Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হিসেবে ভুল ছিল (১৯৯৭) || Samaresh Majumdar » Page 4

হিসেবে ভুল ছিল (১৯৯৭) || Samaresh Majumdar

সকালে ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। ভাঙামাত্র মনে হল আজ বিছানা থেকে নামতে পারবে না। সর্বাঙ্গে ব্যথা, শরীর আরাম চাইছে। সে কোনওমতে টয়লেটে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই দরজায় টোকা পড়ল। অর্জুন দরজা খুলতেই দেখতে পেল ডেরেককে।

গুডমর্নিং। শরীর ঠিক আছে তো?

গুডমর্নিং। হঠাৎ শরীরের কথা জিজ্ঞেস করছেন?

গতকালের তুলনায় আজকে আপনি অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেন। এ কী! এসব কী হয়েছে? দেখি, দেখি! আরে, আপনি দেখছি কাল আহত হয়েছিলেন। কী ব্যাপার?

সব বলছি। সমস্যা হল, আমার সঙ্গে কোনও ওষুধ নেই। কেটে-ছুড়ে গেলে, পড়ে গিয়ে শরীরে ব্যথা হলে আপনারা কী করেন?

ওষুধ খাই। গাছগাছড়ার পাতা, শেকড় থেকে ওষুধ বানানো হয়। এ ছাড়া শিলিগুড়ির একজন ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে সবরকমের ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। তাও আছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। ডেরেক বেরিয়ে গেল।

কিন্তু ফিরে এল মিনিট তিনেকের মধ্যে, এখনই নিয়ে আসছে। ছড়ে যাওয়া ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেছে। রক্ত পড়েছিল বোঝা যাচ্ছে। আর কি অসুবিধে হচ্ছে?

পড়ে গিয়েছিলাম। অনেকখানি। পায়ে এবং কোমরে বেশ ব্যথা।

ভাঙেনি তো?

না, না। ভাঙলে এতটা পথ ফিরতে পারতাম না, আর এভাবে দাঁড়াতেও না।

অর্জুন বসল। সেই সময় পল এল চায়ের কাপ নিয়ে। কোনও কথা না বলে সেটা টেবিলে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অর্জুন ডাকল, গুডমর্নিং, পল।

পল দাঁড়াল, গুডমর্নিং স্যার। তারপর চলে গেল।

ডেরেক বলল, আমি শুনেছি আপনি কাল রাত্রে বেরিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। ওই পাহাড়ে গিয়েছিলাম, যেখানে আগুন জ্বলেছিল।

আপনার সঙ্গে কাকাও গিয়েছিলেন?

না। আমি গিয়েছিলাম আগুন জ্বলবার আগে। উনি গিয়েছিলেন আগুন জ্বলতে দেখে, ছবি তোলার লোভে। আমরা একসঙ্গে ফিরে এসেছিলাম।

কাকার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। বুড়োমানুষ, এখনও ঘুমোচ্ছেন। কীভাবে আগুন জ্বলে উঠল বলুন তো? ডেরেক জিজ্ঞেস করল।

ঠিক কীভাবে জ্বলেছিল আমি দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ওখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। যারা জ্বালিয়েছে তারা বাইরের লোক।

বাইরের লোক? তাদের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে ওখানে আগুন জ্বালার?

এখনও জানি না।

এই সময় একটি মানুষ দরজায় এসে দাঁড়াতেই ডেরেক তাঁকে বলল, আসুন, আসুন। ইনি অর্জুন, আমাদের অতিথি। গতকাল ইনি পাহাড়ে পড়ে গিয়ে একটু আহত হয়েছেন।

ভদ্রলোক বয়স্ক। প্রথমে তিনি অর্জুনের নাড়ি দেখে মাথা নাড়লেন। তারপর শুকিয়ে যাওয়া দাগগুলো দেখলেন। অর্জুন দেখল ভদ্রলোক ব্যাগ খুলে একটি শিশি থেকে তরল দ্রব্য তুলোয় নিয়ে তার আঁচড়ে যাওয়া চামড়ায় বোলাতে লাগলেন। চিনচিনে ভাবটা সামলে নিল। তারপর চায়ের কাপের দিকে ভদ্রলোক তাকালেন, আপনি চা খেয়ে নিন। খাওয়ার আধঘণ্টা বাদে ওই পুরিয়াটা খেয়ে নেবেন। এতে যদি ব্যথা না কমে তা হলে এই ট্যাবলেটটা খাবেন। এটা বোধ হয় আপনার চেনা ট্যাবলেট।

ব্যাগ গুছিয়ে তিনি ডেরেককে বললেন, ভয়ের কিছু নেই।

ডেরেক বলল, অনেক ধন্যবাদ।

ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ইনি কি ডাক্তার?

ডেরেক বলল, আপনারা যে ডিগ্রি থাকলে কাউকে ডাক্তার বলেন সেটা যে ওঁর নেই, বা থাকতে পারে না, সেটা নিশ্চয়ই বুঝেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন তখন নিজেদের গরজেই তাঁরা প্রকৃতি থেকে আত্মরক্ষার অস্ত্র খুঁজে নিয়েছিলেন। প্রতিটি প্রজন্ম সেই বিদ্যেটাকে আরও বাড়িয়েছে। গত তিন পুরুষ ধরে এঁরাই আমাদের গ্রামের মানুষের অসুখ-বিসুখে ওষুধ দেন। এখানে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মরে যাওয়া ছাড়া তেমন কোনও বড় অসুখ এখনও কারও হয়নি। আপনি শুনলে অবাক হবেন, ইনি অপারেশন পর্যন্ত করতে পারেন। তবে সেগুলো খুবই সাধারণ কেস।

বড় কেস হলে?

এখন আমরা নর্থবেঙ্গল হসপিটালে নিয়ে যাই রুগিকে।

চা খাওয়া হয়ে গেলে অর্জুন বলল, এখন অনেকটা ভাল লাগছে। ডেরেক, আপনি চারজন শক্তিশালী লোককে সঙ্গে নিন। আমাদের একবার পাহাড়ে যেতে হবে।

কেন?

যাওয়ার সময় বলব। আমার জন্যে চিন্তা করবেন না, আমি ঠিকই আছি।

পাহাড়ে বলতে?

যেখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে, তার নীচে। সঙ্গে বেশ শক্ত লম্বা দড়ি নেবেন।

কী ব্যাপার?

একটা খুব বড় রহস্য পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে আমরা ওখানে গেলে।

ডেরেক চলে গেলে অর্জুন ঘড়িটা বের করল। গত রাতে এই জিনিসটা তার প্রাণরক্ষা করেছে। একটা নিরীহ ঘড়ি যে অমন মারাত্মক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে তা কে জানত! অমল সোমই এর রহস্য তার কাছে আগে কখনও ফাঁস করেননি।

বেরনোর আগে কাগজের মোড়ক খুলে পুরিয়াটাকে দেখল সে। শুকনো ছালের গুঁড়ো। এখন সামান্য অসুখ করলেই শহরের মানুষ অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে নেয়। কবিরাজি ওষুধের চল খুবই কমে গেছে। হয়তো তেমন উপকার পায় না বলেই মানুষের ভরসা কম। নেহাত কৌতূহলেই অর্জুন ওটাকে মুখে ঢেলে দিল। কিন্তু সঙ্গে পরিচিত ব্যথা কমানোর ট্যাবলেটটা নিতে ভুলল না। গত রাত্রে যেটা বোঝা যায়নি, এখন পা ফেলতে ব্যথাটা বেশ জানান দিচ্ছে। একটু-একটু করে নীচে নেমে এল সে।

হলঘরে বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। কেউ-কেউ বায়না ধরছে বাইরে যাওয়ার জন্যে। মিসেস বেনসন ওদের জন্যে প্রচুর খেলনা নিয়ে এসেছেন। বাচ্চাগুলোর কেউ-কেউ তাই নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু ব্যতিক্রম একজন। মায়ের কোল ঘেঁষে বসে গম্ভীর মুখে সে সমবয়সীদের দেখছে। সেই মুখের অভিব্যক্তি বলছে, কী ছেলেমানুষ এরা!

অর্জুন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, হ্যালো।

বাচ্চাটা মুখ ফেরাল। স্পষ্ট চোখে তাকাল। ওর মা বললেন, বলো, হ্যালো।

বাচ্চাটা নীরবে ঘাড় নেড়ে না বলল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওর নাম কী, বব? রবার্ট? অর্জুন আবার বলল, হ্যালো বব। তোমার খেলতে ইচ্ছে করছে না?

বব এবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে আধোগলায় জিজ্ঞেস করল, হু ইজ হি?

হি ইজ আওয়ার ফ্রেন্ড।

ফ্রেন্ড?

ইয়েস। হি ওয়ান্টস টু হেল্প আস।

হোয়াই?

ওর মা হেসে উঠলেন। অর্জুন থতমত হয়ে গেল। ওইটুকুনি বাচ্চা কী দারুণ বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করল। সে নিশ্চয়ই বন্ধুর মতো স্বার্থহীন হয়ে সাহায্য করতে এখানে আসেনি। অমল সোম দক্ষিণার কথা বলেছেন, নেবেনও, যদি ইচ্ছে হয়। কিন্তু ওর মা যতই বন্ধু বলুন, ওই বাচ্চাটার প্রশ্নের কী জবাব সে দেবে?

অর্জুন বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে বিরক্ত হয়ে মাথা সরাল। দরজার দিকে যেতে-যেতে অর্জুনের মনে হল, এই বাচ্চাটা সবার চেয়ে আলাদা। এই দু বছর বয়সে ও যেন গভীর জ্ঞান নিয়ে পৃথিবীকে দেখছে। আচ্ছা, এই বাচ্চাটাই ওই বাইরে থেকে আসা মানুষদের লক্ষ্য নয় তো?

বাইরে বেরিয়ে আসতেই সে ডেরেককে দেখতে পেল। সঙ্গে দড়ি হাতে তিনজন বেশ স্বাস্থ্যবান যুবক। ডেরেক বলল, আমরা তৈরি।

পাঁচজন হচ্ছি। আর একজন হলে ভাল হত। আপনি চার্লসকে নিতে পারেন?

চার্লস? কোন চার্লস?

আপনাদের দরজি এডের বন্ধু।

ওঃ। এই নামটা আপনি সবে গতকাল শুনেছেন। ঠিক আছে। চলুন, যাওয়ার পথে চার্লসের বাড়ি পড়বে। ওকে বলছি।

ওরা রওনা হল। হাঁটতে হাঁটতে ডেরেককে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি কোনও অস্ত্র সঙ্গে নিয়েছেন?

ডেরেক হাসল, অস্ত্র? কেন?

যদি প্রয়োজন হয়?

দুর! এই পাহাড়ে দিনদুপুরে কোনও হিংস্র জীব সামনে আসবে না।

অর্জুন আর কথা বাড়াল।

চার্লসের বাড়ি গ্রামের একান্তে। বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগানের আগাছা পরিষ্কার করছিল চার্লস। পাঁচজন মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল অবাক হয়ে। ডেরেক ডাকল, হ্যালো, চার্লস।

চার্লস এগিয়ে এল, হ্যালো, ডেরেক।

তুমি কি এখন খুব ব্যস্ত?

না। তেমন নয়। কিন্তু কেন?

চলো আমরা পাহাড়ে যাচ্ছি। গতকাল পাহাড়ে আগুন জ্বলেছিল, তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ। জায়গাটা আমরা দেখে আসতে যাচ্ছি।

তোমরা তো পাঁচজন আছ, আমাকে কী দরকার?

ডেরেক হাসল, তুমি বেশ শক্তিমান মানুষ। আমাদের বন্ধু অর্জুন তাই তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চাইছে।

চার্লসের মুখ অর্জুনের দিকে ফিরল। মুখের অভিব্যক্তিতে প্রশ্ন।

অর্জুন কোনও কথা বলল না।

এবার চার্লস জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে চেনেন নাকি?

চিনি বলা ঠিক হবে না। তবে দেখেছি।

দেখেছেন?

হ্যাঁ। পরশু রাত্রে পাব থেকে বেরিয়ে এডের সঙ্গে গল্প করছিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে চার্লসের কপালে ভাঁজ পড়ল। এবং তারপরেই লোকটার কথাবার্তা বদলে গেল। হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে গেট খুলে সে এগিয়ে এল, ঠিক আছে ডেরেক, চলুন, যাওয়া যাক।

ওরা হাঁটা শুরু করল। ডেরেক ওর পাশে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার কাকার খবর কী?

ডেরেক বলল, বৃদ্ধ সারারাত জেগে এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আমি গিয়ে দরজায় শব্দ করেও সেই ঘুম ভাঙাতে পারিনি।

অর্জুন বলল, ওঁকে দেখে মনে হয় না ওঁর ঘুম এত গভীর।

ডেরেক জবাব দিল না। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর ওরা সেই পোড়া জায়গাটায় পৌঁছল। কাল রাত্রে যেহেতু বৃষ্টি হয়নি তাই পোড়া গাছগাছালির ছাই কাদা হয়ে যায়নি। অর্জুন লক্ষ করল ডেরেক ছাড়া অন্যরা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। কৌতূহল এবং ভয় একই সঙ্গে রয়েছে তাদের দৃষ্টিতে। এখন হালকা রোদ সর্বত্র। জঙ্গলের রহস্যময় চরিত্রটি এখন বোঝা যাচ্ছে না। তবু যে ভীতি ওরা মনে পুষে রেখেছে তা এখনও সরাতে পারছে না।

অর্জুন লক্ষ করল এর আগের বার যেখানে আগুন লাগানো হয়েছিল ঠিক তার পাশেই এবার আগুন জ্বলেছে। এসব জায়গায় গাছগাছালি ছাড়া বুনো ঝোপে। ভর্তি। কিন্তু ওই লোকগুলো উধাও হয়ে গেল কোন পথে? সে ডেরেককে ডাকল, আপনার কাকার সঙ্গে আমার এখানেই দেখা হয়েছিল। ওঁর ক্যামেরার ফিল্ম শেষ হয়ে গিয়েছিল।

তখন কত রাত?

অনেক।

আমি ভেবে পাচ্ছি না কাকা অত রাত্রে আগুন জ্বলছে দেখেও এখানে আসার সাহস পেলেন কী করে? গ্রামের সবাইকে ওই সময়ে বাইরে যেতে নিষেধ করা আছে।

একটা লোক নাকি ওঁর ডার্করুমে কাল রাত্রে ঢুকেছিল। সেই লোকটাকে অনুসরণ করে তিনি এখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অন্তত আমাকে তাই বলেছেন।

বাড়ি বন্ধ, ডার্করুমে ঢুকেছিল? তার মানে চুরি করতে গিয়েছিল?

হ্যাঁ। ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে আরও বিশদ জানা যাবে।

অসম্ভব! আমাদের গ্রামে কেউ এমন কাজ করবে না।

হয়তো। কেউ এতদিন করেনি, করবে না ভাবছেন কেন?

ভাবছি, কারণ আমি আমার গ্রামের মানুষদের চিনি।

তা হলে বলতে হয় বাইরের লোক চুরি করতে এসেছিল।

সেই লোকটি যদি আপনি হন? হঠাৎ ডেরেক ঘুরে দাঁড়াল।

তার মানে?

আপনি জানতেন কাকার সংগ্রহ থেকে নেগেটিভ এবং কিছু প্রিন্ট হারিয়ে গিয়েছে। হয়তো আপনি বিশ্বাস করেননি। রাত্রে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে তাই কাকার বাড়িতে ঢুকেছিলেন সেগুলোর সন্ধানে। না পেয়ে বাইরে এসে আগুন দেখতে পান এবং যেহেতু এই আগুন সম্পর্কে আপনার কৌতূহল আছে তাই সটান এখানে চলে আসেন। কাকাকে আপনার পেছন-পেছন আসতে দেখে লুকোতে চান এবং পড়ে যান। সেই সময় আপনি আহত হন। তারপর উপায় না দেখে কাকার সঙ্গে কথা বলেন এমনভাবে, যেন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ডেরেক একটানা বলে থামল।

হেসে ফেলল অর্জুন, হ্যাঁ, এরকম ভাবা যেতে পারে। আমরা বলি কেউ সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। তবে আপনার কাকা লোকটিকে পেছন থেকে দেখেছেন। তার উচ্চতা এবং শরীরের আয়তন সম্পর্কে আন্দাজ নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছিল। সেটার সঙ্গে আমার কতটা মিল আছে তা তিনিই বলতে পারবেন। ততক্ষণ আসুন, আমরা কাজ শুরু করি।

ডেরেক বলল, সকালে আপনি যেভাবে শরীরের ব্যথার কথা বলছিলেন, এখানে আসার পথে কিন্তু তার কোনও নমুনা দেখতে পাইনি।

অর্জুনের খেয়াল হল। সকালে যেরকম তীব্র ব্যথা ছিল এখন সেটা একদম থিতিয়ে গেছে। ওই পুরিয়া দারুণ কাজ করেছে। সে বলল, এর সমস্ত কৃতিত্ব ওই ভদ্রলোকের, যিনি আমাকে পুরিয়া দিয়েছিলেন। যাকগে, ডেরেক, আমাকে সন্দেহ করলে এই মুহূর্তে আপনার কোনও লাভ হচ্ছে না। আপনাদের গ্রামে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল বলেই আপনি অমল সোমের কাছে গিয়েছিলেন। আমি এসেছি সেটা সমাধান করতে, সমস্যা বাড়াতে নয়।

ডেরেক মুখ ফেরাল। সম্ভবত অর্জুনের রাতের অভিযান তার পছন্দ হয়নি। অন্তত তাকে না জানিয়ে অর্জুন বেরিয়েছিল বলে কোথাও লেগেছিল তার। তা ছাড়া গ্রামের মানুষদের সম্পর্কে অর্জুনের সন্দেহ সে পছন্দ করেনি। আর এইজন্যেই মনে যে বাষ্প জমা হয়েছিল তা ওর মুখ দিয়ে কথা হয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

ডেরেক জিজ্ঞেস করল, আমাদের কী করতে হবে।

আমরা নীচে নামব। একেবারে নীচে।

সে কী! চমকে গেল ডেরেক।

অর্জুন সবাইকে হাত নেড়ে কাছে ডাকল। ওরা এলে অর্জুন বলল, চার্লস, আপনি তো পাহাড়টাকে ভালভাবে জানেন। আমরা ঠিক ওইখানে, একেবারে নীচে নামতে চাই। কীভাবে যাব বলতে পারেন?

চার্লস ডেরেকের দিকে তাকাল, আমি তো কখনও এর আগে যাইনি।

আপনি তো পাকদণ্ডী ভাল চেনেন।

একথা কে বলল আপনাকে?

আমি শুনেছিলাম। আচ্ছা, কাল রাত্রে যে পথ দিয়ে নেমেছিলাম সেই পথেই চেষ্টা করি। আমাদের খুব সাবধানে নামতে হবে।

দড়ির সাহায্যে ওরা নামছিল। যেভাবে পা পিছলে যাচ্ছিল তা অর্জুনকে গত রাতের পতনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। নামবার সময় একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে দড়ির এক প্রান্ত শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ওঠার সময় উঠতে সুবিধে হবে এতে। পা পিছলে মাধ্যাকর্ষণের টানে অল্প সময়ে যতটা নীচে নামা যায়, সচেতনভাবে তার অর্ধেকও সম্ভব নয়। একসময় লম্বা দড়িও শেষ হয়ে এল।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অর্জুনকে জিজ্ঞেস করল ডেরেক, আপনি কাল রাত্রে এখানে এসেছিলেন?

আরও নীচে।

উঠলেন কী করে?

খুব কষ্ট করে। তবে সেই জায়গাটা ওপর থেকে দেখে ঠাহর করতে পারিনি। আরও মিনিট কুড়ি বাদে ওরা নীচে নামতে পারল। এখানকার গাছগাছালি, বুনো গন্ধ, মাটি হয়তো পৃথিবীর আদিমতম দিনগুলো থেকে মানুষের স্পর্শবর্জিত ছিল। গতরাতের আগে কেউ এখানে নেমেছে বলে মনে হয় না।

চার্লস বলল, সাবধান। সাপ!

সবাই স্থির হয়ে গেল। সাপটার পেট এবং লেজ দেখা যাচ্ছে। সামনের অংশ পাতার আড়ালে। কিন্তু, অর্জুনের মনে হল, ওটা নড়ছে না। একটা গাছের ডাল ভেঙে ওর পেটে খোঁচা দেওয়া সত্ত্বেও যখন প্রতিক্রিয়া হল না তখন ডালটা শরীরের তলায় ঢুকিয়ে টেনে তুলল সে। এবং তখনই সে চিনতে পারল। এটা গতরাতের ফণা তোলা সাপ। মাথা এবং তার নীচের খানিকটা অংশ পুড়ে গলে গিয়েছে।

চার্লস এগিয়ে এল, কীভাবে মরল এটা? আগুনে পুড়েছে বোধ হয়।

ডেরেক বলল, হতেই পারে। ওপরের গাছে ছিল। আগুনে পুড়ে খাদে পড়ে গেছে।

আর একটু হাঁটতেই চার্লস দাঁড়িয়ে পড়ল। ডেরেককে বলল, ব্যাপারটা লক্ষ করো। দুপাশের গাছের ডাল ছেটে কেউ যেন রাস্তা করে রেখেছে। মানুষ ছাড়া এমন কেউ করতে পারে না। নিশ্চয়ই মানুষ এসেছিল। কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি?

অর্জুন বলল, আমরা প্রায় এসে গিয়েছি। একটু বাদেই জানতে পারবেন।

কিছুক্ষণ পরে অর্জুনই প্রথম দেখতে পেল, পেয়ে ছুটে গেল কাছে। সেই শক্ত বস্তুটি দু টুকরো হয়ে পড়ে আছে। ভেতরটা ভেজা-ভেজা, লালচে হয়ে আছে। দুটো টুকরো যদি গোল হয় তা হলে সেই খোলের মধ্যে কিছু নেই।

ডেরেক জিজ্ঞেস করল, এটা কী? কী ছিল এর ভেতরে?

অর্জুন চারপাশে তাকাল। এখানে মাটি নরম। স্যাঁতসেঁতে। এবার স্পষ্ট দাগ দেখতে পেল সে। ইঞ্চি ছয়েকের গোল দাগ, পাশাপাশি। দাগের গভীরতা বলে দিচ্ছে প্রাণীটি ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর এগিয়ে গেছে। সেই দাগ অনুসরণ করে এগোতেই বাধা পেল অর্জুন। সামনেই পাথর। পাথরে পায়ের চিহ্ন নেই।

সে হতাশ হয়ে বলল, ইস৷ দেরি হয়ে গেল।

কীসের দেরি? ডেরেক কিছুই বুঝতে পারছিল না।

অর্জুন বলল, আপনার মনে আছে ডেরেক, মিস্টার সেম একটা ছবিতে আধপোড়া গাছের ভেতর বিশাল ডিমের আকারের কিছু দেখিয়ে জানতে চেয়েছিলেন ওটা কী? আপনি উত্তরটা বলতে পারেননি। আপনার কাকার সঙ্গে আমি আর আপনি যখন আগুনে পোড়া জায়গাটায় প্রথমবার এলাম তখন সেই আধপোড়া গাছটির দেখা পাইনি। বস্তুটিও ওখানে ছিল না। কাছেই একটা বিশাল পাথরের গায়ে ছাই এবং ঘষা দাগ দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল ওটাকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমি সেটার সন্ধানে গত রাত্রে নীচে নামতে গিয়ে পড়ে যাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডিমটার কাছে পৌঁছই। এসে দেখি ওই শক্ত ডিম, যদি ডিম বলা যায়, একটু-একটু নড়ছে। অর্থাৎ ওটার মধ্যে কোনও জন্তুর প্রাণ আছে। প্রাগৈতিহাসিক অনেক প্রাণীর জ্বণ ওপরের খোলস ফসিল হয়ে গেলেও ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় বহুকাল থেকে যেতে পারে। আমার সন্দেহ হয়েছিল এটা সেইরকম হলেও হতে পারে। আগুনের তাত এবং ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার আঘাত পেয়ে সেই সুপ্ত প্রাণ জেগেছে। যে কোনও কারণেই ভাঙা খোলটা দিয়ে ভেতরে বাতাস যাওয়া অক্সিজেন পেয়ে দুলছে। এরকম একটা প্রাণীর সন্ধান জীববিজ্ঞানীরা পেলে সারা পৃথিবীতে কীরকম আলোড়ন হবে ভেবে দেখুন। আমার মনে হয়েছিল অনুমান সত্যি হলেও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খোলস ভেঙে ওর বেরোনোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমি দেরি করে ফেলেছি। উঃ, কী আফসোস

হচ্ছে।

এতক্ষণ সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। চার্লসই প্রশ্ন করল, ওটা কী প্রাণী?

আমি জানি না। আর-একজন জিজ্ঞেস করল, ওটা কি খুব হিংস্র হতে পারে?

তাও জানি না। তবে মানুষের চেয়ে হিংস্র প্রাণী পৃথিবীতে কিছু নেই।

ডেরেক বলল, সবে জন্মেছে যে, সে আর কতদূরে যাবে? এসো, খুঁজে দেখা যাক। সবাই গাছের ডাল ভেঙে লাঠি করে নিয়ে চারপাশের গাছে আঘাত করতে লাগল। সেই আঘাতের শব্দে ভয় পেয়ে দুটো খরগোশ আর একটা সাপকে পালিয়ে যেতে দেখা গেল। হঠাৎ একজন চিৎকার করে ডাকতেই অর্জুন ছুটে গেল। পাথরগুলোর ওপাশে জঙ্গলের মধ্যে আবার পায়ের ছাপ রয়েছে। পরপর চারটে। কিন্তু সেগুলো আবার পাথরে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু অর্জুন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। একটু আগে যে চিহ্নটাকে মাত্র ছয় ইঞ্চি মনে হচ্ছিল এখন সেটা আরও বড় হয়েছে। মাত্র পঞ্চাশ গজ পথ পেরিয়েই পায়ের চিহ্ন বড় হয় কী করে? না কি এতকাল নির্দিষ্ট খোলের মধ্যে থাকায় প্রাণীটির চেহারা গুটিয়ে ছিল, বাড়তে পারেনি। বাইরের হাওয়া পেয়ে সেটা দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রায় একটা বাচ্চা হাতির পায়ের মাপে এখন ওই দাগটা।

ডেরেক পাশে এসে বসে পড়েছিল দাগটা দেখতে। দেখে বলল, অসম্ভব! এটা নিশ্চয়ই আলাদা প্রাণী। কিন্তু দুটো প্রাণীর পায়ের আকৃতি একই রকম হল কী করে?

চার্লস বলল, আমাদের আর এখানে থাকা উচিত নয়। এই প্রাণী হিংস্র কি না তা কেউ জানি না। যদি হিংস্র হয় তা হলে আত্মরক্ষার কোনও অস্ত্র নেই আমাদের কাছে।

অর্জুন দেখল সবাই চার্লসকে সমর্থন করছে। কিন্তু ফিরে যাওয়া মানে প্রাণীটিকে হয়তো চিরকালের মতো হারাতে হবে।

এই পাহাড়-জঙ্গল ভারত, ভুটান, নেপাল ছাড়িয়ে চলে গেছে অনেকদূর। এই বিশাল জায়গায় কাউকে খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যেহেতু এই প্রাণী সদ্য খোল থেকে বেরিয়েছে তাই ও বেশিদূরে যাবে না। এখন দু-একদিন ও খোলের কাছে ফিরে আসবেই। সে ঠিক করল, এখানে আজকালের মধ্যে আবার আসবে।

যে-পথ দিয়ে গতরাত্রে ওপরে উঠেছিল সেটা পাওয়া গেল একটু খুঁজতেই। ওপরে উঠে আসার পর অর্জুন দড়িটাকে খুলতে নিষেধ করল।

হঠাৎ চার্লস জিজ্ঞেস করল, ওই প্রাণী যদি গ্রামে গিয়ে হামলা করে?

অর্জুন মাথা নাড়ল, ওকে বিরক্ত না করলে ওসব ঘটবে না। তা ছাড়া ওর চরিত্র সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। যারা বাইরে থেকে এসে ঝামেলা ইতিমধ্যে পাকাতে শুরু করেছে তাদের মোকাবিলা করার কথা ভাবুন।

চার্লস হাসল, ওঃ, ওই ব্যাপার। বাচ্চাগুলোকে তো আপনার উপদেশমতো ভিলেজ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর কোনও ভয় নেই।

অর্জুন মাথা নাড়ল, তা কী করে বলা যায়। ধরা যাক পল, পলের কোনও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কেউ যদি ভিলেজ সেন্টার থেকে কোনও বাচ্চাকে সরিয়ে নেয়?

ডেরেক অবাক হল, পলের দুর্বলতা?

হ্যাঁ। সবাই জানে মিসেস বেনসনের মেয়ের সঙ্গে পল বন্ধুত্ব করতে চায়। মিসেস বেনসন সেটা চান না। কেউ যদি বলে এব্যাপারে সাহায্য করব, তা হলে পল তার কথা শুনবে। আপনি এই ব্যাপারে কী বলেন চার্লস? হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞেস করল অর্জুন।

চার্লস চমকে তাকাল। অর্জুন দেখল ওর মুখের চেহারা সমস্ত স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে অদ্ভুত বিবর্ণ দেখাচ্ছে। ডেরেক সেটা না লক্ষ করে উষ্ণ গলায় বলল, অর্জুন, আপনি আবার ওই ধরনের কথা বলছেন! পল খুব ভাল ছেলে।

তা হলে পল মিসেস বেনসনের…!

আপনি জানলেন কী করে?

জেনেছি।

কিন্তু গ্রামের কোনও লোক, ধরে নিলাম আপনার সন্দেহ সত্যি হলে, বাইরের লোক পলকে প্রভাবিত করতে পারবে না। গ্রামের লোকই করবে। কিন্তু কেন? কী তার স্বার্থ?

