নবম পরিচ্ছেদ
পরদিন নগেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের সহিত এই খুনের বিষয় আলোচনা করিবার জন্য সম্মিলিত হইলেন। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “নগেন্দ্রনাথবাবু, আমার মতের পরিবর্ত্তন হইয়াছে।”
“কোন্ বিষয়ে?”
“আমার এখন মত কোন স্ত্রীলোক হুজুরীমলকে খুন করে নাই।”
“কেন?”
“আমরা গঙ্গার ঘাটে একখানা ছোরা কুড়াইয়া পাইয়াছি। যেখানে স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া গিয়াছিল, তাহারই নিকটে পাওয়া গিয়াছে। লোকটা স্ত্রীলোকটিকে খুন করিয়া ছোরাখানা জলে ফেলিয়া দিয়াছিল। ভাটার সময় জল সরিয়া যাওয়ায় ছোরা পাওয়া গিয়াছে।”
“তাহাতে কিরূপে বুঝিলেন যে, স্ত্রীলোকটি হুজুরীমলকে খুন করে নাই?”
“ছোরাখানি পঞ্জাবী, এদেশে এ ছোরার বড় ব্যবহার নাই। যেভাবে এ ছোরা হুজুরীমলের ও এই স্ত্রীলোকের বুকে বসান হইয়াছিল, তাহাতে শরীরে অসীম বল না থাকিলে কেহ তাহা পারে না।”
“সে খুন না করিতে পারে, কিন্তু যখন হুজুরীমল খুন হয় তখন সে নিকটেই ছিল, নতুবা হুজুরীমল তাহার কাপড় ছিঁড়িয়া লইবে কিরূপে?”
“কোচম্যানের কথা শুনিয়া আমার এই কথাই প্রথমে মনে হইয়াছিল, কিন্তু কি উদ্দেশ্যে একজন লোক এরকম ভয়ানক কাজ করিবার জন্য একজন স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবে? কিসে এ কথা জানা যায়?”
“এখন কি করিবেন, মনে করিতেছেন?”
“এই স্ত্রীলোকটিকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে।”
“এ পর্য্যন্ত ত তাহার কিছুই হইল না?”
“কতক করিয়াছি, স্ত্রীলোকটির পরনে যে কাপড় ছিল তাহাতে ধোপার একটা দাগ ছিল। কলিকাতা ও চন্দননগরে সমস্ত ধোপার সন্ধান লইয়া যে ধোপা এই কাপড় কাচিত, তাহাকে পাইয়াছি।”
“আপনার খুব বাহাদুরী আছে।”
“আমাদের প্রত্যহই এ কাজ করিতে হয়।“
“ধোপা কি বলিল?”
“কাহার কাপড় তাহা ধোপার নিকটে জানিয়াছি।” নগেন্দ্রনাথ সোৎসাহে বলিলেন, “তবে ত আপনি মৃত স্ত্রীলোকটির নাম জানিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “ঐ টুকুই গোল–ধোপার কাছে জানিয়াছি, কাপড়খানি হুজুরীমলের স্ত্রীর।”
“বলেন কি, হুজুরীমলের স্ত্রীর, তবে এ স্ত্রীলোক এ কাপড় পাইল কোথা হইতে?”
“তাহাই এখন সন্ধান করিতে হইবে।”
“কিন্তু ললিতাপ্রসাদের ভাবভঙ্গি দেখিয়া তাহার উপরে আমার কিছু সন্দেহ হয়।”
“আরও সন্দেহ হয়, এই গুণবান্ উমিচাদের উপর। সে শিব দেখিয়া অজ্ঞান হইয়াছিল; বলে কি না যে সে এ শিব সর্ব্বদা হুজুরীমলের কাছে দেখিয়াছে। তাহাই ইহা দেখিয়া খুনের কথা মনে পড়ায় অজ্ঞান হইয়াছিল, এ কথা যে সর্ব্বৈব মিথ্যা তাহা বলা নিষ্প্রয়োজন।”
“যেদিক দিয়াই হউক এই শিবঠাকুরটি এই খুনের মূলে আছেন। আপনি গুরুগোবিন্দ সিংহের একবার সন্ধান লউন। দেখিতেছেন না যে, এই খুনের সূত্র সকল রকমে পঞ্জাবের দিকেই যাইতেছে। এই শিবলিঙ্গের সম্প্রদায় পঞ্জাবেই আছে। পঞ্জাবে হুজুরীমল বিবাহ করিয়াছিল। পঞ্জাবী ছোরায় সে খুন হইয়াছে। পঞ্জাবী স্ত্রীলোক হুজুরীমলের স্ত্রী। পঞ্জাবী কাপড় স্ত্রীলোকটির পরা ছিল—আর পঞ্জাবী গুরুগোবিন্দ সিং সম্প্রতি পঞ্জাব হইতে এখানে আসিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার চিন্তিতভাবে বলিলেন, “কথা বটে—তবে স্ত্রীলোকটি কেন খুন হইল সেটাও একটা কথা।”
“আপনি হুজুরীমলের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন না কেন?”
“করিব। আপাততঃ চলুন, প্রথমে একবার হুজুরীমলের চাকরকে নাড়াচাড়া করিয়া দেখা যাক্, সে কিছু না কিছু বলিতে পারে।”
“আপনি যে এ ব্যাপারের কিছু করিয়া উঠিতে পারিবেন বলিয়া আমার ভরসা নাই।” অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “দেখিতেছি, আপনি ইহারই মধ্যে এ ব্যাপারে ক্লান্ত ও হতাশ্বাস হইয়া পড়িয়াছেন।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “না আমি হতাশ হই নাই—আমি আপনার সঙ্গ সহজে ছাড়িতেছি না।” অক্ষয়কুমার বলিয়া উঠিলেন, “তবে আসুন, একবার হুজুরীমলের আবাসভূমিটা পর্যবেক্ষণ করা যাক্।”
উভয়ে বড়বাজারের দিকে চলিলেন।