Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হেতমগড়ের গুপ্তধন || Shirshendu Mukhopadhyay

হেতমগড়ের গুপ্তধন || Shirshendu Mukhopadhyay

মাধববাবু রাগ করে

মাধববাবু রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তা মাধববাবু রাগ হলেও হতে পারে। এমনিতেই তিনি রাগী মানুষ। তার ওপর সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি দেখেন, কাঁচের গ্লাসে জলে-ভেজানো তার বাঁধানো দাঁতজোড়া নেই, ঘরে পরে বেড়ানোর হাওয়াই চটি দুটো হাওয়া, চশমাটাও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকী, ঘরের কোণে দড়িতে ঝোলানো গামছাখানা পর্যন্ত বেপাত্তা।

পল্টনের পোষা বাঁদরটা ছাড়া এ-কাজ আর কার হবে? দিনরাত খেয়ে-খেয়ে আর আশকার পেয়ে-পেয়ে সেটার চেহারা হয়েছে জাম্বুবানের মতো। কাউকে বড় একটা তোয়াক্কা করে না। এর আগেও দু-চারবার তার চুরিবিতে ধরা পড়েছে। একেই জাতে বাঁদর, তার ওপর অতিরিক্ত আদরে বদ হয়ে যাওয়ায় তার বাঁদরামির আর লেখাজোখা নেই। ইচ্ছেমতো ঘরে ঢুকে তার রেডিও চালায়, ছোটদের পড়ার টেবিলে গিয়ে খাতা-বই বেগোছ করে, পেনসিলের শিস ভেঙে রেখে আসে, দিনের বেলায় খুটখাট সুইচ টিপে আলো জ্বালায় বা শীতকালে পাখা চালিয়ে দেয়। চৌবাচ্চা থেকে মগ দিয়ে জল তুলে যার-তার গায়ে ঢেলে দিয়ে আসে। বড়বাবুর ইজিচেয়ারে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে থাকে। কেউ শাসন করতে গেলে বিশাল চেহারা নিয়ে হুপহাপ করে তেড়ে আসে। বলতে কী, তার ভয়ে বাড়ির সবাই কাঁটা হয়ে থাকে।

একেবারে ব্রাহ্মমুহূর্তে মাধববাবু বিছানা ছাড়েন। তারপর হরেক কাজ করতে হয় তাকে। বারান্দার একশো ত্রিশটা টবে গাছে চাকরদের দিয়ে জল দেওয়ানো। পুরনো আমলের বিশাল জমিদার বাড়ির সেই জৌলুস এখন আর নেই বটে, কিন্তু বিশাল আয়তনটা এখনো আছে। আর কিছু পুরনো প্রথা এবং অভ্যাস। পিছনের দিকে একটা মস্ত হলঘরে হরেক রকম পাখির খাঁচা। মাধববাবুর সকালে দ্বিতীয় কাজ হল, এইসব পাখিদের খাঁচায় ঠিকমতো দানাপানি দেওয়া হচ্ছে কি না তার তদারক করা। তারপরই শুরু হয় চার-চারটে গরুর দুধ দোয়ানো। সে সময়েও তাকেই সামনে থাকতে হয়। এরপর বিশাল বাগানের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে মালিদের দিয়ে আগাছা উপড়ে ফেলা, ফুলের বেড তৈরি করা, মৌসুমি ফলের চাষ দেখা ইত্যাদি আছে। ভাল করে আলো ফোঁটার আগেই বাজারের লম্বা ফর্দ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। সঙ্গে ধামাধরা দু-দুটো চাকর। আজ মাধববাবু কিছুই করেননি। ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠেই নিজের অত্যাবশ্যক জিনিসগুলো না-পেয়ে তেড়ে চেঁচামেচি শুরু করলেন। বলি একটা বাঁদরের এত আস্পদ্দা হয় কোত্থেকে? লেজওলাদের বোধহয় লজ্জা শরমের বালাই নেই? বলি আমার বানোত তোর গুষ্টির পিণ্ডি চিবোতে লাগবে রে হতচ্ছাড়া? চশমা দিয়ে কোন রামায়ণ মহাভারত পড়বি শুনি? গলায় দেওয়ার দড়ি জুটছে না বলেই বুঝি গামছাখানা নিয়ে গেছিস? ডান-বা জ্ঞান নেই যে বাঁদরের, সে কোন আকেলে চটি চুরি করে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই চেঁচামেচি শুনে পল্টন সবার আগে চোখ রগড়াতেরগড়াতে এসে হাজির।

“কী হয়েছে কাদামামা?”

মাধববাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, “বড় সুখের ব্যাপার ঘটেছে।

ডিয়ার ভাগ্নে, বড় সুখের ব্যাপার। এমনিতেই একদিন সংসার ত্যাগ করে লোটা-কম্বল নিয়ে সন্নিসি হব ভেবে রেখেছিলুম, তা তোমার জাম্বুবানের আলায় সেটা একটু আগেভাগেই হতে হবে দেখছি। দাঁতের পাটি নেই, গামছা নেই, চটি নেই, চশমা নেই, তাহলে একটা লোকের আর কী থাকে বলে দিকি! লোটা-কম্বল আর নেংটি ছাড়া?”

পল্টন মুখ কাঁচুমাচু করে মাথা চুলকাতে চুলকোতে বলে, “কিন্তু ঘটোৎকচ তো এখনো শিকলে বাঁধা রয়েছে দেখে এলাম। কাল রাতে তো তাকে আমি খুলে দিইনি।”

মাধববাবু যাত্রাপালার ঔরঙ্গজেবের মতো হাঃ হাঃ করে হাসলেন খুব কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “শিকল? গলার বকলশে একটা সেফটিপিনের মতো ফজবেনে হাঁসকল দিয়ে আঁটা তো? তা তুমি কি ভাবছ তোমার ঐ হাড়-বজ্জাত মহাবাঁদর সেটা খুলতে বা আটকাতে পারে না? সে কি হাওয়ায় বড় হচ্ছে? সেয়ানা হচ্ছে না?”

পল্টনও সেটা হাড়ে-হাড়ে জানে বলে বিশেষ তর্ক-টর্ক করল না। বাড়ির সবাই যখন ধরেই নিয়েছে যে, দুষ্কর্মটি ঘটোৎকচেরই, তখন সাতজন ঠিকে-ঝিয়ের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্কা এবং বকাবাজ হাঁড়ির মা ঘর মুছতে এসে বলল “কাদাবাবুর ঘরের দোর বন্ধ ছিল, জানালায় এত মোটা মোটা শিক, ঐ গন্ধমাদন তবে ঢুকল কোন ফোকর দিয়ে?”

এ কথায় সকলের চোখ খুলে গেল। বাস্তবিক, এই অতি সত্যি কথাটি তো কেউ এতক্ষণ ভাবেনি! ঘটোৎকচ তো আর দুচো ইঁদুর বা বেড়াল নয় যে, জানালা দিয়ে ঢুকবে! বড়বাবু শুনে বললেন, “মাধবের মাথাটাই গেছে।”

মাধববাবুই শুধু এর প্রত্যুত্তরে বলতে লাগলেন, “ফোকর থাক বা থাক, এ কাজ ঘটোৎকচ ছাড়া আর কারো হতেই পারে না। যেমন করেই হোক সে রাতে ঘরে ঢুকেছিল।”

বড়বাবু শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু ঢুকল কেমন করে সেটা তো বলবে!”

মাধববাবু মরিয়া হয়ে বললেন, “রাতের বেলা আমার তো তেমন ভাল ঘুম হয় না। চারবার উঠি, পায়চারি করি, তামাক বা জল খাই। তারই কোন ফাঁকে ঢুকেছিল।”

কিন্তু মাধববাবুর কথাটা কেউ তেমন বিশ্বাস করল না। এ-বাড়ির বুড়ো দারোয়ান তায়েবজি সাফ-সাফ বলে দিল, “মাধুবাবু কোনোদিন রাতে ওঠেন না। রাতভর তার নাকের ডাকে পাড়ার লোকের অসুবিধে হয়, চোর ডাকু সব তফাত থাকে।”

মাধববাবু এইসব কথায় অল্পস্বল্প রেগে যাচ্ছিলেন। তবে তখনো একদম রেগে টং হয়ে যাননি। তায়েবজির কথার জবাবে বললেন, “আমার ছেলেবেলা থেকেই ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস আছে। এখন আবছা মনে পড়ছে কাল রাতেও আমি খানিকক্ষণ জীপ-ওয়াকিং করেছিলাম যেন। দরজা খুলে বারান্দায় এসেও হাঁটাহাঁটি করেছি।”

এসব কথা বলতে বলতে মাধববাবু টের পাচ্ছিলেন যে, তিনি খুবই রেগে যাচ্ছেন। আর কথা চালাচালি হলে এবার তাঁর ভিতরে রাগের বোমাটা ফাটবে। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন, তার মাথার ভিতরে ঠিক ব্ৰহ্মতালুতে বোমাটা বসানো রয়েছে। বোমার পলতেয় আগুন দেওয়া হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে পুড়তে পুড়তে পলতেটা ছোট হয়ে এসে বোমার গায়ে প্রায় লাগে-লাগে।

ঠিক এই সময়ে অক্ষয় খাজাঞ্চি এসে বলল, “হিম শেখ পাতুগড়ের আমবাগানটা কিনবে বলে বায়না দিতে এসেছে।”

ব্যস, বোমাটা ফাটল দড়াম করে। সবাইকে চমকে দিয়ে ধমকে ওঠেন মাধববাবু, “ইয়াকি পেয়েছ? মস্করা পেয়েছ সবাই? জানো, মাধব চৌধুরী ভাল থাকলে গঙ্গাজল, আর রাগলে মুচির কুকুর?”

রোগাভোগা অক্ষয় খাজাঞ্চি ভয় পেয়ে তিন হাত পিছিয়ে চৌকাঠের ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল। তায়েবজি তার মোটা গোঁফ চোমরাচ্ছিল, আঁতকে ওঠায় একদিকের গোঁফ আঙুলের টানে ঝুলে পড়ে চিনেম্যানের গোঁফ হয়ে গেল। হাঁড়ির মা ঘর মোছর ন্যাতা দিয়ে ভুল করে নিজের মুখ মুছে ফেলল। বড়বাবুর ইজিচেয়ারটা হঠাৎ একটা দোল খেয়ে গেল জোরে। পল্টনের মুখ এমনভাবে হাঁ হয়ে ছিল যে, একটা বোল ভুল করে ঢুকে পড়ল তার ভিতরে আর পল্টনও ভুলে কেঁত করে গিলে ফেলল সেটাকে। বাড়ির আরো লোকজন সব দৌড়ে এসে ভিড় করল চারধারে।

মাধববাবু চেঁচাতে লাগলেন, “জানো, আমার দু দুটো দোনলা বন্দুক আছে! সরস্বতীর চরে গায়েব হওয়া বসতবাটী খুঁজে পেলে এখনো আমি চার-পাঁচলাখ মোহরের মালিক, তা মনে আছে তো? হিসেব করে কথা কও না, এত আম্পদ্দা তোমাদের?”

অক্ষয় খাজাঞ্চি বাইরে থেকে মৃদু স্বরে বলে, “আজ্ঞে কথাটা হচ্ছিল পাতুগড়ের আমবাগানটা নিয়ে। বৃকোদরের কথা বলিনি আজ্ঞে।”

অক্ষয় খাজাঞ্চি বহুদিন ধরেই ঘটোৎকচকে ভুল করে বৃকোদর বলে আসছেন। বহুবার তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু মনে রাখতে পারেন না।

মাধববাবু হুংকার দিয়ে উঠলেন, “চালাকির আর জায়গা পেলে! তোমাদের সব চালাকি আমি জানি। এই মুহূর্তেই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চললাম। যেখানে মানুষ আত্মসম্মান নিয়ে থাকতে পারে না সেখানে থাকার চেয়ে জঙ্গলে থাকা ভাল। আর শোনো অক্ষয়, তোমাকে এই শেষবারের মতো বলে যাচ্ছি, দ্বিতীয় পাণ্ডব বৃকোদরের সঙ্গে কখনো ঘটোৎকচকে গুলিয়ে ফেলো না। তাতে বৃকোদরের অপমান। ঘটোৎকচ তার ছেলে ছিল বটে, কিন্তু তার মা ছিল রাক্ষসী। তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘটোৎকচকে স্যাক্রিফাইস করতে কারো বাধেনি। তোমাদের ঐ নোংরা, পাজি, চোর, হাড় হাভাতে ঘটোৎকচকেও তোমরা স্যাক্রিফাইস করে দাও। তাতে সকলেরই মঙ্গল। নইলে আর একটা কুরুক্ষেত্র লাগল বলে।”

এই শেষ কথা উচ্চারণ করে মাধববাবু তার দুটো পুরনো দোনলা বন্দুকের বাক্স, শতরঞ্চিতে বাঁধা বিছানা আর একটি টিনের তোরঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এমনকী, নিজের দিদির সঙ্গে পর্যন্ত দেখা করলেন না।

দেউড়িতে বড়বাবু, পল্টন, অক্ষয় খাজাঞ্চি, তায়েবজি সমেত বাড়ির বহু লোক তার গৃহত্যাগ রোধ করতে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কারো কথায় কর্ণপাত করার লোক তিনি নন। এর আগে আর না হোক পঞ্চাশবার তিনি গৃহত্যাগ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁকে খুবই দক্ষ বলতে হবে। তাই তাকে ফেরানো যাবে না জেনে বড়বাবু একটা মোষের গাড়ির বন্দোবস্ত পর্যন্ত রেখেছেন।

বাইরে বেরিয়ে মাধববাবু তাঁর মালপত্র নিয়ে সোজা গিয়ে গাড়িতে চেপে বসলেন।

সরস্বতী নদীর ধারে লাতনপুরে মাধববাবুর এক খুনখুনে বুড়ি

পিসি থাকেন। তিনি চেনা লোককেও চিনতে পারেন না, চোখে দেখতে পান না, কানেও শোনেন না। সারাদিন আপনমনে বকবক করতে করতে ঘরের হাজারো কাজ করে বেড়ান। তার ছেলেপুলে আর নাতি-নাতনি নিয়ে বিশাল সংসার। মাধববাবু রাগ করে ঘর ছাড়লে এর বাড়িতেই এসে ওঠেন। আজও উঠলেন।

মাধববাবু যেখানেই যান, সেখানেই একটা হৈ-চৈ পড়ে যায়। তিনি দারুণ গল্প বলতে পারেন, এটেল মাটি দিয়ে চমৎকার পুতুল গড়তে পারেন, গানবাজনা করতে পারেন। তাই তাঁকে দেখেই বাড়ির কাচ্চাবাচ্চাদের কিছু দৌড়ে এসে গাড়ির গায়ে ঝুলতে শুরু করল, কেউ কোলেপিঠে চড়ে বসল, আবার একটু বড় যারা তারা দৌড়ে গেল মাধববাবুর পিসিকে খবর দিতে।

বাইরের ঘরে মাধববাবু জমিয়ে বসেছেন। বাচ্চারা তাঁর বন্দুকের বাক্স, তেরঙ্গ আর বিছানা টানা-হঁচড়া করে খোলবার চেষ্টা করছে। বাড়ির এক বউ এসে বাতাস দিচ্ছে, এক বউ জলের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে, পিসতুতো ভাইয়েরা এসে খোঁজখবর নিচ্ছে। এমন সময় কোলকুঁজো হয়ে ঘরে ঢুকে পিসি তাঁকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, “অচেনা লোক ঘরে ঢুকতে দিয়েছিস! চোর-ছ্যাচড় নয় তো! দেখিস আবার বাসন-কোসন কাপড়-চোপড় পোঁটলা বেঁধে না শটকান দেয়। এর মুখচোখ দেখে তো ভাল লোক মনে হচ্ছে না।”

কাদা ছেনে পুতুল গড়েন বলেই মাধববাবুর ডাক নাম কাদা। পিসির বড় ছেলে গদাই দৌড়ে গিয়ে মায়ের মুখে হাতচাপা দিয়ে কানে কানে বলে, “অচেনা লোক কী গো! কাদাদাদা যে।”

পিসি তা বুঝল না, তবে এক গাল হেসে ছেলের দিকে চেয়ে বলল, “তুমিও বুঝি ঐ লোকটার সঙ্গে এলে! দেখো বাপু, চুরি-টুরি কোরো না। থাকো, ঘরের কাজকর্ম করে, খাবে দাবে মাইনে পাবে।” বলে পিসি চলে গেল।

নেয়ে-খেয়ে ঘুমিয়ে বিকেলের দিকে একটা বন্দুক বগলদাবা করে মাধববাবু নিজেদের হারানো বসতবাড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। রাগ হলেই মাধববাবুর এই বাতিকটা মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে।

সত্যি বলতে কী, মাধববাবুর পিতৃ-পিতামহের অবস্থা ছিল বিরাট। সরস্বতী নদীর ওধারে হেতমগড়ে প্রায় দেড়শো বিঘা জমি ঘিরে ছিল তাদের বাড়ির সীমানা। মাঝখানে প্রাসাদের মতো বাড়ি, ফোয়ারা, আস্তাবল, জুড়িগাড়ি, গোলাপ বাগিচা, পদ্মের পুকুর। সরস্বতীর খাত বদল হওয়ায় নদীর ভাঙনে সব ভেসে গেছে। এখন আর সে বাড়ির চিহ্নও নেই। এমনকী, বাড়িটা কোন্ জায়গায় ছিল তারও হদিস কেউ দিতে পারে না। সরস্বতীর ওপারে এখন বিশাল ঘন জঙ্গল, সাপখোপের আড্ডা, বুনো জন্তুর আস্তানা। তবু মাঝে মাঝে মাধববাবু সেই বাড়িটা খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন।

নদীর এধারে আস্তে-আস্তে হাঁটতে-হাঁটতে মাধববাবু নিজের রাগের কথা ভাবছিলেন। আর মাঝে-মাঝে নদীর ওধারে ঘন জঙ্গলের দিকে চেয়ে দেখছিলেন। মধ্যে-মধ্যে হেসেও ফেলছিলেন আপনমনে। জমিদারি রক্তে রাগ থাকাটা এমনিতেই স্বাভাবিক। কিন্তু রহিম শেখের আমবাগান কেনার কথায় হঠাৎ মাথার মধ্যে বেকায়দায় বোমাটা ফেটে যাওয়াতে এখন তার একটু লজ্জা-লজ্জা করছে। কোথায় ঘটোৎকচ, আর কোথায় রহিম শেখ।

মাধববাবুর বাঁধানো দাঁতের কথা শুনে কেউ তাঁকে বুড়ো ভাবলে ভুল হবে। বলতে কী, মাধববাবু রীতিমত যুবক মানুষ। বয়স বত্রিশ টত্রিশ হবে। বছর পাঁচ-সাত আগে বিজয়পুরের জমিদারের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু সে বিয়েটাতেই যত ভণ্ডুল লেগেছিল। বিয়ের পরদিন সকালে শালীরা আদর করে এক থালা নারকেলনাড় এনে দিল। বলল, সব কটা খেতে পারলে বুঝব জামাইবাবু আমাদের বাহাদুর। শালীরা জামাইবাবুকে নানা কায়দায় জব্দ করে জেনেও অকুতোভয় মাধববাবু ঠিক করলেন, এদের কাছে হার মানা চলবে না। প্রথম নাড়টায় কামড় দিয়েই দেখলেন ভিতরে গোটা সুপুরি রয়েছে। কিন্তু এখন আর ফেরার উপায় নেই। দাঁতের জোর ছিল খুব। তাই খটাস মটাস শব্দে সুপুরিসুদ্ধ সেই নাড় চিবোতে লাগলেন। গোটা পাঁচেক খেতে পেরেছিলেন বোধহয়। কিন্তু তা করতে অর্ধেক দাঁতের চলটা উঠে গেল, কিছু নড়ল, কিছু ভাঙল। রাগ করে সেই যে শ্বশুরবাড়ি থেকে একবস্ত্রে চলে এলেন, আর কোনোদিন ওমুখো হননি। দাঁতগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই তুলে বাঁধিয়ে নিতে হল। কিন্তু যুবক হলেও বাঁধানো দাঁতগুলোর অভাবে ফোকলামুখে এখন তাঁকে রীতিমত বুড়ো দেখাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বুড়ো নন সেইটে লোকের কাছে প্রমাণ করার জন্য বুক চিতিয়ে চওড়া ছাতি ফুলিয়ে খুব দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছিলেন তিনি।

তবে তার দরকার ছিল না। নদীর ধারে একটা লোককে বন্দুক হাতে চলাফেরা করতে দেখে লোকজন ভয়ে এমনিতে তফাত থাকছিল।

বড় বাঁধের ধারে হাইস্কুলের মাঠে আজ ফাঁইনাল ফুটবল ম্যাচ। দারুণ ভিড় চারদিকে। সেই ভিড়ে ছুচ গলবার উপায় নেই। লাতন পুর হাইস্কুলের সঙ্গে হেতমগড় বিদ্যাপীঠের খেলা। খেলা দেখেই মাধববাবুর রক্তটা ঝাঁ করে গরম হয়ে গেল। নিজে তিনি এক সময়ে দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু সেজন্য নয়। আসলে হেতমগড় নামটাই তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। সেই হেতমগড় আজ আর নেই। সরস্বতীর বানে পুরনো হেতমগড় ভেসে গিয়ে আবার নতুন করে হেতমগড়ের পত্তন হয়েছে। তবু হেতমগড় নামটাই যথেষ্ট। এই হেতমগড় বিদ্যাপীঠেই তিনি পড়তেন। তার আমলে বিদ্যাপীঠ কখনো হারেনি।

মাধববাবু ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেন এমনই ঠাসা ভিড় যে, লোকগুলোকে যেন আঠা দিয়ে এর-ওর গায়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাধববাবুর ধৈর্য কম। ঝাঁ করে বন্দুকের নলটা ভিড়ের ভিতরে সেঁদিয়ে দিয়ে হুংকার ছাড়লেন, “রাস্তা না দিলে গুলি চালাব কিন্তু।”

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই লাতনপুর হেতমগড়কে তিন নম্বর গোলটা দেওয়ায় মাঠে এমন চেঁচামেচি উঠল যে, মাধববাবুর গলার স্বর কারো কানে পেীছল না। তবে লোকগুলো উল্লাসের চোটে বেহেড হয়ে নাচতে শুরু করায় মাধববাবুর একটু সুবিধে হয়ে গেল। লোকে যেমন দু হাতে গাছ ফাঁক করে পাটখেতে ঢোকে তিনিও তেমনি নৃত্যরত লোকগুলোকে বন্দুকের কুঁদো আর হাত দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লেন এবং একেবারে সামনের সারিতে চলে এলেন। মাধববাবু যে বে-আইনিভাবে ঢুকছেন সেটা সামনের সারির লোকেরা কতকটা বুঝলেও তাঁর হাতে বন্দুক দেখে কেউ কিছু বলতে সাহস পেল না।

তিন গোল খেয়ে হাফটাইমের আগেই হেতমগড় হেদিয়ে পড়েছে। প্লেয়াররা যেন সব কোমরসমান জল ভেঙে হাঁটছে এমন করুণ অবস্থা। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অন্তত আধ ডজন গোল খাবেই। ভব তারিণী স্মৃতি শীল্ড বলতে গেলে লাতনপুরের পকেটে। মাধববাবু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ইশ ইশ! চুকচুক। ছিঃ ছি! রাম রাম! দূর দূর! ঘেন্না ঘেন্না লজ্জা লজ্জা! করতে লাগলেন।

হেতমগড় হাফটাইমের আগে আর গোল খেল না ভাগ্যক্রমে। তবে বাঁশি বাজতেই হেতমগড়ের সব প্লেয়ার মাঠের ওপর টান টান হয়ে শুয়ে ঘাসে মুখ লুকোল।

মাধববাবু আর থাকতে পারলেন না। হেতমগড়ের গৌরব-রবি অস্তে যায় দেখে তিনি বন্দুক বগলে চেপে লম্বা লম্বা পা ফেলে মাঠে নেমে পড়লেন। দৃশ্যটা দেখে চারদিকে একটা বিকট চেঁচামেচি উঠল। কিন্তু মাধববাবু গ্রাহ্য করলেন না।

প্লেয়াররা মাঠের ঘাসে শুয়ে দম নিচ্ছে। সকলেরই চোখ বোঝ। খানিক লজ্জায়, খানিক ক্লান্তিতে। তাদের গেম-স্যার প্রিয়ংবদবাবু পিঞ্জরাবদ্ধ বাঘের মতো পায়চারি করতে করতে গাধা, উল্লুক, বেতে ঘোড়, ম্যালেরিয়া রুগি, বার্লিপোর এই সব বলে বকাবকি করছেন। এই সময়ে মাধববাবু গিয়ে প্রিয়ংবদবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে বললেন, “আমাকে চিনতে পারছ প্রিয়?”

প্রিয়ংবদ চিনতে পারলেন, এক সময়ে হেতমগড় বিদ্যাপীঠে একসঙ্গে পড়তেন। প্রিয়ংবদ ছিলেন লেফট-আউট আর মাধব ছিলেন রাইট-আউট। জ কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে প্রিয়ংবদ বললেন, “তুমি! তা কী খবর? মুখোনা ফোকলা কেন? হাতে বন্দুক কেন?”

মাধবের মাথায় আবার একটা রাগের বোমা ফাটবার জন্য অপেক্ষা করছে। পলতের আগুন বোমার গায়ে লাগে লাগে। তবু যথাসাধ্য অমায়িক হেসে মাধব বললেন, “বন্দুক দেখে ভয় পেলে নাকি প্রিয়? ছ্যাঃ ছ্যাঃ! তোমাকে যে বেশ সাহসী লোক বলে জানতাম।”

তা, বলতে নেই, প্রিয়ংবদ একটু ভয় পেয়েছিলেন ঠিকই। মাধবের ধাত তিনি ভালই জানেন। মাধবের ঠাকুর্দা রাগ হলে বন্দুক পিস্তল তোয়াল তো বের করতেনই, তার ওপর আবার নিজের মাথার চুল দু হাতে টেনে ছিঁড়তেন। তাই অল্প বয়সেই মাথায় টাক পড়ে গেল। বলতে কী, সেই রাগ আর টাকই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে পঁড়িয়েছিল। টাক পড়ার পর একবার রেগে গিয়ে যখন মাথার চুল ছিঁড়তে গিয়ে দেখলেন যে, চুল আর একটাও অবশিষ্ট নেই তখন নিজের টাকের ওপর রেগে গিয়ে দমাস দমাস করে দেয়ালে মাথা ঠুকতে ঠকতে খুলিটাই ফেটে গেল। মাধবের বাবা ছিলেন সাধু প্রকৃতির লোক। তা বলে রাগ তাঁরও কম ছিল না। রেগে গিয়ে পাছে মানুষ খুন করে বসেন সেই ভয়ে প্রায় সময়েই তিনি রেগে গেলে খুব লম্বা কোনো নারকোল বা তাল গাছে উঠে ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। কিন্তু এত ঘন ঘন তার রাগ হত যে, একটা জীবন তাঁর প্রায় গাছের ওপর বসে থেকেই কেটে গেছে। সেই রক্তই মাধবের ধমনীতে বইছে। সুতরাং ভয়েরই কথা। তাই প্রিয়ংবদ কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “সারা বছর ধরে এত করে খেলা শেখালাম, কিন্তু ছেলেগুলো একেবারে শেষ সময়টায় ভরাডুবি ঘটাবে কে জানত?”

মাধব খুব মিষ্টি করে বললেন, “সে তো ঠিকই, কিন্তু তা বলে হেতমগড়ের ইজ্জত তো ভেসে যেতে পারে না। হেতমগড় জায়গাটা ভেসে যেতে পারে, কিন্তু ইজ্জত নয়।” এই বলে মাধব হঠাৎ বিকট হুংকার ছেড়ে বললেন, “বুঝলে?”

প্রিয়ংবদ চমকে তিন হাত শূন্যে উঠে আবার পড়লেন। হেতম গড়ের খেলোয়াড়রা শোয়া অবস্থা থেকে ভিরমি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

মাধববাবু নিজের ব্যক্তিত্বের জোর এবং তেজ দেখে একটু খুশিই হলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব স্বয়ং প্রাইজ দিতে মাঠে এসেছেন। সুতরাং প্রচুর পুলিস আর পাহারার ব্যবস্থাও মাঠে ছিল। মাধববাবুকে বন্দুক হাতে মাঠে নেমে গুণ্ডামি করতে দেখে সেই সব পুলিস চার দিক থেকে খুব সতর্কভাবে ঘিরে ধরে ক্রমে বৃত্তটা ছোট করে আনছিল। মাধববাবু রাগের মাথায় অতটা লক্ষ করেননি। হঠাৎ তিন-চারটে মুশকো জোয়ান তার ওপর লাফিয়ে পড়ে হাত-পা ধরে ফেলায় তিনি ভারী হতভম্ব হয়ে গেলেন। বললেন, “এ কী!”

পুলিস ইনস্পেকটর এগিয়ে এসে বললেন, “প্রকাশ্য জায়গায় ফায়ার আর্মস নিয়ে গুণ্ডামি করার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল।”

মাধববাবুর মাথার মধ্যে বোমার পলতের আগুনটা হঠাৎ নিভে গেল। বলতে নেই, দুনিয়ায় একমাত্র পুলিসকেই তাঁর যত ভয়। মাথা নিচু করে পুলিসে ঘেরাও মাধববাবু মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress