হিসেবের বাইরে
থলের মুখটা বড়ো করে ধরেছেন উমাপদ। মুলো, বেগুন, ঝিঙে, কুমড়ো সব। নেওয়া সারা। শাকটার জন্য ভেবেছিলেন চাষিদের কাছেই যাবেন। কিন্তু লখার কাছেই পেয়ে গেলেন।
দে বাবা, দেখেশুনে দে, উঁতের জলে ভিজিয়ে রাখিসনি তো? দেখিস, তোর বউদি এঁতের জিনিস ছুঁয়ে দেখে না।
এঁতের কারবার লখা করে না, লখা ঝাঁজিয়ে ওঠে, কোনোদিন আপনাকে খারাপ জিনিস দিয়েছি?
বা, বা দিব্যি পাটশাক উঠেছে তো! এক আঁটি কিনেই ফেললেন উমাপদ। যতই লিস্ট মিলিয়ে খরিদ করুন, হিসেবের বাইরে হাত চলেই যায়।
তা যদি বলো, বাজারহাট খুব সোজা জিনিস না। সময় লাগে। বাড়িটা ভাগ্যক্রমে কাছাকাছির মধ্যেই। তাই নিয়ম করে আসেন। রোজ না হলেও একদিন বাদ-বাদ তো বটেই। ফ্রিজে সাতদিন জমিয়ে রেখে খাওয়া তাঁরও পছন্দ নয়, তপরও নয়। এইবার মৎস্যমখী হতে হবে। মাছটা তিনি বোজ আগেই কিনে থাকেন। তরিতরকারি সময়ের জিনিস মোটের উপর সবই পাওয়া যায় কিন্তু মাছের ব্যাপারটা তো আর তা নয়। পাবদা না ট্যাংরা, পারশে না ভেটকি–কী পাওয়া যাচ্ছে তার উপর মেনু প্রোগাম সব নির্ভর করছে। আজকে এই পুঁইয়ের অনারে ভালো চিংড়ি দেখতে হচ্ছে। পুহঁটাই আজকের অর্ডার ছিল। অর্ডার বলো অর্ডার, আবদার বলো আবদার। চিংড়ি নেহাত পাওয়া না গেলে কাতলার মুড়ো ভরসা। মুশকিল হল ব্যাটারা মুড়োগুলো এমন করে কাটে যে কাঠ ছাড়া আর কিছু থাকে না। একটু কণ্ঠা, কণ্ঠার শাঁস না হলে ছ্যাঁচড়া জমে?
পাটপাতা দিয়ে খাবার জন্য দুশো মতো মৌরলাও কিনে ফেললেন উমা। তপু একেবারে অবাক হয়ে যাবে আজ।
এইজন্যেই লোকে আড়ালে উমাপদকে তপতীপদ বলে উল্লেখ করে থাকে। তিনি এ অঞ্চলের একজন ডাকসাইটে স্ত্রৈণ।
ছোটোখাটো মানুষটি। চটপটে, তরতরে। এ মোড় থেকে ও মোড় পৌঁছে যাবেন লহমার মধ্যে। খুরে এমন ধার! পরেন ধুতি আর রঙিন খাদির পাঞ্জাবি। মুখটা রূপী বাঁদরের মতো রাঙা ধরনের। কুতকুতে চোখ, ঝুপড়ি ভুরু। এক মাথা চুল গন্ধ তেল দিয়ে ঠেলে আঁচড়ানো ব্যাকব্রাশ।
উমাপদর শৌখিনতায় কেউ খুঁত ধরতে পারবে না। বাজার যাবার সময়ে ধুতিটা একটু হেঁটো করে পরেন অবশ্য। বাজারের চটিও আলাদা, রবার বা প্লাস্টিক যা-ই হোক। ধুয়ে নিলেই কাদা চলে যাবে। কিন্তু বাজারের এই কাদা, নোংরা, দুর্গন্ধ, ঠাসাঠাসির মধ্যেও তাঁর সবুজ কিংবা কমলা পাঞ্জাবির বোতামপটিতে গলার কাছের ভি-তে চিড় ধরে না। পাশ-পকেটে পরিষ্কার ভোয়ালে রুমাল। চুলের ফের একটা এদিক-ওদিক হবার জো নেই। ব্যাপার-বাড়িই যান আর বাজারেই যান উমাপদর চুল সদাসর্বদা ঠাস। চুলগুলিতে বলা বাহুল্য কড়া কলপ। তাঁর রাঙা মুখের শিরে কুচকুচে কালো চুলের বাহারের দিকে পথচলতি লোক ফিরে তাকাবেই।
জামার বোতাম, চটিজুতোর পালিশ, ধুতিপাঞ্জাবির ইস্তিরি, মায় চুলের কলপটি পর্যন্ত তপতীর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে, তবু মানুষের নিজের স্বভাবের অভ্যেসের দিক তো একটা আছেই! ধরুন উমাপদ বর্ধমানের সুদূর গ্রামের ছেলে, পড়াশোনা করতে তাঁকে বোর্ডিংয়ে থাকতে হয়েছে বরাবর। চাকরিকালে আবার যে দু চারখানা মেস কলকাতায় এখনও বহাল আছে, তারই একটাতে বাস করেছেন। ফলে নিজের জামাকাপড়ের বন্দোবস্ত নিজে করাটা গড়পড়তা বাঙালির ছেলের চেয়ে তাঁকে বেশিই রপ্ত করতে হয়েছে। গিন্নিরা গোছানো হোন বা না হোন এসব মানুষ কড়া মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা ফিটবাবু থাকবেই। জামার বোতাম সেলাই বা জুতো পালিশের জন্য এদের বউয়ের কাছে ধরনা দিতে হয় না, দর্জি-মুচির কাছে দৌড়াদৌড়ি করবারও দরকার পড়ে না। ঠিক কথা। কিন্তু খাওয়াদাওয়া? বোর্ডিংয়ের কুমড়োর ঘ্যাঁট আর মেসের মচ্ছের কালিয়া নামধারী বস্তুটির সঙ্গে যাদের পরিচয় গাঢ় হয়, তাদের যা-ই হোক রসনাগত শৌখিনতা বজায় থাকতে পারে না। থাকলে তারা সারভাইভ করতেই পারতেন না। অসাড় জিহ্বাই এসব ক্ষেত্রে একমাত্র বর্ম। আর বোডিং মেসের বোর্ডারের ছুটি-ছাটার বাড়ি? কে না জানে বর্ধমানের লোকেরা বেঁচে থাকে পোস্ত খেয়ে। সকালের জলখাবারে মুড়ি পোস্ত, দুপুর-ভোজনে ভাত-পোস্ত, রাত-ভোজনে ভাত বা রুটি-পোস্ত। পোস্ত মুখরোচক সন্দেহ নেই। কিন্তু উঠতে বসতে যদি কেউ একই জিনিস খেতে থাকে, খেতে চায়, সেটাকে কি ঠিক শৌখিনতা বলে অভিহিত করা যায়?
অথচ সেই উমাপদ এখন পোস্তর ঘের থেকে দিব্যি বেরিয়ে এসেছেন। তিনি এমনকি মাছের তেলের বড়া, ইলিশের মুড়ো-ল্যাজার টক, মোচার পাতুরি ইত্যাদির মতো অচিরাচরিত পদাদির আস্বাদন পাবার জন্য মুখিয়ে থাকেন। বেশি কথা কি বঙ্গীয় বেগুনভর্তার সঙ্গে বিহারি বেগুনচোকার কী তফাত, বা কত চালে কত ডাল মেশালে খিচুড়ি উপাদেয় হয় এসব কুটকচালিও তিনি দিব্যি জেনে গেছেন। এ বাবদে তাঁর শৌখিনতা বা পরিপক্কতার কৃতিত্ব পত্নী তপতীকে দিতেই হয়।
তাই বলে কেউ যেন না ভাবে উমাপদর তপতী দিনরাত্তির রান্নাঘরের খিদমতগারি করছেন। হলুদ-লংকায় হাত-রাঙা, নখ ভেঙে গেছে, ভাজা খেয়ে খেয়ে চামড়া ঢ্যাপচ্যাপ, পান খেয়ে দাঁতে ছোপ। তপসী সেই জাতের মহিলা নন। যাঁরা গৌরবর্ণ চাঁদ হেন মুখটি জন্মসূত্রে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে। উমাপদও তপতীকে তা থাকতে দেবেন না। ডাঁই করা ফ্যাশন-পত্রিকা উমাপদর টেবিলে। পাঠিকা তপতী, পাঠক উমাপদ।
পত্রিকার টিপস দেখে উমাপদ তপতীকে হেনার প্যাকেট এনে দেন। এই দ্যাখো, ডিমের সাদা, কফি-পাউডার, পুরোটাই ডিটেলে বলে দিয়েছে। লাগাও, লাগাও। লাগিয়ে ফ্যালো।
কী ব্যাপার? না, তপতীর মাথায় উত্তর-চল্লিশের পাকা চুল ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
শীতের হাওয়া শুরু হতে না হতেই দু-তিন খেপ ক্রিম এসে যায়। মাখো মাখো, মুখে হাতে, পায়ে, আঙুলের মধ্যে মধ্যে ভালো করে ঘষে,—কী ব্যাপার, না তপতীর গোড়ালি ফাটছে, হাত খসখস। গাল-গলা খসখস। এসব নিয়ে উমাপদর ভারি উদ্বেগ। তপতীর চেয়েও।
লোকে জানে রকমারি মনোহারির দোকানে উমাপদবাবুকে দেখা মানে তিনি কসমেটিকস কিনছেন। জুতোর দোকানে? তিনি স্কিন-কালারের মোজা কিনছেন। মিশন রো-এর মোড়ে?-হঠাৎ ভালো জাতের মুসাম্বি কি বেদানা দেখেছেন। জীবনদায়ী, যৌবনদায়ী এসব ফল।
ছেলে পড়ছে হায়দ্রাবাদে। বাড়ি শুনসান। কর্তা-গিন্নিতে রাঁধেন বাড়েন, থাকেন খান, বকবকম করেন আর টিভি দেখেন। পড়শিরা বলে কর্তার আপিসটাই মাঝখানে একটা বেরসিক ড্যাশ। ড্যাশটিকে হাইফেন করতে নাকি উমাপদবাবুর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু এদান্তে বড্ড কড়াকড়ি পড়েছে। ভাগ্যিস পাতাল রেল হয়েছিল তাই হুশ করে যেতে আসতে পারছেন। গিন্নির আঁচল ছেড়ে বেরোনো কি উমাপদর পক্ষে সহজ?
না, না দ্বিতীয় পক্ষ-টক্ষ নয়। সিলভার জুবিলি হয়ে গেল তপুকে ঘরে এনেছেন উমাপদ। সেই থেকেই মজে আছেন। যেমন রং, তেমনি চুলের বাহার। মুখ চোখের বিচার অত আলাদা করে কে-ই বা করতে যাচ্ছে। আসল হল টান। টানছে কিনা। তা তার পিছনে অন্য বস্তুও তো কিছু না কিছু আছেই। রসনেন্দ্রিয় হয়ে পাকস্থলির ট্রাডিশনাল পথেও তো তপতী উমার হৃদয়মন্দিরে প্রবেশ করেছেন কিনা! বাঙাল মামারবাড়ি আর ঘটি বাপেরবাড়ি হওয়ার সুবাদে দুই বাংলার পাকপ্রণালীর যা কিছু মোহিনীমায়া সবই যে তপতীর আয়ত্তে সে আভাস পূর্বেই পেয়েছি। ওদিকের কচুরশাক এদিকের লাউশাক দিয়ে পোস্ত, এদিকের মুলো ভেটকি ওদিকের কালোজিরে কাঁচালংকার বিখ্যাত ট্যালটেলে মাছের ঝোল সর্বত্রই তপতী-হস্তের অবাধ কৃতি। কাজেই, মুচকি হাসলে কী হবে! সবকিছুরই একটা কার্যকরণ থাকে।
হনহন করে চলেছেন উমাপদ খাস্তগির। হাতে ব্যাগ, ব্যাগে বাক্স, বাক্সে টিফিন, গায়ে জহর, তলায় খাদি, তলায় উলিকট। পায়ে মোজা, মোজার ওপর পাম্প, জিবে তপতী, বুকে তপতী—আপাদমস্তক তপতীতে ঠাসা হয়ে চলেছেন উমাপদ।
আস্তে দাদা, আস্তে,—পাতাল রেলের সিঁড়িতে রবিন।
কেন? ধাক্কা? পা মাড়িয়েছি?
আরে না, না আপনি মারবেন ধাক্কা? বলছি আপনার জন্যই। বয়স তো হচ্ছে।
উমাপদবাবু কাষ্ঠ হাসলেন।
প্রথমত, বয়স হচ্ছে, এ একটা ফালতু কথা। আপামর জনগণ হল গিয়ে জম্মবুড়ো। জন্মেই মরে আছে। এই বুঝি এল, এই বুঝি…। তিনি সে বান্দা নন। কত বয়স? পঞ্চাশ? পঁচানববুইয়ে অলিম্পিক করছে আজকাল, একশো পার করছে লিখতে লিখতে, লেকচার দিতে দিতে। দেশ চালাচ্ছে কারা? ছেলেছোকরারা? পাকা পাকা মাথা সব। হয় পরিপক্ক শুভ্র-সনাতন, নয়তো বেল, সব চুকেবুকে গেছে। তা এদের কাছে তো তাঁর পঞ্চাশ নস্যি? তুরতুর করে ওর এর পাশ দিয়ে গলে গলে ঠিক ন-টা পনেরোরটাতে উঠে পড়বেন তিনি। বাঁধা নিয়ম। হাতেই বাঁধা হিসেব।
ভিড় কাটিয়ে এগোতে এগোতেই এক দঙ্গল স্কুল-ছাত্রী। বাঙালি নয়। মাড়োয়ারি এরা। দুধ-ঘি-খাওয়া নধর চেহারা। স্বাস্থ্য ফেটে পড়ছে। হলুদ ব্লাউজ, নীল স্কার্ট, টানটান দু-বিনুনি একেবারে খুলির ওপর থেকে ঝুলিয়েছে কেউ কেউ, আবার ঝুঁটি বেঁধেছে ক্লিপ দিয়ে। মুঠো করে সহজেই ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। উমাপদবাবুর হাইটে কুলোবে না। কিন্তু এইভাবেই তিনি কচি লাউ, বোম্বাই বেগুনের বোঁটা ধরে ঝুলিতে পোরেন।
সুতরাং আর এগোলেন না তিনি। ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না এরা, কিচিরমিচির শালিক-ছাতারে-চড়ই-বাবুই। এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে, সামনে দিয়ে, পিছন দিয়ে মাখন-চকচক হাত ঘুরে যায়। গোল গোল হাত গাল ঝাপটা মেরে যায়। কিচ্ছুটি বলবেন না উমাপদ। করুক যা করছে, দিক না তাঁকে চেপটে, তাঁর আপত্তি নেই। ওই রবীন্দ্রসদন আসছে, হুড়মুড় করে নেমে যায় সব। চোখে-কানে দেখতে দেয় না এই মেট্রো রেল।
এইবার এগোতে থাকেন উমাপদ। একজন বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছেন। পাশে এক ছোকরা। সামনে সিটে একটি ফ্রক, আর আশ্চয্যি, একটি শাড়ি। ডাইনে বাঁয়ে যদ্দূর চোখ যায়, চোখ চালিয়ে-সালোয়ার-কামিজ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলেন না উমাপদ। আছে বুড়ি-থুড়ি। কিন্তু কাঁচা গায়ে শাড়ি এই একটি মাত্তরই। সালোয়ার-কামিজ ড্রেসটা দুচোখ পেড়ে দেখতে পারেন না উমাপদ! পোশাক না পাশবালিশের ওয়াড় বোঝা যায় না। ফ্রক তবু একরকম। কিছুটা খোলাখালা থাকে। তবে সব পোশাকের সেরা পোশাক হল গিয়ে শাড়ি। এই যে মেয়েটি সবুজ রঙের গোল-গলা ব্লাউজ পরেছে, উপরের দিকে ভাঁজটা কেমন চমৎকারভাবে ভেসে রয়েছে। যতই চেষ্টা করুক পুরোপুরি ঢাকাতে পারবে না। ব্লাউজের আর কোমরের মাঝখানে যে নরম, সাদা, রসালো পেটিটুকু ওর দাম লাখ টাকা। এমন পুরু অথচ ফোলা নয়, চিকন, সুস্বাদু জিনিস কুমারী মেরে ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। নাভিটি খোলা আছে কি না দেখা যাচ্ছে না। তবে অনুমান করা যায়, আছে। কোনো বিনোদিনী আজকাল নাভির ওপরে শাড়ি পরে না। উঠে দাঁড়ালে বোঝা যাবে।
সামনে দিয়ে শটাশট অন্ধকার পাতাল চলে যাচ্ছে। সুতল, তলাতল, রসাতল। সেইদিকেই ঠায় চেয়ে আছেন উমাপদ। ছোকরা ঝুঁকে পড়ে ফুটকি-ফোড়ন কাটছে। চেনাশোনা বোধহয়। কলেজ-টলেজ? প্রেম নাকি? আজকাল আবার এদের ফঞ্চুড়ি দেখে এসব বোঝা যায় না ফ্রকে-শাড়িতে-প্যান্টে দিব্যি জমেছে। উমাপদবাবুও হাত টান টান করে জমে গেছেন। শাড়ির পাশে ফাইল। এসপ্লানেড এলেই উঠে যাবে। বয়স্কা মহিলার তাক ওদিকেই। তিনি তা হতে দেবেন না। টুক করে বড়ি নামিয়ে দেবেন।
আ মলো! উঠে পড়ল যে! এটা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। ফ্রক বসে। শাড়ি উঠে যাচ্ছে। বয়স্ক মহিলা বসছেন। ছোকরা অমায়িক। মুহূর্তে এসপ্লানেডমুখী কিউয়ে শামিল হয়ে গেলেন উমাপদবাবু। কখন যে চলতে শুরু করেছেন, কখন যে নেমে পড়েছেন বুঝতেই পারেননি। সামনেই মেয়েটির ধড়। বেশ ধড়ফড়ে, জ্যান্ত-জিয়ল।
কখনো ঠিক পাশে, কখনো ঠিক পিছনে, কখনো দু মানুষ পিছনে, তুরতুর খুরখুর চলেছেন উমাপদ। সামনে লকলক করছে সবুজ লাউডগা আঁচল, বিনুনিটিরও বেশ গোছ আছে। এক গোছে এক কেজি, বেশি তো কম হবে না। খুলিটি বেশ ঢাকা তো! শাঁসে জলে মাখা। ফঙ্গবেনে জিনিস নয়।
বেরোবার ঘুরনচাকের কাছে এসে টনক নড়ল। কাজ সেরে নিলেন। ঝট করে রাগত মুখ ফেরাল শাড়ি। উমাপদ তখন দু মানুষ পিছনে, সামনে ঢ্যাঙার পিছনে একেবারে ঢাকা পড়ে গেছেন। কিছু না, একটা কৌতূহল ছিল, মিটে গেল। আধপর্ব মতো ডেপথ। উপর ভাসা জিনিস নয়। মানে নাভিটি। এইবার উমাপদ ফিরে আবার পর-ট্রেনে উঠবেন। উটকো কিছু না ঘটলে নিশ্চিন্তে আপিস যাবেন।
ওদিকে উমাপদকে খাইয়েদাইয়ে সাজিয়েগুজিয়ে দুগগা-দুগগা করে রওনা করিয়ে তপতী আস্তে সুস্থে চান করেন। তাঁর সর-ময়দায় সামান্য কাঁচা হলুদ মেশানো থাকে। একটা সোনার জেল্লা আসে চামড়ায়। নিখুঁত হিসেব। সর-ময়দা শুকোবে। তারপর ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে-দিয়ে স্পঞ্জ রগড়ে সব তুলবেন। রিঠে ভিজছে রাত থেকে। সেই জল মাথায় পড়বে, ফুরফুরে রেশমি হয়ে থাকবে চুল। এসব করতে সারতে টাইম লেগে যায়। তারপর চান-টান সেরে ধোয়া ছাপা শাড়ি আলগা করে পরে তপতী খেতে বসেন। একলার ঘরে একলার টেবিলে খাওয়া। সে যে কী তরিবত আর কী পরিতৃপ্তি তা একমাত্র তপতীই জানেন। সোনামুগের ডাল দিয়ে চামরমণি চালের ভাত মাখো, আধা নরম কড়া ঢ্যাঁড়স ভাজা দিয়ে খাও। ডাল মেখেও খাও, গন্ধ মেখেও খাও। চক্ষু বুজে কষের দাঁত দিয়ে কাঁকড়ার দাঁড়া ভাঙো। চুষে চুষে ভেতরের ঘি টানতে থাকো, টানতে টানতে কুঁদ হয়ে যাও, তারপর টকটক জিবের আওয়াজ করে চাটনি বা অম্বল। চেটেপুটে শব্দ করে, এক চেয়ারে গা আর এক চেয়ারে পা এলিয়ে বসে, আয়েশ করে খাও। খেয়ে-দেয়ে মুখ কুলকুচো করে একটি দাঁতখড়কে নাও, ঠিকঠাক জায়গা খুঁচিয়ে কাঁকড়ার খোলামকুচি ঢ্যাঁড়সের বিচি, খেজুরের খোসা এসব বের করে আনো। যত খুশি মুখ ভ্যাটকাও, দাঁত ছরকুটে করো, কেউ দেখতে আসবে না। বলতে কী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই সময়টায় তপতী ইচ্ছে করেই বেশ খানিকটা মুখ ভেংচিয়ে নেন। যেন সামনে কোনো বাঁদর-টাঁদর আছে। নিরাপদ দূরত্বে অবশ্য। মাঝে জাল। তা নয়তো তপতীর ভেংচি-ভিরকুট্টির বাহার দেখে বাঁদরটা নির্ঘাত বিপজ্জনকভাবে খিচিয়ে খিমচিয়ে দিত। সুন্দর সুসংস্কৃত মুখখানায় কত রকম কাটাকুটি খেলা যায় সেটা দেখা, এবং নিজেকে দেখানোই যেন তপতীর উদ্দেশ্য।
বেল বাজে, সেলস গার্ল এসেছে। আবার বেল বাজে। কাজের লোক এসেছে।
পাখার তলায় বসে চুলটাকে একটু শুকিয়ে নেন এবার। ভিজে চুলে শুলে মাথা ধরা কেউ আটকাতে পারবে না। মাথা ধরলে চোখে কালি, চোখে কালি পড়লে উমা ব্যস্ত হবেন। পত্রিকার ডাঁই থেকে চোখে কালির নিদান খুঁজতে সন্ধে কাবার। সুতরাং চুল শুকোলে তবেই পছন্দসই কয়েকখানা পত্রপত্রিকা নিয়ে তপতী বিছানাসই হবেন। যত না পড়েন তারচেয়ে বেশি দেখেন তপতী। প্রথমে দেখেন। সাজ। তারপর দেখেন রূপ। তারপর দেখেন গল্প। তারপর ফিরে আসেন সাজসজ্জায়। কত লেহেঙ্গা চোলি, কত বীরবউলি, বডিসুট, বাউটি, শেরওয়ানি, জিনস, কত জিম-যন্ত্র, কত ব্রেসিয়ার, কত হোসিয়ারি। দেখতে দেখতে চোখ ফেরে না। শেষে যখন বিউটি-ঘুমে ঢলে ঢলে পড়তে থাকেন বুকের ওপর উপুড় হয়ে থাকে পাতজোড়া এক নবনায়ক। পত্রিকা আঁকড়ে পাশ ফেরেন তপতী। এইবার উটকো কিছু না ঘটলে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন।