Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হারানো প্রাপ্তি || Sujan Dasgupta

হারানো প্রাপ্তি || Sujan Dasgupta

।।১।।

ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলাম একেনবাবুর উৎসাহে। উনি স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম কখনো দেখেননি। আমার আর প্রমথর অবশ্য ওটা আগেই দেখা, তাও একেনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানিতে উত্যক্ত হয়ে দু-দিন ওয়াশিংটন ডিসি-তে কাটিয়ে রবিবার বিকেলের ট্রেনে ফিরছি। এই ট্রেনটা ধরে অনেকেই উইক-এন্ডের শেষে নিউ ইয়র্কে ফেরে। তাই কামরাটা মোটামুটি ভরতি। যেখানে বসেছি সেখানে দুটো সিট মুখোমুখি। এক দিকে একেনবাবু একা বসেছেন, উলটো দিকের সিট দুটোতে আমি আর প্রমথ।

ফিলাডেলফিয়া স্টেশনে এক ভদ্রলোক উঠে একেনবাবুর পাশে এসে বসলেন। লম্বা সুগঠিত চেহারা চোখে চশমা, চুলে একটু একটু পাক ধরেছে। বয়স মনে হল ষাটের কোঠায়। আমাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ‘হ্যালো’ বললেন। আমরা এতক্ষণ বাংলায় বকবক করছিলাম। উনি আসায় তাতে একটু ছেদ পড়ল। সেটা আঁচ করে উনি বললেন, “আপনারা স্বচ্ছন্দে নিজের ভাষায় কথা বলুন, আই ডোন্ট মাইন্ড।”

এটা শোনার পর ওঁকে উপেক্ষা করে আড্ডা মারা যায় না।

ভদ্রলোকের নাম টিম ভ্যান্ডারউইলেন। একেনবাবু অ্যাজ ইউজুয়াল ওঁর প্রশ্নবাণ শুরু করলেন।

“‘ভ্যান্ডার’ দিয়ে অনেক পদবি শুনি স্যার- ভ্যান্ডারপোল, ভ্যান্ডারওয়াল, ভ্যান্ডারউইক— এগুলোর কি কোনো অর্থ আছে?”

“এগুলো ডাচ পদবি, “ ভদ্রলোক উত্তর দিলেন। ““ভ্যান্ডার’ শব্দটার অর্থ ‘অফ দ্য’, আর ‘উইলেন’ একটা জায়গার নাম। তার মানে আমার পদবির অর্থ, উইলেন-এর, অর্থাৎ পুরো নামের অর্থ উইলেন-এর টিম।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। তার মানে আপনার পূর্বপুরুষ এসেছেন উইলেন থেকে।”

“সম্ভবত। কিন্তু ‘উইলেন’-এর আরেকটা অর্থ হুইল।”

“তাই নাকি! তাহলে আপনার পূর্বপুরুষরা হয়তো চাকা বানাতেন।”

“সবই সম্ভব। খোঁজ করিনি।”

একেনবাবু পা নাচাতে নাচাতে বললেন, “আপনার পূর্বপুরুষেরা ইংল্যান্ডের লোক হলে কিন্তু আপনার নাম হত হুইলার।”

“তা হত,” ভদ্রলোক মনে হল একেনবাবুর কথায় বেশ অ্যামিউজড। সকৌতুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তারা ইন্ডিয়ার লোক হলে কী হত? ধরে নিচ্ছি আপনারা ইন্ডিয়ান।”

“ইয়েস স্যার,” বলে একেনবাবু মুখ ঘুরিয়ে বাংলায় আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “পদবিটা কী হবে স্যার?”

“এত ফালতু প্ৰসঙ্গ তোলেন কেন?” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল।

আমি একেনবাবুকে উদ্ধার করার জন্যে বললাম, “মাটির চাকা হলে ‘কুম্ভকার’। ‘চাকাওয়ালা’ বলে দিন না, ইউনিভার্সাল উত্তর।”

‘কুম্ভকার’ পদবিটা ভদ্রলোকের বেশ পছন্দ হল, ধীরে ধীরে কয়েক বার উচ্চারণ করলেন ‘কুম্-ভো-ক্কার।’

“নাহ, ভ্যান্ডারউইলেন-এর থেকে এতে অনেক বেশি ঝংকার।”

পরিচয় পর্বটা আরও এগোল। ভ্যান্ডারউইলেন সাহেবের কর্মজীবন কেটেছে ব্যাঙ্কিং আর ফাইনান্স সেক্টরে। কিছুদিন হল রিটায়ার করেছেন। এখন থাকেন নিউ জার্সির ট্রেন্টন শহরে। আমি আর প্রমথ নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত শুনে বললেন, “হোয়াট এ কো-ইন্সিডেন্স, আমিও এককালে ওখানে পড়াশুনো করেছি।”

একেনবাবুর পরিচয়টা প্রমথ ঠাট্টাচ্ছলে একটু ফলাও করে দিল।

“মাই গড, আমেরিকায় যে কোনো ইন্ডিয়ান গোয়েন্দা আছে সেটা তো জানতাম না।”

“অফিশিয়ালি অবশ্য এখানে গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে আসেননি,” প্রমথ বলল, “এসেছেন ক্রিমিনোলজি নিয়ে রিসার্চ করতে। ‘

“আই সি। তার মানে আন-অফিশিয়ালি মাঝেমধ্যে গোয়েন্দাগিরি করেন?”

“এঁরা সবাই করেন স্যার, এঁরা ছাড়া আমি অচল।” একেনবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন।

“হাউ ফ্যাসিনেটিং, “ ভ্যান্ডারউইলেন সাহেব ওঁর হাতে ধরা একটা বই দেখিয়ে বললেন, “ভেবেছিলাম বইটা পড়ব, কিন্তু এই সুযোগ ছাড়া যায় না।”

তার মানে? আমরা সবাই অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে আছি।

“আপনাদের একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলব। আমার নয়, আমার এক কলিগের জীবনে সেটা ঘটেছিল। শুধু ঘটনা না বলে বলা উচিত রহস্যজনক ঘটনা। আপনারা হয়তো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন।”

“পারব কি না জানি না স্যার, তবে শুনতে রাজি।”

“থ্যাংক ইউ,” বলে ভদ্রলোক শুরু করলেন।

॥২॥

আমার এই বন্ধুর নাম রবার্ট ব্রাউন, সেও আমার মতো একটা ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়েছিল। প্রথম চাকরি টেক্সাস-এর একটা ছোটো শহরে, নতুন ব্রাঞ্চ অফিসের ম্যানেজার। অফিস বলতে একটা ঘর। দরজা খুললেই সামনে কয়েক জন দাঁড়াবার মতো ছোট্ট একটা জায়গা, তারপর একটা কাউন্টার, যার পেছনে দু-জন টেলারের বসার জায়গা। কাউন্টারের পাশ দিয়ে একটু ঢুকলেই পার্টিশন দিয়ে ঘেরা ম্যানেজারের বসার জায়গা। অন্যদিকে একটা লকার ফেসিলিটি। শহরটা বাস্তবিকই ছোটো দুটো মাত্র ব্যাঙ্ক। একটা ব্যাঙ্ক বহু বছর ধরে চলছে, রবার্টের কাজ সেখান থেকে খদ্দের ভাগিয়ে আনা, আর শহরে নতুন যারা থাকতে এসেছে, তাদের খদ্দের বানানো। কাজটা মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবে তত নয়। খামোখা একটা নতুন ব্যাঙ্কে লোকে অ্যাকাউন্ট খুলবে কেন? তাই অ্যাকাউন্ট খুললেই টেবিল ক্লক, ইলেকট্রিক আয়রন—এইরকম হাবিজাবি নানান জিনিস দেওয়া হবে বলে লোকাল নিউজ পেপারে বেশ কয়েক বার বিজ্ঞাপন দিয়ে পয়লা জুন ব্যাঙ্কের উদ্বোধন হল। প্রথম যিনি অ্যাকাউন্ট খুলতে ব্যাঙ্কে এলেন তাঁর বয়স বছর তিরিশেক। কালো চুল, গালের নীচে ঠোঁটের বাঁ-পাশে একটা বড়ো আঁচিল। সুন্দরী হয়তো তাঁকে বলা যাবে না, কিন্তু হাঁটাচলার মধ্যে একটা কিছু আছে যেটা মনে দাগ কাটে। রবার্টের কাজ অ্যাকাউন্ট খোলানো। মহিলাটি যখন সামনে বসে ফর্ম ভরতি করছেন, রবার্টের চোখ বার বার পড়ছে ওঁর আঁচিলটার দিকে। এই আঁচিলটাই ওঁর মুখটাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মহিলাটি হাজার ডলারের একটা চেক জমা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুললেন, কিন্তু কোনো উপহার নিলেন না। বললেন, “ওগুলো লাগবে না, আমার আছে।”

রবার্ট অনুরোধ করলেন, “রেখে দিন না, পরে হয়তো কাজে লাগবে।” কিন্তু উনি অনড়। শান্তভাবে বললেন, “অন্য কাউকে দেবেন, আপনাদের

তো এখন কাস্টমারের দরকার।”

প্রথম দিন এইটুকুই কথাবার্তা হল।

প্রথম মাসে গ্রাহক সংখ্যা জনা কুড়ির বেশি হল না। সংখ্যায় অল্প বলে প্রত্যেকটি মুখই রবার্টের চেনা হয়ে গেল। জুলাই মাসের এক তারিখে আবার সেই মহিলা এলেন। এবার আর রবার্টের কাছে নয়, সোজা কাউন্টারে গিয়ে চেক জমা দিলেন। জমা দিয়ে চলে যাবার পথে রবার্টের সঙ্গে চোখাচোখি হতে একটু হাসলেন। রবার্ট একজন নতুন কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ইচ্ছে থাকলেও কথা বলতে পারল না। শুধু বলল, “নাইস টু সি ইউ এগেইন।”

“সেইম হিয়ার,” বলে মহিলাটি চলে গেলেন।

এইরকম করে প্রায় মাস আটেক গেল।

প্রত্যেক মাসে পয়লা তারিখে উনি আসেন। রবার্ট অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে দুয়েকটা মামুলি কথাবার্তা হয়। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সরি, ওঁর নামটা বলতে ভুলে গেছি— জুডি স্মিথ। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলে ওঁর অ্যাকাউন্টের সব খবরই রবার্টের জানা। উনি প্রতি মাসে এক হাজার ডলারের একটা চেক জমা দেন। চেকটা আসে ইন্ডিয়ানা শহরের একটা ব্যাঙ্ক থেকে। অ্যাকাউন্ট থেকে শ-তিনেক ডলার প্রতি মাসে জুডি তোলেন। টাকার এই অঙ্কটা এখন আপনাদের কাছে মনে হবে খুবই অল্প, কিন্তু আমি বলছি উনিশশো আটষট্টি সলের কথা। তখন টেক্সাসে শ-তিনেক ডলারে সচ্ছন্দে মাস চলে যেত।

এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। জানুয়ারি মাসের এক তারিখে জুডি এসে ওঁর নিয়মিত চেক ছাড়া আরও দশ হাজার ডলারের একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফট জমা দিলেন। তারপর ফেব্রুয়ারি মাসে ওঁর দেখা নেই। এক তারিখ গেল, দু-তারিখ গেল তিন তারিখ চলে গেল। রবার্ট চঞ্চল হয়ে উঠল। যদিও একজন কাস্টমার টাকা জমা দিতে আসছে কি আসছে না- তার জন্যে রবার্টের এরকম ব্যস্ত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ওঁর এই না-আসাটা রবার্টকে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ফেলল। ফেব্রুয়ারির পাঁচ তারিখ, দিনটা রবার্টের মনে আছে, সেটা ছিল সোমবার। ভিয়েতনামে ‘খে শান’-এর যুদ্ধ সে-দিনই শুরু হয়। বিকেল বেলা ব্যাঙ্ক বন্ধ হবার পর রবার্ট খুঁজে খুঁজে জুড়ির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল। ঠিকানাটা জানা ছিল, কিন্তু শহরের এই দিকটাতে রবার্ট আগে আসেনি। বাড়িগুলো বেশ পুরোনো। জুডির বাড়িটা এক তলা ছোট্ট একটা বাড়ি। বাইরের দরজায় বেল বাজাতেই মাঝবয়সি এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। রবার্ট জুডির খোঁজ করতেই রুক্ষ স্বরে বললেন, “ও নামে কেউ এখানে থাকে না।” বলেই দড়াম করে মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দিলেন!

রবার্ট হতবাক। একটু আগেই ও ভালো করে জুডি স্মিথ-এর ঠিকানা দেখে ডায়েরিতে লিখে এনেছে। বাড়ির দরজার ওপরে নম্বর লেখা, সেখানে কোনো ভুল নেই। কিন্তু যিনি দরজা খুললেন তিনি যদি বলেন, জুডি এখানে থাকে না, তাহলে তো মানতেই হবে।

রবার্ট গাড়ি ঘুরিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে রওনা দিতেই দেখে জুডি সামনে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। রবার্ট জুডির সামনে এসে গাড়ি থামাতেই জুডি ওর দিকে খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী চান?”

রবার্ট বলল, “আমি আপনার খোঁজেই এখানে এসেছিলাম।

“আমার খোঁজে!” জুডি বিস্মিত হয়ে রবার্টের দিকে তাকালেন।

রবার্ট একটু লজ্জিত হয়ে বলল, “আসলে আপনি প্রতি বার ব্যাঙ্কে চেক জমা দেন এক তারিখে, আপনাকে না দেখে ভাবলাম কিছু হয়েছে কিনা!”

জুডি আরও বিস্মিত। “আমি চেক জমা দিতে যাই!”

এবার রবার্টের অবাক হবার পালা। “আপনি যান না? গত মাসেও আপনি দশ হাজার ডলারের ব্যাঙ্ক ড্রাফট জমা দিলেন!”

“না, আপনি ভুল করছেন।”

তখন রবার্টের এই ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাব্য কারণ মাথায় এল- যাঁর সঙ্গে ও কথা বলছে তিনি হয়তো জুডি-র যমজ বোন। কিন্তু মুখের আঁচিলটাতেও মিল! যাইহোক, রবার্ট বলল, “আই অ্যাম ট্রলি সরি। মনে হচ্ছে আপনার বোনের সঙ্গে আপনাকে গুলিয়ে ফেলছি।”

“আমার কোনো বোন নেই।” মহিলা শান্তস্বরে বললেন।

ইতিমধ্যে একজন মহিলা যিনি একটু দূরে কুকুর নিয়ে হাঁটছিলেন, তিনি জুডির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

বলার তো কিছুই নেই। ক্ষমা-টমা চেয়ে রবার্ট চলে এল।

।।৩।।

বাড়ি ফিরে রবার্ট জ্যাককে ফোন করল। জ্যাক পোস্ট অফিসে কাজ করে। চিঠি বিলি করে বলে প্রায় সবার ঠিকানাই জানে। কয়েক মাস হল রবার্টের সঙ্গে ওর ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। -জুডি স্মিথ কোথায় থাকে তার উত্তর জ্যাক দিতে পারল না। রবার্ট ওকে জুডি স্মিথ-এর ঠিকানাটা বলাতে বলল, ওটা মারিয়া টমাসের বাড়ি। তবে কিছুদিন হল স্টেলা ব্লুম বলে একজন ওখানে পেয়িং গেস্ট হিসেবে রয়েছে। রবার্ট তখন জ্যাককে জিজ্ঞেস করল, প্রতি মাসে জুডির কাছে যে ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট পাঠানো হয় সেটা তাহলে যায় কোথায়? সেই মুহূর্তে জ্যাক কোনো উত্তর দিতে পারল না। পরের দিন অফিস থেকে খোঁজ নিয়ে বলল, ওদের হেড পোস্ট অফিসে জুডি স্মিথের নির্দেশ রয়েছে মারিয়া টমাসের ঠিকানায় জুড়ির নামে কোনো চিঠি এলে, সেটা শিকাগো-র একটা ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবার।

“কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব যদি জুডি স্মিথ কোনোদিন মরিয়া টমাসের বাড়িতে না থেকে থাকে?”

জ্যাকের উত্তর, “নিশ্চয় একসময় জুডি স্মিথ ওই ঠিকানায় ছিল, কিন্তু এই ফরোয়ার্ড করার ইনস্ট্রাকশনটা পার্মানেন্ট— প্রায় আট মাস আগে দেওয়া হয়েছে।”

অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে!

সেদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ হবার একটু পরেই জুডি স্মিথ এসে হাজির! টেলার দু-জন ইতিমধ্যে বাড়ি চলে গেছে, রবার্ট একা বসে কতগুলো কাজ শেষ করছে। জুডি রবার্টের দিকে তাকিয়ে কিছুই যেন ঘটেনি ভাব করে বললেন, “আমি আমার অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করতে এসেছি।”

রাগে রবার্টের শরীরটা রি-রি করে উঠল! মেয়েটা ভেবেছে কী— যখন দরকার পড়বে চিনতে পারবে, কাজ ফুরোলেই চিনবে না! রাগটা কোনোমতে চেপে বলল, “এখন ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেছে। আপনি কাল অফিস আওয়ার্সে আসবেন।”

জুডি একটু ইতস্তত করে বললেন, “কালকের জন্যে আমি সরি।”

যাক, অন্তত এই ভদ্রতাটুকু আছে, রবার্ট একটু নরম হল। তবে নিস্পৃহভাবে বলল, “দেখুন অফিসের কাজের বাইরে আমারও কৌতূহল দেখানো উচিত হয়নি। যাইহোক, কালকে সকালে আপনি আসবেন, অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দেওয়া যাবে।”

জুড়ি তখনও দাঁড়িয়ে আছেন।

রবার্ট জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু বলবেন?”

“একটা অনুরোধ করব?”

“বলুন।”

“আমি একটা সই-করা উইথড্রয়াল স্লিপ আর পাসবুকটা আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি, আপনি টাকাগুলো তুলে রাখবেন, কাল এই সময়ে আমি এসে নিয়ে যাব।”

“না, না, কাস্টমারদের টাকা এভাবে তো আমি তুলে রাখতে পারি না,” রবার্ট আপত্তি জানাল।

“প্লিজ, এই সাহায্যটুকু আপনি আমায় করুন।”

রবার্ট তাকাল জুড়ির মুখের দিকে। নিজের অজান্তেই জুড়ির কাছ থেকে পাসবুক আর স্লিপটা নিল।

সেভিংস-এ জুডির প্রায় পনেরো হাজার ডলার ছিল। সেটা ক্যাশ করে নিজের লকারে রেখে দিল রবার্ট। পরের দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাবার পর প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত ব্যাঙ্কে বসে রইল, কিন্তু জুডি এলেন না। রবার্ট উদ্‌বিগ্ন হল, এইভাবে কাস্টমারের টাকা তুলে নিয়ে রেখে দেওয়া ঘোরতর অপরাধ। জুডিকে বিশ্বাস করে এই কাজটা করা ওর উচিত হয়নি। জুডির পাসবুক ওর নিজের ড্রয়ারে। অন্যমনস্ক হয়ে সেটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল উলটো দিকে লেখা: আই ট্রাস্ট ইউ, জুডি।

এরপর আমি জানি রবার্ট বহু বছর ধরে জুডিকে খুঁজেছে, বোঝার চেষ্টা করেছে তাঁর এই অদ্ভুত আচরণের কারণ। কেন ঠিকানা নিয়ে এত গোপনীয়তা? রাস্তায় না-চেনা, অথচ পাসবুক দিয়ে এতগুলো টাকা তুলতে দেওয়া ‘আই ট্রাস্ট ইউ’ লিখে? টাকাগুলো কি অসৎভাবে পাওয়া? কেন টাকাগুলো নিতে এলেন না? ডিড শি গেট কিল্ড? প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই ঘটনাটা রবার্টকে মানসিকভাবে তাড়া করে বেড়িয়েছে। তারপর…”

কাহিনি শেষ হবার আগেই ট্রেন্টন স্টেশনে ট্রেনটা এসে থামল। মাত্র মিনিট দুই-তিন থামে এই স্টেশনে। ভদ্রলোক তাড়াহুড়ো করে উঠে কোনোমতে “গুডবাই” বলে ট্রেন থেকে নেমে গেলেন।

এক মিনিটের মধ্যেই ট্রেনটা আবার ছাড়ল। চোখে পড়ল ভদ্রলোক একজন মহিলাকে চুমু খাচ্ছেন। স্টেশনের আলো ওঁদের দু-জনের ওপরে এসে পড়েছে। মহিলার চুলগুলো প্রায় সাদা, গালের নীচে একটা আঁচিল।

।।৪।।

“রবার্টই যে টিম আমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছি, তবে গল্পটা বানানো।” প্রমথ মন্তব্য করল।

“পুরোটা হয়তো নয়,” আমি বললাম। “অবভিয়াসলি উনি প্রথম থেকেই জুডির প্রেমে পড়েছিলেন। প্রেম নিবেদনে জুডি প্রথমে সাড়া দেননি, না-চেনার গল্পটা একটা রূপক। পরে সাড়া দিলেও পাঁচ বছর বিয়েটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।”

“হয়তো স্যার টিম সাহেবের সব কথাই সত্যি, নামগুলো ছাড়া,” একেনবাবু পা নাচাতে নাচাতে বললেন।

“হোয়াট ডু ইউ মিন?”

“ধরুন স্যার, ওঁর স্বামী ছিলেন ভয়ংকর অত্যাচারী। তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেতে জুডি টেক্সাসে গিয়ে লুকোন। ওঁর পুরোনো ব্যাঙ্ককে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যান যাতে মাসে মাসে ওঁর অ্যাকাউন্ট থেকে একটা চেক ওঁকে পাঠানো হয়। এর মধ্যে উনি খবর পান যে, স্বামী ওঁর পুরোনো ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জেনে গিয়েছেন কোন ব্যাঙ্ক থেকে চেকগুলো ক্যাশ করা হচ্ছে। জুডি তখন ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত টাকা তুলে অন্য কোথাও অদৃশ্য হবার প্ল্যান করেন। এই সময়ে টিম সাহেবের ওঁকে খুঁজতে যাওয়াটা জুডি সন্দেহের চোখে দেখেন, না-চেনার ভান করেন। যাইহোক, টাকাটা ওঁকে তুলতে হবে। ইচ্ছে করেই উনি অফিস আওয়ার্সের পরে ব্যাঙ্কে যান, কারণ স্বামী ব্যাঙ্কের খোঁজ পেয়ে থাকলেও ওই সময়ে জুডিকে সেখানে এক্সপেক্ট করবেন না। পরের দিন টাকা নিতে যাবার আগে হয় ওঁর সঙ্গে স্বামীর দেখা হয়ে যায়, অথবা শেষ মুহূর্তে ওঁর মনে হয় টিম সাহেবও স্বামীর দলে। ওখানে গেলে টাকা তো যাবেই স্বামীর খপ্পরেও পড়বেন। পরে স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেলে টিম সাহেবের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয়। টিম সাহেব তো আগেই প্রেমে পড়েছিলেন। জুডি প্রেমে পড়লেন টিম সাহেবের সততা দেখে।”

প্রমথ বলল, “ননসেন্স, আপনার এই ব্যাখ্যায় অনেক ফাঁক আছে। প্রথমত…”

একেনবাবু বললেন, “কী মুশকিল স্যার, সেইজন্যেই তো ‘হয়তো’ দিয়ে শুরু করেছি।”

Tags:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress