পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
রাত্রি আটটার সময়ে যমুনাদাস আসিয়া রঙ্গিয়াকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় আসিল। তাহারা ভাবিয়াছিল যে, রঙ্গিয়া পাঁচ শত টাকার লোভে গঙ্গার হইয়া হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিতে যাইতেছে। তাহারা উমিচাদের ব্যাপার কিছুই জানিত না।
রঙ্গিয়া একাকিনী যাইবে মনে ভাবিয়াছিল; কিন্তু যমুনাদাস রঙ্গিয়াকে বিশ্বাস করিত না। রঙ্গিয়াকে বিশ্বাস করিবে কিরূপে? সে রঙ্গিয়াকে চোখের আড়াল হইতে দিল না।
রঙ্গিয়া বিপদে পড়িল। সে কিরূপে তাহাকে ফাঁকী দিবে তাহার হাত এড়াইয়া টাকা উমিচাঁদকে দিবে, তাহাই ভাবিতে লাগিল; মনে মনে একটা উপায়ও স্থির করিয়া ফেলিল।
এদিকে যমুনাদাস কলিকাতায় আসিয়া রঙ্গিয়াকে একটা বাড়ীতে লইয়া গেল। তথায় তাহাকে বলিল, “রঙ্গিয়া! হুজুরীমল ভাল লোক নয়—তাহার কাছে গেলে তোমার বিপদের সম্ভাবনা আছে। যদি সে কোনরূপে জানিতে পারে যে, গঙ্গা আসে নাই, অন্যকে পাঠাইয়াছে, তখন সে যে কি করিবে, তাহার ঠিকানা নাই। তোমাকে অনর্থক এত বিপদে ফেলিতে আমার ইচ্ছা নাই, তাই একটা মতলব স্থির করিয়াছি।”
রঙ্গিয়ার ভয় হইয়াছিল। সে যমুনাদাসকে ভালরূপেই জানিত—তাহার সহিত একাকী এই নির্জন বাটীতে আসিতেই তাহার ভয় হইয়াছিল; কিন্তু সে তাহার হাতে আসিয়া পড়িয়াছে। কি করে—কোন কথা কহিবার উপায় নাই। সে বুঝিয়াছিল যে, যমুনাদাস তাহাকে সন্দেহ করিয়াছে, সুতরাং এখন ইতস্ততঃ করিলে তাহার সন্দেহ আরও বাড়িবে। যমুনাদাসকে বিশ্বাস নাই—সে তাহাকে অনায়াসে খুন করিতেও পারে। সে কেবলমাত্র বলিল, “বলুন, কি করিতে হইবে।”
যমুনাদাস বলিল, “আমি মনে করিয়াছি, আমি গঙ্গার কাপড় পরিয়া মেয়ে মানুষ সাজিয়া যাইব—তোমাকে পুরুষ বেশে লইয়া যাইব।”
এই বলিয়া যমুনাদাস এক লম্বা কাল দাড়ি বাহির করিল। বলিল, “সাবধানে মার নাই; যদি কোন গোলযোগ হয়, তাহা হইলে পুলিসেও আমাদের ধরিতে পারিবে না—তুমি এই দাড়ি পরিয়া পুরুষ সাজিলে আর কেহ তোমাকে সন্দেহ করিতে পারিবে না। আমিও মেয়ে মানুষ সাজিলে পরে আমার উপরও কাহারও সন্দেহ হইবে না।”
রঙ্গিয়া যদিও এইসকল কিছুই পছন্দ করিতেছিল না; কিন্তু কি করে, উপায় নাই, সে অসম্মত হইলে যমুনাদাস তাহার উপর অত্যাচার করিবে—যমুনাদাস না পারে, এমন কাজ নাই।
সে ধীরে ধীরে বলিল, “আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই করিব।”
যমুনাদাস হাসিয়া বলিল, “বেশ, ভাল কথা, একেই বলে লক্ষ্মী মেয়ে। প্রথমে তোমায় সাজাইয়া দিই।”
যমুনাদাস রঙ্গিয়াকে পুরুষবেশে সাজাইতে আরম্ভ করিল। তৎপরে তাহার মুখে সেই লম্বা কাল দাড়ি লাগাইয়া দিল। সে বেশে কাহারই সাধ্য ছিল না যে, রঙ্গিয়াকে চিনে?
তাহাকে সাজান শেষ হইতে যমুনাদাস গঙ্গার কাপড় পরিয়া স্ত্রীবেশ ধারণ করিল। তাহার গোঁফদাড়ি ছিল না, ছদ্মবেশেও যমুনাদাস সিদ্ধহস্ত ছিল—কয়েক মুহূর্ত্তের মধ্যেই একটী যুবতী স্ত্রীলোকে পরিণত হইল।
তখন যমুনাদাস বলিল, “তুমি অন্ধকারে লুকাইয়া থাকিয়ো, আমি হুজুরীমলের সম্মুখে যাইব। সে আমাকে টাকা দিলে তোমায় আমি দিব। তুমি টাকা লইয়া সরিয়া গিয়া অন্ধকারে লুকাইয়ো।”
ঠিক বারটার সময়ে পুরুষ-বেশে রঙ্গিয়া ও স্ত্রী-বেশে যমুনাদাস রাণীর গলিতে প্রবিষ্ট হইল। রঙ্গিয়াকে একটা পার্শ্ববর্ত্তী পোড়োবাড়ীর অন্ধকারে লুকাইয়া রাখিয়া, যমুনাদাস একটু অগ্রবৰ্ত্তী হইয়া হুজুরীমলের অপেক্ষা করিতে লাগিল।
তাহাদের অধিকক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না। দশ মিনিট যাইতে-না-যাইতে দরওয়ানবেশে হুজুরীমল তথায় উপস্থিত হইল। এই গলির মধ্যে সরকারী আলো ছিল—তাহাও অতি দূরে দূরে; কাজেই গলির ভিতর খুব অন্ধকার।
হুজুরীমল সভয়ে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে অগ্রসর হইতেছিল। যমুনাদাস প্রকাণ্ড অবগুন্ঠন টানিয়া অন্ধকারে দাঁড়াইয়াছিল। হুজুরীমল নিকটস্থ হইলে সে অগ্রসর হইল। সহসা অন্ধকারে তাহাকে দেখিয়া হুজুরীমল চকিতভাবে দাঁড়াইল। তৎপরে মৃদুস্বরে বলিল, “গঙ্গা, আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি আসিবে না।”
যমুনাদাস মাথা নাড়িয়া হাত বাড়াইল। হুজুরীমল তাহার আরও নিকটস্থ হইল। প্রেমভরে বলিল, “এতদিনে বুঝিলাম, তুমি যথার্থই আমাকে ভালবাস। আমি দুখানা টিকিট কিনিয়াছি, চল আর এখানে দেরী করিবার আবশ্যক নাই—এ জায়গা ভাল নয়।”
যমুনাদাস কথা না কহিয়া আবার হাত বাড়াইল। এবার হুজুরীমলের সন্দেহ হইল, তৎপরে কয়েকপদ সরিয়া দাঁড়াইল। কিয়ৎক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, “তুমি আমার সঙ্গে কথা কহিতেছ না কেন? এখানে কেহ নাই, কিসের ভয়?”
হুজুরীমল সহসা যমুনাদাসের নিকটস্থ হইল। যমুনাদাস সরিয়া দাঁড়াইবার অবসর পাইল না। তাড়াতাড়ি হুজুরীমল তাহার অবগুন্ঠন সরাইয়া দিল; তাহার বিস্ময় চরমসীমায় উঠিল। চকিতভাবে হুজুরীমল বলিল, “একি! তুমি কে?”
যমুনাদাস দেখিল যে, আর লুকাইবার উপায় নাই, হুজুরীমল তাহাকে চিনিয়া ফেলিয়াছে। পাছে সে চীৎকার করিয়া উঠে, এই ভয়ে সে তাড়াতাড়ি হুজুরীমলের গলা টিপিয়া ধরিল। পরক্ষণে উভয়েই ভূতলশায়ী হইল।
হুজুরীমল বৃদ্ধ হইলেও তাহার দেহ বেশ সবল ছিল। বৃদ্ধ প্রাণপণে আত্মরক্ষা করিতে লাগিল। যমুনাদাস দক্ষিণহস্তে হুজুরীমলের কন্ঠদেশ চাপিয়া ধরিয়া বাম হস্তে তাহার বুক-পকেট হইতে টাকা ছিনিয়া লইতে চেষ্টা পাইতে লাগিল। প্রায় পাঁচ মিনিট নিঃশব্দে উভয়ে মাটীতে পড়িয়া লুণ্ঠিত হইতে লাগিল। অবশেষে সহসা যমুনাদাস গলা ছাড়িয়া দিয়া নিমেষ মধ্যে বস্ত্ৰ মধ্য হইতে একখানা সুদীর্ঘ ছোরা বাহির করিয়া হুজুরীমলের বুকে আমূল বসাইয়া দিল। হুজুরীমলের কন্ঠ হইতে এক অব্যক্ত শব্দ নির্গত হইল, সে গড়াইয়া পড়িল। তাহার পকেট হইতে নোটের তাড়া লইয়া নিজ বস্ত্রে বাঁধিয়া যমুনাদাস উঠিয়া দাঁড়াইল। হুজুরীমল দৃঢ়রূপে যমুনাদাসের পরিহিত রঙ্গিন শাড়ীর একটা কোণ চাপিয়া ধরিয়াছিল, যমুনাদাস উঠিয়া জোর করিয়া কাপড়খানা টানিতে খানিকটা ছিঁড়িয়া হুজুরীমলের মুষ্টিমধ্যে রহিয়া গেল।