Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হিসেবে ভুল ছিল (১৯৯৭) || Samaresh Majumdar » Page 3

হিসেবে ভুল ছিল (১৯৯৭) || Samaresh Majumdar

এগারোটা বাচ্চা কিছুতেই ঘুমোতে চাইছে না। তাদের মায়েরা খুবই বিব্রত। বড় হলঘরে এগারোটি সুন্দর বিছানা করা হয়েছে। এরই মধ্যে নীচের ঘরে বাচ্চাদের বাবারা পাহারা দিতে চলে এসেছেন পালা করে। বাড়িতে ঢোকার সময় তর অর্জুনকে যাচাই করে দরজা খুলেছেন। নিজের ঘরে ঢোকার সময় অর্জুন শুনতে পেল, হলঘর থেকে গান ভেসে আসছে। কোনও এক মা ইংরেজিতে ঘুমপাড়ানি গান গাইছেন। পৃথিবীর সমস্ত শিশুদের জন্যে তাদের মায়েরা মোটামুটি একই সুরে গান গেয়ে থাকেন।

ডিনার নিয়ে এল পল। ভাবগতিক দেখে মনে হল, সে খুবই ব্যস্ত। বলল, আজকালকার বাবা বাচ্চারা ঘুমোতে চা-চা-চায় না কেন বলো তো?

অর্জুন খাওয়া শুরু করল, আমি জানি না।

পল চলে যাচ্ছিল, অর্জুন তাকে ডাকল, তোমার কি খুব জরুরি কাজ আছে?

তা নেই, তবে, মিসেস বেনসনের মেয়ে এ-এ-এলি তো এসব কাজ কখনও করেনি।

ওহো, এলি বুঝি তোমাকে সাহায্য করছে?

হ্যাঁ। কি-কি-কিন্তু তুমি কি ওকে চেনো?

একটুও না। তবে তুমি যে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাও এবং মিসেস বেনসন সেটা পছন্দ করেন না, তা জানি। কী, ঠিক তো?

পল অবাক হয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আচ্ছা পল, কেউ যদি তোমাকে প্রস্তাব দেয় ওই বন্ধুত্বটা করিয়ে দেবে কিন্তু তার বদলে ও যা বলবে তাই করতে হবে, তা হলে তুমি কি রাজি হবে?

কী করতে হবে?

এই ধরো, মাঝরাত্রে ভিলেজ সেন্টারে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, অথবা এগারোটা বাচ্চার একটাকে গোপনে বের করে তার হাতে তুলে দিতে হবে।

নো। নেভার। প্রায় চিৎকার করে উঠল পল, যে এই কথা বলতে আসবে তা-তা-তাকে মেরে ফেলব আমি।

অর্জুন বলল, শুনে খুব খুশি হলাম পল। ভোমার খুব ভাল হবে।

পল দাঁড়াল না। ঝড়ের মতো চলে গেল ঘর ছেড়ে।

আজকের রাতের আকাশ পরিষ্কার। ফলে ঠাণ্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে। রাতের খাওয়া শেষ করে নীচে নেমে এল অর্জুন। চারটে চেয়ারে চারজন পুরুষ বসে গল্প করছিল। বাচ্চাদের বাবারা পালা করে পাহারা দিচ্ছেন, এঁরা প্রথম দল। অৰ্জুনকে দেখামাত্র চারজন উঠে দাঁড়ালেন।

অর্জুন বলল, আমি আপনাদের কয়েকদিন কষ্ট দিচ্ছি বলে দুঃখিত।

ওঁরা মাথা নেড়ে না বলে হাসলেন। অর্জুন ওঁদের অনুমতি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

আজ সত্যি ছবির মতো দেখাচ্ছে গ্রামটাকে। রাস্তায় অবশ্য লোকজন নেই। হয়তো আগন্তুকদের কারণে যে ভীতি ছড়িয়েছে তা বড়দেরও আক্রমণ করেছে। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে আজ। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল অর্জুন। হাঁটতে-হাঁটতে অনেকটা আসার পর সে বাড়িটাকে চিনতে পারল। ডেরেকের কাকার বাড়ি। বাড়িটা এখন অন্ধকার। বৃদ্ধ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু ওঁর তোলা ছবির বাক্স থেকে নেগেটিভ এবং বিশেষ একটা ছবি চুরি গেল কী করে?

অর্জুন দাঁড়াল না। হাঁটতে-হাঁটতে সে পাহাড়ে উঠতে লাগল। চাঁদের আলো থাকায় পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সে পোড়া জায়গাটায় পৌঁছে গেল। একটু খুঁজতেই সেই পাথরটা পেয়ে গেল, যার গায়ে ঘষটানো দাগ আর কাদার চিহ্ন রয়েছে৷ দাগটা গিয়েছে ওপর থেকে নিচু পর্যন্ত। অর্থাৎ কোনও ভারী বস্তু ওই পাথরে ধাক্কা খেয়ে নীচে পড়েছে অথবা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু নীচে গভীর খাদ এবং জঙ্গল। অর্জুন খানিকটা নেমে দেখল গাছ থেকে উঠে আসা একটা বড় গাছের ডাল ভেঙে ঝুলছে। অর্থাৎ ভারী বস্তুটি ওখান দিয়েই নীচে পড়েছে।

এখন এই রাত্রে নীচে নামা অসম্ভব! এই জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী নিশ্চয়ই রয়েছে। তা ছাড়া নামার রাস্তা করে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। কিন্তু ছবিতে যেটাকে বিশাল ডিমের মতো মনে হচ্ছিল এবং যেটি অদৃশ্য হয়েছে সেটি যদি ওই ভারী বস্তু হয় তা হলে কে সেটাকে সরাল? তার কী স্বার্থ! ঘষটানোর দাগটা দেখে বোঝা যায় প্রচুর শক্তি না থাকলে ওই বস্তুটিকে গাছ থেকে তুলে নিয়ে এসে ওখান দিয়ে ফেলা যেত না।

হঠাৎ অর্জুনের মনে পড়ল ঘড়িটার কথা। আসার আগে অমলদা এটার ক্রিয়াকর্ম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সে ঘড়ির ঢাকনাটাকে খুলে বোতাম টিপতেই সরু টর্চের আলোর মতো একটা উজ্জ্বল রেখা বেরিয়ে এল। খাদের দিকে সেটা ধরতে রেখাটা নীচে নেমে যেতে লাগল। যত নামছে তত স্পষ্ট হচ্ছে জায়গাটা। যেসব গাছের ডালপাতা ওর যাওয়ার পথে পড়ছিল সেগুলো মুহুর্তেই শুকনো হয়ে সরে যাচ্ছিল দুপাশে। ওই আলোর রেখা পাথর অথবা মাটি ছাড়া যে-কোনও শক্ত বস্তুকে ভেদ করতে সক্ষম। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অর্জুন রেখাটাকে নিয়ে যেতে পারল সেই ডিমের আকারের বস্তুটির গায়ে। স্পর্শ লাগতেই মনে হল শক্ত বস্তুটির একাংশে চিড় ধরল। আর তখনই মাথার ওপরে গুম-গুম শব্দ বাজল। অর্জুন দ্রুত চাবি ঘুরিয়ে আলোর রেখা নিভিয়ে দিয়ে পাহাড়ের খাঁজে সরে এল। আর এই তাড়াহুড়োতে ঘড়ির ঢাকনাটা বন্ধ করতে ভুলে গেল সে।

আওয়াজটা যে কোনও যন্ত্রের, তা বোঝা যাচ্ছে। একসময় আওয়াজটা থেমে গেল। এই গভীর জঙ্গলে ডেরেকদের গ্রাম থেকে কেউ এত রাত্রে নিশ্চয়ই কোনও স্ত্র নিয়ে বেড়াতে আসবে না। আর তখনই চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। কাছাকাছি কোথাও আগুন জ্বলছে। পুড়ে যাচ্ছে গাছপালা। শব্দ হচ্ছে পোড়ার। হঠাৎই অর্জুন ওদের দেখতে পেল। তরতর করে নেমে আসছে চারটে মূর্তি। আকৃতি বেশ ছোট। এখন আগুনের কল্যাণে চারপাশ দিনের মতো স্পষ্ট কিন্তু তা সত্ত্বেও ওদের মুখ-চোখ ভাল করে দেখতে পেল না সে। অতি দ্রুত ওরা নেমে গেল খাদের মধ্যে। যেন ওই পথ ওদের খুব চেনা।

অর্জুন একবার ভাবল ওদের অনুসরণ করবে। কিন্তু সেটা একটু দুঃসাহসিক হয়ে যাবে। বরং অপেক্ষা করাই ভাল। ওদের উঠে আসতে হবে এই পথ দিয়ে। তারপরই মনে হল ওপরে গিয়ে দেখলে কেমন হয়? এই লোকগুলোর আসার সঙ্গে শব্দটার যোগাযোগ আছে। অর্জুন সন্তর্পণে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে সে আগুনের শিখা দেখতে পেল। হু-হু করে জ্বলছে জঙ্গল। ডেরেকরা ওদের গ্রাম থেকে এই আগুন দেখতে পায়। আর একটু এগোলে নিজেকে আড়াল করার কোনও সুযোগ থাকবে না। চারজন নীচে গিয়েছে, ওপরে কতজন রয়েছে কে জানে। এবং ওরা নিছক চড়ুইভাতি করতে রাতদুপুরে এখানে আসেনি।

হঠাৎ নীচে একটা চিৎকার শোনা গেল। অর্জুন দ্রুত সরতে যেতেই তার পা পিছলে গেল। সরসর করে অনেকটা নীচে ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল তার শরীরটা। পড়ার সময় কাঁটাজাতীয় কিছু ফুটে গেল হাতে, কাঁধে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সত্ত্বেও সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে পড়ে রইল। তার পড়ার সময় শব্দ হয়েছে। অবশ্য আগুনে গাছ পোড়ার আওয়াজ ছাপিয়ে সেই শব্দ কারও কানে গিয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

হঠাৎ সেই শব্দটা বাজল। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেটা। অর্জুন মাথা তুলল। শরীরটাকে সোজা করা যাবে না। পায়ের সামান্য চাপেই নুড়ি গড়িয়ে পড়ছে। সে একটু বাঁ দিক ঘেঁষে ওপরে উঠতে যেতেই পায়ের তলার পাঁথর সরে গেল। সরসরিয়ে নেমে যাচ্ছিল সে। প্রচণ্ড আঘাত লাগছে পাথরে। শেষপর্যন্ত দু হাতে একটা পাথর আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলাতে পারল সে।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওপরদিকে তাকিয়ে মনে হল আগুন অনেক কম এখন। অথবা যেখানে আগুন জ্বলছিল সেখান থেকে অনেক নীচে নেমে এসেছে সে। সমস্ত শরীর জ্বলছে। রক্ত বেরিয়ে গেছে কোথাও কোথাও। সে ঘড়িটার দিকে তাকাল। ঢাকনাটা নেই। এটা কী করে হল? ঢাকনাটা বন্ধ থাকলে সেটা না ভাঙার কথা। তা হলে কি কোনও কারণে ওটা খুলে গিয়েছিল? ও বোতামটা টিপল। সঙ্গে সঙ্গে আলোর রেখা বেরিয়ে এল। না, এখনও এটা ঠিক রয়েছে। হাত থেকে খুলে ঘড়িটাকে পকেটে রাখল অর্জুন।

এখন মনে হচ্ছে, তখন ওই আড়াল থেকে না বেরিয়ে এলেই ভাল হত। এই দুর্ঘটনায় সে না পারল লোকগুলোকে দেখতে, না ওই আওয়াজটা কীসের তা বুঝতে। এখন ওপরে উঠতে হবে। হঠাৎ খেয়াল হল লোকগুলো খাদে নেমেছিল। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে খাদের নীচটা বেশি দূরে নয়।

ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগল অর্জুন। গাছের ঘন ছায়ায় ঝোপঝাড় ক্রমশ অন্ধকার টেনে আনছিল। অর্জুন পকেট থেকে ঘড়িটা বের করল। মাটির দিকে সেটার মুখ করে সুইচ টিপতেই আলোর রেখা বের হল। কিন্তু যেখানেই আলো পড়ছে সেই জায়গাটা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে টুকরো-টুকরো হয়ে। এতে অবশ্য যথেষ্ট আলো পাওয়া যাচ্ছে নীচের দিকে যাওয়ার জন্যে। হঠাৎ কিছু একটু শব্দ করতেই অর্জুনের হাত সেদিকে ঘুরল। একটা মোটা কালো সাপ ফণা তুলতেই আলোর রেখা ওর শরীরে পড়ল। অর্জুন অবাক হয়ে দেখল সাপটা গলে মাটিতে পড়ে গেল নিঃসাড়ে।

অনেকটা নামার পর মাটি যখন প্রায় সমতল তখন অর্জুন চারপাশে খুঁজল। সেই ডিম্বাকৃতি বস্তুটি কোথায় পড়েছে তা হাজার খুঁজেও বের করতে পারত না সে এই ঘন জঙ্গলের অন্ধকারে। যদি অমল সোম এই ঘড়িটা না দিতেন? এগোতে এগোতে একসময় সে দাঁড়িয়ে গেল। বস্তুটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। আলোর রেখা সচেতনভাবে বস্তুটির ওপর না ফেলে সে কাছে পৌঁছে গেল কোনওমতে। গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল।

ডিম্বাকৃতি বলে যাকে মনে হয়েছিল ছবি দেখে, সামনাসামনি অর্জুন বুঝতে পারল অমল সোমের ভুল হয়নি। কিন্তু এ কেমন ডিম? এত বড় এবং এত শক্ত খোলস? বস্তুটির একপাশে চিড় ধরছে। সম্ভবত তার ভেতর দিয়ে ভেতরে হাওয়া ঢুকছে। সেই হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে ভেতরে ঘুমন্ত কিছু এখন নড়তে শুরু করেছে। এটা বোঝা যাচ্ছে বস্তুটি এক জায়গায় স্থির হয়ে নেই বলে। ওর ভেতরে একটা কিছু মোচড় না দিলে এভাবে নড়তে পারে না। অর্জুন অনেক চেষ্টা করেও ভেতরটা দেখতে পেল না।

লোকগুলো কি এখানে এসে এই নড়াচড়া দেখে ভয়ে চিৎকার করেছিল? ওর খুব লোভ হচ্ছিল বস্তুটির ওপর আলোর ব্রেখটাকে রাখতে। একটু বেশি সময় রাখলে হয়তো ওর শক্ত খোলস ফেটে যাবে এবং ভেতরে কী আছে তা দেখা যাবে। কিন্তু উলটোটা যদি হয়? যদি বস্তুটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়? তা হলে ভেতরে যা আছে তা রক্ষা পাবে না।

অর্জুন ঠিক করল, কোনও ঝুঁকি নেবে না। হয়তো কোনও বিস্ময়কর প্রাণী জ্বণ অবস্থায় রয়েছে এই বিশাল ডিম্বাকৃতি বস্তুতে। বরং কাল সকালে গ্রাম থেকে ডেরেকদের নিয়ে এখানে চলে আসবে। চেষ্টাচরিত্র করে এটাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যে, চব্বিশ ঘণ্টা নজরে রাখা যায়।

চারপাশে মোটামুটি নজর বুলিয়ে জায়গাটাকে বুঝে নিয়ে সে আবার ওপরে উঠতে লাগল। সমস্ত শরীরে ব্যথা; কেটে যাওয়া শরীরে তীব্র জ্বলুনি। ওপরে উঠতে কাহিল হয়ে পড়ছিল সে। তারপর একসময় আগুনের আঁচ দেখতে পেয়ে বুকে উৎসাহ এল। সে পৌঁছে গিয়েছে।

অর্জুন যখন ওপরে এসে গেল, আগুন অনেক কমে এসেছে। হঠাৎ তার কানে একটা আলতো শব্দ বাজতেই সে মুখ ফিরিয়ে উৎসটা খুঁজতে চেষ্টা করল। এবং তখনই ডেরেকের কাকাকে দেখতে পেল।

ভদ্রলোক ছবি তুলছেন। ওঁর মুখ-চোখে উত্তেজনা, পরপর ছবি তুলতে-তুলতে হঠাৎ থেমে গেলেন। বিস্মিত হয়ে ক্যামেরাটা দেখলেন। রাগ এবং পরে আফসোস ছড়িয়ে পড়ল মুখে। অর্জুন বুঝতে পারল ভদ্রলোকের ক্যামেরার ফিল্ম শেষ হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু আগুন জ্বলার সময় ডেরেকদের গ্রামের লোক এখানে আসে না। অবশ্যই একটা না-জানা-আতঙ্ক ওদের দূরে সরিয়ে রাখে। পরদিন, আলো নিভে গেলে কেউ-কেউ এসে উঁকিঝুঁকি মেরে যায়। এই বৃদ্ধ যেমন ছবি তুলেছিলেন। তা হলে ইনি এই সময় কী করে চলে এলেন? অর্জুন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।

বৃদ্ধ অনামনস্ক ছিলেন, হঠাৎ অর্জুনকে দেখে ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আগুনের ছবি তুললেন?

অ্যাঁ। ও, হ্যাঁ। কিন্তু আর ফিল্ম নেই। উঃ, কী দারুণ দৃশ্য, ওই ছবিটা তোলা হল না। বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে দেখালেন। একটা গাছের ডাল আগুনসমেত নীচে ঝরে পড়ল।

আপনি একা-একাই চলে এলেন?

অ্যাঁ। না তো। বৃদ্ধ চারপাশে তাকালেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি বললেন, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মনে হল কেউ যেন আমার ডার্করুমে ঢুকে কিছু করছে। ওখানে আমি কাউকে যেতে দিই না। বিছানা থেকে উঠে ক্যামেরাটা নিয়ে এগোতেই একজনকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। বাড়ির পেছনের দরজা খুলে। লোকটাকে দেখব বলে ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎই এই আগুন চোখে পড়ল। মনে হচ্ছিল লোকটাও এইদিকে আসছে। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সে। বৃদ্ধ চারপাশে আবার খুঁজতে লাগলেন।

আপনি কি এখন গ্রামে ফিরে যাবেন?

অ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। এখানে থেকে আর কী হবে? ছবি না তুলতে পারার হতাশা ওঁর গলায় স্পষ্ট। ওরা ধীরে ধীরে নেমে আসতে-আসতে দেখল আগুন নিভে আসছে।

গ্রামের কাছে এসে ওরা দৃশ্যটা দেখতে পেল। প্রচুর লোক জড়ো হয়ে গেছে রাস্তায়। কিন্তু কেউ কথা বলছে না। সবাই তাকিয়ে আছে পাহাড়ের দিকে, যেখানে একটু আগে আগুন জ্বলছিল। হঠাৎ কেউ ওদের দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে জনতা সরে এল তাদের দিকে। মূলত বৃদ্ধকেই প্রশ্ন করতে লাগল তারা। কোন সাহসে বৃদ্ধ ওই আগুনের কাছে গিয়েছিল? ছবি তোলার নেশায় নির্ঘাত একদিন মারা পড়বেন তিনি। কেউ-কেউ প্রশ্ন করতে লাগল, সেখানে গিয়ে কী দেখেছেন? ভৌতিক কিছু নজরে পড়েছে কিনা।

বৃদ্ধ উত্তেজিত হয়ে ওদের বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন ফিল্ম শেষ হয়ে যাওয়ায় কী মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ওরা শুনতে চাইছে ভৌতিক দৃশ্যের বর্ণনা, ফিল্ম সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই। অর্জুন চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে এল ভিলেজ সেন্টারে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বিস্তর শব্দ এবং ডাকাডাকি করার পর পাহারাদাররা দরজা খুলল। একজন আতঙ্কিত গলায় বলল, ওঃ, আপনি! পাহাড়ে আবার আগুন জ্বলেছে। আপনার জন্যে খুব চিন্তা হচ্ছিল। ভুল করে ওদিকে যাননি তো?

কেন?

হয়তো, হয়তো। লোকটার কথা বন্ধ হয়ে গেল।

আমি তো বেঁচেই আছি। অর্জুন হাসল।

না। মানে, শুনেছি, ঘোস্ট মানুষের শরীরে ঢুকে চুপচাপ চলে আসে।

অর্জুন কথা না বাড়িয়ে দোতলার ঘরের দিকে এগোল। কুসংস্কার বড় মারাত্মক জিনিস। বাইরের পৃথিবীতেও সেটা যেমন প্রবল, এখানে, এই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষেরাও তা থেকে মুক্ত নয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress