পঞ্চম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আপনি কি করিবেন, মনস্থ করিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “প্রথমে আমি বসু কোম্পানীর নিকট সন্ধান লইব। সম্ভবতঃ তাহারা কাহার জন্য এই জামা প্রস্তুত করিয়াছিল, তাহা জানিতে পারিব। তাহা হইলে তাহার বিষয় একটু সন্ধান লইলে তাহাকে কেন খুন করিয়াছে, তাহাও জানিতে পারা যাইবে। খুনীর উদ্দেশ্য জানিতে পারিলে তাহাকে ধরা বড় কঠিন হইবে না। কিন্তু এছাড়াও আর এক সূত্র আছে—ভাড়াটিয়া গাড়ী।”
“কোন্ গাড়ী, যেখানায় আমি উঠেছিলাম? না, যেখানায় উঠিয়া ঐ লোক আমার চোখে ধূলি দিয়াছিল?”
“ও দু’খানার একখানাও নয়। আর একখানা যে গাড়ী ছিল, সেইখানা।”
সেখানার কোচম্যান এমন বিশেষ কি সন্ধান দিতে পারিবে?”
“নগেন্দ্রনাথবাবু, আপনি একজন ভাল উপন্যাস লিখিয়ে হইতে পারেন কিন্তু আপনি ডিটেক্টিভগিরির বিশেষ কিছু জানেন না। ইহা কি সম্ভব নয় যে, আপনাদের দুখানা গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া সেইখানা ভাড়া করিয়া তৎক্ষণাৎ তথা হইতে চলিয়া যাইবে?”
“খুব সম্ভব। কিন্তু সে কি সেই সময়ে আর কোন লোকের সঙ্গে দেখা করিতে সাহস করিবে? তাহা হইলে একজনও ত তাহার চেহারা দেখিয়া রাখিতে পারে?”
“এতটা বুদ্ধি বোধহয়, তাহার সে সময়ে হয় নাই; বিশেষতঃ আমার বিশ্বাস সে-ও ছদ্মবেশে আসিয়াছিল। আরও কারণ—গঙ্গার ধারে আর কোন লোকের সঙ্গে তাহার দেখা করিবার কথা স্থির ছিল। এই খুন করিতেই হয়ত তাহার বিলম্ব হইয়া গিয়াছিল; পাছে সে লোক তাহাকে দেখিতে না পাইয়া চলিয়া যায়, এই ভয়ে সে গাড়ী লইয়াছিল। আরও কারণ আছে, এত রাত্রে স্ত্রীলোক একাকী রাস্তায় গেলে, পাছে পাহারাওয়ালারা ধরে বলিয়া সে গাড়ীতে উঠিয়াছিল। যাহাই হউক, আমি এই গাড়োয়ানকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব।
“তাহাকে কোথায় পাইবেন?”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “এটা কি আপনি বড় শক্ত কাজ মনে করিলেন? আমি এখন উঠিলাম।”
“কখন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হইবে?”
অক্ষয়কুমার দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, “সত্যই কি আপনার একটু ডিটেকটিভগিরি করিবার সখ হইয়াছে?”
নগেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “আপনি আমাকে এ-ব্যাপারে সঙ্গে লইতে অস্বীকার করিয়াছেন।”
“ভাল, তবে এক কাজ করুন—আসুন, আমরা দুজনে কাজের একটা বখ্া করিয়া লই।”
“বলুন, কি করিতে হইবে।”
“আপনি এই বসু কোম্পানীর দোকানে গিয়া সন্ধান লউন, আমি গাড়োয়ান প্রভৃতিকে দেখি।”
‘কোথায় আপনার দেখা পাইব?”
“আমি সন্ধ্যার সময়ে আপনার এখানে আসিব। আপনি বাড়ী থাকিবেন।”
“আমি আহারাদির পরই বাহির হইব।”
“আপনার যে বন্ধুর কথা বলিলেন, তাঁহার নিকটে যাইবেন; দেখুন তিনি যদি আপনাকে এই সিন্দুর মাখা দেবতার কিছু সন্ধান দিতে পারেন।”
“নিশ্চয়ই যাইব। একটা শিব আমার কাছে থাকিল।”
“খুব ভাল কথা।”
“কিন্তু আপনি একটা বিষয়ে এখনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন নাই।”
“এখন আমি কোন বিষয়েই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি নাই; তবে আপনি কোনটার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“স্ত্রীলোকটিকে যে খুন করিয়াছে, সে স্ত্রী না পুরুষ?”
“অন্য অনেক বিষয়েই আমি নিবিড় অন্ধকারের ভিতরে আছি সত্য, কিন্তু এবিষয় আমি স্থির নিশ্চিত হইয়াছি; পরে দেখিবেন, আমার কথা ঠিক কি না।”
“কি হইয়াছেন? যে স্ত্রীলোকটিকে খুন করিয়াছে, সে স্ত্রী না পুরুষ?”
“দুশোবার পুরুষ।”
“আপনি কিরূপে এত কৃতনিশ্চয় হইলেন?”
“নগেন্দ্রনাথবাবু, আপনি উপন্যাস লিখেন, তথাপি এই জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“কেন?”
কেন? কোন পুরুষের জন্য ভিন্ন কোন স্ত্রীলোক কি কখনও এমন অসমসাহসিকের কাজ করিতে সাহস করে? স্ত্রীলোক ভালবাসায় পড়িয়া সব করিতে পারে—এই স্ত্রীলোক খুন পর্য্যন্ত করিয়াছিল।”
“তবে সে যাহাকে এত ভালবাসিত, সেই তাহাকে এইরূপ নিৰ্দ্দয়ভাবে খুন করিল?”
“জগতে অনেক হয়, অনেক হইতেছে। নগেন্দ্রবাবু, আপনি উপন্যাস লিখিতে বসিয়া পাঠককে মুগ্ধ করিবার জন্য কল্পনার সাহায্যে কত অসম্ভব বিস্ময়জনক ঘটনার অবতরণ করেন, কিন্তু এক একটা সত্য ঘটনা এত বিস্ময়কর যে-আপনার কল্পনা সেখানে কোথায় লাগে?”
তিনি প্রস্থান করিলেন।
নগেন্দ্রনাথ চিন্তিতমনে বসিয়া রহিলেন।