খুব সহজ। টাকার দরকার হতে পারে তার।

নো। আমি বিশ্বাস করি না। আমার গ্রামের মানুষ টাকার জন্যে বিশ্বাসঘাতকতা কখনওই করতে পারে না। আপনি আপনাদের দেখা মানুষদের সঙ্গে দয়া করে মিলিয়ে ফেলবেন না। ডেরেক জোরালো গলায় বলল।

অর্জুন হাসল, চার্লস, আপনি কি ডেরেকের কথা সমর্থন করেন? ধরুন, কেউ এখানে থাকতে চাইছে না। এই জায়গাটা তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তার পূর্বপুরুষ ইংল্যান্ড থেকে এসেছিল। এখন তার মনে হচ্ছে সেই দেশে গেলে সে ভাল থাকবে। কিন্তু যেতে হলে অনেক টাকা চাই। সেই টাকার লোভে একটু যদি অন্যায় করে তাতে এমন কী ক্ষতি! সে তো আর এখানে ফিরে আসবে না।

চার্লসের মুখ তখন প্রায় বুকের ওপর। ডেরেক ঝলল, আমরা যদি ইংল্যান্ডে যেতে চাইতাম তা হলে অনেক বছর আগে ফিরে যেতাম। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর আর এখানে পড়ে থাকতাম না। আপনাকে তো বলেছি পূর্বপুরুষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আর যেখানেই যাই না কেন, ইংল্যান্ডে যাব না।

অর্জুন আর কথা বাড়াল না। ফেরার পথে সে লক্ষ করছিল চার্লস আর একটা কথাও বলছে না। মাঝে-মাঝে আড়চোখে তাকে দেখছে। সে হয়তো ভেবেই পাচ্ছে না তার গোপন পরিকল্পনা, যা এড ছাড়া কেউ জানে না, তা বাইরের লোক জানল কী করে? নিশ্চয়ই ওর মনে হচ্ছে, এড ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এরকম ক্ষেত্রে চার্লস এডকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

হাঁটতে-হাঁটতে অর্জুন ইচ্ছে করেই অন্যদের থেকে ব্যবধান রেখে চার্লসের পাশে চলে এল, চার্লস। ওই জন্তুটার খোঁজে আমি আবার জঙ্গলে আসব। আপনি আমার সঙ্গী হলে ভাল লাগবে। কী, রাজি আছেন?

শুকনো গলায় অস্পষ্ট স্বরে চার্লস বলল, ঠিক আছে।

অর্জুন নিচু গলায় বলল, আর একটা কথা। এড আপনার বন্ধু। উনি আপনার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি। পরশু রাত্রে রাস্তায় উত্তেজিত হয়ে আপনি যখন এডকে আপনার পরিকল্পনার কথা বলছিলেন তখন সেটা আমার কানে এসেছিল। অতএব ভুল করেও এডকে শত্রু ভাববেন না।

হঠাৎ ওরা দেখতে পেল দুজন লোক চিৎকার করতে করতে এদিকে ছুটে আসছে। এটা দেখামাত্র ওরা জোরে পা চালাল। লোক দুটো মুখোমুখি হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় যা বলল তা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ওরা। অনেক বেলা পর্যন্ত সুম থেকে উঠে দরজা না খোলায় মিস্টার জোন্সের নির্দেশে বৃদ্ধ ফোটোগ্রাফারের দরজা ভাঙা হয়। ভেতরে গিয়ে দেখা যায় তিনি মেঝেতে পড়ে আছেন প্রাণ হারিয়ে। ওঁর মাথার পেছনটা কেউ আঘাত করে থেতলে দিয়েছে। ডেরেক কেঁদে উঠল।

বৃদ্ধের বাড়ির সামনে বেশ ভিড়৷ মিস্টার জোন্স, মিস্টার স্মিথ গম্ভীর মুখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ওদের দেখে সবাই রাস্তা করে দিল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ডেডবডি কেউ স্পর্শ করেননি তো?

মিস্টার স্মিথ বললেন, না। ঘরে ঢুকে ওঁকে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আমরা বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এটা খুন, খুন করা হয়েছে ওঁকে।

অর্জুন ভেতরে গেল। সঙ্গে ডেরেক। বৃদ্ধ উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর মাথার পেছনে ক্ষতচিহ্ন। সেখান থেকে রক্ত মেঝেতেও পড়েছে। পরনের পোশাকটাকে গতরাত্রে অর্জুন দেখেছিল। অর্জুন তন্নতন্ন করে খুঁজছিল। কিন্তু আততায়ী কোনও কু রেখে যায়নি। কিন্তু আততায়ী যখন বাইরের দরজা খুলে বের হয়নি তখন গেল কোন পথে? ভেতরের দরজাও বন্ধ। একটা টয়লেট কাম বাথরুম। আর একপাশের দরজা খুলতে বোঝা গেল ওটা বৃদ্ধের ডার্করুম ছিল। সেখানে ঢুকতেই সে ক্যামেরাটিকে দেখতে পেল। এই ক্যামেরা বুকে নিয়ে বৃদ্ধ ঘুরতেন। ক্যামেরাটা খোলা। তাতে কোনও ফিল্ম নেই। অর্জুন দেখল ঘরের জানলাটা বন্ধ। ভার্করুমের কাজ করতে হলে জানলা বন্ধ রাখতেই হয়। কিন্তু কোনও ছিটকিনি বা হুড়কো লাগানো নেই কেন? সামান্য টানতেই সেটা খুলে গেল। আর জানলায় কোনও গ্রিল বা শিক নেই। একজন লোকে অনায়াসেই ওখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। অর্জুন দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে জানলাটার কাছে গেল। নীচের মাটিতে দুটো গভীর দাগ। লাফিয়ে ওপর থেকে পড়লে জুতো কিছুটা বসে যায়। যে লোকটা লাফিয়েছিল তার ডানপাটির জুতোর একটা পাশ বেশি ক্ষয়ে গিয়েছে, সেদিকের গোড়ালিও সমান নেই। তার মানে লোকটা যেদিকে বেশি ভর করে রেখে চলে সেই দিকটার জুতো কিছুটা ক্ষয়ে গেছে। অর্জুন ফিরে এল। মিস্টার জোন্সকে বলল, আপনারা থানায় খবর দিন। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ওঁকে খুন করা হয়েছে।

মিস্টার জোন্স মাথা নাড়লেন। মিস্টার স্মিথের কানে কানে কিছু বললেন। মিস্টার স্মিথ বললেন, দেখুন, আজ পর্যন্ত এখানে কেউ খুন হয়নি। পুলিশের সাহায্য তাই কখনও আমাদের প্রয়োজন হয়নি। এক্ষেত্রে পুলিশকে জানানো কি বাধ্যতামূলক?

নিশ্চয়ই। যে-কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা পুলিশকে না জানানো অপরাধ।

কিন্তু অর্জুন দেখল থানায় খবর দেওয়ার ব্যাপারে গ্রামের মানুষ একমত হতে পারছে না। কেউ-কেউ বলছে, এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আজ পর্যন্ত যখন গ্রামে পুলিশের কোনও প্রয়োজন হয়নি তখন খামোক খবর দিয়ে কী লাভ! পুলিশকে জানালে বৃদ্ধের শরীর আবার উঠে বসবে না। ডেরেক চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, কিন্তু আমার কাকার হত্যাকারীকে ধরতেই হবে। আর সেই লোকটা ধরা পড়লে চূড়ান্ত শান্তি দিতে হবে। এখন পর্যন্ত আমাদের নিয়মে যে শাস্তি দেওয়া হয় তা হত্যাকারীর পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ এধরনের ঘটনা এর আগে ঘটেনি এখানে। আর লোকটা যদি বাইরের লোক হয় তা হলে এখান থেকে চলে গেলে আমরা কিছুই করতে পারব না। সেক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য লাগবেই। এইজন্যেই খবরটা থানায় জানানো দরকার।

কথাগুলোয় যুক্তি আছে, মেনে নিল সবাই। মিস্টার জোন্স দুজনকে তখনই থানায় পাঠালেন। অর্জুনের অস্বস্তি হচ্ছিল। এখানে বাইরের লোক বলতে সে একাই আছে। ডেরেক কি তাকে সন্দেহ করছে। কিন্তু কেন করবে? ওর কাকাকে সে কেন খুন করতে যাবে?

অর্জুন বলল, মিস্টার জোন্স, কাল রাত্রে আমি এবং মিস্টার মুরহেড একসঙ্গে গ্রামে ফিরে এসেছিলাম। তখন এখানে বেশ ভিড় ছিল। সবাই পাহাড়ের আগুন দেখার জন্যে জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের কেউ-কেউ কি এখানে আছেন?

সঙ্গে-সঙ্গে অনেকেই বলে উঠলেন, হ্যাঁ। আমরা ছিলাম।

যাঁরা বললেন তাঁদের একজনকে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, সেই সময় কী ঘটেছিল বলুন তো?

ভদ্রলোক বললেন, আপনারা একসঙ্গে এলেন। আমরা মিস্টার মুরহেডকে আগুনের কথা জিজ্ঞেস করছিলাম। আপনি তখন ভিলেজ সেন্টারে চলে গেলেন। মিস্টার মুরহেড তারপরে প্রায় আধঘণ্টা আমাদের সঙ্গে গল্প করে বাড়িতে চলে গেলেন। বললেন, তখনই ফিল্মগুলো ওয়াশ করবেন।

অর্জুন বলল, আমি ভিলেজ সেন্টারের দরজা অনেক ডাকাডাকির পর খোলাতে পেরেছিলাম। যাঁরা পাহারায় ছিলেন তাঁরা অত রাত্রে নিঃসন্দেহ না হয়ে দরজা খোলেননি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার প্র যা ঘটেছে তা ডেরেক জানে। আর রাত্রে, একবার ভেতরে ঢোকার পর পাহারাদারদের ফাঁকি দিয়ে বের হওয়া যায় না।

মিস্টার জোন্স আপত্তি করলেন, আহা! এসব কথা বলছেন কেন?

অর্জুন বলল, কারণ কেউ সন্দেহের বাইরে নয়। আমার তরফ থেকে যা ঘটেছিল তা আপনাদের জানিয়ে দিলাম। আর মিস্টার মুরহেডের মাথার আঘাত আর শরীরের লক্ষণ দেখে মনে হয়েছে তিনি খুন হয়েছেন ভোরের দিকে। আততায়ী তাঁর সঙ্গেই ঘরে ঢুকেছিল। যেহেতু বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তাই পরে ঢোকা সম্ভব নয়। আততায়ী মিস্টার মুরহেডের পরিচিত ছিল বলে সঙ্গী হতে পেরেছিল, অনুমান করা যেতে পারে। যা হোক, পুলিশ নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি আসবে। আমি আশা করছি আততায়ী পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে না।

কথাগুলো বলে অর্জুন হাঁটতে লাগল ভিলেজ সেন্টারের দিকে।

মিস্টার মুরহেডের মৃত্যুর খবর পেয়ে শুধু শিশু, অসুস্থ আর বৃদ্ধেরা ছাড়া গ্রামের কেউ যে দুপুরে খাচ্ছে না তা অর্জুন জানত না। পল এসে জিজ্ঞেস করল, আ-আ-জ আমি লা-লা-লাঞ্চ বানাইনি, তবে আপনি যদি খেতে চান তো-তো-তো বানিয়ে দিচ্ছি। পলের কথার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট।

লাঞ্চ বানাওনি কেন?

এটা নিয়ম। যদি কেউ মামা-মারা যায়, সবাই উপোস করি।

তা হলে আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?

আপনি বাবা বাইরের লোক। নিয়ম নাও মানতে পারেন।

অর্জুন হেসে মাথা নাড়ল। ডেরেক থেকে পল কেউ তাকে নিজেদের লোক বলে ভাবতে পারছে না। সেটাই স্বাভাবিক। সে বলল, নাঃ। আমারও কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

পল চলে যাচ্ছিল, অর্জুন তাকে ডাকল, পল, এক মিনিট। তুমি কি আমার কথায় দুঃখ পেয়েছ? তা হলে আমি ক্ষমা চাইছি।

পল কোনও জবাব না দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি তোমাকে একটা সম্ভাবনার কথা বলছিলাম। শত্রুরা তো মানুষের দুর্বলতারই সুযোগ নেয়। তুমি ওটা করবে না জেনেও তোমাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলাম।

হঠাৎ পল বলল, সবাই বলছে, আপনাকে এখানে আ-আ-আনা ঠিক হয়নি। আপনি আ-আ-আসার পর এখানে প্রথম খুন হল। কথাগুলো বলে পল চলে গেল। অর্জুনের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। পৃথিবীর সমস্ত সভ্য-অসভ্য মানুষের এক জায়গায় মিল, কুসংস্কার এড়িয়ে থাকতে পারে না।

এখনও সে এখান থেকে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু অমল সোম তাকে কখন ফিরে যেতে হবে, বলেননি। তিনি আসবেন রবিবারে, এটুকুই জানে। অর্জুন এখানে আসার পর যা যা ঘটেছে তার নোট রাখল কাগজে।

এক, পাহাড়ের আগুন জ্বলা প্রাকৃতিক বা ভৌতিক ঘটনা নয়। কিন্তু মানুষ বস্ত্রচালিত যানে চেপে পাহাড়ে এসে আগুন জ্বালায়। কিন্তু কেন?

দুই, সেই প্রাগৈতিহাসিক বস্তুটি, যা গাছের মধ্যে ছিল, সেটাকে কেন ওরা নীচে ফেলে দিয়েছিল?

তিন, নীচে ফেলে দেওয়ার পর সেটার খোঁজে ওরা কেন নেমেছিল? যে ভয়ার্ত ঠিকার সে শুনেছিল সেটা কীজন্য? বস্তুটিকে নড়তে দেখে কি?

চার, বৃদ্ধ ফোটোগ্রাফারের ডার্করুমে যে ঢুকেছিল, সে এখানকার লোক নয়। তা হলে লোকটা আগুনের দিকে আসত না। বৃদ্ধ তাকে অনুসরণ করে এসেও শেষপর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলেন। লোকটা গেল কোথায়?

পাঁচ, বৃদ্ধ মারা গিয়েছেন ছবি তোলার কারণে। ওই ছবিগুলো সরাতে চেয়েছিল কে অথবা কারা?

ছয়, যে আগন্তুকরা বাচ্চা দেখতে এসেছে এবং আসবে, তাদের সঙ্গে এইসব ঘটনার কোনও যোগাযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। এরা কি আলাদা?

দরজায় শব্দ হল। অর্জুন মুখ তুলে বলল, আসুন।

সন্তর্পণে ঘরে ঢুকল চার্লস। মুখচোখে অপরাধী ভাব।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার চার্লস?

আপনি, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। মুখ নিচু করল লোকটা।

আরে বসুন। হ্যাঁ, ওখানেই বসুন। হঠাৎ আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন কেন?

আমার মনে হচ্ছে আপনি সব জানেন। চার্লস মাথা নাড়ল, আমি অনুতপ্ত, দয়া করে এই ব্যাপারটা আর কাউকে বলবেন না। তা হলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।

তার মানে আপনি আর ইংল্যান্ডে যাচ্ছেন না?

না। আমার পূর্বপুরুষরা যা চেয়েছিল আমি তাই করব।

এটা আপনার একটা চাল নয় তো?

ছি ছি। বিশ্বাস করুন। আমি মিথ্যে কথা বলছি না।

তা হলে আমাকে সব কথা খুলে বলুন।

কী কথা?

গতবার যারা এসেছিল, পাকদণ্ডী দিয়ে গিয়ে যাদের সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন সেই কথাগুলো আমাকে বলুন।

কেউ যদি জানতে পারে…।

আপনি সত্যি কথা বললে কেউ জানতে পারবে না।

আমাকে একা দেখে ওরা খুব খুশি হয়েছিল। দোভাষী বলেছিল ওরা একটা বাচ্চাকে চায়। ওদের মহাগুরু দুবছর আগে মারা গিয়েছেন। মারা যাওয়ার আগে বলে গেছেন তিনি পাহাড়ের কোনও গ্রামে জন্মগ্রহণ করবেন। এই দুবছর ধরে ওরা পাহাড়ে পাহাড়ে অনেক খুঁজেছে। ওদের গনকাররা যেদিকের হদিস দিয়েছে সেইমতো ওরা অভিযান চালিয়েছে। হিমালয়ের অনেক জায়গা ওরা হেলিকপ্টারে ঘুরে দেখেছে, গ্লাইডারে উড়ে পরীক্ষা করেছে। শেষপর্যন্ত এখন ওদের ধারণা, মহাগুরু আমাদের গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছেন। যে-কোনও মূল্যে সেই মহাগুরুকে ওরা নিয়ে গিয়ে মাথায় করে রাখবে। ওরাই প্রস্তাব দেয়, যদি আমি ওদের সাহায্য করি তা হলে দুলক্ষ টাকা আমাকে দেবে। আমাকে প্রতিটি দু বছরের শিশুর বর্ণনা তৈরি করতে বলেছে। চার্লস বলল।

কবে দিতে হবে?

আজই।

কোথায়?

যেখানে আমি ওদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, সেখানে। কিন্তু আমি ঠিক করেছি, যাব না। ওদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখব না। চার্লস মাথা নাড়ল।

অর্জুন বলল, না চার্লস। আপনি যাবেন।

সে কী! আপনি আমাকে যেতে বলছেন?

হ্যাঁ। তবে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্যে নয়, লোকগুলোকে বোকা বানাতে।

কীরকম?

আপনি বাচ্চাদের যে তালিকা করবেন তাতে প্রত্যেকের হাবভাব, ভঙ্গি একই রকম লিখবেন। বর্ণনা পড়ে কেউ যেন পার্থক্য না করতে পারে।

চার্লস বলল, ওরা বলেছিল ওই বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে কেউ কম কথা বলে কিনা, গম্ভীর হয়ে থাকে কিনা খুঁজে দেখতে।

অর্জুন বলল, না, কেউ নেই। আপনি কাউকে খুঁজে পাননি।

ঠিক আছে। চার্লস মাথা নাড়ল।

কাল রাত্রে গ্রামের মানুষ যখন আগুন দেখতে জড়ো হয়েছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন? বাইরে বের হননি?

না। আমার মনখারাপ ছিল, কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।

ঠিক আছে। আজ কখন আপনার যাওয়ার কথা?

বিকেল পাঁচটার সময়।

আমি আপনার সঙ্গে যাব।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress