আমাদের হেড স্যার
এক সময় পড়াতেন আমাদের
সৌম্যকান্তি চেহারা, উজ্জ্বল চাউনি
পরনে পাট ভাঙা কোঁচানো ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি
রোজ সাইকেলে চেপে স্কুলে আসতেন,
রোদ ঝড় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রোজ তিন মাইল
পথ পেরিয়ে স্কুলে আসতেন।
ও রকম চেহারার মানুষ বড় কম দেখা যায়
দেখলেই মাথা নুইয়ে আসে।
দাদা দিদিরা উঁচু ক্লাসে পড়ত তখন
আমি ছোট, দূর থেকে শুধু দেখা, উঁকি মেরে
লাইব্রেরির ভিতরটা এক ঝলক দেখে নেওয়া।
আমাদের তখন টিচার কমন রুম বলতে লাইব্রেরি,
হেড স্যারের রুম বলতেও লাইব্রেরি, কোনো পানিশমেন্ট বলতেও লাইব্রেরি, একটা
লাইব্রেরিতে যে এত কিছু ধরতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন,সেই লাইব্রেরিতে বেতের প্রহারের ব্যথার চেয়ে লজ্জা বড় হয়ে যেত।
তখন থেকেই দেখেছি আমাদের হেডস্যার
কী করে শাসন করতেন,কী করে নিজেকে নিঙড়ে
দিতেন, কী করে ভাসিয়ে দিতেন আলোর সন্ধানে।
যতদূর দেখেছি দু’য়েকটা পাকা ঘর
বাঁশের ঘরই বেশি,একটা মাঠ, এই ছিল স্কুল বাড়ি,
তিরিশ টাকা বেতনে তখন হেড স্যার পাওয়া যেত
আর পাওয়া যেত তাঁর আনুগত্য ঘন্টি বাজানোর
যতীনদাকে, ক’টাকা বেতনে শুরু হয়েছিল
জানা নেই,জানা নেই এমন অজানা ইতিহাস।
তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই স্কুল বাড়ি
অনেক উত্থান পতন
অনেক ঘাম ঝরা মুহূর্তের সাক্ষী
অনেক না জানা কথা
অনেক আত্মনিবেদন জড়িয়ে আছে
জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি, অনেক স্বপ্ন।
আমাদের হেডস্যার
তাঁর স্নেহ, ভালবাসা, এসবের মাঝে
আমাদের বেড়ে ওঠা
প্রতিটি শিশুকে মানুষ করার মহান প্রতিশ্রুতি
এক মহান শপথ, তাঁর ভিতর দেখেছিলাম
সূর্যের অমল আলো
আরো দেখেছিলাম নিশুতি রাতে জেগে থাকা
এক ফালি চাঁদের অমলিন জ্যোৎস্না।
বৃষ্টি গাছের নীচে শীতের কোনো এক সকালে
যখন ঠায় বসে রোদ্দুর পোহাতে পোহাতে
বার্ষিক ফলের প্রহর গুনতাম,
একে একে নাম ধরে ডেকে দেওয়া হত পরীক্ষার
ফল, সে সব স্মৃতি আজো ভাসে, মনে হয় বৃষ্টি গাছের নীচে গিয়ে একটু বসি, আসুক হেড স্যার
ডেকে উঠুক এক একটা ছাত্রের নাম ধরে,
গাছ সাক্ষী, মাঠ সাক্ষী, আমাদের এই বেড়ে ওঠা
বড় হওয়া জীবন এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত
জাজ্জ্বল্যমান, হেড স্যারের অমলিন হাসি,
আনত চোখের দৃষ্টি, আজো আমাকে ঘিরে রাখে
হাত বাড়ায়, নিরিবিলি হাতের স্পর্শ আজ বহুদূরে
তবুও সেই উদাত্ত কন্ঠস্বর আজো ধ্বনিত হয়
দুস্তর প্রান্তরে,ধ্বনিত হয় ক্লাস থেকে ক্লাসে
যেন দেখতে পাই আপনি আসেন দূর দিগন্ত থেকে
নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে, প্রতিটি ঘাসে আপনার
পদচারণা, যেন আবার এক একটা নাম ধরে ডেকে
ওঠেন, আকাশ সাক্ষী, বাতাস সাক্ষী
সাক্ষী মাঠের প্রতিটি ঘাস, প্রতিটি স্বপ্নের
বেড়ে ওঠা, রামধনু রঙে রাঙানো
ছোট এই স্কুল বাড়ি।
আজ মেঘপুঞ্জের অনেক উপরে চাঁদ
পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়
মেঘের ফাঁক দিয়ে অপার্থিব আলোর ঝিলিক
ছৈপানী নদীর বুক চিরে ফুটে ওঠে
ফুটে ওঠে এক চিরন্তন ছবি
মুখে অমলিন হাসি,দীপ্তমান চাহনি
অজেয় তৃপ্তির সহাস্য এক মূর্ত্তি
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই স্কুল বাড়িকে
ভালবেসে যে প্রাণ নিঃশেষিত
তার মূল্যায়ন হোক বা না হোক এতে
কিছু যায় আসে না, জীবনের যে শিক্ষা
আমাদের হেড স্যার এই শহর গ্রাম
স্কুলকে ভালবেসে দেখিয়ে গেলেন
তা অনন্ত কাল মহীরুহের মতই ছায়া ছড়াবে
তিনি দেখিয়ে গেলেন এভাবেও ভালবেসে
বেঁচে থাকা যায়, এভাবেও ভালবেসে হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসা যায় বারবার।
সেই মহান আত্মাকে
আজ শুধু দূর থেকে প্রণাম
আর শতকোটি প্রণাম।