নিয়ে পুরনো বন্ধু কান্তচন্দ্রের ওখানে সন্ধ্যার পরে এলেন। বৃষ্টির দিন ছিল, ছাতার আড়ালে তাকে কেউ দেখতে পায়নি।

জায়গাটা অনেক বদলে গেছে। কান্তদের বাড়ির সামনে আগে একটা বড় খাল ছিল, তার ওপরে চওড়া লম্বা ব্রিজ উঠেছে। কান্তদের পুরনো বাড়ির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। পুরনো ভাঙা একতলা বাড়ি এখন আড়াই তলা। বাইরেটায় তেমন রং-চং নেই, সাদামাটা কিন্তু ভেতরে মার্বেলের মেঝে, দেয়ালে দামি রং।

চন্দ্রকে দেখে কান্ত উদ্বেল হয়ে উঠল। কোথায় বসায়, কী খাওয়ায়। মুরগির রোস্ট, দামি বিলিতি মদ অনেক কিছু ব্যবস্থা হল। খেতে খেতে চন্দ্র কান্তকে বললেন, তোর অবস্থা বেশ সচ্ছল হয়েছে। দেখছি।

পানীয়ের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে পুরনো সুহৃদের কাছে কান্ত কবুল করলেন, এ সবই ওই ব্রিজটার দৌলতে। তারপর মাংসের একটা হাড় চিবোতে চিবোতে কান্ত বললেন, টোয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট কাটমানি ব্রিজের টাকা থেকে সরিয়ে ফেললাম। হাওলা-গাওলায় কত কোটি টাকা ছয়লাপ হয়েছে আর আমার তো দু-চার লাখ।..

সেদিন শেষ রাতে গ্রামের লোকজন ঘুম থেকে ওঠার আগেই চন্দ্র চুপিচুপি বাড়ি ফিরে এলেন। আসার সময় কান্তকে নিমন্ত্রণ করে এলেন।

যথা নির্দিষ্ট দিনে রাতের গভীরে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে কান্ত বন্ধুর বাড়িতে এসে পৌঁছলেন।

বন্ধুর বাড়ি দেখে কান্ত তাজ্জব, বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। ঘরে ঘরে এয়ার কন্ডিশন যন্ত্র, গ্যারেজে একাধিক নতুন জাপানি গাড়ি। পানভোজনের ব্যবস্থাও অত্যন্ত উচ্চমানের।

কিঞ্চিৎ পান করার পর কান্ত বললেন, আমার তো ব্রিজ। তোমার কী?

চন্দ্র বললেন, আমার পুকুর। ওই যে সামনে পুকুরটা দেখছ। কিন্তু পুকুর কোথায়, সামনে একটা বড় মাঠ। তার মধ্যে বড় বড় গাছ। আম-জাম-কাঁঠাল।

কান্ত বিস্ময় প্রকাশ করায় চন্দ্র বললেন, এখন নেই কিন্তু ওখানে একটা পুকুর কাটা হয়েছিল জল দপ্তরের টাকায় গত বছর। তারপর ম্যালেরিয়া নিবারণ দপ্তরের টাকায় এ বছর পুকুর বোজানো হল।

বিস্মিত কান্ত বললেন, কিন্তু অত বড় বড় গাছ কী করে পুকুরের মধ্যে ছিল? চন্দ্র বললেন, তা থাকবে কেন? আমার কি আর তোমার মতো পঁচিশ পারসেন্টের কারবার। আমার একেবারে আড়াইশো পারসেন্ট। পুকুর কাটতে একশো, পুকুর বোজাতে একশো, গাছপালা ইত্যাদি বাবদ পঞ্চাশ।

সাধু, সাধু বলে কান্ত তাঁর গেলাস আবার পূর্ণ করে নিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress