তপনের সঙ্গে কলকাতা শহরে
তপনের সঙ্গে কলকাতা শহরে প্রথম একজন চেনা লোকের দেখা হল সন্ধ্যে সাতটা আন্দাজ। তপন তখন মেট্রো সিনেমার কাছে ঘোরাঘুরি করছিল, নাইট শো-র জন্য একটা টিকিট কাটবে কিনা সেকথাই ভাবছিল সত্যি সত্যি। তার তো আর কিছুই করার নেই। একবেলাতেই সে কলকাতায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কলকাতায় তার কলেজজীবনের বন্ধুবান্ধব এখনও কয়েকজন আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তাদের বাড়ি গিয়ে গিয়ে দেখা করার কোনো উৎসাহ পাচ্ছে না।
তবু, একজনের বাড়িতে গিয়েছিল অবশ্য বিকেল বেলা–মির্জাপুর স্ট্রিটে তার বন্ধু দীপেন থাকত–ছাত্র বয়সে দীপেন তাকে কিছু সাহায্য করেছে। মীর্জাপুর স্ট্রিটের নাম বদলে সূর্য সেন স্ট্রিট হয়ে গেছে, রাস্তাটার কোনোই বদল হয়নি এই ক-বছরে, দীপেনদের বাড়িটাও সেরকমই আছে। কিন্তু দীপেনরা আর সেখানে থাকে না। দরজায় কড়া নাড়তেই একজন অপরিচিতা মহিলা খুলে দিলেন, ভুরু কুঁচকে বললেন, দীপেন দাশগুপ্ত? জানি না তো। তপনের বাড়ি ভুল হয়নি–এ বাড়িতে সে দীপেনের সঙ্গে বহুবার এসেছে, তবু সেই মহিলা বললেন, ও নাম তিনি শোনেননি, হতে পারে, আগের ভাড়াটেদের কেউ ছিল হয়তো–কিন্তু তারা এখন কোথায় থাকে, সে-সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই। ভদ্রমহিলা ভুরু কুঁচকে কথা বলছিলেন, যেন তপন কোনো অন্যায় করেছে-তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে চলে এল– ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে ওরকম অভদ্র ব্যবহার করলেন কেন? সে কি কোনো দোষ করেছে? তপন তো জানতই না, দীপেনরা ভাড়া বাড়িতে থাকে–দীপেনের ব্যবহারে বেশ খানিকটা চালিয়াতি ছিল। একটু ভাবতেই তপন বুঝতে পারল, ভদ্রমহিলা শুধু বিশেষ করে তার সঙ্গেই ওরকম ব্যবহার করেননি–অপরিচিত পুরুষ দেখলেই বাঙালি মেয়েরা ওইরকম আড়ষ্ট ও কর্কশ মুখ করে কথা বলে- যেন, সব পুরুষই নরখাদক। একথা তো তপন জানতই!
এরপরে আর কোনো বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার উৎসাহ পায়নি, এসপ্ল্যানেড পাড়ায় বিদেশি টুরিস্টদের মতন ঘুরছিল সেখানে ড. চ্যাটার্জিই প্রথম তপনকে দেখতে পেলেন। অন্যমনস্ক তপনের মুখোমুখি পড়ে গিয়ে বললেন, আরে, তপন না? কেমন আছ? কী করছ এখন?
বি এসসি ক্লাস পর্যন্ত তপন ড. চ্যাটার্জির ছাত্র ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে। খুব ভালোবাসতেন তপনকে। একজন অধ্যাপকের পক্ষে যা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, ড. চ্যাটার্জি নিজেই মাঝে মাঝে আসতেন তপনের সঙ্গে ওর মেসে দেখা করতে। তপনকে বলতেন, তোমার মধ্যে বিজ্ঞান শেখার এমন একটা স্বাভাবিক বুদ্ধি আছে, যা আজকাল অনেক ছাত্রর মধ্যেই দেখা যায় না। সবাই তো মুখস্থ করে। আমারও তাই, বুঝলে তপন, আমিও মুখস্থ করেই পাস করেছি।
হাতে একটা গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ, পাঞ্জাবিটা সামান্য ময়লা-আগে ড. চ্যাটার্জির পাঞ্জাবি সবসময় ধপধপে ফর্সা থাকত, চশমার লেন্স আর একটু পুরু হয়েছে। ড. চ্যাটার্জিকে দেখে তপন সত্যিই খুব খুশি হয়ে উঠল। আগে ও কখনো অধ্যাপকদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনি, আজ সামান্য ইতস্তত করে ঝুপ করে পায়ে হাত ছুঁইয়ে দিল। হাসিমুখে বলল, স্যার, আপনি ভালো আছেন?
এই, কোনোরকম। তুমি এখন কোথায় চাকরি করছ?
চাকরি কোথাও করছি না। রিসার্চ করছি বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে।
রিসার্চ করছ! চাকরি পাওনি বুঝি? চাকরির বাজার বড়ো খারাপ। কোথায় রিসার্চ করছ? যাদবপুরে?
না, স্যার, বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে।
কোথায়? বার্কলে মানে? ও, আমেরিকায়–তা ফিরে এলে কেন? অ্যাঁ?
ফিরে ঠিক আসিনি, কয়েকদিনের জন্য
না, না, ওসব করতে যেও না, আজকাল আবার পাসপোর্ট ভিসার যা হাঙ্গামা–মাসে মাসে নিয়ম পালটাচ্ছে, তাড়াতাড়ি ফিরে যাও–এখানে আর মরতে এসো না।
ড. চ্যাটার্জি কথা বলতে বলতে বেশ দ্রুত হাঁটছিলেন, তপন পাশে পাশে পা মিলিয়ে চলছিল। ড. চ্যাটার্জি তপনের রিসার্চ বিষয়ে কোনো আগ্রহই দেখালেন না, চাকরি-বাকরি নিয়েই কথা বলতে লাগলেন, তাঁর এক ভাগ্নে এম এসসি পাস করে বেকার বসে আছে–শেষপর্যন্ত হয়তো স্কুল মাস্টারিতেই ঢোকাতে হবে, একবার যদি স্কুল মাস্টারিতে ঢোকে তা হলে কী আর-তপন কি ওর জন্যে আমেরিকায় কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?
তপন একথার কী উত্তর দেবে ভাবছিল, ড. চ্যাটার্জি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওসব বাতিক যেন মাথায় ঢুকিয়ো না, দেশে ফেরা-টেরার বাতিক–যতদিন পার বিদেশেই থাকবে। কী হবে এখানে ফিরে কোনো চাকরি পাবে না। সায়েন্টিফিক পুল-এ সাড়ে চার শো টাকা করে বেকারভাতা পেতে পার, কিন্তু বছরের পর বছর বসে থেকে থেকে বিজ্ঞান সব কিছু ভুলে, শিখবে শুধু তাশ-পাশা খেলা! খবরদার যেন আমার মতন মাস্টারির লাইনেও ঢুকো না। জীবনটা ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
স্যার, আপনিও তো ইচ্ছে করলেই বিদেশে যেতে পারতেন! আপনি কেন যাননি?
যাবার কি ইচ্ছে ছিল না? খুব ছিল। সম্ভব নয় আমার পক্ষে, বাড়িতে সবসুদ্ধ আট ন-জন লোক, আমার দিদি বিধবা হয়ে আমার কাছেই এসেছেন–তাঁর তিনটে ছেলে-মেয়ে, ফেলতে তো পারি না।
স্যার, আপনি কেমিক্যাল রি-অ্যাকশানস-এর কজ অ্যাণ্ড এফেক্ট নিয়ে যে কিছু কাজ করছিলেন, সে-সম্পর্কে কোনো পেপার বার করেছেন?
দূর, দূর, ওসব কাজটাজ গোল্লায় গেছে কবে! এখন ছাত্রদের শুধু নোট মুখস্থ করাই! আচ্ছা, টু-বি বাস এখন একটু ফাঁকা পাওয়া যেতে পারে, তাই না?
ড. চ্যাটার্জি এত দ্রুত প্রসঙ্গ পালটালেন যে, তপন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। অবাক হয়ে বলল, টু-বি বাস? তারপর হেসে বলল, স্যার, আমি সাড়ে পাঁচ বছর বাদে আজই এদেশে ফিরেছি–কলকাতায় ট্রাম-বাসের অবস্থা এখন কীরকম ঠিক জানি না।
তপন মনে মনে প্রত্যাশা করেছিল, এতদিন পরে সে আজই প্রথম কলকাতায় এসেছে শুনে ড. চ্যাটার্জি খানিকটা বিস্মিত হবেন, তার সঙ্গে অনেক কথা বলতে চাইবেন। কিন্তু, ও দেখল, এতদিন পর ফেরাটা শুধু ওর নিজের কাছেই একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, আর কারুর কাছে কিছু না। ড. চ্যাটার্জি ও সম্পর্কে কোনো ক্ষেপই করলেন না, আপন মনে বললেন, আমার টিউশনি আছে, যেতে হবে কসবায়–ট্রামে, বাসে যা ভিড়।
তপন তবু বলল, স্যার, একটু কোথাও বসে চা খাবেন? অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হল।
চা তো আমি খাই না, গ্যাসট্রিক আলসার হবার পর থেকে।
আপনার আলসার হয়েছে?
ড. চ্যাটার্জি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাসীনভাবে বললেন, একটা কথা কি জানো তপন, আমি খাই শুধু সেদ্ধ ভাতে-ভাত, সামান্য একটু দুধ, আমি যা খাই পরি–তাতে আমার নিজের জন্য মাসে শ-খানেক টাকার বেশি খরচ হয় না–তবু সংসার চালাবার জন্য আমাকে মাসে বারো-তেরো-শো টাকা রোজগারের জন্য মুখের রক্ত তুলে খাটতে হচ্ছে–আমার নিজের সব শখ, ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে এজন্য। এরকমভাবে বেঁচে থাকার মানে কী বলতে পার? এখন আমার আর বিজ্ঞান পড়তে ইচ্ছে করে না, একটু সময়-টময় পেলে দর্শনের বই-টই পড়ে শান্তি পাবার চেষ্টা করি।
তপন অনেক কিছু বলতে পারত, কিন্তু চুপ করে রইল। ড. চ্যাটার্জি আবার বললেন, আমরা এই ভাবেই নষ্ট হয়ে যাব, তোমাদের বয়স কম, তোমরা যদি কিছু করতে পার।
স্যার, আমার বয়স আপনার থেকে খুব বেশি কম নয়। আমি হয়তো আপনার থেকে বছর দশেকের ছোটো হব।
তা হলে, তোমারও উদ্দেশ্যহীন ভাবেই জীবনটা নষ্ট করে যাবে। তোমাদের পরের ছেলেরা যদি কিছু পারে! তপন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলি বুঝলে–।
প্রায় ছুটতে ছুটতেই ড. চ্যাটার্জি একটা চলন্ত টু-বি বাসে উঠে পড়লেন। ভেতরে ঢুকতে পারলেন না, ঝুলতে লাগলেন ফুটবোর্ডের হাতল ধরে। তপনের হঠাৎ মনে হল, ড. চ্যাটার্জি নিশ্চয়ই আজকাল ক্লাসে ফাঁকি দেন, আগেকার মতন আর মন দিয়ে পড়ান না, ওঁর মুখে চোখে একটা ক্লান্তির ছাপ গাঢ় হয়ে ফুটে উঠেছে।
ড. চ্যাটার্জি তপনকে আর দু-টি কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। গ্যাসট্রিক আলসার–তপনেরও গ্যাসট্রিক আলসারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরে আর ব্যথা হয়নি–তপন অবশ্য খাওয়া সম্পর্কে এখনও বাছবিচার করে না। আর টিউশনি–তপনও একসময় টিউশনি করত। কলেজ জীবনটায় টিউশনি করেই নিজের খরচ চালিয়েছে– স্কলারশিপের সামান্য ক-টা টাকায় কিছুই হত না–ড. চ্যাটার্জিও ওকে দু-একটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। তার ছাত্রদের মধ্যে একটি ছেলে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, সুবীর গুপ্ত, সদানন্দ রোডে বাড়ি–ছেলেটা খুব ভালোবাসত তপনকে–বিদেশেও প্রথম দু বছর অনেক চিঠি লিখেছে। সুবীরের দিদি দময়ন্তী, বড়ো অহংকার ছিল মেয়েটির কোনো কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে অহংকার খুব মানায়, দময়ন্তীকে মানাত।
সুবীরদের বাড়িতে গেলে কেমন হয়? ওদের নিজস্ব বাড়ি সদানন্দ রোডে–তপন সেটা খুব ভালোভাবে জানে, ওদের অন্য কোনো জায়গায় উঠে যাবার সম্ভাবনা নেই। তপনকে দেখলে সুবীর নিশ্চয়ই খুশি হবে। তপন একসময় সুবীরের চোখে হিরো ছিল। দময়ন্তীও কি এখনও ওবাড়িতে থাকে? দময়ন্তীরও বিদেশে যাবার কথা। একটা খালি ট্যাক্সি দেখে তপন হাত তুলে ডাকল।
ট্যাক্সিটা গতি কমিয়ে তপনের থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়াল। তপন একটু দ্রুত হেঁটে এসে ট্যাক্সিটাতে উঠতে যেতেই একজোড়া সাহেব-মেম ট্যাক্সির হাতল ধরে দাঁড়াল। তপন খানিকটা অবাক হয়ে বলল– এক্সকিউজ মি, আমি এটা আগে ডেকেছি।
সাহেবটি বলল, আই ডোন্ট থিংক সো, সরি–।
উচ্চারণ শুনেই তপন বুঝতে পারল, ওরা ব্রিটিশ। কিন্তু নিশ্চয়ই অনেকদিন এদেশে আছে, কোট-প্যান্টের কাট একেবারে বাঙালের মতন, লণ্ডনের রাস্তায় ওইরকম পোশাক পরে ঘুরলে লোকে হাসবে। এদেশে থেকে থেকে কি সাধারণ সভ্যতা-ভদ্রতাও ভুলে গেছে? তপন স্পষ্ট জানে, সে হাত তুলে ডাকার পরই ট্যাক্সি ড্রাইভার তার দিকে ফিরে তাকিয়েছে, তারপর গাড়ির গতি কমিয়েছে। ড্রাইভারটা কিন্তু এখন বলল, নেহি, সাহাব আগাড়ি বোলায়া, আপ ছোড় দিজিয়ে।
ঝট করে তপনের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। এখনও সাদা চামড়ার প্রতি ভক্তি! আমেরিকাতেও তাকে কোনোদিন সাদাকালোর সমস্যায় পড়তে হয়নি, আর এই কলকাতা শহরে। মেমসাহেবটি ট্যাক্সির মধ্যে ঢুকতে যেতেই তপন দৃঢ় হাতে গাড়ির দরজা চেপে ধরল।
অন্য সময় হলে, স্বাভাবিক ভদ্রতায় তপন ওদেরই ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিত-মহিলাকে অগ্রাধিকার দেবার স্বাভাবিক সহবৎ জ্ঞান ওর আছে। কিন্তু রাগের মুহূর্তে তপন সব কিছু ভুলে যায়। বিশেষত, সাহেব-মেমটির মুখের ভাব এমন যে, তারা যেন তপনকে মানুষ বলেই গ্রাহ্য করছে না, তারা জানেই, ট্যাক্সি ড্রাইভার তপনকে নেবে না, তাদেরই নেবে–এতেই তপনের রাগ হল বেশি।
তপন ড্রাইভারকে ধমকে বলল, কাহে ঝুট বোলতা?
নেহি সাহেব, মেমসাহেব হাত দেখায়। আপ ছোড় দিজিয়ে না—
আবার মিথ্যে কথা
সাহেবটি তপনের কাঁধে হাত রাখার ভঙ্গি করল, হাত ছোঁয়ালো না, বলল, লিসন,–।
তপন বলল, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।
মেমটি তিক্ত গলায় বলল, উই শুড নট ওয়েস্ট আওয়ার টাইম।
সাহেবটি জোর করে দরজা খোলার চেষ্টা করতেই, তপন গোঁয়ারের মতন প্রায় ঠেলেই নিজে উঠে পড়ল। জানলা দিয়ে বলল, তোমরা যদি জোর না করে অনুরোধ করতে, আমি নিশ্চয়ই তোমাদের ছেড়ে দিতাম।
সাহেবটি তপনকে কিছু না বলে মেমের দিকে তাকিয়ে বলল, ইউ নো দেম! মেমটি তপনের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন কোনো অসভ্য বর্বর বন-মানুষকে দেখছে। একটা ঘৃণার ভঙ্গি করে ওরা দু-জনে সরে গেল। তপনের একবার ইচ্ছে হল, ওদের বাপ-মা তুলে গালাগাল দেয়। কিন্তু নিজেকে সামলে গম্ভীরভাবে ড্রাইভারকে বলল, চলিয়ে কালিঘাট।
ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিল না, কর্কশ গলায় জানাল, নেহি জায়েগা!
তপনের মাথায় আগুন জ্বলছে। পৃথিবীতে আর সব কিছু ভুলে এখন এই ট্যাক্সিতে কালিঘাট যাওয়াই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এদেশে এখনও সাদা চামড়াদের কাছে নিজেদের এত হীনমন্যতা! এই ট্যাক্সি ড্রাইভার কেন তার বদলে ওদের নিতে চাইছিল, বকশিশের আশায়? ওই সব ফোতো কাপ্তেন সাহেবরা ক-পয়সা বকশিশ দেয়, তা তপনের খুব জানা আছে! উত্তেজনা যতদূর সম্ভব দমন করে তপন শান্তভাবে বলার চেষ্টা করল, শোনো সর্দারজি, তুমি কেন এ-রকম ব্যবহার করছ? তুমি ট্যাক্সি চালাচ্ছ যে তোমাকে আগে ডেকেছে
বোলতা হ্যায় তো কালিঘাট নেহি জায়েগা! উতার যাইয়ে।
তুমি যাবে না, তোমার ঘাড় যাবে।
লোকটি তার দাড়িওয়ালা মুখখানা সম্পূর্ণ তপনের দিকে ফিরিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কাহে আপ ঝামেলা করতা; উতার যাইয়ে গাড়ি সে।
-না, যাব না! দেখি তুমি কি কর, পুলিশ আসুক। তপনের শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা সতর্ক হয়ে উঠেছে। দরকার হলে সে মারামারি করবে। ওই বিশাল চেহারার লোকটার সঙ্গে মারামারি করতে গিয়ে সে যদি মরেও যায়, তাতেও ক্ষতি নেই, সে মরে গেলে পৃথিবীতে কারুর কিছু যাবে আসবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে এ গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
প্রায় এক মিনিট ট্যাক্সি ড্রাইভারটি তপনের চোখের দিকে চেয়ে রইল। তপনও চোখ সরাল না, কটমট করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তপনের হাত দু-খানা তৈরি হয়ে আছে, সর্দারজির কোমরে ছুরি ঝুলছে, যদি ছুরি বার করার চেষ্টা করে, তা হলে তার আগেই তপন ওর টুটি চেপে ধরবে।
লোকটি তপনের দিকে চেয়ে থেকে কী বুঝল কে জানে, হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে গজগজ করতে করতে গাড়িতে স্টার্ট দিল। তপন সিটে হেলান দিয়ে রাজা-বাদশার মেজাজে হুকুম করল চৌরঙ্গি দিয়ে সোজা চলো–
আশ্চর্য, ওই ব্রিটিশ দম্পতি ইংল্যাণ্ডে থাকলে কিছুতেই এ-রকম অভদ্র ব্যবহার করতে পারত না। সেখানে যদি ওরা ভুল করেও, মনে করত যে, ওরাই আগে ট্যাক্সি ডেকেছে, তাহলেও আরেকজন এসে দাবি জানালেই সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিত এবং সেই আরেকজনও ওদেরই শেষপর্যন্ত যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত। এখানে ওরা তপনকে সে ভদ্রতা দেখাবার সুযোগই দিল না। নিজেদের দেশে ওরা ভদ্র, আর বাইরে এসে এ-রকম অভদ্র, নীচ হয় কী করে? ভারতবর্ষে ইংরেজরা যতরকম নীচতা করেছে, ইংল্যাণ্ডের বহু লোক তা বিশ্বাসই করতে পারবে না। ইংল্যাণ্ডে তো টেডের মতন হৃদয়বান ছেলেও আছে, কিংবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সেই বুড়ো লোকটি, অথবা দিবাকরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই পুলিশ কনস্টেবল
হঠাৎ অ্যালিসের মুখখানা মনে পড়ল তপনের। তার রাগী মস্তিস্কে অ্যালিসের মুখখানা এখন আরও রাগ বাড়িয়ে দিল না, বরং তপনের সমস্ত স্নায়ুগুলো নরম হয়ে এল, এক ধরনের মমতায় ভরে গেল মনটা। কেন অ্যালিস অত অপমান সহ্য করেছে তার কাছে? অ্যালিস বলেছিল, তাকে ভালোবাসে। সত্যিই কি এর নাম ভালোবাসা? তপনকে এমনভাবে ভালোবাসার কথা আর কেউ কখনো বলেনি। যদি এর নামই ভালোবাসা হয়, তাহলেও আমার কোনো দোষ নেই। অ্যালিস কেন ভুল লোককে ভালোবাসতে গেল!
তপন অ্যালিসের কথা ভাবতে ভাবতে খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, তাই সুবীরদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমেও লক্ষ করেনি যে, সুবীরদের বাড়ির সামনে দু-তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, লোকজন আনাগোনা করছে দ্রুতভাবে। যে-বৈঠকখানায় বসে তপন সুবীরকে পড়াত, সে-ঘরে চার-পাঁচজন নারী-পুরুষ নিজেদের মধ্যে কী বিষয়ে আলোচনা করছেন নিবিষ্টভাবে। তপন সেখানে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, সুবীর আছে নাকি?
ওঁরা আলোচনা থামিয়ে সবাই চুপ করে গেলেন এক সঙ্গে। তারপর একজন মহিলা বললেন, হ্যাঁ, আছে, এক্ষুনি নামবে নীচে, আচ্ছা আমি খবর পাঠাচ্ছি। আপনি বসুন, তপনবাবু।
তপন এবার চিনতে পারল, মহিলাটি সুবীরের কাকিমা। প্রায় পাঁচ বছর এ বাড়িতে মাস্টারি করেছে তপন, সুতরাং এ পরিবারের প্রায় সবারই সঙ্গে তার চেনা ছিল। সুবীরের কাকাও ঘরে উপস্থিত ছিলেন, তিনিও খানিকটা নীরস গলায় বললেন, বসুন মাস্টারমশাই, অনেক দিন আসেননি এদিকে–।
তারপর তপনের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই পাশের এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে মৃদু গলায় কি যেন বলতে লাগলেন। তপন একটু আহত বোধ করল। চেনা কারুর সঙ্গে দেখা হলেই সে আশা করে, সে যে এতদিন পর হঠাৎ কারুকে না জানিয়ে কলকাতায় ফিরেছে এতে সবাই অবাক হয়ে যাবে, তাকে নিয়ে সবাই আলোচনা শুরু করবে! ড. চ্যাটার্জিকে দেখেই একথা মনে হয়েছিল। এতদিন পরে ফিরে তার অনেক কিছুই নতুন লাগছে, চোখের ঘোর এখনও কাটেনি মাত্র গতকালই সে ছিল রোমে, তার দু-দিন আগে লণ্ডনে। কিন্তু কলকাতায় যারা রয়েছে, তারা সবাই নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। তপন যে বিদেশে গিয়েছিল, সে-কথাই তো সুবীরের কাকার মনে পড়ল না। আগে তপন সুবীরের বাড়ির গুরুজনদের সামনে সিগারেট খেত না, কিন্তু আজ ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। এখনও তার পকেটে রোম থেকে কেনা সিগারেটের প্যাকেট।
একটুক্ষণের মধ্যেই সুবীর এল, বাইরে যাবার পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে। তপনকে দেখে এক পলকের জন্য তার মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, উৎফুল্ল গলায় বলল, তপনদা! কবে এলেন? পরক্ষণেই সুবীরের মুখ আবার বিমর্ষ হয়ে গেল, আস্তে আস্তে বলল, আপনি এখন কলকাতাতেই থাকবেন তো? আপনার ঠিকানা কী? আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে।
তপন উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, সুবীর তুমি কোথায় যাবে?
নার্সিং হোমে।
কার অসুখ?
দিদির, মানে পরশুদিন দিদির একটি ছেলে হয়েছে, সিজারিয়ান করতে হয়েছিল, এমনি কোনো গন্ডগোল ছিল না, কিন্তু আজ থেকে হঠাৎ খারাপ দিকে টার্ন নিয়েছে, বাচ্চা আর দিদি দু-জনেরই ক্রাইসিস এখনও কাটেনি, আমরা একটু আগে নার্সিং হোম থেকে ফিরেছি
-হঠাৎ আবার টেলিফোন।
এরপর তপন যেটা বলল, এক মুহূর্ত আগেও সে নিজেই–ভাবেনি যে সে একথা বলবে। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, চলো, আমিও তোমার সঙ্গে নার্সিং হোমে যাই।
আপনি যাবেন? আপনার কোনো কাজ নেই?
না।
চলুন, তাহলে বেরিয়ে পড়ি।
সুবীরের কাকা-কাকিমা এবং আরও দু-জন লোক গাড়িতে উঠলেন। সুবীর বসল স্টিয়ারিং এ। তপন একটু সংকুচিতভাবে বলল, তাহলে যাক বরং, আমি আর–গাড়িতে জায়গা হবে না–।
সুবীর বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হবে! আপনি আমার পাশে বসুন, বেশি দূর তো নয়।
যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে সেই তপনকে এড়িয়ে ব্যস্তভাবে চলে যাচ্ছে, এটা আর তপন সইতে পারছিল না। কলকাতায় একাকীত্ব তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। সে চাইছিল চেনাশুনো কারুর সঙ্গে সঙ্গে থাকতে। নইলে সম্পূর্ণ বাইরের লোক হয়েও ওদের সঙ্গে তার এখন নার্সিং হোমে যাওয়া হয়তো ঠিক মানায় না।
দময়ন্তীর মুখখানা মনে পড়ল তার। দময়ন্তীর কবে বিয়ে হয়েছে, সে খবরও তপন রাখে না। শেষ যেদিন দময়ন্তীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, সেদিন দময়ন্তী বড়ো নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিল তার সঙ্গে। সায়েন্স কলেজে রি-ইউনিয়ান ছিল সেদিন, দময়ন্তী হাসতে হাসতে তাকে বলেছিল–। থাক, তপন সেসব কথা এখন মনে করতে চায় না। দময়ন্তী এখন হাসপাতালের খাটে মুম্ষু হয়ে শুয়ে আছে।
দময়ন্তীরও একদিন বিয়ে হবে, সন্তান হবে,–এসব যেন ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। পোয়াতি অবস্থায় কীরকম চেহারা হয়েছিল দময়ন্তীর? তপন ভাবতেই পারছে না। এক ধরনের মেয়ে আছে, যাদের সম্পর্কে কল্পনাই করা যায় না যে, কোনোদিন তাদের অসুখ হবে কিংবা রূপ ঝরে যাবে। মনে হয়, দেবীর মতনই তাদের রূপ ও আয়ু অবিনশ্বর। দময়ন্তীকে দেখে তপনের এই রকম মনে হত! উঠতি যৌবন বয়সের পাগলামি! এখন তপন যদি দেখে দময়ন্তী ফুটবলের মতন গোল আর মোটা হয়েছে, তাহলেও আশ্চর্য হবে না। পৃথিবীর নিয়মই তো এই, সবাই বদলাবে, বদলাতে হবেই, এ-নিয়ম ক্ষমা করে না কারুকে।
নার্সিং হোমে পৌঁছেই একটা দুঃসংবাদ পাওয়া গেল। বাচ্চাটা একটু আগেই মারা গেছে। দময়ন্তীর এখনও জ্ঞান ফেরেনি। বাচ্চাটির মৃত্যুসংবাদে কেউ একটুও বিচলিত হল না, কেউ কাঁদল না, সুবীরের আত্মীয়স্বজনরা পরস্পরের দিকে চোখাচোখি করে চুপ করে রইল। একটা প্রাণ জননীর গর্ভের অন্ধকারে দু-শো-সত্তর আশি দিন ধরে একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠেছিল, মায়ের শরীর থেকে রস আর জীবন নিঙড়ে নিয়েছে, তারপর ভূমিষ্ঠ হয়ে শুধু কেঁদেছে ক-বার, দু-দিন শুয়ে ছিল অক্সিজেন টেন্টে, বোধ ছিল না, চেতনা ছিল না। তার মৃত্যুতে আর কে শোক করবে! এখন সবার চিন্তা, ওই হতভাগ্য শিশু তার জননীকেও না খায়।
দো-তলার কোণের ঘরে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে দময়ন্তী, ওরা সবাই এক-তলায় অপেক্ষা করছে। কেউই প্রায় কোনো কথা বলছে না। এতটা থমথমে ভাব তপনের ভালো লাগে না। দময়ন্তীকে বাঁচাবার যা-কিছু চেষ্টা করবেন ডাক্তাররাই, প্রায় শুধু শুধু মুখ ভার করে থেকে তো কোনো উপকার করতে পারবে না। বরং স্বাভাবিক ধৈর্য নিয়ে প্রতীক্ষা করাই তো ভালো। দময়ন্তী মারা যাবে–একথা তপন যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। না, না, তা হয় না, ওটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। ইচ্ছাশক্তির যদি কোনো মূল্য থাকে তবে তপন তার প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি দিয়েই দময়ন্তীকেই বাঁচিয়ে তুলতে পারে। বারবার মনে পড়ছে, দময়ন্তীর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর মুখ। বিভিন্ন পটভূমিতে দময়ন্তীর মুখখানা দেখতে দেখতে তপনের বুকটা টনটন করে উঠল। অন্তত দু-তিন বছর দময়ন্তীর কথা তার একবারও মনে পড়েনি, অথচ, আজ মনে হচ্ছে, দময়ন্তীর মৃত্যুসংবাদ শুনলে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।
তপন সুবীরকে জিজ্ঞেস করল, দময়ন্তীর স্বামী, মানে তোমার জামাইবাবুকে দেখছি না তো! তিনি—
অরুণদা তো কালই দিল্লি ফিরে গেছেন। একদম ছুটি পান না, পরশুদিন সেফ ডেলিভারির খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন–আজ আবার টেলিগ্রাম করা হয়েছে অবশ্য।
তোমার অরুণদা দিল্লিতে কী কাজ করেন?
উনি তো ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।
কবে বিয়ে হয়েছে?
এই জুলাইতে তিন বছর হল।
এরপর তপনের মনে যে প্রশ্নটা এল, সেটা ও উচ্চারণ করল না। দময়ন্তী নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছে, নাকি বাড়ির ব্যবস্থা করা বিয়ে? পাঁচ-ছ বছর আগে অরুণ নামে কোনো ছেলের সঙ্গে দময়ন্তীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল না। প্রশান্ত দেববর্মন নামে একটি ছেলে বরং দময়ন্তীর কাছাকাছি খুব ঘুর ঘুর করত।-বাড়ির কথামতো কারুকে বিয়ে করবে দময়ন্তীর মতন মেয়ে, তাও বিশ্বাস হয় না! কিন্তু এখন এই প্রশ্ন করা যায় না।
তপনের সঙ্গে দময়ন্তীর যে-সম্পর্ক ছিল, তাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না। ছাত্রীর দিদির সঙ্গে প্রেম করার কোনো মতলবই তপনের কোনোদিন ছিল না। সুবীরকে পড়াবার সময় দময়ন্তী মাঝে মাঝে ঘরে ঢুকতে দুটো-একটা কথা বলত, কিন্তু বসে গল্প করেনি কখনো। কিন্তু দময়ন্তীর সঙ্গে প্রায়ই বাইরে দেখা হয়ে যেত। দময়ন্তী পড়ত সাইকোলজি, তপনের সঙ্গে সায়েন্স কলেজে ক্যান্টিনে দেখা হত, তপন নিজে থেকে কোনোদিনই দময়ন্তীকে ডাকেনি, দময়ন্তীই তার বান্ধবীদের ছেড়ে উঠে এসেছে তপনের কাছে। অন্যান্য মেয়েদের মতন দময়ন্তীর ব্যবহারে কোনো আড়ষ্টতা ছিল না, এক-এক দিন সায়েন্স কলেজ থেকে বেরিয়ে দময়ন্তী বলত, আপনি ছবি দেখতে ভালোবাসেন? চলুন, চৌরঙ্গিতে একটা আর্ট এক্সিবিশান হচ্ছে, দেখে আসি! বাড়ি থেকে গাড়ি আসত দময়ন্তীর জন্য, গাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে তপনের সঙ্গে সে রাস্তায় হাঁটত। দময়ন্তীর সমস্ত অস্তিত্বে কাচের মতন একটা কী যেন সূক্ষ্ম ব্যাপার ছিল, হাত দিয়ে ছুঁলেই যেন ভেঙে যাবে। তপন কোনোদিনই ছোঁয়ার চেষ্টাও করেনি। একদিন আউটরাম ঘাটে জলের ধারে অন্ধকারে ওর সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েক ধরে গল্প করেছিল, সেদিনও না।
ওরকম এক-এক দিন দেখা হবার পরও কিন্তু দময়ন্তী বলত না, আবার কবে দেখা হবে, কিংবা তপন তার পরদিনও সায়েন্স কলেজে আসবে কি না। চলুন পরশুদিন অমুক জায়গায় যাব, এ ধরনের কথা দময়ন্তী কোনোদিন উচ্চারণ করেনি, হঠাৎ দেখা হলেই তার যা-কিছু মনে পড়ত–তখন সে অবলীলাক্রমে বন্ধু বান্ধবীদের ছেড়ে তপনের সঙ্গে চলে আসত। তপনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কোনো প্রশ্ন করেনি কোনোদিন। তপনও নিজে থেকে কোনোদিন বলেনি, কোনোদিন ডাকেনি।
একবার শুধু ডেকেছিল। রি-ইউনিয়নের দিন দময়ন্তীর গান শেষ হবার পর তপন ওকে আলাদা ডেকে বলেছিল, আমার এ জায়গায়টায় থাকতে আর ভালো লাগছে না। চলো, আমরা অন্য কোথাও যাই। দময়ন্তী একটু অবাক হয়ে বলেছিল, কোথায়? তপন বলেছিল, যেকোনো জায়গায়, এখানে ভিড়ের মধ্যে ভালো লাগছে না। দময়ন্তী ওর চোখের দিকে একটুক্ষণ স্থিরভাবে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, আপনার ভালো না লাগলে যে আমারও ভালো লাগবে না–এমন কোনো কথা কোনোদিন হয়েছে কি আমাদের? তপন থতোমতো খেয়ে বলেছিল, না, না, তা বলছি না, যদি তোমার ভালো লাগে সে কথা আলাদা, আমার ভালো লাগছে না সেই জন্যই। দময়ন্তী বলেছিল, আপনার কী ভালো লাগে না, সেকথা আমাকে বলবেন না, আমি শুনতে চাই না। আপনার কী কী ভালো লাগে, সেকথা যেদিন বলতে চাইবেন, শুনব! সাধারণ একটা কথা। হয়তো বিশেষ কিছু না ভেবে, শুধু চালাকের মতন কথা বলার জন্যই দময়ন্তী ওকথা বলেছিল, তবু তপন তাতে দারুণ আঘাত পেয়েছিল। যেন দময়ন্তী তাকে মনে করিয়ে দিতে চায়, আপনি বড্ড বেশি কাছে আসবার চেষ্টা করছেন। আপনাকে যতখানি দূরে রেখেছি, ঠিক সেখানেই থাকুন।
পৌনে দশটা। সুবীর বলল, তপনদা, আপনি আর কতক্ষণ বসবেন! আপনি আজই এসে পৌঁছেছেন, টায়ার্ড নিশ্চয়ই, বিশ্রাম করুন গিয়ে বরং
তপন বলল, না, না, আমি একটুও টায়ার্ড নয়। আমি আর একটু বসি।
পৌনে দশটা। কাল রাতে এই সময় তপন রোমের একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার খাচ্ছিল। ভোর রাত্রে প্লেন, এই সময় সে ডিনার শেষ করে ব্র্যাণ্ডির গ্লাস হাতে নিয়ে একটা মেয়ের নাচ দেখছিল। সামান্য একটু জাঙিয়া আর কাঁচুলি পরা মোটা মতন মেয়েটা নাচছিল ঘুরে ঘুরে, তপনের টেবিলের পাশে এসে ওর ব্রাণ্ডির গ্লাসে একটা চুমুক দিয়েছিল– আর আজ এই সময় তপন কলকাতার একটা নার্সিং হোমের বেঞ্চে বসে আছে, একটি মেয়ে বাঁচবে কী বাঁচবে না এই প্রশ্ন নিয়ে।
মোটরসাইকেল আরোহী দু-জন পুলিস সার্জেন্ট এসে থামল গেটের সামনে, তারপরই একটা কালো গাড়ি। কিছু লোক ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল গেটের দিকে। গাড়ি থেকে নামলেন একজন বৃদ্ধ, মাথার চুল কাঁচা-পাকা, খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, হাতে একটা ছড়ি। তাকে পথ দেবার জন্য ভিড় ফাঁক হয়ে গেল। লোকজনের কথাবার্তায় তপন বুঝতে পারল, উনি একজন মান্যগণ্য মন্ত্রী। সুবীর এগিয়ে গেছে সেই বৃদ্ধের দিকে, তিনি সুবীরকে দেখে বললেন, কী রে, এখন কেমন আছে খুকু?
জ্ঞান ফেরেনি এখনও।
জ্ঞান ফেরেনি? আমি সেই সন্ধ্যে থেকেই আসব আসব করছি, কিন্তু ক্যাবিনেটের মিটিং ছিল-চল দেখে আসি।
ডাক্তাররা এখন দেখা করতে দিচ্ছে না।
সুবীরের শেষ কথাটা হয় তিনি শুনতে পেলেন না কিংবা গ্রাহ্য করলেন না। চকচকে পাম্পশু-তে মচ মচ আওয়াজ করে উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। তাঁর হাঁটা-চলার মধ্যে এমন একটা গাম্ভীর্য ও দৃঢ়তা আছে, যেন স্বয়ং মৃত্যুও তাঁকে সম্ভম করবে। কিংবা অন্যদের পক্ষে ডাক্তারের বারণ খাটতে পারে, কিন্তু তিনি মন্ত্রী, তাঁর পক্ষে খাটবে কেন? তিনি দেখতে এসেছেন, দেখে যাবেন।
তপন সুবীরকে জিজ্ঞেস করল, উনি কে হন তোমার? সুবীর বলল, আমার মেশোমশাই। দিদিকে খুব ভালোবাসেন।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মন্ত্রীমহোদয় নীচে নেমে এলেন। এসেই কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ দিলেন। সুবীরকে ডেকে বললেন, জ্ঞান ফিরে এসেছে, বুঝলি, মিনিট পনেরো আগে –বাচ্চাটা গেছে অবশ্য, কিন্তু ওর আর ভয় নেই।
সুবীর বলল, আমরা দেখা করতে পারব এখন? কথা বলছে?
না, ডাক্তারকে আমি বলে এসেছি, একবার দেখা করে আয়, বেশীক্ষণ থাকিসনি, তবে আর কোনো ভয় নেই, বুঝলি।
মন্ত্রীর মুখখানি এমন হয়ে উঠল, যেন মনে হয়, ওঁর আসার জন্যই জ্ঞান ফিরে পেয়েছে দময়ন্তী। ওঁকে দেখেই অসুখও ভয় পেয়েছে। আর একটু বেশি জুতোর আওয়াজ করে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সুবীর চলে গেছে দো-তলায়। তপনকে ডাকেনি, তবুও তপন উঠে এল। কোণের কেবিনটার সামনে পাঁচ-ছ-জনের ভিড়। সুবীরের মা ওখানে রয়েছেন অনেকক্ষণ আগে থেকেই। অন্যদের আড়াল থেকে তপনও উঁকি দিল। দরজার দিকেই মুখ দময়ন্তীর, স্পষ্ট চোখে চেয়ে আছে। না, মোটা হয়নি, বরং আগের চেয়েও রোগা হয়েছে, যন্ত্রণায় এক একবার কুঁকড়ে উঠছে মুখ, অস্ফুটভাবে বলছে, মা, মা, বড় কষ্ট হচ্ছে। সুবীরের মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন চুলে, ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছেন চোখ। একবার দময়ন্তী সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকাল, ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, মা ছেলেটা কেমন আছে? ছেলেটা?
সুবীরের মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ভালো আছে, সে ভালো আছে
ওকে আমার কাছে দিচ্ছে না কেন?
এখন তো দেয় না। পাঁচ-ছ-দিন বাদে।
না, নার্সকে বলল, ছেলেটাকে এখানে নিয়ে আসতে।
নার্স আনতে পারবে না, নিয়ম নেই।
না, তুমি নার্সকে বলো, আমি দেখব একবার।
সুবীর এগিয়ে গিয়ে দময়ন্তীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, দিদি, আমি এইমাত্র দেখে এলুম, তোর ছেলে ভালো আছে, খুব সুন্দর ছেলে হয়েছে তোর।
সুবীর সরে যেতেই একটু জায়গা ফাঁকা হয়েছিল, তপন সেখানে এগিয়ে এসেছিল। হঠাৎ দময়ন্তীর চোখ পড়ল তপনের দিকে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ও কে? ও কে ওখানে?
সুবীর তাড়াতাড়ি বলল তপনদা, আমার মাস্টারমশাই ছিলেন, আজ বিলেত থেকে ফিরে তোকে দেখতে এসেছেন।
দময়ন্তী কিছুই শুনল না, আবার বলল, ও কে? কে ওখানে?
তপন নিজেই এবার বলল, আমি তপন, আমি
দময়ন্তী আবার গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কে? মা, ও কে?
সুবীরের কাকা ফিসফিস করে তপনকে বললেন, আপনাকে চিনতে পারছে না, আপনি বরং একটু সরে গিয়ে পিছনে দাঁড়ান। এখনও বিকার রয়েছে তো।
তপন দ্রুত সরে এল আড়ালে। আর দাঁড়াল না, সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল নীচে। তখনও কানে আসছে দময়ন্তীর ভয়ার্ত গলা, ও কে? ও কে? দময়ন্তী তাকে দেখে ভয় পেল? কেন, সে তো কোনোদিন দময়ন্তীকে কোনো আঘাত দেয়নি, কোনো ক্ষতি করেনি। সিঁড়ি দিয়ে নামছে তপন, তার বুকটা পাথরের মতন ভারী, নিশ্বাস আটকে আসছে গলার কাছে। সুবীরের বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই তাকে অপয়া ভাবছে। তার কী দরকার ছিল এখানে আসবার? তাকে দেখে ভয় পাবার ফলে দময়ন্তীর অবস্থা যদি আবার খারাপ হয়ে যায়, কেউ কী তাকে ক্ষমা করবে; কিন্তু তার কী দোষ? আমি কি অন্যায় করেছি? আমি শুধু দময়ন্তীকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম–আমি তো ওরা ভয় পাবার মতন কিছু করিনি! আমি তো আন্তরিকভাবে চেয়েছিলাম দময়ন্তী ভালো হয়ে উঠুক। আমার জীবনটাই কি অশুভ?
নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে তপন কতক্ষণ সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল তার খেয়াল নেই। যেন সে সব রাস্তা ভুলে গেছে, দিক ভুল হয়ে গেছে। একসময় সুবীর এসে পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরল।
.
১০.
আমি তোমার বাবাকে চিনতাম। ঘটনাটাও মনে আছে, সে তো প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছর আগেকার কথা, আমিও সেসময় ঢাকাতেই ছিলাম, তোমার বাবা প্রিয়নাথ রায় চৌধুরিকে নিয়ে সেসময় কী হইচই।
আজ্ঞে, প্রিয়নাথ রায়চৌধুরি ছিলেন আমার জ্যাঠামশাই। আমার বাবার নাম দেবনাথ রায়চৌধুরি।
ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেবনাথ। প্রিয়নাথ রায়চৌধুরির ঘটনাটাও আমি শুনেছি, তবে তাঁকে অবশ্য দেখিনি, কিন্তু দেবনাথ আমার থেকে বয়েসে ছোটো ছিল, কিন্তু কী সাহস, যেদিন ফাঁসি হল, সেদিনও গীতা-র শ্লোক পড়তে পড়তে–আমি তখন ওই একই জেলে।
কিন্তু আমার বাবার তো ফাঁসি হয়নি।
তোমার তখন কীই-বা বয়েস, তোমার কি কিছু মনে আছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে, দেবনাথ আর আমি একই জেলে ছিলাম ওখান থেকেই আমাকে পাঠানো হল বক্সা ক্যাম্পে, সেখানে সেই যে অম্বলের অসুখটা বাধিয়ে বসলাম।
আমার বাবার কিন্তু সত্যিই ফাঁসি হয়নি। আমি ভালোভাবে জানি।
ফাঁসি হয়নি দেবনাথ রায় চৌধুরির? সেই যে দেবনাথ একা রিভলবার নিয়ে তিন জন মিলিটারি অফিসারকে খুন করেছিল।
আমার বাবা রিভলবার চালাতেই জানতেন না। উনি সংস্কৃতের মাস্টার ছিলেন।
ওঃ হো, আর বলতে হবে না, আর বলতে হবে না, বরদাপ্রসন্নর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছিলুম, বয়েস হয়ে গেছে তো, সব মনে থাকে না—
তোমার বাবা, দেবনাথ, একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ছুরি মেরেছিল। সেও কি কম সাহসের কথা? আমরা অবশ্য ওদের হিংসার পথ থেকে ফেরাতে চেয়েছিলুম–দু-একজনকে ছুরি মেরে আর গুলি চালিয়ে তো দেশ স্বাধীন করা যায় না। তবে বড় খাঁটি লোক ছিল দেবনাথ, খুব কম কথা বলত, সে যে অমন কান্ড করবে–শোনো, তোমার বাবার কোনো ছবি আছে তোমার কাছে?
একটা গ্রুপ ফোটো আছে জানি, এ ছাড়া আলাদা কোনো ছবি আছে কিনা –।
গ্রুপ ফোটোতে হবে না, আলাদা ছবি আছে কিনা খুঁজে দেখো।
কী করবেন ছবি দিয়ে?
অয়েল পেইন্টিং করাব। আমরা মহাজাতি সদনে সব শহিদদের অয়েলপেইন্টিং টাঙাচ্ছি, দেখোনি?
কিন্তু আমার বাবাকে কি শহিদ বলা যায় ঠিক? ও রকম তো অনেকেই ছিলেন। আমার বাবা রাগের মাথায় একজন ইংরেজকে খুন করতে গিয়ে নিজেও খুন হয়েছিলেন।
তোমার বাবা একজন বিপ্লবী ছিলেন, দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন এজন্য বুঝি তোমার কোনো গর্ব হয় না? শ্রদ্ধা হয় না।
শ্রদ্ধা হবে না কেন? কিন্তু নিজের বাবা হলেও তাঁর সম্পর্কে কতকগুলো মিথ্যা প্রশংসা চাপানো তো ঠিক নয়। আমার বাবা ঠিক বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি কোনো সংগঠনেও যোগ দেননি, তিনি শুধু একটা পারিবারিক প্রতিশোধের জন্য।
মোটেই পারিবারিক প্রতিশোধের জন্য নয়। দেশমাতৃকার অপমানের প্রতিশোধের জন্য! যা জানো না, তা নিয়ে কথা বোলো না! দেশের জনগণ ওই সব মহৎ সন্তানদের কোনোদিন ভুলবে না। ওর একটা ছবি আমাদের চাই–দাঁড়াও এক সেকেণ্ড।
টেলিফোন বেজে উঠতেই মন্ত্রী মহোদয় টেলিফোন তুললেন। হ্যালো, কে বলুন, ও আচ্ছা! শোনো, তুমি ঠিক সাড়ে বারোটার সময় অ্যাসেম্বলিতে আমার চেম্বারে ফোন করবে। এখন ব্যস্ত আছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি তখন দেখা হবে।
যাবার ছবির প্রসঙ্গ উঠতেই তপনের মনটা লণ্ডনে অ্যালিসের ঘরে চলে গিয়েছিল। সেই দেয়ালে ঝোলানো বিবর্ণ ছবি। তার বাবার পূর্ণাঙ্গ ছবি ওখানেই শুধু দেখেছে তপন। ইস, অ্যালিসের সঙ্গে ঝগড়া না করে, ওই ছবিটার একটা কপি করিয়ে নিয়ে এলে হত। কিন্তু কী হত ছবি দিয়ে। কোনো প্রয়োজন নেই আর। মহাজাতি সদনে তার বাবার ছবি টাঙাবার কোনো উৎসাহ নেই তপনের। অ্যালিসের কথা মনে পড়তে তপনের আর রাগ হল না এখন, বরং ক্ষণিকের মন খারাপ অকারণ ঝিলিক দিয়ে গেল।
কলকাতায় তপনের তিনদিন কেটে গেছে। দময়ন্তী, সংকট কেটে গিয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। সুবীর সবসময় লেগে রয়েছে তপনের সঙ্গে। এই তিনদিনে কলকাতায় পরিচিত অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়েছে তপনের, দিবাকরদের বাড়িও ঘুরে এসেছে একবার। বন্ধুবান্ধব যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তার প্রায় সকলেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শেষপর্যন্ত তপনকে বলেছে, তপন তাদের জন্য আমেরিকায় কোনো সুযোগ করে দিতে পারে কিনা। তপন যেন কোনোদিন এখানে ফিরে না আসে তা হলে সেটা দারুণ বোকামি হবে। একমাত্র সুবীরই তাকে ওসব কিছু বলেনি, সুবীরের ইচ্ছে তপন আর যেন বিদেশে ফিরে না যায় তপন এখানেই ভালো কাজ করার সুযোগ পাবে। সুবীর প্রায় জোর করেই তপনকে আজ সকাল বেলা তাঁর মেসোমশাই, এই মন্ত্রীর কাছে নিয়ে এসেছে।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে বৃদ্ধ মন্ত্রী দু-হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ কচলালেন চশমা খুলে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার পর গাঢ় গলায় বললেন, তোমরা এখনকার দিনের ছেলেরা বুঝতেই পারবে না, কী উন্মাদনা ছিল তখন। জোয়ান জোয়ান, ভালো ভালো বংশের কত ছেলে, সব সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমিই তো জেল খেটেছি মোট এগারো বছর চার মাস, ইলেভেন ইয়ার্স ফোর মানথস, সেখানেই তো চুল পেকে গেল! দেখো না এক তোমাদের পরিবার থেকেই দু-জন, তোমার বাবা আর জ্যাঠা প্রাণ দিয়েছেন, আজ তাঁরা বেঁচে থাকলে দেশের আরও কত উপকার হত, আমার বদলে ওঁরাই মন্ত্রী হতেন।
তপন বলল, না, হতেন না–।
হতেন না? তুমি কী করে জানলে? মন্ত্রী হওয়াটা কি দোষের ব্যাপার নাকি?
না, তা বলছি না। আপনিই তো বললেন ওঁরা ছিলেন বিপ্লবী। ওঁরা হিংসার পথ নিয়েছিলেন, গান্ধীজির কথা শোনেননি। যাঁরা গান্ধীজির চ্যালা হননি–দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁদের একজনও কী দেশের কোনো উঁচুপদ পেয়েছেন? পাননি। তাঁদের দেশপ্রেম তো মূল্যহীন হয়ে গেছে। তাঁরা তো সব ছিলেন পাগল!
অ্যাঁ? কী বললে? কে বলেছে তোমায় এসব কথা। এসব বুঝি বিলেতে শিখেছ? দাঁড়াও এক মিনিট।
মন্ত্রীমশাই আবার টেলিফোন ধরলেন। আবার বললেন, হ্যালো, কী? কোন ডিস্ট্রিক্ট বললে? ও আচ্ছা! শোনো ওসব কথা এখন হবে না, পরে টেলিফোন করে অ্যাসেম্বলিতে আমার চেম্বারে।
সুবীর তপনের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, তপনদা, মেসোমশাইয়ের ব্লাড প্রেসার আছে, ওঁকে বেশি চটাবেন না।
তপন উত্তর না দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মন্ত্রীর ঘরখানা দেখতে লাগল। বেশ বড়ো ঘর, ঘরখানার মধ্যে একটা শুভ্রতা আছে। মনে হয় দেওয়ালগুলো দু-চারদিন আগেই হোয়াইটওয়াশ করা হয়েছে, এমন ধপধপে সাদা! চেয়ার-টেবিল নেই, একটা নীচু মতন তক্কোপোষের ওপর সাদা চাদর বিছানো, টি-পয়ের ওপর ফুলদানিতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা, দু-টি টেলিফোন–দু টিরই রং সাদা। পাখা নেই, এক কোণে এয়ারকুলার বসানো–বেশ মনোরম ঠান্ডা আবহাওয়া। তপন একটা জিনিস লক্ষ করল, টেলিফোন গাইড ছাড়া, সারাঘরে একখানাও বই নেই।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে মন্ত্রী একটু হাসলেন তপনের দিকে তাকিয়ে। টেলিফোনের কথার সূত্র ধরেই হাসলেন, না তপনকে দেখে তার কোনো হাসির কথা মনে পড়ল, তা ঠিক বোঝা গেল না। হাসতে হাসতে বললেন, তুমি বিলেতে থেকে থেকে কমিউনিস্ট হয়ে যাওনি তো? এখানকার সব কমিউনিস্ট নেতাই তো বিলেতফেরতা। এখন তো আবার ওখানে লেবার পার্টির যুগ। আমার এক জামাই-ই তো
তপনও সামান্য হেসে বলল আমি বিলেতে কখনো দু-এক সপ্তাহের বেশি থাকিনি।
ওঃ হো, তুমি তো জার্মানিতে না? বিলেতেও তো আজকাল সে সুবিধে নেই, এখন তো তাড়িয়ে দিচ্ছে। আর কোথা থেকেই বা তাড়াচ্ছে না, এমনকী আফ্রিকা থেকেও ভারতীয়দের ইয়ে দিচ্ছে, গলা ধাক্কা–সিংহল থেকে, বার্মা থেকে–যাকগে, আমি সামনের মাসে দিল্লি যাচ্ছি, নাজির কাছে তোমার কথাটা পাড়ব-নেহরুজি তো চাইতেনই দেশের গুণী ছেলেদের বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে, লালবাহাদুরও তাই চান, বলব এখন দেবনাথের ছেলে তুমি, চেহারারও মিল আছে, জেলখানায় দেবনাথ আর আমি পাশাপাশি সেলে ছিলাম।
তপন আর মনে করিয়ে দিল না যে তার বাবা কোনোদিন জেল খাটেননি। একথাটাই মন্ত্রীর মনে থাকছে না, অথচ তিনি কী করে তপনের চেহারার সঙ্গে তার বাবার চেহারার মিল খুঁজে পাচ্ছেন, কে জানে।
মন্ত্রী আবার বললেন, তোমার ঠাকুরদা-ঠাকুমা কেউ বেঁচে আছেন?
ঠাকুমা বেঁচে আছেন।
ঠিক আছে, তুমি ঠাকুমার নাম করে আমার কাছে একটা দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়ে, আমি ওঁর জন্য একটা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দেব–ওঁর ছেলেরা দেশের জন্য এত করেছেন।
তার বোধ হয় দরকার নেই। আমার ছোটোকাকা ভালোই রোজগার করেন, নিজের মায়ের খরচ নিশ্চয়ই চালাতে পারবেন।
তাহলে অবশ্য, ইয়ে, ভিক্ষের টাকা নেবে কেন? আরও কত নিডি লোক আছে, পলিটিক্যাল সাফারার তো কম নেই। যাক আমার বেশি সময় নেই, শোনো, আমাদের স্টুডেন্টস হেলথ হোমের জন্য একজন সুপারিনটেনডেন্ট দরকার–তুমিই লেগে পড়ো না।
হেলথ হোমের সুপারিনটেনডেন্ট? আপনি ভুল করছেন, আমি ডাক্তার নই।
ডাক্তার নও? তবে যে ছোটো খোকা বললে।
সুবীর চুপচাপই বসে ছিল আগাগোড়া। এবার তাড়াতাড়ি বলল, না, মেসোমশাই, আমি তা বলিনি। আমি বলেছিলাম, তপনদা বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে নিউ ক্লিয়ার ফিজিকস-এর ওপর পোস্ট ডক্টরেট রিসার্চ করেছেন, ওঁকে যদি এখানে কাজ করার সুযোগ দিয়ে এদেশে আটকে রাখা যায়।
ও, পিএইচ ডি-র ডাক্তার। তাই বলো! তা হলে তো-।
একজন সুবেশ যুবক ঘরে ঢুকে গৃহভৃত্যের মতন বিনীতভাবে মন্ত্রীর কানের পাশে কী যেন বলল। মন্ত্রী হাত নেড়ে বললেন, এখন না, এখন না, বসতে বলো ওঘরে, আর শোনো, চেম্বার অব কমার্সের ভাইস-প্রেসিডেন্টের আসবার কথা আছে, এলে খবর দিয়ে!
মন্ত্রী আবার তপনের দিকে চেয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে বললেন, তাহলে, তাহলে, আর একটা হয়, আমরা কংগ্রেস থেকে ডে-স্টুডেন্টস হোম খুলছি–মেধাবী ছাত্ররা বিনা পয়সায় থাকা খাওয়া পাবে, পড়াশুনো করবে–তুমি তার একটার ভার নাও না। মাইনে বেশি পাবে না কিন্তু যদি মানিয়ে নিতে পার–এইতো খালি আছে এখন দেখতে পাচ্ছি।
আপনি আমার সম্বন্ধে বোধ হয় ভুল ধারণা করেছেন। আমি আপনার কাছে কোনো চাকরি চাইতে আসিনি।
তবে কী জন্য এসেছ?
তপন কিছু বলার আগেই সুবীর বলল, আমি তপনদাকে নিয়ে এসেছি, আমার মাস্টারমশাই ছিলেন।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমি ওর জন্য কী করব এখন? চাকরি-বাকরির যা বাজার এখন, এর থেকে ভালো কোনো কাজ তো ঠিক এই মুহূর্তে।
তপন বলল, আমি আপনার কাছে ভালো-মন্দ কোনোরকম চাকরি চাইতে আসিনি! আপনার কাছে বুঝি সবাই চাকরি চাইতে আসে?
তাই তো আসে। সকালবেলা দু-ঘণ্টা সময় বাইরের লোকের জন্য রেখেছি, কারুর চাকরি, কারুর হাসপাতালে ভরতির ব্যবস্থা, কার বাড়ি অর্ধেক তৈরি হয়েছে তার জন্য সিমেন্টের পারমিট, বোঝে না তো, সবাইকে খুশি করা, সবার দাবি মেটানো সম্ভব নয়।
সবার মানে দেশের সব লোক, না, আপনার কাছে যারা অনুগ্রহ চাইতে আসে, শুধু তারা
মন্ত্রী গম্ভীর হয়ে বললেন, তা বলল, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি! তুমি কীজন্য এসেছ?
তপন এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, আমি শুধু আপনাকে দেখতে এসেছি। মন্ত্রী হঠাৎ ঘর ফাটানো হাসি হেসে উঠলেন, যেন ওই হাসিতে আগেকার সব কথাবার্তা মুছে গেল। তিনি এখন নতুন মানুষ!
সুবীর তপনের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অধৈর্য হয়ে বলল, চলুন, তপনদা, এবার ওঠা যাক। মেসোমশাই এখন স্নান করতে যাবেন।
মন্ত্রী বললেন, না, না, আর দু-মিনিট বোসো। তপনের দিকে চেয়ে বললেন, দেখতে এসেছ তা কী দেখলে বলো!
ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে বলব।
তুমি ইয়ংম্যান, তোমার আবার ভয়টা কী! আমরাই বরং তোমাদের ভয় করব!
দেখলাম, দেশের জন্য একসময় আপনারা অনেক ত্যাগ করেছেন, জেল খেটেছেন, আজ তার যোগ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তার ফলে আপনাদের স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, আপনারা আগেকার সব কথা ভুলে গেছেন!
ভুলে গেছি? কীরকম? কীরকম? তুমি কী করে জানলে?
আগে আপনারা ছিলেন জনতার একজন। এখন আপনারা, সেই জনতা থেকে দূরে সরে গেছেন! আগে আপনারা ইংরেজের লাঠি-বন্দুকের বিরুদ্ধেও অসীম সাহসে এগিয়ে গিয়েছিলেন আজ জনতা যখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আপনারা ঠিক ইংরেজের মতনই তাদের বিরুদ্ধে লাঠি-বন্দুক এগিয়ে দেন। কোনোদিন তাদের সামনে গিয়ে বলেছেন, আমি তোমাদেরই একজন, যদি আমার ভুল হয়ে থাকে, আমি ক্ষমা চাইছি। পরাধীন দেশকে পায়ের নীচে রাখার জন্য ইংরেজরা যে শাসনযন্ত্র বানিয়েছিল, আজ আঠারো বছর ধরে সেই শাসনযন্ত্রই আপনারা আঁকড়ে রয়েছেন। আজ আপনারা আর দেশপ্রেমিক নন, আপনারা পলিটিসিয়ান–আপনারা শুধু চান, কী করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। রাগ করবেন না, আপনার কথা শুনে আমার রাজা-মহারাজাদের কথা মনে পড়ছিল, আমাকে চাকরি দিয়ে কিংবা আমার ঠাকুমাকে মাসোহারা দিয়ে আপনি যেন দয়া দেখাতে চান–যেন এসবই আপনার নিজের সম্পত্তি।
দু-জন যুবক আবার এসে দাঁড়িয়েছে মন্ত্রীর পাশে। তিনি তাদের দিকে হাত নেড়ে বললেন, না ঠিক আছে এখন যাও!
তপনের দিকে চেয়ে বললেন, তুমি যা বললে তার খানিকটা সত্যি, এমন কিছু নতুন কথা বলনি। কিন্তু আমরা বদলাবার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করলেও সহজে বদলানো যায় না–দু-শো বছরের জঞ্জাল কি কুড়ি বছরে সাফ করা যায়। আসলে আমাদের দোষ কী জান, নির্বাচনের আগে আমাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়–আমরা নিজেরাও জানি, সেসব প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়, দেশের এ অবস্থায়। কিন্তু লোকে যে রূপকথা শুনতে চায়! তুমি বিদেশে ছিলে তো–তাই চোখ ধাঁধিয়ে গেছে, কিন্তু তোমার ওই আমেরিকায় একজন লোকের মাথাপিছু আয় কত? সে তুলনায় এই দেশে।
আমি অন্য কোনো দেশের কথা ভাবছি না, এদেশের কথাই ভাবছি। আপনারা কতখানি বদলাতে পেরেছেন, সেটা বড়ো কথা নয়, কথা হচ্ছে আপনাদের চেষ্টা কতখানি আন্তরিক। আন্তরিক নয় বলেই আপনারা সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরে এসে এক-একটা দুর্গের মধ্যে বাস করছেন। আপনারা সেকালের রাজাদের মতন চোখ দিয়ে শোনেন, কান দিয়ে দেখেন এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন না। সবসময় একদল লোক আপনাদের ঘিরে রেখেছে, আজ আপনারা মাঝে মাঝে দয়া করে কারুকে চাকরি, কারুকে পারমিট বিলোচ্ছেন! এদেশে কেউ কোনোদিন কোনো মন্ত্রীকে সাধারণ মানুষের মতন ট্রামে-বাসে চলাফেরা করতে দেখেছে? পাড়ার চায়ের দোকানে কোনো মন্ত্রী কখনো চা খেতে যায়? মন্ত্রীদের একজন আত্মীয়স্বজনও গরিব থাকে না কেন? মন্ত্রীর বাড়ির চাকরকেও লোকে খাতির করে–একী গণতন্ত্র, না রাজতন্ত্র?
ঘরে এখন অনেক লোক। তপনের গলা আবেগে অভিভূত, পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাত দুটো মুঠো করে রেখেছে। মন্ত্রীর মুখে ক্রোধের চিহ্ন পর্যন্ত নেই, খানিকটা হাসিমুখেই তিনি তপনের দিকে চেয়ে আছেন। সুবীরের মুখটা শুকনো। একটু কেশে গলা সাফ করে মন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিত্ব ফিরিয়ে আনলেন, খুব আস্তে আস্তে বললেন, সেন্টিমেন্টাল, বড্ড সেন্টিমেন্টাল! আজ অ্যাসেম্বলি আছে, তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারব না! যাক ওসব কথা থাক। তোমার নিজের কথা শুনি। তুমি এখন কী করবে ঠিক করেছ?
আমি কিছুই ঠিক করিনি।
তুমি নিজের থেকেই দেশের কোনো একটা কাজে নেমে না পড়ে আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছ কেন?
আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি, আমি আপনার কাছে কোনো সাহায্য চাইতে আসিনি।
এসেছ, নিশ্চয়ই এসেছ। আমি তোমাকে যে যে কাজের কথা বললাম, তার একটাও তোমার পছন্দ হয়নি, তাই রেগে গেছ। একটা সত্যি কথা বলো তো! আমি যদি এক্ষুনি তোমাকে একটা খুব বড়ো চাকরি দিয়ে দিই, তাহলে কি তুমি সেটা নেবে না? কিংবা তখনও আমার সমালোচনা করবে? ঠিক সত্যি কথা বলো, অনেককেই তো দেখলাম।
শুনুন, বিদেশে আমি যেখানে কাজ করি সেখানে আমি যা পাই, টাকার অঙ্কে তা প্রায় সাত হাজার টাকা। এখানে আমাকে সাত হাজার টাকা মাইনের কোনো চাকরি হঠাৎ দেবার ক্ষমতা বোধ হয় আপনারও নেই। সুতরাং আমার ক্ষেত্রে ওই প্রশ্নটা ওঠে না।
শোনো, একটা কথা বলি। মনে করো, আমি মন্ত্রী-টন্ত্রী কেউ নই, তোমার বাবার বয়েসি একজন বৃদ্ধ, সেই হিসেবে বলছি আমি তোমার কথায় রাগ করিনি–কিন্তু তোমার কথা শুনে আমি ভয় পাচ্ছি। তোমার বয়েস তো বেশি নয়, কিন্তু তোমার গলায় একটা তিক্ততা এসেছে, মুখে একটা বেপরোয়া ভাব, যেন পৃথিবীর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নেই–এই ভাবটা ভালো নয়, এতে মানুষ কোনো কাজই সম্পূর্ণভাবে করতে পারে না। জীবনটা এতে জ্বলে-পুড়ে যায়–বড়ো অশান্তি আর যন্ত্রণা পাবে তুমি
তপন হঠাৎ মুখ তুলে একটু হেসে বলল, আপনি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন না তো? মন্ত্রী একটু ফ্যাকাশে ভাবে হাসি আনার চেষ্টা করলেন, আবেগে তাঁর গলা কেঁপে উঠল, বললেন, না, না, বাবা, আমি তোমাকে অভিশাপ দিতে চাই না! জীবনে ক-টা মানুষের ভালো করতে পেরেছি, তা জানি না, কিন্তু সজ্ঞানে কারুর মন্দ করতে চাইনি। আমি আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করছি, যেখানেই থাক, শান্তিতে বেঁচেবর্তে থাক, আমরা বুড়ো হয়েছি, আমরা আর ক-দিন, কিন্তু তোমরা যদি শান্তি না পাও—