হাতি-মার্কা বরাত
বাজার মন্দা মানেই বরাত মন্দ। কালীকেষ্টর পড়তা খারাপ পড়েছে। ট্যাঁক খালি—কয়েক হপ্তার থেকে টাকার আমদানি নেই। আধুলিটা সিকিটাও আসছে না। খদ্দেরের দেখা নেইকো, টাকাওয়ালা দূরে থাক, একটা টাকওয়ালা পর্যন্ত টিকি দেখায় না।
এমনি অচল অবস্থা। কালীকেষ্ট ভাবে, খালি ভাবে; ভেবে ভেবে কূল পায় না। অর্ডার সাপ্লায়ের কারবার তার। সব কিছু বেচা-কেনার লাভ কুড়িয়ে তার মুনাফা। নানা রকমের মালের তার জোগানদারি। দোকানদারিও। পাইকারি আর খুচরোয়। যেটি চাই, আর যেটি চাইনে, আর যে জিনিস হাজার চাইলেও কোত্থাও পাইনে—সব তার আড়তে মজুত।
কিন্তু মজুত মালে মজা কোথায়? মূলধন আটকে তা তো উলটে মালিককেই আরও বেশি মজায়। মাল কাটাতে পারলে তবেই-না তা টাকাতে ঘুরে আসে। ঘুরে টাকা হয়ে আসে। কাটা মানেই টাকা। না কাটলে সবই তো পয়মাল। মহাজনের দেনা মেটাতেই মাথার চুল বিকিয়ে যাবার জোগাড়।
কিন্তু তাও বুঝি আর বিকোবে না। টেনে টেনে মাথার চুল ছিঁড়ছিল কালীকেষ্ট। ভাবনায় চিন্তায় সেপাগলের মতো হয়েছে। অবশেষে ভাবলে, না, এ জীবন রেখে কোনো লাভ নেই, গঙ্গার জলে বিসর্জন দেয়াই ভালো।
সেই মতলবে সেগঙ্গার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। নিজেকে জলাঞ্জলি দিতে যাচ্ছে এমন সময়ে দেখল গাছতলার থেকে এক সন্ন্যাসী হাত তুলে তাকে ডাকছে।
সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে প্রণাম করে বসতেই তিনি বললেন—‘কেন বাপু অকারণে মরতে যাচ্ছ? তোমার বরাত তো খারাপ নয়। তোমার দরজায় হাতি বঁাধা থাকবে আমি দেখছি। কপাল দেখে আমি বলতে পারি।’
‘হাতি! প্রভু, বললেন ভালো! সাত দিন থেকে হাতে একটা পাই নেই। কিচ্ছু পাইনি, বিক্রিপাট বন্ধ! খাব কী তার সংগতি নেই, আর আপনি বলছেন হাতি! বলছেন বেশ।’
সন্ন্যাসী ধুনির থেকে একটু ছাই তুলে ওর হাতে দিলেন—বললেন—‘এই নাও বৎস! এই ছাইটুকু নস্যির সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে নাকে দাও গে। বরাত কাকে বলে তখন দেখবে। এই নস্যি নাকে দিয়ে তুমি যেকোনো জিনিস যাকে খুশি যেকোনো দামে বেচতে পারবে। যদ্দিন এ জিনিস তোমার নাকের কাছে থাকবে, কিছুতেই তোমার মার নেই। ব্যাবসার লক্ষ্মী মা গন্ধেশ্বরীর কৃপা, আর এই নস্যি, একসঙ্গে তুমি টানবে।’
কালী তো লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরল। তার নিজের আড়তেই নস্যি ছিল, খানিকটা নিয়ে তার সঙ্গে সেই ছাই মিশিয়ে ডিবেয় ভরে রাখল নিজের ট্যাঁকে। এক টিপ-না নাকে দিয়ে ভাবতে লাগল কী করা যায়। কী বেচা যায়—কাকে বেচা যায়।
ভাবতে ভাবতে তার চোখ খুলল। চোখের কাছেই পড়েছিল চকের ঢেরি—চকচক করে উঠল সামনে। এই চকখড়ির সাত গাড়ি সেকিনেছিল এক নিলামে—বেশ দাঁওয়ের মাথায়—জলের মতন সস্তায়—কিন্তু তারপর থেকেই পস্তাচ্ছে। এই চিজের একটুকরোও সেতারপরে গছাতে পারেনি কাউকে।
স্কুল পাঠশালায় তো খড়ি লাগে, তাই ভেবে সেপাচার করতে গেছল সেখানে। তাঁরা বলেছিলেন, নিতে পারি এক-আধ সের—এত খড়ি নিয়ে কী করব? যদি এ শহরের সবাই সাতপুরুষ ধরে এ-স্কুলে পড়ে তাহলেও লিখে লিখে সাতাত্তর বছরেও ফুরোতে পারবে না। ব্ল্যাকবোর্ড ক্ষয়ে যাবে তবু সব খড়ি খরচ হবে না। সারা বাংলা দেশের তামাম ছেলের যদি একসাথে হাতেখড়ি হয়, তাহলেও নয়।
আচ্ছা, দেখা যাক-না নস্যির গুণটা! ভাবল সে। সেই ইশকুলেই খড়ি বেচতে পারি কি না, দেখি না গে! যদি এই অচলকে চালাতে পারি তবেই বুঝব এই নস্যির দৌলতে বাকি জিনিস চালু করতে বেগ পেতে হবে না।
খড়িবোঝাই এক গাড়ি নিয়ে সেপাড়ি দিল ইশকুলের দিকে। যেতে যেতে পথে পড়ল এক রাজজ্যোতিষীর বাড়ি। ভাবল সে—গণতকারদের তো গুনতে লাগে। এখানেও খানিক বেচা যাক-না? গোড়াতেই কিছু বউনি হওয়া তো ভালো। মাল বেচে যাওয়া মানে যদিও—খানিকটা তার কমে যাওয়া—মালের ঘাটতিই, তাহলেও মালের কাটতি মানেই মালিকের বেঁচে যাওয়া। আর, মাল বেঁচে যাওয়া মানেই মালিকের মরণ। টাকার জন্যেই টেকা আর টেকার জন্যেই টাকা। মাল না বঁাচলেই মালিক বঁাচল। এই ভেবে সেগণকালয়ের দরজায় গিয়ে ‘নক’ করল।
বেরিয়ে এলেন গণক—‘কী? কী চাই?’
‘আজ্ঞে, খড়ি বেচতে এসেছি। গুনতে তো আপনাদের খড়ি লাগে। তাই—এই এক গাড়ি এনেছি—কয়েক মণ মোটে।’
‘গুনতে? হ্যাঁ, লাগে। কিন্তু তাই বলে কি এত খড়ি? একটু হলেই তো হয়। একেবারে গাড়ি খানেক এনে ফেলেছ, তা এনেছ যখন, তোমাকে ফেরাতে চাইনে, দাও তাহলে একটুখানি। এই এক কাচ্চার। এইটুকুর দাম কত?’
‘একটুতে কী হবে?’ বলে কালীকেষ্ট এক টিপ নস্যি নেয়—‘অন্তত মণ খানেক তো নিন? এক মণ না হলে গুনবেন কী করে? আর্ধেক মন নিয়ে কি গোনা যায় মশায়? গোনাগাঁথা একমনে করার জিনিস,—নয় কি কর্তা? আপনিই বলুন-না। একমন না হলে কি কেউ কখনো গুনতে পারে?’
‘তা বটে! একমনেই গুনতে হয়—সেকথা ঠিক!’ মানতে হয় গণকঠাকুরকে— ‘তাহলে দাও, এক মণই দাও—বলচ এত করে।’
মণ খানেক সেখানে দিয়ে মনের ভার একটু লাঘব করে—দোমনা গণককে দু-মণ গছানো যেত কি না, ভাবতে ভাবতে সেস্কুলের দিকে এগুল।
গাড়ি আর খড়ি নিয়ে হেডমাস্টারের কাছে গিয়ে খাড়া হতেই তাঁর চোখ পড়ল সেই খড়ির ওপর, আর উঠল—সোজা কড়িকাঠেই। ‘এ কী! আবার তুমি সেই খড়ি নিয়ে এসেছ? অ্যাঁ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ,’ বলে কালী এক টিপ নস্যি দিল নাকে—‘দিন কয়েক আগে আপনার এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে আমার নজরে পড়ল আপনার ইশকুলের অনেক জানলার খড়খড়ি ভাঙা। অনেক দিনের ইশকুল তো—ভাঙবে তার বিচিত্র কী! একেই ছেলেরা ডানপিটে। তার পরে পড়া না পারলেই মাস্টাররা তাদের ধরে পিটোন আবার। তাঁদের কাছে যা পিটুনি খায় তার সব ঝালটাই তো ঝাড়ে ওই জানলার ওপরে!—’
‘কিন্তু খড়ির সঙ্গে তোমার খড়খড়ির কী?’ হেডমাস্টার অবাক হন।—‘খড়ি তার কী কাজে লাগবে?’
‘খড়খড়ি সারাতেই মশাই! ওই খড়খড়ির অভাব মোচনের জন্যেই। খড়ি তো মজুত, এখন কিছু খড় হলেই হয়ে যায়।’ বলে আরেক টিপ নস্যি সেলাগায়—‘খড় আর খড়ি জুড়ে—সন্ধি করে কিংবা সমাস করে লাগিয়ে দিন—হয়ে গেল! যদি বলেন তো খড়ও আমরা জোগান দিতে পারি।’
কথাটা হেডমাস্টারের মনে ধরে, মাথা চুলকে তিনি বলেন—‘কথাটা বলেচ মন্দ না। আইডিয়াটা আমার মাথায় লাগচে। এইভাবে খড়খড়ির সমস্যা মিটলে খরচা খুব বেশি পড়বার কথা নয়। খড়ি তো পেলাম—আচ্ছা, যাও, খড়টা চটপট পাঠিয়ে দাও গে।’
খড়খড়ি সরবরাহ করার পর সারদিনের কারবার তার মন্দ হল না। এক বিজলিবাতির কারখানায় শ-পাঁচেক লন্ঠন সেপাচার করেছে! জুতোর দোকানে মজুত করেছে খড়ম। গোরুর খাটালওলাকে গছিয়ে এসেছে ঘোড়ার লাগাম—এক-আধটা নয়—কয়েক ডজন। টেকো লোকের কাছে বেচেছে মাথার চিরুনি, চুলের বুরুশ।
তার আড়তে বেদবাক্যের মতো অকাট্য যা ছিল তার প্রায় সবই সেকাটিয়েছে সারাদিনে। হেসে খেলে। কিন্তু পঁচিশ মণ খড়ি তখনও গড়াগড়ি যাচ্ছিল এক ধারে। সেগুলো গাড়ি বোঝাই করে সেরওনা দিল শহরতলিতে। সেখানে নতুন এক সার্কাসের দল এসে তাঁবু গেড়েছিল। লরিবোঝাই খড়ি নিয়ে কালীকেষ্ট হাজির।
সার্কাসের ম্যানেজার ঘাড় নেড়েছেন—‘না, মশাই না। চকের আমাদের কোনোই প্রয়োজন নেই। চক নিয়ে আমরা কী করব?’
‘তাঁবুতে লাগান’, কালী তাদের বাতলেছে—‘তাঁবুর চেহারা ফিরবে। চক লাগিয়ে তাঁবু চকচকে করুন। চটের গায়েও খড়ি মাখালে তার চটক বাড়ে, জানেন তা? চকচকে তাঁবু হলে তবে-না চোখ টানবে সবার? আর লোকের নজরেই যদি না পড়ে তবে নজরানা পড়বে কেন? চাকচিক্য না দেখলে গাঁটের কড়ি খরচ করে দেখতে আসবে কেন মানুষ?’
খড়ি বেচতে তারপর আর দেরি হয়নি। বেগ পেতে হয়নি বিশেষ।
কিন্তু বেগ পেতে হল বেশ—তারপরেই। এক গোসাঁইবাড়ি মাংস থুড়বার যন্ত্র জোগাতে গিয়ে। যন্ত্রটা দেখেই-না তিনি এমনভাবে না না করে উঠলেন যেন ভয়ংকর এক যন্ত্রণা পেয়েছেন। নাক সিঁটকে বললেন—‘আমরা বৈষ্ণব মানুষ, মাছ-মাংস তো ছুঁইনে? মাংস থোড়ার যন্তর নিয়ে কী করব আমরা?’
‘মাংস না খান, থোড় তো খান? এঁচোড় চলে? গাছপাঁঠাতে তো অরুচি নেই? থোড়কেও যদি এতদ্দারা থোড়েন—থুড়ে নেন—কী চমৎকার যে হয় বলবার নয়! পাঁঠার মতো গাছপাঁঠাকেও এই যন্ত্রে ফেলে পাট করা যায়। তারপর সেই উত্তমরূপে থুড়িত—সেই থোড়া এঁচোড় দিয়ে—তারপরে, তার সঙ্গে থোরা গাওয়া ঘি মিশিয়ে—আহা!’ কালীকেষ্ট সড়াৎ করে জিভের ঝোল টেনে নেয়।
‘থুড়লাম নাহয়, কিন্তু তারপর?’ জিগেস করেন গোসাঁই ঠাকুর—‘ততঃ কিম?’
‘তারপরেই কিমা। কাঁঠালের কিমা। সেই কিমার পুর দিয়ে বেসনে ভেজে চপ কাটলেট যা খুশি বানান—যা আপনার প্রাণ চায়। বিলাসব্যসন একাধারে। যা ইচ্ছে বানিয়ে খান—খাদ্যের যেকোনো বিলাসিতা! এঁচোড়ের দোপেঁয়াজি কি থোড়ের শামিকাবাব।’
শামিকাবাবের নামে গোস্বামী একটু কাতর হয়েছেন কিন্তু কাত হননি, বিলাসব্যসনের কথাটায় টলেছেন, কিন্তু কাবার হননি। থোড়াই-মেশিন থোরাই তিনি নিয়েছেন, একখানাই মোটে। ডজন খানেক কিছুতেই তাঁকে গছানো যায়নি। তিনি বলেছেন—‘একটাই তো যথেষ্ট। দুটি মাত্র হাত আমার, দু-ডজন তো নয়। বারোটা যন্তর নিয়ে কী করব বাপু, ক-হাতে চালাব?’
‘আজ এটায়, কাল ওটায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চালান-না। বারোটাকেই কাজে লাগান এইভাবে। যন্তরকেও মাঝে মাঝে বিশ্রাম দিতে হয়, তাতে ভালো কাজ দেয় আরও।’
‘বুঝলাম, কিন্তু দু-টি তো মোটে বাহু। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এতগুলি নেওয়া একটু বাহুল্যই নয় কি?’
‘আপনি নিজে কি আর থুড়তে যাবেন, থুড়বে তো বাড়ির মেয়েরা। গিন্নিবান্নিরাই। আর, তাঁরা যে দশ হাতে কাজ করেন তা কি আপনার শোনা নেই? তাঁরা যদি কিমা বানাতে বসেন, কী না করতে পারেন? সামান্য এ-ক-টা যন্ত্র কি পেরে উঠতে পারবে তাঁদের সঙ্গে?’
‘ভালো কথা মনে করিয়ে দিলে। কিমার কথাতেই মনে পড়ল। কিমা করবে কে? কাকিমাই নেই যে! তীর্থ করতে বেরিয়েছেন—প্রয়াগ, বৃন্দাবন, মথুরা—চারধাম ঘুরে তারপর ফিরবেন। তিনি মথুরা থেকে ফিরলে তারপরে তো এই থুড়াথুড়ি। না বাপু, ও যন্তরের এখন কোনো কাজ নেই। একটাও আমার চাইনে।’
কালীকেষ্ট ধাক্কা খেল। এমন ধাক্কা সেসকাল থেকে খায়নি। চালের দোকানদারকে কাঁকরের বদলে কাঁকুড় গছাতে সেবাধা পায়নি, দর্জির কাছে দরজা বেচে এসেচে, ঘড়িওয়ালার কাছে ঘড়া, ডাক্তারের কাছে থার্মোমিটারের বদলে হাতুড়ি, হাতুড়ের কাছে ইঞ্জেকশনের দাবাই, রেশনের দোকানে অপারেশনের যন্ত্রপাতি চালাতেও কোনো অসুবিধা হয়নি, কিন্তু টক্কর খেল এই প্রথম।
খেতেই সেটক করে নাকে হাত দিল—না, এক টিপ নস্যি নেয়ার দরকার। কিন্তু ট্যাঁকে হাত দিয়েই তার চক্ষু স্থির! এ কী, ডিবেটা তো নেইকো! গেল কোথায়?
কোথায় ফেলল ডিবেটা? কখন হারাল সে? ভাবতে ভাবতে তার খেয়াল হল, সার্কাসের ম্যানেজারের টেবিলে ফেলে আসেনি তো ভুল করে?
ছুটল সেতাঁবুর দিকে—এক মুহূর্ত আর দেরি না করে। ডিবেটা নিজের তাঁবে না আসা অবধি তার স্বস্তি ছিল না।
সার্কাসে ফিরে গিয়ে সেঅবাক হয়ে গেল। ম্যানেজার হাঁচতে হাঁচতে তাকে অভ্যর্থনা করলেন, কিন্তু বিস্ময় সেজন্যে নয়। সেহাঁ হয়ে গেল এই দেখে যে তার খড়ি তাঁবুতে না লাগিয়ে গুঁড়িয়ে গুলে কাই বানিয়ে হাতির গায়ে মাখাচ্ছে তাই।
‘ইস, কী কড়া নস্যি মশাই আপনার। একটু-না নাকে দিয়েই যা নাকাল হয়েছি—’
সেকথা না কানে তুলে কালী শুধল—‘এ কী মশাই? খড়ি দিয়ে এ কী হচ্ছে?’
‘হাতিটার হাতেখড়ি হচ্ছে আর কি!’ বলল ম্যানেজার। হাতির সামনের গোদা পা-দুটোয় খড়িগোলা লাগাতে লাগাতেই বলল।
‘তা তো দেখছিই, কিন্তু এমন করে খড়ি মাখিয়ে হচ্ছে কী?’
‘হাতিটা বেজায় বুড়ো হয়ে গেছে কিনা, কোনো কাজেই লাগে না আর। ক-দিন বঁাচবে কে জানে! তাই ভাবচি এটাকে এবার বেচে দেব।’
‘বুড়ো হাতি কিনবে কে?’ কালী ঠোঁট উলটায়—‘তার ওপর আবার ফোকলা! দাঁত নেইকো একদম।’
‘তা বটে! কিন্তু হাতিদের দাঁত বঁাধাবার ডাক্তার মেলে কোথায়? হাতিদের কি ডেনটিস্ট আছে? হস্তীসমাজে আছে কি না জানিনে, কিন্তু মনুষ্যসমাজে তো নেই। তাই ভাবছিলাম কী করি। আপনার নস্যির ডিবে ফেলে গেছলেন, তার এক টিপ নাকে দিতেই মাথা খুলে গেল।—দেখলাম, তাই তো! আপনার খড়ি দিয়েই তো হয়ে যায়। বেশ হয়।’
‘কী হয়?’
‘মানে, এটাকে শ্বেতহস্তী বলে চালানো যায়। সাদা হাতির বেজায় দাম, জানেন নিশ্চয়? অতি দুর্লভ জিনিস কিনা!
‘বটে বটে? কেমন দাম এক-একটা তেমন হাতির?’
‘লাখ খানেকের কম তো নয়। শ্যাম দেশে শ্বেতহস্তীর পূজা হয়ে থাকে। যাকে বলে রাজপূজা—রাজা-রানিরা পূজা করেন। ঐরাবতের বংশধর কিনা ওরা, দেবতা-বিশেষ, বুঝলেন?
‘তা, কত দামে বেচবেন এটাকে?’
‘লাখ খানেক আর কে দেবে এখানে? এ তো শ্যামদেশ নয়। হাজার বিশেক হলেই ছেড়ে দেব। ভারি পয়মন্ত মশাই, এই শ্বেতহস্তী। যার দরজায় এই হাতি বঁাধা থাকে, বুঝলেন কিনা, মা লক্ষ্মী তার বাড়িতে অচলা। তবে কিনা, বরাত করে আসা চাই। যার-তার দরজায় কি হাতি বঁাধা থাকে?’
শুনেই কালীকেষ্টর টনক নড়ে। মনে মনে সেখতায়। সারাদিনের রোজগারে হাজার বিশেক টাকা তার হয়েছিল—হিসেব করে দ্যাখে। তারপর বিশেষ বিবেচনা করে দ্যাখে—‘কিন্তু সত্যিকারের শ্বেতহস্তী তো নয় মশাই?’ সেবলে—‘আমারই খড়িগোলা মাখানো জাল হাতিই তো, বলতে গেলে? কিংবা হাতির ভেজাল—তাও বলতে পারেন!’
‘টের পাচ্ছে কে? সবে তো এর হাতেখড়ি হয়েছে, পায়ে খড়ি হোক, সারা গায়ে খড়ি লাগাই—তখন দেখবেন! মুনিরও মন টলে যাবে সে-চেহারা দেখলে। হুঁ।’
বলে সার্কাসের মালিক আরেক টিপ নস্যি লাগায় নাকে। লাগিয়ে আরেক প্রস্থ হাঁচির মহড়া দেয়।
তারপর আর বলতে হয় না। হাঁচতে হাঁচতেই হাসিল হয় কাজ—হাসতে হাসতেই।
খানিক বাদে কালীকেষ্ট সার্কাস থেকে বেরয়—খালি হাতে নয়, হাতি হাতিয়ে। হাতির লেজ ধরে—নিজের ট্যাঁক হালকা করে।
তাঁবুর গেটে যে তাঁবেদার ছিল সেতাকে শুধাল—‘কী মশাই! পেলেন আপনার হারানো জিনিস—যা খুঁজতে এসেছিলেন?’
‘না, পাইনি—তবে একটা পেয়েছি।’
‘এই হাতিটা?’
‘হ্যাঁ, ভারি দুর্লভ জিনিস মশাই!’ এই সাদা হাতিটাকে বেশ দাঁওয়ে পাওয়া গেছে।’
‘দাঁওয়ে?’ লোকটা হাঁ হয়ে থাকে।
‘দাঁও বই কী! লাখ টাকা একটা সাদা হাতির দাম। সোজা কথা নয়। এদিকে সারাদিনের আমার আমদানি মাত্তর বিশ হাজার। কিন্তু তাতেই হয়ে গেল। বিশে বিষক্ষয় করে এই হাতিটাকে নিয়ে চললাম—বেঁধে রাখব আমার দরজায়!…বেশ হবে।’